ওয়ালিউল্লাহ আন্দোলনের প্রধান নেতা শাহ আবদুল আযীয দেহলবী (রহ)
[ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে প্রথম ফতওয়াদানকারী]
সাধারণত কোনো মহৎ চিন্তা-ভাবধারা বা আদর্শের উদ্ভাবকের পক্ষে নিজের চিন্তাধারাকে আপন জীবদ্দশাতেই পূর্ণাঙ্গরুপে সমাজে বাস্তবায়িত করা কিংবা এর ব্যাপক প্রসার দান সম্ভবপর হয়ে ওঠে না। পরবর্ত যুগে তাঁর অনুসারীদের মধ্য থেকেই এ মহান কাজে কেউ এগিয়ে আসেন। এই উপমহাদেশে ইসলামী রেনেসা আন্দোলনের অগ্রদূত মহামনীষী ইমাম শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভী (রহ) (১৭০৩-১৭৬৭ খৃঃ) ইসলামী বিপ্লবের যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, তাঁর বেলায়ও ঠিক এমনটিই ঘটেছিল। তিনি কুসংস্কারাচ্ছন্ন জড়তাগ্রস্ত ক্ষয়িষ্ণু মুসলিম জাতির সামনে দীর্ঘদিনের চিন্তা-গবেষণার ফলশ্রুতিরূপে ইসলামের বিপ্লবী ব্যাখ্যা প্রদান করেছিলেন, আর সেই মহান লক্ষ্যকে কার্যকরী করার পথে যিনি সর্বাগ্রে এগিয়ে এসেছিলেন, তিনিই হচ্ছেন শাহ্ আবদুল আযীয দেহলভী (রহ)। শাহ্ আবদুল আযীয ইমাম দার্শনিক শাহ্ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভীর (রহ) জ্যেষ্ঠ পুত্র।
জন্ম ও শিক্ষা-দীক্ষা
শাহ্ আবদুল আযীয দেহলভী (রহ) সম্রাট দ্বিতীয় আলমগীরের শাসনামলে অনুমান ১৭৪৭ খৃস্টাব্দে দিল্লীতে জন্মগ্রহণ করেন। পরিবারের প্রচলিত নিয়ম মাফিক তিনি নিজ গৃহেই প্রাথমিক শিক্ষা আরম্ভ করেন। তাঁর শিক্ষার জন্য মওলানা শাহ্ মুহাম্মদ আশেক এবং মওলানা খাজা মুহাম্মদ আমীনকে নিযুক্ত করা হয়। তিনি তাদের নিকট থেকে প্রথমতঃ ফরাসী ও আরবী ব্যাকরণ শিক্ষা লাভ করেন। পরে আরবী ফিকাহ, উসুল, মানতেক, কালাম আকায়েদ, অংক, জ্যোতিবিদ্যা ইত্যাদি বিষয়ে জ্ঞানার্জন করেন। এসব জরুরী বিষয় শিক্ষা লাভের পর তের বছর বয়সে শাহ আবদুল আযীয (রহ) পিতার নিকট হাদীস ও তফসীর সম্পর্কে উচ্চতর জ্ঞানার্জন করে দুবছর পরই সাফল্যের সনদ লাভ করেন। শাহ ওয়ালিউল্লাহর (রহ) ইসলামী আন্দোলনের কর্মী বাহিনীর কেন্দ্রীয় সংস্থা কৈশোরেই আবদুল আযীয (রহ) এর চারিত্রিক গুণাবলী, আল্লাহভীরুতা ও কর্মকুশলতা দেখে তাকেঁ পিতার স্থালাভিষিক্ত করার বিষয় চিন্তা করছিলেন। সেই দৃষ্টিভঙ্গিতেই ওয়ালীউল্লাহর সংস্পর্শে শিক্ষাপ্রাপ্ত ইসলামী আন্দোলনের কর্মীবৃন্দের শীর্ষস্থানীয় নেতাগণ মহামান্য ওয়ালিউল্লাহ (রহ) এর আদর্শের অনুসরণে তাকে গড়ে তোলার প্রতি বিশেষ যত্নবান হন। উল্লিখিত শিক্ষকদ্বয় ইলমে