ব্যক্তি স্বাধীনতা ও মৌলিক অধিকার
মৌলিক অধিকার বলতে কি বুঝায়?
মৌলিক অধিকার বলতে বুঝায় এমন সব অধিকার, যা সমাজের লোক হিসাবে জীবন যাপনের জন্যে একজন মানুষের পক্ষে একান্তই অপরিহার্য। যা থেকে বঞ্চিত হয়ে থাকা কিছুতেই সম্ভবপর নয়, উচিত নয়। এ অধিকারগুলো নির্দিষ্ট হয়ে রয়েছে, ব্যক্তির নিজের প্রাণ সংরক্ষণ, তার আযাদী এবং তার ব্যক্তিগত সম্পদ-সম্পত্তির নিরাপত্তা ব্যবস্থার ক্ষেত্রে। এ অধিকারগুলো যথাযথরূপে সংরক্ষিত না হলে মানুষের মানবিক মর্যাদা অরক্ষিত ও বিপন্ন হতে বাধ্য।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এ অধিকারগুলোকে দুটো বড় বড় ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। প্রথম-সাম্য ও সমতা, দ্বিতীয়-আযাদী বা স্বাধীনতা। সমতা বা সাম্য কয়েক ভাগে বিভক্ত। তাহলোঃ আইনের দৃষ্টিতে সাম্য, বিচারের ক্ষেত্রে সাম্য ও সমতা। আযাদীও এমনিভাবে কয়েক ভাগে বিভক্ত। তাহলোঃ ব্যক্তিগত স্বাধীনতা, মালিকানা অর্জন ও রক্ষণের স্বাধীনতা, বাসস্থান অর্জনের ও গ্রহণের স্বাধীনতা, আকীদা-বিশ্বাস ও ইবাদাত-উপাসনার স্বাধীনতা, মত প্রকাশের ও শিক্ষার স্বাধীনতা।- আদ দিমোক্রতিয়াতুল ইসলামিয়া লিদ দাক্তু উসমান খলীল, ২৩ পৃষ্ঠা।
আলোচনার পদ্ধতি
ইসলামী শরীয়ত প্রদত্ত জনগণের সাধারণ অধিকারসমূহ সম্পর্কে আমরা এখানে আলোচনা করতে প্রবৃত্ত হবো। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এ অধিকারগুলোকে যেভাবে বিভক্ত করা হয়েছে, আমরা বিষয়টিকে ঠিক সেভাবে ভাগ করেই আলোচনা করতে চাই। ইসলামের ছত্র ছায়ায় এ অধিকারগুলো সাধারণ মানুষ কিভাবে এবং কতখানি উপভোগ করতে পারে, তা বিশ্লেষণ করাই হলো আমাদের এ আলোচনা লক্ষ্য। এজন্যে আমরা বিষয়টিকে মৌলিকভাবে দুপর্যায়ে ভাগ করবো। প্রথমে আমরা সাম্য ও সমতা সম্পর্কে সম্পর্কে আলোচনা করবো এবং পরে আযাদী বা স্বাধীনতা সম্পর্কে।
সাম্য ও সমতা
ইসলামী শরীয়তে সাম্যের গুরুত্বঃ ইসলামী শরীয়তে সাম্য ও সমতার গুরুত্ব বিরাট। সব মানুষ মৌলিকভাবেই সমান বলে ইসলাম ঘোষণা করেছে। ইসলাম মূলের দিক দিয়েই সব মানুষের মাঝেও অভিন্ন সাম্য কায়েম করতে বদ্ধপরিকর। ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষের মাঝে পার্থক্য হতে পারে কেবল নেক আমল ও কল্যাণকর কার্যক্রমের ভিত্তিতে। আল্লাহ তায়ালা একথাই ঘোষণা করেছেন কুরআন মজীদের নিম্নোদ্ধৃত আয়াতেঃ
*****আরবী******
হে মানুষ! আমি তোমাদের সৃষ্টি করেছি পুরুষ ও স্ত্রী থেকে। আর তোমাদের বিভিন্ন গোষ্ঠী ও গোত্রে বিভক্ত করেছি তোমাদের পারস্পরিক পরিচিতি লাভের জন্যে। তবে আসল কথা হলো, তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি আল্লাহর কাছে সবচেয়ে বেশী সম্মানার্হ, যে তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী আল্লাহভীরু।- সুরা হুজরাতঃ ১৩
