জি-২৬ বাগদান (Engagement) (চলমান)
প্রশ্নঃ
১. বাগদান এর সময় প্রস্তাবিত বর কনের পারস্পারিক সাক্ষাত ও আলাপের সময় উভয় পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের উপস্থিতি প্রয়োজন কি?
২. কারো বাগদাত্তাকে তার পরিবারের অজ্ঞাতে দেখা যায় কি?
৩. বাগদানে কোন নির্ধারিত আনুষ্ঠানিকতা আছে কি?
৪. বাগদান ভেঙ্গে গেলে বাগদানের সময় প্রদত্ত উপহার কি ফেরৎ দিতে হয়?
৫. মেয়ে কর্তৃক প্রদত্ত উপহারও কি বিয়ের প্রস্তাব ভেঙ্গে গেলে ফেরৎযোগ্য?
৬. আনুষ্ঠানিক উপহার প্রদান ছাড়া বাগদানে আর কোন আর্থিক দায়িত্ব আসে কি?
৭. বাগদানে পালনীয় আর কি মৌলিক দিক আছে?
৮. পাত্র-পাত্রী নির্বাচনে পারস্পারিক গ্রহণযোগ্যতার (Compatibility) গুরুত্ব কি?
৯. কোন কোন মহিলাকে বিয়ে করা পুরুষের জন্য নিষেধ?
উত্তরঃ
১. প্রস্তাবিত বর কনের একান্ত ও নিভৃতে সাক্ষাত নিষিদ্ধ করার কারণ
বাগদান (engagement) বিয়ের প্রস্তুতিমূলক প্রক্রিয়া কিন্তু কোনভাবেই বিয়ের সমতুল্য নয়। বাগদানের পরিণতিতে বিয়ে নাও হতে পারে। এজন্যই ভবিষ্যতে ছেলে এবং মেয়ে উভয়ের সুনাম, নির্মলতা ও সততার উপর যেন কোন প্রশ্ন না আসতে পারে সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন। এজন্যই তাদের একান্ত সাক্ষাৎ নিষেধ। এছাড়াও কোন অসৎ লোক এই সুযোগের অপব্যবহার করতে পারে। বাগদানের নাম করে নিভৃতে কোন সরল মেয়েকে পেয়ে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে তার অসৎ উদ্দেশ্য চরিতার্থ করে পরে বাগদান ভেঙ্গে দিতে পারে। এজন্যে এই ব্যবস্থা এমনভাবে করা হয়েছে।
সাধারণভাবে ইসলামে বিবাহিত বা নিকটাত্মীয় ব্যতীত কোন পুরুষ ও মহিলার একাকী অবস্থান নিষিদ্ধ।
২. সম্ভাব্য কনেকে দেখার অনুমোদন
রাসূল (সঃ)-এর সাহাবা জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ তাঁর বিয়ের পূর্বে একটি গাছের আড়ালে লুকিয়ে তাঁর প্রস্তাবিত স্ত্রীকে দেখতেন। বস্তুতঃ পরস্পরের প্রতি আকর্ষণ তৈরির জন্য দেখার অনুমোদন ইসলামে আছে।
৩. বাগদানের আনুষ্ঠানিকতা প্রসঙ্গে
বাগদান পালনের জন্য কোন নির্ধারিত আনুষ্ঠানিকতা ইসলামে নেই। এটা একজন পুরুষ কর্তৃক একজন মহিলাকে দেয়া বিয়ের অঙ্গীকার (informal promise) যা সাধারণতঃ নিকটাত্মীয় পরিজনের উপস্থিতিতে কিছু উপহার প্রদানের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়।
৪. বাগদান ভেঙ্গে গেলে বাগদানের উপহার ফেরত প্রসঙ্গে
ইসলামে উপহার হিবা সম্পর্কে কিছু আইন আছে। ইসলাম মতে উপহার দুই ধরণের,
ক. অফেরৎযোগ্য নিঃশর্ত উপহার (যেমন- গরীব নিঃস্ব মানুষকে দান/উপহার)
খ. শর্তযুক্ত উপহার (যেমন, বাগদানের উপহার বিয়ের আশাতেই দেয়া হয়)। এই দ্বিতীয় ধরণের উপহারের ক্ষেত্রে আইনবিদরা বলেন যে, যদি মেয়ে পক্ষ থেকে বিয়ে ভেঙ্গে দেয়া হয় এবং উপহার ফেরৎযোগ্য অবস্থায় থাকে তবে তা ফেরৎ দিতে হবে। যদি উপহার ফেরৎযোগ্য অবস্থায় না থাকে (যেমন, ব্যবহৃত হয়ে যাওয়া অথবা বিক্রি করে দেয়া) তবে তার ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। আর বিয়ে যদি ছেলেপক্ষ থেকে ভাঙ্গা হয় তবে মালিকী মতে উপহার ফেরত দিতে হবে না। হানাফী এবং অন্যান্য মতে উপহার ফেরৎযোগ্য অবস্থায় থাকলে ফেরত দিতে হবে।
৫. মেয়ের পক্ষ প্রদত্ত বাগদানের উপহার প্রসঙ্গে
যদি মেয়ে পক্ষ ছেলেকে বাগদানের কোন উপহার দেয় তবে বিয়ে ভেঙ্গে গেলে উপরে বর্ণিত আইন তাদের জন্যও প্রযোজ্য হবে।
৬. বাগদানের সাথে সংশ্লিষ্ট অন্য আর্থিক দায়িত্ব
বাগদান হচ্ছে বিয়ের অঙ্গীকার যার সাথে যুক্ত আছে নৈতিক দায়িত্ব যে কোন সংগত কারণ ছাড়া কোন পক্ষ এই অঙ্গীকার থেকে সরবে না। এই নৈতিক দায়িত্ব ছাড়া কোন আর্থিক দায়িত্ব বাগদানের মাধ্যমে কারো উপর বর্তায় না।
তবে যদি বাগদানের প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতে কোন চাকুরীরত মেয়ে তার প্রস্তাবিত স্বামীর পরামর্শে চাকুরী ছেড়ে দেয় এবং এ অবস্থায় বিয়ে ভেঙ্গে যায় তবে সেই মেয়েকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। এই ক্ষতিপূরণের অর্থ প্রস্তাবিত মোহরানার অর্ধেক হবে। ডঃ সাবুনী এ কথা বলেন।
৭. বাগদানে পালনীয় মৌলিক বিধান
ক. রাসূল (সঃ) বলেন যে, কোন পুরুষ অন্য পুরুষের বাগদত্তার সাথে বাগদান করতে পারবে না। এটা শুধু ভদ্রতার ব্যাপারই নয় বরং উভয় পরিবারের মধ্যে খারাপ সম্পর্ক ও বোঝাবুঝি প্রতিহত করে।
খ. একই আইন মহিলাদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। কোন মহিলা অপর মহিলার সাথে বাগদানে আবদ্ধ পুরুষের সাথে বিয়ের আলোচনা করতে পারবে না।
গ. কোন পুরুষ কোন তালাকপ্রাপ্তা মহিলার সাথে তার ইদ্দত কাল পুরো না হওয়া পর্যন্ত বিয়ের আলাপ করতে পারবে না। তালাকের পর তিনমাস অপেক্ষা করতে হবে কারণ এই সময়ের মধ্যে তালাকপ্রাপ্ত স্বামী স্ত্রীর পুনর্মিলনও হতে পারে।
ঘ. কোন মহিলা বিধবা হবার পর একশ ত্রিশ দিন পার হবার আগে তাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়া যাবে না। তবে এক্ষেত্রে অথবা সদ্য তালাকপ্রাপ্তা এবং ইদ্দতকালীন সময়ে সম্ভাব্য বিয়ের বিষয়ে ইঙ্গিত দেয়া যেতে পারে, যা তা’রিদ নামে পরিচিত।
ঙ. বাগদান প্রক্রিয়া আরম্ভের পূর্বে সম্ভাব্য পাত্র-পাত্রীর পারস্পারিক গ্রহণযোগ্যতা (Compatibility) যাচাই করে নেয়া উচিৎ।
চ. কুরআনে নিষিদ্ধ মহিলাদের সাথে বাগদান নিষিদ্ধ।
৮. পারস্পারিক গ্রহণযোগ্যতার গুরুত্তঃ
রাসূল (সঃ) বলেন, “একজন মহিলার তার জন্য উত্তম ও গ্রহণযোগ্য পুরুষকেই বিয়ে করা উচিৎ।” কিছু কিছু বিশেষজ্ঞ এর ব্যাখ্যা করেছেন যে, একজন পুরুষ আর্থিক, সামাজিক ও শিক্ষাগত যোগ্যতায় নারীর সমপর্যায়ের হবেন। অবশ্য কুরআনে এর চাইতে উত্তম ব্যাখ্যা আছে যার অর্থ হচ্ছে উভয় পক্ষের মধ্যে বিয়ের সফলতার ব্যাপারে যৌক্তিক অঙ্গীকার থাকলে উভয়েই উভয়ের নিকট গ্রহণযোগ্য। কুরআন বলে প্রত্যেক বিশ্বাসী প্রত্যেক বিশ্বাসীর সমপর্যায়ের, এবং গ্রহণযোগ্যতার সবচেয়ে বড় মাপকাঠি হচ্ছে খোদাভীতি। রাসূল (সঃ) নিজের তত্ত্বাবধানে এমন অনেক বিয়ে দিয়েছেন যাতে আর্থিক বা সামাজিক সামঞ্জস্য ছিল না। তাহলে এটা নিশ্চিত হয় যে ঈমান ছাড়া বাকী সব সামঞ্জস্যতার প্রশ্ন কোন বাধ্যবাধকতা নয়। অবশ্য তাই বলে অন্যান্য বিষয়গুলো উপেক্ষারও নয়। এবং এটা সুস্পষ্ট যে, বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই সত্তর বছরের বৃদ্ধের সাথে নিশ্চয়ই ২০ বছরের তরুণীর বিয়ে মানানসই হবে না; এবং শিক্ষাগত যোগ্যতার বড় ব্যবধান দু’ব্যক্তির সামঞ্জস্যহীনতা প্রদর্শন করতে পারে।
৯. যেসব মহিলা (এবং পুরুষ)- কে বিয়ে নিষেধ
স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধঃ
স্থায়ীভাবে নিম্নবর্ণিত মহিলাদের বিয়ে হারামঃ
ক. রক্ত সম্পর্কে উপরের (যেমন, মা, খালা, ফুফু), এবং নিচের (যেমন, কন্যা বা নাতনী), আত্মীয় এবং পিতা মাতার রক্তসম্পর্কিতরা।
খ. বিয়ের মাধ্যমে সম্পৃক্ত আত্মীয়, যেমন- শাশুড়ি, স্ত্রীর পূর্বে পক্ষের কন্যা, পিতার বা পুত্রের বিধবা বা তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রী।
গ. দুধ্মাতা এবং তার সূত্রে সম্পৃক্ত মেয়েরা (দুধ্মাতার কন্যা, বোন, মাতা ইত্যাদি)। রাসূল (সঃ) বলেন, ‘রক্তের সম্পর্কের কারণে যারা নিষিদ্ধ, একই বক্তব্য দুধ্মাতার সম্পর্কে।’
অস্থায়ীভাবে নিষিদ্ধঃ যে কোন অবিশ্বাসী বা বিশ্বাসহারা মহিলাকে এবং ইদ্দতকালীন যে কোন মহিলাকে বিয়ে নিষেধ। অবশ্য অবিশ্বাসী মহিলা ঈমান আনলে তাকে বিয়ে করা যাবে।
সূত্র নির্দেশিকাঃ
প্রশ্ন-১: রাসূল (সঃ) বলেন, “কোন অবিবাহিত পুরুষ ও মহিলা একসাথে থাকলে তাদের মাঝে তৃতীয় ব্যক্তি হয় শয়তান।”
প্রশ্ন-৭: তা’রিদ (Ta’arid)-এর উদাহরণ হচ্ছে কোন সদ্যবিধবা অথবা ইদ্দতকালীন মহিলার এ আশা ব্যক্ত করা, “আমি খুব শীঘ্রই বিয়ের আশা করছি” অথবা তাকে এভাবে প্রস্তাব করা যে আমি আল্লাহর কাছে দোয়া করছি তিনি যেন আমাকে তোমার মত ধার্মিক স্ত্রী উপহার দেন।
প্রশ্ন-৮: আল কুরআন ৪৯:১০, ৪৯:১৩, ২:২২১
জি-২৭ ইসলামের বিয়ে সংক্রান্ত আইন-১
(নিষিদ্ধ বিষয়সমূহ)
প্রশ্নঃ
১. কয়েক ধরণের মহিলাকে বিয়ে হারাম ঘোষণার কারণ কি?
২. এছারা বিয়ে সংক্রান্ত আর কোন নিষেধাজ্ঞা আছে কি?
৩. ব্যভিচারী তওবা করলে তার ক্ষমার সুযোগ আছে কি?
৪. স্বামী বা স্ত্রী যে কেউ অপরের বিরুদ্ধে ব্যভিচারের অভিযোগ আনলে তাদের সম্পর্ক কি ভেঙ্গে যায়?
৫. অমুসলিমকে বিয়ে করতে বাধা কোথায়?
৬. কোন মুসলিম ছেলে কি আহলে কিতাব (ইহুদী, খ্রীস্টান) মেয়েকে বিয়ে করতে পারে?
৭. অনেকে বলেন যে যেহেতু খৃস্টানরাও আল্লাহর সাথে শরীক করে, সেহেতু তাদের আহলে কিতাব ধরা যায় না- এ ব্যাপারে কি বলবেন?
৮. আহলে কিতাব থেকে বিয়ে করার ক্ষেত্রে কি সতর্কতা নিতে হবে?
উত্তরঃ
১. মুসলিম বিয়ে আইনে কয়েক ধরণের মহিলাকে বিয়ে হারাম কেন?
