বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম
প্রাক-ইংরেজ আমলের ভারত
আজাদী আন্দোলনের সূচনা সম্পর্কিত আলোচনায় স্বাভাবিক ভাবেই গোলামীর যুগ ও তার পটভূমি সম্পর্কে একটি জিজ্ঞাসা জাগে। এ জিজ্ঞাসার জবাব খুঁজতে গিয়ে ইতিহাস থেকে আমরা এটাই জানতে পারি যে, তাওহীদ, রেসালাত ও আখেরাত-ভিত্তিক ইসলামী জীবনধারা থেকে বিচ্যুতির ফলে যেমন পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলে মুসলমানরা দুর্বল ও বিদেশী দাসত্বের নিগড়ে আবদ্ধ হয়েছিল, তেমনি হিমালয়ান উপমহাদেশেও তারা মোগলপতন যুগে প্রথমে শিখ-মারাঠা কর্তৃক পির্যস্ত ও পরে ইংরেজদের দাসত্বশৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। সম্রাট আলমগীর আওরঙ্গজেবের পর থেকেই উপমহাদেশের মুসলমানদের শাসন ক্ষমতায় পতনের সূচনা ঘটে। আওরঙ্গজেবের তিরোধানের পর তাঁর উত্তরাধিকারীদের মধ্যে যারা দিল্লীর মসনদে আসীন হয়েছিলেন, তাদের বেশীর ভাগই ছিলেন অযোগ্য ও দুর্বল শাসক। ধর্মীয়, চিন্তাগত, নৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যে বন্ধ্যাত্ব এবং পতন দেখা দিয়েছিলো তা রোধ করার মতো ক্ষমতা তাদের মোটেই ছিল না”। কেন্দ্রীয় সরকারের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের শাসকগণ নিজেদেরকে নামেমাত্র দিল্লীর অধীন বলে প্রকাশ করলেও কার্যতঃ ঐসব আঞ্চলিক শাসক স্বাধীন শাসনকর্তা হিসাবেই সংশ্লিষ্ট এলাকাসমূহ শাসন করতেন।
উপমহাদেশের মুসলিম শাসন ক্ষমতার এ দুর্বলতা লক্ষ্য করেই বণিক হিসাবে আগত ইংরেজরা এদেশের শাসক হবার স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। পরিণামে, ঘরের ইঁদুরদের কারণে পলাশীযুদ্ধে ইংরেজদের হাতে মুসলমানদের বিপর্যয় ঘটে। বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার শাসক নবাব সিরাজুদ্দৌলাকে মুনাফিকদের ষড়যন্ত্রে ইংরেজরা পরাজিত ও হত্যা করে। এভাবে ১৭৫৭ খৃষ্টাব্দের যুদ্ধে বাংলা দখল করার মধ্য দিয়েই ইংরেজদের সেই স্বপ্নসাধ পূর্ণ হতে থাকলো। পলাশী যুদ্ধের পর দিল্লী কেন্দ্রকে লক্ষ্যস্থল স্থির করে তারা ধীরে ধীরে সম্মুখে অগ্রসর হতে লাগলো। একের পর এক কেন্দ্র থেকে বিচ্ছিন্ন মুসলিম অমুসলিম শাসকদের স্বাধীন রাজ্যগুলোকে বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য করলো।
