১নম্বর পরিশিষ্ট
ইসলাম ও পরিবার পরিকল্পনা
(আবুল আ’লা মওদুদী)
এ প্রবন্ধের বিষয়বস্তু হচ্ছে, “ইসলাম ও পরিবার পরিকল্পনা।” বাহ্যত এ আলোচ্য বিষয় সম্পর্কে শুধু সন্তানের জন্মসংখ্যাকে কোন নির্দিষ্ট স্থানে সীমাবদ্ধ রাখার ইচ্ছা ও চেষ্টা এবং এর বাস্তব কর্মপন্থা সম্পর্কে ইসলামের নির্দেশাবলীর উল্লেখ করে প্রবন্ধকারের অভিমত অনুসারে ইসলামী বিধানমতে এ কাজ যায়েজ কিনা, তা বলে দেয়াই যথেষ্ট বিবেচিত হতে পারে। কিন্তু এত সংকীর্ণ পরিসরে আলোচনা সীমাবদ্ধ রেখে বিষয়টি সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা সৃষ্টিও কঠিন। এ বিষয়ে আলোচনা করার পূর্বে জানা দরকার:
- প্রকৃতপক্ষে “পরিবর পরিকল্পনা বিষয়টি কি?
- এরসূত্রপাত হলো কেন?
- আমাদের জীবনের কোন কোন দিক এ বিভাগের সঙ্গে এর কি ধরনের সম্পর্ক?
- এ পথে বাস্তব পদক্ষেপের ফলে জীবনের বিভিন্ন দিকে কি কি প্রভাব পড়তে পারে?
- ব্যক্তিগতভাবে এর ইচ্ছা ও চেষ্টায় তদ্বিয় এবং জাতীয় ভিত্তিতে একটি সমষ্টিগত আন্দোলনের সৃষ্টি করার মধ্যে কোন পার্থক্য আছে কি নেই? যদি থাকে তবে সে পার্থক্যটা কি এবং এর ভিত্তিতে উভয় প্রচেষ্টার মধ্যে কি কি নিয়ম-কানুনের পার্থক্য থাকা দরকার?
এসব বিষয়ে সুস্পষ্ট ধারণা সৃষ্টির পরই ইসলামের নির্দেশনাবলীর গভীরে পৌঁছে এবং এর উদ্দেশ্য বুঝা সম্ভব হতে পারে। এ জন্যে আমি সর্বপ্রথম এসব বিষয়েই কয়েকটি জরুরী কথা বলবো।
সমস্যার ধরন
“পরিবার পরিকল্পনা” কোন নূতন বিষয় নয় বরং একটি অতি পুরাতন ধারণার নূতন নাম মাত্র। মানব জাতির ইতিহাসে দেখা যায় যে, বিভিন্ন যুগে মানুষ তার বর্ধিত বংশধরের হার ও দুনিয়ার উপকরণাদির পরিমাণ তুলনা করে আশঙ্কা করেছে যে, জনসংখ্যা বিনা বাধায় বাড়তে দিলেতাদের বসবাসের স্থান ও খাদ্যের অভাব দেখা দেবে। পুরাতন জামানায় মানুষ এ আশঙ্কাটি অত্যন্ত সহজ ভাষায় প্রকাশ করতো। আধুনিক যুগের মানুষ রীতিমত হিসাব করে বলে দিচ্ছে আবির্ভাবের সতেরো শ’ বছর পর্যন্ত মানুষ কল্পনা পর্যন্ত করতে পারেনি যে, অষ্টদশ শতকের মাঝামাঝি এ বাষ্প থেকেই রেজেকের অসংখ্য উৎস আবিষ্কৃত হবে।
সভ্যতার সূচনা থেকেই মানুষ জ্বালানী তৈল ও এর দহিকা শক্তি সম্পর্কে অবগত ছিল, কিন্তু ঊনবিংশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত কেউ এক থা জানতো না যে, অচিরেই পৃথিবীর বুক চিরে পেট্রোলের প্রস্রবন বের হয়ে আসবে এবং এর সঙ্গে সঙ্গে মোটর, বিমান, শিল্প ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এক নয়া মোড় পরিবর্তন করে দেবে। স্মরণাতীতকাল থেমে মানুষ ঘর্ষণের ফলে অগ্নিষ্ফুলিংগ সৃষ্টি হতে দেখেছে কিন্তু হাজার হাজর বছর পর ইতিহাসের বিশেষ পর্যায়ে এসে বিদ্যুতের রহস্য মানুষের কাছে ধরা পড়েছে িএবং এর ফলে শক্তির এক বিপুল ভাণ্ডারে মানুষের হস্তগত হয়েছে। বর্তমান দুনিয়ার অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যেভাবে এর ব্যবহর হচ্ছে মাত্র দেড় শত বছর আগে মানুষ তা কল্পনাও করতে পারেনি। পুনরায় অণু (Atom) বিশ্লেষণযোগ্য কিনা এ বিষয়ে দার্শনিকদের মধ্যে হযরত ঈসা (আ)-এর জন্মের বহু বছর পূর্ব থেকেই বিতর্ক চলে আসছিল। কিন্তু কে জানতো যে, বিংশ শতকে এসে ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র অণূ বিষ্ফোরিত হবে এবং এর গর্ভ থেকে এত বিপুল শক্তি বের হয়ে আসবে যে, এ পর্যন্ত মানুষের জ্ঞাত সকল শক্তি এর তুলনায় নগণ্য মনে হবে।
অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ও এর উপকরণাদির মধ্যে উপরোল্লিখিত পরিবর্তন সাধিত হয়েছে গত দু’শো বছরের মধ্যে এবং এসব পরিবর্তনের ফলে পৃথিবীতে জীবনযাপনের বস্তুসামগ্রী ও উপকরণাদি এত বেড়ে গিয়াছে যে, মানুষ খৃষ্টীয় আঠারো শতকের স্বপ্নেও তা ধারণা করতে পারতো না। এসব আবিষ্কারের পূর্বেই যদি কেউ তৎকালীণ দুনিয়ার উপায়-উপকরণের হিসেব করে জনসংখ্যাকে তদনুসারে নিয়ন্ত্রিত করার পরিকল্পনা করতো তাহলে সেটা যে কত বড় মুর্খতার কাজ হতো তা চিন্ত করে দেখা উচিত।