যাদের বিয়ে করার হারাম তাদের তালিকা কুরআনে ৪ নং সূরার ২২ থেকে ২৪ আয়াতে বিস্তারিত দেয়া আছে। এই নিষিদ্ধ হবার পেছনে নিম্নলিখিত যুক্তি দেয়া যায়ঃ
ক. মৃত পিতার বিধবা অথবা তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীকে বিয়ে নিষিদ্ধ করে প্রাক ইসলামী যুগের আরবদেশের প্রচলিত এক জঘন্য প্রথাকে বাতিল করা হয়। সেযুগে পিতার মৃত্যুর পর তার ছেলেরা পিতার অন্যান্য সম্পদের সাথে তার বিধবা স্ত্রীদেরও মালিক হয়ে যেত। ইসলাম মাতৃতুল্য এই মহিলাদের বিয়ে নিষিদ্ধ করে তাদের মায়ের মর্যাদাকেই তুলে ধরেছে। ইসলাম আরও নিশ্চিত করেছে যে নারী সম্পত্তির মত উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়ার মত বিষয় হতে পারে না। উপরন্তু, ঐ নারী তার স্বামীর সম্পত্তি থেকে ভাগ পাবে। বস্তুত সৎমাকে ইসলাম মায়ের আসনেই নিয়ে এসেছে।
খ. পৃথিবীর প্রায় সব সভ্যতাতেই মা, কন্যা, ও বোনকে বিয়ে নিষিদ্ধ, কারণ তাদের প্রতি ভালবাসা, সম্মান যৌনতার ঊর্ধ্বে।
গ. খালা ও ফুফুরাও মায়ের মতই এবং ভাগ্নি, ভাইঝিরাও কন্যার মত, তাই তাদের বিয়ে নিষিদ্ধ।
এই সব মহিলারাই ‘মাহরিম’ যাদের বিয়ে করা হারাম। একইভাবে মহিলাদের জন্যও তাদের ঐরকম সম্পর্কীয়রা মাহরিম। নিকটাত্মীয়দের বিয়ে হারাম করে ইসলাম বিয়ের মাধ্যমে সমাজে মানুষের আত্মীয়কে বিস্তৃত করতে চায়। আধুনিক বিজ্ঞান মতেও দেখা যায় যে, আত্মীয়দের মাঝে বিয়ে হলে সন্তানদের মধ্যে জন্মগত ও জিনবাহিত (Genetic) রোগের পরিমাণ বেড়ে যায়।
এছাড়াও মুসলিমদের মধ্যে বিয়ে নিষিদ্ধ তালিকা হচ্ছেঃ
ঘ. দুধ্মাতা, ঐ দুধ্মাতার অন্যান্য দুধসন্তানেরা (কারণ তারা তার বোন/ভাই), অথবা দুধ্মাতার বোন- কারণ এসব বোনেরা ছেলের খালা হয়ে যায়।
ঙ. ঐ ব্যক্তির পুত্রবধু, কারণ ইসলামে সে কন্যার সমতুল্যা।
চ. দু’বোন একই সময়ে এক পুরুষের স্ত্রী হতে পারবেনা। কেননা, এক্ষেত্রে বোনদের পারস্পারিক সম্পর্ক সুস্পষ্টভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত, পরস্পরের প্রতি আন্তরিকতাশূন্য ও অবিশ্বাসপূর্ণ হবে।
ছ. এবং বর্তমানে বিবাহিত (অর্থাৎ অন্যের স্ত্রী)- কে বিয়ে করা যাবে না।
২. আর কোন নিষেধাজ্ঞা আছে কি?
কুরআনের এক আয়াতে বলা হয়েছে যে, যারা ব্যভিচারের অপরাধী তারা সৎ এবং নির্মল কাউকে বিয়ে করার অধিকার রাখে না। এই নিষেধাজ্ঞার কারণ নিম্নরূপঃ
ক. ইসলামের নৈতিক শিক্ষা যেকোন রকম অবৈধ যৌনাচারকে নিষেধ করে। এই নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে ব্যভিচারী অসৎদের এটাই বোঝানো হয়েছে যে তাদের জন্য কোন পুরষ্কার নেই। বরং সৎ চরিত্রবানদের জন্যই রয়েছে পুরস্কার।
খ. এই কঠোর ব্যবস্থা ব্যভিচারের বিরুদ্ধে নিবারক (Deterrant)-এর কাজ করবে।
গ. ইসলাম মতে বিয়ের অন্যতম উদ্দেশ্য প্রশান্তি ও বন্ধুত্ব। কাজেই একজন সৎচরিত্রবান খোদাভীরু নারী বা পুরুষ প্রশান্তি পাবেন না যদি তার সাথী দুশ্চরিত্রের হয়। ইসলাম এটা নিশ্চিত করেছে যে সমকক্ষ নয় এমন দু’জনের বিয়ে সফল হবে না।
ঘ. ব্যভিচারের সাথে চরিত্রবানের বিয়েতে বিভিন্ন যৌন রোগের বিস্তারের সম্ভাবনাও থাকে যা এই নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে দূরীভূত হয়।
৩. ব্যভিচারকারীর তওবা প্রসঙ্গে
ইসলামে আন্তরিক তওবার জন্য তিনটি শর্ত জরুরীঃ ক. অপরাধের তাৎক্ষণিক অবসান; খ. অপরাধীর তীব্র অনুশোচনা বোধ; এবং গ. ভবিষ্যতে আর একই অপরাধ না করার দৃঢ় সংকল্প। এভাবে যদি আন্তরিকতার সাথে তওবা করা হয়, তাহলে আল্লাহর তরফ থেকে ক্ষমার সুযোগ রয়েছে। তবে এক্ষেত্রে সে সৎ চরিত্রবান মানুষের সাথে বিয়ের অধিকার পাবে কিনা তা কুরআনে স্পষ্ট করে বলা নেই। আইনবিদরা মনে করে যেহেতু তওবার মাধ্যমে বড় অপরাধের ক্ষমার সুযোগ রয়েছে সেহেতু ব্যাভিচারীও এই সুযোগ পেতে পারেন। তবে তওবাকারী যদি মহিলা হয় এবং তাকে কোন পুরুষ বিয়ে করতে চায় তবে আইনবিদরা বলেন তিনমাস অপেক্ষা করে তার গর্ভাবস্থা নিশ্চিত করতে। যদি গর্ভবতী হয় তবে তার সন্তানের জন্ম পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
৪. স্বামী বা স্ত্রী যে কেউ অপরের বিরুদ্ধে ব্যভিচারের অভিযোগ আনলে
স্বামী বা স্ত্রী যে কেউ অপরের বিরুদ্ধে ব্যভিচারের অভিযোগ আনলে ইসলামের শিক্ষা কি তা জি-১৩ অধ্যায়ে আলোচনা করা হয়েছে। এখানে দু’পক্ষই পাঁচবার কসম খেলে করোরই শাস্তি হবে না তবে বিয়ে ভেঙ্গে যাবে। ইসলামী আইনে স্বামী এবং স্ত্রীর স্থায়ীভাবে বিচ্ছেদ হয়ে যাবে।
৫. অমুসলিম/ভিন্নধর্মাবলম্বীদের বিয়ে প্রসঙ্গে
ইসলামী আইনে মুশরিক, নাস্তিক (খাঁটি মার্ক্সবাদীরাও) এবং রাসূল (সঃ)-এর খতমে নবুওয়তে বিশ্বাসী নয় তাদের বিয়ে করা হারাম।
৬. আহলে কিতাবকে বিয়ে প্রসঙ্গে
কুরআন মুসলিম পুরুষদের আহলে কিতাবের সতী মেয়ে বিয়ের অনুমতি দিয়েছে। আহলে কিতাব বলতে ইহুদী-খ্রীস্টানদের বোঝায়। তবে কোন কোন আইনবিদ এদের ছাড়াও যারা আন্তরিকভাবে এক আল্লাহ, রাসূলদের এবং কিতাবে বিশ্বাস করে তাদেরও এর অন্তর্ভুক্ত করেছেন। অবশ্য এই ছাড় তাদের প্রতি সহনশীলতা ও শুভেচ্ছা প্রদর্শনের একটা সুযোগ মাত্র, কোন নির্দেশনা নয়।
৭. যারা খ্রীষ্টানদের আহলে কিতাব বলে স্বীকার করতে চান না কারণ তারা খোদার সাথে শরীক করে প্রসঙ্গে
রাসূল (সঃ)-এর সময়েই আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রাঃ) প্রমুখ সাহাবা অভিযোগ করেন যে সেই সময়কার খ্রীষ্টানরা যেহেতু যীশুকে খোদার পুত্র মনে করে সেহেতু তারাও মুশরিক। এতদসত্ত্বেও কুরআনে কাফেরদের কথা একভাবে এবং ইহুদী খ্রীষ্টানদের কথা অন্যভাবে বলা হয়েছে। ইহুদী খ্রীষ্টানদের ‘আহলে কিতাবের’ মর্যাদা দেয়া হয়েছে। আহলে কিতাবদের সতী নারীকে বিয়ের অনুমতি কুরআনে দেবার পরও আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রাঃ) প্রমুখ একে নিরুৎসাহিত করতেন এবং সতর্কতা অবলম্বন করে চলতে অন্য মুসলিম পুরুষদের বলতেন।
৮. আহলে কিতাবীদের সতী নারীকে বিয়ের ক্ষেত্রে সতর্কতা
বর্তমান বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইসলামী আইনবিদ আল্লামা ইউসুফ আল কারযাভী তার ‘ফতওয়া মুয়াসিরা’-তে বলেন আহলে কিতাবী মেয়ে বিয়ের সময় খেয়াল রাখতে হবে যে-
ক. ইহুদী বা খ্রীষ্টান মেয়ে স্বধর্মে ধার্মিক হতে হবে; নিছক জন্মসূত্রে আহলে কিতাবী, বাস্তবে অধার্মিক হলে চলবে না।
খ. প্রস্তাবিত মেয়েকে সতী হতে হবে। মুসলমানরা ভাল করে খোঁজ নেয় যেন সেই মেয়ের নৈতিক মান ইসলামী নৈতিক মানে মনোতীর্ণ হয়। যেমন, অবিবাহিত মেয়ে হলে সে যেন কুমারী (Virgin) হয়।
গ. প্রস্তাবিত মেয়ে যেন এমন জাতির না হয় যারা সক্রিয়ভাবে ইসলাম ও মুসলমানদের ক্ষতি সাধনে লিপ্ত কেননা কুরআন এসব মানুষদের সাথে বন্ধুত্ব করতে সতর্ক করেছে।
ঘ. নিজের বা অন্য মুসলিমদের উপর যেন কোন নেতিবাচক পরিণতি না হয় তা খেয়াল রাখতে হবে।
এমন বিয়ের সম্ভাব্য ক্ষতিকর দিকঃ
ক. মুসলিম মেয়েরা যারা শুধু মুসলিম ছেলেকেই বিয়ে করতে পারে তার যখন দেখবে মুসলিম ছেলেরা অন্য ধর্মের মেয়ে বিয়ে করছে তখন তারা অসুবিধার সম্মুখীন হবে।
খ. পরিবারের স্থিতিশীলতা বিপন্ন হতে পারে, বিশেষতঃ যখন পিতা ছেলেমেয়েদের ইসলামী কায়দায় বড় করতে চাইবে আর মা ভিন্ন ধারায় বড় করতে চাইবে।
এধরণের বা অন্য রকমের নেতিবাচক ফলাফলের আশংকা থাকলে এমন বিয়ে করা বৈধ নয়, বিশেষত এমন সমাজে যা এমনিতেই ইসলাম বিরোধী।
সূত্র নির্দেশিকাঃ
প্রশ্ন-১: আত্মীয়দের মাঝে বিয়ের ফলে জীনবাহিত রোগের আধিপত্যের কথা বিবেচনা করে সমকালের প্রখ্যাত মুসলিম আইনবিদ আল গাযালী কাজিন (Cousin) দের মাঝে বিয়ে না করতে বলেছেন, যদিও কুরআনে তা নিষেধ করেনি।
প্রশ্ন-২: আল কুরআন ২৪:৩, ৫:৬, ৪:২৫, ২৪:২৬
প্রশ্ন-৩: আল কুরআন ২৪:৩, ২৫:৬৮-৭০,
প্রশ্ন-৫: আল কুরআন ২:২২১, ৬০:১০
প্রশ্ন-৬: আল কুরআন ৫:৬
প্রশ্ন-৭: আল কুরআন ২২:১৭, ৯৮:১
প্রশ্ন-৮: আল কুরআন ৬০:৮-৯, ৫৮:২২
জি-২৮ ইসলামের বিয়ে সংক্রান্ত আইন-২
(বিয়ের বৈধতা)
প্রশ্নঃ
১. অমুসলিম পুরুষকে মুসলিম নারী বিয়ে করতে পারবে না কুরআনে এমন নিষেধ আছে কি?
২. মুসলিম মেয়ে আহলে কিতাব পুরুষকে বিয়ে করতে পারবে না কেন?
৩. যারা বলে মুসলিম ছেলে আহলে কিতাবী মেয়ে বিয়ে করলেও সন্তান লালন পালন-এর ক্ষেত্রে একই সমস্যা হতে পারে, তাদের যুক্তির জবাবে কি বলবেন?
৪. যদি একটি অমুসলিম দম্পত্তির একজন ইসলাম গ্রহণ করে তাহলে কি হবে?
৫. মুসলিম বিয়ে চুক্তি কি Scared অথবা Civil?
৬. বিয়ে চুক্তির বৈধতার শর্ত কি কি?
৭. এর বাইরে আর কোন শর্ত আছে কি?
৮. অভিবাবকের অনুমতি ছাড়া কোন মুসলিম মেয়ে বিয়ে করতে পারে কি? যদি পারে, তাহলে এর স্বপক্ষে প্রমাণ কি?
