কর্মের স্বাধীনতা
“শরীয়ত সম্মত যে কোনো কাজই ইসলামে সম্মানার্হ। অতএব ব্যক্তিকে শরীয়ত সম্মত যে কোন কাজ করার পূর্ণ স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে ইসলামে। হাদীসে স্পষ্ট করে বলা হয়েছেঃ
*****আরবী******
“ব্যক্তি তার নিজের শ্রমে উপার্জিত যে খাদ্য খায়, তার চেয়ে উত্তম খাওয়া আর কিছু হতে পারে না। আল্লাহর নবী হযরত দাউদ আঃ নিজের শ্রমে অর্জিত খাদ্য খেতেন। ”
অতএব ইসলামী রাষ্ট্রে প্রত্যেক ব্যক্তিকে ব্যবসায়, শিল্পে ও কৃষি প্রভৃতি বিভিন্ন উপার্জন কাজে শুধু স্বাধীনতাই দেয়া হয় না, সে জন্যে রীতিমতো উৎসাহিতও করা হয়। তবে শরীয়ত বিরোধী কোন কাজের সুযোগ দেয়া হয় না ইসলামী রাষ্ট্রে। কেননা সেরূপ কাজ করা হলে হয় তাতে অপরের প্রতি যুলুম করা হবে, না হয় তা নৈতিকতা বিরোধী কাজ হবে। আর এ ধরনের কাজে যে সমাজের সাধারণ মানুষেরই ক্ষতি সাধিত হয়, তবে কোন সন্দেহ নেই। এভাবে ব্যক্তি যদি শরীয়ত সম্মত কোনো কাজে ব্যতীত হয় তাহলে ইসলামী রাষ্ট্র তার সাথে পূর্ণ সহযোগিতা করবে এবং সে কাজের ফলাফল সে-ই ভোগ করবে। কেননা প্রত্যেকেরই নিজের শ্রমের ফল ভোগ করার অধিকার রয়েছে। আল্লাহ কোন আমলকারীর আমলের ফল নষ্ট করেন না-সে আমল বৈষয়িক উপার্জন সংক্রান্ত হোক কি পরকালীন, তা কুরআনেরই ঘোষণা:
তবে তার মানে নিশ্চয়ই এই নয় যে, ইসলামে প্রত্যেক ব্যক্তিকে এমন নিরঙ্কুশ স্বাধীনতাই দেয়া হয়েছে যে, কাউকে কোন কাজের জন্যে কৈফিয়ত ও জিজ্ঞেস করা হবে না। যেমন সরকারী কর্মচারীরা যদি সরকারি দায়িত্বে নিযুক্ত থাকা অবস্থায় উপার্জন সংক্রান্ত অন্য কোন কাজ করে তবে সে অধিকার কাউকে দেয়া যেতে পাওে না। এ কারনেই হযরত উমর ফারুক রা: তাঁর নিয়োগকৃত সরকারী কর্মচারীদেরও ধন-সম্পদেও হিসাব নেয়ার ব্যবস্থা করে ছিলেন। এদের একজন যখন বললো:
*****আরবী******
“আমি ব্যবসা করেছি এবং তাতে মুনাফা হয়েছে, এতে কার কি বলার থাকতে পারে?”
