বাংলার আলেম সমাজ
ঐ সময় বাংলা দেশে মওলানা থানভীর বিশেষ শিষ্য মওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী ও প্রখ্যাত সংগ্রামী আলেম মওলানা আতহার আলী সাহেব মুসলমানদের আলাদা বাসভূমি পাকিস্তানের জন্য বিরাট কাজ করেন। মওলানা জা’ফর আহমদ ওসমানী, মওলানা সোলায়মান নদভীকে নিয়ে মওলানা আতহার আলী সাহেব সিলেট গণভোটের প্রাক্কালে পাকিস্তানের সপক্ষে সভা-সমিতির মাধ্যমে বিরাট আন্দোলন গড়ে তোলেন। সেদিন তাঁরা এগিয়ে না এলে জমিয়তে ওলামায়ে হিন্দ প্রভাবিত সিলেট পাকিস্তানভুক্ত হতো কি না সন্দেহ। পাক-বাংলার প্রখ্যাত যুক্তবাদী আলেম চট্টগ্রামের মওলানা সিদ্দীক আহমদ সাহেবও সে সময় আজাদী আন্দোলনে বক্তৃতা, সভা-সমিতির মাধ্যমে অনকে কাজ করেন। মওলানা থানভীর শিষ্য বাংলার সর্বজন শ্রদ্ধেয় বুযর্গ হাফেজ্জী হুযুর (মওলানা মুহাম্মদুল্লাহ সাহেব) ও পীরজী হুযুর (মওলানা আবদুল ওহাব সাহেব) ও তাঁদের ভক্ত অনুসারীদের নিয়ে পাকিস্তানের জন্যে কাজ করে যান।
এভাবে বাংলার প্রখ্যাত পীর শর্ষিণার হযরত মওলানা নেসারুদ্দীন আহমদ সাহেব, পীর বাদশা মিয়া সাহেব এবং হাজী শরীয়তুল্লাহর বংশধর পীর মুহসিনুদ্দীন এবং ফুরফুরার পীর আবদুল হাই ছিদ্দিকী সাহেবান পাকিস্তানের সমর্থনে এগিয়ে আসেন। তাঁরা নিজেদের লক্ষ লক্ষ ভক্ত-মুরিদ ও অনুগামীর দ্বারা বাংলার ঘরে ঘরে জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামের প্ল্যাটফরম থেকে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলেন। তাঁদের আন্দোলনের ফলেই সেদিন বাংলার আনাচে-কানাচে, মসজিদে-মাদ্রাসায়, স্কুলে-কলেজে ধ্বনিত হয়ে উঠেছিল “পাকিস্তান জিন্দাবাদ” “লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান”, “মারকে লেঙ্গে পাকিস্তান, “পাকিস্তানের লক্ষ্য কি –লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ”।
ফুরফুরার পীর সাহেব [১৮৪১-১৯৩৯ খৃঃ]
যে কোনো মহৎ উদ্দেশ্যে ত্যাগ ও সংগ্রাম কোনো দিন বৃথা যেতে পারে না। গৌণে হরেও তার ফলশ্রুতি দেখা দেবেই। আর তাই দেখা যায়, ওয়ালিউল্লাহ আন্দোলনের কর্মীদের রক্তে বালাকোটের খুনরাঙা জমিনে যে ইসলামী আন্দোলনের বীজবৃক্ষ জন্ম নিয়েছিল, তার শাখা-প্রশাখা একদিকে যেমন ভারতের অন্যঅন্য অংশে বিস্তার লাভ করে, তেমনিভাবে বাংরাদেশের মাটিতেও সে বৃক্ষ শিকড় বিস্তার করে। এ জন্যেই দেখা যায়, যখন দিল্লীতে ১৮০৩ খৃঃ মওলানা শাহ আবদুল আজীজ দেহলভীর ইংরেজ বিরোধী ফতওয়া প্রচারিত হয়েছে, বাংলাদেশেও হাজী শরীয়তুল্লাহ (১৭৮১-১৮৪০ খৃঃ) ইসলামী আন্দোলনের ঝাণ্ডা বুলন্দ করে তুলেছেন। আবার যখন ওয়ালিউল্লাহ আন্দোলনের এ সংগ্রামী কাফেলা বালাকোটের দিকে এগিয়ে চলেছে, তখন মওলানা সাইয়েদ হাজী নিসার আলী তিতুমীর (১৭৮২-১৮৩১ খৃঃ) উস্তাদ সাইয়েধ আহমদের অনুকরণে এখানে ইংরেজদের বিরুদ্ধে বাঁশের কেল্লার প্রতিরোধ গড়ে তুলছেন এবং সাইয়েদ আহমদের শিষ্য মরহুম মওলানা কারামত আলী জৈনপুরীও (১৮০০-১৮৭৩ খৃঃ) বাংলার আকাশে-বাতাসে ইসলামের সৌরভ ছড়িয়ে দিচ্ছেন। হাদিয়ে বাঙ্গাল মওলানা কারামত আলী জৈনপুরী মুসলিম যুব সমাজকে ইসলামী শিক্ষা-সংস্কৃতির প্রশিক্ষণ দিয়ে এখানে ইসলামী রাষ্ট্রের অবকাঠামো নির্মাণ করেন।
ঠিক তেমনিভাবে বাংলায় ইসলামী রেনেসাঁ সৃষ্টিকারী ফুরফুরার পীর হযরত মওলানা আবু বকর ছিদ্দিক সাহেবও ঐ বালাকোট কেন্দ্রিক ইসলামী আন্দোলনেরই আর এক উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন। তার পরবর্তী পর্যায়ে মুনশী মেহেরুল্লাহ (জন্ম ১৮৬২-১৯০৭ খৃঃ) খৃষ্টান মতবাদ বিরোধী জাল ছিন্ন করে চলেছিল। তাঁর আন্দোলনকেও বালাকোট আন্দোলনের বাইরে বলা চলে না।
ফুরফুরার পীর সাহেব মওলানা আবু বকর ছিদ্দীক ১৯৪১ সালে কলকাতার হুগলী জেলার ফুরফুরা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি সাইয়েদ আহমদ শহীদের বিশেষ খলীফা হাফিয জালাল উদ্দীনের নিকট হাদীস, তাফসীর ও ফেকাহ শাস্ত্র অধ্যয়ন করেন এবং আধ্যাত্মিক জ্ঞান সাধনা করেন। পরে এ সিলসিলারই চট্টগ্রামের শাহ সুফী মরহুম ফতেহ আলীর নিকটও তিনি আধ্যাত্মিক জ্ঞান লাভ করেন।