হাদীস ও ওয়ালিউল্লাহ আন্দোলনের মূলনীতি স্মপর্কে তাকে জ্ঞানগভীর করে তোলেন। ইসলামী আইনশাস্ত্র তথা ফিকাহ সম্পর্কে শাহ আবদুল আযীয (রহ) কে জ্ঞানসমৃদ্ধ করে তোলার জন্য যিনি দায়িত্ব নিয়েছিলেন, তিনি হলেন মওলানা নূরুল্লাহ। শাহ ওয়ালিউল্লাহ (রহ) ছাত্র এবং আবদুল আযীয (রহ)- এর উস্তাদ এ তিন মহৎ ব্যক্তির দ্বারাই ওয়ালিউল্লাহ (রহ)-এর শিক্ষা এবং আদর্শের প্রসার ঘটেছিল। তাদের পাশাপাশি ওয়ালিউল্লাহ (রহ)-এর শাগরিদদের মধ্যে অপেক্ষাকৃত কমবয়সী আরেকটি শ্রেণী গড়ে উঠেছিল। ওয়ালিউল্লাহ (রহ)-এর সন্তানগণ ও শ্রেণীর সঙ্গেই শিক্ষা লাভ করেন। তার পিতার তিরোধানের পর (১৭৬৩ খৃঃ) এই উভয় শ্রেণীর সমর্থনে ১৭ বছর বয়সের সময় তিনি পিতার স্থানে ইসলামী আন্দোলনের নেতা মনোনীত হন। দেশের তৎকালীন অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, তামাদ্দুনিক ও ধর্মীয় বিপর্যয়ের প্রেক্ষিতে এই সুযোগ্য উত্তরাধিকারী কর্তৃক অনুসৃত কর্মসূচীর বদৌলতে উপমহাদেশে ইসলামী শিক্ষা অনুশীলনের প্রচার ও সুদুর প্রসারী প্রভাবের প্রতি লক্ষ্য করে সঙ্গতভাবেই বলা চলে যে, শাহ আবদুল আযীয (রহ)-এর নিজ যোগ্যতার কারণেই তাকে এই মহান পদে সমাসীন করা হয়েছিল-শাহ ওয়ালিউল্লাহ (রহ)-এর ছাহেবযাদা হবার মর্যাদার কারণে নয়। তার দ্বারা উপমহাদেশে কুরআন হাদীস তথা ইসলামী শিক্ষার এত ব্যাপক প্রসার ঘটেছিল যে, উপমাহেধে এমন কোনো দ্বীনী শিক্ষা কেন্দ্র নেই, যা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তার শিক্ষা কেন্দ্রের সঙ্গে জড়িত নয়। এমন কি এশিয়ার অন্যান্য মুসলিম রাষ্ট্রেও তার শিক্ষা আলোকচ্ছটা ছড়িয়ে পড়েছিল।
শাহ্ আবদুল আযীয (রহ)- এর কর্মজীবন
যেহেতু মোঘল শাসনের পতন যুগেই শাহ্ আবদুল আযীয (রহ)- এর জন্ম, তাই এই মুসলিম রাজত্বের অধঃপতনের ধারাবাহিক চিত্র ও ভারতে মুসলিম আধিপত্য ক্ষুণ্ন হবার মূল কারণ সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা শুরু থেকেই তার মন-মগজকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। তিনি মুসলমানদের মুক্তির পথ খুজছিলেন। উপ মহাদেশে ইসলাম ও ইসলামী কৃষ্টি সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রাখা এবং এর ভিত্তিতে পুনরায় এখানে এসলামী আন্দোলনের দীপশিখা প্রজ্জ্বলিত করার উদ্দেশ্যে সময়োপযোগী এমন কি কর্মসূচী গ্রহণ করা যেতে পারে, তিনি তাই ভাবছিলেন। অবশেষে শাহ আবদুল আযীয (রহ) এমন এক পন্থা অবলম্বন করলেন, যার ফলে তিনি উপমহাদেশের