উত্তরঃ
১. মুসলিম মেয়ের অমুসলিম পুরুষ বিয়ে নিষেধাজ্ঞা প্রসঙ্গে
কুরআন স্পষ্টভাবে মুসলিম মেয়েদের অমুসলিম পুরুষ বিয়ে নিষেধ করেছে। এই আয়াত কুরআনে তখন নাযিল হয় যখন মক্কা থেকে অমুসলিম স্বামী/পিতার ঘর ছেড়ে আসা মুসলিম মেয়ের স্রোতে মদীনা ভরে গিয়েছিল। ৬০ নং সূরার ১০ নং আয়াতে রাসূল (সঃ)-কে বলা হয় যে, যে মেয়েরা শুধুমাত্র আল্লাহর পথে হিজরত করেছে তাদের অবিশ্বাসীদের কাছে যেন ঠেলে দেয়া না হয়। সেই থেকে মুসলিম মেয়েদের অমুসলিমদের সাথে বিয়ে নিষেধ; সেই সাথে আহলে কিতাবের সাথেও মুসলিম মেয়েদের বিয়ে বারণ। কারণ ৫ নং সূরার ৬ নং আয়াতে শুধুমাত্র আহলে কিতাব চরিত্রবান মেয়েদের মুসলিম পুরুষের বৈধ বলা হয়েছে, আহলে কিতাবের চরিত্রবান পুরুষদের জন্য নয়।
২. আহলে কিতাবের সাথে মুসলিম নারীর বিয়ে নিষিদ্ধ হবার কারণ
প্রথমত এই নিষেধাজ্ঞা কোন মানুষ আরোপিত নয়। এটা সর্বশ্রেষ্ঠ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতায়ালার, যিনি তার আদেশ নিষেধের মাধ্যমে মানব-মানবীর কল্যাণ করেন। এর সম্ভাব্য কারণ সম্ভবতঃ এই যে, সাধারনত স্বামীই পরিবারের প্রধান এবং পরিচালক থাকেন। সেক্ষেত্রে একজন আহলে কিতাব স্বামীর পরিচালনায় একজন মুসলিম মেয়ের ধর্মীয় স্বাধীনতা বিপন্ন হতে পারে। পক্ষান্তরে একজন মুসলিম স্বামীর কাছে আহলে কিতাব মেয়ে নিরাপদ। কারণ তার ধর্মগ্রন্থ, তার নবী-রাসূলদের প্রতি মুসলিম স্বামীরও স্বীকৃতি থাকে এবং তার ধর্মীয় স্বাধীনতার প্রতি সে সজাগ থাকে, প্রভৃতি। অমুসলিম স্বামীর ক্ষেত্রে এসবই অনুপস্থিত থাকতে পারে। ইসলাম শুধু একটি বিশ্বাসই নয় পরিপূর্ণ জীবন বিধান। অমুসলিম স্বামীর সংসারে ইসলামী জীবন পরিচালনায় মুসলিম মেয়ে ব্যর্থ হবারই কথা।
৩. যারা বলে যে মুসলিম পুরুষের ক্ষেত্রেও একই সমস্যা হতে পারে
মুসলিম ছেলে আহলে কিতাব মেয়ে বিয়ে করলে তারও নিজের বিশ্বাস বজায় রাখা ও ছেলেমেয়েকে ইসলামী কায়দায় বড় করার ক্ষেত্রে সমস্যা হতে পারে- এই সত্য ইসলামও স্বীকার করে। সেজন্য এমন শঙ্কা থাকলে এ ধরণের বিয়ে ইসলাম নিষেধ করে। বস্তুতঃ ইসলামে বিয়ের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে আধ্যাত্মিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও দৈহিক পার্টনারশীপ, যা শুধুমাত্র মোমেন-মোমেনার মধ্যেই সফলভাবে সম্ভব। ইসলামের এ অনুমোদন কেবল আহলে কিতাবধারীদের প্রতি সহনশীলতা (tolerance) ও শুভেচ্ছা প্রদর্শনস্বরূপ (goodwill)। কিন্তু এ সুযোগ শর্তমুক্ত নয়। যেখানে অশুভ সম্ভাবনা নেই এবং সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ ভাল এমন ক্ষেত্রেই ইসলাম আহলে কিতাব বিয়ে অনুমোদন করে। আর শর্তসাপেক্ষে অনুমোদিত বিষয় শর্ত ভঙ্গের সম্ভাবনা থাকলে অননুমোদিত (হারাম) হয়ে যায়। এবং এরকম শর্তযুক্ত বিয়ের ক্ষেত্রেও এটা প্রযোজ্য হবে।
৪. অমুসলিম দম্পত্তির মধ্যে একজন ইসলাম গ্রহণ করলে
অমুসলিম দম্পত্তির মাঝে স্বামী ইসলাম গ্রহণ করলে তার স্ত্রী অমুসলিম (আহলে কিতাব) থাকতে চাইলে অসুবিধা নেই। কিন্তু স্ত্রী ইসলাম গ্রহণ করলে এবং স্বামী ইসলাম গ্রহণে অস্বীকৃতি জানালে বিষয়টি জটিল আকার ধারন করে। কারণ ইসলাম অমুসলিমের সাথে মুসলিম নারীর বিয়ের অনুমতি দেয় না। অবশ্য এক্ষেত্রে তাৎক্ষণিকভাবে বিয়ে ভাঙ্গার প্রয়োজন নেই, বরং তারা একটি অন্তর্বর্তীকালীন সময় অপেক্ষা করবে যার মধ্যে স্বামীকে পরিবার অটুট রাখাতে ইসলাম গ্রহণে সময় দেয়া হবে (ঐ সময় স্বামী স্ত্রীর মাঝে কোন দৈহিক সম্পর্ক থাকবে না)। অন্তর্বর্তীকালীন সময়ের মধ্যে স্বামী মুসলমান না হলে বিয়ে ভেঙ্গে যাবে। আজকাল পশ্চিমা জগতে অনেক নওমুসলিম মেয়েই এই সমস্যায় পড়ছে এবং সেই প্রথম যুগের মুসলিম মেয়েদের মতই দৃঢ়ভাবে ঈমানের পরীক্ষায় জয়ী হচ্ছে।
৫. ইসলামের বিয়ে চুক্তি Sacred অথবা Civil
ইসলামী আইনে বিয়ে কোন Sacred এবং Mundane অথবা Civilএবং Religious- এই পার্থক্য নেই। সেজন্য কোন ধর্মীয় ব্যক্তিত্বের পরিচালনায় এই বিয়ে সম্পন্ন হতে হবে এমন কোন শর্ত নেই। খ্রীষ্টানদের মত ইসলামে কোন যাজক নেই। যে কোন মুসলমান নামাজ পড়াতে ও বিয়ে পড়াতে পারেন। যদিও ঐতিহ্যগতভাবে ইমাম সাহেব দিয়ে বিয়ে পড়ানো হয়। তবুও এটা কোন বাধ্যবাধকতা নয়। মুসলিম বিয়ে এই অর্থে Sacred (পবিত্র) যে এটা আধ্যাত্মিক আইনের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিতঃ এটা দুজন মানুষের পবিত্র বন্ধন ও চুক্তি।
৬. বিয়ে চুক্তি বৈধতার শর্তঃ
ক. বর কনে উভয়ের সজ্ঞান ও স্পষ্টভাবে সম্মতি।
খ. দু’জন আইনগত যোগ্যতাসম্পন্ন (মুসলিম) সাক্ষী। যদি কনে আহলে কিতাব হয়, তবে একজন সাক্ষী তার পক্ষের হতে পারবে বলে ইমাম আবু হানিফা বলেন।
গ. বর কনে অবশ্যই বিয়ে নিষিদ্ধ (মাহরিম) সম্পর্কের হবে না।
৭. আরও যে সব শর্ত প্রযোজ্যঃ
ঘ. যদি কোন অপ্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তির বিয়ে হয় (যা কদাচিৎ দৃষ্ট) তবে তার অভিবাবকের নির্দিষ্ট সম্মতি, অথবা অভিবাবক না থাকলে মুসলিম মুসলিম বিচারকের সম্মতি।
ঙ. কোন পক্ষ থেকে রোগ, অক্ষমতা বিষয়ে বা অন্য যে কোন বিষয়ে কোন সত্য গোপন করা বা কোন মিথ্যা তথ্য দেয়া যাবে না। কাবিনে এমন শর্ত যুক্ত থাকতে পারে যে এমন কোন তথ্য গোপন করলে বিয়ে ভেঙ্গে যাবে।
চ. অভিবাবকের অসম্মতিতে কোন মেয়ে নিজ দায়িত্বে বিয়ে করলে, তার অভিবাবক মেয়ের মঙ্গলার্থে আদালতে এই বিয়ে বাতিলের আবেদন জানাতে পারে। যেমন, আবেগবশত কোন মেয়ে এমন কাউকে বিয়ে করে বসতে পারে যে ড্রাগ আসক্ত। এমন ক্ষেত্রে কনের সর্বোচ্চ স্বার্থে পিতা বিয়ে রদ করার আবেদন করতে পারে।
৮. মুসলিম মেয়ের পিতার অমতে বিয়ে প্রসঙ্গে
ইমাম আবু হানিফাসহ একদল বিশেষজ্ঞ বলেন, মুসলিম মেয়ে অভিবাবকের সম্মতি ছাড়া বিয়ে করতে পারে। তবে অধিকাংশ বিশেষজ্ঞ এর বিরুদ্ধে বলেন। তারা রাসূলের (সাঃ) একটি হাদিসের উদ্ধৃতি দেন যেখানে তিনি বলেন যে মেয়ের অভিবাবকের সম্মতি ছাড়া বিয়ে বাতিল। আর এর বিপক্ষের বিশেষজ্ঞরা যুক্তি দেন যে, কুরআনের আয়াতে দেখা যায় যে বিয়ে মেয়ের হাতে। আর যেহেতু মেয়েরা আর্থিক চুক্তিসহ অন্যান্য চুক্তি করার অধিকার রাখে, সেহেতু তারা বিয়েরও অধিকার রাখে।
সূত্র নির্দেশিকাঃ
প্রশ্ন-১: আল কুরআন ৬০:১০, ৫:৬
প্রশ্ন-৬: বিয়েতে মত দেবার একটি প্রচলিত নমুনা হচ্ছে, মেয়ের পিতা বা উকিলঃ “আমি আপনার কাছে আমার কন্যা (নাম) কুরআন ও সুন্নাহ অনুযায়ী আমাদের মাঝে সম্মত মোহরানার শর্তে আল্লাহকে সাক্ষী রেখে বিয়ে দিচ্ছি।”
বর অথবা তার অভিবাবকঃ আমি কুরআন ও সুন্নাহ অনুসারে সাক্ষী রেখে সম্মত মোহরানার শর্তে আপনার কন্যাকে গ্রহণ করছি।
প্রশ্ন-৮: আল কুরআন ২৪:৩২, ২:২৩২ রাসূল (সাঃ) বলেন, “…… যদি কোন নারী তার অভিবাবকের অসম্মতিতে বিয়ে করে, তবে তার বিয়ে বাতিল বলে গণ্য হবে।”
জি-২৯ ইসলামের বিয়ে সংক্রান্ত আইন-৩
(বিয়ে চুক্তি)
প্রশ্নঃ
১. প্রাপ্ত বয়স্ক মহিলার বিয়েতে অভিবাবকের ভূমিকা কি?
২. যেহেতু ইসলামে বিয়ের ন্যূনতম বয়স নির্ধারিত নেই, সেহেতু ইসলামে কি বাল্য বিবাহের অনুমতি আছে?
৩. একজন পুরুষকে স্বামী হিসেবে পছন্দ করা বা সম্মতি দেয়ার অধিকার মুসলিম নারীকে ইসলাম দেয় কি? এক্ষেত্রে মুসলিম সমাজে এ অধিকারের প্রয়োগ কেমন?
৪. বিয়েতে প্রদত্ত উপহার কি যৌতুকের মত?
৫. মেয়ের প্রাপ্ত মোহরানা কি তার জন্য ফার্নিচার কেনার বা অন্য কাজে তার পরিবার ব্যয় করতে পারে?
৬. মোহরানার সর্বোচ্চ বা সর্বনিম্ন সীমা ধার্য করা যায় কি?
উত্তরঃ
১. প্রাপ্ত বয়স্কার বিয়েতে অভিবাবকের ভূমিকা
এব্যাপারে দু’টো মত রয়েছে। যারা মনে করেন মেয়ের বিয়েতে অভিবাবকের সম্মতি অত্যাবশ্যক তারা এ ব্যাপারে তিনটি যুক্তি দেখানঃ
ক. কুরআনে যেখানে মেয়েদের বিয়ের কথা বলা হয়েছে তাতে তাদের অভিবাবককে সম্বোধন করা হয়েছে। এতে মনে হয় মেয়ের বিয়ে অভিবাবকের মধ্যস্থতাতেই হতে হবে।
খ. রাসূলের একটি হাদিসে দেখা যায় যে তিনি বলেছেন বিয়েতে মেয়ের অভিবাবকের সম্মতি না থাকলে বিয়ে বাতিল হয়ে যায়।
গ. মেয়ের দীর্ঘ মেয়াদী স্বার্থ সংরক্ষণের জন্যই বিয়ে চুক্তিতে এমন প্রিয় কারো পরামর্শ নেয়া উচিত, যারা তাকে অত্যন্ত ভালবাসে, যেমন- মা-বাবা/অভিবাবক।
যারা বলেন মেয়ের বিয়েতে অভিবাবকের সম্মতি অত্যাবশ্যক না তারা যুক্তি দেখান যেঃ
ক. কুরআনের সুরা বাকারায় ২৩০ এবং ২৩২ নং আয়াতে বিয়ের আলোচনায় মেয়েদের সরাসরি সম্বোধন করা হয়েছে।
খ. ইসলামী আইন মেয়েদের আর্থিক চুক্তিসহ অন্যান্য সিভিল চুক্তি সাক্ষর করার অধিকার দিয়েছে। সেহেতু তাদের বিয়েতেও স্বেচ্ছায় অগ্রসর হবার অধিকার আছে।
গ. তারা বলেন, রাসূল (সঃ)-এর অভিবাবকের মত সংক্রান্ত হাদিস কেবল অপ্রাপ্তবয়স্কার মেয়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
এ ভিন্ন দু’টি মতের প্রতি কারো দৃষ্টিভঙ্গি যাই হোক না কেন, সাধারণভাবে মুসলিম মেয়েরা এটা পছন্দ করে যে তাদের অভিবাবক তাদের স্বামীর হাতে তুলে দেবেন এবং তাদের হয়ে সম্মতি দেবেন।
২. অপ্রাপ্ত বয়স্কের বিয়ে প্রসঙ্গে
কুরআন এবং সুন্নাহয় বিয়ের কোন বয়সসীমা নির্ধারিত নেই। এর কারণ কুরআন কালোত্তীর্ণ জীবন ব্যবস্থা। এখানে সব জাতির, সব কালের, সব স্থানের, সব মানুষের জন্যই কল্যাণকর বিধান রয়েছে। (বয়সসীমা নির্ধারিত থাকলে অনেক সমাজের জন্যই তা অসুবিধাজনক হত।– অনুবাদক)
আলোচনার স্বার্থে কয়েকটি শব্দের পৃথক অর্থ বোঝা প্রয়োজন- বাল্য বিবাহ, অপ্রাপ্তবয়স্ক বিবাহ এবং Consummation of Marriage । সমাজ বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন যে, বাল্য বিবাহের প্রচলন ইসলামের অভ্যুদয়ের আগেও ছিল, পরেও আছে; কিন্তু এর মানে এটা ছিল না যে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক সাথে সাথে শুরু হত। এ বিয়ে চুক্তির কারণ ছিল দু;টি সমাজ ও পরিবারের মধ্যে বড় মিল ও আন্তরিকতা বৃদ্ধির এক প্রতিশ্রুতি। আগে থেকে প্রচলিত এ ব্যবস্থাকে ইসলাম কতগুলো শর্ত প্রয়োগ করে বাস্তবতার কাছে নিয়ে এসেছে। এই শর্তগুলো হলঃ
ক. অপ্রাপ্ত বয়স্ক বিয়ের ক্ষেত্রে অভিবাবকের (বা একজন বিচারকের) পূর্ব সম্মতি আবশ্যক।
খ. বিয়ের পর মেয়ে প্রাপ্তবয়স্ক না হওয়া পর্যন্ত Consummation of Marriage (স্বামী-স্ত্রীর মিলন) হবে না।
গ. মেয়ে প্রাপ্তবয়স্কা হবার পর স্বামীর সাথে মিলিত হবার আগেই বিয়ের ব্যাপারে তার মতামত দিতে পারবে। যদি তার মত নাবাচক হয় তবে বিয়ে ভেঙ্গে যাবে। ইসলামে এটা গুরুত্বপূর্ণ নীতি যে, মেয়েদের বিয়েতে তাদের মত দেয়ার স্বাধীনতা আছে।
৩. বিয়েতে মেয়ের পছন্দ-অপছন্দের অধিকার ও মুসলিম সমাজে এর স্বীকৃতি
কুরআন এবং সুন্নাহয় বিবৃত ইসলামে বিয়েতে মেয়ের সম্মতির ও বর পছন্দের অধিকার সন্দেহাতীতভাবে স্বীকৃত। কিন্তু মুসলিম সমাজে এ অধিকার চালু রাখার ব্যাপারে বিভিন্ন দেশে এ জাতিতে বিভিন্ন অনীহা বিরাজমান। অবস্থা ভেদে ‘A’ থেকে ‘F’ মান পর্যন্ত grade- এ ভাগ করা যায়। এটা নির্ভর করে মুসলমানরা কুরআন সুন্নাহর জ্ঞান কতটা রাখে ও কতটা পালন করে। যখন কুরআন বিয়েকে আধ্যাত্মিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও দৈহিক পার্টনারশিপ হিসেবে বর্ণনা করে তখন এটা স্পষ্ট যে দুই পক্ষের সানন্দ সম্মতি ছাড়া এটা সফল হতে পারেনা। হাদিসে একাধিক ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, রাসূল (সাঃ)-এর কাছে মহিলারা যখন অভিযোগ নিয়ে আসেন যে বিয়েতে তাদের সম্মতি ছিলনা, তখন রাসূল (সাঃ) বিয়ে বাতিল বলে ঘোষণা দিয়েছেন।
৪. বিয়ের উপহার ও যৌতুক-এর পার্থক্য
ইসলামে বিয়ের উপহার যৌতুক (dowry) নয়। যৌতুক সাধারণত মেয়ে পক্ষ বরকে নগদ দেয়। পক্ষান্তরে ইসলামে বরকেই নগদ মোহরানা প্রদান করতে হয়, যা কুরআন অনুসারে ‘সাদাকা’ বা উপহার হিসেবে চিহ্নিত, যা নবজীবনের প্রতি ভালবাসা ও প্রতিশ্রুতির নিদর্শনস্বরূপ। আবার এই মোহরানা কোন কোন সমাজে মেয়ে নেবার সময় মেয়ের পিতাকে যে ক্ষতিপূরণ মূল্য দেয়া হয় তার সমার্থক নয়। করণ মোহরানা মেয়ের পিতা পায়না এটা নিরঙ্কুশভাবে মেয়ে পায়। এটা কোন মূল্য নয় বরং উপহার।
৫. মেয়ে পক্ষের মোহরানা খরচের অধিকার
মোহরানা নিরঙ্কুশভাবে মেয়ের। কাজেই মেয়ের পরিবার কর্তৃক এই টাকা খরচ করা ইসলাম পরিপন্থী। স্ত্রীর ভরণ-পোষণ ও আসবাব নিশ্চিত করা স্বামীর দায়িত্ব। তবে মেয়ের অনুমতি নিয়ে কেউ কেউ নতুন সংসার শুরুর জন্য প্রয়োজনীয় কিছু আসবাব মোহরানার অর্থে কিনে থাকে। এক্ষেত্রে ঐসব আসবাবের মালিকানা স্ত্রীর থাকবে।
৬. মোহরানার সীমা নির্ধারণ
কুরআন বা হাদিসে মোহরানার কোন ন্যূনতম বা সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ করে দেয়া হয়নি। ইসলাম উভয়ের জন্য বিয়েকে সহজ ও গ্রহণযোগ্য করতে চায়। তাই দেখা যায় রাসূল (সাঃ) কখনো মোহরানা হিসেবে মাত্র একজোড়া জুতা, বা কুরআনের একটি সূরা তিলাওয়াৎ বা ঈমান আনাকেই অনুমোদন করেছেন। রাসূল (সাঃ) বলেছেন যে, সবচেয়ে রহমত প্রাপ্ত বিয়ে হবে সেটা, যেটা সহজে হয়েছে অর্থাৎ যেটায় খরচ খুব বেশী হয়নি।
রাসূল (সাঃ) এর মৃত্যুর পর ওমর (রাঃ) মোহরানার সীমা নির্ধারণ করতে চাইলে একজন মহিলা কুরআনের উদ্ধৃতি দিয়ে তা প্রতিহত করেন যাতে বলা হয়েছে কেউ যদি তার সমস্ত সম্পদও মোহরানা হিসেবে দেয় তাও অনুমোদিত।
ইসলামে এটা নিশ্চিত করে যে বিয়ে কে পবিত্র বন্ধন। এটা কোন ব্যবসা নয় যে মেয়ে পক্ষ ইচ্ছেমত মোহরানা ধার্য করে অর্থ লুটে নেবে। এ হৃদয়ের বন্ধনকে জাগতিক দরকষাকষির ঊর্ধ্বে রাখতে হবে।
সূত্র নির্দেশিকাঃ
প্রশ্ন-২: Edward Weston-Mark, ‘History of Human Marriage’
প্রশ্ন-৩: আল কুরআন ৩০:২১,
বুখারী শরীফে উদ্ধৃত আছে যে, রাসূল (সাঃ) সেই বিয়ে বাতিল করে দেন যা মেয়ের পিতা মেয়ের অমতে দিয়েছিলো।
রাসূল (সাঃ) আরও বলেন, যে মহিলার আগে একবার বিয়ে হয়েছে বিয়ের ব্যাপারে তার মতামত অভিবাবকের ঊর্ধ্বে। আর কুমারী মেয়েরও অনুমতি নিতে হবে, তার নীরবতাই হবে তার অনুমতি।
একবার একজন মহিলা রাসূল (সাঃ)-এর কাছে এসে বলেন যে তার অমতে বিয়ে হয়েছে, তখন রাসূল (সাঃ) সেই বিয়ে বাতিল করে দেন। তখন সেই মহিলা বলেন যে, তিনি পরে বিয়ে মেনে নিয়েছেন; তবু রাসূলের কাছে এসেছেন এটা প্রতিষ্ঠিত করতে যে মেয়ের অমতে বিয়ে দেবার অধিকার তাদের পিতার নেই।
প্রশ্ন-৪: আল কুরআন ৪:৪
জি-৩০ ইসলামে বিয়ে সংক্রান্ত আইন-৪ (বিয়ে চুক্তি)
প্রশ্নঃ
১. বিয়ে চুক্তির সময় যদি মোহরানার অংক নির্ধারিত না হয়ে থাকে তাহলে কি বিয়ে বাতিল হয়ে যায়?
