আজাদী আন্দোলনঃ মওলানা মওদূদী ও জামায়াতে ইসলামী
একটি পর্যালোচনাঃ ইতিপূর্বেকার আলোচনায় একথা সুস্পষ্ট হয়ে গিয়েছে যে, শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভীর চিন্তাধারাকে কেন্দ্র করে পাক-ভারত উপমহাদেশ ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাকল্পে এ পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী বাতিল শক্তিসমূহের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার জন্যে শাহ আবদুল আযীযের প্রচেষ্টায় যে ইসলামী আন্দোলন দানা বেঁধে উঠেছিল, তারই ফলশ্রুতি হিসাবে পরিচালিত হয়েছিল ১৯৩১ সালের বালাকোট যুদ্ধ ও ১৮৫৭ সালের জাতীয় বিপ্লব; আর সে বিপ্লব ব্যর্থ হবার পরই ওয়ালিউল্লাহ আন্দোলনের পরবর্তী কর্মীবৃন্দের প্রচেষ্টায় ইসলাশী আন্দোলনের কেন্দ্র হিসাবে প্রায় দশ বছর পর ১৮৬৭ সালে দারুল উলুম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু যে মুহুর্তে উপরোল্লিখিত মহৎ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে এ প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়েছিল, তার কয়েক বছর পর দারুল উলুমের প্রতিষ্ঠাতা মওলানা কাসেম নানতুবীরই সহপাঠী স্যঅর সাইয়েদ আহমদের প্রচেষ্টায় আরেক দৃষ্টিকোণ থেকে ১৮৭৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়। দারুল উলুম দেওবন্দের ভূমিকা যেখানে ছিল ইসলামী ভাবধারার বিকাশ দান ও ইংরেজ উচ্ছেদের মাধ্যমে এদেশে ইসলামী হৃত মর্যাদা পুনঃ প্রতিষ্ঠা করা, সে ক্ষেত্রে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হলো ইংরেজদের ভাষা শিক্ষা করে রাষ্ট্রীয় কায়কারবারে অংশ গ্রহণের যোগ্যতা অর্জন এবং যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আগে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা ও কাঁটা দিয়ে কাঁটা উঠাবার অভিপ্রায় নিয়ে। অবশ্য তাতে ইসলামী শিক্ষার ব্যবস্থঅও রাখা হয়েছিল।
কিন্তু আলিগড়ের প্রতিষ্ঠাতা স্যার সাইয়েদ আহমদ তৎকালীন সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রতি লক্ষ্য করে উপরোক্ত উদ্দেশ্য এই কর্মপন্থা অবলম্বন করলেও তিনি হয়তো একথা চিন্তা করেননি যে, তাঁর প্রতিষ্ঠানে মুসলিম স্বকীয়তাবোধের চেতনা আশানুরূপ বহাল থাকবেনা। এখানকার শিক্ষিতদের দ্বারা আজাদী আসলেও ইসলাম আসা কঠিন হবে। উপমহাদেশের মুসলমানগণ এযাবত যেই সংগ্রামী ভূমিকা পালন করে এসেছে, তাতে তাঁর অনুসৃত নীতির ফলে পরবর্তী পর্যায়ে এক শ্রেণীর পরাজিত মনোভাবের মুসলমান সৃষ্টি হবে, যারা ভোগবাদী পশ্চিমের মতবাদের কাছে সহজেই নতি স্বীকার করে বসবে আর বালাকোটের ইসলামী প্রেরণা সম্মুখীন হবে বিরাট চ্যালেঞ্জের। কেননা, মুসলমান একটি ইসলামী আদর্শিক জাতি; আর কোনো আদর্শিখ বল বা জাতি যদি অপর জাতির জীবন বোধ ও শিক্ষা-সংস্কৃতির প্রতি অভিভূত হয়ে পড়ে এবং নিজেদের স্বকীয়তাবোধ হ্রাস পেতে থাকে, তাহলে তারা ভীরুতা, হীনমন্যতা ও বৈপরীত্যের শিকার হয়ে পড়ে। তাই এ ক্ষেত্রেও তার ব্যভ্যয় ঘটেনি। বিশেষ করে ইংরেজরা যেখানে ভারতের নিরংকুশ ক্ষমতার অধিকারী হবার পর থেকেই শিক্ষা-সংস্কৃতি নানান দিক থেকে এদেশের মুসলমানদের চিন্তাধারায় পাশ্চাত্য সভ্যতা, শিক্ষা-সংস্কৃতি ও ভাবধারার ছাপ বসানোর পরিকল্পনায় লিপ্ত ছিলো, যেখানে তাদের পরিকল্পনা হলো –এদেশের সংগ্রামী জাতি মুসলমানদের বশে আনার জন্য এমন ধর্ম-নিরপেক্ষ শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করতে হবে, যাতে মুসলমানরা বর্ণ ও আকৃতিতে ভারতীয় থাকলেও মনের দিক দিয়ে সম্পূর্ণ ইংরেজ-মানসিকতা সম্পন্ন হয়ে গড়ে উঠবে, সেক্ষেত্রে ধর্মনিরপেক্ষ আধুনিক শিক্ষিতদের পেয়েতো তারা খুশীতে আত্মহারা। কেননা, এদের মাধ্যমে সম্পূর্ণ ইংরেজভক্ত না হলেও অন্ততঃ কিছু কিছু নমনীয় মনোভাবের মুসলমানতো এদেশে সৃষি।ট হবেই। আর ইংরেজদের এ নীতি কেবর অবিভক্ত ভারতেই নয় গোটা পরাধীন মুসলিম বিশ্বেই তারা একইন নীতির অনুসরণ করে চলেছিল। তারই পরিণতি হিসেবে আজ বাংলা-পাক-ভারত উপমহাদেশসহ মুসলিম বিশ্বের সর্বত্রই নিজেদের কৃষ্টি-সংস্কৃতি ও গৌরবময় ঐতিহ্যের প্রতি উন্নাসিক এক শ্রেণীর পরাজিত মনোভাব সম্পন্ন শিক্ষিত মুসলমানের অস্তিত্ব দেখতে পাওয়া যায়। তারা ইসলামের শাশ্বত সুন্দর কৃষ্টি সভ্যতা ও জীবনাদর্শকে বাদ দিয়ে আমেরিকা-ইউরোপের বস্তুবাদী, মানবতাবিধ্বংসী, প্রাণহীন, শুষ্ক, উচ্ছৃংখল নগ্ন সভ্যতার কাছে পদে পদে নতি স্বীকার করছে। ইংরেজ প্রভুদের বিদায়ের পর পাশ্চাত্যের এইসব ভক্তবৃন্দ মুসিলম বিশ্বের ক্ষমতায় সমাসীন হয়ে স্থানীয় মুসলমানদের বিশ্বাসে আঘাত হেনে চলেছে। তাদের ধ্যান-ধারনা ও জীবনধারার ব্যতিক্রম সম্পূর্ণ বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে দেশের শিক্ষা-সংস্কৃতি ও রাজনীতি পরিচালনা করছে। মুসলিম মিল্লাতকে আজ তারা এভাবেই বিপদের মুখোমুখি এনে দাঁড় করিয়েছে। তবে বাংলা-পাক-ভারতের ব্যাপারে কিছুটা রক্ষা এই যে, এখানে স্যার সাইয়েদের উপরোক্ত ভূমিকার পাশাপাশি দেওবন্দ আনেদালন সক্রিয় ছিলো। তাই আলীগড়ে শিক্ষা লাভের পরও দেখাগেছে যে, অনেকে দেওবন্দের সংগ্রামী আলেমদের কাতারে গিয়ে আন্দোলনে শরীক হয়েছিলেন, যাদেরকে পানি হজম করতে ইংরেজী কৃষ্টি-সংস্কৃতি। অন্যথায় এখানে মুসলিম জাতীয়তাবোধের যে কি পরিণতি ঘটতো তা একমাত্র আল্লাহই জানেন।
