বালাকোটের বিপর্যয়ের পটভূমি
বালাকোটের বিপর্যয় আকস্মিক নয়, অভাবনীয়ও নয়। সাম্প্রতিককালে যেসব প্রামাণ্য ঐতিহাসিক তথ্য প্রকাশিত হয়েছে, সেসব থেকে নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয় যে, ১৮৩১ সালের ৬ই মে [ ২৪শে জিলকদ, ১২৪৬ হিজরী] তারিখে বালাকোটে সৈয়দ আহমদ ও শাহ্ ইসমাইল শহীদ কয়েক’ শ মুজাহেদিন নিয়ে যে মৃত্যুযজ্ঞের সম্মুখীন হয়েছিলেন, তা ছিল কারবালার মর্মন্তুদ ঘটনার মতই পূর্বনির্দিস্ট অবশ্যম্ভাবী ঘটনা। মুজাহিদদের আজাদী আন্দোলনের প্রায় পৌনে এক শতক ব্যাপী কর্মতৎপরতার প্রথম বিপর্যয় ঘটে বালাকোটে দ্বিতীয় বিপর্যয় ঘটে ১৮৫৭ সালের আজাদী সংগ্রামে। আর তার শেষ পরিণতি হয়েছিল ১৯১৯ সালের খেলাফত আন্দোলনে।
একথা সর্ববাদীস্বীকৃত যে, এ আন্দোলনের পুরোধা ছিলেন ভারতীয় আলেম সম্প্রদায়, যারা পরবর্তীকালে গোঁড়া, সংকীর্ণমনা, অপরিনামদর্শী ও প্রতিক্রিয়াশীল ‘মোল্লা’ হিসেবে ধিকৃত ও উপহাসিত হয়েছেন। কিন্তু একথা আজ তর্কের বিষয় নয় যে, পাক- ভারতে প্রথম বিদ্রোহ- বহ্নি প্রজ্বলিত হয়েছিল এবং প্রত্যক্ষ ভাবে এই বিদ্রোহ আন্দোলনকে সংগঠন ও পরিচালনা করেছিলেন মুসলিম আলেম সম্প্রদায়। বস্তুত পাক- ভারতীয় বাসিন্দাদের আত্মজিজ্ঞাসা ও আত্মচেতনার উদগাতা হিসেবে এই আলেম সমাজকে বিবেচনা করা অত্যুক্তি হলেও আংশিক ভাবে বাস্তব অবস্থাকেই স্বীকার করা হয়। কোনও রকম স্বার্থসিদ্ধির বাসনাউ চারিত না হয়ে এই আলেম সমাজ আজাদীর ঝাণ্ডা উর্ধে তুলে ধরেছিলেন ইসলাম রক্ষা, ধর্ম ও সমাজ- সংস্কার এবং ধর্মরাস্ট্র প্রতিষ্ঠার চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে। হয়তো তাদের মানসে কোন বাস্তব ধর্মরাস্ট্রের চিত্র বা পরিকল্পনা দানা বাধেনি এবং এই বিদ্রোহ আন্দোলন উপযুক্তভাবে সংগঠন ও পরিচালনা করবার সঠিক পরিকল্পনাও রচিত হয়নি। হয়তো তাদের ধর্মবুদ্ধি ও ইসলাম প্রীতি সমকালীন সমস্যাসমূহের মোকাবিলা করতে বাস্তব ও যুগোপযোগী পরিচ্ছন্ন দৃষ্টিভঙ্গি অর্জনে অক্ষম ছিল। কিন্তু একথা নিঃসন্দেহে সত্য যে, এই আলেম সমাজই- যাদের নেহাত সুবিধার জন্য সমকালীন শক্তিলোভী শাসকসম্প্রদায় ‘ওহাবী’ নামে চিহ্নিত করেছিল- পলাশীর পর ১৮৫৭ এর সারা ভারতব্যাপী বিপ্লবের পূর্বে ও পরবর্তীকালের আম্বালা ও সিয়াকোহ অভিযানের যুগ পর্যন্ত পাক- ভারতীয় জনগণের অন্তরে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, বিক্ষোভ ও আসন্তোসের তীব্র বহ্নি ধূমায়িত ও প্রজ্বলিত রেখেছিলেন। তাদের দেশপ্রেমে খাদ ছিল না, সে দেশপ্রেম নকল বা সৌখিন ছিলনা। বাস্তব সত্যোপলব্ধির আন্তরিকতার উপরেই ছিল তার জ্বলন্ত প্রতিষ্ঠা।
পাক- ভারতীয় মুসলমানদের এই রাষ্ট্রীয় চেতনার চেতনার মূল উদগাতা ছিলেন শাহ্ ওয়ালীউল্লাহ। তার হাতেই মুসলমানদের সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবন সংস্কারের যে কাজ আরম্ভ হয়, তার উপযুক্ত পুত্র ‘শামসুল হিন্দ’ শাহ্ আবদুল আজীজের সময় যে কাজ আরও প্রসারিত ও কর্মমুখর হয়ে উঠে। তারিই দুই উপযুক্ত শিষ্য সৈয়দ আহমদ ও শাহ্ ইসমাইলের হাতে এই আন্দোলনের ক্ষাত্রশক্তি উজ্জীবিত হয়ে উঠে, এবং প্রত্যক্ষ সংগ্রামের রূপ গ্রহণ করে। তাদের অস্ত্র প্রথমে উদ্যত হয় ক্ষমতাগর্বী শিখদের উপর; কারণ শিখরাই তখন মুসলমানদের ঈমান ও আমান বিপন্ন করে তুলেছিল। এজন্য এই জাতীয় সংগ্রামের প্রথম পর্যায়ে আমরা লক্ষ্য করি, মুজাহিদরা শিখদের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছে।
এই জেহাদের প্রথম স্তরে মুজাহিদরা আশ্চর্যমূলক জয়লাভ করলেও এমন একটা মরাত্মক ভুল করে বসে, যার দরুন ১৮২৯ সালের প্রথম ভাগে তাদের অবস্থা আশ্চর্যরুপ সুবিধাজনক হলেও শীঘ্রই সঙ্গীন ও সংকট জনক হয়ে উঠে, এবং শেষে বালাকোটের বিপর্যয়ে তাদের সব আশা ভরসার সমাধি হয়ে যায়। এই মারাত্মক ভুলটিকে ঐতিহাসিকগণ চিহ্নিত করেন, আন্দোলনের রূপটিকে ‘ইমারত- ই- জেহাদ’ বা জেহাদের ডাক থেকে ‘ইমারত- ই- শরীয়ত’ বা শরীয়তী শাসনের জিগীরে পরিবর্তন করা।
এই মারাত্মক পরিবর্তিত পদক্ষেপের পূর্বে সৈয়দ আহমদ ব্রেলভীর জন্য শ্রদ্ধার আসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল পাক- ভারতীয় প্রত্যেক মুসলমানের অন্তরে। আবার সে আসন সবচেয়ে নিরংকুশ ছিল সীমান্তবাসী আদি জাতিদের মধ্যে। আদি জাতিরা তখন তাকে এতোখানি শ্রদ্ধা করত ও ভালবাসত যে, ১৮২৬ সালের ডিসেম্বর মাসে যখন তিনি পেশোয়ার থেকে সিন্ধুনদের পশ্চিম দিকে অবস্থিত সাম্মা সমতল ভূমিতে অবতরণ করেন, তখন স্ত্রী- পুরুষ নির্বিশেষে সেখানকার প্রত্যেকটি মানুষ ‘সৈয়দ বাদশার’ ঘোড়ার পায়ের ধূলিতে চুমা দিতে থাকে, এবং তার উটের কাপড়খানিকে টুকরা টুকরা করে সংগ্রহ করে ‘তবররুক’ হিসেবে তাবিজ বাঁধবার জন্য। যদিও এই প্রথম কাফেলার গাজীদের সংখ্যা ছিল মাত্র ৫৫০ জন, তবুও তারা স্থানীয় সরদারের সহায়তায় শিখদের উপর ঝাপিয়ে পরে এবং আকোরা ও হুজরোর নৈশ আক্রমণে আশ্চর্য সাফল্য অর্জন করে। তার দু’তিন মাস পরে সিন্ধুনদের তটস্থ ছন্দে স্থানীয় বাশিন্দারা সৈয়দ বাদশার নিকট ‘ইমামাত- ই- জেহাদের’ বয়েত বা শপথ গ্রহণ করেন। তার ফলে ১৮২৭ সালের সাইদুর যুদ্ধের সময় সৈয়দ আহমদ প্রায় ৮০ হাজার আদিবাসী বাহিনী সংগ্রহ করতে সক্ষম হন, তার ৬০ হাজার ছিল ইউসুফজাই ও বজউর এলাকার এবং বাকী ২০ হাজার ছিল পেশোয়ার ও হাসতননগরের শাসক ভ্রাতৃদ্বয় ইয়ার মুহম্মদ ও সুলতান মুহম্মদের নিজস্ব তত্ত্বাবধানে।
গাজীরা যদি সাইদুর যুদ্ধে জয়লাভ করত, তাহলে শিখদের সিন্ধুনদের পূর্ব দিকে বিতাড়িত করে দেওয়া সহজ হত এবং তার ফলে হাজারা জিলা শিখদের হামলা থেকে একেবারে নিরাপদ করে সমগ্র উত্তর- পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ শিখদের অত্যাচার থেকে একেবারে রক্ষা করা সম্ভবপর হত। কিন্তু গাজীদের ভাগ্যই ছিল বিরূপ। তার কারণ এই নয় যে, গাজীরা সংখ্যায় শক্তিমত্তায় শিখদের চেয়ে দুর্বল ছিল। তার কারণ ছিল দুররানী সরদার ইয়ার মুহম্মদের দারুণ বিশ্বাসঘাতকতা এবং আদিবাসী বাহিনীর মধ্যে নিয়মানুবর্তিতার অভাব। স্থানীয় শিখ ও ইংরেজ লেখকদের সাক্ষ্যেই একথা পরিস্কারভাবে প্রমাণিত হয়েছে। যুদ্ধজয় যখন প্রায় নিশ্চিত, এই সঙ্গীন কঠিন মুহূর্তে ইয়ার মুহম্মদ বিষ প্রয়োগ করে সৈয়দ আহমদকে অজ্ঞান করে ফেলেন এবং তার দরুন মুজাহিদ বাহিনীতে বিশৃঙ্খলা শুরু হয়ে যায়। আর ইয়ার মুহম্মদও খটক পার্বত্য অঞ্চলের কূটনৈতিক অবস্থাপূর্ণ স্থানটি পরিত্যাগ করে ভ্রাতা সুলতান মুহম্মদ সহ শিখদের সঙ্গে যোগদান করেন এবং মুজাহিদ শিবিরের সমস্ত গুপ্তসংবাদ ফাঁস করে দেন। তাদের পলায়নের সঙ্গে সঙ্গে সমগ্র ৮০ হাজার আদিবাসী বাহিনী যেন কর্পুরের মত চারিদিকে মিলিয়ে গেলো, যুদ্ধক্ষেত্রে মাত্র ৯০০ মুজাহিদ টিকে রইল। গাজীরা অবশ্য প্রাণ তুচ্ছ ক্রে বীরবিক্রমে যুদ্ধ চালাতে থাকে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত পরাজয় বরন করতে বাধ্য হয়।
