আযাদীর অমর মুজাহিদঃ সৈয়দ আহমদ শহীদ
[১২০১- ১২৪৬ হিঃ ১৭৮৬- ১৮৩১ খ্রীঃ]
দুশো বৎসরের ঘৃণ্য বিদেশী গোলামির বিষময় ফলে এদেশীয় লোকদের দাস- মনোভাব এতোখানি চরমে উঠে যে, তারা মহৎ ব্যাক্তি ও মহৎ কাজ সম্পর্কে একদম বিরুতসাহ ও নির্বিকার হয়ে পড়ে। আর এই মনোভাব বেশি লক্ষ্য করা যায় সৈয়দ আহমদ শহীদ সম্পর্কে; অথচ এক হিসেবে তিনিই ভারতে সত্যিকারভাবে স্বাধীন ইসলামী গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা করেন এবং তার জন্য নিজের জীবনও দান করেন।
সারা পাক- ভারতে যেসব আলেম ও ধর্মনেতারা আবির্ভাব হয়েছে, তাদের মধ্যে কারও প্রকাশ্যে এই ঘোষণা দেওয়ার সৎসাহস ছিল না যে, বিদেশীর শাসনাধীন ভারত হিজরত করাই প্রত্যেক খাঁটি মুসলমানের পক্ষে অবশ্য কর্তব্য। দিল্লীর শাহ্ আবদুল আযীযই উনিশ শতকের প্রথম ভাগে প্রকাশ্যে ফতোয়া জারী করে এই অভিমত প্রকাশ করেন।
স্বৈরাচারীর প্রভাব থেকে মুসলিম- ভারতকে মুক্ত করার আকুল আগ্রহে শাহ্ আবদুল আযীয প্রবর্তন করেন মশহুর সমাজ সংস্কার আন্দোলন ‘তাগরিব- ই- মুহম্মদীয়া’। এর উদ্দেশ্য ছিল, যেসব ইসলাম বিরুদ্ধ কুসংস্কার, চাল- চলন ও রীতিনীতি সাধারন মুসলমানের দৈনন্দিন জীবনে প্রবেশালাভ করেছে, সেগুলির মূলোৎপাটন করা ও খাঁটি ইসলামী শিক্ষাদর্শে তাদের উদ্বুদ্ধ করা। এই আন্দোলনের ফলেই বহু লোক ইসলামের সত্যিকার ভাবাদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে নানা রকম বেদআত পরিত্যাগ করতে হবে। এক সুপরিকল্পিত নিয়মে শাহ্ সাহেব সারা ভারতে এই আন্দোলন শুরু করেন, এবং এ কাজে একদল নিঃস্বার্থ ও অক্লান্তকর্মা লোক নিয়োগ করেন। কালক্রমে শীঘ্রই ‘তাগরিব- ই- মুহম্মদীয়া’ আন্দোলন স্বাভাবিকভাবে অত্যাচারী শিখ ও ব্রিটিশের বিরুদ্ধে আজাদীর আন্দোলনে পরিণত হয়।
কিন্তু জেহাদ আন্দোলনকে লোকপ্রিয় করে তুলতে এবং ব্যাস্তভাবে জেহাদী অভিযান পরিচালিত করতে সবচেয়ে বেশি উৎসাহী ছিলেন শাহ্ আবদুল আযীযের ভাইপো ইসমাইল শহীদ ও তার মুর্শেদ সৈয়দ আহমদ ব্রেলভী। সৈয়দ আহমদও শাহ্ আবদুল আযীযের মুরীদ ছিলেন।
১৭৮৬ খৃস্টাব্দে এক মশহুর সূফী পরিবারে সৈয়দ আহমদের জন্ম হয়। তার পূর্বপুরুষ সৈয়দ ইবনউল্লাহ রায়বেরেলীর প্রান্তভুমে বাদশাহ আওরঙজেব আলমগীরের সময় বাসস্থান কায়েম করেন। সেখানে তিনি হযরত ইব্রাহীমের মত নিজের বংশের জন্য একটা মসজিদও নির্মাণ করেন। তিনি একজন বেশ হৃষ্টপুষ্ট স্বাস্থ্যবান বালক ছিলেন; তার দৈহিক শক্তি ও মনোবল ছিল অসাধারণ। কিন্তু লেখাপড়ায় তার বিশেষ মনোযোগ ছিলনা, তার দরুন তার পিতার চিন্তার অন্ত ছিলনা। তার কৈশোরে আশপাশের গ্রামে কিংবা সায় নদীতীরে সমবয়সীদের সঙ্গে ঘুরে বেড়াতেন, এবং কপাটি খেলা, মল্লক্রীড়া, সাঁতার ও ঘোড়দৌড় এ প্রচুর আনন্দ পেতেন। কিন্তু খেলাধূলায় যেমন তার তীব্র নেশা ছিল, লোকসেবায়েও তার তেমনি প্রচুর আগ্রহ ছিল। গরীব গ্রামবাসীদের ছোটখাটো কাজ করে দিতে পারলে তার আনন্দের সীমা থাকতনা। অথচ তার স্বভাবের দরুন মুরব্বিদের মাথাব্যাথার অন্ত ছিলনা, কারণ, তার মত একজন আশরাফুল কুলোদ্ভবের এসব কাজ করা মর্যাদার হানিকর ছিল। কিন্তু এসব তুচ্ছ পারিবারিক রুচি ও নীতির কাছে নতি স্বীকার করা তার স্বভাব বিরুদ্ধ ছিল। তিনি বেপরয়াভাবে লোক- সেবায় ও সমাজ উন্নয়ন কাজে লিপ্ত ছিলেন আবার খেলাধুলায়েও মশগুল থাকতেন। এভাবে তার জীবনের ১৭ বছর কেটে গেল, তিনি বেশ ব্যাক্তিত্বশালী ও সংবেদনশীল তরুন হয়ে উঠেন। কিন্তু তার কেতাবী শিক্ষা লাভ কিছুই হল না।
যখন তার বয়স ১৭ বছর, তখন তার পিতার মৃত্যু হয়। তার দু’তিন বছর পর কয়েকজন বন্ধু নিয়ে এই গেঁয়ো তরুন সভ্যতাভিমানী লক্ষনউ শহরে উপস্থিত হলেন দুনিয়ার অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করার জন্য এবং সম্ভব হলে কোন চাকুরী জোগাড়ের উদ্দেশ্যে। সে সময়টা ছিল খুব টানাটানি ও অভাবে। তিনি তার পিতার জনৈক মুরীদের নিকট আশ্রয় পেলেন। কিন্রু শহরের জীবনের উচ্ছৃঙ্খলা ও অসারতায় তার বিতৃষ্ণা জন্মে গেল। তিনি শীঘ্রই এই শহর ত্যাগ করে দিল্লী চলে গেলেন। এভাবে দুনিয়াবী শান- শওকতের তৎকালীন লীলানিকেতন লখনউ শহর, তার থেকেও পিছন ফিরলেন।