১৭৯৯ খৃঃ শাহওয়ালীউল্লাহ দেহলভীর চিন্তায় উদ্ধুদ্ধ এবং ইংরেজবিরোধী স্বাধীনতাযুদ্ধে নিবেদিতপ্রাণ মহীশূরের বীর সুলতান টিপুকে ইংরেজরা পরাজিত ও হত্যা করলো। সর্বশেষ সম্রাট শাহ আলমকে জায়গীর হিসাবে লাল কেল্লা ছেড়ৈ দিয়ে ১৮০৫ খৃঃ দিল্লী হস্তগত করে ইংরেজরা সমগ্র ভারতে নিজেদের নিরঙ্কুশ ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করলো।
কয়েকটি জিজ্ঞাসা
ইতিহাসের কোন ঘটনাই সম্পর্কহীন নয়। কার্যকারণ পরম্পরার ফলেই ঐতিহাসিক ঘটনার সূত্রপাত হয়। বস্তুতঃ এ কারণেই দেখা যায়, বাংলা পাক-ভারত উপমহাদেশের আজাদী আন্দোলনের সাথে ১৭৫৭, ১৮৫৭ এবং ১৯৪৭ সালের ঐতিহাসিক ঘটনাবীল পরস্পর ওতঃপ্রোতভাবে জড়িত। সম্রাট আলমগীর আওরঙ্গজেবের প্রথম উত্তরাধিকারীদের যুগ থেকে এ জাতি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে বিয়োগান্ত ঘটনা তাদের জন্য প্রথম বাস্তব ও বেদনাদায়ক আঘাত হিসাবে আত্মপ্রকাশ করলো। তার পরবর্তী কালে ১৮৫৭ ও ১৯৪৭ সালের ঘটনাদ্বয় ছিল উপমহাদেশে মুসলিম পুনর্জাগরণের বাস্তব ফলশ্রুতি।
কিন্তু এই পুনর্জাগরণ কার চিন্তার ফসল ছিল? উপমহাদেশে ইসলামী রেঁনেসার বীজ মুসলমানদের চিন্তা ও মগজে কে বপন করেন? হতোদ্যম পরাজিত মুসলিম জাতি এ চেতনা ও অনুপ্রেরণা কোত্থেকে পেয়েছিলো, যদ্দরুন ১৮৫৭ সালে উপমহাদেশের নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী ইংরেজ রাজ-শক্তির বিরুদ্ধে তারা প্রকাশ্যে রুখে দাঁড়িয়েছিল? তার পূর্বে ১৮৩১ সালে কোন অনুপ্রেরণা তাদের বালাকোটের রণাঙ্গণে ছুটে যেতে পাগল করে তুলেছিলো এবং কোন যাদুপ্রেরণা এই রণক্লান্ত ভগ্নহৃদয়ের মুসলমানদেরকে পুনরায় বলবীর্য ও শক্তি-সাহসে উজ্জীবিত করে ইংরেজ শক্তির বিরুদ্ধে ১৯৪৭ সালের শেষ বিজয়ের আগ পর্যন্ত সংগ্রামে অটল রেখেছিলো? –এ সব বিষয় আজ ব্যাপকভাবে পর্যালোচনা ও তরুণ সমাজের কাছে তুলে ধরার সময় এসেছে। সময় এসেছে অবিভক্ত ভারতকে দ্বিখন্ডিত করে মুসলমানরা কোন দুঃখে উপমহাদেশে নিজেদের জন্যে স্বতন্ত্র রাষ্ট্র পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় বাধ্য হয়েছিল। যার একাংশ পরে স্বাধীন বাংলাদেশ রূপে গঠিত হয়। এজন্যে সৃষ্ট আন্দোলনের সঠিক পটভূমি জাতির সামনে যথাযথভাবে তুলে ধরা এবং এরই আলোকে সেই আন্দোলনের মূল লক্ষ্য সম্পর্কে ভ্রান্তি সৃষ্টিকারী ফাঁস করা একান্ত্র প্রয়োজন।
অবিভক্ত ভারতের সর্বত্র নিরাশার কালছায়া নেমে এলো
আলেমগণই আজাদী আন্দোলনে এগিয়ে এলেন
