ইসলামের দৃষ্টিতে জন্ম নিয়ন্ত্রন
সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদী (র)
বর্তমান পরিস্থিতি
পাক-ভারত উপমহাদেশে গত সিকি শতকের মধ্যে জন্মনিয়ন্ত্রণ (Birth Control)- এর আন্দোলন ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। [এখন এ আন্দোলনের নাম ‘পরিবার পরিকল্পনা’ (Planned Parent hood)। আমেরিকায় সর্বপ্রথম এ পরিভাষা ব্যবহার করা হয় এবং ধীরে ধীরে এ আন্দোলন এ নামে পরিচিত হয়ে পড়ে। ১৯৪২ সালে আমেরিকায় জন্মনিয়ন্ত্রণ সংস্থাগুলোর ফেডারেশনের নাম Birth Control Federation of America (আমেরিকার জন্মনিয়ন্ত্রণ ফেডারেশন) থেকে পরিবর্তন করে Planned Parent hood Federation of America (আমেরিকার পরিবার পরিকল্পনা ফেডারেশন নামকরণ করা হয়য়। (Encyclopedia Britanica, 1955, Vol. 3.)]। এর সমর্থনে প্রচার কার্য চালানো, মানুষকে এর প্রতি আকৃষ্ট ও এর বাস্তব কর্মপন্থা সম্পর্কে তথ্য সরবরাহ করার জন্যে সংস্থা কায়েম করা হয়েছে এবং পুস্তিকাদিও ছাপানো হয়েছে। সর্বপ্রথম লন্ডন বার্থ কন্ট্রোল ইন্টারন্যাশনাল ইনফরমেশন সেন্টারের ডাইরেক্টর মিসেস এডিথ হো মার্টিন (Mrs. Edith How Martyn) এ আন্দোলনের প্রচারের জন্যে এদেশ সফর করেন। পুনরায় ১৯৩১ সালে আদমশুমারীর কমিশনার ডাঃ হাটন (Dr. Hutton) তাঁর রিপোর্টে ভারতের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে কার্যকরী ব্যবস্থা অবলম্বনের জন্যে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। ভারত সরকার সে সময় উক্ত প্রস্তা বাতিল করে দিলেও মহিলাদের এক নিখিল ভারত সংস্থা লক্ষ্ণৌয়ে অনুষ্ঠিত এক অধিবেশনে এর সমর্থনে একটি প্রস্তাব পেশ করে। করাচী ও বোম্বাই পৌরসভায় এর বাস্তব শিক্ষা প্রচারের ব্যাপারে আলোচনা করা হয়। মহীশূর, মাদ্রাজ ও অন্যান্য কতিপয় স্থানে এজন্যে ক্লিনিক স্থাপন করা হয়। এসব ব্যাপার থেকে পরিষ্কার বোঝা গেলো যে, পাশ্চাত্য দেশ থেকে আগত নানাবিধ বিষয়ের সঙ্গে এ আন্দোলনও নিশ্চিতরূপে এদেশে বিস্তার লাভ করবে। এরপর হিন্দুস্থান ও পাকিস্তান দুটি আজাদ রাষ্ট্রে পরিণত হয় এবং উভয় দেশ নিজ নিজ জাতীয় কার্যসূচীর মধ্যে এ বিষয়টিকে শামিল করে নেয়।
হিন্দুস্থান নিজেকে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র বলেই দাবী করে। তাই তার কোন জাতীয় কর্মসূচীর জন্যে ধর্মীয় অনুশাসনের সমর্থন জরুরী নয়। কিন্তু পাকিস্তান আল্লাহর রহমতে একটি ইসলামী রাষ্ট্র। এজন্যেই এখানে এ আন্দোলনকে ইসলামী আদর্শের সাথে পূর্ণ সামঞ্জস্যশীল বলে প্রমাণ করার চেষ্টা চলছে। এর পরও যদি ইসলামী আইন-কানুন সম্পর্কে অভিজ্ঞ ব্যক্তিগণ নীরব থাকে তাহলে এর অর্থ এই দাঁড়াবে যে, সত্য সত্যই ইসলাম জন্মনিরোধের সমর্থক অথবা অন্ততপক্ষে একে বৈধ মনে করে।
এ বিভ্রান্তি নিরসনের উদ্দেশ্যেই এ পুস্তক লেখা হলো। কিন্তু ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে এ বিষয়টি আলোচনা করার পূর্বে জন্মনিয়ন্ত্রণ আন্দোলনটির স্বরূপ জানা অত্যন্ত প্রয়োজন। এ আন্দোলন কিভাবে শুরু হলো, কি উপায়ে বিস্তার লাভ করলো এবং যেসব দেশে এ নীতি অনুসৃত হয়েছে সেখানে এর ফলাফল কি, এসব বিষয় ভালভাবে জানা দরকার। এসব সামাজিক বিষয় পুরোপুরি অবগত না হলে ইসলামী শরীয়তের সিদ্বান্ত যথাযথভাবে হৃদয়ংগম করা সম্ভব হবে না এবং ঐ সিদ্বান্ত সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া সম্ভবপর নয়। এজন্যে প্রথমে আমি এসব বিষয়েই আলোকপাত করবো এবং পরে এ সম্পর্কে ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গী পেশ করবো। এই সঙ্গে পরবর্তী পৃষ্ঠাগুলোতে আমি যেসব তথ্য পেশ করবো, দেশের সুধীসমাজ, শাসন কর্তৃপক্ষ ধীর-স্থির ভাবে সেগুলো বিবেচনা করে দেখবেন বলে আমি আশা করি। সমষ্টি জীবনের সমস্যাবলী এত জটিল যে, কোন এক বিশেষ দৃষ্টিভংগীতে চিন্তা করা এবং একমাত্র সমাধান পেশ করে দিয়ে ক্ষান্ত থাকা কিছুতেই কল্যাণকর হতে পারে না। একটি সমষ্টিগত সমাধানের জন্যে সংশ্লিষ্ট সকল দিকে সামগ্রিক দৃষ্টি নিক্ষেপ করা এবং আলোচনা ও বিতর্কের পথ বন্ধ না করাই সমীচীন। কোন জাতীয় সমস্যা সম্পর্কে বিশেষ নীতি গৃহীত হয়ে থাকলেও বিষয়টি সম্পর্কে চিন্তা-গবেষণা ও পূনর্বিবেচনা করা যাবে না বলে মনে করাও ভুল।