আন্দোলনের পুনরুজ্জীবন
সৈয়দ আহমদ ব্রেলভীর শাহাদাতের পর নেতৃত্বের অভাবে দীর্ঘদিন পর্যন্ত তাঁর প্রতিষ্ঠিত ত্বরীকায় মুহাম্মদী আন্দোলন মুমূর্ষু অবস্থায় ছিল। কিন্তু আন্দোলনের সাংগঠনিক কাঠামো মজবুত থাকার কারণে ধীরে ধীরে আবার সংগঠন গা ঝাড়া দিয়ে উঠে। বাংলাদেশ অঞ্চলের দায়িত্বশীল মাওলানা বেলায়েত আলী এবং পাটনার দায়িত্বশীল মাওলানা এনায়েত আলী যৌথ প্রচেষ্টায় ত্বরীকায়ে মুহাম্মদী আন্দোলন পুনরায় জীবন ফিরে পায়। ইসলামী আন্দোলনের পতাকা আবার মুক্ত বাতাসে পত পত করে উড়তে থাকে। মাওলানাদ্বয় সম্পর্কের দিক থেকে আপন ভাই ছিলেন। তাদের জ্বালাময়ী বক্তৃতা মুসলিম যুবক বিশেষ করে বাংলাদেশের মুসলমান যুবকদেরকে পাগল করে তুলেছিল। তখনকার বাংলাদেশের মুসলমান পরিবারগুলোতে এমন কোন সমর্থ যুবক ছিল না, যারা সীমান্তের জেহাদি বসতিতে গিয়ে প্রশিক্ষণ গ্র্হণ করেনি। ব্যাপক সফরের মাধ্যমে এই আলী ভাতৃদ্বয় উপমহাদেশের সর্বত্র সংগঠনকে পুনর্গঠিত করেন এবং পুনরায় ব্রিটিশ শক্তির বিরুদ্ধে জিহাদ করার জন্য মুজাহিদ সংগ্রহ শুরু করেন। আবার দলে দলে সীমান্তের দিকে মুজাহিদদের যাত্রা শুরু হলো। সাংগঠনিক পদ্ধতিতে লোক সংগ্রহ, প্রশিক্ষণ, দ্বীনি তালিম, জিহাদে উদ্বুদ্ধকরণ, লোক বাছাই, নেতৃত্বে সৃষ্টি, অর্থ সংগ্রহ ইত্যাদি কর্মসূচী বাস্তবায়িত হতে লাগলো। আন্দোলনের তৎপরতা নতুন করে শুরু হবার সংবাদ পেয়ে ব্রিটিশ সরকার সংগঠনের বিরুদ্ধে পুলিশি তৎপরতা বৃদ্ধি করে। বিভিন্ন এলাকার দায়িত্বশীলদের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার দায়ে মামলা রুজু করে। অনেকেরে বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারী হয়। বহু মুজাহিদ এবং কর্মীকে গ্রেফতার করে জেলে পুরে দেয়। সমাজের সর্বস্তরের মুসলমানগণ নামাজের জামায়াতের মত সমস্ত ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে জিহাদি আন্দোলনে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ইসলাম বিরোধী শক্তির মোকাবিলা করেছে। ষড়যন্ত্র মামলায় বাঙ্গালী বিহারী, পাঞ্জাবী, সিন্ধী এবং সীমান্তের পাঠান মুসলমানগণ এক আদর্শের পতাকাবাহী হিসেবে নির্দ্বিধায় একই আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েছে। এ সময়কার কয়েকটি সংঘর্ষে বাঙ্গালী মুসলমানরা তাদের ঐতিহাসিক বদনাম ভীরু বাঙ্গালী শব্দটিকে মিথ্যা প্রমাণিত করে অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে শত্রুর মোকাবিলা করেছে। আন্দোলনটিকে নির্মূল করার জন্য ব্রিটিশ সরকার সবসময়েই সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। আধুনিক সশস্ত্র বাহিনী এবং ব্রিটিশ গোয়েন্দারা সবসময় এ আন্দোলনের কর্মীদের খুঁজে বেড়াতো যত্রতত্র। সংগঠনের দায়িত্বশীল এবং সক্রিয় কর্মীদের মাথার উপরে ঝুঁলতো সর্বদা রাষ্ট্রদ্রোহিতার খড়গ কৃপাণ। কিন্তু এই সব কিছুর পরও কোন সময়ই ব্রিটিশ সরকার এ আন্দোলনকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। শিখ ও ব্রিটিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য বাংলাদেশ সহ সমগ্র উপমহাদেশ থেকে অসংখ্য মুসলমান আর অগণিত টাকা পয়সা নিয়মিতভাবে ব্রিটিশ সরকারের দৃষ্টি এড়িয়ে অত্যন্ত সুকৌশলে সীমান্তের জেহাদি বসতিতে প্রেরিত হয়েছে। মুসলমানদেরকে জিহাদ থেকে বিরত রাখার জন্য ইংরেজ সরকার বহু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল। কিন্তু তাদের সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবার পর তারা অর্থের বিনিময়ে স্বার্থান্বেষী আলেমদের ফতোয়াবাজীরও আশ্রয় নিয়েছিল। এদেশে এ সময়ে জিহাদের অংশ গ্রহণ করা জায়েজ নয় বলে প্রচারিত তথাকথিত আলমদের ফতোয়াতে তৎকালীন মুসলমানেরা বিভ্রান্ত হয়নি। শহীদ সৈয়দ আহমদ ব্রেলভীর অনুপস্থিতিতে ত্বরীকায়ে মুহাম্মদী আন্দোলনের নেতৃত্বে দিয়েছিলেন তৎকালীন সমাজের শ্রেষ্ঠ আলেমগণ। ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত না করা গেলে ইসলামকেও সুপ্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব নয় এই চিন্তাধারার উপরই তারা আন্দোলনের গতি পরিচালিত করেন। রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলায় ব্রিটিশ সরকার এ আন্দোলনের কর্মাদেরকে কঠোর শাস্তি প্রদান করেও আন্দোলন থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারেনি। এক ভাইয়ের কঠোর শাস্তি দেখে অপর তিন ভাই জিহাদি বসতিতে যোগান করার জন্য রওয়ানা হয়ে যাওয়ার ইতিহাস রয়েছে। ১৮৯০ সালেও সীমান্তে মুজাহিদদের ঘাঁটি ছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। ১৮১৫সালে ব্রিটিশ বাহিনীর সাথে সীমান্তের এক সংঘর্ষে ১২ জন কালো পোশাকধারী মুজাহিদের লাশ উদ্ধার করা হয়। এই বছরেরই ফেব্রুয়ারি মাসে লাহোর পেশোয়ারও কোহাটের প্রায় ৫০জন ছাত্র মুজাহিদ বাহিনীতে যোগদান করার জন্য কাবুল চলে যায়। ১৯১৭ সালে জানুয়ারিতে রংপুর ও ঢাকার ১৮ জন মুসলমান মুজাহিদ বাহিনীতে যোগ দিয়েছেন। মুজাহিদ শিবিরে গোপনে টাকা নিয়ে যাওয়ার সময় এ বৎসরের মার্চ মাসে দুজন মুসলমান ৮ হাজার টাকাসহ গ্রেফতার হন। এরা উভয়ই বহু পূর্ব থেকে ত্বরীকায় মুহা্ম্মদী আন্দোলনের সাথে জড়িত ছিলেন। দেওবন্দ মাদ্রাসার মাওলানা ওবায়দুল্লাহর নেতৃত্বে আন্দোলনের এক দল কর্মী বিদেশে বসে দেশের ইংরেজ বিতাড়নের জন্য সাধ্যানুযায়ী তৎপরতা চালাতেন। এ তৎপরতার সাথে সংশ্লিষ্ট কিছু চিঠি সিন্ধুর জনৈক মুজাহিদ নেতার নিকট প্রেরিত হবার সময় পথিমধ্যে তা ব্রিটিশ সরকারে লোকদের হাতে ধরা পড়ে। এটাকে ইংরেজ সরকার রেশমী চিঠির ষড়যন্ত্র নামে আখ্যায়িত করেছিল। উপরোক্ত তথ্যগুলো ইংরেজ সরকারের বিভিন্ন রেকর্ড পত্র থেকে সংগ্রহ করা। ইংরেজ সরকারের দৃষ্টির অগোচরে সংঘটিত হয়েছে, আন্দোলনের এমন অসংখ্য কাজ এখানে উল্লেখ করা সম্ভব হয়নি। শুধুমাত্র যে সব তৎপরতা ইংরেজ সরকারের গোচরীভূত হয়েছে, এখানে মাত্র তার কয়েকটি তুলে ধরা হলো।
এ আন্দোলনের কর্মীদের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে দি ইন্ডিয়ান মুসলমানস গ্রন্থে উইলিয়াম হান্টার লিখেছেন, মুহাম্মদী আন্দোলনের কর্মারা ছিল অক্লান্ত পরিশ্রমী, ব্যক্তি স্বার্থ সম্পর্কে একেবারে অমনোযোগী, নিষ্কলুষ চরিত্রের অধিকারী, বিধর্মী ইংরেজ উৎখাত করার জন্য সর্বস্ব ত্যাগে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, কর্মী, সমর্থক ও অর্থ সংগ্রহের স্থায়ী ব্যবস্থা পত্তনে অত্যন্ত সুকৌশলী এবং চরিত্রবান হিসেবে সর্বদা প্রশংসার যোগ্য। ১৮৫৭ সালের স্বাধীনতার সংগ্রামীদের সম্মুখে এ আন্দোলন প্রেরণার উজ্জ্বল প্রতীক হিসেবে ভাস্বর ছিল। শহীদ সৈয়দ আহমদ ব্রেলভীর শাহাদাতের কয়েক বছর পর তাঁরই অনুসৃত নীতি ও পদ্ধতি অনুসরণ করে রাশিয়ায় তাখফায নিবাসী বিশ্ব বিখ্যাত মুজাহিদ শায়খ শামেল এমন এক মুজাহিদ সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন, যে সংগঠনের কর্মারা রাশিয়ার অত্যাচারী জার শক্তির সাথে ২৫ বৎসর পর্যন্ত জিহাদ অব্যাহত রাখতে সক্ষম হয়েছিল। সৈয়দ সাহেবের শাহাদাতের ৪০ বৎসর পর তাঁর কর্ম পদ্ধতির অনুসরণে শায়খ মুহাম্মদ সুদানী অতি অল্প সময়ের মধ্যে আদর্শিক দিক থেকে মৃত প্রায় সুদানবাসীকে ঐক্যবদ্ধ করে ইসলামী আন্দোলনের প্রেরণায় উদ্দীপ্ত এক শক্তিশালী জাতিতে পরিণত করেছিলেন। দুঃখের বিষয় আজ আমরা আমাদের এ গৌরবময় এবং ঐতিহ্যবাহী ইতিহাস ভুলে গেছি। এমনকি আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদেরকেও তা ভুলিয়ে দেয়ার চেষ্টা চলছে।
সাইয়েদ আহমদ ব্রেলভী ও তার আন্দোলন সম্পর্কে সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদীর পর্যালোচনা
শাহ ওয়ালিউল্লাহর মৃত্যুর অর্ধশতক অতিক্রম হবার আগেই হিমালয়ান উপমহাদেশে একটি আন্দোলনের উদ্ভব হলো। শাহ ওয়ালিউল্লাহ জনগণের দৃষ্টিসমক্ষে যে লক্ষ্যবিন্দুকে উজ্জ্বল করে গিয়েছিলেন, এ আন্দোলন ছিল সেই একই লক্ষের অনুসারী, সাইয়েদ সাহেবের পত্রাবলী ও বাণী এবং শাহ ইসমাঈল শহীদের মাসনাবে ঈমামাত উকবাত কাকবিয়াতুল ঈমান ও অন্যান্য রচনাবলী পাঠ করলে উভয় স্থানেই শাহ ওয়ালিউল্লাহরই সরব কণ্ঠ শ্রুত হবে। শাহ সাহেব কার্যত: যা করেছিলেন তা হলো এই যে, তিনি হাদিস ও কুরআনের শিক্ষা এবং জের ব্যক্তিত্বের প্রভাবে সৎ ও সুস্থ চিন্তা সম্পন্ন লোকদের একটি বিরাট দল সৃষ্টি করেন। অতঃপর তার চারপুত্র বিশেষ করে শাহ আবদুল আজিজ (রঃ) বিপুলভাবে এ দলটির কলেবর বৃদ্ধি করেন। তাঁর প্রচেষ্টায় ভারতের বিভিন্ন এলাকায় হাজার হাজার ব্যক্তি ছড়িয়ে পড়েন। তাঁরা ছিলেন শাহ ওয়ালিউল্লাহর চিন্তার ধারক। তাঁদের হদয়পটে ইসলামের নির্ভুল চিত্র অঙ্কিত ছিল। তারা নিজেদের বিদ্যা বুদ্ধি ও উন্নত চরিত্রের কারণে সাধারণ লোকদের মধ্যে শাহ ওয়ালিউল্লাহ ও তাঁর শাগরেদগণের প্রভাব প্রতিষ্ঠিত করার মাধ্যম পরিণত হন। এ জিনিষটি পরোক্ষভাবে সেই আন্দোলনের জন্য ক্ষেত্র প্রস্তুত করে যেটি শাহ সাহেবের পরিবার এবং তাঁর ভক্তগোষ্ঠীর মধ্য থেকে জন্ম লাভ করার প্রতীক্ষায় ছিল।