কোনো জীবনের ত্যাগ, শ্রমসাধনা ও সংগ্রাম ছাড়া আসে না। বিশেষ করে জাতীয় জীবনের সফলতার ক্ষেত্রেতো কোনো অবস্থাতেই নয়। তেমনিভাবে ১৯৪৭ সালে পাক-ভারত উপমহাদেশের আজাদীও বিচ্ছিন্ন কোনো আন্দোলনের ফলে আসেনি। তার পেছনে রয়েছে এক সুদীর্ঘ ত্যাগ ও রক্তাক্ত সংগ্রামের ইতিহাস। সেই ত্যাগ-সংগ্রামই ধীরে ধীরে গোটা অবিভক্ত ভারতের আজাদীর পথকে প্রশস্ত করেছিলো। আর পূর্বেই উল্লেখিত হয়েছে যে, সেই সংগ্রামের পুরোভাবে ছিলেন তৎকালীন মুসলিম সমাজের শিক্ষিত নেতৃবৃন্দ আলেম সমাজই।
১৮০৫ খৃষ্টাব্দে ইংরেজরা দিল্লীর শাসক সম্রাট শাহ আলমকে লাল-কেল্লা, এলাহাবাদ ও গাজীপুরের জায়গীর ছেড়ে দেয়। কিন্তু উপমহাদেশে মুসলিম শাসন ক্ষমতার শেষবিন্দুটি পর্যন্ত মুছে দেয়ার পূর্বেই ইংরেজগণ সমগ্র ভারতে নিরঙ্কুশ অধিকার প্রতিষ্ঠা করে নিয়েছিল। সারা দেশে আলেম ও গায়ের আলেম সুধী সমাজের মধ্যে প্রকাশ্যে এ ঘোষণা দেয়ার সাহস এমন কারও ছিল না যে, -বিদেশীর শাসনাধীন ভারত হচ্ছে ‘দারুল হরব’ যেখানে জেহাদ করা প্রতিটি খাঁটি মুসলমানের কর্তব্য। সর্বত্র নৈরাশ্যের কাল ছাড়া ঘনীভূত হয়ে এসেছিলো। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছিলেন সকল শ্রেণীর মুসলমান। ইংরেজগণ উপমহাদেশে নিজেদের রাজনৈতিক ক্ষমতাকে দৃঢ়তর করার জন্য এবং পাশ্চাত্য শাসকজাতি মুসলমানদেরকে পাশ্চাত্যমুখী ও হীনমনা করে গড়ে তোলার জন্যে গভীর পরিকল্পনায় নিয়োজিত ছিলো। তারা অমুসলিম এবং মুসলমানদের থেকেও কিছু সংখ্যক লোককে ইতিমধ্যেই হাত করে নিয়েছিল। মুসলমান জাতির জন্যে ঐ সময়টি ছিল এক কঠিন পরীক্ষার।
মওলানা শাহ আবদুল আজীজের বিপ্লবী ফতওয়া
ঠিক এ সময়ই ‘ওয়ালিউল্লাহ আন্দোলনে’র প্রধান নেতা ও তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র শাহ আবদুল আজীজ দেহলভী এক বিপ্লবী ফতওয়া প্রচার করে এই হতোদ্যম জাতিকে পথের সন্ধান দেন এবং তাদেরকে ইসলামের জেহাদী প্রেরণায় উদ্ধুদ্ধ হবার আহবান জানান। শাহ আবদুল আজীজ তাঁর পিতা মহামনীষী ও ইসলামী রেনেঁসার উদগাতা হযরত শাহ ওয়ালী-উল্লাহ দেহলভীর তিরোধানের পর (১৭৬৭ খৃঃ) থেকে দিল্লীর রহিমিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে ওয়ালীউল্লাহ চিন্তাধারার প্রচার, জনসংগঠন প্রভৃতির মাধ্যমে “তারগীবে মুহাম্মদী” নামে ইসলামী পুনর্জাগরণের কাজে নিয়োজিত ছিলেন। এই নির্ভীক মোজাহিদ দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ফতোয়ার মাধ্যমে ঘোষণা করলেন যে, –
“এখানে (ভারতে) অবাধে খৃষ্টান অফিসারদের শাসন চলছে, আর তাদের শাসন চলার অর্থই হলো, -তারা দেশরক্ষা, জননিয়ন্ত্রণ বিধি, রাজস্ব, খেরাজ, ট্যাক্স, ওশর, ব্যবসায়গণ্য, চোর-ডাকাত-দমনবিধি, মোকদ্দমার বিচার, অপরাধমূলক সাজা প্রভৃতিকে (যেমন –সিভিল, ফৌজ, পুলিশ বিভাগ, দীওয়ানী ও ফৌজদারী, কাস্টমস ডিউটি ইত্যাদিতে) নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী। এ সকল ব্যাপারে ভারতীয়দের কোনই অধিকার নেই। অবশ্য এটা ঠিক যে, জুমার নামাজ, ঈদের নামাজ, আজান, গরু জবাই –এসব ক্ষেত্রে ইসলামের কতিপয় বিধানে তারা প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করছে না। কিন্তু এগুলোতো হচ্ছে শাখা-প্রশাখা; যে সব বিষয় উল্লিখিত বিষয়সমূহ এবং স্বাধীনতার মূল (যেমন –মানবাধিকার, বাকস্বাধীনতা, নাগরিক অধিকার) তার প্রত্যেকটিই ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে এবং পদদলিত করা হয়েছে। মসজিদসমূহ বেপরোয়াভাবে ধ্বংস করা হচ্ছে, জনগণের নাগরিক স্বাধীনতা খতম করে দেয়া হয়েছে। এমন কি মুসলমান হোক কি হিন্দু-পাসপোর্ট ও পারমিট ব্যতীত কাউকে শহরে প্রবেশের সুযোগ দেয়া হচ্ছে না। সাধারণ প্রবাসী ও ব্যবসায়ীদেরকে শহরে আসা-যাওয়ার অনুমতি দানও দেশের স্বার্থে কিংবা জনগণের নাগরিক অধিকারের ভিত্তিতে না দিয়ে নিজেদের স্বার্থেই দেওয়া হচ্ছে। বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ যেমন সুজাউল-মুলক, বেলায়েতী বেগম প্রমুখ ইংরেজদের অনুমতি ছাড়া বাইর থেকে প্রবেশ করতে পারছেন না। দিল্লি থেকে কলকাতা পর্যন্ত তাদেরই আমলদারী চলছে। অবশ্য হায়দ্রাবাদ, লক্ষ্ণৌ ও রামপুরের শাসনকর্তাগণ ইংরেজদের আনুগত্য স্বীকার করে নেওয়ার সরাসরি নাছারাদের আইন সেখানে চালু নেই। কিন্তু এতেও গোটা দেশের উপরই ‘দারুল হরবের-ই হুকুম বর্তায়”। -ফতওয়ায়ে আজীজী (ফারসী), ১৭ পৃঃ মুজতাবীয়া প্রেস।
এ ভাবে শাহ আবদুল আজীজ দেহলভী অন্য একটি ফতওয়ার মাধ্যমে ভারতকে ‘দারুল হরব’ “শত্রুদেশ” বলে ঘোষণা করেন। ফতওয়ার ভাষায় ‘দারুল হরব’ পরিভাষা ব্যবহারের মূল লক্ষ্য ছিলো রাজনৈতিক ও স্বাধীন সংগ্রামের আলো প্রজ্জ্বলিত করা। যার সারমর্ম দাঁড়ায় এই যে, -“আইন রচনার যাবতীয় ক্ষমতা খৃষ্টানদের হাতে, তারা ধর্মীয় মূল্যবোধকে হরণ করেছে। কাজেই প্রতিটি দেশপ্রেমিকের কর্তব্য হলো বিদেশী ইংরেজ শক্তির বিরুদ্ধে এখন থেকে নানানভাবে সংগ্রাম করা এবং লক্ষ্য অর্জনের আগ পর্যন্ত এই সংগ্রাম অব্যাহত রাখা”।
ইসলাম বিরোধী ফতওয়ার প্রতিক্রিয়া