সাইদুর যুদ্ধিক্ষেত্রে আদিবাসী বাহিনীর পাঁচটি স্বাভাবিক দুর্বলতা প্রকট হয়ে উঠেঃ
[১] আদিবাসী সরদারেরা, বিশেষত সরদাররা মোটেই বিশ্বাসযোগ্য নয়, আর তার প্রধান কারন ছিল তাদের সর্বদাই স্বার্থান্ধ মনোবৃত্তি।
[২] আদিবাসীরা দুর্ধর্স যোদ্ধা ছিল সত্যি, কিন্তু তার নিয়মানুবর্তিতা ও শৃঙ্খলার মোটেই ধার ধারত না। এর জন্য হুন্দ, জায়দা, পঞ্জতর প্রভৃতির খানরা দৃঢ়ভাব অবলম্বন করেও অনুগামীদের সঙ্গিন মুহূর্তে ইতস্তত পলায়ন প্রতিরোধ করতে পারতেন না।
[৩] আকোরা ও হজরোর যুদ্ধকালে লক্ষ্য করা গেছে যে, আদিবাসীরা অত্যন্ত লুন্ঠনপ্রিয়। এমনকি ভীষণ যুদ্ধের সংকট মুহূর্তেও তাদের এ মনোবৃত্তি প্রদমিত করা সম্ভব হতনা। আর এজন্য প্রায়ই যুদ্ধ জয়ের সুযোগ নষ্ট হয়ে যেত।
[৪] আধিবাসিরা প্রায়ই যুদ্ধকালে সংখ্যাল্প গাজীদেরকে পুরোভাগ থাকতে বাধ্য করত এবং নিজেরা যথাসম্ভব নিশ্চেষ্ট থাকত।
[৫] মুজাহিদরা ছিল সংখায় অল্প এবং ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে নবাগত। আর তার দরুন আদিবাসীদের যুদ্ধকালীন বা শান্তির সময় চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে ছিল সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ।
সাইদুর যুদ্ধক্ষেত্রে আদিবাসীদের এসব চারিত্রিক দুর্বলতা যদি মুজাহিদ নেতারা সম্যকভাবে অনুধাবন করে সেগুলির সংশোধন ও দূরীকরণ করবার এবং উপযুক্ত যুদ্ধকৌশল অবলম্বন করার চেষ্টা করতেন, তাহলে হয়ত এই পরাজয়ের শোচনীয় ধাক্কা কেটে উঠতে পারতেন। কিন্তু এসকল কিছু ছিল তাদের অজানা। তার দরুন এসবের পরিবর্তে তারা নিজেরা আরম্ভ করলেন কঠোর কৃচ্ছ্র- সাধন ও নিয়ম পালন এবং আদিবাসীদের ধর্মীয় অনুরাগ উদ্দীপনা করবার সবরকম উপায় অবলম্বন। রণনীতির ও রাজনৈতিক নিয়মানুসারে তখন কর্তব্য ছিল শুধু ধর্মীয় ক্ষেত্রেই গঠন নয়, রাষ্ট্রীয় ও রণচাতুর্যের সম্পূর্ণ নয়ানীতি অনুসরণ করে অবস্থার সুশৃঙ্খলা আনয়ন করা। সৈয়দ আহমদ ও তার খলিফা তখন যেরূপ আশ্চর্য প্রভাব বিস্তার করেছিলেন অনুগামীদের উপর, তার দরুন এমন অবস্থা আনয়ন করা মোটেই কঠিন ছিলনা। সৈয়দ বাদশাহ ও শাহ্ ইসমাইল তখন জনগণের নয়নমণি এবং সদাররাও ছিলেন একান্ত বশংবদ। আকোরা ও সাইদুর যুদ্ধক্ষেত্রে মুজাহিদ বাহিনী যে নির্ভিকতা, ধর্মের জন্য প্রাণের তুচ্ছতা ও নিয়মানুবর্তিতা দৃষ্টান্ত দেখিয়েছিল তার দরুন সাধারণ আদিবাসীদের চোখে তাদের শ্রদ্ধাও বেড়ে গিয়েছিল। আদিবাসীদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে বলীর শ্রদ্ধা করা এমন কি ধার্মিকের চেয়েও। শাহ্ ইসমাইল ছিলেন মুজাহিদ নেতাদের মধ্যে ধর্মনিষ্ঠার ও বলবীর্যের মূর্ত প্রতীক। এমন ব্যাক্তিত্বের উপস্থিতিতে শুধু প্রয়োজন ছিল আদিবাসীদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সম্যক অনুধাবন করা এবং তার সুবিধা গ্রহণ করা। কিন্তু মুজাহিদ নেতাদের এখানেই ছিল শোচনীয় দুর্বলতা। আর তার দরিন একের পর এক নির্মম পরাজয় ও ব্যার্থতার সম্মুখীন হতে হয়েছে তাদের।
তাদের ভুলের সংখ্যাও ছিল মাত্রাবিহীন। মুজাহিদরা প্রথমকালে কোন ছাউনি প্রস্তুত করতনা। অথচ পরবর্তীকালে যখন তাদের প্রভাব একেবারে ক্ষয়িত হয়ে যায়, তখন তারা ইসমত ও চমরকন্দে নিজস্ব ছাউনি করতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু তার আগে পর্যন্ত তারা সরদারের গৃহেই আতিথ্যগ্রহন করে কাজ চালিয়ে নিত। তার দরুন স্বাভাবিকভাবেই নানা রকম অবাঞ্ছিত জটিল অবস্থার হতো।
সৈয়দ আহমদ প্রথম তার কর্মকেন্দ্র স্থাপন করেন হুন্দের দুর্ধর্ষ ইউসুফজাই সরদার খাদি বা গাদী খানের মেহমান হিসাবে। পরে পঞ্জতরের ফতেহ খানের ধর্মপ্রিতি ও জায়দার আশরাফ খানের ভক্তি- শ্রদ্ধা তাকে আকৃষ্ট করে এবং কোনও উপযুক্ত কারন না দেখিয়ে তিনি সহসা পঞ্জতরে কর্মক্ষেত্রে পরিবর্তন করেন। অথচ এ দুজন সর্দার ছিলেন খাদি খানের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী। আর এজন্য খাদি খান সৈয়দ আহমদের উপর বিরূপ হয়ে উঠেন। আরও এক সমস্যা ছিল যে মুজাহিদদের সংখ্যা ক্রমাগতই বর্ধিত হতে থাকত, আর তার দরুন তাদের আহার ও আশ্রয় যোগানো এক রকম অসম্ভব হয়ে দাঁড়াত; ফলে সবচেয়ে অতিথিবৎসল সরদারকেও নাজেহাল হয়ে পড়তে হতো।
যা হোক, এই সৈয়দ আহমদ একদল মুজাহিদ সোয়াত, চামলা ও বনায়ের সফর করলেন ‘হিদায়াত’ বা ধর্মশিক্ষা দানের উদ্দেশ্য নিয়ে। অন্য দিকে শাহ্ ইসমাইল বাকী মুজাহিদের বৃহৎ বাহিনী নিয়ে অভিযান চালাতে লাগলেন শিখদের অধিকার থেকে আম্ব ও হাজরা মুক্ত করতে। শাহ্ ইসমাইলের এ উদ্যম কিছুটা সফল হয় এবং সাময়িকভাবে তিনি কয়েকটি কিল্লাহ অধিকার করে ফেলেন দুশমনের কবল থেকে।
মুজাহিদদের ইতিহাসে এটাই ছিল গৌরবমণ্ডিত কাল। তাদের কর্মকেন্দ্র প্রথমে পঞ্জতরে ও পরে খেহরে থাকাকালে তাদের একাধিপত্য বিস্তৃত হয়ে পরে হাজারা, আশ্ব, সোয়াত ও দক্ষিণে নওশেরা ও আকোরা পর্যন্ত। সৈয়দ আহমদ এই সময় কিছুকাল একদল বেতনভোগী সৈন্য রাখতেও সক্ষম হয়েছিলেন এবং তখন একমাত্র দুররানী সরদাররা ব্যাতীত আর কারও সাধ্য ছিলনা তার কর্তৃত্ব অস্বীকার করার।
‘সৈয়দ বাদশার’ও তখন ছিল গৌরবমণ্ডিত সময়। তখন তার বশ্যতা স্বীকার করতেন এবং অনুগামী হিসেবে গর্ববোধ করতেন সমকালীন এসব আদিবাসী সরদারগণঃ আম্বের পায়েন্দা খান, মজফফরবাদের জবরদস্ত খান্দ ও নজব খান, জায়দার আশরাফ খান, সরবলন্দ খান তালোনী, আগরোরের গফুর খান, হাবিবুল্লাহ খান, শেবার আনন্দ খান, মিশকার খান, পঞ্জতরের ফতেহ খান, খানখেলের আমানউলাহ খান, ভাতগ্রামের নাসির খান, কাগান ও সিত্তানার সৈয়দগণ, তেহকালের আরবার বাহরাম, চারগলায়ের মনসুর খান, তুংগীর মাহমুদ খান, আলাদন্দের ইনায়াতউল্লাহ খান ইত্যাদি। হুন্দের খাদি খান যদিও অসন্তুষ্ট ছিলেন, তবুও তিনি সৈয়দ বাদশার বশ্যতা অস্বীকার করার সাহস পেতেন না।
তখন ছিল শিখদের বিরুদ্ধে ছোটখাটো অভিযান চালানোর চেয়ে ব্যাপক আক্রমণ করবার উপযুক্ত সময়। তার ফলে দুররানী সরদাররা ও পেশোয়ারের ইয়ার মুহম্মদ শিখদের সঙ্গে গোপনে ষড়যন্ত্র চালাবার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতো এবং সহজেই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ত। কিন্তু সৈয়দ আহমদ অন্য পন্থা অবলম্বন করতে চেয়েছিলেন। তিনি হয়তো ভেবেছিলেন, বরকাজই দুররানিদেরকে শায়েস্তা করে পশ্চাদভাগ নিরঙ্কুশ করাই যুক্তিযুক্ত হবে। তার এ কাজের যৌক্তিকতা সম্বন্ধে হয়তো মতভেদ থাকতে পারে, কিন্তু পরিণামে তার পক্ষে অসুবিধাই সৃষ্টি হয়েছিল।