জবাবে হযরত ওমর বলেছিলেনঃ
*****আরবী******
“আমিতো তোমাকে ব্যবসায়ের জন্যে নিযুক্ত করিনি” মাআরেমুশ শারহিল ইসলামী, অহমদ যারকা।
ব্যক্তি যে কাজ যতক্ষণ করতে চাইবে সে ততক্ষণই করবে এবং যখন সে কাজ ত্যাগ করার ইচ্ছা করবে, তখনই সে তা ত্যাগ করতে ও পারবে। কিন্তু এ অধিকার এ শর্তের অধীনে যে, তাঁর এ কাজ ত্যাগ করায় অপর কারোরই যেন এক বিন্দু ক্ষতি সাধিত না হয়। এজন্যে ইসলামী আইনবিদরা বলেছেনঃ
*****আরবী******
“সর্বসাধারণের জন্যে জরুরী ও অপরিহার্য শিল্প ও ব্যবসায়ের কাজে তৎসংশ্লিষ্ট কর্মচারীদেরও বাধ্য করার পূর্ণ অধিকার রয়েছে রাষ্ট্র সরকারের এবং সে জন্যে তাদের ন্যায্য মজুরী দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। আত তুরুকুল হুকমীয়াতু ইবনে কায়েম।
এ কারণে এসব ক্ষেত্রে কর্মচারীদেরও সাধারণ ধর্মঘট করার কোন অধিকারই ইসলামী রাষ্ট্রের দেয়া যেতে পাওে না। কেননা, তার ফলে সাধারণ জন মানুষের জীবন কঠিন বিপর্যয় নেমে আশার আশংকা রয়েছে। তবে তারা কাজ উপযোগী ন্যায্য মজুরীর দাবী জানাতে পাওে ও সে জন্যে নিয়মতান্ত্রিক চাপ সৃষ্টি করতে পারে। আর রাষ্ট্র তাদেও কাজ অনুপাতে ন্যায্য মজুরী নির্দিষ্ট করে দিতে বাধ্য। কেননা সর্ব পর্যায়ে ইনসাফ কায়েম করাই রাষ্ট্রের দায়িত্ব। আর শ্রমিকদের জন্যে ন্যায্য মজুরীর ব্যবস্থা রাষ্ট্রীয় ইনসাফেরই অন্তর্ভুক্ত কাজ এরূপ মজুরী দিতে মালিক পক্ষ যদি অস্বীকৃতি জানায়, তাহলে রাষ্ট্র তাতে হস্তক্ষেপ করবে এবং মজুরী দানের ক্ষেত্রে পূর্ণ ইনসাফ প্রতিষ্ঠিত করবে। তাহলে এর ফলে না শ্রমিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে না মালিক পক্ষ। বরং এর ফলে সামাজিক সাম্য ও শান্তি স্থাপিত হবে।
ব্যক্তিগত মালিকানা রাখার অধিকার
ইসলামী শরীয়ত ব্যক্তিকে ব্যক্তিগত মালিকানা রাখার অধিকার দিছে। অতএব ইসলামী রাষ্ট্রে কোনো ব্যক্তির ব্যক্তিগত মালিকানার ওপর অন্যায় ভাবে হস্তক্ষেপ করা চলবে না। বরং তা রক্ষা করার দায়িত্বই পালন করতে হবে রাষ্ট্রকে। যদি কেউ তার ওপর হস্তক্ষেপ করে তবে তার প্রতিরোধেও জন্যে সরকারকে অবিলম্বে এগিয়ে আসতে হবে। অপরাধীকে উপযুক্ত শাস্তি দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
ইসলামে ব্যক্তিগত মালিকানা স্বীকৃত এবং মালিক তার মালিকানা ভোগ ব্যবহার করার অবাধ অধিকারই লাভ করে থাকে। তবে তা শর্তহীন ও নিরঙ্কুশ নয়। সে জন্যে কতগুলো জরুরী ও অপরিহার্য শর্ত পালন করতে হবে। এ শর্ত গুলো মালিকানা লাভ, বৃদ্ধিসাধন ও তাঁর ব্যয় ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে আরোপিত এবং যেসব দিক দিয়ে তা অন্য মানুষের সাথে সংশ্লিষ্ট সে সব দিক দিয়ে তা অবশ্যই লক্ষণীয়।