সাইয়েদ আহমদ ব্রেলভী ১৭৮৬ খ্রীঃ (১২০১ হিজরি) জন্মগ্রহণ করেন। শাহ ইসমাইল শহীদ ১৭৭৯খ্রীঃ(১১৯৩ হিজরি) জন্মগ্রহণ করেন। উভয়ই ১৮১৩ খ্রীঃ (১২৪৬হিজরী) বালাকোটের প্রান্তরে শাহাদাত বরণ করেন। সাইয়েদ আহমদ ব্রেলভী (রঃ) ও শাহ ইসমাইল (রঃ) উভয়ই আত্মিক ও চিন্তাগত দিক থেকে একই অস্তিত্বের অধিকারী ছিলেন। আর এই একক অস্তিত্বকে আমি স্বতন্ত্র মুজাহিদ মনে করিনা না, বরং শাহ ওয়ালিউল্লাহর তাজদীদের পরিশিষ্ট মনে করি। তাঁদের কর্মকাণ্ডের সংক্ষিপ্ত সার হলোঃ (১) তাঁর সাধারণ মানুষের ধর্ম, চরিত্র, আচার ব্যবহার ও লেনদেনের সংস্কারের দায়িত্বগ্রহণ করেন। যে সব স্থানে তাদের প্রভাব পৌঁছা, সেখানকার জীবন ধারায় এমন বিপুল বিপ্লব সাধিত হয় যে, মানুষের চোখে সাহাবীদের (রাঃ) জামানার চিত্র ভেসে উঠে। (২) উনবিংশ শতকের প্রথম দিকে ভারতের মত একটি পতনোম্মখ দেশে তাঁরা যেভাবে ব্যাপক হারে জিহাদের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন এবং এ প্রস্তুতির ক্ষেত্রে যেভাবে নিজেদের সাংগঠনিক যোগ্যতার পূর্ণতা প্রকাশ করেন তা এক প্রকার অসম্ভব ছিল। অতঃপর একান্ত দূরদর্শিতার সাথে তাঁরা কার্যারম্ভের জন্য উপমহাদেশের উত্তর পশ্চিম অঞ্চলকে নির্বাচিত করেন। বলাবাহুল্য, ভৌগলিক ও রাজনৈতিক দিক দিয়ে এটিই ছিল কাজের উপযোগী স্থান। অতঃপর এই জিহাদে তাঁরা এমন চরিত্রনীতি ও যুদ্ধ আইন ব্যবহার করেন যে, তার মাধ্যমে একজন দুনিয়াদার স্বার্থবাদী যোদ্ধার মোকাবিলায় একজন খোদার পথে জিহাদকারীর বৈশিষ্ট্য অর্জন করতে সক্ষম হয়। এভাবে তাঁরা দুনিয়ার সামনে আর একবার সঠিক ইসলামী আদর্শ ও ধ্যান ধারণার বিকাশ ঘটান। তাঁদের যুদ্ধ দেশ জাতি বা দুনিয়ার স্বার্থকেন্দ্রীক ছিল না, বরং একান্তভাবে খোদার পথে ছিল। খোদার সৃষ্টিকে জাহিলিয়াতের শাসনমুক্ত করে তাদের উপর স্রষ্টা ও বিশ্ব জাহানের মালিকের শাসন প্রতিষ্ঠিত করা ছাড়া তাদের দ্বিতীয় কোন উদ্দেশ্য ছিল না। এ উদ্দেশ্যে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে নিয়মানুযায়ী প্রথমে তাঁরা ইসলাম অথবা জিজিয়ার দিকে আহবান করেন। অতঃপর নিজেদের পক্ষ থেকে পূর্ণরূপে নিশ্চিত হবার পর তাঁরা অস্ত্র ধারণ করতেন আর অস্ত্র ধারণ করতেন আর অস্ত্র ধারণ করার পর ইসলামের মার্জিত ও উন্নত যুদ্ধ আইনের পুরোপুরি আনুগত্য করতেন। কোন নির্যাতনমূলক ও হিংসাত্মক কার্য তাদের দ্বারা সম্পাদিত হয়নি। তাঁরা যে লোকালয়ে প্রবেশ করেছেন, সংস্কারক হিসেবেই করেছেন। তাঁদের সেনাদলের সাথে শরাব থাকতো না, ব্যান্ড বাজাতেন, তাঁদের সেনাদলের সাথে শরাব থাকতো না, ব্যান্ড বাজতোনা, তাঁদের পতিতাদের পল্টন, তাদের সেনানিবাস ব্যভিচারীদের আড্ডাখানায় পরিণত হতো না এবং এম কোন দৃষ্টান্তও পাওয়া যায়নি যে, তাঁদের সেনাদল কোন স্থান অতিক্রম করেছে আর সেখানকার মহিলারা তাদের সতীত্ব হারিয়ে মাতম করতে বসেছে। তাদের সিপাহীরা নের বেলায় ঘোড়ার উঠে আর রাতে জায়নামাজের উপর থাকতেন। তাঁরা খোদার ভয়ে ভীত থাকতেন, আখিরাতের হিসাব ও জওয়াবদিহীকে হামেশা সামনে রাখতেন। এ ব্যাপারে তাঁরা কোন প্রকার লাভ ক্ষতির পরওয়া করতেন না। তাঁরা কোথাও পরাজিত হলে কাপুরুষ প্রমাণিত হননি। আবার কোথাও বিজয় লাভ করলে নিষ্ঠুর ও অহংকারী প্রমাণিত হননি। তাঁদের আগে ও পরে এ অঞ্চলে এ দরণের নির্ভেজাল ইসলামী জিহাদ আর অনুষ্ঠিত হয়নি। (৩) তাঁরা একটি ক্ষুদ্রতম এলাকায় স্বল্পকালীন ইসলামী রাষ্ট্র পরিচালনার সুযোগ লাভ করেন। এ সময় তাঁরা যথার্থ খিলাফত আলা মিনহাজিন নবুয়ত ( নবুয়তের পন্থানুসারে খিলাফত) এর পদ্ধতিতে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। ফকীরি শাসন, সাম্য, পরামর্শ সভা, ন্যায় বিচার, ইনসাফ, শরীয়তের আইন, হক অনুযায়ী অর্থ গ্রহণ করা এবং হক অনুযায়ী খরচ করা, দুর্বল হলেও মজলুমের সাহায্য করা, শক্তিশালী হলেও জালিমের বিরোধিতা করা, খোদা-ভীরুতার সাথে দেশ শাসন করা এবং সততার সাথে রাজনীতি পরিচালনা করা ইত্যাদি সকল দিক দিয়েই তাঁরা সেই ইসলামী খিলাফতের পূর্ণাঙ্গ নমুনা পেশ করেন। হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ) এবং হযরত ওমর ফারুক (রাঃ) এর আমলের খিলাফতের চিত্রকে তাঁরা পুনরুজ্জীবিত করেন।