অনেকখানি রাস্তা পায়ে হেটে ক্লান্ত হয়ে তিনি শাহ্ আবদুল আযীযের দরবারে এসে জোর গলায় জানালেন- ‘আসসালামু আলায়কুম’। ২০ বছরের যুবকের মুখে এই বলিষ্ঠ সম্ভাষণ ‘আদাব ও তসলিমাত’ অভ্যস্ত শহরে ভদ্রশ্রেণীর কানে খুবীই অদ্ভুত শোনাল। কিন্তু তার নিরভিমান সারল্য সহজ ও ব্যক্তিত্বশালী চেহারা ও গভীর দৃষ্টিতে ‘শেখুল হিন্দ’ মুগ্ধ হলেন এবং সহজেই অনুধাবন করলেন যে, তার নতুন শিষ্য পালিশহীন হীরার একটি টুকরা।
উর্দু ভাষায় কোরআন শরীফের প্রথম তর্জমাকারী আবদুল কাদি তখন আকবরী মসজিদের মশহুর মাদ্রাসায় অধ্যাপনা করতেন। মসজিদের বহির্দেশে বহু কুটুরীতে অবস্থান করে শাহ্ আবদুল কাদিরের নিকট বিদ্যাশিক্ষা আরম্ভ করেন। কিন্তু তাসাউফ তত্ত্বে তাকে শিক্ষা দেয়ার ভার গ্রহণ করলেন খোদ শাহ্ আবদুল আযীয সাহেব।
মাত্র দুই বছরের সাধনায় তিনি ইসলাম জগতের অসামান্য মনীষা হিসেবে বিকশিত হয়ে উঠলেন। এই সময়ের একটি দৃষ্টান্তে তার আধ্যাতিক গুরু লক্ষ্য করলেন যে, ইসলামের মৌলিক শিক্ষা গ্রহনে তার পরম জ্ঞান অসাধারণ। সফী সাধনানুযায়ী শাহ্ আবদুল আযীয তার মুরীদকে শিক্ষা দিলেন যে, পীর মুর্শেদের চিন্তায় মনের এতোখানি একাগ্রতা আনতে হবে যে, তার ব্যাক্তিত্ত্বের মধ্যেই নিজেকে বিলীন করে দিতে হবে। তিনি আপত্তি তুলে প্রমাণ চাইলেন যে, এ পদ্ধতি কেন পৌত্তলিকতার পর্যায়ে পরবেনা? শাহ্ সাহেব তার সাধু সন্দেহের মুক্ত প্রকাশে ও বিষয়টার তাত্ত্বিক সূক্ষজ্ঞানে বিস্ময় মুগ্ধ হয়ে তৎক্ষণাৎ ভবিষ্যদ্বাণী করেছেলেন। শীঘ্রই শাহ্ আবদুল হক প্রকাশ্যে স্বীকার করতে বাধ্য হন যে, সৈয়দ আহমদের কেতাবী শিক্ষার প্রয়োজন নেই, কারণ আল্লাহ তাকে এতোখানি পরম জ্ঞান দান করেছেন যে, কেতাবী শিক্ষা তার কাছে তুচ্ছ ব্যাপার। এরপর থেকে তাঁকে অধ্যয়ন করতে না দিয়ে স্বাধীন এবাদত- বন্দেগীতে মশগুল থাকতে দেয়া হয়। কথিত আছে যে, এই সময় সৈয়দ আহমদ স্বপ্ন ও অন্য উপায়ে তার উপর আল্লাহর অপার করুণার যেসব বাস্তব চিহ্ন পান, সে অন্য কোন দরবেশের পক্ষে এত অল্প সাধনায় লাভ করা সম্ভব হয়নি।
অতঃপর ১৮০৮ সালে সৈয়দ আহমদ মাতৃভূমি রায়বেরেলীতে ফিরে আসেন ও জোহরা বিবিকে শাদী করেন। পর বছর তার একটি কন্যা সন্তান জন্ম হয়। প্রায় দু বছর গৃহবাস করে তিনি দিল্লীতে ফিরে যান। কিন্তু সেখানে বেশিদিন না কাটিয়ে তিনি মধ্য ভারতে টংক গমন করেন ও নওয়াব আমীর খাঁর অধীনে সামরিক বিভাগে চাকরি গ্রহণ করেন। আল্লাহর পথে মুজাহিদ ও সংস্কারক হতে হলে উপযুক্ত সামরিক শিক্ষালাভের দরকারও তার ছিল।
নওয়াব আলী খা তখন ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়ছিলেন। এবং তৎকালীন ডামাডোলের সময় একটা বিশিষ্ট স্থানও অধিকার করেছিলেন। সে দরুন সৈয়দ আহমদের আশা হল যে, তাঁকে দিয়ে ইসলামের কাজ করানটা অনেক সহজ হবে। অতএব, সৈয়দ আহমদ নওয়াব সাহেবের অধীনে সাময়িকভাবে সামরিক কাজে নিযুক্ত হলেন ও গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি কাজের ভার পেলেন। তাছাড়া তিনি নওয়াবের বিশ্বাসও অর্জন করেন এবং খাস পরামর্শদাতা হিসেবে তার পাশে পাশে থাকলেন। এভাবে প্রায় ৬ বছর তিনি বিশ্বস্তভাবে নওয়াবের সেবা করলেন। কিন্তু নওয়াব সাহেব যখন মধুপুর আক্রমণের সুবিধার্থে ইংরেজের সাহায্য গ্রহনে লালায়িত হলেন, তখন সৈয়দ আহমদেরও টংকে থাকা দুষ্কর হয়ে উঠলো। তিনি বার বার নওয়াব সাহেবকে বোঝাতে চাইলেন যে, একবার ইংরেজের অর্থ গ্রহণ করলে তার পক্ষে আর তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারন করা অসম্ভব হয়ে উঠবে। কিন্তু তিনি দেখলেন যে, ইংরেজের বিপুল অর্থের প্রলোভন ত্যাগ করা নওয়াবের পক্ষে সুকঠিন। সুতরাং তিনি নীরবে দিল্লী ফিরে গেলেন। কিন্তু তার হেফাজতে ও শিক্ষাধীনে ন্যস্ত শাহাজাদাকেও সঙ্গে নিয়ে গেলেন।
