রাষ্ট্র সংস্থা ও সংগঠন
ইসলামী রাষ্ট্রে ব্যক্তির মর্যাদা এবং অধিকার অতীব স্পষ্ট এবং প্রকট। ব্যক্তির স্বাতন্ত্র্যকে সেখানে কখনোই অস্বীকার করা হয় না বরং ব্যক্তি সেখানে ব্যক্তিগত পর্যায়ের যাবতীয় অধিকার ও মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকতে পারে, প্রত্যেক ব্যক্তি অবাধে কাজ করতে পারে সেখানে স্বীয় যোগ্যতা ও প্রতিভার স্ফুরণ ও বিকাশদানের জন্যে, নিজস্ব রুচি ও ঝোঁক প্রবণতা চরিতার্থতার জন্যে। ব্যক্তির অধিকার ইসলামী রাষ্ট্রে এক স্বাভাবিক অধিকাররূপেই স্বীকৃতি পায় এবং তার ওপর কোনোরূপ হস্তক্ষেপ বা তাকে ক্ষুণ্ণ ও ব্যাহত করার অধিকার দেয়া যেতে পারে না কাউকেই। ইসলামী রাষ্ট্রের দৃষ্টিতে ব্যক্তির অধিকার রাষ্ট্রের কল্যাণ ও স্থিতি, উন্নতি লাভ ও শক্তিশালী হয়ে ওঠার জন্যেই অপরিহার্য। সেখানে ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের মাঝে কোনো বিরোধ নেই, হবে না কোনো সংঘর্ষ। পরস্পরের বিরোধ সৃষ্টিতে কোনো কল্যাণ নিহিত রয়েছে বলে মনে হয় না। স্বাভাবিক ও সাধারণ অবস্থায়ই ইসলামী রাষ্ট্রে ব্যক্তির মর্যাদা এমনি-ই হয়ে থাকে।
তবে ইসলামী রাষ্ট্রে রাষ্ট্র ও ব্যক্তির মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি হয় শুধু তখন, যখন এ দুয়ের কোনো একটি ইসলামী আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়, ইসলামী আদর্শের বিরুদ্ধতা করতে উদ্যত হয়। কেননা, এ দুয়ের মাঝে যে মিল, মৈত্রীর সম্পর্ক, তা শুধু এ ইসলামের কারণেই এবং ইসলামের ভিত্তিতেই। এ ভিত্তিকে কেউ অস্বীকার বা উপেক্ষা করলে অপর পক্ষ সক্রিয়ভাবে তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলবে, তাতে কোনোই সন্দেহ থাকতে পারে না। এজন্যে ইসলাম ব্যক্তিকে যা কিছু অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা দিয়েছে তা সে সেখানে পুরোপুরিই লাভ করতে পারে। কেননা, ইসলাম ব্যক্তিকে যা কিছু দিয়েছে, ইসলামী রাষ্ট্র স্বাভাবিকভাবেই তা দেবে, দেবে নিজের আভ্যন্তরীণ তাগীদেরই। বিশেষত এজন্যে যে, ইসলামের দৃষ্টিতে ব্যক্তির যাবতীয় অধিকার লাভে ধন্য হওয়া-ই হলো ইসলামী রাষ্ট্রের বুনিয়াদ সুদৃঢ় হওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ। অধিকার দিলেই অধিকার হরণ করে যে রাষ্ট্র, তার মত দুর্বল ক্ষণভঙ্গুর রাষ্ট্র আর একটিও হতে পারে না। এজন্যে ব্যক্তিদের অধিকারের ওপর অকারণ হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে কি না, সেদিকে তীব্র-তীক্ষ্ণ সজাগ দৃষ্টি রাখা ইসলামী রাষ্ট্রের এক স্থায়ী স্বভাব।
বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ বিধায় আরো বিস্তারিতভাবে আলোচনা করার প্রয়োজন রয়েছে। সে আলোচনার জন্যে ব্যক্তির অধিকারসমূহকে আমরা আরো দুভাগে ভাগ করে নেবোঃ রাজনৈতিক অধিকার ও সাধারণ অধিকার। এ দুয়ের প্রত্যেকটি সম্পর্কেই আমরা বিস্তারিত আলোচনা করছি।