মওলানা আবুবকর ছিদ্দীক যে সময় পরিণত বয়সে এবং যখন তাঁর কর্মময় জীবনের সূচনা, তখন বাংলাদেশ সহ গোটা ভারতের মুসলমানের জীবনে চরম দুর্দিন।উপমহাদেশের রাজনৈতিক আকাশ তখন ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ। ১৮৫৭ সালের বিপ্লবের ব্যর্থতার পর মুসলমানদের জীবনে চরম দুর্দিন নেমে এসেছে। মুসলমানদের মাথায় ভেঙ্গে পড়েছে বিপদের পাহাড়। ঠিক তখনই এক রাতে “স্বপ্নে আযান দেওয়ার” একটি ঘটনা তাঁকে কর্মমুখর করে তোলে। এ স্বপ্ন দেখার পর থেকে তিনি বাংলার মানুষের মধ্যে ইসলামের বাণী প্রচারে উঠেপড়ে লাগেন। তাঁর অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা, চারিত্রিক ও দার্শনিক যুক্তি মানুষকে অভিভূত করে তুললো। বহু অমুসলিম তাঁর হাতে ইসলামের দীক্সা নেয়। বাংলা, আসাম সহ ভারতের লক্ষ লক্ষ মুসলমান তাঁর হাতে মুরীদ হয়।
বক্তৃতার প্রভাব সাময়িক, তাই মাতৃভাষায় সাহিত্য সাংবাদিকতার দ্বারা ইসলাম প্রচারের আধুনিক পদ্ধতির প্রতি ফুরফুরার পীর সাহেব অধিক যত্মবান ছিলেন। তাঁর প্রচেষ্টায় অনেক দ্বীনি গ্রন্থের বঙ্গানুবাদ হয়। বিশ শতকের গোড়ার দিকে গ্রাম বাংলার স্বল্প শিক্ষিত মুসলিম জনসাধারনের অতিপ্রিয় “মুসলি হিতৈষী’র তিনি প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। এ ছাড়াও তিনি তাঁর সুদীর্ঘ জীবনে বহু সংবাদপত্রের পৃষ্ঠপোষকতা করেন। যথা –মিহির ও সুধারক, ইসলাম প্রচারক, নবনূর, ইসলাম দর্শন, হানাফী, মোহাম্মদী, শরীয়তে ইছলাম, ছুন্নাতুল জামায়াত, হেদায়েত, ছোলতান ইত্যাদি।
ইন্তেকালের কিছুদিন পূর্বে মুসলমানদের বিশেষ করে সর্বভারতীয় ওলামা প্রতিষ্ঠান ‘জমিয়তে ওলামা’র বাংলা ভাষার মুখপত্রের অভাব তীব্রভাবে উপলব্ধি করেন। রোগশয্যায় শায়িত থেকেও তিনি “মোছলেম” নামক সাপ্তাহিক পত্রিকার পৃষ্ঠপোষকতা করেন। এ পত্রিকার জন্যে পীর সাহবে নিজ তহবিল থেকে ১ হাজার টাকা প্রদান করেছিলেন।
একদিকে পত্র-পত্রিকা, ওয়াজ-নছীহত অপরদিকে নিজের শিষ্য-শাগরিদদের মাধ্যমে বাংলা ও আসামে তিনি ইসলামী আন্দোলন চালিয়ে যান। তদ্রুপ তাঁর আবর্তমানেও যাতে এ মহৎ কাজের চর্চা এখানে অব্যাহত থাকে, সে জন্য তিনি বাংলাদেশে অসংখ্য মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। জনশ্রুতি আছে, একই মাহফিলের প্রাপ্ত চাঁদায় নোয়াখালীর বিখ্যাত ইসলামিয়া মাদ্রাসাটি একই দিনে তিনি স্থাপন করে আসেন। ‘মাদ্রাসায়ে ফতেহিয়া ইসলামায়িা ফুরফুরা’র জন্য তিনি বহু সম্পত্তি ওয়াকফ করেন।
ফুরফুরার পীর সাহেবের একটি বড় বৈশিষ্ট্য ছিল এই যে, তিনি দ্বীনি শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে হালাল রুজী অর্জনের নিয়তে আধুনিক শিক্ষা গ্রহণের বিরোধী ছিলেন না, যেমন কোনো কোনো আলেম তখন আধুনিক শিক্ষা গ্রহণের প্রশ্নে বিরূপ মনোভাব পোষণ করতেন। মাদ্রাসা শিক্ষাপ্রাপ্ত লোকেরা যথার্থ ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হয়। দ্বিনী শিক্ষায় যথেষ্ট ব্যুৎপত্তির অধিকারী হয়েও আধুনিক মানে তারা দ্বীনের সত্যকার শিক্ষা আদর্শ তুলে ধরতে অক্ষম। অন্যদিকে অর্থকরী শিক্ষার অভাবে কর্মজীবনেও নিজের বিবেকবিরোধী অনেক ভ্রান্ত পথ তাদের অবলম্বন করতে হয়। ফুরফুরার পীর সাহেব ছিলেন এ শ্রেণীর আলেমের ব্যতিক্রম। তিনি এরূপ দৃষ্টিভঙ্গির বিরোধী ছিলেন যাতে কেউ মাদ্রাসা শিক্ষা লাভের পর মাদ্রাসা বা খানকাহ ছাড়া অন্য কোথাও ঠাঁই না পায়। বরং মাদ্রাসা শিক্ষকরা দ্বীনি এলেমের সঙ্গে আধুনিক শিক্ষা লাভ করে হালাল রুজি-উপার্জন করতে সক্ষম হোক, এ জন্যে তিনি ফুরফুরা শরীকে ওল্ড স্কীম মাদ্রাসার সঙ্গে একটি প্রকাণ্ড নিউ স্কীম মাদ্রাসাও স্থাপন করেন। মূলতঃ তাঁর এই বাস্তবধর্মী ভূমিকার ফলেই দেখা যায়, বহু লোক ইংরেজী শিক্ষা লাভ করেও তাঁর শিষ্যত্ব লাভ করেছেন এবং বাংলাদেশে আধুনিক শিক্ষিত সমাজের মধ্যে দ্বীনি কাজ করেগেছেন। তন্মধ্যে তাঁর খলীফা প্রফেসার আবদুল খালেক এবং এশিয়া বিখ্যাত অন্যতম ভাষাবিদ মরহুম ডক্টর শহীদুল্লাহর নাম বিশেষবাবে উল্লেখযোগ্য।
মওলানা আবুবকর সাহেব বাংলা-আসামের মুসলমানদের মধ্য থেকে বেদয়াত, শিরক ও যাবতীয় কুসংস্কার দূর করার উদ্দেশ্যে এবং ইংরেজ ও হিন্দু সভ্যতা-সংস্কৃতির হাত থেকে এ দেশের মুসলমানদের ক্ষার জন্যে রীতিমতো আন্দোলন চালিয়েছেন।
তাঁর ইসলামী আন্দোলন ছিল সর্বমুখী। শিক্ষা ক্ষেত্রে, সমাজ সংস্কারের ব্যাপারে, মুসলমানদের সাহিত্য-সাংবাদিকতায় উৎসাহ দানে, আধ্যাত্মিক উন্নতি সাধনে এবং রাজনৈতিক তৎপরতা ও আজাদী আন্দোলনে সকল দিকে তিনি এ দেশে ইসলামী রেনেসাঁ সৃষ্টির কাজ করে গেছেন।
