জি-২১ ইতিহাসে মুসলিম নারী-৩
প্রশ্নঃ
১. ইসলামের প্রাথমিক যুগের বিখ্যাত মহিলাদের কথা গুরুত্বের সাথে আলোচনার কি প্রয়োজন?
২. পরবর্তী যুগের মুসলিম নারীদের সামাজিক অবস্থান ও মর্যাদা সম্পর্কে কি জানা যায়?
৩. এই অবনতির কারণ কি?
৪. ইসলামী আইনে প্রাপ্য অধিকার থেকে নারীকে পরবর্তী যুগে বঞ্চিত করার উদাহরণ দিন।
৫. নারীর প্রতি এই বঞ্চনা যে ইসলাম বিরোধী এ ব্যপারে যুক্তি কি?
৬. উপরের প্রশ্নের উত্তরে কুরআন ও হাদিসের উদ্ধৃতি দিন।
৭. নারীর কণ্ঠ শোনা যে পুরুষের জন্য হারাম নয় তা প্রমাণ করুন।
৮. কিছু মুসলিম কিসের ভিত্তিতে দাবী করে যে নারীর কণ্ঠ শোনা হারাম?
উত্তরঃ
১. ইসলামের প্রাথমিক যুগের মহিলাদের কথা আলোচনার প্রয়োজনীয়তা
প্রাথমিক যুগের মুসলমানদের জীবনধারা আধুনিক মুসলমানদের জন্য আদর্শ। কারণ তখন স্বয়ং রাসূল(সঃ)-এর প্রত্যক্ষ নির্দেশনায় মুসলমানরা জীবন পরিচালিত করত। ইসলামের এই প্রাথমিক যুগ এবং সেই সময়ের মহিলাদের অবস্থা পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে সমগ্র বিশ্বে নারীর অধিকার ছিল উপেক্ষিত নারীর প্রতি আচরণ ছিল নেতিবাচক সেই সময় ইসলামই নারীকে যথার্থ অধিকার ও মর্যাদা দিয়েছিল। আর সে সময়কার নারীরা সেই মর্যাদায় অধিষ্ঠিত ছিলেন।
২. পরবর্তী যুগে মুসলিম নারীদের অবস্থা
যদিও ইসলাম নারীদের পূর্ণ অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছিল এবং প্রাথমিক যুগের সকল মুসলিম তা মেনে চলত, কিন্তু পরবর্তী যুগে এই চর্চা অনেকাংশে রক্ষিত হয়নি। ইসলাম পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ, জাতিতে প্রসারিত হয়েছে। যুগের আবর্তনে সেসব জাতির বিভিন্ন কুসংস্কার ইসলামের নিজস্ব নীতি-নিয়মকে অনেক ক্ষেত্রে গ্রাস করেছে। বর্তমানে ৫০টিরও বেশী দেশ জুড়ে বিস্তৃত মুসলিম বিশ্বের অধিকাংশ স্থানে নারীর অধিকার বলতে ইসলামী মূল্যবোধের সাথে সেই দেশের বা জাতির মূল্যবোধের এক সমন্বিত রুপ বিরাজ করছে।
৩. ইসলামী সভ্যতার অবনতির কারণ
মুসলমানদের ঈমান তথা বিশ্বাসের প্রতি আন্তরিকতার অভাবই ইসলামী সভ্যতার পতনের মূল কারণ। যখন থেকে মুসলমানরা ঈমানের বাস্তব অনুশীলন কমিয়ে শুধু মুখের স্বীকৃতির ((Lip service) মাঝে ঈমানকে সীমাবদ্ধ করা শুরু করল তখন থেকে সবক্ষেত্রেই তাদের পতনের শুরু। ফলশ্রুতিতে অজ্ঞতা ও মূর্খতা বেড়েছে এবং বিভিন্ন কুসংস্কারে তারা আচ্ছন্ন হল। যার পরিণতিতে মুসলিম নারী এবং পুরুষ উভয়েই মর্যাদা এবং অধিকার নষ্ট হল, যদিও নারীর ক্ষতিই ছিল ছিল বেশী। এভাবেই মুসলিম পুরুষরা একসময় নারীদের আল্লাহ প্রদত্ত অধিকার থেকে বঞ্চিত করা শুরু করল। আর নারীরাও এসব অধিকার ফিরে পেতে নিচেষ্ট বসে রইল।
৪. খোদা প্রদত্ত নারীর অধিকার হরণের কয়েকটি দৃষ্টান্ত
অনেক ক্ষেত্রেই নারীর অধিকার ছিনিয়ে নেয়া হয়। তবে তার মধ্যে চারটি উল্লেখযোগ্য-
ক. মেয়েদের মসজিদে যাওয়া থেকে বিরত করা
খ. কনের মত ছাড়াই বিয়ে দেয়া
গ. হিজাবের পরিবর্তে পর্দা (অবরোধ) আরোপ
ঘ. নারীর কণ্ঠস্বর পুরুষের জন্য হারাম (আওরা) ঘোষণা
৫. সব অধিকারহরণ ইসলাম বিরোধী কেন?
ক. রাসূল (সঃ)-এর বহু সহীহ হাদিস আছে যাতে তিনি মেয়েদের মসজিদে যাওয়া থেকে বিরত রাখতে তাদের পিতা-স্বামীদের নিষেধ করেছেন।
খ. ইসলামী আইন অনুসারে বর ও কনে উভয়ের মত না থাকলে বিয়ে বাতিল হয়ে যায়।
গ. পর্দার নামে যে অবরোধ প্রথা চলছে তা ইসলাম সম্মত নয়। এটা হিন্দু, পার্সিয়ান এবং বাইজাইন্টাইন সভ্যতায় এবং কোন কোন খ্রিষ্টান সমাজে দেখা যেতো। কুরআনে পর্দা শব্দটি নেই এবং কুরআনে যে হিজাব শব্দ এসেছে তার ব্যাখ্যা অন্য। হিজাব হচ্ছে পোশাক, মন ও আচরণে শালীনতা এবং অবাধ মেলামেশা এড়িয়ে নৈতিকতা ও নারীর পবিত্রতা রক্ষা করা। হিজাব মেয়েদের প্রয়োজনে ঘর থেকে বের হওয়া এবং সামাজিক কর্মকাণ্ডে বন্ধ করে না।
এই সাথে আর একটি শব্দের ব্যাখ্যা প্রয়োজন যা হচ্ছে ‘হারেম’। এই শব্দটিও নেতিবাচক অর্থে ব্যবহৃত হচ্ছে। হারেম শব্দটি ‘হারাম’ শব্দ থেকে এসেছে, যার অর্থ নিষিদ্ধ। যা মূলতঃ ছিল মুসলমানের বাড়ির যে অংশে পরিবারের মহিলারা থাকেন এবং যেখানে বাইরের পুরুষের প্রবেশ নিষেধ। কিন্তু এই হারেম শব্দ মুসলিম নামধারী কিছু রাজা-বাদশা ও ধনী ব্যক্তির রক্ষিতাদের আবাস্থলের নামে ব্যবহৃত হয়, যা সম্পূর্ণ অনৈসলামী চর্চা।
৬. উপরোক্ত বক্তব্যের ব্যাপারে কুরআন ও হাদিসের উদ্ধৃতি