সাধারণ প্রচলিত কাজ ও শ্রমের পরিণামে অর্জিত সম্পদ, মীরাস সূত্রে প্রাপ্ত ও পারস্পরিক লেনদেন ও চুক্তি ব্যবসায়ের মাধ্যমে অর্জিত ধন ঐশ্বর্যে ব্যক্তিগত মালিকানা ইসলামী শরীয়তে বৈধ মালিকানা রূপে স্বীকৃত। কিন্তু তাতে যদি চুরি, লুটতরাজ, জুয়া মাত্রাতিরিক্ত মূল্য গ্রহন, ঘুস ও সুদ ইত্যাদি ধরনের কোন আয় জড়িত হয়, তবে তা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। অতএব শরীয়তের দৃষ্টিতে কারোর মালিকানা বৈধ প্রমাণিত হলে তার ব্যয় ও ব্যবহারের অধিকার ও নিঃসন্দেহে স্বীকৃত হবে এবং তা সে শরীয়ত সম্মত পথে নিয়োগ করে তার পরিমাণ বৃদ্ধি করতে পারবে। ধোঁকা-প্রতারণা, সুদী কারবার, মওজুদ করণ ও অতিরিক্ত মূল্য গ্রহনের মাধ্যমে সম্পদ ও সম্পত্তির পরিমাণ বৃদ্ধি করার অধিকার কারোর নেই। তা কেউ করলে সরকারে বাজেয়াপ্ত হবে।
শরীয়তের ব্যক্তি মালিকানা স্বীকৃত হওয়া সত্ত্বেও জাতীয় প্রয়োজনে শরীয়তের কল্যাণ দৃষ্টিতে ন্যায্য মূল্যের বিনিময়ে ব্যক্তি মালিকানা হরণ ও করা যেতে পারে।
ব্যক্তি মালিকানার উপর ইসলামী শরীয়ত অনেকগুলো শর্ত ও অধিকার ধার্য করেছে। যে লোকই ব্যক্তি মালিকানার অধিকারী তাকে এসব শর্ত পূরণ এবং অধিকার আদায় করতে প্রস্তুত থাকতে হবে। এ শর্ত গুলোর মধ্যে মোটামুটি উল্লেখযোগ্য হলো (১) নিকটাত্মীয়ের অধিকার আদায়, (২) যাকাত দান ও (৩) অভাবগ্রস্তদের সাহায্য করা। অভাবগ্রস্ত ও দরিদ্রজনের সাহায্য দান করার কাজটি অপরিহার্য হবে তখন, যদি যাকাত ফান্ড ও সরকারী ব্যবস্থাপনা তাদের অভাব মেটাতে ও প্রয়োজন পূরণ যথেষ্ট না হয় এবং রাষ্ট্রের বায়তুলমাল এ কাজে সম্পূর্ণ অক্ষম হয়ে পড়ে।
মত প্রকাশের স্বাধীনতা
ইসলামী রাষ্ট্রে ব্যক্তির মত পোষণ ও প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়। এ অধিকার হরণ করার এবং এ থেকে জনগনকে বঞ্চিত করার অধিকার কারো নেই। বস্তুত ব্যক্তির চিন্তা ও মানসিক প্রতিভার স্ফুরণের জন্যে ব্যক্তির মতের স্বাধীনতা থাকা একান্তই অপরিহার্য। এ না থাকলে মুসলমানরা তাদের দ্বীনি দায়িত্ব কর্তব্য ও পালন করতে পারে না। ন্যায়ের আদেশ ও অন্যায়ের প্রতিরোধ তো মুসলিম মাত্ররই কর্তব্য। আর চিন্তা ও মতের স্বাধীনতা থাকলেই এ কাজ বাস্তবায়িত হতে পারে। কুরআন মাজীদে এ জিনিষের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। এবং এ কাজকে মানুষের ঈমানের সাথে সংশ্লিষ্ট করে দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছেঃ
*****আরবী******
“ কালের শপথ মানুষ মাত্রই ধ্বংসের মুখে উপস্থিত। তবে যারা ঈমান এনেছে, নেক আমল করেছে এবং সত্য ও ধৈর্যাবলম্বনের জন্যে উপদেশ দেবে-তারা এ থেকে বাচতে পারবে। ” সূরা আল আসরঃ১-৩
বলা হয়েছেঃ
*****আরবী******
“ মু’মিন পুরুষ ও মু’মিন স্ত্রী পরস্পর বন্ধু। তারা ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা ও অন্যায়ের প্রতিরোধ ব্রতে ব্রতী হয়ে থাকে। ”-সুরা আত তওবাঃ৭১
আর এক আয়াতে ইরশাদ হয়েছেঃ
