আজাদী আন্দোলনের নির্ভীক সিপাহসালার মওলানা আবদুল হামীদ খান ভাসানী
মওলানা আবদুল হামীদ খান ভাসানী ওরফে মওলানা ভাসানী হচ্ছেন রূপকথার নায়ক তুল্য বাংলা-পাক-ভারত উপমহাদেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসের এক অমিত তেজা বিমূর্ত ব্যক্তিত্ব। তিনি ছিলেন আজাদী আন্দোলনের নির্ভীক সিপাহসালার। দেশ জাতি ধর্মের মর্যাদা রক্ষা, জনগণের ন্যায্যা অধিকার ও দাবী দাওয়া আদায়ের সংগ্রামে তিনি একাধিকবার কারাবরণ করেন। তিনি ছিলেন শোষিত বঞ্চিত নির্যাতিত মানুষের কণ্ঠস্বর। ইসলামের এক অনাড়নম্বর খাদেম। বাংলাদেশের বৃহত্তর পাবনা জেলার সিরাজগঞ্জের ধনগরা নামক গ্রামে এক মধ্যবিত্ত পরিবারে তাঁর জন্ম। মওলানা ভাসানীর পিতা মরহুম হাজী শারাফত আলী ছিলেন একজন ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি। তাঁর পেশা ছিল চাষাবাদ। মওলানা ভাসানী চাষী পরিবারে জন্ম লাভ করে চাষীদের পরিবেশেই বেড়ে ওঠেন, গড়ে ওঠেন, যেই চাষীরা বেঁচে থাকার তাগিদে অপরিসীম কষ্ট পরিশ্রম ও সংগ্রাম সাধনার মধ্যে নিজেদের সদা নিয়োজিত রাখেন। যুবক ভাসানীর ভবিষ্যত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব সৃষ্টিতে পরিবেশগত তাঁর এই অবস্থান সুদূর প্রসারী প্রভাব বিস্তার করে।
মুসলিম পারিবারিক শিক্ষার ঐতিহ্যগত প্রথা অনুযায়ী মওলানা ভাসানী প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। তবে তিনি সৌভাগ্যক্রমে শাহ সুফী নাসিরুদ্দীন বাগদাদীর ন্যায় একজন আধ্যাত্মিক শিক্ষকের সাহচর্যও লাভ করেন। বাগদাদী ছিলেন একজন সুবিখ্যাত আধ্যাত্মিক নেতা। বিশ্ববিখ্যাত ইসলামী শিক্ষার পাদপীঠ দারুল উলূম দেওবন্দের সুবিখ্যাত মুহাদ্দিস এবং উপমহাদেশের অন্যতম সুপরিচিত রাজনীতিক আজাদী সংগ্রামের নির্ভীক সেনানী মরহুম মওলানা হোসাইন আহমদ মাদানী সাচচর্যেও মরহুম মওলানা ভাসানী দু’বছর অতিবাহিত করেন। শাহ সুফী বাগদাদীর সাহচর্যেও মরহুম মওলানা ভাসানী দু’বছর অতিবাহিত করেন। শাহ সূফী বাগদাদীর ন্যায় আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্বের সংসর্গ এবং কুরআন সুন্নাহর জ্ঞানে পরিপক্ক মহা পণ্ডিত ও বুজর্গ মাওলানা মাদানীর সাহচর্য ভাসানী চরিত্রকে জাগতিক আধ্যাত্মিক উভয় বৈশিষ্টে করেছিলেন বিমণ্ডিত।
রাজনৈতিক ভবিষ্যতঃ বর্তমান শতকের প্রথম দশকে মওলানা ভাসানী ট্যারোরিষ্ট মোভমেন্টের সাথে জড়িত ছিলেন। এই আন্দোলনের প্রধান লক্ষ্য ছিল সংগ্রামের মাধ্যমে ভারত থেকে বৃটিশ শাসনের অবসান ঘটানো। এই শতকের দ্বিতীয় দশকে তিনি খেলাফত আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী হিসাবে আজাদী সংগ্রামে রত ছিলেন। এই সময়ের মধ্যে খেলাফত আন্দোলনের নেতা মওলানা মুহাম্মদ আলীর সাথে কাজ করার তাঁর সুযোগ ঘটে। খেলাফত আন্দোলনের সাথে জড়িত থাকার কারণে মওলানা ভাসানী বৃটিশ শাসকদের দ্বারা কারানির্যাতন ভোগ করেন। ১৯২৩ সাল থেকে খেলাফত আন্দোলন অনেকটা নিস্তেজ হয়ে পড়ে। পরন্তু দেশবন্দু চিত্তরঞ্জ দাসের মৃত্যুতে (১৯২৫) স্বরাজ পার্টীর নীতিতে আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়। এই দুটি ঘটনার পর রাজনৈতিক তৎপরতার ক্ষেত্রে মাওলানা ভাসানী নতুন ধারা গ্রহণ করেন। এময় তার রাজনেতিক তৎপরতা ছিল অবহেলিত বাংলা আসামের গ্রামীণ জীবনকেন্দ্রীক।
১৯৩০ সালে মওলানা ভাসানী বাংলা-আসামের লক্ষ লক্ষ কৃষকের জীবন মান উন্নয়নের লক্ষ্যে বিভিন্ন দাবী দাওয়ার ভিত্তিতে পরিচালিত কৃষক আন্দোলনে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন। ১০২৪ সালে ভাসান চরে অনুষ্ঠিত বাংলা-আসামের জিরাতিয়া প্রজাদের এক ঐতিহাসিক সম্মেলনের মধ্যদিয়ে মওলানা ভাসানী কৃষক আন্দোলনের সূচনা করেন। শোষক সামন্তবাদী জোৎদার মহাজন শ্রেণীর বিরুদ্ধে মুসলিম চাষী সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করার লক্ষ্যে মওলানা ভাসানী ১৯৩০ সালে বাংলা আসামের মুসলমানদের এক বিরাট সম্মেলনের আয়োজন করেন। তৎকালীন বৃহতহ্তর মোমেনশাহী জেলার সামন্ত প্রভুদের বিরুদ্ধে মওলানা ভাসানী ১৯৩১ থেকে ১৯৩২ সালে ডাইরেক্ট একশনের লক্ষ্যে চাষী সাধারণকে সংগঠিত করেন। এসব তৎপরতার কারণে ১৯৩২ সালের প্রথম দিকে বৃটিশ সরকার এ জেলায় তাঁর তৎপরতা বন্ধ করে দেয়।
১৯৩৭ সালে অল ইন্ডিয়া লক্ষ্ণৌ কনফারেন্সের অব্যবহিত পূর্বে মুসলিম লীগ নেতা কয়েদে আযম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ এবং রাজা গজনফর আলীর অনুরোধে মওলানা ভাসানী মুসলিম লীগে যোগদান করেন। সিলেট জেলা গণভোটের মাধ্যমে পাকিস্তানের সাথে মিলিত হয়েছিল। গণভোটে সিলেটবাসীরা যেন আদৌ কোন ভুল না করেন সেজন্য মওলানা ভাসানী সারা সিলেট ঝটিকা সফর করে পাকিস্তানের সপক্ষে জনমত সৃষ্টি করেন। ৪৭-এর আজাদী আন্দোলনের এই সংগ্রামী নেতার রয়েছে অসামান্য অবদান।
১৯৪৮ সালে তিনি উত্তর টাঙ্গাইল থেকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পূর্ব পাকিস্তান আইনসভার সদস্য নির্বাচিত হন। কিন্তু মুসলিম লীগ সরকার তাদের দলীয় মেনিফেস্টো মোতাবেক কাজ না করায় তিন মাস পর তিনি তাঁর সদস্য পদ থেকে ইস্তেফা প্রদান করেন। এক বছর পর তিনি পাকিস্তান আন্দোলনের মূল ভিত্তি লাহোর প্রস্তাব বাস্তবায়নে ক্ষমতাসীন দলের ব্যর্থতার প্রবিাদে নিখিল পাকিস্তান মুসলিম লীগের সাথে সকল প্রকার সম্পর্ক ছিন্ন করেন। উল্লেখ্য, ঐতিহাসিক লাহের প্রস্তাবে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তানকে স্বতন্ত্র দু’টি মুসলিম রাষ্ট্র হিসাবে উল্লেখ করা হয়। এভাবে স্বায়ত্ত শাসিত দু’টি স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের ধারণা থেকে ক্ষমতাসীন সরকার জনগণ থেকে ভোট আদায় করলেও পশ্চিম পাকিস্তানের দ্বারা নাননা বৈষম্যের শিকার হয়। মুসলিম লীগ নেতাদের সাথে লাহেরা প্রস্তাবকেন্দ্রিক মতবিরোধের ফলে মওলানা ভাসানী মুসলিম লীগের সাথে সকল প্রকার সম্পর্ক ছিন্ন করেন এবং ১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ নামে স্বতন্ত্র রাজনৈতিক দল গঠন করেন। মওলানা ভাসানী এই নবগঠিত দলের সভাপতি নির্বাচিত হন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তিনি তাঁর এই সংগঠনের কর্মসূচী বাস্তবায়ন করতে পারেননি। পাকিস্তানের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক চুক্তি এবং বাগদাদ প্যাক্ট ইস্যুকে ভিত্তি করে নিজদলীয় সহকর্মীদের সাথে তাঁর মতবিরোধ দেখা দেয়। এ কারণে আবারও তিনি নিজ দল আওয়ামী মুসলিম লীগের সাথে তাঁর রাজনৈতিক যাবতীয় সম্পর্ক ছিন্ন করেন। এই দলই আওয়ামী নেতাদের হাতে গিয়ে ‘মুসলি’ শব্দ বর্জিত হয়। ১৯৫৭ সালে তিনি নতুন দল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি গঠন করেন। ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সভাপতি হিসাবে ও মওলানা ভাসানীকেই নির্বাচিত করা হয়।
উল্লেখিত বছরগুলোতেও মওলানা ভাসানী দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী কৃষকদের স্বার্থেই কাজ করেন। তিনি ১৯৫৭ সালে কৃষক সমিতি নামে কৃষকদের জন্যে একটি স্বতন্ত্র সংগঠন কায়েশ করেন। কৃষক সমিতিরও সভাপতি মওলানা ভাসানীই ছিলেন। ১৯৬৭ সালে মওলানা ভাসানী পাকশীতে এক বিরাট কৃষক সম্মেলনের আয়োজন করেন। উক্ত সম্মেলনে প্রায় আড়াই রাখ কৃষক অংশ গ্রহণ করেছিল। প্রায় অনুরূপ তিনি আরেকটি বিরাট কৃষক সম্মেলনের আয়োজন করেন ১৯৭০ সালে। এই সম্মেলনেও দুলাখ কৃষক অংশ নেয়। একই সালে তিনি মাহিপুরেও এক বিশাল কৃষক সম্মেলনের আয়োজন করেন। মহিপুরের কৃষক সম্মেলনে প্রায় তিন লাখ কৃষক সমবেত হয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন রাষ্ট্র রূপে ঘোষণা প্রদানঃ মওলানা ভাসানীই প্রথম ব্যক্তি যিনি পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে গর্জে উঠেন এবং পাকিস্তানের সাথে সম্পর্কচ্ছেদের আহবান জানান। তিনিই ১৯৭০ সালে নির্বাচিত সংখ্যা গরিষ্ঠ দলের হাতে ক্ষমতা না দেয়ায় ৪ঠা ডিসেম্বর পল্টন ময়দানের এক জন সভায় পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন রাষ্ট্র রূপে ঘোষনা প্রদান করেন।