খোদার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত করার যথাসাধ্য প্রচেষ্টা চালানোই মুমিনের সত্যিকারের সাফল্য। এ পরিপ্রেক্ষিতে সৈয়দ আহমদ ব্রেলভী, শাহ ইসমাঈল শহীদ ও তাঁদের অনুসারীগণ অবশ্যই সফলকাম হয়েছিলেন। তবে পার্থিব ফলাফলের দিক দিয়ে তাঁদের ব্যর্থতা পরিস্ফুট। কার্যত: তারা জাহেলিয়াতের কর্তৃত্ব নির্মূল করে ইসলামের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি। আমরা এই কারণসমূহ পর্যালোচনা করবো। যাতে করে পরবর্তীকালে দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত করার প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে ঐ কারণসমূহের ব্যাপারে সতর্ক থাকা সম্ভব হয়। কতিপয় জাগতিক কারণে তাঁরা ব্যর্থ হন। এ কারণগুলো আমি পরে বর্ণনা করছি। কিন্তু চিন্তার জগতে তাঁরা যে আলোড়ন সৃষ্টি করে যান, তার প্রভাব এক শতাব্দীর অধিক সময় অতিক্রান্ত হবার পর আজও উপমহাদেশে পরিদৃষ্ট হচ্ছে।
ব্যর্থতার কারণ
এই সর্বশেষ সংস্কারমূলক আন্দোলনের ব্যর্থতার কারণসমূহ পর্যালোচনা করা সাধাণতঃ তাঁদের রুচি বিরুদ্ধ, যাঁরা নিছক ভক্তি সহকারেই মহামনীষীদের কথা আলোচনা করার পক্ষপাতী। এজন্য আমার আশঙ্কা হচ্ছে যে, উপরোক্ত শিরোনামে আমি যা কিছু পেশ করবো, তা আমার অনেক ভাইয়ের মনোবেদনার কারণ হবে। কিন্তু পূর্ববর্তী মনীষীগণের উদ্দেশ্যে নিছক প্রশংসাবাণী বিতরণ করাই যদি আমাদের উদ্দেশ্য না হয়ে থাকে বরং আগামীতে দ্বীনের সংস্কারের কাজে তাঁদের কার্যাবলী থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা যদি আমাদের লক্ষ্য হয়, তাহলে সমালোচকের দৃষ্টিতে ইতিহাস পর্যালোচনা করা এবং এই মনীষীদের কার্যাবলী বিশ্লেষণ করার সাথে সাথে উদ্দেশ্য সাধনে তাঁদের ব্যর্থতার কারণসমূহ অনুসন্ধান করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। শাহ ওয়ালিউল্লাহ (রঃ) এবং তাঁর পুত্রগণ হকপরস্ত আলেম ও সৎলোকদের যে মহান দল সৃষ্টি করেন, অতঃপর সাইয়েদ আহমদ ব্রেলভী (রঃ) ও শাহ ইসমাঈল শহীদ (রঃ) সৎ খোদা ভীরু লোকদের যে বাহিনী গঠন করেন, তার বিবরণ পড়ে আমরা বিস্ময়ে অভিভূত হই, মনে হয় বুঝি আমরা ইসলামের প্রথম যুগের সাহাবা ও তাবেঈনের জীবন চরিত্র পাঠ করছি। আমরা অবাক হয়ে ভাবি যে, আমাদের এতো নিকটতম যুগে এমন অদ্ভুত উন্নত চরিত্রের লোকের আগমন হয়েছিল। কিন্তু এই সঙ্গে আমাদের মনে স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন জাগে যে, এতো বড় সংস্কার ও বিপ্লবী আন্দোলন, যার নেতৃবৃন্দ ও কর্মীগণ এমন সৎ খোদাভীরু ও অক্লান্ত মুজাহিদ ছিলেন, তাঁরা চরম প্রচেষ্টা চালানো স্বত্বেও উপমহাদেশে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হননি কেন? অথচ এর বিপরীত পক্ষে সাত সমুদ্র তের নদীর পাড় থেকে আগত ইংরেজরা এখানে নির্ভেজাল জাহেলী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে। ভক্তির উচ্ছ্বাসে অন্ধ হয়ে এ প্রশ্নটির জবাব দানে বিরত থাকার অর্থ এই দাঁড়াবে যে, লোকেরা সত্য, সততা, খোদাভীরুতা ও জিহাদকে খোদার দুনিয়া সংশোধনের ক্ষেত্রে দুর্বল প্রভাবের অধিকারী মনে করতে থাকবে। এ চিন্তা তাদেরকে নিরাশ করবে যে এতো বড় সৎ ও খোদাভীরু লোকদের প্রচেষ্টায় যখন কিছু হলোনা তখন ভবিষ্যতেও আর কিছু হবে না। এ ধরণের সন্দেহ আমি লোকদের মুখে শুনেছি, বরং হালে আমি যখন আলীগড়ে যাই, তখন ষ্ট্রেচী হলের বিরাট সমাবেশে আমার সম্মুখে এই সন্দেহই পেশ করা হয়। এ সন্দেহ আপনাদের করার জন্য আমাকে একটি সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দিতে হয়। উপরুন্ত আমি এও জানি যে, অধুনা উলামা ও সৎ লোকদের যে বিরাট দল আমাদের মধ্যে আছেন, তাঁদেরও বেশীরভাগ এ ব্যাপারে একেবারেই চিন্তাশূন্য। অথচ এ সম্পর্কে অনুসন্ধান চালানো হলে এমন সব শিক্ষা আমরা লাভ করতে পারি যার আলোকে আগামীতে আরো বেহতের ও অধিকতর নির্ভুল কার্য সম্পাদিত হতে পারে।
প্রথম কারণ
