গুন্ডামীর সম্মুখীন
হযরত শাহ আবদুল আযীয (রহ) বলেন যে, “আমরা দিল্লীতে বসবাস করা কালে নিজেদের হাতেই (ইংরেজ তোষামোদকারী ও শীয়া মুসলমান) আমাকে অকথ্য জ্বালা-যন্ত্রণা সহ্যক রতে হয়েছে। আমাদের প্রতি দুর্বুত্ত, বখাটে ও দুস্কৃতিকারীদেরকে লেলিয়ে দেওয়া হতো। তারা আমাদের ঘরের ছাদে তাজিয়া রেখে দিত। পবিত্র রমযানে তারাবীহ হচ্ছে, হঠাৎ মদমত্তা কোন দুশ্চরিত্রা নারীকে মসজিতে ঢুকিয়ে দেওয়া হতো, আর সে হাফেজ শিরাজীর কবিতা আবৃত্তি করে নাচানাচি করতো। গুন্ডারা বাইরে দাড়িয়ে দাড়িয়ে ঢোল বাজাতো আর অশোভনীয় উক্তি ও বিশ্রী ধ্বনি দিতো। এসব গুন্ডার উপযুক্ত জবাব দিতে গেলে মূল আন্দোলনের ক্ষতির আশংকা ছিল” (টীকা: মলফুযাত পৃঃ ৫৪)
সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত
“গুন্ডামী দ্বারা কোনো ফলোদয় না হওয়াতে হযরত শাহ্ আবদুল আযীয (রহ)-এর বিষয়সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে নেওয়া হয়। অবশ্য অন্য প্রভাব কাটিয়ে পরে এই নির্দেশ প্রত্যাহার করানো হয়। (টীকা: মানাকেবে ফরীদ)
নির্বাসন
একটি মামলা রফাদফা হতে না হতেই তার বিরুদ্ধে আর একটি রুজু করা হতো। সম্পত্তি বাজেয়াপ্তির মামলা প্রত্যাহৃত হবার পর তার প্রতি সপরিবারে দেশ ত্যাগের হুকুম আসলো। এবার কোন প্রভাবেও কাজ হলো না। শাহ আবদুল আযীয (রহ) নিজ ভ্রাতৃবৃন্দ, পরিবারের অন্যান্য সদস্য ও অনুসারীগণসহ পদব্রজে দিল্লী ছেড়ে শাহেদরাহ্ চলে যান। সেখান থেকে হযরত শাহ ফখরুদ্দীন (রহ)-যিনি বাজেয়াপ্তির হুকুম রদ করেছিলেন, তাদের যান-বাহনের ব্যবস্থা করেন।“ (টীকা: ওলামায়ে হিন্দ কা শানদার মাষী)।
প্রাণনাশের ষড়যন্ত্র
শুধু তাই নয়। শাহ আবদুল আযীয (রহ) কে কুচক্রীরা দুই দুইবার বিষপ্রয়োগে হত্যা করারও ষড়যন্ত্র করেছিলে। কিন্তু আল্লাহর অনুগ্রহে তাদের ষড়যন্ত্রজাল ছিন্ন হয়ে যায়। তবে তার শরীরের উপর এক ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছিল। জানা যায়, একবার তার গায়ে টিকটিকির মলম ডলে দেওয়ায় তার শরীরে শ্বেত রোগের সৃষ্টি হয়েছিল। এসব কষ্ট নির্যাতনের ফলে তিনি দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেছিলেন, রক্তচাপ বেড়ে গিয়েছিল এবং শ্বেত রোগসহ আরও নানাবিধ ব্যধির তিনি সম্মুখীন হয়েছিলেন। (টীকা: আরওয়াহে সালাসা।)
১৮৫৭ সালের বিপ্লবের পটভূমি