রাজনৈতিক অধিকার
রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের দৃষ্টিতে রাষ্ট্রের নাগরিকদের রাজনৈতিক অধিকারের সংজ্ঞা হলোঃ
*************আরবী**************
একটি রাষ্ট্রের নাগরিক হওয়ার কারণে, অর্থনৈতিক লালন-পালন ও রাষ্ট্রের সাধারণ সুযোগ-সুবিধে প্রভৃতির ক্ষেত্রে এক একজন নাগরিক যা কিছু লাভ করে, তা-ই তার রাজনৈতিক অধিকার রূপে গণ্য।
-উসুলুল কানুন লিদদাকতুর সিনহুরা, ২৬৮ পৃ.।
অথবা তারা সংজ্ঞা হবেঃ
***********আরবী************
রাষ্ট্রের আওতায় রা তার বিধান অনুযায়ী ব্যক্তি যা কিছু লাভ করে তা-ই তার রাজনৈতিক অধিকার।- আল কানুনুদ্দুয়ালীলখাস লিদদাকতুর জাবের জাদ, ১ম খণ্ড, ২৭২ পৃ.।
এ দৃষ্টিতে ইসলামী শরীয়ত ব্যক্তিকে কি সব অধিকার দিয়েছে, অতঃপর আমরা তার উল্লেখ করবো। তাতে করে শরীয়তের দেয়া অধিকার ও রাষ্ট্র বিজ্ঞানীদের বিবৃত অধিকারে যে কোনো বিরোধ বা পার্থক্য নেই, তা স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
নির্বাচনের অধিকার
রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচনঃ দেশে রাষ্ট্রপ্রধান কে হবে, সে ব্যাপারে মত জানানোর অধিকার রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের। ফলে নাগরিকগণ যে ব্যক্তিকে রাষ্ট্রপ্রধান পদের জন্য নির্বাচিত করবে সে-ই হবে রাষ্ট্রপ্রধান। ইসলামী রাষ্ট্র বিজ্ঞানীগণ এ পর্যায়ে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন। তাদের একটি স্পষ্ট উক্তি হলোঃ
************আরবী*************
যে ব্যক্তিত্বের নেতৃত্ব সম্পর্কে মুসলিম নাগরিকগণের মতৈক্য হবে এবং ঐক্যবদ্ধভাবে যার হাতে বাইয়াত হবে তারাই ইমামত (রাষ্ট্রপ্রধান) হওয়া স্বীকৃত ও প্রতিষ্ঠিত হবে এবং তারই সাহায্য-সহযোগিতা করা সকলের প্রতিই অবশ্য কর্তব্য।
-আলমুগান্নী লে-ইবনে কুদামা হাম্বলী, ৮ম খণ্ড, ১০৬ পৃ.।
ইমাম ইবনে তাইমিয়া বলেছেনঃ
*********আরবী**************
রাষ্ট্রের নেতৃত্ব জনগণের বাইয়াতের ভিত্তিতে স্বীকৃত ও প্রতিষ্ঠিত হয়ে থাকে। অর্থাৎ জনগণ যখন কারোর হাতে রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব অর্পণ করে, তখনি সে রাষ্ট্রপ্রধান হতে পারে, পূর্ববর্তী কোনো পদাধিকার বলে নয়।-মিনহাজুস সুন্নাত, ১ম খণ্ড, ১৪২ পৃ.।
এসব সংজ্ঞা থেকে স্পষ্ট হয়ে গেল যে, রাষ্ট্রপ্রধান হবে সে, যাকে সমাজের জনগণ রাষ্ট্রপ্রধানরূপে বাছাই ও নির্বাচিত করবে এবং তার প্রতি এ জন্যে সন্তুষ্ট থাকবে। জনগণের এ অসন্তোষ ও নির্বাচনের ফলেই এক ব্যক্তি রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব লাভ করতে পারে। এছাড়া অন্য কোনো উপায়ে নয়।
কিন্তু রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচনের ব্যাপারে জনগণের এই যে অধিকার তার ভিত্তি কি?…..কি কারণে জনগণের এ অধিকার স্বীকৃত হচ্ছে?
