২নম্বর পরিশিষ্ট
জন্মনিয়ন্ত্রণ আন্দোলনের তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ
(অধ্যাপক খুরশদি আহমদ, করাচী)
বর্তমানে প্রাচ্য দেশগুলোতে- বিশেষত, মুসলিম জাহানে জন্মনিয়ন্ত্রণের আন্দোলনকে অতি দ্রুত সম্প্রসারিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। ধর্ম ও যুক্তি- উভয় দিক থেকেই এ বিষয়ে তুমুল বিতর্ক হচ্ছে এবং এ বিষয়ে চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গীর বিভিন্ন দিক জনসমক্ষে প্রকাশিত হচ্ছে। বিতর্কের বিভিন্ন দিকে সঙ্গে কারো মতৈক্য হোক বা না হোক, এ কথা অনস্বীকার্য যে, বিতর্কের ফলে সত্য উৎধাটনের পথ সহজতর হয় এবং যুক্তির সংঘর্ষে প্রকৃত সত্য পর্যন্ত পৌঁছার নিশ্চিত সুযোগ সৃষ্টি হয়। তত্ত্বমূলক বিতর্কের দ্বারা অনুসন্ধান ও গবেষণার পথ প্রশস্ত হতে থাকে এবং মানবীয় চিন্তার ক্রমবিকাশের ব্যবস্থা হয়। প্রকৃত মানুষ হচ্ছে তারা, যারা অন্ধ অনুকরণের ছক্কাটা রাস্তাধরে চলার পরিবর্তে আল্লাহ প্রদত্ত যোগ্যতার ভিত্তিতে সততা ও নিষ্ঠা সহকারে চেষ্টা-যন্ত্রের মাধ্যমে নিজের পথ নিজেই তৈরী করে নেয়। এ ধরনর মানুষ যুক্তির ভাষায় কথা বলে এবং বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে।
দুর্ভাগ্যবশত মুসলিম জাহানে এমন এক শ্রেণীর লোক সৃষ্টি হয়েছে- যারা নিজেদর বুদ্ধি ও চিন্তার আজাদীকে পশ্চিমের দাসত্বের বেদীমূলক কোরবানী করে দিয়েছে। এ শ্রেণীর লোকেরা ইজতিহাদ (গবেষণা)-এর পরিবর্তে পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুসরণ ও অনুকরণেরপথ চলে এবং নিজেদের চিন্তা শক্তিকে ব্যবহার করার পরিবর্তে চোখ বুঝে দৈনন্দিন সকল বিষয়ে পশ্চাত্য পদ্ধতিই গ্রহণ করতে চায়।
কোন বিষয়ের প্রতি অন্দ পক্ষপাতিত্ব, চোখ বুজে কারো অনুসরণ এবং নির্বিচারে পরানুকরণের দোষ শুধু যে ধর্মানুসারীদের এক সীমাবদ্ধ শ্রেণীতে পাওয়া যায় তাই নয়, বরং আধুনিক শিক্ষা ও সংস্কৃতির ধারক-বাহকদের মধ্যে এসব দোষ যথেষ্ট পরিমাণে পাওয়া যায়। প্রকৃতপক্ষে গোঁড়ামির মনোভাব প্রথমোক্ত দলের চেয়ে দ্বিতীয় দলেই সুস্পষ্ট। এ শ্রেণীর লাকেরা ইজতিহাদের স্বপক্ষে জোর প্রচার চালিয়ে থাকে কিন্তু তাদের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে িইজতিহাদের সাহায্যে কোন উপায়ে ইসলামকে পাশ্চাত্য সভ্যতার ছাঁচে ঢালাই করা। প্রকৃত ইজতিহাদের গন্ধও তারা পায় নি। তারা নিজেদের মস্তিষ্কের পরিবর্তে পাশ্চাত্যের মস্তিষ্ক চিন্তা করে- পাশ্চাত্যের মুখ দিয়ে কথা বলে এবং চিন্তা-ভাবনার প্রতি বালাই থেকে মুক্ত হয়ে তাদেরই পদাঙ্ক অনুসরণ করে চলে। পাশ্চাত্যের প্রতি আমার কোন বিদ্বেষ নেই, সেখানে ভাল ও মন্দ উভয়ই আছে। আমাদের চোখ খুলে সব কিছু দেখা দরকার এবং নিজেদের বুদ্ধি-বিবেচনা শক্তি ব্যবহার করে গভীর অন্তর্দৃষ্টিসহকারে সব কিছু যাচাই করে নিজেদের পথ নিজেদেরই তৈরী করে নেয়া উচিত। অন্ধ অনুসরণ ও অনুকরণ জাতির বুদ্ধিবৃত্তির মৃত্যু ও সাংস্কৃতিক পথভ্রষ্টতা ডেকে আনে।
মরহুম কবি ইকবা সারা জীবন এ মনোভাবের বিরোধিতা করেছেন। এ শ্রেণীর লোকদের লক্ষ্য করে তিনি অভিযোগ করেছেন:
“পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণে তুমি হয়ে গেলে রাজী,
আমার অভিযোগ তোমার বিরুদ্ধে,
পাশ্চাত্যের বিরুদ্ধে নয়।”
তিনি দুঃখ করে বলেছেন:
“এ যুগে যে ইমাম হতে পারতে।
সে যুগান্তকারী মস্তিষ্ক আজ করছে দাসত্ব।”
আর নিজের জাতির প্রতি আল্লামা ইকবাল মরহুমের বাণী ছিলো:
“তুমি নিজের চোখে তাকাও যদি যুগের প্রতি,
মাহুশূন্য আলোকিত কবে তোমার ঊষার জ্যোতি।
তোমার ষ্ফুলিঙ্গ থেকে সূর্য করতে আলো আহরণ,
চাঁদের মুখবয়ব থেকে তোমার সৌভাগ্যের হবে স্ফূরণ।
তোমার চিন্তার মুক্তমালায় সাগর তরঙ্গায়িত হবে,
আর প্রকৃতি তোমার অলৌকিক নৈপূণ্যে লজ্জিত হবে।
অন্যের চিন্তার দুয়ারে তোমার এ ভিজ্ঞাবৃত্তি!
তুমি কি হারিয়েছ তোমার খুদীর সীমান্তে পৌঁছার শক্তি?”
দুর্ভাগ্যবশত মুসলিম জাহানেও বর্তমানে জন্মনিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে পাশ্চাত্যের এ অন্ধ অনুসরণের মনোভাব নিয়েই বিচার বিশ্লেশষণ চলছে। পাশ্চাত্যের রঙ্গীন চশমায় দেখার পরিবর্তে দুনিয়াকে তার নিজস্ব রঙ্গে দেখা এবং স্বাধীন চিন্তা ও উদার দৃষ্টির পরিচয় দান করাই আমাদের উচিত। যুক্তকে গ্রহণ করার জন্যে আমাদের সর্বদাই প্রস্তুত থাকতে হবে। কিন্তু অন্ধ পক্ষপাতিত্ব ও পরানুকরণের নিকট আত্মসমর্পণ করতে আমাদের কিছুতেই রাজী থাকা উচিত নয়। কারণ “যে যুক্তি শুনতে ও যুক্তির ভিত্তিতে আলোচনা করতে নারাজ সে পক্ষাতদুষ্ট ও হঠকারী। আর যে যুক্তি দিয়ে যুক্তির মোকাবিলায় যুক্তি পেশ করতে অক্ষম সে স্থুলবুদ্ধিসম্পন্ন ও নির্বোধ।” এ বিষয়ে মুসলমান জাতি দাসসুলভ মনোভাব পরিত্যাগ করে আজাদ মনোভাব নিয়ে চিন্তা গবেষণা করবে- এইটি আমার আন্তরিক কামনা। আমি বর্তমানে যা পেশ করতে চাই তা এ প্রসঙ্গেরেই সামান্যতম প্রচেষ্টামাত্র।
১. জন্মনিয়ন্ত্রণের মূল কারণ কি অর্থনৈতিক
জনসংখ্যা সীমিতকরণ মতবাদে বিশ্বাসীগণ আজকাল তাদের যুক্তির ভিত্তি অর্থনৈতিক অবস্থার ওপরেই স্থাপন করে এবং বাড়তি জনসংখ্যার ফলে উদ্ভুত অসুবিধাগুলো দূর করার জন্যে জন্মনিয়ন্ত্রণের প্রস্তাব পেশ করে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, সত্যই কি নিছক অর্থনৈতিক কারণে বর্তমান দুনিয়ার এ আন্দোলন প্রসার লাভ করেছে? ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, অর্থনৈতিক কারণ ও জনসংখ্যা সীমিতকরণ আন্দোলনের মধ্যে কোন সম্পর্ক নেই।
এ বিষয়ে সন্দেহ নেই যে, ম্যালথাস (Malthus) জনসংখ্যা বৃদ্ধির সমস্যাকে অর্থনৈতিক ভিত্তিতেই পেশ করেছিলেন এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধি প্রতিরোধের প্রস্তাবও দিয়েছিলেন (প্রকাশ থাকে যে, ম্যাল্যাস জন্মনিয়ন্ত্রণের ঘোর বিরোধী ছিলেন। তিনি তো বংশ সীমিত করার জন্যে স্মাবী-স্ত্রীর পৃথক অবস্থান ও দাম্পত্য জীবনে নৈতিক নিয়ন্ত্রণের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেছিল মাত্র)। কিন্তু ম্যালথ্যাসের জামানায় ও তাঁর পরবর্তীকালে অর্থনীতি ও শিল্পক্ষেত্রে পাশ্চাত্য দেশে যে বিপ্ব সংঘটিত হয় তার ফলে অবস্থা সম্পূর্ণরূপে পরিবর্তিত হয়ে যায় এবং মানুষের জীবনযাত্রার গতি এমন এক পথ ধরে চলতে শুরু করে যা ম্যালথ্যাসের কল্পনায়ও স্থান পায় নি অর্থাৎ উৎপন্ন দ্রব্যের সীমাহীন সম্ভাবনা সম্পর্কে তাঁর কোন ধারণাই ছিল না।
ঈসায়ী ১৭৯৮ সালে ম্যালথ্যাস অর্থনৈতিক উপকরণের অভাবের ধুয়া তুলেছিলেন। কিন্তু উনিশ শতকের যে অর্থনৈতিক উন্নতি সাধিত হয় তার ফলে ম্যালথ্যাস বর্ণিতসকল আশঙ্কা সম্পূর্ণ অমূরক প্রমাণিত হয়েছে।
এর পূর্ণ এক শ বছর পরে ১৮৯৮ ঈসায়ী সালে বৃটিশ এসোসিয়েশনের সভাপতি স্যাল উইলিয়াম ক্লোকস্ পুনরায় বিপদসংকেত দান করেন এবং বলেনযে, ১৯৩১ সাল পর্যন্ত উৎপাদন ভীষণভাবে কমে যাবে এবং বিপুল সংখ্যক মানুষ দুর্ভিক্ষ ও মৃত্যুর কবলে পড়তে বাধ্য হবে। কিন্তু ১৯৩১ সালে দুনিয়া উৎপাদনের অভাজনিত সমস্যার পরিবর্তে প্রয়োজনতিরিক্ত উৎপাদনের (Over Production) সমস্যার সম্মুখীন হয়।
জনসংখ্যা ও অর্থনৈতিক উপকরণ সম্পর্কে এ যাবৎ যত ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে তা থেকে শুধু একটি দৃঢ়তা সহকারে বলা যেতে পারে যে, এ ধরনের ভবিষ্যদ্বাণী সর্বদাই ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়েছে। প্রফেসার জাইড্ ও রিস্ট (Charles Gide and Charles Rist) তো নিম্নরূপ উক্তি করেন:
“এ বিষয়ে সন্দেহ নেই যে, তিনি (অর্থাৎ ম্যালথ্যাস) যেসব আশংকার কথা প্রকাশ করেছিলেন, বিশ্বের ইতিহাস তা সমর্থন করে না। দুনিয়ার কোন দেশই এমন অবস্থার সম্মুখীন হয়নি যার দরুন সে দেশকে অতিরিক্ত জনসংখ্যা (Over Population) সমস্যায় পতিত বলে মনে করা যেতে পারে- জনসংখ্যা অত্যন্ত ধীরগতিতে বাড়তে থাকে। অন্যান্য দেশ অবশ্য উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। কিন্তু কোন দেশেই জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার সম্পদ বৃদ্ধির হর সম্পদ বৃদ্ধির হারের তুলনায় বেশী হয়নি।[Gide and Rist: A History of Economic Doctirines, London, 1950. p. 145.]