কুরআন ও হাদিস থেকে এটা স্পষ্ট যে মেয়েরা ঘরের বাইরে যেতে পারবে। ৩৩ নং সূরার ৫৯ নং আয়াতে দেখা যায় যে আল্লাহ মেয়েদের ঘরের বাইরে যেতে বারণ করেননি বরং তাদের শালীনতা বজায় রেখে যেতে বলেছেন। রাসূল (সঃ) বলেন, “আল্লাহ তোমাদের বৈধ প্রয়োজনে বাইরে যাবার অনুমতি দিয়েছেন”। রাসূল (সঃ)-এর জীবনে এমন ঘটনাও দেখা যায় যে তিনি তাঁর আত্মীয় অথবা বন্ধুর বাড়ী বেড়াতে গেছেন যেখানে প্রধান মেহমান ছিলেন মহিলা। তিনি সেখানে তাদের সাথে কথা বলতেন, একসাথে খেতেন এবং তাঁদের খুঁটিনাটি খবর নিতেন। যেমন তিনি রাবেয়া বিনতে মাউদ-এর বাড়ী গিয়ে তাঁর কাছে অযুর পানি চাইলেন। যদিও এসব সাক্ষাতে নারী পুরুষ উভয়েই থাকত তবুও তারা ইসলামের শালীনতার আইন মেনে চলতেন। এতে পরিষ্কার হয় যা, নারীরা ঘরের বাইরে যেতে পারবে।
৭. নারীর কণ্ঠস্বর পুরুষের জন্য নিষিদ্ধ (আওরা) না হবার প্রমাণ
যদি নারীর কণ্ঠস্বর পুরুষের জন্য নিষিদ্ধই হত তবে ৩৩ নং সুরার ৩২ নং আয়াতে রাসূলের স্ত্রীদের এভাবে বলা হত না যে পুরুষের সাথে কোমল (আকর্ষণীয়) ভাষায় কথা বলোনা বরং স্বাভাবিকভাবে (Customary ভাষায়) কথা বলো। এছাড়াও অনেক প্রমাণ পাওয়া যায় যে অনেক সাহাবা ও ইসলামের পণ্ডিত নারীর কাছ থেকে হাদিসসহ অনেক বিষয় শিখেছেন। রাসূলের কাছে নারীরা আসতো এবং তাদের সমস্যা ও বিভিন্ন বিষয় নিয়ে খোলাখুলি আলাপ করত। বস্তুতঃ নারীর কণ্ঠস্বর পুরুষের জন্য নিষেধ এমন কোন উদ্ধৃতি কুরআন বা হাদিসে নেই।
৮. যার ভিত্তিতে কিছু মুসলিম নারীর কণ্ঠস্বর পুরুষের জন্য হারাম হবার কথা বলে
এ বিষয়ে কুরআন এবং সুন্নায় প্রাপ্ত শিক্ষা অপরিবর্তনীয় এবং তা আমরা আলোচনা করেছি। কিন্তু তারপরও কিছু ব্যক্তি এসব শিক্ষার নিজস্ব ব্যাখ্যা দেয়। তাদের ব্যাখ্যা হচ্ছে রাসূলের (সঃ) উপস্থিতিতে মানুষ বেশী ধার্মিক ছিল ফলে তাদের জন্য অনেক সুযোগ অবারিত ছিল, যার অপব্যবহার তারা তারা করত না। এখনকার যুগে এসব সুযোগ উন্মুক্ত থাকলে সমাজ পাপে সয়লাব হয়ে যাবে। কারণ মানুষের নৈতিক মান নেমে গেছে। (মূলতঃ এসব যুক্তি আমার ও ইসলামের দৃষ্টিতে অগ্রহণযোগ্য- অনুবাদক)
সূত্র নির্দেশিকাঃ
প্রশ্ন- ৩: আল্লাহ বলেন, “আল্লাহ কোন জাতির ভাগ্য পরিবর্তন করেন না যতক্ষণ না তারা নিজেদের অবস্থার পরিবর্তন করে (অর্থাৎ আল্লাহর নির্দেশনা ও আদেশ মত না চলে। )” (১৩:১১)
প্রশ্ন-৫: আয়েশা (রাঃ) প্রায়ই রাতে জামাতে নামাজ পড়তে অন্যান্য মহিলাদের নিয়ে মসজিদে যেতেন এবং কেউ এতে বাধা দিতেন না।
ঐতিহাসিকরা বলেন হারেম কোন বন্দীশালা ছিল না বরং মুসলমানদের বাড়ির সবচাইতে সুন্দর অংশ যেখানে বাগান ও ঝর্ণা পর্যন্ত থাকত।
প্রশ্ন-৬: আল কুরআন ৩৩:৫৯
হাদিসে রাসূল (সঃ) সতর্ক করেন যে মুসলমানরা কিছু বৈশিষ্ট্য অর্জন না করে যেন পথে বের না হয়, তা হচ্ছে জথাঃ ‘দৃষ্টিকে সংযত করা, মানুষকে আঘাত না করা, সালামের জবাব দেয়া, মেয়েদের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ না করা সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ করা’। এই হাদিসের বাচনভঙ্গী দেখে বোঝা যায় রাসূল (সঃ) আশা করছেন মেয়েরা ঘরের বাইরে থাকবে।
প্রশ্ন-৭: আল কুরআন ৩৩:৩২, সুরা মুজাদালা।
জি-২২- সাম্প্রতিক ইতিহাসে মুসলিম নারী
প্রশ্নঃ
১. সাম্প্রতিক সময়ে মুসলিম নারীদের মধ্যে কোন কোন প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে?
২. এর মধ্যে প্রথম ধারাটি কেন ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছে?
৩. যারা এর মাঝে স্থিতাবস্থা (Status quo) বজায় রাখতে চায় তাদের যুক্তি কি?
৪. রাসূলের (সঃ) ঐ হাদিসের ব্যাপারে মন্তব্য করুন যেখানে বলা হয়েছে মেয়েরা শুধু সতীত্ব বজায় রেখে নামাজ, রোযা আর স্বামীর আনুগত্য করলেই বেহেশতে যাবে।
৫. এটা কি সত্যি যে রাসূল (সঃ) বলেছেন যে তাঁর মৃত্যুর পর পুরুষরা নারীদের দ্বারা বিভ্রান্ত হবে? এ কথার অর্থ কি?
৬. কিছু মানুষ রাসূলের (সঃ) উদ্ধৃতি দিয়ে বলে যে মেয়েরা ধর্ম ও মনের দিক দিয়ে পুরুষের চেয়ে অসুবিধাজনক অবস্থানে- এ ব্যাপারে মন্তব্য করুন।
৭. রাসূল (সঃ)-এর হাদিসের ব্যাখ্যা করুন যেখানে বলা হয়েছে ‘মেয়েরা পাঁজরের বাঁকা হাড়’।
৮. উপরের প্রশ্নগুলোয় রাসূলের হাদিসের যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন তা কিভাবে ইসলামের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ?