*****আরবী******
“ তোমাদের মধ্যে থেকে একটি সুসংহত বাহিনী এমন বের করতে হবে, যারা কল্যাণের দিকে আহবান জানাবে, ন্যায়ের আদেশ করবে ও অন্যায়ের প্রতিরোধ করবে। ” সূরা আল ইমরাণঃ১৪
হাদিসে রাসূলে করীম স: এর স্পষ্ট ঘোষণা ও উদ্বৃত্ত হয়েছে এ পর্যায়েঃ
*****আরবী******
“ তোমাদের মাঝে যে লোক কোন অন্যায় দেখতে পাবে সে যেন তা তার শক্তি দিয়ে প্রতিহত করে, শক্তি না থাকলে মুখে যেন তার বিরুদ্ধে কথা বলে। আর মুখে বলার মতো অবস্থা না হলে অনন্ত মনে মনেও যেন তার প্রতি ঘৃণা পোষণ করে। যদি ও এ অত্যন্ত দুর্বল ঈমানের পরিচয়।
শাসন কর্তৃপক্ষের ওপর তীব্র-তীক্ষ্ণ সজাগ দৃষ্টি রাখা এবং তাদের কোনো ত্রুটি গোচরীভূত হলে তার প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ করা প্রত্যেকটি নাগরিকেরই কর্তব্য। আর এসব কাজ সম্ভব হতে পারে ঠিক তখন যদি ব্যক্তির মত পোষণ ও প্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা স্বীকৃত থাকে।
পারস্পরিক পরামর্শ বিধান এ কাজে যে মতবিরোধ হয় এবং শেষ পর্যন্ত একটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়, তাতে ও চিন্তা ও মতের স্বাধীনতা অপরিহার্য, বরং তা না থাকলে পারস্পরিক পরামর্শের ইসলামী বিধান কার্যকরই হতে পারে না।
“এ সব কারণে ইসলামী রাষ্ট্রে ব্যক্তিদের নিজস্ব চিন্তা ও মতের স্বাধীনতাকে পূর্ণ গুরুত্ব সহকারে রক্ষা করা হয়। ব্যক্তির অনুরূপ পরিবেশ দিয়ে লালন ও প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এবং শাসন কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে জনগনকে সব সময়ই উৎসাহ দান করে থাকে। কেউ যদি এ অধিকার ভোগ না করে তাহলে বরং তাদের কড়া শাসন করা হয়। এ পর্যায়ে ঐতিহাসিক ঘটনার কোন শেষ নেই। হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব রা: কে লক্ষ্য করে একব্যক্তি বললো ‘ হে ওমর তুমি আল্লাহকে ভয় কর। তখন ওমর রা: বললেন, হ্যাঁ, আমাকে তাই বলবে। না বললে বরং তোমরা কোনো কল্যাণ লাভ করতে পারবেনা। আর আমরাও কোনো কল্যাণ লাভ করতে পারবো না, যদি তা না শুনি।”
তবে ব্যক্তি স্বাধীন মত পোষণ ও প্রকাশের শুধু সুযোগ থাকাই যথেষ্ট নয় বরং এ জন্যে তাদের মাঝে প্রবল মনোবল, সৎ সাহস, ও বীরত্ব বর্তমান থাকা আবশ্যক। শাসকদের ব্যাপারে তাদের সম্পূর্ণ নির্ভীক হতে হবে, তবেই তারা এ সুযোগের পুরোমাত্রায় সদ্ব্যবহার করতে পারবে। কেননা ভয়, ত্রাস ও শঙ্কা মানুষকে তার স্বাধীন মত প্রকাশ থেকে বিরত রাখে, সুযোগ হলেও কোনো কথাই বলতে দেয়া হয় না। আর কোনো জাতি যদি এমনি ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে তা হলে সে জাতির ধ্বংস অনিবার্য। সে জাতি আল্লাহর রহমত থেকেও বঞ্চিত হয়। এ জন্য নবী করিম সা: ইরশাদ করেছেনঃ
*****আরবী******
“ তুমি যখন আমার উম্মতকে দেখবে যে, সে যালেমকে যালেম বলতে ভয় পায়, তখন তুমি তার কাছ থেকে বিদায় নিবে। ”
