জন্মনিরোধ আন্দোলনের উদ্দেশ্য ও পটভূমিকা
জন্মনিরোধের আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে বংশ বৃদ্ধির প্রতিরোধ। প্রাচীনকালে এতদুদ্দেশ্যে আজল, গর্ভপাত, শিশুহত্যা ও ব্রহ্মচর্য (অবিবাহিত থাকা অথবা স্বামী-স্ত্রীর যৌন মিলন পরিহার করা) অবলম্বন করা হতো। আজকাল শেষের দুটি ব্যবস্থা পরিত্যাগ করা হয়েছে এবং এদের পরিবর্তে এমন নয়া পদ্ধতি আবিষ্কার করা হয়েছে, যাতে করে যৌন মিলন বহাল রেখে ঔষধ অথবা উপকরণাদির দ্বারা গর্ভ সঞ্চারের পথ বন্ধ করে দেয়া যায়। ইউরোপ ও আমেরিকায় গর্ভপাতের ব্যবস্থা এখনও প্রচলিত আছে। কিন্তু জন্মনিরোধ আন্দোলন শুধু গর্ভ সঞ্চার বন্ধ করার প্রতিই গুরুত্ব আরোপ করে। এ আন্দোলনের উদ্দেশ্য হচ্ছে, এ বিষয়-সম্পর্কিত তথ্যাবলী ও উপায়-উপাদান ব্যাপক হারে সমাজে ছড়ানো, যেন প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ ও নারী এর সুবিধা ভোগ করতে পারে।
আন্দোলনের সূচনা
ইউরোপে ঈসায়ী আঠারো শতকের শেষাংশে এ আন্দোলনের সূচনা হয়। সম্ভবত ইংল্যান্ডের বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ ম্যালথ্যাস-ই (Malthus) এর ভিত্তি রচনা করেন। সে সময় ইংরেজদের প্রাচুর্যময় জীবন যাপনের ফলে জনসংখ্যা দ্রুতগতিতে বেড়ে চলে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির উচ্চ হার দেখে মিঃ ম্যালথ্যাস হিসাব করতে শুরু করেন যে, পৃথিবীর আবাদযোগ্য জমি ও অর্থনৈতিক উপায়-উপাদান সীমিত। কিন্তু বংশ বৃদ্ধির সম্ভাবনা সীমাহীন। যদি স্বাভাবিক হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায় তাহলে পৃথিবীর বর্ধিত জনসংখ্যার তুলনায় সঙ্কীর্ণ হয়ে যাবে-অর্থনৈতিক উপকরণাদি, তখন মানুষের ভরণপোষণের ভার বইতে পারবে না এবং মানুষের সংখ্যা বেশী হয়ে যাবার ফলে জীবন যাত্রার মান নিম্নগামী হয়ে যাবে। সুতরাং মানব জাতির স্বাচ্ছন্দ্য, আরাম, কল্যাণ ও শান্তির জন্যে মানব বংশ বৃদ্ধির হারকে অর্থনৈতিক উপাদান বৃদ্ধির সংগে সংগতি রক্ষা করে চলতে হবে। জনসংখ্যা যেন কখনও অর্থনৈতিক উপাদানের ঊধ্বে যেতে না পারে। মোটামুটি এ-ই হচ্ছে ম্যালথ্যাসের প্রস্তাব। এতদুদ্দেশ্যে তিনি ব্রহ্মচর্যের প্রাচীন প্রথাকে পুনর্জীবিত করার পরামর্শ দিয়েছেন অর্থাৎ তাঁর মতে অধিক বয়সে বিয়ে করতে হবে। ১৭৯৮ সালে মিঃ ম্যালথ্যাস জনসংখ্যা ও সমাজের ভবিষ্যত উন্নয়নে এর প্রভাব (An Essay on Population