সংগ্রামী নেতা শায়খুল হিন্দ মওলানা মাহমুদুল হাসান
দারুল উলূম দেওবন্দের প্রথম হেডমুদার্রিস ছিলেন হযরত মওলানা মুহাম্মদ ইয়াকুব সাহেব। তারপর এই পদে দায়িত্ব পালন করে হযরত মওলানা সাইয়েদ আহমদ দেহলভী। অতঃপর শায়খুল হিন্দ হযরত মওলানা মাহমুদুল হাসান দারুল উলুমের হেড মুদার্রিস নিয়োজিত হন। (১২০৮-১২৩৩ হিঃ)। শায়খুল হিন্দ সংগ্রামী নেতা মওলানা কাসেম নানতুবী ও রশিদ আহমদ গংগুহীর শিষ্য ছিলেন বলে তিনি দেওবন্দ আন্দোলনের মূল লক্ষ্য সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন ছিলেন। তাই তাঁর শিক্ষকতার জীবনেও দেখা গেছে যে, তিনি শুধু প্রতিক্রিয়াযুক্ত, নির্লিপ্ত গতিহীন তাকওয়া-পরহেযগারীর উপদেশ, তালিম বা শিক্ষা-প্রশিক্ষণই দিতেন না বরং তাঁর তরবিয়তের জন্যে তারা হয়ে উঠতো উদ্বেলিত। এ কারণেই তাঁর শিষ্যরা ছিলেন উপমহাদেশের রাজনৈতিক গগণের এক একজন উজ্জ্বল নক্ষত্র।
শায়খুল হিন্দ-এর বিশিষ্ট শিষ্যবৃন্দ
১। আজাদী আন্দোলনের বীর সেনানী মওলানা হোসাইন আহমদ মাদানী (মোহাদেদ্স ও হেড মোদর্রিস দারুল উলুম দেওবন্দ, সভাপতি জমইয়তে ওলামায়ে হিন্দ)।
২। মওলানা ওবায়দুল্লাহ সিস্ধী
৩। মওলানা সাইয়েদ আনওয়ার শাহ কাশ্মীরি
৪। মওলানা মুফত কেফায়াতুল্লাহ (সভাপতি জমইয়তে ওলাময়ে হিন্দ)
৫। মওলানা মুহাম্মদ মিঞা ওরফে (মওলানা মনসুর আনসারী)
৬। মওলানা হাবীবুর রহমান (সাবেক মোহতামিম দারুল উলূম দেওবন্দ)
৭। আল্লামা শাব্বীর আহমদ ওসমানী (শায়খুল আদব ওয়াল ফিকহ ও হেড মুদার্রিস দারুল উলুম দেওবন্দ, শায়খুল ইসলাম পাকিস্তান ও সভাপতি জমইয়তে ওলাময়ে ইসলাম।)
৮। শায়খুল আদব ওয়াল ফিকহ, মওলানা মুহাম্মদ ইযায আলী, দারুল উলূম দেওবন্দ।
৯। মওলানা ফখরুদ্দীন আহমদ (শায়খুল হাদীস জামেয়ায়ে কাসেমিয়া, মুরাদাবাদ)।
১০। মওলানা ইবরাহীন বিলইয়াবী (অধ্যাপক দারুল উলুম দেওবন্দ)
১১। মওলানা আবদুস সামী (অধ্যাপক দারুল উলুম দেওবন্দ)
১২। মওলানা আহমদ আলী (মুহতামিম আঞ্জুমানে খুদ্দামুদ্দীন শীরিনওয়ালা, লাহোর।
১৩। মওলানা মুহাম্মদ সাদেক করাচী, প্রমুখ।
ইংরেজ সরকারের উৎখাতের জন্যে ইরান ও আফগানিস্তানের সাহায্য কামনা
ভারত থেকে ইংরেজ সরকারকে উৎখাত আন্দোলনে মওলানা মাহমুদুল হাসান যে ত্যাগ ও সংগ্রাম করেছেন, তা শুধু উপমহাদেশের আলেম সমাজ বা সাধারণ মুসলমানই নয় বরং বিশ্বের মুক্তিকামী যে কোনো মানুষের জন্যে চিরদিন অনুপ্রেরণা রূপে কাজ করবে। তিনি এ উদ্দেশ্যে ইরান, তুরস্ক ও আফগানিস্তানের শাসকদের ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করেন। এসব ইসলামী রাষ্ট্রের নেতৃবৃন্দ ও উপজাতীয় পাঠানদের মধ্যে তিনি জিহাদী ভাব সৃষ্টি করেন এবং সম্মিলিতভাবে ইংরেজদের উপর আক্রমণ চালিয়ে সাবেক মুসলিম শাসিত ভারতকে তার স্বাধীন ‘ইসলামী হিন্দুস্থান’ পরিচয়ে ফিরিয়ে নেয়ার আন্দোলন চালান। শায়খুল-হিন্দ এ উদ্দেশ্যে মওলানা ওবায়দুল্লাহ সিন্ধীকে প্রেরণ করেছিলেন। উপজাতীয় পাঠানগণ এবং আফগান শাসকের নিকট আর নিজে তুরস্ক সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের উদ্দেশ্যে হেজাজ গমন করেন। তুর্কী খেলাফতের অধীন তৎকালীন হেজাজের তুর্কী শাসক গালিব পাশা ও তুরস্কের সেনাবাহিনী প্রধান আনওয়ার পাশার সঙ্গে মওলানা মাহমুদুল হাসান সাক্ষাত করেন এবং আন্দোলনের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে তাদেরকে অবহিত করেন।
কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস তদানীন্তন আরব শাসক শরীফ হোসাইন ইংরেজদের উস্কানীতে তুরস্ক সাম্রাজ্যের কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে বসেন। শরীফ হোসাইন ইংরেজদের সঙ্গে যুক্ত হন। ফলে হেজাজেও ইংরেজ শক্তির দৌরাত্ম চলে। এ দিকে বৃটিশ সরকারও শায়খুল হিন্দের ইংরেজ সরকার উচ্ছেদ আন্দোলন চলে। এ দিকে বৃটিশ সরকারও শায়খুল হিন্দের ইংরেজ সরকার উচ্ছেদ আন্দোলন সম্পর্কে অবগত হয়। ইংরেজগণ তাদের তাবেদার আরব শাসক শরীফ হোসাইনের দ্বারা শায়খুল হিন্দ মওলানা মাহমুদুল হাসানকে গ্রেফতার করেন (১৯১৬) ইং। ফলে প্রায় ৫ বছর পর্যন্ত মাল্টাদ্বীপে তাঁকে গ্লানিকর নির্বাসন জীবন যাপন করতে হয়। সেই নির্যাতনের ইতিহাস সুদীর্ঘ ও মর্মস্পর্শী। মাল্টাদ্বীপ থেকে তিনি মুক্তি পাওয়ার পর (১৯২০ খৃষ্টাব্দের ১২ই মার্চ) ভারতে ফিরে আসেন এবং খেলাফত আন্দোলনের মাধ্যমে আবার সংগ্রামে লিপ্ত হন। মওলানা ওবায়দুল্লাহ সিন্ধিকে ইংরেজ সরকার ভারত থেকে বহিষ্কার করেন। শায়খুল-হিন্দের সঙ্গে এ আন্দোলনে আলীগড়ে শিক্ষাপ্রাপ্ত বিপ্লবী ব্যক্তিগণও জড়িত ছিলেন। যেমন মওলানা মুহাম্মদ আলী ও উক্টর মোখতার আহমদ আনসারী প্রমুখ
শায়খুল হিন্দ মওলানা মাহমুদুল হাসান বাংলা-পাক-ভারত উপমহাদশ তথা মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলসমূহকে পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদীদের কবল থেকে মুক্ত করার জন্যে যে সশস্ত্র বিপ্লব ঘটাতে চেষ্টা করেছিলেন, সেই সংস্থাটির নাম ছিল “জমিয়তে আনছারুল্লাহ”। এ সংস্থার বিপ্লবী পরিষদকে ‘আজাদ হিন্দ মিশন’ও বলা হতো। এর সদস্যদের মধ্যে ছিলেন মওলানা হাজী তোরঙ্গজয়ী, মওলানা লুৎফুর রহমান, মওলানা ফযলে রাব্বী, মওলানা ওবায়দুল্লাহ সিন্ধী। এ সময় তাঁর অন্যতম ছাত্র ও পরবর্তীকালের শায়খুল হিন্দ মওলানা হোসাইন আহমদ মাদানী পবিত্র মদীনা থেকে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। শায়খুল হিন্দের দরবার থেকে ইলমে হাদীস ও রুহানিয়াত তথা আত্মিক পরিশুদ্ধির অনুশীলনের সাথে সাথে এই বিপ্লবী আন্দোলনেও তিনি সক্রিয় ভাবে সহযোগিতা করে যান। উল্লেখ্য, মওলানা মাদানীও তাঁর শায়েখ ও রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে মক্কায় বন্দী হয়ে মাল্টাদ্বীপে নির্বাসিত জীবন যাপন করেন।
মাল্টা দ্বীপে নির্বাসন ও তার পূর্বে মক্কায় বন্দী হবার বিস্তারিত বিবরণ দান এখানে সম্ভব না হলেও তিনি যে কি পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন এবং তা বাস্তবায়নের কি পন্থা চিন্তা করেছিলেন ও কখন মক্কা গিয়েছিলেন, তা উল্লেখ করা প্রয়োজন।
শায়খুল হিন্দের ইংরেজখেদা আন্দোলনের পরিকল্পনা
উক্ত পরিকল্পনার প্রেক্ষিতে ইংরেজ বলয়ের বাইরে ভারতের উত্তর পশ্চিম সীমান্তের ‘ইয়াগিস্তান’ এলাকায় ‘আযাদ হিন্দ মিশনে’র কেন্দ্র স্থাপন করা হয়। ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদীদের সঙ্গে জেহাদের জন্য অস্ত্র-শস্ত্র, অর্থ ও সৈন্য সংগ্রহ ইত্যাদি সর্বপ্রকার আয়োজন চলতে থাকে।
তখনই ইউরোপের কতিপয় শক্তি ঐক্যবদ্ধ হয়ে তুর্কী খিলাফতের অন্তর্ভূক্ত কয়েকটি এলাকা আক্রমণ করে এবং ইংরেজগণ তুর্কী সরকারের দু’টি যুদ্ধ জাহাজ আটক করে ফেলে। প্রতিক্রিয়া স্বরূপ ভারত সহ সমগ্র মুসলিম জাহানে নতুন করে পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী বিক্ষোভ বিদ্যুৎ গতিতে ছড়িয়ে পড়ে।
এসব অবাঞ্ছিত কারণে তুর্কী সরকারও শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ ঘোষণা করে। এদিকে বৃটেন, রাশিয়া প্রমুখ শক্তিবর্গ তুর্কী খেলাফতের উপর বিভিন্ন দিক হতে চতুর্মূখী আক্রমণ করে বসে। ইসলাম ও মুসলিম রাষ্ট্রসমূহকে ভূপৃষ্ঠ থেকে চিরতরে মুছে ফেলাই ছিল তাদের আসল লক্ষ্য।
দেওবন্দী মোজাহেদগণ ইংরেজদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন
এহেন সংকট কালে হযরত শায়খুল হিন্দ ভারতের উত্তর পশ্চিম সীমান্ত এলাকা হতে বিপ্লব অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা নেন। তিনি মওলানা হাজী তোরঙ্গযয়ীর নেতৃত্বে ইয়াগিস্তান কেন্দ্র থেকে বৃটিশ সেনাবাহিনীর উপর আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী মুজাহিদগণ বীরবিক্রমে শত্রু বাহিনীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। মুক্তি-যোদ্ধাদের আক্রমণে ইংরেজ শক্তি পর্যুদস্ত হয়ে পড়ে এবং শেষ পর্যন্ত পশ্চাদ্ধাবন করে। তাতে বহু ইংরেজ সৈনিক হতাহত হয়। কিন্তু কুচক্রী ইংরেজগোষ্ঠী মুজাহিদের দুর্দমনীয় আক্রমণের ঝক্কি সামলাতে না পেরে একদিকে কতিপয় স্বার্থপর ভাড়াটিয়া শিক্ষিতকে হাত করে নেয়, অপরদিকে সরকারী তল্পীবাহক জনৈক মওলভীর দ্বারা জেহাদের বিরুদ্ধে ফতওয়া প্রচার করতে থাকে। কিন্তু কাবুলের বাদশাহ আমীর হাবীবুল্লাহ খানকে প্রচুর অর্থ ও নানান প্রলোভনে তার দ্বারা ইংরেজরা কাবুল সীমান্তের উক্ত জেহাধী আন্দোলনকে বানচাল করে দিতে প্রয়াস পায়।
এই মহাবিপর্যয় ও সংকট মুহুর্তে বিপ্লবীগণ মুসলিম রাষ্ট্রসমূহের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেন। তাই হিজরী ১৩৩৩ সনে শায়খুল হিন্দ হিজাজ অভিমুখে যাত্রা করেন। কিন্তু ইংরেজদের কড়া দৃষ্টি এড়িয়ে বাইরে সফর করা তাঁর পক্ষে মুশকিল ছিল। তবুও তিনি আল্লাহর প্রতি ভরসা করে রওয়ানা হন। কিন্তু সে খবরটি প্রকাশ হয়ে পড়ে। যুদ্ধকালীন অবস্থায় শায়খুল হিন্দের বিদেশ সফর করা হলে বিশৃংখলার সম্ভাবনা রয়েছে ভেবে বোম্বাই ঘাটে স্টীমারে আরোহণকালে গ্রেফতার করার পরিকল্পনা নেয়। ইউ পি সরকার বোম্বাইয়ের গভর্ণরের নিকট এই মর্মে তারবার্তা প্রেরণ করেন। কিন্তু বার্তা পৌঁছার পূর্বেই জাহাজ ছেড়ে দেয়া হয়।
যাহোক, হিজাজের তুর্কী প্রতিনিধি গালিব পাশার মাধ্যমে আরবের উক্ত এলাকার তুর্কী কর্মকর্তা জামাল পাশা ও সেনাবাহিনী প্রধান আনোয়ার পাশার সঙ্গে শায়খুল হিন্দের চুক্তি হয় যে, আনোয়ার পাশা ও জামাল পাশার স্বাক্ষরিত প্রতিশ্রুতি অনুরোধপত্র ও নির্দেশাবলী ভারতের বিভিন্ন কেন্দ্রে পৌঁছিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা হবে এবং তিনি নিজে যে কোন প্রকারে হোক সংগ্রামের ঘাটি ইয়াগিস্তানে চলে যাবেন। সেখান থেকে ভারতে ও অন্যান্য মুসলিম রাষ্ট্রে পূর্ণোদ্যমে সক্রিয়ভাবে ইংরেজ বিরোধী আন্দোলন চালানো হবে। তুর্কী কর্মকর্তাদের সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তিটির নাম ছিলো ‘গালিব নামা’। রাওলেট এ্যাক্ট কমিটির রিপোর্টে সেই চুক্তির সংগ্রামী ভূমিকার বিশেষ অংশ হলোঃ
“হে ভারতবাসী! এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকার মুসলমানগণ সর্ব প্রকার অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে আল্লাহর রাস্তায় জেহাদে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। আল্লাহর অনুগ্রহে তুর্কী সেনাবাহিনী এবং মুজাহিদগণ সাফল্যের সঙ্গে এগিয়ে চলেছেন। সুতরাং হে মুসলমান, তোমরা যে ইংরেজ শক্তির লৌহজলে আবদ্ধ রয়েচো, সংঘবদ্ধভাবে তাকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলার উদ্দেশ্যে সর্বপ্রকার চেষ্টা ও সামর্থ্য নিয়ে পূর্ণোদ্যমে এগিয়ে আসো। দেওবন্দ মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মওলানা মাহমুদুল হাসানের সঙ্গে একমত হয়ে তাকে আমরা ঐ বিষয়ে পরামর্শ দান করেছি; ধন, জন ও সর্বপ্রকার প্রয়োজনীয় সমর উপকরণ দ্বারা তাঁর সহযোগীতা করো। এতে কিছুমাত্র ইতস্তঃত করো না”।