মুসলমানদের অন্তরে চিরদিন অমর ও শ্রদ্ধেয় সত্তা হিসেবে বিরাজ করবেন। এ উদ্দেশ্যে প্রথম তিনি তার পিতার দর্শন মাফিক ইসলামী বিপ্লব সৃষ্টির উদ্দেশ্যে এর পূর্বশর্ত হিসেবে মুসলমানদের ইসলামী জীবনবোধের সঠিক তাৎপর্য অনুধাবন করাবার ব্যাপারে উদ্যোগী হন। তিনি দিল্লীস্থ পৈত্রিক শিক্ষাদান কেন্দ্রের মাধ্যমেই এ কাজ শুরু করেন। এটা ছিল সত্যিকার অর্থে শাহ ওয়ালিউল্লাহ (রহ)- এর দর্শন ও শিক্ষার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়। শাহ আবদুল আযীয (রহ)- এর পিতামহ শাহ আবদুর রহীমের “রহীমিয়া মাদ্রাসায়” ছাত্র সংকুলান হচ্ছিল না দেখে সম্রাট মুহাম্মদ শাহ মহামনীষি ওয়ালীউল্লাহকে দ্বীনী শিক্ষা কেন্দ্রের জন্য এই সরকারী ভবনটি ওয়াকফ করেছিলেন।
শিক্ষার মূলনীতি
ভাবী ইসলামী রেনেসার এই কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা মূলনীতি হিসেবে যে সব বিষয় গৃহীত হলো, তা হচ্ছে (১) কুরআন-সুন্নাহর শিক্ষার ব্যাপক প্রসার দেওয়া এবং ইমাম শাহ ওয়ালিউল্লাহর চিন্তাধারাকে মন-মগজ দিয়ে উপলব্ধি করা। (২) আল্লাহ ভীতি ও আদর্শ জীবন গঠনের প্রেরণা সৃষ্টি করা, (৩) রাজতন্ত্র ও সরকার তোষণ মনোভাব মন-মস্তিস্ক থেকে দূর করা এবং ইসলামী বিপ্লবকে পরিপূর্ণ জয়যুক্ত করার জন্য মানুষের মধ্যে ত্যাগের স্পৃহা সৃষ্টি করা, (৪) সমাজসেবা ও দুস্থ মানবতার প্রতি সহানুভূতির উদ্রেক করা, (৫) রাজকীয় বিলাসিতা পরিহার করে সহজ সরল জীবন-যাপন করা, (৬) ত্যাগী ভাবধারা সৃষ্টি করা এবং যে কোন দুর্যোগ মুহুর্তে দৈর্য ও সহনশীলতার অনুশীলন করা, (৭) সমাজ বিধ্বংসী সকল প্রকার অনাচার, কুসংস্কর ও রীতিনীতি উৎখাতের চেষ্টা করা এবং বিলাসিতার আখড়াসমূহের অবসান করা-যা সমাজকে আরামপ্রিয় ও দুর্বল করে তোলে। এছাড়া শাহ আবদুল আযীয (রহ) রীতিমতো সপ্তাহে দু’বার ইসলামী আদর্শ, শিক্ষা-সংস্কৃতি ও জটিল জটিল সমস্যাবলী নিয়ে সাধারণ সভায় বক্তৃতা করতেন।
কতিপয় বিখ্যাত ছাত্র
তাঁর নিকট শিক্ষাপ্রাপ্ত সংগামী যেসব ছাত্রবৃন্দ উপমহাদেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিলেন তাদের তালিকা সুদীর্ঘ। এখানে কতিপয় বিখ্যাত ছাত্রের নাম প্রদত্ত হলো। এদের অধিকাংশই পরবর্তী পর্যায়ে সাইয়েদ আহমদ শহীদ (রহ)-এর নেতৃত্বে ১৮২৮ খৃষ্টাব্দে উপমহাদেশের মুসলমানদেরকে শিখ ও ইংরেজদের হাত থেকে আজাদ করার মরণপণ ব্রত নিয়ে রণাঙ্গনে ঝাপিয়েঁ পড়েছিলেন। উল্লেখ্য যে, শাহ্ আবদুল আযীয (রহ) ঐ সময়ও যে কয়দিন