আর মুসলমানদের মনোবল, সাহস, হিম্মত ও বীরত্বের মূল উৎস হচ্ছে তাদের তাওহীদি আকিদা। এ আকিদা যদি তাদের মনে বদ্ধমূল হয় এবং তারা গভীর ভাবে এর তাৎপর্য অনুধাবন করতে পারে, তাহলে তাদের মনে জাগবে সাহস ও বীরত্ব। মুসলমানদের এ কথাই বুঝতে হবে যে, ক্ষতি এবং উপকার সম্পূর্ণ আল্লাহর হাতে নিবন্ধ, অন্য সবই আল্লাহর দাসানুদাস মাত্র, রাষ্ট্রপ্রধান ও অন্যান্য সরকারী কর্মচারী সকলে আল্লাহরই সৃষ্ট, আল্লাহর কাছে তাদের ও হিসাব দিতে হবে। তাহলেই তারা স্পষ্ট ভাষায় নিজেদের মত প্রকাশ করার সাহস পাবে এবং এ ব্যাপারে তরা কাউকে ভয় পাবে না।
ব্যক্তির মত প্রকাশের স্বাধীনতার সীমা
অবশ্য একথা মনে রাখতে হবে যে, ব্যক্তির মত পোষণও প্রকাশের স্বাধীনতা নিরঙ্কুশ ও উৎশৃঙ্খল হতে পারে না। বরং সে জন্যে কিছু শর্ত কিছু কিছু নিয়ম-নীতি অবশ্যই রয়েছে। তার আসল শর্ত হলো তার মূলে সদিচ্ছা নিহিত থাকতে হবে। কল্যাণের উদ্দেশ্যই এ অধিকার প্রয়োগ করতে হবে। আর আল্লাহকে সন্তুষ্ট করাই হতে হবে তার চরম লক্ষ্য। মত প্রকাশের এ স্বাধীনতা থেকে সামগ্রিক কল্যাণ লাভ করাই উদ্দেশ্য হতে হবে। আর এ শর্ত ইসলাম প্রদত্ত অপরাপর অধিকার ভোগের মতোই অত্যন্ত যুক্তিসংগত। দ্বিতীয় শর্ত এইযে, ব্যক্তিগত মত প্রকাশ করে নিজের বীরত্ব ও বাহাদুরি জাহির করা চলবে না। চলবে না তা করে অন্যকে হীন প্রমাণ করার চেষ্টা করা। কিংবা অপর কোনো বৈষয়িক স্বার্থ লাভ করার চেষ্টা করা।
তৃতীয় শর্ত এইযে, এ অধিকার ভোগ করার সময় ইসলামের মৌলিক আকীদা ও ইসলামের সামাজিক প্রয়োজনীয়তা বৈধতার বিরোধীতা করা চলবে না। ইসলামী আকীদা –বিশ্বাস ও জীবনাদর্শের সমালোচনা করা চলবে না এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতার দোহাই দিয়ে ইসলামী আদর্শের কোনো দোষ প্রচার করার অধিকার কাউকে দেয়া যেতে পারে না। কেন না এ কাজ মুসলমানকে মুরতাদ বানিয়ে দেয়, সে জন্যে তার শাস্তি হওয়াই বিধেয়। আর চতুর্থ শর্ত এই যে ইসলামের নৈতিক নিয়ম-নীতিকে পূর্ণ মাত্রায় বহাল রাখতে হবে তাকে লঙ্ঘন করা চলবে না। কেউ কাউ গালাগাল করতে পারবে না, মিথ্যা দোষারোপ করতে পারবে না কেউ কারো ওপর। কেননা, সেরূপ করার স্বাধীনতা দেয়ার মানে মত প্রকাশের স্বাধীনতা নয়। এ পর্যায়ে এ কথাও মনে রাখতে হবে যে, রাষ্ট্র, সরকার ও সরকারী দায়িত্বশীল কর্মচারীদের কাজকর্ম ও চরিত্রে কোনোরূপ অন্যায় দেখতে পেলে তার বিরুদ্ধে কথা বলার ও পূর্ণ স্বাধীনতা রয়েছে প্রত্যেকটি নাগরিকের। কিন্তু তাই বলে তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রহাত্মাক কথা বলার অধিকার কাউকে দেয়া যেতে পারে না। বিপরীত মতাদর্শের সাথে মতবিরোধ করার অধিকার রয়েছে তার সমালোচনা ও দোষ-ত্রুটি বর্ণনা করা ও যেতে পারে। কিন্তু কারোর সভা-সম্মেলনে গোলযোগ করার অধিকার কারোর থাকতে পারে না। আর যতক্ষণ কেউ বিপরীত মতপোষন