কিন্তু এ পরিকল্পনা নিয়ে মওলানা মাহমুদুল হাসান স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করবেন ঠিক এমন সময় (১৯১৬ খৃঃ) ইংরেজরা ষড়যন্ত্র করে মক্কার ইংরেজ-তাবেদার শাসক শরীফ হোসাইনের দ্বারা তাঁকে গ্রেফতার করে। শরীফ হোসাইনের সমর্থনসূচক বক্তব্য এবং “আরবদেশ শাসনকারী তুর্কী খলীফা ও তুর্কীগণ কাফের ও খেলাফতের অযোগ্য” এই মর্মে লিখিত একটি ফতওয়ায় দস্তখত করতে তাঁকে চাপ দেওয়া হয়। তিনি ঘৃনা ভরে তাতে অস্বীকৃতি জানান। অতঃপর তাঁর শিষ্য মওলানা মাদানীসহ কতিপয় বিপ্লবী আলেমকে গ্রেফতার করে মাল্টা দ্বীপে প্রেরণ করা হয়। উল্লেখ্য, তখন মুসলিম সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল তুরস্কের স্তাম্বুলে। মক্কা-মদীনা ছিল তুরস্ক খেলাফতের অধীন আরব প্রদেশের অন্তর্ভূক্ত। শরীফ হোসাইন বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের নেতার ভূমিকায় অবতীর্ণ ছিলেন।
রাওলেট অ্যাক্ট কমিটি
অবিভক্ত ভারত থেকে ইংরেজদের বিতাড়িত করে ভারত স্বাধীন করা এবং এখানে পুনরায় ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যেই শাহ ওয়ালিউল্লাহর চিন্তাধারার ভিত্তিতে আন্দোরন পরিচালিত হয়। শাহ আবদুল আজীজ মুহাদ্দিসে দেহলভী থেকে শুরু করে শায়খুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদুল হাসান পর্যণ্ত কয়েকটি বিপ্লব ঘটে যায়। বাংলা-পাক-ভারতের আলেম সমাজই ছিলেন এসব বিপ্লবী আন্দোলনের পুরোধা। ১৮৩১ খৃঃ বালাকোট জেহাদ ও ১৮৫৭ সালের রক্তাক্ত সংগ্রামের পর বিপ্লবী আলেমগণ পরিবর্তিত অবস্থার প্রেক্ষিতে একান্ত গোপনীয় ভাবে এ আন্দোলন পূর্ণোদ্যমে চালিয়ে যান। শত্রুপক্ষ প্রথম এর কিচুই টের পায়নি। ফলে ইংরেজ সরকারকে বহু ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধা মুজাহেদ বাহিনীর হাতে পর্যুদস্ত হতে হয়। এখাতে ইংরেজ সরকারের বহু কোটি টাকা ব্যয় হয় এবং ক্ষয় হয় অসংখ্য সৈন্য। ইংরেজগণ নির্বিঘ্নে টিকে থাকতে পারে এমন উপায় খুঁজে পাচ্ছিল না। অবশেষে তারা বিভ্রান্ত ও হতবুদ্ধি হয়ে এসব বিপ্লবের মূলড তথ্য উদঘাটন ও এর মূলোচ্ছেদের লক্ষ্যে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। এটাই হচ্ছে রাওলেট অ্যাক্ট কমিটি।
১৯১৩ খৃষ্টাব্দে উক্ত কমিটি তাদের রিপোর্ট পেশ করতে সক্ষম হয়। কমিটি মওলানা শায়খুলহিন্দের আনছারুল্লাহ’ সংস্থার বিপ্লবী শাখা “আজাদ হিন্দ মিশন” আন্দোলনের অনেক ঘটনারই তথ্য উদঘাটন করতে পারেনি। যে কয়টি বিষয়ের আবিস্কার করেছে তাও অসম্পূর্ণ। তাতে আলেমগণ ও তাদের বিপ্লবী সহকর্মীদের কর্মতৎপরতা এবং রাজনীতি ও যুদ্ধনীতির ক্ষেত্রে যে অদম্য সাহস ও দক্ষতার পরিচয় পাওয়া যায়, সেটা আধুনিক শিক্ষিত যুবকদের কাছে অবাকই মনে হবে। মনে করার কারণও রয়েছে, কেননা ঐ সকল সংগ্রামী আলেমের শিষ্য-শাগরিদদের অনুসৃত নীতিকে সেই সংগ্রামী ভাবধারার যথাযথ প্রতিফলন তারা মাঝ-খানে দীর্ঘ দিন দেখতে পায়িনি। যাহোক, ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা ও পরিবেশে লালিত শিক্ষিত কতিপয় যুবক তাতে হতবাক হলেও একথা সত্য যে, বৃটেন, আমেরিকা, রাশিয়া প্রভৃতি উন্নত রাষ্ট্রসমূহের কর্মকর্তা এবং ঐ সকল দেশের বিশিষ্ট রাজনীতিক ও কুটনীতিকরা বিদেশ সম্পর্কে রাজনীতি, সমরনীতি, রাজ্য পরিচালিনায় অগাধ জ্ঞান ও দক্ষতার বিষয়ে সচেতন ছিলেন। বিশেষ করে শায়খুলহিন্দ মওলানা মাহমুদুল হাসানের “আজাদ হিন্দ মিশনের” দুর্দমনীয় সতর্কতাপূর্ণ আন্দোলনের নামে বৃটিশ সরকার যে আতঙ্কিত থাকতো, তাদের লেখকদের লেখাই তার বড় প্রমাণ।
অবিভক্ত ভারতের আলেম সমাজ ইংরেজদের বিরুদ্ধে কিরূপ বীরত্বপূর্ণ আন্দোলন পরিচালনা করেছিলেন, প্রখ্যাত ইংরেজ লেখক ইউলিয়াম হান্টার লিখিত ‘আওয়ার ইণ্ডিয়ান মুসলমান’ গ্রন্থে তাঁর আক্ষেপ থেকেও সেটা আঁচ করা যেতে পারে। তা হচ্ছে এই-
“এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, ভারত গর্ভর্ণমেন্ট যদি পূর্ব থেকেই ষড়যন্ত্র আইনের ৩নং ধারা অনুযায়ী ভারতে আলেমদের কঠোর হস্তে দমন করতো, তা হলে ভারত গভর্ণমেন্টকে ১৮৬৩ খৃষ্টাব্দে মোজাহিদ আলেমদের আক্রমণের ফলে এত দুঃখ ভোগ করতে হতোনা। কতিপয় প্রসিদ্ধ আলেমকে গ্রেফতার করা হলে আম্বালা ঘাটিতে আমাদের এক সহস্র সৈন্য হতাহত হতো না এবং লক্ষ লক্ষ পাউণ্ড অর্থও বেঁচে যেতো। এমন কি উক্ত লড়াইর পরও যদি কঠোর হস্তে আলেমদেরকে দমন করা হতো, তবে অন্ততঃ পক্ষে ১৮৬৮ খৃষ্টাব্দে কালাপাহাড় অভিযান হতে রক্ষা পাওয়ার আশা ছিল”।
এমনিভাবে শায়খুলহিন্দ মওলানা মাহমুদুল হাসান প্রমুখ বিপ্লবী আলেমের ইংরেজ-খেদা আন্দোলন ও ষড়যন্ত্রের বিবরণ তাদের লেখায় প্রকাশ পায়। ঐ সকল বিবরণ থেকে জানা যায় যে, ১৯১৬ খৃষ্টাব্দের আগষ্ট মাসে ভারতীয় মুক্তি যোদ্ধাদের ষড়যন্ত্র ধরা পড়ে। ইংরেজ সরকারের ফাইলে তাকে ‘রেশমী রুমালের চিঠি’ নামে অভিহিত করা হয়। কারণ, ইংরেজ বিরোধী পরিকল্পনা সম্বলিত লেখা চিঠিটি রেশমী কাপড়ে লেখা ছিল। তাতে-
“ভারতের উত্তর পশ্চিম সীমান্ত থেকে ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে প্রবল আক্রমণ চালাবার পরিকল্পনার কথা উল্লেখ আছে এবং ভারতের মুসলমানদের পূর্ণোদ্যমে অগ্রসর হয়ে বৃটিশ হুকুমতকে উচ্ছেদ করার কথাও ছিল। “উক্ত পরিকল্পনাকে বাস্তবে রূপায়িত করার জন্যে মওলভী ওবায়দুল্লাহ নামক এক ব্যক্তি ১৯১৫ খৃষ্টাব্দে তার সহকর্মীকে সঙ্গে নিয়ে ভারতের উত্তর পশ্চিম সীমান্ত অতিক্রম করে। মওলভী ওবায়দুল্লাহ পূর্বে শিখ ধর্মাবলম্বী ছিলেন। তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে প্রথমতঃ ছাহারনপুর জিলার অন্তর্গত দেওবন্দে মুসলমানদের ধর্মীয় মাদ্রাসায় শিক্ষা লাভ করে ফাজেল ডিগ্রী লাভ করেন এবং কতিপয় মওলভীকে বৃটিশ সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ও আক্রমণ পরিচালনার পক্ষে তাঁর মতাবলম্বী করে তোলেন। তন্মধ্যে মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক মওলানা মাহমুদুল হাসান ছিলেন প্রধান নায়ক। মওলভী ওবায়দুল্লাহ একান্ত ইচ্ছা ছিল, দেওবন্দ মাদ্রাসায় শিক্ষাপ্রাপ্ত আলেমদের সহযোগিতায় সারা ভারতে ইসলামী হুকুমাতের প্রেরণা জাগ্রত করে মুসলমানদেরকে বৃটিশ সরকারের বিরুদ্ধে জোর আন্দোলনের জন্য প্রস্তুক করা”।
বস্তুতঃ এসব কারণেই বৃটিশ ভারতের মুসলমান তাদের প্রিয় সংগ্রামী নেতা শায়খুলহিন্দ মওলানা মাহমুদুল হাসানকে কেন্দ্র করে রণোন্মাদনা-মূলক গান গেয়ে গেয়ে কুখ্যাত ইংরেজদের বিরুদ্ধে মুসলিম যুবসমাজের উষ্ণ রক্তে অগ্নিস্ফুলিঙ্গের সৃষ্টি করতো। সেদিন কেবল সিন্ধু, মাদ্রাজ, ইউ পিতের নয় বাংলার পথে-ঘাটে, গঞ্জে-বাজারে, বন্দরেও এই ধ্বনি উচ্চারিত হতে শোনা যেতো যে, –
“মুসলমানের শেখুল হিন্দ আছে মাল্টাতে,
চল খেলাফত উদ্ধারে মুসলমানী যেতে বসেছে”।
যাহোক, এই সিংহদিল মহান সংগ্রামী নেতা মাল্টার কারাজীবন শেষে ভারতে এসে যখন খেলাফত আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন, তখন তাঁর কারাক্লান্ত দেহ অধিক পরিশ্রম হেতু আরও দুর্বল হয়ে পড়ে। অবশ্য এই দুর্বলতা নিয়েও তিনি আন্দোলন করে যান। এমনকি তাঁর জীবদ্দশাতেই যখন অসহযোগ আন্দোলন দেখা দেয়, তখনও তাঁকে মওলানা আবুল কালাম আজাদের অনুরোধে দুর্বল শরীর নিয়ে সরকার নিয়ন্ত্রণমুক্ত জাতীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দিল্লীর বিখ্যাত “জামায়ায়ে মিল্লিয়া’র দ্বারোদঘাটন করতে দেখা যায়। কিন্তু বার্ধক্যপীড়ার মধ্যে অস্বাভাবিক পরিশ্রমের দরুণ শেষ পর্যন্ত তাঁর শরীর বেশীদিন টিকেনি। ১৯২০ সালে মওলানা মাহমুদুল হাসান সংগ্রামরত ভারতীয় মুসলমানদেরশোকের সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে দুনিয়া থেকে চির বিদায় গ্রহণ করলেন।
সংগ্রামী নেতা মওলানা হোসাইন আহমদ মাদানী
শায়খুল হিন্দ মওলানা মাহমুদুল হাসানের ইন্তেকালের পর ইংরেজবিরোধী আন্দোলনে দেওবন্দ বাহিনীর পক্ষ থেকে ভারতে মুসলমানদের নেতৃত্ব দানে যাঁরা এগিয়ে আসেন, তাঁদের মধ্যে মওলানা হোসাইন আহমদ মাদানী (রহঃ) ও মওলানা শাব্বীর আহমদ ওসমানীর ত্যাগ ও সংগ্রাম অপরিসীম। উভয়ই ছিলেন মওলানা মাহমুদুল হাসানের যোগ্য সহকর্মী শিষ্য। মওলানা মাদানী মহান সংগ্রামী উস্তাদের আদর্শ এবং দারুল উলুম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে তাঁর গোটা জীবনকে দ্বীন ও মিল্লাতের স্বার্থে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত করেছেন। তিনি প্রখ্যাত মুহাদ্দিস আনওয়ার শাহ কাশ্মীরীর (রহঃ) পর ১৯২৯ খৃষ্টাব্দে দারুল উলুম দেওবন্দের প্রধান অধ্যাপক নিয়োজিত হন। এক কালের অবিভক্ত ভারতের আলেমদের সংগ্রামী প্রতিষ্ঠাত ‘জমিয়তে ওলামায়ে হিন্দের’ও তিনি সভাপতি ছিলেন (১৯২৩ খৃঃ)। মওলানা মাদানী অসহযোগ আন্দোলন সহ অখণ্ড ভারতের পূর্ণ আজাদী পর্যণ্ত হিমালয়ের মতো অটলভাবে আনাচে কানাচে বহুবার সফর করেন। মওলানা মাদানীকে কয়েকবার ইংরেজ সরকার জেলে আবদ্ধ রেখে তাঁর প্রতি অকথ্য জুলুম নির্যাতন চালায়।
খেলাফত ও অসহযোগ আন্দোলন
খেলাফত আন্দোলনের পাশাপাশি যখন অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়, তখন সরকারী অফিস-আদালত থেকে শুরু করে সরকার পরিচালিত স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা সব শূন্য হতে শুরু করলো। অসহযোগ আন্দোলনকে জোরদার করার জন্য মওলানা মাদানী যে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন, তা ভারতের মুক্তি-সংগ্রামের ইতিহাসে এক গৌবরজনক অধ্যায় হিসাবে ভাস্বর হয়ে থাকবে। তিনি ‘রিসালা-এ তরকে মুয়ালাত’ নামে একখানা তথ্য ও যুক্তির্পূণ পুস্তিকা রচনা করে ইংরেজদের ব্যাপারে উত্তেজিত ভারতবাসীর জেহাদী আগুনকে অধিক প্রজ্জ্বলিত করেছিলেন। পুস্তকটি এতই আলোড়ন সৃষ্টি করিছিল যে, শেষ পর্যন্ত ইংরেজ সরকার তা বাজেয়াপ্ত করতে বাধ্য হয়। তাতে মওলানা মাদানী যুক্তি প্রমাণ ও শরীয়তের হুকুম-আহকামের উদ্ধৃতি দিয়ে প্রমাণ করে দেখিয়ে দিয়েছিলেন যে, বৃটিশ শক্তি তদানীন্তন মুসলিম বিশ্বের রাজনৈতিক শক্তি-কেন্দ্র তুর্কী খেলাফতের মূলোৎপাটন করতে বদ্ধপরিকর। যারা মিসর, হেজাজ বিশেষতঃ মক্কা-মদীনা ভূমির উপর নানা ষড়যন্ত্রজাল বিস্তার করে নির্যাতন ও সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে, যারা আরব জাহাদের বিষফোঁড়া ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছে, যারা মুসলিম জাহানের মেরুদণ্ড তুরস্ক সাম্রাজ্যকে আক্রমণের পর আক্রমণ চালিয়ে খণ্ড-বিখণ্ড করেছে, তাদের সঙ্গে সহযোগিতা ইসলামী শরীয়ত বিরোধীই নয়, মানবতা বিরোধীও বটে। বলাবাহুল্য, মওলানার এই পুস্তক বৃটিশ-ভারতে ইংরেজদের ভিত্তিমূল কাঁপিয়ে তোলে।
