ত্বরীকায়ে মুহাম্মাদী সা. আন্দোলন
আমীর খান পিন্ডারীর বাহিনীতে যোগদানের পর প্রাথমিক পর্যায়ে কেউ তাঁকে চিনতো না, উন্নত ব্যক্তিত্ব এবং চারিত্রিক মাধুর্যের কারণে মাত্র কিছুদিনের মধ্যেই তিনি সকলের প্রিয় পাত্র হয়ে উঠলেন। তাঁর ব্যক্তিত্ব এবং বুদ্ধিমত্তার ফলে নবাব সাহেব তাকে খুব সম্মান করতেন। এমন কি প্রায় সব ব্যাপারেই সৈয়দ সাহেবের পরামর্শ গ্রহণ এবং তা বাস্তবায়ন করতেন। সেনাবাহিনীতে চাকুরী করার পরও সৈয়দ সাহেব সুযোগ পেলেই নফল নামাজ পড়তেন। আশে পাশে দাওয়াতী কাজ করার মত লোক না পেলে তিনি চাদর মুড়ি দিয়ে নিরিবিলি প্রভুর স্মরণে সময় অতিবাহিত করতেন। তিনি যখন কাপড় ধুতে যেতেন, বন্ধুদের ময়লা কাপড়ও ধোয়ার জন্য নিয়ে যেতেন। নবাব আমীর খান ইংরেজদের সাথে সন্ধি করতে চাইলে তাঁর মন্ত্রী পরিষদের প্রায় সকলেই ঐকমত্য প্রকাশ করলেন। কিন্তু সৈয়দ সাহেব এই সন্ধির প্রবল বিরোধিতা করলেন। তিনি বললেন, ইংরেজদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরুন, আল্লাহর সাহায্য আসবে, জয়লাভ করলে গাজী হবো, মরলে শহীদ হবো। কোন মসতেই তাদের সাথে সন্ধি করা ঠিক হবেনা। আর যদি আপনি ইংরেজদের ইংরেজদের সাথে সন্ধি করেন, তাহলে আমি আপনার সাথে থাকবোনা। সন্ধির পর নবাব সাহেবের বহু অনুরোধ সত্বেও সৈয়দ সাহেব তাঁর কয়েকজন সাথীসহ বাহিনী ত্যাগ করে জয়পুর চলে যান। কারণ যে ইংরেজ তাড়িয়ে ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে তিনি বাহিনীতে যোগদান করেছিলেন, সে উদ্দেশ্য যখন সাধিত হবার হবার শা আর নেই, তা হলে এখানে থেকে লাভ কি? অতঃপর দিল্লী গিয়ে শিক্ষাগুরু শাহ আবদুল আজীজ দেহলবীর সাথে সাক্ষাৎ করে পুরো পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করেন এবং নিজেই সংস্কারের উদ্দেশ্যে কাজ শুরু করার সংকল্প ব্যক্ত করেন। শাহ সাহেব দোয়া করলেন। এবার সৈয়দ আহমদ মুসলিম সমাজ থেকে কুসংস্কার বিদূরিত করার কাজ শুরু করেন এবং এ উদ্দেশ্যে ব্যাপক কর্মী সংগ্রহ অভিযান পরিচালনা করেন।
সৈয়দ সাহেব তৎকালীন রাজনৈতিক এবং সামাজিক অবস্থা ভালোভাবে বুঝতে পরেছিলেন, য ভয়াবহ পরিস্থিতির দিকে উপমহাদেশ অগ্রসর হচ্ছিল, সর্বশক্তি দিয়ে এর প্রতিরোধ না করলে এ ব্যাপারে তিনি কিছু উচ্চপদস্থ লোকজনের সাথে যোগাযোগ করেন। তৎকালীন উপমহাদেশে কাদেরিয়া, চিশতিয়া এবং নকশবন্দিয়া এই তিনটি বাইয়াত গ্রহণের ত্বরীকা প্রচলিত ছিল। সৈয়দ সাহেব এসব ত্বরীকা বাদ দিয়ে মুহাম্মদী ত্বরীকায় বাইয়াত গ্রহণ করাতেন। এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, মুহাম্মদ সা. হলেন সবচেয়ে বড় পীর। তাঁর উপর কোন পীর নেই। তাঁর ত্বরীকা বাদ দিয়ে অন্য কারুর ত্বরীকা শ্রেষ্ঠ হতে পারেনা।জীবনের প্রত্যেকটি কাজ আল্লাহর সন্তুষ্টি হাসিলের উদ্দেশ্যে মুহাম্মদ সা. এর ত্বরীকা বা পদ্ধতি অনুযায়ী সমাধা করা, যেমন শ্রম দেয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে নিজের ও পরিবারের ভরণ পোষণের জন্য হালাল উপার্জন, রাতে ঘুমানোর উদ্দেশ্য শেষ রাতে জেগে তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করা এবং ওয়াক্তের প্রথম দিকে ফরযের নামাজ আদায় করা, পানাহার করার উদ্দেশ্য হচ্ছে শরীর সুস্থ রেখে আল্লাহর আহকাম পালন করা, রোজা, নামাজ, হজ্জ আদায় করা এবং প্রয়োজন বোধে জিহাদ করার শক্তি সঞ্চয় করা। মোট কথা জীবনের প্রতিটি কাজকর্ম, কথা বার্তা, চলা ফেরা, আদান প্রদান, মুহাম্মদ সা. প্রদর্শিত পদ্ধতি বা ত্বরীকা অনুযায়ী শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে হতে হবে। কুসংস্কারাচ্ছন্ন মুসলিম সমাজকে হযরত মুহাম্মদ সা. এর মূল শিক্ষার দিকে ফিরে আসার আহবান জানাতেন বিধায় সৈয়দ সাহেবের নীতিসমূহ ত্বরীকায়ে মুহাম্মদী বা রসুল সা. এর মৌলবাদ হিসেবে ইতিহাসে খ্যাতি অর্জন করে। সৈয়দ আহমদ কর্তৃক গৃহীত নীতিসমূহের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনের নাম পড়ে গেল ত্বরীকায়ে মুহাম্মদী আন্দোলন।