উত্তরঃ
১. সাম্প্রতিক ইতিহাসের মুসলিম নারীদের প্রবণতা সমূহ
সাম্প্রতিক ইতিহাসে বিশ্বে মুসলিম নারীদের মাঝে তিনটি প্রবণতা দেখা যাচ্ছেঃ
ক. একদল সম্পূর্ণ পাশ্চাত্যের আদর্শে বিশ্বাসী,
খ. একদল বর্তমান অবস্থাতায় স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে চাইছেন,
গ. ইসলামী পুনর্জাগরণের জন্য একদল কাজ করছেন (এর পক্ষেই দ্রুত সমর্থন বাড়ছে)
উনবিংশ শতকের শেষভাগে এসে সমগ্র মুসলিম বিশ্ব রাশিয়া, ইংল্যান্ড ফ্রান্স, ইতালী ও নেদারল্যান্ডের উপনিবেশে পরিণত হয়। সমগ্র বিশ্বে পাশ্চাত্যের দোর্দন্ত আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হলে কিছু মুসলমানদের মধ্যে এই ধারণা জন্ম নেয় যে তাদের এই পিছিয়ে পড়ার কারণ হচ্ছে তাদের ধর্ম। পশ্চিমা বুদ্ধিদাতারাও তাদের এই মন্ত্রনা দিতে থাকে যে ইসলামই মুসলিম বিশ্বকে পশ্চাতে নিয়ে জাচ্ছে। যেসব মুসলমানদের ঈমান ছিল দুর্বল এবং বিশেষভাবে যারা সাম্রাজ্যবাদের দালাল ছিল তারাই ইসলাম বাদ দিয়ে অবাধ পাশ্চাত্যকরণের পক্ষে বেশী সাফাই গায়। এর অংশ হিসেবেই মুসলিম মেয়েদের শালীন পোশাক বাদ দিয়ে পাশ্চাত্যের অনুকরণে অশালীন পোশাক পরানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়।
২. পশ্চিমাকরণ কেন ব্যর্থ প্রমাণিত হল
ইসলামের দৃষ্টিতে ধর্মের সীমা ও বিশ্বাসের আওতায় যে কোন উন্নয়ন বা আধুনিকায়ন বৈধ। কিন্তু যখন মানুষ তার ধর্ম ও রীতি-নীতি ভুলে অন্ধের মত পাশ্চাত্যের অনুকরন শুরু করে তখন সে ভুলে যায় কোনটা প্রয়োগযোগ্য আর কোনটা প্রয়োগযোগ্য না। নিজের ধর্ম বিশ্বাস সম্পর্কে অজ্ঞতা তাকে আরও পিছিয়ে দেয়। ইসলাম এই শিক্ষা দেয় যে আল্লাহর সাথে বিদ্রোহ করে কোন আধুনিকায়ন প্রক্রিয়াই সফল হতে পারে না। কিন্তু পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুসারী নেতারা এটাই করেন। তারা যদি এমন না করে নিজের ধর্মের দিকে তাকাতেন তাহলে দেখতেন পাশ্চাত্যের সব চ্যালেঞ্জের উপযুক্ত জবাব ইসলামেই আছে। সমাজের উন্নয়নে আধুনিকায়নে পাশ্চাত্যের কাছে না গিয়ে ইসলামের কাছেই সমাধান পাওয়া যেতো, বিশেষভাবে নারীর উন্নয়নের ক্ষেত্রে যেখানে বিশ্বে একমাত্র ইসলামই নারীর সর্বোচ্চ মর্যাদা ও অধিকার নিশ্চিত করেছে।
৩. বর্তমান অবস্থায় স্থিতাবস্থা যারা বজায় রাখতে চায় তাদের দৃষ্টিভঙ্গী
পাশ্চাত্যের আগ্রাসনে ভীত একদল সমাজবিদ শংকা প্রকাশ করছেন যে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির এই অপস্রোতকে ইসলামী আদর্শ রোধ করতে পারবে না। তারা আরও ভয় পাচ্ছেন এই যে পাশ্চাত্যকরণের ফলে সৃষ্ট অবাধ মেলামেশা মুসলিম সমাজের নৈতিক মানকে ধ্বংস ও পর্যুদস্ত করবে; ইসলামের ঐতিহ্যবাহী পারিবারিক বন্ধন ভেঙ্গে দেবে। তাই তারা এই অপস্রোত থেকে নারীকে দূরে রাখতে তাকে আরও ঘরে আবদ্ধ করে শিক্ষা দীক্ষা থেকে বঞ্চিত রাখতে চাচ্ছেন। এজন্য তারা কুরআন বা হাদিসে বর্ণিত নারীকে অনেক অধিকারকে রদ করে দিচ্ছেন। এবং কিছু হাদিসের ভুল ও বিভ্রান্ত ব্যাখ্যা ব্যবহার করছেন।
৪. নারীর বেহেশতে যাবার জন্য কি শুধু সতীত্ব রক্ষা, নামাজ, রোযা আর স্বামীর আনুগত্যই যথেষ্ট?
এ ধরণের একটি হাদিসে আছে যে কয়টি কাজ করেই নারী বেহেশত লাভ করতে পারে। কিন্তু তাই বলে এই হাদিসের এমন ব্যাখ্যা করা ভুল যে মুসলিম নারীর বেহেশত লাভের জন্যে একটি কাজই করতে হবে। কারণ-
ক. ইসালামের পাঁচটি মৌলিক স্তম্ভ আছে যা সকল মুসলিম নর-নারীর জন্য ফরয। কিন্তু ঐ হাদিসের ব্যাখ্যা করে যারা নারীর অন্যান্য কাজ বাদ দিতে চান তারা কি নারীর উপর আল্লাহর আরপিত ফরয যাকাত এবং হজ্জও নিষিদ্ধ করবেন?
খ. স্বয়ং রাসূল (সঃ) তাঁর জীবদ্দশায় সমাজ ও রাষ্ট্রের সব ক্ষেত্রে সব কাজে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করেছেন। (কাজেই একটি হাদিসের ভিত্তিতে তাঁর সমগ্র জীবনের বাস্তবতাকে উল্টে দেয়া যায় না- অনুবাদক)।
৫. পুরুষেরা নারীদের দ্বারা বিভ্রান্ত হবেন- এর ব্যাখ্যা
এ ধরণের শঙ্কা এক হাদিসে রাসূল (সঃ) বলেছেন যা সহীহ। লক্ষ্য করা দরকার যে এখানে ফিৎনা শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে, যার অনূদিত অর্থ দাঁড়ায় ভ্রান্তি (temptation)। কিন্তু এর আরও অর্থ আছে যার মানে পরীক্ষা (test or trial)। কুরআনে বলা হয়েছে যে, “নিশ্চয়ই তোমাদের সম্পদ এবং তোমাদের সন্তান তোমাদের জন্য ফিৎনা (অর্থাৎ পরীক্ষা)” কাজেই এখানে স্বামী-স্ত্রী, সম্পদ বা সন্তান কাউকেই হেয় করা হয়নি বা নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখা হয়নি। বরং মানুষকে এটাই সতর্ক করা হয়েছে যে যখন সে আল্লাহর রহমতে স্ত্রী, স্বামী, সন্তান, সম্পদ লাভ করবে তখন এসব যেন তাকে খোদার স্মরণ থেকে দূরে নিয়ে না যায়। জীবনের প্রতিটি বিষয়ই একেকটি পরীক্ষা (test)।
৬. ধর্ম ও মনের দিক থেকে মেয়েরা কি পুরুষের চেয়ে অসুবিধাজনক অবস্থানে?
কোন আলোচনার প্রসঙ্গে রাসূল (সঃ) এমন উক্তি করেছেন তা জানা প্রয়োজন। রাসূল (সঃ) মেয়েদের সৎ কাজের উপদেশ দিতে গিয়ে প্রসঙ্গক্রমে বলেন যে, আল্লাহ নারী ও পুরুষকে পৃথকভাবে বানিয়েছেন। তখন কেউ তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন যে ধর্মের দিক থেকে নারীর পিছুটান কোথায়; তার উত্তরে তিনি তিনি বলেন, তাদের ঋতুস্রাবের দিনগুলোয় তারা নামাজ পড়তে পারে না। (এখানে উল্লেখ্য যে শরীর থেকে রক্তঝরার সময় নারী পুরুষ উভয়েরই অযু নষ্ট হয়। নামাজ পড়তে পারে না যতক্ষণ না তারা গোসল করে) অতঃপর রাসূল (সঃ) মেয়েদের ভালো কাজ করার মাধ্যমে নামাজ না পড়ার ঘাটতি (অবশ্যই এ জন্য তারা আদৌ দায়ী নয়) পুষিয়ে নিতে বলেন। (অবশ্য তাঁর এ কথায় মেয়েদের প্রতি মমত্বই ফুটে উঠে, অবজ্ঞা নয়- অনুবাদক)। একই সময়ে যখন তাঁকে জিজ্ঞেস করা হল মেয়েদের মনের দিক থেকে অসুবিধা কোথায়, তখন তার জবাবে তিনি বলেন যে আর্থিক লেনদেনের ব্যাপারে বলা হয়েছে যে দু’জন পুরুষ পাওয়া না গেলে একজন পুরুষ ও দু’জন মেয়ের সাক্ষ্য যথেষ্ট হবে।
এই সাক্ষ্য সংক্রান্ত বিষয়টির আগেই ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে। (আরও উল্লেক্ষ্য যে রাসূলকে যে ভাষায় প্রস্ন করা হয়েছে উত্তর সেভাবেই এসেছে। প্রেক্ষিত বিবেচনা না করে শুধু উত্তরের বাক্য বিবেচনা করলে চলবে না।– অনুবাদক) কোনভাবেই রাসূল (সঃ) বলছেন না যে মেয়েরা পুরুষদের চেয়ে কম বুদ্ধিমান, বরঞ্চ এরকম বলা ইসলামের শিক্ষারই বিরুদ্ধ কথা।
৭. মেয়েরা কি পাঁজরের হাড়ের মত?