ইয়ার মুহম্মদ ও সুলতান মুহম্মদ শিখদের আজ্ঞাবহ হয়ে এবং তাদের সহযোগ সিন্ধু রাজপুতনার মধ্য দিয়ে পাক- ভারতের অন্যান্য অঞ্চল থেকে মুজাহিদ শিবিরে টাকা ও অন্যান্য রসদ সরবরাহের পথে বারবার বাধা সৃষ্টি করেছিলেন। এজন্য দুররানিদেরকে শায়েস্তা করতে মুজাহিদ নেতারা প্রথমেই পেশোয়ার দখল করতে চেষ্টা করলেন। শাহ্ ইসমাইলের পক্ষে এটি ছিল একটি বলিষ্ঠ পদক্ষেপ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পেশোয়ার দখল করা সম্ভব হয়নি। তারা উত্মনজাই পর্যন্ত অগ্রসর হল এবং সরদায়ের ছ’ খানি বিরাট কামান দখল করে নিল। কিন্তু এ যুদ্ধজয়ে পশ্চিম দিকের বিপদ দূরীভূত না হয়ে নানা অসুবিধার সৃষ্টি হল। এখন ইয়ার মুহম্মদ প্রকাশে্য সৈয়দ সাহেবের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করলেন। আর তার ভাই সুলতান মুহম্মদ বিশ্বাসঘাতকতা করে মুজাহিদদের সর্বনাশ সাধনের উদ্দেশ্যে শিখদের সঙ্গে গোপন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলেন।
ঠিক এই সময়ে মুজাহিদ শিবিরে আত্মকলহ শুরু হয়ে গেলো, যার ফল হল অত্যন্ত বিষময়। শাহ্ ওয়ালীউল্লাহ আন্দোলনের অন্যতম নেতা মাওলানা মাহবুব আলী মুজাহিদদের জীবনধারার কয়েকটি বিষয়ে আপত্তি তুললেন শরীয়তের প্রশ্ন নিয়ে এবং শেষে বিরক্ত হয়ে শিবির ত্যাগ করে দিল্লী ফিরে গেলেন। উত্থাপিত প্রশ্নে হয়তো সত্য উভয় দিকেই ছিল এবং মাওলানা মাহবুব আলীকে একক দোষী করা নিশ্চয়ই সমীচীন হবে না। কিন্তু আত্মকলহের ফলে এই হল যে, দিল্লী থেকে মুজাহিদ শিবির একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো। অথচ তখন দিল্লীই ছিল এই আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র। শাহ্ আবদুল আজীজের মৃত্যুর পর তার গদ্দিনশীন শাহ্ ইসহাক মুজাহিদদেরকে সাহায্য পাঠাবার সবরকম চেষ্টা কতেন। কিন্তু মাহবুব আলীর মত নেতৃস্থানীয় মাওলনা প্রত্যাবর্তনে আন্দোলনটাই অনেকখানি আঘাতপ্রাপ্ত হল। অতঃপর ভারত থেকে মুজাহিদ শিবিরে মানুষ ও রসদ প্রেরণ একেবারে বন্ধ হয়ে গেলো। এবং সীমান্ত থেকে প্রাপ্ত সাহায্য ছাড়া সৈয়দ সাহেবের আর কোন উপায় রইল না। তিনি কিছুদিন একদল বেতনভোগী সৈন্য পোষণের ব্যাবস্থা করেছিলেন, কিন্তু অর্থাভাবে তাকে এই সৈন্যদলও ভেঙে ফেলতে হয়।
দিল্লী থেকে মুজাহিদ শিবির বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবার পর আরও কয়েকটি সংকটজনক অবস্থার সৃষ্টি হয়। অতঃপর পঞ্জতর অন্যান্য স্থানের উপর দিল্লীর নৈতিক প্রভাব একেবারে ক্ষয়িত হয়ে যায়। তার উপর ১৮২৮ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে অন্যতম মশহুর আলেম ও নেতা মাওলনা আবদুল হাই এর সহসা মৃত্যু হওয়ায় মুজাহিদ শিবিরের এক বিরাট ব্যাক্তিত্বের তিরোধান হয়। তার ফলে তাদের মনোবলও অনেকখানি দুর্বল হয়ে যায়। গোলাম রসুল মেহের প্রমুখ লেখকেরা ‘মনজুরা’ ও ‘ওয়াকেয়ার’ ঐতিহাসিক তথ্য থেকে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন যে, দিল্লীর তেমন কিছু প্রান সঞ্জীবনী ছিলনা মুজাহিদ শিবিরের উপর। কিন্তু এসব একদেশদর্শী বিবরণীর উপর নির্ভর না করে যদি নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গিতে যাবতীয় প্রাপ্ত ঐতিহাসিক তথ্য থেকে আলোচনা করা হয়, তাহলে কোন সন্দেহ থাকেনা যে, দিল্লীই ছিল মুজাহিদ শিবিরের প্রধান প্রান সঞ্জীবনী সূত্র এবং এ সূত্র ছিন্ন হয়ে যাওয়ার পর মুজাহিদরা স্বাভাবিকভাবেই দুর্বল হয়ে পরে।
কিন্তু অবস্থা চরমভাবেই খারাপ হয়ে উঠে আর একটি বেদনাদায়ক কারনে। তখন শিবিরে বাস করতেন ইয়ামেন দেশাগত আল্লামা শওকতী নামক একজন জবরদস্ত আলেম। তার প্রভাবে ও উদ্দীপনায় মাওলানা মুহম্মদ আলী রামপুরী, বিলায়েত আলী আজিমাবাদী ও আওলাদ হোসেন কনৌজী বেদাত- অবেদাতের প্রশ্ন তুলে মুজাহিদ শিবিরকে দ্বিবিভক্ত করতে উদ্যত হলেন। তখন অনন্যোপায় হয়ে সৈয়দ আহমদ ও শাহ্ ইসমাইল এই তিন জন উগ্রপন্থী মাওলানা কে শিবির থেকে বের করে ভারতে চালান দেন। কিন্তু তাতে সমস্যার সমাধান না হয়ে আরও জটিল হয়ে উঠলো। তারা একজন হায়দ্রাবাদ, মাদ্রাজ ও যুক্তপ্রদেশে হাজির হয়ে নিজ নিজ কর্মকেন্দ্র গড়ে তুলেন এবং নতুনভাবে মজহাবী বিরোধের সৃষ্টি করতে থাকেন। তার ফল এই হল যে, নয়া উদ্যমে তারা বেদাতী আলেমদের নামে ফতওয়া প্রচার করতে লাগলেন; আর সেই ফতোয়াগুলোকে ক্ষমতাগর্বী দুররানি সুলতান মুহম্মদ নিরীহ মুজাহিদদের বিরুদ্ধে ব্যাবহার করতে থাকেন। অথচ মুজাহিদরা কোন ওহাবী বা আহলে- হাদীস মতবাদের অনুসারী ছিলনা। বরং একথা সত্য যে, মুজাহিদ বাহিনী তখন পর্যন্ত এবং পরে নাসিরউদ্দিন দেহলভীর সময়ে ও ১৮৫২ সালে মাওলানা বিলায়েত আলীর মৃত্যুর সময় পর্যন্ত শাহ্ ওয়ালীউল্লাহর মৌল আন্দোলনের সঙ্গে নিবিড়ভাবেই জড়িত ছিলেন। একথাও সঠিক বলা যায়না যে, ওয়ালীউল্লাহর আন্দোলনের সঙ্গে পরবর্তীকালে চিহ্নিত আহলে- হাদীস কিংবা তথা কথিত ওহাবী আন্দোলনের বিচ্ছিন্নতা ঘটেছিল।
তবে একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, মুজাহিদ বাহিনীর উপর অন্তত ১৮৪০ সাল পর্যন্ত সুপন্ডিত ‘মওলানা’ ও ধর্মনিস্থ ‘সুফী’ দের প্রভাব বরাবরই ছিল অব্যাহত ও অপ্রতিদ্বন্দ্বী; আর তারা ছিলেন সৈয়দ আহমদ ব্রেলভী, শাহ্ ইসমাইল, শাহ্ আবদুল হাই, ‘কুতুব- ই- ওয়াক্ত’ ইউসুফ ফুলাতী, নিজামউদ্দিন চিশতী, ইমামউদ্দিন বাঙালি, ওয়ালী মুহম্মদ ফুলাতী, নাসিরউদ্দিন মাঙ্গালরী ও নাসিরউদ্দিন বেহলভীর মত সর্বজন মন্য আলেম ও সুফী। শাহ্ আবদুল আজীজের গদ্দিনশীন ও ওয়ারিস শাহ্ ইসহাক মুজাহিদ বাহিনীকে বরাবরই সাহায্য করে গেছেন ১৮৩৮ সালে তার হেজাজে হিজরত করা পর্যন্ত। তবে তিনিও সৈয়দ আহমদ কর্তৃক বহিষ্কৃত উপরোক্ত তিনজন মাওলানা মজহাবী বিরোধের প্রতিরোধ করতে সক্ষম হননি।
আমাদের এখানে উদ্দেশ্য নয় এই মজহাবি বিরোধের বিশ্লেষণ করা। ওহাবী হিসেবে চিহ্নিত সম্প্রদায়ের কিংবা মওলবী নজির হোসেন দেহলবীর অনুসারীর আজাদী সংগ্রামের ভূমিকা অস্বীকার করার অর্থই হবে প্রকৃত ও বাস্তব ঘটনার সত্যতা অস্বীকার করা। আবার তেমনই ভুল হবে মজহাবি দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে মুজাহিদ আন্দোলনকে মৌল ওয়ালীউল্লাহ আন্দোলনের একাংশ হিসেবে বিবেচনা না করে পৃথক দেখা।
যা হোক, কাহিনীর মূল সূত্রে ফিরে আসা যাক। আমরা পূর্বেই বলেছি যে, পঞ্জতরে অবস্থিত মুজাহিদ শিবিরের দিল্লী থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়াটা খুবই মারাত্মক ছিল। তার ফলে মুজাহিদ শিবির ১৮২৮ সাল থেকে ১৮৩১ সাল পর্যন্ত ভারতীয় মুসলমানদের চিন্তাধারা থেকেই বিচ্ছিন্ন হয়ে পরে। তখন শাহ্ শিবকাতুল্লাহ রাশদী প্রতিষ্ঠিত সিন্ধুকেন্দ্র ও সিন্ধুনদের অপর তীরস্থ টংক রাজ্যই মুজাহিদদের প্রধান সাহায্যের উৎস ছিল।
১৮২৯ সালে মুজাহিদ শিবিরে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়, যেটি মোটেই সময়োপযোগী হয়নি এবং যার ফলে এই বিচ্ছিন্ন ভাবটা আরও সঙ্গিন হয়ে পরে। সেটি হল পঞ্জতরকে কেন্দ্র করে ‘ইমারত- ই- শরীয়ত’ বা শরীয়তের শাসন প্রবর্তন করা।
