দার্শনিক শাহ ওয়ালী উল্লাহ দেহলভী ও তাঁর চিন্তাধারা
মাওলানা জুলফিকার আহমেদ কিসমতি
প্রকাশকের কথা
ভারতবর্ষে মুসলিম শাসকরা দীর্ঘদিন রাজত্ব করলেও এবং তাঁদের কেউ কেউ অল্প বিস্তর ইসলাম প্রচারে সহযোগিতা করলেও তাঁদের অনেকেই সত্যিকার ইসলামকে জনগণের মধ্যে প্রচার করেননি। প্রচার করেননি শুধু তাই নয় বরং ইসলামকে বিকৃতভাবে তুলে ধরা হয়েছে, অপব্যাখ্যা করা হয়েছে এবং কোন কোন শাসক নিজের কায়েমী স্বার্থকে মজবুত করার জন্যে ইসলামের বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিয়েছেন। ইসলামের এ বিপর্যয়ের মাঝে মুজাদ্দিদে আলফেসানীর আবির্ভাব ঘটে এবং তিনি উপ-মহাদেশে ইসলামের মূল আদর্শকে বিপর্যয় থেকে রক্ষা করেন। মোঘল সাম্রাজ্যের পতন কালে ও তার পতনের পর ইসলাম পুনরায় বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। সে সময় যে মহাপুরুষ তাঁর অসামান্য মেধা, দূরদর্শিতা, প্রজ্ঞা ও সাধনা দ্বারা ইসলামের পুনরুজ্জীবন ঘটান এবং বিভ্রান্তি ও বিপর্যয়ের হাত থেকে মুসলমানদের রক্ষা করার চেষ্টা করেন তিনি হলেন শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী (রহ)। মওলানা জুলফিকার আহমদ কিসমতী এ পুস্তকে উক্ত মহাপুরুষের মহামূল্যবান জীবন ও জীবনাদর্শ তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। বইটি মোগল শাসনের পর গোটা হিমালয়ান উপমহাদেশে ইসলামী পুনঃর্জাগরণের উদগাতা শাহ ওয়ালিউল্লাহর আদর্শ, চিন্তাধারা ও ইসলামের জন্য তাঁর অমর অবদানকে জানতে সবাইকে সাহায্য করবে। আমাদের আশা, পাঠক এ গ্রন্থ পাঠে ইতিহাসের একটি যুগসন্ধিক্ষণে একজন মহাপুরুষের অমর কীর্তি অবলোকন করে সেই আদর্শে নিজে দীক্ষিত হবেন এবং তাঁর চিন্তাপ্রসূত ইসলামী রেনেসাঁর বর্তমান সম্প্রসারিত অবস্থার এর লক্ষ্য অর্জনে তৎপর হবেন।
লেখকের কথা
ব্যাক্তি জীবনে মানুষের উত্থান- পতন আসে, সমাজ জীবনেও তেমনি উত্থান- পতন দেখা দেয়। পার্থক্য এই যে, একটির শুভ কিংবা অশুভ পরিণতি থাকে সীমিত অপরটির পরিণতি অসংখ্য মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করে। পৃথিবীর কোন না কোন দেশ বা সমাজে সব সময়ই উত্থান-পতন চলছে। কোন জাতি দ্রুত উন্নতির দিকে এগিয়ি যাচ্ছে আবার কোন জাতিকে নিজের স্বকীয়তা হারিয়ে অবনতির অতল গহরে নিমজ্জিত হতেও দেখা যায়। এ অবনতি ও অগ্রগতির পেছনে কতকগুলো কার্যকারণ থাখে। সে সকল কার্যকারণ সম্পর্কে অবগতি একান্ত জরুরী। কেননা, যে জাতি অতীতের ব্যর্থতা- সফলতার ইতিহাসকে সামনে না রাখে, সে কিছুতেই নিজের চলার পথের সার্বিক দিশা পায় না। তবে এ সকল কার্যকারণ সময় মতো যথারীতি চিহ্নত করা ও জাতির সমনে উপস্থাপিত করা সহজ ব্যাপার নয়। এটা সম্বব হলেও অগণিত দেশবাসীর হৃদয়- কন্দয়-কন্দরে এর লব্ধ জ্ঞনের শুভ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে জাতির পুনর্জাগরণ আনয়ন সত্যই কঠিন কাজ বটে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যারাই জাতীয় পুনর্জাগরণের ভিত্তি রচনা করেছেন, তারা জাতির দিকপাল হয়ে ইতিহাসে চিরদিন অমর হয়েই কেবল থাকেন না তাঁদের থেকে অনাগত দিনের মানুষও সকল সময় অনুপ্রেরণা পায়।