এই উক্তি বিভিন্ন হাদিস সংকলনে বিভিন্নভাবে বর্ণিত হয়েছে। কোথাও এটা লিখা হয়েছে যে আল্লাহ নারীদের ‘পাঁজরের হাড় থেকে’ তৈরী করেছেন আর কোথাও লিখা হয়েছে যে ‘নারী পাঁজরের হাড়ের মত’। দ্বিতীয় বর্ণনাটাই সঠিক বলে প্রতীয়মান হয়। এখানে রাসূল (সঃ) যেটা বোঝাতে চেয়েছেন তার অর্থ হচ্ছে পাঁজরের হাড় প্রকৃতই বাঁকা। কেউ যদি তাকে জোর করে সোজা করতে চায় তবে তা ভেঙ্গে যাবে। তেমনি নারীকে আল্লাহ যে সহজাত বৈশিষ্ট্য ও প্রবৃত্তি নিয়ে তৈরী করেছেন, কোন মানুষ (সম্ভবত স্বামী) যদি তাকে তার বৈশিষ্ট্য জোর করে বদলাতে চায়, তবে সেও ভেঙ্গে যাবে। একদল আইনবিদ এ ভেঙ্গে যাওয়াকে মনে করছেন যে, তা বিবাহ বিচ্ছেদে রুপ নিতে পারে। কাজেই দেখা যায় যে, এই পাঁজরের হাড়ের কথা রাসূল (সঃ) নারীকে অপমান করছেন না বরং তাদের সহজাত বৈশিষ্ট্য অক্ষুন্ন রাখতে পুরুষকে উপদেশ দিচ্ছেন যাতে পুরুষেরা নারীদের (স্ত্রী, কন্যা, বোন) আরো সহনশীল আচরণ করে।
এর প্রমাণস্বরূপ আর একটি হাদিসে দেখা যায় রাসূল (সঃ) বলছেন, “নারীর প্রতি দয়ালু হও কারণ তারা পাঁজরের হাড়ের মত। আমি তাদের প্রতি দয়ালু হতে তোমাদের বলছি”।
৮. এসব ব্যাখ্যার যথার্থতার প্রমাণ
ইসলামের মূল সূত্রই হচ্ছে কুরআন এবং হাদিস। সামগ্রিকভাবে কুরআনের কোথাও এমন কথা নেই যাতে নারীকে খাট করা হয়েছে। আবার এমন কোন হাদিসও নেই যা কুরআনের শিক্ষার পরিপন্থী। কাজেই বিচ্ছিন্নভাবে দু’একটা হাদিসের দ’একটা বাক্য উদ্ধৃত করে নারী সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপারে ভ্রান্ত ধারণা তৈরীর চেষ্টা করা ভুল। কুরআন স্পষ্টভাবেই ঘোষণা করে যে, নারী ও পুরুষ উভয়েই সৎ কাজের জন্যে সমান পুরষ্কার পাবেন।
সূত্র নির্দেশিকাঃ
প্রশ্ন-১: যেমন, মিসরের কাশিম আমীন এবং হুদা শরাভী
প্রশ্ন-৫: আল কুরআন ৮:২৮, ৬৪:১৪
প্রশ্ন-৮: আল কুরআন ৭৪:৩৮, ৩৩:৩৫
জি- ২৩- বর্তমান সমাজে মুসলিম নারী
প্রশ্নঃ
১. পাশ্চাত্যের আগ্রাসনের মোকাবেলায় ইসলামী পুনর্জাগরণ আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য কি?
২. ইসলামী পুনর্জাগরণের মূলভিত্তি কি?
৩. সামাজিক রীতিনীতি কি ইসলামী আইনেরর গ্রহণযোগ্য অংশ?
৪. বর্তমান সমাজে নিজের অবস্থার উন্নয়নে মুসলিম নারী কিভাবে ভূমিকা রাখতে পারে?
৫. পরিবারের মধ্যে থেকে সামাজিক উন্নয়নে মুসলিম নারী কিভাবে ভূমিকা রাখতে পারে?
৬. বৃহত্তর সামাজিক পরিবেশে মুসলিম নারীর ভূমিকা কি?
৭. নারীর উন্নয়নে মুসলিম পুরুষের কি ভূমিকা রাখা উচিত?
উত্তরঃ
১. পাশ্চাত্যের মোকাবেলায় ইসলামী পুনর্জাগরণ আন্দোলন
চারটি মূলনীতি ভিত্তি করে এই পুনর্জাগরণ আন্দোলন চলছে। তা হলোঃ
ক. এটা সবার কাছে প্রচার করা যে ইসলামের প্রাথমিক যুগে নারী সমাজের সকল স্তরের সব কাজে জড়িত ছিল। ইসলামী সভ্যতা ও মূল্যবোধের পতনের সাথে নারীর উপর বিভিন্ন বিধি নিষেধসহ অবরোধ নেমে আসে। কাজেই এই আন্দোলন নারীকে আবার সমাজে সক্রিয় হতে বলে, এবং অবশ্যই তা ইসলামের সীমার মধ্যে থাকে।
খ. মুসলমানদের মধ্যে এই চেতনা জাগ্রত করা যে তারা হবে পথিকৃৎ, অনুকরণকারী নয়; নেতা, অনুসরণকারী নয়। কাজেই পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া। সমাজ ব্যবস্থার যে কোন উন্নয়ন বা সংস্কার হতে হবে আল্লাহর ও রাসূলের (সঃ) অনুমোদিত পন্থায়।
গ. সবার কাছ থেকে এই স্বীকৃতি আদায় যে ইসলামই নারীর মর্যাদা, সম্মান ও অধিকার নিশ্চিত করেছে। ইসলাম প্রদত্ত এই অধিকার আদায়ে মুসলিম মেয়েদের সচেতন করা।
ঘ. সবার মাঝে এই অনুভূতি জাগানো যে ইসলামী সভ্যতার সমস্যা ও বিপদ ইসলামের ও ইসলামী আইনের কোন দুর্বলতা বা অপরিপূর্ণতা নয় বরং মুসলমানদের ইসলামের শিক্ষা ও তার প্রয়োগ থেকে দূরে সরে যাবার পরিণতি মাত্র। কাজেই এ থেকে পরিত্রাণের একটাই উপায়, তা হচ্ছে ইসলামে পরিপূর্ণ প্রত্যাবর্তন। সমস্যা মুসলমাদের নিয়ে এবং এটা ইসলাম ধর্মের সমস্যা নয়।
২. ইসলামী পুনর্জাগরণের মূলভিত্তি
যে কোন ধর্মীয় পুনর্গঠন আন্দোলনের প্রধান ভিত্তি হচ্ছে আল্লাহর প্রতি ঈমান। এর অর্থ হচ্ছে মানবজীবনের সার্বিক পুনর্বিন্যাস সাধনে ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে বা সামষ্টিক ক্ষেত্রে একমাত্র আল্লাহর নির্দেশ নির্দ্বিধায় বাস্তবায়নের দৃঢ় মানসিকতা। এই আধ্যাত্মিক ভিত্তি বিনির্মাণের পর আসে বুদ্ধিভিত্তিক ভিত্তি নির্মাণের প্রশ্ন। বুদ্ধিভিত্তিক ভিত্তি নির্ভর করে ইসলামের ‘নির্ভরযোগ্য উৎস’ থেকে প্রকৃতভাবে ইসলামকে বুঝা।
এই আন্দোলনের বুদ্ধিভিত্তিক ভিত্তি হচ্ছে মুসলমানদের এমন জ্ঞান অর্জন যার মাধ্যমে তারা আল্লাহর নির্ধারিত মাপকাঠিতে যে কোন কিছুর গ্রহণযোগ্যতা, ঠিক বা বেঠিক হবার প্রশ্নের সমাধানে সক্ষম হবে। মূলতঃ ইসলামের শিক্ষা আক্ষরিক অর্থে ও ভাবার্থে (in letter and spirit) প্রয়োগ করতে হবে এবং এক্ষেত্রে আঞ্চলিক রীতিনীতি ও চর্চা যা ইসলামী শিক্ষাকে বিতর্কিত করতে পারে তা বেছে চলতে হবে।
৩. সামাজিক রীতিনীতি (Custom) প্রসঙ্গে
ইসলামী আইনে সামাজিক রীতিনীতি কোনো কোনো সময় অবদান রাখতে পারে। তবে তা কখনই ইসলামী আইনের নিঃশর্ত উৎস হতে পারে না। বস্তুতঃ অনেক স্থানীয় রীতিই অনৈসলামিক হতে পারে। সামাজিক রীতিনীতির গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে যে তা অবশ্যই ইসলামসম্মত হতে হবে বা অন্তত পক্ষে তাতে ইসলাম বিরোধী কিছু থাকতে পারবে না। যদি এমন কোন রীতি থাকে যা ইসলাম বিরোধী তবে তা অবশ্যই বাতিল বা বর্জন করতে হবে, এর অন্যথা হতে পারবে না।
৪. সমাজে নিজেদের অবস্থানের উন্নয়নে মুসলিম নারীর ভূমিকা
পুরুষের মত প্রত্যেক নারীও এই পৃথিবীতে আল্লাহর খলিফা। পৃথিবীতে আল্লাহর বিধান প্রতিষ্ঠার ব্যাপক দায়িত্ব তার উপরও সমানভাবে আছে- এই অনুভূতি নিয়ে প্রতিটি মেয়ের কাজ করা উচিৎ। এভাবে কাজ করলে সে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক- এ সকল ক্ষেত্রেই উন্নয়নে বিরাট অবদান রাখতে পারবে।
৫. পারিবারিক পর্যায়ে কিভাবে মুসলিম নারী সমাজে উন্নয়নে অবদান রাখতে পারে?