একথা স্বীকার করতে হবে যে, আদর্শ হিসেবে এটি একটি উৎকৃষ্ট ও বলিষ্ঠ পদক্ষেপ। সমকালীন অবস্থা বিবেচনা করলে একথা অনস্বীকার্য যে, ক্ষমতাগর্বী শিখদের এবং রাজ্যলোলুপ ব্রিটিশের সঙ্গে সর্বাত্মক মুকাবিলা করতে হলে আদিবাসী এলাকায় শান্তি শৃঙ্খলা স্থাপন ও সামাজিক ধর্মীয় সংস্কারসাধন ছিল প্রথম কর্তব্য। তখনকার সীমান্ত এলাকা ছিল আদিবাসীদের গোত্রে গোত্রে ও মানুষে মানুষে অহরহ রক্তক্ষয়ী কলহ- দ্বন্দের এক শোচনীয় লীলাভূমি। আঞ্চলিক বাসিন্দাদের শৌর্যবীর্য ও যুদ্ধপ্রিয়তা ছিল অতুলনীয়, কিন্তু শতাব্দী ধরে তারা গোত্রীয় আত্ম কলহে মগ্ন থাকায় সে শক্তি ও সাহস শোচনীয়ভাবে অপব্যয় হয়ে হয়ে অবক্ষয় হয়ে পড়েছিল। বাশিন্দারা অবশ্য ছিল ইসলামে দৃঢ় বিশ্বাসী এবং আজাদী সংগ্রামের নির্ভীক যোদ্ধা। কিন্তু তাদের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবন আরবের ইসলামপূর্ব ‘আইয়ামে জাহেলিয়া’র চেয়ে কোনও অংশে উন্নত ছিল না।
এই রকম পরিস্থিতে সহসা ‘শরীয়তী শাসন’ প্রবতন কত দূর সমীচীন হয়েছিল, বিবেচনাযোগ্য। ইতিহাসে শিক্ষা ও দূরদর্শিতার মাপকাঠি বিচার করলে মনে হয়, এই পরিবর্তন সময়োপযোগী হয়নি। সাহসা কোন জাতির জীবনধারায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন সম্ভব হয় না। ক্রমে ক্রমে জাতীয় জীবনের ধারাকে পরিবর্তন সংশোধিত করতে হয় লোকমানসের সঙ্গে তাকে উপযোগী ভাবে গড়ে তোলবার চেষ্টা করে। লোকমানসকে উপেক্ষা করে রাতারাতি পরিবর্তন করতে গেলে সংশয় ও মানসিক দ্বন্দ্বের ফলে জনমন তার প্রতি বিমুখই হবে, অন্তরের সঙ্গে তা গ্রহণ করতে পারেনা। লোকমানস ও পরিবেশকে অবহেলা করে দ্রুত জীবনধারার পরিবর্তন সাধনের প্রচেষ্টা বহু ক্ষেত্রেই ব্যার্থ ও নিষ্ফল হয়ে গেছে।
বর্তমানক্ষেত্রে আদিবাসীদের সংস্কার ও মন- মেজাজের দিকে লক্ষ্য রেখে ক্রমে ক্রমে সামাজিক ও ধর্মীয় জীবনে সংস্কার সাধন ও শরীয়তী শাসন প্রবর্তন প্রচেষ্টা সবচেয়ে সমীচীন নিতি ছিল। তখন শিখরা বলদৃপ্ত হয়ে মুসলমানদেরকে কোণঠাসা করে ফেলে শিখসম্রাজ্য স্থাপনের স্বপ্ন দেখছিল। অন্যদিকে বিদেশী বণিকজাতি তুলাদণ্ড পরিত্যাগ করে। রাজদণ্ড ধারক পূর্বক সমগ্র উপমহাদেশে ব্রিটিশ সম্রাজ্জ স্থাপনের দিকে ধীরে ধীরে অগ্রসর হচ্ছিল। আদিবাসী সরদারের মধ্যে মোটেই ঐক্য ও সদ্ভাব ছিলনা। সমকালীন রাজনৈতিক অবস্থা সম্যক অনুধাবন করে ও বিবেচনা করে মুজাহিদ নেতাদের একমাত্র কর্তব্য ছিল, জনমানসকে এতোটুকু বিক্ষুদ্ধ ও প্রতিকুল না করে সমস্ত আদিবাসীদের মধ্যে ঐক্য স্থাপন করা, শিখ ও ব্রিটিশ শক্তির সম্যক পরিচয় উদঘাটন করে সমগ্র সরদারকে এক পতাকার তলে আনা ও সর্বত্মক জনযুদ্ধের পরিবেশ সৃষ্টি করা এবং জনমানস শিক্ষিত করার সঙ্গে একটু একটু করে শরীয়তী নিয়ম- কানুন প্রবর্তিত করে শরীয়তী শাসন প্রবর্তনের দিকে লক্ষ্য দেয়া। শিখদের বিরুদ্ধে একটা নিঃসন্দেহে যুদ্ধজয় এবং সম্মিলিতভাবে যুদ্ধজয় করার মনোবৃত্তি সৃষ্টি করার মধ্যেই ছিল তখন মুজাহিদদের শক্তিসঞ্চয় ও নিরংকুশ কর্তৃত্ব স্থাপনের উপযুক্ত কৌশল। তার ফলে যে আবেগ উত্তেজনা সৃষ্টি হতো, মুজাহিদদের যে মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হতো, তার দ্বারাই উপযুক্ত ক্ষেত্র প্রস্তুত করা যেত ক্রমে ক্রমে লোক জীবনকে শরীয়তী পন্থী করে নিয়ে প্রকৃত শরীয়তী শাসন প্রবর্তন করার।
মুজাহিদ কর্তৃপক্ষের এরূপ দূরদৃষ্টি ছিলনা। এজন্য শরীয়তী শাসন প্রবর্তনই প্রথম প্রধান কর্তব্য হিসেবে বিবেচিত হল। আদিবাসী চরিত্র অভিজ্ঞ হিতাকাঙ্ক্ষী পঞ্জতরের ফতেহ খান ও জায়দার আশরাফ খান এরূপ পন্থা সহসা অনুসরণ করার বিরুদ্ধে বার বার উপদেশ জানালেন জোরালো যুক্তি দেখিয়ে। কিন্তু তাদের সব উপদেশ ও সাবধানবাণী অগ্রাহ্য হল। অবশ্য প্রধান সরদার উদ্বিগ্ন ও দ্বিধাগ্রস্ত হয়েও সৈয়দ আহমদের প্রতি অকুণ্ঠ আনুগত্য স্বীকার করে কিছু দিন চুপ চাপ রয়ে গেলেন।
এই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহনে পাঠান সরদারদের সাবধানবাণীর চেয়ে শেষ পর্যন্ত পাঠান আলেম সম্প্রদায়ের জিদই প্রবল হয়েছিল। ১৮২৯ সালের ৬ই ফেব্রুয়ারী বাদ জুমা এক আজীম উশ শান জলসা বসে। সে জায়গায় শরীক হন প্রায় ২০০০ আলেম, কয়েকহাজার আদিবাসী এবং সোয়াত ও সাম্মা অঞ্চলের সমস্ত সরদার। বহু বাক- বিতণ্ডার পর সর্বসম্মতিক্রমে এসব সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়ঃ
[১] ইমামের নিকট বয়েত বা আনুগত্য স্বীকার করার পর তার না- ফরমানী করা গুনাহ কবীরা ও শক্ত অপরাধ।
[২] দলত্যাগীকে সৎপথে আনয়নের সব রকম চেষ্টা আপোষে ব্যার্থ হলে তার সঙ্গে জেহাদ জায়েজ।
[৩] এরকম জেহাদে যারা মৃত্যু আলিঙ্গন করে, তারা বেহেশতে শহীদের মর্যাদা পায় এবং বিরুদ্ধবাদীরা অনন্ত কাল দোজখে নিক্ষিপ্ত হয়।
বলাবাহুল্য, এরকম জালসা মাঝে মাঝে বসত ও গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গৃহীত হতো। পরবর্তী ২০শে ফেব্রুয়ারী জলসায় সৈয়দ মুহম্মদ হাব্বান নামে একজন স্থানীয় মশহুর আলেম নিযুক্ত হলেন কাজী- উল- কুজজাত এবং কুতুবউদ্দিন নাঙ্গাশারী নামে একজন স্থানীয় মোল্লা হলেন প্রধান কোতোয়াল।
পূর্বেই উক্ত হয়েছে যে, সাম্মা ও সোয়াতের সরদারগণ বিশেষত হুন্দের খাদি খান, জায়দার আশরাফ খান প্রথম থেকেই শরীয়তী শাসনের বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করেছিলেন।ফতেহ খান অবশ্য বিনা প্রতিবাদে এসব সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছিলেন, কিন্তু এ সময় তিনি যা বলেছিলেনঃ
এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা খুবই কঠিন কাজ। শরীয়তী শাসন প্রবর্তনের প্রধান লক্ষ্য হল, সব রকম ক্ষমতা ও ধনসম্পত্তি ত্যাগ করা। তার দরুন আমাদের জীবিকা উপার্জনের উপায় নষ্ট হয়ে যাবে। আর আমাদের মধ্যে বহু শতাব্দী ধরে প্রচলিত বহু রীতি ও প্রথাও বাতিল হয়ে যাবে। তবুও আমি সব রকম ঝুকি নিতে প্রস্তুত আছি। আমি অকুণ্ঠভাবে ইমামের আনুগত্য স্বীকার করে নিচ্ছি; কারন আমাদের শিক্ষায় হচ্ছে যে, এ পথেই আল্লাহর করুণা মিলবে ও মৃত্যুর পর নাজাত মিলবে।
শেষ পর্যন্ত আশরাফ খান, খাদি খান ও ফতেহ খান প্রমুখ আদিবাসী সরদারগণ একখানি একরারনামা সহি করলেন ও অঙ্গীকার করলেনঃ
[১] উলেমা জলসায় তারা যে আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করেছেন, বিনা প্রতিবাদে তা পালন করতে সর্বদা প্রস্তুত থাকবেন।
[২] তারা সৈয়দ আহমদকে ইমাম হিসেবে স্বীকার করলেন এবং বিনা প্রতিবাদে সর্বদাই তার হুকুম মেনে চলবেন বলে স্বীকৃত হলেন।
[৩] যেসব বেদাত আদিবাসীদের মধ্যে চলিত আছে, তারা সেগুলি বর্জন করলেন এবং ভবিষ্যতে তারা কুরআন ও সুন্নার নির্দেশ মুতাবেক চলতে বাধ্য থাকবেন।
নয়া পদ্ধতিতে যে হুকুমত প্রতিষ্ঠিত হল, তা আধুনিক পরিভাষায় একটি যুক্তরাজ্য, যেখানে প্রত্যেক সরদারের থাকবে সুশাসন এবং স্থানীয় শাসনকার্যে এক রকম দ্বৈত শাসন থাকবে, যাতে কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় শক্তির নির্দেশ বলবত থাকবে।
শরীয়ত সাসনে এসব নিয়ম গৃহীত হয়ঃ
[১] একমাত্র খলিফার জেহাদ ঘোষণা করার অধিকার থাকবে এবং এজন্য তিনি ‘ওশর’ [ উৎপন্ন ফসলের দশমাংশ] ও জাকাত আদায়ের হকদার হবেন।
[২] দেওয়ানী ও ফৌজদারি মামলার নিষ্পত্তির জন্য শরীয়তী আদালতে প্রতিষ্ঠিত হবে।