এ ধরনের হিসেব যারা করে, তারা শুধু যে বর্তমান সময়ের সীমাবদ্ধ জ্ঞানকে ভবিষ্যতের জন্যেও যথেষ্ট মনে করার ভ্রান্তিতে নিমগ্ন হয় তই নয় বরং তারা এ কথাও ভুলে যায় যে, জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে শুধু খাদ্য গ্রহণকারীর সংখ্যাই বেড়ে যায় না বরং সঙ্গে সঙ্গে উৎপাদন ও উপার্জনকারীর সংখ্যাও বাড়ে। অর্থনীতর নিয়মানুসারে তিনটি বিষয়কে উৎপাদনের উৎস মনে করা হয়। এ তিনটি হচ্ছে জমি, পুঁজি এবং জনশক্তি। এ তিনটির মধ্যে আসল ও সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে জনবল। কিন্তু অতিরিক্ত জনসংখ্যার দুশ্চিন্তায় যারা দিশে হারিয়ে ফেলেন তারা মানুষকে উৎপাদনকারীর পরিবর্তে নিছক সম্পদ ব্যবহারকারী হিসেবেই গণ্যৗ করেন এবং সম্পদ উৎপাদনকারী হিসেবে জনশক্তির ভূমিকাকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে থাকেন। তারা এ কথা চিন্তাও করেন না যে, মানব জাতি অতিরিক্ত জনসংখ্যাসহ বরং তার বদৌলতেই এ পর্যন্তকার যাবতীয় উন্নতি সাধনে সক্ষম হয়েছে। বর্ধিত জনসংখ্যঅ শুধু যে নয়া নয়া কর্মক্ষেত্রের দ্বার খুলে দেয় তাই নয় বরং কাজের তাগিদও সৃষ্টি করে থাকে। প্রতিদিন বাড়ত জনসংখ্যার খাদ্য, পোশাক, আশ্রয় ও অন্যাণ্য প্রয়োজন পূরণের ব্যবস্থা করতে বাধ্য হওয়াই হচ্ছে বর্তমান উপায়-উপকরণের সম্প্রসারণ, নয়া উপায়-উপকরণ অনুসন্ধান এবং জীবনের সকলক্ষেত্রে চিন্তা-গবেষণা করার কঠোর তাগিদ। এ তাগিতের দরুনই পতিত জমিতে চাষাবাদ করতে হয়। বালিয়াড়ি, ঝোপঝাড় ও সমুদ্রের তলদেশ থেকে কৃষিযোগ্য জমি বের করা হয়, চাষাবাদের নয়া নয়া পদ্ধতি আবিষ্কার করতে হয়, মাটি খুঁড়ে সম্পদ বের করা হয়। মোটকথা বাড়তি জনসংখ্যার চাপেই মানুষ জলে, স্থলে ও অন্তরীক্ষে নিজেদের চেষ্টা-সাধনা চালিয়ে যায়- জীবনযাপনের উপকরণ অনুসন্ধানের কাজে দ্রুতগতিতে অগ্রসর হয়। এ তাগিদের অবর্তমানে অলসতা ও নিষ্ক্রিয়তা এবং উপস্থিত ও বর্তমানের উপর সন্তুষ্ট থাকা ছাড়া আর কি-বা হাসিল হতে পারে? সন্তানের বাড়তিগ সংখ্যাই তো একদিকে মানুষকে বেশী বেশী কাজ করতে বাধ্য করে এবং অপরদিকে কর্মক্ষেত্রে নতুন নতুন কর্মী আমদান করে থাকে।
বাড়তি জনসংখ্যা কি সত্যিই অর্থনৈতিক দুর্গতির কারণ?
জীবনধারণের জন্যে প্রয়োজনীয় উপকরণারি হার মানব বংশ বৃদ্ধির হারের তুলনায় অনেক কম বলে যারা দাবী করেন, তাদের উক্তিকে মিথ্যা প্রমাণ করার জন্যে আমাদের কাছে অতি নিকট অতীতের যেসব তথ্য আছে তাই যথেষ্ট।
১৮৮০ সালে জার্মানীর জনসংখা ছিল, ৪,৫০,০০০,০০ (চার কোটি পঞ্চাশ লক্ষ)। ঐ সময় সে দেশের লোক খাদ্যাভাবে মরণ বরণ করছিল এবং হাজার হাজার অধিবাসী দেশ ত্যাগ করে অন্যান্য দেশে চলে গিয়েছিল। এরপর মাত্র ৩৪ বছরের মধ্যে জার্মানীর জনসংখ্যা ৬,৮০,০০,০০০ (ছয় কোটি আশি লক্ষ) পৌঁছে যায় এবং এ সময়ে জার্মানীর অধিবাসীদের অর্থনৈতিক দুর্গতি বৃদ্ধির পরিবর্তে জনসংখ্যা বৃদ্ধির তুলনায় অর্থনৈতিক উপকরণ কয়েক শতগুণ বেশী বেড়ে যায়। এমনকি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা পরিচালনার জন্যে ভিন্ন দেশ থেকে লোক আমদানী করতে হয়। ১৯০০ সালে ৮ লক্ষ বিদেশী জার্মানীতে কার্যরত ছিল। ১৯১০ সালে এদের সংখ্যা ১৩ লক্ষে পৌঁছে যায়।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর পশ্চিম পর পশ্চিম জার্মানীর যে অবস্থা হয়েছে তা আরও আশ্চর্যজনক। সেখানে জনসংখ্যার স্বাভাবিক বৃদ্ধি ছাড়াও পূর্বজার্মানী, পোল্যাণ্ড, চেকোশ্লোভিয়া এবং অন্যান্য কমিউনিষ্ট কবলিত অঞ্চল থেকে জার্মান জাতির প্রায় এক কোটি পঁচিশ লক্ষ লোক মুহাজির হয়ে এসেছে এবং আজ পর্যন্তও প্রতিদিন শত শতলোক আসা অব্যাহত আছে। এ দেশের আয়তন মাত্র ৯৫ হাজার বর্গমাইল এবং এর অধিবাসীদের সংখ্যা ৫ কোটি ২০ লক্ষের উপরে পৌঁছে গেছে। এ অধিবাসীদের প্রতি ৫ জনের মধ্যে একজন মুহাজির এবং কাজের অযোগ্যবিধায় ৬৫ লক্ষ লোক পেন্সনভোগী। কিন্তু এতদসত্ত্বেও পশ্চিম জার্মানীর অর্থনৈতিক অবস্থা দিন দিন উন্নতির দিকে এবং যুদ্ধ পূর্বকালীণ অবিভক্ত জার্মানীর মোট সম্পদের চাইতেও এর বর্তমান সম্পদের পরিমাণ অনেক বেশী। এ দেশ মানুষ বৃদ্ধির জন্যে নয়, মানুষের সংখ্যাল্পতার জন্যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এবং কার্যোপযোগী যত মানুষ আছে সকলকে কাজে নিয়োজিত করেও আরও মানুষ চাচ্ছে।
হল্যাণ্ডের অবস্থা দেখুন। আঠারো শতকে এ দেশের জনসংখ্যা প্রায় ১৮ লাখ ছিল; দেড় শ’ বছরের মধ্যে এ সংখ্যা বেড়ে ১৮৫০ সালে ১ কোটির উপর পৌঁছে গেছে। মাত্র ১২,৮৫০ বর্গমাইলের মধ্যেই এসব মানুস বসবস করে। এদের চাষাবাদ যোগ্য জমি গড়ে জনপ্রতি এক একরও হয় না। কিন্তু এদেশ আজ শুধু যে নিজেরই প্রয়োজন পূরণ করতে সক্ষম তাই নয়, উপরন্তু দেশটি বিপুল পরিমাণ খাদ্যোপকরণ বিদেশে রফতানী করছে। তাহা সমুদ্রকে পিছনে দিয়ে এবং কর্দম শুকিয়ে দু’লক্ষ একর জমি বের করে নিয়েছে এবং আরও তিন লক্ষ একর বের করে নেবার চেষ্টা করছে। দেড় শ’ বছর পূর্বে এ দেশের যে সম্পদ ছিল তার পরিমাণ এর বর্তমান সম্পদের তুলনায় কিছুই নয়।
এখন ইংলন্ডের অবস্থা দেখা যাক। ১৭৮৯ সালে বৃটন ও আয়ারল্যান্ডের মোট জনসংখ্যা ১ কোটি ২০ লক্ষ ছিল্ ১৯১৩ সালে এ সংখ্যা ৪ কোটি ৩০ লক্ষ হয়ে যায়। জনসংখ্যার এই পাঁচগুণ বৃদ্ধির ফলে বৃটেনের অধিবাসীগণ পূর্বের চাইতে অধিকর দরিদ্র হয়ে গেছে বলে কি কেউ বলতে পারে?