and as it effects, the future Improvement of the Society) নামক পুস্তকে সর্বপ্রথম এ মতবাদ প্রচার করেন। এরপর ফ্রান্সিস প্ল্যাস (Francis Place) ফরাসী দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধি রোধ করার প্রতি জোর দেন। কিন্তু তিনি নৈতিক উপায় বাদ দিয়ে ঔষধ ও যন্ত্রাদির সাহায্যে গর্ভ নিরোধ করার প্রস্তাব দেন।
আমেরিকার বিখ্যাত ডাক্তার চার্লস নেলটন (Charles Knowlton) ১৮৩৩ ঈসায়ী সালে এ প্রস্তাবের প্রতি সমর্থনসূচক উক্তি করেনঃ তাঁর রচিত ‘দর্শনের ফলাফল’ (The Fruits of Philosophy) নামক পুস্তকেই সর্বপ্রথম গর্ভ নিরোধের চিকিৎসাশাস্ত্রীয় ব্যাখ্যা এবং এর উপকারিতার প্রতি গুরুত্ব প্রদান করা হয়।
প্রাথমিক আন্দোলনের ব্যর্থতা ও এর কারণ
প্রথমে পাশ্চাত্য দেশের লোকেরা এর প্রতি কোন গুরুত্ব দান করে নি। কারণ প্রকৃতপক্ষে এটি ছিলো ভ্রান্ত মতবাদ। ম্যালথ্যাস মানুষের বংশ কি হারে বেড়ে চলছে তা হিসাব করে বলে দিতে পারতেন-কিন্তু অর্থনৈতিক উপায়-উপাদান কি হারে বাড়ে এবং জ্ঞান ও বুদ্ধির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীর যে লুক্কায়িত সম্পদ মানুষের আয়ত্তে এসে অর্থনৈতিক উপাদান বাড়িয়ে দেয় তার পরিমাণ হিসাব করার কোন উপায়ই তার জানা ছিলো না। চর্মচক্ষুর আড়ালে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির যে সম্ভাবনা লুক্কায়িত থাকে তা ম্যালথ্যাসের দৃষ্টিতে ধরা পড়ে নি। এজন্যে তাঁর হিসাব প্রকাশের পর এ ধরনের যে সমস্ত সম্পদ মানুষের করায়ত্ত হয়েছে সে সম্পর্কে তিনি কোন ধারণা করতে পারেন নি। উনিশ শতকের শেষের দিকে ইউরোপের জনসংখ্যা দ্রুত গতিতে বেড়ে যায়। মাত্র ৭৫ বছরের মধ্যে জনসংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে যায়, বিশেষত ইংলন্ডের লোকসংখ্যা এত বেড়ে যায় যে, অতীত বংশ বৃদ্ধির ইতিহাসে এর নজীর নেই। ১৭৭৯ সালে ইংলন্ডের জনসংখ্যা ছিল, ১,২০,০০,০০০। ১৮৯০ সালে এ সংখ্যা ৩,৮০,০০,০০০ গিয়ে দাঁড়ায়। শিল্পের অর্থনৈতিক উপাদানও অনেক বেশী পরিমাণে বৃদ্ধি পায়। শিল্প ও ব্যবসায়ের ব্যাপারে এদেশ প্রায় সমস্ত দুনিয়ার ইজারাদার হয়ে যায়। জীবন যাপনের জন্যে শুধু দেশের উৎপন্ন ফসলের ওপরই তাদের নির্ভর করতে হয় নি, বরং শৈল্পিক উন্নতির মূল্যস্বরুপ পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান থেকে তাদের রসদ সংগৃহীত হতে থাকে এবং এত উচ্চ হারে লোক সংখ্যা বেড়ে যাওয়া সত্ত্বেও তারা কখনও মনে করে নি যে, ভূপৃষ্ঠ তাদের খাদ্য সরবরাহ করতে অসমর্থ হয়ে পড়েছে- অথবা প্রকৃতির সম্পদের ভান্ডার তাদের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সহযোগিতা করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।