[৩] একটি বায়তুল মাল প্রতিষ্ঠিত হবে এবং সেখান থেকে মুজাহিদ ও অন্যান্য সকলের মধ্যে সমান হিসসায় মালামাল বণ্টন করা হবে।
[৪] স্বায়ত্তশাসনের অধিকারী আদিবাসীদের মধ্যে কোনও বিরোধ উপস্থিত হলে তার চরম নিষ্পত্তির অধিকার থাকবে খলিফার।
[৫] সকল প্রকার বেদাত বাতিল বলে গণ্য হবে।
[৬] একটি ‘ইহতিসাব’ [পুলিশ] দফতর গঠিত হবে এবং তার কর্তব্য হবে সাধারণের নৈতিক ও ধর্মীয় জীবন নিয়ন্ত্রণ করা এবং প্রত্যেক সমর্থ মুসল্মাঙ্কে ‘সিয়াম’ [রোজা] ও ‘সালাত’ [নামাজ] পালন করতে বাধ্য করা।
[৭] শিক্ষার ব্যবস্থা করার দায়িত্ব হবে সরকারের উপর। প্রত্যেক মহল্লায় মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হবে এবং কেবলমাত্র কুরআন, হাদীস ও ফিকহ শিক্ষা দেয়া হএব।
[৮] সব মুজাহিদ ও সব কর্মচারীকে গণ্য করা হবে আল্লাহর রাহে স্বেচ্ছাসেবক ও পদমর্যাদা নির্বিশেষে সকলকে সমান আহার ও বসন দেওয়া হবে,
[৯] কয়েকজন নেতৃস্থানীয় আলেম ও সরদার নিয়ে একটি ‘মজলিস- ই- শুরা’ গঠিত হবে।
সামাজিক ন্যায়নীতি ও সাম্যনীতির দিক দিয়ে বিবেচনা করলে একথা নিঃসন্দেহ যে, এ ছিল এক আদর্শিক পদ্ধতি, যা বিশ্বনবী ও খোলাফায়ে রাশেদীনের সাশনপদ্ধতির আদর্শেই গঠিত হয়েছিল। এ শাসনব্যাবস্থায় উচ্চ- নীচ, শিক্ষিত- অশিক্ষিত, ধনী- দরিদ্র কোন ভেদাভেদ একেবারেই ছিলনা। খোদ খলিফাও সাধারণ ভান্ডার থেকে বরাদ্দ পেতেন হীনতম ব্যাক্তির মতই মাত্র দৈনিক এক সের আটা, মোটা কাপড়ের দু’ খানি পোশাক ও একখানি কম্বল। তার কোনও বিশেষ ভাতা ছিলনা, সুবিধা ছিলনা বা আইনের চোখে রেহাই ছিলনা। তিনি ‘মজলিস- ই- শুরা’র নির্দেশমত শাসন চালাতে বাধ্য থাকতেন এবং প্রয়োজন হলে তার মতের বিরুদ্ধেও ঐ সিদ্ধান্ত চরম হিসেবে গণ্য হতো।
এরকম গণকল্যাণভিসারী সামাজিক ব্যাবস্থার প্রথমে বেশ সুফলই দেখা গিয়েছিল। আদিবাসী অধ্যুষিত সীমান্ত এলাকায় আইন- শৃঙ্খলার বালাই ছিল না। কিন্তু ইতিহাসে এই প্রথম এলাকাটিতে আইন ও শৃঙ্খলা স্থাপিত হল। মানুষের জীবনও হল মর্যাদাশিক্ত, আর বিনা কারণে কিংবা অতি তুচ্ছ কারণে মানুষের জীবন নিয়ে খেলা করা চলতনা। শতাব্দী ধরে যেসব আদিবাসীদের পারিবারিক বিরোধ ও রক্তের প্রতিশোধ নিয়ে মারামারি কাটাকাটি চলত, সহসা সেসব বন্ধ হয়ে গেলো। শরীয়তী আইন প্রবর্তনের পূর্বে আদিবাসীদের মধ্যে এ রীতি চলিত ছিল যে, কেউ যদি কোনও অপরাধ করে, তা সে যতই গুরুতর হোক না কেন, যদি সে কোনও গোত্রের নিকট আশ্রয় লাভ করত, তাহলে আর কেউ তার কেশ স্পর্শ করতে পারতোনা এবং এরকম চেষ্টা করলে সারা গোত্রটি অপরাধীর আশ্রয়দাতা হিসেবে তাকে রক্ষা করত তার ফলে বংশাবলীক্রমে বহু শতাব্দী ধরেও খুনখারাবী চলত। এখন অপরাধীরা এরকম নির্ভরযোগ্য আশ্রয় লাভে বঞ্চিত হল। বরং সকলের কর্তব্য হয়ে দাঁড়ালো, অপরাধীকে উপযুক্ত শাস্তি প্রদানে সাহায্য করা।
আদিবাসীদের মধ্যে এমন অনেক রেওয়াজ ছিল, যা নীতি- বিগর্হিত, সামাজিক শৃঙ্খলা বিপরীত ও শরীয়তের বরখেলাপ। যেমন বলপুর্বক বিবাহ করা, বিবাহার্থে কন্যা বিক্রয় করা, সাধারণ জিনিসপত্রের মত বিধবাগনকে ওয়ারিশানের মধ্যে ভাগ- বাঁটোয়ারা করে নেওয়া, চারের অধিক স্ত্রী গ্রহণ করা,বলপূর্বক স্ত্রীকে স্বামীর নিকট থেকে বিচ্ছিন্ন করা, বিধবাদের পুনরায় বিবাহ না দেওয়া, মৃতের নাজাতের জন্য মোল্লাদের নির্দিস্ট অর্থ দেয়া, ইচ্ছামত চুক্তি ভঙ্গ করা ইত্যাদি। এসব অদ্ভুত প্রথা প্রচলিত থাকার দরুন আদিবাসীদের নীতিজ্ঞান ছিল নিম্নস্তরের ও জীবন হয়ে উঠেছিল অভিশপ্ত। যাহোক, এসব কুপ্রথা যতই প্রাচীন ও সর্বজন- গ্রাহ্য হোক, নিশ্চয়ই শরীয়তের বরখেলাপ এবং কোন শরীয়তপন্থী এসব কুপ্রথার প্রচলন সহ্য করতে পারতোনা। অতএব এসব কুপ্রথার বিলোপ সাধন সকল ন্যায়নিষ্ঠ ও ধর্মনিস্ট ব্যাক্তিরই কাম্য। কিন্তু এ কাজ একদিনে করা নিশ্চয়ই যুক্তিযুক্ত ছিলনা। আদিবাসীরা ছিল অশিক্ষিত এবং বহু শতাব্দী যাবত প্রচলিত এসব প্রথাকে তারা ধর্মীয় অনুশাসনের মতই পালন করত। অতএব এখানে উচিত ছিল, ধীরে ধীরে জনমানসকে এসব কুপ্রথার কুফল সম্বন্ধে শিক্ষিত ও অবহিত করে তোলা এবং ক্রমে ক্রমে এগুলির বাতিল করার চেষ্টা করা, যেন জনমানস সহসা বিক্ষুদ্ধ না হয়ে ওঠে। কিন্তু কাজে প্রকৃত তাই করা হয়েছিল। এতোটুকু দূরদর্শিতা বা সবধানতা অবলম্বন না করে মানুষের স্বাভাবিক অনুভূতিকে শীঘ্রই ক্ষুদ্ধ ও উত্তেজিত করে তোলা হয়েছিল। আর তার দরুন কল্যাণভসারী হোক, এই সংস্কার সাধনের প্রচেষ্টায় আদিবাসীগণ শরীয়তী শাসনের বিরুদ্ধে খড়গহস্ত হয়ে উঠেছিল।
তাছাড়া আরও একটি প্রবল কারন ছিল। শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষার্থে সকলকে একটি কেন্দ্রীভূত কর্তৃত্বের অধীন করা হয়েছিল। অথচ আদিবাসীদের মজ্জাগত প্রবৃত্তিই ছিল কারও হুকুমের তাঁবে না হওয়া। তাদের নিকট স্বাধীনতা ছিল স্বেচ্ছাচারিতা। যারা এতোটুকু নিয়ন্ত্রণ বা নিয়মিতকরন মোটেই বরদাশত করতে পারতোনা। কিন্তু কোনও সভ্য সরকারই বল্পাহীন স্বেচ্ছাচারিতার প্রশ্রয় দিতে পারে না। এজন্য শরীয়তী শাসনকর্তৃপক্ষের যখন আইন ও শৃঙ্খলা রক্ষার্থে স্বেচ্ছাচারিতা নিয়ন্ত্রণ করতে চাইল, তখন আদিবাসীরা ক্রোধে ফেটে পড়ল।
অতএব দেখা যাচ্ছে যে, এ নয়া প্রবর্তিত সমজব্যাবস্থা যতই ভাল ও আদর্শিক হোক, বাস্তব ক্ষেত্রে তা ফলপ্রসূ হয়নি। এবং মুজাহিদ আন্দোলনের পক্ষে তা শুভও হয়নি।
প্রথম আঘাত এল খাদি খানের নিকট থেকে। মানেরী নামক গ্রামের স্বত্বাধিকার নিয়ে বিরোধটা উঠে। এই গ্রামখানি একটি আদিবাসী গোত্রের প্রায় নব্বই বছর ধরে আইনত মালিকদের বলপূর্বক বেদখল করে নিজেদের নিরংকুশ স্বত্বে ভোগ করত। এ নিয়ে বহু মারামারি ও রক্তপাত হয়েছিল। আদিবাসীদের প্রথা অনুযায়ী যারা একবার রক্তের বিনিময়ে কোনও জমি দখল করে তাতে তাদের স্বত্বাধিকার জন্মে যায় এবং আর তাদেরকে বেদখল করা চলেনা। সৈয়দ আহমদের নিকট মানেরী গ্রামের আদি মালিকরা গ্রামখানির স্বত্বা দাবী করল এবং তিনি ইসলামী আইনানুযায়ী গ্রামটি তাদেরকে প্রত্যার্পনের নির্দেশ দিলেন। এতেই খাদি খান বিদ্রোহী হয়ে উঠেন, কারন তিনি বিপক্ষদলের সাহায্যকারী ছিলেন।
খাদি খান ক্রোধে লিপ্ত হয়ে শত্রু শিবিরে যোগ দিলেন। তিনি শিখদের সঙ্গে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলেন, এবং একদল ধিখ বাহিনীকে পঞ্জতর মুজাহিদ বাহিনী আক্রমণ করতে সাহায্য করেন। কিন্তু শিখদের আক্রমণ কার্যকর হয়নি। তাদেরকে গাজীরা সহজেই বিতাড়িত করে।
অতঃপর সৈয়দ আহমদ আলেমদের ও খানদের একটি মজলিস আহ্বান করেন দলত্যাগীদেরকে কাফের হিসেবে ফতোয়া দিতে এবং তাদের হত্যা করা শরীয়তসম্মত রূপে ঘোষণা করতে। বলা বাহুল্য, এর লক্ষ্য ছিল স্বয়ং খাদি খান ও তার দলবল। মজলিশে এ নিয়ে তুমুল বাক- বিতণ্ডা হয় ও খাদি খানের প্রতি সহানুভূতিশীল খানরা মজলিশ ত্যাগ করেন। এরপর খাদি খান ও তার দলভুক্ত সদাররা প্রকাশ্যে শিখদের সঙ্গে যোগ দেয়। মুজাহিদরা তখন সিন্ধু নদের অপর তীরস্থ আটক আক্রমণ করবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল, কিন্তু খাদি খানের বিরুদ্ধতা ও শিখদের উপযুক্ত সময়ে সতর্ক থাকার ফলে মুজাহিদদের এ পরিকল্পনা ব্যার্থ হয়ে যায়।