হযরত মুজাদ্দিদে আলফিসানির যুগ থেকে নিয়ে শাহ ওয়ালিউল্লহ দেহলবী ও তার প্রতিনিধিবৃন্দের সময় পর্যন্ত যাবতীয় সংস্কারমূলক কাজে যে জিনিসটি প্রথম আমার চোখে বাধে, তা হলো এই যে, তাঁরা তাসাউফের ব্যাপারে মুসলমানদের রোগ পুরোপুরি অনুধাবন করতে পারেননি এবং অজানিতভাবে তাদেরকে পুনর্বার সেই খাদ্যই দান করেন যা থেকে তাদেরকে পূর্ণরূপে দূরে রাখার প্রয়োজন ছিল। তারা যে তাসাউফ পেশ করেন তার মুল কাঠামোর বিরুদ্ধে আমার কোন আপত্তি নেই, বরং প্রাণবস্তুর দিক দিয়ে তা ইসলামের আসল তাসাউফ। এ তাসাউফ এহসান থেকে মোটেই ভিন্নতর নয়। কিন্তু যে বস্তুটিকে আমি পরিত্যাজ্য বলছি, তাহলো তাসাউফের রূপক, উপমা ও তার ব্যবহার এবং তাসাউফের সাথে সামঞ্জস্যশীল পদ্ধতি জারী রাখা। বলা বাহুল্য সত্যিকার ইসলামী তাসাউফ এ বিশেষ খোলসের মুখাপেক্ষী নয়। এরজন্য ছাঁচও আছে। এরজন্য অন্য প্রকার ভাষাও ব্যবহার করা যেতে পারে। উপমা ও রূপক থেকেও অব্যাহতি লাভ করা যেতে পারে উপমা ও রূপক থেকেও অব্যাহতি লাভ করা যেতে পারে। পীর মুরিদী এবং এ ব্যাপারে যাবতীয় বাস্তব আকৃতি পরিহার করে অন্য আকৃতি গ্রহণ করা যেতে পারে। তাহলে সেই পুরানো ছাঁচ যার মধ্যে দীর্ঘকাল থেকে জাহেলী তাসাউফের আধিপত্য চলে আসছিল তাকে গ্রহণ করার জন্য চাপ দেয়ার কিইবা প্রয়োজন ছিল। এর ব্যাপক ও বিপুল প্রচার মুসলমানদের মধ্যে যে সব কঠিন নৈতিক ও আকিদাগত রোগের সৃষ্টি করেছে, তা বিচক্ষণ ব্যক্তির দৃষ্টির অগোচরে নেই। বর্তমান পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, কোন ব্যক্তি যতই নির্ভুল শিক্ষাদান করুক না কেন এই ছাঁচ ব্যবহার করার সাথে সাথেই শত শত বছরের প্রচলনের ফলে এর সাথে যেসব রোগ সংশ্লিষ্ট হয়েছে সেগুলির পুনরাবির্ভাব ঘটে। কাজেই পানির মত হালাল বস্তুও যেমনি ভাবে ক্ষতিকর প্রমাণিত হলে রোগীর জন্য নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়, অনুরূপভাবে এ ছাঁচ বৈধ হওয়া স্বত্বেও শুধুমাত্র একারণেই পরিত্যাজ্য যে, এরই আবরণে মুসলমানদের মধ্যে আফিমেরে নেশা সৃষ্টি করা হয়েছে। এর নিকটবর্তী হতেই পুরাতন রোগীদের মানসপটে আবার সেই ঘুমপাড়ানির কথা ভেসে উঠে, যার মাধ্যমে শত শত বছর থেকে গায়ে পিঠে হাত বুলিয়ে বুলিয়ে তাদেরকে নিদ্রাভিভূত করেছে। পীরের হাতে বাইয়াত হবার পর মুরিদের মধ্যে সেই বিশেষ মানসিকতা সৃষ্টি হয় যা একমাত্র পীর মুরিদের জন্য নির্ধারিত হয়ে গেছে। অর্থাৎ পীরের কথায় সিরাজির রঙ্গে রঙ্গিন হও এ ধরণের মানসিকতায় যার পর পীর সাহেব ও গায়রুল্লাহর মধ্যে কোন পার্থক্য থাকেনা। তাদের চিন্তা ও দৃষ্টিশক্তি স্থায়িত্বে পৌঁছে যায় এবং পর্যালোচনা ও সমালোচনা ও সমালোচনা শক্তি নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। বুদ্ধি জ্ঞানের ব্যবহার স্থগিত হয়, এবং মন মস্তিষ্কের উপর শায়খের বন্দেগীর এমন পরিপূর্ণ আধিপত্য বিস্তার লাভ করে যার ফলে শায়খ যেন তাদের প্রতিপালক এবং তারা শায়খের প্রতিপালিত হিসেবে পরিগণিত হয়। অতঃপর কাশফ ও ইলহামের আলোচনা শুরু হবার সাথে সাথে মানসিক দাসত্বের বাধন আরও বেশী শক্তিশালী হতে থাকে। তারপর শুরু হয় সূফীদের রূপক ও উপমার প্লাবন। এর ফলে মুরিদদের কল্পনাশক্তি যেন চাবুক খাওয়া অশ্বের ন্যায় তাদেরকে নিয়ে তীর বেগে ছুটতে থাকে। এ অবস্থায় তারা প্রতি মুহূর্তে অদ্ভুত তেলেসমাতির দুনিয়ায় সফর করতে থাকে, বাস্তবের দুনিয়ায় অবস্থান করার সুযোগ তারা খুব কমই লাভ করে।
মুসলমানদের এ রোগ সম্পর্কে হযরত মুজাদ্দিদে আলফেসানী (রঃ) ও হযরত শাহ ওয়ালিউল্লাহ অনবগত ছিলেন না। উভয়ের রচনায় এর সমালোচনা করা হয়েছে। সম্ভবত: এ রোগের ব্যাপকতা সম্পর্কে তাঁদের পূর্ণ ধারণা ছিলনা। এ কারণেই তাঁরা এই রোগীদেরকে পুনর্বার এমন পথ্য দান করেন যা এই রোগে ক্ষতিকর প্রমাণিত হয়েছিল। ফলে তাঁদের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ধীরে ধীরে আবার সেই পুরাতন রোগে আক্রান্ত হতে থাকে। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, হযরত মুজাদ্দিদে আলফেসানী (রঃ)এর ইন্তেকালের কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর সমর্থকগণ তাঁকে কাইউমে আউয়াল ও তাঁর খলিফাদেরকে কাইউমে সানী উপাধি দান করেন। অথচ কাইউম খোদার একটি সিফাত। যদিও মাওলানা শাহ ইসমাঈল শহীদ (রঃ) এ সত্য যথার্থরূপে উপলব্ধি করে ঈমাম ইবনে তাইমিয়ার (রঃ) নীতি অনুসরণ করেন কিন্তু শাহ ওয়ালিউল্লাহর (রঃ) রচনাবলীতেই এর যথেষ্ট মাল সমলা ছিল এবং শাহ ইসমাইল (রঃ) রচনাবলীও তার প্রভাব কাটিয়ে উঠতে পারেনি। কাজেই ব্রেলভীর আন্দোলনেও পীর মুরিদীর সিলসিলা চালু হয়ে গিয়েছিল। তাই সূফীবাদের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে এ আন্দোলনও মুক্ত হতে পারেনি। এমনকি সাইয়েদ আহমদের শাহাদত লাভের পরই তাঁর সমর্থকদের মধ্যে এমন একটি দলের উদ্ভব হয়, যারা শিয়াদের ন্যায় তাঁর অদৃশ্য হবার কথা বিশ্বাস করেন এবং আজ ও তাঁর পুনরাবির্ভাবের প্রতীক্ষায় আছেন। বর্তমানে যিনি তাজদীদে দ্বীনের কাজ করতে চাইবেন, তাঁকে অবশ্যই সূফীবাদের ভাষা পরিভাষা, ব্যাপক উপমা, পীর মুরিদী এবং তাদের পদ্ধতি স্মরণ করিয়ে দেয় এমন প্রতিটি জিনিষ থেকে মুসলমানদেরকে দূরে রাখতে হবে। এক্ষেত্রে বহুমূত্র রোগীকে যেমন চিনি থেকে দূরে সরিয়ে রোখা হয়, মুসলমানদেরকে অনুরূপভাবেই উল্লেখিত বিষয়গুলো থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে হবে।
দ্বিতীয় কারণ
এ আন্দোলনকে সমালোচনার দৃষ্টিতে অধ্যয়ন করার সময় দ্বিতীয় যে জিনিসটি আমি অনুভব করেছি, তা হলো এই যে, সাইয়েদ আহমদ ও শাহ ইসমাঈল শহীদ যে এলাকায় অবস্থান করে জিহাদ পরিচালনা করেন এবং যে ইসলামী হুকুমত কায়েম করেন, সে এলাকাটিকে পূর্ব থেকেই এ বিপ্লবের জন্য ভালোভাবে প্রস্তুত করেননি। তাঁদের সেনাবাহিনী অবশ্যই উন্নত নৈতিক ও আধ্যাত্মিক ট্রেনিং প্রাপ্ত ছিলেন। কিন্তু উপমহাদেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে একত্রিত হয়েছিলেন। উপমহাদেশের উত্তর পশ্চিম অঞ্চলে তাঁরা ছিলেন মোহাজিরের পর্যায়ভুক্ত। এই এলাকায় রাজনৈতিক বিপ্লব অনুষ্ঠানের জন্য প্রথমে স্থানীয় লোকদের মধ্যে নৈতিক ও মানসিক বিপ্লব অনুষ্ঠানের প্রয়োজন ছিল। এর ফলে স্থানীয় লোকেরা ইসলামী রাষ্ট্রকে বুঝবার এবং তার সাহায্যকারী আনসার হবার যোগ্যতা অর্জন করতে পারতো। উভয় নেতৃবৃন্দই সম্ভবত এই বিভ্রান্তির শিকার হন যে, সীমান্তের লোকেরা যেহেতু মুসলমান এবং অমুসলিম শাসকদের দ্বারা নির্যাতিত কাজেই তারা ইসলামী শাসনকে স্বাগত জানাবে। এ কারণেই তাঁরা সেখানে পৌঁছে জিহাদ শুরু করেছেন এবং কতগুলো এলাকা তাদের কর্তৃত্বাধীনে আসে, তার সবগুলোতেই খিলাফত কায়েম করেন। কিন্তু অবশেষে পরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণ হয়ে যায় যে, নামের মুসলমানকে সত্যিকার মুসলমান মনে করা এবং সত্যিকার মুসলমানের দ্বারা যে কাজ সম্ভব, নামের মুসলমানদের নিকট থেকে সে কাজের আশা করা নিছক প্রতারণা ছিল। যারা খেলাফতের বোঝা বহন করার শক্তি রাখতো না, তাদের ওপর এ বোঝা রাকার ফলে নিজেরাতো ভূপাতিত হয়েছেই সাথে সাথে এই ইমারতটিকেও ভূপাতিত করে ছেড়েছে। আগামীতে প্রতিটি সংস্কারমূলক কাজে ইতিহাসের এ শিক্ষাকে সম্মুখে রাখা প্রয়োজন। এ সত্যটি পুরোপুরি হৃদয়ঙ্গম করা উচিৎ যে, যে রাজনৈতিক বিপ্লবের শিকড় সামগ্রিক চিন্তা, চরিত্র ও তমদ্দুনের মধ্যে আমূল বিদ্ধ না থাকে তা কো দিন সার্থক হতে পারেনা। কোন সামরিক শক্তির মাধ্যমে এমন বিপ্লব কোথাও সংঘটিত হয়ে গেলে স্থায়িত্ব লাভ করতে পারেনা। আর তা বিলুপ্ত হবার সময় পিছনে কোন চিহ্নই রেখে যায় না। এ কারণেই বর্তমানে সীমান্ত প্রদেশে হযরত সাইয়েদ আহমদ ব্রেলভী ও শাহ ইসমাঈল শহীদের কোন প্রভাব অকে অনুসন্ধান করেও পাওয়া যায় না। এমন কি সেখানকার লোকেরা বর্তমানে বিভিন্ন উর্দু বই পত্রে মাধ্যমে তাঁদের নাম জানতে পারছে।
তৃতীয় কারণ
এখানে একটি প্রশ্ন থেকে যায় যে, এই বুজুর্গগণের তুলায় কয়েক হাজার মাইল দূর থেকে আগত ইংরেজদের এমন কি শ্রেষ্ঠত্ব ছিল, যার ফলে তারা এখানে জাহেলী রাষ্ট্র কায়েম করতে সক্ষম হয়? অথচ এঁরা নিজেদেরই দেশে ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম করতে পারলেন না কেন? আঠার ও উনিশ ঈসায়ী শতকের ইউরোপের ইতিহাস সম্মুখে না থাকলে এর নির্ভুল জবাব পাওয়া যাবে না। সৈয়দ আহমদ (রঃ) শাহ ইসমাঈল(রঃ) ও তাঁদের অনুগামীগণ ইসলাম সংস্কারের জন্য যে কার্য সম্পাদন করেন, তাঁর সমস্ত শক্তিকে তুলাদেন্ডের একদিকে এবং অন্যদিক সমকালীন জাহেলিয়াতের শক্তিকে স্থাপন করলে তবেই পূর্ণরূপে অনুমান করা সম্ভব হবে যে, এই বস্তুজগতে যে নীতি নিয়ম কার্যকরী রয়েছে তার পরিপ্রেক্ষিতে এই দুই শক্তির আনুপাতিক হার কি ছিল?