সমগ্র দুনিয়ার অবস্থা একবার দেখা যাক। আঠারো শতকের শেষের দিকে দুনিয়ার জনসংখ্যা অস্বাভাবিতরূপে বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু সে সময় থেকে আজ পর্যন্ত মানুষের সংখ্যা যে হারে বেড়েছে তার চাইতে অনেকগুণ বেশী হারে সম্পদ উৎপাদনের উপকরণ বেড়েছে। আজ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর লোকেরা যে সব জিনিস ব্যবহার করে থাকে দু’শো বছরপূর্বের বাদশাহদের ভাগ্যেও তা জোটেনি। বর্তমন কালের জীবন যাত্রার মানের সঙ্গে দু’শো বছর পূর্বের জীবন যাত্রার মানের কোন তুলনাই হতে পারে না।
জনসংখ্যা বৃদ্ধি সমস্যার যথার্থ সমাধান
উপরে যে সব দৃষ্টান্ত পেশ করা হলো- তাথেকে একথা পরিষ্কার ভাবেই বুঝা যায় যে, জনসংখ্যাকে হ্রাস করে অথবা এর বৃদ্ধি রোধ করে অর্থনৈতিক উপাদানের সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষার চেষ্টা সমস্যা সঠিক সমাধা নয়। এ ব্যবস্থার ফলে সঙ্গতি সৃষ্টি হবার পরিবর্তে ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাবার আশংকা রয়েছে।
এর পরিবর্তে জীবন যাপনের উপকরণ বাড়ানা এবং নয়া নয়া উপকরণ খুঁজে বের করার জন্যে আরও চেষ্টা করাই হচ্ছে এর প্রকৃত সমাধান। এ পন্থাকে যেখানেই পরীক্ষা করা হয়েছে সেখানেই জনসংখ্যা ও উপকরণের মধ্যে শুধু যে ভারসাম্য রক্ষা পেয়েছে তাই নয়, বরং জনসংখ্যা বৃদ্ধির তুলনায় উপকরণ ও জীবন যাত্রার মান বৃদ্ধি পেয়েছে অনেক বেশী পরিমাণে।
এ পর্যন্ত আমি শুধু জীবিকা ও এর অগণিত উপকরণ সম্পর্কে বলেছি যা মানুষের স্রষ্টা (খোদাকে অস্বীকারকারীদের মতে ‘প্রকৃতি’) পূর্বথেকেই পৃথিবীতে মওজুদ রেখেছেন। এখন আমি সংক্ষেপে মানুষ ও তার বংশ বৃদ্ধি সম্পর্কেও কিছু বলতে চাই যেন সত্য সত্যই আমরা এ সম্পর্কে কোন পরিকল্পনা করার যোগ্য কিনা তাও বিচার করে দেখা সহজ হয়।
মানব বংশের প্রকৃত পরিকল্পনাকারী কে?
এ দুনিয়াতে সম্ভবত একজন মানুষও একথা বিশ্বাস করে না যে, সে নিজের ইচ্ছা ও পছন্দ মোতাবেক জন্ম নিয়েছে।আর এ-ও অনস্বীকার্য সত্য যে, দুনিয়াতে আসার ব্যাপারে মানুষের নিজের পছন্দ-অপছন্দ বা ইচ্ছা-অনিচ্ছা মেযন কিছু আসে যায় না ঠিক তেমনি এ ব্যাপারে তার মাতা-পিতার এখতিয়ারও নাম মাত্র। বর্তমান দুনিয়ার বাস্তব পরীক্ষা-নিরীক্ষা থেকে জানা গেছে যে, পুরুষের প্রতিবার বীর্যপাতের সময় তার দেহ থেকে ২২ কোটি থেকে ৩০ কোটি শুক্রকীট বের হয়ে যায়। কোন কোন বিশেষজ্ঞ ৫০ কোটি শুক্রকীট প্রতিবার নির্গত হয়ে যাবার কথাও বলেছেন। এ কোটি কোটি শুক্রকীটের প্রত্যেকটি স্ত্রী ডিম্ব কোষে প্রবেশ করার সুযোগ পেলে এক একটি পূর্ণ মানুষের পরিণত হতে পারে।এদের প্রতিটি কীট পৈতৃক গুণাবলী ও ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে এক একটি স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্বের অধিকারী। অপরদিকে একজন সাবালিকা নারীর ডিম্বকোষে প্রায় ৪ লক্ষ অপরিপক্ষ ডিম্ব মওজুদ থাকে। তন্মধ্যে প্রতি তোহরে (অর্থাৎ দুই মাসিক ঋতুর মধ্যবর্তী সময়ে) একটি মাত্র ডিম্ব পূর্ণতা লাভ করে (সাধারণত মাসিক ঋতুর ১৪ দিন পূর্বে) ডিম্বকোষ থেকে বের হয়ে সর্বাধিক ২৪ ঘন্টা কালের মধ্যে কোন পুরুষের শুক্রকীট পেলে তাকে গ্রহণ করে গর্ভ সঞ্চার করার জন্যে প্রস্তুত থাকে। ১২ বছর বয়স থেকে ৪৮ বছর বয়স পর্যন্ত ৩৬ বছর সময়ের মধ্যে প্রত্যেকটি নারীর ডিম্বকোষ গড়ে ৪৩০ টি পূর্ণাবয়ব ও ফল দানে সক্ষম ডিম্ব নির্গত করে থাকে। এ সব ডিম্বের প্রত্যেকটি মাতৃত্বের যাবতীয় বৈশিষ্ট্যের উত্তরাধিকার ও ব্যক্তিগত গুণাবলীর দিক থেকে পৃথক পৃথক ব্যক্তিত্বের অধিকারী হয়ে থাকে। নর ও নারীর প্রতিবারে বীর্যপাতের সময় পুরুষের দেহ থেকে চঞ্চল শুক্রকীট বের হয়ে নারীর ডিম্বের সন্ধানে ছুটাছুটি করতে থাকে। কিন্তু কোন সময় হয়তো ডিম্বকোষ থেকে পরিপক্ক ডিম্ব বের হয়ে না আসার দরুন এরা ব্যর্থ হয়। আবার কোন সময় এসব শুক্রকীটের সব কয়টি ডিম্ব বের হয়ে না আসার দরুন এরা ব্যর্থ হয়। আবার কোন সময় এসব শুক্রকীটের সব কয়টি ডিম্ব পর্যন্ত পৌঁছতে ব্যর্থ হয়। অনুরূপভাবে প্রতিটি নারী ডিম্বকোষ থেকে প্রতি তোহরে কোন একটি নির্দিষ্ট সময়ের মাত্র একটি ডিম্ব নির্গত হয়ে ২৪ ঘন্টা পুরুষের শুক্রকীটের জন্যে অপেক্ষা করে থাকে। কিন্তু এ সময়ে হয়তোবা পুরুষের কোন বীর্যপাতই হয় না অথবা হয়ে থাকলে এর নিঃসৃত শুক্রকীটগুলো ডিম্ব পর্যন্ত পৌঁছতে পারে না। এভাবেই অসংখ্য বীর্যপাত এমনকি কারো কারো জন্যে সমগ্র জীবনের বীর্যপাত ব্যর্থ হয়ে যায়। পুরুষের কোটি কোটি শুক্রকীট এবং নারীর শত শত ডিম্ব এভাবে নষ্ট হয়ে যায। কখনও কখনও এমন একটি মুহূর্ত আসে যখন পুরুষের শুক্রকীট যথার্থই নারীর ডিম্বকোষে প্রবেশ করার সুযোগ পেয়ে যায় এবং এভাবে গর্ভ সঞ্চার হয়।