এরিত রোল (Erich Roll)-ও এ কথা বলেন:
“অর্থনৈতিক উন্নতির বাস্তব অবস্থা ম্যালথ্যাসের পেশকৃত মতবাদকে উত্তমরূপে মিথ্যা ও ভিত্তিহীন প্রমাণ করবে।[Erich Roll; A History of Economic Thought, NewYOrk, 1947,p.21]
নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে ইতিহাস পাঠে পরিষ্কারভাবে জানা যায় যে, পাশ্চাত্যের কোন একটি দেশেও অর্থনৈতিক উপকরণাদির অভাব এবং ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার দৈনন্দিন প্রয়োজন পুরণের অক্ষমতা হেতু জন্মনিয়ন্ত্রণ প্রবর্তন করা হয়নি। যে যুগে (উনিশ শতকের শেষার্ধ থেকে বিশ শতকের প্রথম ত্রিশ বছর) ইউরোপ ও আমেরিকায় জন্মনিয়ন্ত্রণ আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। সে যুগে এ দু’মহাদেশে অর্থনৈতিক উন্নতি ও সমৃদ্ধি বিদ্যমান ছিলো। যাঁরা অর্থনৈতিক কারণে এ আন্দোলনের গোড়ায় অর্থনৈতিক কারণ থাকা সম্পর্কি কহিনীটিকে সম্পূর্ণরূপে বাতিল করে দেয়।
দেশ | সময় | মাথাপিছু জাতীয় সম্পদ উৎপাদন বৃদ্ধির হার |
ইংলন্ড- | ১৮৬০-১৯৩৮ | +২৩১% |
আমেরিকা | ১৮৬৯-১৯৩৮ | +৩৮১% |
ফ্রান্স | ১৮৫০-১৯৩৮ | +১৩৫% |
সুইডেন | ১৮৬১-১৯৩৮ | +৬৬১% |
জনসংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি সম্পদ ব্যবহারকারীদের সংখ্যা বৃদ্ধি সত্ত্বেও সম্পদ উপরিউক্ত হারেবেড়ে যায়। এভাবে জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে গণনায় শামিল করে এসব দেশের বার্ষিক উন্নতির হার হিসাব করলে অবস্থা নিম্নরূপ দেখা যায়-
দেশ | উৎপাদন হারের বার্ষিক বৃদ্ধি |
ইংলন্ড- | +২.৯% |
আমেরিকা- | +৪.৮% |
সুইডেন- | +৮.৫% |
ফ্রান্স- | +১.৪% [এ সব সংখ্যাতত্ত্ব নিম্নবর্ণিত গ্রন্থাবলী থেকেক গৃহীত:
Buchana and Ellis. Approaches to Economic Development, New York, 1955.pp 213-15 |
এসব তথ্য থেকে জানা গেল যে, ইউরোপে যে যুগে জন্মনিয়ন্ত্রণ প্রবর্তন করা হয় সে যুগে সেখানকার জীবনযাত্রার মান উন্নত ছিলো এবং ক্রমে অধিকতর উন্নতির দিকে ধাবমান ছিলো। এ ছাড়া ইউরোপের বিভিন্ন দেমের উৎপাদনের হাড়ও প্রতি বছর দ্রুতগতিতে বাড়ছিলো। অন্য কথায় সে যুগে কোন অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা ছিলো না এবং জন্মনিয়ন্ত্রণ প্রবর্তন করার কোন অর্থনৈতিক ভিত্তিও ছিল না। বর্তমান দুনিয়ার অবস্থাও ঐ একইরূপে। ১৯৪৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত পৃথিবীর খাদ্য উৎপাদন গড়ে শতকরা ২.৭ হারে প্রতি বছর বেড়ে চলেছে। আর এ বৃদ্ধির হার জনসংখ্যা বৃদ্ধিরহ হারের দ্বিগুণ। এছাড়া ঐ একই সময়ে শিল্প উৎপাদনের হার প্রতি বছর শতকরা ৫ হারে বেড়ে চলেছে। উৎপাদন বৃদ্ধির এ হার জনসংখ্যা বৃদ্ধি হারের প্রায় তিন গুণ।[A Zimmerman – এর প্রবন্ধ Over-Population’ শিকাগো থেকে প্রকাশিত Whati’s New পত্রিকায় ১৯৫৯ সালে বসন্তকালীন ২১১ সংখ্যা।]
এ আন্দোলনের যদি কোন অর্থনৈতিক ভিত্তি না থঅকে তাহল এর প্রসারের মুলীভূত কারণ কি? আমাদের মতে ইউরোপের সামাজিক ও তমদ্দুনিক অবস্থাই এর আসল কারণ। পাশ্চাত্য দেশগুলোতে নর-নারীর সমানাধিকার ও অবাধ মেলামেশার ভিত্তিতে যে সমাজ কায়েম হয়েছিল তারই স্বাভাবিক ও যুক্তিসম্মত পরিণতি হিসাবেই জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা প্রবর্তন অপরিহার্য হয়ে দাঁড়ায়, যাতে করে মানুষ নিজের ভোগ-লিপ্সা চরিতার্থ করার পরও এর স্বাভাবিক পরিণতির দায়িত্ব বহন করা থেকে রেহাই পেতে পারে। আল্লামা ইকবার এ বিষয়টির প্রতি ইঙ্গিত করে বলেছেন:
(উর্দু**********)
‘এই কি সমাজের বাহাদূরী
পুরুষ কর্মহীন, শূন্যকোল নারী?
পাশ্চাত্যের ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, জন্মনিয়ন্ত্রণের প্রশ্নটি আগাগোড়াই সামাজিক ও তমদ্দুনিক কারণে উঠানো হয়েছে এবং অর্থনীতির সঙ্গে যদি এর কোন সম্পর্ক থেকে থাকে তবে তা ‘সৃষ্টর্মী নীয়’। বরং প্রলয় ধর্মী। কেননা নারীর “কোল শূন্য” ও পুরুষের কর্মহীন (Unemployed) থাকার মধ্যে নিকট সম্পর্ক রয়েছে। লর্ড কেনীস, প্রফেসার হেইনসন ও প্রফেসার কোল-এর ন্যায় বিশেষজ্ঞগণও আধুনিক অর্থনীতি সম্পর্কে আলোচনায এ বিষয়ে পরিষ্কারাবে আলোকপাত করেছেন।
২। জন্মনিয়ন্ত্রণ ও বিশ্ব রাজনীতি
আগেই বলেছি যে, অতীতেও জন্মনিয়ন্ত্রণের সঙ্গে অর্থনীতির কোন সম্পর্ক ছিল না- আজও নেই। পাশ্চাত্য দেশগুলোতে সামাজিক ও তমদ্দুনিক কারণে এ ব্যবস্থা প্রসার লাভ করেছে এবং বর্তমানে রাজনৈতি উদ্দেশ্যে নিয়েই পাশ্চাত্য দেশগুলা অন্যান্য দেশকে এ পথ দেখাচ্ছে।
ইতিহাস পাঠক মাত্রই এ কথা জানেন যে, জনসংখ্যার রাজনৈতিক প্রভাব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিটি সভ্যতা ও প্রতটি বিশ্ব-শক্তি নিজেদের গঠন উন্নয়নের যুগে তাদের জনসংখ্যা বাড়াবার চেষ্টা করেছে। বিখ্যাত ঐতিহাসিক উইল ডুরান্ট(Will Durant) টয়েনবীও (Arnold Toynbee) জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে সে সব বুনিয়াদি চ্যালেঞ্জসমূহের অন্যতম বলে ঘোষণা করেছেন যেগুলোর জোরে একটি জাতির উন্নতি ও বিস্তৃতি ঘটে। যে সব জাতি ইতিহাস সৃষ্টি করেছে এবং দুনিয়ার বুকে তাদের কীর্তি রেখে গিয়েছে তারা সর্বদাই জনসংখ্যা বৃদ্ধির পথ ধরে অগ্রসর হয়েছে। অপরদিকে পতনশীল সভ্যতা সকল যুগেই জনসংখ্যার অভাবের সম্মুখীন হয়েছে। জনসংখ্যা ক্রম হ্রাস হয়ে রাজনেতিক ও সামষ্টিক শক্তির ভিত্তি দুর্বল করে দেয় এবং যে জাতি এ অবস্থায় পতিত হয় সে ধীরে ধীরে বিস্তৃতির অতল তলে তলিয়ে যায়। সভ্যতার সকল প্রাচীন কেন্দ্রগুলোর ইতিহাস ও কথার সত্যতা সপ্রমাণ করে।
আধুনিক ইউরোপের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রাধান্যের রহস্যও জনসংখ্যার মধ্যেই নিহিত। প্রফেসার আর্গানস্কীর (Albrano F. K. Organski) ভাষায়:
“জনসংখ্যার বিপুল বৃদ্ধি-এমন বৃদ্ধি যা অবাধ ও অপরিকল্পিত উপায়ে হচ্ছিল তা- ইউরোপকে দুনিয়ার প্রথম শ্রেণীর শক্তি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার ব্যাপারে চুড়ান্ত প্রভাব বিস্তার করে। ইউরোপে জনসংখ্যা বৃদ্ধির িএই বিস্ফোরণের (Population Explosion) ফলেই নুতন শিল্পকারখানা ভিত্তিক অর্থনীতিকে কার্যকরী করার জন্যে প্রয়োজনীয় বিপুল সংখ্যক কর্মী পাওয়া যায় এবং দুনিয়ার অর্ধেক এলাকা ব্যাপী ও বিশ্বের সমগ্র জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশের ওপর প্রতিষ্টিত বিশাল সাম্রাজ্য পরিচালনা করার উপযোগী সৈনিক ও কর্মচারী তৈরী হয়ে যায়।” [Organaski Albrano F.k. Population and Politics in Europe,” Science Magazine, American Association for Advancement of Science, vide Loory Stuart H. Population Explosion, Dawn’ July 17,1961.]