এ আয়াত স্পষ্ট বলছে, মানুষ মৌলিকভাবেই এক, অভিন্ন ও সর্বতোভাবে সমান। মানুষ হিসাবে তাদের মাঝে কোনোই পার্থক্য নেই। আর মানুষকে যে বিভিন্ন গোত্র, গোষ্ঠী ও বংশ সম্ভূত করে সৃষ্টি করা হয়েছে, এর উদ্দেশ্য মানুষকে নানাভাবে বিভক্ত এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন ও নিঃসম্পর্ক করে দেয়া নয়, বরং তার একমাত্র উদ্দেশ্য হলো মানুষের পারস্পরিক পরিচিতি লাভ ও পারস্পরিক গৌরব-অহংকার করা এবং নানাভাবে পার্থক্য ও ভেদাভেদের পাহাড় খাড়া করা কখনো এর উদ্দেশ্য নয়, তা করা জায়েযও নয় কারোর জন্যে। এর ভিত্তিতে কেউ কারোর ওপর শ্রেষ্ঠত্ব, প্রাধান্য ও বৈশিষ্ট্যের দাবী করতে পারে না। বস্তুত ইসলামের এ মহান আদর্শ মানব সমাজ থেকে হিংসা, বিদ্বেষ ও ভেদাভেদের মূলকেই উৎপাটিত করে দিয়েছে, শেষ করে দিয়েছে সব বংশীয় ও বর্ণীয় গৌরব অহংকার। অতঃপর প্রশ্ন ওঠে, তাহলে কি মানুষের মাঝে পার্থক্য ও তারতম্য করার কোনো ভিত্তি নেই? পার্থক্য করার বস্তুনির্ভর কোনো ভিত্তি যে নেই তা চূড়ান্ত। ইসলাম এ পার্থক্যের একটি ভিত্তিই শুধু উপস্থাপিত করেছে এবং তা এমন, যা মানুষের নিজস্ব গুণ ও ইচ্ছা প্রণোদিত হয়ে অর্জন করতে পারে, যে কোনো মানুষ তা লাভ করতে পারে। তার পথে কোনো বংশগত বা অর্থগত-সম্পদগত মর্যাদা বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না।
বস্তুত ইসলামী শরীয়তে সাম্য ও সমতার শিকড় অতি গভীরে নিবদ্ধ। শরীয়তে যাবতীয় বিধি-বিধান ও আইন-কানুনেই এ সাম্য পূর্ণ মাত্রায় প্রতিফলিত হয়েছে। আমরা এখানে এ পর্যায়ের কয়েকটি দিকের উল্লেখ করছি। এর মধ্যে আইনের দৃষ্টিতে সাম্য ও বিচার-ব্যবস্থার সাম্যের দিকটি সবচেয়ে বেশী উল্লেখ্য।
আইনের দৃষ্টিতে মানুষের সাম্যঃ আইনের দৃষ্টিতে মানুষের সাম্য, সাম্যের এক পরম প্রকাশ। ইসলাম যে সুবিচার নীতি উপস্থাপিত করেছে এ তারই চুড়ান্ত রূপ। ইসলামে আইন সকল মানুষের প্রতিই সমানভাবে প্রযোজ্য। আইন প্রয়োগে মানুষের মানুষে মানুষে কোনোরূপ ভেদাভেদ করার নীতি ইসলামে আদৌ সমর্থিত নয়, না বংশের দিক দিয়ে না বর্ণ, ভাষা ও সম্পদ পরিমাণের ভিত্তিতে। এমনকি আকীদা, বিশ্বাস, আত্মীয়তা, নৈকট্য, বন্ধুত্ব ইত্যাদির কারণেও আইন প্রয়োগে মানুষের মাঝে কোনোরূপ পার্থক্য করা চলবে না। হাদীসে নবী করীম স.-এর এ ঘোষণাটি এক বিপ্লবী ঘোষণা হিসাবেই উদ্ধৃত হয়েছেঃ