করাচীর মোকদ্দমা ও মওলানা মাদানী
বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের প্রধান সম্বল ছিল ভারতের জনবল ও সম্পদ। তুর্কী খেলাফতের অধীন মক্কা মদীনার পবিত্র ভূমিকা মধ্যপ্রাচ্যেল মুসলিম দেশগুলোতে খণ্ড-বিখণ্ড করে ফেলার জন্য যে বৃটিশ সামরিক শক্তি ব্যবহৃত হয়েছিল, তাতে সৈন্য সংগ্রহ করা হয়েছিল প্রধানতঃ ভারত থেকেই। এতে করে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা প্রকারান্তরে মুসলিম সেনাবাহিনী দ্বারাই তুরস্ক, সাইপ্রাস এবং সমস্ত মধ্যপ্রাচ্যের আরব মুসলমানদের বুকে গুলি বর্ষণ করাচ্ছিল। মুসলমানদেরকে দিয়ে কুচক্রী সাম্রাজ্যমাদীদের চালিত জগধৎজোড়া মুসলিম নিধনের এই ন্যাক্কার-জনক ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে ভারতীয় মুসলমানরা প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠে। ১৯২১ খৃষ্টাব্দের ৮, ৯ ও ১০ ই জুলাই তারিখে করাচীতে ‘নিখিল ভারত খেলাফত কমিটি’র সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে মওলানা মাদানী এই প্রস্তাব উত্থাপন করলেন যে,-
“যে কোন মুসলমানের পক্ষে বৃটিশ সৈন্যবাহিনীতে চাকুরী করা বা চাকুরীকে উৎসাহিক করা সম্পূর্ণ হারাম। বৃটিশ সৈন্যবাহিনীতে কর্মরত সকল মুসলিম সৈনিকের নিকট একথা পৌঁছিয়ে দেয়া প্রত্যেক মুসলমানের কর্তব্য”।
সম্মেলনে মওলানা মাদানীর এই বিপ্লবাত্মক প্রস্তাবটি বিপুল উত্তেজনাপূর্ণ সাড়ার মধ্য দিয়ে গৃহীত হয় এবং মুহুর্তের মধ্যে সারা ভারতে একথা ছড়িয়ে পড়ে। মওলানা মাদানীর এ প্রস্তাবকে প্রকাশ্য রাষ্টদ্রোহিতা বলে বৃটিশ সরকার ঘোষণা করে এবং ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২০, ১৩১ ও ৫০৫ ধারা মতে মওলানা মাদানী ও মওলানা মুহাম্মদ আলী জাওহার, মওলানা শওকত আলী, ডক্টর শায়ফুদ্দীন কিচলু, মওলানা নিসার আহমদ কানপুরী, পীর গোলাম মুজাদ্দিদ সিন্ধী ও স্বামী শঙ্কর আচার্যের বিরুদ্ধে এক রাষ্ট্রদ্রোহিতা মূলক মোকদ্দমা দায়ের করে।
মওলানা মাদানীর গ্রেফতারী
নিখিল ভারত খেলাফত কমিটির সম্মেলন সমাপ্ত হওয়ার পর মওলানা মাদানী করাচী থেকে দেওবন্দ চলে যান। ১৯২১ খৃষ্টাব্দে ১৮ই সেপ্টেম্বর তাঁর নামে গ্রেফতারী পরওয়ানা জারী হয়। মাদানীর গ্রেফতারী পরওয়ানার কথা প্রচার হওয়া মাত্র সমগ্র দেওবন্দ শহরে স্বতঃস্ফুর্ত ধর্মঘট পালিত হয় এবং অল্পক্ষণের মধ্যে হাজার হাজার লোক তাঁর বাসভবনে এসে জমায়াত হয়। পুলিশের সঙ্গে বিক্ষুব্ধ জনতার সংঘর্ষের আশংকায় সরকার তাৎক্ষনিকভাবে সিদ্ধান্ত নেয় যে, পরদিন শহরবাসী শোভাযাত্রা সহকারে মওলানাকে ষ্টেশনে পৌছিয়ে দেবে। কিন্তু গভীর রাত্রে দেখা গেলো, একজন গুর্খা ও কতিপয় গোরা পুলিশ কর্মচারী এসে তাঁর বাসভবন ঘিরে ফেলে এবং রাত ৩টার সময় তাঁকে গ্রেফতার করে স্পেশাল ট্রেনে করে নিয়ে যায়। তাতে পরদিন আবার তার গ্রেফতারির প্রতিবাদে ও মুক্তির দাবীদে অন্যান্য শহর সমেত ক্ষুব্ধ জনতা স্বতঃস্ফুর্ত ধর্মঘট পালন করে।
আসামীয় কাঠগড়ায় মওলানা মাদানী
১৯১২ খৃঃ ২৬ শে ডিসেম্বর করাচীর খালেকদিনা হলে এই ঐতিহাসিক মোকদ্দমার শোনানী শুরু হয়। আইনগত দিক থেকে এ মোকদ্দমায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ফাঁসি অথবা আজীবন নির্বাসন হবার কথা। হলের গোটা পরিবেশকে বিভীষিকাময় করে তোলা হয়েছিল। দেড় শত সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী এবং হলের চার পাশে ছিল কাঁটাতারের বেড়া। করাচী শহরের সর্বত্র বৃহদাকারে দণ্ডধারী পুলিশের তৎপরতা। বেলা দশটার দিকে যে কোন ব্যক্তির মনে ভয় ও আতঙ্ক সৃষ্টি হওয়াই স্বাভাবিক ছিল। মওলানা মাদানী প্রমুখ আলেমকে এই বিভীষিকাময় পরিবেশের মধ্য দিয়ে হলে আনা হলো। কিন্তু যাদের উদ্দেশ্যে ইংরেজ সরকার এই ভীতিপ্রদ পরিবেশ সৃষ্টি করেছিলো তাঁরা এসবকে শিশুর ক্রীড়-কৌতুকের ন্যায় মনে করলেন। তাঁদের সংগ্রাম ছিল ন্যায় ও সত্যের। এসব সিংহদিল মোজাহিদ তার কিছুই পরওয়া করেননি। তাঁরা এটা স্পষ্টই জানতেন যে, যদি ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদীরা তাঁদেরকে ফাঁসি কাষ্ঠে ঝুলায়, তাতে তাঁরা শাহাদাতের অমীয় সুধা পান করবেন এবং জাতি পাবে সত্যনিষ্ঠার প্রেরণা; আর এমনিভাবে ভারতের আজাদীর পথ কাফের বিরোধী জেহাদে দ্রুত রূপান্তরিত হবে।
নেতৃবৃন্দ মোকদ্দমায় কোন প্রকার আইনজীবী নিযুক্ত করেননি। মওলানা মাদানী ও তাঁর সহকর্মী মওলানা মুহাম্মদ আলী জাওহার ইংরেজ আদালনের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে যেই নির্ভীক ও অনলবর্ষী ভাষণ দিয়েছিলেন, তাতে এই ষড়যন্ত্রমূলক মোকদ্দমার রহস্যই কেবল ফাঁস হয়ে যায়নি, এর দ্বারা পাক-ভারতে ইংরেজ সাম্রজ্যবাদের ভিত্তিমূলও কেঁপে উঠে। করাচীতে ইংরেজ কাঠ গড়ায় মওলানা মাদানী ও মওলানা জাোহারের সে-সব অনলবর্ষী ইংরেজ কাঠগড়ায় মওলানা মাদানী ও মওলানা জাওহারের সেসব অনলবর্ষী বক্তৃতা উপমহাদেশের আজাদী সংগ্রামের ইতিহাস চিরদিন স্বর্ণাক্ষরে লিখিত থাকবে।
আদালতে মওলানা মুহাম্মদ আলী জাওহারের ভাষণ
“যে প্রস্তাবকে বৃটিশ সরকার রাজদ্রোহ বলে অভিযুক্ত করছে, এটা এমন এক মহাপুরুষের আনীত প্রস্তাব, যাঁকে আমি শ্রদ্ধেয় মুরব্বি হিসাবে গ্রহণ করতে গৌরব বোধ করি। তিনি হচ্ছেন হযরত মওলানা সাইয়েদ হুসাইন আহমদ মাদানী। ‘ইংরেজ সরকারের পুলিশ ও সৈন্য বিবাগে মুসলমানদের যোগদান হারাম এবং শরীয়ত নিষিদ্ধ’ বলে ফতওয়া ও বিজ্ঞপ্তি সামরিক অফিসার সিপাহীদের নিটক প্রচারিত হচ্ছে জেনে আমার অন্তর আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে উঠেছে”।
মওলানা মাদানীর ভাষণ
“অত্যাচারী শাসকের সামনে ন্যায় ও সত্য কথা বলাই উত্তম জেহাদ” –এই হাদীসের মর্ম বাণী দ্বারা অনুপ্রাণিত মওলানা মাদানী আদালতের সামনে যেই নির্ভীক ভাষণ দিয়েছিলেন তা হলোঃ
“আমি একজন ধর্মানুরাগী ব্যক্তি হিসাবে আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের হাদীসের প্রতি রয়েছে আমার অটল ঈমান ও পূর্ণ আস্থা। ‘কেউ ধর্মীয় কাজে বাধার সৃষ্টি করলে কোনোরূপ পরওয়া না করেই তা প্রতিহত করা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য ফরজ’। মহানবীর নির্দেশ হচ্ছে, কোনো শাসক বা রাষ্ট্রের আনুগত্য স্বীকার তখনই জায়েজ, যদি তাতে আল্লাহর অবাধ্যতা না থাকে। এমন কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর অধীনে থাকা বা তার আদেশ পালন করা অবৈধ, যারা বা যে ব্যক্তি আল্লাহর নির্দেশ বিরোধী শাসনকার্য চালায়। ধর্মীয় আলেম হিসাবে সাধারণ মানুষের তুলনায় আমার প্রতি আল্লাহ-রসূলের প্রত্যেকটি হুকুম তামিল করা এবং অন্যের নিকট প্রচার করা অধিকতর কর্তব্য। ধর্মীয় গ্রন্থে রয়েছে, যে ব্যক্তি সত্য গোপন করবে কেময়ামতের দিন তাকে দোযখের জ্বলন্ত আগুনে নিক্ষেপ করা হবে। কুরআন পাকে কাফের সম্পর্কে কঠোর আযাবের কথা উল্লেখ হয়েছে। কিন্তু যে মুসলমান অপর মুসলমানকে হত্যা করে, তার জন্যে পাঁচ প্রকারের শাস্তির কথা উল্লেখ রয়েছে”। বর্তমান পরিস্থিতিতে ইংরেজ সরকারের পুলিশ বা সৈন্য বিভাগে যোগদান করলে তাকে বাধ্য হয়ে অপর মুসলমানকে হত্যা করতে হয়। তাই আলেম সমাজ ইংরেজ সৈন্যবাহিনীতে কোনো মুসলমানের যোগদান করাকে হারাম বলে ফতওয়া জারী করেছেন। ইসলাম ধর্মমতে এটা হচ্ছে তাদের অপরিহার্য ধর্মীয় দায়িত্ব। সুতরাং করাচী সম্মেলনে যে প্রস্তাব পাশ করা হয়েছে , সেটা নতুন কিছু নয় বরং তেরশো বছর পূর্বেকার একটি বিশেষ ধর্মীয় অনুশাসনেরই অভিব্যক্তি মাত্র”।
“মিঃ লয়েড জর্জ ও মিঃ চার্চিল যখন এ ঘোষণা করেছেন যে, তুর্কী খেলাফতের সঙ্গে তাদের যেই যুদ্ধ, সেটা ক্রুসেডের ধর্ম যুদ্ধ, ইসলাম খৃষ্টধর্মের মধ্যে শেষ বুঝা-পড়ার যুদ্ধ, তখন মুসলমানদের পক্ষে ইসলাম বিরোধী সকল শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা প্রধান ফরজ হয়ে দাঁড়িয়েছে”।
“উল্লেখ্য যে, এই ধর্মীয় উত্তেজনার ফলেই ১৮৫৭ সালে সারা ভারতের সর্বত্র যখন বিপ্লবের আগুন জ্বলে উঠেছিল, তখন রানী ভিক্টোরিয়া অর্থাৎ ইংরেজ সরকার ভারতীয়দেরকে যে প্রতিশ্রুতি ও সরকারী ঘোষণা প্রচার করে তাদের সান্ত্বনা দিয়েছিলেন, তাতে উল্লেখ ছিল যে, “কারও ধর্মের উপর কোন প্রকার হস্তক্ষেপ করা হবে না বরং ধর্মীয় বিষয়ে দেশবাসীর পূর্ণ আজাদী থাকবে”। বৃটিশ পার্লামেন্টেও তা স্বীকৃত হয়েছিল। এমনকি পরবর্তীকালে সপ্তম এডওয়ার্য এবং পঞ্চম জর্জও এ ঘোষণা সমর্থন করেছিলেন। কিন্তু বর্তমান সরকার যদি রানী ভিক্টোরিয়া, পরবর্তী সম্রাটগণ ও তাদের পার্লামেন্টের প্রতিশ্রুতি ও ঘোষণার কোনো মর্যাদা না দেন আর ভারতবাসীর ধর্মীয় বিষয়ে হস্তক্ষেপকে সঙ্গত মনে করেন, তা হলে এদেশের কোটি কোটি মুসলমানকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহন করতে হবে যে, তারা মুসলমানকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে যে, তারা মুসলমান হিসাবে বেঁচে থাকবে চায়, না নিরেট ইংরেজ বশংবদ প্রজা হিসাবে। ভারতের তেত্রিশ কোটি হিন্দুকেও অনুরূপ সিদ্ধান্ত নিতে হবে। অবশ্য আমি মুসলমানদের তরফ থেকে ইংরেজ সরকারকে সতর্ক করে দিতে চাই, যদি সরকার ধর্মীয় স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে, তাহলে মুসলমানরা নিজের ধর্ম রক্ষার খাতিরে জীবন উৎসর্গ করে দিতেও কিছুমাত্র ইতস্ততঃ করবে না। আর এ জন্য আমিই সর্বাগ্রে জীবন উৎসর্গ করতে এগিয়ে আসবো”।
এ সময় মওলানা মুহাম্মদ আলী জাওহার শ্রদ্ধাভরে মওলানা মাদানীর পদচুম্বন করে তাঁর প্রতি অকৃত্রিম ভক্তি প্রদর্শন করেন।
অতঃপর ১৯২১ সালের ১লা নভেম্বর এই ঐতিহাসিক মোকদ্দমার রায় প্রকাশিত হয়। মওলানা মাদানী ও তাঁর সহকর্মীদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ শেষ পর্যণ্ত তাদের ক্ষুরধার যুক্তির সামনে বাতিল হয়ে যায়। এসত্ত্বেও অপর কয়েকটি অভিযোগের অজুহাতে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৫০৫ ও ১০৯ ধারা মতে হযরত মওলানা মাদানী ও তাঁর সহকর্মীদেরকে দু’বছর করে সশ্রম কারা দণ্ডের হুকুম দেয়া হয়।
করাচীর মোকদ্দমা চলা কালে দেশব্যাপী উত্তেজনার আগুন প্রজ্জ্বলিত ছিল। যে সত্যের বাণী উচ্চারণ করে মুসলিম ভারতের সংগ্রামী নেতাগণ ইংরেজ নির্যাতনের লৌহ প্রাচীরের অন্তরালে নিষ্পেষিত হচ্ছিলেন, দেশবাসী তা অন্তর দিয়ে উলব্ধি করেছিল এবং প্রতিক্রিয়া হিসাবে সারা দেশে সভা, শোভাযাত্রা ও হরতার পালিত হয়। মূলতঃ এমনিভাবেই উপমহাদেশের আজাদী আন্দোলনের পথ প্রশস্ত হতে থাকে। জেলে অবস্থান রত মওলানা মাদানীর কাছে তাঁর সহকর্মীদের পক্ষ থেকে অসংখ্য চিঠিপত্র যেতো, সে সব চিঠিপত্রের জবাব হিসাবে মওলানা সাহেব যে জ্ঞানগর্ভ ও জ্বালাময়ী কথাবার্তা লিখতেন, সেগুলোর সংকলন “করাচীর চিঠি” হিসাবে প্রসিদ্ধ। (হায়াতে মাদানী)
