তিনিই ইসলামী দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা
বিশেষজ্ঞদের মতে, ইতিহাসে তিনিই প্রথম ব্যক্তি, যাকেঁ ইসলামী দর্শন লিপিবদ্ধকরণের ভিত্তি বলেছেন ও লিখেছেন, লোকেরা তাকে ভ্রান্তিবশত ইসলামী দর্শন নামে আখ্যায়িত করেছে। অথচ সেগুলো ছিল মুসলিম দর্শন। ঐ সব দর্শনের বংশসূত্র গ্রীস, রোম, ইরান ও হিন্দুস্তানের সাথে সম্পর্কিত। যদিও শাহ্ সাহেবের পরিভাষার ক্ষেত্রে পুরাতন দর্শন, কালাম শাস্ত্র কিংবা সেখানকার বহু চিন্তা ও ধারণা লক্ষ্য করা যায়, তা শুরুতে নতুন পথ আবিস্কারদের জন্য স্বভাবতই অপরিহার্য হয়ে পড়ে।
শাহ ওয়ালিউল্লাহর সমাজ দর্শন
তিনি বিশ্ব জাহান ও এর মানুষ সম্পর্কে এমন এক দর্শন সৃষ্টি চেষ্টা, করেছেন, যা ইসলামের নৈতিক ও সাংস্কৃতিক ব্যবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্যশীল ও তার সমভাবাপন্ন প্রকৃতিক অধিকারী হতে পারে।
নৈতিক ব্যবস্থা উপর তিনি একটি সমাজ দর্শনের (Social Philosophy) ইমারত নির্মাণ করেন। ইরতিফাকাত (মানুষের দৈনন্দিন সংগঠন, সামাজিক রীতিনীতি, রাজনীতি, বিচার ব্যবস্থা, কর-ব্যবস্থা (Taxation), দেশ শাসন, সামরিক সংগঠন প্রভৃতি বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেন। এ সঙ্গে সমাজ সভ্যতার বিপর্যয় ও বিকৃতি সৃষ্টির কারণসমূহের উপর আলোকপাত করেন। তারপর তিনি শরীয়ত, ইবাদত, আহকাম ও আইন কানূনের পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থা পেশ করেন এবং প্রত্যেকটি জিনিসের গুঢ় তথ্য বুঝাতে থাকেন। ইমাম গাযযালীকেও তিনি এ ব্যাপারে ছাড়িয়ে গেছেন। শেষের দিকে তিনি বিভিন্ন জাতির ইতহাস ও আইন-কানুনের প্রতি দৃষ্টি নিবন্ধ করেন।
উপরিউক্ত বিষয়গুলোর মধ্যে এখানে শুধু তাঁর দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উপর আলোকপাত করা হচ্ছে। একটি অর্থনৈতিক, অপরটি রাজনৈতিক।
অর্থনৈতিক চিন্তাধারা
ইমাম শাহ্ ওয়ালিউল্লাহ অর্থনৈতিক দর্শনের মূলকথা হলো দেশের সামগ্রিক সম্পদ যে জনগোষ্ঠীর যৌথ বা বিক্ষিপ্ত প্রচেষ্টায় উৎপন্ন হয়ে থাকে, তাতে এমন সুষম বন্টন বা বিকেন্দ্রীকরণ ব্যবস্থা থাকতে হবে, যাতে সম্পদ কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বিশেষের হাতে পুঞ্জিভূত না হয়ে পড়ে। একচেটিয়া মালিকানা কিংবা দৈহিক বা মানসিক কোনরূপ শ্রমবিহীন মালিকানার তিনি বিরোধী। তাঁর মতে, নাগরিকত্বের প্রাণসত্তা হচ্ছে পারস্পরিক সহযোগিতা, আর এই সহযোগিতা সম্পূর্ণ নির্ভরশীল হয়ে থাকে একের প্রতি অপরের কল্যাণকারিতার উপর, যা একমাত্র শ্রমের মাধ্যমেই হয়ে থাকে। উল্লেখ্য যে, তিনি পুজিঁ ও মানসিক প্রচেস্ঠাকেও শ্রমের মধ্যে গণ্য করেন। অতএব তাঁর মতে, সমাজে কোন ব্যক্তি বিনাশ্রমে সম্পদ ভোগ করতে কিংবা অল্প শ্রমে অধিক সম্পদের অধিকারী হতে পারে না। কেননা, তাদের মধ্যে নারিকত্বের এই মূল শর্ত অনুপস্থিত থাকা সত্ত্বেও যদি তারা সম্পদের অধিকারী হয়, তা হলে স্মপদের যারা মূল উপার্জন শক্তি তথা কৃষক, শ্রমিক, পুজিঁ ও মানসিক শ্রমদাতা, তাদের