প্রফেসার আর্গানস্কীর অভিমত হচ্ছে এই যে, দুনিয়ার যে সমস্ত দেশে জনসংখ্যা বেশী তাদের অবস্থা সর্বদাই উত্তম ছিলো রয়েছে এবং যে যুগে জনসংখ্যা দ্রুতগতিতে বেড়ে চলেছিলো ঐ যুগেই তাদের অবস্থা সবচাইতে ভালো ছিলো।
প্রফেসর কলিন ক্লার্ক বলেন :
“বৃটেনের অধিবাসীরা পরম সহাসিকতার সঙ্গে ম্যালথ্যাসের যুক্তিগুলোকে অগ্রাহ্য করেছে। যদি তারা ম্যালথ্যাসের মতবাদের নিকট নতি স্বীকার করতো তাহলে বৃটেন আজ আঠারো শতকের একটি কৃষিজীবি জাতিতে পরিণত হতো। আমেরিকা ও বৃটিশ কমনওয়েলথের বিকাশ ও উন্নতির কোন প্রশ্নই ঐ অবস্থায় উঠকো না। ভারী শিল্পের স্বাভাবিক অর্থনৈতিক দাবীই হচ্ছে- ব্যাপক চাহিদা পণ্য বিক্রয়ের বাজার ও পরিবহণের উন্নত ব্যবস্থা। আর এসবই একটি দ্রুত বর্ধিত জনসমাজেই সম্ভব।” [Colin Clark, “World Population and Food Supply”, Nature vol, 181, May, 1985]
জনসংখ্যার এই যে গুরুত্ব এর অত্যন্ত প্রভাব বিস্তারকারী রাজণেতিক ও অর্থনৈতিক দিকও রয়েছে। এ বিষয়ে কয়েকটি জরুরী কথা পেশ করা দরকার মনে করছি।
বর্তমানে দুনিয়ার জনসংখ্যা যেভাবে বিভক্ত হয়েছে এসব এলাকার মুসলিম জাহান বিপুল কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়েছে। িএসব এলাকার তুলনায় ঐ অঞ্চলের লোকসংখ্যঅর অনুপাত আরও কমে যাবে। বিগত পাঁচ শত বছর যাবত জনসংখ্যা কম থাকা সত্ত্বেও পাশ্চাত্য দেশগুলো বিজ্ঞান ও যান্ত্রিক শ্রেষ্ঠত্বের দরুন প্রাচ্যদেশগুলোর উপর তাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও প্রাধান্য কায়েম করতে পেরেছিলো, বরং সাম্রাজ্যবাদিতার প্রাথমিক যুগেই এ ভ্রান্ত ধারণার জন্ম হয় যে, জনসংখ্যার স্বল্পতা সত্ত্বেও পাশ্চাত্য জাতিগুলো স্থায়ীভাবে তাদের প্রাধান্য কায়েম রাখতে সক্ষমহবে। কিন্তু নূতন অবস্থা ও বাস্তব তথ্যাবলী এ অমুলক ধারণার জাল ছিন্ন ভিন্ন করে দিয়েছে।
পাশ্চাত্য জাতিগুলোর জনসংখ্যা ক্রমেই কমে যাওয়ার ফলে তাদের রাজনৈতক ক্ষশতার অবনতি ঘটেছে এবং প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের পর থেকে সেখানকার সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করেছে যে, জনসংখ্যা সীমিতকরণ প্রচেষ্টার মূল্য খুব বেশী পরিমাণে দিতে হচ্ছে। ফ্রান্সও ধীরে বিশ্বের দরবারে তার মর্যাদা হারিয়ে ফেলেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মার্শাল প্যাঁতে েএ কথা প্রকাশ্যভাবে স্বীকার করেছেন যে, ফ্রান্সের অবনতির সবচাইতে বড় কারণ হচ্ছে সন্তান সংখ্যার স্বল্পতা (Too Few Children) ও লোক সংখ্যার অভাব। ইংলন্ড ও অন্যান্য দেশেও জন্মনিরোধের কুফল ফলতে শুরু করেছে এবং এ অবস্থা দেখে সুইডেন, জার্মানী, ফ্রান্স, ইংলন্ড ইটালী প্রভৃতি দেশসমূহ তাদর কর্মনীতি পুনর্বিবেচনা করতে শুরু করে দিয়েছে। এখন অবস্থা দেখে এই যে, ওপরে বর্ণিত দেশগুলোতে জনসংখ্যা কমানোর পরিবর্তে বাড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু এসব প্রচেষ্টা সত্ত্বেও পাশ্চাত্য জাতিগুলো তাদের রাজনেতিক মর্যাদা বহাল এবং বিশ্বরাজনীতির রাজমুকুট মস্তকে দীর্ঘকাল রাখার জন্যে যে পরিমাণ জনসংখ্যা বাড়ানো দরকার সে পরিমাণ বাড়াতে সক্ষম হবে কি না- এ বিষয়ে সন্দিহান হয়ে পড়েছে। তারা পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে যে, জনসংখ্যা বাড়িয়েও ভবিষ্যতে তাদের পক্ষে প্রাচ্য দেশ ও মুসলিম জাহানের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা সম্ভব হবে না।
পুনরায় যে সূক্ষ্ম শিল্প, বিজ্ঞান ও কারিগরী তথ্যাবলী এ পর্যন্ত প্রাচ্যের ওপর পাশ্চাত্যের প্রাধান্য কায়েম করে রেখেছিলো এবং বহু চেষ্টা করে প্রাচ্যকে এ বিষয়ে অজ্ঞ রাখার চেষ্টা করা হয়েছিল বর্তমানে সে সব তথ্য ও জ্ঞানের ব্যাপারেও প্রাচ্য দেশগুলো দ্রুত উন্নতির সাথে এগিয়ে যাচ্ছে। যেহেতু এসব দেশের জনসংখ্যা পাশ্চাত্য দেশগুলোর তুলনায় অনেক বেশী- সেহেতু আধুনিক যন্ত্রপাতিতে সুসজ্জিত হবার পর এদের পরাধীন থাকার আর কোন কারণই থাকতে পারে না। ফলে প্রাকৃতিক নিয়ম অনুযায়ী উক্তরূপে বিপ্লবের অনিবার্য পরিণতিস্বরূপ পাশ্চাত্যের রাজনেতিক প্রাধান্যের দিন সীমিত হয়ে যাবে এবং যে সব দেশগুলো জনসংখ্যা, বিজ্ঞান, কারিগরী ও যুদ্ধবিদ্যায় অগ্রসর তারাই বিশ্বরাজনীতিতে নেতৃত্ব দেবে। এমতাবস্থায় পাশ্চাত্য দেশগুলো এক ধ্বংসাত্মক রাজণেতিক খেলা শুরু করে দিয়েছে অর্থাৎ একদিকে বংশ সীমিতকরণ ও জন্মনিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে প্রাচ্য দেশসমূহের লোক সংখ্যা কমানোর এবং অপরদিকে কারিগরী তথ্যাবলীর প্রসারে বাধা সৃষ্টির মাধ্যমে তারা নিজেদের প্রাধান্য বহাল রাখার চেষ্টায় লিপ্ত আছে। আমি নিছক বিদ্বেষের বশবর্তী হয়ে এ কথা বলছি না, বরং পাশ্চাত্য দেশের উপকরণাদি থেকেই আমি এটা প্রমাণ করতে পারি। জনসংখ্যা সম্পর্কে অনেক বই লেখা হয়েছে। সে সবের মধ্যে প্রাচ্য দেশসমূহের সংখ্যাকে অতিরঞ্জিত করে ভীতি হিসাবে পেশ করা হয়েছে এবং এসব দেশে জন্মনিরোধ প্রবর্তনের প্রতি জোর দেয়া হয়েছে। এসব পুস্তক পাশ্চাত্য দেশীয়দের মন-মগজ ও সরকারগুলোকে প্রভাবিত করেছে এবং সাম্রাজ্যবাদীদের বাস্তব কার্যধারা থেকেও এর সমর্থন পাওয়া যায়। আমরা দাবির সমর্থনে কতিপয় প্রমাণ পেশ করছি বিখ্যাত মার্কিন পত্রিকা, “ফরেন এফেয়ার্স” (Fjoreign Affairs)-এ ফ্রাঙ্ক নোটেনস্টন “Politicsd and Power in Post-war Europe” (যুদ্ধোত্তর ইউরোপের রাজনীতি ও ক্ষমতা) শীর্ষক প্রবন্ধে লিখেছেন:
“উত্তর পশ্চিম ইউরোপের কোন জাতির পক্ষে দুনিয়াকে চ্যালেঞ্জ করা এখন আর কিছুতেই সম্ভব নয়। জার্মানী এককালে দুনিয়াতে শক্তিশালী জাতি হিসাবে পরিগণিত হয়েছিলো কিন্তু অন্যান্য ইউরোপীয় জাতির মত আজ জার্মানীও সেদিন হারিয়ে ফেলেছে। আর এর কারণ হচ্ছে এই যে, যে সব দেশের জনসংখ্যা আজ দ্রুত গতিতে বেড়ে চলেছে সে সব দেশেই শিল্প ও কারিগরী সভ্যতা প্রসার লাভ করছে।” [***১]
এশিয়া ও মুসলিম জাহানো ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার দরুন ইউরোপের রাজনৈতিক নেতৃত্ব বিশং শতকের শেষার্ধেই বিপদের সম্মুখীন হওয়ার তীব্র আশংকা রয়েছে। টাইম (Time) নামক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাপ্তাহিক পত্রিকার ১১ই জানুয়ারী ১৯৬০ সংখ্যায় লেখা হয়েছে:
“জনসংখ্যার আধিক্য (Over Population) সংক্রান্ত ইউরোপীয় জাতিসমূহের যাবতীয় ভীতি এবং এজন্যে তাদের সমস্ত প্রচারণা ও উপদেশ প্রকৃতপক্ষে এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার জাতিসমূহ বর্তমান হারে বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয়ে বিপুল সংখ্যাধিক্য সৃষ্টি করলে যে রাজনেতিক প্রাধান্য স্থাপিত হবার আশংকা আছে তারই ফল বিশেষ।” [ Time Magazine, 11 January, 1960.]
আর্নল্ড গ্রীন (Arnold H. Green) লিখেছেন:
“বিগত ৫০ বছরের দুনিয়ার জনসংখ্যা দিগুণ হয়ে গেছে এবং এজন্যে সারা দুনিয়ার অর্থনৈতিক ও সামরিক ভারসাম্যের (Ballnace of Economic and Military Power) ওপর ভীষণ চাপ (Strim) পড়েছে।” [Green Arnold, H. Sociology: An Analysis of Life in Modern Society, New York, 1960, p. 154.]
আর্থার ম্যাক্করম্যাক (Arther Mccormack) অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় প্রকাশ করেছেন:
“উন্নত দেশের অধিবাসিগণ স্বাভাবিকভাবেই অপেক্ষাকৃত অনুন্নত দেশের জনসংখ্যাক কমিয়ে রাখা পছন্দ করে। এর কারণ হচ্ছে এই যে, অনুন্নত দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে উন্নত দেশের অধিবাসিগণ তাদের নিজেদের জীবন যাত্রার মান এবং রাজনৈতিক নিরাপত্তা (Security) বিপন্ন মনে করে।” [Mccormack, Arther, People, Space, Food, London 1960, Page 77.]
ম্যাক্করম্যাক পাশ্চাত্যের এ ঘৃণ্য মনোভাবের তীব্র সমালোচনা করে স্পষ্ট ভাষায় বলেন যে, প্রাচ্যের অধিবাসীগণ শীঘ্রই এ হীন ষড়যন্ত্র সম্পর্কে অগগত হবে এবং তারপর তারা পাশ্চাত্য জাতিদের কিছুতেই মাফ করবে না। কারণ:
“এটা সাম্রাজ্যবাদের একটি নতুন ধরন। এর লক্ষ্য হচ্ছে অনুন্নত জাতিগুলোকে বিশেষ সাদা রংয়ের শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখার জন্যে কালো আদমীদের পদদলিত করে রাখা।” [Mccormack, Arther, People, Space, Food, London 1960, Page 78.]
আমি পাশ্চাত্য লেখকদের অসংখ্য উদ্ধৃতি পেশ করতে পারি। কিন্তু জ্ঞান-চক্ষু উন্মীলনের জন্যে এ কয়টি উদ্ধৃতিই যথেষ্ট বলে মনে করি।
উপরিউক্ত সমগ্র আলোচনা থেকে এ কথা স্পষ্টরূপে বোঝা গেল যে, ভবিষ্যতে যে সব দেশের জনসংখ্যা বেশী হবে এবং নয়া কারিগরী বিদ্যাও যাদের আয়ত্বে থাকবে তারাই শক্তিশালী দেশ হিসেবে প্রাধান্য লাভ করবে। এখন এসব দেশকে আধুনিক করিগরী বিদ্যা থেকে কোনক্রমেই দূরে রাখা যাবে না। এমতাবস্থায় পাশ্চাত্য জাতিসমূহের প্রাধান্য ও নেতৃত্ব বহাল রাখার একটি মাত্র উপায় আছে, আর তা হচ্ছে অনুন্নত দেশগুলোর জনসংখ্যা সীমিতকরণ। এক কারণেই পাশ্চাত্য দেশগুলো নিজেদের জনসংখ্যা বাড়ানোর জন্যে প্রাণপণ চেষ্টা করছ এবং এই সঙ্গে প্রাচ্য দেশগুলোতে তাদের প্রচারণার যাবতীয শক্তি নিয়োগ করে জন্মনিরোধের সপক্ষে প্রচারণা চালাচ্ছে। [এ ব্যাপারে অপর একটি চিত্তাকর্ষক দিক এই যে, পাশ্চাত্য জাতিগুলো এদের যাবতীয় প্রচারণা বন্ধু রাস্ট্রগুলো পর্যন্ত সীমাবদ্ধ রেখেছে। এদের বিরোধী চীন ও রাশিয়া এ প্রচারণার প্রভাবে পড়ে নি। অন্য কথায় পাশ্চাত্য জাতিগুলো এ প্রচারণার দ্বারা বন্ধুদের সংখ্যা কমাচ্ছে- দুশমনের সংখ্যা কমানা তাদের আয়ত্বের বাইরে। -(আবুল আলা মওদুদী)] আর অনেক সরল প্রাণ মুসলমান এগিয়ে গিয়ে এ প্রতারণার জালে ধরা দিচ্ছে।
(উর্দু************)
“চক্রান্তের চালবাজীতে জয়ী হলো পুঁজিপতি
আর সরলতার আধিক্যে হেরে গেল মেহনতি।” (ইকবাল)
কিন্তু এখন গোমর ফাঁক হয়ে গেছে, যদি এর পরও আমরা পুনরায় প্রতারিত হই তাহলে এর কুফলের জন্যে আমরা নিজেরাই দ ায়ী হবো এবং আজ যে ‘দরদিগণ’ আমাদের জন্মনিরোধের সবক দিচ্ছে, কাল তারাই জনশক্তির দুর্বলতার সুযোগ গ্রহণ করে আমাদের ওপর পূর্ণ কর্তৃত্ব কায়েম করার চেষ্টা করবে। আল্লামা ইকবাল এ বিপদের আভাস আগেই পেয়েছিলেন। তাই মুসলিম জাতিকে এ বিষয়ে হুশিয়ার থাকার জন্যে তাগিদ করেছিলেন। তাঁর কথাগুলো আজও আমাদের চিন্তা ও কাজে পথ নির্দেশ করে। তিনি বলেন:
“সাধারণত বর্তমানে ভারতে (পাক-ভারত-বাংলাদেশে) যা কিছু হচ্ছে বা হতে যাচ্ছে তার সবটুকুই ইউরোপীয় প্রচারণার ফলমাত্র। এ জাতীয় বই-পুস্তক সয়লাবের গতিতে আমাদের দেশে ছড়িয়ে পড়ছে। এ ব্যবস্থার প্রসার ও স্থায়িত্ব দানের জন্যে অন্যান্য উপায় পন্থাও ব্যবহার করা হচ্ছে। অথচ এরা নিজেদের দেশের জনসংখ্যা কমানোর পরিবর্ত বাড়ানোর চেষ্টা করছে। আমার মতে এর কারণ হচ্ছে এই যে, পাশ্চাত্য দেশগুলোর নিজেদের কার্য-কলাপের ফলে তাদের জনসংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে এবং অপরদিকে প্রাচ্য দেশে জনসংখ্যা ক্রমেই ক্রমেই বেড়ে চলেছে। তাই প্রাচ্য জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে ইউরোপ তাদের জন্য ভয়াবহ বিপদ বিবেচনা করছে।” [দিল্লী থেকে প্রকাশিত ‘হামদর্দে ছেহেত’ নামক পত্রিকার জন্ম নিয়ন্ত্রণ সংখ্যা জুলাই, ১৯৩৯, ১৮২ পৃষ্ঠা-লাহোর থেকে প্রকাশিত ‘আল হাকিম’ পত্রিকায় ১৯৩৬ ‘সালের নভেম্বর সংখ্যায় আল্লামা ইকবার এ তথ্য প্রকাশ করেন।]