আজাদী আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা ছিল বাংলার সকল আলেমের চাইতে অধিক। বাংলার প্রত্যেক মুসলিম নেতাকেই রাজনৈতিক ব্যাপারে বাঙ্গালী মুসলমানদের সমর্থন পাওয়ার জন্য তাঁর শরণাপন্ন হতে হয়েছে। এমন কি হিন্দু নেতারাও তাঁর কাছে যেতেন। রাজনীতিতে তিনি ছিলেন দূরদর্শী। একবার মিষ্টার গান্ধী, সি, আর, দাস, মওলানা মুহাম্দ আলী যখন অসযোগ আন্দোলনে যোগদানের জন্যে তাঁর কাছে গিয়েছিলেন, তখন তিনি স্পষ্ট বলে দিয়েছিলেন যে, “আমি প্রথমে কোরান-হাদীসের পক্ষপাতী। কংগ্রেস এর কোনো একটির বিরুদ্ধাচরণ করলে কখনও আমার সহযোগিতা পাবে না”। তিনি আরও বলেছিলেন –“ঘর পোড়া গরু যেমন সিঁদুরে মেঘ দেখে ভয় পায়, তেমনি আমি আপনাদের সঙ্গে (হিন্দুদের) সহযোগিতা করতে ভয় পাই। কেননা, সিপাহী বিদ্রোহের সময় যখন হিন্দুগণ সমস্ত দোষ গরীব মুসলমানদের উপর চাপিয়ে দিয়ে পলায়ন করলো, তখন সে বিশ্বাসঘাতকতার দরুণ বহু মুসলমানের প্রাণ হানি ঘটেছিল। সে সব কথা স্মরণ হলে আমার শরীর শিউরে উঠে। তাই হিন্দু-মুসলমান একতাবদ্ধ হতে হলে হিন্দুদেরকে মুসলমানদের দাবি-দাওয়া মেনে নিতে হবে”।
এ জবাবে হিন্দু নেতারা নিরাশ হলে তিনি তাদের অজ্ঞাতসারে মওলানা মুহাম্মদ আলীকে বললেন, “আমি কংগ্রেসের প্রতি আস্থা আনতে পারি না। তাদের চেহারার হাবভাব দেখে আমার সন্দেহ হয়। আপনাকে আমি এ উপদেশ দিচ্ছি, যাই করুন আগে দ্বীন, পরে দেশ। দ্বীন ছেড়ে দিয়ে দেশ উদ্ধার করা আমাদের কর্তব্য নয়। আমার একথাগুলো স্মরণে রাখবেন। আমি প্রথমে মুসলমান পরে ভারতবাসী”। তিনি সব সময় বলতেন, “শরীয়তবিরোধী যা-ই হোক না কেন, নিশ্চয়ই তার প্রতিবাদ করতে আমি কখনও পশ্চাদপদ হবো না। আবু বকর আল্লাহকে ছাড়া কাউকে ভয় করে না”।
বিচক্ষণ মওলানা আবু বকর সাহেব তাঁর এই দ্বিজাতিত্ত্ববোধের কারণেই জমিয়তে ওলামায়ে হিন্দ কংগ্রেসকে সমর্থন করায়, তা থেকে বের হয়ে আসেন এবং বাংলার আলেম সমাজকে রাজনৈতিক দিক থেকে সংঘবদ্ধ করার জন্যে “জমিয়তে ওলামায়ে বাঙ্গাল ও আসাম” গঠন করেন। তিনি খেলাফত আন্দোলনকালে বহু অর্থ চাঁদা তুলে তুর্কী মুসলমানদের সাহায্য করেছেন। বাংলার মুসলমানদের ভোট পেতে হলে শেরে বাংলা মৌলভী এ, কে, ফজলুল হক অনেক নেতাকেই ফুরফুরার পীর সাহেবের সমর্থন নিতে হতো।
মওলানা আবু বকর সিদ্দীক প্রথমে রাজনীতিতে তেম আগ্রহী ছিলেন না। কিন্তু যখন দেখলেন যে, কাউন্সিল তথা আইন পরিষদে ইসলামের শরীয়তবিরোধী আইনসমূহ পাশ হচ্ছে, তখনই তিনি ইসলামপন্থী দ্বীনদার মুসলমান ও আলেমদেরদে আইন সভায় পাঠানোর তীব্র প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। ৪৭ পূর্বে যুক্ত বাংলার ‘ব্যবস্থা পরিষদে’ বেশ কয়জন আলেম সমস্য ছিলেন। ফেনীর মওলানা আবদুর রাজ্জাক, মওলানা ইবরাহীন ও মওলানা আবদুল জাব্বার খদ্দর প্রমুখসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার যেসব আলেম তখন যুক্ত বাংলা আইন পরিষদের সদস্য ছিলেন, তাঁদের রাজনীতিতে অংশ গ্রহণের পেছনে মূলতঃ এই চেতনা ও দৃষ্টিভঙ্গিই কাজ করেছিল।
বস্তুতঃ বাংলা-আসামে মুসলিম লীগের যে জনপ্রিয়তা ছিল, তার উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব ফুরফুরার পীর সাহেবেরই। তিনি এ দেশের বাঙ্গালী মুসলমানের মনে মুসলিম স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্যে যে ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিলেন, তা চিরদিন এদেশের ইতিহাসে অম্লান হয়ে থাকবে। তেমনি বাঙ্গলার আলেম সমাজও তাঁর এই আদর্শ থেকে আজীবন প্রেরণা লাভ করবে। তাঁর ইন্তেকালের এক বছর পরই ১৯৪০ সালে মুসলিম লীগ লাহেরা প্রস্তাবের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে মুসলমানের জন্যে আলাদা রাষ্ট্রের প্রস্তাব গ্রহণ করে।
ফুরফুরার পীর সাহেবের ইনতেকালের পর বাংলা-আসামে তাঁর যেসব শিষ্য অনুসারী ইসলামের শিক্ষা ও আদর্শ বিস্তারে কাজ করেন, তাদের মধ্যে শর্ষিনার পীর মওলানা ছুফী নেছারুদ্দীন সাহেব, ছুফী ছদরুদ্দীন সাহেব, মওলানা রুহুল আমীন সাহেব, প্রফেসর আবদুল খালেক সাহেব এবং ডক্টর শহীদুল্লাহ সাহেব, মওলানা মুয়েযুদ্দীন হামীদী সাহেব প্রমুখের নাম সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য। তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র পীর মওলানা আবদুল হাই ছিদ্দিকী তাঁর অনুগামীদের নেতৃপদে অধিষ্ঠিত হন। পাকিস্তান আন্দোলনকালে ফুরফুরার পীর সাহেবের এসব খলীফা ও তাঁর লক্ষ লক্ষ মুরীদের অপরিসীম ত্যাগ রয়েছে। এমন দিনও গিয়েছে, মুসলিম লীগ ও পরবর্তী পর্যায়ে পাকিস্তানের সপক্ষে বাঙ্গালী মুসলমানদের সমর্থনের জন্যে সংবাদপত্রের প্রথম পৃষ্ঠায় আলেমদের ফতওয়া ও অভিমত প্রকাশ না করলে এ দেশের মানুষ রাজনৈতিক ব্যাপারে কোনো নেতাকে তেমন সমর্থন জানাতে না।