এ কথা মোটেই অতিশয়োক্তি হবে না যদি আমি বলি যে, এ দুটির মধ্যে এক তোলা ও এক মনের সম্পর্ক ছিল। এ জন্যে বাস্তবে যে ফলাফল সূচিত হয়েছে তা থেকে ভিন্নতর কিছু হওয়া সম্ভবপর ছিল না। যে যুগে আমাদের দেশে শাহ ওয়ালিউল্লাহ, শাহ আবদুল আজিজ, সৈয়দ আহমদ ব্রেলভী, শাহ ইসমাঈল শহীদ জন্মগ্রহণ করেন, সে যুগেই ইউরোপ নব শক্তির নবউদ্দীপনা নিয়ে মধ্য যুগের নিদ্রা থেকে জেগে উঠেছিল। সেখানে জ্ঞান ও শিল্প অনুসন্ধানকারী উদ্ভাবক ও আবিষ্কারক এত বিপুল সংখ্যায় জন্মলাভ করেছিলেন যে, তারা সবাই মিলে এই দুনিয়ার চেহারাই পাল্টিয়ে দেন। এই যুগেই হিউম, কষ্ট্র, ফিশতে, (FICHTE), হেগেল, কোতে(COMET)শিলার মাশার (SCHLIER MACHER)ও মিলের ন্যায় দার্শনিক জন্মগ্রহণ করেন। তাঁরা তর্ক শাস্ত্র, দর্শন, মনস্তত্ব, এবং যুক্তিবিদ্যার সমগ্র শাখা প্রশাখায় বিপ্লব সাধন করেন। এ যুগেই শারীরবিদ্যায় গ্যালভানী (GALVANI) ও ভল্টা(VOLTA) রসায়ন শাস্ত্রে ল্যাভয়সিয়র (LAVOUER), প্রিস্টলি (PRIESTLEY) ডেভী(DEVY), বার্জিলয়িস(BERZIVS) এবং জীব বিদ্যায় লিনে (LINNE) হলার(HALLER), বিশাত(BICHAT), ও উলফ (WOLF), এর ন্যায় পণ্ডিতদের আর্বিভাব হয়। তাঁদের গবেষণা শুধু বিজ্ঞানে উন্নতির সহায়কেই হয়নি বরং বিশ্ব জাহানের মানুষ সম্পর্কে একটি নয়া মতবাদেরও জন্ম দেয়। এ যুগেই কুইসনে (QUISNEY), টার্গট(TUROIOT), এড্যাম স্মিথ(ADAMSMITH), ও ম্যালথাসের গবেষণার মাধ্যমে নয়া অর্থনীতি বিজ্ঞানের উদ্ভব হয়। এ যুগেই ফ্রান্সে রুশো, ভলটেয়ার, মান্সস্কো, ডেনিস ডাইডর্ট(DANIS DIDEROT), লা ম্যাটরি(LA MATTRIE), ক্যাবানিস (CABANIS), বাফন (BAFFON)ও রোবিনেট (ROBINET ), ইংল্যান্ডে টমাসপোন (TOMASPOUNE), উইলিয়াম গডউইন (WILLIAM GODWIN), ডেভিট হার্টলে (DAVID HARTLEY), জোসেফ প্রিস্টলে (JOSEPH PRESTLY), ও এরসমাস ডারউইন এবং জার্মানিতে গেটে, হার্ডার শিলার (SCHILER), উইঙ্কেল্যান (WINEKELMANN), লিসিং (LISSING), হোলবাস (HOLBACH), এবং আরো অনেক গবেষকের জন্ম হয়। তাঁরা নৈতিক দর্শন, সাহিত্য, আইন, ধর্ম, রাজনীতিবিদ্যার সকল শাখায় বিপুল প্রভাব বিস্তার করেন। তাঁরা নির্ভীকভাবে প্রাচীন মতবাদ ও চিন্তা ধারার কঠোর সমালোচনা কর চিন্তার এক নতুন দুনিয়া সৃষ্টি করেন। প্রেসের ব্যবহার, প্রচারের আধিক্য, আধুনিক প্রকাশভঙ্গী ও কঠিন পরিভাষার পরিবর্তে সাধারণের বোধগম্য ভাষা ব্যবহার করার কারণে তাঁদের চিন্তার ব্যাপক প্রচার হয়। তাঁরা মাত্র গুটিকয়েক ব্যক্তিকে নয় বরং বিভিন্ন জাতিকে সামগ্রিক ভাবে প্রভাবিত করেন। পুরাতন মানসিকতা, নৈতিকবৃত্তি ও রীতি প্রকৃতি, শিক্ষাব্যবস্থা, জীবনাদর্শ ও জীবনব্যবস্থা এবং তমদ্দুন ও রাজনীতির সমগ্র ব্যবস্থার মধ্যে তাঁরা আমূল পরিবর্তন সাধন করেন। এ যুগেই ফরাসী বিপ্লব সাধিত হয়। এ থেকে একটি নতুন সভ্যতার জন্ম হয়। এ যুগেই যন্ত্রের আবিষ্কারের ফলে শিল্পক্ষেত্রে বিপ্লব সাধিত হয়। যার ফলে একটি নতুন তমদ্দুন, নতুন শক্তি, নয়া জীবন সমস্যার উদ্ভব হয়। এ যুগেই ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প অসাধারণ উন্নতি লাব করে। এর ফলে ইউরোপ এমন সব শক্তির অধিকারী হয়, যা ইতোপূর্বে আর কোন জাতির ছিলনা। এ যুগেই পুরাতন যুদ্ধনীতি স্থলে নয়ানীতি, নয়া যুদ্ধার্থ ও যুদ্ধপদ্ধতির প্রচার হয়। দস্তুরমত ড্রিলের মাধ্যমে সৈন্যদেরকে সংগঠিত করার পদ্ধতি গৃহীত হয়। এর ফলে যুদ্ধক্ষেত্রে সেনাদল মেশিনের ন্যায় আন্দোলিত হতো এবং পুরাতন পদ্ধতিতে শিক্ষিত সেনাদল তাদের মোকাবিলায় টিকতে পারতো না। সৈন্যদের ট্রেনিং, সেনাদল বিভাগ ও যুদ্ধ কৌশলের মধ্যে বিপুল পরিবর্তন সাধিত হয় এবং প্রতিটি যুদ্ধের অভিজ্ঞতার আলোকে এ শিল্পটাকে অনবরত উন্নত করার প্রচেষ্টা চলতে থাকে। অনবরত আবিষ্কারের মাধ্যমে যুদ্ধাস্ত্রের মধ্যে বিরাট পরিবর্তন সাধিত হয়। রাইফেল আবিষ্কার হয়। হাল্কাও দ্রুত বহনকারী মেশিনগান তৈরি করা হয়। কেল্লা ধ্বংসকারী মেশিনগান পূর্বের চাইতে শক্তিশালী করে তৈরি করা হয় এবং সর্বোপরি কার্তুজের আবিষ্কার, বন্দুকের মোকাবিলায় পুরানো পাউডার বন্দুককে একেবারেই অকেজো প্রমাণ করে। এ কারণেই ইউরোপে তুর্কীদেরকে এবং উপমহাদেশে দেশীয় রাষ্ট্রগুলোকে আধুনিক পদ্ধতিতে সুশিক্ষিত ও আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত সেনাবাহিনীর মোকাবিলায় অনবরত পরাজয় বরণ করতে হয় এবং মুসলিম জাহানের কেন্দ্রস্থলে হামলা করে নেপোলিয়ন মুষ্টিমেয় সেনাবাহিনীর সাহায্যে মিশর দখল করে নেয়।