এটা হলো মানুষ সৃষ্টির আল্লাহ-র ব্যবস্থা। এ ব্যবস্থার মধ্যে সামান্য মনোযোগ সহকার নজর করলেই এতে আমাদের পরিকল্পনা করার অধিকার কতটুকু আছে তা বোঝা যাবে। কোন মা-বাপ, ডাক্তার বা সরকারের পক্ষে এক দম্পত্তির অসংখ্যবার যৌন মিলনের মধ্য ধেকে কোন এক বিশেষ সময়ে বীর্যপাতকে সন্তান জন্মানোর জন্যে বাছাই করে নেবার কোন ক্ষমতা নেই। পুরুষের কোটি কোটি শুক্রকীট থেকে একটি নারীর শত শত ডিম্বের কোনটির সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া হবে এবং এ দুয়ের মিলনের ফলে কোন ধরনের গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্যের অধিকারী সন্তান জন্মাবে, এসব বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত করা তো দূরের কথা- মানুষ জানতও পারে না যে, কোন নির্দিষ্ট সময়ে নারীর গর্ভ সঞ্চার হয় এবং তার গর্ভে যে শিশু আসছে তা তার মধ্যে কোন কোন গুণাবলীকে একত্র করা হচ্ছে। এসব তো একমাত্রতাঁরই কাজ যার ইঙ্গতে মানুষের ইচ্ছা-অনিচ্ছার অনেক ঊর্ধ্বে আল্লাহর সৃষ্টি ও সম্প্রসারণের পরিকল্পনা সুষ্ঠুরূপে কার্যকরী হচ্ছে এবং এর পরিচালনা কার্যে আল্লাহ ছাড়া আর কোরো কোন হাত নেই। তিনিই গর্ভ সঞ্চারের সময় নির্ধারণ করেন, তিনিই বিশেষ শুক্রকীটকে বিশেষ ডিম্বের সঙ্গে মিলনের জন্যে মনোনীত করে থাকেন এবং নর নারীর বাঞ্ছিত মিলনের ফলে পুত্র অথবা কন্যা, সুষ্ঠু ও পূর্ণাঙ্গ অথবা অপূর্ণ ও বিকলাঙ্গ, সুশ্রী অথবা বিশ্রী, বুদ্ধিমান অথবা নির্বোধ, যোগ্য বা অযোগ্য ইত্যাদি কোন ধরনের সন্তান জন্মানো হবে এ ফয়সালাও একমাত্র তিনিই করে থাকেন। এ সমগ্র পরিকল্পনার মধ্যে শুধু নিজেদের দৈহিক চাহিদা পূরণের জন্যে যৌনমিলন ও সন্তান জন্মানোর যন্ত্রটিকে সক্রিয় করে নেয়ার দায়িত্বটুকু মাত্র মানুষকে দেওয়া হয়েছে। এর পরবর্তী যাবতীয় কাজ স্বয়ং স্রষ্টার কর্তৃত্বাধীন।
মানব বংশের প্রকৃত পরিকল্পনা উল্লিখিত সৃষ্টি ব্যবস্থার মাধ্যমেই করা হচ্ছে। একটু লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, একদিকে মানুষের মধ্যে এত প্রবল প্রজনন শক্তি রয়েছে যার ফলে একজন মানুষের দেহ থেকে একবার যে পরিমাণ বীর্য স্খলন হয় তা পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার কয়েকগুণ বেশি মানুষের জন্ম দিতে পারে। কিন্তু অপর দিকে এ প্রবল প্রজনন শক্তিকে কোন বিশেষ উচ্চতর শক্তি এতটুকু সীমাবদ্ধ করে রেখেছে যে, মানব সৃস্টির শুরু থেকে আজ পর্যন্ত হাজার হাজার বছরে মানুষের মোট সংখ্যা মাত্র তিন অর্বুদ পর্যন্ত পৌছতে সক্ষম হয়েছে। আপনি নিজেই হিসাব করে দেখুন। খৃস্টপূর্ব তিন হাজার সল থেকে যদি একজন মাত্র পুরুষ একজন নারীর সন্তান-সন্ততিকে স্বাভাবিক হারে বেড়ে যেতে দেওয়া হতো এবফ প্রতি ৩০/৩৫ বছর সময়ের মধ্যে তাদের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে যেতো তাহলে একটিমাত্র দম্পতির বংশধর আজ পর্যন্ত এত বিপুল সংখ্যক হয়ে দাঁড়াতো যে, তা লিখে প্রকাশ করার জন্যে ২৬ অংকের রশির দরকার হতো। কাজেই প্রশ্ন ওঠে যে, মানুষের স্বাভাকি জন্মহার মুতাবিক তাদের বংশধর যে বিপুল পরিমাণে বেড়ে যাবার সম্ভাবনা ছিল তা একমাত্র স্বয়ং স্রষ্টার পরিকল্পনা ছাড়া আর কার পরিকল্পনায় এভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়ে রয়েছে? প্রকৃত ব্যাপার এই যে, একমাত্র আল্লাহর শক্তিশালী পরিকল্পনা মানুষকে পৃথিবীতে এনেছে এবং কখন কত সংখ্যক সৃষ্টি করা হবে এবং কি হারে তাদের হ্রাস-বৃদ্ধি করা হবে, এসব বিষয়ও ঐ পরিকল্পনার মাশ্যমেই সাব্যস্ত হয়ে থাকে। ঐ একই শক্তিমান পরিকল্পনাকারী প্রত্যেক পুরুষ ও নারী সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন যে, কে কে কোন্ কোন্ আকৃতি, কোন্ কোন্ শক্তি ও কোন্ কোন্ যোগ্যতাসহ জন্মাবে? কে কি অবস্থায় লালিত-পালিত হবে এবং কে কি পরিমাণ কাজ করার সুযোগ পাবে। কোন সময় কোন জাতির মধ্যে কোন জাতিকে কি পরিমাণ বেড়ে দেয়া হবে এবং কোথায় পৌঁছাবার পর এর বৃদ্ধি বন্ধ অথবা হ্রাস করতে হবে, এসব বিষয়ও একমাত্র তিনিই নির্ধারণ করেন। তাঁর এ পরিকল্পনা বুঝে ওঠা বা এতে রদবদল করা আমাদের সাধ্যের বাইরে। তবুও যদি আমরা এতে হস্তক্ষেপ করি, তাহলে তা অন্ধকারে তীর নিক্ষেপ করার শামিল হবে। কেননা এই বিশাল বিস্তৃত কারখানাটি যিনি পরিচালিত করেন তাঁর প্রকাশ্য অংশটুকু পূর্ণরূপে দেখার যোগ্যতা আমাদের নেই। তাঁর গোপন পরিকল্পনায় পৌঁছার তো প্রশ্নই উঠতে পারে না। কাজেই সমগ্র সৃষ্টির যাবতীয তথ্য না জানার দরুন সুষ্ঠূ পরিকল্পনা রচনা আমাদের পক্ষে সম্ভব হতে পারে না।
কেউ কেউ হয়তো আমাদের এসব উক্তিকে ধর্মীয় ভাবাবেগ আখ্যা দিয়ে উড়িয়ে দিতে চেষ্টা করবেন এবং জোরেশোরে প্রশ্ন রবেন যে, আমাদের অর্থনৈতিক শক্তি সামর্থ্যের সঙ্গে সন্তান সংখ্যাকি সঙ্গতিশীল করবো না কেন বিশেষত স্বয়ং আল্লাহই যখন এ কাজ করার উপযোগী নানাবিধ তথ্য যন্ত্রপাতি আমাদের অধীন করে দিয়েছেন? তাই, এবার জনসংখ্যার স্বাভাবিক বৃদ্ধির ব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ করার কি কি কুফল দেখা দিতে পারে এবং যে যে স্থানে হস্তক্ষেপ করা হয়েছে সেখানে এ কি ফলাফল দেখা দিয়েছে, তা’ েএবার পরিষ্কারভাবে ব্যক্ত করেবো
জনসংখ্যার পরিকল্পনার পরিবর্তে পরিবার পরিকল্পনা কেন?