******আরবী*******
তোমাদের পূর্ববর্তী জাতিগুলো ধ্বংস হয়েছে কেবল এ বিভেদ নীতির ফলে যে, তাদের সমাজের ভদ্রলোকেরা যখন চুরি করতো, তখন তাদের কোনো শাস্তি দেয়া হতো না। পক্ষান্তরে তাদের মাঝে দুর্বল লোকেরা যখন চুরি করতো, তখন তারা তাদের ওপর কঠোর অনুশাসনই চাপিয়ে দিতো। আল্লাহর শপথ, মুহাম্মদের কন্যা ফাতেমাও যদি চুরি করে, তাহলে তার হাতও কেটে দেয়া হবে।- তাফসীরুল উসূল, ২য় খণ্ড, ১৪ পৃষ্ঠা।
আইনের দৃষ্টিতে সাম্যের গুরুত্বঃ বস্তুত জনসম্পদে এরূপ নির্বিশেষে সমতা বিধানের ফলেই রাষ্ট্রের জনগণ সন্তোষ এবং নিশ্চিন্ততা লাভ করতে পারে। তারা কার্যত দেখতে পায় যে, এখানে কারোর প্রতিই কোনোরূপ অবিচার বা যুলুম করা হয় না, করা হয় না কারোর প্রতি এক বিন্দু পক্ষপাতিত্ব, এখানে নির্বিশেষে সকলেরই অধিকার পূর্ণ মাত্রায় সংরক্ষিত হয়। তখন তারা রাষ্ট্র ও সরকারের প্রতি পূর্ণ আনুগত্য পোষণ করে। এ রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষার জন্যে তারা সর্বশক্তি নিয়োগ করতে কুণ্ঠিত হয় না।
কিন্তু এ সাম্য যদি কখনোও লঙ্ঘিত হয় আর আইন যদি কেবল দুর্বলদের ওপরই কার্যকর হতে থাকে, তখন জনগণ এ রাষ্ট্র সম্পর্কে চরম নৈরাশ্য পোষণ করতে শুরু করে। রাষ্ট্র ও সরকারের প্রতি তাদের মনে থাকে না কোনোরূপ আন্তরিকতা। তখন তারা এর স্থিতি ও প্রতিরক্ষার জন্যে কোনোরূপ ত্যাগ
স্বীকার করতে ও প্রস্তুত হয়না। আর এর ফলেই জনগণের উপর যুলুম হতে শুরু হয়। এখানে কেবল শক্তিশালীদেরই কর্তৃত্ব চলে। শক্তিই হয় চুড়ান্ত ফয়সালাকারী, আইন নয়। জোর যার মুল্লুক তার এ-ই হয় এখানকার অবস্থা সম্পর্ক সঠিক কথা। আর কোন রাষ্ট্র যখন এ অবস্থায় পৌঁছে যায়, তখন স্থায়িত্ব অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। এজন্য আরবী ভাষায় এ কথাটি প্রচলিত হয়েছে:
*****আরবী******
সুবিচারকারী রাষ্ট্র কাফের হলেও টিকে থাকে আর যালেম রাষ্ট্র মুসলিম হলেও টিকে থাকেনা।
একটি দৃষ্টান্তঃ খলীফায়ে রাশেদ হযরত উমর ফারুক রা: এর খেলাফতের আমলে মিসরের শাসনকর্তা হযরত আমর এবনুল আছ রা: একজন কিবতী নাগরিককে অকারনে চপেটাঘাত করেছিলেন। কিবতি হযরত উমর রা: এর কাছে অভিযোগ করলো। পরে ইবনে আমর যখন খলীফার দরবারে হাযির হলেন, তখন তিনি কিবতিকে হাযির করে জিজ্ঞেস করলেন: তোমাকে এই লোক মেরে ছিলো? কিবতি বললো হ্যাঁ, এ লোকই আমাকে অকারনে চপেটাঘাত করেছিলো। খলীফা বললেন: তাহলে তুমিও ওকে মারো। এ আদেশ পেয়ে ইবনে আমরকে মারতে শুরু করলো। পরে খলীফা ওমর রা: আমর ইবনুল আসকে লক্ষ্য করে বলেন:
*****আরবী******
হে আমর! কবে থেকে তুমি লোকদের গোলাম বানাতে শুরু করলে। অথচ তাদের মায়েরাতো তাদের স্বাধীন রূপেই প্রসব করেছিল?