নূতন আন্দোলন
উনিশ শতকের শেষ চতুর্থাংশে নয়া ম্যালথ্যাসীয় আন্দোলন (New-Malthusian Movement) নামে এক নূতন আন্দোলন শুরু হয়। ১৮৭৬ সালে মিসেস এ্যানী বাসন্ত ও চার্লস বাডর ডাঃ নোলটনের রচিত “দর্শনের ফলাফল” পুস্তক ইংলন্ডে প্রকাশ করেন। গভর্মেন্ট এর বিরুদ্ধে এক মোকদ্দমা দায়ের করে। মোকদ্দমার প্রচার কার্যের ফলে জনসাধারণের দৃষ্টি এদিকে আকৃষ্ট হয়। ১৮৭৭ সালে ডাক্তার ড্রাইসডেল (Drysdale)- এর সভাপতিত্বে একটি সমিতি গঠিত হয় এবং জন্মনিয়ন্ত্রণের প্রচার শুরু হয়ে যায়। দু’বছর পরে মিসেস ব্যাসন্ত-এর Law of Population (জনসংখ্যার আইন) নামক গ্রন্থ প্রকাশিত হয় এবং প্রথম বছরেই এর ১ লক্ষ ৭৫ হাজার কপি বিক্রি হয়। ১৮৮১ সালে হল্যান্ড, বেলজিয়াম, ফ্রান্স ও জার্মানিতে এ আন্দোলন পৌছে যায় এবং ক্রমে ইউরোপ ও আমেরিকার সকল সভ্য দেশে ছড়িয়ে পড়ে। এসব দেশে এ উদ্দেশ্যে রীতিমত বিভিন্ন সমিতি গঠিত হয় এবং এসব সমিতি বক্তৃতা ও লেখার মারফত জনসাধারণকে জন্মনিয়ন্ত্রণের উপকারিতা ও বাস্তব উপায় শিক্ষা দান করতে শুরু করে। এর সপক্ষে প্রচার চালানো হয় যে, এ পদ্ধতি নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে শুধু বৈধই নয়, বরং উত্তম এবং অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে শুধু লাভজনকই নয়, বরং অপরিহার্য। এজন্যে ঔষধ আবিষ্কার করা হয়, যন্ত্রাদি তৈরী করা হয় এবং এসব ঔষধ ও যন্ত্র জনগণের জন্যে সহজলভ্য করার ব্যবস্থাও করা হয়। স্থানে স্থানে জন্মনিরোধ ক্লিনিক (Birth Control Clinics) খুলে দেয়া হয় এবং এসব ক্লিনিক থেকে বিশেষজ্ঞগণ নারী পুরুষ নির্বিশেষে সবাইকে পরামর্শ দিতে থাকেন। এভাবে এ নূতন আন্দোলন অতি দ্রুত শক্তি অর্জন করে। বর্তমানে এ আন্দোলন ক্রমেই প্রসার লাভ করছে।
আন্দোলন প্রসারের কারণ