এ বিষয়ে সর্বপ্রথম জানা দরকার যে, পরিবার পরিকল্পনা সমর্থনে যেসব যুক্তি পেশ করা যায় সেগুলো প্রকৃতপক্ষে জন সংখ্যার পরিকল্পনা দাবি করে, পরিবার পরিকল্পনা নয়। অন্য কথায় এ বিষয়ে পেশকৃত যাবতীয় যুক্তি গ্রহণ করে নিলে একদিকে দেশের অর্থনৈতিক উপকরণাদির সঠিক হিসাব গ্রহণ অপরদিকে এ উপকরণাদির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে জনসংখ্যা কি পরিমাণ থাকা দরকার ও যারা মরে যায় তাদের স্থানে কত সংখ্যক নতুন শিশু জন্মানো প্রয়োজন এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে এ ধরনের পরিকল্পনা সফলতা লাভ ক রতে পারে না, যে পর্যন্ত না বিয়ে ও পরিবারের ব্যবস্থা উঠিয়ে দিয়ে পুরুষও নারীকে সরকারের মজুর শ্রেণীতৈ পরিণত করা যায়। এসব মজুর নর-নারীর দল এক নির্দিষ্ট পরিকল্পনা মাফিক নিছক সন্তান জন্মানোর উদ্দেশ্যে সরকারী ডিউটি পালনের জন্যে পরস্পরের সঙ্গে মিলিত হবে িএবং বাঞ্ছিত সংখ্যক নারীর গর্ভসঞ্চারের পর সকল নার ও পুরুষকে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিতে হবে। এছাড়া অন্য এক উপায়েও পরিকল্পনার রূপদান করা যেতে পারে। এ পরিকল্পনায় পুরুষ ও নারীর সরাসরি মিলন নিষিদ্ধ করে দিতে যেতে পারে। এ পরিকল্পনায় পুরুষ ও নারীর সরাসরি মিলন নিষিদ্বধ করে দিতেহবে এবং ‘রক্ত ব্যাঙ্কে’র মত কৃষি ব্যাঙ্ক কায়েম করে নারীদের গরু মহিষ ও ঘোড়ার মতই নির্দিষ্ট পরিকল্পনা মোতাবেক গর্ভবর্তী করার ব্যবস্থা করতে হবে। এ দু’টি পথ ছাড়া জনসংখ্যাকে পরিকল্পনাধীনে আনার জন্য কোন পথ নেই।
যেহেতু মানুষ এখনও এতটা অধপতন মেনে নিতে রাজী নয়, সেজন্যেই বাধ্য হয়ে জনসংখ্যা পরিকল্পনার পরিবর্তে পরিবার পরিকল্পনার পন্থা অবলম্বনস করতে হয়েছে। অর্তাৎ মানুষের সন্তান ‘গৃহ’ নামক স্বাধীন ও ক্ষুদ্র কারখানায়ই জন্মানো হবে এবং এদের জন্ম ও প্রতিপালকের দায়িত্বও একজন মাতা ও একজন পিতার হাতেই ন্যস্ত থাকবে, তবে এ স্বাধীন কারখানার মালিকদের স্বেচ্ছায় তাদের উৎপাদন কমিয়ে দেবার জন্যে উৎসাহিত করা হবে।
পরিবার পরিকল্পনার উপকরণ
উল্লিখিত উদ্দেশ্য হাসিল করার জন্যে মাত্র দু’টি পথই গ্রহণ করা যেতে পারে- আর তাই গ্রহণ করা হচ্ছে।
প্রথম পন্থা হচ্ছে, জনগণের ব্যক্তিগত স্বার্থের দোহাই দিয়ে তাদের নিকট জন্ম নিরোধের আবেদন জানানো এবং প্রচার মারফত তাদের মনে এমন একটি অনুভূতি সৃষ্টি করা যেন তারা অধিক সন্তানের জন্ম দিয়ে নিজেদের জীবনযাত্রার মানের অবনতি না ঘটায়। তাদের বুঝতে হবে, যেন তারা নিজেদের আরাম ও স্বাচ্ছন্দের জন্যে এবং সন্তানদের উন্নত ভবিষ্যতের খাতিরে কম সংখ্যক সন্তান জন্মায়। এ ধরনের আবেদন করার কারণ এই যে, আজাদ মানুষকে নিছক সমষ্টিগত কল্যাণের খাতিরে তাদের ব্যক্তিগত ব্যাপারে নিজে নিজে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করার জন্যে তৈরী করা সম্ভব হয় না। তাই এদের ব্যক্তিগত স্বার্থের ধুয়া তোলা ছাড়া অন্য উপায় নেই।
দ্বিতীয় পন্থ হচ্ছে, নর-নারীর পরস্পরের সম্ভোগ সুখ উপভোগের পথ বহাল রেখে সন্তানের জন্ম বন্ধ করার উপযোগী তথ্য ও উপকরণাদি ব্যাপকভাবে সমাজে ছড়িয়ে দেয়া, যেন সকলর জন্যেই তা সহজলভ্য হয়।
এ পরিকল্পনার ফলাফল
উল্লিখিত দু’ধরনের পরিকল্পনার যে ফলাফল প্রকাশিত হয় তা আমি ক্রমিক নম্বর অনুসারে পেশ করছি:
১. জনসংখ্যা হ্রাস
এ উভয় পরিকল্পনার পদ্ধতির ফলাফল কখনও বাহ্ছিত উদ্দেশ্য সিদ্ধ করতে পারে না। জনসংখ্যাকে পরিকল্পিত উপায়ে বাড়াতে হলে দেশের অর্থনৈতিক উপায়-উপাদান হিসাব করে আমাদের কি হারে শিশু জন্মানো দরকার তা নির্ধারণ করতে হবে যেন জনসংখ্যা বাঞ্ছিত সীমারেখার আওতায় থাকে। কিন্তু কত সন্তান জন্মাবে এ ফয়সালা করার ভার যখন আজাদ স্বামী-স্ত্রীর মর্জির ওপর ছেড়ে দিতে হয় এবং তারা যখন দেশের উপায়-উপাদানের পরিমাণ হিসাব না করে শুধু নিজেদের সুখ-সুবিধার পরিপ্রক্ষিতে এ বিষয়ে ফয়সালা করতে তখন তারা যে, দেশের সামগ্রিক প্রয়োজনের প্রতি লক্ষ্য করে সন্তানের সংখ্যা স্থির করবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই। এ অবস্থায় বেশী যা আশঙ্কা করা যেতে পারে তা হচ্ছে এই যে, এদের ব্যক্তিগত আরাম-আয়েশ ও উচ্চমানের জীবন যাপনের লোভ যে পরিমাণে বাড়তে থাকবে, ঠিক সে অনুপাতে এদের সন্তানের সংখ্যা কমে যেতে থাকবে। ফলে এমন এক সময় আসবে যখন জাতির জনসংখ্যা বেড়ে যাবার পরিবর্তে কমে যাওয়া শুরু করবে।