এভাবে একদিকে দারুল উলুম দেওবন্দ ও অপরদিকে আলীগড় মুসলমানদের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা সৃষ্টি করে যা। মূলতঃ সে সময় থেকেই বাংলা-পাক-ভারত উপমহাদেশে মুসলিম মিল্লাতের মধ্য থেকে পাশ্চাত্য ধ্যান-ধারণা ও চিন্তাধারা সম্পন্ন এক শ্রেণীর শিক্ষিত লোকের সৃষ্টি হতে থাকে। তারা আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে ইংরেজ সরকারের অধীনে রাষ্ট্রীয় কায়কারবারে অংশ নিয়ে অপেক্ষাকৃত আরামে জীবন-যাপন করতে থাকে আর ইংরেজী শিক্ষায় ধর্মহীন পরিণতিতে তাদের সভ্যতা-সংস্কৃতির মোহগ্রস্থ হয়ে পড়ে। অপরদিকে, আলেম সমাজ আপোষহীনভাবে তাঁদের সংগ্রামী ভূমিকার উপর অটল থাকেন এবং শাহ আবদুল আযীযের ইংরেজ বিরোধী ভাব জাগ্রত রাখেন, অপরদিকে নৈতিকতা, সমাজ সেবা, ইসলামী শিক্ষা-সংস্কৃতি ও মূল্যবোধকে টিকিয়ে রাখার লক্ষ্যে স্থানে স্থানে মাদ্রাসা-মসজিদ স্থাপন করেন। অনাহরে-অর্ধাহারে থেকে চরম দারিদ্রপীড়ায় জর্জরিত হয়ে তারা দেশ ও সমাজের কাজে নিয়োজিত থাকেন। দেশ, জাতি ও জাতীয় আদর্শকে রক্ষাকল্পে উপমহাদেশের আলেমদের এই ত্যাগ ও তিতিক্ষার নযীর ইতিহাসে অতি বিরল।
সব চাইতে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে এই যে, ইসলাম ও মুসলমানদের এই মহাপরীক্ষার দিনে কঠোর দারিদ্রের সম্মুখী হয়েও আলেম সমাজ মুসলিম জাতির দুশমন ইংরেজ সরকারের নিকট কোনোদিন অর্থের জন্যে হাত পাতেননি, যা কিছু করেছেন মুসলমানদের সাহায্য-সহানুভূতিতেই করেছেন। এমনকি বড় বড় ইংরেজ কর্তৃত্বশালীরা যখন স্বেচ্ছায় অর্থদানের উদ্দেশ্যে দারুল উলুম দেওবন্দ ও এর শাখা প্রতিষ্ঠানগুলোতে গিয়ে কর্তৃপক্ষের নিকট প্রস্তাব দিয়েছেন, সে সময়ও দেখা গেছে যে, তাদের অর্থ গ্রহণতো দূরের কতা বরং আত্ম মর্যাদাবোধ-সম্পন্ন মহাপ্রাণ আলেমগণ কিতাব পড়ানো বাদ দিয়ে দাঁড়িয়ে তাদের সম্মান করাকেও ঘৃণার চোখে দেখেছেন। ইংরেজদের প্রতি তাঁরা কিরূপ ভীতশ্রদ্ধ ছিলেন, এ থেকেই তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। এভাবে ইংরেজদের ভাষা, কৃষ্টি-সভ্যতা, সংস্কৃতি সকল কিছুর বিরুদ্ধেই জাতীয় মর্যাদাবোধ সম্পন্ন এ সব সংগ্রামী আলেমের মধ্যে প্রচণ্ড ঘৃণার ভাব বিদ্যমান থাকে। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, জাতির এহেন নিঃস্বার্থ সেবকরাই পরবর্তী পর্যায়ে গিয়ে ইংরেজ মানস সন্তানদের ভাষায় আখ্যায়িত হলেন ‘মোল্লা’ হিসেবে আর তাঁরা নিজেরা সাজলেন ‘মিষ্টার’। উল্লেখ্য, অনেকে এই সেদিন পর্যন্তও –“আলেমরা ইংরেজী শিখতে নিষেধ করে মুসলমানদের সর্বনাশ করেছে” –এই বলে সাধারণ সমাজের কাছে তাঁদের হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করতো।
অথচ আসল ব্যাপার ছিল এইযে, ইংরেজরা যখন মুসলমানদেরকে শিক্ষার মাধ্যমে তাদের সভ্যতা-সংস্কৃতি ও জীবন দর্শনের গোলামে পরিণত করার হীন ষড়যন্ত্র চালাচ্ছিল, তখন জাতীয় আত্মমর্যাদাসম্পন্ন তৎকালীন আলেম সমাজ ও জাতিকে তাদের মারাত্মক ষড়যন্ত্র সম্পর্কে হুঁশিয়ার করে দিয়েছিলেন আর সেটাকেই এক শ্রেণীল তথাকথিত শিক্ষিত লোক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ভিন্নরূপ ‘কালার’ দিয়ে প্রচারণা চালায়। আলেম সমাজ তাঁদের এই স্বকীয়তা ও জাতীয় মর্যাদাবোধের জন্যে যেখানে ধন্যবাদ পাবার যোগ্য ছিলেন, সেক্ষেত্রে উল্টো তাঁদেরকে অভিযুক্ত করা হলেও একথা আজ প্রমাণিত হয়ে গেছে যে, মুসলিম জাতির অধঃপতনের মূল কারণই ছিল ঐ ‘স্নো পয়জন’টি। আলেমদের ন্যায় গোটা মুসলিম জাতি নিজেদের স্বকীয়তাবোধ নিয়ে সেদিন অটল থাকতে পারলে এবং ইংরেজী সভ্যতা-সংস্কৃতির সয়লাভে ভেসে না গেলে একটি আদর্শিক জাতি হিসেবে মুসলমানদের অস্তিত্ব কিছুতেই আজকের এই চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতো না। আলেমগণ সেদিন একথাই বলেছিলেন যে –ইংরেজদের গোলামী করে তাদেরকে টিকিয়ে রাখার নিয়তে ইংরেজী শিক্ষা করা ঠিক নয়, তবে কাঁটা দিয়ে কাঁটা উঠাবার মনোভাব নিয়ে কেউ যদি ইংরেজদেরকে এদেশ থেকে তাড়ানো ও ইসলামী শিক্ষা আদর্শের বিকাশার্থে ইংরেজী ভাষা শিক্ষা করে, সেটা দোষের কিছু নয়। কিন্তু তাদের এই ভূমিকার কদর্য করা হলো। সময়ের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পরিত্যক্ত ইংরেজী ভাষাকে পুনরায় যদি মুসলমানদের জন্য জরুরী মনে করাকে একটি দূরদর্শিতার কাজ ধরা যায় এই বিরাট কাজটিও করে ছিলেন মূলতঃ আলেমরাই। কারণ, যেই স্যার সাইয়েদ আহমদ এবং সাইয়েদ আমীর আলী ও নবাব আব্দুল লতিফ মুসলমানদেরকে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ইংরেজী শিখতে উদ্ধুদ্ধ করেছিলেন তারাও মাদ্রাসাপাশ আলেমই ছিলেন। আলেম সমাজ পাইকারীভাবে অভিযুক্ত হলে; যদিও ৫০-এর দশকে দেশীয় ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠাকল্পে ইংরেজী সাইনবোর্ড ভাঙ্গার মধ্য দিয়ে আমাদের যুব সমাজ শতাব্দীকাল ধরে আলেমদের অনুসৃত সেই সত্য উপলব্ধির বাস্তব প্রমাণ দিল।
যা হোক, দেওবন্দ ও আলিগড় –এই উভয় প্রতিষ্ঠানের কাজ পাশাপাশি চলতে থাকে। একটি ইংরেজতের প্রতি নমনীয় ভূমিকায়, অপরটি তাদের রক্তচক্ষুর কড়া পাহারায়। দারুল উলুম দেওবন্দকে ইংরেজরা নানানভাবে কোণঠাসা রাখাতে সচেষ্ট ছিল। এজন্য এই প্রতিষ্ঠানটিকে নানা ঘাত-প্রতিঘাত, বাধা-প্রতিবন্ধকতা ও আগাতের পর আঘাত সামলিয়ে সতর্কতার সহিত সম্মুখে অগ্রসর হতে হয়েছিল, যার ফলে সম্পূর্ণ প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে কাজ করতে করতে এ প্রতিষ্ঠানটিকে শেষ পর্যণ্ত নিজের অলক্ষ্যেই তার প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্য থেকে অনেকটা পিছু হটতে হলো। বালাকোটের পূণাঙ্গ ভাবধারাকে সময়োপযোগী করে সম্মুখে অগ্রসর করার পরিবর্তে সে কোন মতে একে টিকিয়ে রাখার কাজেই নিজেকে ব্যস্ত রাখলো।