এটা হলো এ বিষয়ের মূল কথা ও আন্দোলনের রাজনৈতিক পটভূমিকা। এ আন্দোলনের পটভূমিকা ভালভাবে জেনে না নিলে আমরা এ সম্পর্কিত প্রকৃত ব্যাপার বুঝতেও পারবো না এবং কোন সঠিক কর্মপন্থা গ্রহণ করাও আমাদের পক্ষে সম্ভব হবে না।
৩। জনসংখ্যা ও দেশরক্ষা
দেশ রক্ষার ক্ষেত্রে জনসংখ্যার গুরুত্ব আমি সংক্ষেপে আলোচনা করেছি। অধ্যাপক অর্গানস্কী যথার্থই চলেছেন, “যে ব্লকের লোকসংখা বেশী হবে, সেই ব্লকই অধিকতর শক্তিশালী হবে।” যারা সামরিক উন্নয়নের প্রতি লক্ষ্য রাখেন তারা ভালভাবেই অবগত আছেন যে, আণবিক অস্ত্র আবিষ্কারের ফলে দেশরক্ষার ব্যাপারে অধিক লোকসংখ্যার গুরুত্ব পূর্বের চেয়েও অনেক বেশী হয়ে গিয়াছে। কিছু কাল পূর্বে ধারণা হচ্ছিল, নয়া যুদ্ধস্ত্রের কারণে দেশরক্ষা বিষয়ে জনসংখ্যার গুরুত্ব কমে যাচ্ছে এবং জনশক্তি ক্রমেই যুদ্ধে প্রভাবহীন হয়ে পড়েছে। কিন্তু বর্তমানে মানুষ আর এ ধারণায় বিশ্বাসী নয়। কোরিয়া যুদ্ধের শেষ পর্যন্ত জনসংখ্যার আধিক্যের কারণেই চীন আমেরিকার উৎকৃষ্ট ধরনের যাবতীয় হাতিয়ার ব্যর্থ করে দেয়। আমেরিকার নয়া সামরিক বাহিনীতে স্থল-সৈন্য ও গেরিলা সৈন্যদের আগাগোড়া নূতন ছাঁচে ঢেলে গঠ করা হচ্ছে। এজন্যেই দেশরক্ষার দৃষ্টিকোণ থেকেও জনসংখ্যা সম্পর্কে চিন্তা করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না।
নিছক দেশরক্ষার দৃষ্টিকোণ থেকে পাকিস্তানের অবস্থা বত্রিশ দাঁতের মধ্যে একটি জিহ্বারই মত। আমাদের একদিকে ভারত রাষ্ট্র রয়েছে। এদেশের জনসংখ্যা আমারে দেশের জনসংখ্যার পাঁচ গুণ এবং আমাদের দেশের সংগে সে দেশের সম্পর্কও নানা কারণে অত্যন্ত নাজুক পর্যায়ে অবস্থান করছে; অন্যদিকে রাশিয়ার মত বিশাল দেশ। এদেশ সারা বিশ্বে কমিউনিজম প্রসারের জন্যে রাজনেতিক ও সামরিক শক্তি ব্যবহার করে আসছে এবং সে দেশের জনসংখ্যাও আমাদের দেশের জনসংখ্যা তিন গুণ। অপর দিকে চীন রয়েছে। এশিয়া মহাদেশে ক্রমেই চীনের ক্ষমতা সম্প্রসারিত হচ্ছে এবং এদেশে আমাদের দেশের আট গুণ অধিবাসী রয়েছে। এতিনটি দেশেরই নজর রয়েছে আমাদের প্রতি- আর যে নজরে তারা আমাদের দেখছে তাকে কোনমতেই সুনজর মরে করা যায় না। এমতাবস্থায় আমাদের দেশরক্ষার প্রকৃত চাহিদা উপলব্ধি করা উচিত। জনসংখ্যা কমিয়ে আমাদেরকে আরো দুর্বল করা উচিত অথবা লোক সংখ্যা বাড়িয়ে দেশকে এতটা শক্তিশালী করা দরকার যেন কউ আমাদের দিকে চোখ তুলে তাকাবার সাহাসও না পায়।
এভাবেই সমগ্র মুসলিম জাহানোর দিকে তাকালে সুস্পষ্টরূপে বোঝা যায় যে, আমরা তিনটি বড় ধরনের বিপদের সম্মুখীন।
প্রথমত, পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যাদীদের বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রাম আজও শেষ হয় নি। এ সংগ্রাম বর্তমানের একটি নয়া পর্যায়ে উপনীত হয়েছে মাত্র। সুয়েজ ও বিজার্তায় অনুষ্ঠিত ঘটনাবলী আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, দুনিয়ায় দুর্বলের কোনই মর্যাদা নেই এবং মুসলিম জাহানোর গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলো একনো নিরাপদ নয়। যদি আমরা উন্নত শিরে মর্যাদার সাথে বেঁচে থাকতে চাই তাহলে আমাদের রাজনেতিক ও সামরিক শক্তির মান অত্যন্ত উন্নত করতে হবে।
দ্বিতীয়ত, আমাদের সবচাইতে বড় সমস্যা হলো ইসরায়ীলী সাম্রাজ্যবাদ। ইস্রায়ীল রাষ্ট্র অধিক সংখ্যক সন্তান জন্ম দিয়ে এবং বহির্বিশ্ব থেকে লোক আমদানী করে জনসংখ্যা বাড়ানোর চেষ্টায় তৎপর। সমগ্র দুনিয়ার ইহুদীদের সম্পদ এ রাষ্ট্রের সাহায্যের জন্যে প্রস্তুত রাখা হয়েছে; আর এ রাষ্ট্র সামরক ও যুদ্ধাস্ত্রের শক্তির প্রতি মুহূর্তেই বাড়িয়ে চলেছে। এ রাষ্ট্রের বর্ধিষ্ণু শক্তির সম্মুখীন হবার জন্যেও দুনিয়ার রাষ্ট্রগুলোর প্রস্তুত থাকত হবে।
তৃতীয়ত, কম্যুনিস্ট সাম্রাজ্যবাদ বিভিন্ন স্থানে মুসলিম জাহানের সঙ্গে সংঘর্ষ বাধানোর চেষ্টায় রত। ইরান, পাকিস্তান, ইরাক ও তুরষ্কের সীমান্তে বিশেষভাবে এরা চাপ সৃষ্টি করে রেখেছে। এমতাবস্থায় আমরাযদি এদের সম্পর্কে সামান্য মাত্র উদাসীন হই, তাহলে আল্লাহ না করুন, আমাদে অপূরণীয় ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে।
এসব অবস্থায় আমাদের জন্যে দেশরক্ষায় জনসংখ্যার গুরুত্ব অনেক বেড়ে যায় এবং মুসলিম জাহানের পক্ষে পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণে এমন কোন কাজ করা উচিত নয়,যা আমাদের জাতীয় আত্মহত্যার শামিল হয়।
পুনঃ পাশ্চাত্য জাতিসমূহের মনে রাখা দরকার যে, পূর্বদিকে পাশ্চাত্যের দেশ ও কম্যুনিস্ট দেশগুলোর মধ্যে মুসলিম জাহান দুর্লংঘ প্রাচীরের ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে। সমগ্র কম্যুনিস্ট ব্লক তাদের জনসংখ্যা বাড়ানোর চেষ্টায় তৎপর রয়েছে। রাশিয়া ও চীন বিশেষভাবে জনসংখ্যা বাড়ানোর কর্মপন্তা গ্রহণ করেছে এবং তারা দাবি করেছে যে, তাদের বর্তমান জনসংখ্যার কয়েকগুণ বেশি পরিমাণ জনসংখ্যাকে তারা অতি সহজেই কর্মে নিযুক্ত করতে পারবে। শুধু তা-ই নয়, এ-ও তাদের দাবী যে, দুনিয়ার সকল দেশই জন্মনিরোধ না করে কম্যুনিস্ট ব্যবস্থাধীন উন্নতির পথে এগিয়ে যেতে পারে। তাদের মতে জনসংখ্যা হ্রাস করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় শুধু পুঁজিবাদী দেশে।
অনুরূপভাবে ইউরোপের দেশরক্ষা ব্যবস্থার প্রতি লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, ইউরোপের কম্যুনিস্ট ব্লকের (রাশিয়াসহ) অধিবাসী সংখ্যা ৩০ কোট ২০ লক্ষ। দুনিয়ার জনসংখ্যা হিসাব করে জানা যায় যে, কম্যুনিস্ট ব্লকের অধিবাসী সংখ্যা প্রায় এক অর্বুদ আর অবশিষ্ট দুনিয়অর (নিরপেক্ষা দেশগুলোসহ) অধিবাসী সংখ্যা দুই অর্বুদ মাত্র। এ অনুপাত অত্যন্ত বিপজ্জনক। যদি কম্যুনিস্ট ব্লকে জনসংখ্যা বদ্ধি ও অকম্যুনিস্ট দেশে জনসংখ্যা হ্রাসের ব্যবস্থা জারী থাকে তাহলে যে শীঘ্রেই উল্লিখিত সংখ্যানুপাত পালটিয়ে যাবে এবং পাশ্চাত্য দেশগুলোর দেশরক্ষা ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে যাবে এটা উপলব্ধি করার জন্যে অস্বাভাবিক ধরনের বুদ্ধিমত্তার প্রয়োজন হয়না। পাশ্চাত্য দেশগুলোর পক্ষেও আপতস্বার্থের দৃষ্টিতে কাজ করা উচিত নয়, বরং দূরদর্শিতা সহকারে তাদর সমগ্র কার্যসূচী সম্পর্কে পুনর্বিবেচনা করা উচিত।
৪। কতিপয় অর্থনৈতিক তথ্য
জন্মনিয়ন্ত্রণের বিষয়টি প্রকৃতপক্ষ অর্থনৈতিক ব্যাপার নয়, তবু কতিপয় দিক এমনও আছে যেগুলোর সম্পর্কে অর্থনৈতিক দৃষ্টিতে বিবেচনা করা যেতে পারে।
এ বিষয়ে প্রথম কথা হচ্ছে এই যে, অধিক সংখ্যক সন্তানের জন্ম সাধারণত অর্থনৈতিক দৃষ্টিতে উপকারই প্রমাণিত হয়। দুনিয়াতে যত মানুষ আসে তারা শুধু একটি পেট নিয়ে আসে না, বরং তাদের সকলেই দুটি হাত, দুটি পা এবং একটি মস্তিষ্কও নিয়ে আসে। পেট যদি অভাব পূরণের দাবী পেশ করে তাহলে অপর পাঁচটি অঙ্গ তা পূরণ করার চেষ্টা করে। এছাড়া অর্থনীতিবিদদের িএকটি বিরাট প্রবাবশালী দল এ অভিমতের সমর্থক যে, অনুন্নত দেশসমূহের অর্থনৈতিক বিপ্লবের প্রাথমিক অবস্থায় অধিক সংখ্যক শিশুরু জন্ম অত্যন্ত উপকারী। কারণ এর ফলে একদিক প্রয়োজনীয় শ্রম (Labour) ও অন্যদিকে উৎপন্ন দ্রব্যাদির ফলোৎপাদক চাহিদা (Effective Demand) সৃষ্টি হয়। তাঁরা এ সঙ্গে এ কথাও বলেন যে, একটি উন্নত দেশের অর্থনৈতিক মান কায়ম রাখার ও চাহিদা সম্প্রসারণের (যেন বাজারে মন্দাভাব দেখা দিতে না পারে) জন্যে জনসংখ্যাকে ক্রমেই বাড়ানো উচিত। লর্ড কেনিজ (L. M. Keynes) অধ্যাপক হানসান (A. I. Hanson) ডক্টর কলীন ক্লার্ক (Colin Clark), অধ্যাপক জি. ডি. এইচ. কোল (G. D. H. Cole) এবং আরও অন্য অনেক চিন্তাবিদ এ ধরনেরই মত প্রকাশ করেছেন। আর অর্থনীতির ইতিহাসও এ অভিমতের সমর্থনই করে থাকে।
দ্বিতীয় কথা হচ্ছে এই যে, সমগ্র দুনিয়অয় য সব উপকরণ মওজুদ আছে তা শুধু যে বর্তমান জনসংখ্যাকে প্রতিপালনের জন্যে যথেষ্ট, তাই নয় বরং জনসংখ্যার যে কোন সম্ভাব্য বাড়তি পরিমাণকেও প্রতিপালন করার জন্যে যথেষ্ট। কোথাও প্রয়োজনের চেয়ে বেশি পরিমাণ উপকরণ রয়েছে এবং কোথাও বা এসব মোটেই ব্যবহার করা হচ্ছে না। কলীন ক্লার্ক অত্যন্ত বলিষ্ঠ তথ্যের ভিত্তিতে বলেন যে, দুনিয়ার মানুষের জ্ঞানের আওতায় যে সব উপকরণ রয়েছে শুধু সেগুলোকেই সঠিকরূপে ব্যবহার করে দুনিয়ার বর্তমান জনসংখ্যার দশ গুণ অধিবাসীকে স্বচ্ছন্দে ইউরোপীয় মানের খাদ্য সরবরাহ করা যেতে পারে। [Internationlam Labour Revies, August, 1953-তে “Population Growth and Living Standards” শীর্ষক প্রবন্ধ।]
জে. ডি. বার্ণালও (J. d. Bernal) নিরপেক্ষ ও বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের পর এ অভিমতই প্রকাশ করেন। [অধ্যাপক বার্ণাল এ বিষয়ে “World without war” নামক যুক্তিসংগত পদ্ধতিতে একখানি পুস্তক রচনা করেছেন এবং অনস্বীকার্য তথ্যের ভিত্তিতে প্রমাণিত করেছেন যে, ক্রমবর্ধামন জনসংখ্যার তুলনায় দুনিয়ার উপকরণের পরিমাণ অনেক বশি।]
তৃতীয় কথা হচ্ছে এই যে, দুনিয়ায় বর্তান জনসংখ্যা সম্পর্ক যে সব হিসাব প্রকাশকরা হয় তা যদি গ্রহণযোগ্য বলে ধরেও নেয়া যায়, তবু অতীত ও ভবিষ্যতের গতিধারা সম্পর্কে অনুমানভিত্তিক যা কিছু বলা হয় সে সম্পর্কে অনেক মতভেদের অবকাশ রয়েছে। কারণ ডেমোগ্রাফী (Demography) জাতীয় বিদ্যা সবেমাত্র আবিষ্কার করা হয়েছে। তাই এ বিদ্যা এখনও এমর পরযায়ে পৌঁছে নি যার ওপর ভরসা ও নির্ভর করেও আমরা এ বিদ্যার ভিত্তিতে শুধু নিকট ভবিষ্যৎ সম্পর্কেই কিছু অনুমান করতে পারি, শত শত বছর পর জনসংখ্যার গতি ও প্রকৃতি কি ধরনের হবে তা নির্ণয় করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়।
বিশ্বাসযোগ্য হিসাব পেশ করার মত নির্ভরযোগ্য কোন উপায় উপাদানই এ যাবৎ আমাদের হস্তগত হয়নি। উপরন্তু জনসংখ্যার গতিধারা সম্পর্কেও অনেক তথ্য এখনও আমাদের অজ্ঞাত। উদাহরণস্বরূপ ডাঃ আর্নাল্ড টয়েনবী (Dr. Arnold Toyenbee) বলেছেন যে, ২৩ টি সভ্যতার মধ্যে ২১টিতেই উন্নতির শিখরে ওঠার পর জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার পুনরায় কমে যেতে দেখা গেছে। জনসংখ্যার স্বাভাবিক বৃদ্ধির ইতিহাসও একথা সমর্থন করে। রেমেন্ড পার্ল (Raymond Pearl) এক প্রবন্ধে লিখেছেন:
“শৈল্পিক উন্নতি, শহরোন্নয়ণ ও এর ফলে উদ্ভূত লোক বসতির ঘনত্ব যতই বেশী পরিমাণে হতে থাককে ততই উর্বরতা ও জন্মহার কমে যেতে থাকবে। অল্প কয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া প্রায় সর্বত্র ও সর্বদা এরুপ হতে দেখা গেছে।” [Raymend Pearl, “The Biology of Population Growth”, In Natural History of Population, P. 227.]