ওপরে যা বলা হলো তা নিছক সম্ভাব্য ফল নয়, বরং বাস্তবে ফ্রান্সে এ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। দুনিয়ার মধ্যে ফ্রান্সই সর্বপ্রথম ব্যাপকভাবে জন্মনয়ন্ত্রণের উপায় ও পদ্ধতিকে পরীক্ষা করেছে। সেখানে উনিশ শতকের শুরু থেকেই এ আন্দোলন জনপ্রিয়তা অর্জন করতে শুরু করে। এক শত বছর সময়ে মধ্যে অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছে যায় যে, প্রতিটি জেরায় মৃত্যুহারের চেয়ে জন্মহার কমেযেতে থাকে। ১৮৯০ সাল থেকৈ ১৯১১ সাল পর্য়ন্ত ২১ বছর সময়েরমধ্যে ৭ বছর এমন অবস্তা ছিল যে, ফ্রান্সের মোট মৃত্যু সংখ্যা থেকে জনসংখ্যা ১ লাখ ৬৮ হাজার কম ছিল। ১৯১১ সালের তুলনায় ১৯২১ সালে ফ্রান্সের জনসংখ্যা ২১ লাখ কম হয়ে যায়এবং ১৯৩২ সালে ফ্রান্সের মোট ৯০টি জেলার মধ্যে মাত্র ১২টি জেলায় জন্মহার মৃত্যুর হারের চেয়ে সামান্য বেশী ছিল। ১৯৩৩ সালে এ ধরনের জেলা মাত্র ৬ টি ছিল অর্থাৎ সে বছর ফ্রান্সের ৪৮টি জেলায় নবজাতকদের সংখ্যা মৃত্যুবরণকারীদের তুলনায় বেশী ছিল। এ নির্বুদ্ধিতার দুরুনই দু’ দুটি বিশ্বযুদ্ধে ফ্রান্স এমন শোচনীয় পরাজয় বরণ করে যে, বিশ্বের দরবারে তার সকর প্রভাব প্রতিপত্তির সমাধি রচিত হয়।
কাজেই প্রশ্ন হচ্ছে, ৮/৯ কোটি অধিবাসীর একটি দেশে ১ অর্বুদ ২৮ কোটি লোক অধ্যুষিত চারটি দেশ কর্তৃক পরিবেষ্টিত অবস্থায় ফ্রান্সের মত বিপদের ঝুঁকি নিতে পারেকি, বিশেষত পার্শবর্তী দেশসমূহের সঙ্গে নিজেদের বা অন্যের বিবাদের দরুন যখন সম্পর্ক খুব বন্ধুত্বপূর্ণ নয় তখন জনসংখ্যা হ্রাস করা কি বুদ্ধিমানের কাজ হবে?
২. নৈতিক পতন
ব্যক্তিগত স্বার্থের দোহাই দিয়ে সন্তান সংখ্যা কমানোরযে আবেদন সর্বসাধারণ্যে প্রচারিত হবে, তার প্রভাব শুধু সন্তান কমানো পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকবে না। কেবার আপনি মানুষের চিন্তার ধারা বদলিয়ে দিন। তাকে বুঝিয়ে দিন যে, তার উপার্জনলম্ভসম্পরেদ যত অধিক সম্ভব অংশ তার নিজের আরাম-আয়েশেই নিয়োজিত হওয়া উচিত এবং যারা উপার্জন করতে পারে না, সম্পদ ব্যবহার করার ব্যাপারেতাদের অংশ গ্রহণ সহ্য করা উচিত নয়। এ মনোভাব সৃষ্টি করে দেবার পর দেখতে পাবেন, শুধু যে নতুন নতুন সন্তানের জন্মই তার কাছে অসহনীয় মনে হবে তাই নয়, বরং নিজের বুড়ো বাপ-মা ও এতিম ভাই-বোন সবই তার কাছে অসহ্য মনে হবে; যে সকল পুরাতন রোগীর রোগ মুক্তির আশা নেই- বিকলাঙ্গ, অকর্মণ্য আত্মীয়-স্বজন ইত্যাদি যারা উপার্জনের অযোগ্য তাদের জন্যে নিজের সম্পদ ব্যয় করতে উপার্জনকারী প্রস্তুত হবে না। কারণ এরূপ করলে তার নিজের জীবন যাত্রার মান নীচে যাবে বলে সে বিশ্বাস করবে।
যারা নিজেদের সন্তানের বোঝা বইতে পর্যন্ত রাজী নয় এবং শুধু এজন্যেই দুনিয়ায় আগমনকারীদের পথ রোধ করে দাঁড়ায় তারা কেমন করে এমন সব লোকের বোঝা বইতে রাজী হতে পারে, যারা আগে থেকেই দুনিয়ায় আগমন করেছে এবং নিজেদেরে সন্তানের তুলনায় ভালবাসার সম্পর্কের ক্ষেত্রে অধিকতর দূরে অবস্থান করে। এভাবেই এ ধরনের মনোভাব আমাদের নৈতিক দিক থেকে দেউলিয়া করে দেবে, আমাদের জনগণকে স্বার্থপর করে তুলবে িএবং ত্যাগ, তিতিক্ষা, সমবেদনা ও পরোপকারের প্রেরণা নির্মূল করে দেবে।
এ ফলাফলও নিছক ধারণা ও অনুমানভিত্তিক নয়, বরং যেসব সমাজে এ ধরনের মনোভাব সৃষ্টি করা হয়েছে সেখানে ওপরে বর্ণিত সব কিছুই মওজুদ রয়েছে। পাশ্চাত্য দেশসমূহে বুড়ো মা-বাপের সঙ্গে যে ব্যবহার করাহ হয় এবং ভাই-বোন ও নিকটাত্মীয়দের বিপদ-আপদে যে ধরনের খোঁজ-খবর নেয়া হয়, তা আজ কে না জানে?