আজাদী আন্দোলনের শেষ পর্যায়ে দেওব্ন্দী কর্মীদের যে সংগ্রাম আমরা দেখতে পাই, সেটা বালাকোট আন্দোলনের অংশ ছির বটে সন্দেহ নেই, কিন্তু ধর্মীয়, রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিকূলতার দরুণ দারুল উলুম দেওবন্দ মওলানা মাহমুদুল হাসানের পরে এমন এক পর্যায়ে গিয়ে উপনীত হয় যে, সে বালাকোট আন্দোলনের মূল প্রেরণার উৎস শাহ ওয়ালিউল্লাহর বৈপ্লবিক চিন্তাধারাকে সর্বাঙ্গীনভাবে আঁকড়ে ধরে রাখতে সক্ষম হয়নি। ফলে এ প্রতিষ্ঠানটির শেষ পর্যায়ে শিক্ষানীতির দিক থেকে সাধারণ ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পর্যায়ে নেমে আসলো। উপমহাদেশের সকল দ্বীনি শিক্ষার পাদপীঠ এই প্রতিষ্ঠান ও এরশাখা প্রশাখা সবগুলো মূলতঃ ইসলামের আনুষ্ঠানিক এবাদত সমূহের শিক্ষাদান কেন্দ্র হিসাবেই কাজ করতে থাকলো। “ইকামতে দ্বীন” “ইজহারে দ্বীন” ও “তা’সীসে খেলাফতে ইসলামিয়া”র ভাব গৌন হয়ে গেল। ইসলামী অর্থনীতি, রাজনীতির আলোকে সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের অনুভূতি ও প্রেরণা এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অনুসৃত শিক্ষানীতিতে এক রকম অনুপস্থিত হয়ে পড়ে। এমন কি পরিস্থিতির এতটুকু পর্যন্ত অবনতি ঘটল যে, অনেক বড় বড় খ্যাতনামা আলেমের মধ্যেও আধুনিক যুগ-সমস্যার মোকাবেলায় একটি ইসলামী রাষ্ট্রের রূপরেখার ধারনা অনুপস্থিত ছিল। তাঁরা মনে করতেন, রাষ্ট্র পরিচালনার সামগ্রিক দায়িত্বতো পালন করবেন অন্যেরা, আলেমতের তো প্রশ্নই ওঠে না। কেননা, দ্বীনি চিন্তায় বিভ্রাটের দরুণ এবং মাদ্রাসাগুলোর শিক্ষানীতির ভ্রান্তির ফলে এ সব প্রতিষ্ঠানে এ সব প্রতিষ্ঠানে দীর্ঘ দিন যাবত ওসুল-ফিকাহ সহ অসংখ্য কিতাব, হাদীস তাফসীর ও কোরআন মজীদ অধ্যয়নের পরেও তাদের মধ্যে এ ধারণাই বদ্ধমূল থাকতো যে, ইসলাম কেবল মসজিদের চার দেওয়াল, মাদ্রাসা, খানকাহ তথা নামায-রোযা, হজ্জ-যাকাত, যিকির-আযকার এ কয়টির মধ্যেই সীমাবদ্ধ, এর সঙ্গে আবার এসেম্বলী, রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজ বিজ্ঞানের কি সম্পর্ক? অথচ সমাজকে যথার্থ ইসলামী সমাজে পরিণত করতে হলে, সমাজ গঠনের প্রধান ৫টি বিভাগ নিয়ন্ত্রণে আনা না হলে তা কিছুতেই সম্ভব নয়।
(১) রাষ্ট্রীয় আইন, (২) শিক্ষা ব্যবস্থা (৩) প্রচার মাধ্যম (৪) সামরিক ব্যবস্থা (৫) অর্থ ব্যবস্থা –এসব বিভাগ আবু জাহল আবু লাহাবদের হাতে তুলে দিয়ে যারা রাজনীতি নিরপেক্ষ ইসলাম কায়েম করতে চায়, এর সাথে মহানবীর ইসলামের যেমন সম্পর্ক নেই তেমনি তাতে ইসলামের লক্ষ্য অর্জনও সম্ভব নয়। ৫ ইঞ্চি পাইপ দিয়ে ময়লা ছড়ানো হলে কোয়াটার ইঞ্চি পাইপ দিয়ে আতর ছিটানোতে কখনও দুর্গন্ধ দূর করা সম্ভব নয়। এ জন্যে আগে ৫ ইঞ্চি পাইপের উৎস মুখ বন্ধ করতে হবে। এক কথায়, ইসলাম যে একটি স্বয়ং-সম্পূর্ণ পরিপূর্ণ জীবনবিধান এবং যেকোন রাষ্ট্রে এর বিধি-ব্যবস্থা সর্বত্র চালু করলে একটি শোষণহীন শান্তিপূর্ণ সমাজ কায়েশ হতে পারে –এ ধারণাটিই তাদের মধ্য থেকে এক রকম লেপ পেয়ে গিয়েছিল। আর রোপ যে পেয়েছে তার বড় প্রমাণ হচ্ছে আমাদের দেশের বর্তমান রাজনৈতিক ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় যোগ্য ওলামা নেতৃত্বের অভাব। অন্যথায়, গত কয়েক দশকে এ দেশের মাদ্রাসাগুলো থেকে কম আলেম বের হয়েছে কি? ইসলামী শিক্ষার মূল লক্ষ্য ও ভাবধারার সঠিক অনুভূতি ও সে অনুযায়ী শিক্ষাদান ও শিক্ষালাভের অভাবেই এহেন পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে। পক্ষান্তরে মাদ্রাসায় না পড়েও কিছু লোকের মধ্যে সেই ভাবধারা সৃষ্টির ফলে তারা ইসলামী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
এভাবে দেখা যায়, একদিকে ধর্মীয় চিন্তার এই অবস্থা, অপরদিকে দুশো বছর স্থায়ী ইংরেজ প্রভুত্বের প্রবাবে উনিশ শতকের দিকে মুসলমানরা ক্রমে ইংরেজী শিক্ষা-সংস্কৃতি ও সভ্যতার নিগড়ে আষ্টেপিষ্ঠে জড়িয়ে পড়ে। পাশ্চাত্য সভ্যতার চাকচিক্যে মুগ্ধ হয়ে কেউ ধর্মনিরপেক্ষতা, কেউ কম্যুনিজম, কেউ প্রকৃতিবাদ, কেউ খৃষ্টানিজম, কেউ হীনমন্যতা, কেউ যুক্ত-জাতীয়তাবাদ প্রভৃতি ভ্রান্ত মতাদর্শের শিকারে পরিণত হয়। কিছু কিছু আলেমও এ বিভ্রান্তিতে নিপতিত হন। তাদের দু’এক জন পরোক্ষভাবে রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ কম্যুনিজমের অর্থ ব্যবস্থার গোলক ধাঁধাঁও পড়েছিলেন, আবার উল্লেখযোগ্য অংশতো নিজেদের অলক্ষেই হিন্দু-মুসলিম যুক্ত-জাতীয়তার সমর্থনে রীতিমতো আন্দোলনই করেছেন।
এক কথায়, মুসলিম সমাজ আদর্শচ্যুত গভীর খন্দকের প্রতি দ্রুত এগিয়ে চলছিলো। সকলেই জীবনকে নিছক বৈষয়িক উন্নতি ও জীবিকা সংগ্রহের উদ্দেশ্যে ইংরেজী শিক্ষা ও ভাবধারার প্রতি ঝাঁপিয়ে পড়ছিলো। স্কুল-কলেজের শিক্ষার দিকে অধিকাংশ মুসলমান মনোযোগী হয়ে পড়লো এবং সে অনুপাতে জীবন গঠনকেই গর্ব মনে করতে লাগলো। মাদ্রাসাগুলো কোনো প্রকারে ইসলামের নিভু নিভু আলোটুকু তখনকার মতো জ্বালিয়ে রাখলো। অপরদিকে তাঁর পাশাপাশি আজাদী আন্দোলনতো অব্যাহত আছেই।