এ উপমহাদেশে মুসলিম আধিপত্যের অবসানের পর মুসলমাদের মধ্যে নৈরাশ্য, লক্ষ্যহীনতা এ জাতীয় স্থবিরতা দেখা দেয়। সে সময় মুলমানদের জাতীয় পুনর্জাগরণের পটভূমি রচনা করেন শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী। উপমহাদেশে মুসলিম পুনর্জাগরণে অন্যান্যরও দান রয়েছে। কিন্তু স্থায়িত্ব, ব্যাপকতা ও গভীরতার দিক থেকে তাঁর জীবনী, শিক্ষা ও আদর্শের যেরূপ ব্যাপক আলোচনা, প্রচার ও প্রসার ঘটার দরকার ছিল তা হয়নি। মুষ্টিমেয় অনুসন্ধিৎসু শিক্ষাত ব্যাক্তি তাঁর সম্পর্কে কিছুটা জানলেও মাধারণভাবে তাঁর জীবনী ও দর্শনে এখানে আলোচিত হয়নি। আবার অনেক আধুনিক শিক্ষিত লেখককে তাঁর কার্যাবলী সম্পর্কে সম্যক অবগতির অভাবে তাঁর সম্পর্কে ভ্রান্ত তথ্য পরিবেশন করতেও দেখা যায়। এ ব্যাপারে বাংলদেশ টেক্সট বুক বোর্ডের একটি ইতিহাস পুস্তকের কতিপয় তত্ত্ব ও তথ্যাগত ভ্রান্তি আমার লেখা ‘আযাদী আন্দোলনে আলেমদের সংগ্রামী ভূমিকা’ (১ম সংস্করণ) পুস্তকের ৮-১১ পৃষ্ঠায় সম্রমাণ উল্লেখ বহু পরিশ্রমের পর বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আলিম লেখক বহু গ্রন্হ প্রণেতা সাহত্যিক সাংবাদিক মরহুম মাওলানা নূর মুহম্মদ আজমী ও মাওলানা আবদুর রহীম সাহেব তাঁর বিশ্ববিক্ষাত ‘হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা’র অনুবাদ করেছেন শুনেছি। স্থানীয় একটি প্রতিষ্ঠান তাঁদের দ্বারা এর অনুবাদ করালেও পরবর্তী অপর কোন পরিচালকের অবহেলায় বা অন্য কারণে তা আজও প্রকাশিত হয়নি। অবশ্য এদেশের আলিম সমাজের মধ্যে শাহ ওয়ালিউল্লাহর নাম ও তাঁর প্রতি সম্মানের কোন অভাব নেই। একজন আধ্যাত্মিক আলিম ও ইসলামী জ্ঞান- বিজ্ঞানে পারদর্শী ইমাম হিসাবে শিক্ষার প্রসার ও ব্যাপকতা দানে যে একজন শ্রেষ্ঠ ইসলামী দার্শনিক চিন্তানায়ক এ উপমহএদেশে ‘হুকুমতে উলাহীয়া’ প্রতিষ্ঠা আন্দোলনের বীজ বপনকারী আধূনিক সমাজের কাছে ইসলামী অনুশাসনসমূহের ব্যাখ্যাদানে তাঁর যুক্তিদর্শন বিশেষ উপযোগী তাঁর জীবনের সেই দিকটি ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়নি।
বইটিতে এ মহপুরুষের জীবনী ও শিক্ষা আদর্শ সম্পর্কে আলোচানার চেষ্টা কারা হয়েছে। বিশেষ করে এ উপমহাদেশে শেষ মোগল শাসকদের আমলে মুসলিম আধিপত্যের অবসান ঘটার পর ইংরেজ প্রভুত্ব ও বিভিন্ন কুসংস্কোর ভ্রান্ত চিন্তাধারা ও মুসলিম সমাজের শোচনীয় অবস্থার মধ্যেও কি করে তাঁর বিশেষত আলোচিত হয়েছে। এদেশে ইসলামী জাতীয়তাবোধ ও ইসলামী কৃক্টি-সংস্কৃতিকে অক্ষুন্ন রাখার ব্যাপরে বইটি পাঠকমহলে অনুপ্রেরণার কাজ করুন এটাই কামনা রইল।