সাধারণ মুসলমানগণ এযাবত ইংরেজদের ক্ষমতা ও প্রতাপের সামনে নিজেদেরকে অসহায় মনে করতেন এবং নানা দ্বিধাদ্বন্দ্বে লিপ্ত ছিলেন। এ ফতওয়া প্রকাশের পরই মুসলমানরা কর্জনীতি নির্ধারণের পথ খুঁজে পায়। শাহ আবদুল আজীজ দেহলভীর আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত কর্মী ও তাঁর বিশিষ্ট ছাত্রবৃন্দ দ্বারা উপমহাদেশের সকল শ্রেণীর মুসলমানদের নিকট এই বিপ্লবী ফতোয়ার বাণী প্রচারিত হয়। আর এমনিভাবে মুসলমানদের মনে ক্রমে ক্রমে ইংরেজদের বিরুদ্ধে জিহাদী ভাব জাগ্রত হতে থাকে।
পরবর্তীকালে দেখা যায়, শাহ আবদুল আজীজেরই শিষ্য সাইয়েদ আহমদ শহীদের নেতৃত্বে এবং তাঁর জামাতা মওলানা আবদুল হাই ও ভ্রাতুষ্পুত্র মওলানা ইসমাইল শহীদের সেনাপতিত্বে (আনুঃ ১৮১৭ খৃঃ) বিরাট মোজাহেদ বাহিনী গঠিত হয়। এই মোজাহেদ বাহিনীর একমাত্র লক্ষ্য ছিলো খাটি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা এবং তার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী (শিখ ও ইংরেজ)দের বিরুদ্ধে জেহাদ করা। তাঁরা এ উদ্দেশ্য পূর্ব-ভারত কিংবা দক্ষিণ অথবা উত্তর ভারতে কোন স্থানে নিরাপদ মনে না করে ভারতের উত্তর পশ্চিম সীমান্তবর্তী অঞ্চলে পেশোয়ার-কাশ্মীর এলাকায় নিজেদের কেন্দ্র স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেন। তাঁদের এ আন্দোলন ও সংগ্রামে উপমহাদেশের পূর্ব সীমান্তবর্তী এলাকাসমূহ, (কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, মোমেনশাহ প্রভৃতি) থেকেও মুসলমানরা যোগদান করেছিল।
বাংলাদেশে সাড়া জাগলো
শাহ আবদুল আজীজের এই ইসলামী আন্দোলন ও উক্ত ফতওয়ার প্রভাবে বাংলাদেশেও বিপুল সাড়া জেগেছিলো। যার ফলে ১৮১৮ খৃষ্টাব্দে এখানে ফরিদপুরের জাহী শরীয়তুল্লাহর নেতৃত্বে ফরায়েজী আন্দোলনের নামে এক শক্তিশালী ইসলামী আন্দোলন গড়ে ওঠে। তার সামান্য কিছুদিন পরেই মোজাহেদ আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত বাংলার মওলানা তীতুমীর (হাজী সাইয়েদ নেসার আলী) ও তাঁর সঙ্গীরা এখানে বহু স্থানে ইংরেজদের সংগে সংঘর্ষে লিপ্ত হন। মওলানা তিতুমীর ছিলেন ‘শহীদে বালাকোট’ সাইয়েদ আহমদ শহীদের একনিষ্ঠ শিষ্য। তিনি ১৮৩১ খৃঃ সাইয়েদ সাহেব যে সালে বালাকোটে শাহাদাত বরণ করেন ঐ সালেই ইংরেজ দোসরদের সংগে জেহাদে শহীদ হন।
ফরায়েজী আন্দোলনের শেষের দিকে মওলানা কারামত আলী জৈনপুরীও সাইয়েদ আহমদ শহীদের শিষ্য হিসাবে বাংলাদেশে ইসলামী শিক্ষা-সংস্কৃতি ও আদর্শ প্রচারে বিরাট কাজ করেন। বাংলা দেশে মুসলমানদের জীবন থেকে হিন্দুয়ানী তথা বিজাতীয় শিক্ষা-সংস্কৃতির প্রভাব দূরীকরণ ও এ অঞ্চলের জনগণের মধ্যে ইসলাম প্রচারের ব্যাপারে মওলানা আলী জৈনপুরীর অসামান্য দান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। মূলতঃ এ কারণেই এখনও বাংলার প্রতিটি মানুষ “হাদিয়ে বাঙ্গাল” মওলানা কারামত আীল জৈনপুরীকে অতি ভক্তি শ্রদ্ধা সহকারে স্মরণ করে।