৩. ব্যভিচারের আধিক্য
জন্মনিরোধ আন্দোলনকে স্বার্থকরূপে বাস্তবায়নের জন্যে জন্মনিরোধ সম্পর্কি তথ্যাবলীর অবাধ প্রচার ও এর উপকরণাদি সর্বত্র সহজলভ্য করে দেয়ায় শুধু যে বিবাহিত দম্পত্তিই এইগুলো ব্যবহার করবে তার নিশ্চয়তাকি? প্রকৃতপক্ষে বিবাহিত দম্পত্তির তুলনায় অবিবাহিত বন্ধুযুগলই এ ব্যবস্থা দ্বারা অধিকতর উপকৃত হবে এবং ব্যভিচার এত প্রসর লাভ করবে যে, আমাদের ইতিহাসে এর কোন নজীর নেই। যে সমাজের শিক্ষা ব্যবস্থা ধর্ম ও নৈতিকতা সম্পর্কিত শিক্ষার অনুপাত দিন দিন ক্ষীণতর হয়ে আসছে, যেখানে সিনেমা, অশ্লীল সাহিত্য,অশ্লীল ছবি, গান ও যৌন আবেদনমলক অন্যান্য কার্যকলাপ দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে, যেখানে পর্দার কড়াকড়ি দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে এবং নর-নারীর অবাধ মেলামেশার সুযোগ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে, যেখানে নারীদের পোশাক উলংগপনা, রূপচর্চা ও সৌন্দর্য প্রদর্শনেচ্ছা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে, যেখানে একাধিক বিয়ে করার পথে বাধা সৃষ্টি করা হচ্ছে কিন্তু পর-পুরুষ ও নর-নারীর অবৈধ মিলনের পথে কোন আইনগত অসুবিধা থাকবে না, যেখানে ১৬ বছরের নিম্ন বালিকার বিয়ে আইনত নিষিদ্ধ, সেখানে নৈতিক অধপতন থেকে রক্ষা করার একটি মাত্র পথই বাকী থাকে- আর তা হচ্ছে অবৈধ গর্ভ সঞ্চারের আশঙ্কা। একবার এ বাধাটুকু অপসারণ করেদিন এবং বদ স্বভাববিশিষ্ট নারীদের নিশ্চযতা দান করুন যে, গর্ভ সঞ্চারের আশঙ্কা না করেই তারা নিশ্চিন্তে নিজেদেরকে পুরুষ বন্ধুর নিকট সোপর্দ করে দিতে পারে, তারপরে দেখবেন যে, ব্যভিচারের সর্বগ্রাসী বন্যায় সমাজ এমনভাবে প্লাবিত হয়ে যাবে যে, এর প্রতিরোধ করার সাধ্য কারোর নেই।
এর কুফলও নিছক অনুমানভিত্তিক নয়, বরং দুনিয়ার যেসব দেশে জন্ম নরোধ ব্যবস্থা সাধারণভাবে প্রচলিত হয়েছে সেসব দেশে ব্যভিচার এমনভাবে বেড়েছে যে, ইতিহাসে তার কোন নজির পাওয়া যায় না।
ব্যক্তিগতভাবে জন্মনিয়ন্ত্রণ ও এজন্যে সমষ্টিগত আন্দোলন
পরিবার পরিকল্পনাকে একটি ব্যাপক আন্দোলনে পরিণত করায় ওপরে বর্ণিত তিনটি পরিণতি থেকে রেহাই পাবার কোন উপায় নেই। যদি জন্মনিরোধকে বিশেষ বিশেষ ব্যক্তিগত অবস্থার চাহিদা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ রাখা হয় এবং কোন বিবাহিত স্বামী-স্ত্রী সংগত কারণে এর প্রয়োজন অনুভব করে, একজন আল্লাহ ভীরু দীনী আলেম এদের বর্ণিত প্রয়োজনকে বৈধমনে সতর্কতার সঙ্গে জায়েজ হবার সপক্ষে ফতওয়া দেন এবং শুধু একজন অভিজ্ঞ চিকিৎস মারফতই জন্মনিরোধের সরবরাহ করা হয় তাহলে ইতিপূর্বে আমি যেসব সামষ্টিক ক্ষতি উল্লেখ করেছি তার উদ্ভবের কোন সম্ভাবনাই দেখা দিতেগ পারে না। কিন্তু এ সীমাবদ্ধ ব্যক্তিগত পর্যায়ের জন্মনিরোধ সমষ্টিগত পর্যায়ে মারফত জন্মনিরোধের উপকরণগুলো সরাসরি প্রত্যেক লোকের নাগালের মধ্যে পৌছিয়ে দেয়া হয়। এমতাবস্থায় উপরোল্লি্যিখত কুফলসমূহ প্রতিরোধ করা কারো আয়াসসাধ্য নয়।
ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি
এ আলোচনার পর আমরা যে দীনের অনুসারে সে এ বিষয়ে আমাদের কি কি পথনির্দেশ দান করে তা প্রকাশ করা আমার পক্ষে অত্যন্ত সহজ হয়ে গেছে। সাধারণত জন্মনিরোধের সমর্থকবৃন্দ যেসব হাদীস থেকে ‘আজল’ (সঙ্গমকালে চরম মুহূর্তে বীর্য স্ত্রীঅঙ্গের বাইরে নিক্ষেপ)-এর বৈধতা করে দেখান তারা ভুলে যান যে, ঐসব হাদীসের পটভূমিকায় বংশ বৃদ্ধি নিরোধ করার কোন আন্দোলন কার্যকরী ছিল না। হযরত রসূলে করীম (স)-এর নিকট জন্ম নিরোধের কোন আন্দোলন শুরু করা সম্পর্কে কেউ ফতওয়া জিজ্ঞাসা করেন নি। বরং বিভিন্ন সময় কেউ কেউ নিছক ব্যক্তিগত অসুবিধার দরুন জানতে চেয়েছিলেন যে, ঐ অবস্থায় একজন মুসলমানের জন্যে আজল করা জায়েয কি না? এসব বিভিন্ন ধরনের প্রশ্নকারীদের উত্তরদ দান প্রসেঙ্গ তিনি কাকেও নিষেধ করেছেন, কারো বেলায় এটাকে অপ্রয়োজনীয় কাজ আখ্যা দিয়েছেন এবং হুজুর (স)-এর কোন কোন উত্তর অথবা কোন ক্ষেত্রে নীরবতা অবলম্বন থেকে আজলকে জায়েয বলে ধরে নেয়ার ধারণাও পাওয়া যায়। এসব প্রশ্নোত্তর থেকে শুধু বৈধতার জবাবগুলোকেও বাছাই করে একত্রিত করে নেয়া যায় তবু শুধু ব্যক্তিগত কারণেই জন্মনিরোধকে বৈধ করা যেতে পারে। একটি ব্যাপক আন্দোলন শুরু করার সপক্ষে এসব হাদীসকে দলিলরূপে ব্যবহার করার কোন উপায় নেই। আর ব্যক্তিগত জন্মনিরোধ ও গণ আন্দোলন মারফত জনসংখ্যা হ্রাস করার মধ্যে যে বিরাট পার্থক্য রয়েছে তা একটু আগেই আমি উল্লেখ করেছি। এ পার্থক্যটি উপেক্ষা করে একের বৈধতাকে অপরের জন্যে দলিল হিসাবে পেশ করার অর্ধ জরবদস্তি আর কিছুই নয়।