জীবিত ছিলেন, বার্ধক্যপীড়াকে উপেক্ষা করে পরামর্শ, পরিকল্পনা ও বক্তৃতা দ্বারা এই সংগ্রামী বাহিনীকে অনুপ্রাণিত করে গেছেন। তার খ্যাতনামা ছাত্রের নাম হচ্ছেঃ (১) মওলানা রীফউদ্দিন, (২) মওলানা শাহ আবদুল কাদের (৩) মওলানা আবদুল গনী (আবদুল আযীযের ভ্রাতৃবৃন্দ), (৪) মওলানা আবদুল হাই (জামাতা) (৫) মওলানা মুহাম্মদ ইসহাক (৬) মওলানা মুহাম্মদ এয়াকুব (নাতিদ্বয়), (৭) মওলানা মাখসুসুল্লাহ (ভ্রাতুস্পুত্র), (৮) মওলানা ইসমাইল শহীদ দেহলভী (ভ্রাতুস্পুত্র), (৯) সাইয়েদ আহমদ শহীদ বেরেলবী, (১০) মওলানা রশীদুদ্দীন, (১১) মওলানা মুফতী সদরুদ্দীন, (১২) হযরত শাহ গোলাম আলী, (১৩) মওরানা করীমুল্লাহ, (১৪) মওলানা মীর মাহবুব আলী, (১৫) মওলানা আবদুল খালেক, (১৬) মওলানা হাসান আলী লক্ষৌবী ও (১৭) মওলানা হোসাইন আহম্মদ মালীহাবাদী।
(উল্লেখ্য যে, সাইয়েদ আহমদ শহীদ (রহ) ১৮২৬ সালে শিখদের বিরুদ্ধে অকোরার যুদ্ধে জয়ের পর ও দলের “আমীরুল মুমিনীন” খেতাব প্রাপ্তির পূর্ব পর্যন্ত এর নেতৃত্ব ছিল মওলানা ইসহাক সাহেবের হাতে)।
সমসাময়িক রাজনৈতিক পরিস্থিতি
ঈসায়ী ১৭৪৭ সাল। সম্রাট দ্বিতীয় আলমগীরের যুগ। মোগল শাসন ব্যবস্থা নিস্তেজ হয়ে পড়েছে। সুদুর কাবুল থেকে আরাকান পর্যন্ত যে মোঘল শাসকদের প্রতাপ ছিল, আজ সেখানে সম্রাট দ্বিতীয় আলমগীর দিল্লীর সিংহাসনে প্রভাবশাল আমীরদের হাতের পুতুলে পরিণত হয়ে আছেন। বিভিন্ন প্রদেশ এক এক করে দিল্লীর কেন্দ্রীয় সরকারের হাত ছাড়া হয়ে গেছে। দু’শ বছর যাবত মোঘল বাদশাহগণ ভারতের বিভিন্ন ভূখন্ডের সমন্বয়ে যে মহাসাম্রাজ্যের গোড়া পত্তন করেছিলেন তা খন্ডবিখন্ড হয়ে উপমহাদেশে বহু স্বাধীন রাষ্ট্র জন্ম নিয়েছে। ন্যায়পরায়ণ সাধক সম্রাট আলমগীর আওরঙ্গজেবের (১৬৫৮-১৭০৭ খৃঃ) পর থেকেই মোঘল সাম্রাজ্যের ফাটল ধরতে থাকে। আওরঙ্গজেবের তিরোধানের পর মোঘলদের চিরাচরিত উত্তরাধিকার সংঘর্ষে শাহযাদা মুয়াযযম তথা প্রথম বাহাদুরশাহ বিজয়ী হন। তিনি ৫ বছর রাজত্ব করেন। সম্রাট আলমগীর আওরঙ্গজেবের পর ১৮৫৭ খৃস্টাব্দ পর্যন্ত যেসব শাহজাদা স্বল্পকালের জন্য কিংবা দীর্ঘকাল পর্যন্ত দিল্লীর শাহী সিংহাসনে সমাসীন ছিলেন, তাঁরা হলেনঃ (১) প্রথম বাহাদুরশাহ, (২) মুয়েযযুদ্দীন, (৩) ফররুখ সিয়ার, (৪) রফীউদ্দারাজাত, (৫) রফীউদ্দৌলা, (৬) মুহাম্মদ শাহ, (৭) আহমদ শাহ্, (৮) দ্বিতীয় আলমগীর, (৯) শাহে আলম, (১০) দ্বিতীয় আকবর ও (১১) শেষ সম্রাট বাহাদুরশাহ জাফর। তাদের মধ্যে মুহাম্মদ শাহ, দ্বিতীয় আলমগীর এবং শাহে আলমের সম্রাট-জীবনই অধিককাল স্থায় ছিল। এদের সকলেই শাসন পরিচালনার ব্যাপারে দুর্বর ও অকর্মন্য সম্রাট ছিলেন এবং ক্ষমতার দ্বন্দ্বে লিপ্ত উজীর ও আমীরুল ওমারাদের ক্রীড়নক ছিলেন।