২. মোহরানা নির্ধারিত হবার পর বিয়ের সময় যদি তা পুরোপুরি আদায় করা না হয় তাহলে কি হবে?
৩. আইনের দৃষ্টিতে কখন মোহরানা পাওনা হবে?
৪. যদি স্বামী-স্ত্রীর দৈহিক মিলনের আগেই তালাক হয়, তাহলে কি স্ত্রী মোহরানার টাকা পাবে?
৫. মোহরানা ছাড়া অন্যান্য শর্তও কি বিয়ে চুক্তিতে অন্তর্ভুক্ত রাখা যায়?
৬. যদি কনে বিয়েতে এমন শর্ত রাখতে চায়, যেমন বিয়ের পর স্বামীকে নির্দিষ্ট এলাকায় অবস্থান করতে হবে, এমন শর্ত কি রাখতে পারবে?
৭. ন্যূনতম আইনানুগ আনুষ্ঠানিকতা ছাড়া বিয়েতে পালনযোগ্য আর কোন আনুষ্ঠানিকতা আছে কি?
৮. এক সময় ইসলাম অস্থায়ী বিয়ে অনুমোদিত করেছিল। তেমন বিয়ে কি এখনও অনুমোদিত?
উত্তরঃ
১. মোহরানার অংক বিয়ে চুক্তিতে নির্ধারিত না থাকলে
ইসলামী আইনবিদরা একমত যে, বিয়ের সময় মোহরানার পরিমাণ নির্ধারিত না থাকলে বিয়ে বাতিল হয় না। তবে ভবিষ্যৎ ভুল বুঝাবুঝি এড়াবার জন্য বিয়ে চুক্তি স্বাক্ষরের সময়ই তা নির্ধারণ করে রাখা উচিৎ। যদিও ইসলাম মতে দু’জন সাক্ষী থাকলে চুক্তি লিখিত না হলেও চলে তবে লিখিত চুক্তিই উত্তম। বিয়ে চুক্তির সময় মোহরানা নির্ধারিত না থাকলে এবং পরে এই নিয়ে বিতর্ক হলে ইসলামী আইনে ‘মোহর আল মিসলি’র সুযোগ আছে, যা অনুযায়ী বিচারক মেয়ের আর্থ-সামাজিক ও শিক্ষাগত অবস্থান অনুযায়ী মোহরানার অংক নির্ধারিত করে দেবেন। এই বিচারকের রায় উভয়ে মানতে হবে।
২. বিয়ের সময় মোহরানার অর্থ পুরোপুরি না দেয়া হলে
ইসলামী আইনমতে বিয়ের সময় মোহরানা পুরো অর্থ না দেয়া হলে বিয়ে ভাঙবে। ইসলামী আইন এ ব্যাপারে শিথিল করা হয়েছে বিয়ের অনুষ্ঠানকে সফল ও সহজ করার জন্য। কাজেই মোহরানা বিয়ের সময় পুরোপুরি বা আংশিক দেয়া যেতে পারে এমনকি পুরোটাই বকেয়া থাকতে পারে। মোহরানার অনাদায়কৃত অংশকে ‘মুয়াজ্জিল’ বলা হয়। তবে স্বামী স্ত্রীর দৈহিক মিলনের পূর্বেই মোহরানা পুরোপুরি বা আংশিক দেয়া উত্তম। এটা প্রতিশ্রুতি এবং আন্তরিকতার বহিঃপ্রকাশ।
৩. পুরো মোহরানা কখন পাওনা হবে
তিন ক্ষেত্রে পুরো অর্থ আইনগত পাওনা হয়ঃ
ক. স্বামী স্ত্রীর মিলনের পর পুরো মোহরানাই স্ত্রীর পাওনা হয়ে যায়।
খ. স্বামী স্ত্রীর মিলনের পূর্বে যে কেউ মারা গেলে পুরো মোহরানা পাওনা হয়।
গ. বিয়ের পর স্বামী স্ত্রীর মিলন না হলেও তারা যদি একান্তে বসবাস করে যাতে সামাজিক ভাবে মনে হয় স্বামী স্ত্রীর মিলন হয়েছে, তাহলেও স্ত্রী পুরো মোহরানা পাওনা হবে।
৪. স্বামী স্ত্রীর মিলনের পূর্বে তালাক হলে মোহরানা প্রসঙ্গে
ইসলামী আইন মহিলাদের প্রতি অত্যন্ত সহানুভূতিশীল এবং কোন বিবেকবর্জিত মানুষ যেন তাদের প্রতারিত বা বঞ্চিত করতে না পারে সে ব্যাপারে সজাগ। যদি বিয়ের পর দৈহিক মিলনের আগেই তালাক হয় তাহলেও স্ত্রী মোহরানার অর্ধেক অর্থ পাবে। মোহরানার পরিমাণ নির্ধারিত না থাকলে কুরআন অনুসারে স্বামী ‘মুতা’ বা ক্ষতিপূরণ বাবদ অর্থ প্রদানে (consolation gift) বাধ্য থাকবে। অবশ্য যদি মেয়ে পক্ষ কর্তৃক কোন মিথ্যা তথ্যের ভিত্তিতে অথবা কোন সত্য গোপন করে বিয়ে দেয়া হয় এবং সেজন্য বিয়ে ভাঙ্গে তবে স্ত্রী কোন মোহরানা পাবে না।
৫. মোহরানা ছাড়া বিয়ে চুক্তিতে আর শর্ত রাখা যাবে কি?
ইসলামী আইনে মোহরানা ছাড়াও স্বামী বা স্ত্রী যে কেউ বিয়ে চুক্তিতে অন্য যে কোন বৈধ ও পারস্পারিক সম্মতিতে করা আইনানুগ শর্ত রাখতে পারেন। রাসূল (সাঃ) বলেন, এমন শর্ত পালনে উভয়েই বাধ্য থাকবে। কারণ চুক্তি মেনে চলা মুসলমানদের দায়িত্ব। উপরন্তু এটা এমন মহৎ চুক্তি যা একজন মানুষকে আরেক জনের জন্য বৈধ করে। তবে শর্ত আরোপের সময় খেয়াল রাখতে হবে তা যেন আল্লাহ স্বীকৃত কোন বৈধ অধিকারকে অবৈধ বা অবৈধ অধিকারকে বৈধ না করে।
৬. এমন শর্ত দেয়া যাবে কিনা যা স্বামীকে নির্দিষ্ট স্থানের বাইরে যেতে বারণ করবে
এ বিষয়ে ইসলামী আইনবিদরা দু’ধরনের মত ব্যক্ত করেন। শাফায়ী এবং হানাফীরা বলেন যে এমন শর্ত দেয়া যাবে না যা মানুষের বৈধ/হালালভাবে স্বাধীন চলাফেরার অধিকার কেড়ে নেয়। অন্য আইনবিদরা যেমন ইমাম হানবালী বলেন যে, যে স্বামী বিয়ের এমন শর্ত মেনে নেয় তবে সে তা পালন করতে বাধ্য। তারা বলেন এর ফলে স্বামী কেবল একটি বিষয় অর্থাৎ নির্দিষ্ট দেশ বা স্থান ছেড়ে চলে যেতে পারবে না।
৭. আইনগত আনুষ্ঠানিকতার বাইরে বিয়েতে অনুমোদিত অনুষ্ঠানাদি
ক. বিয়ের আনুষ্ঠানিকতায় এমন একজনকে উপস্থিত রাখা ভাল যিনি আল্লাহ ও রাসূলের প্রশংসার পর বর-কনে ও সবার উদ্দেশ্যে কুরআন-হাদিসের আলোকে বিয়ের উদ্দেশ্য, দায়িত্ব ও গুরুত্ব আলোচনা করবেন।
খ. সাক্ষীর উপস্থিতিতে বর কর্তৃক বিয়ের প্রস্তাব ও কন্যার প্রস্তাব কবুল করা আনুষ্ঠানিকভাবে হওয়া উচিৎ।
গ. বিয়ে চুক্তি স্বাক্ষরের পর বিয়ে পরিচালনাকারী ব্যক্তি বিবাহিতদের সাফল্য কামনা করে সবাইকে নিয়ে দোয়া করতে পারেন এবং বর-কনেকে মোবারকবাদ জানাতে পারেন এই বলে যে, বারাকাল্লাহ ফিকুম (আল্লাহর সন্তুষ্টি আপনাদের জন্যে হোক)।
ঘ. বিয়ের দিন অথবা তার পর বর তার আত্মীয় ও বন্ধু বান্ধবদের ডেকে আপ্যায়ন করাবে (যার নাম ওয়ালিমা)। এই অনুষ্ঠান হওয়া উচিত ইসলামের নৈতিক সীমার মধ্যে এবং সেখানে গরীব ও মিসকীনরাও আমন্ত্রিত থাকবে।
৮. অস্থায়ী বিয়ে
মদ্যপানের নিষেধাজ্ঞা যেমন ধাপে ধাপে করা হয়েছে, সেই রকমই ইসলাম-পূর্ব আরবের বিশৃঙ্খলা ও বাছ বিচারহীন জীবনকে কিছু সময় সহ্য করতে হয়েছে, ততক্ষন পর্যন্ত যতক্ষণ না ইসলামের সংস্কার প্রতিষ্ঠিত করা গেছে। নবী (সাঃ) পুরুষদের জন্যে অস্থায়ী বিয়ে বহাল রেখেছেন যারা বড় সময়ের জন্যে (এক রাত নয়, কয়েক মাস) ঘরের বাইরে থাকে (যুদ্ধের প্রয়োজনে)- যাতে তারা নিজেদেরকে ব্যভিচার থেকে দূরে রাখতে পারে। সাধারণ বিয়ের মতই শর্ত এ বিয়েতে থাকত; কেবল এ বিয়ে চিরস্থায়ী সম্পর্কের জন্য করা হত না। যত সময় যেতে থাকল, মুসলমানরা ঈমানে দৃঢ় হল, তখন মদ্যপান নিষিদ্ধ করার মতই এরকম অস্থায়ী বিয়ের প্রচলন পুরোপুরি নিষিদ্ধ করা হয়। অস্থায়ী বিয়ে নিষিদ্ধ কারণঃ
ক. ইসলামে কুরআন অনুযায়ী বিয়ের এক উদ্দেশ্য হচ্ছে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা; এবং
খ. রাসূল (সঃ) ‘শেষ বিচারের দিন পর্যন্ত’ এরকম বিয়ে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন।
সূত্র নির্দেশিকাঃ
প্রশ্ন-৪: আল কুরআন ২:২৩৬-২৩৭
প্রশ্ন-৫: আল কুরআন ৫:১
বেআইনী শর্তের উদাহরণ হচ্ছে, যেমন কোন মহিলা যদি কোন পুরুষকে এই শর্ত দেয় যে, “আমি তোমাকে বিয়ে করব যদি তুমি তোমার প্রথম স্ত্রীকে তালাক দাও।” রাসূল (সঃ) নির্দিষ্টভাবে বলেছেন যে, কোন পুরুষ প্রথম স্ত্রীকে বাদ দিয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করতে পারবে না।
প্রশ্ন-৭: বিয়ের কথা বহুল প্রচারের জন্য রাসূল (সঃ) বলতেন বিয়ের অনুষ্ঠান মসজিদে করার জন্য। রাসূল (সঃ) বলতেন যে সবচেয়ে জঘন্য আয়োজন হচ্ছে সেটা যেখানে শুধু ধনীদের দাওয়াত দেয়া এবং গরীবদের অবজ্ঞা করা হয়।
প্রশ্ন-৮: আল কুরআন ১৬:৭২, ৩১:২১
জি-৩১. বহুবিবাহ ও ইসলাম-১ (ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত)
প্রশ্নঃ
১. বহু বিবাহ কি?