সর্বপ্রথম সৈয়দ সাহেব উত্তর ভারতের রোহিলাদেরকে আন্দোলনের দাওয়াত দেন এবং তাদেরকে কর্মী হিসেবে গ্রহণ করেন। সেখান থেকে দিল্লী পৌছার কিছু দিন পর অর্থাৎ তাঁর সাংগঠনিক তৎপরতার প্রথম দিকেই কয়েকজন প্রখ্যাত ব্যক্তি এ আন্দোলনে শরীক হন এবং সৈয়দ আহমদের নিকট বাইয়াত গ্রহণ করেন। এঁদের মধ্যে সর্ব প্রথম আনুগত্য গ্রহণ করেন শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলবীর বড় ভাই শাহ আবদুল্লাহর পৌত্র মৌলবী ইউসুফ। তিনি জীবনের শেষদিন পর্যন্ত সৈয়দ সাহেবের বন্ধু এবং নির্ভরযোগ্য পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ করেন। তৎকালীন বিখ্যাত আলেম মাওলানা আবদুল হাই এবং মাওলানা শাহ ইসমাইল মৌলবী ইউসুফকে বলে দিলেন, আপনি প্রথমে সৈয়দ সাহেবের বাইয়াত গ্রহণ করুন।ফলাফল ভালো মনে করলে আমাদেরকে জানাবেন, আমরাও বাইয়াত গ্রহণ করবো। পরে মৌলবী ইউসুফের কাছ থেকে বিস্তারিত জেনে তাঁরা উভয়েই সৈয়দ সাহেবের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন এবং আজীবন তাঁর সাথী ছিলেন।এছাড়া মাওলানা শাহ মুহাম্মদ ইসহাক, মাওলানা শাহ মুহাম্মদ ইয়াকুবও প্রায় একই সময়ে সৈয়দ সাহেবের নিকট বাইয়াত গ্রহণ করেন। এঁরা প্রায় সকলেই শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলবীর বংশধর ছিলেন। শাহ দেহলবী র. ছিলেন তৎকালীন উপমহাদেশের বিশিষ্ট মুসলিম নেতা। সৈয়দ সাহেবের সাথে দেহলবী বংশের নেতৃস্থানীয় লোকদের যোগদানের ফলে উপমহাদেশের মুসলমানদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া পড়ে গেল। দেহলবী বংশের প্রভাব ও ব্যক্তিত্বের কারণে অসংখ্য মুসলমান সৈয়দ আহমদের ত্বরীকায়ে মুহাম্মদী আন্দোলনে যোগদান করেন। এতে করে ইসলামের একজন মহান শিক্ষক হিসেবে সৈয়দ আহমদ প্রসিদ্ধি লাভ করেন।
দাওয়াতে দ্বীন ও কর্মী সংগ্রহ অভিযান
১৮২০ খ্রিষ্টাব্দে সৈয়দ আহমদ মাওলানা ইসমাইল ও মাওলানা আবদুল হাইকে সাথে নিয়ে দিল্লী থেকে দাক্ষিণাত্যের নিযামের রাজ্য, পাটনা থেকে কোলকাতা ও বর্তমান বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত এবং বর্তমান পাকিস্তানের সীমান্ত হয়ে আফগানিস্তানের অভ্যন্তর ভাগ পর্যন্ত দাওয়াতে দ্বীন বা ইসলামী আন্দোলনের আহবান এবং ব্যাপক কর্মী সংগ্রহ অভিযান পরিচালনা করেন। এই দাওয়াতি অভিযানের প্রথমে তিনি বেনারসের সেলুন সফরে যান। সেখানে একজন প্রভাবশালী পীরের দরবারে নাচ গান সহ কিছু বেদয়াতী অনুষ্ঠান হতো। সৈয়দ সাহেব খবর পেয়ে উক্ত পীরের সাথে দেখা করেন এবং তাঁকে কুরআন হাদিসের দলীল দিয়ে বেদয়াতী কাজ বন্ধ করার পরামর্শ দিলে পীর সাহেব তা গ্রহণ করেন এবং তখন থেকে তাঁর দরবারে আর বেদয়াতী কোন অনুষ্ঠান হতোনা। উক্ত পীর সাহেবের নাম ছিল শাহ করীম আতা। সেলুন থেকে এলাহবাদ যাওয়ার পথে সৈয়দ সাহেব আহলাদগঞ্জ, মাঞ্জাপুর এবংয় কাড়া অঞ্চলে অবস্থান করেন। আহলাদগঞ্জের বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব কাজী মির্জা কাজেম বেগ সহ বহু লোক সৈয়দ সাহেবের বাইয়াত গ্রহণ করেন। এলাহবাদে অনেক মুসলমান বাইয়াত গ্রহণ করেন। এদের মধ্যে শায়খ গোলাম আলীর নাম বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য।
