শাহ ওয়ালিউল্লাহ (রহ) –এর কাজ চিন্তাধারা
পবিত্র মক্কয় অবস্থানকালে পৃথিবীর বিভিন্ন মুসলিম-অমুসলিম রাষ্ট্রর ধর্মীয়, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক উত্থান- পতনের খবরাখবরের আলোকে লব্ধ অভিজ্ঞতা ও আল্লাহ প্রদত্ত জ্ঞানের সাহাযো শাহ ওয়ালিউল্লাহর নিকট এ বিষয়টি প্রতিভাত হয়ে উঠেছিল যে, জীবনাদশের অন্তনিহিত শক্তি ছাড়া কেবলমাত্র রাষ্টীয় ক্ষমতাই কোন জাতিকে বাচিয়ে রাখতে পারে না। অন্যথায় বহুশত বছর যাত দোর্দন্ড প্রতিাপে শাসনদন্ড পরিচালনা করার পরও মুসলিম মিল্লাতের এ দুরবস্থা কেন? তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, একমাত্র ইসলামের অন্তনিহিত শক্তির দ্বারাই মসলমানরা দুনিয়ার দিকে দিকে বিজয় পতাকা উড্ডীন করতে সমর্থ হয়েছে। কাজেই মুসলিম জাতির উপযোগী রাস্ট্রয় পরিকল্পনা পেশ করার সাথে সাথে ইসলামী শক্তির বাদের একটি যুক্তিযুক্ত ব্যাখাও মানুষের সামনে পেশ করা একান্ত প্রয়োজন। ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবন গড়ে তুলতে পারলেই মুসলমানগণ তাদের গৌরবোজ্জল অতীতকে ফরে পাবে-লাভ করবে তার আদর্শ জীবন, আর এভাবেই জাতি হিসাবে বেঁচে থাকতে সমর্থ হবে। রাজতান্ত্রিক পরিবেশের প্রতিকূতার মধ্যে সৃষ্ট বিশেষ এক সকম সুফী ভাবধারার ক্রমবিকাশের ফলে মুসলিম জনগণের মধ্যে ইসলামের যে অসম্পূর্ণ রূপে ফুটে উঠেছিল, তার কারণে অধিকাংশের মধ্যেই এ ধারণা বদ্ধমুল হতে চলেছিল যে, রাষ্ট্রীয় ব্যাপার তথা রাজনীতি এ ধর্ম আলাদা জিনিস, ব্যক্তিগততভাবে ইসলামের আনুষ্ঠানিক কতিপয় বিধি-বিধান পালিত হলেই মানুষ পরকালে মুক্তি পাবি, আর রাজনীতি দুনিয়াদারির ব্যাপার, এটা দুনিয়াদারদের জর্নই শোভা পায় শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী এ দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি কঠোর আঘাত হেনেছেন। তাঁর মতে মানুষের পার্ধিব ও পারলৌকি উভয় জীবনের উন্নতি সাধনই নবুওতের মূল্য। তিনি বলেন, আমরা কুরআন মজীদে দেখতে পাই, যখন কোন জাতির নৈতিক অবনতি ঘটেছে তখনই তাদের মধ্যে নবী- রসূলের আগমন হয়েছে আর তাদের নির্দেশিত জীবন ব্যবস্থা অনুসারে চলার ফলে জাতির নৈতিক উন্নতির সাথে সাথে আর্থিক তথা জাগতিক উন্নতি সাধিত হয়েছে। তার মতে, দীনের দৃষ্টিতে আধ্যাত্মিক রাষ্ট্রীয় উন্নতিতে কোন তফাত নেই। জাতীয় উন্নতি বলতে নৈতিক এবং পার্থিব উন্নতি দু’ই বুঝতে হবে। মুসলমান জাতির ক্রমোন্নতির ইতহাসই তার সাক্ষ্য। এ জন্যই পবিত্র কুরআনের ভাষায় মুসলমানদের এ বলে মুনাজাত করতে বলা হয়েছে যে, ‘হে আমাদের প্রতপালক! তুমি আমাদেরকে দুনিয়া এ আখিরাতের কল্যণ দান করো।,
