জন্ম নিয়ন্ত্রণের কুফল
বিগত ১০০ বছরের অভিজ্ঞতায় জন্মনিয়ন্ত্রণের যেসব ফলাফল দেখা দিয়েছে তাও আলোচনা করা দরকার। যে আন্দোলন বিভিন্ন দেশ ও জাতির মধ্যে দ্রুতগতিতে প্রসার লাভ করেছে এবং যার ফলাফল বরাবর অভিজ্ঞতায় ধরা পড়েছে তার ভাল-মন্দ সম্পর্কে মতামত গঠন করার জন্যে একশত বছরের অভজ্ঞতাই যথেষ্ট। জন্মনিয়ন্ত্রণকারী দেশগুলোর মধ্যে ইংলন্ড ও আমেরিকাকে আদর্শ দেশ হিসেবে গ্রহণ করা যায়। কেননা, আমাদের নিকট অন্যান্য দেশের তুলনায় এ দু’দেশে সমৃদ্ধি ও তথ্য অনেক বেশী পরিমাণে আছে। আর অন্যান্য দেশের সঙ্গে এ দু’দেশের পার্থক্যও খুব বেশী নয়।
১. বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যস্থিত ভারসাম্য নষ্টঃ
ইংলণ্ডের রেজিষ্টার জেনারেলের রিপোর্ট, ন্যাশনাল বার্থ কন্ট্রোল কমিশনের অনুসন্ধান এবং জনসংখ্যা সম্পর্কিত রয়েল কমিশনের রিপোর্ট দেখে জানা যায় যে, উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যেই জন্মনিয়ন্ত্রণ সব চাইতে বেশী প্রচলিত। বেশীর ভাগই উচ্চ বেতন ভোগী কর্মচারী, উচ্চ শিক্ষিত ব্যবসায়ী, মধ্যবিত্ত সচ্ছল লোক এবং ধনী, শাসক, ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিগণই জন্মনিরোধ অভ্যাস করে থাকে। আর নিম্ন শ্রেণীর মজুর ও শ্রম পেশা লোকদের মধ্যে জন্মনিরোধ প্রথা না থাকারই শামিল। এদের জীবন যাত্রার মান উন্নত হয়নি, এদের মনে উচ্চাশাও নেই এবং ধনীদের মত জাক-জমকপূর্ণ সামাজিকতার প্রতিও এদের কোন লোভ নেই। এদের সমাজে এখনও পুরুষ উপার্জনকারী এবং নারী গৃহকর্ত্রী। এ প্রাচীন প্রথাই এখনো এখানে প্রচলিত আছে। আর এ কারণেই এরা আর্থিক অসচ্ছলতা, নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির অগ্নি মূল্য এবং গ্রহসমস্যা সত্ত্বেও জন্মনিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন বোধ করে না। এদের মধ্যে জন্মহার হচ্ছে প্রতি হাজারে ৪০ জন। অপর দিকে উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে জন্মহার এত কমে গিয়েছে যে, ইংল্যাণ্ডের মোট জন্মহার ১৯৫৪ সালে হাজার প্রতি ১৫৫.৩ জন ছিল। কায়িক পরিশ্রমকারীদের পরিবারগুলো বৃহদাকৃতির। সাম্প্রতিক সংখ্যাতত্ত্ব থেকে জানা যায় যে, ১৯০০ থেকে ১৯৩০ সালের মধ্যে যেসব বিয়ে হয়েছে তার মধ্যে, শ্রমিক পরিবারগুলোর শতকরা ৪০টিই হচ্ছে বড় পরিবার। (Britain: An Official Handbook, 1954,page-8)
জনসংখ্যা বিষয়ক মার্কিন বিশেষজ্ঞ প্রফেসার ওয়ারেন থম্পসন ইংল্যাণ্ড, আমেরিকা, জার্মানী, ফ্রান্স ও সুইডেনের জনসংখ্যার শ্রেণী ভিত্তিক পর্যালোচনা করে এ সিদ্ধান্তে পৌছেছেঃ-
“ কায়িক শ্রমকারী লোক ও শ্বেতাংগ চাকুরীজীবীদের মধ্যে তুলনামূলক ভাবে প্রথম গ্রুপের প্রজনন শক্তিই বেশী। কায়িক শ্রমকারীদের মধ্যেও কৃষক ও অন্যান্য শ্রমিকদের তুলনায় কৃষক শ্রেণীর প্রজনন শক্তি বেশী। কৃষকদের বাদ দিয়ে অপরাপর শ্রমিকদের বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে তুলনা করে দেখা যায় যে, যারা কারিগরিতে বিশেষজ্ঞ নয় এবং যাদের কাজ কঠিন ও নিম্নশ্রেণীর এবং জীবন যাত্রার মান যাদের নিম্ন তাদের প্রজনন ক্ষমতা বেশী।
…… শিক্ষার মাপকাঠিতে বিচার করলে দেখা যাবে যে অল্প শিক্ষিত লোকদের পরিবার উচ্চ শিক্ষিতদের তুলনায় অনেক বড়।” (Thompson Warren.S. Population Problem, New York, 1953.pp. 19195.
এর ফলে জন্মনিন্ত্রণকারী সমাজের দৈহিক পরিশ্রমকারীদের সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে এবং যারা অধিক বুদ্ধি ও বিবেচনার অধিকারী, যাদের কর্ম পরিচালন ও নেতৃত্ব দানের যোগ্যতা রয়েছে তাদের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। কোন জাতির জন্য এ ধরণের অবস্থা অত্যন্ত বিপজ্জনক। কারণ, এর অনিবার্য পরিণতি হচ্ছে নেতৃত্বদানকারী লোকের অভাব। আর নেত্ত্রিত্বদানকারী লোকের অভাব দেখা দিলে কোন জাতিই নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারে না। জন্মনিরোধকারী দেশগুলো বর্তমানে যোগ্যতা সম্পন্ন শ্রেণীর অভাব, সাধারণ ভাবে বুদ্ধি ও বিচক্ষণতার অধোগতি এবং নেতৃত্বের অভাব ইত্যাদি ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে। এ জন্য সে সব দেশের চিন্তাবিদগণ অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। অলডাস হাক্সলী (Aldous Huxley) সম্প্রতি প্রকাশিত তাঁর পুস্তক Brave New World Revisited (ব্রেভ নিউ ওয়ার্ল্ড রিভিজিটেড)- এ বলেন, “আমাদের কার্যকলাপের ফলে আমাদের বংশবৃদ্ধি জৈবিক দিক দিয়ে নিশ্চিতভাবে অত্যন্ত নিম্নমানের হতে চলেছে।” ( Huxley, Aldous, Brave New World Revisited, 1959 page-127). ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তিনি বলেনঃ “নতুন ঔষধপত্র ও উচ্চতর চিকিৎসার প্রচলন সত্বেও (এবং আংশিকভাবে এদের কারণেও) সাধারণ অধিবাসীদের স্বাস্থ্যের মান জীবনতত্ত্বের নিয়ম মাফিক যে শুধু উন্নত হয় না তাই নয়- বরং নিম্ন হয়ে যাচ্ছে। যার স্বাস্থ্যের মান নিম্ন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে- সাধারণ বুদ্ধিমত্তার মানও হ্রাস পাওয়া স্বাভাবিক।” (Huxley, Aldous, Brave New World Revisited, 1954, Page-28.
হাক্সলী জনৈক জীবতত্ত্ব বিশেষজ্ঞের (ডাক্তার সিল্ডান) মতামত নিম্ন ভাষায় উদ্বৃত করেনঃ ‘বর্তমান অবস্থায় উচ্চশ্রেণীর লোকদের তুলনায় নিম্ন শ্রেণীর লোক সংখ্যা অধিক পরিমাণে বেড়ে চলেছে। মানব বংশ বৃদ্ধির ধারণা এ ধরনের ভ্রান্তি ও বক্রগতি জীব-বিজ্ঞান মুতাবিক একটি বুনিয়াদী সত্য বৈ আর কিছু নয়।’
সিল্ডান এ কথাও বলেন যে, আমেরিকার চিকিৎসা বিজ্ঞানের পরীক্ষা-নিরীক্ষা থেকে জানা গিয়েছে যে, ১৯১৬ সালের তুলনায় সাধারণ বুদ্ধিমত্তার মান বর্তমানে অনেক নিম্ন।
ইংল্যাণ্ডের বিখ্যাত চিন্তাবিদ বারট্রাণ্ড রাসে অত্যন্ত উদ্বেগের সঙ্গে (অথচ অত্যন্ত মজার ব্যাপার এই যে, রাসেল ও হাক্সলী দু’জনেই জন্মনিরোধ- বিশেষত প্রাচ্যে এর ব্যাপক প্রসারের ঘোর সমর্থক) লিখেছেনঃ
“ফ্রান্সে বর্তমানে জনসংখ্যা স্থির অবস্থায় (Stationary) আছে অর্থাৎ একই অবস্থায় রয়েছে। এবং ইংল্যাণ্ড দ্রুতগতিতে ঐ একই অবস্থায় পৌছুচ্ছে। এর অর্থ হচ্ছে এই যে, বিশেষ এক শ্রেণীর লোক সংখ্যা কমে যাচ্ছে এবং অপর বিশেষ শ্রেণী সংখ্যা বেড়ে চলেছে। কাজেই অবস্থার কোন মৌলিক পরিবর্তন না হলে যা হবে তা হচ্ছে এই যে, যে শ্রেণী কমে যাচ্ছে তা ক্রমে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে এবং যে শ্রেণী বেড়ে চলেছে তাঁর দ্বারাই দেশ ভরে যাবে। যে শ্রেণীর লোক কমে যাচ্ছে তারা হচ্ছে-দক্ষ কারিগর এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণীর লোক। বুদ্ধিমত্তার দিক থেকে যারা সর্বোচ্চ শ্রেণীর তাদের সংখ্যা প্রতিদিনই কমে যাচ্ছে। এর অর্থ হচ্ছে এই যে, আমাদের বংশধরদের প্রত্যেক শ্রেণী থেকে উত্তম অংশ নষ্ট হয়ে যায় এবং কৃত্রিম উপায়ে এতে বন্ধাত্ব সৃষ্টি করা হয়। অন্তত যারা বৃদ্ধি পায় তাদের তুলনায় যারা কমে যায় তাদের অবস্থা ঠিক উল্লেখিত ধরনেরই হয়।” (Russel Bertrand: Principles of Social Reconsrtuctions, 1951. Page24.)