মুরাদাবাদ ও নৈনিতাল কারাগারে মওলানা মাদানী
১৯৪২ খৃষ্টাব্দে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলা কালে যখন বৃটিশ সরকার বিপক্ষের উপর্যুপরি আক্রমণের ফলে নিরাশ হয়ে পড়ে এবং মর্মে অনুভব করে যে, ভারতের সঙ্গে একটা বুঝাপড়া করা না হলে উপায় নেই, তখন বৃটিশ প্রধান মন্ত্রী স্টাফোর্ড ক্র্যুপসের নেতৃত্বে ক্র্যুপস মিশন’ ভারতে প্রেরিত হয়। এ সময় ভারতের বিভিন্ন পার্টির মধ্যে এ সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে মতভেদ ভীষণ এক আলোড়ন সৃষ্টি করে। তখন মওলানা মাদানী সমঝোতার উদ্দেশ্যে ধর্ম, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় দৃষ্টি ভঙ্গিতে সূক্ষ্মতত্ত্ব সন্নিবেশিত প্রমাণাদি দ্বারা দ্বিজাতিতত্ব ও এক জাতিতত্ত্বের সমস্যার সমাধানের অবতারণা করে যে ফর্মূলা পেশ করেছিলেন, উক্ত মিশন তাতে স্তম্ভিত হয়ে যায়। তারা মওলানা মাদানীর অগাধ রাজনীতি, সমাজনীতি ও ধর্মনীতি, জ্ঞান, কর্মদক্ষতা ও অভিজ্ঞতার প্রশংসা করতে বাধ্য হয়। পরে মওলানার এই ফরমূলা ‘মাদানী ফরমূলা’ নামে প্রসিদ্ধি লাভ করে। কিন্তু শেষ পর্যণ্ত নানান কারণে উক্ত মিশন ব্যর্থ হলে পুনরায় আজাদী আন্দোলনের পূর্ণোদ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। তখন দিশেহারা ইংরেজ সরকার বলপূর্বক ভারতের আন্দোলন দমন করার জন্য গভর্ণর জেনারেল মি. এমেরী ও বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী মি. চার্চিল একটি যুক্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন এবং মওলানা মাদানীকে এ প্রেক্ষিতে গ্রেফতার করার বাহানা খুঁজতে থাকেন। কেননা মাওলানা মাদানীর ব্যক্তিত্ব এবং সাম্রাজ্যবাদীতের ভারত থেকে বিতাড়িত করার মরণপণ সংগ্রামী নেতা হিসাবে মাদানী সম্পর্কে তারা খুব ভালভাবেই সচেতন ছিলেন। অতঃপর ১৯৪২ খৃষ্টাব্দের ২৩, ২৪ ও ২৫শে এপ্রিল তারিখে মুরাদাবাদে অনুষ্ঠিত জেলা জমইয়তে ওলামায়ে হিন্দের কনফারেন্সে মওলানা মাদানীর বক্তৃতাকে উপলক্ষ করে তাঁর বিরুদ্ধে মোকদ্দমা সাজানো হয় এবং গ্রেফতারী পরওয়ানা জারী করা হয়। কনফারেন্স শেষে মওলানা সাহেব দেওবন্দ পৌঁছে যান। সেখানে গ্রেফতার করা নিরাপদ মনে না করে তাঁকে পাঞ্জাব ইত্তেহাদ কনফারেন্সে যাওয়ার পথে দেওবন্দ ও ছাহারণপুরের মধ্যবর্তী তিলছড়ী ষ্টেশনে রাত দুটার সময় গ্রেফতার করা হয়। মওলানা মাদানীর এ গ্রেফতারীর পর প্রথম মুরাদাবাদে ও পরে এলাহাবাদের নৈনিতাল জেলে তাঁকে বহুদিন কারা রুদ্ধ করে রাখা হয়।
মওলানা মাদানী পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে অনেক সময় উদ্দীপনাময়ী ভাষায় বক্তৃতা দিতেন। ১৯২১ খৃষ্টাব্দের ২১শে ফেব্রুয়ারী তারিখে অনুষ্ঠিত খেলাফত কনফারেন্সে সভাপতির ভাষন দান কালে তিনি আন্দোলন সম্পর্কিত যে ভাষণ দিয়েছিলেন, এখানে তার কিছু অংশ পেশ করা হলোঃ
রক্তের বদলে ভারতের ভাগ্য
“হে ভারত! ফ্রান্সের ময়দানে, ইটালীর পাহাড় পর্বতে, সালুনিকার মাঠে-ঘাটে, দারাদানিয়ালের প্রস্তর ভূমিতে, সিনাই উপত্যকা এবং সুয়েজ ও সিরিয়ার বালুকা প্রান্তরে, এডিন ও ইয়ামতের কঙ্কর ভূমিতে, ইরাক, ইরানের মাঠে-ময়দানে, পূর্ব ও পশ্চিম আফ্রিকার জার্মান অধিকৃত অঞ্চলে, মধ্য এশিয়া ও কাফকাজিয়ার তুষার ভূমিতে এবং কৃষ্ণ সাগর, লোহিত সাগর ও শ্বেত সাগরের উপকূলসমূহে বন্য পশু ও জন্তুর ন্যায় অতীব নির্দয়ভাবে তোর লক্ষ্য লক্ষ কচি সন্তানের রক্তের স্রোত প্রবাহিত করা হচ্ছে, তাদের উপর গোলা বর্ষণ চলছে, লক্ষ লক্ষ মানুষ অস্ত্রঘাতে দুনিয়া থেকে বিদায় নিচ্ছে। কিন্তু জিজ্ঞাসা করি হে ভারত! এর বিনিময়ে তোকে কি পুরস্কার দেওয়া হলো? উত্তরে এছাড়া তোর আর কি বলার আছে যে, এর পুরস্কার স্বরূপ তোর ভাগ্যে জুটেছে স্ত্রীদের বৈধব্য, সন্তানদের এতীম হওয়া, তোর গলায় দাসত্বের শৃংখল পরানো, রাওলেট বিল পাশ হওয়া, কোর্ট মার্শালের কবলে পড়া, পাঞ্জাবের দিকদিগন্তকে রক্তে রঞ্জিত করা, জালিনওয়ালাবাগে মিশিন গানের বর্ষণ, তোর নিরিহ সন্তানদের উপর পাশবিক অত্যাচার ও অপমানজনক ব্যবহার, তোর স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া, তোর উপর নানাবিধ টাক্স বসানো, তোকে রাজদ্রোহিতার নানারূপ ষড়যন্ত্রের বেড়াজালে শৃঙ্খলিত করা”।
“ভাইসব, এ সমস্ত কি কারণে সম্ভব হচ্ছে তা আপনারা চিন্তা করেছেন কি? আমাদের অনৈক্য এবং বিদেশীদের সঙ্গে আমাদেরই এক শ্রেণীর লোকের অবৈধ মৈত্রী সহযোগিতার কারণেই এসব সম্ভব হচ্ছে। আজ যদি আমরা গোটা ভারতবাসী ঐক্যবদ্ধ হই, পৃথিবীর কোনো শক্তি আমাদের প্রতি চোখ তুলে তাকাবার সাহস পাবে না। আমাদের ঐক্যশক্তির কাছে তাদের গোলা-বারুদ নিস্ক্রিয় হতে বাধ্য। …. আমাদের মতবিরোধে কেবল আমাদেরকেই বিপদে পড়তে হবে না বরং এর ফলে গোটা প্রাচ্যের অন্যান্য দেশ ও জাতির স্বাধীনতাও বিপন্ন হতে পড়বে”। -(হায়াতে মাদানী)
আজাদী অর্জন ও ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে দারুল উলুম দেওবন্দকে কেন্দ্র করে শাহ ওয়ালি উল্লাহ দেহলভীর অনুসারীদের যে আনেদালন গড়ে উঠেছিল, এই সঙ্গে উপমহাদেশের প্রায় সকল শ্রেণীর আলেমই জড়িত ছিলেন। এ আন্দোলনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এমন আরও অসংখ্য নির্যাতিত আলেম রয়েছেন, যাদের সুদীর্ঘ ফিরিস্তি পেশ করা এখানে সম্ভব নয়। তাদের মধ্যে মওলানা হাসরাৎ মোহানী, মওলানা আজাদ সোবহানী, মওলানা আবুল কালাম আজাদ, মওলানা আতাউল্লাহ শাহ বুখারী, মওলানা মুহাম্মদ আলী, মওলানা শওকত আলী, মওলানা ওজাইর গুল পেশোয়ারী, মওলানা ওয়াহীদ আহমদ, মওলানা আবদুল রহীম রায়পুরি, মওলানা মুহাম্মদ সাদেক, মওলানা শেখ আবদুল রহীম, প্রমুখ ওলামায়ে কেরাম।
আজাদী আন্দোলনে বাংলা দেশ থেকে যেসব আলেম জড়িত হয়ে অগ্রবর্তী ভূমিকা পালন করেছিলেন তাদের মধ্যে মওলানা মনীরুজ্জামান ইসলামাবাদী, পীর বাদশা মিয়া, মওলানা আকরাম খাঁ, মওলানা আবদুল্লাহির কাফীও ও মওলানা আবদুল্লাহিল বাকী, মওলানা অতহার আলী, মওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী প্রমুখ ওলামায়ে কেরামের নাম উল্লেখযোগ্য।
এসব সংগ্রামী ওলামা কেবল রাজনৈতিক সংগঠন, বক্তৃতা ও তৎপরতার দ্বারাই আজাদী আন্দোলন পরিচালতা করেননি, সাহিত্য, সাংবাদিকতার মাধ্যমেও তাদের ক্ষুরদার লেখনী সমানে চালিত হয়েছিল। আজাদী আন্দোলনের নির্ভীক সেনানী বিপ্লবী নেতা মওলানা আলী কর্তৃক কলকাতা থেকে প্রকাশিত ইংরেজী পত্রিকা “দি কমরেড” ও দিল্লী থেকে প্রকাশিত উর্দূ দৈনিক “হামদর্দ” সারা দেশে জেহাদের আগুন জড়িয়ে দিয়েছিলো। মওলানা মনীরুজ্জামান ইসলামাবাদীর সম্পাদনায় প্রকাশিত হতো ‘সুলতান’ ও ‘আল-ইসলাম’। এ ছাড়া তিনি অনেক পুস্তকও এই মর্মে রচনা করেন। মওলানা জাফর আলী খানের সম্পাদনায় প্রকাশিত হতো ‘জমিনদার’ পত্রিকা। মওলানা আবুল কালাম আজাদের পাণ্ডিত্য পূর্ণ বক্তৃতা ও ক্ষুরদার লেখনীর কথা উপমহাদেশের কে না জানে। উর্দু ভাষায় প্রকাশিত ‘আল-হেলাল’ ও ‘আলবালাগ’ পত্রিকায় তাঁর উত্তেজনাপূর্ণ জ্ঞানগর্ভ লেখা মুসলমানদের অন্তরে ঈমানের দীপশিখা ও বৃটিশ সরকার বিরোধী আগুন জ্বালিয়ে দিতো।
বস্তুতঃ ইংরেজদের ব্যাপারে কারও কারও অনুসৃত নীতির ফলে এক শ্রেণীর মুসলমানের মধ্যে ইংরেজ আনুগত্যের যে ভাব সৃষ্টি হয়েছিল, এসব মুসলিম মনীষী ও আজাদী আন্দোলনের বীর সেনানী অনলবর্ষী বক্তৃতা ও লেখা বৃটিশ সরকারের প্রতি সে সব পরাজিত মনোভাবের মুসলমানদের আনুগত্যেরও পরিসমাপ্তি ঘটায়। আর তাই ঐ সকল লোকও মওলানা মুহাম্মদ আলীর অনুসরণে পরবর্তী পর্যায়ে এ আন্দোলনের সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে।
নাদওয়াতুল মুসান্নেফীন
ইসলামী জ্ঞান-গবেষণা ও সংস্কৃতিকে ভারতের বুকে অক্ষুন্ন রাখা এবং তার প্রচার ও প্রসার দানের ক্ষেত্রে দারুল উলূম দেওবন্দের আর এক অবদান হলো দিল্লীর ‘নাদওয়াতুল মুসান্নেফীন’ প্রতিষ্ঠানটি। এর প্রতিষ্ঠাতা হলেন মুফতী আতীকুর রহমান, ফাজেলে দেওবন্দ। এটি ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানে গবেষণা ও বুদ্ধিবৃত্তিক সেবা ক্ষেত্রে উপমহাদেশের একটি অতুলনীয় প্রতিষ্ঠান। এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পণ্ডিতগণ অধিকাংশই দেওবন্দে শিক্ষাপ্রাপ্ত ছিলেন। এ প্রতিষ্ঠান ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ের উপর গবেষণামূলক বহু মূল্যবান গ্রন্থ প্রণয়ন করে উপমহাদেশে ইসলামের বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্বদানে বিরাট অবদান রাখে।
এভাবে কংগ্রেসেরও বহু আগে তেকে অবিভক্ত ভারতের মুসলমানরা ওলামায়ে কেরামের নেতৃত্বে যখন নানান ঘাত-প্রতিঘাত ও বাধাবিপত্তির মাধ্যমে ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে আজাদী আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন তাঁদের সঙ্গে গঠিত হিন্দু প্রভাবিত ভারতীয় কংগ্রেসও এক যোগে আন্দোলনে জড়িত ছিল।
মূলতঃ খেলাফত আন্দোলনের পর কংগ্রেসই ছিল ভারতের আজাদী আন্দোলনের হিন্দু-মুসলমানের ঐক্যবদ্ধ রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেই অহযোগ আন্দোলন পরিচালিত হয়। কিন্তু মুসলমানদের প্রতি হিন্দু নেতাদের বিমাতা-সুলভ মনোভাব, পদে পদে মুসলমানদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা, হিন্দু সংস্কৃতির মধ্যে মুসলমানদেরকে হজম করে নেওয়ার প্রবণতা এবং তাঁদেরকে রাষ্ট্রীয় জীবনে সকল ক্ষেত্রে কোনঠাসা করার দুরভিসন্ধি প্রভৃতি সংকীর্ণতার কারণে অধিকাংশ মুসলিম নেতা হিন্দু মুসলমানের এ ঐক্য সংস্থাটিতে মুসলমানদের টিকে থাকার ব্যাপারে সন্দিহান হন। বাস্তবেও তাই ঘটে, পৌনপুনিক হিন্দু নেতৃত্বের সংকীর্ণ মানসিকতার বহিঃপ্রকাশে মুসলিম নেতৃবৃন্দ ১৯০৬ সালে গঠিত মুসলমানদের জাতীয় প্রতিষ্ঠান মুসলিম লীগে এসে তারা ক্রমে যোগদান করতে থাকেন। তবে তখনও কংগ্রেসে বহু প্রভাবশালী মুসলমান নেতা থেকে যান।
জমিয়তে ওলামায়ে হিন্দ গঠন (১৯১৯ ইং)
সকল আলেম এ যাবত আজাদী সংগ্রামে লিপ্ত ছিলেন, কিন্তু তাঁরা দেখতে পেলেন যে, বর্ণিত দু’টি রাজনৈতিক দলের গঠনতন্ত্র বিশেষ করে কংগ্রেসের গঠনতন্ত্রের মধ্যে তাদের সেই মূল লক্ষ্য শামিল নেই, যা ১৮০৩ খৃঃ শাহ আবদুল আজীজ দেহলভী তাঁর বিপ্লবী ফতওয়ার মাধ্যমে মুসলিম ভারতের জন্যে নির্দেশ করে গিয়েছিলেন আর যে জব্য বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিলেন বালাকোটের বীর শহীদান। তাই অবিভক্ত ভারতের আলেমগণ উপমহাদেশের মুসলমানদের ইসলামী নেতৃত্ব দানের উদ্দেশ্যে ১৯১৯ খৃষ্টাব্দের ২৮শে ডিসেম্বর “জমীয়তে ওলাময়ে হিন্দ’ নামক একটি সর্ব ভারতীয় ওলামা প্রতিষ্ঠান গঠন করেন। উল্লেখিত তারিখে অমৃতশ্বরে মওলানা আবদুল বারী ফিরিঙ্গি মহল্লীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত ওলামা সম্মেলনে জমিয়তে ওলামা-ঈ-হিন্দ গঠিত হয়।