সাইয়েদ আহমদ বেরেলভীর আন্দোলন
মোজাহেদ বাহিনীর নেতা সাইয়েদ আহমদ শহীদ জেহাদের উদ্দেশ্যে আধ্যাত্মিক শক্তি সঞ্চয়ের জন্যে তাঁর শত শত কর্মীকে নিয়ে ১৮১৯ খৃষ্টাব্দে পবিত্র হজ্জ পালনের লক্ষ্যে মক্কা শরীফ গমন করেন। ১৮১৯ খৃষ্টাব্দে তিনি ভারতে প্রত্যাবর্তন করেন। স্বদেশে ফিরে তিনি ইসলামী আন্দোলনকে লক্ষ্যে পৌঁছাবার জন্যে জেহাদের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। তাঁর দলের প্রতিটি মোজাহিদকে তিনি ইসলামের সোনালী যুগের আন্দোলনের কর্মী সাহাবীদের আদর্শে গঠন করতে চেষ্টা করেন। তাদের রাত্রদিনের কর্মসূচীর মধ্যে ছিলো ভোরে প্রচারকার্য, দিবা ভাগে দৈনিক কঠোর পরিশ্রম, রাত্রির একাংশে তাহাজ্জুদ ও ইবাদতে জাগরণ –এসব ছিলো এই খোদাভক্তদের দৈনন্দিন সাধারণ কর্মসূচী। ইসলামের খাঁটি গণতান্ত্রিক নিয়মে তারা মসজিদ চত্বরে মেঝেয় সকলে সম্মিলিতভাবে খানাপিনা করতেন।
প্রস্তুতি পর্বে সাইয়েদ সাহেব দেশের প্রভাবশালী মুসলমানদের সাথেও যোগাযোগ করেন। নবাব সোলায়মান জা’কে লিখিত তাঁর একটি পত্র পাওয়া যায়। ঐ পত্র থেকে তাঁর আন্দোলনের মুখ্য উদ্দেশ্য পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। পত্রটি হলো –“আমাদের দুর্ভাগ্য, হিন্দুস্থান কিছুকাল হয় খৃষ্টানদের শাসনে এসেছে এবং তারা মুসলমানদের উপর ব্যাপকভাবে জুলুম নিপীড়ন শুরু করেছে। বেদআ’তে দেশ ছেয়ে গেছে এবং ইসলামী আচার-আচরণ ও চালচলন প্রায় উঠে যাচ্ছে। এসব দেখে আমার মন ভারাক্রান্ত হয়ে উঠেছে। আমি জেহাদ অথবা হিজরত করতে মনস্থির করেছি”।
সাইয়েদ আহমদের নেতৃত্বে সেনারা এগিয়ে চল্লো
সাইয়েদ আহমদ বেরেলভী বেশ হৃদয়ঙ্গম করছিলেন এবং বারবার প্রচার করছিলেন যে, প্রকৃত মুসলিম সমাজ সংগঠন করতে হলে শক্তি ও রাজ্য প্রতিষ্ঠার দরকার। তিনি এই উদ্দেশ্য সীমান্তে কাজ শুরু করেন যে, আন্দোলনের কেন্দ্র স্থাপন করতে হলে শত্রু থেকে দূরে একটি স্বাধীন এলাকার দরকার। তাছাড়া তিনি ভেবেছিলেন, সীমান্তের যুদ্ধপ্রিয় গোত্রগুলো তাঁর সহায়খ হবে।