সমাজ উন্নয়নে ভূমিকা রাখার ক্ষেত্রে পরিবার মুসলিম নারীর সবচেয়ে বড় কর্মক্ষেত্র। বধু, মাতা, কন্যা তিনভাবেই নারী পরিবারে সক্রিয়। বিয়ের পূর্বে একটি মেয়ে তার তৎপরতায় তার পরিবার পিতা, মাতা, ভাই, বোনদের ও আত্মীয়ের মাঝে ভালবাসা ও শান্তির পরিবেশ তৈরী করতে পারে, যা অবশেষে সমাজেই শান্তি আনবে। বিবাহিত জীবনে সে স্বামীর সৎপথে চলার সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণাদাতা হতে পারে। সংসারে যত্নবান থেকে স্বামীকে সৎকাজে উৎসাহ আর অসৎকাজ থেকে দূরে রাখতে পারে। তার যদি সন্তান থাকে তবে তাদের মাধ্যমে সমাজের ভবিষ্যৎ বিনির্মাণের কাণ্ডারীর ভূমিকা রাখতে পারে। সে শুধু সন্তানদের শারীরিকভাবেই বড় করবে না বরং আধ্যাত্মিকভাবেও। বস্তুতঃ সন্তানের দ্বীন শিক্ষার প্রথম ইনস্টিটিউট মা।
৬. বৃহত্তর সামাজিক পরিবেশে নারীর ভূমিকা
বৃহত্তর সামাজিক পরিবেশে নারী, সমাজে সবার কল্যাণকামী বোনের ভূমিকা রাখবে। কুরআনে ৯ নং সূরার ১৭ নং আয়াতে যেভাবে বলা হয়েছে সেভাবে মানুষকে সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ করবে। মনে রাখতে হবে যে এই কাজের জন্য তাকে আখেরাতে জবাবদিহি করতে হবে। এ জবাবদিহিতা এড়ানো যাবে না।
আল্লাহর খেলাফতের দায়িত্ব পালনের জন্য একজন মুসলিম নারী (পুরুষের মতই) প্রথমে নিজেকে পরিশুদ্ধ করবে। আল্লাহর প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস, আস্থা অর্জন করে নিজের সব পছন্দ অপছন্দের উপর আল্লাহর ইচ্ছাকে স্থান দিতে হবে।
আর দ্বিতীয় কাজ হবে পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা হিসেবে পোশাকে, চলাফেরায়, ব্যবহারে, নামাজে, রোযায়, দানশীলতায় তথা জীবনের সবক্ষেত্রে ইসলামের বাস্তবায়ন করা। সমাজে সচেতন মুসলিম হিসেবে ভূমিকা রাখবার জন্য ইসলামের সীমার মধ্যে পর্যাপ্ত জ্ঞান এবং প্রশিক্ষণে নিজেকে সমৃদ্ধ করতে হবে।
তৃতীয়ত মুসলিম নারী ধৈর্য, অধ্যবসায় এবং দৃঢ়তার সাথে সমাজে সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের প্রতিরোধ করবে এবং এই কাজে তার অংশ নেয়ার যৌক্তিকতা অন্য মুসলামানদের বুঝাবে। সর্বশেষ সে জ্ঞান ও প্রজ্ঞার সাথে বিভ্রান্তিমূলক প্রশ্নের জবাব দেবে। ইসলামই যে নারীর অধিকার ও মর্যাদা দিয়েছে তা সরবে প্রকাশ করবে। এবং প্রজ্ঞার সাথে এসবের প্রয়োগ ঘটাবে, নতুন কিছু আমদানীর পরিবর্তে।
৭. মুসলিম নারীর উন্নয়নে পুরুষের ভূমিকা
উপরে নারীর দায়িত্ব হিসেবে যা যা উল্লেখ করা হল তার অধিকাংশই নারী পুরুষ উভয়েরই যৌথ দায়িত্ব। ব্যক্তিগত পর্যায়ে নারী এবং পুরুষের দায়িত্ব একই। পারিবারিক পর্যায়ে পুরুষ তার মা, স্ত্রী কন্যা ইসলামে বর্ণিত উপায়ে আচার-ব্যবহার করবে। সে তার পরিবারের নারীদের পৃথক ব্যক্তিত্বের স্বীকৃতি দেবে এবং তাদের পরিচয় ও অধিকার নিশ্চিত করবে। সে এটা স্বীকার করে যে নারী তার কাজের জন্য স্বামীর কাছে নয় আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করবে। কাজেই সে তার স্ত্রীর মধ্যে যাতে পরিপূর্ণ ব্যক্তিত্ব ও আল্লাহর কাছে জবাবদিহির দায়িত্ববোধ জাগ্রত হয় তার ব্যবস্থা করবে। কোন কোন পুরুষ তাদের স্ত্রী-কন্যাদের আল্লাহর প্রতি কাজে বাধা হয়ে দাঁড়ান। অথচ উচিৎ হচ্ছে সে তাদের আল্লাহর কাজে শুধু অনুমতিই দেবে না বরং উৎসাহ যোগাবে। ইসলাম বলে যে নারীর দায়িত্ব শুধু পরিবারেই সীমাবদ্ধ নয় বরং ইসলাম নারীকে সমাজ সচেতন হিসেবেই দেখতে চায়। কাজেই সমাজ নিয়ন্ত্রন করার মত উপযুক্ত জ্ঞান, প্রশিক্ষণ, প্রশাসনিক ও সাংগঠনিক দক্ষতা, প্রভৃতি অর্জনের জন্যে উৎসাহ ও সহযোগিতা দিয়ে প্রত্যেক পুরুষ তার স্ত্রী, কন্যা এবং বোনকে তৈরী করবে, যাতে তারা সামাজিকভাবে ফলপ্রসূ ও কার্যকর হয়।
সূত্র নির্দেশিকাঃ
প্রশ্ন-৩: ইসলামের দৃষ্টিতে ভালো সামাজিক রীতির উদাহরণ হচ্ছে আতিথেয়তা বা মহত্ত্ব, যা ইসলামের শিক্ষার সাথে সংগতিপূর্ণ। ইসলামের দৃষ্টিতে মুবাহ সামাজিক রীতি হচ্ছে কোন নির্দিষ্ট জাতির মধ্যে নির্দিষ্ট বৈধ খাবারের প্রতি আগ্রহ। আর ইসলামের দৃষ্টিতে নিষিদ্ধ সামাজিক রীতি হচ্ছে মেয়েদের মতের তোয়াক্কা না করে বিয়ে দেয়া।
প্রশ্ন-৬: আল কুরআন ৯:৭১
• যে সমাজে সে বাস করে সেই সমাজের দারিদ্র্য, নিরক্ষরতা, রোগব্যাধি, অজ্ঞতা, প্রভৃতি থেকে মুক্ত করা নারীর দায়িত্ব।
জি-২৪ যৌনতার বিষয়ে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি
প্রশ্নঃ
১. এই বিষয়ের সাথে ইসলামের পরিবারের গুরুত্ব বিষয়ের সম্পর্ক আলোচনা করুন।
২. যৌনতা সম্পর্কে ইসলামের সাধারণ নীতিমালা আলোচনা করুন।
৩. উপরে বর্ণিত ইসলামের যৌনতা বিষয়ক নীতিমালার পক্ষে কুরআন ও হাদিসের উদ্ধৃতি দিন।
৪. যৌন বিষয়ে বাড়াবাড়ি সম্পর্কে ইসলামের মত কি?