স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হবার পর মওলানা ভাসানী লক্ষ্য করেন যে, ঢাকার সরকারতো মূলতঃ বিদেশী রাষ্ট্রের তাবেদার হিসাবে ভূমিকা পালন করছে তখন তিনি আর নিশ্চিন্তে ঘরে বসে থাকতে পারেননি। নিজের সকল আরাম হারাম করে বার্ধক্যকে উপেক্ষা করে আবার তিনি রাজপথে নেমে পড়েন। তিনি দেখলেন, তৎকালীন সরকার ধর্ম নিরপেক্ষতার নামে মুসলিম প্রধান এ দেশের কৃষ্টি-কালচার ও ধর্মীয় সকল মূল্যবোধ ধ্বংসের কাজ করছে আর বাংলাদেশের স্বাধীনতা মূলতঃ প্রভু ও পতাকা বদল ছাড়া আর কিছুই নয়। ভারতের স্বার্থ রক্ষা আর বাংলাদেশের মুসলমানদের শোষণেরই ব্যবস্থা হয়েছে, তখন দেশব্যাপী আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য তার অনুসারীদের সংগঠিত করেন। কিন্তু ক্ষমতাসীন দল মওলানা ভাসানীকে গৃহবন্দী করে রাখে যেন তিনি আন্দোলনের উদ্দেশ্যে কোথাও বের হতে না পারেন।
হুকুমতে রাব্বানী সোসাইটি ও ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ঃ
১৯৪৭ সালে মওলানা ভাসানী যখন বাংলাদেশকে একটি ইসলামী কল্যাণ রাষ্ট্রে পরিণত করার অভিপ্রায়ে হুকুমতে রাব্বানী সোসাইটি গঠন করেন, তখন এই পদক্ষেপ তাঁর জীবনের একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হিসাবে প্রতিভাত হয়ে ওঠে। তিনি একটি দীর্ঘ প্রবন্ধে তাঁর নবগঠিত দল –‘হুকুমতে রাব্বানী সোসাইটি’ গঠনের মূল দর্শন ব্যাখ্যা করেন। রাজনৈতিক দর্শনের অনুখূলে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর জন্য তিনি চিন্তা করেন। মূলতঃ মওলানা ভাসানী কর্তৃক টাঙ্গাইলের সন্তোষে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে তিনি তাঁর শিক্ষা সংক্রান্ত চিন্তাধারা ও স্বপ্নের বাস্তবায়নেরই পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। ১৯৫৭ সাল থেকেই তিনি এই বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে চিন্তা গবেষণা করে আসেন। অবশেষে ১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে তাঁর স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয় –প্রতিষ্ঠিত হয় সন্তোষ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়।
ঐতিহাসিক ফারাক্কা মার্চঃ মওলানা ভাসানীর সংগ্রামমুখর জীবনের সর্বশেষ ঘটনা ছিল ঐতিহাসিক ফারাক্কা মার্চ। বাংলাদেশে মরু প্রক্রিয়া সৃষ্টিকারী “ফারাক্কা বাঁধ ভেঙে দাও উড়িয়ে দাও” শ্লোগানের মধ্য দিয়ে ১৯৭৬ সালের ১৬ ও ১৭ই মে রাজশাহী থেকে হাজার হাজার লোক নিয়ে ভাসানী লং মার্চ শুরু করেন। সেই লং মার্চের উদ্দীপনাপূর্ণ স্মৃতি প্রতিটি মানুষকে এখনও দেশপ্রেমে অনুপ্রাণিত করে।
খোদায়ী খেদমতগার দলঃ ভাসানী জীবনের সর্বশেষ সংগঠনটি ছিল খোদায়ী খেদমতগার। তিনি ১৯৭৬ সালের ১লা অক্টোবর সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন হিসাবে এটির ভিত্তি স্থাপন করেন। তিনি ১৯৭৬ সালে সন্তোষস্থ তাঁর দরবার স্থলে সখল খেদমতগারের উদ্দেশ্যে যেই ভাষণ দেন, সেটিই ছিল এই নেতার জীবনের সর্বশেষ ভাষণ। সেদিন মওলানা ভাসানীর বক্তব্য ছিল, “আমি উপলব্ধি করতে পেরেছি যে,-যত সব দলই বদল করি না কেন, কোন ফলোদ্বয় হবে না, যদি না শাসকবর্গ চরিত্রবান হয়। আর চরিত্রবান লোকেরাই কেবল আল্লাহর শাসক কায়েম করতে পারে। আমি তাই হুকুমতে রাব্বানীয়ার আশ্রয় নিয়েছি। দোয়া করি, আল্লাহর মর্জি হোক। বিশ্ব মানবতার জয় হোক”।
ইন্তেকালঃ ১৭ই নভেম্বর ১৯৭৬ সালে মওলানা ভাসানী তাঁর জীবনের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। সন্তোষে তিনি চির নিদ্রায় শায়িত রয়েছেন।
ভাসানী জীবনের শিক্ষাঃ যে কোন সমাজে কোন আদর্শ বাস্তবায়নের দ্বারা ঐ সমাজের কল্যাণ সাধন করতে হলে সেই আদর্শকে প্রথমে সংশ্লিষ্ট সমাজের মানুষের কাছে পরিচিত করতে হয়। উক্ত আদর্শের বাস্তবায়ন দ্বারা জনগণের কি কি কল্যাণ সাধিত হয়, সেটা বোধগম্য ভাষায় তাদের কাছে তুলে ধরতে হয়। অন্যথায় আদর্শের ধারক-বাহকরা সংশ্লিষ্ট সমাজের শত কল্যাণকামী হলেও জনগণ কখনও তাদেরকে নিজেদের শুভাকাঙ্খী মনে করেনা। তাদের প্রতি বাহ্যিক ভাবে সম্মান জানালেও সমাজ ও রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বের আসনে বসার সুযোগ তাদেরকে কখনও তারা দেবেনা। আদর্শের প্রচারকদের কর্তব্য হলো নিজের কথা, আচার-আচরণ ও একই সংগে চারিত্রিক গুণাবলী দ্বারা জনচিত্তকে জয় করা। বলাবাহুল্য মওলানা ভাসানী তাঁর গোটা সংগ্রামমুখর জীবনে জনপ্রিয়তার যেই উত্তুঙ্গ চূড়ায় সমাসীন ছিলেন, এর পেছনে তাঁর উল্লেখিত গুণাবলীই কাজ করেছিল। সমাজের সাধারণ মানুষ সব সময় এই অনাড়ম্বর মহান ব্যক্তিত্বকে দেখেছে নিজেদের আপন মানুষ হিসাবে। তাদের দুঃখ দুর্গতির কথা বলিষ্ঠ কণ্ঠে বলতে এবং এজন্যে দায়ী শাসকদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে ও হুশিয়ারি উচ্চারণ করতে। তারা দেখেছে, ক্ষমতায় না গিয়েও এই নিঃস্বার্থ মজলুম জননেতা সখল সময় তাদের সমস্যাবলী নিয়েই দেশের একপ্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যণ্ত সভা করে বেড়াতে এবং অত্যাচারী শাসকদের সন্ত্রস্ত করে রাখতে। সবচাইতে বড় কথা হলো, মওলানা ভাসানী এদেশের মানুষের কল্যাণে তাদেরকে যে কথা বলতেন, তারা সে কথা বুঝতো। পক্ষান্তরে একই ‘মওলানা’ লকবে ভূষিত আরও বহু আলেম যারা নিজেদের অক্লান্ত পরিশ্রম দ্বারা নিঃস্বার্থ ভাবে এ দেশ-জাতির সেবা করে আসছেন এবং তাদের ইহ-পারলৌকিক মুক্তির সন্ধান দিচ্ছেন, তারা রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এ দেশবাসীর হৃদয় সে রকম জয় করতে পারেননি, যেমনটি পেরেছিলেন মওলানা ভাসানী। অথব তাঁদের মধ্যে ধর্মীয় ও বৈষয়িক বড় বড় এমন পণ্ডিতও ছিলেন ও আছেন, যাদের ইলমের পরিধি হয়তো মওলানা ভাসানীর চাইতেও অনেক ব্যাপক ছিল। এর কারণ সম্ভবত সাক্ষাত জনসেবামূলক কাজ ভাসানী অধিক করেছেন আর যা বলেছেন জনগণের সাক্ষাত সমস্যার সমাধানে তাদের বোধগম্য ভাষায় বলেছেণ। জনগণের জন্য কথা বলে জেল খেটেছেন।
এদেশের গরীব জনগনের হৃদয় কাংখিত ভাবে জয় করতে অন্য ইসলামী পন্থীরা আশানুরূপ সফল হয়নি। সেটা বলার অপেক্ষা রাখেনা। ব্যর্থতার এই ছিদ্র পথেই আমাদের দেশজাতির বড় সর্বনাশটি সাধিত হয়ে গেছে। ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদী, নাস্তিকতাবাদীরা ও খৃষ্টান মিশনারী এদেশের কোটিকোটি তওহীদি জনতার সাক্ষাত সমস্যাবলীর সূত্র ধরে কোটি কোটি মুসলমানকে ওলামা নেতৃত্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে। কেউ লক্ষ্যে ইসলাম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে কেউ হয়েছে অলক্ষ্যে। এভাবেই আমাদের দেশের ওলামা সমাজ ধীরে ধীরে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন অতঃপর অবহেলিত হয়ে পড়েছেন আর সেই সুযোগে আজ এ জাতির ব্যক্তি জীবন, পারিবারিক জীবন, সামাজিক জীবন, ও রাষ্ট্রীয় জীবনে ইসলামী শিক্ষা ও মূল্যবোধ চরম সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে, যা কিনা দেশের লক্ষ লক্ষ তালেবান ও আলেমানের পক্ষেও এখন ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব হয়ে উঠছেনা। এই আলোকে চিন্তা করলেও সংগ্রামী নেতা মওলানা ভাসানীর জীবন নিঃসন্দেহে একটি শিক্ষনীয় জীবন।
সুতরাং আজাদী আন্দোলনের নির্ভীক সেনানী এবং ইসলামী সাম্য ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা আন্দোলনের অগ্রপথিক, এ দেশের রাজনৈতিক গগণের প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর জননেতা মওলানা ভাসানীর সংগ্রাম মুখর জীবন থেকে আজকের ইসলামী আন্দোলনের ওলামা, আধুনিক শিক্ষিত সকলের এমন অনেক কিছু বিষয় শিক্ষনীয় রয়েছে, যে গুলোর অভাবে তারাও এ দেশবাসীর অকৃত্রিম শুভাকাংখী হয়েও এখনও মওলানা ভাসানীর ন্যায় মানুষকে আপন করে নিতে পারেননি। বিশেষ করে জনজীবনের সাক্ষাত সমস্যাবলী যে গুলোর কাণে সাধারণ মানুষ জর্জরিত হচ্ছে, তাদের ঐসব সমস্যা সমাধানে সম্ভাব্য বস্তুগত সাহায্য সহানুভূতি নিয়ে তাদের দ্বারে পৌঁছুতে হবে। তাদের সাহায্যার্থে সাহায্য সংস্থা গঠন করতে হবে। নিছক বেশী বেশী উপদেশাবলী তাদের শোনানোর দ্বারা যতদূর না তাদের চিত্ত জয় করা সম্ভব, ঐ পদ্ধতিতে স্বল্প উপদেশেই তাদের অধিক সাড়া মিলতে বাধ্য। অন্ন ব্স্ত্রহীন চিকিৎসা বঞ্চিত কর্ম সংস্থাহীন ক্ষুদাক্লিষ্ট মানুষের সামনে খাদ্য বস্ত্র ও ওষুধের প্যাকেট রাখা কিংবা সেই আয়োজনই প্রধান কর্তব্য, তাতে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাদের চিত্ত জয় সহজ হবে, অন্য পন্থায় তা করতে বহু সময় লাগবে বৈ কি। মহান আল্লাহ এই জন্যেই সূরা মাউনে বলেছেন, “তুমি কি দ্বীনের অস্বীকারকারীদের দেখেছ? তারা হচ্ছে সেই সকল মানুষ যারা এতিম (অসহায়-দুর্বল) –দের গলা ধাক্কা দিয়ে তাদেরকে অবজ্ঞা করে চলে আর অন্ন বস্ত্রহীন অভাবী-ক্ষুধাক্লিষ্টদের খাবার দানে উদ্যোগী হয় না বা অপরকে উদ্যোগী করে তোলেনা? ঐ সকল নামাজীর জন্যেও দুর্ভোগ যারা নিজেদের নামাজের (তাৎপর্য সম্পর্কে) গাফিল উদাসীন। শুধু লোক দেখানোর জন্যেই তা করে এবং অপরকে প্রয়োজনীয় তুচ্চ জিনিস দানেও নিষেধ করতে দ্বিধা করেনা”। তেমনি মহানবী (সঃ) বলেছেন, “সে ব্যক্তি খাটি মুমিন নয় যে নিজে পেট পুরে আহার করে আর তার প্রতিবেশী ক্ষুধায় মরে”।