এ অধিকারের ভিত্তি সংস্থাপিত হয়েছে পরামর্শ নীতির ওপর। ইসলামী শরীয়ত এ পরামর্শ নীতির ওপর সমধিক গুরুত্ব আরোপ করেছে। সমাজ যেহেতু শরীয়তের বিধান কার্যকরী করার জন্যে দায়ী এবং সে দায়িত্ব এই পারস্পরিক পরামর্শ নীতির ভিত্তিতেই প্রতিপালিত হতে পারে। আর সে কারণেই রাষ্ট্রপ্রধান নিয়োগের ব্যাপারে ব্যক্তির পরামর্শ দানের অধিকার অনস্বীকার্যভাবে গুরুত্বপূর্ণ। আর এ পরামর্শ নীতির মূল উৎস হচ্ছে কুরআন মজীদের নিম্নোদ্ধৃত আয়াত। ইরশাদ হয়েছেঃ
**********আরবী*************
মুসলমানদের যাবতীয় ব্যাপারে পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে সম্পন্ন করতে হবে।-সূরা আশ শুরাঃ ৩৮
এ আয়াতাংশ স্পষ্টভাবে ঘোষণা করছে যে, মুসলমানদের সকল ব্যাপার বিশেষভাবে যাবতীয় গুরুতর সামাজিক ও জাতীয় ব্যাপার পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে সুসম্পন্ন করতে হবে। আর রাষ্ট্রপ্রধান নিয়োগের ব্যাপারটি নিঃসন্দেহে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও জটিল জাতীয় ও সামাজিক ব্যাপার। কেননা, রাষ্ট্রপ্রধানের পক্ষে পূর্ণ আত্মবিশ্বাস সহকারে কাজ করার জন্যে প্রয়োজন তার পিছনে সক্রিয় জনসমর্থন বর্তমান থাকা। এ সমর্থন আচে কি নেই, কত সংখ্যক লোকের রয়েছে, কত সংখ্যকের নেই, বেশীরভাগ লোকের এ সমর্থন বা আস্থা রয়েছে কার ওপর, তা নিঃসন্দেহে জানার একটি মাত্র উপায়-ই হতে পারে। সে উপায় হলো জনগণের রায় জানার জন্যে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচন। অতএব রাষ্ট্রের প্রত্যেক ব্যক্তিকে রাষ্ট্রপ্রধানরূপে সে কাকে পেতে চায়-কার ওপার আস্থা আছে, তা জানার অধিক-সুযোগ দিতে হবে।
দ্বিতীয়, শরীয়ত কার্যকর করণ জাতীয় দায়িত্ব। শরীয়তের আইন-বিধান কার্যকর ও জারী করার দায়িত্ব সমজের, জাতির, জনগণের। সে জন্যে বাস্তব ব্যবস্থা গ্রহণ করা সমাজ ও জাতির-ই কর্তব্য। কুরআন থেকে এ বিধান অকাট্যভাবেই প্রমাণিত। আর তার সমর্থনে ইতিহাস অত্যন্ত স্পষ্ট ও প্রকট। কুরআন মুসলিম সমাজ ও জাতিকে সম্বোধন করে নির্দেশ দিয়েছে এই বলেঃ
**********আরবী***********
হে ঈমানদার লোকেরা, তোমরা ইনসাফ প্রতিষ্ঠাকারী হয়ে উঠো আল্লাহর জন্যে সাক্ষদাতারূপে তা যদি তোমাদের নিজেদের, তোমাদের পিতা-মাতা, ও আত্মীয়-স্বজনদের বিরুদ্ধেও যায়, তবুও।
বলা হয়েছেঃ
****************আরবী*********************
ঈমানদার পুরুষ ও ঈমানদার মেয়েলোক পরস্পরের পৃষ্ঠপোষক। তারা সবাই ভালো কাজের আদেশ করে ও মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখে।
*****************আরবী****************
তোমাদের রবের কাছ থেকে যা-ই নাযিল হয়েছে তা-ই তুমি পালন করে চলো।-সূরা আল আরাফঃ ৩
*******************আরবী*****************
ব্যভিচারী নারী ও পুরুষ প্রত্যেককেই একশটি কোড়া মারো।-সূরা আন নূরঃ ২