ডাঃ ডেওয়ার অে, আর, এস, তদীয় ১৯৫৯ সালের অধ্যাপনার বক্তৃতায় জনসংখ্যা বিষয়ক তথ্যাবলী সম্পর্কিত অসুবিধাগুলো বিস্তারিতভাবে প্রকাশ করেন। [Dr. p. . Medawarad রচিত ‘The Future of man’ পুস্তক “The Falliblity of Predition” শীর্ষক প্রবন্ধে প্রকাশিত লন্ডন, ১৯৬০ সাল।]
“সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের এক সরকারী রিপোর্টেও এ কথা বলা হয় যে, অতীতের যে হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধির দিকে এগিয়ে গেছে, ভবিষ্যতেও সে হারে অগ্রসর হতে থাকবে বলে মনে করা ভুল। এ রিপোর্ট অনুসারেই- “বর্তমান সময়ের অনুমান ও হিসেবগুলোকে সুদুর ভবিষ্যতের ওপর প্রয়োগ করা নিতান্তই নির্বুদ্ধিতা”। [The Futrue Growth of World Population P-21]
এই রিপোর্ট অনুসারে বর্তমান শতকের শেষ পর্যন্ত সময়ের জন্যে সঙ্গত ভাবই অনুমান করা যেতে পারে- এর বেশি নয়। অপর কয়েকজন বিশেষজ্ঞের মতে আমরা বেশির পক্ষে মাত্র দশ বা পনর বছর সময়ের জ্যন্যে একটি অনুমান করতে পারি এবং এর বেশি সময়ের জন্যে এরূপ করা অসতর্কতার পরিচায়ক হবে। [Migration News, Ceneva, March April 1959, Page 2] অপর একজন সমাজ বিজ্ঞানী সমগ্র বিষয়টিকে এভাবে প্রকাশ করেন:
“জনসংখ্যা সম্পর্কিত পরিসংখ্যান ও ভবিষ্যদ্বাণীগুলোতে লোকের আগ্রহ অত্যন্ত কমে গেছে আর এর কারণ হচ্ছে অবস্তার অভাব। কিছুদিন পূর্ব পর্যন্তও জনসংখ্যা বিশেষজ্ঞ মহলে বাইরে (Non-Demographers) সাধারণত ধারণা করা হতো যে, পরিসংখ্যান এমন একটি বিদ্যা যার সাহায্যে ভবিষ্যদ্বাণী করা হলে তা অস্বাভাবিকরূপে সঠিক হয়। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নৈরাশ্য আসতে থাকে েএবং অবশেষে তা আস্থাহীনতায় পরিণত হয়েছে।” [Sociology To-day, Ed. R. K. Mertor, Newyork, 1956, Page 215.]
এ আলোচনা থেকে জানা গেল যে, অর্থনৈতি দৃষ্টিকোণ থেকে জনসংখ্যার অনুমান ও এর গিত প্রকৃতি সম্পর্কেও অত্যন্ত সতর্ক সহকারে বিবেচনা করা প্রয়োজন এবং সাধারণ সংবাদ পরিবেশনের মত ৬০০ বছর পর দুনিয়াতে মানুষের দাঁড়াবারও স্থান থাকবে না বলে উক্তি করাও অত্যন্ত আপত্তিকর।
চতুর্থ কথা হচ্ছে এই য, অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে যদি জনসংখ্যা সম্পর্কিত প্রশ্ন বিবেচনা করা যায় তাহলে দেখা যাবে যে, অর্থনৈতিক কাঠামোর (Structure of the economy) সাথে এর গভীর যোগসূত্র রয়েছে। পাশ্চাত্য দেশের বিশেষ অবস্থা অনুসারে সেখানে বিশেষ কাঠামোতে বিরাট আকার ও পুঁজি কেন্দ্রীভূত করার নীতিতেই অর্থনীতিকে সংগঠিত করা হয়েছিল এবং এর যাবতীয় প্রচেষ্টা ও তৎপরতার লক্ষ্য ছিলো শ্রমের জন্যে সর্বনিম্ন পরিমাণ এ পুঁজির জন্যে সর্বাধিক পরিমাণ মুনাফা নির্ধারণ। এ ধরনের অর্থনীতিকে পুঁজিবাদী ভারী শিল্পভিত্তিক অর্থনীতি (Capilist Intensive Industry) বলা হয়। এ ধরনের অর্থনীতিতে শ্রমের প্রয়োজন দিন দিন কমে যায় এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বেকার সমস্যা সৃষ্টি হতে থাকে। কিন্তু ডদি অর্থনীতিকে অন্য কোন কাঠামোতে সংগঠিত করা যায় তাহলে নুতন কাঠামোতে জনসংখ্যা একটা সমস্যারূপে দেখা দেবে না। জাপানে এ ধরনের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার দৃষ্টান্ত মওজুদ আছে। জাপান বুঝতে পেরেছিলো যে, ভারী শিল্পভিত্তিক অর্থনীতি তাদের উপযোগী নয়। সে দেশে পুঁজি কম এবং শ্রম অনেক বেশি ছিল। এজন্যে সে দেশ বিকেন্দ্রীকরণ নীতির ছোট ছোট শিল্প প্রসারের পরিকল্পনা গ্রহণ করে এবং এ শিল্পকে উচ্চমানে উন্নীত করার চেষ্টা করে। জনসংখ্যার অস্বাভাবিক বৃদ্ধি সত্ত্বেও কোন সমস্যা দেখা দেয় নি। জাপানের আয়াতন পাকিস্তানের অর্ধেক মাত্র। তা-ও সেস দেশের সমগ্র ভূখণ্ডের মাত্র শতকরা ১৭ ভাগ চাষাবাদ যোগ্য। অবশিষ্ট জমি আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতের দরুন অকেজো অবস্থায় আছে। এ হিসাব অনুসারে জাপানের আবাদ যোগ্য জমি পাকিস্তানের আবাদী জমির মোট পরিমানে বারো ভাগের এক ভাগ ১/১২ মাত্র। কিন্তু জাপান আমাদের চাইতে অনেক বেশি সংখ্যক অধিবাসীর জীবনযাত্রার মান অনেক উন্নত পর্যায়ে পৌঁছিয়ে দিয়েছে এবং নিজের অর্থনৈতিক শক্তিকে এমন পর্যায়ে উন্নীত করেছে যে, তার শিল্পজাত দ্রব্যাদি বৃটেন ও আমেরিকার বাজার দখল করে ফেলেছে। এমন কি ইউরোপের সকল দেশ এক জোট হয়েও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে জাপানের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে সমর্থ হয় নি। শুধু তাই নয়, তার রাজনৈতিক শক্তিও এমন স্তরে পৌঁছে যায় যে, সমগ্র পাশ্চাত্য জগতকেই চ্যালেঞ্জ করে বসে।
এ আলোচনা থেকে জানা গেলো যে, নেহাত হালকাভাবে জনসংখ্যা সম্পর্কে অধ্যয়ন করা উচিত নয়। যদি অর্থনৈতিক কাঠামোকে দেশের অবস্থার সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষা করে উন্নত ছাঁচে ঢালাই করা হয় তাহলে অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে জনসংখ্যা কখনও কোন সমস্যারূপে দেখা দেবে না। বর্তমান দুনিয়ায় মানুষ যদি দারিদ্র, অভাব ও দুরবস্থায় পতিত হয়ে থাকে, তবে তা হয়েছে আমাদের নিজেদেরেই ভুলের কারণে। প্রাকৃতিক উপায়-উপাদানকে এজন্যে দায়ী করা যায় না। এ সম্পর্কেও আমি কতিপয় জরুরী বিষয় পেশ করতে চাই:
(ক) আমাদের নিকট যেসব উপকরণ রয়েছেতা আমরা ঠিকভাবে কাজে লাগাচ্ছি না। উপকরণ মওজুদ রয়েছে, এমন কি প্রাচুর্যও রয়েছে। কিন্তু মানুষ অলসতা ও কর্মবিমুখতার দরুন এগুলো থেকে উপযুক্ত পরিমাণ কল্যাণ হাসিল করতে পারছে না। এটিই পৃথিবীতে বিরাজমান দারিদ্রের সব চাইতে বড় কারণ।
(খ) মানুষের প্রয়োজন পূরনের উপযোগী যাবতীয় উপায়-উপকরণ প্রকৃতিই দুনিয়াতে রেখে দিয়েছে। উপকরণের দৃষ্টিতে বিচার করলে প্রতীয়মান হয় যে, সমগ্র দুনিয়া এক অখন্ড ইউনিট। দুনিয়াতে এমন একটি দেশও নেই যেখানে তার অধিবাসীরা প্রয়োজন পূরণ করার সকল উপকরণ স্থানীয়ভাবে সংগৃহীত করতে পারে। সমগ্র দুনিয়ার সকল উপকরণ একত্রে গোটা মানব সমাজের জন্যে যথেষ্ট। সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গী পরিহার করে এ ধরনের সমস্যা সমাধানের উদ্দেশ্যে সমগ্র দুনিয়ার প্রতি লক্ষ্য রেখে মানুষের চিন্তা-গবেষণা করা উচিত। দেশের মধ্যে যেমন বিভিন্ন শহরকে আমরা প্রয়োজনীয় উপকরণের ক্ষেত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণ মনে করতে পারি না, তেমনি সমগ্র দুনিয়অ সম্পর্কেও ঐরকম মনোভাব নিয়ে বিবেচনা করতে হবে। আর এ ধরনের দৃষ্টিভংগী প্রবর্তিত হলেই দুনিয়ার উপায়-উপকরণগুলো সমগ্র মানব জাতির কল্যাণে নিয়োজিত হতে পারবে।
(গ) উপরিউক্ত ভ্রান্ত দৃষ্টিভংগীর কারণেই অত্যন্ত ভ্রান্ত পদ্ধতিতে সম্পদের বর্তমান বিলি-বন্টনের ব্যবস্থা জারী আছে। যেখানে কোন দ্রবের প্রাচুর্য আছে সেখানেই তার অপচয় হচ্ছে। অন্যস্থানে এ দ্রব্যের অভাবে যারা কষ্ট ভোগ করচে এগুলো তাদের ব্যবহারে আনার কোন উপায় নেই। যারা বলে থাকে দুনিয়ার উৎপাদন ক্ষমতা জনসংখ্যার তুলনায় কম তারা জানে না যে, পাশ্চত্য জগত, বিশেষত আমেরিকা উৎপাদনের ঘাটতি নামক কোন সমস্যাই নেই, সেখানে প্রয়োজনতিরিক্ত উৎপাদন (Over Production) সমস্যারূপে বিরাজমান। কি পরিমাণ প্রয়োজন অতিরিক্ত উৎপাদন হয় তা নির্ণয় করাই তাদের জন্যে একটি স্থায়ী মাথা ব্যথার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। মার্কিন সরকারকে প্রতি বছর ২০ কোটি থেকে ৪০ কোটি ডলার (প্রায় এক অর্বুদ টাকা) শুধু অপ্রয়োজনীয় আলু নষ্ট অথব কম মূল্যে বিক্রয় করার জন্যে খরচ করতে হয়। ক্যালিফোর্নিয়অয় কোটি কোটি টাকার কিশমিশ ও মনাক্কা শুকরকে খাইয়ে দেয়া হয়।
আমেরিকার ক্রেডিট কর্পোরেশনের নিকট ২০ অর্বুদ ডলার (প্রায় ১৯০ অর্বুদ টাকা) মুল্যের দ্রব্য-সামগ্রী অকেজো অবস্থায় পড়ে রয়েছে। তন্মধ্যে কতিপয় দ্রব্যের তালিকা নিম্নে দেয়া হলো:
দ্রব্য | পরিমাণ | মূল্য |
তূলা | প্রায় ৫০ লক্ষ গাট | ৭৫ কোটি ডলার |
আটা | ৪০ কোটি ব্যসিল [ব্যাসিল-২৯ সের পরিমাণ ওজরে এক ব্যসিল হয়।] | ৯০ কোটি ডলার |
ভুট্টা | ৬০ কোটি ব্যসিল | ৯০ কোটি ডলার |
ডিম (শুষ্ক) | ৭ কোটি পর্যন্ত | ১০ কোটি ডলার |
মাখন | ১০ কোটি পর্যন্ত | ৬ কোটি ডলার |
দুধ (শুষ্ক) | ২৫ কোটি পর্যন্ত | ৩ কোটি ডলার [ড্যাডলে স্টম্প প্রণীত “Our Deveoping World”-এর ১৬৬ পৃঃ] |
এভাবেই E. A. O. পরিবেশিত সংখ্যাতত্ত্ব থেকে জানা যায় যে, অব্যাহত মওজুদ স্টকের পরিমাণ বরাবরে বেড়েই চলেছে এবং কোটি কোটি মণ খাদ্য ও অন্যান্য স্টকের পরিমাণ বরাবরই বেড়েই চলেছে এবং কোটি কোটি মণ খাদ্র ও অন্যান্য দ্রব্য দুনিয়ার বিভিন্ন স্থানে অব্যবহৃত অবস্থায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে িএবং এগুলোর রক্ষণাবেক্ষণের জন্যেও কোটি কোটি টাকা খরচ হচ্ছে। অথচ ঐ একই সময় দুনিয়ার অন্যান্য অংশে দারিদ্র্য ও খাদ্যাভা মানুষকে অস্থির করে রেখেছে। তাই প্রশ্ন হচ্ছে, অবস্থা যখন এমন পর্যায়ে বিরাজ করছে তখন আমরা অভাবের ধুয়া তুলে আল্লাহর ব্যবস্থাপনা ও অর্থনৈতিক উপকরণের বিরুদ্ধে চীৎকার করছি কোন্ কারণে?