সত্যি কথা বলতে কি, আল-কুরআনে উল্লেখিত মানব জীবনের অতীব জরুরী খাদ্য সমস্যার সমাধানের প্রতি আমাদের ধর্মীয় মহলের যেরূপ গুরুত্ব দেয়া জরুরী ছিল, সেরূপ এই গরীব দেশে দেয়া হয়নি কিংবা দেয়া হলেও কুরআনের পারলৌকিক বিষয়াদিকে যেরূপ অধিক প্রাধান্য দেয়া হয়েছে, সে তুলনায় বহুত কমই দেয়া হয়েছে।
কায়েদে আযম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ও মওলানা আশরাফ আলী থানভী (রহ)
কায়েদে আযম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব ও বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ছিলেন। দীর্ঘ দিনের আযাদী আন্দোলনের পটভূমিতে শেষ পর্যায়ে আলাদা মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন তাঁরই নেতৃত্বে মনযিলে মাকসুদে পৌঁছে। ভারতে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের প্রবল বিরোধিতার মুখে অখণ্ড ভারতকে খণ্ড করে একটি মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সফলতা বিশ্বকে অবাক করে দিয়েছিল। বেশী অবাক করেছিল বস্তুবাদী সভ্যতার এই চোখ-ঝলসানো মুহুর্তে ধর্মের নামে, ইসলামের নামে শ্লোগান দিয়ে একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিষয়টি। এই বিস্ময়কর সফলতার মূলে কি রহস্য কাজ করেছিল, তার অনুসন্ধান করার দায়িত্ব ছিল তাঁর জীবনী লেখকদের উপর। সেই রহস্য উদঘাটনের চেষ্টা করা হলে আলেমদের আরেকটি বিরাট অবদানের তথ্য উদঘাটিত হত। মুলতানের জনাব আবদুল রহমান খাঁ তাঁর লেখায় অবিভক্ত পাকিস্তান আন্দোলনের মূল প্রেরণা সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে মরহুম মওলানা আশরাফ আলী থানভীর রুয়েদাদে তাবলীগ এর উদ্ধৃতি দিয়ে যুক্তি প্রমাণ সহকারে দেখিয়ে দিয়েছেন যে, পাকিস্তান আন্দোলনের প্রধান নেতার চরিত্রে মওলানা থানভীর কি প্রভাব ছিল।
মওলানা থানভীল আত্মবিশ্বাস ছিল যে, পাকিস্তান আন্দোলন অবশ্যই সফলতায় পৌঁছুবে। তাই তিনি একে ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত করা এবং কোরআন-সুন্নাহর ভিত্তিতে এর সংবিধান গঠন করতে হলে এর নেতাদের সর্বপ্রথম ইসলাশী হওয়ার বিষয়টি গভীরভাবে চিন্তা করেছিলেন। তিনি মনে করেছিলেন, যেই কথার ভিত্তিতে ভারতের ন্যায় বিশাল দেশকে খণ্ড করা হচ্ছে, তা প্রতিষ্ঠিত না হলে, এত বড় পরিবর্তন ও এই উদ্দেশ্য বহু মুসলমানের রক্ত, ত্যাগ-তিতিক্ষা সব কিছুই বিফলে যাবে। এজন্য তিনি ইসলামী রাষ্ট্র হবার প্রথম শর্ত মুসলিম নেতাদের তাবলীগের মাধ্যমে সংশোধনের চেষ্টা করেন। থানা ভবনের সবচাইতে বিত্তবান ব্যক্তি থানভী দরবারের বিশিষ্ট দূত খানকা-এ এমদাদিয়ার পরিচালিক ও মওলানা থানভীর ভ্রাতুষ্পুত্র জনাব শাব্বির আলীকে কাজে লাগান। শাব্বীরের লিখিত “রুয়েদাদে তাবলীগ” এর উদ্ধৃতিটি এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য –
১৯৩৮ খৃষ্টাব্দের কথা। একদিন দ্বিপ্রহলে খানা খেয়ে আমি অফিসে বসে কাজ করছি। হযরত থানভীও দুপুরের খানা খেয়ে বিশ্রামের উদ্দেশ্যে খানকায় তাশরীফ এনেছেন। বারান্দায় এসে আমাকে ডাক দিলেন। আমি দ্রুত হাযির হয়ে গেলাম এবং তাঁর সামনে বসে পড়লাম। হযরত থানভী মাথা নিচু করে কি যেন ভাবছিলেন। সে সময় ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব গৃহীত হয়নি। তবে কংগ্রেস ও হিন্দু নেতাদের মনের গতি অনেকটা আঁচ করা গেছে। নেতৃবৃন্দ ও সাধারণ মানুষ সকলের মুখে একই কথা যে, হিন্দুদের মুসলিমবিদ্বেষী মনোভাবের দরুণ তাদের সাথে মুসলমানদের ধর্মীয়, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, আর্থিক কোনদিক থেকেই সহাবস্থান সম্ভব নয়।
সুতরাং আলাদা মুসলিম রাষ্ট্র অবশ্যই গঠন করতে হবে। মওলানা থানভী দুই/তিন মিনিট পর মাথা তুললেন এবং আমাকে যেসব শব্দ বললেন আজও সেগুলো আমার কানে প্রতিধ্বনিত হচ্চে। তা হলো এই-
“মিঞা শাব্বির আলী! বায়ুর গতিপ্রবাহ বলে দিচ্ছে, লীগই জয়যুক্ত হবে। তারাই শাসনক্ষমতার অধিকারী হবে, যাদেরকে আজ ফাসেক-ফাজের বলা হচ্ছে। এজন্যে আমাদের এই প্রচেষ্টা চালানো উচিত যেন এসব লোক (মুসলিম লীগ নেতাদের) কে সংশোধন করা যায়। বর্তমান বাস্তব পরিস্থিতি হলো, আলেমদের হাতে ক্ষমতা আসলেও (আধুনিক রাজনীতিজ্ঞানসম্পন্ন আলেমের সংখ্যাল্পতা হেতু এ মুহুর্তে) তাদের রাষ্ট্র চালাতে বেগ পেতে হবে বৈ কি? ইউরোপের সঙ্গে কায়কারবার, আন্তর্জাতিক টানাহেঁচড়া, এই অবস্থায় ইংরেজী শিক্ষিত নেতাদের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত মুসলমান নেতারা ধার্মিক হয়ে ওঠে, সেটাই বরং আমাদের আনন্দের কথা। তারা ইসলাম অনুযায়ী দেশ শাসন করলে তাদের হাতেই রাষ্ট্রীয় পরিচালনা-ভার থাকতে অসুবিধা নেই। আমরা তাতে বরং আনন্দিতই হবো। ইসলামের জন্যই ক্ষমতায় যাওয়া। তারা সে দায়িত্ব পালন করলে আমরা ক্ষমতার প্রত্যাশা করি না। আমরা এটাই চাই যে, রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হোক, দ্বীনদার খোদাভীরু নেতৃত্বের হাতে ক্ষমতা থাকুক, যেন দ্বীনের প্রাধান্যই সমাজ জীবনের সর্বত্র প্রতিষ্ঠিত হয়”।
আমি একথার জবাবে বললাম, তবে হুযুর! এ তাবলীগ কি নিম্ন পর্যায় তথা সাধারণ মানুষ তেকে শুরু হবে, না উপরস্থ নেতৃবৃন্দ থেকে? থানভী সাহেব বল্লেন, “উপর থেকে শুরু করতে হবে। কেননা সময় অতি কম। উপরন্তু নেতার সংখ্যাও ততবেশী নয়। আন্নাসু আলা দ্বীনে মুলুকিহিম “মানুষ সকল সময় নিজেদের রাষ্ট্রীয় নেতাদের রীতিনীতিরই অনুসরণ করে। নেতারা ধার্মিক হলে ইনশাআল্লাহ সাধারণ মানুষও সংশোধন হয়ে যাবে”। (-রুয়েদাদ পৃঃ ১,২)
তাবলীগী প্রতিনিধি দল গঠন
৪ঠা জুন, ১৯৩৮ খৃঃ। বোম্বেতে মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটির অধিবেশন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। লীগ নেতাদের হেদায়াতের জন্য মওলানা থানভী উক্ত অধিবেশনে এক তাবলীগী প্রতিনিধি দল পাঠাতে মনস্থির করলেন। তিনি মওলানা শাব্বীর আহমদ ওসমানীকে এই প্রতিনিধি দলের নেতা নির্বাচন করলেন। মওলানা আবদুর রহমান গমথালভী এবং ছাহারানপুরের অপর একজনকে প্রনিতিধি দলের সদস্য মনোনীত করেন। প্রতিনিধি দলের খরচ বাবত তিনি নিজ পকেট থেকে তিন’শ টাকা বের করে দিয়ে বললেনঃ মওলানা শাব্বীর আহমদ ট্রেনে সেকেণ্ড, ফার্ষ্ট যেই ক্লাসেই সফর করে, তাঁকে সেই ক্লাসের টিকেট কেটে দিও। তোমরা তৃতীয় অথবা ইন্টার ক্লাসের টিকেট কেটো। বোম্বেতে আরও টাকার দরকার পড়লে হাকীম আজমীরী সাহেব থেকে নিয়ে নিও এবং বোম্বেতে থাকতে আমাকে চিঠি দিও যেন টাকা পাঠাতে পারি। ফিরে এসে বললে টাকা পৌঁছুতে বিলম্ব হবে। (-রুয়েদাদ, ২ পৃঃ)
মওলানা শওকত আলীকে পত্রদান
মওলানা থানভী (রহ) প্রতিনিধি দলের যাত্রা সম্পর্কে মওলানা শওকত আলীকে অবহিত করেন এবং ইউ পি-র মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারী বোর্ডের সভাপতি জনাব ইসমাঈল খাঁকেও এই মর্মে একটি পত্র লিখলেন। পত্রটির সারমর্ম এই-
“আসসালামু আলাইকুম, আপনার পত্রখানা পেয়েছি। জেনে খুশি হলাম যে, আপনিও ঐ সম্মেলনে ওলামা প্রতিনিধি দলের অংশগ্রহণকে গুরুত্ব দিচ্ছেন। এ প্রতিনিধি দলের থাকার ব্যবস্থাকল্পে মওলানা শওকত আলীকেও পত্র লিখেছি। তাতে একথা জানিয়ে দিয়েছি যে, খাবার ব্যবস্থা তারা নিজেরাই করবে”। সারকথা, ইনশাআল্লাহ তারা ৩রা জুন ভোরে এক্সপ্রেসে বোম্বে পৌঁছুবে। আশা করি, আপনি মিস্টার মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ এবং অন্যান্য মুসলিম লীগ সদস্যের সঙ্গে আলাপ করে তাদের সাথে তাঁর আনুষ্ঠানিক আলেচনার যাবতীয় ব্যবস্থা করে দেবেন”।
-ওয়াসসালাম
আশরাফ আলী
থানাভবন
প্রতিনিধি দলের প্রতি উপদেশ
লীগ নেতা জিন্নাহ সাহেবের সঙ্গে আলোচনার ব্যাপারে মওলানা থানভী মওলানা শাব্বীর আলীকে যেই পরামর্শ দিয়ে পাঠান, তা হলো-