শাহ আবদুল আযীয দেহলভী (রহ) দ্বিতীয আলমগীরের (১৭৪১-১৭৫৯ খৃঃ) যুগ থেকে সম্রাট শাহে আলমের যুগের (১৭৫৯-১৮০৬) পরেও ছয় বছর এই দুর্ভাগা মুসলিম রাজত্বের পরিণতি স্বচক্ষে লক্ষ্য করেছেন। এদের রাজত্বকালে বাংলা, (নবাব আলীবর্দীর শাসনকাল) অযোধ্যা এবং দাখ্ষিণাত্যের হায়দারাবাদের শাসনকর্তাগণ কার্যত স্বাধীনভাবে দেশ শাসন করতেন। মুসলিম আমীরগণ কেউ ভারতীয, কেউ ইরানী ওবং কেউ তুরানী মোঘল ছিলেন। তাদের মধ্যে শিয়া-সুন্নী বিরোধও ছিল প্রকট। তাদের পরস্পরের উপর প্রাধান্য লাভের প্রতিযোগীতা সাম্রাজ্যকে আরও দুর্বল করেছিলেন। মারাঠাদের অভ্যুত্থান, শিখ ও জাঠদের শক্তি মোঘল সাম্রাজ্যের অস্তিত্বকে অধিক বিপন্ন করে তুলেছিল। দাখ্ষিনাত্যের শাসনকর্তা নেজামুল মূলক আসেফজাহ মারাঠাদের সহায়তায় অযোধ্যার শাসক মীর মুহাম্মদ আমীন বরুহানুল মূলক নওয়াব সায়াদাত খাকেঁ ডিঙ্গিয়ে কেন্দ্রীয় শাসক সম্রাট মুহাম্মদ শাহের উপর প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হলে, সায়াদত খা ও অন্যান্য শিয়া কর্মচারী প্রতিশোধ নেবার উদ্দেশ্যে ইরান থেকে নাদির শাহকে দিল্লী আক্রমণের আমন্ত্রণ জানান। নাদির শাহ ১৭৩৯ খ্রীষ্টাব্দে নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে পরাজিত ও নিহত করে তারা বংলা-বিহার-উড়িষ্যা দখল করে নেয়।
শিখ ও মারাঠাদের অকথ্য জুলুম-অত্যাচারে মুসলমানদের জানমাল ও ইজ্জৎ আবরুর প্রভূত ক্ষতি সাধিত হতে থাকে। ক্রীড়নক সম্রাটের প্রতিকারের কোনই ক্ষমতা ছিল না। তাদের জুলুম থেকে মুসলমানদের রক্ষা করার চিন্তা সকলকে ভাবিয়ে তুলল। খোদ আমীরুল উমারাও অস্থির ছিলেন। শাহী দরবারে প্রধান কর্মকর্তা নাজীবুদ্দৌলা হযরত শাহ ওয়ালিউল্লাহ (রহ) এর ভাসশিষ্য ছিলেন। শাহ সাহেবের অভিপ্রায় অনুযায়ী নাজীবুদ্দৌলা ও তার সঙ্গিগণ মারাঠাদের হাত থেকে মুসলমানদের রক্ষার জন্য কান্দাহারের আহমদ শাহ্ আবদালীকে দিল্লী আগমনের আমন্ত্রণ জানান। আহমদ শাহ দুররানী তথা আব্দালী পলাশী যুদ্ধের সাড়ে চার বছর পর ১৭৬১ খৃস্টাব্দে পানিপথের সর্বশেষ যুদ্ধে মারাঠাদেরকে ভীষণভাবে পরাস্ত করেন। কোন কোন ঐতিহাসিক শাহ ওয়ালিউল্লাহ (রহ)- এর অভিপ্রায় অনুযায়ী আহমদ শাহের দিল্লী আগমনের সমালোচনা করেছেন। তাদের এই সমালোচনা যে