অধিকার ক্ষুণ্ন হবে। আর তার অবশ্যন্তাবী পরিণতি হিসাবে সমাজে একদিকে শোষিত ও বঞ্চিতের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে, তাদের উপর নাগরিক দায়িত্বভার বেড়ে যাবে, তারা করভারে জর্জরিত হবে, অনাদায়ে নির্যাতন ও কঠোরতার সম্মুখীন হবে, অপরদিকে আর এক শ্রেণী কর্তৃক বিলাসিতা, বাহুল্য ও ইন্দ্রীয়পূজার বাজার গরম হয়ে উঠবে, যাতে কোন অবস্থায়ই জাতীয সম্পদ তো বৃদ্ধি পাবে না, পরন্তু তা অনেকের পকেটশূন্য হয়ে এক স্থানে এসে কুক্ষিগত হবে।
এক কথায়, তাঁর চিন্তাধারা অনুযায়ী চাষী-মজুর এবং অন্যভাবে শ্রমদাতা যেসব ব্যক্তি দেশ ও জাতির জন্য চিন্তামূরক কাজে নিয়োজিত, তারাই সম্পদের আসল অধিকারী (অবশ্য অক্ষম ও বিকলাঙ্গের কথা স্বতন্ত্র)। উপরিউক্ত ব্যক্তিদের উন্নতি ও সমৃদ্ধিই মূলত জাতির উন্নতি ও সমৃদ্ধি। এ শক্তিসমূহকে দাবিয়ে রাখার জন্য যে কোন ব্যবস্থা (চাই সেটা রাজতন্ত্রমূলকই হোক কিংবা অন্য কোন প্রকারের) সচেষ্ট হয়ে উঠলে সেটা কোন দেশ ও জাতির জন্য অবশ্যই মারাত্মক। এহেন অশুভ শক্তিকে অবশ্যই খতম করা উচিত-(হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা)। যে সমাজ ব্যবস্থা শ্রমের প্রকৃত মূল্য দেয় না তার অবসান হওয়া আবশ্যক- (হুজ্জাতুল্লাহিল বারিগা, সিয়াসাতুল মাদানীয়া অধ্যায়)। তাঁর মতে, অভাবী শ্রমিকের সম্মতিকে তার সন্তুষ্ঠি মনে করা চলে না, যে পর্যন্ত না তার ন্যায্য পারিশ্রমিক আদায় করা হবে, যা পারস্পরিক সহযোগিতার মূল নীতির ভিত্তিতে অপরিহার্য বলে গণ্য;(হুজ্জাত)। শ্রমিকের কাজের সময়কাল নির্দিষ্ট থাকতে হবে। তাকে নৈতিক ও আধ্যাত্মিক সংশোধন এবং পরকালের ধ্যান ও চিন্তাভাবনার জন্য অবশ্যই অতিরিক্ত সুযোগ দিতে হবে। জনগণের উপর অধিক করের বোঝা চাপানো অন্যায়-(হুজ্জাত)। ব্যবসায়-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর একচেটিয়া অধিকার বা প্রভাব দেশের জন্য মারাত্মক-(হজ্জাত)। কোন রাজকীয় জীবন ব্যবস্থার অধীনে-যেখানে বিশেষ গোষ্ঠী বা পরিবারের অমিতব্যয়িতা, বিলাসিতা, খামখেয়াল ও ব্যয়-বাহুল্যের ফলে সমাজে সম্পদ বিকেন্দ্রীকরণের পথে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়, সে ক্ষেত্রে সাধারণ নাগরিকের দুঃখ মোচনার্থে উক্ত ব্যবস্থার অবসান হওয়া একান্ত জরুরী-(হুজ্জাত)।
এ থেকে এটাও স্পষ্ট হয়ে যায় যে, তাঁর নিকট রাজতন্ত্রের অপকারিতাসমূহ সুস্পষ্ট ছিল এবং ইসলামী খিলাফত ব্যবস্থার মধ্যেই তিনি মানবতার মুক্তি লক্ষ্য করেছেন। প্রসঙ্গত এ কথা উল্লেখ করা যেতে পারে যে, আধুনিককালে যদিও এসব বিষয় অহরাত্র চর্চা হয়ে থাকে, কিন্তু তিনি যে যুগে বসে এ কথা বলে গেছেন, সে সময়কাল পরিবেশ চিন্তু করলে সত্যি বিস্মিত হতে হয়। কেননা, তখনও ফরাসী বিপ্লব সংঘটিত হতে অর্ধশতক বাকী। কম্যুনিজমের জনক কার্লমার্ক্স ও তাঁর সহযোগী এঙ্গেলস-এর জন্মেরও এক শতক পরে। তখন ইউরোপের যান্ত্রিকযুগের বয়স মাত্র চল্লিশ বছর। তাই এ কথা নিসন্দেহে বলা চলে যে, শাহ্ ওয়ালিউল্লাহর মতো চিন্তাবিদ ও