দুর্ভাগ্যজনক হলেও এ কথা সথ্য যে, ইংরেজশক্তির বিরুদ্ধে ১৮৫৭ সালের ঐতিহাসিক বিপ্লব এবং উত্তরকালে পাক ভারতের স্বাধীনতা অর্জিত হওয়া পর্যন্ত এ ব্যাপারে আমাদের অধিকাংশ ঐতিহাসিকই আলিম সমাজের ভূমিকাকে আশানুরূপভাবে প্রাধান্য দিতে যে কার্পণ্যের পরিচয় দিয়েছেন, তেমনিভাবে ১৮৫৭ সালের বিপ্লবের পটভূমি রচনায় আরিমদের যে একক প্রভাব কাজ করেছিল, সে ক্ষেত্রেও তারা ঐ একই সংকীর্ণ মানকিতার পরিচয় দিয়েছেন। বাস্তব ঘটচনা ও অনেক নির্ভরযোগ্য উর্দু-ফারসী ইতিহাস থেকে স্পষ্ট জানা যায় যে, উপমহাদেশের পরাজিত ও ভগ্রোৎসাহ মুসলমানদের মনে ইংরেজবিরোধী যে আগুন জ্বলে উঠেছিল, তার প্রধানতম কারণ ছিল একটি নির্ভীক ও বৈপ্লবিক ফতোয়া। এই ফতোয়াদাতা ছিলেন উপমহাদেশের তদানীন্তন সর্ব-জনমান্য বুযুর্গ ও সর্বশ্রেষ্ঠ আলিম শাহ আবদুল আযীয দেহলভী (রহ)। এই ফতোয়া প্রকাশিত হবার পরই কিংকর্তব্যবিমুঢ় মুসলিম জাতি আন্দোলনের পথ খুজে পায়। এই ফতোয়া সকল শ্রেণীর মানুষকে স্বাধীনতা আন্দোলনে অনুপ্রাণিত করে তোলে। ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৭৬৫ খৃঃ যখন পাটনা এবং বক্সারের যুদ্ধে সুজাউদ্দৌলা (অযোধ্যা) ও শাহে আলম পরাস্ত হন, তখন সঙ্গে সঙ্গেই দিল্লী দখল করা ইংরেজদের পক্ষে তেমন অসুবিধার কিছু ছিল না। কিন্তু সুচতুর ইংরেজগণ নিজেদের বেনিয়া বুদ্ধি খাটিয়ে জনগণের মধ্যে প্রথমেই ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি না করে কয়েক বছর অপেক্ষা করে অতপর ১৮০৩ খৃঃ দিল্লী দখল করে। কিন্তু এখানেও তারা চতুরতার আশ্রয় নেয়। প্রথমে সম্রাটকে মসনদচ্যুত না করায় এবং তার থেকে শাহী মুকুট ছিনিয়ে নেয়ার পরিবর্তে ইংল্যান্ডের সম্রাটের ন্যায় তাকে পার্লামেন্ট স্বীকৃত ক্ষমতাহীন প্রধান করে রাখা হলো। তখন থেকে সমস্ত ক্ষমতা ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানীর হাতে চলে গেলো। যার ব্যাখ্যা এভাবে দেয়া যেতে পারে যে, জনগণ হচ্ছে আল্লাহর, দেশ সম্রাটের আর হুকুম কোম্পানী বাহাদুরের।
পরিস্থিতি অত্যন্ত নাযুক। একদিকে তারা আল্লাহর থেকে ও তার অসীম কর্তৃত্বকে স্বীকার করে ধর্মীয় কর্তৃত্ব নিজেদের হাতে নিয়ে নিলো এবং অপরদিকে মুঘল সম্রাটের রাজত্ব ও তৈমুরী খান্দানের সম্মান সংরক্ষণের প্রতিশ্রুতি দেয়া হলো। রাষ্ট্রীয় কার্কারবার যা হিন্দু-মুসলমান উজীর ও আমীর-উমারাদের হাতে সোপর্দ ছিল, এখন থেকে তা ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানীর হাতে ন্যস্ত হলো। শুধু তাদের ধর্ম ও সংস্কৃতিকে সংরক্ষণ করারই প্রতিশ্রুতি দেয়া হলো না বরং মুসলমানদের সামাজিক ও ধর্মীয় বিষয়ের ফয়সালা মুসলমান কাজীদের হাতে এবং হিন্দুদের ফয়সালা হিন্দু পন্ডিতদের হাতে অর্পণ করা হলো। এভাবে তারা ভারতীয়দেরকে তথাকথিত ‘কালচারাল অটোনমী’ প্রদান করলো। সাধারণ মানুষ সব সময়ই অসচেতন থাকে, ঐ সময় সমাজের বুদ্ধিজীবীরাও এই পার্থক্য তথা চক্রান্তটি ধরতে পারেননি। তারা ভাবলেন, যখন আমাদের ধর্মীয় ও তামাদ্দুনিক অধিকার ঠিক থাকবে এবং সম্রাটকেও সমনদচ্যুত করা হবে না, তাতে আর আপত্তির কি আছে।
জটিল প্রশ্ন
এ জটিল পরিস্থিতিকে ‘আজাদী’ বলা হবে, না ‘গোলামী’? ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গীতে এটা এক জটিল প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ালো যে, এ অবস্থায় ভারতে কি পূর্বের ন্যায় ‘দারুল ইসলাম’রূপে আখ্যায়িত হবে, না ‘দারুল হরব’ (ইসলামী পরিভাষায় দারুল হরব সে দেশকেই বলা হয়, যে দেশে ইসলাম বিরোধী সরকারের সঙ্গে জিহাদ করা হয় অথবা যেখান থেকে ধর্মীয় নির্দেশ অনুযায়ী হিজরত করতে হয়) বলতে হবে কিংবা ঐ অবস্থায় ভারতকে ‘দারুল আমান’ বলা হবে, যেখানে সরকার অমুসলিম হলেও মুসলমানদের জানমাল নিরাপদ এবং তাদের ধর্মীয় স্বাধীনতা বিদ্যমান থাকে? আর ঐ দৃষ্টিতে সেখানে প্রতিষ্ঠিত সরকারের সঙ্গে লড়াই করাও অবৈধ।
উনিশ শতকের শুরুতে এ বিষয় তদানীন্তন ভারতের রাজনৈতিক চিন্তাবিদ ও ওলামায়ে কেরামের সামনে এক জটিল প্রশ্ন হয়ে দেখা দিলো।
এটা এমন এক প্রশ্ন ছিল, যেখানে মতভেদের যথেষ্ট অবকাশ ছিল এবং ইংরেজদের ন্যায় ধুর্ত জাতির পক্ষে এই মতদ্বৈদতার সুযোগ নিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করার যথেষ্ট মওকা ছিল। অবশ্য তারা তাই করেছে এবং সফলকামও হয়েছে। তবে হযরত শাহ ওয়ালিউল্লাহ (রহ) শিক্ষায়তনে ট্রেনিংপ্রাপ্ত ইসলামী আন্দোলনের কোন কর্মীকে এহেন ধাপ্পাবাজির শিকারে পরিণত করা সহজ ছিল না। তাই ১৮০৩ খৃষ্টাব্দে হযরত শাহ আবদুল আযীয দেহলভী (রহ) তখন পুর্বোক্ত ফতোয়া প্রকাশ করে ইসলামী আন্দোলনের নতুন দ্বার উন্মোচিত করেন। (ফতোয়াটি ………. পৃষ্ঠায় দ্রষ্টব্য)
১৮৫৭ সালে