এরপর সৈয়দ সাহেব বেনারস সদরে পৌঁছেন। স্থানীয় শাহী মসজিদ বহুদিন ধরে অনাবাদী থাকায় সৈয়দ সাহেব তাঁর সাথীদের নিয়ে সেখানেই উঠেন এবং ধুলাবালি পরিষ্কার করে নতুনভাবে মসজিদটি আবাদ করেন। বেনারসে মাসাধিককাল অবস্থানের সময় ১০/১৫ হাজার লোক সৈয়দ সাহেবের নিকট বাইয়াত গ্রহণ করেন। এ অঞ্চলে মুসলমানদের মধ্যে অনেক কুসংস্কার প্রচলিত ছিল। যেমন স্থানীয় পীর সাহেবকে ছয়মাস অন্তর চাঁদা দিলে নামাজ রোজা না করার সার্টিফিকেট দেয়া। সৈয়দ সাহেবের আগমনে এসব কুসংস্কার বন্ধ হলো এবংয় মুসলমানগণ প্রকৃত দ্বীনের অনুসারী হলো। সৈয়দ সাহেবের এই বেনারস সফরের সময় বিখ্যাত তৈমুর বংশের কয়েকজন শাহজাদাও তাঁর বাইয়াত গ্রহণ করেন। বেনারস থেকে বিভিন্ন স্থান হয়ে সৈয়দ সাহেব সুলতান পুরের গোলাম হোসেন খানের সৈন্য শিবিরে উপস্থিত হন। লক্ষ্নৗ সরকারের পক্ষে গোলাম হোসেন সুলতান পুরের হাকিম ছিলেন। সৈয়দ সাহেবের আগমনে বহু সৈন্য তাঁর নিকট বাইয়াত গ্রহণ করে। সৈয়দ সাহেবের কানপুর সফরের সময় আল্লাবখশ্ খান, শমসির খান, মেহেরবান খান এবং রমজান খান নামক চারজন প্রতিষ্ঠিত যুবক তার নিকট বাইয়াত গ্রহণ করেন। সৈয়দ সাহেবের অপরাপর সাথীদের মতো এই চারজন ও তার সাথে রওয়ানা হলেন এবং জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সৈয়দ সাহেবের সাথেই ছিলেন। এই চারজনের একজন মেহেরবান খান ১১৭৪ হিজরিতে মারা যান। বাকী তিনজন বালাকোটের জিহাদে শহীদ হন। কানপুর থেকে সৈয়দ সাহেব ঘানঝাউ জাহানাবাদ এবং ফতেহপুর হয়ে দালমু পৌঁছান। দালমুতে সৈয়দ সাহেবের এক অনুসারী মাওলানা মাযহার আলী শিয়াদের তাজিয়া মিছিলের বিরুদ্ধে বক্তৃতা করায় স্থানীয় কর্তৃপক্ষ মাওলানাকে গ্রেফতার করে। পরে মাওলানা জামিনে মুক্তি পেয়ে এলাকা ছেড়ে চলে যান। এ খবর পেয়ে সৈয়দ সাহেব খুব অসন্তুষ্ট হন।মাওলানা মাযহার আলীকে ডেকে পাঠান এবং বললেন, আপনার বাইয়াত ভেঙ্গে গেছে, বার বাইয়াত গ্রহণ করুন এবং নিজের এলাকায় চলে যান।কোন বিপদ এলে মাথা পেতে নিবেন।সৈয়দ সাহেব তার শিষ্টদিগকে এ ধরনের শিক্ষাই দিতেন। জীবন বাজী রেখে আল্লাহর দ্বীন বাস্তবায়নের আন্দোলন করেই যেতে হবে। ১৮০ জন সাথী নিয়ে সৈয়দ আহমদ অতঃপর লক্ষ্নৌ রওয়ানা হলেন। এখানকার কান্দাহারী সেনা ছাউনীতে তাঁর ভাগনে আবদুর রহমান চাকুরী করতেন। মামার আগমনের অপেক্ষায় তিনি সেখানে ছোলা ভাজ, গুড়, লবণ, মরিচ ইত্যাদি সংগ্রহ করে রেখে দিলেন। দুপুরে সৈয়দ সাহেব তাঁর সঙ্গী সাথী সহ সেনা ছাউনিতে পৌঁছে একমুঠো ছোলা খেয়ে পানি পান করে বিশ্রাম নিলেন। জোহরের নামাজের পর থেকে লোক সমাগম শুরু হলো, আগত লোকদের প্রায় সকলেই সৈয়দ সাহেবের নিকট বাইয়াত গ্রহণ করেন। লক্ষ্নৌতে সৈয়দ সাহেব দুমাস অবস্থান করেন, প্রতি জুমার নামাজের পর তাঁর বিশিষ্ট সহচর মাওলানা আবদুল হাই উপস্থিত জনতার সম্মুখে ইকামতে দ্বীনের আন্দোলন সম্পর্কে ওয়াজ করতেন। এই সফরে যে সব লোক বাইয়াত গ্রহণ করেন, তাঁদের মধ্যে মাওলানা আশ্রাফ আলী, মাওলানা ইমাম উদ্দীন বাঙ্গালী, মৌলবী সৈয়দ মাখদুম, মৌলবী বাসতে, আবুল হাসান নাসিরাবাদী, আবদুল্লাহ ফেরেঙ্গী, শাহ ইয়াকিনুল্লাহ লাখনবী, হাফেজ আবদুল ওয়াহেদ প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