জিন্নাহ সাহেবের সঙ্গে যেসব বিষয় আলোচনা করা হবে আমি সেগুলো মওলানা শাব্বীর আহমদকে লিখে দিয়েছি। সেই দলের প্রতিনিধি। এ ছাড়া কথাবার্তাও গুছিয়ে বলার যোগ্যতা আছে, তবে তোমার কথা বলার প্রয়োজন হলে নরম সুরে বলবে। বিতর্কমূলক বিষয় অবশ্যই পরিহার করবে। শ্রোতা বিতর্কমূলক বিষয় আলোচনায় আনতে চেষ্টা করলেও বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে তা এড়িয়ে যাবে এবং অন্য প্রসঙ্গের অবতারণা করবে। শ্রোতার কোনো কাজের ব্যাপারে সমালোচনার দরকার হলে তা সমালোচনার সুরে না বলে তাবলীগ ও সহানুভূতির ভঙ্গিতে ব্যক্ত করবে। শব্দ মোলয়েম হলেও জবাব এমনভাবে দেবে যাতে শ্রোতা অনায়াসে বুঝে নিতে পারেন। যেমন একটা দৃষ্টান্ত দিচ্ছি –একবার আমি ফতেহপুর হতে এলাহাবাদ যাচ্ছিলাম। ট্রেনে কয়েকজন আলীগড়ের শিক্ষাপ্রাপ্ত যুবকও সফর করছিল। তারা আমাকে জানতো না। মৌলভী আকৃতির দেখে জিজ্ঞেস করলো, “মওলানা! কুকুর পালা শরীয়তে নিষেধ কেন? অথচ এর মধ্যে অনেক ভাল গুণওতো রয়েছে”। জাতীয় সহমর্মিতা ও সহানুভূতির জন্য আলীগড়ের তখন খ্যাতি। ঐ সময় আমি তাদের নিকট শরীয়তের মাসয়ালা ও আল্লাহ-রসূলের হুকুম-আহকাম বর্ণনা করলে আলোচনা দীর্ঘায়িত হয়ে যাবে। এদিকে তাদের অন্তরে কুকুর পালার অপকারিতার প্রতি ঘৃণার ভাব সৃষ্টির আসল উদ্দেশ্যও হাসিল হবে না। তাই বল্লামঃ কুকুরের অন্যান্যগুণ আছে ঠিকই, কিন্তু এর এমন একটি দোষ রয়েছে যা সকল গুণকে বিনষ্ট করে দেয়। তারা ঔৎসুক্য নিয়ে জিজ্ঞাসা করলো, তবে সেই দোষটি কি? আমি বললাম, এতে স্বজাতীয় সহানুভূতি নাই। নিজ সম্প্রদায়ের অন্য একটিকে দেখামাত্রই তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তার সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। জবাবে যুবকদল অত্যন্ত সন্তুষ্ট হয়ে বলল, সত্রই এ জীব কাছে রাখার অনুপযোগী। এতে নিজের মধ্যেও এর প্রভাব দেখা দেবে। -কাজেই নেতাদের সঙ্গে আলোচনাকালে লক্ষ্য রাখবে যাতে মূল উদ্দেশ্য হাতছাড়া না হয়। তবে কথা বলার সময় শ্রোতার জ্ঞানের দিকেও বিশেষ লক্ষ্য রাখবে। (-রুয়েদাদ, ৩ পৃষ্ঠা)
এ নির্দেশ নিয়ে মওলানা শাব্বীর আলী ১লা জুন (১৯৩৮ খৃঃ) প্রতিনিধি দলের অন্যান্য সদস্যের সাথে মওলানা শাব্বীল আহমদ ওসমানীর নিকট পৌঁছেন, যিনি প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব করবেন। তাঁর নিকট মওলানা থানভীর চিঠি দেয়া হলো। কিন্তু অকস্মাৎ মওলানা শাব্বীর আহমদ ওসমানীর মাতা গুরুতর রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ায় তিনি বোম্বে যেতে অক্ষমতা প্রকাশ করলেন। প্রতিনিধিদলের সদস্যগণ পুনরায় থানাভবন এসে মওলানা থানভীর কাছে সকল ঘটনা খুলে বললেন। এতে তিনি অত্যন্ত অস্বস্তি বোধ করলেন। অতঃপর ‘যা হয়েছে ভালর জন্যই হয়েছে” বলে নবাব মুহাম্মদ ইসমাঈল খাকেঁ তিনি পুনরায় চিঠি লিখলেন যে, উল্লেখিত কারণে প্রতিনিধি দলের বোম্বে যাওয়া অনিশ্চিয়তার সম্মুখীন হয়ে পড়েছে। পরে বিস্তারিত জানাবো। মওলানা থানভী প্রতিনিধি দলের উপযুক্ত নেতৃত্বদানের লোক না পেয়ে ঐবারের মতো বিষয়টি মুলতবী রেখে দিলেও ঐ সালের (১৯৩৮ খৃঃ) ডিসেম্বর মাসে তিনি পাটনায় মুসলিম লীগের বার্ষিক অধিবেশনে তাবলীগি প্রতিনিধি দল প্রেরণ করেছিলেন। বিশিষ্ট মুসলিম নেতারা ঐ অধিবেশনে যোগ দিয়েছিলেন। এবারকার প্রতিনিধি দলের সদস্য ছিলেন –মওলানা জাফর আহমদ ওসমানী, মওলানা আবদুল জাব্বার আবুহবী, মওলানা আবদুল গণী ফুলপুরী এবং মওলানা মুয়াযযম হোসাইন। মওলানা মুরতাজা হাসানকে প্রতিনিধি দলের নেতা নির্বাচন করা হয়। প্রয়োজনীয় খরচের টাকা মওলানা নিজের পকেট থেকে বের করে মওলানা শাব্বীর আলীর হাতে দিলেন এবং পাটনায় গিয়ে তাঁর বিশিষ্ট শিষ্য উকিল আবদুর রহমানের বাসায় অবস্থানের জন্য বলে দিলেন। মওলানা থানভী পূর্বাহ্নেই আবদুর রহমান কে এ ব্যাপারে চিঠি দিয়ে রেখেছিলেন। ২৪শে ডিসেম্বর (১৯৩৮ খৃঃ) প্রতিনিধি দল পাটনায় পৌঁছুল। কায়েদে আযমের সঙ্গে সাক্ষৎ প্রসঙ্গে রুয়েদাদ মওলানা শাব্বীর আলী লেখেন-
“আমাদের কোন কোন সঙ্গী মুসলিম লীগ অধিবেশনে শরীক হতে চাইলেন। আমি নিষেধ করলাম। কারণ আমরা মওলানা থানভীর পক্ষ থেকে প্রেরিত। জিন্নাহ সাহেবের সঙ্গে আলোচনার আগ পর্যন্ত আমরা অধিবেশনে শরীক হতে পারি না- আমরা দেখবো, তিনি কি জবাব দেন। আমি এখনই নবাবযাদা লেয়াকত আলী খানের নিকট যাচ্ছি। তাঁর মাধ্যমে আলোচনার সময় নির্ধারণ করে আসবো। আমি চলে গেলাম। লিয়াকত আলী খান জিন্নাহ সাহেবকে জানালেন। জিন্নাহ সাহেব বিকেল ৫টায় আলোচনার সময় রাখলেন। ফিরে এসে প্রতিনিধি দলের নেতা মওলানা মুরতাযা হাসান সাহেবকে জানালাম।
বিকেল সাড়ে চারটায় আমরা বাসা থেকে বের হলাম। ঠিক ৫টার সময় জিন্নাহ সাহেবকে আমাদের আগমনের খবর দিলাম।
কায়েদে আযম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর সঙ্গে প্রতিনিধি দলের প্রথম সাক্ষাতকার
“উপরে উঠলাম। জিন্নাহ সাহেব কুরসীতে বসা। আমাদের দেখে দাঁড়িয়ে গেলেন। সকলের সঙ্গে মোসাফাহা করলেন। জিন্নাহ সাহেব অধিবেশন উপলক্ষে যাঁর বাড়ীতে অতিথি হয়েছেন, তিনি হলেন ব্যারিষ্টার আবদুল আযিয। তিনি আমাদের সকলকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। আলোচনা শুরু হলো। প্রায় এক ঘণ্টা কাল আলোচনা স্থায়ী ছিল। জিন্নাহ সাহেব এমন সন্তোষজনক উত্তর দিলেন যে, তাঁর প্রতিটি উত্তরে আমরা সকলে বিশেষ করে আমি অত্যন্ত প্রভাবিত হলাম।
কারণ আলোচনা চলাকালে তাঁর কোন কথা-কাজের অসঙ্গতির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি কোনরূপ ব্যাখ্যা কারণ প্রদর্শন ছাড়াই নিজের ত্রুটি স্বীকার করে নিতেন এবং ভবিষ্যতে সংশোধনের প্রতিশ্রুতি দিতেন। আমাদের বলতেন –“আপনারাও আমার জন্য দোয়া করবেন যেন নিজেকে সংশোধন করতে পারি”। জিন্নাহ সাহেবের মত ব্যক্তিত্বকে আমরা কি সংশোধন করবো? –এটা বরং মওলানা থানভীর ন্যায় আল্লাহর খাস বান্দাহ আধ্যাত্মিক আকর্ষণেরই ফল যে, জিন্নাহ সাহবে আমাদের সাক্ষাতে অত্যন্ত প্রভাবিত হয়েছেন। অথচ এটা প্রায় সকলেরই জানা কথা যে, অনেক বড় বড় ব্যক্তির কথায়ও জিন্নাহ সাহেব সহজে প্রভাবিত হওয়ার পাত্র ছিলেন না”।
জিন্নাহ সাহেবের সঙ্গে নামাজের আলোচনা
একবার এক ঘটনার আলোচনা প্রসঙ্গে অনেক ধর্মীয় বিষয়ও তাঁর সাথে আলোচিত হয়। তন্মধ্যে একটি বিষয় এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, যা কায়েদে আযমের চরিত্র ও চিন্তাধারার বিরাট পরিবর্তন এনে দিয়েছিল। মওলানা শাব্বীর আলী সাহেব জিন্নাহ সাহবেরে সাথে প্রথম সাক্ষাকতারের উপর আলোকপাকত করতে গিয়ে লিখেছেন-
“আলোচনার এক পর্যায়ে আমি জিন্নাহ সাহেবকে প্রশ্ন করলাম যে, আপনি হাজার হাজার টাকা ব্যয়ে র্সভার প্যাণ্ডেল ইত্যাদি তৈরী করেন। জনতা গলা ফাটিয়ে ‘নারায়ে তাকবীর’ শ্লোগান দেয়। তাতে লাভ কি? জিন্নাহ সাহেব বল্লেন, “এতে বিধর্মীদের উপর প্রভাব পড়ে”। আমি বল্লাম, এজন্যে অন্য একটি প্রস্তাব দিতে পারি কি, যাতে আরও অধিক প্রভাব পড়বে? তিনি বল্লেন, তা কেমন? বল্লাম, সভা চলাকালীন যদি নামাজের সময় এসে যায়, তখন এক লাখ/দেড় লাখ লোক নিয়ে জামায়াতে নামাজ আাদায় করা। তাতে দেখবেন মানুষের উপর এর কিরূপ প্রভাব পড়ে। জিন্নাহ সাহেব সঙ্গে সঙ্গে বল্লেন, আপনি তা ঠিকই বলেছেন, কিন্তু এ মুহুর্তে আমি তা করতে অপারগ”। অতপর আমি কারণ জানতে চাইলে তিনি বল্লেন, “আপনি জামাতে নামাজ আদায় করার কথা বলছেন। ইমাম কাকে করবো? সকলে না হোক, বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ লোক আমার পেছনে নামাজ পড়বে না। এছাড়া আমি ইমামতের যোগ্যও নই। আমার মধ্যে এর যোগ্যতাও নেই। এজন্যে অপরকে ইমাম বানাতে হবে। ফলে ইমাম দেওবন্দী হলে ব্রেলভী তাঁর পেছনে নামাজ পড়বে না, আর ব্রেলভী হলে দেওবন্দী নামাজ পড়বে না তাঁর পেছনে। আলাদাভাবে নামাজ পড়লেও প্রভাবের পরিবর্তে বিজাতীয়ের কাছে মুসলমানদের মতবিরোধ নগ্ন হয়ে ফুটে উঠবে। এখন প্রত্যেকে নিজ নিজ মসজিদে নামাজ পড়ে আসে। একাধিক দল কয়েক জায়গায় নাজা পড়লে এতেও প্রভাব বেশী বই কম পড়বে না। এ কারণে বর্তমান পরিস্থিতিতে তা করতে অসুবিধা বৈ কি? তবে ভবিষ্যতে দেখা যাবে”।
আমি বল্লাম, এই অজুহাত যথার্থ কিনা সে বিষয়ে আলাপ করতে গেলে আলোচনা দীর্ঘ হয়ে যাবে। সে সম্পর্কে অন্যসময় আলোচনা করবো। এখন আর একটি কথা আরয করছি। খোদ আপনার উপরওতো নামাজ ফরয –পড়েন না কেন? আপনি সভা-সমিতিতে যখন নামাজের সময় হয় জায়নামাজ বিছিয়ে নিয়ত বেঁধে নিন –তাতে অপর কেউ পড়ুক বা না পড়ুক”।
এ পর্যন্ত আমি জিন্নাহ সাহেবের কথা নকল করলাম। ভাষা আমার –বক্তব্য তাঁর। সামনে উপরোল্লিখিত প্রশ্নের যে জবাব জিন্নাহ সাহেব দিয়েছেন, সে সকল শব্দের ধ্বনি আজও আমার কানে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। ঐ জবাবটি শুনে আমি ঘর্মাক্ত হয়ে গেলাম। একজন বেআমল অথচ বিরাট ব্যক্তিত্বের পক্ষে এভাবে সবার সামনে নিজের ত্রুটি স্বীকার করা অত্যন্ত বড়কতা। আমাদের মতো লোক এরূপ প্রশ্নের সম্মুখীন হলে হয়তো অন্য কোনো ব্যাখ্যার আশ্রয় নিতাম। আল্লাহ তাঁকে ক্ষমা করুন। তিনি কুরসীতে হেলান দিয়ে বসা ছিলেন। আমার কথা শুনে সম্মুখে ঝুঁকে আসলেন এবং নেহায়েত অনুশোচনার সুরে নিম্নের কথাগুলো বল্লেনঃ