ভবিষ্যৎ বিপদ সম্পর্কে হুশিয়ার করার উদ্দেশ্যে রাসেল আরও লিখেনঃ
“ইংল্যাণ্ডের অধিবাসীদের মধ্য থেকে নমুনাস্বরুপ কিছু সংখ্যক শিশু বাছাই করে নিয়ে যদি মাতা পিতার (পরিসংখ্যান বিভাগের একটি বিশেষ পরিভাষা মাফিক পর্যালোচনা করে সকল গ্রুপের প্রতিনিধিত্বশীল একদল লোক বাছাই করে নেওয়াকেই Sample বা নমুনা গ্রহণ বলে) অবস্থা পর্যালোচনা করা হয় তাহলে জানা যাবে যে, বোধশক্তি, দৈহিকশক্তি ও বুদ্ধি-জ্ঞানের আধুনিকতায় এরা সাধারণ অধিবাসীদের তুলনায় নিম্নমানের; আর নিষ্ক্রিয়তা, নির্বুদ্ধিতা, চিন্তাশক্তিহীনতা ও সংস্কার আসক্তির ব্যাপারে এরা সকলের উর্ধে। আমরা আরও জানতে পারি যে, বোধশক্তি সম্পন্ন সক্রিয় মেধাবী ও প্রগতিশীল শ্রেণী তাদের সমসংখ্যক সন্তান জন্মাতে পারছে না।
অন্য কথায়, সাধারণত এ শ্রেণীর লোকদের গড়ে দু’টি করে সন্তাত জীবিত থাকে না। পক্ষান্তরে নিম্নশ্রেণীর লোকেরা উচ্চশ্রেণীর সম্পূর্ণ বিপরীত, এদের পরিবারে দু’টির বেশী সন্তান জন্মায় এবং বংশবৃদ্ধির মারফত এরা বরাবর নিজেদের সংখ্যা বাড়িয়ে যায়। (Russel Betrand, Principles of Social Reconstruction. pp. 124 125 ).
পুনরায় এ পরিবর্তনের প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা প্রসংগে রাসেল বলেন যে, সমাজের উচ্চ শ্রেণীর লোক সংখ্যা অস্বাভাবিক হ্রাস প্রাপ্তির পরিণাম স্বরুপঃ
(১) ইংরেজ, ফরাসী এবং জার্মান জাতির লোক-সংখ্যা অনবরত কমে যাচ্ছে।
(২) লোক-সংখ্যা কমে যাওয়ার দরুন এসব জাতির উপর অপেক্ষাকৃত কম সভ্য জাতির প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে এবং এদের উচ্চমানের রীতিনীতি খতম হয়ে যাচ্ছে।
(৩) এসব জাতির মধ্যে যাদের সংখ্যা বাড়ছে তারা নিম্নশ্রেণীর লোক এবং দুরদর্শিতা ও বুদ্ধিমত্তার সাথে এদের কোন সম্পর্ক নেই।
এ সম্পর্কে রাসেল বর্তমান অবস্থাকে রোমীয় সভ্যতার সঙ্গে তুলনা করে বলেন যে, ঐ সভ্যতার ধ্বংসের মূলেও এ ধরনের কার্যকারণই বিদ্যমান ছিল। তিনি বলেনঃ দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ ঈসায়ী শতাব্দীতে রোম সাম্রাজ্যে কর্মক্ষম জনসমাজেও বুদ্বিমত্তার যে অধঃগতি দেখা দেয় তা চিরকালই অবোধগম্য রয়ে গেছে। তবু আজকের দুনিয়ায় আমাদের সভ্যতায় যা কিছু ঘটছে- সে যুগেও ঠিক ঐ ধরণেরই ব্যাপার ঘটেছিল বলে বিশ্বাস করার সংগত কারণ রয়েছে। অর্থাৎ রোমীয়দের প্রত্যেক স্তরের উত্তম লোকগণ তাদের সম-সংখ্যক সন্তান জন্মাতে ব্যর্থ হয় এবং যাদের কর্মশক্তি ছিল না তারাই হয় জনসংখ্যার বৃহত্তম অংশ।” (রাসেলের পূর্বোলেখিত পুস্তক. ১২৬)
এসব আলোচনার পর জন্মনিয়ন্ত্রণের সমর্থক রাসেলের মত চিন্তাবিদও এ সিদ্ধান্তে উপনীত হন যেঃ
“এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, আমাদের বর্তমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ও নৈতিক মানদণ্ড পরিবর্তিত না হলে সকল সভ্য দেশে পরবর্তী দু-তিন স্তরের বংশধরদের নৈতিক মান নিকৃষ্টতম পর্যায়ে পৌছবে এবং সভ্য লোকদের সংখ্যা শোচনীয়ভাবে হ্রাস প্রাপ্ত হবে। ……… এ পরিণতি থেকে রক্ষা পেতে হলে আমাদের জন্মহারে প্রচলিত অশুভ নির্বাচন পদ্বতিকে (অর্থাৎ উচ্চশ্রেণীর বৃদ্ধিকারী পন্থা নির্বাচনের পদ্ধতি) (Sefectiveness)-কেননা কোন উপায়ে বন্ধ করতে হবে।”
এভাবে জন্মনিয়ন্ত্রণের কল্যাণে একদিকে সমাজের শ্রেণীগত ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায় এবং কর্মদক্ষ শ্রেণীর সংখ্যা ক্রমশঃ কমে যায়- অপর দিকে সমাজে শিশু ও বৃদ্ধদের অনুপাত বিকৃত হয়ে অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে অত্যন্ত সুদূর প্রসারী ও উদ্বেগজনক অবস্থা সৃষ্টি করে। সমগ্র জনসংখ্যায় শিশুদের অনুপাতের তুলনায় বৃদ্ধদের অনুপাত অনেক বেড়ে যায় এবং এর ফলে স্বাভাবিক পন্থায় জাতির দেহে নয়া রক্ত সঞ্চয়ের পদ্ধতি ব্যাহত হয়। শিশুদের সংখ্যা হ্রাস প্রাপ্তির দরুন ব্যবহার্য দ্রব্যের চাহিদাই শুধু হ্রাস পায় না; পরন্ত সমগ্র জাতির কর্মশক্তি, উদ্যম ও প্রেরণার স্থলে নিষ্ক্রিয়তা ও স্থাবিরতা স্থান পায়। বিপদের মোকাবিলা করা এবং প্রয়োজনের সময় জান-প্রাণ দিয়ে কাজ করার প্রেরণা খতম হয়ে যায়। এর ফলে জাতির বিপুল সংখ্যক লোক শুধু ছককাটা পথে চলতে অভ্যস্ত হয়ে যায়। এ ব্যবস্থা ক্রমে ক্রমে একটি জাতিকে জ্ঞান, জীবিকা ও বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ঐ সব জাতির অনেক পেছনে ফেলে দেয় যারা স্বাভাবিক পদ্ধতিতে নতুন সন্তান জন্মায় এবং যাদের বিপুল সংখ্যক যুবক জাতির আশা-আকাংখ্যাকে উচ্চস্তরে পৌছিয়ে দেয়।
পাশ্চাত্য দেশসমূহে জন্মনিয়ন্ত্রণের ফলে যে হারে শিশু ও যুবকদের সংখ্যা কমে যাচ্ছে এবং বৃদ্ধদের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে তাঁর স্বাভাবিক কুফল দেখা দিতে শুরু করেছে। প্রত্যেক চক্ষুষ্মান ব্যক্তিই নিজের চোখে এসব দেখতে পারেন। গত ৭০ বছরে যে অবস্থা দাঁড়িয়েছে পরের পৃষ্টায় প্রদত্ত চার্টই তাঁর জ্বলন্ত প্রমাণঃ
এ সব দেশে জনসংখ্যার আভ্যন্তরীণ অবস্থায় যে পরিবর্তন হচ্ছে, কোন দেশেই এ থেকে বাদ পড়ছে না। সম্প্রতি জাতিসংঘ জনসংখ্যার এই ভারসাম্যহীনতার গতিধারা সম্পর্কে একটি অনুসন্ধান জনিত রিপোর্ট প্রকাশ করেছে এবং এতে এ বিষয়ে উদ্বেগজনক তথ্য পরিবেশন করেছে। (The Aging Population and Its Social Implication United Nations Department of Economic and Social Afiairs, New York, 1956.) এ রিপোর্ট পরিবেশিত সংখ্যাতত্ত্ব থেকে জানা যায় যে, ১৯০০ এবং ১৯৫০ সালের মধ্যে জনসংখ্যায় ৬৫ বৎসরের উর্ধ্ব বয়স্কদের সংখ্যা যদি ১০০ ধরে নেয়া যায় তা হলে ১৯৫০ সালে এদের সংখ্যা নিম্নরূপ দাঁড়ায়।