মিঃ ম্যালথ্যাস যেসব কারণের ওপর ভিত্তি করে জন্মহার বৃদ্ধি রোধ করার প্রস্তাব পেশ করেছিলেন, বর্তমান যুগে এ আন্দোলন প্রসার লাভ করার মূলে ঐ সব কারণ প্রকৃত কারণরূপে পরিগণিত হচ্ছে না, বরং পাশ্চাত্যের শিল্প বিপ্লব (Industrial Revolution), পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা, বস্তুতান্ত্রিক কৃষ্টি ও আত্নসূখলিপ্সু সভ্যতাই এর প্রকৃত কারণ। আমি এর প্রতিটি বিষয় সম্পর্কে পৃথক পৃথক পর্যালোচনা করে কি কারণে পাশ্চাত্য জাতিগুলো জন্মনিরোধ করতে বাধ্য হয়ছে তা দেখাবার চেষ্টা করবো।
১. শিল্প বিপ্লব
ইউরোপে যন্ত্র আবিষ্কারের পর সম্মিলিত পুঁজির বিত্তিতে বড় বড় কারখানা গড়ে ওঠার ফলে ব্যাপক উৎপাদন (Mass Production)শুরু হয় এবং গ্রামের অধিবাসিগণ দলে দলে চাষাবাদ ছেড়ে দিয়ে চাকরীর উদ্দেশ্যে শহরের পথ ধরে। অবশেষে গ্রামাঞ্চল জনশূন্য হয়ে পড়ে এবং বড় বড় শহর গড়ে ওঠে। এসব শহরে সীমাবদ্ধ স্থানে লক্ষ লক্ষ লোক একত্র হয়; এ ব্যবস্থায় প্রাথমিক স্তরে ইউরোপের অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই উন্নত হয়। কিন্তু পরবর্তীকালে এ ব্যবস্থার ফলেই অনেক অর্থনৈতিক সমস্যা সৃষ্টি হয়। জীবন সংগ্রাম কঠোর হয়ে পড়ে। পারস্পরিক প্রতিদ্বন্দিতা তীব্র আকার ধারণ করে। সামাজিকতার মান উর্ধ্মুখী হয়। জীবন যাত্রার প্রয়োজনীয় সামগ্রীর তালিকা দীর্ঘ হয় এবং এদের দাম এত বেড়ে যায় যে, সীমাবদ্ধ আয়ে নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী সামাজিক মর্যাদা বহাল রাখা অসাধ্য হয়ে পড়ে। আবাসস্থান সংকীর্ণ এবং ভাড়া বেশী হয়ে যায়। উপার্জনকারী খাবার লোকের সংখ্যা বৃদ্ধিকে ভীতির চোখে দেখতে থাকে। পিতার জন্যে সন্তান এবং স্বামীর জন্যে লালন-পালন এক দুঃসহ বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। প্রত্যেকটি লোকই নিজের উপার্জন শুধু নিজেরই প্রয়োজনে খরচ করতে এবং এ ব্যাপারে অন্যান্য অংশীদারের সংখ্যা যথাসম্ভব কমাতে বাধ্য হয়। [ প্রফেসর পল লিন্ডসে নামক জনৈক আধুনিক লেখক খুবই অর্থপূর্ণ ভাষায় উপরিউক্ত কথা স্বীকার করেছেনঃ “শিল্পভিত্তিক সমাজের মানুষ জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও উর্বরতা সম্পর্কে অত্যন্ত ভ্রান্ত ধারণার শিকারে পরিণত হয়েছে। এমন কি এখন যৌনসম্পর্ক স্থাপনকে সন্তান জন্মানোর সম্ভাবনা থেকে পৃথক করে দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ যৌন যন্ত্রের আসল উদ্দেশ্য বর্তমানকালে সন্তান উৎপাদন (Procreation)নয়, বরং আনন্দ উপভোগ (Recreation) বলে পরিগণিত হচ্ছে। দেখুন- Social Problems, Chicago, 1959, Page 102, Landis PaulH.]