এভাবে অবিভক্ত ভারতের সর্বত্র জেহাদের প্রস্তুতি ও প্রচারণা শেষ করে সাইয়েদ আহমদ ১৮২৬ খৃষ্টাব্দে রায়বেরিলী ত্যাগ করেন। সাইয়েদ সাহেবের সঙ্গে এ সময় মোহাজিদের সংখ্যা ছিলো ১২ হাজার; অল্প দিনের মধ্যেই তা এক লক্ষে উন্নীত হয়। তারা গজনী কাবুল ও পেশোয়ারেরপথে নওশেরায় হাজির হলে পর শিখদের সাথে সংঘর্ষ বাধে। উল্লেখ্য, শিখগণ ঐ সময় রণজিৎ সিংহের নেতৃত্বে পাঞ্জাবে আধিপত্য বিস্তার করে মুসলমানদের উপর অকথ্য জুলুম অত্যাচার চালাচ্ছিল। এ অত্যাচারের পেছনে ইংরেজদেরও উস্কানি ছিলো। যা হোক, উক্ত সংঘর্ষে মাত্র ৯ শত মোহাজিদের সাথে বিপুল সংখ্যক শিখ সৈন্য পরাজয় বরণ করলো। সারা সীমান্ত প্রদেশ মুজাহিদদের প্রশংসা মুখর হয়ে উঠলো। কিছুদিন পর শের সিংহ ও জনৈক ফরাসী জেনারেলের অধীন প্রায় তিরিশ হাজার সৈন্য পুনরায় মুজাহিদদের মোকাবেলা করতে আসে। কিন্তু মুজাহিদ বাহিনী এগিয়ে আসলে শিখরা পনজতারে পিছু হটে যায় এবং সেখান থেকে খণ্ডযুদ্ধে পরাজিত হয়ে পলায়ন করে। মুজাহিদদের এই বিরাট সাফল্য জনগণের উপর মস্তবড় প্রভাব বিস্তার করে।
পেশোয়ার অধিকার
পেশোয়ারবাসী সাইয়েদ আহমদকে সামগ্রিকভাবে শিখদের উপর হামলা করতে আবহান জানায়। ঐ সময় গরহিমাজির দশ হাজার যুদ্ধপ্রিয় লোক সরওয়ার জা’য় অধীন সাইয়েদ সাহেবকে ইমাম হিসাবে গ্রহণ করে। মোজাহিদদের সংখ্যা তখন সর্বমোট এক লক্ষ্যে উপনীত হয়। এদিকে রণজিৎ সিংহ কতিপয় মুসলিম সরদারকে হাত করার জন্যে মুক্ত হস্তে অর্থ বিলি শুরু করলো এবং আর নানাভাবে তাদের প্রলুব্ধ করার চেষ্টা চালালো। শেষ পর্যন্ত মোজাহিদ বাহিনীকে তিনটি শক্তির মোকাবেলা করতে হলো –শিখ, পেশোয়ারের বিশ্বাসঘাতক সর্দারবৃন্দ এবং খুবী খাঁ। বালাকোটের লড়াইর সবগুলোতেই শিখরা মুজাহিদদের হাতে পরাজিত হয়। সাইয়েদ সাহেবের এক পত্র থেকে জানা যায় যে, শেষ পর্যায়ে মোজাহিদদের সংখ্যা ৩ লক্ষ্যে গিয়ে উপনীত হয়েছিল। সাইয়েদ সাহেব ও তাঁর বাহিনী, রণজিৎ সিংহের সুশিক্ষিত খালসা বাহিনীকে পরাজিত করে পেশোয়ার অধিকার করে নেন (১৮৩০ খৃঃ)।
ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা
অতঃপর তিনি কাশ্মীরে প্রধান ঘাটি স্থাপন করতে ইচ্ছা করেন। কিন্তু আম্বের পায়েন্দা খাঁ বাধা দিতে চেষ্টা করলে মোজাহিদ বাহিনীর সেনাধ্যক্ষ শাহ ইসামইল আম্ব অধিকার করেন এবং সেখানে প্রধান ঘাটি স্থাপন করেন। আম্ব থেকে মর্দান পর্যন্ত বিশাল এলাকায় তাঁর অধিকার স্বীকৃত হলো। সাইয়েদ আহমদ সেখানে ইসলামী গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা কায়েম করলেন। তিনি অধিকৃত এলাকায় মওলানা সাইয়েদ মযহার আলীকে কাজী (বিচারক) নিযুক্ত করলেন এবং প্রশাসনিক দায়িত্বভার অর্পণ করলেন কাবুলের আমীর দোস্ত মুহাম্মদের ভ্রাতা সুলতান মুহাম্মদের উপর।