নিউজিল্যাণ্ড- ২৩৬
বৃটেন- ২৩১
অষ্ট্রিয়া- ২১২
আমেরিকা- ২০০
জার্মানী- ১৯০
বেলজিয়াম- ১৭৩
ফ্রান্স- ১৪৪
রিপোর্টে এ কথাও প্রকাশ করা হয়েছে যে, জনসংখ্যার অনুপাত পরিবর্তনে গর্ভধারণ ক্ষমতা ও জন্মহার পরিবর্তনের প্রভাব বেশী। এ ব্যাপারে জন্মহার যে প্রভাব বিস্তার করতে পারে মৃত্যুহার তা পারে না (উল্লেখিত পুস্তক ২২ পৃষ্টা)।
এ বিষয়টি (বৃদ্ধদের সংখ্যা বৃদ্ধি) অত্যন্ত প্রভাবশালী এবং অর্থবোধক। অর্থাৎ পরিণত বয়স্কদের সংখ্যা বৃদ্ধির অর্থ হচ্ছে এই যে, মৃত্যুহার বৃদ্ধি পাবে এবং জন্মহার হ্রাস পাবে। এছাড়া যুবকদের তুলনায় বৃদ্ধ লোকের অর্থনৈতিক ও সম্পদ উৎপাদনের ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত কম উপযোগী (অধ্যাপক থম্পসনের উল্লেখিত পুস্তক ৯৫ পৃষ্টা)।
অর্থনৈতিক কাঠামো সুষ্ঠু ভিত্তিতে উন্নত করার জন্য বৃদ্ধ ও যুবকদের সংখ্যায় এক বিশেষ ভারসাম্যমূলক অনুপাত থাকা দরকার যেন সভ্যতার গাড়ীকে যারা চালিয়ে নিয়ে যাবে তাদের হাত কখনও দুর্বল না হয়ে যায়। প্রকৃতি এর সুষ্ঠু ব্যবস্থাই করে রেখেছে। কিন্তু জন্মনিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে প্রকৃতির আওতায় হস্তক্ষেপ করার দরুন স্বাভাবিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়। বৃদ্ধদের সংখ্যা অব্যাহত গতিতে বেড়ে যায় এবং যুবকদের সংখ্যায় প্রয়োজনীয় বৃদ্ধির অভাবহেতু প্রতিকুল অনুপাত সৃষ্টি হয়। এর পরিণতি হচ্ছে কর্মী লোকদের অভাব। জাতীয় শক্তির অধঃপতন এবং অর্থনৈতিক শক্তির দূর্বলতা। অতঃপর যুবকদের অনুপাত হ্রাসের সঙ্গে সঙ্গে কর্মী ও জনসংখ্যার অভাব শামিল হলে একটি জাতি শাসক থেকে শাসিত এবং উন্নত ও সম্মানজনক স্থান থেকে অবনত ও অবমাননাকারীদের কখনো ক্ষমা করে না। এই বিদ্রোহের মধ্যেই এমন সব বিষয় লুক্কায়িত থাকে যা অবশেষে অপরাধের সাজা দানকারীর ভূমিকায় অবতরণ এবং অন্যদের শিক্ষা গ্রহণ করার জন্যে যথেষ্ট উপাদান সরবরাহ করে।
(****************আরবী )
“হে চক্ষুষ্মানেরা! শিক্ষা গ্রহণ কর। ”
২. ব্যভিচার ও কুৎসিত রোগের প্রসারঃ
জন্মনিয়ন্ত্রণের ফলে ব্যভিচার ও কুৎসিত রোগ প্রসারের সুযোগ হয়েছে অত্যধিক। নারী জাতি খোদাভীতি ছাড়া আরও দু’টি বিষয়ের কারণে উচ্চমানের নৈতিকতা রক্ষা করতে বাধ্য হয়। প্রথমটি হচ্ছে এদের জন্মগত স্বাভাবিক লজ্জাশীলতা। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে অবৈধ সন্তান জন্মের ফলে মায়ের সামাজিক মর্যাদা বিনিষ্ট হবার আশংকা। প্রথম প্রতিবন্ধকটি তো আধুনিক সভ্যতার বদৌলতে বহুলাংশে দূর হয়ে গিয়েছে। নাচ-গান, আমোদ-স্ফুর্তি, নৈশক্লাবে ও শরাবের মজলিশে পুরুষদের সাথে অবাধে মেলা-মেশার পর লজ্জা বহাল থাকতে পারে কি করে? বাকী ছিলো অবৈধ সন্তান জন্মানোর আশংকা। জন্মনিয়ন্ত্রণকে সর্বসাধারণ্যে প্রচারের ফলে এ প্রতিবন্ধকটুকুও আর থাকলো না। এখন নর ও নারীদের ব্যভিচারে লিপ্ত হবার প্রকাশ্য সাধারণ লাইসেন্স (O.G.L)প্রবর্তিত হয়েছে। আর ব্যভিচার বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কুৎসিত রোগ বৃদ্ধিও অপরিহার্য।
ইংল্যান্ডে প্রতি বছর ৮০ হাজারেরও বেশী সংখ্যক অবৈধ সন্তান জন্মায়। ডায়োসিজেন কনফারেন্সের (Diocesan Conference) রিপোর্ট মুতাবিক দেশে ১৯৪৬ সালে যেসব শিশু জন্মায় তাদের প্রত্যেক ৮টি শিশুর মধ্যে একটি অবৈধ ছিল এবং প্রতি বছর প্রায় এক লক্ষ নারী বিয়ে ব্যতিরেকেই গর্ভবতী হয়। ডাক্তার অসওয়াল্ড শোয়ারজ (Oswald Sehwarz) লিখেনঃ
“প্রতি বছর গড়ে ৮০ হাজার স্ত্রীলোক অবৈধ সন্তান জন্মায়। (অর্থাৎ গর্ভ ধারিণীদের মোট সংখ্যার এক তৃতীয়াংশ)। অতি সতর্কতার সঙ্গে গৃহীত হিসাব এই যে, প্রত্যেক দশজন নারীর মধ্যে একজন বিয়া ছাড়াই যৌন সম্পর্ক স্থাপন করে। এদলে যেসব নারী স্থান পেয়েছে তাদের অবৈধ সন্তান জন্মের সময় শতকরা ৪০ জনের বয়স ২০ বছরেরও কম, শতকরা ৩০ জনের বয়স ২০ বছর এবং শতকরা ২০ জনের বয়স ২১ বছর ছিলো। এ সংখ্যাতত্ত্ব অত্যন্ত উদ্বেগজনক। কিন্তু আমাদের স্মরণ রাখতে হবে যে উপরোক্ত সংখ্যা কিছু না কিছু দুর্ঘটনার ফল। জন্মনিয়ন্ত্রণের যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার পরও যারা দুর্ঘটনাবশত গর্ভবতী হয়ে পড়েছিল এ শুধু তাদেরই সংখ্যা। সুতরাং বুঝা যাচ্ছে প্রকৃতপক্ষে যে হারে ব্যভিচার হচ্ছে তার অতি নগণ্য সংখ্যাই এখানে পাওয়া গিয়েছে।” [Sehwarz Oswald, The Psychology of Sex, Pelican Book 1951]
ডাক্তার শোয়ারজ প্রদত্ত সংখ্যাতত্ত্ব থেকে জানা যায় যে, প্রতি দশ জনের মধ্যে একজন নারী পাপ কাজে লিপ্ত থাকে। কিন্তু সর্বশেষ প্রাপ্ত তত্ত্ব আরও ভায়াবহ চিত্র পেশ করে। ১৯৫৬ সালে প্রকাশিত চেসার রিপোর্ট (Chesser Report)টি ৬০০০ রমণীর নিকট থেকে সংগৃহীত তথ্যের উপর নির্ভর করে তৈরী করা হয়েছে। এতে দাবী করা হয়েছে যে, প্রতি তিনজন নারীর একজন বিয়ের পূর্বেই সতীত্ব সম্পদ হারিয়ে বসে। [Chesser, Dr. Eustace. The Sexual, Marital and Family Relationship of the English Women- 1956.] ডাঃ চেসার তাঁর “সতীত্ব কি অতীতের স্মৃতি?” শীর্ষক গ্রন্থেও এ বিষয়টি পরিস্কার ভাষায় বর্ণনা করেছে। [Chesser, “Is Cjastity Outmoded; London 1960. Page 75.]