ভ্রান্ত, তার বড় প্রমাণ হলো আহমদ শাহ আবদালীর পানি পথের যুদ্ধে বিজয়োত্তর কালের ঘটনাবলী। তিনি পানি পথের যুদ্ধের পর দিল্লী দখল করে বসে থাকেননি, বরং সম্রাট শাহে আলমকে সিংহাসনে বসিয়ে সূজাউদ্দৌলাকে উজীর ও নাজীবুদ্দৌলাকে আমীরুল উমারা পদে বহাল করে স্বদেশে ফিরে গিয়েছিরেন। (তাযকেরায়ে শাহ্ ওয়ালিউল্লাহ) গাযী আব্দালী মারাঠা শত্রদের দমন করে মোঘল সাম্রাজ্যকে ইসলামপ্রিয় রুহীলা পাঠান নেতাদের হাতে তুলে দিলেও তৎকালীন অযোগ্য মোঘল সম্রাট তার থেকে কোনরূপ লাভবান হতে পারেননি। পানি পথের শেষ যুদ্ধের সময় শাহ আবদুল আযীয যৌবনে পদাপর্ণ করেছেন। ইমাম শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী (রহ) পানিপথ যুদ্ধের ৬ বছর পর ইনতিকাল করেন। উল্লেখযোগ্য যে, মারাঠাগণ পরে শক্তি সঞ্চয় করে শীয়া আমীরুল উমারা নজফ আলী খার (১৭৭৩-১৭৮২ খৃঃ-কর্তৃত্বকাল) মৃত্যুর পর ২০ বছর যাবত দিল্লীর কর্তা ছিল। সম্রাট তাদের কথায়ই ওঠা-বসা করতেন।
কেন্দ্রীয় সরকারের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ভারতের বিভিন্ন অংশে দেশী-বিদেশী কর্তৃত্বে অনেক স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলো এবং নামে মাত্র দিল্লী সরকারের প্রতি শ্রদ্ধা ও আনুগত্য দেখানো হতো। সম্রাটগণ নিজ ব্যর্থতাবশত কার্যত শাসকের মর্যাদা হারিয়ে বসলেন। আব্বাসীয় খেলাফতের পতন যুগে যেমন বিভিন্ন আঞ্চলিক শাসক বাগদাদের নামে মাত্র খলীফাদেরকে মৌখিক আনুগত্য জানাতেন, তেমনি পতন যুগের মোঘল সম্রাটদের প্রতিও আঞ্চলিক শাসকগণ মৌলিক আনুগত্য ও শ্রদ্ধা জানাতেন। আর দু’এক অঞ্চল থেকে কেন্দ্রীয় সরকারের নিকট শুধু বাৎসরিক নির্ধারিত রাজস্ব বা অধিকৃত এলাকা শাসনের আনুষ্ঠানিক অনুমতি সনদ বাবদ নজরানা আসতো। এরূপ করার একমাত্র কারণ ছিল জনগণের ভয়। কেননা, ধর্মবিশ্বাসের ন্যায় জনগণের এটা বদ্ধমূল ধারণা ছিল যে, দেশের আসল মালিক হচ্ছেন দীর্ঘকাল স্থায়ী সেই দিল্লীর রাজা-বাদশাহগণ। তাই যিনিই আঞ্চলিক শাসন ক্ষমতায় অধিষ্টিত হতেন না কেন, বাধ্য হয়েই তাকে মোঘল বাদশাহদেরকে মুরব্বী মানতে হতো। বিদ্রোহী শাসকদেরও চেষ্টা থাকতো যাতে বাদশাহ্র নিকট থেকে অধিকৃত এলাকার বৈধ শাসনের সনদ লাভ করতে পারেন। স্বায়ং ইংরেজদেরকেও দীর্ঘ দিন যাবত তা করতে হয়েছিল। ১৮০৩ খৃস্টাব্দে সম্রাট শাহে আলমের স্বপক্ষে মারাঠা শক্তিকে ক্ষমতাচ্যুত করে ইংরেজরা যখন পূর্ণরূপে দিল্লীতে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে এবং সম্রাট শাহে আলম ইংরেজদের আশ্রয়ে বসবাস করতে থাকেন তখন কার্যত গোটা ভারতে ইংরেজ ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানীর প্রভূত্ব চলা সত্ত্বেও তাদেরকে প্রকাশ্যে বাদশাহের আনুগত্য দেখাতে হয়েছে। উল্লেখ্য যে, ১৮০৫ খৃষ্টাব্দে সম্রাট শাহ আলমের সঙ্গে এক চুক্তিতে ইংরেজরা তাকে দিল্লীর লালকেল্লা, শহর এলাকা এবং এলাহাবাদ এবং গাজীপুরের জায়গীর দিয়ে সমগ্র ভারতে তাদের একচ্ছত্র কর্তৃত্ব কায়েম করে।
শাহ আবদুল আযীয (রহ) ভারতবাসী মুসলমানদের এ অবস্থাও দেখতে পেয়েছিলেন যে, কিভাবে ইংরেজগণ ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধ জয়ের পর থেকে ১৮০৩ খৃষ্টাব্দে দিল্লী দখল পর্যন্ত একের পর এক দিল্লী কেন্দ্র থেকে বিচ্ছিন্ন মুসলিম-অমুসলিম স্বাধীন শক্তিগুলোকে ধ্বংস বা বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য করেছিল। কিরূপে প্রচন্ড শক্তি ব্যয় করে ১৭৯৯ খৃস্টাব্দে শাহ ওয়ালীউল্লাহ (রহ)- এর চিন্তায় উদ্বুদ্ধ মহীশুরের বীর সুলতান টীপুকে বিপর্যস্ত, পরাজিত ও নিহত করে সমগ্র ভারতে নিজেদের নিরংকুশ কর্তৃত্ব প্রতিস্ঠা করেছিল। তারপর থেকে ও দেশে ইংরেজদের রাজনৈতিক ক্ষমতা সুদৃঢ়করণ এবং পাশ্চাত্য শিক্ষা-সততা, ধ্যান-ধারণা, কৃষ্টি সংস্কৃতির প্রসার দান ও এদেশের ঐতিহ্যবাহী শাসক জাতি মুসলমানদেরকে পাশ্চাত্যমুখী ও হীনমনা করে গড়ে তোলার কি সব ষড়যন্ত্র শুরু করা হয়, তিনি তাও প্রত্যক্ষ করলেন। সেই দুর্দিনে এ ভারতীয় মৃতপ্রায় মুসলিম জাতির দেহে প্রাণ সঞ্চারের জন্য এবং পুনরায় তাকে বল-বীর্যে বিশ্বের দরবারে সরফরাজ জাতিরূপে দাড় করাবার উদ্দেশ্যে একমাত্র এই সাধক মনীষী শাহ আবদুল আযীযই নিরবচ্ছিন্ন চেষ্টায় নিয়োজিত ছিলেন।
সরকারের দুর্ব্যবহার ও তার পটভূমি
শাহী পরিবারে সম্রাট আলমগীর আওরঙ্গজেবের আমল থেকেই ওয়ালি উল্লাহ পরিবারের একটি আলাদা মর্যাদা স্বীকৃত ছিল, যদিও বহু অনুরোধ উপরোধ ও বিরাট অংকের ভাতার আকর্ষণ কোনো দিনই তাদেরকে শাহী দরবারের সংস্পর্শে নিতে পারেনি। সম্রাট আলমগীর কর্তৃক বিশ্ববিখ্যাত ইসামী আইনশাস্ত্র ফতওয়ায়ে আলমগীরী’ গ্রন্থ রচনায় ওয়ালীউল্লাহর পিতা শাহ আবদুর রহীমকে অংশগ্রহণের অনুরোধ (টীকা: তিনি সরকারী চাকরির প্রতি বীতশ্রদ্ধ ছিলেন বলে তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। অবশ্য সংশ্লিষ্ট বোর্ডকে বাইরে থেকে নানাভাবে সাহায্য করেছেন।) সম্রাট মুহাম্মদ শাহ কর্তৃক পুরাতন রহিমীয়া