*******************আরবী*****************
পুরুষ চোর ও মেয়ে চোর-প্রত্যেকেরই হাত কেটে দাও।
কুরআন মজীদের এ আয়াতসমূহে এবং এমনিতর আরো বহু সংখ্যক আয়াত স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, শরীয়তের আইন বিধান কার্যকর করা এবং এ কার্যকারিতার জন্যে বাস্তব ও সক্রিয় ব্যবস্থা গ্রহণের দায়িত্ব মুসলিম সমাজের।
এ সামাজিক ও জাতীয় দায়িত্ব পালনের জন্যেই সমাজের পক্ষ থেকে এক ব্যক্তির প্রত্যক্ষভাবে দায়িত্বশীল হওয়া একান্তই অপরিহার্য। সেই দায়িত্বশীল ব্যক্তি সমাজ ও জাতীয় দায়িত্বশীল প্রতিনিধি হিসাবে এসব কর্তব্যসমূহ যথাযথ মর্যাদা সহকারে পালন করবে।
কেননা, শরীয়তের তরফ থেকে গোটা সমাজ ও জাতির ওপর যে দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে, সমাজ ও জাতি হিসাবে তাতো পালন করতে পারে না। সমাজের সকলে মিলে এক সাথে এ কাজ করা অসম্ভব। এ কারণেই প্রতিনিধিত্বের প্রশ্ন দেখা দিয়েছে আদিম কাল থেকে সভ্য সমাজের শৃঙ্খলা বিধানের জন্যে। তাই সমাজ ও জাতি-ই তাদের মধ্য থেকে প্রতিনিধি নির্বাচন করবে, যেন সমাজের ওপর আরোপিত দায়িত্ব সমাজের পক্ষ থেকে সে পালন করতে পারে। অতএব এ প্রতিনিধি নির্বাচন করার ব্যাপারে প্রত্যেক ব্যক্তির অধিকার অত্যন্ত ন্যায়সঙ্গত ও স্বাভাবিক। এ অধিকার সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন-কোনো আপত্তিই তোলা যেতে পারে না। কেননা, যে লোক যে জিনিসের মালিক সে জিনিসের ব্যাপারে প্রতিনিধি বা উকিল নিয়োগ করার অধিকার তারই থাকতে পারে, অন্য কারোর নয়। আর রাজনীতির দৃষ্টিতে জাতি-মুসলিম সমাজই-রাষ্ট্রের মালিক। সে মালিকানায় শরীক প্রত্যেকটি মানুষ ব্যক্তিগতভাবে এবং সমষ্টিগতভাবেও। অতএব সে রাষ্ট্রের ব্যাপারে প্রতিনিধি নিয়োগের অধিকার প্রত্যেক ব্যক্তির ব্যক্তিগতভাবেও এবং সমষ্টিগতভাবেও। তাই রাষ্ট্রপ্রধান নিয়োগে প্রত্যেক ব্যক্তির ভোট দেয়ার অধিকার-প্রত্যক্ষভাবে, পরোক্ষ নয়-প্রত্যেকটি নাগরিকের। এ অধিকার থেকে তাকে বঞ্চিত করার অধিকার কারোরই থাকতে পারে না।
জাতিই সার্বভৌমত্বের উৎস
রাষ্ট্রপ্রধান যখন জাতির প্রতিনিধি, তখন একথা স্পষ্ট যে, তাকে প্রতিনিধি নিয়োগকারী জাতিই হবে সার্বভৌমত্বের উৎস। এজন্যে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিভাষায় বলা হয়ঃ রাষ্ট্রপ্রধান জাতির নামে ও জাতির প্রতিনিধি হিসাবেই সার্বভৌমত্বের প্রয়োগ করে।