কিনসে রিপোর্ট (Kinsey Report) থেকে আমেরিকা সম্পর্কে জানা যায় যে, সেখানে ব্যভিচার ও কুৎসিত রোগের এত আধিক্য যে, সমাজের ভিত্তিমূল নড়ে উঠেছে। পুরুষদের শতকরা ৪৭ জন এবং নারীদের শতকরা ৫০ জন বিনা দ্বিধায় অবৈধ যৌনসম্পর্ক স্থাপন করে থাকে। [Sexual Behaviour in Human Male. Page-552]
বিখ্যাত ঐতিহাসিক ও সমাজ বিজ্ঞান বিশেষজ্ঞ ডাঃ সারোকিন নিম্নবর্ণিত সংখ্যাতত্ত্ব পেশ করেন এবং অবস্থার জন্য রক্তাশ্রু বর্ষণ করেনঃ
টেবিল
++++++++++++++++++++++
এ তথ্যও কম চিত্তাকর্ষক নয় যে, জন্মনিরোধ ঔষধ ও উপকরণের (Contraceptives) বিক্রয় হার আজ আসমান বরাবর উঁচু।
এরপর সারোকিন বলেনঃ
“এ বলগাহীন যৌন উচ্ছৃংখলতার পরিণামে ব্যক্তি, সমাজ ও সমগ্র জাতি যে কী ভয়াবহ পরিণতির সম্মুখীন হবে তা প্রকাশ করা আমি দরকার মনে করি না। এর নাম যৌন আজাদী অথবা যৌন স্বৈরাচার যা-ই বলুন না কেন- এ বাস্তব সত্য তো পরিবর্তিত হতে পারে না যে, এ অবস্থায় এমন সুদূর প্রসারী প্রতিফল দেখা দেবে যে, পৃথিবীর ইতিহাসে তার নজীর পাওয়া যাবে না।” [Sorkin Pitrim A, The American Sex Revolution, Boston, 1956. Page 13-14]
কিনসের অনুমান মুতাবিক আমেরিকায় অবৈধ সন্তানের অনুপাত ৫ জনে ১ জন। কুমারী মেয়েদের সন্তান সংখ্যা শতকরা ৪ জন। এছাড়া গর্ভপাত সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য হিসাব হচ্ছে এই যে, প্রতি ৪টির মধ্যে একটি গর্ভ নষ্ট করে দেয়া হয়। বরং টাইম পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী সানফ্রান্সিসকোতে ১৯৪৫ সালে ১৬,৪০০ শিশু জন্মায় এবং ১৮,০০০ গর্ভপাত করে নষ্ট করে দেয়া হয়। [Social Problems. P.P.418-19]
এভাবে অপরাধ প্রবণতা বিশেষত যৌন অপরাধ সম্পর্কে পর্যালোচনা করলে জানা যায় যে, দিন দিন তা কেবল বেড়েই চলেছে। ইংলন্ডের যেসব দণ্ডনীয় অপরাধ পুলিশের গোচরীভূত হয়েছে তা নিম্নহারে বেড়ে চলেছে [A Survey of Social Conditions in England and Wales, Oxford, 1258 Page 266]:
১৯৩৮ সালে – ২,৮৩,০০০
১৯৫৫ সালে – ৪,৩৮,০০০
উল্লেখিত সময়ের মধ্যেই যৌন অপরাধের সংখ্যা সমগ্র অপরাধের সংখ্যার শতকরা ১.৭ থেকে শতকরা ৬.৩ এ পৌছেছে।
আমেরিকার ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেষ্টিগেশন (F.B.I)- এর সংগৃহীত তথ্য থেকে জানা যায় যে, ১৯৩৭-৩৯ এর তুলনায় ১৯৫৫ সালে ব্যভিচার শতকরা ৬০ ভাগ বৃদ্ধি পায়। অন্যান্য অপরাধের সংখ্যাও শতকরা ৫ থেকে শতকরা ৮০ ভাগ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। [Social Problem, Page 386.]
যদি সকল ধরনের গুরুত্বপূর্ণ অপরাধের হিসাব করা হয়, তাহলে জানা যায় যে, ১৯৫৮ সালে ২৩ লাখেরও বেশী সংখ্যক অপরাধ পুলিশের গোচরীভূত হয়েছে। অথচ ১৯৪০ সালে এ সংখ্যা ছিল মাত্র ১৫ লাখ। [Blaich and Baumgartner. The Challenge of Democracy, New York, 4th Edition. P.510.] কিশোরদের বখাটেপনাও দিন দিন বেড়ে চলেছে। আমেরিকার ১৪৭৩ টি শহরে ১৯৫৭ সালে যে ২০ লাখ ৯৮ হাজার লোককে বিভিন্ন অপরাধে গ্রেফতার করা হয় তন্মধ্যে ২ লাখ ৫৩ হাজার অপরাধীর বয়স ছিল ১৮ বছরের নিম্নে।
যৌন আজাদী সৃষ্ট রোগগুলি উত্তরোত্তর বেড়ে যাচ্ছে। চিকিৎসার যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা সত্ত্বেও ঐ রোগগুলি স্বাস্থ্যের উপর মারাত্মক ক্ষতিকর প্রাভাব বিস্তার করেছে।
যদি কেবল সিফিলিস রোগকে ধরা হয় তাহলে আমেরিকার পাবলিক হেলথ সার্ভিসের সার্জেন জেনারেল মিঃ থমাস প্যারানোর উক্তি অনুসারে এ অবাঞ্ছিত রোগ শিশুদের পক্ষাঘাত রোগের তুলনায় শতগুণ বেশী ধ্বংসাত্মক এবং বর্তমানে এ রোগ আমেরিকার যক্ষা, ক্যান্সার এবং নিউমোনিয়া রোগের সমান ক্ষতিকর। প্রত্যেক চারটি মৃত্যুর মধ্যে একটি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সিফিলিসের দরুন হয়ে থাকে।
অধ্যাপক পললিন্ডেস ডাঃ প্যারানোর উক্তির উদ্ধৃতি সহকারে আমাদের জানাচ্ছেনঃ
“নতুন ধরনের ঔষধের উন্নতি ও ব্যবহারের ফলে ১৯৪৭ সাল থেকে এ অবাঞ্ছিত রোগ কমে যাচ্ছিল, কিন্তু ১৯৫৫ সালে হঠাৎ গতি ফিরে যায়। আমেরিকার বড় বড় শহরে সিফিলিস এবং গনোরিয়া রোগ দ্রুতগতিতে বিস্তার লাভ করছে এবং কুড়ি বছরের নিন্ম কিশোরদলই এবার এ রোগে বেশী করে আক্রান্ত হয়েছে। প্রকৃত ব্যাপার হচ্ছে এই যে, মোট রোগীদের শতকরা ৫০ ভাগ যুবকদের মধ্যেও পাওয়া যাচ্ছে।” [Social Problems- page 313]
১৯৬১ সালের আগষ্ট মাসের ‘রিডার্স ডাইজেষ্টে, জর্জ কেন্ট এবং উইলফ্রে গোটোরেসের একটি প্রবন্ধ ছাপানো হয়। ওতে লেখকদ্বয় বলেন যে, বৃটেনের বড় বড় শহর তথা লন্ডন, বার্মিংহাম ও লিভারপুলে এ অবাঞ্ছিত রোগ দ্রুতগতিতে বেড়ে চলছে। রোগজীবাণু ধ্বংসকারী নতুন ঔষধ-পত্রের বদৌলতে এসব রোগ কিছুকাল চাপা ছিল, কিন্তু অবশেষে সাফল্য ব্যার্থতায় পরিণত হয়েছে। ১৯৫৬ সাল থেকে ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত ৪ বছর সময়ের মধ্যে এ অবাঞ্ছিত রোগ শতকরা ২০ ভাগ বেড়ে গিয়েছে। ১৯৫৯ সালে গণোরিয়া রোগে যারা নতুন আক্রান্ত হয়েছিল তাদের সংখ্যা ছিল একত্রিশ হাজার। অর্থাৎ ১৯৫৫ সালের তুলনায় শতকরা ৭০ ভাগ বৃদ্ধি। আর এ সংখ্যার মধ্যে শুধু তাদেরকেই ধরা হয়েছে যারা চিকিৎসার জন্য নির্দিষ্ট কেন্দ্রে এসেছে। যারা সাধারণ পেশাদার চিকিৎসক এবং প্রাইভেট বিশেষজ্ঞদের দ্বারা চিকিৎসা করায় অথবা যারা মোটেই চিকিৎসা করায় না তারা উপরোক্ত হিসাবের মধ্যে নেই। লেখকদ্বয় এ-ও বলেন যে, ১৯৪৮ সাল থেকে এ যাবত রোগের গতি প্রকৃতির সংখ্যাতত্ত্ব থেকে দেখা যায় যে, এক বছরে ১৮-১৯ বছর বয়স্ক যুবকদের মধ্যে গণোরিয়া শতকরা ৩৬ ভাগ এবং যুবতীদের মধ্যে শতকরা ২৮ ভাগ বেড়ে যাচ্ছে। বৃটেনের কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য ও শিক্ষা বিভাগের ডাইরেক্টর ডালজেল ওয়ার্ড (Dalzell Ward)-এর অনুমান এই যে, ২০ বছরের নিম্ন বয়স্কদের মধ্যে এ অবাঞ্ছিত রোগ বর্তমানে যে পরিমাণে বেড়ে চলেছে ইতিপূর্বে কখনও এমনভাবে বাড়তে দেখা যায়নি। লণ্ডনের একটি মাত্র হাসপাতালেই এই সময়ে উক্ত রোগের ৪৯০ জন রোগী বর্তমান ছিল। লিভারপুলের এ অবাঞ্ছিত রোগীদের অর্ধেক সংখ্যক ছিল ১৭ বছর থেকে ২১ বছরের মধ্যবর্তী বয়স্ক।