বিচারের ক্ষেত্রে সাম্য: ইসলামী রাষ্ট্রে দেশের সকল নাগরিকই বিচারের ক্ষেত্রে সমান ব্যবহার পাওয়ার অধিকারী। সে খানে যে কোন লোকের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা দায়ের করা যায় এবং আদালত যেকোন লোককে বিচারের সম্মুখীন হতে বাধ্য করতে পারে। বিচারালয়ে কোন রূপ বাদী বিবাদীর মাঝে কোনরূপ পার্থক্য করা চলেনা। এমনকি কোন শত্রু ও যদি আদালতের সামনে ফরিয়াদি হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে সে ঠিক তেমনি আচরণই পাবে যেমন আচরণ পাবে একজন মিত্র বা স্বদেশের নাগরিক। একথাই আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করেছেন কুরআন মাজীদের নিম্নক্ত আয়াতে: হে, ঈমানদারগণ! আল্লাহর ওয়াস্তে সত্য নীতির উপর স্থায়ীভাবে দণ্ডায়মান ও ইনসাফের সাক্ষ্য দাতা হও। কোন বিশেষ দলের শত্রুতা তোমাদেরকে যেন এতদূর উত্তেজিত করে না দেয় যে, (তার ফলে) ইনসাফ ত্যাগ করে ফেলবে। ন্যায় বিচার করো। বস্তুত আল্লাহর পরস্তির সাথে এর গভীর সামঞ্জস্য রয়েছে। আল্লাহকে ভয় করে কাজ করতে থাক। সুরা আল মায়েদা: ৮
তিনি আরো স্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছেন এ ভাষায়:
*****আরবী******
তোমরা যখন লোকদের মাঝে বিচার কার্য করবে, তখন অবশ্যই সুবিচার করবে। সুরা আন নিসা: ৫৮
বস্তুত আইনের দৃষ্টিতে সাম্য ও বিচারের ক্ষেত্রে সাম্য—এ দুটোই ইসলামী শাসন ব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। খলীফা হযরত উমর রা: গভর্নর হযরত আবু মুসা আশয়ারীকে লিখেছেন:
*****আরবী******
তোমরা বৈঠকে, চেহারা ও বিচারে পূর্ণ সাম্য রক্ষা করবে লোকদের মাঝে, যেন কেউ তোমার দোষ ধরতে না পারে এবং দুর্বল লোকেরা যেন তোমার সুবিচার থেকে নিরাশ হয়ে না যায়। এনামুল মুয়াওবেকিন, ১ম খন্ড, ৭২ পৃষ্ঠা।
বস্তুত ইসলামের এ সাম্যনীতি এতই উন্নত যে, আধুনিক কালে কোন রাষ্ট্র ব্যবস্থাও এর সমান হওয়া দাবি করতে পারেনা।
ব্যক্তি স্বাধীনতা
ব্যক্তি স্বাধীনতার সংজ্ঞা: রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ব্যক্তিস্বাধীনতা বলতে বুঝায়, রাষ্ট্রর নাগরিকদের স্বাধীন, অবাধ চলাফেরা ও যাতায়াতের অধিকার, শত্রুতা শত্রুতা থেকে আত্মরক্ষা করার অধিকার; এ অধিকার যে তার মালিকানাধীন সম্পদ ও সম্পত্তি অকারনে কেউ হরণ করে নেবে না কেউ তার উপর অকারণে অত্যাচার যুলুম করবে না। কেউ তাকে বিনা অপরাধে আটক করবে না দেশের বৈধ আইন মোতাবেকই সে জীবন যাপন করতে পারবে এবং তার সাথে আইন –সম্মত ভাবেই আচরণ করা হবে সে নিজের ইচ্ছায় দেশের বাইরে ও যেতে পারবে, আবার সময় মতো নিজের ঘরে ও আসতে পারবে।