পাকিস্তান আন্দোলন শুরু হলে মওলানা শাব্বীর আহমদ ওসমানী ও কায়েদে আযম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ যখন তাঁর প্রতি সহযোগিতার আহবান জানান, তখন ফুরফুরার পীর সাহেবের সুযোগ্য পুত্র মওলানা আবদুল হাই ছিদ্দিকী ও তাঁর বিশিষ্ট শিষ্য মওলানা নেছারুদ্দীন আহমদ সহ ফুরফুরার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অসংখ্য ওলামা ও সাধারণ মুসলমান এ ব্যাপারে ঝাঁপিয়ে পড়েন।
শর্ষিণার পীর মওলানা নেছারুদ্দীন আহমদ সাহেব
বিশেষ করে শর্ষিণার পীর মওলানা নেছারুদ্দীন আহমদ সাহেব ও ফুরফুরার পীর মওলানা আবদুল হাই ছিদ্দীকী মুসলিম লীগ ও জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামের মাধ্যমে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে এ দেশের মানুষের দুয়ারে দুয়ারে পৌঁছাবার জন্যে তৎপর ছিলেন। ফুরফুরার বড় পীর সাহেব কর্তৃক স্থাপিত “জমিয়তে ওলাময়ে বাঙ্গাল ও আসামে”র তরফ থেকে মুসলিম লীগ নেতাদের কাছে ইসলামী চরিত্র গঠনের জন্যে তারা চাপ সৃষ্টি করতেন। এ প্রত্যেকটি বিষয়ই ছিল আলেম সমাজের জন্যে প্রেরণার বিষয়। সিলেটের গণ-ভোটের প্রাক্কালে শর্ষিণার পীর সাহেব অত্যন্ত উদ্বিগ্ন ছিলেন, না জানি সিলেটের মুসলমান পাকিস্তানের বিরুদ্ধে রায় দিয়ে বসে। এ আশংকায় তিনি তাঁর জ্যৈষ্ঠপুত্র মওলানা আবু জাফর মুহাম্মদ ছালেহ ছাহেবসহ বহু ভক্তকে আন্দোলনের উদ্দেশ্যে সিলেটে প্রেরণ করেন।
পাকিস্তান আন্দোলনের ব্যাপারে শুধু রাজনৈতিক সুবিধাই যে মানুষ কামনা করেনি এবং আলেম সমাজ পাকিস্তান আন্দোলনে শরীক না হলে যে এ দেশের মুসলমানদের ভিন্নমত প্রকাশের সম্ভাবনা ছিল, শর্ষিণার দূরদর্শী পীর নেছারুদ্দীন সাহেব কর্তৃক কায়েদে আযমকে লিখিত একটি চিঠি থেকেও তা সুস্পষ্ট হয়ে উঠে। তাহলোঃ
“মুসলিম লীগ আজ যতোখানি রাজনৈতিক চেতনা জাগ্রত করতে সমর্থ হইয়াছে, সেই পরিমাণ ধর্মীয় চেতনা জাগ্রত করিতে সমর্থ হয় নাই। এই কারণে জনসাধারণ মুসলমানদের জন্যে আলাদা রাষ্ট্র ‘পাকিস্তান’ শব্দ বার বার শুনিয়ে কণ্ঠস্থ করিলেও ইহা তাহাদের কতোখানি আপনার জিনিস শুধু রাজনৈতিক সুবিধা লাভের ভিতর দিয়া তাহারা ইহা ভাল বুঝিতে পারে না –তাহারা ইহা বঝিতে চাহে ধর্ম ও নৈতিক উন্নতির স্বীকৃতির ভিতর দিয়া আর ইহা কার্যতঃ কিভাবে আরম্ভ করা হইয়াছে তাহাও কাজের ভিতর দিয়া দেখাইয়া দিতে হইবে”।
বস্তুতঃ ভারতের বিভিন্ন এলাকায় মুসলমানদের এজাতীয় বিজ্ঞাসার জবাব হিসাবেই কায়েদে আযম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ পাকিস্তান, পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র, এ দেশের অর্থ ও সমাজ ব্যবস্থার কথা উল্লেখ করে বার বার ইসলামী শাসনব্যবস্থা ও কুরআন-সুন্নাহ ভিত্তিক শাসনতন্ত্রের ওয়াদা করেছিলেন। এ কারণেই দেখা যায়, ১৯৪৬ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত ওলামা সম্মেলনে কায়েদে আযম তাঁর দক্ষিণ হস্ত মওলানা যাফর আহমদ আনছারীর মাধ্যমে প্রেরিত পয়গামে পাকিস্তানকে ইসলামী রাষ্ট্র করার ওয়াদা প্রদান করেন।
মওলানা আবদুল্লাহির বাকী
আজাদী আন্দোলনে বাংলাদেশের অন্যতম উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক, ইসলামী চিন্তাবিদ, বিচক্ষণ রাজনীতিক নেতা ছিলেন মওলানা আবদুল্লাহিল বাকী। মওলানা বাকী প্রখ্যাত সাহিত্যিক, সাংবাদিক, রাজনীতিক ও ইসলামী চিন্তাবিদ মওলানা কাফীর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা ছিলেন। উভয় ভ্রাতাই উপমহাদেশের মুসলিম রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি আন্দোলনের ইতিহাসের উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন। জাতির সার্বিক কল্যঅণ-চিন্তায় মওলানা কাফীর ন্যায় মওলানা বাকী্ও ছিলেন নিবেদিত। তিনি অসহযোগ ও খেলাফত আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন। ১৯৩০ সালে আইন অমান্য করে আন্দোলনে জড়িত হয়ে এ দেশ থেকে ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ আওয়াজ তোলেন। ইংরেজ সরকার তাঁকে কারাগারে নিক্ষেপ করে। ১৪৪ ধারা ভঙ্গের অভিযোগে
তাঁকেও অতিরিক্ত জেল ভোগ করতে হয়েছিল। ১৯৩৩ সালে তিনি তৎকালীন বঙ্গবন্ধু –শেরে বাংলা মৌলভী এ, কে, ফজলুল হক সাহেবের প্রজা আন্দোলনে যোগদান করেন। ১৯৩৪ সালে মওলানা বাকী ভারতীয় কেন্দ্রীয় ব্যবস্থা পরিষদের সদস্য নিযুক্ত হন। এবং দেশবাসীর অধিকার ও স্বার্থরক্ষার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেন। তিনি সে সময় কৃষক শ্রমিক প্রজা পার্টির সহ-সভাপতি হিসাবে জনগণের অধিকার নিয়ে সংগ্রাম করতেন। মওলানা বাকী ১৯৪৩ সালে মুসলিম লীগে যোগদান করে একে অধিক জোরদার করে তোলেন। ১৯৪৬ সালে অবিভক্ত বাংলার ব্যবস্থা পরিষদের তিনি সদস্য ছিলেন। মওলানা বাকী আজাদী আন্দোলনের যে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছেন, তার দীর্ঘ বিবরণ এখানে সম্ভব নয়। তিনি আজাদী-উত্তরকালেও মুসলিম লীগের সহ-সভাপতি ছিলেন। ১৯৫২ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বার্ধক্যে পৌঁছে ইসলামী শাসনতন্ত্র রচনার ব্যাপারে যথেষ্ট চেষ্টা করেছেন।