করা সত্ত্বে ও কোনোরূপ অশান্তিকর অবস্থার সৃষ্টি না করবে। ততক্ষণ সরকার ও তার বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ গ্রহন করবে না। ব্যক্তিগত মত পোষণ ও প্রকাশের এই হলো সীমা নির্দেশ। এ সীমা রক্ষা করাই সকল শ্রেণীর নাগরিকদের কর্তব্য। এ পর্যায়ে ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত হলো, হযরত আলী রা: এর খেলাফত আমলে বিরোধী মতাবলম্বী খাওয়ারিজদের প্রতি তাঁর গৃহীত নীতি। তাদের লক্ষ করে খলীফা বলেছিলেনঃ
*****আরবী******
“ তোমরা যতক্ষণ পর্যন্ত কোনোরূপ অশান্তি ও বিপর্যয় সৃষ্টি না করবে ততক্ষণ তোমাদের বিরুদ্ধে আমরা লড়াই শুরু করবো না। ” নাইলুল আওতার, ৭ম খন্ড ১৫৭ পৃষ্ঠা
বস্তুত বিরোধী মতাবলম্বীরা যতক্ষণ জনগনকে তাদের মত গ্রহনে বলপূর্বক বাদ্য করেত না চাইবে, ততক্ষণ ইসলামী রাষ্ট্র তাদের বিরুদ্ধে কোনো কঠোর দমন নীতি গ্রহন করবে না ততক্ষণ পর্যন্ত সরকারের কর্তব্য হলো তাদের বুঝানো, ভালো শিক্ষাদানে উপদেশ –নসিহতের মাধ্যমে তাদের মনের পরিবর্তন করতে চেষ্টা করা। খাওয়ারিজদের সম্পর্কে এ নীতিই গৃহীত হয়েছিল। বলা হয়েছে, তারা ইনসাফ পূর্ণ সমাজে বসবাস করা সত্বেও যদি তাদের মতাদর্শ নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি করে, তাহলে রাষ্ট্রর কর্তব্য হলো তাদের মতাদর্শের দোষ-ত্রুটি ও মারাত্মকতা লোকদের সামনে সুস্পষ্ট করে তুলে ধরা। তাহলে তারা সে ভুল মত ত্যাগ করে সত্য ও নির্ভুল মতাদর্শ গ্রহন করে সমাজের সাথে শান্তিতে বসবাস করতে পারবে। ইমতাউল আসমা, ১১০ পৃষ্ঠা
শিক্ষাখাতের অধিকার
ইসলামে জ্ঞান ও শিক্ষার এবং জ্ঞানী ও শিক্ষিত লোকদের মর্যাদা সর্বোচ্চ। ইসলাম মানুষকে জ্ঞান লাভের জন্যে তৎপর হতে, জ্ঞান বৃদ্ধির জন্যে চেষ্টা করতে ও সে জন্যে আল্লাহর কাছে দোয়া করতে নির্দেশ দিয়েছে। কুরআন মাজীদে ইরশাদ করা হয়েছেঃ
*****আরবী******
“ তুমি বলো হে, আল্লাহ আমার জ্ঞান ও বিদ্যা বাড়িয়ে দাও। ”
আর আমল কবুল হওয়ার জন্যে ইলম তো একান্তেই জরুরী। কেননা সে কেবল আল্লাহর কাছে কবুল হতে পারে, যা হবে খালেস ভাবে কেবল মাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্য, যা হবে শরীয়তের বিধান মোতাবেক নির্ভুল ও সঠিক। আর ইলম জ্ঞান ও বিদ্যা ছাড়া এরূপ হওয়া সম্ভব নয়।
ইলম ও কয়েক প্রকারের রয়েছে। কিছু ইলম তো অর্জন করাতো ‘ফরজে আইন’। যেমন আকীদা ও ইবাদত সংক্রান্ত ইলম। আর কতক রয়েছে ‘ফরযে কেফায়া’। এ জ্ঞান সাধারণ ভাবে সমাজ ও জাতির লোকদের কারো মধ্যে থাকলেই হলো। মানুষের দ্বীনের বিস্তারিত রূপ, শিল্প ব্যবসায়-বাণিজ্যে, রাষ্ট্র শাসন বিধি, আইন কানুন ইত্যাদি সংক্রান্ত জ্ঞান এ পর্যায়ে গণ্য। এসব বিষয়ে জ্ঞান অর্জনও জরুরী বটে, এবং রাষ্ট্রের কর্তব্য হলো জনগণের প্রতিনিধি হিসাবে জনগণের মধ্যে এ সব জ্ঞান বিস্তারের জন্যে সুষ্ঠু ব্যবস্থা গ্রহন