“আমি গুনাহগার –অপরাধী। আপনাদের অধিকার আছে আমাকে বলার। এসব কথা শোনা আমার কর্তব্য। আমি আপনাদের সঙ্গে ওয়াদা করছি ভবিষ্যতে নামা পড়বো”। আমরা প্রতিনিধি দলের সদস্যরা ছাড়াও সেখানে অন্য বার/তের জন বিশিষ্ট ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন। তন্মধ্যে ছাহারণপুরের উকিল মৌলভী মনফাত আলী সাহেব, পাটনার উকীল মৌলভী আবদুল রহমাদন সাহেব এবং পাটনার ব্যারিষ্টার জনাব আবদুল আযীয সাহেবই শুধু আমার পরিচিত ছিলেন। তাঁদের সামনে কোনোরূপ ব্যাখ্যার আশ্রয় না নিয়ে এরূপ ভাষায় অকপটে নিজের ত্রুটি স্বীকার এবং ভবিষ্যতে সংশোধনের প্রতিশ্রুতি আমাদের দারুনভাবে প্রভাবিত করে। এ অবস্থায় নিজেকে সামলে নিয়ে চট করে আমি বল্লাম –দেখুন, এটা জিন্নাহ সাহেবের ওয়াদা –কোন পথ চলা লোকের ওয়াদা নয়। এ ওয়াদা অবশ্যই পূরণ হবে। এ কথায় জিন্নাহ সাহেব সোজা হয়ে বসলেন এবং বার বার বুকে হাত মেরে বলতে লাগলেনঃ জিন্নাহর ওয়াদা, জিন্নাহর ওয়াদা, আমি এই ওয়াদা পালনের চেষ্টা করবো। আপনি আমার জন্য দোয়া করবেন”। -(মুশাহাদাত ও ওয়ারেদাত, ১১৪-১১৮ পৃঃ)
মুসলিম লীগ অধিবেশনে মওলানা থানভীর লিখিথ ভাষণ পাঠ
“জিন্নাহ সাহেবের সঙ্গে প্রতিনিধি দলের সাক্ষাতের পর মুসলিম লীগের দ্বিতীয় দিনের অধিবেশনে আমি মওলানা থানভীর প্রতিনিধি হিসাবে যোগদান করি। এই অধিবেশনে থানভীর লিখিত ভাষণ পাঠ করে শুনান হয় এবং সকলের মধ্যে এর ছাপানো বুকলেট বিলি করা হয়। এ পুস্তিকায় লীগ নেতৃবৃন্দ ও কর্মীদেরকে নামায, রোযাসহ ইসলামী কৃষ্টি-সংস্কৃতির পূর্ণ অনুসারী হবার আহবান জানানো হয়। তার পূর্বদিন প্রতিনিধি দল থানভী সাহেবের নিকট তাদের প্রথম সফলতার কথা ব্যক্ত করেন। তিনি তাতে অত্যন্ত সন্তুষ্ট হন এবং জিন্নাহ সাহেবও তাঁর লক্ষ্য অর্জিহত হবার জন্য দোয়া করেন”।
কায়েদে আযমের সঙ্গে দ্বিতীয় দফা সাক্ষাত
এরপর থেকেই থানভীর সাহেব কায়েদে আযমের কথা ও কাজের প্রতি গভীরভাবে লক্ষ্য রাখতেন। তাঁর মধ্যে শরীয়ত বিরোধী কোনো কিছু দেখা মাত্রই তিনি প্রতিনিধির মাধ্যমে তাঁর কাছে লিখে পাঠাতেন। ১৯৩৮ সালের আগষ্টের পর কায়েদে আযম যেসব বক্তৃতা দিয়েছেন এগুলোর মধ্য দিয়ে তাঁর ধর্মীয় ও রাজনৈতিক চিন্তাধারা পরিস্কার হয়ে ওঠে। তিনিও পাশ্চাত্যের ধর্মনিরপেক্ষদের ন্যায় ধর্ম ও রাজনীতিকে আলাদা জ্ঞান করতেন এবং একটিকে আরেকটি থেকে আলাদা করতে চেয়েছিলেন। এতে মওলানা থানভী শাব্বীর আলী সাহেবকে ডেকে বললেনঃ
“জিন্নাহ সাহেবের বক্তৃতা-বিবৃতিতে দেখা যাচ্ছে যে, তিনি ধর্ম ও রাজনীতিকে আলাদা মনে করছেন। এ ব্যাপারে তুমি তাঁকে বুঝাবে”। -(রুয়েদাদ এ তাবলীগ, ৬ পৃঃ)
মওলানা শাব্বীর আলী সাহেব এজন্যে ঝটপট তৈরী হয়ে গেলেন। তাঁর অনুরোধে থানভী সাহব এবার তার সহকারী দিলেন মওলানা জা’ফর আহমদ ওসমানী ও মুফতী –এ আযম মওলানা মুফতী মুহাম্মদ শফী সাহেবকে। তিন সদস্য বিশিষ্ট এই প্রতিনিধি দলটি ১২ই ফেব্রুয়ারী ১৯৩৯ খৃঃ দিল্লী পৌঁছেন। মওলানা শাব্বীল আলী কায়েদে আযমকে টেলিফোনে নিজের পরিচয় পেশ করলেন। “আমি সেই ব্যক্তি যে একবার পাটনায় আপনার সাক্ষাত লাভ করেছিলাম। আমাকে কিছু সময় দিতে মর্জী করবেন”। কায়েদে আযম তাঁকে সন্ধ্যা ৭টায় সময় দিলেন। প্রতিনিধি দল যথাসময় উপস্থিত হয়ে তাঁর কাছে আগমনের উদ্দেশ্য ব্যক্ত করলেন।
ধর্ম ও রানীতি সম্পর্কে আলোচনা
ধর্ম ও রাজনীতি সম্পর্কে জ্ঞানের আদান-প্রদান চলল। মওলানা জা’ফর আহমাদ ওসমানী কায়েদে আযমকে বল্লেনঃ
“মুসলমান কোন আন্দোলনে ততক্ষণ পর্যন্ত সফলতা লাভ করতে পারবে না, যতক্ষণ না ঐ আন্দোলনের নেতারা নিজেরা ইসলামী বিধানের অনুসারী হবেন এবং তাদের কর্মীরা ইসলামী কৃষ্টি-সংস্কৃতি মেনে চলে। তাঁরা নিজেদেরকে ধর্মীয় বিধানের অনুসারী করলে ইনশাআল্লাহ তার বরকতেই আল্লাহর সাহায্য আসবে ও সফলতা তাঁদের পদচুম্বন করবে। প্রতিনিধি দল বললেন, -“মুসলমানদের রাজনীতি কখনও ধর্ম থেকে আলাদা নয়। মুসলিম জাতির মহান নেতৃবৃন্দ এক সময় মসজিদের ইমাম ছিরেন আবার রণাঙ্গণেও সেনাধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেছেন। খোলাফায়ে রাশেদীন, হযরত খালেদ ইবনে ওলীদ (রাঃ), হযরত আবু ওবায়দা ইবনুল জাররাহ, হযরত আমর ইবনুল আ’স প্রমুখ মুসলিম নেতৃবৃন্দ যুগপৎ ধর্ম ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের অনুশীলনকারী ছিলেন”। কায়েদে আযম বল্লেন –আমারতো ধারণা এই যে, ধর্মকে রাজনীতি থেকে আলাদা রাখা উচিৎ। প্রতিনিধি দল বললেনঃ –তাহলে এভাবে কিছুতেই সফলতার আশা করা যায় না। এ ব্যাপারে জিন্নাহ সাহেবের সঙ্গে আড়াই ঘন্টা আলোচনা চলে। তারপর প্রতিনিধি দলের আলেমগণ বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ও সফলকাম রাজনীতিককে ধর্মের সীমায় আনতে সক্ষম হন। কায়েদে আযম প্রতিনিধি দলের উপস্থাপিত বক্তব্যসমূহ স্বীকার করে নিয়ে নিজের এই ঐহিাসিক সিদ্ধান্তের কথা ঘোষনা করলেনঃ
“বিশ্বের অন্য কোন ধর্ম রাজনীতি থেকে আলাদা থাক বা না থাক, আমার নিকট এটা সুস্পষ্ট যে, ইসলামের রাজনীতি ধর্ম থেকে আলাদা নয়। বরং এখানে রাজনীতি ধর্মের অনুগত”। -(রুয়েদাদ, ৭ পৃঃ)
-[ কায়েদে আযম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ মওলানা আযাদ সম্পর্কে যে উক্তি করেছেন, সম্ভবতঃ আযাদের রচনাবলী, তাঁর চিন্তাধারা ও ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে সম্যক অবগতির জন্যে যেসব বিষয় এবং যেই প্রচুর সময় ও মনমানসিকতার দরকার ছিল, জিন্নাহ সাহেবের পক্ষে তা সম্ভব হয়ে ওঠেনি বলেই এরূপ মন্তব্য করে বসেছেন। উভয়ের রাজনৈতিক মতদ্বৈদতা জনিত সাময়িক উত্তেজনাও এরূপ মন্তব্যে তাঁকে উদ্ধুদ্ধ করতে পারে বৈ কি। অন্যথায়, এশিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজনীতিবিদ ও চিন্তানায়খ পরলোকগত ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীে নেহরু অল ইন্ডিয়া রেডিওতে মওলানা আযাদ প্রসঙ্গে “মেরা সিয়াসী উস্তাদ –আমার রাজনৈতিক গুরু” বলে তাঁকে উল্লেখ করতেন।]
তাবলীগী সাক্ষাতকারের ধারাবাহিকতা
এভাবে থানভী দরবার ও কায়েদে আযম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর সঙ্গে সাক্ষাতকার পর্যায়ক্রমে চলতে থাকে। যখনই কোনো ব্যাপারে ধর্মীয় দিক থেকে মওলানা থানভী কায়েদে আযমকে কিছু বলার প্রয়োজন মনে করতেন, সঙ্গে সঙ্গে তিনি তাঁর কাছে প্রতিনিধি প্রেরণ করতেন। পরবর্তী পর্যায়ে মওলানা শাব্বীর আলীই কেবল প্রতিনিধিত্বের দায়িত্ব পালন করতেন। তবে মওলানা শাব্বীর আলীকে জিন্নাহ সাহেবের সঙ্গে রাজনৈতিক আলোচনার অনুমতি থানভীর দেননি। কারণ, জিন্নাহ সাহেব নিজেই এ ব্যাপারে অভিজ্ঞ ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর মধ্যে অভাব ছিল শুধু ইসলামী জ্ঞানের। তাই জিন্নাহ সাহেবের সঙ্গে মওলানা শাব্বীর আলী যতবারই সাক্ষাত করেছেন প্রত্যেকবার ধর্মীয় বিষয়ই আলোচ্য বিষয়। রাজনৈতিক কোনো আলোচনা হয়নি। যেমন রুয়েদাদে মওলানা শাব্বীর আলী উল্লেখ করেছেন-
একবার থানভী সাহেবের নির্দেশক্রমে আমি কায়েদে আযমের নিকট উপস্থিত হলাম, সময় ঐ সন্ধ্যা সাতটা। এখনও পরস্পরের কুশলাদি জিজ্ঞাসাবাদ চলছে, এমন সময় বাইরে গাড়ীর হর্ণ শুনা গেল। দারওয়ান এসে বলল, ডক্টর জিয়াউদ্দীন সাহেব এসেছেন। আমি তো ভেবেছি আজকের আলোচনা বোধ হয় এ পর্যণ্তই শেষ –আর এক দিনের প্রোগ্রাম করতে হবে। কিন্তু জিন্নাহ সাহেব ক্ষণিক ইতস্তত করে দারওয়ানকে বল্লেনঃ ডক্টর সাহেবকে বসিয়ে দাও। অতঃপর তিনি আমাকে লক্ষ্য করে বললে, হ্যাঁ জী বলুন। আমি আমার বক্তব্য পেশ করতে লাগলাম। জিন্নাত সাহেবও আলোচনা করতে লাগলেন। এটা হযরত থানভীরই বরকত যে, আমার মতো পুঁজিশূন্য ব্যক্তি আলোচনার মধ্য দিয়ে জিন্নাহ সাহেবের মতো ব্যক্তিত্বের সামনে যুক্তিপূর্ণভাবে বক্তব্য পেশ করতে সক্ষম হয়েছিলাম। এই আলোচনা বৈঠকও কায়েদে আযমের এই বাক্যটির মধ্যদিয়ে সমাপ্ত হয়েছিল যে, -“হ্যাঁ, আমার ভুল ছিল। এখন বুঝে এসেছে”।
