হাজী শরীয়তুল্লাহ
মোশাররফ হোসেন খান
আগের কথা
সতেরো শো সাতান্ন সাল।
মীর জাফরদের চক্রান্তে ইংরেজদের কাছে পরাজিত হলেন বাংলার নবাব সিরাজদ্দৌলাহ।
পলাশীর প্রান্তরে নবাব সিরাজদ্দৌলার পরাজয়ের পর বাংলার মুসলমানদের ভাগ্যাকাশে দেখা দেয় এক ভয়ংকর সর্বনাশের ঘনঘটা।
ইংরেজ এবং উগ্র হিন্দুদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়ে বাংলার মুসলমান। রাজনৈতিক, ঐতিহ্যিক এবং সাস্কৃতিক ক্ষেত্রে মুসলমানরা এ সময়ে যেমন ইবংরেজ ও হিন্দুদের উৎপীড়নের শিকার হয়, তেমনি তাদের নির্মমতার শিকার হয়ে অর্থনৈতিকভাবে তারা দুর্বল ও নিঃস্ব হয়ে পড়ে।
মুর্শিদকুলী খানের আমল থেকেই হিন্দুরা মুসলিম শাসন উৎখাত করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলো। ইংরেজ ব্যবসায়ীদের সাথে তাদের সম্পর্ক ছিলো অত্যন্ত নিবিড়।
সতেরো শো ছত্রিশ সাল থেকে সতেরো শো চল্লিশ সালের মধ্যে ইংরেজ কোম্পানী- কলকাতায় বায়ান্নজন ব্যবসায়ী নিয়োগ করেছিলেন। তাদের সবাই ছিলো হিন্দু। সতেরো শো ঊনচল্লিশ সালে কাশিম বাজারে তারা পঁচিশজন ব্যবসায়ী নিয়োগ করে। তারাও ছিলো হিন্দু।
এ সময়ে মুসলমানদের কোথাও স্থান ছিলো না। না ব্যবসায় বাণিজ্যের ক্ষেত্রে। না চাকরীর ক্ষেত্রে। যাদের আগে থেকেই চাকরি ছিলো, তাদেরকেও বাদ দেয়া হলো।
এই চরম দুঃসময়ে লাখ লাখ মুসলমান বেকারত্বের অভিশাপ নিয়ে যাত্রা করলো গ্রামের দিকে। উদ্দেশ্য ছিলো, কৃষিকে আঁকড়ে ধরে কোনো রকমে বেঁচে থাকা।
গ্রামের অবস্থা ছিলো আরো ভয়াবহ।
শাসন ক্ষমতা হস্তগত করার সাথে সাথে ইংরেজ বণিকরা বাংলার প্রাচীন গ্রামের ভিত্তি ভূমিকে ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়েছিলো। ভেঙ্গে দিয়েছিলো তারা গ্রামের সমাজ কাঠামোকেও। এ কাজে তারা প্রধানত দু’টি অস্ত্র ব্যবহার করলো- ভূমি রাজস্বের নতুন ব্যস্থা ও ভূমি রাজস্ব হিসেবে ফসল বা দ্রব্যের পরিবর্তে মুদ্রার প্রচলন।
এই দুই অস্ত্রের প্রচণ্ড শক্তির আঘাতে স্বল্পকালের মধ্যে প্রাচীন গ্রাম-বাংলার ভিত্তি একেবারে ধূলিসাৎ হয়ে গেলো। শ্মসানে পরিণত হলো হাজার হাজার গ্রাম।
বহুমুখী শোষণ-উৎপীড়নের চাপে পড়ে বাংলার অসহায় কৃষক সমাজ নিঃস্ব হয়ে অনিবার্য ধ্বংসের মুখে এসে দাঁড়ালো।
বাংলার দরিদ্র কৃষক মানেই মুসলমান। আর জমিদার এবং বিত্তবান মানেই হিন্দু।
ক্ষমতা হারিয়ে, চাকরি খুইয়ে মুসলমানরা যখন দারিদ্র্যের নিষ্পেষণে হতাশাগ্রস্ত, তখন ইংরেজ সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় সর্বস্তরে ক্ষমতা সম্পদের অধিকারী হলো হিন্দু দেওয়ান, গোমস্তা, বেনিয়ান, মুৎসুদ্দিরা। সকল ক্ষেত্রে তখন হিন্দুদেরই একচ্ছত্র দাপট।