সমকালীন ইতিহাসের পাতায় মোটামুটি একটু দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে এ কথা সহজেই পরিস্ফুট হবে যে, আমাদের এখানে কতিপয় ব্যক্তি জাগ্রত হন। এখানে জীবনের মাত্র একটি দিকে সামান্য কাজ হয়। কিন্তু সেখানে জীবনের প্রতিটি দিকে হাজার গুণ বেশী কার্য সম্পাদিত হয়। বরং জীবনের এমন কোন দিক ছিল না যেখানে দ্রুত অগ্রগতি সাধিত হয়নি। এখানে শাহ ওয়ালিউল্লাহ ও তাঁর পুত্রগণ এবং তাঁর শিষ্যগণ বিশেষ শাস্ত্রে কতিপয় কিতাব লিখেন। তাঁদের এ চিন্তাগুলো অত্যন্ত সীমিত পরিবেশে পৌঁছেই আটকে থাকে। আর সেখানে প্রতিটি বিদ্যা শিল্পের উপর বই লিখে লাইব্রেরির পর লাইব্রেরি ভর্তি করা হয়। তাদের চিন্তাসমূহ সমগ্র দুনিয়ায় পরিব্যাপ্ত হয়। অবশেষে মানুষের মন মগজের উপর আধিপত্য বিস্তার করে। এখানে দর্শন, নৈতিক চরিত্রনীতি, সমাজনীতি, রাজনীতি, অর্থনীতি প্রভৃতি শাস্ত্রের ভিত্তিতে নয়া বুনিয়াদ স্থাপনের আলোচনা নেহায়েত প্রাথমিক পর্যায়ে থাকে। পরবর্তীকালে তার ওপর আর কোন কাজ হয়নি। আর সেখানে ইত্যবসরে এইসব সমস্যার ওপর পূর্ণাঙ্গ চিন্তাধারা গড়ে ওঠে। এই চিন্তাধারা সমগ্র বিশ্বের চিত্র পরিবর্তিত করে। এখানে শারীরবিদ্যা ও বস্তু শক্তি সম্পর্কিত বিদ্যা পাঁচশ বছর আগের ন্যায় একই পর্যায়ে অবস্থান করে। আর সেখানে এই ক্ষেত্রে এতবেশী উন্নতি এত বেশী বেড়ে যায় যে, তাদের মোকাবিলায় পুরাতন যুদ্ধাস্ত্র ও যুদ্ধোপকরণের জোরে সাফল্য লাভ করা একেবারেই অসম্ভব ছিল। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো এই যে, শাহ ওয়ালিউল্লাহর যুগে ইংরেজরা বাংলাদেশে বিস্তার লাভ করেছিল এবং এলাহাবাদ পর্যন্ত তাদের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিল। কিন্তু শাহ সাহেব এই নয়া উদীয়মান শক্তিটির ব্যাপারে কোন খোঁজখবর নেননি। শাহ আবদুল আজিজের যুগে দিল্লীর ইংরেজদের নিকট থেকে পেনশন লাভ করতো আর প্রায় সমগ্র ভারতবর্ষের ওপর ইংরেজদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু অগ্রসর হচ্ছে এবং এই নয়া শক্তির পেছনে কোন শক্তি কার্যকরী আছে? সাইয়েদ সাহেব ও শাহ ইসমাঈল শহীদ কার্যত: ইসলামী বিপ্লব সৃষ্টি করার জন্য কর্ম ক্ষেত্রে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তাঁরা যাবতীয় ব্যবস্থা ও আয়োজন সম্পন্ন করেন। কিন্তু জ্ঞানী ও বিচক্ষণ আলেমদের একটি দলকে ইউরোপে প্রেরণ করতে পারেননি যারা গিয়ে অনুসন্ধান চালাতেন যে, কোন শক্তির জোরে এ জাতিটি তুফানের বেগে অগ্রসর হচ্ছে এবং নয়া যুদ্ধাস্ত্র, নয়া উপকরণ, নয়া পদ্ধতি ও নয়া জ্ঞান বিজ্ঞানের সাহায্যে অভিনব শক্তি ও উন্নতি লাব করছে? এর কারণ কি? তারা নিজেদের দেশে কোন ধরনের প্রতিষ্ঠান কায়েম করেছে? তারা কোন ধরণের জ্ঞান বিজ্ঞানের অধিকারী? তাদের তমদ্দুন কিসের ভিত্তিতে গড়ে উঠছে? এবং তার মোকাবিলায় আমাদের নিকট কোন জিনিষের অভাব আছে? যখন তাঁরা জিহাদের অবতীর্ণ হন, তখন একথা কারুর অবিদিত ছিলনা যে, উপমহাদেশে শিখদের নয় ইংরজদের শক্তি হলো আসল শক্তি, আর ইংরেজদের বিরোধিতাই ইসলামী বিপ্লবের পথে সবচেয়ে বড় বিরোধিতা হতে পারে। এ ক্ষেত্রে ইসলাম ও জাহেলিয়াতের সংঘর্ষের চরম সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বে প্রতিদ্বন্দ্বীর মোকাবিলায় নিজেদের শক্তির পরিমাপ করা বরং নিজেদের দুর্বলতাসমূহ চিহ্নিত করে সবগুলো দূর করার প্রচেষ্টা চালানো উচিৎ ছিল। আমি বুঝতে পারিনা, এই বুজুর্গদের দূরদর্শী দৃষ্টি থেকে পরিবেশের এ গুরুত্বপূর্ণ দিকটি প্রচ্ছন্ন রইল কেমন করে? বলাবাহুল্য, এ ধরণের ভুলের ফলাফল থেকে তাঁরা নিষ্কৃতি পেতে পারেন না। আসুন, পাশ্চাত্য জাহেলিয়াতের মোকাবিলায় ইসলাম পুনরুজ্জীবনের এ আন্দোলনটি যে ব্যর্থতার সম্মুখীন হয় তা থেকে আমরা শিক্ষা গ্রহণ করি যে, ইসলাম পুনরুজ্জীবনের জন্য নিছক এলমকে পুনরুজ্জীবিত ও শরীয়তের প্রাণ শক্তিকে সঞ্জীবিত করাই যথেষ্ট নয় বরং একটি ব্যাপক ও বিশ্বজনীন ইসলামী আন্দোলন প্রয়োজন। এ আন্দোলন সমস্ত জ্ঞান বিজ্ঞান, চিন্তা শিল্প- বাণিজ্য তথা জীবনের সকল বিভাগে নিজের প্রভাব পরিব্যাপ্ত করবে এবং সকল সম্ভাব্য শক্তিকে ইসলামের সেবায় নিয়োজিত করবে।
সমাপ্ত
গ্রন্থপঞ্জী
১. ওয়াহাবী আন্দোলন –আবদুল মওদুদ
২. সৈয়দ আহমদ শহীদ(রহঃ)
৩. দি ইন্ডিয়ান মুসলমানস –ডাব্লিউ. ডাব্লিউ. হান্টার
৪. শায়খ আবদুল ওয়াহহাব নজদীর জীবনী
৫. ইসলামী রেনেসাঁ আন্দোলন- সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী
৬. মর্দে মুজাহিদ যুগে যুগে- বদরে আলম
৭. শহীদ হাসানুল বান্নার ডায়েরী- খলিল আহমদ হামিদী