৫. যৌন বাড়াবাড়ির পরিণতি কি?
৬. যৌনতা বিষয়ে ইসলামের পন্থা ও সমাধান আলোচনা করুন।
উত্তরঃ
১. এই বিষয়ের সাথে ইসলামের পরিবারের গুরুত্বের সম্পর্ক
ইসলামে পরিবার হচ্ছে সমাজের এবং সমাজ কাঠামোর একক(Cornerstone)এবং পরিবারের কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে নারী। তিনি পরিবারের শৃঙ্খলা ও বন্ধন তৈরীতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। আর ইসলামী মতে পারিবারিক বন্ধনই হচ্ছে বৈধভাবে যৌনচাহিদা পূরণের একমাত্র সুযোগ।
২. যৌনতা সম্পর্কে ইসলামের নীতি
যৌনতা মানুষের এক সহজাত প্রবৃত্তি। ইসলামে মানুষের সব আচরণই আল্লাহর প্রতি ঈমান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। কাজেই যে মানুষ আল্লাহকে বিশ্বাস করে, আল্লাহ প্রদত্ত দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন, এ পৃথিবীর ক্ষণস্থায়িত্বের বাস্তবতা সম্পর্কে অবহিত এবং আখেরাতের জবাবদিহি ও জীবন সম্পর্কে সজাগ তার প্রতিটি কর্মই হবে পরিমিত ও পরিশীলিত। এজন্য ইসলামী পন্থায় যে কোন অভ্যাস সম্পর্কে মানুষের আচরণ নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে আগে তার ঈমানকে মজবুত করতে হয়।
ইসলামী মতে মানুষের তিনটি চাহিদা আছেঃ আধ্যাত্মিক, বুদ্ধিবৃত্তিক এবং দৈহিক। এই তিনটি চাহিদা পূরণের ভারসাম্যপূর্ণ সুষম ব্যবস্থা একমাত্র ইসলামই দিয়েছে। আধ্যাত্মিক চাহিদার জন্য ইসলাম আল্লাহর স্মরণ এবং নামাজ সহ ধর্মীয় কাজে উৎসাহিত করে। বুদ্ধিভিত্তিক বিকাশের জন্য পৃথিবী ও বিশ্বজগতের সকল জ্ঞানের ভাণ্ডার রয়েছে উন্মুক্ত। দৈহিক চাহিদা পূরণের জন্য খাদ্য বাসস্থান ও যৌন আকাঙ্ক্ষা পূরণের বৈধ পন্থা ইসলামে নির্দেশিত আছে। উপরন্তু ইসলাম যৌন চাহিদা পূরণকে আধ্যাত্মিক বিকাশের সাথে সাংঘর্ষিক মনে করে না যা কোন কোন ধর্মে মনে করা হয়।
৩. এই নীতিমালার পক্ষে কুরআন ও হাদিসের দলিল
কুরআন আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস এবং ভাল কাজ ও সঠিক আচরণের নির্দেশনায় ভরা। কুরআনের উদ্ধৃতি থেকে দেখা যায় মানুষের তিন ধরণের চাহিদা আছেঃ আধ্যাত্মিক, বুদ্ধিবৃত্তিক এবং দৈহিক (উদ্ধৃতি সংযুক্ত)। কুরআন থেকে এটাও স্পষ্ট যে আল্লাহ নির্ধারিত পন্থায় এসব চাহিদা পূরণ মানুষের জন্য বৈধ। আল্লাহ বলেন, ‘মানুষের চোখে আকর্ষণীয় সম্পদ হচ্ছে নারী, সন্তান, স্তূপীকৃত রূপা’ (৩:১৪)। এখানে কুরআন এসব জাগতিক বিষয়ে আকর্ষণের জন্য মানুষকে দোষী সাব্যস্ত করেনি; শুধু মানুষকে সতর্ক করে দিয়েছে যে এসব যেন তাকে খোদার স্মরণ থেকে দূরে সরিয়ে না নেয়। ‘এই হচ্ছে পৃথিবীর সম্পদ কিন্তু খোদার নৈকট্য এর চেয়ে উত্তম পাওয়া’। সুতরাং ইসলাম নির্দেশ দেয় বস্তুগত চাহিদা অর্জনের প্রচেষ্টা ও পারলৌকিক জীবনের পুরষ্কার প্রাপ্তির মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে চলতে। ইসলামের দৃষ্টিতে দূষণীয় এবং পরিত্যাজ্য হচ্ছে অনৈতিক এবং অবৈধভাবে পার্থিব আনন্দে জড়িয়ে পড়া এবং প্রবৃত্তির দাসে পরিণত হওয়া।
৪. যৌনতা বিষয়ে বাড়াবাড়ি
মানব সভ্যতায় এই ব্যাপারে দুই রকমের বাড়াবাড়ি দেখা যায়। একটিতে যে কোন যৌন তৎপরতাকে আধ্যাত্মিক পরিশুদ্ধির পরিপন্থী এবং অশুভ অশুচি বলে ধরে নেয়া হয়, যার ফলশ্রুতিতে চিরকুমার, সংসারত্যাগী যাজক শ্রেণীর বিকাশ। এরা বিয়ে এবং যৌন সম্পর্ককে কোন নেয়ামত মনে না করে শয়তানের বাহন হিসেবেই মনে করে। এ ব্যাপারে আর এক রকম বাড়াবাড়ি হচ্ছে সব ধরণের নীতি নৈতিকতার বাধা সরিয়ে প্রবৃত্তির জোয়ারে গা ভাসিয়ে দেয়া। প্রথম ধরণের বাড়াবাড়ি বিভিন্ন মানসিক বিকারের জন্ম দেয়। আর দ্বিতীয় ধরণের বাড়াবাড়ি সমাজে ব্যাভিচার, বেশ্যাবৃত্তির বিস্তৃতির (সাথে সাথে ভয়ংকর রোগের- অনুবাদক) বিস্তার ঘটায়। পরিবার ও মানবিক বন্ধনকে ধ্বংস করে দেয়। উভয় পন্থাই মানুষের স্বাভাবিক প্রকৃতির বিরুদ্ধে যায়। ইতিহাস থেকে এটাই শিক্ষণীয় যে এমন ব্যবস্থা থাকা উচিৎ যাতে নৈতিক ও ধর্মীয় কাঠামোর মধ্যেই মানুষের যৌন চাহিদা পূরণের সুযোগ থাকবে। যা ব্যক্তিকে উচ্ছৃঙ্খলা থেকে মুক্তি দেবে এবং পরিবারকে রক্ষা করবে।
৫. যৌন বিষয়ে বাড়াবাড়ির পরিণতি
অমুসলিমসহ অনেক পর্যবেক্ষকের মত হচ্ছে, যৌন উচ্ছৃঙ্খলা জন্ম দিয়েছে অসংখ্য অপরাধের। এই বাড়াবাড়ি ব্যক্তির স্বাস্থ্যহানি, চরিত্রহানি এবং মানবিকতাবোধ ধ্বংসের কারণ হয়েছে। (ইতিহাসে দেখা যায় বহু যুদ্ধে এক বাহিনীর পরাজয় ঘটেছে ঐ বাহিনীর সৈনিকদের উচ্ছৃঙ্খলতার জন্য)। যখন মানুষ প্রবৃত্তির দাসে পরিণত হয় তখন তার মাঝের মানবিক শিষ্টাচার ধ্বংস হয়ে জন্ম নেয় স্বার্থপরতা ও সুবিধাবাদিতা, পরিবার ও সমাজ সম্পর্কে দায়িত্বহীনতা, মিথ্যাবাদিতা ও সার্বক্ষণিক নিজের বিবেকের সাথে দ্বন্দ্ব। এ থেকেই উদ্ভুত হয় ব্যভিচার, ধর্ষণ, মাদকাসক্তি, সমকামিতা, ইতরকামিতার মত জঘন্যতা, যার ফলশ্রুতিতে শুধু ব্যক্তিজীবনই কলুষিত ও অশান্ত হয় না বরং গোটা সমাজ এবং বিশেষ করে পরিবার অধঃপাতে যায়।