সৈয়দ আহমদ অবশ্য শান্তিপূর্ণ উপায়ে খাদি খানের সমগে একটা আপোষ মীমাংসা করতে বার বার চেষ্টা করেছেন। এজন্য উভয় পক্ষে কয়েকটা বৈঠক হয় এবং খাদি খান এক পক্ষে সৈয়দ আহমদ ও শাহ্ ইসমাইল অন্য পক্ষে নেতৃত্ব দেন। খাদি খানকে ইসলামের দোহাই দিয়ে, ন্যায় ও নীতির দোহাই দিয়ে পুনরায় মিলিত হতে আহ্বান জানানো হয়। কিন্তু হুন্দের খান বরাবরই একরোখা রয়ে গেলেন। তার জওয়াবও ছিল পরিস্কার ও অর্থপূর্ণ। তিনি ‘ইমারত- ই- শরীয়ত’ সোজাসুজি অস্বীকার করেন এবং ‘মোল্লাদের’ ফতোয়ার বিরোধিতা করেন ও বলেন যে এগুলি আদিবাসীদের উপর বলবত হতে পারেনা। কারণ সরদারই এসব অঞ্চলের মালিক ও শাসক এবং তারা কারও হুকুমের তাবেদার নয়। তিনি দৃঢ় কণ্ঠে ব্যংগভরে বলেনঃ
মোল্লারা তো আমাদের এটোয়াটো খুঁটে খায়। আমরা ভিক্ষে দিই,অশর দিই, ইসকাত দিই, আর তাই তারা কুঁড়িয়ে খেয়ে বাচে। শাসননীতি তারা কি বোঝে? আমরা তাদের ফতোয়া মানি আমাদের সুবিধামাফিক। কিন্তু তাদের হুকুম আমরা মোটেই গ্রাহ্য করিনা। আমাদের শক্তি আছে, সাহস আছে, সামর্থ্য আছে আর আছে সমস্ত আদিবাসীরা আমাদের পিছনে। আমরা কারও অধীন নয়। মোল্লারা আমাদের প্রজা, আমরা তাদের প্রজা নয়।
এভাবে বিরোধটা দাঁড়ালো চরমে। খাদি খান পুনরায় শিখদের সঙ্গে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। জেনারেল ভেন্ডুরার অধীনে একটি শিখ বাহিনী হুন্দের খানের প্রদর্শিত পথে পুনরায় মুজাহিদ শিবিরে আক্রমণ করল। কিন্তু এবারও আক্রমকরা পরাজিত হল।
সৈয়দ আহমদ তখনও আশা ছাড়েনি। তিনি খাদি খানের সঙ্গে মিলন হবার শেষ চেষ্টা করলেন। কিন্তু কোনও কাজ হলনা। শাহ্ ইসমাইল এবার শর্ত দিলেন, কেবলমাত্র ‘তওবা’ করেই খাদি খান পুনরায় ফিরতে পারবেন। কিন্তু জেদী খান উত্তর দিলেনঃ আমি তো কোনও পাপ করিনি। আমরা দেশের শাসক, সৈয়দ বাদশার মত ‘মোল্লা’ ‘মওলবী’ মানুষ নয়। আমাদের জীবনই পৃথক ধরনের। আমরা পাঠানরা সৈয়দ বাদশার শরীয়তী পথে চলতে অভ্যস্ত নই, প্রস্তুত নই।
তখন মুজাহিদ কর্তৃপক্ষ উপায়ন্তর না দেখে হুন্দের আপদ নিশ্চিহ্ন করাই সাব্যস্ত করেন। প্রাচীনকালে ভারতবিজয়ী আলেকজান্ডারের আমল থেকে শিখদের কাল পর্যন্ত যে মশহুর কিল্লাটি এই উপমহাদেশের প্রবেশপথে অবস্থিত ছিল, এক অতর্কিত আক্রমনে মুজাহিদরা সেটা দখল করে ফেলে এবং খোদ খাদি খানও যুদ্ধে নিহত হন।
নানা কারণে এই বিজয় গুরুত্বপূর্ণ। শাহ্ ইসমাইলের যুদ্ধকৌশল, রণনীতির জ্ঞানের এটি একটি চূড়ান্ত পরিচয়। হুন্দ কিল্লাহটির অবস্থান ছিল সিন্ধুনদের মুখে সমগ্র পাঞ্জাব ও ভারতে প্রবেশদ্বারপথে। এরূপ গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অবস্থিতির দরুন অতঃপর আদিবাসী এলাকা বার বার শিখদের হামলা থেকে নিশ্চিত হল। এরকমও সম্ভাবনা দেখা দিলো যে, ভবিষ্যতে শিখদের সীমান্ত বিজয় স্বপ্ন একেবারে বিলীন হয়ে গেছে মুজাহিদদের হাতে। কিন্তু আফসোস এই যে, মুজাহিদদের অদৃষ্টই ছিল অপ্রসন্ন। খাদি খানের মৃত্যুতে এমন কয়েকটি ঘটনার সূত্রপাত হয় যার ফলে শোচনীয় বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠে।
খাদি খানের মৃত্যুর পর মুজাহিদ কর্তৃপক্ষ তার স্ত্রী ও সন্তানদেরকে আটক করে গোলমাল নিবারণের অজুহাতে। তার দরুন খাদি খানের শ্যালক ও জায়দার নয়া সরদার মুকাররব খাঁর মুজাহিদদের উপর খড়গহস্ত হয়ে উঠেন, অথচ ইতিপূর্বে তার পিতা আশরাফ খান বরাবরই মুজাহিদদের অকৃত্রিম বন্ধু ছিলেন। মুকাররব পলায়ন করে শত্রুপক্ষে যোগ দিলেন। সৈয়দ বাদশাহ তার কনিষ্ঠ ভ্রাতাকে জায়দার সরদার নিযুক্ত করেন।
এদিকে খাদি খানের ভাই আমীর খান উপস্থিত হলেন পেশোয়ারের দুররানি সরদার ইয়ার মুহম্মদের দরবারে। ইয়ার মুহম্মদ মুজাহিদশিবিরে হামলা করবার সুযোগের প্রতীক্ষা করছিলেন। তিনি আমীর খানকে সঙ্গে নিয়ে শিখদের দরবারে উপস্থিত হলেন ও মিত্রমূলক সন্ধি করলেন। নিজের বিশ্বস্ততার প্রমাণ সরূপ তিনি হুন্দের কিল্লাহ শিখদের অর্পন করলেন, নিজের পুত্রকে জামীন হিসেবে লাহোরে শিখদের দরবারে প্রেরণ করলেন এবং অতিপ্রিয় অশ্বিনী ‘লায়লা’কে উপহার দিলেন রণজিৎ সিংহকে। বলাবাহুল্য, বহু দিন থেকেই রণজিৎ সিংহের এই বিখ্যাত অশ্বিনীর উপর লোলুপ দৃষ্টি ছিল। শিখরা ইয়ার মুহম্মদকে অনেক যুদ্ধাস্ত্র দান করল। এভাবে সুসজ্জিত হয়ে স্বজাইদ্রোহী বিশ্বাসঘাতক দুররানি সরদার মুজাহিদ শিবির আক্রমণ করতে অগ্রসর হলেন।
১৮২৯ সাকের ৪ সেপ্টেম্বর জয়দার বিখ্যাত যুদ্ধ আরম্ভ হয়। শাহ্ ইসমাইল একটি ক্ষুদ্র মুজাহিদ বাহিনী নিয়ে দুররানি সরদারের মুকাবিলা করেন। এই যুদ্ধে তার রণচাতুর্থ চরমভাবে প্রকাশ হয়। ইয়ার মুহম্মদ নিহত হন এবং তার সৈন্যবাহিনী একেবারে বিধ্বস্ত হয়। মুজাহিদরা ছয়টি বৃহৎ কামান সহ তার সমস্ত সমরোপকরন হস্তাগত করে।
জয়দার যুদ্ধ মুজাহিদ সংগ্রামের এক স্মরণীয় অধ্যায়। ইয়ার মুহম্মদ খান মৃত এবন কুচক্রী সুলতান মুহম্মদ অবস্থার চাপে মুজাহিদদের বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য। মুজাহিদদের শক্তির প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে আপাতত কেউ আর সাহসী নয়। গুরুত্বপূর্ণ কিল্লাহ হুন্দ হস্তাগত হওয়ায় এবং কুচক্রী দুররানি সরদারেরা একেবারে বিধ্বস্ত হওয়ায় সিন্ধুনদের পূর্ব দিক শিখদের হামলা থেকে একেবারে সুরক্ষিত হয়ে উঠে। এদিকে নিশ্চিত হয়ে শাহ্ ইসমাইল তখন পূর্ব- উত্তর দিকের পুখলি অঞ্চলে অর্থাৎ হাজারা ও বর্তমান আজাদ কাশ্মীরের মুজফফরবাদ জিলায় দৃষ্টিপাত করেন। সৈয়দ আহমদ এবার স্বয়ং মুজাহিদ বাহিনীর সঙ্গে রইলেন। প্রথমে তারবেলায় আক্রমণ করা হয় এবং শিখদের হাত থেকে খাববল অধিকার করে নেওয়া হয়। তখন পরিস্কার বোঝা গেলো যে, এই অভিযানে আম্বের শাসক পায়েন্দা খানের সঙ্গে সাহায্যের শর্তাবলী সম্বন্ধে আলোচনা চলতে লাগলো। ঠিক এই সময় সক্রিয় সাহায্য ব্যতীত জয়লাভ করা অসম্ভব। অতএব পায়েন্দা খানের সঙ্গে সংবাদ পাওয়া গেলো যে, মুজাহিদ বাহিনীর অনুপস্থিতির সুযোগে সুলতান মুহম্মদ অতির্কিতে হামলা চালিয়ে হুন্দ দখল করে নিয়েছে ও পঞ্জতরে আক্রমনের চেষ্টা করছেন। তখন সৈয়দ আহমদ তাড়াতাড়ি পঞ্জতরে ফিরে আসেন ও শাহ্ ইসমাইলের উপর অভিযান চালাবার ভার দিয়ে।
পায়েন্দা খান শুধুমাত্র সাহায্য প্রত্যাখ্যান করেননি, তিনি বাধা দিতেও প্রস্তুত হলেন। শাহ্ ইসমাইল তাকে কানেরী, আশরা, কোটারিয়া ও আম্বের যুদ্ধে একে একে পরাজিত করেন ও সন্ধি করতে বাধ্য করেন। পায়েন্দা খানের সঙ্গে সন্ধিপত্র স্বাক্ষরিত হওয়ার পর সৈয়দ আহমদ সাময়িকভাবে আম্বের মধ্যে কর্মকেন্দ্র স্থাপন করেন।