রাত দশটায় আলোচনা বৈঠক সমাপ্ত হয়। আমি অনুমতি নিয়ে দাঁড়িয়ে বললাম, সর্বদাই আপনার সময় ব্যয় করি, আজ কিন্তু আমার কারণে ডক্টর সাহেবের বেশী কষ্ট হয়েছে। এতে কায়েদে আযম বল্লেনঃ “না না, আপনি কখনও এটা মনে করবেন না। ডক্টর সাহেবের সঙ্গে সব সময়ই কথা হয়। এখনও তিনি কেন এসেছেন আমি জানি। কিন্তু আপনি তো মাঝে-মধ্যে আসেন এবং হযরত থানভীর কতাই আমাকে বুঝান। আমার নিকট অনেক আলেমই আসেন, কিন্তু তাঁরা অভিজ্ঞ নন। আমি ধর্মের ব্যাপারে অনভিজ্ঞ। হযরত থানভী আপনাকে একবারও কোন রাজনৈতিক ব্যাপারে কথা বলার জন্য পাঠাননি। আপনার দ্বারা আমার খাস ধর্মীয় ব্যাপারে জ্ঞান লাভ হচ্ছে, যা অপর কোথাও ভাগ্যে জুটছে না। আপনি যদি আরও কিছু বলতে চান, বসুন-আমার কোনো তাড়াহুড়া নেই। আমি পূর্ণ মনোযোগ সহকারে শুনবো”।
আমি বললাম, অদ্য আমার যা বক্তব্য ছিল বলে ফেলেছি। ধর্মীয় ব্যাপারে আপনার এই আগ্রহ আল্লাহ আরও বৃদ্ধি করুন। হযরত থানভী আবার হুকুম করলে আপনার দরবারে হাযির হবো। “আচ্ছা আপনার মর্জী” –জিন্নাহ সাহেব বললেন। আমি ঐ দিনকার মত চলে এলাম। (রুয়েদাদ ৮, ৯ পৃঃ)
মওলানা থানভীর প্রতি জিন্নাহ সাহেবের আস্থা
হযরত মওলানা আশরাফ আলী থানভী সাহেবের প্রতিনিধি শাব্বীর আলী সাহেবের সঙ্গে কায়েদে আযমের অকপটে কথাবার্তা চলতো। কোন কোন সময় উভয়ের সূক্ষ্মানুভূতি বিনিময়েরও পরিবেশ সৃষ্টি হতো। যেমন শাব্বীর আলী সাহেব লিখছেনঃ
“একবার আলোচনা প্রসঙ্গে আমি বললামঃ জিন্নাত সাহেব! আমরা ইংরেজী রাজনীতিতে অনভিজ্ঞ, এজন্যে সে ব্যাপারে আপনার ‘তকলীদ’ (অনুসরণ) করি। আপনি ইংরেজকে থাপ্পর মারতে বললে আমরা থাপ্পর মারি। আপনি ঘুষি মারতে বল্লে আমরা ঘুষি মারি। মোটকথা, আপনি যা বলেন এ ব্যাপারে আমরা আপনার অনুসরণ করি। আমরা (আধুনিক) রাজনীতির ব্যাপারে যে পরিমাণ অনভিজ্ঞ আপনি ধর্মের ব্যাপারে তার চাইতে বেশী বা সে পরিমাণ অনভিজ্ঞ। সুতরাং আমরা যেভাবে আপমার ‘তকলীদ’ করি, আপনারও ধর্মীয় ব্যাপারে আমাদের তকলীদ করা উচিত। তার জবাবে জিন্নাহ সাহেব প্রশ্ন করলেন, “বর্তমানে পৃথিবীতে নেতার সংখ্যা কত? আমি বললাম, বর্ষাকালে ব্যাঙের সংখ্যা যত থাকে। এতে কায়েদে আযম বেশ হাসলেন এবং বললেনঃ ঠিকই বলেছেন। তারপর বললেনঃ “আপনারা কি প্রত্যেক নেতাকেই মানেন?” আমি বললামঃ না। মানার জন্য কারুর প্রতি আস্থা থাকা শর্ত”। তিনি বললেনঃ
“বস, আপনার যদি এটাই উদ্দেশ্য হয়ে থাকে যে, আমি বিনা দ্বিধায় আপনার কথা মেনে নেই, তাহলে আমি প্রস্তুত আছি। এযাবত তো বুঝার জন্যেই আমি আপনার সঙ্গে তর্ক-করতাম; কিন্তু আজ থেকে চুপচাপ বসে শুনবো। ধর্মীয় ব্যাপারে আপনি যেই নির্দেশ দেবেন, তা মেনে নেবো। কারণ, মওলানা থানভীর প্রতি আমার পূর্ণ আস্থা রয়েছে। ধর্মীয় ব্যাপারে তাঁর স্থান অনেক ঊর্ধ্বে এবং তাঁর মতসমূহ সঠিক ও নির্ভরযোগ্য হয়ে থাকে”।
আমি বললাম, “আল্লাহ আপনাকে প্রতিদান দিন। হযরত থানভীর মতামত গৃহীত হোক এটাই আমি চাই। তবে তর্ক অবশ্যই আপনি করবেন। এভাবে কথা বুঝে নিলে হৃদয় তা স্থায়ীভাবে রেখাপাত করে। তবে হতে পারে, আমার ত্রুটির ফলে কোনো সময় কথা বুঝাতে আমি ব্যর্থ হবো। আপনাকে কিন্তু তা মেনে নিতে হবে”। -একথা শুনে জিন্নাহ সাহেব হেসে উঠে বললেনঃ “অবশ্য অবশ্যই”। -(রুয়েদাদ-৯, ১০ পৃঃ)
কায়েদে আযমের নিকট থানভী সাহেবের চিঠি
তাবলীগী প্রতিনিধি দল প্রেরণ ছাড়াও মওলানা থানভী সাহেব কখনও কখনও সরাসরি জিন্নাহ সাহেবের সঙ্গে পত্র-বিনিময় করতেন। যেমন একটি চিঠিতে তিনি লিখেছেন-
…. “আমি বরাবর মুসলিম লীগকে সংশোধনের চেষ্টা চালিয়ে আসছি এবং দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের নামে চিঠিপত্র ও সাধারণ পুস্তিকা প্রেরণ করে আসছি। সম্প্রতি পাটনায় অনুষ্ঠিত লীগ সম্মেলনে আমার কতিপয় প্রিয়জন ও বন্ধুবান্ধবের সমন্বয়ে গঠিত একটি প্রতিনিধি দল এ উদ্দেশ্যে প্রেরণ করেছি। তারপর ১৯৩৯ সালের ১২ই ফেব্রুয়ারী কয়েকজন বন্ধু-বান্ধবকে একই উদ্দেশ্যে দিল্লী প্রেরণ করেছি। মোটকতা, আমার পক্ষে যতদূর সম্ভব আমি লীগ নেতাদের মধ্যে দ্বীনের তাবলীগ করে যাচ্ছি। আমার সঙ্গে অন্যরাও এ ব্যাপারে জোর দিলে এবং নামায, রোযা ওঅন্যান্য ইসলামী রীতিনীতি ও কৃষ্টি-সংস্কৃতি অনুসরণের ব্যাপারে তাদের প্রতি চাপ প্রয়োগ করলে মুসলিম লীগ খাঁটি মুসলিম লীগে পরিণত হতো”।
(ইফাতাতে আশরাফিয়া দর মাসায়েলে সিয়াসিয়া, ৮৬ পৃঃ)
একই পুস্তকের ৯৬ পৃষ্ঠায় হযরত থানভীর আর একটি বক্তব্য হলো এই যে- “যে সময় মুসলিম লীগের সঙ্গে কংগ্রেসের বুঝাপড়া চলছিল, আমি তখন মুসলিম লীগ নেতা মিষ্টার জিন্নাহকে এ ব্যাপারে লিখলাম যে, পারস্পরিক আলোচনায় মুসলমানদের ধর্মীয় স্বার্থ সংরক্ষণের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই শরীয়ত সংক্রান্ত প্রসঙ্গে প্রথমে আপনি কোনো দখল না দিয়ে বিচক্ষণ আলেমদের সঙ্গে পরামর্শ করে সে সম্পর্কে মতামত ব্যক্ত করবেন”। তিনি অত্যন্ত ভদ্র ও মার্জিত ভাষায় তার জবাব দিয়ে আমাকে আশ্বস্ত করলেন যে, এই অনুসারেই কাজ করা হবে”।
কায়েদে আযম যেহেতু শান্ত প্রকৃতির লোক ছিলেন এবং হযরত থানভীর তাবলীগে অনেক প্রভাবিত হয়ে পড়েছিলেন, তাই থানভী সাহেবের উপদেশাবলী তিনি সন্তুষ্টচিত্তে মেনে নিতেন। একবার মওলানা জা’ফর আহমদ ওসমানীর উপস্থিতিতে থানভী দরবারে কায়েদে আযমের লেখা একটি ইংরেজী চিঠি আসে। তাতে লেখা ছিল-
“আপনার মোবারক চিঠি পেলাম। অত্যন্ত সুখী হলাম। শুকরিয়া আদায় করছি। আপনার উপদেশাবলী অনুসারে কাজ করার চেষ্টাক রবো। ভবিষ্যতেও আপনি আমাকে এভাবে উপদেশ দিতে থাকবেন”।
হযরত থানভী সাহেব উর্দুতেই চিঠি লিখতেন। কিন্তু আযীযুল হাসান সাহেব মজযূব (থানভীর শিষ্য) ওইগুলো ইংরেজী অনুবাদ করে মূল চিঠির সঙ্গে জিন্নাহ সাহেবের নিকট পাঠাতেন যেন তাঁর বুঝতে সুবিধে হয়। এ জাতীয় সকল চিঠিপত্রের রেকর্ড মওলানা শাব্বীর আলী সাহেবের নিকট রক্ষিত থাকতো।
কায়েদে আযমের ফাইল
হযরত মওলানা থানভীর ইন্তেকালের পর বোম্বে থেকে পাঁচজন লোক থানাভবন এসেছিলেন। তাঁরা বোম্বের “দাওরাতুল হক” সংস্থার সদস্য ছিলেন। এ সংস্থাটি মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ ও অন্যান্য মুসলমানদের মধ্যে তাবলীগী কাজ করার জন্য মওলানা থানভীর আহবানে গঠিত হয়েছিল। তাঁরা উল্লেখ করেন-
“আমরা একবার তাবলীগী প্রতিনিধি দল হিসাবে কায়েদে আযমের সঙ্গে সাক্ষাত করতে গিয়েছিলাম। আলোচনার মাঝখানে তিনি বেশ প্রেরণা নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন- “আচ্ছা বলুন তো, নিকট অতীতে হিন্দুস্থানে কোন বড় আলেম অতীত হয়ে গেছেন? আমাদের পাঁছ জনের মনেই হযরত থানবীর কথা ছিল। কিন্তু ভাবলাম হয়ত তাঁর দৃষ্টিতে অন্য কেউ হবেন। তাই আমরা কায়েদে আযমকে জিজ্ঞেস করলাম –আপনিই দয়া করে বরুন। সঙ্গে সঙ্গে কায়েদে আযম অপর একটি কক্ষে গেলেন এবং একটি ফাইল এনে খুলে দেখালেন। আপনারা বলতে পারেন কি এ লেখা কার? আমরা সকলেই হযরত থানভীর লেখা ধরে ফেললাম। বললাম, এতো হযরত থানভীর লেখা। এতে কায়েদে আযম উত্তেজনা সহকারে বললেন, হ্যাঁ, ইতিই এ যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ আলেম গুযরে গেছেন। তিনি হযরত থানবীর ভূয়সী প্রশংসা করলেন।
মিরাঠ জেলার সর্বাধিক ধনী ব্যক্তি, ইউ, পি আইন পরিষদের সদস্য নবাব জামশেদ আলী খাঁ মওলানা থানবীর বিশিষ্ট শিষ্য ছিলেন। থানভীল প্রতি তাঁর অগাধ শ্রদ্ধা। নবাব সাহেবের সাধুতা ও আন্তরিকতায় কায়েদে আযম অত্যন্ত মুগ্ধ ছিলেন। তিনি তাঁকে পরম বন্ধু মনে করে মাঝে-মধ্যে স্নেহের বোন ফাতেমা জিন্নাহকে নিয়ে জামশেদ খানের বাড়ী যেতেন। নবাব সাহেবের বাড়ীতে প্রায়ই থানবী সাহেবের কথা উঠতো। নবাব সাহেবের মুখে থানবী সাহেবের বিভিন্ন উপদেশাবলী কায়েদে আযম অত্যন্ত মনযোগ সহকারে শুনতেন। এতে পরোক্ষভাবে থানভী সাহেবের প্রতি জিন্নাহ সাহেবের শ্রদ্ধা, ভালোবাসা অধিক বেড়ে গিয়েছিল। ১৯৫৫ সালের ৪ঠা এপ্রিলে লিখিত নবাব জামশেদ সাহেবের একটি চিঠি এ ব্যাপারে লক্ষ্যণীয়।
“এটা সম্পূর্ণ সত্য যে, কায়েদে আযমের সকল ধর্মীয় সংশোধনে একমাত্র হযরত থানভীরই অবদান ছিল। তাঁর ইসলামী জ্ঞান থানভী সাহেবের দ্বারাই হয়েছিল। মওলানা শাব্বীর আলী কায়েদে আযমকে থানভীর নিকটতর করার ক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা পালন করেছেন”।
একবার কায়েদে আযমের নির্দেশে ইউ, পি, মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারী পার্টির সদস্য ব্যারিষ্টার নবাব ইসমাঈল খাঁ সাহেব থানভী সাহেবের দরবারে আসেন এবং কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বিষয় আলোচনা করছিলেন। হযরত থানভী ধীরস্থিরভাবে তাঁর প্রত্যেকটি কথা শুনলেন এবং একেক প্রশ্নের সুষ্ঠু জবাব দিলেন। ইসমাঈল খাঁ সাহেব হতবাদ হয়ে গেলেন এবং পরে বললের্নঃ
“আমি জানতাম না, খানকাহশীন, চাটাইতে বসা নীরব জীবন যাপনকারী হওয়া সত্ত্বেও কি করে তিনি রাজনীতিতে এত বিচক্ষণতার অধিকারী হলেন!”