আর জনসংখ্যা কমানোর জন্যে সমষ্টিগত আন্দোলন সম্পর্কে আমার বক্তব্য হচ্ছে এই যে, এ ধরনের ধারার গোড়া থেকে শুরু করে এর কার্যক্রম ও ফলাফল সবই ইসলামী আদর্শের সঙ্গে পূর্ণ সংঘর্ষশীল। এ চিন্তার মূল বিষয়বস্তু হচ্ছে এই যে, মানুষের সংখ্যা বেশী হলে রেজেকের অভাব দেখা দেবে এবং মানুষের জীবন ধারণ অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়বে। কিন্তু কোরআন বার বার বিভিন্ন ধরনের মানুষের মনে এ বিশ্বাস বদ্ধমূল করে দিয়েছে যে, সৃষ্টি করেছেন যিনি, রেজেক দানের দায়িত্বও তাঁরই। তিনি এরূপ এলোপাতাড়ি সৃষ্টি করে যান না যে, কেবলি সৃষ্টি করে চলেছেন, অথচ যে পৃথিবীতে তাদের পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে, সেখানে তাদের জীবন যাপনের উপযোগী মাল-মসলা মওজুদ আছে কিনা সেদিকে মোটেই লক্ষ্য করছেন না এবং তিনি রেজেকের ভার অন্য কারো ওপর অর্পণ করেন নি যে, সৃষ্টির কাজ তিনি করে যাবেন এবং রেজেকের সংস্থান অন্য কেউ করতে থাকবে। তিনি শুধু খালেকই (স্রষ্টা) নন, রাজ্জাকও (রেজেকদাতা) এবং নিজের কাজ সম্পর্কে তিনিই পূর্ণ জ্ঞানের অধিকারী। এ বিষয়ে কোরআন শরীফে বহু আয়াত রয়েছে। সবগুলো উল্লেখ করলে আলোচনা দীর্ঘ হয়ে যাবে। আমি মাত্র নমুনাস্বরূপ কয়েকটি আয়াত উল্লেখ করছি।
(আরবী*************)
“অসংখ্য জীবন এমন রয়েছে যারা কোন মওজুদ খাদ্যভাণ্ডার বয়ে বেড়ায় না, অথচ আল্লাহ-ই এদের রেজেক দিয়ে থাকেন। তিনি তোমাদেরও রেজেকদাতা।” (সূরা আনকাবুত-৬০)
(আরবী**********)
“পৃথিবীতে বিচরণকারী এমন প্রাণী নেই, যার রেজেকদানের দায়িত্ব আল্লাহ গ্রহণ করেন নি।” (সূরায়ে হুদ-৬)
(আরবী**********) “নিসন্দেহে আল্লাহ তায়ালাই রেজেকদাতা, মহাশক্তিশালী ও পরাক্রান্ত।” (সূরায়ে জারিয়া-৫৮)
(আরবী**********)
“আসমান ও জমিনের যাবতীয় সম্পদ একমাত্র তাঁর আয়ত্তাধীন, তিনি যাকে ইচ্ছা প্রাচুর্য দান করেন এবং যাকে ইচ্ছা অভাবের মধ্যে নিক্ষেপ করেন।” (সূরা-শুরা: ১২)
(আরবী**********)
“আমি পৃথিবীতে তোমাদের জন্যেও রেজেকের সংস্থান করেছি এবং তাদের জন্যেও যাদের রেজেক দাতা তোমরা নও। এমন কোন বস্তু নেই যার ভাণ্ডার আমার হাতে নেই আর এ ভাণ্ডার থেকে আমি এক পরিকল্পিত হিসাব অনুসারে বিভিন্ন সময় রেজেক নাজিল করে থাকি।” –(আল হিজর ২০-২১)
এসব তথ্য বর্ণনা করার পর আল্লাহ মানুষের ওপর যে দায়িত্ব অর্পণ করেন তা হলো এই যে, তাঁর বিরাট ভাণ্ডার থেকে রেজেক সংগ্রহ করার জন্যে চেষ্টা সাধনার দয়িত্ব তিনি মানুষে ওপরা অর্পণ করেন। অন্য কথায় রেজেক অনুসন্ধান করা মানুষের কাজ, আর রেজেক দান করা আল্লাহর কাজ।
(আরবী**********)
“সুতরাং আল্লাহর কাছে রেজেক অনুসন্ধান করো, তাঁরই বন্দেগী করো এবং তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকে।” (আনকাবুত-১৭)
এরই ভিত্তিতে জাহেলিয়াতের যুগে যার খাদ্যাভাবের আশংকায় সন্তান হত্যা করতো কোরআন তাদের তিরষ্কার করেছে।
(আরবী**********)
“তোমাদের সন্তানদের অভাবের দরুন হত্যা করো না। আমিই তো তোমাদের এবং তাদের সকলেরই রেজেক দাতা।” (সূরা আন-আম- ১৫১)
(আরবী**********)
“দারিদ্রের ভয়ে তোমাদের সন্তানদের হত্যা করো না। আমি তাদের এবং তোমাদের রেজেক দাতা।” (বনী ইসরাঈল- ৩১)
এসব আয়অতে একটি ভুলের জন্যে নয়, বরং দু’টি ভুলের জন্যে তিরষ্কার করা হয়েছে। প্রথম ভুল হচ্ছে নিজেদের সন্তান হত্যা করা। দ্বিতীয় ভুল হচ্ছে এই যে, সন্তানের জন্মকেই তারা দারিদ্রের কারণ বলে মনে করছিল। এজন্যই দ্বিতীয় ভুলটি অপনোদনের জন্যে বলা হচ্ছে, ভবিষ্যৎ বংশধরদের খাদ্যসংস্থান করার ভার তোমাদের ওপর দেয়া হয়েছে বলে তোমরা কি বুঝে নিয়েছ? বরং আমিই তো তাদের এবং তোমাদেরও রেজেকের সংস্তান করে থাকি।
আজকাল যদিও সন্তান হত্যার পরিবর্ত অন্যবিধ উপায়ে তাদের জন্মের পর বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে, তবুও সন্তান জন্মানোর ফলে আর্থিক আশংকাজনিত ভুল ধারণাই জন্মনিরোধের মূল কারন হিসাবে টিকে আছে। এ বিষয়ে সন্দেহমাত্র নেই।
এটাতো হলো দনিয়ায় অতীতের যে ধরনের চিন্তাধারার ফলে জন্মনিরোধ বা বংশ সংকোচনের মনোভাব সৃষ্টি হয়েছিল বা বর্তমানেও হচ্ছে তৎসম্পর্কে কোরআনের দৃষ্টিভঙ্গী। এবার এধরনের চিন্তাকে একটি ব্যাপক আন্দোলন হিসাবে পেশ করার অনিবার্য পরিণতিসমূহ সম্পর্কে চিন্তা করে নিজেরাই বিবেচনা করুন, ইসলাম এসব পরিণতির কোন একটিও স্বীকার করতে পারে কি না। যে জীবন বিধান ব্যভিচারকে জঘন্যতম নৈতিক অপরাধ বলে মনে করে এবং এজন্য কঠোর সাজা দান করে থাকে, সে এমন কোন ব্যবস্থাকে কেমন করে গ্রহণ করতে পারে যার ফলে ব্যভিচার মহামারীর মত সমাজের বর্বত্র ছড়িয়ে পড়ার নিশ্চিত আশংকা রয়েছে? যে জীবন বিধান মানব সমাজে আত্মীয়-স্বজনের হক আদায় এবং ত্যাগ ও সমবেদনার গুণ সম্প্রসারণের অভিলাষী, সে জীবন বিধান জন্ম নিরোধের প্রচারের ফলে অনিবার্যরূপে যে স্বার্থপরতার মনোভাব সৃষ্ট হয়তাকে কি করে গ্রহণ করতে পারে? পুনরায় যে জীবন বিধানের দৃষ্টিতে মুসলমান জাতির নিরাপত্তার প্রশ্ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সে কেমন করে অসংখ্য শত্রুপরিবেশিষ্টত মুষ্টিমেয় মুসলমানদের সংখ্যাকে আরো কমিয়ে তাদের রক্ষা ব্যবস্থাকে দুর্বল করার পক্ষপাতী হতে পারে?
এসব প্রশ্নের সঠিক উত্তর দেবার জন্যে বেশী বুদ্ধির দরকার হয় না। -সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন যে কোন ব্যক্তিই এ উত্তর অতি সহজেই দিতে পারে। এজন্যে কোরআনের আয়াত ও হাদীস পেশ করার প্রয়োজন হয় না।