অন্যান্য দেশেরও অল্প বিস্তর একই অবস্থা। বিশ্ব স্বাস্থ্য-সংস্থার (World Health Organisation or WHO) এক সাম্প্রতিক সম্মেলনে ১৬ টি দেশের পক্ষ থেকে পেশকৃত রিপোর্টে বলা হয় যে, ও-সব দেশে সিফিলিস ও গনোরিয়া ভয়ংকর মহামারীরুপে বিস্তার লাভ করেছে। ১৯৫৮ ও ১৯৫৯ সালের মধ্যে সিফিলিস রোগীর সংখ্যা ইটালীতে তিনগুণ এবং ডেনমার্কে দ্বিগুণ হয়ে গেছে।
এ অবস্থা থেকে পরিষ্কার বুঝা যাচ্ছে যে, জন্মনিয়ন্ত্রণ, আধুনিক দুনিয়ায় পাপের যেসব দরজা খুলে দিয়েছে তার মধ্য দিয়ে ব্যভিচার, যৌন অপরাধ এবং অবাঞ্ছিত রোগের বাহিনী নর্তন-কুর্দন করে প্রবেশ করেছে এবং সমগ্র সমাজকে ধ্বংসের কবলে টেনে নিয়ে চলেছে।
৩. তালাকের আধিক্য
যেসব কারণে পাশ্চাত্য দেশগুলোতে দাম্পত্য জীবনের বন্ধন অত্যন্ত শিথিল হয়ে পড়েছে তার মধ্যে জন্মনিয়ন্ত্রণ অন্যতম। স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্য বন্ধনকে মজবুত করার ব্যাপারে সন্তানের ভূমিকা খুবই প্রাভাবশীল। সন্তানের অবর্তমানে স্বামী-স্ত্রীর একের পক্ষে অপরকে ত্যাগ করা খুবই সহজ হয়ে পড়ে। এ কারণেও ইউরোপে তালাকের ব্যবহার খুব বেশী পরিমাণে বেড়ে যাচ্ছে। আর বিয়ে ভঙ্গকারীদের মধ্যে সন্তানহীনদের সংখ্যা বেশী দেখা যায়। কিছু দিন পূর্বে লন্ডনের এক আদালতে মাত্র দেড় মিনিট সময়ের মধ্যে ১১৫ টি বিয়ে বাতিল ঘোষণা করা হয় এবং ১১৫ টি দম্পতির সব কয়টিই নিঃসন্তান ছিল।
সমাজ-বিজ্ঞান বিশেষজ্ঞদের সাধারণ সিদ্ধান্ত এই যে, সন্তানের অভাব বিয়ে বাতিল করার ব্যাপারে বিশেষ প্রভাবশীল বিষয়। এ ব্যাপারে প্রায় সকল বিশেষজ্ঞই একমত। টালকোট পারসনস (Talcott Parsons)স্পষ্ট হিসাব প্রদান করার পর বলেনঃ
“বেশীর ভাগ তালাকই বিয়ের প্রথম বছরে এবং সন্তানহীন স্বামী স্ত্রীর মধ্যে ঘটে থাকে এবং ঘটছে। এ বিয়ের পূর্বে এদের জীবনে বিয়ে এবং বিচ্ছেদ ঘটে থাকলেও ঐ একই অবস্থা এর মূলে কাজ করেছে। একবার সন্তানের জন্ম শুরু হয়ে গেলে স্বামী-স্ত্রীর একত্রে বসবাস করার সম্ভাবনা অনেক বেশী হয়ে যায়।” [Persons. Talcott. The Stability of American Family System, Bell and Vogel (Ed).A Modern Introduction of the Family, London 1961. Page 94.]
অনুরুপভাবেই বার্ণস এবং রুয়েদী (Barnes and Ruedi) নিজেদের অনুসন্ধানের বিবরণ নিম্ন ভাষায় ব্যক্ত করেনঃ
“বিয়ে বাতিলকারীদের দুই তৃতীয়াংশ নিঃসন্তান এবং মাত্র এক পঞ্চমাংশ এক সন্তানের পিতা মাতা। প্রকৃত ব্যাপার এই যে, তালাক ও সন্তানহীন দম্পতির মধ্যে একটি পরিস্কার সম্পর্ক দেখতে পাওয়া যায়।” [Barnes. H. F. And Ruedi. O. M.; The American Way of Life, New York. 1951. Page 652.]
বিখ্যাত ইংরেজী পত্রিকা সাইকোলোজিষ্ট-এর জুন, ১৯৬১-এর সংখ্যায় এ কথা স্বীকার করা হয়েছে যে, সাধারণত সকল দম্পতির জন্যে সন্তানের মাতা-পিতা হওয়া জরুরী। যারা সন্তানের জন্মকে বিলম্বিত করে তাদের তজ্জন্য পরে আফসোস করতে হয়। সন্তানহীন দাম্পত্য জীবন নিত্য নতুন সমস্যার জন্ম দেয় এবং সাময়িকভাবে স্বামী-স্ত্রী পরস্পরকে পরস্পরের প্রতি যথেষ্ট আকৃষ্ট করতে সক্ষম হলেও পরবর্তীকালে তাদের মধ্যে একটা বিতৃষ্ণা সৃষ্টি করে। এর পরিণতি স্বরুপ দাম্পত্য জীবনে এমন একটা উদ্যমহীনতা এসে যায় যে, তা দেখে মনে হয় পথিক তার গন্তব্যস্থলে পৌছে গেছে। সমাজ বিজ্ঞানীগণ আমাদের বার বার সতর্ক করে বলেছেন যে, সন্তানহীন পরিবারে তালাকের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। এর কারণ সুস্পষ্ট। সন্তানহীন অবস্থায় (সন্তানের মাতা বা পিতা হওয়ার) গোপন বাসনা অতৃপ্ত থেকে যায়। স্ত্রীদের ব্যাপারে তো এ বিষয়টা আরও জটিল হয়ে ওঠে। জন্মনিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে তার জন্মগত সন্তান বাৎসল্যকে গলা টিপে হত্যা করা হয়। ফলে তার দৈহিক ব্যবস্থায় বিশৃংখলা দেখা দেয়। স্বাস্থ্য ভেংগে যায় এবং তার জীবনের সকল আনন্দ ও উৎসাহ হিম-শীতল হয়ে পড়ে।[ Alexander, James N. The Psychologist Magazine, London, June. 1961. P.5]
ডাঃ ফ্রিডম্যান ও তাঁর সংগীদের অনুসন্ধানের ফলও অনুরুপ। তিনি তাঁর নিজের এবং অন্যান্য সংগীদের গবেষণার ফলাফল নিম্ন ভাষায় ব্যক্ত করেনঃ
“তালাকের হার সেসব পরিবারের মধ্যেই বেশী যেগুলো বিয়ের পর সন্তান থেকে বঞ্ছিত থাকে অথবা যেসব পরিবারে সন্তানের সংখ্যা কম”। [Freedman, Whelpton and Campbell., Family Planning, Sterility and Population Growth, New York. 1959,Page 45]
জন্মনিয়ন্ত্রণ প্রবর্তনকারী দেশগুলোতে দিন দিন তালাকের সংখ্যা যেভাবে বেড়ে যাচ্ছে তা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। ডাঃ অসওয়াল্ড শোয়ারজ ইংল্যান্ড সম্পর্কে লিখেনঃ
“গত অর্ধ শতাব্দীর মধ্যে যে হারে তালাকের সংখ্যা বেড়ে চলেছে, তাতে মহামারীর মত দ্রুতগতি ও ধ্বংসলীলার আভাস পরিলক্ষিত হয়। এদেশে ১৯১৪ সালে সর্বমোট ৮৫৬টি তালাক সম্পাদিত হয়েছিল। এ সংখ্যা ১৯২১ সালে ৩৫২২, ১৯২৮ সালে ৪০০০ এবং ১৯৪৩ সালে ৩৫,৮৭৪ পর্যন্ত পৌছে যায়। তবু কি বিপদ সংকেত পাওয়া যাচ্ছে না যে, আমাদের তাহজীব নৈতিক অধপতনের চরম সীমায় পৌছে গেছে”? [Sehwarz; The Philosophy of Sex, P.243]
ইংলন্ডের পারিবারিক আদালতের সংখ্যাতত্ত্ব অধ্যয়ন করলে জানা যায় যে, সেখানে তালাকের মোকদ্দমার ডিক্রী নিম্ন হারে বেড়ে চলেছেঃ
১৯৩৬ সালে – ৪০৫৭
১৯৩৯ সালে- ৭৯৫৫
১৯৪৭ সালে- ৬০৭৫৪
এরপরে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত তালাকের হার কিছুটা কমে যেতে থাকে। কিন্তু ১৯৫২ সালে পুনরায় এ হার বাড়তে থাকে এবং এরপর থেকে বরাবর তালাকের সংখ্যা বৃদ্ধির দিকেই চলেছে।
আমেরিকার অবস্থা হচ্ছে এই যে, ১৮৯০ সালে সে দেশে স্বামী স্ত্রীর কোন একজনের মৃত্যুর দরুন যদি দশটি দম্পতির সম্পর্কচ্ছেদ হতো তবে তালাকের দরুন হতো একটির। কিন্তু ১৯৪৯ সালে এর অনুপাতও বরাবর ভারসাম্য হারিয়ে চলেছে। নিম্নের বর্ণিত সংখ্যা থেকে এ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা করা সম্ভব হবেঃ
সাল বিয়ে তালাক
১৮৭০ ৩৩.৭ ১
১৯১৫ ১০.১২ ১
১৯৪০ ৬ ১
১৯৪২ ৫ ১
১৯৪৪ ৪ ১
১৯৪৫ ৩ ১
১৯৫০ ৪.৩ ১
১৯৫৮ ৩.৭ ১
এর অর্থ হলো এই যে, ১৮৭০ সালে প্রায় ৩৪ টি বিয়ে হলে একটি তালাক হতো। কিন্তু এখন প্রতি চারটি বিয়েতে একটি তালাক হয়ে থাকে। ১৮৯০ সালে ১০০০ নারীর মধ্যে মাত্র তিনজন হতো তালাক প্রাপ্তা। কিন্তু ১৯৪৬ সালে এ সংখ্যা ১৭.৮ এ পৌছে। বুঝা গেল তালাক প্রাপ্তা নারীর সংখ্যা প্রায় ৬ গুণ বেড়ে গিয়েছে। এ জন্যই অধ্যাপক সারোকিন বলেছেন যে, বিয়ের পবিত্রতা সম্পর্কিত ধারণা পূর্বের তুলনায় এখন দ্রুতগতিতে এবং তীব্রভাবে পালটিয়ে যাচ্ছে এবং গৃহ একটি স্থায়ী বাসস্থান হওয়ার পরিবর্তে গ্যারেজে পরিণত হতে চলেছে। এটাকে রাত্রিযাপনের স্থান মাত্র বিবেচনা করা হয়, যদিও সম্পূর্ণ রাত্রি এতে থাকা জরুরী নয়।