৬. যৌনতার বিষয়ে ইসলামের সমাধান
যৌন উচ্ছৃঙ্খলতা রোধে এবং একে ধর্ম ও নৈতিকতার পূর্ণ নিয়ন্ত্রনে আনতে ইসলাম বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন ব্যবস্থা নিয়েছে। ইসলাম প্রথমত ব্যক্তির ঈমান ও খোদাভীতি জাগ্রত করে তাকে নিয়ত আল্লাহর কাছে জবাবদিহির অনুভুতিসম্পন্ন করেছে। যার ফলে সে যৌন বিষয়ক যে কোন লোভের কাছে নত হবে না। তারপর তাকে জ্ঞান দেয়া হয়েছে সত্য-মিথ্যা, সঠিক-বেঠিক, গ্রহণযোগ্য-অগ্রহণযোগ্য পৃথক করবার। তাকে সতর্ক করা হয়েছে যে ইসলামে বিয়ে ভিন্ন আর কোন যৌন সম্পর্কের ব্যবস্থা নেই। ইসলামে সমকামিতা, ইতরকামিতা নিষিদ্ধ।
এরপর পারিবারিক বন্ধনের মাধ্যমে বৈধভাবে যৌনতৃপ্তির সবচাইতে বাস্তব ব্যবস্থা ইসলাম নিয়েছে। কুরআন এবং হাদিস থেকে দেখা যায় যে-
ক. ইসলামী মতে পরিবার ও স্বামী-স্ত্রীর ভালবাসা আল্লাহর পক্ষ থেকে উপহার;
খ. স্বামী স্ত্রীর ভালবাসার মাঝেও ইসলামে কিছু নিয়ম আছে যাতে কেউ স্বার্থপর হয়ে না উঠে;
গ. যারা বিয়েতে অসমর্থ তাদের পবিত্রতা বজায় রাখার জন্য রোযার বিধান রয়েছে।
সূত্র নির্দেশিকাঃ
প্রশ্ন-৩: আল কুরআন ১৮:১০৭, ১৫:২৯, ৩২:৯, ৩৮:৭২, ২:৩১, ১৬:৭৮, ৬:২, ৩৮:৭১, ৩:১৪-১৫, ২৮:৭৭
প্রশ্ন-৬: রাসূল (সঃ) নিম্নলিখিত হাদিসসমূহে ইসলামের সুস্থ যৌনাচার প্রমাণ পাওয়া যায়ঃ
ক. আমি তোমাদের মাঝে সবচাইতে ধার্মিক এবং খোদাভীরু, তথাপি আমি নামাজ পড়ি এবং ঘুমাই, আমি রোযা রাখি এবং রোযা ভাঙ্গি আর আমি বিবাহিত জীবন যাপন করি। এবং তোমাদের মাঝ থেকে যে আমার পথ থেকে সরে যায় সে আমার অন্তর্ভুক্ত নয়।
খ. যে বিয়ে করেছে সে তার বিশ্বাস অর্ধেক পূর্ণ করেছে, এখন বাকী অর্ধেক বিশ্বাস পূরণে আল্লাহর প্রতি আন্তরিক হও।
গ. তিনি বলেন তিন ধরণের মানুষ আল্লাহর কাছে থেকে সাহায্য পায়ঃ জীবিকার সংগ্রামে লিপ্ত ব্যক্তি, যে ব্যক্তি দাসত্ব থেকে মুক্ত হবার চেষ্টায় রত, আর যে ব্যক্তি চরিত্র রক্ষার জন্য বিয়ে করতে চায়। তিনি আরও বলেন স্বামী-স্ত্রীর অন্তরঙ্গতা স্থাপনের মাধ্যমে আল্লাহর কাছ থেকে সওয়াব পায়, কারণ তারা এই বৈধ ও হালাল পন্থায় করছে। রাসূল (সঃ) বলেন, মুসলিম পুরুষেরা যেন তাদের স্ত্রীদের কাছে পশুর মত না যায় বরং তার আগে একজন ‘দূত’ পাঠাবে। সাহাবাগণ জিজ্ঞাসা করল যে এই দূত কি, তখন তিনি বললেন, ভালবাসার কথা আর আদরের চুম্বন। এছাড়া তিনি অন্তরঙ্গ মেলামেশার তথ্য প্রকাশ করতে নিষেধ করেছেন।
জি-২৫ বাগদান (Engagement) ও পাত্র-পাত্রী নির্বাচন
প্রশ্নঃ
১. ইসলামের দৃষ্টিতে বিয়ের অবস্থান অত্যন্ত উচ্চে। এর গুরুত্ব ও দর্শন কি?
২. জীবন সাথী নির্বাচনের জন্য ইসলাম কি কি বিষয় লক্ষ্য রাখতে বলে?
৩. মেয়েদের পাত্র নির্বাচনের জন্যও কি একই বৈশিষ্ট্য নির্ধারিত?
৪. ইসলামী আইন মেয়েরা কি নিজেদের জন্য বর সন্ধান করতে পারে?
৫. ডেটিং ও অবাধ মেলামেশার অনুমতি না থাকায় ইসলামসম্মত পন্থায় যোগ্য জীবন সাথী নির্বাচন আদৌ কি সম্ভব?
উত্তরঃ
১. ইসলামে বিয়ের গুরুত্ব ও দর্শন
কুরআন বিয়েকে তিনটি প্রেক্ষিতে গুরুত্বের সাথে দেখেঃ
ক. এটা সামগ্রিকভাবে মানব ঐক্য ও সংহতির প্রাথমিক উৎস;
খ. সমাজের একক পরিবার। পরিবারের সূচনা বিয়ের মাধ্যমে। আর বিবাহ বন্ধন হচ্ছে পৃথিবীতে মানব বংশধারা টিকিয়ে রাখার একমাত্র বৈধ মাধ্যম;
গ. স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের প্রেক্ষিতে।
কুরআন বলে বিয়ে হচ্ছে আল্লাহর মহাজ্ঞানের এক নিদর্শন (Sign)। কারণ বিয়ে হচ্ছে মানব প্রকৃতি এবং চাহিদার প্রতি আল্লাহর অনুমতি, স্বীকৃতি ও ভালবাসার প্রতীক। এই বক্তব্য অন্যান্য ধর্মের চেয়ে বিয়েকে সম্মানিত করেছে যেখানে বিয়েকে পৃথিবীতে মানবের পতন এবং অব্যাহত পাপের প্রক্রিয়া হিসেবেই চিন্তা করা যায়।
বিয়ে সংক্রান্ত আলোচনায় আযওয়াজ শব্দের ব্যবহার (৩০:২১) লক্ষ্য করার মত, যার অর্থ স্বামী বা স্ত্রী (Spouse), যার মাধ্যমে এটাও প্রমাণিত হয় যে বিয়ে মানে একটি পারস্পারিক সম্পর্ক। কোন কোন ধর্মের মত এটা নয় এমন যে বিয়ে মানে পুরুষ তার যৌন সাথী খুজে নিচ্ছে। এর মাধ্যমে নর-নারীর মধ্যে মানবিক ও আধ্যাত্মিক সাম্যেরও ইঙ্গিত পাওয়া যায়। কুরআনে আরও উল্লেখ আছে যে, বিয়ে হচ্ছে প্রশান্তি, তৃপ্তি ও নিশ্চয়তার উৎস, যা স্বামী-স্ত্রীর অন্তরঙ্গ সম্পর্ক, আকর্ষণ ও ভালবাসা থেকে আসে। ইসালামে মানব-মানবীর পারস্পারিক ভালবাসা বৈধ, অনুমোদিত, পবিত্র এবং আল্লাহর আশীর্বাদ প্রাপ্ত। আল্লাহ মানব-মানবীর এই ভালবাসাকে অনুমতি দেন ও বরকত দেন যতক্ষণ তা অনুমোদিত সীমার মধ্যে চর্চা হয়। বিয়ের পরিণতিতে যে গর্ভসঞ্চার হয় তা ইসলামের দৃষ্টিতে নারীর প্রতি কোন শাস্তি নয় বরং বিবাহিত দম্পতির আশা আনন্দের উৎস এবং তাদের প্রতি আল্লাহর সন্তুষ্টির পুরষ্কার। সবশেষে বলতে হয় যে ইসলাম বৈরাগ্যকে বা চিরকৌমার্যকে অনুমোদন দেয়নি। আর অননুমোদিত বিষয়কে অনুমোদিত বানাবার চেষ্টা অপরাধ।