১৮১৮ সালে মে মাসে সৈয়দ আহমদের তৃতীয় বার আগমন এক গুরুত্বপুর্ণ অধ্যায়। তখন তিনি আধ্যাতিক সাধনামর্গের শিখরে উঠেছেন। তার প্রস্তুতির সময় শেষ হয়ে এখন গঠনমূলক কাজের পালা শুরু হয়েছে। আগের মত তখনও তিনি আকবরী মসজিদের কুটুরীতেই থাকতেন। সেখানেই হাজার হাজার লোক ভিড় জমাতো তার উপদেশ শুনতে ও সঠিক পথের অনুবর্তী হতে। তার আধ্যাতিক সাফল্যের কামালিয়াতের কাহিনী নানামুখে শহরময় ছড়িয়ে পড়ল। কিন্তু শাহ্ আবদুল আযীয ও শাহ্ আবদুল কাদিরের মত মহৎ ব্যাক্তির সামনে সাধারন লোক তাঁকে গ্রহণ করতে কিছুটা দ্বিধাবোধ করল।
তারপর একদিন দেখা গেল শাহ্ আবদুল আযীযের জামাতা শাহ্ আবদুল হাই ও ভাইপো শাহ্ ইসমাইল তার পেছনে নামায পড়ছেন। তার ফল এই দাঁড়ালো যে, লোকে তার শিষ্য হতে ব্যাকুল হয়ে উঠলো এবং তার সেবায় তারা এতোখানি দেহমন সমর্পন করল যে, ১২- ১৩ বছর পরে তার সঙ্গে একই সময়ে বালাকোটের ময়দানে যুদ্ধে প্রাণ বিসর্জন দিল [১৮৩১ খৃঃ]।
মশহুর আলেম ও শ্রদ্ধেয় মানুষ হিসেবে আমদুল হাই ও শাহ্ ইসমাইলের প্রচুর খ্যাতি ছিল। অতএব, সৈয়দ আহমদকেই মুর্শেদ হিসেবে তারা গ্রহণ করায় সাধারন লোকও তাদের অনুবর্তী হল। তাছাড়া তাদের বংশেই শাহ্ আবদুল আযীযের মত সুবিখ্যাত আধ্যাত্মিক গুরু থাকা সত্ত্বেও তারা সৈয়দ আহমদকে গ্রহণ করেছেন দেখে লোকের বিস্ময়ের অবধি রইলো না। এইসব কারণে সারা মধ্যভারতে বিদ্যুৎগতিতে সৈয়দ আহমদের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল। চারিদিক থেকে জনসাধারন তাঁকে আহ্বান জানাল। তিনি ওস্তাদ আবদুল আযীযের অনুমতি নিয়ে এসব জায়গার সফর করতে আরম্ভ করলেন।
দোয়াব অঞ্চলের গাযিয়াবাদ, সাইমাম মীরাট, মুজফফরপুর, সাহারানপুর, দেওবন্দ প্রভৃতি স্থানে সৈয়দ আহমদ ব্যাপকভাবে সফর করলেন [১৮১৯]। প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ থেকে জানা যায় যে, তিনি যেখানেই গেছেন, অলৌকিকভাবে জীবনে বিপ্লব এনেছেন। তাদের অন্তরের পরিবর্তন ঘটিয়েছেন। তার উপস্থিতিতেই যেন আল্লাহর আশীস ও করুনা ঝরে পরত। ঘোর পাপীও তওবা করল, পথহারা মানুষ দিশা খুজে পেল এবং সাধুলোক মহত্তর জীবন অনুশীলনে মতুন প্রেরণা লাভ করেছিল। তার জনৈক জীবনীকার আবদুল আহাদ বলেন যে, প্রায় চল্লিশ হাজার হিন্দু ও অন্যান্য বিধর্মী তার শিক্ষার শিক্ষার মাধুর্যে মুগ্ধ হয়ে ইসলাম গ্রহণ করে। এই সফরকালেই সৈয়দ আহমদ শিখদের হাতে মুসলমানদের নির্যাতনের কাহিনী প্রথম শুনেন, তার অন্তর মন সমবেদনায় ভরে উঠলো। ১৮১৯ সালে তিনি শেষবারের মত দিল্লীতে ফিরে গেলেন এবং শীঘ্রই স্বদেশে গমন করেন। সেখানে প্রথম তার অগ্রজের মৃত্যিসংবাদ পেলেন।
এখানে তিনি কিছুকাল অতিবাহিত করেন। সেখানে এই খোদাভক্তদের জীবনযাত্রা ছিল আদর্শস্থানীয় এবং দর্শকদের শিক্ষার যোগ্য। দুর্ভিক্ষ প্রপীড়িত অঞ্চলে প্রায় সত্তর- আশি জন লোক সায় নদীর তীরে সৈয়দ বংশের পুরনো মসজিদের চারিধারে নিজ হাতে কুটির তৈরী করে বাস করতেন। সে বছর [১৮১৯ খৃঃ] গ্রীষ্মকালে জোর বৃষ্টি নামলো এবং নদী গুলতে প্রবল প্লাবন এলো। খাবার হয়ে পড়ল দুর্মূল্য ও দুষ্প্রাপ্য। কিন্তু সৈয়দ সাহেব নির্বিকার চিত্তে তার আশিজন খোদাপ্রিয় ও খোদাভক্ত সঙ্গী নিয়ে এবাদত বন্দেগীতে, লোকসেবা ও প্রচারকার্যে দিন রাত ব্যাস্ত থাকলেন। তার তখনকার কর্মব্যাস্ততায় হযরত ‘সারমান- অব দি মাউন্টের’ বিখ্যাত উপদেশাবলীর আক্ষরিক প্রতিপালনই লক্ষ্য করা যায়ঃ তোমার নিজের জীবনে কি খাবে কি পান করবে সে বিষয়ে কোন চিন্তা কর না- এমনকি দেহের চিন্তাও করনা যে, কি পরবে। কিন্তু আল্লাহর প্রেমে রাজ্যের প্রতিষ্ঠা কর তোমার এসবই হবে।
ইসলাম জগতের এতগুলো জ্ঞান- জ্যাতিস্কের যেখানে সমাবেশ ছিল, সেখানে শিক্ষার চর্চা বাদ যেতে পারেনা। সেখানে ছিলেন হুজ্জাতুল ইসলাম মওলানা মুহুম্মদ ইসমাইল- অসীম পান্ডিত্য সত্ত্বেও যিনি আজীবন ছায়ার ন্যায় নীরবে সৈয়দ সাহেবের মত অশিক্ষিত পীরের অনুগামী হতেন; শেখুল- ইসলাম মওলানা আবদুল হাই, কুতব- ই- ওয়াখত মওলানা মুহম্মদ ইউসুফ, শেখুল- মাশারখ হাজী আবদুল রহীম, এবং শেখুল শেখ ও আরও অনেকে। তারা সবাই শিক্ষা ও মর্যাদার মোহ ত্যাগ করে স্বেচ্ছায় সৈয়দ সাহেবের তল্পীবাহক ও পদানুসারী হয়েছিলেন। এসব মনীষীর জ্ঞানগর্ভ আলোচনা ও খোদ সৈয়দ সাহেবের উদ্দীপনাময় হৃদয়গ্রাহী বক্তৃতাবলী বাস্তবিকই মন ও আত্নার