এগিয়ে এলেন বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াইর মহান সিপাহসালার
কিন্তু তখন যে বিরাট জিজ্ঞাসা দেখা দিয়েছিল তা হলো, দেশ আজাদ হলেও ধর্মীয়, সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, সাংস্কৃতিক ও নৈতিক দিক থেকে পাশ্চাত্যের বিপরীতমুখী এসব ভ্রান্ত দর্শন ও চিন্তার শতমুখী সয়লাব থেকে মুসলমানদেরকে রক্ষা করবে কে? আল্লাহর অসীম অনুগ্রহে ঠিক ঐ সময়ই বর্তমান বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম ইসলামী চিন্তানায়ক, চিশতিয়া তারিকার প্রবর্তনকারী খান্দানের উজ্জ্বল তারকা, আওলাদে রসূল মহামনীষী হযরত মওলানা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী আত্মপ্রকাশ করেন। মওলানা মওদূদী (রহ) ছিলেন তাঁর সমকালীন বিশ্বের মুসলিম মিল্লাতবিরোধী পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদী শিবির ও কম্যুনিষ্ট শিবিরের বড় আতঙ্ক। ইসলামের পক্ষে পাশ্চাত্য সভ্যতা, শিক্ষা-সংস্কৃতি ও যাবতীয় ভ্রান্ত দর্শন মতবাদের জন্যে প্রচণ্ড এক চ্যালেঞ্জস্বরূপ।
মাওলানা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী ১৭ বছর বয়সে বড় ভাইয়ের সঙ্গে সাংবাদিকতার মাধ্যমে তাঁর কর্ম জীবনের সূচনা করেন। মাত্র ২০ বছর বয়সের সময় প্রথমে জব্বল পুরের ‘তাজ’ পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেন। তারপর তিনি দিল্লীর বিখ্যাত আল-জমিয়ত পত্রিকায়ও কিছুদিন সম্পাদনা কাজ করেছিলেন। ১৯২৮ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি বিভিন্ন পত্রিকার সম্পাদনা কাজে ব্যাপৃত থাকেন। ১৯২৯ সনে তাঁর বিখ্যাত গবেষণামূলক গ্রন্থ ‘আল-জিহাদ ফিল ইসলাম’ প্রণয়ন করেন। ১৯৩২ সালে ইসলামী রেনেসাঁ আন্দোলনের মুখপত্র হিসাবে তাঁর মাসিক ‘তারজুমানুল কুরআন’ দাক্ষিণাত্যের হায়দারাবাদ শহর থেকে প্রকাশ পেতে থাকে। এই পত্রিকার মাধ্যমেই মওলামা মওদূদী উল্লেখিত পরিস্থিতির পটভূমিতে নানামুখী সমস্যার আবর্তে বিভ্রান্ত উপমহাদেশের মুসলমানদের অতীত, বর্তমান নিয়ে গভীর পর্যালোচনা করেন এবং তাদের ধর্মীয়, রাজনৈতিক, চিন্তাগত সকল বিষয়ের ভবিষ্যত কর্মসূচী নির্দেশ করেন।
বালাকোটের জেহাদের পর মোজাহেদ আন্দোলন যখন বিভিন্ন প্রতিকূলতার দরুণ ধীরে ধীরে স্তিমিত হতে থাকে, তখন দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ওলামায়ে কেরাম শিক্ষার ক্ষেত্রে ইসলামী ধারাকে সঞ্জীবিত রেখে মুসলিম জাতির মনে কিছুটা আশার সঞ্চার করতে সক্ষম হন বটে, কিন্তু ইসলামকে একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য সর্বাত্মক আন্দোলন পরিচালনা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠেনি। তাই ধীরে ধীরে মুসলিম জাতির মনে জীবনের সর্বক্ষেত্রে সামাজিক, নৈতিক, রাষ্ট্রীক, অর্থনৈতিক ইত্যাদি ক্ষেত্রে নৈরাশ্য ভাসা বাঁধতে থাকে এবং এই সুযোগে পাশ্চাত্য চিন্তা-ভাবধারা আমাদের শিক্ষা সংস্কৃতি তথা জীবনের সর্বস্তরে প্রভাব বিস্তারের সুযোগ পায়। মওলানা মওদূদী তখন প্রাচীন, আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান ও পাশ্চাত্য মতবাদসমূহ হজম করে আদর্শিক দ্বন্দ্ব সংঘাতের বুদ্ধিবৃত্তিক নতুন হাতিয়ারে সজ্জিত হয়ে ময়দানে অবতীর্ণ হন। তাঁর সমগ্র চিন্তা গবেষণা অনৈসলামিক প্রভাবের মূলে চরম কুঠারাঘাত হানতে থাকে। এভাবে তাঁর যুক্তি ও চিন্তা-গবেষণামূলক দিক-নির্দেশনা জাতিকে নৈরাশ্যের অন্ধকার আবর্ত থেকে আলোর রাজপথ দেখাতে থাকে, যার প্রভাব আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে গিয়ে পড়ে।
মওলানা মওদূদীর প্রথম দিকের কাজ ছিল গবেষণা পর্যায়ের
প্রথম দিকে তাঁর কাজ ছিল গবেষণার পর্যায়ে। তিনি ঐ সময় ধর্মীয় চিন্তার পুনর্গঠনের মাধ্যমে সত্যকার ইসলামী রেনেসাঁ সৃষ্টির কর্মসূচী ও ফরমূলা তৈরীতে ব্যস্ত ছিলেন। এ জন্যে প্রথমেই তিনি তওহীদের মূলমন্ত্রের প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টি করে মুসলমানদের মন-মগজ থেকে ইংরেজ বা যেকোনো শক্তির প্রাধান্যের ভাব দূরীভূত করার চেষ্টা করেন এবং মুসলমানদের পতনের মূল কারণসমূহ দার্শনিক যুক্তিতর্ক সহকারে ব্যাখ্যা করে তাদের মধ্য থেকে হীনমন্যথার ভাব দূর করার চেষ্টা করেন। আব্বাসীয় শাসনামলে বিজাতীয় গ্রীক চিন্তাধারা মুসলমানদের যেমন হীনমনা করে তুলেছিল আর আবুল হাসান আশয়ারী ও ইমাম গাযযালী প্রমুখের শাণিত যুক্তি সেগুলোকে খান খান করে দিয়ে মুসলিম জাতিকে রক্ষা করেছিল, মওলানা মওদূদী (রহ) দ্বীনি চিন্তার পুনর্গঠন করেছিলেন এবং যাবতীয় চিন্তাগন আবিলতাকে সরিয়ে দিয়ে আধুনিক কায়দায় ইসলামী রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজনীতির উজ্জ্বল কাঠামো ও রূপরেখাসমূহ তুলে ধরেছিলেন, তেমনিভাবে মওলানা মওদূদীও সর্বপ্রথম পাশ্চাত্য সভ্যতার যাবতীয় দর্শন ও চিন্তা-ভাবধারার কাঁটাঝাড়া সমালোচনা করে মানব কল্যাণে সেগুলোর অসারতা ও ব্যর্থতা বলিষ্ঠ যুক্তি-প্রমাণ দ্বারা প্রমাণিত করেন। ইসলামকে একটি বিজয়ী, সর্বকালের উপযোগী জীবন বিধান হিসেবে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক যাবতীয় সমস্যা সমাধানের সুষ্ঠু মাধ্যম ও মানবজাতির জন্যে একমাত্র মুক্তিসনদ রূপে সমাজের কাছে তিনি তুলে ধরেন। ইসলামী দর্শন, ইসলামী রাজনীতি ও অর্থনীতি সম্পর্কীয় তাঁর