সেই সাথে একথাও মনে রাখতে হবে যে, জাতি যদিও এ সার্বভৌমত্বের উৎস কিন্তু তার সার্বভৌমত্ব কোনো অসীম ক্ষমতার অধিকারী নয়, নয় নিরঙ্কুশ। বরং তা আল্লাহর অসীম-অশেষ-সর্বাত্মক সার্বভৌমত্বের অধীন, তারই দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। আর আল্লাহর সার্বভৌমত্ব বাস্তবায়িত হয়েছে তারই ব্যক্তি ও সমষ্টির জন্য দেয়া শরীয়তের বিধানের মাধ্যমে। এ থেকেই বুঝা যায় যে, জাতির সার্বভৌমত্ব হচ্ছে প্রশাসন সংক্রান্ত, কার্যকর করার সার্বভৌমত্ব-এর সার্বভৌমত্ব। তা অসীমও নয়, জন্মগতও নয়, নয় নিজস্ব অর্জিত কিছু। কাজেই সে সার্বভৌমত্ব আল্লাহর সার্বভৌমত্বকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে না, আল্লাহর বিধানের বিপরীত পন্থায় ও কাজে তা প্রয়োগও করতে পারে না। আল্লাহর বিধানকে তা পরিবর্তনও করতে পারে না। আর জাতিই যখন আল্লাহর শরীয়ত বদলাতে পারে না, তার বিরুদ্ধতা করতে পারে না, তাকে নিয়ন্ত্রিত করতে পারে না, তখন রাষ্ট্রপ্রধান-যে হলো জাতির প্রতিনিধি, নির্বাচিত-ভারপ্রাপ্ত, সেও এরূপ কাজ করার অধিকারী নয়। কেননা, রাষ্ট্রপ্রধানের নিয়োগকারী জাতি যে কাজ করার অধিকার দেয়নি, সে কাজ করার কোনো অধিকার তার কেমন করে থাকতে পারে।
এ প্রেক্ষিতে বলা যায়, জাতি যদি আল্লাহর শরীয়তের বিপরীত কোনো আইন প্রণয়ন করে বা তার বিপরীত কোনো ফরমাশ বা অর্ডিনেন্স জারী করে অথবা জাতির প্রতিনিধি রাষ্ট্রপ্রধান তেমন কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করে, তাহলে এ উভয় অবস্থায়ই এ কাজটি শরীয়তের সনদবিহীন বলে গণ্য হবে এবং সার্বভৌমত্বের নির্দিষ্ট সীমালঙ্ঘন করার কারণে তা বাতিল হয়ে যাবে। কেননা জাতির সার্বভৌমত্ব হলো বাস্তবায়নের সার্বভৌমত্ব। তার ক্ষমতা সীমাবদ্ধ হচ্ছে আল্লাহর শরীয়তকে কার্যকর করার মধ্যে, কোনো নতুন শরীয়ত বা শরীয়ত বিরোধী আইন রচনা করে তা জারি করার মূলগতভাবেই তার কোনো অধিকার নেই।
প্রত্যক্ষ নির্বাচন ও পরোক্ষ নির্বাচন
রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচন করা জাতির এক সাধারণ ও মৌলিক অধিকার। কিন্তু এ অধিকার তারা কিভাবে প্রয়োগ করবে? জাতির ব্যক্তিগণ প্রত্যক্ষ ও সরাসরিভাবে রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচন করবে, না পরোক্ষভাবে? সত্যি কথা হচ্ছে এই যে, শরীয়তে এ ব্যাপারে স্পষ্ট ও অকাট্যভাবে কোনো পদ্ধতি নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়নি। বরং তা জাতির ওপর ন্যস্ত করা হয়েছে, তারা দেশ-স্থান-কাল খেদে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ যে কোনো একটা পদ্ধতি গ্রহণ করতে পারে। এ উভয় ধরনের নির্বাচনের-ই অবকাশ ইসলামী শরীয়তে স্বীকৃত। তবে কুরআনের আয়াতে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের সনদই অনেকটা স্পষ্টভাবে পাওয়া যায়।
কুরআনের আয়াত
*******************আরবী*****************
তাদের যাবতীয় ব্যাপারে পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতেই মীমাংসিত হয়।-সূরা আশ শুরাঃ ৩৮