শ্যাক্সপীয়ার বলেন:
The fault, dear Brurus, is not in o ur stars.
But in ourselves that we are, underlings.
“আসমান ও জমীনের কোথায়ও গলদ নেই। গলদ যা আছে তা আমাদের নিজেদেরই মধ্যে। নিজের চোখের মণির প্রতিই আমাদের তাকানা উচিত।”
পাশ্চাত্য দেশীয় স্বার্থপরতায় দুনিয়ার অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের কারণ। সভ্যতার ধ্বজাধারী হয়ে তারা একদিকে নিজেদের উৎপন্ন দ্রব্যাদি কৃত্রিম উপায়ে সৃষ্ট বাজার দর কায়েম রাখার জন্যে নষ্ট করে দিচ্ছে এবং মানব জাতিকে এসব দ্রব্যের ব্যবহার থেকে বঞ্চিত করছে, অন্যদিকে তাদের সকল উপায়-উপাদানের কাজে নিয়োজিত না করে ভোগ ও বিলাসিতায় লাগিয়ে দিচ্ছে।
অধ্যাপক লিন্ডসে বলেন:
“ভোগস্পৃহায় মগ্ন পাশ্চাত্য জাতি এমন এক স্তরে এসে পৌঁছেছে যে, তারা তাদের সমগ্র শক্তি খাদ্য ও রসদ বাড়ানোর কাজে নিয়োজিত করতে রাজী নয়। [Landis, Social Problems, Chicago, 1959 p-6000]
(ঘ) প্রাচ্য দেশগুলোতে দুর্বলতা ও অলসতা নিশ্চয়ই রয়েছে। কিন্তু প্রাচ্যের উপকরণ থেকে পাশ্চাত্য যেভাবে স্বার্থোদ্ধার করছে তাও প্রাচ্যের দারিদ্র ও অর্থনৈতিক দুরাবস্থার জন্য বহুল পরিমাণ দায়ী। পাশ্চাত্য দেশগুলো যেভাবে প্রাচ্য দেশের সম্পদ ও উপকরণ লুন্ঠন করছে এবং আফ্রিকার দেশসমূহে আজো লুণ্ঠন করে চলেলে তার ইতিহাস তিক্ততায় পরিপূর্ণ। আজাদী লাভের পর এসব দেশে শত উপায়ে পাশ্চাত্য চাতিসমূহের সুবিধা ভোগ করার ব্যবস্থা জারী করেছে। এর একটি দৃষ্টান্ত হচ্ছে দ্রব্যমূল্যের স্থিতিহীনতা (Instability)। পাশ্চাত্য দেশগুলো প্রাচ্য থেকে যে সব দ্রব্য খরিদ করে সেগুলোর মূল্যমানকে স্থিতিশীলতায় পৌঁছতে তারা দেয় না। এর ফলে প্রাচ্য দেশগুলোকে বিরাট ক্ষতি স্বীকার করে তাদের উৎপন্ন দ্রব্য বিক্রি করতে হয়। দৃষ্টান্তস্বরূপ, একমাত্র কোকের মূল্য অস্বাভাবিকরূপে কমে যাওয়ার দরুন পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলোতে মাত্র এক বছরে (১৯৫৬ সালে) ৬২ কোটি ডলার ক্ষতি স্বীকার করতে হয়। (১৯৫৪ সালে কোকের দাম ছিল প্রতি পাউন্ড ৭৫ সেন্ট- ১৯৫৬ সালে এর দাম ছিল পাউন্ড প্রতি সেন্ট মাত্র ২৬ হয়ে যায়) পুনঃ রবারের দামে স্থিতিহীনতার দরুন এক বছরে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এক অর্বুদ ৩২ কোটি ডলার ক্ষতি হয়। (১৯৫১ সালে এর দাম ছিল প্রতি পাউন্ড ৫৬ সেন্ট-১৯৫৪ সালে এর দাম দাঁড়ায় মাত্র ২৩ সেন্ট) [ডাডলে স্টাম্প প্রণীত পূর্বোল্লিতি পুস্তক ১৭২ পৃষ্ঠা।]
সকল তথ্য বিবেচনা করলে দেখা যায় যে, মানুষের যাবতীয় সমস্যা এই মহামহিম মানুষেরই সৃষ্টি। ওপরর দুটি উদাহরণ থেকে বোঝা যায় যে, দ্রব্যের মূল্যমানে স্থিতিশীলতা কায়েম হলে এবং এদেশগুলোর অসহায়ত্বের সুযোগ পাশ্চাত্য দেশগুলো অযৌক্তিক সুবিধা আদায়ের ফন্দি না করলে ক্ষতিগ্রস্ত সম্পূর্ণ সম্পদ জাতিনর উন্নয়ন কার্যে নিয়োজিত হতে পারতো। অনুন্বত দেশগুলোর সম্পদের অভাব আসে সন্দেহ নাই। আর এ অভাব অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে বাধা সৃষ্টি করে, এও সত্য। কিন্তু অভাবের মূল কারণ কী? যে সব দয়ালু জাতি অনুন্নত দেশগুলোর অভাব সম্পর্কে রাত দিন নানা সুরের ঝংকার তোল আর প্রাচ্যবাসীদের প্রতি সন্তান না জন্মানোর নসিহত খয়রাত করে, এ অভাব তাদেরই সৃষ্টি।
(ঙ) এধরনেরই অপর একটি বিষয় হচ্ছে সমর সরঞ্জাম। দুনিয়ায় যে পরিমাণ সম্পদ সরঞ্জাম তৈরীর কাজে লাগানো হচ্ছে তা সম্পূর্ণ তসংগত। এর বৃহত্তম অংশ উন্নয়ন কাজে নিয়োজিত হলে দারিদ্র পৃথিবীর বুক থেকে অল্প সময়ের মধ্যেই মুছে যেতে পারে। ১৯৫০ -৫৭ ডলার সংখ্যা তত্ত্ব থেকে জানা যায় যে, ঐ সময়ে বার্ষিক কমপক্ষ ১৯০ অবুর্দ ডলার (অর্থাৎ বার্ষিক প্রায় ৪০০ অর্বুদ টাকা) যুদ্ধ প্রস্তুতির জন্যে খরচ করা হয়েছে। [বার্ণাল প্রণীত “World Without War” -22 পৃষ্ঠা] বার্ণল দীর্ঘ আলোচনার পর প্রমাণ করেন:
পৃথিবীরসকল অনুন্নদ দেশের দ্রুত উন্নয়ন সাধনের জন্য যে পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন, এ অর্থ (অর্থাৎ যুদ্ধের জন্যে যে পরিমাণ খরচ হয়) তার চাইতে অনেক গুণ বেশী।
মোটামুটি এ সব বড় বড় কার্যকারণ দুনিয়ার দারিদ্র ও অর্থনৈতিক দুর্গতির জন্যে দায়ী। এ অবাঞ্ছিত কারণসমূহ দূর করাই হচ্ছে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সমস্যা প্রকৃত সমাধান, জন্মনিরোধ নয়।
৫। জন্মনিরোধ কি সমস্যার কোন সমাধান
জন্মনিরোধ সম্পর্কে দীন ও যুক্তির ভিত্তিতে ওপরে আলোচনা করা হলো তা থেকে এ বিষয়টা পরিষ্কারভাবে বোঝা গেলো যে, ইসলামী শরীয়ত এ বিষয়টিকে কোনো পর্যায়েই সমর্থন করে না। মাত্র কতিপয় ব্যক্তিগত অসুবিধার ক্ষেত্রে বৃহত্তর মঙ্গলের তুলনায় একটি কম ক্ষতিকর বিষয় বিবেচনা করে শরীয়তে এ বিষয়টিকে বরদাশ্ত করে নেবার অবকাশ পাওয়া যেতে পারে। আর এ ক্ষেত্রেও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি তার প্রকৃত অসুবিধা ও সমস্যাবলী যাচাই করে আল্লাহর নিকট জওয়াবদিহির পূর্ণ অনুভূতিসহ যথারীতি চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করে জন্মনিরোধ করবে। নিছক ভোগ-লিপ্সা পরিতৃপ্তির জন্যে এরূপ করা কিছুতেই জায়েজ হতে পারে না। তাই জন্মনিরোধের জন্যে দেশব্যাপী কোন আন্দোলন শুরু ইসলামের দৃষ্টিতে কিছুতেই বৈধ হতে পারে না।
উপরন্তু এ আন্দোলনের ফলে যে মানসিক, নৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কক্ষতি সাধিত হয় তা ধ্বংসাত্মক এবং মানুষের সুস্থ বিবেক-বুদ্ধি কখনও এ ধরনের আন্দোলনকে দেশের জন্যে কল্যাণকর বলে গ্রহণ করতে পারে না।
এসব কথা সত্য, সন্দেহ নেই! কিন্তু আমরা আরও দেখতে পাচ্ছি যে, মুসলিম জাহান কিংবা প্রাচ্য দেশগুলোতে দীর্ঘকাল পর্যন্ত এ আন্দোলনের সফলতা লাভ করার কোন সম্ভাবনা নেই। এতদ অঞ্চলের সুস্পষ্ট পরিস্থিতিই এর প্রমাণ।
নিছক বস্তুতান্ত্রিক দৃষ্টিতে বিচার করলেও এর সফলতা অত্যন্ত অনশ্চিত মনে হয় এবং এটা শেষ পর্যন্ত একটা ‘বিস্বাদ’ অপরাধে পরিণত হবে তা বুঝতে কষ্ট হয় না। এ সম্পর্কেও যথাযথভাবে চিন্তা-বিবেচনার জন্যে আমি কয়েকটি কথা বলতে চাই।
প্রথম, জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা কোন ইতিবাচ পন্থা নয়। এব্যবস্থার দ্বারা উদ্ভূত অবস্থাকে জয় করার পরিবর্তে অবস্থার নিকট আত্মসমর্পণ করা হয় মাত্র। তাই এটা একটা নেতিবাচক পন্থা; আর এর দ্বারা সমস্যার কোন সমাধান পাওয়া যায় না। দুনিয়া খাদ্য চায়-জন্মনিরোধ বটী চায় না। এ আন্দোলন আগাগোড়াই নেতিবাচক এবং অর্থনৈতিক সমস্যার কোন ইতিবাচক সমাধান এর মধ্যে মোটেই নেই। এজন্যেই এ আন্দোলন সফল হলেও অর্থনৈতিকহ দৃষ্টিতে এ আন্দোলনের মাধ্যমে দেশের কোন লাভ হয় না- আগে যে স্থানে ছিলো, সে স্থানেই কায়েম থাকে বরং লাভের পরিবর্তে নূতন জটিলতা সৃষ্টি হয়।
দ্বিতীয় কথা হচ্ছে এই যে, যদি অত্যন্ত কঠোরভাবেও এ ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয় তাহলেও কম পক্ষে শতাব্দী- অর্ধশতাব্দী পর এর ফল দেখা দিতে পারে। ইউরোপেও এর ফল দীর্ঘদিন পরেই দেখা গিয়েছিলো। তাই এ ব্যবস্থা দ্বারা আমাদের অর্থনৈতিক দুর্গতি শীঘ্র দূর হয়ে যাবার কোন আশা নেই। দীর্ঘকাল সম্পর্কে কেনীস বলেন যে, আমরা এ বিষয়ে শুধু একটি কথাই জানি। আর তা হচ্ছে এই যে, দীর্ঘকাল পর আমরা সকলে মরে যাবো।”
“In the Long run we all shall be dead”
তৃতীয কথা হচ্ছে এই যে, জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা চিকিৎসা বিজ্ঞান বা অর্থনীতি বিষয়ক কোন পরিকল্পনা নয় যে যখন ইচ্ছা যে কোন দেশে তা প্রবর্তন করা যেতে পারে। এর সফলতার জন্যে বিশেষ ধরনের সাংস্কৃতিক পরিবেশ, বিশেষ ধরনের নৈতিক অনুভূতি ও বিশেষ ধরনের মানসিককতার (Attiitude) প্রয়োজন।
এগুলোর অবর্তমানে এ আন্দোলন চলতেই পারে না। হোরেস্ বেলশ (Horace Belshaw) বলেন:
“জন্মনিয়ন্ত্রণের প্রচারের ফলে অনেক যুগ পর (After many decaces) জন্মহার কমে যাবার আশা করা যায়। এ প্রচারে ধীরে ধীরে জনমত গঠন করবে। কিন্তু ঘটনাপরম্পরায় জানা যায় যে, সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবেশ পরিবর্তন করে জন্মনিরোধের সঙ্গে সামঞ্জস্যশীল করে তোলার পূর্ব পর্যন্ত এ প্রচারের কোনই প্রভাব আশা করা যায় না। [Horace, Belshaw, “P)opulation Growth and Level of consumption” (With Special reference to Countries inn Asia) London, 1956. p. 25.]