২. আদর্শ মুসলিম কি একাধিক স্ত্রী সম্পন্ন?
৩. বহুবিবাহের ঐতিহাসিক ভিত্তি কি? প্রাচীন সভ্যতা সমূহে এটা কিভাবে চালু ছিল?
৪. বহু বিবাহ সম্পর্কে ইহুদী সভ্যতায় কি দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়?
৫. ইহুদী জনগণের মাঝে বহুবিবাহের চর্চা কেমন ছিল?
৬. এটা কি বলা যায় যে খ্রীস্টবাদ সবসময় বহুবিবাহের বিরুদ্ধে ছিল?
৭. এমন কোন ঐতিহাসিক উদাহরণ আছে কি যাতে দেখা যায় যে চার্চ বহুবিবাহের অনুমতি দিয়েছে?
উত্তরঃ
১. বহুবিবাহ
সাধারণতঃ ‘বহুবিবাহ’ বলতে একই স্বামীর একসাথে একাধিক স্ত্রী রাখাকে বুঝায়। অবশ্য দু’একটি প্রাচীন সমাজে একই স্ত্রীর একসাথে একাধিক ঘর করার নজিরও দেখা যায়। তবে তা ইসলামসহ সব একেশ্বরবাদী ধর্মেই নিষেধ।
২. আদর্শ মুসলিম পরিবার
যদিও ইসলামে বহুবিবাহ নিষেধ করা হয়নি তবুও আদর্শ মুসলিম পরিবার বলতে এক স্বামী এক স্ত্রীর পরিবারকেই বুঝায়। ইসলামে এটা কেবল অনুমোদিত একটা বিষয়। ইসলাম বহুবিবাহের সুচনা করেনি। অতি প্রাচীনকাল থেকেই এর প্রথা চলে এসেছে। ইহুদীদের মাঝেও এই প্রথা ছিল। খ্রিস্টানরাও এর ঊর্ধ্বে নয়। বরং ইসলামই বহুবিবাহ সম্পর্কে খোলাখুলি সরল্ভাবে আলোচনা করেছে এবং এর উপর কিছু নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে।
৩. বহুবিবাহের ঐতিহাসিক ভিত্তি
সমাজবিদ এবং ঐতিহাসিকগণ দেখিয়েছেন যে, মিসর, পারসা, ভারত, ইউরোপ, প্রাচীন আরব ও শ্লাভ সভ্যতাসহ প্রায় সকল প্রাচীন সভ্যতায় বহুবিবাহের প্রচলন ছিল। এমনকি যেসব সমাজে বহুবিবাহ নিষিদ্ধ ছিল সেখানেও যারা চাইত তাদের জন্য বহুগামীতার ব্যবস্থা ছিল। যেমন ‘কোড অব হামুরাবি’ টে যদিও এক স্ত্রীকে নিয়ে সংসার করার নিয়ম ছিল কিন্তূ সেখানেও উপপত্নী রাখবার ব্যবস্থা ছিল। একইভাবে গ্রীক-রোমান সভ্যতায়ও একক স্ত্রী বিশিষ্ট পরিবার দেখা গেলেও বহুগামীতা ছিল খোলামেলা বিষয়।
৪. বহুবিবাহ ও ইহুদী সভ্যতা
যদিও সাধারণভাবে মনে করা হয় ইহুদী-খ্রীস্টান আইন বহু বিবাহ প্রথার বিরুদ্ধে কিন্তূ বাস্তবে তা সত্য নয়। ওল্ড টেস্টামেন্টে দেখা যায় যে বহু নারী, রাজ্য এবং বিচারকের একাধিক স্ত্রী ছিল এবং কোথাও এটাকে নিষিদ্ধ বা অনৈতিক বলা বা ইঙ্গিত দেয়া হয়নি। যেমন গিডিয়ন (Gideon)-এর অসংখ্য স্ত্রী ছিল এবং ওল্ড টেস্টামেন্ট বলে যে তার চরিত্র এত পবিত্র ছিল যে, স্বয়ং খোদার জ্যোতি তার উপর চলে আসত। আবাদন (Abandon) যিনি আট বছর ইসরাইল শাসন করেছেন তার চল্লিশজন পুত্র ছিল এবং অবশ্যই একাধিক স্ত্রী ছিল। ডেভিড এর একশ স্ত্রী ছিল, Rehoboan-এর ১৮ জন স্ত্রী এবং তিনশত উপপত্নী ছিল এবং আব্রাহাম যাকে একত্ববাদীদের পিতা বলা হয় তারও দু’জন স্ত্রী ছিল।
৫. ইহুদী জনগণের মাঝে বহুবিবাহের চর্চা
প্রখ্যাত সমাজবিদ এডওয়ার্ড ওয়েস্ট-মার্ক তার ‘Short History of Marriage’s-এর তৃতীয় খণ্ডে (১৯২৬ সালে প্রকাশিত) বলেন,
“ইউরোপীয় ইহুদীদের মধ্যে মধ্যযুগ পর্যন্ত বহুবিবাহের চর্চা ছিল এবং আরব বিশ্বের ইহুদীদের মধ্যে আজও এই চর্চা আছে। প্রথমতঃ জার্মান এবং ফ্রান্সে এর বিরুদ্ধে প্রচারনা শুরু হয় দ্বাদশ শতকে, যার ফলশ্রুতিতে ইউরোপে ইহুদীদের মাঝে বহুবিবাহ বন্ধ হয়। তবুও ইহুদী বিবাহ আইনে বহু বিবাহের অনেক পথ রয়েছে যা বহুবিবাহ যখন অনুমোদিত ছিল, তা থেকে উৎসারিত।”
যারা বলেন যে যেসব ইহুদী, মুসলিম সমাজের সংস্পর্শে এসেছে, তারা মুসলমানদের দেখে বহুবিবাহ করেছে, তারা ঠিক বলেন না। কারণ ইসলাম তার আইন কখনই অমুসলিমদের উপর চাপায়নি। মুসলিম এলাকায় বাসরত ইহুদীরা তাদের বহুবিবাহের চর্চা বন্ধ করতে চাইলে যে কোন সময় আইন করে বন্ধ করতে পারত। অবাক হবার কথা হচ্ছে যে, যখন ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে, তখন কিছু ইয়েমেনী ইহুদী দুই বা ততোধিক স্ত্রীসহ ইসরাইলে আগমন করে।
৬. খ্রীস্টবাদ ও বহু বিবাহ
এটা বহুল প্রচলিত ধারণা যে খ্রীস্টবাদ কঠোরভাবে বহুবিবাহের বিরোধী। কিন্তূ এই ধারণার পক্ষে তাদের ধর্মগ্রন্থে কোন দলিল পাওয়া যায় না, যদিও এক স্ত্রী নিয়ে সংসার করা উত্তম-এমন কথা দেখা যায়; কিন্তূ বহুবিবাহ নিষিদ্ধ এমন কোন আদেশ নেই। ওল্ড টেস্টামেন্ট খ্রীস্টান ঐতিহ্যের অংশ, তাতে দেখা যায় যীশু (আঃ) বলেন, “আমি আমার পূর্ববর্তী নবীদের আইন ধ্বংস করতে আসিনি বরং তাকে পূর্ণতা দিতে এসেছি।” কাজেই আগের নবীদের আমলে বহুবিবাহের চর্চা ইহুদীদের তুলনায় কম হবার সম্ভাব্য কয়েকটি কারণ হচ্ছেঃ
ক. প্রাথমিক জুগের খ্রীস্টান যাজকরা এবং সাধারণভাবে সকল খ্রীস্টান বিয়ে ও যৌন সম্পর্কের উপর তীব্র ঘৃণাবোধে ভুগতেন। বিয়েকে তারা শয়তানী কাজ বলে মনে করতেন।
খ. প্রাথমিক যুগের খ্রীস্টানদের মাঝে আত্নাকে পরিশুদ্ধির (Soul-Saving) চেষ্টায় প্রাধান্য দেখা যায়।
গ. খ্রীস্টবাদ প্রথমে গ্রীক-রোমান সভ্যতার এলাকাতে বিস্তার লাভ করে যাদের মধ্যে এক স্ত্রী নিয়ে সংসার করা চালু ছিল।
ঘ. ওয়েস্ট মার্কের মতে, প্রাথমিকভাবে খ্রীস্টবাদ গরীবদের মাঝেই প্রসার লাভ করে যাদের একাধিক একাধিক বিয়ের সামর্থ্য ছিল না।
৭. খ্রীস্টবাদে বহুবিবাহ অনুমোদনের ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত
এডওয়ার্ড ওয়েস্টার্ন মার্ক তাঁর ‘History of Human Marriage’ গ্রন্থে বলেন, ‘যদিও গ্রীক রোমান সমাজে এক বিবাহেই একমাত্র বৈধ ব্যবস্থা ছিল তবুও একথা বলা যাবেনা যে খ্রীস্টানদের জন্য বহুবিবাহ একেবারে নিষিদ্ধ ছিল’….. এবং যদিও নিউ টেস্টামেন্টে এক বিয়েকেই আদর্শ এবং স্বাভাবিক বলা হয়েছে, তবুও বহু বিবাহকে নিষেধ করে কিছু বলা হয়নি; ব্যতিক্রম শুধু বিশপ বা ডিকন (Deacon)-র ক্ষেত্রে। “(চার্চের) ফাদাররা ইহুদী রাব্বীদের ভোগবাসনা (Sensuality)-র জন্যে অভিযুক্ত করলেও চার্চ কাউন্সিল থেকে বহুবিবাহের বিপক্ষে কিছু বলা হয়নি এবং সেইসব সমাজের রাজারা প্রকৃতিপূজারী যুগের মতই অনেক স্ত্রী রাখার ক্ষেত্রে কোন বাধার সম্মুখীন হননি।”
এরকম সম্প্রতি কয়েকটি উদাহরন হচ্ছেঃ
ক. সপ্তম শতকে মাঝামাঝি আয়ারল্যান্ডের আরমাইক রাজার দু’জন রানী এবং দু’জন উপপত্নী ছিল।
খ. চার্লস দ্য গ্রেট-এর দুই স্ত্রী এবং অসংখ্য উপপত্নী ছিল এবং তার এক আইনে দেখা যায় যে যাজকরা বহুবিবাহ সম্পর্কে জানতেন।
গ. প্রুশিয়ার রাজা উইলিয়াম-২ এবং হেস-এর ফিলিপ একাধিক বিয়ে করেন যাজক মার্টিন লুথারের অনুমতি নিয়ে। মার্টিন লুথার বলেন যে, ‘খোদা এটা নিষেধ করেননি।’
ঘ. এনাব্যাপটিস্ট এবং মরমনস সহ কয়েকটি খ্রীস্টান সম্প্রদায় বহুবিবাহ সমর্থন করে।
ঙ. ত্রিশ বছর ব্যাপী যুদ্ধের অবসানের পর (১৬৫০ সালে) নুরেমবার্গে আইন পাশ হয় যে প্রত্যেক পুরুষ দু’জন নারী বিয়ে করতে পারবে।
সূত্র নির্দেশিকাঃ
প্রশ্ন-৫: J.Hastings সম্পাদিত ‘The Dictionary of the Bible’- এ বলা হয়েছে, “বহুবিবাহ একটি বাস্তবতা কারণ আব্রাহাম, জেকব, ডেভিড, সলোমন এ চর্চা করেছেন।”
Deut Ch.17.17-এ রাজাদের সতর্ক করে দেয়া হয় ১৮ এর বেশী বিয়ে না করতে এবং সাধারনের জন্য এ সংখ্যা চার।
প্রশ্ন-৬: আদম এবং হাওয়া (আঃ)-কে এক স্বামী-স্ত্রী দম্পত্তি হিসেবে দেখা যায় আর আল্লাহ নারী-পুরুষকে জোড়ায় জোড়ায় বানিয়েছেন।
“Short History of Marriage.” Vol.iii.Edward Weston-Mark.1926.
“History of Human Marriage.”Edward Weston-Mark.1925.
“The dictionary of the Bible, J.Hasting সম্পাদিত, ১৯৬৩ (পৃষ্ঠা ৬২৪)
জি-৩২ বহুবিবাহ ও ইসলাম-২ (ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত)
প্রশ্নঃ
১. মরমন (Mormon) সম্প্রদায়ভুক্ত খ্রীস্টানরা কি বহুবিবাহ অব্যাহত রেখেছিল?
২. সমগ্র ইতিহাস জুড়ে বিভিন্ন সভ্যতায় ও জাতিতে বহুবিবাহ প্রথা চালু থাকার কারণ কি?
৩. এতে কি বলা যায় যে ইসলাম বহুবিবাহ চালু কারেনি, এটাকে শুধুমাত্র স্বীকৃতি দিয়েছে।
৪. কুরআনে বহুবিবাহের অনুমতি সূচক কোন উদ্ধৃতি আছে কি?
৫. ৪নং সূরার ৩ নং আয়াতের পটভূমি ও ব্যাখা কি?
৬. বহুবিবাহের ক্ষেত্রে সমব্যবহারের অর্থ কি?