লক্ষ্ণৌ সফরের সময় বহু শিয়া মুসলমান নিজেদের সকল প্রকার বেদয়াতী অনুষ্ঠান বর্জন করে সৈয়দ সাহেবের নিকট খাটি মুসলমান হিসেবে বাইয়াত গ্রহণ করেন। কিন্তু স্থানীয় শিয়া নেতৃবৃন্দ এতে ভীত হয়ে সরাসরি সৈয়দ সাহেবের নিকট লোক মারফত খবর পাঠালেন, যেন কোন শিয়াকে বাইয়াত করানো না হয়। উত্তরে সৈয়দ সাহেব বললেন আমি সৎ কাজের আদেশ এবং অসৎ কাজের নিষেধ থেকে বিরত হতে পারি না। কাউকে আমি জোর জবরদস্তি উপদেশ দান করি না। যে আমার নিকট আসবে তাকে আমি অবশ্যই সত্যের বাণী শুনাবো।শেষ পর্যন্ত স্থানীয় জনৈক কর্তা ব্যক্তি হুমকি দিলেন, যদি সৈয়দ আহমদ তাঁর কাজ থেকে বিরত না হয়, তাহলে তাঁর আস্তানা ধ্বংস করার জন্য দু চারটি তোপই যথেষ্ট। সৈয়দ সাহেব উত্তর পাঠালেন, আমি বিশ্বাস করি, আল্লাহ ব্যতীত কেউ আমার কোন ক্ষতি করতে পারবেনা। সত্যের প্রচার থেকে বিরত হওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। হাজার তোপকে আমি ভয় করিনা। আল্লাহ আমার সহায়।
সৈয়দ সাহেবের দৃঢ়তা দেখে কর্তৃপক্ষ নরম হয়ে গেল। এমনিভাবে সৈয়দ সাহেব ব্যাপক হারে দাওয়াতে দ্বীন ও কর্মী সংগ্রহের কাজ চালিয়ে যেতে লাগলেন।সৈয়দ সাহেব দ্বীনের দাওয়াত বা ইসলামী আন্দোলনের আহবান নিয়ে যখন কোলকাতায় এলেন, এখানকার প্রায় সব মুসলমানই তাঁর আন্দোলনে যোগদান করেন। এছাড়া তৎকালীন বাংলাদেশের চব্বিশ পরগনাসহ সমগ্র উত্তরবঙ্গ, সিলেট, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, যশোর, ফরিদপুর, নদীয়া, মুর্শিদাবাদ প্রভৃতি জেলা থেকে অসংখ্য মুসলমান কোলকাতা গিয়ে আন্দোলনের তালিকায় নিজেদের নাম অন্তর্ভুক্ত করান।
লক্ষ্ণৌ সফরের সময় যে সমস্ত বিখ্যাত ব্যক্তি সৈয়দ সাহেবের নিকট বাইয়াত গ্রহণ করেন, তাঁদের তালিকায় মাওলানা ঈমাম উদ্দীন বাঙ্গালীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশের নোয়াখালী জেলার অধিবাসী ছিলেন তিনি। সৈয়দ সাহেবের খুবই অনুরক্ত ছিলেন। বাইয়াত গ্রহণের পর থেকে জীবনের শেষ পর্যন্ত সৈয়দ সাহেবের সাথী ছিলেন। সৈয়দ সাহেবের হজ্জ গমন উপলক্ষে মাওলানা ঈমাম উদ্দীন বাঙ্গালী নোয়াখালী সফর করেন এবং প্রায় ত্রিশ চল্লিশ জন নোয়াখালী-বাসীকে সাথে করে নিয়ে আসেন। পরবর্তী সময়ে এরা সকলেই সৈয়দ সাহেবের নিকট বাইয়াত গ্রহণ করেন এবং ত্বরীকায়ে মুহাম্মদী আন্দোলনের কর্মী হেসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া বাংলার এক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি মুন্সী আমিন উদ্দীন আহমদ সৈয়দ সাহেবের হজ্জে যাওয়ার সময় বাইয়াত গ্রহণ করেন এবং জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তাঁর সাথী ছিলেন। মৌলবী ওয়ারেস আলী বাঙ্গালী নামের আর একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব প্রথমদিকে আন্দোলনের প্রাথমিক সদস্য হিসেবে নাম লিখালেন। কিছুদিন কাজ করার পর সঠিক অর্থে আন্দোলন বুঝতে পেরে নিজের ভাগ্যকে আন্দোলনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ফেললেন এবং সৈয়দ সাহেবের হিজরতের সময় তিনিও নিজের জন্মভূমি এই সুজলা সুফলা বাংলাদেশ ত্যাগ করে সীমান্তের পাহাড়িয়া এলাকার পাঞ্জাতারে বসতি স্থাপন করেন। এই আন্দোলনের নেতৃস্থানীয়দের মধ্যে আরেকজন বাংলাভাষী মুসলমানের নাম পাওয়া যায়। তিনি হচ্ছেন শেখ বুরহানুদ্দীন বাঙ্গালী। ইনিও জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সৈয়দ সাহেবের সাথী ছিলেন।
হজ্জে যাওয়ার সময় সৈয়দ সাহেব বহু স্থান সফর করেন এবং দাওয়াতের কাজ চালাতে থাকেন। সৈয়দ সাহেবের এই সফরের সময় কোলকাতায় অবস্থানরত টিপু সুলতানের পুত্রগণ এবং তাদের স্ত্রীগণ তাঁর নিকট বাইয়াত গ্রহণ করেন। বার্মার জনৈক ব্যবসায়ী প্রায়ই বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে কোলকাতা সফর করতেন। সৈয়দ সাহেবের কোলকাতা অবস্থানের সময় সৈয়দ হামযা নামক উক্ত স্বর্ণ ব্যবসায়ী বাইয়াত গ্রহণ করেন।সাধারণত বার্মার লোকদের দাড়ি খুব কম হয়, কিন্তু সৈয়দ হামযার দাঁড়ি ছিল সম্পূর্ণ গাল ভরা এবং দীর্ঘ। তাই বার্মার শাসক গোষ্ঠীর নিকট তিনি খুব সম্মানিত ব্যক্তি ছিলেন।