খোরাক ছিল। সৈয়দ সাহেবের নির্দেশক্রমে মওলানা ইসমাইল কর্তৃক সে সবের অনেকাংশ ‘সিরাত- উল- মুস্তাকিমে’ লেখা হয়েছে। প্রাতঃকালে প্রচারনা, দিবাভাগে কঠোর দৈহিক পরিশ্রম অ সারারাত্রি তহজ্জুদ অ এবাদাতে জাগরন- এসব ছিল এই খোদাভক্তদের দৈনন্দিন সাধারন কর্মসূচি। ইস্লামের খাঁটি গণতন্ত্র নিয়মে তারা মসজিদের মেঝেয় বসে একত্র খানাপিনা করতেন। সৈয়দ সাহেবের সাহচার্যে পূণ্য সঞ্চয় অ আল্লাহর করুনাভিক্ষা ছাড়া তাদের আর কোনও খেয়াল ছিলনা। একই উদ্দেশ্য সাধনে তারা পরস্পরের উপদেশ- নির্দেশঅ অসংকোচে গ্রহণ করতেন। শাহ ইসমাইল অন্যসব মহৎ ব্যাক্তির দুর্বলতাও অসংকোচে দেখিয়ে দিতেন, এমনকি তার পীরকেউ রেহাই দেননি। তিনি অসংকোচে সৈয়দ সাহেবের দৃষ্টি আকর্ষণ কলেন যে, তার বংশে বিধবাদের পুনরায় বিবাহ না দেওয়ার শরীয়তী বরখেলাপ রয়ে গেছে। সৈয়দ সাহেব তৎক্ষণাৎ তার মতের যৌক্তিকতা স্বীকার করলেন, এবং তার পরিবারের এই ইসলাম বিরুদ্ধ প্রথা রহিত করতে চেষ্টিত হলেন; আর তার প্রমাণ হিসেবে নিজেই প্রথমে তার জ্যাস্থভ্রাতার বিধবাকে পুনর্বিবাহ করলেন।
সৈয়দ সাহেবের শিক্ষার প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল ধর্ম থেকে ভণ্ডামি অ জাঁকজমক দূর করা। এবং জীবনের প্রত্যেক স্তরে বিশ্বনবীর সহজ সরল জীবনধারা অনুসরণ করা। ধর্মবিশ্বাসে তিনি ছিলেন তওহীদপন্থী, আল্লাহর একত্বে অকুণ্ঠ বিশ্বাসী- সবরকম শিরক যেমন পীর আওলিয়ার বিশ্বাস একেবারে ত্যাগ করা, ধর্মীয় অনুষ্ঠানে সুন্নার পাওবন্দ হওয়া এবং হযরতেরই একান্ত অনুসারী হওয়া। মোট কথা, তিনি ধর্মীয় আচার- অনুষ্ঠান পালনের চেয়ে প্রকৃত সাধু জীবন যাপনের দিকেই বেশি জোর দিতেন- কারন তার ফলেই মানুষ একটা মহৎ লক্ষের দিকে অগ্রসর হতে পারে এবং কেবলমাত্র আল্লাহর করুণারই ভিখারী হয় এ কথায় সন্দেহের অবকাশ নেই যে, তিনি নিজের ইচ্ছা ও আশা- আকাঙ্ক্ষাকে আল্লাহর ইচ্ছার উপর এতদূর সমর্পন করেছিলেন যে, কাজে ও বিশ্রামে, অনুরাগে ও বিরাগে সব সময় তিনি আল্লাহর ইচ্ছানুযায়ী চলতে প্রস্তুত থাকতেন।
সৈয়দ সাহেব যখন হজ্জে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন ও তার শরীক হতে সকলকে অনুরোধ জানালেন, তখন দলে দলে স্ত্রী- পুরুষ তার পাশে জমায়েত হতে লাগলো। ১৮২০ সালে ঈদের নামাজের পর প্রায় ৪০০ জনের একটি কাফেলা তার সঙ্গে সাঙ্গে রওয়ানা হল। এলাহাবাদে পৌঁছাবার পূর্বেই কাফেলাটি ৭০০ জনের হয়ে দাঁড়াল। নদী পারাপার হতে নৌকার অভাবে তার গতি শিথিল হল, তার উপর পথে নানা শহর থেকে আমন্ত্রণ আসতে লাগলো সেখানে তশরিফ নেওয়ার জন্য। এতে তার একটা সুবিধা হল যে, বহুস্থানে তিনি তার বাণী প্রচারের অবকাশ পেলেন। তিনি মানুষকে সহজ, সরল ও মহৎ জীবনের পথে আহ্বান করলেন, এবং হজ্জের প্রয়োজনীয়তা প্রচার করলেন। হাজার হাজার লোক তার নিকত বয়াত গ্রহণ করল এবং তার শিক্ষা বুকে ধারন করল। এখান থেকে কলকাতা ও সেখান থেকে মক্কাশরীফ পর্যন্ত তার আসা- যাওয়া প্রশংসামুখর সফরের বিশদ বিবরণ দেওয়া অসম্ভব। এখানে এইটুকুই বলা যথেষ্ট যে, হেজাজে ১৪ মাস অবস্থানের পর তিনি ১৮২৩ সালে রায়বেরেলীতে ফিরলেন। সুদীর্ঘ পথে লক্ষ লক্ষ মানুষকে খাঁটি ইসলামের মানুষ করে ও তাদের ঈমান বা ধর্ম বিশ্বাসকে সুসংস্কৃত করে, আর অসামান্য সম্মানের পশরা মাথায় নিয়ে।
পাক- ভারতে প্রত্যাগমন করে ১৮২৩ সালে প্রথমভাগে সৈয়দ সাহেব আত্মনিয়োগ করলেন শিখদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাবার উপযুক্ত মানুষ অ অর্থসংগ্রহ করতে। তিনি দেশের প্রত্যেক ধর্মনেতার নিকট পত্র পাঠালেন ফরয হিসেবে জেহাদের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতে অ জেহাদের জন্য সর্বতোভাবে সাহায্য করতে। এরকম একখানি চিঠিতে তিনি নওয়াব সুলেমান জাকে লিখেছেনঃ
আমাদের বরাতের ফেরে হিন্দুস্থান কিছুকাল খৃষ্টান অ হিন্দুদের শাসনে এসেছে, এবং তারা মুসলমানদের উপর ব্যাপক ভাবে নির্যাতন শুরু করেছে। কুফরী অ বেদাতীতে দেশ ছেয়ে গেছে এবং ইসলামী চালচলন প্রায় উঠে গেছে। এসব দেখেশুনে আমার মন ব্যাথায় ভরে গেছে, আমি হিজরত করতে ও জেহাদ করতে মনস্থির করেছি।