যা হোক মানব জীবনের সার্বিক উন্নতিকল্পে ইসলামকে জীবনের পরিপূর্ণ একটি বিজয়ী ও শক্তিশালী আদর্শ হিসাবে তুলে ধারা জন্য খৃস্টীয় অষ্টাদশ শতকের এ শ্রেষ্ঠ চিন্তনায়ক দার্শনিক হজ্ব থেকে ফিরে আসার পর নতুন পরিকল্পনা মাফিক ইসলাম সম্পর্কে যেসব অমর গ্রন্হ রচনা করে গেছেন, তন্মধ্যে তিনটি বিষয় লক্ষ করা যায় (১) সমালোচনা ও সংশোধনমূলক বিষয়, (২) গঠনমূলক বিষয় (৩) এসবের আলোকে গণসংগঠন। তবে যেহেতু পূর্বেই বলা হয়েছে, যে তৃতীয় বিষয়টির প্রতি হাত দেয়ার সময় তাঁর হয়ে উঠেনি, কিন্তু তাঁর রচনায় এদিক ইঙ্গিত রয়েছে। তাই তাঁর কাজ ও চিন্তাধারার প্রথম দু’টি বিষয় নিয়েই এখানে আলোচনার প্রয়াস পাবে।
শাহ ওয়ালিউল্লাহ (রহ) মক্কা থেকে আগমনের পর নতুন পরিকল্পনা মাফিক যেসব সংস্কারমূলক কাজ করেন প্রধানত ঐগুলোকে দু’ভাগে বিভক্ত করা চলে (১) সমালোচনা ও সংশোধনমূলক এবং (২) গঠনমূলক। বিশেষজ্ঞদের মতে শাহ ওয়ালিউল্লাহই প্রথম ব্যাক্তি যাঁর দৃষ্টি ইসলামের ইতিহাস ও মুসলমানের ইতহাস- এ সূক্ষ্ণ ও মৌল পার্থক্য পযর্ন্ত পৌছেছে, যিনি ইসলামী ইতিহাসের দষ্টিভঙ্গি দিয়ে মুসলিম ইতিহাসের সমালোচনা ও পর্যালোচনা করেন এবং যিনি এ কথা অবগত হবার চেষ্ট করেন যে, বিভিন্ন শতকে ইসলাম গ্রহণকারী জাতিদের মধ্যে আসলে ইসলামের কি অবস্থা ছিল। এটা অত্যন্ত জটিল বিষয়বস্তু। অতীতেও এ ব্যাপারে কিছু লোক বিভ্রান্তির শিকার হন এবং আজও হচ্ছেন। এ ব্যাপারে ‘ইযালাতুল খিফা [ ১২৮৬ হিজরীতে বেরিলী থেকে প্রকাশিত সংস্করণ] গ্রন্হের ষষ্ঠ অধ্যায়ের ১২২ পৃষ্ঠা থেকে ১৫৮ পৃষ্ঠায় তিনি ধারাবাহিক ভাবে মুসলিম ইতহাস সম্পর্কে আলোচনা করেন। তিনি অত্যন্ত সাফল্যের সাথে প্রত্যেক যুগের বিশেষত্ব এবং উদ্ভুত ফিতনার বিবরণ দান প্রসঙ্গে এ সম্পর্কিত সুস্পষ্ট ইঙ্গিতবহ মহানবীর ভবিষ্যদ্বাণী সমূহ উব্ধত করেন। তাতে তিনি মোটামুটিভাবে মুসলমানদের আকীদা, বিশ্বাস শিক্ষা, সংস্কৃতি, নৈতিকতা ও রাজনীতি সংমিশ্রিত সকল প্রকার জাহিলিয়াতের দিকে অঙ্গুলি নিদের্শ করেন। অতপর যাবতীয় ক্রটির মধ্য থেকে যেগুলো মৌলিক এবং সকল ক্রটির উৎস, এমন দু’টির প্রতি অঙ্গুলি নিদের্শ করেন। এক নবুওত পদ্ধতির খিলাফত থেকে রাজতন্ত্রের দিকে রাজনৈতিক কর্র্তত্বের গতি পরিবর্তন। দুই, ইজতেহাদের প্রাণ শক্তির মৃত্যু ও মনে মস্তিষ্কর উপর অন্ধ অনুসারিতার আধিপত্য। প্রথমটির ব্যাপারে তিনি। বর্ণিত কিতাবে রাজতন্ত্রের নীতিগত ও পারিভাষিক পার্থক্যকে এমন সুস্পষ্টরূপে তুলে ধরেন এবং হাদীসের সাহায্যে তার এমন যুক্তিপূর্ণ ব্যাখ্যা প্রধান করেন যে, তাঁর পূর্বেকার লেখকদের রচনায় তার দৃষ্টান্ত বিরল। এমনিভাবে ইসলামী বিপ্লবের ফলাফলকে তিনি যেরূপ পরিষ্কারভাবে বর্ণনা করেছেন, পূর্ববর্তীদের রচনায় তেমনটি দেখা যায় না। এক স্থানে তিনি লেখেনঃ “ইসলামের মূল স্তম্ভগুলো প্রতিষ্ঠা করার ব্যাপারে বিরাট ক্রটি পরিলক্ষিত হয়েছে। হযরত উসমান (রা) এর পর কোন শাসক হ্জ্ব কায়েম করা ইসলামে অপরিহার্য বিষয়গুলোর অন্তর্ভুক্ত। কেননা, সিংহাসনে আরোহণ করা, রাজমুকুট পরিধান করা এবং অতীত রাজা- বাদশাহদের আসনে বসা যেমন কায়সার ও কিসরার জন্য রাত্বের প্রতীকরূপে পরিগণিত হতো, তদ্রপ নিজের কর্তৃকত্ব হজ্ব প্রতিষ্ঠ করা ইসলামে খিলাফতের প্রতীক হিসাবে পরিচিত।“ ( ইযালাতুল খিফা- ১ম খন্ড, ১২৩- ১২৪ পৃষ্ঠা)