এ লেখক আরও বলেন:
“বিভিন্ন ধরনের বাধা ও অর্থনৈতিক এবং কার্যকারণ ঘটিত অসুবিধা এত শক্তিশালী ও প্রভাবশালী যে, সীমিত পরিবার সম্পর্কিত শিক্ষা ও প্রচারের পরোক্ষ ব্যবস্থা শীঘ্র ফলদায়ক হতে পারে না। পাশ্চাত্য দেশেও এসব কারণেই এ আন্দোলন অনেক বিলম্বে ফলপ্রসু হয়েছিলো।” [Horace,Belshaw, Population, Page 41.]
বেলশ-এর সিদ্ধান্ত হচ্ছে:
“উপসংহারে আস্থা সহকারে বলা যেতে পারে যে, দীর্ঘ সময়ের মধ্যে মানুষের মনোভাবের পরিবর্তন হতে পারে বলে সহজভাবেই আশাবাদী (Qualified Optimism) হওয়া যেতে পারে। অপরদিকে পরবর্তী ২০/৩০ বছরের মধ্যে জন্মহারযে পরিমাণ কমে যাবে বলে আশা করা যায় তা মৃত্যুহার হ্রাসের পরও ফলপ্রসূ হওয়ার ব্যাপারে আমি অনেকাংশেই নৈরাশ্যবাদী (Qualified Pessmism)।” [Growth & Levels of consumption, Page 45.]
এজন্যেই লেখক পরামর্শ দেন যে, জনসংখ্যার প্রতি এত বেশী গুরুত্ব না দিয়ে আমাদের উপকরণ বৃদ্ধির প্রতি লক্ষ্য করা দরকার। জন্মনিয়ন্ত্রণের ঘোর সমর্থক স্যার চার্লসস ডারইউন তাঁর সাম্প্রতিক ‘দি প্রেসার অব পপুলেশ্যন’ (The Pressure of Population) শীর্ষক প্রবন্ধে লিখেছেন:
“যত দ্রুততার সঙ্গেইএর (জন্মনিয়ন্ত্রণের) প্রচার চালানো হোক না কেন, এক অর্বুদ সংখ্যকক লোকের অভ্যাস ও স্বভাব , মাত্র ৫০ বছর সময়ের মধ্যে সম্পূর্ণ বিপ্লবী কায়দায় পরিবর্তন করে দেয়া অনুমানেরও অতীত বলে মনে হয়। প্রকৃতপক্ষে এ বিষয় সম্পর্কিত সাম্প্রতিক সকল অভিজ্ঞতা অত্যন্ত নৈরাশ্যব্যঞ্জক। ….. এ কাজটা এমন যে, এর প্রতি উৎসাহ দেয়া অত্যন্ত প্রয়োজন। কিন্তু ৪০ বছর পরও দুনিয়ার সমগ্র অধিবাসীদের মধ্য থেকে নগণ্য সংখ্যকের চাইতে বেশী লোক যে এর দ্বারা প্রভাবান্বিত হতে পারবে তার কোনই আশা নেই।” [Darwin, Sir Charles, The Pressure of Population What’s New? No. 210.1958. P. 3..]
ম্যাককারমুক বলেন:
“যে সব দেশে চিকিৎসা ব্যবস্থা খুবই অপ্রতুল এবং অনেক বিস্তৃত এলাকার লোক চিকিৎসা থেকে একেবারেই বঞ্চিত সে সব স্থানে জন্মনিয়ন্ত্রণ প্রবর্তন অসম্ভব এবং সেখানে এর সাফল্যের কোন সম্ভাবনা নেই।” [ম্যাককারমুক প্রণীত পুর্বোল্লখিত পুস্তকের ৫৭ পৃষ্ঠা।]
“গ্রামাঞ্চলের লেখাপড়া জানা লোকদের নিকট জন্মনিয়ন্ত্রণের প্রচার যতটা সহজ, বাস্তব ক্ষেত্রে উক্ত কাজের(জন্মনিরোধ) ব্যবস্থা ততই কঠিন। অবস্থা হচ্ছে এই যে, এশিয়া মহাদেশের গ্রামাঞ্চলে চিকিৎসা ব্যবস্থার দুর্ভিক্ষ বিরাজমান। লক্ষ লক্ষ ঘর এমন রয়েছে যাতে কোন পানির নল বা গোসলখানাও নেই। ও সবব ঘরে গোপনীয়তা রক্ষা করার মত কোন স্থান পর্যন্ত নেই। গ্রামগুলো ডিসপেনসারী এবং চিকিৎসালয় থেকে অনেক দূরে অবস্থিত এবং যে সব স্থানে চিকিৎসা বিজ্ঞানের কিছু ব্যবস্থাদি রয়েছে সেখানেও দারিদ্র, অজ্ঞতা, স্বাস্থ্যহীনতা, স্থবিরতা ও নিষ্ক্রিয়তাজনিত অসুবিধা ও জটিল সমস্যাবলী রয়েছে (যেগুলো জন্মনিরোধের সকল চেষ্টা ব্যর্থ করে দেয়)।”
“এগুলো হচ্ছে সধারণ অসুবিধা। বিভিন্ন জাতির বিভিন্ন ধরনের প্রয়োজনীয়তা থাকতে পারে। সামাজিকক ও নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গী, ধর্মীয বিশ্বাস, বংশগত রীতিনীতি, যৌন সম্পর্ক স্থাপনের পক্রিয়া, পারিবারিক অবস্থা এবং এ ধরনের অসংখ্য বিষয় রয়েচে যেগুলো স্থাপনের পক্রিয়া, পারিবারিক অবস্থা এবং এ ধরনের অসংখ্য বিষয় রয়েছে যেগুলো জন্মনিরোধকে গ্রহণ বা বর্জন করার ব্যাপারে প্রভাব বিস্তার করে থাকে। আমাদের সরলভাবে স্বীকার করে নিতে হবে যে, দুনিয়ায় ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার অধিবাসীদের মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গী সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান অতি সীমাবদ্ধ। এজন্যে ভারতের পর্ণ কুটির, চীনের কুড়ে ঘর এবং বার্মার গ্রামী বাড়ীতে অস্ত্রোপচার, জন্মনিরোধের উপকরণ ও ঔষধপত্র এবং এগুলোর ব্যবহাররোধকে গ্রহণযোগ্য করে তোলার চেষ্টায় শত শত বছর ব্যায়িত হবার আশাংকা রয়েছে।” [Chandra Sekhr, D. Sripati, Hungry People and Empty Lands, London 1956 P.P. 252-253.]
আমেরিকার অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক রিচার্ড মিয়ার (Richard Meer) এই অভিমত প্রকাশ করেন যে, অনুন্নত দেশগুলোতে জন্মনিরোধের উপকরণ ছড়ানো একটা অদ্ভূত বিষয়ে পরিণত হবে। তিনি এ ব্যবস্থার কোন ত্বরিৎ ফল লাভের মোটেই আশা রাখেনা। এতদ্ব্যতীত তিনি এমন সাতটি বিষয়ের উল্লেখ করেন যেগুলো বর্তমান থাকা অবস্থায় জন্মনিরোধ প্রচেষ্টা কিছুতেই ফলবতী হতে পারে না। এরপর তিনি লিখেছেন:
এ ধরনের অবস্থা শুধু সেই সমাজেই কায়েম হতে পারে যেখানে অর্থনেতিক অবস্থা উন্নত। যে সমাজে শিক্ষঅর মান অত্যন্ত নিম্নে িএবং যেখানে কোন উপায়ে বেঁচে থাকার নামই জীবন, সেখানে জন্মনিরোধ পছন্দনীয় বা সফল হয়েছে- এমন একটি নজিরও দুনিয়াতে পাওয়া যায় না।” [Richard Meer, L. Science and Economic Development, Massachuswetts, Page 143.]
বর্তমানর বাস্তব অভিজ্ঞতা দ্বারাও বিশেষজ্ঞদের উল্লিখিত অভিমতেরই সত্যতা প্রমাণিত হয়েছে। জাপান ও পৌরটো রিকুতেহ (Purto Rico) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কোটি কোটি খরচ করে জন্মনিয়ন্ত্রণের প্রবর্তন ও জন্মনিরোধ ঔষধপত্রাদি ছড়ানো হয়েছে। কিন্তু উভয় স্থানেই এ আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছে। অবশেষে জাপানে গর্ভপাত (Abortion) এবং পৌরটো রিকুতে অস্ত্রোপাচারের মাধ্যমে বন্ধা করে দেয়ার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছে। [ম্যাককারমূক প্রণীত পুর্বোল্লিখিত পুস্তক ৬৪-৭১ পৃষ্ঠা, ৮৬-৮৭ পৃষ্ঠা।]
পূর্বের আলোচনা থেকে জানা গেলো যে, জন্মনিয়ন্ত্রণ-
- প্রাচ্য দেশগুলোতে কার্যকরী করা অসম্ভব।
- এর যাবতীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা ব্যর্থ হয়েছে।
- আর যদি সফলও হয় তবু এর ফলাফল প্রকাশ হতে ৫০ থেকে ১০০ বছর সময় দরকার। আর এত দীর্ঘ সময় অপেক্ষা সম্ভব নয়।
এ আন্দোলনের ব্যর্থতার অপর একটি কারণও আছে যা বিবেচনার যোগ্য। জন্মনিরোধের যেসব উপকরণ এ যাবত আবিষ্কার করা হয়েছে তার সবকয়টিই খুব ব্যয়সংকুল ও অপচয়কারী।
সম্প্রতি ইংলন্ডে লর্ড পরিষদে (House of Lords) জন্মনিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে একটি চিত্তাকর্ষক বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়। বিতর্ক চলাকালে জনৈক বক্তা বলেন,
“ভারতের অভিজ্ঞতা থেকে স্পষ্টরূপে প্রমাণিত হয়েছে যে, জন্মনিরোধ উপকরণাদি ব্যবহার অত্যন্ত ব্যয়সংকুল। জনৈক চিকিৎসকের উক্তি নকল করে তিনি বলেন-
“কথাটা শুনতে যতই আশ্চর্যজনক মনে হোক না কেন, বাস্তব সত্য এই যে, গ্রামাঞ্চলে একটি শিশুর জন্মদানের জন্যে তত টাকা ব্যয় করতে হয় না যত টাকা ব্যয় করতে হয় জন্মনিরোধ উপকরণাদি হাসিলের জন্যে।”
এ বিতর্কেই লর্ড কেশী ডাঃ পার্কস-এর উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, “নুতন আবিষ্কৃত বটীগুলো ব্যবহারের নিয়ম এই যে, প্রতি মাসে অন্তত ২০টি সেবন করতেই হবে। এশিয়ার পল্লী অঞ্চলের নারীদের জন্যে স্থায়ীভাবে নিয়মিত এতোগুলো বটী সেবন রীতিমত কষ্টকর, এমন কি অসহনীয়। জন্মনিরোধের অন্যান্য উপকরণও কার্যকরী নয়। কারণ এ সবের কতকগুলোতে কোন প্রকার ক্রিয়াই করে না, আর কতগুলো অত্যন্ত ব্যয়সাধ্য এবং অবশিষ্টগুলোর ব্যবহার-বিধি অত্যন্ত কষ্টকর।” [British Medical Journal, London, July 8, 1961, Page 120.]