ক্ষুরধার লেখনী কেবল উপমহাদেশ ও মুসলিম বিশ্বেই নয় বরং গোটা দুনিয়ায় আলোড়ন সৃষ্টি করে। এ কারণেই বর্তমান বিশ্বের অমুসলিম দু’টি মোড়ল শক্তি পুঁজিবাদ ও কম্যুনিষ্ট শিবিরদ্বয়ের স্থানীয় এজেন্টরা মওলানা মওদূদীর বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারণায় লিপ্ত হয়। মুসলিম সমাজে তাঁকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্যে উঠে-পড়ে লাগে। এদেশের মুসলমান সামগ্রিকভাবে মওলানা মওদূদীকে চিনতে না পারলেও ঐ সকল ইসলাম বিরোধী মহল বুঝতে পারে যে, তারা নিজেরা যেখানে কেউ বসউতবাদী এবং ভৌগোলিক জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতার শ্লোগান তুলে, কেউ মার্কস, লেলিন, স্টালীন ও মাও-সে-তুংগের ভ্রান্ত চিন্তাধারায় নিজ নিজ জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে মুসলমান ও অন্যান্য ক্ষুদ্র জাতির উপর কর্তৃত্ব চালাচ্ছে, তেমনিভাবে মওলানা মওদূদীর বৈপ্লবিক চিন্তাধারাকেও কেন্দ্র করে যদি মুসলিম জাহান আরেবার গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে, তা হলে তাদের মোড়লীর আসন কেঁপে উঠবে। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, ইসলামের আন্তর্জাতিক বৈরী শক্তিরাতো তাঁর বিরুদ্ধে কাজ করছেই, পরন্তু সূক্ষ্মভাবে রাজনীতি নিরপেক্ষ ধর্মমতের অনুসারী কিছু আলেম-পীরও না বুঝেই তার বিরোধিতায় লাগেন, যদিও নবী মুহাম্মদ (স) –এর দ্বীন ও আমাদের খোলাফা-এ-রাশেদীনের দ্বীন রাজনীতি নিরপেক্ষ নয়।
বিশ শতকের শুরুতে মওলানা মওদূদী মুসলমানদের চিন্তার পুনর্গঠন ও পরিশুদ্ধির কর্মনীতির সঙ্গে সঙ্গে যেসব সামাজিক সমস্যার আঘাতে জাতি জর্জরিত হয়ে পড়েছিল, সেগুলো সম্পর্কে মুসলমানদের সতর্ক কর তোলেন। যে-সব বিকৃতি জাতির রাজনৈতিক সংগ্রামকে দুর্বল করে দিচ্ছিলো, সেগুলোর দিকেও তিনি আঙ্গুলি নির্দেশ করেন। সর্বোপরি যে বিশিষ্ট ধারায় জাতির সামাজিক আন্দোলন ও কর্মপ্রচেষ্টাকে সংহত করে আজাদী ও ইসলাম উভয়কেই এক সাথে অর্জন করা যেতে পারে, সে ধারাটিকেও তিনি স্পষ্টতর করে তোলেন। এ জাতীয় প্রবদ্ধ মওলানা মওদূদী ১৯৩৬ সালে লিখতে শুরু করেন এবং তাঁর সম্পাদিত মাসিক “তারজুমানুল কোরআন” পত্রিকায় ১৯৩৬ থেকে ১৯৩৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত এগুলো আত্মপ্রকাশ করতে থাকে। অতঃপর সেগুলো “মুসলমান আওর মওজুদা সিয়াসী কাশমকাশ” –মুসলমান ও বর্তমান রাজনৈতিক সংগঠন –নামে দুখণ্ডে প্রকাশিত হয়। এসব প্রবদ্ধ সমকালীন মুসলিম জাতিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে, অখণ্ড জাতীয়তার ধারনাকে খণ্ডন করে এবং ইসলামী জাতীয়তার চেতনাকে দৃঢ়তর করে একে একটি রাজনৈতিক লক্ষ্যে পরিণত করে।
ইংরেজদের গোলামীর যুগে ভারতের মুসলমানদের সামনে সবচাইতে বড় সমস্যা ছিল অখণ্ড জাতীয়তা। খেলাফত আন্দোলন নিস্তেজ হয়ে পড়ার ফলে এ বিপদ অত্যন্ত তীব্র হয়ে দেখা দেয়। মুসলমানরা জীবনে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বারবার পরাজয় বরণ করায় তাদের মধ্যে নৈরাশ্যের অন্ধকার নেমে আসে। জাতীয় নেতৃবৃন্দ একে একে ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে পড়ছিলেন, নচেৎ পরপারের ডাকে চলে গিয়েছিলেন কিংবা জাতির আস্থা ও শ্রদ্ধা খুইয়ে বসেছিলেন। এ অবস্থায় কংগ্রেস মুসলমানদের নরম মোম ভেবে তাদের পদানত করে ফেলতে চাইছিলো। এ জন্যেই সে অখণ্ড জাতীয়থার আন্দোলনকে তীব্রতর করে তুলছিল। চিন্তা ও জ্ঞান-গবেষণার ক্ষেত্রে পশ্চিমের সমগ্র রাজনৈতিক চিন্তার ভিত্তিতে অখণ্ড জাতীয়তার ধারণাকে পেশ করা হচ্ছিল। ঐ পরিস্থিতিতে কোরআন-সুন্নাহর আলোকে বলিষ্ঠ ও অকাট্য যুক্তির মাধ্যমে কংগ্রেসী মত খণ্ডন করার মতো তেমন কেউ ছিল না বললেই চলে। গণ-সংযোগ (Mass Contact) অভিযানের নামে কংগ্রেস মুসলমানদেরকে তাদের নিজ দলে বিলীন করে নেয়ার চেষ্টা অত্যন্ত ব্যাপক ভিত্তিতে চালিয়েছিল নিজ দলে বিলীন করে নেয়ার চেষ্টা অত্যন্ত ব্যাপক ভিত্তিতে চালিয়েছিল। অপরদিকে, মুসলিম নামধারী একশ্রেণীর লেখক রুটি-রুজীর প্রশ্নকে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ আখ্যা দিয়ে প্রকাশ্যভাবে কম্যুনিজমের প্রচারণা শুরু করেছিল। এমনকি জমিয়তে ওলামায়ে হিন্দের আলেমদের এক প্রভাবশালী শ্রেণী ইংরেজ বিরোধী আন্দোলনে বিরাট অবদান রাখলেও আজাদী লাভের আসল লগ্নে ভারসাম্য হারিয়ে বসেন। তারা শুধু কংগ্রেসের অখণ্ড জাতীয়তার সমর্থনে লেগে পড়েননি, ইসলামী রাষ্ট্র পাকিস্তান গঠনের লক্ষ্যে ভারত বিভক্তির বিরুদ্ধেও সক্রিয় ভাবে তারা কাজ করেন।
এই পটভূমিতেই মওলানা মওদূদী রাজনৈতিক ময়দানে এসে তাঁর খোদাদাদ জ্ঞান ও ধীশক্তির দ্বারা দ্বিজাতিতত্বের বলিষ্ঠ প্রমাণ উপস্থাপন করেন। তিনি কুরআন ও সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণ করেন, এক দেশে সহাবস্থান করলেই সকেল এক জাতি হয়ে যায় না। ফলে, পাকিস্তান সৃষ্টির পথে এক বিরাট বাধা অপসারিত হয়। মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ কুরআন সুন্নাহর প্রমাণ সমৃদ্ধ তাঁর এসব যুক্তি প্রমাণ দ্বারাই কংগ্রেস ও অখণ্ড ভারতের দাবিদারদের লা-জওয়াব করেছিলেন। মওলানা মওদূদীর তখনকার লিখিত প্রবন্ধাদি শুধু জ্ঞান-গবেষণা ও যুক্তিগত প্রমাণাদি, ঐতিহাসিক সাক্ষ্য, অনুপম বর্ণনা ও প্রভাব-শক্তির দিক থেকেই নতুন বৈশিষ্ট্যের অধিকারী নয় বরং এগুলোর সর্বোত্তম কৃতিত্ব এই যে, এ সব লেখার ফলেই ইসলামী জাতীয়তার ধারণা একটি রাজনৈতিক লব্বেপড়ে ফেলা যায় –এটা ছিল হিন্দু নেতাদের সব চাইতে মারাত্মক চক্রান্ত। খোদ মুসলিম লীগ এ বিষয়টির ধর্মীয় দিককে অধিকতর উজ্জ্বল করে তোলার প্রয়াস পায়, যাতে করে কংগ্রেসের চক্রান্তকে জনগণ সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে এবং আপন দ্বীন ও ঈমানের দাবী পূর্ণ করার দিকে মনোযোগী হতে পারে। (পাকিস্তান আন্দোলন ও আলেম সমাজঃ চেরাগে রাহ, নযরিয়া-এ পাকিস্তান সংখ্যা।