শরীয়তে ব্যক্তি স্বাধীনতা: বস্তুত ইসলামী শরীয়তে এ অর্থে ব্যক্তিগত অধিকার পুরোমাত্রায় স্বীকৃত। বরং ইসলামী রাষ্ট্রে কার্যত ব্যক্তিদেরকে এর চেয়ে ও প্রশস্ততর অধিকার দেয়া হয়েছে। জনগণের উপর কোনোরূপ বাড়াবাড়ি করা যুলুম। আর যুলুম ইসলামে চিরদিনের তরে হারাম। এখানে রাষ্ট্র ব্যক্তির যাবতীয় অধিকার রক্ষার জন্য দায়িত্বশীল। ব্যক্তি জীবন, দেহ ইজ্জত আব্রু ও সম্পদ –সম্পত্তি সংরক্ষিত রাখার জন্যে রাষ্ট্র সতত তৎপর হয়ে থাকবে। ইসলামী শরীয়ত একথাই ঘোষণা করছে স্পষ্ট ভাষায়। এ জন্য যুলুমকারীকে শাস্তি ও দন্ড দিতে রাষ্ট্র একান্ত ভাবে বাধ্য। শরীয়তে এ শাস্তির ব্যবস্থা ও রয়েছে। ইসলামী রাষ্ট্রে ব্যক্তিকে কোনোরূপ শাস্তি ভোগের সম্মুখীন হতে হয় তখন যখন শরীয়তের আইনের প্রকাশ্য বিচারে তার অপরাধ সপ্রমানিত হবে এবং শাস্তি ঠিক ততটুকু দেয়া হবে যতটুকু শাস্তি তার অপরাধের জন্য শরীয়তে বিধিবদ্ধ রয়েছে। এখানে একজনের অপরাধের জন্য অন্য জনকে শাস্তি ভোগ করত হয় না। যার অপরাধ তাকেই শাস্তি ভোগ করতে হবে কুরআন মজীদে বলা হয়েছে:
*****আরবী******
একজনের বোঝা অপরজন কখনো বহন করবেনা। সুরা বনী ইসরাইল: ১৫
নিজের ঘরের বাইরে, নিজ দেশের যেখানে সেখানে এবং দেশের বাইরে ভিন্ন দেশে যাতায়াত করার অধিকার ও প্রত্যেক ব্যক্তির মৌলিক অধিকার হিসাবে স্বীকৃত। শুধু তাই নয়, শরীয়তে এজন্য রীতিমত উৎসাহ প্রধান করা হয়েছে। কুরআন মজীদে প্রশ্ন তোলা হয়েছেঃ
*****আরবী******
লোকেরা কি যমীনের যত্রতত্র ঘুরে বেড়াবে না এবং তাদের পূর্ববর্তী লোকদের কি পরিণতি হয়েছে তা স্বচক্ষে দেখবে না?—সুরা ইউসূফঃ১০৯
ব্যবসায়ের জন্য বিদেশে ভ্রমণ করার ও নির্দেশ রয়েছে। কুরআন মজীদে বলা হয়েছেঃ
*****আরবী******
তোমরা যমীনের পরতে পরতে চলাফেরা কর এবং তার ফলে উপার্জিত রিযিক আহার করো। শেষ পর্যন্ত তারই কাছে ফিরে যেতে হবে তোমাদের সকলকে। সূরা আল মূলকঃ১৫
অবশ্য কোন কারণে কো ব্যক্তিকে যদি বাইরে যেতে না দেয়াই আইনসম্মত বিবেচিত হয়, তাহলে সে লোকের যাতায়াতের উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করার অধিকার রাষ্ট্রর রয়েছে। হযরত উমর ফারুক রা: তার খেলাফত আমলে বড় বড় সাহাবীদের মদীনার বাইরে যেতে নিষেধ করেছিলেন, যেন রাষ্ট্রীয় জটিল ব্যাপারে সময় মতো তাদের সাথে পরামর্শ করা যায়। রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনের কারণে যখন এ নিয়ন্ত্রণ আরোপ সংগত, তখন জাতীয় কল্যাণের দৃষ্টিতে ও তা অবশ্যই সংগত হবে।
ব্যক্তির ইজ্জত-আব্রু রক্ষা করা সরকারি দায়িত্ব
ব্যক্তি জীবন, দেহ ও সম্পত্তি রক্ষা করাই রাষ্ট্রর একমাত্র দায়িত্ব নয়। সেই সাথে ইজ্জত আব্রু রক্ষা করা এবং তা কারোর দ্বারা ক্ষুণ্ণ হলে তার প্রতি বিধান করা ও সরকারের দায়িত্ব। রাষ্ট্র সরকার নিজে কাউকে অকারনে অপমান করবেনা। কেননা মুসলিম মাত্রই সম্মানিত, তার সম্মান চির সংরক্ষিত হওয়াই বাঞ্ছনীয়। কুরআন মজীদে বলা হয়েছেঃ ইজ্জত সম্মান সবই আল্লাহ, রাসূল এবং সকল মু’মিনদের জন্য’ অতএব কেউ লজ্জিত বা অপমানিত হোক তা ইসলামী রাষ্ট্র কিছুতেই বরদাশত করতে পারে না। দ্বিতীয়তঃ ইসলামের রিসালাত উত্তরকালীন দায়িত্ব পালন করতে পারে কেবল মাত্র স্বাধীন সম্মানিত ও মর্যাদাবান মুসলমান। এজন্যে ইসলামী রাষ্ট্র জনগনকে ইজ্জত সম্মান ও মর্যাদার তাৎপর্য শিক্ষা দিতে চেষ্টা করবে এবং এ যে সব কাজে তা ব্যবহৃত ও ক্ষুণ্ণ হয় তার প্রতিরোধ করতে সর্ব শক্তি নিয়োগ করবে। হযরত ওমর ফারুক রা: তার শাসন কর্তাদের বলেছিলেনঃ