তিনি হৃদয়ঙ্গম করেছিলেন এবং তার দরুন বরাবর প্রচার করেছিলেন যে, প্রকৃত মুসলিম সমাজ সংগঠন করতে হলে শক্তি ও রাজ্যশক্তি প্রতিষ্ঠার দরকার। তিনি সীমান্তে কাজ শুরু করেন এই উদ্দেশে যে, কর্মকেন্দ্র স্থাপন করতে হলে একটা স্বাধীন এলাকার দরকার। তাছাড়া তিনি ভেবেছিলেন যে,সীমান্তের যুদ্ধপ্রিয় গোত্রগুলি তার বিশেষ সহায়ক হবে।
এভাবে ভারতের প্রত্যেক অংশে জেহাদের প্রস্তুতি ও প্রচারণা শেষ করে সৈয়দ আহমেদ ১৮২৬ সালে রায়বেরেলী ত্যাগ করেন। তারপর জীবনের বাকি ৬ বছর ধরে চলল আল্লাহর সত্য মহিমা প্রচার ও পাঞ্জাবে নির্যাতিত মুসলমানদের উদ্ধারের জন্য বিরামহীন প্রত্যক্ষ সংগ্রাম।
চারদিক থেকে টাকাকড়ি আসতে লাগলো। যুদ্ধের অস্ত্র, সরঞ্জাম ও ঘোড়াও আসতে লাগলো। হাজার হাজার মুজাহিদ তার ঝাণ্ডার নীচে জমায়েত হতে লাগলো। ১৮২৬ সালের শেষের দিকে এই বাহিনী যখন যাত্রা শুরু করল, তখন তার সংখা দাঁড়ালো ১২ হাজার। পরবর্তীকালে আরও মুজাহিদ ছোট ছোট দলে এসে যোগ দিল। তার অনুরক্ত মুরীদ টংকের নওয়াব এই মুজাহিদ বাহিনীকে প্রথম টংকে দাওয়াত দিলেন, এবং জেহাদের যাবতীয় আঞ্জাম নিজের তত্ত্বাবধানে শেষ করে কয়েক মাসের মুজাহিদ বাহিনী বেরেলী থেকে টংকে, তারপর মারিভানের মরুভূমি পার হয়ে সিন্ধুর মুরুভুমিতে, তারপর হায়দরাবাদ ও শিকারপুর হয়ে বোলানপাসের ভিতর দিয়ে আফগানিস্থানের কান্দাহারে এবং নওশেরার নিকটে উপস্থিত হল। পথে অসুবিধা ও দুঃখ কষ্টও কম ছিলনা। তবে শুক্কুরের পর থেকে পূর্বকার গঙ্গানদী বেয়ে তালমাওন থেকে কলকাতা পর্যন্ত নৌকায় যাত্রা বিজয় যাত্রার মত সর্বাঙ্গ সুন্দর হয়েছিল। চারিদিক থেকে সরদারগণ, শাসকগণ, স্থানীয় কর্মচারীগন এবং সাধারন লোক তাকে আনুগত্য জানিয়েছিল- কেউ বা নজরানা দিয়ে, কেউ বয়াত গ্রহণ করে, আবার কেউ বাহিনীতে যোগ দিয়ে। গযনী কাবুল ও পেশোয়ার পার হয়ে বাহিনী নওশেরায় হাজির হলে পর শিখদের প্রকাশ্যে আহ্বান জানানো হল ইসলাম গ্রহণ করার জন্য, অথবা বশ্যতা স্বীকার করতে অথবা যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে। শীঘ্রই এক নৈশ যুদ্ধে মাত্র ৯০০ মুজাহিদ বাহিনী এক বৃহৎ শিখ বাহিনীকে এমন সহজে পরাস্ত করল যে, সারা সীমান্ত প্রদেশে প্রশংসায় মুখর হয়ে উঠলো। অতঃপর বহু স্থানীয় সরদারগণ বিশেষ করে ইউসুফজায়ীরা সৈয়দ সাহেবের সঙ্গে যোগ দিলো।
কিছুদিন পর শের সিংহ ও একজন ফরাসী জেনারেলের অধীনে প্রায় ৩০ হাজার শিখ সৈন্য নিএ পেশোয়ারের মোহাম্মদ খাঁ ও তার ভ্রাতাদের নিকট কর দাবী করল। খুবী খাঁ মনপুরী আক্রমণ করতে শিখ বাহিনীর সাহায্য চাইলেন, এবং তিন হাজার শিখ সৈন্য তার সাহায্যার্থে অগ্রসর হল। কিন্তু মুজাহিদবাহিনি মনপুরী রক্ষার্থে অগ্রসর হলে শিখরা পঞ্চতরে সরে পরল। এবং সেখান থেকেও খন্ডযুদ্ধে পরাজিত হয়ে পলায়ন করল।
শিখদের বিরুদ্ধে এই বিরাট সাফল্য সাধারন লোকের উপর প্রভাব বিস্তার করল, এবং গরহি- ইমাজির প্রায় ১০ হাজার যুদ্ধপ্রিয় লোক সরওইয়াব খাঁর অধীনে সৈয়দ সাহেবকে ইমাম হিসেবে গ্রহণ করল। এমনকি পেশোয়ারবাসী তাকে নওশেরায় ঘাঁটি করতে ও শিখদের বিরুদ্ধে সামগ্রিক ভাবে অভিযান চালাতে আহ্বান জানালো। এই সময়ে প্রায় এক লক্ষ মুজাহিদ তার ঝাণ্ডার নীচে জমায়েত হয়। কিন্তু শেখ সেনাপতি বুধসিংহের প্রলোভন পেশোয়ারের সরদারগণকে বশোভুত করে ফেলল। এমনকি তারা যুদ্ধের পুর্বে সৈয়দ সাহেবকে গোপনে বিষ দানও করে ফেলে। যা হোক, সৈয়দ সাহেব তীব্র বমি করে অলৌকিক ভাবে রক্ষা পেলেন এবং অচৈতন্য অবস্থাতেই হাতির পিঠে চড়ে যুদ্ধক্ষেত্রে গমন করেন। কিন্তু সম্মুখ সমরেও পেশোয়ারের সরদারগণ শিখদের সঙ্গে যোগ দেয়, এবং এভাবে মনোবল হারিয়ে মুজাহিদরা পরাজিত হন।
এভাবে মারাত্মক আঘাত খেয়ে মুজাহিদ বাহিনীর অবস্থা সঙ্গিন হয়ে পরল। তখন তাদেরকে তিনটি দুশমনের মোকাবিলা করতে হয়- শিখ, পেশোয়ারের বিশ্বাসঘাতক সরদারগণ ও হুন্দের দুর্গ মালিক খুবী খাঁ। সৈয়দ সাহেব তখন সমগ্র সরহদ এলাকায় সফর করে ফিরলেন, এবং নাবিরা ও সোয়াতের দরবারেও উপস্থিত হলেন। টংকের নওয়াবকে এই সময়ের লেখা একটি চিঠি থেকে জানা যায় যে, প্রায় তিন লক্ষ লোক তখন তার নিকট বয়াত গ্রহণ করেন।