দার্শনিকের যে যুগে আবির্ভাব ঘটে, সে সময় যদি উপমহাদেশে যান্ত্রিক ব্যবস্থার বিকাশ ঘটতো কিংবা তিনি কার্লমাক্স বা এঙ্গেলসের মতো কোন মুদ্রাযন্ত্রের দেশে জন্ম নিতেন-যেখান থেকে অল্প সময়ের মধ্যেই নিজের মতবাদ ও চিন্তাধারাকে দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে দেয়া যায়, তা হলে সম্ভবত সকলের পূর্বে তার সমাজদর্শন, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মতবাদই বিম্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করতো।
রাজনৈতিক চিন্তাধারা
এক. সার্বভৌমত্বের নিরংকুশ মালিক হচ্ছেন আল্লাহ তায়ালা। এতে কোনরূপ অংশীদারিত্ব সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। ভূ-পৃষ্ঠে বিচরণকারী মানুষ হচ্ছে প্রবাসীর ন্যায়।
দুই. মানুষ হিসাবে প্রতিটি আদম সন্তানের সমান মর্যাদা। একের প্রতি অপরের প্রভুত্ব দাবী করার কোন অধিকার নেই-এক মানুষ আর এক মানুষের দাসত্ব করতে পারে না। কোন ব্যক্তি রাষ্ট্র বা জাতির মালিক হতে পারে না। কোন মানুষের পক্ষে ক্ষমতাশালী কোন শাসকের প্রতিও এরূপ ধারণা পোষণ করা অবৈধ।
তিন. রাষ্ট্র প্রধানের মর্যাদা ‘মুতাওয়াল্লী’র সমতুল্য। মুতাওয়াল্লী প্রয়োজনবোধ করলে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে সে পরিমাণই অর্থ গ্রহণ করতে পারবেন, যে পরিমাণ দ্বারা রাষ্ট্রের একজন সাধারণ নাগরিকের জীবন নির্বাহ হয়ে থাকে।
চার. রাষ্ট্রের সর্বস্তরে একমাত্র আল্লাহর দীনেরই প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত।
মৌলিক অধিকার
এ ব্যাপারে ‘হজ্জাতুল্লাহিল বালিগা’, ‘আল বদুরুল বাযেগাহ্’, প্রভৃতি গ্রন্থে ‘ইরতিফাকাত’-জনকল্যাণ অধ্যায়ে যা বিশদরূপে বর্ণিত হয়েছে, তা হচ্ছেঃ খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, বিবাহ, স্বাস্থ্য, সন্তান-সন্ততি, শিক্ষা-দীক্ষা লাভ প্রভৃতি জাতি-ধর্ম বর্ণ-ভাষা নির্বিশেষে সকল মানুষের জন্মগত অধিকার। ঠিক অনুরূপভাবে উচু নীচু নির্বিশেষে ভেদ-বৈষম্যবিহীন রাষ্ট্রের সকল মানুষের প্রতি ন্যায় বিচার করা, তাদের জানমাল ও ইজ্জত-আবরুর হিফাজত করা, প্রতিটি নাগরিকের ব্যক্তি স্বাধীনতার সংরক্ষণ ও সমান নাগরিকত্বের অধিকার লাভ সকল জন্মগত অধিকারের অন্তর্ভূক্ত। তদ্রুপ প্রত্যেক সম্প্রদায়ের নিজ নিজ ভাষা ও সংস্কৃতি সংরক্ষণের অধিকারও মৌলিক অধিকারসমূহের শামিল।
ইসলাম একটি বিপ্লবী দীন-একটি বিপ্লবী জীবন ব্যবস্থা
শাহ্ ওয়ালিউল্লাহ ইসলামকে একটি বিপ্লবী জন বিধান বলেছেন। তাঁর মতে, ইসলাম যুক্তি ও শক্তিবাদের ধর্ম। বিশ্বমানবের মুক্তি ও কল্যাণের খাতিরে দুনিয়ার সকল মানুষকে একই আদর্শের পতাকা তলে সমবেত করার উদ্দেশ্যেই ইসলামের আবির্ভাব হয়। কুরআন মজীদের নির্দেশ অনুযায়ী যুক্তিবাদ ও সুষ্ঠু বুদ্ধিমত্তার পথেই মানুষকে ইসলামের পথে আহ্বান জানাতে হয়। শান্ত, সাম্য ও ভ্রাতৃত্ব ইসলামের মূল কথা। তবে ইসলামের আহ্বানে একান্তভাবে যুক্তিযুক্ত শান্তি প্রতিষ্ঠার খাতিরে হলেও প্রতিকূল পারিপার্শ্বিকতা, মিথ্যা, অহেতুক