২. নারীদের অর্থনৈতিক স্বয়ংসম্পূর্ণতা
উপরোল্লিখিত অবস্থাগুলোর দরুন নারীদেরও নিজ নিজ ব্যয়ভার বহন করতে বাধ্য হতে হয় এবং পরিবারের উপার্জনশীলদের মধ্যে তাদেরও শামিল হতে হয়। সমাজের প্রাচীন প্রথা মুতাবিক পুরুষের উপার্জন করা এবং নারীর গৃহকর্মে নিযুক্ত থাকার কর্মবন্টন ব্যবস্থা বাতিল হয়ে যায়। নারীগণ অফিস ও কারখানায় চাকরী করার জন্যে হাজির হয়। আর জীবিকা উপার্জনের দায়িত্ব গ্রহণের পর সন্তান জন্মানো ও তাঁর প্রতিপালনের স্বাভাবিক দায়িত্ব পালন করা তার পক্ষে সম্ভব হয় না। যে নারী নিজের প্রয়োজন পূরণ ও ঘরের বাজেটে নিজের অংশ দান করতে বাধ্য হয় তার পক্ষে সন্তান জন্মানো কি করে সম্ভব? অনেক নারীই গর্ভাবস্থায় ঘরের বাইরে দৈহিক বা মানসিক শ্রম করার অযোগ্য হয়ে যায়, বিশেষত গর্ভকালের শেষাংশে তো ছুটি গ্রহণ তার জন্যে অপরিহার্য। পুনঃসন্তান প্রসবকালে ও তার পরবর্তী কিছুদিন সে কাজ-কর্ম করার যোগ্য থাকে না। তারপর শিশুকে দুধ পান করানো এবং অন্তত তিন বছর পর্যন্ত তার প্রতিপালন, দেখাশোনা, শিক্ষা দানের কাজ চাকরীর অবস্থায় করা তার পক্ষে কি করে সম্ভব হতে পারে? দুগ্ধপায়ী সন্তানকে কারখানায় বা অফিসে সঙ্গে নিয়ে যাওয়া যেমন মায়ের পক্ষে সম্ভব নয়, তেমনি আর্থিক অসংগতির দরুন শিশুর রক্ষণাবেক্ষণের জন্যে কোনো চাকর নিয়োগ করাও সম্ভব হয় না। যদি মায়ের স্বাভাবিক দায়িত্ব পালন করার জন্যে বেকার থাকতে হয় তাহলে তাকে অনাহারে মরতে হবে কিংবা স্বামীর জন্যে সে এক অসহনীয় বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। এ ছাড়া তার নিয়োগকারীও পুনঃপুনঃ সন্তান প্রসবের জন্যে তাকে ছুটিদান করা পছন্দ করবে না। মোদ্দাকথা, এসব কারণেই নারী তার স্বাভাবিক দায়িত্ব এড়িয়ে চলতে এবং পেটের দায়ে মায়ের যাবতীয় সহজান প্রবৃত্তিকে কোরবানী করতে বাধ্য হয়।
৩. আধুনিক কৃষ্টি ও সভ্যতা
আধুনিক কৃষ্টি সভ্যতা এমন পরিবেশ সৃষ্টি করে যে, এর ফলে সমাজে সন্তান সংখ্যা বৃদ্ধির প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি হয়। বস্তুতান্ত্রিক মনোভাব মানুষের মধ্যে চরম স্বার্থপরতা সৃষ্টি করে। প্রত্যেকেই নিজ নিজ আরামের জন্যে বেশী পরিমাণ সামগ্রী সংগ্রহ করার পক্ষপাতী এবং একের রেজেকে অন্য কেউ অংশীদার হোক; এটা তারা মোটেই পছন্দ করে না। এমনকি বাপ, ভাই, বোন ও সন্তানকে পর্যন্ত এরা নিজেদের উপার্জিত সম্পদের ভোগে অংশীদার করতে রাজী নয়। ধনী ও বড় লোকেরা বিলাসিতার জন্যে এত সব উপায় উপাদান তৈরী করেছে যে, এদের দেখাদেখি মধ্যবিত্ত ও নম্নশ্রেণীর লোকেরাও এদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করার লোভ সামলাতে পারেনি। এর ফল দাঁড়িয়েছে যে, অনেক