ঐ সময় এবং বর্তমানে কংগ্রেস সমর্থক জমিয়তে ওলামায়ে হিন্দের ভক্ত আলেম ও তাদের শিষ্যরা কেন যে মওলানা মওদূদীর বিরুদ্ধে এত খাপ্পা এবং তাঁর বিরুদ্ধে সদা বিষোদগার করে থাকেন, এ আলোচনা থেকে তা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। যেহেতু জমিয়তে ওলামায়ে হিন্দ নেতা দেওবন্দের মরহুম মওলানা হোসাইন আহমদ মাদানী যুক্ত দিতেন এবং মওলানা মওদূদীর ‘জাতীয়তাবাদ’ গ্রন্থে এই মতের নীতিগত সমালোচনা করে যুক্ত জাতীয়তার অসারতা দেখানো হয়, তাই সে রাজনৈতিক বিদ্বেষ ও প্রতিহিংসাই এখন নানা” শরঈ রূপ ধারণ করে কংগ্রেসী মতের আলেমদের পক্ষ থেকে মওদূদীর বিরুদ্ধে ফতওয়া আকারে আত্মপ্রকাশ করে। একশ্রেণীর আলেমের পক্ষ থেকে মওদূদীর বিরোধিতার এই রাজনৈতিক পটভূমি না জেনে পাকিস্তান সমর্থক কিছু কিছু আলেমও তাঁর ব্যাপারে বিভ্রান্তিথে থাকা ও ‘মোৎমায়েন’ হতে না পারার অন্যতম মূল কারণ এখানেই। এছাড়া, ধর্মনিরপেক্ষ শাসকদের মদদে আরও দু’একটি মহল মাঝে মধ্যে ফতওয়াবাজির দ্বারা মওলানা মওদূদী সম্পর্খে ধূম্রজাল সৃষ্টির যে অপচেষ্টা করেন, তারাও যেহেতু উক্ত শ্রেণীর আলেমদের নিকট থেকে এবং পরোক্ষভাবে হাদীস অস্বীকারকারী (মুনকেরীনে হাদীস) ও কাদিয়ানীদের পরিবেশিত মাল-মশলার সাহায্যেই এসব করে থাকেন, এজন্যে বর্তমান যুগসমস্যা ও ইসলামী ঐক্যের প্রয়োজনীয়তার প্রতি লক্ষ্য করে এসব ব্যাপারে তারতম্যজ্ঞান কাজে লাগানো প্রতিটি মুসলমান বিশেষ করে আলেম সমাজের একান্ত কর্তব্য।
আল্লামা ইকবালের সমর্থনঃ পাকিস্তানের স্বপ্নদ্রষ্টা দার্শনিক কবি আল্লামা ইকবাল মওলানা মওদূদরি তখনকার রচনাবলী দ্বারা অত্যন্ত প্রভাবান্বিত ছিলেন। লাহোরের “ইকদাম” সম্পাদক প্রখ্যাত সাংবাদিক মিয়া মুহাম্মদ শফীর ভাষায় –মরহুম ইকবাল মওলানা মওদূদীর “তারজুমানুল কোরআনের” ঐ সকল রচনা নিয়মিত পড়িয়ে শুনতেন। এগুলোর দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়েই আল্লামা ইকবাল মওলানা মওদূদীকে হায়দরামাদ (দাক্ষিণাত্য) ছেড়ে পাঞ্জাব চলে আসার আহবান জানান। আর সেই আহানেই মওলানা সাহেব ১৯৩৮ সালে পাঞ্জাব চলে আসেন। মিয়া মুহাম্মদ শফী তাঁর লাহোরের ডাইরিতে লিখেছেনঃ
“মওলানা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী প্রকৃতপক্ষে তথাকথিত জাতীয়তাবাদী মুসলমানদের সম্পূর্ণ বিপরীত ছিলেন আর আমি এখানে পূর্ণ দায়িত্বের সাথে বলছি যে, আমি আল্লামা ইকবালের মুখে প্রায়ই এ ধরনের কথা শুনতাম যে, “মওদূদী এই কংগ্রেসী মুসলমানদের দেখে নেবেন”। মরহুম ইকবাল একদিকে (মওলানা) আযাদ ও মওলানা মাদানীর কঠোর সমালোচক ছিলেন; অপরদিকে তিনি মওলানা মওদূদীর তারজুমানুল কুরআন খুঁজে এনে পড়িয়ে শুনতেন। আর একথা শতকরা একশ ভাগ দায়িত্বের সঙ্গে বলতে পারি যে, আল্লাহ ইকবাল এক পত্র মারফত মওলানা মওদূদীকে হায়দারাবাদের (দাক্ষিণাত্য) পরিবর্তে পাঞ্জাবকে তাঁর কর্মস্থল রূপে গ্রহণ করার আহবান জানিয়ে ছিলেন’ –(সাপ্তাহিস ইকদাম, ৯ই জুন, ১৯৬৩ খৃঃ)। সামরিক শাসনকালে রচিত শাসনতন্ত্র কমিশনের উপদেষ্টা ও কোম্পানী আইন কমিশনের সভাপতি এবং সাবেক আইয়ুব সরকারের পররাষ্ট্র উযীর সাইয়েদ শরীফুদ্দীন পীরযাদা তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ ‘পাকিস্তানের ক্রমবিকাশ’ (Evolution of Pakistan) গ্রন্থে মওলানা মওদূদীকে পাকিস্তানের অন্যতম স্বপ্নদ্রষ্টা হিসাবে উল্লেখ করেছেন। উক্ত বইয়ের ১৫৮ পৃষ্ঠায় তিনি লিখেছেনঃ
in a series in the ‘Tarjumanul Quran’ in 1838 Moudodi unmasked the congress and warned the Muslims. He releted the History of the Muslims of the sub-Continent debunded Congres Secularism and showed the unsuitability of (United) India for democratic rule as there would be only one Muslim vote as against three Hindu votes. “মওলানা মওদূদী তারজুমানুল কুরআনের এক ধারাবাহিক প্রবন্ধের সাহায্যে (যা ১৯৩৮ থেকে ১৯৩৯ সালে প্রকাশিত হয়) কংগ্রেস মতের মুখোশ সম্পূর্ণ উন্মোচিত করেন এবং মুসলমানদের ইতিহাস পর্যালোচনা করে কংগ্রেসের ধর্মনিরপেক্ষতার স্বরূপ উদঘাটন করেন এবং এ সত্যকে প্রমাণ করে দেন যে, ভারতের বিশেষ পরিবেশে পশ্চিমা ধরনের গণতন্ত্র অনুপযোগী, কারণ এতে মুসলমানদের এক ভোট আর হিন্দুরা তিন ভোটের অধিকারী হবে”।
মওলানা মওদূদী কতৃক ভারত বিভাগের প্রস্তাব
“তিনি (মওলানা মওদূদী) হিন্দুদের জাতীয় সাম্রাজ্যবাদের কঠোর সমালোচনা করেন এবং এ অভিমত প্রকাশ করেন যে, নিছক যুক্তনির্বাচন কিংবা আইন পরিষদের কিছু বেশী প্রতিনিধিত্ব (Weightage) এবং চাকরি-বাকরিতে একটি হার নির্ধারণের দ্বারা মুসলিম জাতির রাজনৈতিক প্রশ্নের মীমাংসা হবে না। এ ব্যাপারে তি যে প্রস্তাব পেশ করেন, তাতে তিনটি বিকল্প পন্থার নির্দেশ করেছিলেন”। (Evolution of Pakistan.)