তালাকের সঙ্গে সঙ্গে স্বামীকে ছেড়ে চলে যাবার (Desertion)প্রবর্তনও দিন দিন বেড়ে চলছে এবং আমেরিকার দৈনন্দিন জীবনে ওটা গরীবের তালাক (Poor-Man’s Divorce) নামে পরিচিত হয়ে গেছে। বর্তমানে আমেরিকায় দশ লক্ষেরও বেশী পরিবার এ অবস্থায় আছে। আদমশুমারীর হিসেব মুতাবিক আমেরিকায় দশ লক্ষ ছিয়ানব্বই হাজার স্বামী থেকে বিচ্ছিন্ন স্ত্রী এবং পনর লক্ষ ছাব্বিশ হাজার স্ত্রী থেকে বিচ্ছিন্ন স্বামী রয়েছে। [Bergel, Egon Ernest, Urban Sociology, New York, 1955. P 298n.] সারোকিনের অনুমান এই যে, আমেরিকার মোট বিবাহিত নারীদের শতকরা চারজন স্বামী থেকে বিচ্ছিন্ন জীবন যাপন করছে এবং সরকারী তহবিল থেকে এসব পরিবারের জন্যে বার্ষিক প্রায় ২৫ কোটি ডলার খরচ হচ্ছে। [এ হিসাব ১৯৫৩ সালের আমেরিকার যৌন-বিপ্লব থেকে গৃহীত, ৮পৃঃ]
তালাক, বিচ্ছিন্ন জীবন-যাপন এবং স্বামী-স্ত্রীর পরস্পরের প্রতি আস্থাহীনতার দরুন আমেরিকার মোট ৪ কোটি ৫০ লক্ষ শিশুর মধ্যে ১ কোটি ২০ লক্ষ (শতকরা ২৫ ভাগের কিছু বেশী) শিশু আজ মাতা-পিতার স্নেহ থেকে বঞ্চিত। আর এসব ছেলে-মেয়েদের দরুনই আমেরিকায় দিন দিন কিশোরদের উচ্ছৃংখলতা বেড়ে গিয়ে দেশের জন্যে মাথা ব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
৪. জন্মের হার কমে গেছে
এর পরিণতি স্বরুপ বর্তমানে যতগুলো জাতি জন্মনিয়ন্ত্রণ করেছে তাদের জন্মহার ভীষণভাবে কমে গেছে। পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ১৮৭৬ সাল থেকে এ আন্দোলনের প্রচার শুরু হয়েছে। পর পৃষ্ঠায় প্রদত্ত সংখ্যাতত্ত্ব থেকে বিভিন্ন দেশে প্রতি হাজারে জন্মহার কি ছিল এবং পরে কিভাবে কমে চলেছে তা জানা যাবে।
এ সংখ্যাতত্ত্ব জন্মনিয়ন্ত্রণের ফলাফল স্পষ্টভাবে প্রকাশ করছে। এ আন্দোলনের শুরু থেকে বিভিন্ন দেশে বিনা ব্যতিক্রমে জন্মহারের হ্রাস প্রাপ্তি এবং এর গতি অব্যাহত থাকা থেকে একবার পরিস্কার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে যে, জন্মনিয়ন্ত্রণ এর একমাত্র কারণ না হলেও অন্যতম প্রধান কারণ নিশ্চয়ই। ইংল্যান্ডের রেজিষ্ট্রার জেনারেল নিজেই এ কথা স্বীকার করেছেন যে, জন্মহার হ্রাস প্রাপ্তির শতকরা ৭০ ভাগ জন্মনিয়ন্ত্রণের দরুন ঘটে থাকে। ইনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটানিকাতেও স্বীকার করা হয়েছে যে, পাশ্চাত্য দেশ সমূহের জন্মহার হ্রাস প্রাপ্তির কারণগুলোর মধ্যে জন্মনিয়ন্ত্রণের কৃত্রিম উপকরণাদির প্রভাব অত্যধিক।
রয়েল কমিশন অব পপুলেশনের ১৯৪৯ সালের রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে, ১৯১০ সালের পূর্বে যারা বিয়ে করেছিল, তাদের মধ্যে শতকরা ১৬ জন জন্মনিয়ন্ত্রণ করতো। কিন্তু ১৯৪০-৪২ এর পর থেকে শতকরা ৭৪ টি দম্পতি এ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। এ প্রসংগে রয়েল কমিশন পরিস্কার বলেছেন যেঃ
“এদেশে এবং আরও অন্যান্য দেশে এরূপ স্পষ্ট নিদর্শন বর্তমান আছে যাতে এ কথা বুঝা যায় যে, জন্মনিয়ন্ত্রণ ও ইচ্ছাকৃতভাবে পরিবারকে সীমিত করার প্রবণতার দরুনই জন্মহার হ্রাস পাচ্ছে। এ পদ্ধতি চালু করার পূর্বে জন্মহার যেভাবে হ্রাস পাচ্ছিল, তাঁর চেয়ে অনেক গুণ বেশী হ্রাস পেয়েছে এর উপকরণাদি ব্যবহার করার দরুন।” [Report of the Royal Commission on Population H.M.S.O. London. 1949, P.34]
আমেরিকার হোয়েলপটন ও কাইজার (Whelpton and Kiser)-এর গবেষণামূলক সংখ্যাতত্ত্ব থেকে জানা যায় যে, সে দেশে শতকরা ৯১.৫টি দম্পতি কোন না কোন উপায়ে জন্মরোধ করে থাকে। [ The Planning of Fertility Milbank Memorial Fund Quarterly (1947) PP.66-67] ফিডম্যান এবং তাঁর সঙ্গীদের গবেষণা থেকে প্রকাশ; সমষ্টিগতভাবে আমেরিকার শতকরা ৭০টি পরিবার জন্মনিয়ন্ত্রণ করে থাকে। [Family Planning, Sterility and Population Growth, New York. 1959, Page 5] এ লেখকগণ বৃটেন ও আমেরিকার অবস্থা পর্যবেক্ষণ করার পর আমাদের জানানঃ
“এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে, পরিবারগুলোর ক্ষুদ্র আকার প্রাপ্তির মূলে রয়েছে গর্ভনিরোধের প্রচেষ্টা।”
জন্মনিরোধের ফলাফল সম্পর্কে এর চেয়েও সুস্পষ্ট ধারণা পেতে হলে এসব দেশের বিয়ে ও জন্মের হার তুলনা করে দেখুন। ইংলন্ডে ১৮৭৬ সাল থেকে ১৯০১ সাল পর্যন্ত সময়ে বিয়ের হার কমেছে শতকরা ৩.৬ কিন্তু ঐ সময়ে জন্মহার কমেছে শতকরা ২১.৫। পুনরায় ১৯০১ থেকে ১৯১৩ সাল পর্যন্ত বিয়ের হার
+++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++
টেবিল পৃষ্টা ৩২ পিডিএফ
++++++++++++++++++++++++++++++
অপরিবর্তিত থাকে কিন্তু ঐ সময়ে জন্মহার হ্রাস পায় শতকরা ১৬.৫। নিম্নের চার্টে ১৯১২ থেকে ১৯২৬ সাল পর্যন্ত সময়ের বিয়ে ও জন্মহার অনুপাত দেখানো হলোঃ
+++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++
টেবিল পৃষ্টা ৩২ পিডিএফ
++++++++++++++++++++++++++++++
আমেরিকাও এ পথেরই যাত্রী। সে দেশে ঊনিশ শতকের শেষাংশে জন্মহার প্রতি হাজারে ৪০ ছিল। ১৯৩৫ সালে তাদের জন্মহার মাত্র হাজার প্রতি ১৮.৭ এ এসে দাঁড়ায় এবং বর্তমানে সেখানে জন্মহার হচ্ছে প্রতি হাজারে ২৩.৬ [Population and Vital Statistics, U.N.O. Aprial, 1961.] অপরদিকে বিয়ের হার ১৯০১ সালে ছিল প্রতি হাজারে ৯.৩ এবং ১৯৩৫ সালে এর সংখ্যা হাজার প্রতি ১০.৪-এ পৌছে। ১৯৫৬ সালে সে দেশের বিয়ের হার দাঁড়ায় হাজার প্রতি ৯.৪। এ হিসাব থেকে জন্মনিয়ন্ত্রণকারী নারী ও পুরুষের মধ্যে দাম্পত্য সম্পর্ক কিরূপ অর্থহীন হয়ে দাঁড়িয়েছে তা স্পষ্ট বুঝা যায়। যে পরিমাণে বিয়ের হার কমে আসছে তার চেয়ে বেশী পরিমাণে জন্মহার কমে যাচ্ছে। কোন কোন ক্ষেত্রে বিয়ের হার বেড়ে যাওয়া সত্ত্বেও জন্মহার কমে চলেছে। সম্প্রতি বৃটেনের একটি সরকারী বিজ্ঞপ্তিতেও এ কথা স্বীকার করা হয়েছেঃ
“বিশ শতকে বিয়ের হার বেড়ে যাওয়া সত্ত্বেও জন্মহার কমেছে। এ সময়ে শুধু যে বিয়ের হার বেড়েছে তাই নয়-বিয়ের বয়সও অনেকটা কমেছে”। [Britain, An official Hand Book. 1954 P.8.]