উত্তরঃ
১. মরমন সম্প্রদায়ভুক্ত খ্রীস্টানদের বহুবিবাহ
১৮৪৭ সালে মরমনরা তাদের প্রতিশ্রুত ভুমিতে (Promised Land of Utah) বসবাস শুরু করে এবং ব্যাপকভাবে বহুবিবাহের প্রসার ঘটায়। ব্রিগাম ইয়াং-এর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত মরমন চার্চ বহুবিবাহকে অধ্যাত্নিক বিধান হিসেবে প্রচার করত। ১৮৯০ সালে ফেডারেল সরকার বহুবিবাহকে নিষেধ করলেও মরমনদের মাঝে এই চর্চা অব্যাহত থাকে যতক্ষণ পর্যন্ত না সরকার কর্তৃক তাদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত হয়। তাদের সম্পদে ভাটা পড়ায় মরমন চার্চের প্রেসিডেন্ট উইলসন উডরাফ বহুবিবাহ বন্ধ করে বলেন যে, এটাও আধ্যাত্নিক আদেশ। এবং এ আধ্যাত্নিক আদেশ আসে চার্চের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার পর! ১৯৬৭ সালে সাময়িকী ‘Journal’-এ (June সংখ্যা) বেন মারকন প্রতিবেদন দেন যে, তখনও অন্ততঃ ত্রিশহাজার মরমন পরিবারে একাধিক স্ত্রী ছিল।
২. বহুবিবাহ প্রথার কারণ
সমাজ বিজ্ঞানী হামুদাহ আবদ আল-আতি সহ অনেকেই মত প্রকাশ করেন যে বহুবিবাহ কোন সমাজ বিরোধী বা অবিবেচক কাজ ছিল না বরং এক জটিল বহুমাত্রিক প্রক্রিয়া যার বিভিন্ন কারণ রয়েছে। তাঁর রচিত ‘ The Family Structure in Islam’ গ্রন্থে তিনি এর কয়েকটি সম্ভাব্য কারণ চিন্হিত করেছেন। যথাঃ
ব্যক্তিগত
ক. কোন বিবাহিত মানুষ অপর মহিলার প্রতি এতটা আকৃষ্ট হয়ে পড়ল যে তাকে বিয়ে করতে চাইল।
খ. প্রথম স্ত্রীর এমন শারীরিক বা অন্য সমস্যা দেখা দিল যে সে স্বামীর দৈহিক চাহিদা পূরণে অক্ষম হল।
গ. সাংস্কৃতিক কারণ, যেমন প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিদের একাধিক স্ত্রী রাখার রীতি অন্য ব্যক্তিদের বহুবিবাহের দিকে প্রভাবিত করতে পারে।
ঘ. কোন কোন সমাজে গরীব লোকের প্রথম বা একমাত্র স্ত্রী হবার চেয়ে ধনী ব্যক্তির দ্বিতীয় বা তৃতীয় স্ত্রী হতে চাইত।
১. জনসংখ্যাগত
ক. পুরুষের তুলনায় নারীর সংখ্যা সাম্য ব্যাহত হলে সেসব সমাজে অনেক নারীর বিয়ে না হতে পারে এবং এক্ষেত্রে বহুবিবাহকে তারা উত্তম বিকল্প পথে মনে করতে পারে। (যুদ্ধ বা অন্য কারণে এ রকম অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে-অনুবাদক)
জৈবিকঃ
ক) পুরুষের যৌন প্রকৃতি তুলনামুলকভাবে বহুবিবাহের দিকে বেশি।
২. সামাজিক
ক. কোন কোন সমাজে বহুবিবাহের মাধ্যমে বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে ঐক্য ও সমঝোতা হয়।
খ. কোন কোন ক্ষেত্রে দ্বিতীয় বা তৃতীয় স্ত্রীর বাড়ির কাজে প্রথম স্ত্রীর জন্য সহায়ক হয়।
গ. যে সব সমাজে শিশু মৃত্যুর হার বেশী তাদের মাঝেও বহু বিবাহের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়।
আবদ আল-আতি বলেন, ‘এসব কারণ পরস্পরে যুক্ত হয়ে অন্যান্য সামাজিক ফ্যাক্টর যেমন-ঐতিহ্য, নৈতিকতা, রীতি ও আইন ইত্যাদির’ সাথে মিশে বহুবিবাহকে বাস্তবতা দিয়েছে। (পৃষ্ঠা-১১)
৩. ইসলাম কি বহুবিবাহকে অনুমতি দিয়েছে
ইসলাম বহুবিবাহ প্রথা উদ্ভাবন বা চালু করেনি। এটা আগে থেকেই চালু ছিল বরং ইসলামই একমাত্র তৌহিদবাদী ধর্ম যা বহুবিবাহকে কিছু কঠোর শর্ত আরোপ করে সীমাবদ্ধ করেছে। ইসলামে এটা কোন অত্যাবশ্যকীয় বা নির্দেশিত কাজ নয় শুধু বিশেষ কিছু অবস্থার প্রেক্ষিতে সুযোগ মাত্র।
এখানে আর একটা কথা বলা প্রয়োজন যে, ইসলামে অনুমোদিত অনেক কাজও ইসলামের অন্য আইন ভংগ হবার প্রেক্ষিতে অনুমোদিত হতে যেতে পারে। যেমন কেউ যদি এই মতলবে দ্বিতীয় বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয় যে প্রথম স্ত্রীর সাথে সুব্যবহার করবে না তবে তার জন্য দ্বিতীয় বিয়ে অনুমোদিত নয়। (কারণ এখানে অবিচার সম্পৃক্ত) যদিও নীতিগতভাবে বহুবিবাহ অনুমোদিত। (পাঠকদের সর্বদা এসব মৌলিক নীতিমালার আলোকে ইসলামের নীতির বিচার করতে হবে-অনুবাদক)
৪. বহুবিবাহ প্রসঙ্গে কুরআন
বহুবিবাহ প্রসঙ্গ কুরআনের ৪ নং সূরার ৩ নং আয়াতে এসেছে যা থেকে দেখা যায়ঃ
ক. বহুবিবাহ মুসলমানের জন্য ‘আবশ্যক’ কিছু নয়।
খ. একের অধিক বিয়ে শর্তযুক্ত (Conditional)।
গ. সর্বোচ্চ চারজন স্ত্রী বিয়ে করার সীমা নির্ধারিত হয়েছে, যদিও এর আগে এর কোন সীমা ছিল না।
ঘ. উক্ত আয়াতে এক বিশেষ অবস্থার প্রেক্ষিতেই একাধিক বিয়ের কথা বলা হয়েছেঃ
কোন মুসলমানের তত্ত্বাবধানে থাকা এতিমের সাথে যথাযথ ব্যবহার প্রসঙ্গে।
৫. উক্ত আয়াত নাযিলের প্রেক্ষিত ও ব্যাখ্যা
হযরত আয়েশা উক্ত আয়াত নাযিলের পটভূমি প্রসঙ্গে বলেন যে, কয়েকজন এতিম বালিকার তত্ত্বাবধায়ক এক পুরুষকে নির্দেশনা দিতেই উক্ত আয়াত নাযিল হয়। এ আয়াতটি নাযিল হয় ওহুদ যুদ্ধের পরক্ষনেই। ওহুদ যুদ্ধে অনেক মুসলমান শহীদ হন। তাঁদের স্ত্রী, ছেলে-মেয়েরা অভিভাবকহীন হয়ে পড়ে। তাদের খাদ্য, আশ্রয় ছাড়া পারিবারিক পরিবেশে থাকাও জরুরি ছিল। এবং এ কারণে তাদেরকে বিভিন্ন অভিভাবকের নিকট রাখা হল। এমনি কয়েক এতিম বালিকার তত্ত্বাবধায়ক পুরুষ একটি বালিকাকে তাঁর প্রাপ্য মোহরানার চেয়ে কম দিয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করতে চাইল। এই আয়াতে মুসলমানদের সাবধান করে বলল, এতিমের প্রতি ন্যায়বান থাকতে এবং ন্যায্য মোহরানা দিতে না পারলে তাদের বিয়ে না করতে। সর্বোচ্চ চার বিয়ে করার অনুমোদন দেয়া হয়। প্রখ্যাত একজন তাফসীকারক তাঁর ‘আল কাশফ আল তাফসীর’ গ্রন্থে বলেন যারা সন্দিহান যে আরেক বিয়ে না করলে তার দ্বারা ব্যভিচার সংগঠিত হতে পারে তাদের জন্যই এ সুযোগ রাখা হয়েছে। কুরআনের কঠোরভাবে সতর্ক করা যে, এতিমদের সাথে অবিচার না করা এবং অন্যদিকে ব্যভিচারের বিষয়ে ইসলামের শক্ত অবস্থান একজন সত্যিকার মুসলমানকে ভীত করে দেয় এবং তখন বহুবিবাহ এ দু’টির মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করেছিল।
অবশ্য এই আয়াতে এটাও সতর্ক করা হয়েছে যে, যারা দ্বিতীয় বিয়ে করতে চায় তাদের অবশ্যই উভয় স্ত্রীর সাথে সমব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
৬. স্ত্রীদের সাথে সমব্যবহার এর অর্থ
স্ত্রীদের সাথে সমব্যবহার বহুবিবাহের ‘অত্যাবশ্যকীয় পূর্বশর্ত’। এছাড়া দ্বিতীয় বিয়ের আশা করা অবান্তর। রাসুল (সঃ) বলেন যে, “যে ব্যক্তি দুই স্ত্রীর একজনের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করবেন, সে হাশরের ময়দানে শরীরের এক অংশ নীচু অবস্থায় হাযির হবে।”-এটি একটি সংকেত যে ঐ ব্যক্তি অসাম্য ব্যবহারের জন্য ‘চিন্হিত’ ব্যক্তি হিসেবে উপস্থিত হবে হাশরের ময়দানে। যে ব্যক্তি একাধিক বিয়ের চিন্তা করে তার এ দৃঢ়তা ও আস্থা থাকতে হবে যে, সে ‘মানুষের পক্ষে সম্ভাব্য সর্বোচ্চ পর্যায়ে সুবিচার করতে পারবে। সমব্যবহার বলতে বুঝায় সকল স্ত্রীকে এক মানের খাবার, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, বিনোদন, সময় এবং সহানুভূতি দিতে হবে। শুধু এক ক্ষেত্রেই হয়ত সমান থাকা যাবে না তা হচ্ছে ভালবাসা ও আবেগ। এ ব্যাপারে স্বয়ং রাসুল (সঃ) আল্লাহর কাছে পানাহ চেয়েছেন-এভাবে, “হে আল্লাহ! এটাই আমার পক্ষে অপক্ষপাতিত্ব(বা বিভাজন) যা আমার নিয়ন্ত্রনে। অতএব আমাকে তুমি পাপী করোনা যা তোমার নিয়ন্ত্রনে।
সূত্র নির্দেশিকাঃ
প্রশ্ন-২: ‘The Family Structure of Islam,’ Hamudah Abd Al Ati.
‘Sokomo Law and Custom..’ H.Cory, New York.1953.
‘In the Heart of the Bantuland’. D.Campbell, London,1922
প্রশ্ন-৪: আল কুরআন ৪:৩
প্রশ্ন-৫: আল কাশাফ তাফসীর, আসগার মাকশারী।
প্রশ্ন-৬: আল কুরআন ৪:১২৯
জি-৩৩ বহুবিবাহ ও ইসলাম-৩ (কেন অনুমোদিত)
প্রশ্নঃ
১. কেউ কেউ বলে যে, ইসলাম বহুবিবাহ নিষিদ্ধ করেছে এবং এ ব্যাপারে কুরআনের উদ্ধৃতি দেয়-এ বিষয়ে মন্তব্য করুন।
২. চারজন স্ত্রী-এই সংখ্যা নির্ধারণের কারণ কি?
৩. ইসলামের মৌলিক শিক্ষা যদি এক বিবাহই হয় তবে বহুবিবাহের অনুমতি দেয়া হল কেন?
৪. বহুবিবাহের অনুমতি দেবার সামাজিক কারণগুলো কি?
উত্তরঃ
১. কুরআনে বহুবিবাহ নিষিদ্ধ হওয়া প্রসঙ্গে
যদিও চতুর্থ সূরার (নিসা) ৩ নং আয়াতে বহুবিবাহের সুযোগ রয়েছে তবুও সব স্ত্রীর সাথে সমান ব্যবহারের পূর্বশর্ত রাখা হয়েছে। একই সূরার ১২৯ নং আয়াতে বলা হয়েছে, “কিন্তূ তোমরা কখনই সমান ব্যবহার করতে পারবে না…”-এই আয়াত থেকেই অনেকে ব্যাখ্যা করেন যে কুরআনে বহুবিবাহ নিষেধ করা হয়েছে। দু’টি কারণে এই ব্যাখ্যা যুক্তিপূর্ণ নয়-
ক. ৪ নং সূরার ৩ নং আয়াতে এটা স্পষ্ট যে একজন পুরুষ একাধিক বিয়ে করতে পারবে। তাহলে সেই কুরআনেই আবার অন্যত্র এটা নিষিদ্ধ হয় কেমন করে?
খ. এটা ঐতিহাসিক বাস্তবতা যে রাসুল (সঃ) নিজে এবং তার সাহাবীরা একাধিক বিয়ে করেছিলেন। তাহলে এমন কি মনে হওয়া উচিৎ যে তাঁরা কুরআন অমান্য করেছিলেন? এটা নিশ্চিত যে কুরআনে আদল (Justice) সমব্যবহার বহুবিবাহের পূর্বশর্ত হিসেবে রেখেছে। এই ‘সমব্যবহার’ বলতে একই মানের খাবার, পোশাক, বাসস্থান, চিকিৎসা, বিনোদন, সময় প্রদান সহ পার্থিব বিষয়াদিতে সমতার কথাই বলা হয়েছে। আর ১২৯ নং আয়াতে যে সমতা সম্ভব নয় বলা হয়েছে তা মূলতঃ ভালবাসা ও আবেগ প্রসূত আকর্ষণ যাতে সমান বণ্টন মানুষের জন্য কঠিন। কুরআন সমব্যবহারের কথা বলে পুরুষকে সতর্ক করেছে। আরও বলা হয়েছে কেউ যেন প্রথম স্ত্রীর বিনিময়ে (অর্থাৎ তার সুবিধা ও তার প্রতি ভালবাসা বাদ দিয়ে) দ্বিতীয় স্ত্রী না আনে।
২. সর্বোচ্চ সীমা চারজন স্ত্রী হবার কারণ
চারজনের এই সর্বোচ্চ সংখ্যা স্বয়ং সর্বজ্ঞাত, সর্বদ্রষ্টা ন্যায়ের প্রতীক আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা করা। যদি এ সংখ্যা তিন, পাঁচ বা অন্যকোনটিও হত, তবুও কারো না কারো উৎসাহ থাকত কারণ জ্ঞাত হবার। নিম্নে এই সংখ্যা চার হবার সম্ভাব্য কয়েকটি কারণ উল্লেখ করা হল-
ক. এটা বলা হয়ে থাকে যে একজন মেয়ে স্বামী ছাড়া সর্বোচ্চ তিনদিন সুখী থাকতে পারে। যদি একজনের সর্বোচ্চ চার স্ত্রী থাকে এবং সে একদিন পর পর এক একজন স্ত্রীর কাছে থাকে তাহলে প্রতি স্ত্রীর সর্বোচ্চ বিরহকাল হবে তিনদিন।
খ. খুব ধনী ব্যক্তি ছাড়া কারো পক্ষেই চারের অধিক স্ত্রী রাখা সম্ভব নয়। অবশ্য এ দুটি ব্যাখ্যার কোনটাই সন্তোষজনক নাও হতে পারে। যার প্রকৃত ব্যাখ্যা আল্লাহর কাছ। তবে এটা নিশ্চিত যে এই চার সংখ্যা একবিবাহ (Monogamy) এবং বহুগামিতা (Sensuality unlimited Plurality)-এর মাঝে একটি সাম্য এবং যুদ্ধসহ বিভিন্ন কারণে নারী পুরুষের সংখ্যাসাম্য বিপর্যস্ত হলে তার সমাধান। যদি স্বামীর পক্ষে চার এর কম তিন বা দুই স্ত্রী নিয়ে সমস্যার সমাধান হয় তবে আরো ভাল আর এক স্ত্রী নিয়ে সংসার করাতো সর্বোত্তম।
৩. বহুবিবাহের অনুমতি সম্ভাব্য কারণ
কুরআনে বহুবিবাহের অনুমতি প্রদানের কারণ (যা কোন বিশেষ পরিস্থিতিতে সর্বোত্তম সমাধান) আলোচনার পূর্বে কয়েকটি বিষয়ের উপর আলোকপাত করা দরকার। যদিও বহুবিবাহের বিষয়টি অনেকের চোখেই খারাপ লাগে। কিন্তূ এটা মনে রাখা দরকার যে, এই অনুমোদন কোন মানুষের পক্ষ থেকে দেয়া হয়নি। এ সুযোগ আল্লাহর তরফ থেকে সরাসরি ওহীর মাধ্যমে দেয়া হয়েছে, যিনি নারীও নন, পুরুষও নন। কাজেই এর মাধ্যমে পুরুষকে অতিরিক্ত সুবিধা দেয়ার প্রশ্নই উঠে না। এ অনুমতির পেছনে কিছু বাস্তব কারণ আছে। এসব বাস্তবতা উপলদ্ধি করতে হবে আল্লাহ এবং তাঁর জ্ঞানের অসীমত্বের উপর দৃঢ় ঈমান নিয়ে। কারো এমন বললে চলবে না যে, “যতক্ষণ পর্যন্ত বহুবিবাহের অনুমতি যুক্তিসঙ্গত কারণ না জানা যাবে ততক্ষন আমি খোদায় বিশ্বাস করবো না।” আরও মনে রাখা দরকার যে, কুরআন হচ্ছে মানুষের প্রতি আল্লাহর নাযিল করা সর্বশেষ জীবন বিধান। এরপর আর কোন কিতাব আসবে না। কাজেই পরবর্তী সব সমাজ, জাতি ও সময়ের চাহিদা পূরণের মত আইনগত সুযোগ এতে রাখা প্রয়োজন ছিল। যদি শুধুমাত্র সপ্তম শতকের মানুষের চাহিদা পূরণের বিধান এতে থাকত বা শুধুমাত্র আরব বিশ্ব বা কোন নির্দিষ্ট ভৌগলিক এলাকার বা কোন নির্দিষ্ট জাতির সমস্যার সমাধান এতে থাকত, তবে এটা সর্বজনীন বা বিশ্বজনীন হতো না। নির্দিষ্ট কয়েকটি সমস্যার সমাধান এতে থাকলে এটাকে সব সমস্যার সমাধানের নির্দেশক গ্রন্থ বলা হত না। বহুবিবাহের যৌক্তিক কারণ অতীতে ছিল। বর্তমানেও থাকতে পারে এবং ভবিষ্যতেও তৈরী হতে পারে। এই বিভিন্ন সময় ও অবস্থার বাস্তবতা মোকাবেলার জন্যেই ইসলামে এই সুযোগ রাখা হয়েছে।