বাহ্যত ও স্পষ্টত প্রত্যক্ষ নির্বাচনকেই সমর্থন করে। আর রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচন যেহেতু গোটা জাতির একটা সাধারণ অধিকার ও দায়িত্বের ব্যাপার, কাজেই এ কাজের জন্যে এমন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে যেন শরীয়ত অনুযায়ী ভোটের অধিকারী প্রত্যেকটি মানুষই ভোটদান করতে পারে। এ ছোট আয়াতের ভিত্তিতে আমরা এইমাত্র যা কিছু বললাম তার স্পষ্ট সমর্থন পাওয়া যায়, এ আয়াতের বিভিন্ন তাফসীরে। ইমাম ফখরুদ্দীন রাজী লিখেছেনঃ
*******************আরবী*****************
যখন কোনো ঘটনা সংঘটিত হতো তখন তারা সকলে একত্রিত হতেন এবং পরস্পর পরামর্শ করতেন। এজন্যে আল্লাহ তায়ালা এ আয়াতে তাদের প্রশংসা করেছেন। এর অর্থ দাঁড়ায় এই যে, তাঁরা কেউ নিজের ব্যক্তিগত মতে ভিত্তিতে কাজ করতেন না। বরং সবাই একত্রিত না হওয়া পর্যন্ত তাঁরা কোনো সিদ্ধান্তই গ্রহণ করতেন না।
-তাফসীরুর রাজী, ৩৭খণ্ড, ১৭৭পৃ.।
অবশ্য পরোক্ষ নির্বাচনের সমর্থন পাওয়া যায় ইসলামের স্বর্ণযুগের ইতিহাসে খিলাফতে রাশেদার নির্বাচনের। এ ছিলো ইসলামের পূর্ণ প্রতিষ্ঠার যুগ। খোলাফায়ে রাশেদীনের প্রত্যেকের নির্বাচনে প্রথমে অংশগ্রহণ করে মুসলিম জাতির অল্পসংখ্যক লোক। ইসলামী রাষ্ট্র বিজ্ঞানের পরিভাষায় তাদের বলা হয় আহলুল হল্লে ওয়াল আকদ-দায়িত্ব সম্পন্ন সমঝদার লোক। পরে মদীনায় অবস্থিত অপরাপর লোকেরা তাদের অনুসরণ করেছে, তারাও তাকেই খলীফারূপে মেনে নিয়েছে যাকে ইতিপূর্বেই সমাজের দায়িত্বশীল লোকেরা খলীফা পদে বরণ করে নিয়েছে। সমস্ত মুসলমান একত্রে একমত হয়ে কোনো খলীফাকেই নির্বাচিত করেনি। এ বিষয়ে যেমন খলিফাগণ নিজেরা কোনো আপত্তিও তোলেননি, তেমনি জনগণের মধ্য থেকেও এ সম্পর্কে কোনো আপত্তি উত্থাপিত হয়নি। ফলে রাষ্ট্রপ্রধানের এ পরোক্ষ নির্বাচন পদ্ধতির যুক্তিযুক্ততার ওপর তাদের ইজমা হয়েছে বলা চলে। পরোক্ষ নির্বাচনের স্বপক্ষে এটি এটি দলীল বটে। অতএব রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ উভয়ের যে কোনো একটি পদ্ধতি গ্রহণ করার অধিকার জাতির রয়েছে বলা চলে। কেননা কোনো অধিকার সম্পন্ন ব্যক্তি নিজেই তার অধিকারের কাজটি সম্পন্ন করবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতাও নেই। বরং সে ইচ্ছে করলে এ কাজের জন্যে স্বেচ্ছায় অপর একজনকে দায়িত্বশীলও বানাতে পারে। ইসলামের ফকীহগণও এ পরোক্ষ নির্বাচনের স্বপক্ষেই মত জানিয়েছেন। তাঁরা বলেছেনঃ রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচন করা আহলুল হল্লে ওয়াল আকদেরই দায়িত্ব। অতএব এ কাজে সমগ্র জাতিকে যোগদান করানো কোনোই প্রয়োজন নেই। আল্লামা ইবনে খালদুন তার ইতিহাসের ভূমিকায় লিখেছেনঃ