মাদ্রাসায় ছাত্রদের স্থান সংকুলান না হওয়ায় ওয়ালী উল্লাহ (রহ)কে তার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য বিরাট সরকারী ভবন ছেড়ে দেওয়া এবং তারই অভিপ্রায়ে আমীরুল উমারা নাজীবুদ্দৌলা কর্তৃক মারাঠা দমন উদ্দেশ্যে গাযী আহমদ শাহ আবদালীকে আমন্ত্রণ জানানো-এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ। এভাবে সুন্নী উজীর, আমীর উমরাগণ ও তাদের সন্তানদের অনেকেরই ওয়ালিউল্লাহ (রহ)-এর পরিবারকে শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন। কিন্তু সম্রাট হুমায়ুন কর্তৃক শের শাহকে দমন করার উদ্দেশ্যে একবার ইরান থেকে সামরিক সাহায্য নেয়ার পর থেকে মোঘল শাসনযন্ত্রে শীয়াদের যে প্রভাব বেড়ে চলেছিল, তারই সুদূরপ্রসারী প্রভাবে সেনাবাহিনী ও শাসনযন্ত্রের ক্ষেত্রে উজির-নাজির ও আমীর-উমরার মধ্যেও একটি বিরাট শীয়া দল প্রভাবশালী হয়ে উঠেছিল। সম্রাট শাহে আলমের যুগে ১৭৭০ খৃষ্টাব্দে যখন আমীরুল উমারা নাজীবুদ্দৌলার ইনতিকাল হয়, তখন তার পুত্র ইংরেজ বিদ্বেষী জাবেতা খা আমীরুল উমারা নিযুক্ত হন। কিন্তু সুজাউদ্দৌলার প্রচেষ্ঠায় জাবেতার পরিবর্তে ইংরেজদের ক্রীড়নক নজফ আলী খা যখন আমীরুল উমারা পদে আসেন (১৭৭৩-১৭৮১ খৃঃ) তখন শাহ আবদুল আযীয তথা ওয়ালিউল্লাহ পরিবারের উপর অকথ্য নির্যাতন চালানো হয়। কেননা শীয়া কর্মকর্তাগণ তাদের এই দ্বীনী অন্দোলনকে মোটেই পছন্দ করতেন না।
এটাও আশ্বার্যের কিছু ছিল না যে, ইংরেজের মতো সুচতুর জাতি-শাহ্ আবদুল আযীয কর্তৃক দিল্লীতে বসে ওয়ালীউল্লাহর বিপ্লবী দর্শনের যে প্রচার ও তার ভিত্তিতে জনসংগঠনের কাজ চলছিল,-তার সুদূরপ্রসারী প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করে তারা নিজেদের ক্রীড়নক নজফ আল খার দ্বারা এরূপ করিয়ে থাকবেন। পরবর্তী পর্যায়ে ইংরেজগণ কর্তৃক এক শ্রেণীর তল্লীবাহক দ্বারা তাদের ইসলামী আন্দোলনকে ওহাবী আন্দোলনরূপে জনসমক্ষে চিত্রিত করা তারই সাক্ষ্য বহন করেন। যা হোক, এটা এক দুঃখজনক আশ্চর্য মিল যে, মোঘল শাসনের শেষের দিকে তা উপমহাদেশে ইংরেজ প্রাধান্য প্রতিষ্ঠায় মোঘল বশাসনযন্ত্রের আঞ্চলিক ও কেন্দ্রীয় গুরুত্বপূর্ণ পদসমূহে অধিষ্ঠিত যে কয়জন ব্যক্তির সহায়তা ছিল, তাদের প্রত্যেকেই ছিলেন শীয়া। যেমন বাংলার মীরজাফর, মহীশূরের বীর টিপুর প্রধানমন্ত্রী মীর সাদেক, লাক্ষৌর নবাব সুজাউদ্দৌলা ও দিল্লীর সর্বশেষ শীয়া মুসলিম আমীরুল উমারা নজফ আলী খা-(ওলামায়ে হিন্দকা শানদার মাযী পৃঃ ৭৮)