থানাভবন পৌঁছার জন্য কায়েদে আযমের ঐকান্তিক আগ্রহ ছিল। কিন্তু রাজনৈতিক ব্যস্ততায় ও অন্যান্য কতিপয় কারণে তাঁর এই আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হয়নি। কায়েদে আযম অত্যন্ত ভক্তি-শ্রদ্ধা সহকারে থানভী সাহেবের নাম উচ্চারণ করতেন। জীবনের শেষ অধ্যায়ে কায়েদে আযমের চরিত্রে, পোশাকে-আশাকে যেই ধর্মীয় রূপ প্রাধান্য লাভ করেছিল, এটা মওলানা থানভীর প্রভাবেরই ফল ছিল।
থানভীল জনৈক ভক্ত ও কায়েদে আযম
জ্ঞানবানের জীবনের মোড় দু’একটি জ্ঞানগর্ভ কথাতেই অনেক সময় ঘুরে যায়। লীঘ নেতার চরিত্রে মনবাব জামশেদ সাহেবের ভৃত্য হাজী-বন্ধু এক খোদাভীরু ব্যক্তি ছিলেন। সেও থানভীর ভক্ত। একবার কায়েদে আযম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ তাঁর সহোদরা ফাতেমা জিন্নাহসহ নবাব সাহেবের বাড়ীতে অতিথি হয়ে আসলেন। চারদিন তারা অবস্থান করছিলেন। হাজী বন্ধু তাঁদের যথেষ্ট খেদমত করেন। হাজী বন্ধু থানভীর কাছে লিখিত এক পত্রে বলেন, “যাবার সময় জিন্নাহ সাহেব আমাকে ডেকে বললেন, “খোদা আমাকে অনেক কিছু দিয়েছেন। তোমার ছেলেমেয়েদের জন্য কিছু দিতে চাই”। আমি বললাম মওলানা থানভীর প্রভাব বিস্তারের যে কয়টি বিষয় উপরে উল্লেখিত হয়েছে, তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আর একটি ক্ষুদ্র ঘটনা এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। এ ঘটনাটিও তাঁকে অধিক প্রভাবিত করেছিল। থানভীর শিষ্য, “আপনি শুধু মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ হলে আপনার দান গ্রহণ করতাম; কিন্তু আপনি যে আমাদের কায়েদে আযম। তাই গোস্তাখী মাফ করবেন; আমার মন চায়, নিজের কায়েদে আযমকে বরং কিছু হাদিয়া পেশ করি, কিন্তু আমার সেই তওফীক কোথায়?” –ভ্রাতা ভগ্নি উভয়ই নিচের দেক তাকিয়ে আমার কথা শুনছিলেন। আমি আরও বললাম, “ইনশাআল্লাহ, ‘হযরতজীর’ কাছে আমি আপনার প্রশংসা করবো”। -জিন্নাহ সাহেব সবিস্ময়ে জিজ্ঞেস করলেন- “হযরতজী! মওলানা থানভী সাহেব?” আমি বললাম, “জি হ্যাঁ! তিনি বললেনঃ “তোমার মধ্যে মুসলমানদের জন্যে দরদ রয়েছে। চারদিন যাবত তুমি আমাদের যেই সেবা করেছো, তাত্থেকেই বুঝা গেছে”। এমন সময় নবাব জামশেদ সাহেব এসে পড়লেন। তাঁর সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ যাবত তাঁদের কথাবার্তা চলে। গাড়ীতে উঠার পূর্বে জিন্নাহ সাহেব আমার কাছে এসে বললেনঃ আসসালামু আলাইকুম এবং মোসাফাহা করলেন। তারপর দিল্লী চলে গেলেন। পরে নবাব সাহেব বললেনঃ “কায়েদে আযম তোমার বক্তৃতা আমার কাছে পুনরুল্লেখ করেছেন –আমরা তিনজনই (জিন্নাহ সাহেব, ফাতেমা জিন্নাহ, নবাব জামশেদ) তখন চোখের পানি ফেলছিলাম”।
-“হুযুর! এটা একমাত্র আপনারই বরকত। কথাগুলো বলার সময় মনে হচ্ছিল আপনি এই গোলামের সঙ্গে রয়েছেন। আমার মুখ দিয়ে যেসব কথা আসছিল তা হযরতই বলে চলেছেন। অধীন হযরতের নিকট দোয়ার প্রার্থী”। (২০ই এপ্রিল ১৯৪৩ লিখিত হাজী বন্ধুর চিঠি)
থানভী সাহেব এই চিঠি পেয়ে অত্যন্ত খুশী হয়ে হাজী বন্ধুকে লিখলেনঃ “আসসালামু আলাইকুম –শাবাশ! ‘ঈকায় আযতূ আইয়েধ ও মরদাঁ চুনী কুনান্দ”……। আল্লাহ তোমাকে এ সম্পদ আরও দান করুন –এ ব্যাপারে উন্নতি দিন। আমি এতে এতই সন্তুষ্ট হয়েছি যে, কোন কিছুই স্মরণে আসছে না”।
জিন্নাহ সাহেবের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ
উল্লেখিত চিঠিপত্র সমূহের মাধ্যমে হযরত মওলানা থানভী সাহেব ভাবী মুসলিম রাষ্ট্রের কর্ণধার ও তাঁর সঙ্গীসাথীনের ইসলামী চরিত্রে অধিকারী করার যেই তাবলীগী প্রচেষ্টা চালিয়ে ছিলেন, তার সুস্পষ্ট চিত্র ফুটে উঠে। বিশেষতঃ পাকিস্তান আন্দোলনের নেতা কায়েদে আযম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ থানভী সাহেবের তাবলীগে কতদূর প্রভাবিত হয়েছিলেন তাও সহজে আঁচ করা যায়। বস্তুতঃ লীগ নেতা মওলানা থানভীকেই তখনকার সর্বশ্রেষ্ঠ আলেম মনে করতেন [মওলানা জা’ফর আহমদ ওসমানী তাঁর রুয়েদাদে উল্লেখ করেনঃ
“হযতর থানভীর ওফাতের পরবর্তী ঘটনা। বোম্বেতে জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামের কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়। তাতে মওলানা শাব্বীর আহমদ ওসমানী, মরহুম মওলানা মুহাম্মদ তাহের প্রমুখ আলেম অংশগ্রহণ করেন। থানভী সাহেব সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বোম্বের কতিপয় ব্যবসায়ী আমাদের সঙ্গে সাক্ষাত করেন। তারা বললেনঃ একাবর কায়েদে আযমের আলোচনা বৈঠকে এই কথা উঠলো যে, কংগ্রেসে আলেমের সংখ্যা বেশী। মুসলিম লীগে আলেম নেই। ফলে, মুসলিম লীগের ব্যাপারে মুসলমানদের মধ্যে তেমন আগ্রহ নেই। কায়েদে আযম উত্তেজিত কণ্ঠে বল্লেন, তোমরা কাদের ওলামা মনে কর?” তাঁরা মওলনা হোসাইন আহমদ মাদানী, মওলানা মুফতী কেফায়াতুল্লাহ সাহেব এবং মওলানা আবুল কালাম আযাদের নাম উল্লেখ করলেন। কায়েদে আযম বল্লেনঃ “মওলানা হোসাই আহমদ অবশ্য আলেম, তবে ওনার রাজনীতি কেবল ঐ একটা ইংরেজের দুশমনী। এই দুশমনীতে তিনি মুসলিম স্বার্থের প্রতিও লক্ষ্য করছেন না। মওলানা কেফায়াতুল্লাহ সত্যই মুফতী এবং কিছুটা রাজনীতিকও, তবে আবুল কালাম আযান তা আলেম না রাজনীতিক। (১) –মুসলিম লীগের সঙ্গে এক মহান আলম জড়িত রয়েছেন যার এলম, জ্ঞান, চারিত্রিক পবিত্রতা ও তাকওয়া পরহেযগারী এক পাল্লায় রাখা হলে আর অপর সকল আলেমের এলম, তাকাদ্দুস-পরহেযগারী অন্য পাল্লায় রাখলে থানভীর পাল্লাই ভারী হবে। এই মহান আলেমের সমর্থনই মুসলিম লীগের জন্য যথেষ্ট –অন্য কোন আলেম সমর্থন করুক বা না-করুক আমাদের কোন পরওয়া নেই”।
ফলাফল
কায়েদে আযম একজন রাজনৈতিক নেতা ছিলেন। তাঁর গোটা জীবনই রাজনৈতিক টানা-হেঁচড়ার ভেতর দিয়ে অতিবাহিত হয়েছে। এ কারণেই প্রত্যেকটি দৃষ্টি তাঁর রাজনৈতিক কার্যাবলীতেই সীমাবদ্ধ ছিল। শেষের দিকে কেউ তাঁর ধর্মীয় বিশ্বাসের ব্যাপারে কোনোই আলোকপাত করেনি, যেন ধর্মের সঙ্গে তাঁর কোনো সম্পর্কই ছিল না। বরং যখনই তাঁর ধর্মীয় দিকের আলোচনা আসতো, তখন অনেক জ্ঞানী ব্যক্তিও বিস্ময় প্রকাশ করে বলতেনঃ কায়েদে আযম, আবার ধর্মকর্ম? আপনারা কি যে বলেন? অথচ থানভী সাহেবের তাবলীগী মিশন তাঁর ধর্মীয় জীবনে আমূল পরিবর্তন এনে দিয়েছিল –যদিও সেটার কেউ অনুসন্ধান করেনি।
কায়েদে আজমের নামাযের অভ্যাস
মওলানা আশরাফ আলী থানভী তাবলীগী প্রতিনিধি দ্বারা সর্বাগ্রে নামাযের দিকে কায়েদে আযমের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। তিনি বিশিষ্ট ব্যক্তিদের এক সভায় অনুশোচনা সহকারে নামায না পড়ার অপরাধের কথা স্বীকার করে ভবিষ্যতে নামায পড়তে ওয়াদাবদ্ধ হন। সেই থেকে জীবনের শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত রীতিমত নামাপ পড়েছিলেন বলে জানা যায়। লীগ নেতা যদিও শীয়া পরিবার উদ্ভুত, কিন্তু তাঁর ধর্মীয় তা’লীম থানভী সাহেবের দ্বারা হওয়াতে কুরআন-সুন্নাহরই তিনি অনুসারী হয়ে যান। তাঁকে শীয়া বলা তিনি পছন্দ করতেন না। যেমন, কোয়েটাতে একবার এক শীয়া প্রতিনিধি দল তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। তারা নিজেদের দাবী দাওয়া পেশ করে সহানুভূতি লাভের উদ্দেশ্যে বললঃ আপনি আমাদের সম্প্রদায়ের লোক। কায়েদে আযম জোর দিয়ে তার প্রতিবাদ করে বলে উঠলেনঃ “No I am Muslim” তিনি সম্প্রদায়গত পার্থক্যকে পছন্দ করতেন না। এ কারণেই দিল্লীর অধিবেশনে ভাষণদানকালে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করেন যে, -“ঐক্যবদ্ধ হওয়ার মধ্যেই এখন মুসলমানদের মুক্তি। ওহাবী ও শীয়া-সুন্নীর মধ্যে পার্থখ্য সম্পূর্ণ পরিত্যাগ করতে হবে”। -(দৈনিক নাওয়ায়ে ওয়াকত, লাহেরা, ১৯৪৬ খৃঃ)
তিনি নিজেও একথার উপর অটল ছিলেন। নিজের পৈত্রিক পদ্ধতির পরিবর্তে হামেশা সুন্নী তরীকায় নামায পড়তেন। যখন জামাতে নামায পড়তে হতো, তখন বড়দলের মসজিদে গিয়ে নামায পড়তেন। এ জন্যই শীয়া সম্প্রদায়ের বিশিষ্ট নেতা মাহমুদাবাসের রাজা তাঁর সম্পর্কে অভিযোগ তুলেছিলেন। মওলানা শাব্বীর আলী সাহেব তাই রুয়েদাদে উল্লেখ করেছেন যে-
“সম্ভবতঃ ১৯৩৯ সালে মে কি এপ্রিলের দিকে জনাব মকবুল হোসাইন বিলগ্রামী থানাভবন এসেছিলেন। তিনি থানবী সাহেবকে বললেনঃ জিন্নাহ সাহেবের উপর হুযুরের তাবলীগী মিশনের বেশী প্রভাব পড়ছে মনে হয়। আমি মাহমুদাবাদের রাজা সাহেবের নিকট বসেছিলাম। তিনি সম্প্রতি দিল্লী থেকে এসেছেন। বল্লেন,আমি আপনকে এক আশ্চর্য ঘটনা শুনাচ্ছি। তা হলো, জিন্নাহ সাহেব রীতিমত পাঞ্জেগানা নামায শুরু করেছেন এবং সুন্নীদের ন্যায় নামায আদায় করেন। এ ঘটনা ১৯৩৯ সালে প্রেরিত থানভী সাহেবের তাবলীগী মিশনের পরের কথা। -(রুয়েদাদ, ১০ পৃঃ)
মওলানা থানভীর প্রভাব ও কায়েদে আযমের খোদাভীতি