করা। নবী করিম স: এর কর্ম পদ্ধতি থেকে এ পর্যায়ে সরকারী দায়িত্বের কথা স্পষ্ট হয়ে উঠে। বদর যুদ্ধে যেসব কুরাইশ বন্দী হয়েছিল তাদের মুক্তিপণ হিসাবে ঠিক করে দেয়া হয়েছিল, প্রত্যেক লেখাপড়া যানা বন্ধী অন্তত দশজন মুসলমানকে লেখাপড়া শেখাবে কেন না তখন মুসলমানদের মধ্যে লেখাপড়া জানা লোকদের সংখ্যা অত্যন্ত কম ছিল। রাসূলে করীম সা: রাষ্ট্রপ্রধান হিসাবে লোকদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের উদ্দেশ্য এরূপ ব্যবস্থা গ্রহন করার প্রয়োজনবোধ করেছিলেন।
ভরণ-পোষণের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা লাভের অধিকার
ইসলামী রাষ্ট্রের প্রত্যেক নাগরিকই খাদ্য পানিয় বস্ত্র-বাসস্থানের নিরাপত্তা লাভের অধিকারী। কোনো নাগরিকই এসব মৌলিক প্রয়োজনীয় জিনিস থেকে বঞ্চিত থাকতে পারে না। যে লোক নিজের সামর্থ্যে স্বীয় প্রয়োজন পূরণে সামর্থ্য হবে নামাজ ও রাষ্ট্র তার সে প্রয়োজন পূরণের জন্যে দায়ী। এসব মৌলিক প্রয়োজন থেকে বঞ্চিত হয়ে থাকতে কেউ বাধ্য হয় না ইসলামী রাষ্ট্রে।
ইসলামী রাষ্ট্রের এরূপ নিরাপত্তা ব্যবস্থার মূল ভিত্তি হলো এই য, ইসলামী সমাজই হলো পারস্পরিক সাহায্য ভিত্তিক সমাজ। সমাজের প্রত্যেকেই প্রত্যকের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসতে প্রস্তুত। কেননা মুসলমানদের প্রতি আল্লাহর নির্দেশ হলোঃ
*****আরবী******
“ তোমরা সবাই পরস্পরের সাহায্যে কাজে এগিয়ে নেক কাজ ও তাকওয়া সংক্রান্ত বিষয়াদিতে এবং গুনাহের কাজ ও আল্লাহদ্রোহিতায় কোনোরূপ সাহায্য করোনা কারোর। ”
আর অভাব গ্রস্ত ব্যক্তির অভাব মোচনের চেয়ে বড় নেক কাজ কি হতে পারে!পারস্পরিক সাহায্য সংক্রান্ত কাজের মধ্যে উল্লেখযোগ্য দিক হলো, সচ্ছল অবস্থার লোকেরা অভাবগ্রস্ত ও গরীব লোকদের সাহায্য করবে। তাতে তাঁর মৌলিক প্রয়োজন পূরণ হবে নবী করীম স: ইরশাদ করেছেন:
*****আরবী******
“ যার খাবার বেশি আছে সে তাকে তা দেবে, যার খাবার নেই। আর যার পাথেয় বেশি আছে সে তা সেই পথিকে দিবে যার পথের সম্বল নেই। ” আনমাহাল, ইবনে হময ৬ষ্ছ খন্ড ১৫৬ পৃষ্ঠা।
অপর এক হাদিসে বলা হয়েছে:
*****আরবী******
“ যার কাছে দু’জনার খাবার আছে, সে যেন তিন জনকে খাওয়ায়। আর যার কাছে চার জনের খওয়ার আছে, সে যেন পাঁচ জন কিংবা ছয়জনকে খাওয়ায়। ” অনমহাল ২য় খন্ড ৫৭ পৃষ্ঠা।
বস্তুত রাষ্ট্র হলো সমাজ সমষ্ট্রির প্রতিভূ, সমাজের লোকদের প্রতিনিধি। কাজেই এই হাদিসের মূল প্রতিপাদ্য অনুযায়ী আমল করা সমাজ- সমষ্ট্রির পক্ষ থেকে রাষ্ট্র- সরকারেরই দায়িত্ব। অতএব একথা প্রমাণিত যে ইসলামী রাষ্ট্র দেশের সমস্ত অভাব গ্রস্ত ও দরিদ্র জনগণের অভাব মেটানোর জন্যে দায়িত্বশীল। এ পর্যায়ে আরো একটি হাদিস উল্লেখ্য। তাতে সরকারের এ দায়িত্ব কথাই প্রমাণিত হয়। বলা হয়েছে:
*****আরবী******
“ যে মু’মিন মরে যাবে ও ধন সম্পদ রেখে যাবে, তার নিকটাত্মীয়রাই তার ওয়ারিশ হবে। আর যে মু’মিন ণ রেখে বা অক্ষম সন্তান রেখে যাবে, তাদের দায়িত্ব আমার উপর বর্তাবে, আমিই তাদের অভিভাবক হবো। ” নবী কারীম সা: এ দায়িত্ব পালন করতেন ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্র প্রধান হিসাবে, রাষ্ট্রীয় বায়তুলমাল থেকে, নিজের সম্পত্তি থেকে নয়। কাজেই এ দায়িত্ব সুস্পষ্টরূপে প্রমাণিত হলো।
সহীহ হাদিসে বর্ণিত হয়েছে:
*****আরবী******
“ তোমরা প্রত্যেকেই অপরের জন্যে দায়ী এবং তোমাদের প্রত্যেককেই তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। অতএব জনগণের রাষ্ট্রপ্রধান জনগণের জন্যে দায়ী, তাকে জনগণের জন্যে জবাবদিহি করতে হবে। ”
এ হাদিসের ব্যাখ্যায় ইমাম নববী লিখেছেন: “ এ হাদিসে দায়িত্বশীল বলে এ কথা বুজানো হয়েছে যে, প্রত্যেক ব্যক্তিকেই তাঁর অধীন যাবতীয় বিষয়ে দেখাশুনা করা, তাদের যাবতীয় প্রয়োজন পূরণ করা এবং দীন ও দুনিয়ার দিক দিয়ে তাদের পক্ষে কল্যাণ কর যাবতীয় বিষয়ে ইনসাফ করার দায়িত্ব পালন করতে হবে। ” আর জনগণের বৈষয়িক কল্যাণ হচ্ছে তাদের যাবতীয় বৈষয়িক প্রয়োজন পূরণ করে দেয়া, যদি তারা নিজেরা তা পূরণ করতে অক্ষম হয়ে পড়ে। এ প্রয়োজন পূরণ হলেই মুমিনদের আল্লাহর বন্দেগী সংক্রান্ত দায়িত্ব পালনও সহজ হতে পারে। কেননা, একথা সর্বজনবিদিত যে, যারা তাদের বৈষয়িক প্রয়োজন পূরণে অক্ষম, তারা সে চিন্তায় এমন কাতর হয়ে পড়ে যে, তারা আল্লাহর বন্দেগীর কাজ যথাযথভাবে সম্পন্ন করতে সক্ষম হয় না।
ব্যক্তির অধিকার আদায়ে শরীয়তের বিধান
ব্যক্তি অধিকার আদায় করার জন্যে ইসলামী শরীয়তে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহন করা হয়েছে। এ ব্যবস্থা বাস্তবায়িত করা ইসলামী রাষ্ট্রের দায়িত্ব। ইসলামী রাষ্ট্র এ ব্যাপারে জনগণকে সাধারণ নিরাপত্তার কথা ঘোষণা করে। এ জন্যে যে ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছে তা কয়েক পর্যায়ে বিভক্ত:
প্রথম: ব্যক্তির শ্রম ও কাজ। এ পর্যায়ে মৌলিক কথা হলো, ইসলামী রাষ্ট্রের প্রত্যেকটি নাগরিকই নিজের প্রয়োজন নিজে পূরণ করবে। সে, কাজ করবে, উপার্জন করবে। সে জন্যে অপর কোন মানুষের সামনেই ভিক্ষার হাত দরাজ করবে না। কেননা ইসলামের দৃষ্টিতে “ওপরের হাত নিছের হাতের তুলনায় অনেক উত্তম” অতএব গ্রহনের চেয়ে দান ভালো। আর দান সম্ভব হয় যদি ধন থাকে এবং ধন শ্রম ও উপার্জন ব্যতিরেকে হস্তগত হওয়া সম্ভবপর নয়। হাদিস শরীফে উদ্বৃত্ত হয়েছে:
*****আরবী******
“ যার হাতে আমার প্রাণ নিবদ্ধ তার নামে কসম করে বলছি, তোমাদের কেউ যদি রশি দিয়ে পাহাড়ে চলে যায় এবং কাষ্ঠ আহরণ করে পিঠের ওপর রেখে বহন করে নিয়ে আসে, তা বিক্রি করে অর্থ রোজগার করে এবং তা দিয়ে নিজের ভরণ-পোষণ চালায়, তবে তা লোকের কাছে ভিক্ষা করার চেয়ে অনেক ভালো ‘