জন্মনিরোধের এক ফল হচ্ছে এই যে, পরিবারের সদস্য সংখ্যার গড় ক্রমেই কমে আসছে এবং পাশ্চাত্য দেশগুলোতে পরিবার আকারে ছোট হয়ে চলেছে। এখন তো ঐ সব পরিবারের সংখ্যা বেশী যাদের কোন সন্তান নেই অথবা মাত্র একটি কিংবা দুইটি সন্তান আছে। এ বিষয়েও জন্মনিরোধ আন্দোলনের আগের ও পরের সংখ্যাতত্ত্বেও অনেক পার্থক্য দেখা যায়।
ইংলন্ডে ১৮৬০ ও ১৯২৫ সালের মধ্যবর্তী সময়ে যেসব বিয়ে হয়েছিল তাদের সন্তান সংখ্যার হিসাব নিম্নরূপঃ
+++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++
টেবিল পৃষ্টা ৩৪ পিডিএফ
++++++++++++++++++++++++++++++
এর ফল হচ্ছে এই যে, পরিবারের জনসংখ্যার গড় কমে আসছে এবং সে জন্যে পরিবার ক্রমেই ছোট হয়ে চলেছে। ১৮৭০-৭৯ সালে বিবাহিতা নারীদের সন্তান জন্মদানের গড় সংখ্যা ছিল জনপ্রতি ৫.৮। এই সংখ্যা ১৯২৫ সালে মাত্র ২.২ এ এসে দাঁড়ায়। বর্তমান এ সংখ্যা ২.২ এর সামান্য উর্ধে। [Britain An Official Hand Book, Central Office of Information, London, 1961, Page 12.]
১৯১০ সালে আমেরিকার জনপ্রতি গড়ে ৪.৭টি সন্তানের জন্ম হতো- এ সংখ্যা ১৯৫৫ সালে মাত্র ২.৪- এ পৌছেছে। ১৯১০ সালে আমেরিকার সর্বমোট বিবাহিত নারীদের মধ্যে শতকরা দশজন ছিল সন্তানহীনা এবং শতকরা ২২ জন ছিল এক বা দু’সন্তানের মা। কিন্তু ১৯৫৫ সালে মোট বিবাহিতা নারীদের শতকরা ১৬ জনকে সন্তানহীন এবং শতকরা ৪৭ জনকে এক বা দু’সন্তানের মা হিসাবে দেখতে পাওয়া যায়। অপর দিকে ১৯১০ সালে সর্বমোট বিবাহিতা নারীদের মধ্যে শতকরা ২৯ জন ছিল সাত বা ততোধিক সন্তানের জননী। কিন্তু ১৯৫৫ সালে এ সংখ্যা শতকরা মাত্র ৬ এ এসে দাঁড়িয়েছে। [Freedman and other’s Family Planning Sterility and Population Growth P.5]
জন্মহার দিন দিন এভাবে কমে যাওয়া সত্ত্বেও কোন কোন দেশের জনসংখ্যাতে কিছু বৃদ্ধি দেখা যাচ্ছে, তার কারণ হলো চিকিৎসা বিদ্যা ও ব্যাপক স্বাস্থ্যরক্ষা পদ্ধতির উন্নতির দরুন মৃত্যুহারের হ্রাস প্রাপ্তি। কিন্তু এখন জন্মহার ও মৃত্যুহারের মধ্যে আর বিশেষ পার্থক্য নেই। এজন্যেই আশংকা করা যাচ্ছে যে, শীঘ্রই জন্মহার মৃত্যুহার থেকে কমে যাবে। এর মানে হলো ওসব জাতির যত সংখ্যক সন্তান জন্মাবে তার চেয়ে বেশী সংখ্যক লোক মরে যাবে।
ফ্রান্স, বেলজিয়াম ও অষ্ট্রীয়ার জনসংখ্যা কিছুকাল পর পরই বেড়ে যাবার পরিবর্তে কমে যায়। এসব দেশে তাদের সাবেক অবস্থাও বহাল রাখতে পারে না। ইংল্যান্ডের জনসংখ্যাও প্রায় অনড় অবস্থায়ই আছে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আগে আমেরিকাও এ সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিল। অষ্ট্রীয়ায় ১৯৩৫ ও ১৯৩৮ সালের মধ্যবর্তী সময়ে মৃত্যুর হার জন্মহারের চেয়ে বেশী ছিল। ফ্রান্সেও ১৯৩৫ ও ১৯৩৯ সালের মধ্যবর্তী সময়ে মৃত্যুহার জন্মহারের উর্ধে ছিল। যদি এ সময় অন্য দেশের লোক হিজরত করে এসে ফ্রান্সে বসবাস করা শুরু না করতো তাহলে এদেশের জনসংখ্যা ভীষণভাবে কমে যেতো। প্রকৃতপক্ষে ১৯৩৪-৩৬ সাল পর্যন্ত এবং ১৯৩৮-১৯৩৯ সালে ফ্রান্সের মূল অধিবাসীদের সংখ্যা কমে যায়। [Demographic Year Book, 148, U.N.O. Edition. 1949]
আমেরিকার শহরের অধিবাসীদের হিসেব নিয়ে দেখা যায় যে, ১৯৫০ সাল পর্যন্ত তারা নিজেদের সমান সংখ্যক সন্তানও জন্মাতে পারে নি। এ সময়ে যে জন্মহার ছিল, তা থেকে অনুমান করা হয়েছিল যে, অবস্থা অপরিবর্তিত থাকলে এক পুরুষ পরেই সে দেশের জনসংখ্যা শতকরা ২৫ ভাগ কমে যাবে।
ইংল্যান্ডের জনসংখ্যা কমিশনের ১৯৪৯ সালের রিপোর্ট মুতাবেক ১৯৪৫ সালের শেষে সে দেশের অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌছেছিল যে, যারা দৈহিক পরিশ্রম করে না সে সব উচ্চস্তরের লোকদের মধ্যে বিয়ের পর ষোল থেকে কুড়ি বছর পর্যন্ত সময়ে জন্মহার ছিল পরিবার প্রতি ১.৬৮। এ অবস্থা থেকে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছিল যে, উল্লেখিত শ্রেণীর লোক ধীরে ধীরে নির্বংশ হতে চলেছে। এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞদের অভিমত এই যেঃ
“যে জনপদে মাত্র দুটি সন্তানের মাতা-পিতা হবার প্রথা চালু হয়ে যায়। কিংবা যেখানে বিবাহিত নারী-পুরুষের শেষ পর্যন্ত মাত্র দুটি সন্তান জীবিত থাকে সে জনপদ উজাড় হয়ে যাবার পথে এবং প্রত্যেক ত্রিশ বছর পর তার জনসংখ্যা পূর্বের তুলনায় কমে যাবে।”
কথাটা স্পষ্টভাবে বুঝার জন্যে এক হাজার জনসংখ্যাকে ভিত্তি হিসাবে ধরে নিলে উল্লেখিত হিসাব অনুসারে ত্রিশ বছর পর তাদের সংখ্যা ৬৩১, ষাট বছর পর ৩৮৬ এবং দেড়শো বছর পর মাত্র ৯২-এ এসে দাঁড়াবে। [Dr. Frederic Burghoerier quoted by Jacques, Lecharque, Marriage and Family, New York, 1949 Page-239]
অর্থনীতি বিশারদগণ জনসংখ্যার সঠিক গতি সম্পর্কে মতবাদ গঠন করার জন্যে শুধু জন্মহারের উপরই নির্ভর করেন না বরং তাঁরা জনসংখ্যা হ্রাস বৃদ্ধিতে প্রভাব বিস্তারকারী সকল উপায়-উপাদান সম্পর্কে অনুসন্ধান করে জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রকৃতহার (Net Reproduction Rate) নির্ণয় করে ফেলেন। যদি এ হার ১ হয় তাহলে বুঝা যাবে জনসংখ্যা বাড়ছেও না কমছেও না। একের বেশী হলে বুঝা যাবে সংখ্যা বৃদ্ধির পথে এবং একের কম হলে বুঝতে হবে যে, জনসংখ্যা হ্রাস প্রাপ্তির দিকে। কয়েকটি বিশিষ্ট পাশ্চাত্য দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঠিক চিত্র আমরা নীচে উল্লেখ করছি। এর সাহায্যে সে সকল দেশগুলো সম্পর্কে সঠিক ধারণা করা সহজ হবে।
+++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++
টেবিল পৃষ্টা ৩৬ পিডিএফ
++++++++++++++++++++++++++++++
[ইনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটানিকা, ১৯৫৫, ১৮শ খন্ড, ২৪৩ পৃষ্টা]