*****আরবী******
তোমরা মুসলিম জনগণকে অন্যায় ভাবে প্রহার করবে না, কেননা তাহলে তোমরা তাদেরকে অপমান করলে। ”
এ জন্য তিনি হজ্জের সময় সমবেত জনতার সামনে তাদের হাজির করতেন এবং লোকদের সামনে ভাষণ দিয়ে ঘোষণা করতেনঃ
*****আরবী******
“ হে জনতা আমি আমার শাসকবর্গকে তোমাদের উপর নিয়োগ করেছি এ জন্যে যে, তারা তোমাদের জানমাল ও ইজ্জতের উপর হস্তক্ষেপ করবে। বরং তাদের নিয়োগ করেছি এ উদ্দেশ্য যে, তারা তোমাদের পরস্পরের মধ্যে ইনসাফ কায়েম করবে, সরকারি ভাণ্ডার থেকে জাতীয় প্রয়োজনমত তোমাদের মাঝে বণ্টন করবে। এদের কেউ যদি এর বিপরীত কিছু করে থাকে তাহলে এ জনসমাবেশে তার বিরুদ্ধে আমার সামনে দাঁড়িয়ে ফরিয়াদ করো। তাবকাতে ইবনে সায়াদ, ৩য় খন্ড ২৯৩ পৃষ্ঠা।
অমুসলিম ব্যক্তিস্বাধীনতা
ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলমান নাগরিকদের জন্যেও র্পূণমাত্রায় ব্যক্তি স্বাধীনতা রক্ষিত থাকে। এ পর্যায় ইসলামী আইনবিদরা যে ফরমুলা ঠিক করেছেন তাহলোঃ
*****আরবী******
আমাদের জন্যে যেসব অধিকার ও সুযোগ সুবিধা তাদের জন্যে ও তাই এবং আমাদের উপর যেসব দায়িত্ব তাদের উপর ও তাই।
হযরত আলী রা: বলেন
*****আরবী******
অমুসলমান নাগরিকরা জিযিয়া কর আদায় করে এ উদ্দেশ্য যে তাদের ধন সম্পদ জান প্রাণ, মুসলিম নাগরিকদের মতই সংরক্ষিত হবে। আল মগনী ৮ম খন্ড ৪৪৫ পৃষ্ঠা.
বস্তুত ইসলামী শরীয়াত ভিত্তিক রাষ্ট্র অমুসলিমরা যে বিরাট অধিকারও সর্ববিদ যে সুযোগ সুবিধা লাভ করেছে, দুনিয়ার অপর কোনো আদর্শিক রাষ্ট্রও তার কোন তুলনা নাই। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সমাজতন্ত্র বিরোধী মানুষের অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় কি?সে খানে সুযোগ সুবিধা ও ব্যক্তি স্বাধীনতা তো দুরের কথা, সমাজতন্ত্র বিরোধী কোনো আদর্শে বিশ্বাসী মানুষের বেঁচে থাকার ও কোনো অধিকার নেই। অথচ ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলিম নাগরিক শুধু বেঁচেই থাকেনা, বেঁছে থাকে সবর্বিধ অধিকার ও লাভ করে। অমুসলিম নাগরিকদের জন্যে স্বয়ং আল্লাহ এবং তার রাসূলই নিরাপত্তার জিম্মাদার।
নবী করিম সঃ ঘোষণা করেছেনঃ
*****আরবী******
যে লোক ইসলামী রাষ্ট্রের অমুসলিম নাগরিককে কোনোরূপ কষ্ট দেবে, আমি নিজেই তার বিপক্ষে দাঁড়াবো এবং আমি যার বিরুদ্ধে দাঁড়াবো কিয়ামতের দিন তার বিরুদ্ধে আমি মামলা দায়ের করবো।
আল জামেউল সাগীর লিস সুয়ুতী, ২য় খন্ড ৪৭৩ পৃষ্ঠা