বিলাসোপকরণ মানুষের সামাজিক মান এত উঁচু করে দিয়েছে যে, স্বল্প আয় বিশিষ্ট লোকের পক্ষে স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততির ব্যয় ভার বহন করা তো দূরের কথা তার নিজের বাসনা চরিতার্থ করাই দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। [ একজন ফরাসী লেখক প্রকাশ করেছেন, জন্মনিরোধকারী দম্পতিদের নিকট থেকে এদের এ পথ অবলম্বনের কারণ অনুসন্ধান করে জানা যায় যে, অধিক সন্তান ও অধিক অস্বচ্ছলতার দরুন যারা জন্মনিরোধ করে তাদের সংখ্যা অতি নগণ্য। অধিক সংখ্যক লোক যে কারণে জন্মনিরোধ করে তা হচ্ছে, “নিজেদের আর্থিক অবস্থা এবং জীবন যাত্রার মান উন্নত করণ, নিজেদের সম্পত্তির অধিক সংখ্যক ওয়ারিশগণের মধ্যে বন্টন রোধ, প্রিয় সন্তান্দের উচ্চশিক্ষা দিয়ে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্যে তৈরী করণ, স্ত্রীর সৌন্দর্য ও কমনীয়তাকে গর্ভধারণ ও সন্তান পালনের ঝামেলা থেকে হেফাজত করা। নিজেদের ভ্রমণ ও চলাফেরার আজাদী বহাল রাখা যেন অনেক সন্তানের দরুন স্ত্রী শুধু শিশুদের দখলে না যায় এবং স্বামীর আনন্দ অতৃপ্ত থাকতে বাধ্য না হয়।” Paul Burcan, Towards Moral Bankruptcy, London, 1925, Page-46]
নারী শিক্ষা ও নারী স্বাধীনতা এবং নারী পুরুষের অবাধ মেলামেশা এমন একটি নূতন ভাবধারা সৃষ্টি করেছে যার ফলে নারী সমাজ তার স্বাভাবিক মাতৃত্বের দায়িত্ব এড়িয়ে চলার জন্য সর্বদাই চেষ্টা করে চলেছে। এর ঘরের কাজ এবং শিশু পালনকে এক দুঃসহ বোঝা মনে করে এবং এ কাজ থেকে পালিয়ে বেড়ায়। এদের দুনিয়ার যাবতীয় বিষয়েই আসক্তি আছে। যদি কোন বিষয়ে এদের নিরাসক্তি থাকে তবে তা হচ্ছে তাদের ঘর, ঘরের কাজ ও সন্তান প্রতিপালন। বাইরের আনন্দ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ঘরের কষ্ট বরদাশত করা তাদের বিবেচনায় নির্বুদ্ধিতা। পুরুষদের নিকট আকর্ষণীয় হয়ে থাকার জন্যে তারা শীর্ণদেহী, কোমল, কমনীয়, সুশ্রী ও যুবতী হয়ে থাকার জন্য আগ্রহশীল। এ সব উদ্দেশ্য হাসিল করার জন্য তারা বিষাক্ত ঔষধ পান করে জীবন নাশ করতেও রাজী। [ কিছুদিন পূর্বে নিউইয়ার্কের হেলথ কমিশনার এক সতর্কবাণি উচ্চারণ করেন যে, মহিলাগণ শীর্ণদেহী হবার জন্য (Dimitrophenol) নামক যে ঔষধ খুব বেশী পরিমাণে ব্যবহার করে তা বিষাক্ত বলে প্রামাণিত হয়েছে এবং বিষক্রিয়ায় এযাবৎ অনেক মহিলা মৃত্যু হয়েছে। ] নিজেদের প্রাসাধনী ও পোশাক-পরিচ্ছেদের জন্য এরা কোটি কোটি টাকা খরচ করতে পারে; কিন্তু সন্তানদের লালন-পালনের জন্য এদের বাজেটে কোন অর্থ নেই।