অতঃপর শিখদের অধিকারে অবস্থিত ফুলরার দিকে মুজাহিদ বাহিনী অগ্রসর হয়। তখন শিখরা একটি সন্ধির প্রস্তাব করে। তারা পশ্চিম দিকের সমস্ত অঞ্চল সৈয়দ আহমদকে ছেড়ে দিতে রাজি হয় এই শর্তে যে, মুজাহিদরা হাজারা জিলায় কোনও হামলা চালাবেনা এবং একটিমাত্র অশ্ব শিখদেরকে বশ্যতা স্বীকারের চিহ্নস্বরূপ দান করবে! বলা বাহুল্য, এ প্রস্তাব ঘৃণার সঙ্গে প্রত্যাখ্যান হয়।
শাহ্ ইসমাইল পুখলির দিকে অভিযান চালাবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন। চারদিকের পরিস্থিতি সবই অনুকূলে ছিল মুজাহিদ পক্ষে। কিন্তু সহসা রুর আঘাতের মত সংবাদ এলো, সাম্মার আদিবাসীরা ‘ওশর’ আদায় করতে অস্বীকার করেছে ও বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে।
এ সংবাদ বজ্রঘাতের মতই মুজাহিদ শিবিরে পৌঁছে। সৈয়দ আহমদ শীঘ্রই একদল বাহিনীসহ কাজী সৈয়দ হাব্বানকে পঞ্জতরে পাঠান পরিস্থিতি আয়ত্তে আনতে। কিন্তু তার ফলে অবস্থা এমন সঙ্গীন হয়ে উঠে যে, পরবর্তীকালে সৈয়দ বাদশার পতন ও অনিবার্য হয়ে যায়।
কাজী সৈয়দ হাব্বান খুবই গোঁড়া মোল্লা হলেও বেশ কর্মকুশল ছিলেন। তিনি প্রথমেই শিখদেরকে সুলতান মুহম্মদ কর্তৃক ন্যস্ত হুন্দের কিল্লাহটি অধিকার করেন। তারপর তিনি প্রচন্ড তেজে বিদ্রোহী সরদারগণকে শায়েস্তা করতে অগ্রসর হন। তিনি বিদ্যুতগতিতে ঝাঁপিয়ে পরেন খালাবত, মারখাজ, থান্তকুই, টপ্পা অত্মাননামাহ, চার্গালাই, সুদ্দুম, শেখজানা, ইসমাইলিয়া, নবাকলাই প্রভৃতি কবিলার উপর। তাদের সরদাররা ও মোল্লারা সামান্য যুদ্ধেই বশ্যতা স্বীকার করেন। কেবলমাত্র হোতিমর্দান আয়ত্তের বাইরে রইলো।
কাজী হাব্বানের এ কৃতিত্ব স্বীকার করতেই হবে যে, তিনি এই উপদ্রুত অঞ্চলে অতি শীঘ্র কঠোর হস্তে শান্তি ও শৃঙ্খলা আনয়ন করেন। তার কর্যক্রমেও এতোটুকু অন্যায়ের প্রশ্রয় ছিলনা। কিন্তু তা ছিল কঠোর ও জবরদস্তিমূলক। তাতে এতোটুকু দয়ামায়ার স্পর্শ থাকত না। শক্তি ও জবরদস্তি দিয়ে মানুষের মন জয় করা সম্ভব না। কিন্তু দুটি মিষ্টি কথা, শান্তির কথা কিংবা হার্দ্যনীতির বালাই কাজী সাহেবের মোটেই ছিলনা। অতি তুচ্ছ অপরাধে, এমনকি নগ্ন দেহে কেউ পুকুরে- নদীতে গোসল করলেও তাকে বেত্রাঘাত করা হতো, জরিমানা আদায় দিতে হতো। ‘কন্যাপণ’ আদায় না দেওয়ার জন্য যেসব পিতা বিবাহিত কন্যাদেরকে ঘরে আটকে রাখত বহু কালের চলিত প্রথা হিসেবে, সেসব কন্যাকে বলপূর্বক স্বামীর নিকট পাঠিয়ে দেয়া হতো। তরুণী বিধবাদের জোরপূর্বক পুনর্বিবাহ দেওয়া হতো। সেনাবাহিনীর কেউ সামান্য কিছু জোরপূর্বক গ্রাম থেকে আদায় করলে যেমন অপরাধীকে শাস্তি দেয়া হতো, তেমনি ওশরের কড়াক্রান্তি পর্যন্ত আদায় করে গ্রামবাসীদেরকে উত্যক্ত করা হতো। মৃতের নাজাত ক্রয়ের জন্য ওয়ারীশানের নিকট থেকে মোল্লারা যেসব ‘ইসকত’ আদায় করতেন বহুকালীন প্রথা হিসেবে, তা একেবারে বন্ধ করে দেওয়া হয়। এ নিয়ে কোন মোল্লা সাহেব তর্ক তুললে তাকে রীতিমত প্রহার করা হতো এবং ‘আসতগাফার’ ও ‘কালেমা’ পড়ানো হয় ধর্মত্যাগীকে ইসলামে দীক্ষিত করার মত।
এসব জবরদস্তিমূলক কাজের জন্য সারা অঞ্চলে বিরক্তি ও চাপা বিদ্রোহের ঢেউ উঠতে থাকে। মোল্লারা ব্যাক্তিগতভাবে অশর ও ইসকাত আদায় করে নিজেরাই ভোগ করতেন। কিন্তু সরকার অশর আদায় করায় ও ইসকাত একেবারে বন্ধ হওয়ায় মোল্লাদের রুজি- রোজগারের পথও বন্ধ হয়ে যায়, অথচ তাদের জীবিকার কোনও দ্বিতীয় ব্যাবস্থা করা হল না। তার দরুন প্রথমে যে মোল্লাদের আগ্রহে ও সহযোগিতায় শরীয়তী শাসন প্রবর্তিত হয়েছিল, এখন তারাই একযোগে এই শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালেন। আর সরদারদের বিদ্রোহের হেতু পূর্বেই বিশদ হয়েছে। এভাবে কাজী হাব্বানের জবরদস্তি শাসনে বাহ্যিক শান্তভাব দেখা গেলেও প্রকৃতপক্ষে সিন্ধুনদের পশ্চিমভাগে সমগ্র সাম্মা অঞ্চলে ও পেশোয়ারে বিদ্রোহের বহ্নি জ্বলে উঠেছিল।
এরকম জঙ্গি শাসনে অঞ্চলটিকে শায়েস্তা করে কাজী হাব্বান নিশ্চিত মনে অগ্রসর হলেন হোতি ও মরদান দমন করতে। কারন হোতির সরদার আহমদ খান ও মরদানের সরদার রসুল খান ওশর আদায় দিতে অস্বীকার করেছিলেন। মুজাহিদ বাহিনী এই অভিযানও জয়ী হয়েছিল, কিন্তু হাজী হাব্বান নিজেই নিহত হন।
বিপদ কিন্তু এখানেই শেষ হয়নি। পেশোয়ারের সুলতান মুহম্মদ প্রায় ৮ হাজার অশ্বারোহী ও চার হাজার পদাতিক বাহিনী সংগ্রহ করে চামকানির নিকট যুদ্ধার্থে প্রস্তুত হলেন। পঞ্জতর আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিল এবং সৈয়দ আহমদ পুনরায় আম্ব থেকে কর্মকেন্দ্র সরিয়ে ফেলতে বাধ্য হলেন। প্রকৃত যুদ্ধক্ষেত্র হল মাআর তোরার মধ্যবর্তী সমতলভূমি। শাহ্ ইসমাইলের অপূর্ব রণচাতুর্য আর একবার কার্যকরী হল এবং সংখ্যায় কম হয়েও মুজাহিদ বাহিনী আবার জয়ী হল। হোতি ও মরদান পুনরায় অধিকৃত হল। সুলতান মুহম্মদ অতি কষ্টে পেশোয়ার পলায়ন করে আত্মরক্ষা করেন। কিন্তু পেশোয়ারও মুজাহিদদের অধিকার পথে এসে গেলো। তখন অনন্যোপায় হয়ে ‘তওবাহ’ করে সুলতান মুহম্মদ আত্মসমর্পন করলেন ও সন্ধি প্রার্থনা করলেন।
সৈয়দ আহমদ সুলতান মুহম্মদের চাতুরীতে ও মিষ্ট কথায় পুনরায় ভুললেন। এবং একটা মারাত্মক ভুল করে বসলেন। মুজাহিদ কর্তৃপক্ষ যে পরিমান সাহসী, নির্ভীক ও রণনিপুণ ছিলেন, তার উপযুক্ত কিছু পরিমানেও রাজনীতির কূটচাল বুঝতেন না।
সীমান্তে দীর্ঘকাল বাস করেও তারা এই দুররানি সরদারের কূটনৈতিক কুবুদ্ধি এতোটুকু অনুধাবন করতে সক্ষম হন নি। সুলতান মুহম্মদ বার বার বিশ্বাসঘাতকতা করে তাদেরকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছেন। তবুও তারা কুচক্রী স্বভাবের সম্যক পরিচয় পান নি। এজন্য যখনই অনন্যোপায় হয়ে সময় কাটাবার মতলবে সুলতান মুহম্মদ সন্ধি প্রার্থনা করলেন, সৈয়দ আহমদ সহজেই তার প্রস্তাবে রাজী হয়ে গেলেন। শাহ্ ইসমাইল ও অন্যান্য শুভানুধ্যায়ীরা বার বার সৈয়দ আহমদকে বুঝালেন এই বিষধর সর্প প্রকৃতির দুররানি সরদারের কাতর বাক্যে বিগলিত না হতে। তারা একটি একটি করে সুলতান মুহম্মদের পূর্বতন বিশ্বাসঘাতকতার চিত্র তার সামনে তুলে ধরেন। এমনকি জ্যেষ্ঠ ভ্রাতৃদ্বয় আযীম খান ও আমীর দোস্ত মুহম্মদের সঙ্গে তিনি কি ভাবে চরম বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন, সে সব নজীরও তুলে ধরেন। কিন্তু সরলমনা সৈয়দ আহমদ এসব মোটেই আমল দিলেন না। তিনি করুণা দেখিয়ে পেশোয়ার প্রত্যার্পন করলেন সৈয়দ মুহম্মদকে। সুলতান মুহম্মদের আনুগত্য স্বীকারে তিনি সন্তুষ্ট হয়ে নিজের একান্ত অনুগত কাজী মজহার আলীকে পেশোয়ারে রেখে ফিরে এলেন নিজের স্থায়ী কর্মকেন্দ্র।