আভিজাত্যবোধ ও স্বার্থপরতা ইসরামের শিক্ষা প্রতিষ্ঠার পথে অন্তরায় হতে পারে। এ জন্য শাহ ওয়ালিউল্লাহ (রহ) বিশ্বাস করতেন যে, বৃহত্তর মানবগোষ্ঠীর কল্যাণের জন্য, এ সত্য ও শান্তির জবিন বিধান প্রতিষ্ঠার জন্য বিশ্বব্যাপী বিপ্লবের সৃষ্টি হওয়া অসম্ভব নয়। যদি কখনও তদ্রুপ বিপ্লব দেখা দেয়, তবে তাকে সকল মানুষের সমর্থন করা উচিত মানব জাতির সার্বিক কল্যাণের খাতিরেই। তাঁর মতে, বৃহত্তম কল্যাণের খাতিরে ছোটখাট ক্ষয়-কস্থির কথা চিন্তা করা কখনও যুক্তিসঙ্গত নয়। কুরআন মজীদে উক্ত হয়েছে যে, “আল্লাহ পাক তাঁর রাসূলকে পথ নির্দেশমূলক হুকুম ও সঠিক জীবন বিধান দিয়ে একমাত্র এউদ্দেশ্যেই পাঠিয়েছেন যে, এটাকে (সঠিক জীবন বিধানকে) অন্যান্য সকল (মানব রচিত) জীবন বিধান ও বিধি-ব্যবস্থার উপর জয়যুক্ত করতে হবে-যদিও তাতে মুশরিক অবাধ্য লোকেরা জ্বলে পুড় উঠবে।“ এ আয়াতের মর্মানুযায়ী সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে যে, ইসলাম মানুষের পথ নির্দেশ সত্য জীবন-বিধান হওয়া সত্ত্বেও তাকে দুনিয়ায় সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য একটি সুব্যবস্থার অবশ্যক। ইমাম শাহ্ ওয়ালিউল্লাহর মতে, এটা একমাত্র কোনো কেন্দ্রীয় শক্তির অধীন একটি ত্যাগী, একনিষ্ঠ, সুসংবদ্ধ ও ঐক্যবদ্ধ দলের মাধ্যমেই হওয়া সম্ভব। ভাড়াটিয়া বা পেশাদার কোন ফৌজ দ্বারা এরূপ কাজ সম্ভব নয়।
ওয়ালিউল্লাহ চিন্তাধারার ফসল
ইসলামী জীবন-ব্যবস্থা এহেন যুক্তিগ্রাহ্য ও সুসংগঠিত খসড়া পেশ হবার অর্থই হলো এই যে, তা সকল সুস্থ প্রকৃতি ও বিবেক-বুদ্ধি সম্পন্ন ব্যক্তির জীবনের লক্ষ্যে পরিণত হবে, আর তাদের মধ্যে যারা অধিকতর ক্ষমতার অধিকারী তারা এ লক্ষ্য অর্জনে এগিয়ে আসবে। শাহ্ সাহেব জাহেলী রাষ্ট্র ও ইসলামী রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্যকে পরিস্কারভাবে তুলে ধরেই ক্ষান্ত হননি, এ ব্যাপারটাকে বার বার এমনভাবে বর্ণনা করেছেন, যাতে ঈমানদারদের পক্ষে জাহেলী রাষ্ট্র খতম করে সে স্থলে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত করার জন্য প্রচেষ্ঠা না চালিয়ে নিশ্চেষ্ট হয়ে বসে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়ে। ‘হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা’ ও ‘ইযালাতুল খিফা’তে এ বিষয়টির উপর সর্বাধিক জোর দেয়া হয়েছে। এ গ্রন্থটিতে তিনি হাদীসের সাহায্যে প্রমাণ করেন যে, ইসলামী খেলাফত ও রাজতন্ত্র দ্ইটি সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস অতপর একদিকে রাজতন্ত্র এবং সে সব বিপর্যয়কে স্থাপন করেন, যেগুলো ইতিহাসের বিভিন্ন যুগে রাজতন্ত্রের পথে মুসলমানদের সামষ্টিক জীবনে অনুপ্রবেশ করে এবং অন্যদিকে ইসলামী খিলাফতের বৈশিষ্ট্য ও শর্তাবলী এবং সে সব অবদান পেশ করেন, যা ইসলামী খিলাফত আমলে প্রকৃতপক্ষে মুসলমানদের মধ্যে অনুসৃত হয়। এরপরও মুসলমানদের পক্ষে নিশ্চিন্তে বসে থাকা কি করে সম্ভব হতে পারে? আর পারে না বলেই শাহ্ ওয়ালিউল্লাহর ইনতিকালের (১৭৮৬-১৮৩১) অর্ধশতক অতিক্রান্ত হবার আগেই ভরতবর্ষে সাইয়েদ আহমদ বেরেলবী ও ইসমাঈল শহীদ দেহলভীর নেতৃত্বে একটি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের উদ্ভব হয়। তারা একটি অস্থায়ী ইসলামী রাষ্ট্র গঠন করেন। অবশ্য কতিপয় বৈষয়িক কারণে তা সাময়িকভাবে ব্যর্থ হলেও তার প্রভাব উপমহাদেশে এখনও বিদ্যমান। অবিভক্ত পাকিস্তান আন্দোলনের পশ্চাতে সেই আন্দোলনের প্রভাব কাজ করেছে এবং বলতে কী এ অঞ্চলে খাটি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিস্ঠার যে আন্দোলন প্রকট, মূলত এটাও ওয়ালিউল্লাহর চিন্তাধারার ও বালাকোটে ইসলামী আন্দোলনের মুজাহিদদের চরম আত্মত্যাগেরই ফল। কেননা, বালাকোটের ব্যর্থতার পর যখন উপমহাদেশের মুসলমানদের উপর বিজাতীয় কর্তৃত্ব প্রাধান্য লাভ করে, তখনও আলিম সমাজ নিশ্চেষ্ট হয়ে বসে থাকেননি, তাঁরা ঘোর তমসার মধ্যেও ইসলামের নিভু নিভু দীপশিখা জ্বালিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। তাঁরা পরিকল্পনার মাধ্যমে উপমহাদেশে জালের ন্যায় দীনী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান-মাদ্রাসা সমূহ কায়েম করে এগুলোর মাধ্যমে ইসলাম শিক্ষা-সঙস্কৃতিকে টিকিয়ে রেখেছেন। এ পরিকল্পনাধীন মাদ্রাসা সমূহের মধ্যে ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দই ছিল প্রধান। আযাদী ও ইসলামী আন্দোলনের কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্টিত দারুল উলুম দেওবন্দ ও এ জাতীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে উপমহাদেশের মধ্যে ক্রমে ক্রমে যে ইসলামী জাগরণ মুসলমানদের মধ্যে সৃষ্টি হয়, পরবর্তী পর্যায়ে খিলাফত আন্দোলনের মধ্যে তারই অতিব্যক্তি ঘটে। তাই উপমহাদেশের মুসলিম জাগরণ ও পরবর্তীকালে পাকিস্তান আন্দোলন ও র্বমানে এদেশসহ সারা মুসলিম দুনিয়ায় যে ইসলামের নবজাগরণের পূর্বাভাষ লক্ষ্য করা যাচ্ছে এটাকে নির্দ্বিধায় ওয়ালিউল্লাহর চিন্তাধারা ও তাঁর বংশধর ও অনুসারীদের আন্দোলনেরই ফলশ্রতি বলতে হবে।
উল্লেখযোগ্য যে, শাহ্ ওয়ালিউল্লাহর আকাংখিত ইসলামী বিপ্লব সৃষ্টির উদ্দেশ্যে উপমহাদেশে প্রথম ইসলামী আন্দোলন (বালাকোট) এবং পরবর্তী পর্যাযে সিপাহী বিপ্লব, বাঙলাদেশে ফরায়েযী আন্দোলন, হাজী তিতুমীর মুন্সী মেহেরুল্লাহর আন্দোলন প্রভৃতি সকল জাতীয জাগরণের পটভূমি রচনায় যে মহাপ্রাণ ব্যক্তির মাধ্যমে শাহ সাহেবের চিন্তাধারা কাজ করেছিল তিনি ছিলেন তারই সুযোগ্য জেৌষ্ঠপুত্র শাহ্ আবদুল আযীয (রহ) (১৭৪৭-১৮২৪ খৃস্টাব্দ)। পিতার ইনতিকালের পর সমসাময়িক পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে উক্ত মহান লক্ষ্যের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে তিনি পিতৃ শিক্ষা প্রতিস্ঠানের (টীকা: উল্লেখযোগ্য যে, ইমাম সাহেব হজ্জ থেকে প্রত্যাবর্তনের পর পুরাতন রহীমিয়া মাদ্রাসায় ছাত্র সংখ্যার আধিক্য হেতু সম্রাট মুহাম্মদ শাহ্ কর্তৃক মাদ্রাসার জন্য যে বিশাল অট্টালিকাটি প্রদত্ত হয়েছিলো সেটি ১৮৫৭ সালের