সাধারণ মুসলমান ইংরেজদের ক্ষমতা ও প্রতাপের সামনে নিজেদেরকে নিঃসহায় মনে করছিল। তাদের মধ্যে এরূপ যোগ্যতা ছিল না যে, ইংরেজ শক্তির মুকাবিলায় ঐ পরিস্থিতিতে বিরূপ কর্মসূচী বা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। এই ফতোয়ার ফলে তারা কর্মনীতি নির্বাচনের পথ খুঁজে পেলো।
কলমের জিহাদ
শাহ আবদুল আযীয (রহ) উপমহাদেশে মুসলিম পুনর্জাগরণের জন্য কেবল ইংরেজ বিরোধী বিপ্লবাত্মক ফতোয়া জারি, শিক্ষা দান, বক্তৃতা ও জনসংগঠনই করেননি, তিনি মানুষের চিন্তার গভীরে ওয়ালিউল্লাহ (রহ)-এর ইসলামী রেনেসাঁর বাণীকে স্থায়ীভাবে বসিয়ে দেওয়ার জন্য মসীর অস্ত্রও হাতে নিয়েছিলেন। তাঁর লিখিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থাবলী হচ্ছেঃ (১) তফসীরে আযীযী, (২) তোহফায়ে এসনা আশরিয়া (শিয়াদের ভ্রান্ত মতবাদ খন্ডনে লিখিত এ কিতাবটির জবাব আজও তারা দিতে পারেনি), (৩) বুসতানুল মুহাদ্দেসীন, (৪) আযীযুল ইকতেবাস, (৫) সিয়ারুশ শাহাদাতাইন, (৬) ফতোয়ায়ে আযীযী (৭) ফথহুল আযীয (ওয়ালিউল্লাহ (রহ)-এর ফতহুর রহমানের ব্যাখ্যা গ্রন্থ)। এছাড়া তিনি “হাওয়াশী বর শারহে আকায়েদ”, এজাযুল বালাগাত প্রভৃতি বহু পুস্তিকা এবং হাশিয়া রচনা করেন।
অন্যান্য মুসলিম রাষ্ট্রে আবদুল আযীয (রহ)-এর আন্দোলনের প্রভাব
শাহ আবদুল আযীয (রহ) –এর শিক্ষার প্রভাব হেজাজের মাধ্যমে ভারতের বাইরেও পৌঁছেছিল। শেখ খালেদ কুর্দীর দ্বারা ইস্তাম্বুলে তাঁর শিক্ষার চর্চা হতো। তিনি কুর্দী ইসলামী বিপ্লবের অন্যতম মুজাহিদ মওলানা গোলাম আলীর নিকট শিক্ষঅ লাভ করেছিলেন। তিনি ইসমাইল শহীদের মধ্যস্থতায় শাহ আবদুল আযীয (রহ)-এর শিক্ষায় অনুপ্রাণিত ছিলেন। তাছাড়া মওলানা গোলাম আলীও শাহ সাহেবের অন্যতম শিষ্য ছিলেন। ইস্তাম্বুলের আলেম সমাজ শাহ আবদুল আযীয (রহ)কে সেখানে যাবার আমন্ত্রণ জানিয়ে লিখেছিলেন “আপনি ইস্তাম্বুল তশরীফ আনুন, এখানকার সুধীমহল আপনার নেতৃত্বে কাজ করতে প্রস্তুত রয়েছে”। শাহ আবদুল আযীয বিদেশ গমন সমীচীন মনে করেননি। মূলত তার বিদেশ না গিয়ে সাইয়েধ আহমদ ব্রেলভী শাহ ইসমাইল শহীদ, মওলানা আবদুল হাই প্রমুখকে ইসলামী প্রশিক্ষণ দানের ফলে পরবর্তী পর্যায়ে উপমহাদেশে ইসলামের যেই বিরাট কাজ হয়েছে, সেটার মূল্য লাখো বেশী। তাঁর সেই অবদানের কথা ইতিপূর্বে “ওয়ালিউল্লাহ কর্মীদল” শীর্ষক আলোচনায় বিস্তারিত আলোচিত হয়েছে।
ওফাত