যুদ্ধশিবিরের জীবন ছিল বড়ো আশ্চর্য ধরনের। পারস্পরিক সাহায্য- সেবা, এবং সর্বোচ্চ নৈতিক ও ধর্মীয় জীবনাদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে প্রত্যেকেই সেখানে বাস করত। তার দরুন যারা যুদ্ধ শেষে জীবিত ছিল, তারা যেখানেই গেছে, সেখানেই নয়া জীবনের উজ্জ্বল আদর্শ বহন করে নিয়ে গেছে।
স্থানীয় মুজাহিদরা অবশ্য আপন আপন গৃহে বাস করত। প্রবাসী মুজাহিদদের সংখ্যা ছিল প্রায় ১ হাজারের মত, তারা বলাকোটের আশেপাশে বাস করত। তাদের মধ্যে তিনশো বাস করত সৈয়দ সাহেবের সঙ্গে পঞ্চতর শরের মধ্যে, এবং বাকী ৭০০ জন বাস করত আশেপাশের গ্রামগুলিতে। তাদের রসদ যোগান হত সারা ভারতব্যাপী ‘তগরীব- ই- মুহম্মদীয়া’ প্রতিষ্ঠানের গোপন কর্মকুশলতায়। শাহ্ আবদুল আজীজের দুই মশহুর পৌত্র মওলানা ইসহাক ও মওলানা ইয়াকুব ছিলেন তার কর্ণধার। দূর দূর অঞ্চল থেকে কাফেলার দল আসতো মানুষ নিয়ে, টাকা, রসদ ও চিঠিপত্র নিয়ে। এভাবে সারা ভারত থেকে যা আসতো তা এবং যুদ্ধে যা লুট করা হত সবই বায়তুল মালে রাখা হত। আর তার হেফাজতকারী ছিলেন শাহ্ ওইয়ালীউল্লাহর ভাইপো মুজাহিদ বাহিনীর কুতব মওলানা মোহাম্মদ ইউসুফ। তিনি এতদূর ন্যায়নিষ্ঠা ও নিরপেক্ষভাবে সব কিছু ভাগ করতেন যে, খোদ সৈয়দ সাহেবও একজন সাধারন মুজাহিদের চেয়ে বেশি অংশ পেতেন না। স্থানীয় বাশিন্দারা মুজাহিদদের সর্বতোভাবে সাহায্য করত- অবশ্য তাদের অবস্থাও ছিল শোচনীয়। যেখানে বাহিনীর প্রধান ঘাঁটি ছিল সেই পঞ্জতরের শাসকদের, বিশেষত ফতেহ খাঁ ও আশরাফ খাঁর নাম উল্লেখযোগ্য। সবরকম দৈহিক কাজ- যেমন, মেথরের কাজ থেকে ঘোরামীর কাজ সবই মুজাহিদদের করতে হত, অথচ তাদের মধ্যে দিল্লী আগ্রার এমন বহু শরীফ লোক ছিলেন, যাদের জীবন কেটে গেছে আরাম আয়েশ প্রতিপত্তি ও মর্যাদার সঙ্গে। তবু তারা এসব কাজ হাসিমুখে করতেন কেবল আল্লাহ প্রীতিতে মশগুল হয়ে। তাদের জীবনও ছিল বড় কষ্টের। যখনই বাইরের রসদে টানাটানি পড়ত ও স্থানীয় লোকদের সাহায্য মিলত না, তখন জীবন হয়ে উঠত আরও দুঃখময়। সাইদুর যুদ্ধের পর শীতকালটা বড়ো কঠিন সময় হয়ে পড়েছিল। প্রায়ই মুজাহিদগণকে গাছের ডাল, পাতা ও ঘাস খেয়ে কাটাতে হত। অথচ তাদের দেখে ভ্রম হত যেন সবাই উৎসব করতে এসেছে। এত হাসি, এত আনন্দ নিয়ে তারা নিজের নিজের কাজ সমাধা করে যেত।
ভদ্রতা ও সামাজিক সদ্ব্যাবহার, নৈতিক ও ধর্মীয় আচার- অনুষ্ঠান তারা কখনও অবহেলা করতনা। প্রত্যেকেই যেন সেবা করতে ও ত্যাগ করতে প্রস্তুত থাকত। তারা জেহাদ করত অত্যাচারীর বিরুদ্ধে আর সেই সঙ্গে জেহাদ করত হীন মনোবৃত্তির বিরুদ্ধেও। কুকথা, কুচিন্তা ও কুকাজ তারা সর্বোতভাবে পরিহার করত। মশহুর আলিম ও ফাযিলদের সাহচার্যে অশিক্ষিত দলও শিক্ষিত হয়ে উঠলো। শাহ্ ইসমাইল প্রতিদিনই কোরআনের তাফসীর শোনাতেন, ফলে শ্রোতারা পরবর্তীকালে সারা ভারতে তার বাণী ছড়িয়েছিল।
এই সময়ের মধ্যে শিখদের সঙ্গে যুদ্ধ লেগেই থাকত। তাতে বাংলা, বিহার ও মধ্যপ্রদেশের হালকা গঠনের মুজাহিদরা বেশ কৃতিত্বের সঙ্গেই শক্তিমত্তা প্রকাশ করত- শিখ ও বিশ্বাসঘাতক পাঠান গোত্রগুলি সমানভাবে তাদের হাতে মার খেত। পেশোয়ারের দুররানী সরদারেরা এরপর প্রকাশ্যভাবেই শিখদের সঙ্গে যোগ দিলো, কারন শিখদের টাকার লোভ তারা দমন করতে পারলনা। তারা বারে বারে মুজাহিদদের বিরুদ্ধে হামলা চালাত, কিন্তু প্রত্যেকবারই তারা প্রতিহত হত। খুবী খাঁ প্রকাশে স্থানীয় লোকদের মুজাহিদদের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলতে লাগলেন।