২. জীবন সাথী নির্বাচনে লক্ষণীয়
এই ব্যাপারে হাদিসে বিশেষ নির্দেশনা আছে। রাসূল (সঃ) বলেন বিয়েতে কারো পছন্দের ব্যাপারে মানুষ চারটি বিষয় দেখে, যথাঃ সম্পদ, আভিজাত্য, সৌন্দর্য এবং খোদাভীতি। এর মধ্যে ভাগ্যবান এবং শ্রেষ্ঠ সেই যে একজন ধার্মিক মেয়েকে বিয়ে করে। রাসূল (সঃ) মানুষকে আরও সতর্ক করে দেন যে যদি তারা শুধু সম্পদের আকর্ষণেই কাউকে বিয়ে করে তবে আল্লাহর রোষানলে পড়বে। অবশ্য এর মাধ্যমে রাসূল (সঃ) সৌন্দর্য এবং অন্যান্য বিষয়কে উপেক্ষা করতে বলেননি। বরং তিনি খোদাভীতি এবং সৎচরিত্রের উপর গুরুত্ব দিয়ে বলেছেন যে এ দুটোই মানুষের সবচেয়ে বড় সম্পদ। তিনি আরও বলেছেন যে মুসলমানরা তাকেই বিয়ে করবে যে প্রেমময় ভালবাসার যোগ্য ও সন্তান ধারণক্ষম।
৩. মেয়েদের জন্য বর নির্বাচনের পূর্বশর্ত
সাধারণতঃ ছেলেরাই বিয়ের ব্যাপারে উদ্যোগী ভূমিকা নেয়, আর রাসূল (সঃ)-এর কাছে বিয়ে সংক্রান্ত পরামর্শ নিতে মূলতঃ তারাই আসত। এজন্য উপরে বর্ণিত হাদিসগুলোতে পুরুষদের সম্বোধন করা হয়েছে। আসলে হাদিসে বর্ণিত বৈশিষ্ট্য নারী পুরুষ উভয়ের জন্যই প্রযোজ্য। এছাড়াও কয়েকটি হাদিস আছে যাতে বিশেষভাবে মেয়েদের অথবা তাদের অভিবাবকদের উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে। রাসূল (সঃ) বলেন, “এমন লোকের কাছে তোমাদের মেয়েদের বিয়ে দেবে না যারা ভাল নয় বরং মন্দ, এমন যারাই করবে তারা পরিবারকে ধ্বংস করবে।” তিনি আরও বলেন, “যদি কেউ তোমার মেয়ের পাণিপ্রার্থী হয় তবে তার কাছে মেয়ে বিয়ে দেবার পূর্বে তার চরিত্র এবং খোদাভীতি সম্পর্কে নিশ্চিত হও। যদি তোমরা এটা না কর তবে জমিনে অশান্তি সৃষ্টি হবে।” সাধারণভাবে বিয়ের পাত্র-পাত্রী নির্ধারণের ক্ষেত্রে ছেলে ও মেয়ে- উভয়েরই পূর্বশর্ত একই।
৪. মেয়েরা কি বিয়ের প্রস্তাব পাঠাতে পারে?
কুরআন কিংবা হাদিসে এমন কোন নিষেধাজ্ঞা নেই যে মেয়েরা বিয়ের প্রস্তাব পাঠাতে পারবে না। বরং এমন কিছু উদাহরণ আছে তাতে বোঝা যায় মেয়েদের এমন প্রস্তাব পাঠাবার অনুমতি আছে। বিবি খাদিজা (রাঃ) রাসূল (সঃ)-এর চরিত্রে, মাধুর্যে এবং সততায় মুগ্ধ হয়ে তাঁর এক মহিলা সহযোগীর সাথে পরামর্শ করে রাসূল (সঃ)-কে বিয়ের প্রস্তাব পাঠান। রাসূল (সঃ)-এর জীবনে দেখা যায় একবার এক মহিলা তাঁর কাছে উপস্থিত হয়ে সরাসরি তাঁকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। যদিও রাসূল (সঃ) সেই মহিলাকে বিয়ে করেননি, তবুও তিনি এমন কোন কথা বলেননি যে মেয়েরা এভাবে প্রস্তাব দিতে পারে না।
তবে সাধারণতঃ মেয়েরা পুরুষ পক্ষ থেকে প্রস্তাব পেতেই সম্মানিত বোধ করেন।
৫. ডেটিং এবং অবাধ মেলামেশা ছাড়া জীবন সাথী নির্বাচন প্রসঙ্গে
ইসলামের নৈতিক শিক্ষা ডেটিং সহ যে কোন ধরণের বিবাহপূর্ব অবাধ ও একান্ত মেলামেশায় নিষেধ করে। যারা বলে যে বিয়ের পূর্বে ডেটিং ও মেলামেশার মাধ্যমে পরস্পরকে পুরোপুরি জেনে বুঝে বিয়ে করলে এই বন্ধন দৃঢ় হয় তাদের জন্য শুধু এই যুক্তিই কি যথেষ্ট নয় যে যেসব দেশে এ সুযোগ অবারিত সেসব দেশে বিয়ে বিচ্ছেদের সংখ্যা বিশ্বে সর্বাধিক। বস্তুত ইসলামের দৃষ্টিতে বর বা কনে বাজারের পণ্য নয় যে ব্যবহার করে, যাচাই বাছাই করে পছন্দ করতে হবে। বর বা কনে কারো জন্য এটা শোনা সুখবর হবে না যে তার সাথী বিয়ের আগে বিয়ের আগে অন্য কারও সাথে ঘনিষ্ঠতা করেছে। যে সব মুসলমান বিয়ের আগে ছেলে-মেয়েকে পারস্পারিক সাক্ষাত ও আলাপের সুযোগ দেয়না তারাও ভুল করেন। রাসূল (সঃ) কয়েক জায়গাতেই নারী পুরুষকে আদেশ দিয়েছেন বিয়ের আগে দেখা করে নিতে। কারণ তিনি বলেন এতে পরস্পরের প্রতি ভালবাসা ও আকর্ষণ তৈরী হয়। ইসলামে সম্ভাব্য বর কনের পরস্পরকে দেখার ও আলাপের অনুমতি আছে তবে তা একাকী বা নিভৃতে নয়, তৃতীয় ব্যক্তি বা পক্ষের উপস্থিতিতে।
সূত্র নির্দেশিকাঃ
প্রশ্ন-১: আল কুরআন ২৫:৫৪, ১৬:৭২, ৭:১৮৯, ৫:৯০
প্রশ্ন-২: রাসূল (সঃ) বলেন, যে শুধুমাত্র মেয়ের সম্পদ দেখে বিয়ে করে আল্লাহ তার দারিদ্র্য বাড়িয়ে দেবেন। যে শুধুমাত্র মেয়ের বংশ মর্যাদা দেখে বিয়ে করে আল্লাহ তাকে হেয় করবেন। আর যে এমন মেয়ে খুঁজে যে তাকে ভদ্রতা ও সচ্চরিত্র উপহার দেবে অথবা তার এবং তার আত্মীয়দের প্রতি দয়ালু হবে, আল্লাহ তাকে তার স্ত্রীর জন্য এবং তার স্ত্রীকে তার রহমত হিসেবে উপহার দেবেন।
রাসূল (সঃ) আরও বলেন, আল্লাহর আনুগত্যের পর নারীর সবচেয়ে বড় গুন হচ্ছে তার স্বামীর প্রতি মমতাময়ী, সুন্দর ও সহাস্য হওয়া। এবং স্বামীর যে কোন যৌক্তিক আদেশ মেনে নেয়া। এমন নারী স্বামীর অনুপস্থিতিতে তার সম্পদের হেফাজত করে এবং তার সাথে করা প্রতিজ্ঞা রক্ষা করে।
প্রশ্ন-৩: আল কুরআন ২৪:৩২
প্রশ্ন-৫: এটা বর্ণিত আছে যে রাসুলের সাহাবী মুগীরা শোবা রাসূলের কাছে উপস্থিত হয়ে বলেন যে তিনি বিয়ে করছেন, তখন রাসূল (সঃ) বলেন যে তার প্রতি অনুভূতি সৃষ্টির জন্য তাকে দেখ।