যুক্ত-জাতীয়তা ও বিনা শর্তে কংগ্রেসকে সমর্থনের প্রশ্ন দেখা দেয়ার আগ পর্যন্ত এ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ভারতের প্রায় সকল শ্রেণীর আলেমই জড়িত ছিলেন। উল্লেখ্য যে, এই ওলামা সম্মেলনেই ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার প্রস্তাব গৃহীত হয়। ২৮ শে ডিসেম্বর ১৯১৯ ইং সালেই এক দিকে যেমন অমৃতশ্বরে মওলানা শওকত আলীর সভাপতিত্বে খেলাফত কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হচ্ছিল তেমনি হাকীম আজমল খানের সভাপতিত্বে মুসলিম লীগ এবং পণ্ডিত মতিলাল নেহেুরুর সভাপতিত্বে কংগ্রেস অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়।
আলেমরাই কংগ্রেসের দশ বছর আগে ভারত স্বাধীনের প্রস্তাব নেন
জমিয়তে ওলামায়ে হিন্দ কর্তৃক সর্বপ্রথম ১৯১৯ খৃষ্টাব্দের ২৮শে ডিসেম্বর প্রথম ভারত স্বাধীনতার দাবী তোলার দশ বচর পর ১৯২৯ খৃষ্টাব্দে এ প্রস্তাব গ্রহণ করে। জমিয়তের প্রস্তাবের ১৭ বছর র ১৯৩৬ সালের ১৭ই অক্টোবর মরহুম কায়েদে আযম মুহাম্মদ আল জিন্নাহর সভাপতিত্বে লাক্ষ্ণৌতে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগ অধিবেশনে ভারত স্বাধীনতার প্রস্তাব গৃহীত হয়। অনেকেই ভ্রান্তি ও অজ্ঞতা বশতঃ মনে করে থাকেন যে, কংগ্রেসই বুঝি আজাদীর চূড়ান্ত পর্যায়ে প্রথম ভারত স্বাধীনতার প্রস্তাব নিয়েছিল।
সত্য কথা এই যে, ভারত স্বাধীনতা আন্দোলনের ঘোষণা হয়েছিল মূলতঃ ১৮০৩ খৃঃ শাহ আবদুল আজীজের বিপ্লবী ফতওয়ার আহবান দ্বারা, আর ভারতের সেই স্বাধীনতা প্রস্তাবের রক্তক্ষয়ী দৃশ্য দেখা গেছে ১৮৩১ খৃঃ বালাকোটের ময়দানে, যা আলেমদের একক ত্যাগের বিনিময়েই সংঘটিত হয়েছিল। অতঃপর ওলামায়ে কেরামই ১৯১৯ খৃষ্টাব্দের ২৮ শে ডিসেম্বর ভারতবাসীকে ইংরেজের কবল মুক্ত করার জন্যে আজাদীর প্রথম আনুষ্ঠানিক দাবী তোলেন। এভাবে দেড়মো বছর পূর্বে উপমহাদেশের মুসলিম আলেম সমাজ আজাদী আন্দোরনের যেই বীজ বপন করেছিলেন এবং বুকের তপ্ততাজা খুন দিয়ে যাকে সিক্ত করেছিলেন, সেই বীজই শেষ পর্যন্ত পত্র-পল্লবে সুশোভিত হয়ে ফল দানের উপযোগী হয়।
ভারতের বিজনূর থেকে জমিয়াতে ওলামায়ে হিন্দের মুখপত্র “দৈনিক আলজমিয়ত” এবং অর্ধ সাপ্তাহিক “মদীনা” ওলামা সমাজ ও মুসলমানদের মধ্যে আজাদী আন্দোলন, ইসলামী জেহাদ ও শিক্ষা-সংস্কৃতির প্রেরনা যোগায় এবং এগুলোকে কেন্দ্র করে বহু আলেম সাংবাদিক ও সাহিত্যিকের সৃষ্টি হয়। যেহেতু ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রথম প্রতিবন্ধক ছিলো পরাধীনতা, তাই সর্বপ্রথম পরাধীনতার জিঞ্জির চিহ্ন করাকেই তারা অগ্রাধিকার দেয়। ফলে একই লক্ষ্যের অন্যান্য সংগঠনের সাথেও তারা যোগ দেয়। আলেম সমাজের কেউ কেউ লক্ষ্যের অন্যান্য সংগঠনের সাথেও তারা যোগ দেয়। আলেম সমাজের কেউ কেউ ইংরেজ শাসন উচ্ছেদকামী তাঁদের একক প্রতিষ্ঠান ‘জমিয়তে ওলামায়ে হিন্দ’ ছাড়াও অভিন্ন লক্ষ্যের অভিসারী কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে কাজ করতে থাকেন।
মওলানা আকরাম খাঁ
মুসলিম বাংলার সাংবাদিকতার জনক, রাজনীতিক, সাহিত্যিক ও প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ মওলানা আকরাম খাঁ তখন তাঁর সাপ্তাহিক মোহাম্মদী, মাসিক মোহাম্মদী ও দৈনিক আজাদের মাধ্যমে বাংলার মুসলমানদের মধ্যে ইসলামী শিক্ষা-সংস্কৃতির অনুরাগ সৃষ্টি ছাড়াও তাঁর ক্ষুরধার লেখনী দ্বারা এদেশবাসীকে আজাদী পাগল করে তুলেছিলেন। মূলতঃ এজন্যই বলা হয় যে, মওলানা আকরাম খাঁ ও তাঁর আজাদ পত্রিকা না থাকলে বাংলাদেশ পাকিস্তান হতোনা বরং পশ্চিম বাংলার মতোই কোটি কোটি মুসলমনের এ দেশিটিকে ভারতের গোলামীর জিঞ্জিরে আবদ্ধ থাকতে হতো। আজ যে সকল কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক মওলানা আকরাম খাঁর আদর্শকে বক্র দৃষ্টিতে দেখেন এবং বামপন্থী সংস্কৃতির অনুশীলন দ্বারা ধিকৃত চিন্তায় সুখপান, তাদের অনেকেই আজাদী আন্দোলনের বীর সেনানী এই মওলানা সাংবাদিকের কাছে ঋনী।
উপমহাদেশের বিশেষ করে বাংলার মুসলমানদের সার্বিক কল্যাণ চিন্তা মওলানা আকরাম খাঁর মন-মস্তিষ্ককে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। তাঁর কর্মবহুল জীবনই এর জ্বলন্ত স্বাক্ষী। দেশবাসীর সার্বিক কল্যাণের জন্য আজাদীকে তিনি প্রথম ও প্রধান শর্ত করে দিয়েছিলেন। এজন্যই তিনি পরাধীনতার বন্ধক ছিন্ন করার জন্য অকুতোভয়ে স্বাধীনতা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। শিক্ষা-সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় সকল দিক থেকে অনগ্রসর মুসলমানদের কল্যাণ চিন্তায় ঐ সময় অনেকেই এগিয়ে এসেছেন বটে কিন্তু এজন্য জাতীয় জাগরণ সৃষ্টিতে তাঁর অবদান সর্বোচ্চ। কেননা তাঁর দ্বারাই বাংলার ঘরে ঘরে আজাদী পাগল মানুষের কাছে স্বাধীনতা আন্দোলনের বাণী অধিক পৌঁছেছিল। তাঁর নির্ভীক ভূমিকার ফলে তিনি ইংরেজদের রোষ দৃষ্টির সম্মুখীন হয়ে কারাগারেও নিক্ষিপ্ত হয়েছিলেন। হিন্দু নেতৃবৃন্দ মুসলমানদেরকে “আরবের খেজুর গাছের তল থেকে সম্পূর্ণ উৎখার করার জন্য সংকল্পবদ্ধ ছিলেন। এর অনুকূলে বহু অযুক্তি কুযুক্তির অবতারণা করে তারাই ভারতের একচ্ছত্র মালিক বলে নিজেদের প্রমাণ করার ব্যর্থ চেষ্টা চালাতো। মওলানা আকরাম খাঁ তাঁর পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে বিভিন্ন যুক্তিগ্রাহ্য বক্তব্যে তাদের যাবতীয় কুটযুক্তির জাল ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে দিতেন। মওলানা সাহেব খিলাফত, অসযোগ আন্দোলন সহ এ দেশের প্রতিটি আন্দোলনের সঙ্গেই সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন। মুসলমান প্রজাদের দাবী-দাওয়া আদায়ের জন্য তিনি “বঙ্গ প্রজা সমিতি” গঠন করেছিলেন। হতাশাগ্রস্থ মুসলমানদের মধ্যে আত্মজাগৃতি সৃষ্টি করতে হলে তাদের চিন্তা দুয়ারে কড়া প্রথম নাড়া দিতে হবে, মওলানা আকরাম খাঁ তা হাঁড়ে হাঁড়ে উপলব্ধি করেছিলেন। এজন্যই তিনি লেখনীর অস্ত্রকে অধিক প্রাধান্য দিয়ে প্রথমে ‘সেবক’ ‘আলইসলাহ’ উর্দু দৈনিক ‘জামানা’ পত্রিকা বের করেন। সেবক পত্রিকায় “অগ্রসর! অগ্রসর!!” শিরোনামায় উত্তেজনাপূর্ণ সম্পাদকীয় প্রবন্ধ লেখায় তাকে গ্রেফতার হতে হয় এবং পত্রিকার জামাতন তলব করা হয়। মওলানা আকরাম খাঁ কলম যুদ্ধের সঙ্গে সঙ্গে বক্তৃতা বাগ্মীতায়ো অসাধারণ দক্সতার অধিকারী ছিলেন। তাঁর যুক্তিপূর্ণ অনলবর্ষী বক্তৃতা শ্রোতাদের অন্তরে সহজেই প্রভাব বিস্তার করত। মওলানা আকরাম খাঁও অন্যান্যদের মত সর্ব প্রথম কংগ্রেসেই ছিলেন। তিনি কংগ্রেসের প্রাদেশিক সভাপতি হিসাবে ইংরেজদের বিরুদ্ধে কংগ্রেসের শক্তিকে অধিক বৃদ্ধি করেছিলেন। মূলতঃ ঐ সময়ই হিন্দু নেতাদের মুসলিম স্বার্থ বিরোধী মানসিকতার সঙ্গে তাঁর সঠিক পরিচয় ঘটে। বঙ্গ-ভঙ্গ আন্দোলনের মধ্য দিয়েই মওলানা আকরাম খাঁর রাজনৈতিক জীবনের সূত্রপাত ঘটে।
এক মওলানা নেতাই ভারত স্বাধীনতার প্রস্তাবক ছিলেন-
কায়েদে আযম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর নেতৃত্বে ১৯৩৬ খৃঃ লক্ষ্ণৌয় অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগ অধিবেশনে মওলানা আকরাম খাঁ যোগদান করেছিলেন। মুসলিম লীগের ঐ অধিবেশনেই প্রথম ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার প্রস্তাব গৃহীত হয়। সেই প্রস্তাবও এক মওলানা নেতাই উত্থাপন করেছিলেন। তিনি হলেন মওলানা হাসরাৎ মোহানী। “উল্লেখ্য যে, ইতিপূর্বে কংগ্রেসের এক অধিবেশনে মওলানা হাসরাৎ মোহানী ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার দাবী উত্থাপন করেছিলেন। কিন্তু গান্ধীজীর বিরোধিতায় তাঁর সে দাবী নাকচ হয়ে যায়। কেননা কংগ্রেস তখন পর্যন্ত ডোমিনিয়ন স্টেটাসের দাবী নিয়ে সন্তুষ্ট ছিল। অবশ্য মুসলিম লীগের অধিবেশনে গৃহীত হওয়ার পরবর্তী কালে কংগ্রেসের এক অধিবেশনে ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার দাবী গৃহীত হয়। (অতীত দিনের স্মৃতি পৃঃ ১৭১ দ্রঃ)
মওলানা আকরাম খাঁ মুসলিম লীগে যোগদান করে এর সাংগঠনিক কাজ নিজেকে উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন। ১৯৩৭ সালে বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের তিনি সভাপতি ছিলেন। অপর দিকে তিনি নিখিল ভারত মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ছিলেন। মওলানা আকরাম খাঁ অবিভক্ত ‘পাকিস্তান গণপরিষদ’ ও ‘তালীমাতে ইসলামিয়া বোর্ডের সদস্য ছিলেন। ৬০-এ দশকে আইয়ুব সরকারের আমলে তিনি ইসলামী উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ছিলেন। ১৯৫৪ সালে এই সংগ্রামী নেতা সক্রিয় রাজনীতি হতে দূরে সরে এলেও তাঁর কলমের সংগ্রাম আজাদ পত্রিকা মারফত অব্যাহত থাকে। এই বৃদ্ধলে নেমে নেতৃত্ব দিয়ে তার প্রতিবাদ করেছিলেন। বার্ধক্যের ক্লান্তিকে উপেক্ষা করে সংগ্রামী নেতা আইয়ুব আমলে সংবাদ পত্রের কণ্ঠ রোধের প্রতিবাদে রাস্তায় মিছির সাবেক পাকিস্তানকে ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য তিনি যথেষ্ট চেষ্টা করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এ ব্যথা বুকে নিয়ে তিনি জীবনের চরম অবস্থায় পৌঁছেন। তাঁর রাজনৈতিক প্রতিভা কায়েদে আজমকে মুগ্ধ করেছিল। ১৯৪০ সালে মুসলিম লীগ পাকিস্তান প্রস্তাব নেওয়ার সময় থেকে ১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত আজাদী সংগ্রামের এক নির্ভীক সিপাহসালার ছিলেন মওলানা আকরাম খাঁর তিনি ১৯৩৫ সালের ভারত শাসক সংস্কার আইন অনুযায়ী ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে ‘বঙ্গীয় ব্যবস্থা পরিষদের’ সদস্য পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন। এ সময় তিনি মুসলিম স্বার্থ রক্ষায় বিশেষ চেষ্টা করেন।
“বন্দে মাতরম” ও মওলানা আকরাম খাঁ