অতপর তিনি ‘ইযালা’ গ্রন্হের ১৫৭ পৃষ্ঠায় বলেনঃ “এদের সরকার অগ্নিপুজকদের সরকারের ন্যায়। শুধু পার্থক্য এ জায়গায় যে, এরা নামায় পড়ে এবং মুখে কলেমায়ে শাহাদত উচ্চরণ করে। এ পরিবর্তনের মধ্যে আমাদের জন্ম। জানি না, পরবর্তীকালে আল্লাহ আরও বা কতকিছু দেখান। এ ব্যাপারে “ হজ্জাতুল্লাহিল বালিগা”‘বদুরে বাজেগাহ “তাফহীমাত’“মুসফফা’ ও তাঁর অন্যান্য গ্রন্হ আলোচনা রয়েছে।
দ্বিতীয় ক্রটি অর্থাৎ কোন ব্যাপারে নিরপক্ষ এ মুক্ত চিন্তা নিয়ে কুরআন ও সুন্নহর সঠিক অনুশাসন বা তার অনুকূলে বিধানের খোঁজ না নিয়ে অন্ধভাবে অপরের অনুসরণ করা। এ ব্যাপারে শাহ ওয়ালিউল্লাহ (রহ) আলোচ্য গ্রন্হের ১৫৭ পৃষ্ঠা বলেনঃ
সিরীয় শাসকদের ( উমাইয়া সরকার) পতনকাল পর্যন্ত কেই নিজেকে হানাফী বা শাফেয়ী বলে দাবী করতো না। বরং সবাই নিজেরদর ইমাম ও শিক্ষকগণের পদ্ধতিতে শরীয়তের প্রমাণ সংগ্রহ করতেন। ইরাকী শাসকদের ( আব্বাসীয় ) আমলে প্রত্যেকেই নিজের জন্য আলাদা নাম নির্দিষ্ট কের নেয়া। তাদের অবস্থা এ পর্যয়ে গিয়ে উপনীত হয় যে, নিজ নিজ মাযহাবের নেতাদেরর সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত না পাওয়া পর্যন্ত কুরআন ও সুন্নাহর ভিত্তিতে তারা কোন কিছুর সিদ্ধান্ত করতো না। এভাবে কুরআন ও সুন্নহার ব্যাপারে ব্যাপারে অনিবার্যরূপে যেসব মতবৈষম্যের উদ্ভব হয়েছিল, সেগুলো স্থায়ী বুনিয়াদের উপর প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। অতপর আরব শাসকদের পর যখন তুর্কী শাসনামলে মানুষ বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে, তখন প্রত্যেকেই ফিকাহ ভিত্তিক মাযহাব থেকে ছড়িয়ে পড়ে, তখন প্রত্যেকেই ফিকহ ভিত্তিক মাযহাব থেকে যা কিছু স্মরণ করতে সক্ষম হয় ঐ টুকুকেই নিজেদের আসল দীনে পরিণত কর। পূর্বে যে সকল বস্তু কুরআন ও হাদীসের সূত্র উদ্ভূত মাযহাব ছিল, তখন তা স্থায়ী সন্নহতে পরিণত হয়েছে।‘ তিনি ‘মসফফা গ্রন্হের ১ম খন্ডের ১১ পৃষ্ঠায় লেখেনঃ আমাদের যুগের সরল লোকেরা ইজতিহাদ থেকে বিমূখ। এদের নামে। তাদের ব্যাপার্ই আলাদা। ঐসব ব্যাপার বুঝার যোগ্যই নয়। শুধু অন্ধনুসরণ না করে স্বাধীন ও মুক্ত বিচারবুদ্ধি নিয়ে কুরআন-সান্নাহ থেকে সমস্যার মসধান খোঁজ করা সম্পর্কে “হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা”র সপ্তম অধ্যায়ে ও “আল-ইনসাফ” গ্রন্হে শাহ ওয়ালিউল্লাহ বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। অন্ধনুসরণের ও ব্যাধির পূর্ণ ইতিহাসে তাতে বিবৃত হয়েছে এবং এর দ্বারা সৃষ্ট যাবতীয় ক্রটির প্রতি তিনি অঙ্গুলি নিমের্শ করেছেন, যা পরে বিবৃত হচ্ছে।