হাঙ্গামায় ধ্বংস প্রপ্ত হয়) মাধ্যমে প্রথমে দীনী শিক্ষার ব্যাপক প্রচারের পরিকল্পনা নিয়েছিলেন। আজকের উপমহাদেশে অগণিত ইসলামী শিক্ষা কেন্দ্র রয়েছে। এগুলোর পত্যেকটি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে উক্ত প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পর্কিত। শাহ্ আবদুল আযীযের মাধ্যমে অসংখ্য লোক বিপ্লবী বাবধারায় উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। তন্মধ্যে তাঁর চার ভ্রাতা, উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্রদূত সাইয়েদ আহমদ শহীদ ও ইসমাঈল শহীদ দেহলভীসহ কতিপয় প্রখ্যাত শিষ্যের নাম নিম্নে প্রদত্ত হলোঃ (১) মওলানা শাহ্ রীফউদ্দিন, (২) মওলানা শাহ্ আবদুল কাদের, (৩) মওলানা শাহ্ আবদুর গনী, (৪) মওলানা শাহ্ মুহম্মদ ইসহাক, (৫) শাহ্ মুহাম্মদ ইয়াকুব, (৬) মওলানা শাহ্ মুহাম্মদ আবদুল হাই, (৭) মওলানা শাহ্ মুহাম্মদ ইসমাঈল, (৮) সাইয়েদ আহমদ শহীদ, (৯) মওলানা রশীদুদ্দীন, (১০) মওলানা মুফতী সদরুদ্দীন, (১১) মুফতী এলাহী বখশ, (১২) হযরত শাহ্ গোলাম আলী, (১৩) মওলানা মাখসুল্লাহ, (১৪) মওলানা করীমুল্লাহ, (১৫) মওলানা মীর মাহবুব আলী, (১৬) মওলানা আবদুল খালেক, (১৭) মওলানা হাসান আলী লক্ষৌভী, (১৮) মওলানা হোসাইন আহমদ মলীহাবাদী প্রমুখ।
শাহ্ আবদুল আযীয (রহ)-এর শিক্ষাদানের বিষয়বস্তুর মধ্যে ছিল-
(১) ইমাম শাহ্ ওয়ালিউল্লাহর চিন্তাধারাকে মন-মস্তিস্ক দিয়ে উপলব্ধি করা, (২) আল্লাহভীতি ও আদর্শ জীবন গঠনের প্রেরণা লাভ, (৩) রাজতন্ত্র ও সরকার তোষণ মনোভাব মন-মস্তিস্ক থেকে দূর করা, (৪) ইসলামী বিপ্লবকে পরিপূর্ণ জয়যুক্ত করণার্থে ত্যাগের স্পৃহা সৃষ্টি করা, (৫) সমাজসেবা ও দুঃস্থ মানবতার প্রতি সহানুভূতির উদ্রেক করা, (৬) রাজকীয় বিলাসিতা পরিহার করে সহজ-সরল জীবন-যাপন করা, (৭) জিহাদী ভাবধারা সৃষ্টি করা এবং যে কোন দুর্যোগ মুহুর্তে দৈর্য ও সহনশীলতার অনুশীলন করা, (৮) সমাজ বিধ্বংসী সকল প্রকার অনাচার, কুসংস্কার ও রীতিনীতি উৎখাতের চেষ্টা করা, (৯) বিলাসিতার আড্ডাখানাসমূহের অবসান করা, যা সমাজকে আরাম প্রিয় ও দুর্বল করে তোলে। এ ছাড়া শাহ্ আবদুল আযীয (রহ) রীতিমতো সপ্তাহে দুবার মুসলমানদের মধ্যে ইসলামী আদর্শ, শিক্ষা-সংস্কৃতি ও উপরিউক্ত বিষয়সমূহের ব্যাপক প্রচারের উদ্দেশ্যে জনসভায় বক্তৃতা করতেন।
বাংলাদেশে শাহ্ ওয়ালিউল্লাহ চিন্তাধারার প্রভাব
শাহ্ ওয়ালিউল্লাহর চিন্তাধারা ও রচনাবলীর ফলে সার্বিকভাবে সমস্ত উপমহাদেশ উপকৃত হলেও বাঙলাদেশে তার চিন্তাধারার বিস্তার লাভের যে সব কারণ দেখা যায়, তন্মধ্যে দেওবন্দে শিক্ষাপ্রাপ্ত আলিমরা ছাড়াও তার পূর্বে ১৭৮১ সালে শাহ্ ওয়ালিউল্লাহর শাগরিদ মওলবী মজদুদ্দীন ওরফে মোল্লা মদনের ব্যক্তিত্ব ও অপ্যাপনাও কম কাজ করেনি। তিনি ১৭৬৪ সালে দিল্লী থেকে কলকাতা আসেন। এখানে তিনি একান্ত অজ্ঞাত জীবন-যাপন করতেন। কিন্তু আগুন কখনও কাপড়ে জড়ানো অবস্থায় থাকে না। লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকা তাঁর পক্ষে সম্ভব হলো না। তাঁর জ্ঞান-গরিমা ও আল্লাহভীরতার সঙ্গে পরিচিত স্থানীয় মুসলমান সুধীবৃন্দ তাকেঁ কাজে লাগাবার কথা চিন্তা করলেন। তাঁরা একটি ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কথা ভাবলেন। তাঁরা এ ব্যাপারে তদানীস্তন বড়লাট লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংসকে অনুরোধ করলে তিনি তাদের কথায় উদ্দেশ্যমূলকভাবে সায় দেন। তিনি মন্তব্য করলেন হ্যাঁ, সরকারী কাজে সাহায্য করতে পারে এরূপ এক শ্রেণীর কর্মচারী তৈরীর জন্যও সরকারের এ প্রকার একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা রয়েছে। অতপর ১৭৮১ সালের অক্টোবরে কলকাতা শহরের বৈঠকখানা অঞ্চলে একটি মাদ্রাসা স্থাপিত হয়। আর মোল্লা মদন তারই প্রধান শিক্ষক হিসাবে কাজ করেন।
বস্তুত ঐ মাদ্রাসাই পরে কলকাতা আলীয়া মাদ্রাসা হিসাবে পরিচিত হয়। অবশ্য ঐ পরিবেশে কলকাতার উক্ত মাদ্রাসা থেকে ওয়ালিউল্লাহর চিন্তাধারার আশানুরূপ বিকাশ ঘটা কতদূর সম্ভব ছিল তা স্বতন্ত্র কথা। তবে আমরা বর্তমানে যতদূর দেখতে পাই, পরিতাপের সঙ্গে বলতে হয় যে, এককালে শাহ্ ওয়ালিউল্লাহর চিন্তাধারা ভিত্তিক ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা আন্দোলন ও আযাদী আন্দোলনের কর্মীদের দ্বারা যে দেওবন্দ দারুল উলুম প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং কলকাতা আলীয়া মাদ্রাসার কাজ প্রথম যে মহান ব্যক্তির দায়িত্বে শুরু হয়েছিল পরবর্তীকালে সেসব প্রতিষ্ঠান থেকে বিচ্ছুরিত আলোর ফলশ্রতি হিসাবেই উমহাদেশে পাকিস্তানের ন্যায় একটি ইসলামী রাষ্ট্রের অস্তিত্ব সৃষ্টি হলোঃ আজ ঐ সকল প্রতিষ্ঠানের শাখা-প্রশাখা থেকে শিক্ষাপ্রাপ্ত আলিম-উলামাদের কিছু সংখ্যক ছাড়া অনেকের মধ্যেই উক্ত বিপ্লবী ভবধারা ও দৃষ্টিভঙ্গি লক্ষ্য করা যায় না? যুগ সমস্যার, যুগ জিজ্ঞাসা ও আধুনিক নানাবিধ বাতিল মতবাদ ও চিন্তাধারার চ্যালেঞ্জের মুকাবিলা করার মতো যে ধরনের এবং যে পরিমাণ যোগ্য আলিমের প্রয়োজন ছিল, ঐ সকল শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের শাখা-প্রশাখা থেকে শিক্ষাপ্রাপ্ত আলিম-উলামাদের কিছু সংখ্যক ছাড়া অনেকের মধ্যেই উক্ত বিপ্লবী ভবধারা ও দৃষ্টিভঙ্গি লক্ষ্য করা যায় না? যুগ সমস্যার, যুগ জিজ্ঞাসা ও আধুনিক নানাবিধ বাতিল মতবাদ ও চিন্তাধারার চ্যালেঞ্জের মুকাবিলা করার মতো যে ধরনের এবং যে পরিমাণ যোগ্য আলিমের প্রয়োজন ছিল, ঐ সকল শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান তা পরিবেশন করনতে সমর্থ হচ্ছে না, তারই পরিণতিতেই হয়তো যোগ্য ইসলামী নেতৃত্বের অভাব ঘটায় ইসলামের নামে এদেশ অর্জিত হলেও আজও এখানে ইসলামকে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়ে উঠছে না বরং দিনের পর দিন পরিস্থিতি আরও অবনতির দিকে যাচ্ছে। সম্ভবত দীনী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের শিক্ষা-পদ্ধতি ও এ শিক্ষার মূল লক্ষ্য নির্ধারণের ব্যাপারে কোনরূপ ব্যতিক্রম অথবা দীনী চিন্তার গরমিলের দরুনই এমনটি হতে চলেছে। এ ব্যাপারে উলামা নেতৃবৃন্দের আজ নতুন করে ভাববার সময় এসেছে।