মুসলিম জাতীয়তা বোধের বিকাশ দানে সংস্কৃতিক ক্ষেত্রে মওলানা আকরাম খাঁ যেই বিরাট কাজ করেছেন তার একটি মাত্র দৃষ্টান্ত তেকে তা সহজে অনুমেয়। জাতীয়তাবোধ তীব্রতর হওয়ার মধ্য দিয়েই মুসলমানদের মধ্যে স্বতন্ত্র মুসলিম রাষ্ট্রের দাবী জোরদার হয়েছিল। অসযোহ ও খিলাফত আন্দোলন, ব্যাঙ্গল প্যাক্ট ইত্যাদির ভিতর দিয়ে মুসলমানদের ব্যাপারে হিন্দু নেতাদের বিরূপ মনোভাবের দরুণ মুসলমানের জাতীয়তাবোধ অনেক বৃদ্ধি পায়। তবে তা অধিক বৃদ্ধি পেয়েছিল “বন্দে মাতরম” সঙ্গীত ও “শ্রপদ্ম” প্রতীককে কেন্দ্র করে। “কংগ্রেস রাজনীতির ক্ষেত্রে “বন্দে মাতরম” কে জাতীয় সংগীত হিসাবে গ্রহণ করেছিল। এর রচয়িতা ছিল বিখ্যাত মুসলিম বিদ্বেষী লেখক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যয়। মুসলিম বিদ্বেষে পূর্ণ তাঁর গ্রন্থ “আনন্দ মঠে” এ সঙ্গীতটি রয়েছে। মুসলমানদের বিরুদ্ধে অভিযানকারী একদল সন্তানের মুখ দিয়ে এই সঙ্গীতটি গাওয়ানো হয়েছিল। এছাড়া এটি দুর্গাদেবীর প্রশস্তি হিসাবে রচিত হয়েছিল। লা-শরীক-আল্লায় বিশ্বাসী কোন মুসলমান একে কিছুতেই জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে মেনে নিতে পারেনা। দলমত নির্বিশেষে সকল মুসলমান এর বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলল।
কংগ্রেসীরা তবুও একে জাতীয় সঙ্গীত হিসেবেই রাখতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ রইলেন। কিন্তু মুসলমানদের প্রতিবাদ তীভ্রতর হয়ে উঠলে কবি রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর তা মীমাংসায় এগিয়ে আসেন। তিনি বল্লেন, প্রথম চার লানিকে দুর্গার বন্দনা হিসেবে গ্রহণ না করে দেশ মাতৃকার বন্দনা হিসাবে গ্রহণ করা চলে এবং ঐটুকু জাতীয় সঙ্গীতের মর্যাদা পেতে পারে। রবিন্দ্রনাথের এ পরামর্শ সংগ্রেস কর্তৃপক্ষ মেনে নিলেও মুসলমানরা মানতে রাজী হলেন না। তারা জানালেন, বন্দনা ও পূজা একমাত্র আল্লাহ ছাড়া মুসলমাদনরা আর কারুর করতে পারে না। তাছাড়া এর রচনার পটভূমি ও এর সঙ্গে মুসলিম বিদ্বেষের যে যোগ রয়েছে, মুসলমানরা তা ভুলে যেতে পারে না। এটা হিন্দুদের জাতীয় সঙ্গীত হতে পারলেও মুসলমানদের কিছুতেই হতে পারে না। -অতীত দিনের স্মৃতি
“বন্দে মাতরম” ও “শীপদ্ম” কে কেন্দ্র করে মুসলিম ছাত্রদের মধ্যে আন্দোলন প্রবল আকার ধারণ করে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় শ্রীপদ্ম অঙ্কিত মনোগ্রামকে পাঠ্যপুস্তক ও কাগজ পত্রে প্রতীক চিহ্ন হিসাবে ব্যবহার শুরু করে। মওলানা আকরাম খাঁর পত্রিকা মোহাম্মদীতে শ্রীপদ্ম মনোগ্রাম ব্যবহারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সূচক প্রবন্ধাবলী একের পর এক প্রকামিত হয়। মুসলমান ছাত্রেরা যুক্তি দিত, ‘শ্রী’ হিন্দুদের বিদ্যার অধিষ্ঠাত্রী দেবী “স্বরস্বতী” এবং ‘পদ্ম’কে তার আসন হিসাবে গ্রহণ করা হয়েছে। এই পৌত্তলিক ভাবধারার মনোগ্রাম মুসলমানের প্রতীক হতে পারে না। মওলানা আকরাম খাঁ ‘বন্দে মাতরম’ ও শ্রীপদ্মের সপক্ষে আনীত যুক্তিসমূহ সাপ্তাহিক ও মাসিক মোহাম্মদীতে তাঁর ক্ষুরধার যুক্তি দ্বারা খণ্ডন করতেন। এ আন্দোলনে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোগ্রামে ‘শ্রী’ বাদ হয়ে শুধু ‘পদ্ম’ থাকে। পদ্মকে বাংলাদেশের একটি ফুল হিসাবে ব্যাখ্যা দেয়া হয়। এতে মুসলমান ছাত্ররা অনেকটা দমে যায়। ‘শ্রী পদ্ম’ ও ‘বন্দে মাতরমে’র আন্দোলনের ফলে মুসলমানরা দীর্ঘ দিন থেকে এ দেশে মুসলিম নামের পূর্বে ব্যবহৃত ‘শ্রী’ অক্ষর পরিত্যক্ত হয়। তার বদলে মুসলমানদের নামের পূর্বে ‘বজান’ ও ‘মৌলভী’ ব্যবহারও সম্ভবতঃ তখন থেকে বৃদ্ধি পায়। শুধু তাই নয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও অনেক মুসলিম বিরোধী কার্যকলাপ তথা সাংস্কৃতিক দিক থেকে মুসলিম চেতনাকে বিনষ্ট করার সকল ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে মওলানা আকরাম খাঁ রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। অবিভক্ত পাকিস্তানকে একটি জনকল্যানমূলক খাঁটি ইসলামী রাষ্ট্র রূপে প্রতিষ্ঠাই তাঁর স্বপ্ন ছিল। এই জন্য পূর্ব থেকেই তিনি সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ইসলামী ও আজাদী আন্দোলনকে তাঁর লক্ষ্য বিন্দুতে পৌঁছাতে উঠে পড়ে লেগেছিলেন।
বলাবাহুল্য, সাহিত্য ও সাংবাদিকতার প্রতি অনাসক্ত এদেশের আলেম সমাজ ও সাধারণ শিক্ষিতদের মধ্যেও সাংবাদিকতার প্রেরণা মওলানা আকরাম খাঁ, মওলানা মুনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, মুন্সী মেহেরুল্লাহ, ফুরফুরার পীর সাহেব, মওলানা রুহুল আমীন প্রমুখ আলেমরাই অধিক সৃষ্টি করেন। যা হোক, এভাবে যখন আজাদীর ত্রিমুখী চৌমুখী আন্দোলন চলতে থাকলো, তখন ইংরেজ সরকার ভারতবাসীকে আজাদী দানের অভিপ্রায় প্রকাশ করতে বাধ্য হয়।
মুসলিম লীগ ১৯৪০ সালে শেরেবাংলা মওলভী এ,কে, ফজলুল হকের প্রস্তাবনায় মুসলমানদের জন্যে আলাদা রাষ্ট্রের দাবী জানিয়ে ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব গ্রহণ করেন। ইংরেজদের ঐকান্তিক ইচ্ছা ছিল যে, তাদের মনের মতো ব্যক্তি ধর্মনিরপেক্ষ ভোগবাদী ব্যক্তিদের হাতেই ভারতের শাসনভার অর্পণ করে তারা বিদায় নিবেন। আর এ জন্য কংগ্রেসের প্রতিনিধিত্বকে তারা মেনে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু কায়েদে আযম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা ও দ্বিজাতিত্বের বলিষ্ঠ যুক্তি-প্রমানের কাছে ইংরেজ সরকারের এই আশা পূরণ হয়নি। তিনি সমগ্র ভারতের তওহীদী জনতাকে ইসলামের নামে ডাক দেন এবং মুসলমানদেরকে স্বতন্ত্র ইসলামী রাষ্ট্র পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা আন্দোলনে মুসলিম নামে ডাক দেন এবং মুসলমানদেরকে স্বতন্ত্র ইসলামী রাষ্ট্র পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা আন্দোলনে মুসলিম লীগের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করার উদাত্ত আহবান জানান। উল্লেখ্য যে, প্রভাবশালী কংগ্রেসী নেতাদের সামনে ইসলাম ও আদুনিক দৃষ্টিকোণ থেকে দ্বিজাতিত্বের বলিষ্ঠ যুক্তি-প্রমাণ সমূহ তখন জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা প্রখ্যাত ইসলাশী চিন্তাবিদ মওলানা সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী মুসলিম লীগকে পরিবেশন করেন। পরে যথাস্থানে তা বর্ণিত হবে।
দেওবন্দ আন্দোলনের কর্মীবৃন্দ দু’ই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়লেন
দেওবন্দ আন্দোলনের কর্মীবৃন্দের নেতৃত্ব এ যাবত সর্বভারতীয় একক ওলামা সংগঠন জমিয়তে ওলামায়ে হিন্দ শাহ ওয়ালিউল্লাহর পরিকল্পিত ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পূর্বশর্ত হিসাবে আজাদীর জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছিলেন। স্বাধীনতা আন্দোলন বিশেষ এক স্তরে পৌছার পর পরবর্তী পর্যায় উপমহাদেশের আলেমদের মধ্যে বিনা শর্তে কংগ্রেসে যোগদান ও ভারত বিভাগ প্রশ্নে দ্বিমতের সৃষ্টি হয়। জমিয়তে ওলামায়ে হিন্দ শেষ পর্যন্ত মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশগুরোর স্বায়ত্তশাসনের প্রতিশ্রুতিতে অখন্ড ভারতের সমর্থক কংগ্রেসের সংগে কাজ করে যেতে থাকে।
জামিয়তে ওলাময়ে হিন্দের যুক্তি ছিলো, যেই মুসলমান জাতি সারা ভারত শাসন করেছে, তারা আজ কেন ভারতের দুই অংশে দু’টি ভূখণ্ড নিয়ে সন্তুষ্ট হবে? কিন্তু হিন্দু মানসিকতায় অভিজ্ঞ দূরদর্শী কায়েদে আযম শাহ ওয়ালিউল্লাহর চিন্তায় উদ্ধুদ্ধ বিশ্বকমি মরহুম আল্লামা ইকবালের স্বপ্ন অনুযায়ী উপমহাদেশের মুসলমানদের নিকট পেশ করেন। তাতে এই অঞ্চলের মুসলমান এবার চিন্তিত হয়ে পড়ল। কারণ এক দিকে খণ্ড ভারতের স্বপক্ষেও আলেম সংগঠন ও অনেক নামকরা মুসলমান যেমন মওলানা আজাদ প্রমুখ রয়েছেন, অপরদিকে তাদের সামনে অখণ্ড ভারত তথা পাকিস্তানের ইসলামী দাবীর আকর্ষণ।
জনগণ আলেমদের মতামতের প্রতীক্ষায় ছিল
জমিয়তে ওলামায়ে হিন্দের সঙ্গে জড়িত আজাদী আন্দোলনের কতিপয় প্রখ্যাত জনপ্রিয় সংগ্রামী আলেম মুসলিম লীগকে সমর্থন না করায় বহু মুসলমান দ্বিধাদ্বন্দ্বে পতিত হয়ে পড়ে। আর এ সুযোগে ইংরেজ সরকারও কংগ্রেসের হাতে ক্ষমাত তুলে দেবার জন্যে চিন্তা-ভাবনা করছে। আলেমদের প্রতি জনগণের প্রতীক্ষার কারণ ছির এই যে, মুসলিম স্বার্থের খণ্ড ভারতের প্রবক্ত কায়েদে আযম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ স্বতন্ত্র মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা বললেও লীগ বিরোধীদের প্রচারণায় সাধারণ মানুষ বিভক্ত ছিল। যেমন মুসলিম লীগের দ্বারা ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়া সম্ভব নয়, লীগের নেতা “পাশ্চাত্য ধাঁচের জেন্টেলম্যান” আবার তিনি “শিয়া” –এসব বলেও এ দেশের হানাফী মতাবলম্বী ধর্মপ্রান মুসলমানদের বিভ্রান্ত করা হচ্ছিল। সে সময় এদেশের সাধারণ মুসলিম জনসাধারণ যাগের নেতৃত্বে অধিক উঠাবসা করে, সেই আলেম সমাজের মতামতের অপেক্ষায় থাকে।
ওলামায়ে কেরাম এগিয়ে এলেন
কংগ্রেস যেমন ভারতীয় জমিয়তে ওলামায়ে হিন্দের পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়ায় তা যুক্ত-জাতীয়তা ও অখণ্ড ভারতের যুক্তির পক্ষে মুসলমানদের সমর্থন লাভে সচেষ্ট ছিল, তেমনি মুসলিম লীগ ও পাকিস্তান দাবীর সপক্ষে আরেমদের সমর্থন কামনা করেও তখন পাকিস্তান সমর্থক আলেমগণ খণ্ড ভারতের যৌক্তিকতা প্রমাণ ও ইসলামী রাষ্ট্র পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দাবীকে জোরদার করে তোলার উদ্দেশ্যে এগিয়ে আসেন এবং পাকিস্তান সমর্থক আরেকটি ওলামা সংগঠন কায়েমের তীব্র প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন।
কলকাতায় জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম গঠন (১৯৪৫ ইং)
কায়েদে আযম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ, মওলানা শাব্বির আহমদ ওসমানী, মওলানা আকরাম খাঁ, মওলানা আবদুল্লাহিল বাকী, মওলানা আবদুল্লাহিল কাফী প্রমুখ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ যখন মুসলমানদের ব্যাপারে কংগ্রেস নেতৃবৃন্দের সংকীর্ণ মনোভাবের প্রেক্ষিতে ভারত বিভক্তির দ্বারা মুসলমানদের জন্যে একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের দাবী তুললেন, অপরদিকে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে বিভোর মওলানা মওদূদীও এর সমর্থনে তাঁর ক্ষুরধার যুক্তি ও বলিষ্ঠ লেখনী চালনা করলেন, তখন পাকিস্তানের সমর্থনে উপমহাদেশের সিংহভাগ ওলামায়ে কেরাম ও পীর-মাশায়েখ এগিয়ে আসেন। বিশেষ করে শুরু থেকে হাকীমুল উম্মত মওলানা আশরাফ আলী থানবী জিন্নাহ সাহেবের দাবীর প্রতি সমর্থন জানিয়ে আসেন। অন্যান্য খ্যাতনামা ইসলামী ব্যক্তিত্বের মধ্যে মওলানা জাফর আহমদ উসমানী, মওলানা মুফতী মুহাম্মদ শফী, মওলানা ইহশামুল হক থানভী, মওলানা সাইয়েদ সুলায়মান নদভী, মওলানা জাফর আহমদ আনছারী, শর্ষিণার বড়পীর মওলানা নেসারুদ্দীন আহমদ সাহেব, ফুরফুরার পীর মওলানা আবদুল হাই ছিদ্দিকী সাহেব, মওলানা আতহার আলী সাহেব, মওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী, পীর বাদশা মিঞা, মওলানা মুফতী দ্বীন মুহাম্মদ খাঁ, মওলানা আবদুল হামীদ খান ভাসানী, মওলানা আবদুল আলী ফরিদপুরী, মওলানা সাইয়েদ মোসলেহুদ্দীন, মওলানা বজলুর রহমান দয়াপুরী প্রমুখ ওলামায়ে কেরাম এগিয়ে আসেন।