সৈয়দ হামযা দেশে ফিরে মুসলমান জনসাধারণ এবংয় প্রশাসনের বিভিন্ন মুসলিম কর্মকর্তার নিকট আন্দোলনের দাওয়াত দিলে বহু লোক তা গ্রহণ করেন। এভাবে ত্বরীকায়ে মুহাম্মদী আন্দোলনের দাওয়াত বার্মায়ও প্রসার লাভ করে। ১২২৪ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যেই উপমহাদেশের সর্বত্র এ আন্দোলন সম্প্রসারিত হয়ে পড়ে। সৈয়দ আহমদ এ বিস্তৃত ভূখণ্ডে সর্বস্তরের মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষার মূর্ত প্রতীক হিসেবে আবির্ভূত হন।
হজ্জের উদ্দেশ্য এবং সফরের সাংগঠনিক কাঠামো
অর্থ সামর্থ্যের দিক থেকে সৈয়দ সাহেবের উপর হজ্জ ফরজ ছিলনা। তারপরও প্রধানত: দুটি উদ্দেশ্যে তিনি হজ্জ করার নিয়ত করেন। প্রথমত: ইংরেজদের বিরুদ্ধে জিহাদ শুরু করার পূর্বে ইসলামের কেন্দ্র ভূমি এবং খোদার ঘর জিয়ারত করাকে জরুরী মনে করেছিলেন। দ্বিতীয়ত: উপমহাদেশে সে সময়ে হজ্জে যাওয়ার ব্যাপারে একটা ভুল ধারণা প্রচলিত ছিল যে হজ্জে যাওয়া বিপদজনক এবং জীবনের নিরাপত্তা নেই, অতএব উপমহাদেশের কোন লোকের হজ্জে যাওয়া ফরজ নয়। এই ভুল ধারণা দূর করে উপমহাদেশে হজ্জের উপযুক্ত ব্যক্তিদেরকে উৎসাহ প্রদান করার জন্যই সৈয়দ আহমদ বহু প্রচার প্রোপাগান্ডা করে হজ্জে গমন করেন। তাঁর উভয় উদ্দেশ্যই সার্থক হয়েছিল। ইসলামের কেন্দ্র ভূমি পবিত্র মক্কা এবং ইসলামী আন্দোলনের নেতা হযরত মুহাম্মদ সা. এর রওজা মোবারক পবিত্র মদিনা জেয়ারত করা হলো। হজ্জের উদ্দেশ্যে সৈয়দ সাহেবের রওয়ানা হওয়ার কথা শুনে হজ্জের উপযুক্ত বহু লোক উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে তর সফরসঙ্গী হয়েছিল। দীর্ঘদিন থেকে বন্ধ থাকা ইসলামের একটা মৌলিক ফরজ পুনরায় চালু হলো। ১৮২১ খ্রিষ্টাব্দের ৩০শে জুলাই সৈয়দ সাহেব নিজ পরিবার, পরিজন, ভক্ত, আন্দোলনের কর্মী এবং হজ্জের উপযুক্ত ব্যক্তি বর্গসহ প্রাথমিকভাবে প্রায় সম্বলহীন অবস্থায় চারশত লোক নিয়ে হজ্জের উদ্দেশ্যে রায়বেরেলী ত্যাগ করেন। রওয়ানা হওয়ার পূর্বে উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থানের বহু লোককে সৈয়দ সাহেব হজ্জে যাওয়ার জন্য দাওয়াত করেন। এতে যথেষ্ট সাড়া পাওয়া যায়। কাফেলা রায়বেরেলী থেকে দালমুর, ধাই ধমধমা, ডুগডুগী, গাতনা, জাহানাবাদ হয়ে এলাহাবাদ পৌঁছে। এই সময় কাফেলার লোকসংখ্যা চারশত থেকে সাড়ে সাতশত হয়ে যায়।এখান থেকে হুগলী হয়ে ১৮২১ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বর মাসে কাফেলা কোলকাতা পৌঁছে এখানে প্রায় তিন মাস কাল কাফেলা অবস্থান করে। হজ্জে রওয়ানা হওয়ার জন্য কোলকাতা থেকে ১০ টি জাহাজ ভাড়া করা হয়। প্রত্যেক জাহাজের জন্য একজন আমীর, একজন কাপ্তান মনোনীত করা হয়। এছাড়া জাহাজের ধারণ ক্ষমতা অনুযায়ী লোক বণ্টন করে দেয়া হলো।
দরিয়া বাকা জাহাজে ১৫০ জন যাত্রীর আমীর ছিলেন সৈয়দ আহমদ নিজে। সৈয়দ আবদুর রহমানকে কাপ্তান নিযুক্ত করা হলো এই জাহাজের। ফত্হুলবারী জাহাজের যাত্রী ছিল ৭০ জন, মৌলবী আবদুল হক ছিলেন আমীর আর কাপ্তান হলেন আবদুল্লাহ কেজাজ আরব। আতিয়াতুর রহমান নামক জাহাজে কাজী আহমদ উল্লাহ মিরাঠি ও মুহাম্মদ হুসেন তুরককে যথাক্রমে আমীর এবং কাপ্তান নিযুক্ত করা হয়। এই জাহাজে মোট যাত্রী সংখ্যা ৬৭ জন। মৌলবী ওয়াহেদ উদ্দীনের নেতৃত্বে ৫০ জন যাত্রী সহ গোরাবে আহমদী জাহাজের কাপ্তান ছিলেন আহমদ তুরক। আতিয়াতুর রহমান এবং গোরাবায়ে আহমদী এই দুটি জাহাজ ১১টি কামানে সজ্জিত চিল। ফাতহুল করীম জাহাজের কাপ্তান হলেন মুহাম্মদ হোসেন মাশকাতী। এখানে ৭৬ জন যাত্রী নেতা ছিলেন মিয়া