এই পন্থাগুলোর মধ্যে সর্বশেষ পন্থাটি ছিল দেশ বিভাগ। এ কারণেই সাইয়েদ শরীফুদ্দীন পীরযাদা পাকিস্তানের ক্রমবিকাশ ধারার পরিণতিতে পৌঁছে অকপটে প্রকাশ করেছেনঃ “স্যার আবদুল্লাহ হারুন, ডক্টর লতীফ, স্যার সেকান্দার হায়াত, জৈনিক পাঞ্জাবীনেতা, সাইয়েদ জাফরুল হাসান, ডক্টর কাদেরী, মওলানা মওদূদী, চৌধুরী খালেকুজ্জামান প্রমুখ যে প্রস্তাব ও পরামর্শ দেন, তাই এক অর্থে পাকিস্তান পর্যণ্ত পৌঁছুবার পথে মাইল স্তম্ভস্বরূপ”।–(ঐ, পৃষ্ঠা ২৫৮)
বক্তব্য প্রমাণের জন্যে এসব উদ্ধৃতির প্রয়োজন ছিল না, কিন্তু যারা তখনকার পূর্ণাঙ্গ ইতিহাসের সঙ্গে পরিচিত নয়, কেবল তাদেরই সুবিধার্থে এই সহায়ক উদ্ধৃতিগুলো এখানে পেশ করা হলো। এত্থেকে সহজেই অনুমান করা চলে যে, মুসলমানদের আজাদী সংগ্রামে মওলানা মওদূদীর কলম কতখানি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
তবে তিনি মুসলিম লীগের সঙ্গে সক্রিয় হয়ে কাজ করলেন না কেন, সেটা দীর্ঘ আলোচনার ব্যাপার। সংক্ষেপ কথা হলো এইযে, তিনি পাকিস্তানের সমর্থক হলেও মুসলিম লীগের কর্মনীতির সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রে দ্বিমত পোষণ করতেন। মওলানা মওদূদী ভারতের মুসলমানদের যে খেদমত করে আসেন, তা ছিল মূলতঃ তত্ত্ব, তথ্য ও চিন্তা-গবেষণার ক্ষেত্রে। যখন আজাদী আন্দোলন শেষ পর্যায়ে আসে এবং ভারত বিভাগের সময় ঘনীভূত হয়, তখন তিনি এ দুই ভূখণ্ডের মুসলমানদের পরবর্তী পর্যায়ে কর্মসূচী কি হবে, সে নিয়ে গভীরভাবে আত্মনিমগ্ন ছিলেন। কেননা, তিনি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে দেখেছেন যে, ভারত বিভক্তির পর ভারতের বৃহত্তর অংশে যে কোটি কোটি মুসলমান অবশিষ্ট থাকবে, তাদের মধ্যে দ্বীন ও ঈমাদের সত্যিকার আলো জ্বালিয়ে রাখার কি ব্যবস্থা হবে? এবং মুসলিম লীগের নেতৃত্বে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর একে যখন তুরস্কের ন্যায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করণের প্রচেষ্টা চলবে কিংবা এখানে নাস্তিক্যবাদের প্রচার চলবে, সে সময় এ জাতিকে উক্ত ষড়যন্ত্রের হাত থেকে রক্ষাকল্পে প্রথম থেকেই জ্ঞান-গবেষণার মাধ্যমে ইসলামী রাষ্ট্রের পরিকল্পনা তৈরী এবং পরিচালনার জন্যে যোগ্য নেতৃত্ব সৃষ্টির প্রতি মনোনিবেশ করতে হবে। বলা বাহুল্য, এ দায়িত্বই তিনি পালন করেন।
জামায়াতে ইসলামী গঠনঃ এ পরিকল্পনার পরই তিনি ১৯৪০ সালে পাকিস্তান প্রস্তাব গৃহীত হবার এক বছর পর (১৯৪১ সালে) “জামায়াতে ইসলামী” গঠন করে ইসলামী নেতৃত্ব দানের উপযোগী লোক তৈরীর কাজে মনোনিবেশ করেন এবং সম্ভাব্য বিভক্ত ভারতের অপর অংশের মুসলমানদের নেতৃত্বের জন্যেও অনুরূপ ব্যবস্থা অবলম্বন করেন। কেননা, মওলানা মওদূদী তাঁর জ্ঞানদীপ্ত চোখে দেখতে পেয়েছিলেন যে, পাকিস্তানকে ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্যে মুসলিম লীগের সামনে কোনো পূর্ণাঙ্গ পরিকল্পনা ছিল না। [যার প্রমাণ হলো ৪৭-এর পর দীর্ঘ ২৪ বছর যাবত প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে একাধারে মুসলিম লীগ ক্ষমতায় থাকা সত্ত্বেও দেশটি ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত না হওয়া] মুসলিম লীগ যে কর্মসূচী নিয়েছে, তাতে দেশ স্বাধীন হলেও মুসলিম মিল্লাত জাতি হিসাবে যে শক্তি বলে তার স্বাধীনতা ও কৃষ্টি-সংস্কৃতিকে রক্ষা করবে, তা তাদের কর্মসূচীতে অনুপস্থিত। এ ছাড়া গুটিকয়েক নেতা ছাড়া অধিকাংশের চরিত্র, ধ্যান-ধারণা ও যোগ্যতাও তাকে আশ্বস্ত করতে পারেনি যে, এঁদের দ্বারা পাকিস্তান যথার্থ ইসলামী বলে প্রমাণিত হতে পারবে। আর বাস্তবেও তাঁর এই আগাম আশংকা যথার্থ বলে প্রমাণিত হয় এবং এর প্রতিষ্ঠার দীর্ঘ ২৩/২৪ বছরের ইতিহাসই এর জ্বলন্ত প্রমাণ। তাই মওলানা মওদূদী যে মহান কাজ সম্পাদনে ব্যাপৃত ছিলেন, সেটা তৎকালীন শাসকদল মুসলিম লীগের করণীয় কাজটিই তিনি সম্পাদন করেছেন। এদিক থেকে জামায়াত ভারত বিভক্তির মধ্য দিয়ে মুসলমানদের জন্যে প্রতিষ্ঠিত স্বতন্ত্র মুসলিম রাষ্ট্রের পরিপূরক সংস্থা হিসাবেই কাজ করেছে। এ জামায়াতের কোনো বিরোধিতা ছিল না, যা কোনো কোনো লোক উদ্দেশ্যমূলকভাবে প্রচার করে বেড়ায়। মওলানা মওদূদীর খোদাপ্রদত্ত প্রজ্ঞা এবং জামায়াত গঠনের সুচিন্তিত পরিকল্পনা ও সাহসিকতাপূর্ণ পদক্ষেপের ফল আজ উপমহাদেশের যুগ-সমস্যা, আধুনিক মানস ও চ্যালেঞ্জের মোকাবেলায় সঠিক পন্থায় ইসলামী আন্দোলনের নেতৃত্ব দানের মতো লোকের ব্যবস্থা হয়। বিশাল ভারতের আনাচে-কানাচে বর্তমানে বিক্ষিপ্ত কোটি কোটি মুসলমানকে ইসলামী আকীদা বিশ্বাসে অটল রাখা, অমুসলমানদেরকে অতীত ও বর্তমান ভ্রান্ত ধারনার খপ্পর থেকে ইসলাম সম্পর্কে পরিচিত করানো, দাঙ্গা উপদ্রুত মুসলশানদের সাহায্যে এগিয়ে আসা এবং মুসলমানদেরকে হিন্দু জাতীয়দাবাদ ও হিন্দু সভ্যতা-সংস্কৃতিতে বিলীন হওয়া থেকে রক্ষা করা এংব ইসলামের সঠিক শিক্ষা ও আদর্শ প্রচারের বিরাট দায়িত্ব পালন করছেন ভারতে বসবাসকারী জামায়াতে ইসলামী কর্মীবৃন্দ। আর এদিকে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে ইসলামের স্বার্থে এ জামায়াত ইসলাম বিরোধীদের হাত থেকে একে রক্ষায় কিরূপ আপোষহীন সংগ্রামে নিয়োজিত, তাতো সকলের চোখের সামনেই বিদ্যমান। নিজেরা আত্মকলহে ব্রাশ ফায়ারে প্রতিপক্ষ গ্রুপের আটজন ছাত্রকে হত্যা করে জামায়াত ও তার সমর্থক ছাত্রদের উপর দোষ চাপানো সহ অসংখ্য মিথ্যাচারের মোকাবেলা করে তাকে কাজ করতে হয়।
গণভোটে পাকিস্তান সমর্থন
সাবেক সীমান্ত প্রদেশ ও সিলেটের গণভোট গ্রহণকালে মওলানা মওদূদী জনগণকে মুসলমানদের স্বতন্ত্র আবাসভূমির পক্ষে ভোট দেয়ার আহবান জানিয়ে বলেছিলেনঃ
“আমি যদি সীমান্ত প্রদেশের অধিবাসী হতাম তাহলে গণভোট কালে মুসলমানদের স্বতন্ত্র আবাসভূমির পক্ষেই ভোট দিতাম। এ কারণে যে, ভারতের বিভক্তিটি হিন্দু-মুসলিম জাতীয়তার ভিত্তিতে সম্পাদিত হচ্ছে। কাজেই যে এলাকায়ই মুসলিম জাতি সংখ্যাগুরু, স্বভাবতঃ সে এলাকা মুসলিম জাতীয়তাভিত্তিক অঞ্চলের শামিল হওয়াই বাঞ্চনীয়। -(অর্ধ-সাপ্তাহিক ‘কাউসার’ ৫ই জুলাই, ১৯৪৭ খৃঃ)
ভারত বিভাগের প্রায় তিন মাস পূর্বে ১৯৪৭ সালের ৯ ও ১০ই মে তারিখে আয়োজিত জামায়াতের নিখিল ভারত সম্মেলনের প্রকাশ্য অধিবেশনে প্রদত্ত বক্তৃতার উপসংহারে মওলানা মওদূদী বলেনঃ