কর্নওয়ালিসের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের বদৌলতে জমির মালিকরূপে পরিগণিত হলো হিন্দুরাই। শুধামাত্র অর্থগুণে দেব, মিত্র, সিংহ, মল্লিক, শীল এমন কি তিলি আর সাহা-রাও রাতারাতি জমিদাররূপে প্রতিষ্ঠা লাভ করলো।
পুরনো জমিদারদের অনেকেই নানা কারণে জমিদারী বিক্রি করেছিলো। সেই জমিদারী কিনে নিয়েছিলো সম্পদশালী হিন্দু ব্যবসায়ীরা।
নব্য জমিদারদের খাজনা ও বহুবিধ করের চাপের এবং জমিদারদের নিয়োগকৃত নায়েব গোমস্তাদের রোষেপড়ে গরীব চাষীরা হলো এবার ভিটেছাড়া।
একদিকে জমিদার মহাজনের শোষণ-পোড়ণ আর আধুনিক অত্যাচার, অপরদিকে কুশিখ্ষা, অশিক্ষার অভিশাপ। তার ওপর আছে রোগ, মহামারী ও দুর্ভিক্ষ। এ সবকিছু মিলিয়ে মুসলিম চাষীরা এমন এক করুণ ও ভয়াবহ অবস্থার শিকার হলো- যার পরিণতি ছিলো অনিবার্য ধ্বংস।
সরকারী চাকরি পাওয়ার সকল দরোজা বন্ধ হয়ে গেলো মুসলমানদের জন্যে। তাদের মধ্যে যারা ইংরেজী শিখে যোগ্যতা অর্জনের চেষ্টা করলো- তারাও চাকরি পেলো না। কেননা চাকরির বিজ্ঞাপনে তখন স্পষ্ট উল্লেখ থাকতো কেবল হিন্দু প্রার্থদেরই আবেদন গ্রহণযোগ্য।
‘দূরবীন’ নামক কলকাতার একটি ফরাসী পত্রিকা ছিলো।
আঠারো শো ঊনসত্তর সালের জুলাই মাসে চাকরির ক্ষেত্রে মুসলমানদের দুর্দশার কথা বর্ণনা করতে গিয়ে ‘দুরবীন’ পত্রিকাটি লিখেছিলো:
“উচ্চস্তরের বা নিম্নস্তরের সমস্ত চাকরি ক্রমান্বয়ে মুসলমানদের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে অন্যান্য সম্প্রদায়ের মধ্যে, বিশেষ করে হিন্দুদের মধ্যে বিতরণ করা হচ্ছে। সরকার সকল শ্রেণীর কর্মচারীকে সমান দৃষ্টিতে দেখতে বাধ্য, তথাপি এমন সময় এসেছে যখন মুসলমানদের নাম আর সরকারী চাকুরিয়াদের তালিকায় প্রকাশিত হচ্ছে না, কেবল তারাই চাকরির জায়গায় অপাংক্তেয় সাব্যস্ত হয়েছে। সম্প্রতি সুন্দরবন কমিশনার অফিসে কতিপয় চারিতে লোক নিয়োগের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়, কিন্তু অফিসাপরটি সরকারী গেজেটে কর্মখালির যে বিজ্ঞাপন প্রকাশ করেন তাতে বলা হয় যে, “শূণ্য পদগুলিতে কেবলমাত্র হিন্দুদের নিয়োগ করা হবে।”
তখনকার দিনে অফিস আদালত ও পুলিশ বিভাগেও কেবলমাত্র হিন্দুদেরকে নিয়োগ করার নির্দেশ দেয়া হতো।
শুধা চাকরি নয়। শিক্ষা ও ব্যবসার ক্ষেত্রেও মুসলমানদের অবস্থা ছিলো দুর্ভাগ্যজনকভাবে সংকটময়।
অপরদিকে ধর্মীয়ভাবেও মুসলমানরা ছিলো অনগ্রসর। ইসলাম থেকে, ইসলামের মূল শিক্ষা ও আদর্শ থেকে তারা অনেক অনেক দূরে সরে গিয়েছিলো।
হিন্দুদের পাশাপাশি দীর্ঘকাল বসবাস করার কারণে এবং অসচেতন থাকার ফলে তারা শিরক ও বিদআতের মতো বড়ো বড়ো গুনাহের কাজে লিপ্ত থাকতো। হিন্দুয়ানী অপসংস্কৃতির জোয়ারে ভেসে গিয়েছিলো তখনকার অধিকাংশ মুসলিম পরিবার।
ঠিক এমনি এক ক্রান্তিকালে, এমনি এক অস্থির দুঃসময়ে জন্মলাভ করলেন এই উপমহাদেশের সংগ্রামী নেতা- হাজী শরয়তুল্লাহ।