শাহ ওয়ালিউল্লাহ বংশের শাজরা |
I
শায়খ শামসুদ্দিন মুফতী |
I
শাহ ওয়াজিহদ্দীন |
I
শাহ আবদুর রহীম |
I
শাহ আবদুল্লাহ | শাহ ওয়ালিউল্লাহ |
৩. শাহ আবদুল কাদের | ৪. শাহ আবদুল গনী |
I I
১. শাহ আবদুল আযীয | ২.শাহ রফীউদ্দীন |
মওলানা মুখসুল্লাহ |
মওলানা আবদুল হাই(জামাতা) |
I I
শাহ ইসমাইল শহীদ |
I
মওলানা মুহাম্মদ ইসহাক | মওলানা মুহাম্মদ ইয়াকুব |
গ্রন্থাবলী
তাঁর গ্রন্থাবলীকে ছয় শ্রেণীতে ভাগ করা যেতে পারে। প্রথম শ্রেণীতে কুরআন সম্পর্কিত গ্রন্থসমূহ অন্তর্ভূক্ত। এ ক্ষেত্রে তাঁর লিখিত কুরআন মজীদের তরজমা ফতহুর রহমান উল্লেখযোগ্য। এটি কুরআনের সংক্ষিপ্ত অথচ জ্ঞানগর্ভ তরজমা। তাঁর এ পর্যায়ে গ্রন্থের মধ্যে মুকদ্দমা ফী তারজুমাতিল কুরআন আল ফওযুল কবীর এবং আল ফাতহুল কাবীর’ও রয়েছে। এ গুলোতে কুরআনের তরজমা ও ব্যাখ্যার মুলনীতিসমূহ বর্ণিত হয়েছে।
দ্বিতীয় শ্রেণীর গ্রন্থাবলী হাদীস সংক্রান্ত। এর মধ্যে ইমাম মালিকের বিশ্ববিখ্যাত মুয়াত্তার আরবী শরাহ মুসাওয়া ও মুসাফ্ফা’ প্রসিদ্ধ। হাদীসে তাঁর লিখিত গ্রন্থাবলীর মধ্যে আন্নাওয়াদির মিনাল হাদীস আল দুররিশ-সামীন’ ও ‘শরহে তরজমা-এ-আবওয়াবে বুখারী’ প্রসিদ্ধ।
তৃতীয় শ্রেণীর গ্রন্থের মধ্যে হচ্ছে ফিকাহ শাস্ত্র। এর মধ্যে রয়েছে (ক) ‘আল ইনসাফ’ (খ) ইকদুলজীদ ফী আহকামিন ইজতিহাদ ওয়াত্তাকলীদ। এসব গ্রন্থের মধ্যে তিনি ফকীহতের ইখতেলাফকে বিরোধিতা নয় বরং মতদ্বৈধতারূপে দেখিয়ে দিয়েছেন।
চতুর্থ শ্রেণীর গ্রন্থাবলী হচ্ছে তাসাউফ সংক্রান্ত। এর মধ্যে রয়েছে (ক) ফায়সালাতু ওয়াহদাতিল ওয়াজুদ ওয়াশ শাহুদ (খ) আল কওলুল জামীল, (গ) তাফহীমাতে-ইলাহিয়া (ঘ) আলতাফুল কুদুস (ঙ) আন-ফানসুল-আরিফী (চ) ফুয়ুযুল-হারামাইন (ছ) আলখায়রুল-কাসীর (জ) সাৎয়াত ও (ঝ) লুময়াত বিখ্যাত।
পঞ্চম শ্রেণীর গ্রন্থাবলীর মধ্যে রয়েছেঃ ‘আলহুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা’। তাঁর এ বিশ্ববিখ্যাত গ্রন্থটিকে ইসলামের ভাষ্য বলা চলে। মওলানা মানাজির আহসান গিলানীর ভাষায় ‘আমি এ গ্রন্থটির ন্যায় মানব রচিত এমন কোন গ্রন্থ দেখিনি, যাতে ইসলামকে পরিপূর্ণ জীবন-বিধান হিসেবে সুসংবদ্ধভাবে তুলে ধরা হয়েছে।‘
এ অমর গ্রন্থটি সম্পর্কে প্রাচীন ও আধুনিক জ্ঞানে সমৃদ্ধ বহু মূল্যবান গ্রন্থ প্রণেতা বাংলার শ্রেষ্ঠতম সুফী চরিত্রের ইসলামী চিন্তাবিদ হযরত মওলানা নূর মুহাম্মদ আযমী সাহেব আজ থেকে প্রায় ৪৩ বছর পূর্বে উর্দু ভাষায় তাঁর লিখিত ‘নেজামে তালীম’ পুস্তকের ১৬ পৃষ্ঠায় মন্তব্য করেন, “আমার মতে আল্লাহর কিতাব ও রাসুলুল্লাহর (স) সুন্নাহর পরে এটাই সর্বোৎকৃষ্ঠ কিতাব। কেননা, এতে এমন সব জ্ঞানসমৃদ্ধ বিষয় রয়েছে যা অপর কোন গ্রন্থে নাই, যা কোন চক্ষু দেখেনি, কানে শোনেনি, এমনকি কেউ অন্তর দিয়েও উপলব্ধি করেনি। মূলত এটা হচ্ছে কুরআন ও সুন্নাহর ব্যাখ্যা অথচ পূর্ণ নির্ভরযোগ্য-বরং বলা চলে মুহাম্মদী শরীয়তের নির্যাস।