সৈয়দ সাহেব প্রথমে স্থির করলেন যে, খুবী খাকে শায়েস্তা করতে হবে। তিনি শাহ্ ইসমাইলকে মাত্র ১৫০ জন মুজাহিদ নিয়ে হুন্দ কিল্লাহ অধিকার করতে পাঠালেন। শাহ্ ইসমাইল রাত্রির অন্ধকারে অন্তরালে দুর্গদ্বারে উপস্থিত হলেন এবং প্রভাতে দ্বার খোলা হলেই নাটকীয়ভাবে প্রবেশ করে তিনি কিল্লাহ দখল করে ফেললেন। খুবী খাঁ নিহত হলেন। শাহ্ ইসমাইল দৃঢ়ভাবে সব গোলযোগ দমন করলেন। খুবী খাঁর ভাই ইয়ার মুহম্মদের সঙ্গে মিলিত হয়ে এক বিরাট বাহিনী নিয়ে হুন্দ কিল্লাহ পুনর্দখল করতে অগ্রসর হলেন। পঞ্জতরের শাসক আশরাফ খাঁর দুই পুত্র ইসলাম খাঁ ও ফতেহ খাঁর অনুরোধে সৈয়দ সাহেব নিজে হুন্দের দুই- তিন মাইল দূরে ছাউনি ফেললেন। বিপক্ষদলের ৩০০ অশ্বারোহী সৈন্য কিল্লাহ আক্রমণ করল কিন্তু বিফল মনোরথ হল। তখন দুই পক্ষ হারয়ানার প্রান্তরে সৈন্য বিন্যাস করল। শাহ্ ইসমাইলও কিল্লাহর ভার মওলানা মযাহার আলীর হাতে দিয়ে সৈয়দ সাহেবের সঙ্গে মিলিত হন। একটা আপোশের কথাবার্তা চলল, কিন্তু কন মীমাংসা হল না। তখন মুজাহিদরা ক্ষিপ্রগতিতে তাদের উপর হামলা চালায় ও দুশমনদের কামান দখল করে ফেলে। তার দরুন শত্রু পক্ষ সহজেই পরাজিত হল। এই সময় বহু মালামাল মুজাহিদদের হাতে পড়ল। কিন্তু স্থানীয় বাশিন্দারাই বেশিরভাগ মাল লুট করে নিয়ে পালায়। ইয়ার মুহম্মদ খাঁ নিহত হয়। আমীর খাঁর ভাগ্যও অনুরূপ হল। তখন শিখরা ও পেশোয়ারের সুলতান মুহম্মদ সৈয়দ সাহেবের বাকি প্রতিদ্বন্দী রয়ে গেলো।
অতঃপর সৈয়দ সাহেব কাশ্মীরে প্রধান ঘাঁটি স্থাপন করতে ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। কিন্তু আম্বের পায়েন্দা খাঁ বাধা দিতে চেষ্টা করলে শাহ্ ইসমাইল আম্ব অধিকার করেন এবং সেখানেই প্রধান ঘাঁটি স্থাপন করেন। ইতিমধ্যে শিখ নেতা রাজা রণজিৎ সিংহ একটা শান্তির প্রস্তাব পাঠান। তবে তার দূতের পেছনে একজন ফরাসী সেনাপতি ও শের সিংহ একদল বাহিনী নিয়ে অগ্রসর হন। কিন্তু মুজাহিদ বাহিনীকে একরোখা দেখে তারা পিছু হটাই যুক্তিযুক্ত মনে করে। তখন ইয়ার খাঁ স্থানীয় সরদারের সঙ্গে মিলিত হন এবং দূররানী গোত্র এক জোট হয়ে প্রায় বার হাজার সৈন্য নিয়ে মুজাহিদ বাহিনীকে আক্রমণ করে। তারপরও সন্ধির সলাপরামর্শ চলে ১৮৩০ সালের শেষ রাত্রি পর্যন্ত। কিন্তু তাও ব্যার্থতায় পর্যবসিত হয়। তখন মুজাহিদ বাহিনী প্রাণপণে শত্রুপক্ষকে আক্রমণ করে ও বিধ্বস্ত করে ফেলে এবং যায়দার যুদ্ধের মত তাদের সব কামানও দখল করে।
অতঃপর নির্বিঘ্নে পেশোয়ারে প্রবেশ করতে সৈয়দ সাহেবের আর কোন বাধা হল না। সকলেই তাকে সাদরে গ্রহণ করল। তিনিও একটা বিশাল অঞ্চলে শরীয়তী শাসন প্রবর্তন করার পূর্ণ সযোগ পেলেন। আম্ব থেকে মর্দান পর্যন্ত তার অধিকার স্বীকৃত হল।
কিন্তু বিশ্বাসঘাতকতার চরম মার তখনও হয়নি। সব রকম চালাকি ও চতুরতা খাঁটিয়ে সুলতান মুহম্মদ সৈয়দ সাহেবের ক্ষমা ভিক্ষা করলেন। সৈয়দ সাহেবও তার কথায় ভুললেন এবং শরীয়রতের বিধান অনুযায়ী শাসন চালাবার শপথ গ্রহণ করায় তাকে ক্ষমাও করলেন। মওলানা শাহ্ মযহার আলী কাজী নিযুক্ত হলেন। এ থেকে প্রমাণ হয় সৈয়দ সাহেবের কোন উচ্চাশা ছিলনা, শুধু আল্লাহর বাণী প্রচার করা এবং শরীয়তী শাসন প্রবর্তন করাই তার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল। শুধু রাজনৈতিক গরজেই তিনি একজন স্থানীয় শাসক নিযুক্ত করেছিলেন। অন্যথায় সামাজিক হিংসারই প্রশ্রয় দেয়া হত।
যা হোক, এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলে আল্লাহর দেওয়া অধিকারের প্রতিষ্ঠা করতে তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হলেন, এবং ইসলামী সমাজ ও আইন কানুন প্রবর্তনে বিশেষ চেষ্টিত হলেন। পেশোয়ারের নিযুক্ত কাজী সাহেব ও আরও বহু কর্মী সারাদেশে প্রচারকের আগ্রহ নিয়ে দিনরাত কাজ চালাতে লাগলেন। কিন্তু আফসোস এই যে, স্থানীয় লোকের জড়তা ও বহুদিনের কুসংস্কার তাদের উচ্চমান কর্মব্যাস্ততার বিরুদ্ধে দাঁড়ালো; তাদের অনৈতিক উচ্ছৃঙ্খলতা, কু- আচার ও বর্বর প্রকৃতির প্রতি স্থানীয় দেশাচার ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন ধর্মীয় বিশ্বাসের সমর্থন ছিল। অতএব সংস্কারের দল যখন এগুলোকে নির্মূল করতে চেষ্টিত হল, স্থানীয় লোকেরা করল অসহযোগ, এবং অজ্ঞতা ও ক্ষমতালোভী মোল্লার দল করল তীব্র বিরোধিতা। তার দরুন একটা ক্রুদ্ধ আক্রোশ সৈয়দ সাহেবের প্রতি ফেটে পড়ল। বিশ্বাসঘাতক সুলতান মুহম্মদও তার পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করল- এক রাত্রিতে সৈয়দ সাহেবের নিঃস্বার্থ কর্মীদল চক্রান্তমূলক নিহত হলেন!