এভাবে মুসলিম লীগের সঙ্গে পাকিস্তানের জন্যে যারা কাজ করে আসেন বা যারা এতদিন এর বাইরে ছিলেন, সে সকল ওলামায়ে কেরামের উদ্যোগে ১৯৪৫ সালে কলকাতা মোহাম্মদ আলী পার্কে পাকিস্তান সমর্থক সর্বভারতীয় আলেমদের এক ঐতিহাসিক ওলামা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে যুক্ত ভারতের সমর্থকও বহু আলেম উপস্থিত ছিলেন। এ সম্মেলতে সর্বসম্মতিক্রমে দেওবন্দ দারুল উলুমের সাবেক অধ্যক্ষ প্রখ্যাত আলেম মওলানা শাব্বীর আহমদ উসমানীকে এই জমিয়তের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। সে দিনই সর্বভারতীয় ওলামা প্রতিষ্ঠান জমিয়তে ওলামায়ে হিন্দ দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যায়। এক দল দারুল উলুম দেওবন্দের অধ্যক্ষ শায়খুল হাদীস হযরত মওলানা হোসাইন আহমদ মাদানীর নেতৃত্বে ‘জমিয়দে ওলামায়ে হিন্দ’ নামে ভারতে আর অপর দল মওলানা শাব্বীর আহমদ উসমানীর নেতৃত্বে ‘জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামের’ নামে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্যে আজাদী আন্দোলন চালি যান।
মওলানা শাব্বীর আহমদ উসমানী
পাক-ভারত উপমহাদেশে ইসলামী রেনেসাঁর উদগাতা মহামনিষী শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভীল চিন্তাধারাকে কেন্দ্র করে একদিন যে ইসলামী আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল, সেই আন্দোলনেরই একিট অংশ হিসাবে পরে দারুল উলুম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠিত হয় যা পূর্বে বলা হয়েছে। সে থেকে দারুল উলুম দেওবন্দ আজ পর্যন্ত এই উপমহাদেশে ইসলামী শিক্ষা, সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের প্রসার দান ও উৎকর্ষ সাধনে কাজ করে আসছে। এ প্রতিষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষক ও প্রতিষ্ঠাতা সকলেই ছিলেন সেই ওয়ালিউল্লাহ আন্দোলনের সংগ্রামী কর্মী। তাঁদের সকলেই ছিলেন ১৮৫৭ সালে মহাবিপ্লবের সঙ্গে জড়িত। তাই দেখা যায়, এ প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষালাভকারী একেকজন ছাত্র ছিলেন সংগ্রামী এবং আজাদী আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী ত্যাগী বীর পুরুষ। এই আন্দোলনের ঘাঁটি থেকে যে সমস্ত বীর মোজাহিদ বের হয়েছেন এবং পরে দারুল উলুমকে কেন্দ্র করে সারা অবিভক্ত ভারতে আজাদী ও ইসলামী আন্দোলনকে নানাভাবে জোরদার করে তুলেছিলেন, তাদের মধ্যে মওলানা শাব্বীর আহমদ ওসমানী একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র। মওলানা শাব্বীর আহমদ ওসমানী বিশ্ববিখ্যাত এই ইসলামী শিক্ষা ও আন্দোলনের কেন্দ্র দারুল উলুম দেওবন্দের অধ্যক্ষ ছিলেন। ভারত বিভাগ প্রশ্নে যখন সর্বভারতীয় ওলামা প্রতিষ্ঠান জমিয়তে ওলামায়ে হিন্দ দুই অংশে বিভক্ত হয়ে পড়ে, তখন তিনি এক অংশের নেতৃত্বে দেন। জমিয়তের এই অংশটির নাম ছিলো জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম। এভাবে শাহ ওয়ালিউল্লাহ আন্দোলনের কর্মীগণ দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে এক অংশ পাকিস্তানে কাজ করতে থাকে আর অপর অংশ হিন্দুস্তানে থেকে যায়।
মওলানা শাব্বীর আহমদ ওসমানীর বৈশিষ্ট্য হলো এই যে, উপমহাদেশে তাঁর সমসাময়িক শ্রেষ্ঠ আলেমদের মধ্যে কেউ কেউ যেখানে দ্বিজাতিত্বের ভিত্তিতে ভারত বিভাগের প্রশ্নে একমত হতে পারেননি, সেক্ষেত্রে তিনি হিন্দু মানসিকতার অভিজ্ঞতার আলোকে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষার উদ্দেশ্যে দেশ বিভাগের জন্যে উঠেপড়ে লাগেন। পাকিস্তানের জন্যে তাঁর আন্দোলন ও সংগ্রামকে একশ্রেণীর ওলামাবিদ্বেষী কুচক্রী লেখক যতই ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করুক না কেন, তা এ দেশের ইতিহাসে চিরদিন স্বর্ণাক্ষরে লিখিত হয়ে থাকবে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় মরহুম মওলানা শাব্বীর আহমদ ওসমানীর যে বিরাট অবদান রয়েছে, তা কারো অস্বীকার করার উপায় নেই। মূলতঃ তিনি মুসলমানদের স্বতন্ত্র আবাসভূমির আন্দোলনের কায়েদে আযমের পাশাপাশি থেকে কাজ করেছেন। নিকট অতীতের একথা কারো অবিদিত থাকার কথা নয় যে, কায়েদে আযম ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে অবিভক্ত পাকিস্তান দাবীকে যতই জোরদার করতে চেয়েছেন এবং বিভিন্ন সভা-সমিতিকে যতই ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার-প্রতিশ্রুতি দিচ্ছিলেন কিন্তু আলেমদের সক্রিয় অংশগ্রহণের আগে তা ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেনি। কায়েদে আজমকে ‘শিয়া’, “তাঁর দ্বারা ইসলামী রাষ্ট্র হওয়া সম্ভব নয়” –এসব বলে যখন জমিয়তে ওলামায়ে হিন্দের প্রভাবশালী ব্যক্তিগণ বিরূপ মন্তব্য করছিলেন, তখন মওলানা শাব্বীর আহমদ ওসমানী জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামের “প্ল্যাটফরম” থেকে পাকিস্তানের শ্লোগান বুলন্দ করার আগ পর্যন্ত এ দেশের মুসলমানরা ব্যাপকবাবে পাকিস্তান আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েনি। উক্ত প্রচারণার প্রেক্ষিতে উপমহাদেশের ধর্মপ্রাণ হানাফী মতাবলম্বী মুসলমানদের এরূপ ইতস্তত করাটা অস্বাভাবিক কিছু ছিল না। দীর্ঘ দিনের সাহচর্যে হিন্দু নেতাদের মানসিকতা সম্পর্কে পরিচিত স্বাধীন ও মুক্ত চিন্তার অধিকারী মওলানা শাব্বীর আহমদ ওসমানী অনুধাবন করতে পারছিলেন যে, ইসলাম ও মুসলমানদের স্বার্থে ভারতে আলাদা একটি ভূখণ্ড লাভ ছাড়া কোন গত্যন্তর নেই। তিনি এই অনুভূতিতেই এক জাতিত্বের প্রশ্নে কংগ্রস সমর্থক জমিয়তে ওলামায়ে হিন্দ থেকে বের হয়ে আসেন এবং দ্বি-জাতিত্বের ভিত্তিতে আলাদা রাষ্ট্রের দাবীকে জোরদার করার জন্যে সক্রিয় নেতৃত্ব দান করে। কলকাতার মুহাম্মদ আলী পার্কে ১৯৪৫ সালে জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম গঠিত হয়। পাকিস্তান আন্দোলনে জনমত গঠনের জন্যে তিনি লেখনী ধারণ করেন এবং দেশগোড়া ঝটিকা সফর করে বক্তৃতা-বিবৃতি দেয়া শুরু করেন। জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম অবিভক্ত পাকিস্তান আন্দোলনকে জোরদার করার জন্য মুসলিম লীগের সমর্থনে কাজ করে যেতে থাকে। বস্তুতঃ জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামের উদাত্ত আহবানের পর থেকেই উপমহাদেশের মুসলমানরা দ্বিধাহীন চিত্তে কায়েদে আযমের নেতৃত্বে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে যোগ দিয়ে “লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান” ধ্বনিতে আকাশ-বাতাস-জনপদ মুখরিত করে তোলে।
১৩০৫ হিজরী ১০ই মহররম তারিখে বিজনুরের সম্ভ্রান্ত ওসমানী পরিবারে মওলানা শাব্বীর আহমদ ওসমানীর জন্ম। তাঁর পিতা মওলানা ফজলুর রহমান ওসমানী মাদ্রাজের ডেপুটি ইন্সপেক্টর ছিলেন। বংশ পরিচয়ের দিক থেকে তিনি তৃতীয় খলীফা হযরত ওসমানের (রাঃ) বংশধর। ১৩১২ হিঃ সালে মুহাম্মদ আযীম নামক জনৈক শিক্ষকের নিটক শাব্বীর আহমদ ওসমানী দ্বিনী শিক্ষার প্রাথমিক সবক গ্রহণ করেন। তাঁর অংক ও উর্দু ভাষায় প্রথম পাঠ মুনশী মনযুর আহমদ দেওবন্দীর নিকট শুরু হয়। তিনি মুফতী শফী সাহেবের পিতা মুহাম্মদ ইয়াসীন সাহেবের নিকট ফারসী ভাষা শিক্ষালাভ করেন। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্তির পর ১৩১৯ হিঃ সালে মুসলিম জাহানের অন্যদত প্রধান দ্বীনি শিক্ষার প্রাণকেন্দ্র দারুল উলুম দেওবন্দে অধ্যয়ন করতে থাকেন। মওলানা ওসমানী ১৩২৫ হিঃ মোতাবেক ১৯০৮ খ্রীঃ ‘দাওরা-এ হাদীস’ পরীক্ষায় দেওবন্দে প্রথম স্থান অধিকার করেন এবং সেখানেই তাঁর শিক্ষা জীবনের ইতি ঘটে। তাঁর খ্যাতনামা শিক্ষকদের মধ্যে উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম নির্যাতিত সংগ্রামী নিতা শায়খুল হিন্দ মওলানা মাহমুদুল হাসানের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মওলানা মাহমুদুল হাসান ইংরেজ সরকার কর্তৃক দীর্ঘ পাঁচ বছর যাবত মাল্টা দ্বীপে অন্তরীণাবন্ধ ছিলেন। ১৩২৫ হিজরীতে মওলানা ওসমানীর পিতৃবিয়োগ ঘটে। তাঁর পিতা দারুল উলুম দেওবন্দের প্রতিষ্ঠাতা ত্যাগী পুরুষ মওলানা কাসেম নানতুবীর বিশিষ্ট বন্ধু ছিলেন। ১৩২৮ হিজরীতে মওলানা ওসমানী প্রথম পবিত্র হজব্রত পালন উদ্দেশ্যে মক্কা শরীফ গমন করেন। জনাব ওসমানী ছাত্র-জীবনেই নানাভাবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। শিক্ষাজীবন সমাপ্তির পর ১৩২৬ হিজরীতে দিল্লীর ফতেহপুরস্থ এক আরবী মাদ্রাসায় প্রধান শিক্ষক হিসাবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।
১৩২৮ হিজরী সাল মোতাকেব ১৯১১ খৃঃ দারুল উলুম দেওবন্দের ব্যব্স্থাপনা কমিটি তাঁকে এ প্রতিষ্ঠানে অধ্যাপক হিসেবে কাজ করার জন্য অনুরোধ জানান। তিনি ১৯১১ খৃঃ থেকে ১৯২৮ খৃঃ পর্যন্ত সিনিয়র অধ্যাপন হিসাবে তথায় কাজ করেন। শিক্ষকতার বিনিময়ে মওলানা ওসমানী কোন অর্থ গ্রহণ করতেন না। ঠিক ঐ সময় শায়খুল হিন্দ মওলানা মাহমুদুল হাসানের নির্দেশক্রমে মওলানা ওবায়দুল্লাহ সিন্ধী কর্তৃক ‘জমিয়তুল আনসার’ ও এর বিপ্লবী সংস্থা ‘আজাদ হিন্দ মিশন’ গঠিত হয়। মুসলমানদের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা সৃষ্টি ও ইসলামী ভাবধারার জাগৃতির মাধ্যমে ভারতে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাই ছিল এ সংস্থার আসল লক্ষ্য। ১৯১১ খৃষ্টাব্দে মওলানা ওসমানী বলকানে রাজনৈতিক সফরে গিয়েছিলেন। তিনি শায়খুল হিন্দের আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন এবং উক্ত সংস্থা কর্তৃক আয়োজিত বিরাট বিরাট অধিবেশনে মূল্যবান প্রবন্ধাদি পাঠ করতেন। তাঁর জ্ঞানগর্ভ প্রবন্ধ শুনে মওলানা শিবলী নোমানীর মতো চিন্তাবিদগণ ভূয়ষী প্রশংসা করেছেন। মওলানা আশারাফ আলী থানবী (রঃ) ‘ইসলাম’ শীর্ষক ওসমানীর একখানা প্রবন্ধ শুনে প্রকাশ্য সভায় তাঁর প্রশংসা করেন।
খেলাফত আন্দোলন
স্বাধীনতা আন্দোলনে দেশের রাজনীতিতে মওলনা শাব্বীর আহমদ ওসমানী প্রত্যক্ষ পরোক্ষভাবে সকল সময় জড়িত ছিলেন। ১৯১৪ খৃঃ থেকে ১৯১৮ খৃঃ পর্যন্ত প্রথম বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ের পর খেলাফত আন্দোলন শুরু হয়। খেলাফত আন্দোলনে মওলানা মাহমুদুল হাসান বিদেশী পণ্য বর্জন আন্দোলনে গ্রেফতার হয়ে মাল্টা দ্বীপে পাঁচ বৎসর অন্তরীণাবন্ধ থাকার পর মুক্তি পেলে তিনি পরবর্তী সভাসমিতিতে তাঁর সঙ্গে থাকতেন। সাহারনপুর, গাজীপুর, লক্ষ্ণৌ, কানপুর, বেনারস, আলীগড় প্রভৃতি স্থানে তিনি শায়খুল হিন্দ মওলানা মাহমুদুল হাসানের সঙ্গে আজাদী আন্দোলনে শরীক ছিলেন।