আজকাল জন্মনিরোধক যে বটীটির বেশী প্রচলন চলেছে তা ফলপ্রসূ হওয়ার শর্ত হচ্ছে, প্রতি মাসে ২০টি বটীর এক পূর্ণ কোর্স ব্যবহার করা। একদিন ব্যবহার করা বাদ দিলেই পূর্ণ কোর্স ব্যর্থ হয়ে যাবে। তাই প্রত্যেক মহিলাকে বছরে মোট ২৪০ টি বটী গলধঃকরণ করতে হবে এবং তারপরই সন্তান জন্মাবার ‘বিপদ’ থেকৈক রেহাই পাওয়াযাবে। একটি বটীর দাম ৫০ সেন্ট। এরঅর্থ দাঁড়াল এই যে, প্রত্রেক মহিলাকে প্রতি বছর ১২০ ডলার (প্রায ৫৪০ টাকা) মূল্যের ঔষধ সেন করতে হবে। [ডন মারে (Don Murry) লিখিত প্রবন্ধ “How Safe are the New Birth Controll Pills?” Coranet, অক্টোবর ১৯৬০ থেকে গৃহীত।] ১৯৬০-৬১ সালের পরিসংখ্যান মুতাবিক পাকিস্তানের নাগরিকদের বার্ষিক আয়ের গড় মাত্র ২৪৪ টাকা। [Economic Survey and Statistics Budget 1961-62 Government of Pakistan, Table. 1. Page 1.] এমতাবস্থায় প্রত্যেকটি মহিলা শুধু বটী খরিদ করার জন্যে প্রতি বছর ৫৪০ টাকা কিভাবে খরচ করবে তা একবার ভেবে দেখা দরকার।
এখন আমাদের সামর্থ ও উন্নয়ন খরচের ভিত্তিতে হিসাব করে দেখুন আমরা এ দামী বটী হজম করতে পারবো কি না। এ বিপুল পরিমাণ সম্পদ জন্মনিরোধের জন্যে খরচ করার পরিবর্তে উৎপাদন বাড়ানো ও উন্নয়নের জন্যে খরচ করতে আপত্তি কেন?
৬। প্রকৃত সমাধান
উপরিউক্ত আলোচনার পর স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, এ সমস্যার প্রকৃত সমাধান কি? এ সম্পর্কে আমাদের অভিমত হচ্ছে এইযে, উৎপাদন বাড়নো এবং অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উপকরণাদির উন্নয়নের মধ্যেই এ সমস্যার প্রকৃত সমাধান নিহিত। আর সত্য কথা এই যে, অর্থনৈতিক উন্নয়ন উৎপাদনের পরিমাণ বাড়ানোকেই সমাধান বলা যেতে পারে। জন্মনিরোধক সমাধান বলা, সমাধান শব্দটির অপমান।
সামান্য চিন্তা করলেই বোঝা যায় যে, জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গ্রহণের অর্থ হচ্ছে পরাজয় বরণ অর্থাৎ আমরা মানুষের যোগ্যতা ও বিজ্ঞানের শক্তি সম্পর্কে নিরাশ হয়ে উৎপাদন ও উপকরণ বাড়ানোর পরিবর্তে মানুষের সংখ্যা কমিয়ে দিতে শুরু করবো। একটি কাপর কারো শরীরে ঠিকমত ফিট না হলে কাপরটিকে বড় করার পরিবর্তে মানুষটির শরীর কেটে ছেঁটে ছোট করার মতোই জন্মনিরোধ ব্যবস্থা অন্যায় ও অস্বাভাবক।
জন্মনিরোধ মতবাদের পেছনে যে দৃষ্টিভংগী রয়েছে তা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, তাতে মানুষ লক্ষ্য নয়, বরং নিছক একটি উপায়মাত্র। যেভাবে অন্যান্য শিল্পজাত দ্রব্যের পরিমাণ চাহিদা মুতাবিক বাড়ানো ও কমানো যেতে পারে তেমনিভাবে মানুষের সংখ্যাও কমানো বাড়ানো যেতে পারে।বল, ব্যাট ও জুতা যেমন প্রয়োজন অনুসারে তৈয়ার করা হয় মানুষও তেমনি বিশেষ পরিমাণ অনুসারে জন্মানো হবে অর্থাৎ মানুষ এমন পর্যায়ে নয় যে, তার প্রয়োজন মুতাবিক দ্রব্য- সামগ্রীর ব্যবস্থা করা যাবে, বরং দ্রব্য সামগ্রীর সঙ্গে সঙ্গতি রাখার জন্যে খোদ মানুষকে কাট-ছাট করে নিতে হবে। অন্য কথায় মানুষওবাজারের অন্যান্য দ্রব্যের মত একটি পণদ্রব্য (Commodity) মাত্র এবং এর বেশী কোন মর্যাদার অধিকারী সে নয়।
এ দৃষ্টিভংগী নিতান্তই ভ্রান্ত। সকল প্রকার আধ্যাত্মিক ও নৈতিক মূল্যমান সম্পূর্ণরূপে বর্জন করার পরই মানুষ এতটা নিম্নে নেমে আসতে পারে। মানুষেই হচ্ছে সৃষ্টির আসল লক্ষ্য। আর অন্য সকল দ্রব্য মানু্ষের প্রয়োজন পূরণ করার জন্যে সৃষ্ট। এ মর্যাদাকে উলটিয়ে দিলে স্বীয় মর্যাদার আসন থেকে মানুষের পতন হবে। মানুষের আসন থেকে নেমে এসে মানুষ বস্তুগত উন্নতির ও সমৃদ্ধি লাভ করতে সক্ষম হলেও এতে মানুষস হিসাবে লাভ কি হলো? অধ্যাপক কলিন ক্লার্ক পাকিস্তানের অর্থনীতি সম্পর্কে যে রিপোর্ট প্রণয়ন করেছিলেন, তাতে এ ধরনের দৃষ্টিভংগীর সমালোচনা প্রসংগে তিনি লিখেছেন:
“কিছু সংখ্যক লোক বলে যে, অর্থনৈতিক অবস্থা জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমানো অথবা সংখ্যার স্থিতিশীলতা আনয়ন অথবা নিম্নগামী হারের দাবী পেশ করছে। আমি এসব প্রস্তাবের কোন একটিকেও বিন্দুমাত্র বিবেচনার যোগ্য মনে করি না। আমার অভিমত এই যে, অর্থনৈতিক উপকরণ অনুপাতে জনসংখ্যাকে কাটছাঁট করার পরামর্শ না দিয়ে অর্থনীতিবিশারদদের উচিত মানুষের প্রয়োজনের সঙ্গে অর্থনীতিকে সংগতিশীল করে তোলার পরামর্শ দান করা। মাতাপিতা নিজেদের মরজী মুতাবিক সন্তান জন্মিয়ে থাকেন। কোন অর্থনৈতিক চিন্তাবিদ, তিনি যত বড় পণ্ডিতই হোন না কেন এবং উজীরে আজম, তিনি যত জবরদস্ত হোন না কেন, মাতাপিতাকে নিজের মরজী মাফিক সন্তান জন্মানোর ব্যাপারে বাধা দান করার অধিকারী নন। অপর দিকে সকল অধিকার অপর পক্ষের রয়েছে। অর্থনীতিবিদ ও উজিরে আমদের ওপর মানুষের যাবতীয় প্রয়োজন পূরণ করার উপযোগী অর্থনৈতিক উপকরণ সংগ্রহ ও সরবরাহ করার জন্যে চাপ দেওয়ার ন্যায্য অধিকার রয়েছে প্রতেক সন্তানর পিতার।” [Colin Clark. Report, A General Review of some economic Problems of Pakistab, 1953, P.2.]
আমাদের দৃষ্টিতে উৎপাদন বাড়ানো ও অর্থনীতির উন্নয়নের মাধ্যমেই সমস্যার সমাধান রয়েছে। আর উৎপাদন বৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের অবকাশও রয়েছে যথেষ্ট। এখন শুধু সাহস, যোগ্যতা, সঠিক পরিকল্পনা, বাস্তব কর্মচেষ্টা ও তৎপরতার প্রয়োজন। ভিত্তিহীন আশ্রয় ছেড়ে দিয়ে নিজেদের শক্তি সামর্থ্যকে সুগঠিত ও সুবিন্যস্ত করার জন্যে দৃঢ়সংকল্প হলে দুনিয়ার অন্যান্য ‘উন্নত দেশের চাইতেও উন্নত মান কায়েম করতে না পারার কোনই কারণ নেই।
আমাদের সাহসের অভাব ও অযৌক্তিক ধরনের হীমন্যতাই প্রকৃত সমস্যা। অন্যথায় প্রকৃতির মধ্যে আমাদের জন্যে যাবতীয় উপকরণ মওজুদ আছে। এগুলোকে যথাযোগ্য ভাবে ব্যবহার করে আমরা দুনিয়াকে পুনরায় সবকক দিতে পারি।
মূল বইয়ের ৮২ পেইজ এর উল্লিখিত ছকটি পেইজ সেটাপ এর কারণে এখানে দেওয়া হলো
চাষাবাদকৃত ও চাষাবাদ যোগ্য জমির পরিমাণ
[মিলিয়ন (দশ লক্ষ) কিলোমিটার হিসাবে]
অঞ্চল | মোট জমি | বর্তমানে চাষাবা করা হয় | বিভিন্ন উপায়ে বাড়ানো যেতে পারে | মোট চাষ-যোগ্য জমি | |||||||
জমির পরিমাণ | মোট জরি কত অংশ | বর্তমানে ব্যবহৃদ উপরকণ অনুসারে | নতুন উপকণ অনুাসারে | ভবিষ্যতে যে উপকরণ বের হবে তা দ্বারা | পরিমাণ | মোট জমির অংশ | |||||
জমির পরিমাণ | মোট জমির অংশ | জমির পরিমাণ | মোট জমির অংশ | জমির পরিমাণ | মোট জমির অংশ | ||||||
ইউরোপ (রাশিয়া ছাড়া) | ৪.৯ | ১.৫ | ৩১% | .৫ | ১০% | ০.৯ | ১৮% | ১.৫ | ৩১% | ৪.৪ | ৯০% |
রাশিয়া | ২২.৪ | ২.২ | ১০% | ১.৮ | ৮% | ৪.১ | ১৮% | ৬.৯ | ৩১% | ১৫.০ | ৬৭% |
এশিয়া(রাশিয়া ছাড়া) | ২৭.০ | ৪.১ | ১৫% | ২.৯ | ১১% | ৬.১ | ২২% | ৭.১ | ২৬% | ২০.২ | ৭৫% |
আফ্রিকা | ৩০.২ | ২.৪ | ৮% | ২.৬ | ৯% | ৭.৪ | ২৪% | ৯.৫ | ৩১% | ২১.৯ | ৭২% |
যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা | ১৮.৫ | ২.৩ | ১২% | ২.২ | ১১% | ২.৯ | ১৫% | ৪.৪ | ২৩% | ১১.৮ | ৬১% |
ওসিয়ানা | ৮.৬ | ০.৩ | ৩% | ০.৫ | ৬% | ১.৭ | ২০% | ৩.০ | ৩৫% | ৫.৫ | ৬৪% |
সমগ্র পৃথিবী | ১৩৫.০ | ৩.২ | ১০% | ১৩.৫ | ১০% | ২১ | ৩৮% | ২৮ | ৯৩% | ৯ | ৭০% |
এ সংখ্যাতত্ত্ব ইউ. এন. ওর সরবরাহকৃত তথ্য থেকে Prof G. D. Burnel তদীয় পুস্তক World Without War, 1922 এর ৬৯ পৃষ্ঠায় দিয়েছেন।