এই বিষম বিপদে সৈয়দ সাহেব চরম আঘাত পেলেন। মাত্র এক আঘাতেই তিনি কতকগুলি মহৎ সৎকর্মী হারালেন এবং একটি বিস্তৃত অঞ্চল থেকেও বঞ্চিত হলেন। আর তার ফলে একটা আদর্শ সমাজ গঠনের আশাও বিলীন হয়ে গেলো। এভাবে মোহভঙ্গ হওয়ার দরুন বীতশ্রদ্ধ হয়ে তিনি স্থির করলেন যে, এই নিষ্ফলা নিমকহারামের দেশ ত্যাগ করে কাশ্মীরেই কর্ম কেন্দ্র স্থাপন করা উচিত। নওয়াব উযির- উদ্দউলাকে বালাকোট থেকে ১২৪৬ হিজরীতে ১৩ই জিলকদ তারিখের [১৮৩১ খৃঃ] লেখা শেষ চিঠিতে তিনি বলেছিলেনঃ পেশোয়ারের লোকেরা এতই হতভাগ্য যে, তারা জেহাদে আমাদের মুজাহিদ বাহিনীর সঙ্গে যোগ দিলনা, উপরন্তু তারা প্রলোভনে পরে গেলো এবং সারা দেশময় নানা কাজে আমাদের যেসব মহৎ লোক ব্যাস্ত ছিলেন, তাদের অনেককেই হত্যা করে ফেলল। আমাদের আসল সৈন্যবাহিনী অবশ্য অক্ষত ছিল এবং আল্লাহর রাহে শহীদদের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতেও তারা তৎপর ছিল। সেখানে আমাদের অবস্থানের আসল উদ্দেশ্য ছিল যে, বিধর্মীদের বিরুদ্ধে জেহাদে বহুসংখ্যক স্থানীয় মুসলমানের সাহায্য ও সহানুভূতি পাওয়া যাবে, কিন্তু বর্তমানে আর যখন কোন আশা নেই, তখন আমরা স্থির করলাম যে, সেখান থেকে পাখলির পাহাড়ী অঞ্চলেই স্থান বদল করব। এখানকার বাশিন্দারা অবশ্য আমাদেরকে দুহাত বাড়িয়ে গ্রহণ করেছে, জেহাদে যোগ দিয়ে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছে এবং বসবাস করতে আমাদের জমিজায়গাও দান করেছে। এখন আমাদের ঘাঁটি এমন নিরাপদ স্থানে অবস্থিত যে, আল্লাহর মরজি দুশমনরা আমদের সন্ধানও পাবেনা। তবে আমাদের মুজাহিদরা বের হলেই যুদ্ধ বেধে যাওয়া সম্ভব। এবং দুতিন দিনের মধ্যেই এমন একটা কিছু করার ইচ্ছাও তাদের আছে। আমার সম্পূর্ণ বিশ্বাস যে, করুণাময় আল্লাহ তাদের ভাগ্যে জয়ের দরওয়াজা খুলে দেবেন। আল্লাহর রহমত আমাদের উপর বজায় থাকলে এবং এই হামলায় আমরা জয়ী হতে পারলে ইনশাল্লাহ ঝিলাম পর্যন্ত অঞ্চল ও সারা কাশ্মীরটা আমাদের অধিকারে চলে আসবে। ইসলামের তরক্কীর জন্য ও মুজাহিদ বাহিনীর সাফল্যের জন্য মেহেরবানী করে দিনরাত আল্লাহর দরবারে মোনাজাত করুন।
এই সময় শের সিঙ্ঘের সৈন্যবাহিনী মুজাহিদদের মুখোমুখি ছিল। তিনি মুজাহিদ বাহিনীকে নির্মূল করার জন্য সামগ্রিক শক্তি প্রয়োগে শেষ হামলা করতে প্রস্তুত হচ্ছিলেন। সে আমলে বালাকোটে যাওয়ার দুটি রাস্তা ছিল তার একটি জঙ্গলে এত ভর্তি হয়ে উঠেছিল যে, স্থানীয় দু’ একজন বাশিন্দা ছাড়া অন্য কেউ তার অস্তিত্বেও জ্ঞাত ছিলনা। এবং দ্বিতীয় পথটি এমন একটা সংকীর্ণ গিরিসংকটের মধ্যে দিয়ে ও সেতুর উপর দিয়ে ছিল যে শত্রুপক্ষকে খুব সহজেই বাধা দেওয়া সম্ভব ছিল। এই দুটি পথই খুব সাবধানে পাহারা দেয়া হল। কিন্তু কয়েকজন বিশ্বাসঘাতক গোপনে শিখদেরকে জঙ্গলাকীর্ণ পথটির সন্ধান দিলো। তার ফলে শিখরা অতর্কিতে মুজাহিদ বাহিনীকে বেষ্টন করে ফেলল। কিন্তু কিছুমাত্র দমিত না হয়ে মুজাহিদরা বীরবক্রমে যুদ্ধ করল। এবং যে মহান ব্রতের জন্য তারা আজীবন সংগ্রাম করে আসছিলো, তার জন্যই অবশেষে জীবনদান করল। খোদ সৈয়দ সাহেবও তার বাহিনীর পুরোভাগে জেহাদ করতে করতে শহীদ হন। [ ১৮৩১ খৃঃ, মে ]
এভাবে এই উপমহাদেশে একটি আজাদ ইসলামী রাষ্ট্র গঠনপ্রয়াসী সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ শহীদের জীবনাবসান হয়। জীবনে তিনি নির্মম ভাবে বিশ্বাসঘাতকের হাতে প্রতারিত হয়েছেন, আর মরণের পরেও তিনি উপেক্ষিত হয়েছেন। কিন্তু তার অনুসৃত বৃহৎ আন্দলন স্তব্ধ হয় নাই। এই বিধন যজ্ঞের পরেও যারা বেচে ছিলেন, তাদের অনেকেই টংকে অথবা বিহারশরীফের সাতানায় সৈয়দ সাহেবের বিশ্বস্ত খাদেমের নেতৃত্বে এই আন্দোলনের কেন্দ্রস্থল স্থাপন করেন। পরবর্তীকালে পাঞ্জাবে সম্রাজ্জবাদী ইংরেজরা যখন শিখদের ন্যায় অত্যাচার শুরু করে, তখন মুজাহিদদের সর্বরস তাদের উপর উদ্যত হয়। কিন্তু তার দরুন তাদের ভাগ্যে জোটে কারাবাস, উৎপীড়ন ও ফাঁসিকাষ্ঠ মৃত্যুবরণের নির্মম শাস্তি, এবং তারও চেয়ে হীনতম ছিল নিম্নশ্রেণীর মোল্লা ও তথাকথিত আলেমদের দ্বারা এসব সংগ্রামী অগ্রপথিকদের নামে অযথা কুৎসা রটনা ও মিথ্যা ভাষণ। তাদের আন্দোলন নাকি ওহাবী আন্দোলনের নামান্তর এবং জেহাদ ঘোষণাও নাকি শরীয়ত বিরুদ্ধ। অবশ্য স্যার সৈয়দ আহমদের সদিচ্ছা প্রণোদিত বন্ধুদের ভূমিকা অনভিপ্রেত ছিলনা; কারণ, তারা বাস্তবিকই এসব বীর মুজাহিদের কার্যকলাপ এমন ভাবে সমর্থন করতে চেয়েছিলেন যে, তারা ইংরেজদের ক্ষতি বা অনিষ্টকামী নয় এবং তারা বিদেশী শাসকদের প্রতি অনুরক্ত ও বিশ্বাসীও বটে। বর্তমান পরিস্থিতে অবশ্য এরকম ছলনাময় ভূমিকার কোন দরকার নেই। এখন সময় এসেছে এসব বীর মুজাহিদের গৌরবোজ্জ্বল অসমসাহসিক কার্যাবলিকে স্বীকৃতি দেওয়া ও শ্রদ্ধা করা কারণ তারাই প্রকৃতপক্ষে এই উপমহাদেশে বহু পূর্বেই পাকিস্তানের বুনিয়াদ স্থাপনে সব রকম অন্যায়ের বিরুদ্ধে জেহাদ করেছিলেন। যদিও সৈয়দ সাহেবের প্রতিষ্ঠান মারফত পাকিস্তান হাসিল হয়নি, তবু একথা অনস্বীকার্য যে, তার মধ্যেই ছিল বীজমন্ত্র; আর ওয়াকিবহাল ব্যাক্তি মাত্রেই হৃদয়ঙ্গম করবেন যে, রায়বেরেলীর সৈয়দ আহমদ শহীদের দান ছিল এই চেতনা উজ্জীবনে অপরিসীম।