চিন্তাশীল ব্যক্তিদের জন্যে এ অবস্থা অত্যন্ত উদ্বেগজনক হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং এর ফলাফল দেখে সমাজের যেসব চিন্তাশীল ব্যক্তি প্রকাশ্যতঃ জন্মনিরোধের সমর্থক তারাও ভয় পেয়ে গিয়েছেন। এরা নিজেদের হাতে রোপন করা গাছের ফল দেখতে পেয়ে ভীত ও সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছেন এবং অন্তত নিজ নিজ দেশে জন্মনিরোধের পলিসী পরিবর্তন করার চেষ্টা করছেন। দৃষ্টান্ত স্বরুপ জনৈক সমাজ বিজ্ঞানীর মতামত উধৃত করা যেতে পারেঃ
“যদি ম্যালথাস আজ জীবিত থাকতেন তাহলে এটা নিশ্চয়ই অনুভব করতেন যে, পাশ্চাত্য দেশীয় লোকেরা জন্মনিরোধ করার ব্যাপারে প্রয়োজনের চেয়েও অনেক বেশী দূরদর্শীতার পরিচয় দিয়েছে। বরং সত্য কথা হচ্ছে এই যে, তারা নিজেদের তাহজীবের ভবিষ্যত নির্ধারণে সংকীর্ণ দৃষ্টির পরিচয় দান করেছে। ফ্রান্স এবং বেলজিয়ামে তো প্রকৃতপক্ষেই কিছুকাল পর পর জনসংখ্যা কমে যাচ্ছে; কারণ সে সব দেশে মৃত্যুহার জন্মহারের চেয়ে বেশী; উপরন্তু পাশ্চাত্যের শিল্প ও নগর ভিত্তিক সভ্যতার দরুন অন্যান্য জাতিরাও বিপদের সম্মুখীন। আমেরিকার জনৈক জনসংখ্যা বিশেষজ্ঞ আমেরিকার জন্ম ও মৃত্যুর গতিধারা পর্যালোচনা করে এ কথা বলে দিয়েছিলেন যে, এক পুরুষের মধ্যেই জন্মসংখ্যা হ্রাস একটি বাস্তব সত্যে পরিণত হবে।” [Landis, Paul, H; Social Probalems, PP, 596-97]
অর্থনৈতিক দিক সম্পর্কেও একজন বিখ্যাত অর্থনীতিবিদদের মন্তব্য শুনুন
“যদি আমরা জনসংখ্যা হ্রাস করার মত নির্বুদ্ধিতা করি তাহলে আমাদের জেনে রাখা উচিত যে, জনসংখ্যা হ্রাস বেকার সমস্যার সমাধান নয় এবং জীবিত লোকদের জীবন যাত্রার মান উন্নত করতেও সক্ষম নয়। এর অর্থ নৈতিক প্রভাব সুনিশ্চিতভাবেই অবাঞ্ছিতরূপ ধারণ করবে। এর কারণ এই যে, এ ব্যবস্থার ফলে সমাজে বুড়োদের সংখ্যা বেড়ে যাবে এবং উৎপাদনকারী দল কর্মক্ষেত্র থেকে অবসর গ্রহণের বয়সেও লোকদের চাকুরীতে বহাল রাখতে বাধ্য হবে। আর যদি উৎপাদনকারীদেরও বেশীর ভাগ বুড়ো লোকই হয় তাহলে উৎপাদন ব্যবস্থার মধ্যে পরিবর্তনশীল অবস্থার সংগে সংগতি রক্ষা করার ও নিত্যনূতন পদ্ধতি অবলম্বন করার অবকাশ মোটেই থাকবে না। জনসংখ্যা হ্রাস করার ব্যাপারটিকে আমাদের সর্বশক্তি প্রয়োগ করে প্রতিরোধ করা উচিত।” [Cole, G.D.H. The Intelligent Man’s Gudie to the Post-War World, London. 1948. PP. 445-46.
অপর একজন ঐতিহাসিকের চিন্তাধারাও খুবই শিক্ষণীয়
“অপর যে পদ্ধতি দ্বারা একটি উন্নত ও বিত্তশালী জাতির আয়ু ক্ষয় হয়ে থাকে, তা হচ্ছে কৃত্রিম উপায়ে জনসংখ্যা হ্রাস। প্রকৃতির নিয়ম এই যে, যেসব জাতি বিলাসিতা ও যৌন উশৃংখলতায় মগ্ন হয়ে যায় তারা বংশ-বৃদ্ধির দায়িত্ব সম্পর্কে উদাসীন হয় এবং সন্তান তাদের স্বেচ্চাচারিতা ও উচ্ছৃংখলতার পথে অন্তরায় বিবেচিত হয়। এ ধরনের যৌন লিপ্সার পূজারীদল গর্ভনিরোধ উপকরণাদি ব্যবহার, গর্ভপাতের এবং এ ধরনেরই অন্যান্য ব্যবস্থা অবলম্বন করার জন্য সকলকে উৎসাহ দিয়ে থাকে। এর ফলে উক্ত জাতি প্রথমে স্থির ও হ্রাস-বৃদ্ধিহীন হয়ে যায় এবং কিছুকাল পর এর জনসংখ্যা কম হতে শুরু করে। এমনকি উক্ত জাতি ক্রমে এমন স্তরে গিয়ে পৌছে যে, নিজেদের বুনিয়াদী প্রয়োজন পূরণ করার মত শক্তিও তার মধ্যে থাকে না। অর্থাৎ এরা নিজেদের বৈশিষ্ট্যও টিকিয়ে রাখতে পারে না এবং প্রাকৃতিক ও মানব জাতির দুশমনদের হামলা থেকে আত্মরক্ষা করতে পারে না। এ অবস্থা জাতির পক্ষে আত্মহত্যার শামিল। উশৃংখলতা ও চরিত্রহীনতার স্বাভাবিক পরিণতিতে যে বন্ধ্যাত্ব সৃষ্টি হয়, তা এ আত্মহত্যার পথকে আরও প্রশস্ত করে দেয়। আর এ উভয় অবস্থার ফলে জাতির আয়ু অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত হয়ে আসে। এ ধরনের জাতীয় আত্মহত্যার ফলে মানব সমাজের ইতিহাসে বহু শাহী খান্দান, ধনী ও উচ্চ শ্রেণীর লোক সংঘবদ্ধ মানব গোষ্ঠীকে জৈবিক ও মানসিক দিক থেকে নিস্তনাবুদ করে দিয়েছে এবং এ ব্যবস্থার ফলেই বহু জাতি ধ্বংস ও নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে।” [Sorokin, The American Sexual Revolution P. 78-79.]
কলিন ক্লার্ক (Colin Clark) জন্মনিরোধের রাজনৈতিক ও তামাদ্দুনিক ফলের প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য লিখেনঃ
“ভবিষ্যতের ঐতিহাসিকেরা অতীত শতাব্দীগুলোর ইতিহাস থেকে ফ্রান্সবাসীর ঊনিশ শতকের প্রথমাংশে এবং বৃটেনবাসীর উক্ত শতকের শেষাংশে জনসংখ্যা হ্রাস করণের সিদ্ধান্ত এবং এর ফলে এসব দেশের আন্তর্জাতিক মর্যাদা হ্রাস পেয়ে রাজনৈতিক প্রভাব ক্ষুন্ন হওয়ার ব্যাপারটিকে বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করবে।[ লন্ডনের ১৫ই মার্চ, ১৯৫৯ তারিখের দৈনিক টাইম পত্রিকায় “ছোট পরিবার” (Too Small Families) শিরোনামায় লিখিত অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এগ্রিকালচারাল রিসার্চ ইনসটিটিউটের ডিরেক্টর প্রফেসার কলিন ক্লার্কের প্রবন্ধ।]
জন্মনিয়ন্ত্রণকে জাতীয় পলিসী ও একটি সংঘবদ্ধ আন্দোলন হিসাবে চালু করার পর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এর যে বিষময় ফল দেখা দিয়েছে, তার একটা সংক্ষিপ্ত চিত্র উপরে পেশ করা হলো। এ অবাঞ্ছিত ফল আজ সকল চক্ষুষ্মান ব্যক্তির নিকট দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট। যেসব জাতির সংখ্যাতত্ত্ব উপরে প্রকাশ করা হলো, তারা তাদের জাতীয় জীবনের বসন্তকাল দেখে নিয়েছে। আল্লাহর সুন্নত (বিধান) মুতাবিক উন্নতির উচ্চতম শিখর থেকে এদের অধঃপতনের সকল আয়োজন এদেরই নিজেদের হাতে পূর্ণ হচ্ছে। কিন্তু অন্যান্য জাতি উন্নতির শিখরে উঠে যেসব নির্বুদ্ধিতা শুরু করেছিল পরাধীনতার শৃঙ্খলমুক্ত হয়ে সবে মাত্র উন্নতির পথে অগ্রসরমান জাতির জন্যও কি সেসব নির্বূদ্ধিতার কাজ দিয়ে যাত্রার সূচনা করা উচিত হবে?