দীন মুহাম্মদ। ১৭৫ জন যাত্রীসহ ফয়েজে রাব্বানী জাহাজের আমীর ছিলেন শাহ ইসমাইল। ফয়েজুল করীম জাহাজের ৫০ জন যাত্রীর আমীর কাজী আবদুস সাত্তার। পীর মুহাম্মদ রায়বেরেলী আব্বাসী জাহাজের ৩০জন যাত্রীর নেতা ছিলেন। তাজ জাহাজের ৬৫ জন যাত্রীর আমীর ছিলেন কাদের শাহ হারইয়ানবী। তাফহুর রহমান জাহাজের আমীর ছিলেন মুহাম্মাদ ইউসুফ কাশ্মীরী। এতে যাত্রী সংখ্যা ছিল ২০ জন। শেষের পাঁচটি জাহাজের কাপ্তানদের নাম জানা যায়নি। আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের মধ্যে সৈয়দ আবদুর রহমান, মাওলানা আবদুল হাই, শায়খ আবদুল্লাহ প্রমুখ সৈয়দ সাহেবের জাহাজে তাঁর সহযোগী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সফরের সময় প্রত্যেক জাহাজে প্রতিদিনের কর্মসূচী ছিল বাদ ফজর দোয়ায়ে হিজবুল বাহার পাঠ, সূরা যখরুখের প্রথম রুকু তেলাওয়াত, প্রশ্নোত্তরে মাসলা মাসায়েল শিক্ষার আসর, বিশ্রাম, জোহরের নামাজ, রান্না বান্না, আছরের নামাজ, ঈমান সম্পর্কে আলোচনা, মাগরিবের নামাজ, সাধারণ আলোচনা, এশার নামাজ, বিশ্রাম। এমনিভাবে বিভিন্ন স্থান হয়ে মক্কা শরীফে হজ্জ আদায় এবং মদিনা শরীফ জিয়ারত করে দুই বছর দশমাস পর ১৮২৪ খৃষ্টাব্দের নভেম্বর মাসে সৈয়দ সাহেব পুনরায় রায়াবেরেলীতে পৌঁছেন।
সংগঠনের মূলনীতি
সৈয়দ আহমদের প্রতিষ্ঠিত ত্বরীকায়ে মুহাম্মদী আন্দোলনের মূলনীতি সম্পর্কে উইলিয়াম হান্টার তাঁর দি ইন্ডিয়ান মুসলমানস গ্রন্থে উল্লেখ করেন, তাঁর একমাত্র শিক্ষা হলো, আল্লাহর বন্দেগী করা এবং একমাত্র আল্লাহরই সন্তুষ্টি ভিক্ষা করা, যেখানে কোন মানবীয় আচার বা অনুষ্ঠানের মধ্যবর্তীতা একেবারেই নেই, অর্থাৎ ফেরেশতা, জ্বীন, পরী, পীর, মুরিদ, আলেম, সাগরেদ, রসূল বা ওলী, মানুষের দুঃখ দুর্দশা দূর করার ক্ষমতা কারোরই নেই। এ ধ্রুবসত্য বিশ্বাস কারা আর উপরোক্ত কোন সৃষ্ট জীব থেকে নিজের ইচ্ছা বা আশা আকাংখা পূরণের জন্য যে কোন রকম কার্য করণ থেকে বিরত থাকা, কারুর প্রতি অনুগ্রহ করার বা বিপদ ত্রাণ করার ক্ষমতায় বিশ্বাস না করা, স্বার্থসিদ্ধির আশায় কোন পয়গাম্বর, ওলী, দরবেশ বা ফেরেশতার উদ্দেশ্যে কিছু দান না করা, একমাত্র আল্লাহর শক্তির নিকট নিজেকে অসহায় বিবেচনা করা।
সৈয়দ সাহেবের আন্দোলনের দ্বিতীয় মূলনীতি সম্পর্কে উইলিয়াম হান্টার বলেন, সত্য ও অবিকৃত ধর্ম হচ্ছে প্রাত্যহিক জীবনে কেবল সেই সব এবাদত প্রার্থনা করা ও আচার নীতিগুলো আঁকড়ে ধরা যা রসুলুল্লাহর সা. জীবনে প্রতিফলিত হয়েছে।বিয়ে শাদীতে বেদয়াতী উৎসব মৃত্যুতে শোক উৎসব, মাজার সজ্জিতকরন কিংবা কবরের উপর বড় বড় সৌধ নির্মাণ, পথে পথে মাতম শোভা যাত্রা ইত্যাদি পরিহার করা। সমাজে চালু অথচ শরীয়তের দৃষ্টিতে কুসংস্কারাচ্ছন্ন অনুষ্ঠানাদি যথাসাধ্য বন্ধ করে দেয়া, মোট কথা যে কোন নামেই হোক, শিরক থেকে দূরে থাকতে হবে এবং যাবতীয় বিদয়াতকে বর্জন করতে হবে। যেহেতু মহিলাদের কোলে জাতির ভবিষ্যৎ বংশধর লালিত পালিত হয় এবং মহিলাদের কাছ থেকেই শিশুরা প্রাথমিক জ্ঞান অর্জন করে থাকে, যেহেতু বিশেষভাবে মহিলাদেরকে সর্বক্ষণ শিরক থেকে পবিত্র রাখার জন্য কর্মীদের প্রতি সৈয়দ সাহেবের কঠোর নির্দেশ ছিল। কারণ মহিলাদের মন খুব নরম। অল্পতেই তারা শিরক এর প্রতি ঝুঁকে যেতে পারে। যাদের উপর জাতির ভবিষ্যৎ নির্ভরশীল, সেই মহিলা সম্প্রদায়কে সঠিক ইসলাম এবং সততা শিক্ষা দেয়ার প্রতি সৈয়দ সাহেব অত্যন্ত গুরুত্ব আরোপ করেন। মৌলিকভাবে উপরোল্লিখিত এই দুটি মূলনীতিকে ভিত্তি কের সৈয়দ সাহেব তাঁর আন্দোলনকে সম্প্রসারিত করেন।
সংগঠন: প্রশিক্ষণ: ক্যাডার তৈরী