পীর বাদশাহ মিঞা (১৮৮৪-১৯৫৯ খৃঃ)
আজাদী আন্দোলনের অন্যতম বীর সেনানী শরীয়তের নিশানবরদার ফরিপুরের পীর বাদশাহ মিঞার দান মুসলিম আজাদী সংগ্রামের ইতিহাসেই কেবল নয়, এখানকার ধর্মীয়, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও আধ্যাত্মিক ইতিহাসে চিরদিন ভাস্বর হয়ে থাকবে। জাতির এ মহান নেতার অপূর্ব চারিত্রিক দৃঢ়তা, আধ্যাত্মিক শক্তি-সাহসের বদৌলতে এ দেশের মুসলিম সমাজ থেকে শিরক, বেদায়াত ও যাবতীয় অনৈসলামিক রীতিনীতি ও কুপ্রথা বহুলাংশে দূরীভুত হয় এবং ইসলামের বৈপ্লবিক শক্তিবলে পরাধীনতার জিঞ্জিরমুক্ত হবার জন্যে দেশবাসীর মধ্যে ইংরেজ বিতাড়নের মধ্য দিয়ে আজাদী হাসিলের স্পৃহা বদ্ধমূল হয়ে দাঁড়ায়। এ মহান নেতার কর্মবহুল সংগ্রামী জীবনের বিস্তারিত আলোচনা এখানে সম্ভব না হলেও তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সংক্ষিপ্ত আলোচনা একান্ত প্রয়োজন।
মুসলিম বাংলার সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে পীর বাদশাহ মিঞার অবদানের ঐতিহাসিক মূল্যকে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। বাংলার সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ইসলামী আন্দোলনের পথিকৃৎ মহান বিপ্লবী নেতা হাজী শরীয়তুল্লাহর উত্তরাধিকারী পীর বাদশাহ মিঞা তাঁর কর্মজীবনের প্রতিটি পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে বিপ্লবী নেতা হাজী শরীয়তুল্লাহর যোগ্য প্রতিনিধি হিসাবে নিজেকে প্রমাণিত করে গেছেন। উপমহাদেশের মুসলমানদের মুক্তি আন্দোলনের বংশানুক্রমিকভাবে তিনি উত্তরাধিকারী হওয়াতে ইংরেজ বিরোধী আন্দোলনে নির্ভীকভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে। বাংলার আনাচে-কানাচে ঝটিকা সফর করে তিনি তাঁর লাখ লাখ মুরীদ নিয়ে ইংরেজ শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। ১৯২১ সালে পীর বাদশাহ মিঞা খেলাফত আন্দোলনে জড়িত হন এবং ইংরেজ সরকার তাঁকে কারাগারে আবদ্ধ করে। দীর্ঘ দু’বছর তিনি কারাগারে অতিবাহিত করেন। এই নির্ভীক মোজাহিদ কারা-নির্যাতনে এতটুকুও দমেননি। বরং ইংরেজ সরকারের কবল থেকে বাংলাদেশ তথা গোটা উপমহাদেশের মানুষকে মুক্ত করার জন্য তিনি জনগণকে আজাদী আন্দোলনে উদ্বেলিত করে তোলেন। তাঁর জনপ্রিয়তা, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দেশের একনিষ্ঠ সভাব গুণে বাদশাহ মিঞা ইচ্ছা করলে সহজেই প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য হতে পারতেন; কিন্তু তিনি ক্ষমতায় না গিয়ে নিঃস্বার্থভাবে দেশের সেবা করেছেন। ইংরেজ সরকার তাঁকে অনেক সুযোগ-সুবিধা দিয়ে বশ করার জন্য বহুবার ব্যর্থ চেষ্টা করেছে। তিনি ব্যক্তিস্বার্থে রাজনীতি করাকে অত্যন্ত ঘৃণার চোখে দেখতেন। ১৩২৮ বাংলায় মাদারীপুর মহকুমার প্রধান প্রশাসকও কতিপয় ইংরেজ তল্পীবাহক নিয়ে তাঁর বৈঠকখানায় উপস্থিত হন এবং ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধাচরণ হতে বিরত থাকার আহবান জানান। অন্য পীরকের মতো রাজনীতি বাদ দিয়ে শুধু ওয়াজ-নছীহত করতেই মহকুমা প্রশাসক তাঁকে পরামর্শ দেন। জবাবে তিনি বলেছিলেন, উপমহাদেশ থেকে ইংরেজ যালেম সরকারকে বিতাড়িত করা এবং দেশবাসীর ন্যায্যা অধিকার প্রতিষ্ঠা করা তাঁর একটি ধর্মীয় পবিত্র কর্তব্য। মহকুমা এস,ডি ও তাঁকে বশে না আনতে পেরে আর একটি বিরাট টোপ দেখানঃ ইংরেজ সরকারে খাস মহল বিভাগ থেকে তাঁকে আট হাজার বিঘা লাখেরাজ ভূমি ও তাঁকে একজন স্পেশাল ম্যাজিষ্ট্রেটের ক্ষমতা দেয়া হবে। তাঁর বাহাদুরপুর বাসভবন প্রাঙ্গনে ফৌজদারী ও আদালতী বিচার কোর্ট এবং তাঁকে একটি শ্রেষ্ঠতম তমগা দেয়ার ব্যবস্থা হবে। কিন্তু ত্যাগী সংগ্রামী নেতা পীর বাদশাহ মিঞা তখন ঘৃণাভরে এসব প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন ও রাগতস্বরে বলেছিলেন, “ধন-সম্পদ ও পার্থিব সম্মান লাভের উদ্দেশ্যে ইসলামের দুশমন যালেম প্রভুদের সুযোগ দেওয়া কাপুরুষের কাজ। আমি কাপুরুষ নই। কাপুরুষের বংশে জন্ম নেইনি। আমার পূর্বপুরুষগণ ইংরেজদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে তাদের কারাগারে কঠিন যন্ত্রণা ভোগ করেছেন। আমি সেই জালেমশাহী খতম করতে জানমাল উৎসর্গ করতে প্রস্তুত। তাদের আনুগত্য ও দাসত্ব স্বীকার কিছুতেই আমার দ্বারা সম্ভব নয়”।