অমুসলিম নাগরিকদের সম্পর্কে নবী করিম স: যেসব অসিয়ত করেছেন তার ভিত্তিতে ইসলামী আইন পারদর্শীগণ স্পষ্ট করে বলেছেন যে, অমুসলিম নাগরিকদের নিরাপত্তা বিধান ওয়াজিব এবং এদের কোনরূপ কষ্ট দেয়া সম্পূর্ণ হারাম। ফকীহ কারাফী বলেছেনঃ অমুসলিম নাগরিককে যদি কেউ কষ্ট দেয়, একটি খারাপ কথাও বলে, তাদের অসাক্ষাতে তাদের ইজ্জতের উপর এক বিন্দু আক্রমণ ও কেউ করে কিংবা তাদের সাথে শত্রুতার ইন্ধন যোগায় তাহলে সে আল্লাহ এবং তার রাসুলের এবং দীন ইসলামের দায়িত্বকে লঙ্ঘন করলো।
আল্লামা ইবনে হাজার বলেছেনঃ এ ব্যাপারে ইসলামী আইনবিদদের ইজমা হয়ে গেছে যে, ইসলামী রাষ্ট্রের নিয়মিত অমুসলিম নাগরিকদেরকে হত্যা করার জন্যে যদি কোন বৈদেশিক শত্রু এগিয়ে আসে, তাহলে ইসলামী রাষ্ট্রের কর্তব্য হলো তার বিরুদ্ধে লড়াই করে তাকে হত্যা করা। আল ফারুক লিকিরাকি, ৩য় খন্ড, ১৪ পৃষ্ঠা।
আকীদা ও ইবাদতের স্বাধীনতা
ইসলাম কোনো লোককে ইসলামী আকীদা গ্রহনের জন্যে বলপূর্বক বাধ্য করে না। ইসলাম ধর্মমত গ্রহনে এবং পূজা উপাসনা ও আরাধনা করার ব্যাপারে কোনো জোর জবরদস্তি নেই। একথা কুরআন মজীদে স্পষ্ট ভাষায় বলা হয়েছে। এভাবেঃ লা ইকারা ফিদ্ দীন—দীন গ্রহন করানোর ব্যাপারে কোনো জোর জবরদস্তি করা চলবে না অন্য কথায় ইসলাম নিজে এ ব্যাপারে কোনোরূপ বল প্রয়োগ করতে প্রস্তুত নয়, বলপ্রয়োগ করাকে সমর্থন ও করে না ইসলাম ধর্ম প্রচারে বল প্রয়োগ নয়, শান্তি ও শৃঙ্খলা সহকারে প্রচারের মাধ্যমে মানুষের মন ও চিন্তার পরিবর্তন সাধনে বিশ্বাসী। এজন্যে ইসলাম দাওয়াতি কাজের ওপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করেছে। কুরআন মজীদে এরশাদ করা হয়েছেঃ
*****আরবী******
তোমরা তোমাদের আল্লাহর দিকে লোকদের দাওয়াত দাও। যুক্তিপূর্ণ কথাবার্তা ও উত্তম ওয়াজ নছিহতের মাধ্যমে এবং বিরোধীদের সাথে উত্তম পন্থায় মুকাবিলা করো। সূরা আন নাহলঃ১২৫
ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের ওপর ধর্মের ব্যাপারে জোর-জবরদস্তি করা সম্পর্কে কুরআন মাজীদে বলা হয়েছেঃ
*****আরবী******
দীন বা ধর্মের ব্যাপারে কোনোরূপ জোর-জবরদস্তি করা যেতে পারে না।কেননা প্রকৃত হেদায়াতের পথ ও আদর্শ কোন্টি এবং কোন্টি পথভ্রষ্টতা তা স্পষ্ট হয়ে গেছে।–সূরা আল বাকারাঃ ২৫৬
এ পর্যায়ে শরীয়তের নির্দিষ্ট ফর্মূলা হলোঃ
*****আরবী******
তাদের এবং তারা যা কিছু পালন করে তা ছেড়ে দিলাম।
অতএব অমুসলিমদের ধর্মীয় আকীদা-বিশ্বাস ও ইবাদাত-উপাসনার ব্যাপারে ইসলামী রাষ্ট্রের কিছুই করনীয় নেই।নবী করীম স. নাজরানবাসীদের সাথে সন্ধিচুক্তি করেছিলেন, তাতে লিখেছিলেনঃ
*****আরবী******
নাজরানবাসীরা এবং তাদের সঙ্গী-সাথীরা আল্লাহ ও তাঁর রসূল মুহাম্মদ স. এর নিরাপত্তা লাভ করবে, তাদের ধন-সম্পদে তাদের গীর্জা ও উপাসনাগারে এবং আর যা কিছু তাদের রয়েছে সে ব্যাপারে।– কিতাবুল খারাজ, আবু ইউসুফ, ৯১ পৃষ্ঠা।
এরপর ইসলামী রাষ্ট্রের অধীন হওয়া সত্ত্বেও খৃষ্টান ও অন্যান্য বিধর্মীরা তাদের ধর্মীয় ব্যাপারে পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করেছে।তারা রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বা মুসলিম জনগণের পক্ষ থেকে কোনোরূপ ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি।কোনো অপকারিতাই তাদের স্পর্শ করেনি এবং তারা পূর্ণ স্বাধীনতা সহকারে তাদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি পালন করতে পেরেছে।