“এখন এটা প্রায় স্থিরীকৃত যে, দেশ বিভক্ত হবে এবং এক অংশ অমুসলিম সংখ্যাগুরুর কর্তৃত্বাধীনে থাকবে। প্রথম অংশে আমরা জনমত সংগঠন করে খোদায়ী আইন-কানুনের ভিত্তিতে রাষ্ট্রের বুনিয়াদ গড়ে তোলার চেষ্টা করবো। একটি ধর্মহীন জাতীয় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের তুলনায় এটি খোদায়ী খিলাফত যা মুহাম্মদ (সা) এর আনীত শিক্ষার ভিত্তিতে কায়েম হবে –একদিকে খোদ পাকিস্তানবাসীর জন্যেও এবং মুসলিম বিশ্বের জন্যেও, অপরদিকে গোটা দুনিয়ার জন্যে রহমত ও আর্শীবাদ হতে পারে তা আপনারা দেখবেন”। -(তারজুমানুল কোরআন)
দেশ বিভাগের পূর্বে মওলানা মওদূদী এসব বলিষ্ঠ অভিমত প্রকাশ করেন। আর এভাবেই চিন্তা ও জ্ঞান-গবেষণার দিক দিয়ে সংগ্রামের একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্রন্টকে তিনি জোরদার করে তোলেন। এর সঙ্গে সঙ্গে যেসব ক্ষেত্রে বাস্তব সহযোগিতা সম্ভবপর ছিল, সেখানেও তিনি অবদান রাখতে ইতস্ততঃ করেননি।
ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থার খসড়া কমিটি ও মওলানা মওদূদী
ইসলামী জাতীয়তার সম্পর্কে মওলানা সাহেবের তৎকালীন রচনাবলী মুসলিম লীগ মহল অত্যন্ত ব্যাপকভাবে প্রচার কর্রে।
সর্বোপরি যুক্ত প্রদেশ মুসলিম লীগ ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থার খসড়া তৈরীর জন্যে আলেমদের একটি কমিটি গঠন করলে মওলানা মওদূদী সানন্দে তার সদস্য পদও গ্রহণ করেন। সে কমিটির একজন গবেষণা সহকারী মওলানা মুহাম্মদ ইসহাক সানদিলভী যে প্রাথমিক খসড়া (Warking Paper) তৈরী করেছিলেন, পরবর্তীকালে তা প্রকাশিত হয়েছে। তার ভূমিকায় মওলানা আবদুল মাজেদ দরিয়াবাদী লিখেছেনঃ
“সম্ভবতঃ ১৯৪০ কিংবা তার পূর্বের কথা, মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ মনে করণেল যে, ইসলামী রাষ্ট্রের (পাকিস্তান) দাবি জোরে-শোরে তোলা হচ্ছে, তার শাসনতন্ত্র কিংবা আইনগত ভিত্তিতে খাঁটি ইসলামী বানানো প্রয়োজন। এ উদ্দেশ্যে যুক্তপ্রদেশ মুসলিম লীগ শরঈ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিদের সমন্বয়ে একটি ক্ষুদ্রায়তন কমিটি গঠন করেন। ইসলামী শাসনতন্ত্র কমিটির চারজন সদস্যের নাম আমার খুব ভাল করেই স্মরণ আছে। তারা হলেনঃ
১। মওলানা সাইয়েদ সোলাইমান নদভী ২। মওলানা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদী ৩। মওলানা আযাদ সোবহানী ও ৪। মওলানা আবদুল মাজেদ দরিয়াবাদী।
(ইসলামের রাষ্ট্র ব্যবস্থাঃ দারুল মুছান্নেফীন, আজমগড়)
মওলানা মওদূদী সম্পর্কে কায়েদে আযমের উক্তি
এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ইসলামিক রিসার্চ ইনষ্টিটিউটের রীডার জনাব কমরুদ্দীন খানের একটি প্রবন্ধের উদ্ধৃতি এখানে উল্লেখযোগ্য। জনাব কমরুদ্দীন লিখেছেন যে, তিনি মওলানা মওদূদীর অভিপ্রায়ে কায়েদে আযমের সাথে সাক্ষাত করেন এবং মাহমুদাবাদের রাজা সাহেবের সহায়তায় দিল্লীর ‘গোলে রা’নায়” আমাদের সাক্ষাতকারের ব্যবস্থা করা হয়। কায়েদ আযম পঁয়তাল্লিশ মিনিট পর্যন্ত অত্যণ্ত ধৈর্যের সঙ্গে আমার কথা শুনতে থাকেন। এবং তারপর বলেন –“মওলানা মওদূদীর খেদমতকে তিনি অত্যন্ত পছন্দনীয় চোখে দেখছেন। কিন্তু উপমহাদেশের মুসলমানদের জন্যে এই মুহুর্তে বেশী জরুরী একটি স্বাধীন রাষ্ট্র অর্জন। তাদের চরিত্র সংশোধনের কাজের চাইতে এখন এই কাজটি অধিক গুরুত্বপূর্ণ”। তিনি বলেন, “জামায়াত এবং লীগের মধ্যে কোনো মতানৈক্য নেই। জামায়াত একটি মহৎ উদ্দেশ্যে কাজ করছে আর লীগ একটি জরুরী সমস্যার প্রতি লক্ষ্য আরোপ করেছে –যার সমাধান না করা হলে জামায়াতের কাজ সম্পূর্ণ হতে পারে না”।
(Weekly Thinker The Quidi Azam by Reminon December-1963)
এ হচ্ছে মুসলমানদের জন্যে স্বতন্ত্র রাষ্ট্র পাকিস্তান আন্দোলনে মওলানা মওদূদীর প্রকৃত ভূমিকা। কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হবার পর যখন মওলানা মওদূদী ও মওলানা শাব্বীর আহমদ উসমানীর নেতৃত্বে ইসলামী শাসনতন্ত্র রচনার জনদাবী ওঠে, তখন কতিপয় ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী ও সমাজতন্ত্রী নেতা মওলানা মওদূদীর ন্যায় প্রচণ্ড ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নেতার ইসলামী আন্দোলনের ক্রম-অগ্রগতি এবং মওলানা শাব্বির আহমদ ওসমানীর অনুসারীগের ইসলামী তৎপরতা প্রত্যক্ষ করে ঘাবড়ে যায়। তারা ঐসব দেশবরেণ্য ওলামায়ে কেরামসহ মওলানা মওদূদীকে সমাজের সামনে হেয় প্রতিপন্ন করে এখানে ইসলামী আন্দোলনকে দুর্বল করার চেষ্টায় নিয়োজিত হয়। এই উদ্দেশ্যে বাতিল শক্তিগুলো এসব বুজর্গানে দ্বীন সম্পর্কে, যারা আজীবন ব্যক্তিস্বার্থকে জলাঞ্জলী দিয়ে দেশ, ধর্ম ও সমাজের খেদমত করে আসছেন –কাউকে ‘আমেরিকার দালাল’ কাউকে ‘দেশবিরোধী’ কাউকে প্রতিক্রিয়াশীল ইত্যাকার বলে তাদেরকে সমাজে হেয় করার চেষ্টা চালায়। অবশ্য এসব উক্তি তাদের নিজেদেরই পায়ের তলার মাটি সরিয়ে দেয়। বিশেষ করে যে মওলানা মওদূদী দ্বিজাতিতত্বের বিশিষ্ট যুক্তি দিয়ে কংগ্রেস ও কংগ্রেস সমর্থক ওলামায়ে কেরামের একজাতিতত্বের যুক্তিকে বানচাল করার লক্ষ্যে রাজনৈতিক মতলব হাসিলের উদ্দেশ্যে তারা তাঁকে জাতীয়তাবাদী কংগ্রেস সমর্থক আলেমদের পর্যায়ে ফেলে অবিভক্ত পাকিস্তান বিরোধী রূপে চিত্রিক করার অপচেষ্টা চালায়। উপরোক্ত তথ্যাবলীর আলোকে আজাদী আন্দোলনে মওলানা মওদূদীর ভূমিকা সুস্পষ্ট। বলা বাহুল্য, বাতিলপন্থীদের সেই একই ভূমিকা এখনকার ইসলামী আন্দোলন কারীদের বিরুদ্ধেো নানান চরিত্রে অব্যাহত।
উপসংহার
এ পর্যন্ত সংক্ষিপ্তাকারে উপমহাদেশের আজাদী আন্দোলনে সামগ্রিকভাবে আলেম সমাজের কি অবদান ছিল, তার মোটামোটি ধারণা পাঠকের সামনে তুলে ধরা হয়েছে। এবার আমরা আজাদী-উত্তরকালে দেশ সেবা, সমাজ সেবা ও জাতীর্ধ আদর্শ রক্ষায়, রাজনীতি, অর্থনীতিতে এদেশের গণতা্ন্ত্রিক আন্দোলনে তথা এদেশকে একটি শোষণহীন জনকল্যাণমূলক ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্যে “ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের ইতিহাস” নামে অপর একটি গ্রন্থে তাঁদের সংগ্রামী ভূমিকাকে তুলে ধরার প্রয়াস পাবো। আল্লাহ যেন এই মহান প্রচেষ্টাকে বাস্তবায়িত করার তওফীক দেন সে জন্য সকলের কাছে দোয়াপ্রার্থী। -আমীন।।
##সমাপ্ত##