মহাপুরুষ শাহ আবদুল আযীয দেহলভী (রহ) ১১৩৯ হিঃ মুতাবিক ১৮২৮ খৃঃ উপমহাদেশে মুসলমানকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে এ মর জগৎ থেকে বিদায় নেন। তাঁর ইন্তিকালের পূর্বে নিজস্ব কুতুবখানাটি তিনি মওলানা শাহ মুহাম্মদ ইসহাককে দান করেন। খান্দানের অন্যান্য বুযুর্গানের ন্যায় তাঁকে দিল্লীর প্রসিদ্ধ কবরস্তান লেহেন্দীয়ালে দাফন করা হয়। তারপর উক্ত মাদ্রাসায় তাঁর ভ্রাতাগণ পর্যায়ক্রমে অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। মাদ্রসাটি ১৮৫৭ খৃষ্টাব্দের বিপ্লবের সময় ধ্বংস হয়ে যায়। তা সত্ত্বেও এখনও উক্ত এলাকাটি মাদ্রসা মহল্লা নামে পরিচিত। “তাবাকাতে নাসেরিয়া” ও “ফাওয়ায়েদুল ফাওয়ায়েদে” উল্রেখ আছে যে, ঐ সময় সরকারী ব্যয়ে দিল্লীতে মাদ্রাসা-এ-মুয়েবিয়া ‘মাদ্রাসা-এ-নাসেরিয়া’ ও মাদ্রাসা এ-ফিরোযিয়া’ প্রভৃতি কয়েকটি মাদ্রাসাও চালু ছিল।
আবদুল আযীয (রহ) –এর জীবনের কতিপয় ঘটনা
তিনি কেবল ইসলামিয়াতেই একজন দক্ষ আলিম ছিলেন না, আরবী সাহিত্য ও কাব্যেও তাঁর যথেষ্ট দখল ছিল। তিনি আরবী কবিতায় শিখ ও মারাঠানের জুলুম নির্যাতনের বিবরণ দিয়ে তাঁর চাচার নিকট ব্যাখ্যাভারাক্রান্ত মনে যে পত্রটি লিখেছিলেন তার দৃষ্টান্ত হচ্ছে নিম্নরূপ:
“আল্লাহ আমাদের পক্ষ থেকে
শিখ ও মারাঠাদের প্রতিশোধ গ্রহণ করুন।
অত্যন্ত মারাত্মক শাস্তি দিন”।
“শিখ মারাঠারা অসংখ্য মানব সন্তানকে হত্যা করেছে,
তারা নিরপরাধ মানুষকে যন্ত্রণা দিতেছে”।–[মাকতুবাত]
এছাড়াও আরবীতে তাঁর রচিত বহু তত্ত্বপূর্ণ ও রসালো কবিতাও সন্ধান পাওয়া যায়। তিনি একবার মুসলিম শাসনাধীণ ভারতের রাজধানী দিল্লীর প্রশংসা করে একটি শ্লোক লিখেছিলেন।
নিয়ম নিষ্ঠা
ইসলামী আন্দোলনের কর্মীবাহিনীর উদ্দেশ্যে সপ্তাহে তাঁর যে দুটি নির্ধারিত বক্তৃতা চিল, তাতে বার্ধক্য ও শারীরিক পীড়াকে উপেক্ষা করেও সময় মতো তাদের উদ্দেশ্যে নিজের মুল্যবান ভাষণ প্রদান করতেন। তিনি শ্রোতাদেরকে বলতেন যে, “তোমরা দুজনে আমাকে ধরে বসিয়ে দেবে এবং আমি বক্তৃতা শুরু করলে আমাকে ছেড়ে দিবে”। তাতে দেখা গেছে যে, তিনি প্রথমে যেখানে দুর্বলতাবশত শরীর টেনে উঠাতে পারতেন না। সেখানে পরে স্বাভাবিকভাবেই বক্তৃতা দিয়ে গেছেন। তাঁর বক্তৃতায় বহু অমুসলমানও আকৃষ্ট হতো। তাঁর সমালোচনা এমন মার্জিত ছিল যে, তাঁর কথায় কারো মনে কষ্ট নেওয়ার অবকাশ থাকতো না।–[হায়াতে ওয়ালী]
উপস্থিত বুদ্ধি