জমীয়তে ওলামায়ে হিন্দ
খেলাফত আন্দোলনকালেই ১৯১৯ সালের ২৮ শে ডিসেম্বর জমিয়তে ওলামায়ে হিন্দ প্রতিষ্ঠিত হয়। মওলানা শাব্বীর আহমদ ওসমানী ১৯১৯ সাল থেকে ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত জমিয়তে ওলামায়ে হিন্দের কর্ম-পরিষদের সদস্য ছিলেন। ঐ সময়ে তিনি ভারতীয় মুসলমানদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যে বিরাট কাজ করেছেন। ১৯২০ সালের ১৯, ২০ ও ২১শে ডিসেম্বর দিল্লীতে শায়খুল হিন্দের এক বিরাট কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়। ঐ কনফারেন্সে তিনি ‘অসহযোগ’ শিরোনামে লিখিত এক ভাষণ পাঠ করেন। তাঁর উক্ত মূল্যবান ভাষণ উপমহাদেশীয় শ্রেষ্ঠ আলেমদের মধ্যে তাঁকে বিশেষ মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করে। ঐ ভাষণের মধ্য দিয়েই তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও ইসলাম সম্পর্কে গভীর পাণ্ডিত্যের অভিব্যক্তি ঘটেছিল।
হিন্দু মুসলিম ঐক্য
খেলাফত আন্দোলনের ফলে হিন্দুদের মধ্যেও সাহসের সঞ্চার হলো। তারাও হাত-পা মেলতে শুরু করলো। জমিয়তে ওলমায়ে হিন্দের সভা-সমিতির পাশাপাশি একই শহরে কংগ্রেসের বার্ষিক সম্মেলনও অনুষ্ঠিত হতে থাকে। তখন অসহযোগ আন্দোলন চলছিলো পুরোদমে। এই সঙ্গে হিন্দু মুসলমান ঐক্যেরও প্রচেষ্টা চলতে থাকে। হিন্দু নেতৃবৃন্দ ও মুসলমানরা পরস্পরের সভায় বক্তৃতা দিতেন। কংগ্রেসীদের মুখে তখন ‘হিন্দু মুসলমান ভাই ভাই’ –এর শ্লোগান। মওলানা ওসমানী হিন্দু মুসলিম যুক্ত অধিবেশনে মুসলমানদের ন্যায্যা অধিকারের প্রশ্নে জোরালো বক্তৃতা দিতেন। রাজনীতির ক্ষেত্রে মুসলমানদের যাতে হিন্দুদের পশ্চাতে পড়ে না থাকতে হয়, সে ব্যাপারে এবং গুর জবেহ বন্ধ কিংবা মুসলমান মেয়েদের কপালে তিলক-ফোঁটা ব্যবহার করা প্রভৃতি হিন্দুয়ানী রীতির প্রতি শৈথিল্যের আবদারকে তিনি কিছুতেই বরদাশত করতেন না।
শর্তহীন কংগ্রেসে শরীক হবার বিরোধিতা
দিল্লীতে যে হিন্দু-মুসলিম সম্মিলিত অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, তাতে মিঃ গান্ধী, মতিলাল নেহেরু, মওলানা আবুল কালাম আযাদ ও অন্যান্য কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। উক্ত অধিবেশনে এ বিষয়টি আলোচনাধীন ছিল যে, মুসলমানদের কি বিনাশর্তে কংগ্রেসে শরীক হওয়া উচিত, না তাদের অধিকার মেনে নেয়ার শর্তে হিন্দুদের সঙ্গে সহযোগিতা করা? মুসলমানদের একটি দল বিনাশর্তে কংগ্রেসে যোগদানের সপক্ষে মত প্রকাশ করে। কিন্তু দূরদর্শী মওলানা ওসমানী কংগ্রেসের সুচতুর হিন্দু নেতাদের দলে এভাবে বিনাশর্তে যোগদানকে কিছুতেই মানতে রাজী হননি। সভাপিতরি অনুমতিক্রমে তিনি মুসলমানদের স্বার্থ সংরক্ষণের শর্ত ব্যতিরেকে কংগ্রেসে যোগদানের বিরুদ্ধে জ্বালাময়ী ভাষায় বক্তৃতা দান করেন। তাতে মিঃ গান্ধী, নেহেরু বিব্রত বোধ করতে থাকলেও তিনি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলে দিয়েছিলেন যে, “আমার এই সহজ ও সরল ভাষণের মধ্য দিয়ে সেসব বাস্তব সত্যকেই আমি তুলে ধরতে চাই, যাতে মুসলিম স্বার্থকে বানচাল করার সকল প্রকার ষড়যন্ত্রজাল ছিন্নভিন্ন হয়ে যেতে বাধ্য”। বস্তুতঃ তাঁর উক্ত ভাষণই পরবর্তীকালে ‘জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামের’ ভিত্তি স্থাপন করে এবং কংগ্রেস সমর্থক জমিয়তে ওলামায়ে হিন্দ থেকে সম্পর্কচ্যুতির কারণ হয়।
দিল্লীর উক্ত সম্মিলিত অধিবেশনের পর উক্ত শহরেই আলাদাভাবে মুসলমানদের আর একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। তাতে মওলানা উসমানী যুক্তিপূর্ণ ভাষণের দ্বারা মুসলমানদের মধ্যে নতুন উদ্দীপনার সঞ্চার হয়। কেননা ইতিপূর্বে হিন্দু-মুসলমান সহযোগিতার প্রশ্নে সাধারণ মুসলমান ও আলেম সমাজ যে দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মধ্যে ছিলেন, এখন থেকে তাঁরা নির্দিষ্ট লক্ষ্যে অগ্রসর হবার পথ খুঁজে পান। বস্তুতঃ দিল্লী অধিবেশনের পর থেকৈই তিনি কংগ্রেস সমর্থক জমিয়তে ওলাময়ে হিন্দ বর্জন করে খণ্ড ভারতের সমর্থক আলেমদের আলাদা একটি সংস্থা গঠনের বিষয় চিন্তা করেন। অবশ্য তখন পর্যণ্ত এর কোনো পরিকল্পনা তিনি প্রকাশ করেননি। তাঁর তখনকার বক্তৃতার সুরই ছিল এই যে, “মুসলমানরা একটি এতিহ্যপূর্ণ আলাদা জাতি হিসাবে হিন্দু সম্প্রদায়ের সঙ্গে যুক্ত থেকে কোনোদিনই নিজ আদর্শ নিয়ে স্বাধীনভাবে চলতে পারবেনা”। ভারত-বিভাগ তথা পাকিস্তানের স্বপক্ষে তাঁর বলিষ্ঠ যুক্তি এই ছিল যে, “পিঞ্জিরাবদ্ধ পাখী সবসময় মুক্তি পেতে চাইলেও পিঞ্জিরার সামনে কোনো বন্য বিড়াল দাঁড়ানো থাকলে সে কখনও তার থেকে মুক্তি পেতে চায় না”।
জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম ও মওলানা উসমানী
অক্টোবর ১৯৪৫ খৃষ্টাব্দে কলকাতায় মুহাম্মদ আলী পার্কে অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত ওলামা সম্মেলনে দেশ বিভাগের সমর্থক ও বিরোধী উভয় শ্রেণীর ওলামা প্রতিনিধিবৃন্দ উপস্থিত থাকলেও মূলত পাকিস্তান সমর্থক আলেমদের উদ্যোগেই উক্ত ঐতিহাসিক সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনে উপমহাদেশের খ্যাতনামা আলেমদের মধ্যে ছিলেন মওলানা মুফতী আবদুল রউফ দানাপুরী, মওলানা আযাদ সোবহানী, মওলানা তাহের কাসেমী ও মওলানা গোলাম মোরশেদ খতীব আলীগড় মসজিদ। বাংলাদেশের মওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী, মওলানা সাইয়েদ মোছলেহ উদ্দীন, মওলানা আতাহার আলী প্রমুখ। উক্ত সম্মেলনে মওলানা উসমানী অসুস্থতাবশতঃ উপস্থিত হতে না পারলেও তাঁর লিখিত ভাষণ সম্মেলনে পঠিত হলে পাকিস্তান দাবী ও মুসলিম লীগকে সমর্থনের প্রশ্নে শ্রোতাদের মধ্যে তা যাদুমন্ত্রের ন্যায় চেতনার উদ্রেক করে। সে-দিনই আনুষ্ঠানিকভাবে “জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম” প্রতিষ্ঠিত হয় এবং মওলানা ওসমানীকে এই জমিয়তের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। মওলানা উসমানী মুসলমানদের স্বতন্ত্র আবাসভূমির সপক্ষে যে-সব জোরালো যুক্তি পেশ করতেন এবং কংগ্রেস ও অখণ্ড ভারতের সমর্থক বিচদ্বস্মকটি স্বতন্ত্র কেন্দ্রের আবশ্যক, যেখান থেকে তারা পাবে প্রেরণা এবং বিকাশ ঘটবে তাদের জাতীয় ভাবধারার। ঐ কেন্দ্রে তারা পূর্ণ স্বাধীন ও সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হবার সাথে সাথে খোদায়ী জীবন বিধানকেও নির্বিবাদে চালু করার অধিকারী হবে। শুধু তাই নয়, লক্ষ্য বর্তমান বিশ্বে আজ যে জিনিসের বিশেষ অভাব অনুভূত, প্রস্তাবিত কেন্দ্রে সেই দুর্লভ ন্যায়বিচার ও পক্ষপাতমুক্ত খোদায়ী জীবন ব্যবস্থার বাস্তবায়নের মাধ্যমে তারা বিশ্ববাসীকে দেবে পথের সন্ধান”।
“বর্তমান বিশ্ব-রাজনীতির প্রচলিত ধারা অনুযায়ী মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশসমূহের সমন্বয়ে গঠিত স্বাধীন দেশে আমরা এই মহান লক্ষ্য কার্যকরী করতে পারবো। আমাদের আকাংখিত ভূখণ্ডটির নাম ‘পাকিস্তান’ কিংবা ‘হুকুমতে এলাহিয়া’ অথবা অন্য যে কিছুই হোক তবে এটা নিশ্চিত যে, একটি স্বন্ত্র জাতি হিসাবে মুসলমানদের অবশ্যই একটি কেন্দ্রের প্রয়োজন। বলা বাহুল্য, সংখ্যালঘু ও সংখ্যাগুরু জাতিদ্বয়ের যুক্ত-শাসনাধীনে এ লকছুতেই অর্জিত হতে পারে না”।
মুসলিম লীগের প্রতি সমর্থন
তিনি অন্যত্র বলেন যে, “আমি দীর্ঘ দিন থেকে দেশ বিভাগ প্রশ্নটি নিয়ে চিন্তা গবেষণা করেছি। এর ভালমন্দ প্রত্যেকটি দিক বিবেচনার পর আমি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে, এ মুহুর্তে পাকিস্তান লাভের জন্য শরীয়তের আওতাধীন থেকে সম্ভাব্য সকল উপায়ে মুসলিম লীগকে সমর্থন করা উচিত। কারণ, খোদানাখাস্তা মুসলিম লীগ নির্বাচনে হেরে গেলে পুনরায় দীর্ঘদিনের জন্য উপমহাদেশের মুসলমানদের আত্মবিকাশের পথ রুদ্ধ হয়ে যাবে। তাই এই পরিস্থিতিতে মুসলিম লীগের হাতকে মজবুত করা সকল মুসলমানের অপরিহার্য কর্তব্য। এ সঙ্গে সকল মুসলমানকে বিভিন্ন উপায়ে একথা প্রকাশ করা উচিৎ যে, আমরা নিজেদের ধর্ম ও প্রকৃত জাতীয়তার সংরক্ষণের উদ্দেশ্যই মুসলিম লীগের নেতাদের সঙ্গে মিলিত হয়েছি। তবে সকল ধর্মীয় ব্যাপারে ধার্মিক খোদাভীরু আলেমদের কথাকেই আমরা সকলের কথার উপর প্রাধান্য দেবো”।
জমিয়তে ওলাময়ে হিন্দের ঘাটি দেওবন্দে উসমানীর জনসভা
পাকিস্তান আন্দোলনে তিনি যে দুর্জয় মনোভাব গ্রহণ করেছিলেণ এবং কলকাতা মুহাম্মদ আলী পার্কের ওলামা সম্মেলনের দু’মাস পর ২৬শে ডিসেম্বর ১৯৪৫ খৃষ্টাব্দে খোদ কংগ্রেস রাজনৈতিক দর্শনের সমর্থক আলেমদের কেন্দ্রভূমি দেওবন্দের এক বিরাট জনসমাবেশে তিনি যে নির্ভীক উক্তি করেছেন, তা এ দেশের ইতিহাসে চিরদিন লিপিবদ্ধ হয়ে থাকবে। ঐদিন তিনি বলেছিলেনঃ
“শারীরিক অসুস্থতার দরুণ আমি জাতির সমস্যাবলী থেকে এক রকম দীর্ঘকাল প্রবাসী জীবন যাপন করেছি। কিন্তু মুসলমানগণ বর্তমানে যে নানান সংকট সন্ধিক্ষণের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলেছে, তার শেষ পরিণতি এতই গুরুতর যে, তা আমাকে এই রোগাক্রান্ত অবস্থায়ও রাজনীতির ময়দানে টেনে নিয়ে এসেছে। খেলাফত আন্দোলনের পর থেকে আমি সক্রিয় রাজনীতি থেকে প্রায় দূরেই সরে গিয়েছিলাম, কিন্তু দীর্ঘ দিনের চিন্তা-ভাবনার পর এ সিদ্ধান্তে উপনীত হলাম যে, পাকিস্তান অর্জনের জন্য প্রয়োজন হলে রক্ত দেয়াকে আমি গৌরবের বিষয় মলে মনে করবো”।
জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামের দুর্বার আন্দোলন
মওলানা আশরাফ আলী থানভী (রঃ) দেওবন্দ আন্দোলনের মূল লক্ষ্যকে কার্যকরী করার উদ্দেশ্যে প্রত্যক্ষ রাজনীতির পরিবর্তে লেখা ও বক্তৃতার মাধ্যমে উপমহাদেশে ইসলামী শিক্ষা-সংস্কৃতি ও মূল্যবোধকে জাগ্রত ও স্থায়ী করার কাজে লিপ্ত ছিলেন। এ ব্যাপারে তাঁর চেষ্টা-সাধনা ও লেখনীর বদৌলতে তিনি ইসলামের যে মহান খেদমত করেছেন, তা পাক-ভারতের মুসলিম ইতিহাসে অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে। তিনি পাকিস্তান প্রস্তাবকে সমর্থণ জানালে তাঁর পরিশ্রমের ফলশ্রুতি হিসাবে সারা অবিভক্ত ভারতে যে-সব স্থানে ইসলামী শিক্ষাকেন্দ্র ও তাঁর অনুসারীরা ছিলেন, সবাই মুসলিম নেতৃবৃন্দের আহবানে পাকিস্তান আন্দোলনের এগিয়ে আসেন। মওলানা থানভী (রঃ) কায়েদে আযম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর সঙ্গে পত্র-বিনিময় করেন ও তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র শাব্বীর আলীর দ্বারা জিন্ননাহ সাহেবকে ইসলাম শরীয়তের ব্যাপারে বহু জ্ঞান দান করেন। স্বয়ং কায়েদে আযমও একথা স্বীকার করেছেন। বলা বাহুল্য, কায়েদে আযম চরিত্রে পোষাক-আশাকের দিক থেকে যে পরিবর্তণ লক্ষ্য করা গিয়েছে, সেটা মূলতঃ মওলানা থানভীলই উপদেশের ফল ছিল।