কৃষ্টি ও সভ্যতা চরম আত্নসুখবোধ সৃষ্টি করে দিয়েছে। মানুষ যত অধিক পরিমাণে সম্ভব সুখভোগ করতে চায় কিন্তু এর পরিণতিতে স্বাভাবিকভাবে তাদের উপর যে সব দায়িত্ব আসে তা বহন করতে তারা প্রস্তুত নয়। গর্ভকাল ও সন্তান প্রসবের পর সন্তান পালনকালে নিজেদের সম্ভোগ লিপ্সাকে শিথিল করা এদের জন্য অসহনীয়। শিশুদের শিক্ষা-দীক্ষা ও ভবিষ্যতে জীবনে সুখ সমৃদ্ধির জন্যে অনেকেই (বিশেষত মধ্যবিত্ত শ্রেণী) মনে করে যে, একটি কিংবা দু’টি সন্তানের বেশী জন্মাতে তারা ইচ্ছুক নয়। জীবন যাত্রার মান ও কল্পনা বিলাসিতা এত উর্ধগামী হয়ে গেছে যে, জীবন যাপনের উপকরণগুলো এদের সঙ্গে তাল রেখে চলতে পারছে না। এদের এই উচ্চ কল্পনাবিলাস অনুযায়ী অধিক সংখ্যক সন্তানদের প্রতিপালন, শিক্ষাদান ও জীবনের উত্তম সূচনায় Start সুযোগ দান এদের জন্যে অসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া তথাকথিত সভ্যতা শিক্ষা-দীক্ষার উপায়-উপাদানগুলোকে অত্যন্ত ব্যয়বহুলও করে দিয়েছে।
নাস্তিকতা মানুষের মন থেকে আল্লাহর ধারণাই মিটিয়ে দিয়েছে। এমতাবস্থায় আল্লাহর উপর ভরসা করা এবং তাঁর রেজেকদাতা হওয়ার উপর নির্ভর করার প্রশ্নই ওঠে না। এ ধরনের মানুষ শুধু বর্তমান উপকরণের উপর নির্ভর করে নিজেকেই নিজের ও সন্তানদের রেজেকদাতা বলে বিবেচনা করে।
এসব কারণের দরুনই পাশ্চাত্য দেশগুলোতে জন্মনিরোধ আন্দোলন দ্রুত গতিতে প্রসার লাভ করেছে। এসব কারণের প্রতি লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, পাশ্চাত্য জাতিগুলো প্রথমেই ভুল করে তাদের সভ্যতা সামাজিকতা ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে বস্তুতান্ত্রিক পুঁজিবাদ ও আত্নপূজার ভ্রান্ত ভিত্তির উপর স্থাপন করেছে। তারপর যখন তাদের এ-কীর্তি পূর্ণতায় পৌছে তার কুফল দ্বারা সমাজকে আচ্ছন্ন করতে শুরু করেছে তখন দ্বীতীয়বার তারা নির্বুদ্ধিতা করে বাহ্যিক চাকচিক্যময় আর্থিক ও সামাজিক ব্যবস্থাকে বহাল রেখে এর যাবতীয় কুফল থেকে রেহাই পাবার চেষ্টা করেছে। এরা বুদ্ধিমান হলে নিজেদের সামাজিক অত্যাচারের উৎস খুঁজে বের করতো এবং নিজেদের জীবন থেকে এসব দোষ দূর করতে চেষ্টা করতো। এরা আসল দোষের সন্ধান তো পায়ইনি বা পেয়ে থাকলেও বাহ্যিক চাকচিক্যময় সভ্যতার যাদুতে এমনভাবে মুগ্ধ হয়ে পড়েছে যে এর সংশোধন করে কোন উন্নততর সমাজ কায়েম করতে এরা রাজী নয়। বরং এরা নিজেদের কৃষ্টি, সভ্যতা, আর্থিক ব্যবস্থা ও সামাজিকতায় ঠাঁট বজায় রেখে জীবনের সমস্যাবলীকে ভিন্নপথে সমাধান করতে সচেষ্ট হয়। এ উদ্দেশ্যে গবেষণা ও অনুসন্ধান করে এদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেবার জন্যে সন্তান সংখ্যা কমিয়ে দেয়াই এদের নিকট সহজ বিবেচিত হয়েছে; যাতে করে ভবিষৎ বংশধরদেরকে নিজেদের খাদ্য ও বিলাস দ্রব্যের অংশ না দিয়ে পরমানন্দে দিন কাটানো সম্ভব হয়।