সাধারণতঃ দেখা যায়, মানুষ উচ্চ মর্যাদা পেলে বিশেষ করে তা রাতারাতি পেলে আত্মম্ভরিতার শিকারে পরিণত হয়। আল্লাহকে ভুলে যায়। যাবতীয় উন্নতি ও যশঃ গৌরবকে নিজের চেষ্টা-তদবীর ও বাহুবলেরই ফল মনে করতে থাকে। কিন্তু কোনো ঈমানদার ব্যক্তি বৈষয়িক দিক থেকে উন্নতির চরম উচ্চ শিখরে আরোহন করেও সে ক্ষণিকের জন্যও নিজের ভুলকে ভুলতে পারে না। তদ্রুপ তাবলীগী প্রতিনিধি দল যখন জিন্নাহ সাহেবকে বলে বসলেন –“আপনার উপরও তো নামায ফরয –আপনি পড়েন না কেন?” তিনি চেয়ার থেকে সোজা হয়ে বসে গিয়েছিলেন। দুনিয়ার কোনো শক্তিকে যিনি পরওয়া করতেন না, সেই কায়েদে আযমের অন্তরে “ফরয” কথাটা এতই দাগ কাটলো এবং ভীতির সঞ্চার করলো যে, তিনি কোনো ব্যাখ্যার আশ্রয় না নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে ঝুঁকে গিয়ে নিজের ত্রুটির কথা অকপটে স্বীকার করে নিলেন এবং বললেনঃ “আমি গুনাহগার-অপরাধী। আমাকে বলার অধিকার আপনাদের আছে। এসব শোনা আমার কর্তব্য। আমি ওয়অদা করলাম, ভবিষ্যতে নামায পড়বো”।
অতঃপর নামায শুরু করলে তাঁর মধ্যে এমন খোদাভীতির সৃষ্টি হয় যে, অধিকাংশ নির্জন মুহুর্তে তাঁকে রাব্বুল আলামীনের দরবারে সিজদায় পড়ে কান্নাকাটি করতে দেখা গেছে। প্রখ্যাত নেতা মওলানা হাসরৎ মোহনীর এক ঘটনা বিবৃত করে মওলানা শাব্বীর আলী লিখেছেনঃ
“আমার এক নির্ভরযোগ্য বন্ধু আমাকে মওলানা হাসরৎ মোহানী সাহেবের একটি বক্তব্য শোনালেন। তিনি বলেছেন। আমি একদিন অতি ভোরে এক জরুরী ব্যাপারে জিন্নাহ সাহেবের কুটীতে গিয়ে পৌঁছুলাম। চাকরকে বললাম খবর দিতে। সে বলল, এ সময় আমার ভেতরে যাবার অনুমতি নেই। আপনি তশরিফ রাখুন। অল্পক্ষণ পরে জিন্নাহ সাহেব নিজেই তশরীফ আনবেন। আমার জরুরী ব্যাপার ছিল। তাই তাড়াতাড়ি তাকে দিয়ে বলাতে চেয়েছিলাম। চাকরীটার প্রতি রাগ হলো। আমি নিজেই কক্ষে ঢুকে পড়লাম। এক কামরা দুই কামরা পেরিয়ে তৃতীয় কামরায় গিয়ে পৌঁছুলাম। এ কামরা থেকে গিড়গিড় করে কান্নার শব্দ আসছে। ভেসে আসছে কান্নাজড়িত কণ্ঠের কি কি অস্পষ্ট আওয়ায। জিন্নাহ সাহেবের গলার স্বর বুঝে আমি ঘাবড়িয়ে গেলাম এবং আস্তে পর্দা উঠিয়ে দেখি –জিন্নাহ সাহেব সিজদায় পড়ে ব্যাকুলভাবে আল্লাহর নিকট দোয়া করছেন। আপি পা টিপে আস্তে সরে আসলাম। তাই, আমি এখন যখনই যাই, চাকর যদি বলে ভেতরে আছে, আমি বুঝে নেই যে, তিনি সিজদায় পড়ে দোয়া করছেন। আমার কল্পনায় সকল সময় ঐ একই দৃশ্য আর ঐ একই আওয়ায”।
দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন
পূর্বেই বলা হয়েছে, প্রথম দিকে কায়েদে আযম রাজনীতিকে ধর্ম থেকে আলাদা খারার পক্ষপাতী ছিলেন। কিন্তু যেদিন মওলানা থানভীর প্রেরিত প্রতিনিধিবৃন্দ তাঁর কাছে এটা প্রমাণাদিসহ স্পষ্টভাবে তুলে ধরলেন যে, এর একটিকে আরেকটি থেকে আলাদা রাখা হলে কোনো কল্যাণ ও সফলতা সম্ভব নয় এবং ইসলামের মৌল বিধানের তা পরিপন্থী, তখন থেকেই তিনি ধর্মকে রাজনীতির উপর প্রাধান্য দিতে শুরু করলেন। তাঁর বক্তৃতার বিষয়বস্তু বদলে গেলো। তাতে ইসলামী রং প্রাধান্য পেলো। তিনি স্পষ্ট ঘোষণা করতে লাগলেনঃ
“ইসলাম শুধু কতিপয় বিশ্বাস ও আনুষ্ঠানিক এবাদাতেরই নাম নয়, বরং রাজনৈতিক, ব্যবহারিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, নৈতিক সকল কিছু বিধি-বিধানের সমষ্টির নামই ইসলাম। এ সবগুলোকে নিয়েই আমাদের চলতে হবে”।
ইসলামী কৃষ্টির অনুসরণ
কায়েদে আযমের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ ইংরেজী পরিবেশে হয়েছিল। তিনি ইংরেজী পোশাক পরিধানে অভ্যস্ত ছিলেন। মওলানা থানভীর তাবলীগী প্রতিনিধি দর তাঁকে ইসলামী কালচার গ্রহণে অনুপ্রাণিত করে। তাঁর নিকট যখন ইষলামের সঙ্গে বৈসাদৃশ্য ও বিধর্মীর সঙ্গে সাদৃশ্যের ক্ষতিকর দিক সুস্পষ্ট হয়ে ওঠ তখনই তিনি ইংরেজী পোশাকের অভ্যাস ছেড়ে দেন এবং প্রায়ই ইসলামী পোশাকে জনসমক্ষে উপস্থিত হতেন। তারপর থেকেই দেশে জিন্নাহ ক্যাপ, শিরওয়ানী, সেলওয়ার জাতীয় পোশাকের মর্যাদা লাভ করে।
কোরআন চর্চা
থানভীর তাবলীগী মিশনের বদৌলতে পাকিস্তান আন্দোলনের নেতার মধ্যে কোরআন শিক্ষার আগ্রহ সৃষ্টি হয়। তিনি কোরআন মজিদ ও অন্যান্য ইসলামী সাহিত্য মনযোগ সহকারে অধ্যয়ন করতে শুরু করেন। তাতে তাঁর চিন্তাধারা দ্রুত পরিবর্তন দেখা দেয়। ১৯৪১ সালে দাক্ষিণাত্যের হায়দ্রাবাদে যখন ছাত্ররা তাঁকে ধর্ম ও ধর্মীয় রাষ্ট্রের মৌলিক উপাদান সম্পর্কে প্রশ্ন করেন, তিনি স্বয়ং তার জবাবে এটা স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছিলেন যে, “আমি যখন ইংরেজী ভাষায় ধর্ম (Religion) কথাটি শুনতে পাই তখন ঐ ভাষায় ও তার প্রচলিত অর্থ অনুযায়ী অবশ্যই আমার দৃষ্টি স্রষ্টা ও তাঁর বান্দার পারস্পরিক সম্পর্কের দিকটির প্রতি চলে যায়। কিন্তু এটা আমি ভালো করেই জানি যে, ইসলাম এবং মুসলমানদের নিকট ধর্ম কথাটি এই সীমাবদ্ধ অর্থ বা মতবাদ হিসাবে গৃহীত নয়। আমি কোনো মোল্লা-মৌলভী নই –ধর্মীয় ব্যাপারে অভিজ্ঞতারও আমি দাবী করতে পারি না। তবে আমি নিজে নিজে কোরআজ মজিদ ও ইসলামী আইন স্টাডি করে দেখেছি –এই মহাগ্রন্থের শিক্ষা আদর্শে মানবজীবনের প্রতিটি বিভাগ সম্পর্কে বিধি-বিধান মওজুদ রয়েছে। জীবনের আধ্যাত্মিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক –এক কথায় কোনো একটি দিক বা বিভাগ এমন নেই, যা কোরআনের নীতির বাইরে থাকতে পারে। কোরআনের নীতি-নির্ধারক এসব বিধান কেবল মুসলমানের জন্যই কল্যাণকর নয়, ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলমানদের সঙ্গে সৎ, আচরণ এবং তাদের আইনগত অধিকারও তাতে স্বীকৃত রয়েছে। এর চাইতে শাসনতান্ত্রিক অধিকার কল্পনা করা অসম্ভব”। -(হায়াতে কায়েদে আযম, ৪২৭ পৃঃ)
আল্লাহর প্রতি ভরসা
কায়েদে আযমের বভিন্ন প্রকারের যোগ্যতা, বৈশিষ্ট্য ও গুণ থাকা সত্ত্বেও তিনি আল্লাহর উপর নির্ভর করতেন। তিনি গোটা স্বাধীনতা সংগ্রাম লড়েছেন এই শক্তি বলেই। দুশমন যখনই তাঁর জাতির উপর শক্তি-বিক্রমের দাপট দেখিয়ে তাকেঁ প্রভাবিত করতে চেয়েছে, তিনি তখন জাতিকে অভয় দিয়ে বলেছেন, আল্লাহ আমাদের সঙ্গে আছেন। কোনো পর্যায়ে জাতির মধ্যে দুর্বলতা দেখা দিলে তিনি আল্লাহর সাহায্য কামনা করতেন এবং তাঁরই ভরসার এই বিস্মৃত বাণী শুনিয়ে জাতিকে চাঙ্গা করে তুলতেন। এভাবে আল্লাহর প্রতি নির্ভরশীলরা জাতীয় জীবনের প্রতিটি সংকটে জয়যুক্ত হয়েছে।
১৯৪৭ সালের প্রথম স্বাধীনতা দিবসের উৎষবে শিখরা কায়েদে আযমকে বোমা দিয়ে উড়িয়ে দেবার ষড়যন্ত্র করেছিল। এ ব্যাপারে বৃটিশ ভারতের সর্বশেষ ইংরেজ গভর্ণর লর্ড মাউন্ট বেটেন অবহিত ছিলেন। যেহেতু ভারত থেকে ইংরেজদের তল্পিতল্পা গুটিয়ে নিতে কায়েদে আযমের সূক্ষ্ম বুদ্ধিই শেষের দিকে অধিক কাজ করেছিল, তাই ইংরেজরা তাঁকে তেমন ভালো চোখে দেখতেন না। লর্ড মাউন্ট বেটেন প্রথমে তা কায়েদে আযমকে জানাননি। কিন্তু স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে কায়েদে আযম যখন মাউন্ট বেটেনকে রাজধানী করাচীদে আসার আমন্ত্রণ জানান, তখন তিনি উজর পেশ করে লিখলেনঃ এ দিবম উপলক্ষে শিখেরা আপনাকে বোমা দিয়ে হত্যা করার পরিকল্পনা সম্পন্ন করে ফেলেছে। এ পরিস্থিতিতে যেমন আপনার জন্য শোভাযাত্রা বের করা সংগত নয়, তেমনি আমারও ঐদিত তাতে অংশ গ্রহন ঠিক হবে না”। -(মিশন, লর্ড মাউন্ট বেটেন)
কিন্তু তিনি এ সংবাদের কোনোই পাত্তা দিলেন না। মাউন্ট বেটেনকে অভয় দিয়ে বললেন –আল্লাহ রক্ষা করবেন। তিনি যেন নিশ্চিন্ত থাকেন। অতঃপর করাচী আসর পর তাঁকে নিয়ে কায়েদে আযম খোলা গাড়ীতে করে লাখো জনতার মধ্যদিয়ে নিরাপদে গভর্ণমেন্ট হাউসে গিয়ে পৌঁছেন। মাউন্ট বেটেনকে ইচ্ছাকৃতভাবে বুঝিয়ে দিলেন যে, তিনি নিরাপদ। লর্ড মাউন্ট বেটেন তখন হাঁপাতে হাঁপাতে জিন্নাহ সাহেবের কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছেন এবং আল্লার প্রতি তাঁর আস্থার ভূয়সী প্রশংসা করছেন।
আজাদী আন্দোলোনের শেষ পর্যায়ের সফলতাকে যারা কেবল কায়েদে আযম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর রাজনৈতিক প্রজ্ঞারই ফল মনে করেন, তারা অবশ্যই ভুল করেন। কারণ, কায়েদে আযমের সফলতার মূল রহস্য তাঁর রানীতিতেই কেভল নিহিত নয়; বরং তাঁর সততা, খোদাভীরুতা ও খোদার প্রতি আস্থাশীলতার মধ্যেই তাঁর সফলতার আসল রহস্য লুক্কায়িত রয়েছে। মওলানা থানভীর হেদায়াতের পূর্বে তিনিও অন্যঅন্য জননেতার মতোই একজন নেতা ছিলেন মাত্র। -তখনও ‘প্রিয় নেতা’র মর্যাদায় সমাসীন ছিলেন না। জিন্নাহ সাহেবের চিন্তা ও চরিত্রে ধর্মীয় বিপ্লব আসার বরকতেই (১) তাঁর অন্তরে ইসলাম ও মুসলমানদের উন্নতি বিধানে প্রেরণা জাগে, (২) তাঁর ভাষায় যাদুমন্ত্রের প্রভাব সৃষ্টি হয়, (৩) জনগণের হৃদয়ে তাঁর গুরুত্ব, ভালবাসা, সমাদর বৃদ্ধি পায় এবং (৪) দুশমনের হৃদয়ে তাঁর ব্যক্তিত্ব ভীতির সঞ্চার করে, তিনি লাভ করেন দুনিয়ার সর্ববৃহৎ মুসিলম রাষ্ট্র। তবে এর অর্থ এও নয় যে, তাঁর রাজনৈতি প্রজ্ঞার কোনো গুরুত্ব ছিল না। বরং এটা উপলব্ধি করা দরকার যে, জিন্নাহ সাহেবের রানীতির দৃষ্টান্ত হচ্ছে ওযুর ন্যায়। নামাযের বিশুদ্ধতা ওযুর উপর নির্ভরশীল হলেও ওযু মূল লক্ষ্য নয়, বরং উপলক্ষ মাত্র এবং নামাযই হলো আসল লক্ষ্য। এসব বাস্ত্বতার আলোকে পাঠকই বিচার করতে সক্ষম হবেন যে, মওলানা আশরাফ আলী থানভী এই মহান জাতীয় নেতার চিন্তা ও চরিত্রে কিরূপ পরিবর্তন এনে দিয়েছিলেন, যার সুফল হয়তো জিন্নাহ সাহেব আরও দীর্ঘ দিন বেঁচে থাকলে জাতি অবশ্যই ভোগ করতে পারত।