চট্টগ্রামের মওলানা কাসেম আলীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ১৯২১ খৃষ্টাব্দে মহানগরী কলাকাতার খেলাফত কমিটির অধিবেশন থেকে এসে পীর বাদশা মিঞা পূর্বাপেক্ষা অধিক সংগ্রামী হয়ে ওঠেন। সে অধিবেশনে তিনি সি, আর, দাসের সঙ্গেও আজাদী আন্দোলনের ব্যাপারে আলোচনা করেন। দেশে প্রত্যাগমন করে তিনি বাংলার গ্রাম, গঞ্জ, শহর, বন্দরে বিরাট সভা করে ইংরেজবিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলেন। প্রথমে তিনি মাদারীপুরে ১৯২১ খৃঃ ২৮শে আগষ্ট বিরাট সভা করেন। দ্বিতীয় ঐতিহাসিক সভা অনুষ্ঠিত হয় ১৯২১ খৃঃ ২রা সেপ্টেম্বর বরিশাল হাইস্কুল প্রাঙ্গনে। এতে খেলাফত কমিটির প্রতিষ্ঠাতা অবিভক্ত ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নেতা মওলানা মুহাম্মদ আলী, মওলানা আজাদ সোবহানী, কংগ্রেস নেতা মোহনদাস করম চাঁদ গান্ধী, শ্রী বঙ্কিম চন্দ্র প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
গ্রেফতারী
পীর বাদশাহ মিঞা ঐ সালেই ৭ই সেপ্টেম্বর ১০৮ ধারা আইনে গ্রেফতার হন। তাঁকে গ্রেফতার করে নেয়ার সময় মাদারীপুর এস, ডি ও’র বাসায় বসানো হয়। এখানেও রাজনৈতিক আন্দোলন হতে বিরত থাকার জন্য তাঁকে বুঝান হয় এবং একটি চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর দিতে অনুরোধ জানান হয়। তাকে এস,ডি ও রাত্রে তার বাসভবনে আহার করতে অনুরোধ জানালে তিনি জবাব দেনঃ আমি আপনার অতিথি নই। কাজে আপনার খাদ্য খাব কেন? জেলখানার খাদ্যই আমার যথেষ্ট। পরদিন পুলিশ অফিসার তাঁকে জেলা ম্যাটিষ্ট্রেটের নিটক নতি স্বীকার করতে বললে তিনি এই প্রস্তাবও প্রত্যাখ্যান করেন। মাদারীপুরে কারাগার থেকে তাঁকে ফরিদপুর কারাগারে নেয়ার পথৈ জনতা রাস্তায় রাস্তায় ভীড় জমায় এবং ইংরেজ-বিরোধী শ্লোগান দিতে থাকে। তিনি নির্ভীকভাবে অপেক্ষমান সারিবদ্ধ জনতাকে আন্দোলন জোরদার করার আদেশ দেন এবং ভগ্নোৎসাহ হতে নিষেধ করেন। তিনি মওলানা মুহাম্মদ আলীর অমরবাণী –“কতলে হোসাইন আছল মে মুরগে ইয়াজিদ হ্যায়, ইসলাম জিন্দা হোতা হ্যায় হার কারবালাকে বাদ” এই বলে অনুপ্রাণিত করে। অবশেষে তাঁকে আলীপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে নেয়া হয়। তার অল্পদিন পরে অবিভক্ত ভারতের প্রখ্যাত সংগ্রামী আলেম দেশপ্রেমিক মওলানা মুহাম্দ আকরাম খাঁ, মওলানা আবদুর রউফ দানাপুরী, সি, আর, দাস, জে, এম, সেন চৌধুরী, নোয়াখালীর আবদুর রশীদ খান, মৌঃ শামসুদ্দীন আহমদ, মওলানা আজাদ, করটিয়ার জমিদার চাঁন্দ মিঞা প্রমুখ হিন্দু-মুসলিম নেতৃবৃন্দকে আলীপুর সেন্টাল জেলে বন্দী করে আনা হয়। এতে নেতৃবৃন্দের ভবিষ্যত কর্মসূচী উপযুক্ত পরামর্শ কেন্দ্র মিলে।
পীর বাদশাহ মিঞাকে এত নির্যাতন ও লোভ-প্রলোভন দিয়েও তাঁকে রাজনীতি থেকে বিরত না করতে পারার একমাত্র কারণ এই ছিল যে, তিনি মনে করতেন –রাজনীতির সঙ্গে ইসলামের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। বরং এটা ইসলামের একটি শক্তিশালী অঙ্গ। ঈমান-আকীদা, ইবাদাত, রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজনীতি প্রভৃতির সমষ্টির নামই ইসলামী রাজনীতি।
পীর বাদশাহ মিঞা তাঁর সমসাময়িক প্রতিটি জাতীয় আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলেন। ১৯৩৬ সালে শেরেবাংলার কৃষক প্রজা পার্টিরও তিনি পৃষ্ঠপোষক ছিলেন।
১৯৪০ সাল ঐতিহাসিক পাকিস্তানের প্রস্তাব গৃহীত হলে তিনি পাকিস্তান আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। দেশ স্বাধীন হবার পর একে ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য তিনি জমিয়তে ওলামা-এ-ইসলাম ও নেযামে ইসলাম পার্টির সঙ্গে ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনে বিরাট ভূমিকা পালন করেন। মুসলিম লীগ ইসলামের ব্যপারে ওয়াদা খেলাফী করলে তিনি লীগের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেন। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্ত-ফ্রন্টের সপক্ষে তিনি নিজের অনুসারীদের নিয়ে অন্যতম অঙ্গদল নেযামে ইসলামের পক্ষ হয়ে মুসলিম লীগতে তার ওয়াদা খেলাফীর পরিণতি বুঝিয়ে দেন। কেননা, ঐ নির্বাচনেই মুসলিম লীগের ভরাডুবি ঘটেছিল। যা হোক, অতঃপর এই মহান সংগ্রামী নেতা ইসলামী রাষ্ট্রের আকুল আগ্রহ বুকে নিয়ে ১৯৫৯ খৃঃ ১৫ই ডিসেম্বর মাসে চির বিদায় গ্রহণ করেন।