সুলতান মুহম্মদ পেশোয়ারের গদি ফিরে পেয়ে নিজের মূর্তি ধরলেন। এবার অতি গোপনে বাকাপথে তিনি মুজাহিদ সংগঠনের সর্বনাশ সাধনে তৎপর হলেন। প্রথমে তিনি ব্রিটিশ ভারতে কয়েকজন ভাড়াটিয়া আলেমের এক ‘মজহার’ বা প্রচারপত্র সংগ্রহ করলেন। এতে সৈয়দ আহমদের একটি দলকে একটি অভিযানপ্রয়াসী কাফেরের দল ও সুন্নাত জামাতের বহির্ভুত হিসেবে ফতওয়া দেওয়া হয়েছিল। এসব আলেমের অনেকেই ছিলেন ইংরেজের বৃত্তিভোগী। সৈয়দ আহমদের দলত্যাগী কয়েকজন পূর্বতন অনুসারীও ছিলেন এই ফতোয়ার সমর্থক। আমরা পূর্বেই বলেছি যে, তার দল ত্যাগ করে বিলায়েত আলী আজীমাবাদী, মুহম্মদ আলী রামপুরী ও আওলাদ হোসেন দক্ষিণ ও পূর্ব ভারতে মুজাহিদ আন্দোলনের বিরুদ্ধে মহহাবি প্রশ্ন তুলে বিদ্বেশবীজ ছড়াচ্ছিলেন। তাদেরই অবিমৃষ্যকারিতায় মুজাহিদ আন্দোলন ওহাবী আন্দোলন হিসেবে স্বার্থান্ধ বিদেশী শাসকদের দ্বারা চিহ্নিত হয় এবং হানাফী- ওহাবী মতবিরোধের প্রবল তরঙ্গ তোলা হয়। যাহোক, একথা অনস্বীকার্য যে, মজহাবি বিরোধই আর একবার ইতিহাসে সপ্রমাণ করল যে, মুসলমানদের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছে মুসলমানরাই, বাইরের শত্রুর চেয়েও।
এরকম সর্বনাশা ফতওয়া হস্তগত করে সুলতান মুহম্মদ কয়েকজন মোল্লা সংগ্রহ করলেন এবং মুজাহিদ সংগঠনের বিরুদ্ধে প্রচার কার্যে পাঠিয়ে দিলেন। মোল্লারা গ্রামে গ্রামে সফর করে অশিক্ষিত অধিবাসীদেরকে ক্ষেপিয়ে তুলতে লাগলো মুজাহিদদের বিরুদ্ধে। এই বিদ্বেষ প্রচারনার খবর যথাসময়ে সৈয়দ আহমদের কানে পৌঁছাল। কিন্তু সুলতান মুহম্মদ সৈয়দ সাহেবের সঙ্গে বাহ্যিক ও মৌখিক এমন সদ্ভাব বজায় রেখে চলতেন যে, তিনি এসব সুলতান মুহম্মদের বিরুদ্ধবাদীদের মিথ্যা গুজব হিসেবে উড়িয়ে দিলেন।
এভাবে মুজাহিদদের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারকার্য চালিয়েই সুলতান মুহম্মদ ক্ষান্ত থাকেন নি, তাদেরকে ব্যাপকভাবে হত্যা করবার এক গোপন পরিকল্পনাও তিনি প্রস্তুত করেছিলেন। এজন্য তিনি গোপন সাংকেতিক শব্দও ব্যাবহার করতেন। তার একটি ছিল ‘খুন্দরুশ কোবী’ অর্থাৎ জোয়ার ভাঙার প্রস্তুতি। একটি নির্দিষ্ট রাত্রে সমস্ত মুজাহিদকে একযোগে হত্যা করে ফেলাই হল এই সাংকেতিক কথার ইংগিত। এ সম্বন্ধে সৈয়দ আহমদকে পূর্বেই সাবধন করা হয়েছিল, কিন্তু তিনি এ সংবাদও বিশ্বাস করতে পারেন নি।
নির্দিষ্ট দিন- ক্ষন উপস্থিত হলে সুলতান মুহম্মদ কাজী মজহার আলীকে ডেকে পাঠালেন পরামর্শ গ্রহনের অছিলায়। কাজী সাহেব সুলতানের দরবারে উপস্থিত হলেই সংকেত দেওয়া হয় এবং দশ বারো জন ঘাতক সহসা তাকে কেটে কেটে খন্ড খণ্ড করে ফেলে। কাজী মজহার হত্যাকাণ্ড ছিল মোল্লা প্রচারিত বিদ্রোহের প্রধান ইংগিত। সেই রাত্রেই সারা অঞ্চলব্যাপী মুজাহিদরা যখন নিশ্চিতমনে কউ ইশার নামাজে, কেউ ঘুমে, আবার কেউ গল্প গুজবে মত্ত ছিল, তখন তাদেরকে একযোগে হামলা করে হত্যা করে ফেলা হয় এবং ঘোড়া ও খচ্চর দিয়ে তাদের মৃতদেহগুলি পিষে ফেলা হয়। এভাবে খন্দরুশ কোবীর বীভৎস অভিনয় চলে সাম্মা, হশতনগর ও পেশোয়ারের সারা অঞ্চলে। এখানে প্রায় কয়েক হাজার মুজাহিদ মৃত্যু আলিঙ্গন করেন।
এ সংবাদ বজ্রঘাতের মতই পঞ্জতরে পৌঁছাল। তখন মাত্র এই এলাকা ব্যাতীত সমগ্র আদিবাসী অঞ্চল হিংসায় মেতে উঠেছে মোল্লা ও মালিকদের প্ররোচনায়। সৈয়দ আহমদ পরিণতির গুরুত্ব সম্যক বিবেচনা করে আম্ব ও পুখলি অঞ্চল থেকে মুজাহিদ বাহিনী পঞ্জতরে ফিরিয়ে আনেন। এত দিনে তার চৈতন্য হল এবং বেশ বুঝলেন যে, গত চার বছর ধরে মুজাহিদ বাহিনী কঠোর কৃচ্ছতা ও পরিশ্রম করে যা কিছু করতে সক্ষম হয়েছিল, সবই ব্যার্থতায় পর্যবসিত হল। এই গুরুতর অবস্থায় কি করা সমীচীন, সে বিষয়ে পরামর্শ করার জন্য অনুগত সরদারদের এক জলসা ডাকা হয়। কোনও কোনও সরদার প্রতিশোধ নেয়ার পক্ষে মত দিলেন। কিন্তু ফতেহ খানের মত জবরদস্ত সরদার কোনও ভরসা দিতে পারলেন না। সব দিক বিবেচনা করে তিনি সৈয়দ আহমদকে যুক্তি দিলেন শীঘ্রই পঞ্জতর ত্যাগ করে নিরাপদ স্থানে চলে যেতে।
ভারাক্রান্ত মনে, ভগ্নহৃদয়ে সৈয়দ আহমদ বাকী মুজাহিদদের একত্রিত করলেন, এবং ৯০০ অনুচর সহ দ্বিতীয় হিজরত শুরু করলেন পঞ্জতর ত্যাগ করে পুখলির দিকে। ১৮৩১ সালের ফেব্রুয়ারী মাস। তখন কঠোর শীত ও তার যাত্রাপথ ছিল দুর্গম গিরিপথ দিয়ে। আম্বের শাসক পায়েন্দা খান তাকে সজাপথে ছাড় দেন নি। এজন্য মুজাহিদদেরকে উত্তর দিকে দুরতিক্রম্যা পথ বেছে নিতে বাধ্য হল। এ পথে তাদেরকে বহু হিমবাহ অতিক্রম করতে হয়েছে আঁকাবাঁকা ভঙ্গুর গিরিপথে সাচচুন হয়ে কাড়ান উপত্যকার প্রবেশমুখে বালাকটে উপস্থিত হন। বহু ভারবাহী পশু পথে মারা পড়েছে, বহু আসবাব পত্র নষ্ট হয়েছে। শ্রান্ত, ক্লান্ত, মৃতপ্রায় মুজাহিদরা এপ্রিল মাসের শেষ দিকে বালাকোটে উপনীত হন। তাদের গন্তব্য স্থান ছিল মুজাফফরবাদ। কিন্তু সৈয়দ আহমদ তখন যেন অন্য ভাবে বিভোর। তিনি মনস্থির করে ফেলেছে যে, শিখদের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতেই যুদ্ধ করবেন এবং শহীদ হয়ে মুসলমানদের অর্জিত পাপের প্রায়শ্চিত্ত করবেন। পুখলির দিকে গমনপথে তিনি বহুবার অনুগামীদেরকে ‘নসিহত’ দেওয়ার সময় এ অভিমত সুস্পষ্টভাবে ব্যাক্ত করেছেন। হাজারা অঞ্চল তখন সর্বদাই অন্তর্বিদ্রোহ দ্বারা আক্রান্ত থাকতো এবং অস্থিরমতি সরদাররা শিখদের অনুচর হিসেবে নিজেদের সর্বনাশ নিজেই ডেকে আনত। পুখলি সে সময় ঘন ঘন শিখদের বিদ্রোহের শিকার হত। এই রকম একটা অভিযানে সৈয়দ আহমদ তাদের উপর ঝাপিয়ে পড়ে শহীদ হবেন, এ অভিপ্রায় তিনি বহুবার মুজাহিদদের নিকট প্রকাশ করেছেন।
কিন্তু তার নিয়তই ছিল বালাকোটের ময়দানে শহীদী সম্মান লাভ করা। জেনারেল শের সিংহ এক বৃহৎ শিখ বাহিনী নিয়ে খোরারীর সরদার সজফ খানের প্রদর্শিত গুপ্তপথে বালাকতে উপস্থিত হলেন ও মুজাহিদ বাহিনীকে ঘেরাও করলেন। সজফ খান অবশ্য প্রতিদ্বন্দী সরদারেরই বিনাশ চেয়েছিলেন, সৈয়দ আহমদের মৃত্যু চাননি কিংবা তার বাহিনিকেউ ফাঁদে ফেলতে চাননি। কিন্তু অবস্থা সঙ্গীন দেখে তিনি সৈয়দ আহমদকে বাচাতে চাইলেন এবং অবস্থার গুরুত্ব ভালোভাবে বুঝিয়ে দিয়ে মুজাহিদদেরকে একটি গুপ্তপথেরও সন্ধান দিলেন প্রাণ নিয়ে পালিয়ে যেতে। শেষ পর্যন্ত কাগান উপত্যকার দিকে পালিয়ে যাওয়ার একটি নিরাপদ পথও খোলা ছিল মুজাহিদদের সামনে। এবং তারা ইচ্ছা করলে পাহাড়ের অপর পাশে দ্রুত পালিয়ে যেয়ে আত্মরক্ষা করতেও পারতেন। কিন্তু কোন মুজাহিদের তখন এই মনোবৃত্তি জাগেনি। তারা সত্যের জন্য, ন্যায়ের জন্য হাজার হাজার মাইল দূরে এসেছেন, প্রয়োজন হলে জান কুরবানী দিতে। আর বালাকোটের শহীদী দরগাহে যখন সে সুযোগ উপস্থিত হয়েছে, তখন কন মুজাহিদ সে সুযোগ অবহেলা করতে পারেন?
১৮৩১ সালের ৬ই মে এই যুদ্ধ শুরু হয়। এটাকে ঠিক যুদ্ধ বলা চলেনা। শিখপক্ষে ২০ হাজার সুসজ্জিত সুশিক্ষিত সৈন্য। আর পথশ্রমে ক্লান্ত, ক্ষুতপিপাসার্ত ও সুলতান মুহম্মদ শাহের বিশ্বাসঘতকতায় ভগ্নোৎসাহ প্রায় ৯০০ মুজাহিদ। এ ছিল মৃত্যু- অভিসারীদের বহ্নিবন্যায় মুক্তিস্নান। দুর্মদাবেগে তারা ঝাপিয়ে পড়লেন ‘জীবন- মৃত্যু মিশেছে যেথায় মত্ত ফেনিল স্রোতে’। শাহাদাত বরণ করলেন সঙ্গীসহ সৈয়দ আহমদ ও শাহ্ ইসমাইল।
আমাদের আজাদী- জেহাদের প্রথম অধ্যায় এখানেই শেষ।
আজাদীর অমর সৈনিক মাওলনা মুহম্মদ আলী একদা বলেছিলেনঃ মুসলমানের জীবনকাহিনীর বিস্তৃতি মাত্র তিনটি অধ্যায়েঃ হিজরত, জেহাদ ও শাহাদাত। সৈয়দ আহমদ ও শাহ্ ইসমাইলের জীবন এই তিনটি অধ্যায়ের মূর্ত প্রতীক।