বস্তুত ব্যক্তির আকীদা-বিশ্বাসের ক্ষেত্রে ইসলামী আইনে যতখানি আযাদী ভোগ করার সুযোগ রয়েছে, তত সুযোগ দুনিয়ার অন্য কোনো আইনে স্বীকৃত হয়নি।ইমাম শাফেয়ী র. বলেছেন, স্বামী-স্ত্রী একজন যদি মুসলিম এবং অপরজন খৃষ্টান হয়, তাহলে ইসলামী শরীয়ত তাতে কোনো বাদ সাধবে না।কেননা তা যদি করা হয়, তাহলে ব্যক্তির ধর্মীয় স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ করা হয়।অথচ কুরআনের স্পষ্ট ঘোষণা হলো, অমুসলিমের ব্যক্তিগত ও ধর্মীয় ব্যাপারে কোনোরূপ হস্তক্ষেপ বা জোর-জবরদস্তি করা হবে না। -শারহুল কানজ, ২য় খণ্ড, ১৭৪ পৃষ্ঠা।
তবে এ পর্যায়ে মুরতাদকে শাস্তিদানের ইসলামী ব্যবস্থা নিয়ে কোনোরূপ ভুল ধারণার সৃস্টি হওয়া উচিত নয়।কেনা, সেটা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ব্যাপার।একজন মুসলিম নাগরিক যদি মুসলিম থাকার পর ইসলামী রাষ্ট্রে ইসলাম ত্যাগ করে ভিন্ন ধর্ম গ্রহণ করে তাহলে তাকে মুরতাদ বলা হয়।ইসলামী রাষ্ট্রে তাকে কঠোর শাস্তি দেবে।কেনান, সে যখন নিজেকে একবার মুসলিম বলে ঘোষণা দিয়েছে, তখন তাকে মুসলিম হয়েই ইসলামী রাষ্ট্রে বাস করতে হবে।যদি সে তা না করে তাহলে সে ইসলামী রাষ্ট্রেরই ক্ষতি সাধন করে।আর দুনিয়ার কোনো রাষ্ট্রেই কোনো নাগরিকের রাষ্ট্রের এরূফ ক্ষতি বরদাশত করতে প্রস্তুত হতে পারে না বরং এটা অতীব যু্ক্তিসংগত কথা।
বাসস্থানের স্বাধীনতা
ইসলামী রাষ্ট্রে প্রত্যেকটি নাগরিকই তার বাসস্থানের স্থান গ্রহনের ব্যাপারে পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করে। তার অনুমতি ও সন্তোষ ছাড়া কেউই তার ঘরে প্রবেশ করার অধিকার পেতে পারে না। কেন না বসবাসের স্থান হলো ব্যক্তির নিজস্ব গোপন এলাকা। এখানে তার সাথে স্ত্রী ও পরিবারবর্গ বাস করে। কাজেই এখানে যদি কেউ অপরের কারো ঘরে ও বসবাসের স্থানে বিনা অনুমতিতে প্রবেশ করে, তাহলে তা হবে তার অনধিকার চর্চা। আর ইসলামী রাষ্ট্রে কাউকে কারোর উপর অনধিকার চর্চার অধিকার দেওয়া যেতে পারে না। কুরআন মজীদে এজন্যে স্পষ্ট নিষেধ বাণী উচ্চারিত হয়েছে ওজস্বিনী ভাষায়ঃ
*****আরবী******
“ হে ঈমানদার লোকেরা ! তোমরা অপর লোকদের ঘরে প্রবেশ করো না, যতক্ষণ না সে ঘরের লোকদের কাছ থেকে অনুমতি পাবে ও তাদের প্রতি সালাম করবে। তোমরা যদি বুঝতে পারো তবে এ নীতিই তোমাদের জন্য কল্যাণকর। তোমরা সে ঘরে যদি কাউকে বর্তমান না পাও, তাহলে সে খানে তোমরা প্রবেশ করবে না। যতক্ষণ না অনুমতি দেয়া না হবে। আর যদি তোমাদের পিরে যেতে বলে তাহলে তোমরা ফিরেই যাবে। এ ফিরে যাওয়াই তোমাদের জন্যে পবিত্রতার নীতি। জেনে রাখবে তোমরা যা কিছু করো, সে বিষয়ে আল্লাহ খুব ভালোভাবেই অবহিত রয়েছেন। সূরা আন নুরঃ ২৭-২৮