৪. বহুবিবাহের সম্ভাব্য সামাজিক কারণঃ
ক. কোন কোন সমাজে পুরুষের অনুপাতে নারীর সংখ্যা বেশী থাকতে পারে। ঐ সমাজে যদি বহুবিবাহ নিষিদ্ধ হয় তবে অনেক বিয়ের যোগ্য মেয়ে, বিধবা বা তালাকপ্রাপ্তা স্বামী পাবে না। এমতাবস্থায় এসব মেয়ের সামাজিক জীবন বিপন্ন হতে পারে। তারা বিপথে যেতে পারে।
খ. পৃথিবীর আদি থেকে আজ পর্যন্ত যুদ্ধ জীবনেরই অংশ হিসেবে থেকেছে। সাধারণতঃ পুরুষরাই যুদ্ধে অংশ নিয়েছে এবং প্রচুর সংখায় নিহত হয়েছে। যার ফলশ্রুতিতে সমাজে অনেক বিধবার সৃষ্টি হয়েছে। আবার নারীর অনুপাতে পুরুষের সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর অসংখ্য পুরুষের মৃত্যুর প্রেক্ষিতে খোদ ইউরোপেও বহুবিবাহ প্রথা প্রবর্তনের বিষয়ে গভীরভাবে চিন্তা চলে এই অসাম্যকে নিয়ন্ত্রণ করার নিমিত্তে।
গ. যুদ্ধ ছাড়াও পুরুষরা সাধারণতঃ বিপদজনক কাজে বেশী জড়িত থেকেছে। যেমন, খনি শ্রমিক, নির্মাণ শ্রমিক, শিকার ইত্যাদি কাজে জড়িত পুরুষদের মৃত্যু অনেক মহিলাকে অকালে বিধবা করেছে। যাদের অনেকেরই পুনঃবিবাহ প্রয়োজন ছিল পারিবারিক শান্তির জন্যে।
ঘ. যৌন চাহিদাসম্পন্ন পুরুষ যদি এক স্ত্রীতে সন্তুষ্ট না হয় এমতাবস্থায় তার দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহণের অনুমোদন না থাকলে তার দ্বারা অনৈতিক কাজ হতে পারে। ব্যভিচার এবং বিয়ে বহির্ভূত যৌনাচার শুধু আল্লাহর আইনেরই লংঘন নয় বরং সমাজকেও ধ্বংসের দুয়ারে নিয়ে যায়।
ঙ. কোন কোন সভ্যতায় বহুবিবাহ সামাজিক রীতি। আফ্রিকান কোন কোন সম্প্রদায়ে খোদ চার্চ নব্যখ্রিষ্টানদের একাধিক স্ত্রী রাখার অনুমতি দিয়েছে।
৫. বহু বিবাহের কারণঃ ব্যক্তিগত পর্যায়ে
ধরুন বিশেষ একজন সুখী যুবক যার স্ত্রী এবং দুই সন্তান আছে। আকস্মিকভাবে তার স্ত্রী মারাত্মক অসুখে পরলেন (মানসিক অথবা দৈহিক) অথবা এমন দুর্ঘটনার শিকার হলেন যে স্বামীর সাথে ঘনিষ্ঠ মেলামেশার সামর্থ্য আর থাকল না। এ অবস্থায় ঐ যুবকের সামনে যে কয়েকটি পথ খোলা থাকল তা নিম্নরূপঃ
ক. বাকী জীবনের জন্য সে তার জৈবিক কামনাকে দমন করে রাখতে পারে- যা অনেকের পক্ষেই অসম্ভব।
খ. সে তার স্ত্রীকে রেখে বিয়ে বহির্ভূত যৌনাচারে লিপ্ত হতে পারে- যা অনৈতিক, অসামাজিক।
গ. সে তার স্ত্রীকে তালাক দিয়ে নতুন বিয়ে করতে পারে- যা অমানবিক।
ঘ. সে আর একজন স্ত্রীকে বিয়ে করতে পারে তার প্রথম স্ত্রীর এবং তার ও ছেলেমেয়ের সেবা করতে পারে। বস্তুতঃ এটাই একমাত্র সমাধান যা নৈতিকতা, মানবিকতা ও প্রবৃত্তি এই তিন বিষয়ে সাম্য রক্ষা করে।
সূত্র নির্দেশিকাঃ
প্রশ্ন-১: আল কুরআন ৪:১২৯
প্রশ্ন-৩: ১৯৪৮ সালে মিউনিখে যুদ্ধোত্তর নারীর তুলনায় পুরুষের সংখ্যা হ্রাস পাওয়া সমস্যা সমাধানে আন্তর্জাতিক যুবক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে মুসলমানদের বহুবিবাহ প্রথার প্রস্তাব প্রথমে সমালোচিত হলেও শেষে যুক্তির বিচারে বহুবিবাহকে একটি সমাধান ধরে সম্মেলনের প্রস্তাব হিসেবে গৃহীত হয়। তাছাড়া ১৯৪৯ সালে বন-এর জনগণ বহুবিবাহকে সংবিধানে স্বীকৃত করার দাবী জানায়।
জি- ৩৪ বহুবিবাহ ও ইসলাম-৪ (প্রেক্ষিতঃ স্ত্রীর অধিকার)
প্রশ্নঃ
১. ব্যক্তিগত পর্যায়ে কোন কোন অবস্থায় মানুষের একাধিক বিয়ের প্রয়োজন হতে পারে?
২. দ্বিতীয় স্ত্রী হবার কি কি ঐচ্ছিক বিষয় রয়েছে?
৩. দ্বিতীয় বিবাহে ইচ্ছুক স্বামীর প্রথম স্ত্রীর কি কি সুযোগ থাকে?
৪. যদি বিয়ে চুক্তিতে স্ত্রীর তালাকের অধিকার স্বীকৃত না থাকে তবে প্রথম স্ত্রীর জন্য কোন পথ খোলা থাকে?
৫. যদি বিচারক প্রথম স্ত্রীর তালাকের আবেদন প্রত্যাখ্যান করেন তখনও কি তার কোন সুযোগ থাকে?
৬. স্ত্রী স্বামীকে খোলা তালাক দিলে স্বামী তা মানতে বাধ্য কি না?
৭. একজন মহিলা কেন একাধিক স্বামী রাখতে পারে না?
৮. কোন মহিলার স্বামী গুরুতর অসুস্থ বা বন্ধ্যা হলে সে কি করবে?
উত্তরঃ
১. যেসব কারণে কোন ব্যক্তির বহু বিবাহ প্রয়োজন হতে পারেঃ
ক. বন্ধ্যাত্ব- কারো স্ত্রী সন্তান জন্মদানে অক্ষম হবার পরও যদি তার পিতৃত্বে সখ থাকে তবে তার সামনে যেসব পথ খোলা থাকেঃ
i. পিতৃত্বের সখ ত্যাগ করে ধৈর্য ধরা।
ii. বন্ধ্যা স্ত্রীকে তালাক দিয়ে নতুন বিয়ে করা।
iii. সন্তান পালক নেয়া। অবশ্য পাশ্চাত্যে যেভাবে দত্তক নেয়া হয় ইসলামে সেভাবে দত্তক নেয়ার সুযোগ নেই। তারপরও যদি কারো সন্তান পালন নিয়ে নিঃসন্তান দম্পত্তি সুখে থাকে তবে সেটা তো সবচেয়ে উত্তম।
iv. প্রথম স্ত্রীকে স্বমর্যাদায় রেখে দ্বিতীয় বিয়ে করা।
খ. যদি স্বামীর দৈহিক চাহিদা পূরণে স্ত্রী অক্ষম হয়। (অবশ্য এটা খুব কমই হবার কথা) এক্ষেত্রে স্বামীর জন্য অনৈতিক কোন কাজ করা বা স্ত্রীকে তালাক দেবার চেয়ে আর একটি বিয়ে করাই কি শ্রেয় নয়।
২. দ্বিতীয় স্ত্রী হবার সম্ভাব্য কারণ ও তার অধিকার
ইসলামের বিয়ে সংক্রান্ত আইন যা পূর্বে আলোচিত হয়েছে তা দ্বিতীয় বা যে কোন বিয়ের জন্যই অভিন্ন। দ্বিতীয় বিয়ের বৈধতার জন্যও চুক্তি ও কবুলের শর্ত জড়িত। যদি কোন মহিলা কারো দ্বিতীয় স্ত্রী হতে না চায় এবং তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাকে বিয়ে দেয়া হয়ে থাকে, তবে সে বিয়ে বাতিল বলে গণ্য হবে। যদিও মনে পারে যে কোন মহিলা সতীনের ঘর করতে বা কারো দ্বিতীয় বা তৃতীয় স্ত্রী হতে চাইবেন না তবুও এমন বিয়েও অনেক নারীর জন্য উত্তম বিকল্প হিসেবে নিরাপত্তা ও কল্যান এনে দিতে পারে। যেমন-
ক. একজন বিধবা অথবা তালাকপ্রাপ্তা মহিলা যার দুই তিনটি সন্তান আছেঃ সন্তান ও নিজের জন্য একজন স্বামী তথা পুরুষ অভিভাবক দরকার। এ অবস্থায় কোন অবিবাহিত পুরুষ তাকে বিয়ে করতে এগিয়ে আসার সম্ভাবনা ক্ষীণ। তখন সে অবিবাহিত অবস্থার নিরাপত্তাহীন ও দারিদ্র্যের মধ্যে থাকার চেয়ে কারো ২য় বা ৩য় স্ত্রী হতেও পছন্দ করবে।
খ. যেখানে পুরুষের তুলনায় নারীর সংখ্যা বেশীঃ সেখানে সকল নারী যদি বৈষ্ণবী অথবা নান (ধর্মীয় সেবিকা) না হয়ে বিবাহিতা হতে চান তখন বহুবিবাহই তো গ্রহণযোগ্য সমাধান, যার মাধ্যমে সে অবৈধ পথে তার দৈহিক ও মানসিক প্রয়োজন পূরণ থেকে বিরত থেকে পরিবারের উষ্ণতা পেতে পারে।
এ দু’টো উদাহরন তাত্ত্বিক নয় বরং রূঢ় বাস্তব। জীবনের কঠিন বাস্তবতা মোকাবেলা করতে গিয়ে যে সব মহিলাকে জীবনে নিরাপত্তা সম্মানের জন্য নিত্য সংগ্রাম অথবা অনৈতিক জীবন বেছে নিতে হচ্ছে তাদের দিকে তাকালে আর এসব বিধানকে অবাস্তব মনে হয় না।
৩. দ্বিতীয় বিবাহে ইচ্ছুক স্বামীর প্রথম স্ত্রীর সুযোগ সমূহ
যদিও কোন মানুষের দ্বিতীয় বিয়ে করতে প্রথম স্ত্রীর অনুমতি পূর্বশর্ত করা হয়নি এবং প্রথম স্ত্রীকেও এ ব্যাপারে কোন ভেটো ক্ষমতা দেয়া হয়নি তবুও এটা ইসলামী স্পিরিট নয় যে কেউ প্রথম স্ত্রীর সাথে কোন আলাপ না করে তাকে কোনভাবে না বুঝিয়ে তার অজ্ঞাতে দ্বিতীয় বউ ঘরে এনে তাকে অবাক করে দেবে। বস্তূত এটা ভীষণ অভদ্রতা। এক্ষেত্রে প্রথম স্ত্রীর বাধা দেবার অধিকার রয়েছে, যদি সে বিয়ের কাবিনে এই শর্ত আরোপ করে থাকে যে স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করতে পারবে না। সব আইনবিদ একমত যে যদি স্বামী বিয়ের কাবিননামায় এমন শর্ত স্বাক্ষর করে তবে সে প্রথম স্ত্রীর অসম্মতিতে দ্বিতীয় বিয়ে করতে পারবে না। এক্ষেত্রে অবশ্য তাকে প্রথম স্ত্রীকে তালাক দিতে হবে। প্রথম স্ত্রীর আরেকটি সুযোগ হচ্ছে, বিয়ের সময় স্বামী তার স্ত্রীকে তালাক দেবার একতরফা অধিকার দিয়ে দিবে এবং যখন ঐ স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করল এবং প্রথম স্ত্রী এতে সন্তূস্ত নয়, তখন প্রথম স্ত্রী তালাকের জন্যে আদালতে যেতে পারে। এ অধিকারকে বলে ‘আইসিমা’ (aisima)- বা বিচ্ছিন্ন হবার দায়িত্ব অর্পণ করা। (Delegated Repudiation)।
৪. যদি বিয়ে চুক্তিতে স্বামীর দ্বিতীয় বিয়েতে নিষেধাজ্ঞা বা স্ত্রীর তালাকের অধিকার সম্পর্কে লিখা না থাকে সে ক্ষেত্রে প্রথম স্ত্রীর সুযোগ প্রসঙ্গে
কোন স্ত্রী যদি স্বামীর দ্বিতীয় বিয়েতে অসুখী হয় এবং বিয়ে চুক্তিতে লিখা না থাকায় আগে বর্ণিত ব্যবস্থাও নিতে না পারে তবুও সে স্বামীকে তালাকের উদ্যোগ নিতে পারবে। সে কাজীর কাছে গিয়ে স্বামীর বিয়েতে তার স্বার্থ, অধিকার ও মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হবার অভিযোগ তুলে তালাক চাইতে পারে।
৫. যদি কাজী তালাকের আবেদন প্রত্যাখ্যান করে
কাজী তালাকের আবেদন প্রত্যাখ্যান করলেও ইসলামী আইনমতে স্ত্রী স্বামীকে ‘খোলা’ তালাক দিতে পারে। এটা হচ্ছে যে কোন অবস্থায় নিঃশর্ত তালাক। স্ত্রী শুধু বলবে যে আমার পক্ষে তার ঘর করা অসম্ভব। অবশ্য খোলা তালাকে সে মোহরানা দাবী করতে পারবে না বা ফিরিয়ে দিবে।
৬. স্ত্রীর খোলা তালাক স্বামী মানতে বাধ্য কিনা
স্ত্রী স্বামীকে খোলা তালাক দিলে উক্ত স্ত্রীকে বিয়ে বন্ধন থেকে অব্যাহতি দিতে স্বামী বাধ্য এবং এ বিয়ে ভেঙ্গে যাবে।
৭. মেয়েদের বহুবিবাহ নিষিদ্ধ কেন
মেয়েদের বহুবিবাহ পৃথিবীতে খুবই বিরল। ইসলাম বা অন্য কোন ধর্মে টো নেইই, এমনকি গোটা ইতিহাসে এমন উদাহরণ হাতে গোনা। বহুবিবাহে ছেলেদের অধিকারের বিষয়টি কুরআনে স্পষ্ট। (এতে কারো প্রতি পক্ষপাতিত্বের প্রশ্নই উঠে না- অনুবাদক) মেয়েদের বহুবিবাহ নিষিদ্ধ হবার সম্ভাব্য কারনঃ
ক. একজন পুরুষ একই সাথে অসংখ্য মহিলার গর্ভে সন্তান দিতে পারে, কিন্তূ একজন মহিলা বছরে মাত্র একটি সন্তানেরই জন্ম দিতে পারে। জীবজগতে এটাই বাস্তবতা। প্রতি সন্তানেরই পিতার প্রতি আকর্ষণ বা পিতৃপরিচয় জানার অধিকার আছে। একাধিক স্বামীর স্ত্রীর পক্ষে সন্তানকে পিতৃপরিচয় স্পষ্ট করে দেয়া কঠিন।
খ. সাধারনতঃ প্রায় সব সভ্য জাতিতেই স্বামীই পরিবার প্রধান হয়ে থাকেন। যদি কোন মহিলার একাধিক স্বামী থাকেন তবে তাদের মধ্যে সংঘর্ষ হবে পরিবার প্রধানের পদ নিয়ে।
গ. নারীর মনোদৈহিক গঠন থেকে এটাই দেখা যায় যে, নারীরা সাধারনতঃ সেক্সকে দৈহিক বিষয়ের চেয়ে মানসিক (emotional) অনুভূতির দিকে গণ্য করে এবং এজন্য তার সাধারন্তঃ এককেন্দ্রিক। যে কারণে বলা যায় যে বহুগামীতা আসলেই নারীর স্বভাব বিরুদ্ধ। নারী মুলতঃ একজনকেই ভালবাসে, তাকে ঘিরেই তার স্বপ্ন ও কল্পনা আবর্তিত হয়।
৮. রুগ্ন বা বন্ধ্যা স্বামীর স্ত্রীর করণীয়
এ ব্যাপারে বন্ধ্যা বা রুগ্ন নারীর স্বামীর যা যা সুযোগ আছে তার সবই নারীর আছে, শুধুমাত্র বহুবিবাহের সুযোগ নেই। তার সুযোগসমূহ হচ্ছে-
ক. সে ধৈর্যের সাথে রুগ্ন স্বামীর সেবা করেই ঘর করতে পারে।
খ. রুগ্ন স্বামীকে তালাক দিয়ে নতুন বিয়ে করতে পারে (এ ক্ষেত্রে নারীর তালাকের পূর্ণ অধিকার আছে)
সুত্র নির্দেশিকাঃ
প্রশ্ন-৭ঃ আল কুরআন ৪ঃ৩, ৪ঃ১২৯
জি-৩৫ বহুবিবাহ ও ইসলাম-৫ (নিষিদ্ধকরণ অথবা নিয়ন্ত্রণ)
প্রশ্নঃ
১. বহুবিবাহের অসুবিধাগুলো কি?