*************আরবী*****************
একথা যখন স্থির হলো যে, খিলাফতের পদ কায়েম করা সর্বসম্মতভাবে ওয়াজিব তখন তা ফরযে কেফায়া পর্যায়ের কাজ এবং তা সম্পাদনের ভার আহলুল হল্লে ওয়াল আকদ-এর ওপর বর্তাবে। এ কাজ সম্পাদন করা তাদেরই দায়িত্ব এবং জনগণের উচিত তাঁদের নির্বাচনকে মেনে নেয়া।-মুকাদ্দমা ইবনে খালদুল, ১৯৩ পৃ.।
ইমাম মারওয়ারদী এ সম্পর্কে লিখেছেনঃ
***************আরবী****************
ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচন দুভাবে হতে পারেঃ হয় তা আহলুল হল্লে ওয়াল আকদ-এর ভোটে ও নির্বাচনে অনুষ্ঠিত হবে, না হয় পূর্ববর্তী রাষ্ট্রপ্রধানের মনোনয়নে।-আল মাওয়ারদী, ৪র্থ পৃষ্ঠা।
কিন্তু ইসলামী ইতিহাসের এই ব্যাখ্যা-ই চূড়ান্ত, এর অন্য কোনো রূপ ব্যাখ্যা চলে না-এমন কথা বলা যায় না। আমরাও এর একটা ব্যাখ্যা পেশ করতে পারি এবং তা এভাবে যে, খোলাফায়ে রাশেদীনের সব কয়জনেরই নির্বাচন সাধারণ ও প্রত্যক্ষ নির্বাচন তখনকার সময়ে ও তদানীন্তন ভৌগলিক ও যোগাযোগ ব্যবস্থার দিক দিয়ে সম্ভবপর ছিলো। প্রত্যেক খলীফার নির্বাচন সংক্রান্ত যাবতীয় ঘটনাবলী বিশ্লেষণ করলে এ ব্যাখ্যা কিছুমাত্র ভিত্তিহীন বিবেচিত হবে না। বিশেষত কুরআন মজীদ থেকে যখন প্রত্যক্ষ নির্বাচনেরই সমর্থন পাওয়া যায়, তখন তার বিপরীত ব্যাখ্যা দেয়ার কোনো প্রয়োজন থাকতে পারে না।
আহলুল হল্লে ওয়াল আকদ
রাষ্ট্র প্রধানের নির্বাচন যদি পরোক্ষ ও অপ্রত্যক্ষ পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত হয়-যেমন ইসলামী শরীয়ত তাকে সমর্থন করেছে, তখন যারা তাকে প্রথম নির্বাচিত করে ফিকাহবিদগণ তাদের নাম দিয়েছেন আহলুল হল্লে ওয়াল আকদ। কিন্তু এ আহলুল হল্লে ওয়াল আকদ কারা? জাতির সাথে তাদের সম্পর্ক কি? আর তারা এ মর্যাদা পায়-ই কি করে?
পয়লা সওয়ালের জবাব হলো, ফিকাহবিদগণ কতগুলো গুণের উল্লেখ করেছেন, এ গুণ যাদের রয়েছে তারাই আহলুল হল্লে ওয়াল আকদ। আল্লামা মাওয়ারদী এ পর্যায়ের তিনটি গুনের কথা উল্লেখ করেছেনঃ এক, পূর্নাঙ্গ আদালত-সুবিচার-ন্যায়বাদী-বিশ্বস্ত হওয়া। দুই, শরীয়তের নির্দিষ্ট শর্তের ভিত্তিতে জাতির মাঝে কোন লোকটি রাষ্ট্রপ্রধান বা সমাজ-ইমাম হওয়ার যোগ্য অধিকারী তা জানার ও বুঝার মতো জ্ঞান ও ইলম। তিন, জনগণের সার্বিক কল্যাণের দিক দিয়ে ইমাম বা রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার অধিক যোগ্য ব্যক্তি চিনার ও বাছাই করার মতো বিচক্ষণতা ও বুদ্ধিমত্তা। এ তিনটি গুণ সমাজের যেসব লোকের বেশী আছে, তারাই আহলুল হল্লে ওয়াল আকদ হওয়ার যোগ্য। কোনো কোনো মুহাদ্দিস-ফকীহ এ পর্যায়ের গুণাবলীর আরো স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন। আল্লামা রশীদ রেজা মিছরী তাঁর তাফসীরে লিখেছেনঃ