একবার কতিপয় আলিম টমটমে করে দিল্লী রওয়ানা হয়েছিলেন। গাড়োয়ান ছিলো জাতীতে ব্রাহ্মণ। সে আলিমদের প্রশ্ন করে বসলো, “আচ্ছা হুযুর সাহেবান, আপনারা আমার একটি প্রশ্নের উত্তর দেবেন কি? বলুন তো আল্লাহ কি হিন্দু না মুসলমান? প্রত্যেকেই বিভিন্নভাবে প্রশ্নটির জবাব দিলেন, কিন্তু কোন জবাবই গাড়োয়ানের মনঃপুত হলো না। অবশেষে তাঁরা গাড়োয়ানকে দিল্লীতে গিয়ে শাহ সাহেবের নিকট থেকে জেনে তার জবাব দানের প্রতিশ্রুতি দেন। দিল্লীতে পৌঁছে গাড়োয়ান নিজেই গিয়ে শাহ সাহেবক উক্ত প্রশ্নটি করেন। আলিমগণও প্রশ্নটির জবাব দানের জন্য তাঁকে অনুরোধ জানান। শাহ আবদুল আযূীয দেহলভী (রহ) গাড়োয়ানকে বললেন, আমি যা বলি তা মনোযোগ দিয়ে শোন। কথা হচ্ছে, আল্লাহ যদি হিন্দু হতেন তা হলে কোন ব্য্কিত গরু জবাই করতে পারতো না। এ কথা তুমি স্বীকার করো কিনা?” গাড়োয়ান তখল লা জওয়াব হয়ে স্বেচ্ছায় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে।
-(শাহ আবদুল আযীয আওর উনফী তালীমাত)।
পাদরীর সঙ্গে ধর্মীয় বিতর্ক
একবার জনৈক পাদরী ধর্ম সম্পর্কে বাহাস করার জন্য দিল্লী আসেন। শর্ত ছিল, যে কেউ বাহাসে হারবে সে ব্যক্তি দু’হাজার টাকা প্রতিপক্ষকে দেবে। স্থানীয় প্রশাসক বললেন যে, শাহ সাহেব হারলে তাঁর টাকা আমি দেবো। পাদরী বললেনঃ আমি যে প্রশ্ন করবো যুক্তির মাধ্যমে তার জবাব দিতে হবে-ধর্মীয় গ্রন্থের উদ্ধৃতি দ্বারা নয়। এ কথা সিদ্ধান্ত হবার পর পাদরী জিজ্ঞেস করলেন, “আপনাদের পয়গম্বর কি হাবিবুল্লাহ তথা আল্লাহর বন্ধু? “হ্যাঁ নিশ্চয়ই তিনি আল্লাহর বন্ধু” শাহ সাহেব বললেন। পাদরী বললেন, ‘আপনার পয়গম্বর ইমাম হোসাইনের হত্যার সময় আল্লাহর কাছে ফরীয়াদ জানাননি। অথচ বন্ধুর প্রিয়তম অধিক হয়ে থাকেন। তিনি ফরিয়াদ জানালে নিশ্চয় তা শুনতেন’।
শাহ সাহেব জবাব বললেন, “হ্যাঁ, তিনি তো ফরিয়াদ জানাতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু ঐ সময় এমন অদৃশ্য বাণী আসলো যে, তোমার নাতিকে জাতির লোকেরা অন্যায়ভাবে হত্যা করেছে –এ জন্য তুমি ফরিয়াদ জাতাতে যাচ্ছো, অথচ এ মুহুর্তে “আমার ছেলে” ঈসাক ক্রুশবিদ্ধ করে হত্যা করার কথা আমার মনে পড়ছে”।
এ দাঁতভাঙ্গা জবাবে পাদরী লা-জওয়াব হয়ে গেলেন এবং তার দু’হাজার টাকা প্রদান করতে হলো। এ জাতীয় আরও অসংখ্য ঘটনা শাহ আবদুল আযীয দেহলভী (রহ)-এর জীবনে দেখা যায়, যেগুলো থেকে তাঁর অপরিসীম আল্লাহ প্রদত্ত উপস্থিত বুদ্ধির পরিচয় পাওয়া যায়।
— সমাপ্ত —