২. বহুবিবাহের ক্ষতিকর ও কল্যাণকর দিকগুলোর তুলনামূলক আলোচনা করুন।
৩. মুসলিম বিশ্বে বহুবিবাহের প্রচলন কেমন?
৪. বহুবিবাহ নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি কি?
৫. বহুবিবাহের সুযোগের অপব্যবহার রোধে এর চর্চার ওপর আরো বিধিনিষেধ আরোপ করা যায় কি?
৬. অমুসলিম সমাজে কি বহুবিবাহ প্রয়োজনীয় এবং চালু হতে পারে?
৭. এমন কোন পাশ্চাত্য বিশেষজ্ঞ আছেন কি যারা বহুবিবাহ প্রথা সমর্থন করেন?
উত্তরঃ
১. বহুবিবাহের অসুবিধাগুলোঃ
ক. হিংসা-বিদ্বেষঃ কোন মেয়েই তার স্বামীর ভালোবাসা, আকর্ষণ ও সম্পদে আর একজনের ভাগ বসানো সহজে মেনে নিতে পারে না। ফলে হিংসা বিদ্বেষের জন্ম হতে পারে।
খ. অসমতাঃ ইসলাম কঠোরভাবে স্ত্রীদের মধ্যে ‘সমব্যবহার’ করার কথা বলেছে। এই সমতা রক্ষা করতে আর্থিক এবং অন্যান্য দিকে পুরুষ ভীষণ বেকায়দায় পড়ে এবং অনেকেই শেষ পর্যন্ত তা রক্ষা করতে পারে না।
গ. অশান্তিঃ একই বাড়ীতে একাধিক স্ত্রীর উপস্থিতি স্ত্রীদের মাঝে এবং স্বামী-স্ত্রীতে নিত্য নানান ঝগড়ার জন্ম দেয়। এসব ঝগড়াঝাঁটি বিভিন্ন স্ত্রীর সন্তানদের মধ্যেও আক্রান্ত করে।
কিছু সমস্যা সমাধানে ইসলাম সীমিত আকারে বহুবিবাহকে অনুমতি দেয়। এতে সন্দেহ নেই আর সব সুযোগের মত এরও অপব্যবহার হতে পারে। এসব অসুবিধে সত্ত্বেও কিছু বাস্তব সমস্যার সমাধান বহুবিবাহে পাওয়া যায়।
২. বহুবিবাহের ক্ষতিকর ও কল্যাণকর দিকগুলোর তুলনামূলক আলোচনা
বহুবিবাহ নিষিদ্ধ সমাজগুলোতে এ সুযোগ না থাকায় যেসব অপরাধ ও সমস্যা হচ্ছে ইসলামী সমাজে বহুবিবাহ প্রথা চালু থাকায় তার চাইতে অনেক কম সমস্যা হচ্ছে। এর আগে বহুবিবাহের যেসব কারণগুলো আলোচনা করা হল তাতে দেখা যায় বহুবিবাহের যে সব বিকল্প আছে তার সবই মানুষকে হয় চরম কষ্ট নয়তো পাপের পথে ঠেলে দেয়। সেসব সমাজে ক্রমান্বয়ে নৈতিকতার অবাধ লঙ্ঘন শেষ পর্যন্ত পরিবার নামক ইনস্টিটিউটকেই বিপর্যস্ত ও বিলুপ্ত করে। মুসলমানরা একবিবাহের নামে এক স্ত্রী ঘরে রেখে আর অসংখ্য অবৈধ সম্পর্ক গড়ার চেয়ে বৈধভাবে স্ত্রীর স্বীকৃতি, অধিকার ও মর্যাদা দিয়ে আর একজনকে ঘরে আনাই শ্রেয় মনে করে। কোন ধার্মিক মুসলিম মহিলাও স্বামীর পাপে জড়িত হবার চেয়ে দ্বিতীয় বিয়েকেই কম অপছন্দ করবে।
ইসলাম বহুবিবাহকে সবার জন্য সাধারণ বিষয় বলে ঘোষণা দেয়নি বরং কিছু সমস্যার নিরসনে একসাথে বাস্তবতা, নৈতিকতা ও মানবিকতার সমন্বয়ে সমাধান হিসেবে দেখিয়েছে।
৩. মুসলিম বিশ্বে বহুবিবাহের বর্তমান অবস্থা
পাশ্চাত্যের প্রচার মাধ্যমগুলোর প্রচারনায় মনে হয় মুসলিম সমাজ মানেই বহুবিবাহযুক্ত সমাজ, মুসলিম পরিবার মানেই চার স্ত্রীর সমাহার। এ দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণ ভুল। কিন্তূ বাস্তব পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে, সমগ্র বিশ্বের মুসলিম জনসংখ্যার শতকরা একভাগেরও কম বহুবিবাহের সুযোগ নিচ্ছে। এ থেকেই বোঝা যায় যে এই সুযোগের এমন কোন যথেচ্ছা ব্যবহার হচ্ছে না যার জন্য এটা নিয়ে উদ্বিগ্ন হতে হবে।
৪. বহুবিবাহ প্রথা নিষিদ্ধ করা প্রসঙ্গে
দু-একজন মুসলিম বিশেষজ্ঞ বহুবিবাহ নিষিদ্ধ করার কথা বলেছেন। তাদের এই প্রস্তাবনা দেখে মনে হয় পাশ্চাত্যের বহুবিবাহ ও ইসলামের বিরুদ্ধে তীব্র প্রচারণায় তারা অস্থির হয়ে আল্লাহর দেয়া আইন সম্পর্কে এই আপোষকামী সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। যে সব বাস্তব কারণে বহুবিবাহ নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য নয়, তা হচ্ছেঃ
ক. ইসলামের দৃষ্টিতে কোন মানুষ সরাসরি আল্লাহর দেয়া আইনকে বাতিল বা স্থগিত করতে পারে না। সর্বজ্ঞানী আল্লাহ মানুষের গোটা জীবনের সব কিছু বিবেচনা করেই মানুষের জন্য এই সুযোগ উম্মুক্ত রেখেছেন। পাশ্চাত্যের প্রচারণায় লজ্জিত হয়ে এটা থেকে মুখ ফেরানো উচিত হবে না। আল্লাহ জানেন যে তালাক বা ব্যভিচারের চেয়ে এটা উত্তম।
খ. দুনিয়ার এক শতাংশেরও কম মুসলমানের মধ্যে বহুবিবাহ দেখা যায়। কাজেই এটা এমন কোন বিপদজনক সমস্যা নয় যার মোকাবেলায় এত কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
গ. বহুবিবাহ নিষিদ্ধ করা হবে এক নেতিবাচক সিদ্ধান্ত। কারণ যেসব সমস্যার কারণে এই প্রথা চালু এটা নিষিদ্ধ হলে সেসব সমাধানে কোন বৈধ বা মানবিক পন্থা অবশিষ্ট থাকবে না। এভাবে নিষিদ্ধ করলে সেসব মানুষ এ ব্যবস্থায় সংযত থাকত তারা আর নিয়ন্ত্রনের মধ্যে থাকবে না। আর সমাজের এক অংশের পাপ ও ব্যভিচার ক্রমে গোটা সমাজকেই গ্রাস করবে।
বর্তমানে সাড়া দুনিয়ায় মাত্র একটি ‘মুসলিম’ দেশে বহুবিবাহ নিষেধ করা হয়েছে। এদেশে শাসক পাশ্চাত্যের এমন ধামাধরা যে সেখান থেকে যে বিধানই আসে তাই অবিকল অনুকরণ করে। এই নিষেধাজ্ঞার পরিনতি হয়েছে এই যে কেউ বৈধভাবে দ্বিতীয় বিয়ে করলে তার জেল হয় আর একই আদালতে কেউ ঘরে স্ত্রী রেখে হাজারো মহিলার সাথে ব্যভিচার করলেও বেকসুর খালাস পায়।
৫.বহুবিবাহের সুযোগের উপর বিধি নিষেধ আরোপ প্রসঙ্গে
মানুষের স্বভাবের প্রতি এক দয়া হিসেবে ইসলাম বহুবিবাহের সুযোগ দিয়েছে। আর সব সুযোগের মত বিবেকবর্জিত মানুষদের দ্বারা এক অপব্যবহার হতে পারে। এই সুযোগের অপব্যবহার রোধে ইসলামের সীমার মধ্যে আইনকে আরো কঠোর করতে ইসলামে কোন বাধা নেই। বস্তূত ইসলামই বহুবিবাহ প্রথার উপর কিছু কঠোর শর্ত আরোপ করেছিল। যা হচ্ছে একাধিক স্ত্রীর ভরণপোষণের আর্থিক সামর্থ্য এবং সকল স্ত্রীর প্রতি সমব্যবহার। ইসলামের সীমার মধ্যে বহুবিবাহের অপব্যবহার রোধে আরও কঠোর শর্ত আরোপ কোন নিষেধ নেই। তবে খেয়াল রাখতে হবে তা যেন মানুষকে কোনভাবে ব্যভিচারে উৎসাহী না করে। অনেক বিশেষজ্ঞ ও আইনবিদ এর অপব্যবহার রোধে উদ্যোগী হয়েছেন। কেউ কেউ এমন সংশোধনী এনেছেন যা দ্বিতীয় বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেবার অধিকার ব্যক্তির কাছ থাকে ছিনিয়ে বিচারকের কাছে দিয়েছে। তবে বাকী বিশেষজ্ঞরা (যেমন, শায়খ মুহাম্মদ আবু জাহরা) এই সিদ্ধান্ত নেবার অধিকার ব্যক্তির বিবেচনায় রাখারই পক্ষপাতী।
৬. অমুসলিম সমাজে বহুবিবাহ চালু প্রসঙ্গে
যদিও অমুসলিমরা ইসলামে বহুবিবাহ প্রথার তুখোড় সমালোচক তবুও এই প্রথা তাদের সমাজের বহু নোংরামী, পাশবিকতা ও বিবাহ বিচ্ছেদকে কমাতে পারে। যেহেতু সব মানুষই একই প্রকৃতির একই প্রবৃত্তির এবং ইসলামের আইনও সবার জন্যেই সেহেতু এটা নৈতিকতা সংক্রান্ত সমস্যার বিশ্বজনীন সমাধান হতে পারে।
৭. বহুবিবাহের পক্ষের পাশ্চাত্য বিশেষজ্ঞ
অনেক বিশিষ্ট পাশ্চাত্য বুদ্ধিজীবী বহুবিবাহের পক্ষে বলেছেন। Annie Bessant বলেছেন, পাশ্চাত্যে বাহ্যিকভাবে এক বিবাহ চালু থাকলেও নেপথ্যে আছে দায়িত্বহীন বহুবিবাহের চর্চা (বহুগামীতা)। প্রফেসর Von Ernfeldt. প্রফেসর Havelog Ellis এবং R.landorff প্রমুখ বলেছেন বহুবিবাহকে অবশ্যই বৈধ ও স্বাভাবিক হিসেবে নিতে হবে।
সুত্র নির্দেশিকাঃ
প্রশ্ন-২ঃ যেখানে স্বামীর একাধিক বিয়ের কোন সুযোগ নেই অথচ আরও এক বিয়ে প্রয়োজন তখন সে অনিচ্ছাসত্ত্বেও হতভাগা প্রথম স্ত্রীকে তালাক দেয়।
প্রশ্ন-৫ঃ ঊনবিংশ শতকের গুরুতে প্রখ্যাত আলেম শেখ মোহাম্মদ আবদুহ ও তাঁর ছাত্র রশীদ রিয়া বহুবিবাহের অপব্যবহারের সমস্যা সমাধান নিয়ে আলোচনা করেন।
শেখ মোহাম্মদ আবু জাহেরের চিন্তার প্রতিফলন হচ্ছে এরুপঃ ১৯৫৩ সালে সিরিয়ায় আইন করা হয় যে বিচারক ইচ্ছে করলে কোন ব্যক্তিকে দ্বিতীয় বিয়ের অনুমতি নাও দিতে পারে। সেক্ষেত্রে যদি ঐ ব্যক্তি আদালতের আদেশ অমান্য করে দ্বিতীয় বিয়ে করে তবে বিয়ে বৈধ থাকবে কিন্তূ উক্ত ব্যক্তির আর্থিক জরিমানা হবে। এভাবে দ্বিতীয় বিয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রকৃতপক্ষে ব্যক্তির হাতেই থাকে।