***********আরবী*****************
উলুল আমর হচ্ছে মুসলমান সমাজের সবকিছু ভাঙ্গা-গড়ার জন্যে দায়িত্বশীল। আর তারা হচ্ছে উচ্চ পর্যায়ের রাজন্যবর্গ, সর্বোচ্চ শাসক, আলেম-শিক্ষিত, সেনাবাহিনীর প্রধান প্রধান ব্যক্তিরা, আর জনগণ নিজেদের প্রয়োজনে ও সার্বিক কল্যাণের ব্যাপারে যেসব চিন্তাশীল-বুদ্ধিমান নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির প্রতি রুজু করে-আস্থা রাখে-তারা।
-তাফসীরুল মানার, ৫ম খণ্ড, ১৮১ পৃ.।
একথা থেকে বুঝা গেল যে, আহলুল হল্লে ওয়াল আকদ বলতে বুঝায় সমাজের এমন সব লোককে যারা জনগণের অনুসরণীয়, আস্থাভাজন যাদের মতামত জনগণ মেনে নেয়, তার প্রতি যথাযথ গুরুত্ব দেয়।-এজন্যে যে, তাদের ভিতর নিঃস্বার্থতা, দৃঢ়তা, আল্লাহভীতি, সুবিচার ও ন্যায়-নিষ্ঠা, নির্ভুল রায় দান, সব ব্যাপারে গভীর তাৎপর্য অনুধাবন এবং সর্বোপরি জনকল্যাণের উদ্যম-আগ্রহ বিদ্যমান।
দ্বিতীয় সওয়াল-জাতির সাথে আহলুল হল্লে ওয়াল আকদ-এর সম্পর্ক সম্পর্কিত প্রশ্নের জবাব হচ্ছে, এরা হবে জাতির প্রতিনিধি, উকিল-তাদের পক্ষ থেকে তাদের জন্য কর্মসম্পাদনের ব্যাপারে দায়িত্বশীল। তারা জনগণের পক্ষ থেকে প্রত্যক্ষভাবে রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচন করবে। অন্য কথায় নির্বাচনের অধিকার প্রয়োগের জন্য তারা হবে তাদের মনোনীত প্রতিনিধি। আর এজন্যে তাদের রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচন হবে কার্যত জাতির রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচনের সমপর্যায়ভুক্ত।
তৃতীয় সওয়াল- জাতীয় ব্যাপারে তারা আহলুল হল্লে ওয়াল আকদ পর্যায়ভুক্ত হবে কেমন করে। এর জবাব এই যে, একথা তো স্পষ্ট যে, জাতিই তাদের এ মর্যাদায় অভিষিক্ত করবে তাদের নিজস্ব বাছাই নির্বাচনের মাধ্যমে। আর অতীত ইতিহাস আমাদের বলে দেয়, জাতির লোকেরা একত্রিত হয়ে প্রথমে নিজেদের ইচ্ছায় স্বাধীনভাবে তাদের নির্বাচন করে নেবে। এ নির্বাচন আনুষ্ঠানিকভাবেও হতে পারে, আবার তাদের স্বাভাবিক প্রতিষ্ঠিত মর্যাদার ভিত্তিতেও হতে পারে।
খিলাফতে রাশেদার যামানায় যেসব লোক এ মর্যাদায় অভিষিক্ত ছিলেন তারা নিজেদের স্বাভাবিক নীতি-নিষ্ঠা, ইসলাম পালনে অগ্রগণ্যতা ও জনকল্যাণকামী হওয়ার দিক দিয়ে স্বতঃই এ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। সেখানে এজন্যে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রয়োজন দেখা দেয়নি। কেউ তাদের এ মর্যাদাকে চ্যালেঞ্জ করেনি কখনো। এমনকি বলা যেতে পারে যে, তখন যদি আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচন করানো হতো, তাহলে এরাই এ পদমর্যাদায় নির্বাচিত হতেন। কাজেই তারা যখন প্রয়োজন মত রাষ্ট্রপ্রধান খলীফা নির্বাচন করেছে তখন জাতির প্রতিনিধি হিসাবেই তা করেছে। জনগণ তাদের নির্বাচনের বিরুদ্ধে কখনো গররাজি হয়নি, দ্বিমত প্রকাশ করেনি। বরং তাঁকে আন্তরিকভাবে সমর্থন করে নির্বাচিত খলীফার হাতে বাইয়াত করেছে অকুণ্ঠ আগ্রহ ও ভক্তি সহকারে।