উপমহাদেশে আন্দোলনের গভীরতা, ময়দানে কর্মীদের চরিত্র ও মনোবল এবং সংগঠনের ব্যাপকতা ও মজবুতি সম্পর্কে ধারণা নেয়ার জন্য সৈয়দ আহমদ একবার সারা উপমহাদেশে প্রায় বছরাধিককাল ধরে এক জরীপ সফর সম্পন্ন করেন। এই জরীপ সফরের পরপরই তিনি কোন পার্থিব বিশেষ ধন সম্পদ এবং উপকরণ ব্যতিরেকেই শুধুমাত্র দ্বীনের দাওয়াত, ঈমানী চেতনা, ইসলামী পুনর্জাগরণ আন্দোলন এবং জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহর বলিষ্ঠ প্রত্যয়কে সম্বল করে ময়দানে নেমে পড়েন। কর্মী ও সহযোগীদের সংখ্যা ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাওয়ায় আন্দোলনের সুষ্ঠু পরিচালনার জন্য সৈয়দ সাহেব পুরো উপমহাদেশকে কয়েকটি অঞ্চলে ভাগ করেন। পাটনায় আন্দোলনের কেন্দ্র স্থাপিত হয়। নিজের কয়েকজন ঘনিষ্ঠ সহচরকে তিনি আঞ্চলিক প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব প্রদান করেন। নিজে পাটনায় থেকেই আঞ্চলিক প্রতিনিধিদের মাধ্যমে সারা উপমহাদেশে আন্দোলন পরিচালনা করেন। বাংলাদেশ অঞ্চলের প্রতিনিধি ছিলেন মাওলানা বেলায়েত আলী।
ব্যাপক দাওয়াতী অভিযানের ফলে উপমহাদেশের বিস্তৃত অঞ্চলে ত্বরীকায়ে মুহাম্মদী আন্দোলনের শিকড় মাটির গবীরে সুদূর প্রসারী ভাবে বিস্তার লাভ করে। পুরো উপমহাদেশকে আঞ্চলিক প্রতিনিধিদের মধ্যে সাংগঠনিক প্রক্রিয়ায় বণ্টন করে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে সৈয়দ আহমদ একটা ছায়া সরকার গঠন করেন। কঠিন এবং বলিষ্ঠ সাংগঠনিক শৃঙ্খলার কারণে ৪০ বছর পরেও বৃটিশ সরকার এই ছায়া সরকার সম্পর্কে জানতে পারেননি। আদর্শের চাহিদা ও মেজাজ অনুযায়ী কর্মী গঠন করা ছিল এ আন্দোলনের এক বিশেষ কাজ। সৈয়দ সাহেব ক্যাডার ভিত্তিক আন্দোলনে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি প্রায় সবসময়ই বলতেন, আন্দোলনের মেজাজ অনুযায়ী কর্মী তৈরী না হলে সফলতা সম্ভব নয়। সংগঠনের জেলা সদর দপ্তরগুলোতে সাধারণ বাইয়াত গ্রহণকারীদেরকে প্রশিক্ষণের পরন কর্মী বাছাই করা হতো। এরপর কর্মীদের মধ্যে চলতো প্রশিক্ষণ। তুলনামুলকভাবে অগ্রসর কর্মীদের উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য এখান থেকে পাটনার কেন্দ্রীয় দপ্তরে পাঠানো হতো। কেন্দ্রীয় দপ্তরের প্রশিক্ষণ একটু দীর্ঘ সময়ের জন্য হতো।এখান থেকে অপেক্ষাকৃত নির্ভরযোগ্য ব্যক্তিদেরকে আরো দীর্ঘ প্রশিক্ষণের পর নিজ নিজ অঞ্চলে আন্দোলনের প্রতিনিধি হিসেবে প্রেরণ করা হতো। সৈয়দ সাহেব সরাসরি আঞ্চলিক প্রতিনিধিদের প্রতি লক্ষ্য রাখতেন এবং তাদেরকে পরিচালনা করতেন। সাংগঠনিক ব্যবস্থা পর্যালোচনা করলেন দেখা যায় যে, সাধারণ মুসলমান থেকে যারা বাইয়াত গ্রহণ করেছেন, তাঁরা আন্দোলনের সমর্থক। পরের স্তর হচ্ছে অগ্রসর কর্মী এরপর মুজাহিদ। অগ্রসর মুজাহিদদিগকে বিভিন্ন অঞ্চলে র এবং বিভিন্ন বিভাগের দায়িত্বশীল নিযুক্ত করা হতো।
ব্যাপকভাবে দাওয়াত প্রদান, কর্মী গঠন, আন্দোলনের দৃষ্টিভঙ্গি প্রচার এবং সাংগঠনিক মজবুতির জন্য সংগঠনের পক্ষ থেকে প্রচুর ইসলামী সাহিত্য প্রকাশ করা হয়েছে। এই সাহিত্যবন্যা ত্বরীকায়ে মুহাম্মদী আন্দোলনকে বহুগুণে অগ্রসর করে দিয়েছে। অসংখ্য ইসলামী সাহিত্যে মধ্যে সীরাতুল মুস্তাকীম, কাসিদা, সির ই ওয়াকেয়া, তাওয়ারিখ কায়সার রুম, আছার মাহ্শার, হেদায়েতুল মুসলেমিন, তানবীরুল আইনাইন, তাকবিয়াতুল ঈমান, তাযকীরুল আখাওয়াই, নাসীহাতুল মুসলেমীন, তামবীহুল গাফেলীন ইত্যাদি গ্রন্থ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও প্রচুর কবিতা, গান গজল, রচনা করে প্রচার করা হতো। সাধারণ মুসলমানদের মধ্যে এইসব কবিতা, গান ও গজল ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। এখানে উল্লেখযোগ্য যে সিরাতুল মুস্তাকীম নামক গ্রন্থখানি সৈয়দ সাহেব নিজেই রচনা করেন। দিল্লী থাকাকালীন সময়ে তিনি এই গ্রন্থ রচনার কাজ শুরু করেছিলেন। এব্যাপারে শাহ ইসমাইল ও মাওলানা আবদুল হাই তাঁকে সহযোগিতা করেন। সৈয়দ সাহেব ডিকটেট করতেন পালাক্রমে শাহ সাহেব ও মাওলানা সাহেব ডিকটেশান অনুযায়ী লিখে পুরায় সৈয়দ সাহেবকে পড়ে শুনিতেন। মনপুত না হলে আবার বলতেন। কখনো কখনো একটি বিষয়কে কয়েকবার লিখতে হয়েছে।
জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহর ধারণা
জিহাদ শব্দটি আরবী জুহদ শব্দ থেকে উৎপন্ন। এর অর্থ মেহনত বা পরিশ্রম করা এবং কোন কাজ করার উদ্দেশ্যে যে কোন প্রতিবন্ধকতাকে ডিঙ্গিয়ে সর্বান্তকরণে অগ্রসর হওয়া। শরীয়ত মতে জিহাদের অর্থ শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য নিজের সমস্ত শক্তি সামর্থ্য সহকারে প্রকাশ্যে এবং গোপনে চেষ্টা করা। প্রকাশ্যে অর্থ শত্রুপক্ষ আক্রমণ করলে উন্মুক্ত অস্ত্র হাতে তাদের প্রতিহত করা, যতক্ষণ পর্যন্ত নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত না হয় এবং শত্রুপক্ষ পরাজয় বরণ না করে, ততক্ষণ পর্যন্ত প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা।প্রয়োজনে জীবন দিতেও নির্দ্বিধায় প্রস্তুত থাকা। গোপনে অর্থ শয়তানের যাবতীয় চক্রান্ত থেকে নিজেকে মুক্ত রাখা, অর্থাৎ সত্যের পথে নিজে একা বা সম্মিলিতভাবে যে প্রচেষ্টা চালানো হয়, সত্যের পতাকা উড্ডীন রাখার জন্য যেসব জীবন উৎসর্গ করা হয়, এগুলো সবই জিহাদ। অসত্যের অন্ধকারে যারা সত্যের আওয়াজ বুলন্দ করে, শত্রুর বন্দীখানায় কষ্ট সহ্য করে, ইসলামী আন্দোলনের পথে নিজেদের সম্পদ ব্যয় করে, গুলী বিদ্ধ হয়, ফাঁসীতে ঝুলে, বাড়ী ঘর ত্যাগ করে, আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধব থেকে চিরদিনের জন্যে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, তারাই মুজাহিদ।সকল মুসলমানের অন্তরে এই উৎসাহ এবং উদ্দীপনাই সৈয়দ সাহেব সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন। কালেমা তাইয়েবা পাঠকারী প্রত্যেক মুসলমানকেই তিনি আল্লাহর পথে মুজাহিদ হিসেবে তৈরী করার বাসনা নিয়ে সারা জীবন কাজ করেছে। তাঁর নেতৃত্বে গড়ে ওঠা ত্বরীকায়ে মুহাম্মদী আন্দোলনের প্রতিটি কর্মীর মধ্যে একটা বৈশিষ্ট্য এই ছিল যে, তারা নিজেকে এবং নিজের সম্পদকে দ্বীনি আন্দোলনের পথে উৎসর্গ করাকে জীবনের চরম এবং পরম সৌভাগ্য বলে মনে করতেন, আর যখনই কোন মুজাহিদ শাহাদত বরণ করতেন, তখনই বলা হতো, তিনি তাঁর গন্তব্যস্থলে পৌঁছে গেছেন। সে যুগে একমাত্র সৈয়দ সাহেব ও তাঁর অনুসারীরা এমন উদাহরণ সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন। তখন কোন কোন আলেম ফতওয়া দিয়েছিলেন, জিহাদ ফরজে কেফায়া। কিছু সংখ্যক মুসলমান জিহাদে অংশ গ্রহণ করলেই সমস্ত মুসলমানের পক্ষ থেকে ফরজ আদায় হয়ে যায়। অতএব, জিহাদে সকলের অংশ গ্রহণের প্রয়োজন নেই। কেফায়া শব্দটির অর্থ যথেষ্ট হওয়া আ যথার্থ হওয়া। অর্থাৎ শত্রুপক্ষের মোকাবিলায় মুসলমান সৈন্য বা মুজাহিদদের সংখ্যা যথেষ্ট হওয়া এবং জিহাদ করার স্থান কাল যথার্থ হওয়া। স্থান কাল না বুঝে শুধুমাত্র কিছু সংখ্যক মুসলমান জিহাদের অংশ গ্রহণ করলেই সব দায়িত্ব শেষ কেফায়ার অর্থ এটা নয়।এছাড়া যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় ইসলাম তার মর্যাদা সহ প্রতিষ্ঠিত নেই, এই অবস্থায় ফরজে কেফায়ার আপত্তি কোন কাজে লাগে? এখানে জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ ফরজে আইনের স্থানে অবস্থান করছে।