মওলানা আবদুল্লাহিল কাফী
মওলানা আবদুল্লাহিল কাফী আজাদী আন্দোলনের অন্যতম সংগ্রামী বীর ছিলেন। তিনি একাধারে সাহিত্যিক, সাংবাদিক, রাজনীতিক ও সমাজ সংস্কারক যুক্তিবাদী বিচক্ষণ আলেম ছিলেন। এক হিসাবে বলা চলে বাঙ্গালী মুসলমানদের মধ্যে জাতীয় চেতনা সৃষ্টিকল্পে সাহিত্য সাংবাদিকতা, পুস্তক রচনা তথা সাংস্কৃকিত দিক থেকে যে কয়জন আলেম নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছিলেন তাদের মধ্যে মওলানা কাফী অন্যতম অগ্রপথিক। এই ইসলামী চিন্তাবিদ কলিকাতা মাদ্রাসার অ্যাংলো-পারসিয়ান বিভাগ থেকে ১৯১১ সালে বি,এ, পাশ করে উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইসলামী চিন্তাবিদ ও প্রথম শ্রেণীর রাজনীতিক মওলানা আবুল কালাম আযাদের সংস্পর্শে যান। সে সময় মওলানা আযাদ মাসিক ‘আল-হেলাল’ পত্রিকার সম্পাদক। মওলানা আযাদের নিকট রাজনৈতিক প্রেরণা লাভ করে তিনি মুসলমানদের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা সৃষ্টিকল্পে ‘পূর্ববাংলায়’ আসেন। এখানে কিছুকাল সভা-সমিতির মাধ্যমে কলকাতা চলে যান। মওলানা আকরাক খাঁর সম্পাদনায় খেলাফত কমিটির উর্দু দৈনিক ‘যামানা’ পত্রিকায় তখন ইংরেজদের বিরুদ্ধে আপত্তিকর সম্পাদকীয় প্রকাশের অভিযোগে মওলানা আকরম খাঁ ও পত্রিকার সহ-সম্পাদক শেখ আহমদ ওসমানী গ্রেফতার হলে তিনি ১৯২২ সালে ‘যামানার’ সম্পাদক পদে নিযুক্ত হন। মওলানা আবদুল্লাহির কাফী আল-কোরাইশী ১৯২৪ হইতে ১৯২৯ সাল পর্যন্ত ‘সত্যাগ্রহী’ পত্রিকার সম্পাদক ও ব্যবস্থাপক ছিলেন। সে সময়ও ঐ পত্রিকার মাধ্যমে তিনি এ দেশবাসীকে সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকারের কথা বলিষ্ঠ কণ্ঠে তুলে ধরতেন। অতঃপর তিনি রাজনৈতিক আন্দোলনে বিশেষভাবে জড়িত হয়ে পড়েন এবং ১৯৬২ খৃষ্টাব্দে শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত ইণ্ডিপেণ্ডেন্টে মুসলিম পার্টিতে শরিক হয়ে তাঁর সেক্রেটারীর দায়িত্ব পালন করেন।
মওলানা কাফী এ দেশবাসীকে ইংরেজের নাগপাশ থেকে মুক্ত করার উদ্দেশ্যে ১০৩০ সালে আইন অমান্য আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করে বাংলাদেশে বিশেষ করে উত্তরভঙ্গের বিভিন্ স্থানে জ্বালাময়ী ভাষায় বক্তৃতা করেন। ইংরেজ সরকার তাঁকে মুক্তি দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের অভিযোগ পুনরায় ৬ মাসের জন্য কারাগারে আবদ্ধ করে রাখে।
মওলনা আবদুল্লাহিল কাফী দিল্লীতে অনুষ্ঠিত জাতীয় মুসলিম কনফারেন্সেও যোগদান করেছিলেন। আজাদী আন্দোলনের এই সংগ্রামী নেতা দেশ স্বাধীন হবার পর একে ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য রুগ্ন শরীর নিয়েও আপ্রাণ চেষ্টা করেন। আজাদী উত্তরকালে বরং তার কিছুকাল পূর্ব থেকেই তিনি এই উদ্দেশ্যে পরিবেশ সৃষ্টিকল্পে মসীযুদ্ধের প্রতি অধিক মনোনিবেশ করেন। ১৯৪৯ খৃষ্টাব্দে ঢাকা থেকে তিনি ইসলামী জ্ঞান-গবেষণা সমৃদ্ধ মাসিক ‘তারজুমানুল হাদীস’ প্রকাশ করেন। ১৯৫৭ সালে মওলানা কাফী সাহেব একই স্থান থেকে সাপ্তাহিক আরাফাত প্রকাশ করেন। নানা অসুবিধায় মাসিক ‘তারজুমানুল কোরআনের’ প্রকাশ কিছুদিন যাবত বন্ধ থাকলেও সাপ্তাহিক আরাফাত এখনও মওলানা কাফীর স্মৃতি নিয়ে ইসলামী জ্ঞান-পিপাসুদের খোরাক সরবরাহ করে যাচ্ছে। বার্ধক্যে কঠিন রোগে আক্রান্ত থেকেও অবিভক্ত পাকিস্তানকে শোষণহীন ইসলামী কল্যাণ রাষ্ট্রে পরিণত করা এবং ইসলামী শাসনতন্ত্র রচনার জন্য তিনি কিরূপ উদ্বিগ্ন ছিলেন, প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ আল্লামা রাগবে আহসানের নিম্নোক্ত লেখাটি থেকে তা সুস্পষ্ট হয়ে উঠেঃ
“পাকিস্তান শাসনতন্ত্র কমিশনের প্রশ্নমালা সম্পর্কে পরামর্শ করার জন্য তিনি আমাকে তাঁর দু’জন প্রতিনিধি দ্বারা ডেকে পাঠান। আমি ১৯৬০ খৃষ্টাব্দে তাঁর খেদমতে হাযির হলে তিনি বললেন, পিত্তশূলের বেদনার জন্য যে অপারেশন করেছিলাম, তা বিফল হয়েছে। পিত্তকোষে কোন পাথরের সন্ধান পাওয়া যায়নি। বেদনা আগের মতই বর্ধিত হয়েছে। কিন্তু পাকিস্তানের অবস্থা আমাকে পানি থেকে তীর নিক্ষিপ্ত অসহায় মৎস্যের ন্যায় বিচলিত করে তুলেছে। পাকিস্তানকে একটি সেকুলার ষ্টেটে পরিণত করার যে অপচেষ্টা শুরু হয়েছে, সে দৃশ্য অবলোকন করে আমি কিছুতেই স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে পাচ্ছি না। এখন শাসনতন্ত্র কমিশনের প্রশ্নমালার উত্তর দেয়া একান্ত আবশ্যক। এ ব্যাপারে আমি আপনার পরামর্শ ও সাহায্য কামনা করি। আমি বললাম, বান্দা খেতমতের জন্য প্রস্তুত। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে, এই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে দেশের বিশিষ্ট আলেম এবং চিন্তাশীল সূধীবৃন্দের সঙ্গে পরামর্শ করা উচিত, বিশেষ করে যারা ১৯৫১ এবং ৫৩ সালে করাচীতে অনুষ্ঠিত ওলামা সম্মেলনে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। কাফী সাহেব বললেন, এ ধরনের বৈঠকে দীর্ঘসূত্রতার আশঙ্কা আছে। তবে ঢাকা শহরে অবস্থানরত চিন্তাবিদ ও আলেমগণের তরফ থেকে যদি প্রশ্নমালার উত্তর দেয়া যায় তা হলেই যথেষ্ট বিবেচিত হতে পারে। ২৬শে মে রাত্র ১১টায় শাসনতন্ত্রের বিভিন্ন প্রশ্নের উপর দীর্ঘ আলোচনা চলে। তিনি বেদনার ভাব অনুভব করলেন। তাঁর গায়ে জ্বরও এসে গেছে। তাঁর প্রস্তাবেও সকলের সম্মতিতে আমার উপরই কমিশনের প্রশ্নমালার বিস্তৃত জবাবসহ একটি খসড়া প্রস্তুতির দায়িত্ব অর্পিত হয়। পরবর্তী ৩রা জুন ওলামা ও সুধীবৃন্দের একটি বৈঠকে তা পেশ করতে হবে। মওলানা সাহেব আমাকে বার বার একথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিলেন, ইসলাম ও গণতন্ত্র, দেশ ও মিল্লাত এই উভয় দৃষ্টিকোণ থেকে প্রমাণিত ও যুক্তিসিদ্ধ জবাব লিখতে হবে। আমি অনুরোধ করলাম, এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তিনিও যেন তাঁর লিখনী ধারণ করেন। তিনি অসুস্থতার ওজর দেখালেও শেষ পর্যন্ত নীম রাযি হলেন। আমার নিবেদনে সাড়া দিয়ে তিনি নিজেও প্রশ্নমালার উত্তর লিখতে বসে গেলেন। যদিও সে সময় তাঁর পিত্তশূল ক্রমে বেড়ে চলেছিল। কিন্তু দেখা গেল, মওলানা সাহেব তাঁর শয্যার সঙ্গে সংযুক্ত একটি ক্ষুদ্র টেবিলে কেতাবপত্র সংস্থাপন করে লিখে চলেছেন। ডান হাতে অবিরাম গতিতে কলম চলেছে। বাম হাত বক্ষদেশে বেদনাস্থল চেপে রেখেছে। মাঝে মাঝে বেদনার অনুভূতি যখন সহ্যসীমার বাহিরে চলে যাচ্ছে, তখন হাত দিয়ে ডলা শুরু করেছেন। এভাবে দুই বেদনার প্রতিযোগিতা আরম্ভ হলো।
একদিকে শরীরের অভ্যন্তরে পিত্তবেদনা, অন্যদিকে মিল্লাতের জন্য তাঁর অন্তরবেদনা –দুই বেদনায় তুমুল সংগ্রাম। আল্লাহর মনোনীত বান্দাহ মওলানা কাফীর অটল সংকল্পঃ তিনি তাঁর আরম্ভ কাজ সমাপ্ত করেই উঠবেন –‘মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পতন’। ১লা জুন ১৯৬০ খৃঃ। জমঈতের (আহলে হাদীস) অফিস সেক্রেটারী মৌলভী মীযানুর রহমান বি,এ,বি,টি সাহেব উপরে এসে মওলানা সাহেবকে উপরোক্ত অবস্থায় দেখে আরয করলেনঃ হযরত নিজের শরীরের উপর রহম করুন। নিজের স্বাস্থ্যের দিকে একটু খেয়াল দিন! ডাক্তারের কড়া নির্দেশ –শরীরকে আরাম দিতে হবে। মওলানা সাহেব উত্তর করলেনঃ আপনাদের মুখে ঐ কথা –স্বাস্থ্য; কিন্তু আমি স্বাস্থ্যের নি নজর দিব, এখন আমার জ্ঞানের একই ও কোন পরওয়া নাই। সমস্তই পাকিস্তান ও ইসলামের জন্য উৎসর্গীকৃত। এখন আপনি যান। নিচে গিয়ে দফতরের কাজ দেখুন, আমাকে আমার কাজ করতে দিন”।
এই বলে আগের অবস্থায়ই …. কমিশনের ৪০টি প্রশ্নের মধ্যে ৩৮টি জবাব লিকার পর একদম অবশ ও নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়লেন। বেদনায় তীব্রতায় অনুভূতিহীন ও শক্তিহারা অবস্থায় মেঝের উপর স্থাপিত পালঙ্কে নিপতিত হলের আর এই পড়াই তাঁর শেষ পড়া”।
১৯৬০ সালের ৩রা জুনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের আগ পর্যন্ত ইসলামী শাসনতন্ত্র, পাকিস্তান ও মুসলিম মিল্লাতের চিন্তা মওলানা আবদুল্লাহিল কাফির সমগ্র সত্তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। মওলানা রাগেব আহসান তাঁর লেখাটির শিরোনাম এজন্যই দিয়েছিলেন –‘হযরত আল্লামা কাফীর শাহাদাত কাহিনী’। সত্যই তিনি ইসলাম, পাকিস্তান ও মুসলিম জাতির জন্য নিজের স্বাস্থ্যকে বিলীন করে শাহাদাদের অমিয় সুধাই পান করেছিলেন।
যা হোক, এভাবে উপমহাদেশের আলেম সমাজ বহু ত্যাগ ও ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে ভারত-বিভাগ পর্যণ্ত অব্যাহতভাবে আজাদী আন্দোলন চালিয়ে যান। অতঃপর ১৯৪৭ সালের ১৪ আগষ্ট ভারত বিভাগের মধ্য দিয়ে উপমহাদেশের অধিবাসীগণ দীর্ঘ দু’শো বছরের গোলামীর জিঞ্জির থেকে মুক্তি পায়। আজ তারা নিজের স্বাধীন আবাস ভূমিকে ইসলামী মূল্যবোধে গড়ে তোলার কাজে নিয়োজিত। পাক-ভারতের আজাদী আন্দোলনে আলেম সমাজের এই দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের কথা মুসলমানরা তো নয়ই এমনকি এ দেশের অমুসলমানরাও যদি ভুলে যায়, তা হলে পৃথিবীর ইতিহাসে এটা হবে এক চরম অকৃতজ্ঞতা।