মক্কা জীবনে
মাওলানা বশারত আলীর সাথে মক্কায় আসার পর হাজী শরীয়তুল্লাহর বুকটা আনন্দে ভরে উঠলো।
তাঁর ছিলো শিক্ষার প্রতি অসম্ভব আগ্রহ।
তিনি মক্কাতেও শিক্ষালাভের জন্য অপ্রাণ চেষ্টা করলেন। শরীয়তুল্লাহ মক্কায় ছিলেণ একটা বিশ বছরের মতো।
অনেক দীর্ঘ সময়।
এই দীর্ঘ সময়ে তিনি মক্কার বহু বিখ্যাত শিক্ষকের কাছে পড়াশুনা করলেন। কিতাবী শিক্ষার পাশাপাশি তিনি ইসলামের ব্যবহারিতক দিক সম্পর্কেও সম্যক জ্ঞান লাভ করলেন।
যেহেতু মক্কায় গেছেন। সেই কারণে হজ পালন করাটা তো আর হাত ছাড়া করা যায় না!
শরীয়তুল্লাহ সাথে সাথে হজ পালনের পর্বটা সেরে নিলেন।
কি আশ্চর্যের বিষয়!
আপন সাধনা ও শ্রমের বলে হাজী শরীয়তুল্লাহ একজন উচ্চ শিক্ষিত আলেম হিসাবে সুদূর মক্কাতেও বিশেষ খ্যাতি লাভ করেছিলেন।
বাংলাদেশথেকে মক্কা অনেক- অনেক দূরের পথ।
একটি ভিন্ন দেশ। ভিন্ন তাদের ভাষায়। ভিন্ন তাদের শিক্ষা ব্যবস্থাও শিক্ষাদান পদ্ধতি।
কিন্তু তা হলে কি হবে?
হাজী শরীয়তুল্লাহর খ্যাতি তখন মক্কার চারদিকে।
সেই খ্যাতির সৌরভে মৌ মৌ করছে মক্কার বিস্তৃত প্রান্তর।
ইসলাম সম্পর্কে তাঁর পাণ্ডিত্যের কথা তখন সবার মুখে মুখে।
তাঁর জ্ঞানের বহরের কথা মক্কার শিক্ষিত মানুষ মাত্রই জেনে গেছেন।
অবাক হবারই তো কথা!
তাঁর পাণ্ডিত্যে মুগ্ধ হয়ে সেখানকার মানুষ হাজী শরীয়তুল্লাহকে শিক্ষক নিযুক্ত করলেন।
হাজী শরীয়তুল্লাহ মক্কায় বিশ বছর অবস্থান করার সময়ে বেছে নেন শিক্ষকতার এই মহান পেশা।
তিনি মক্কার নামী-দামী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করতে থাকেন।
এতে করে তাঁর সময়টা ভালোই কাটছিলো। আরো বৃদ্ধি পাচ্ছিলো তাঁর জ্ঞানের বহর।
এই সময়ে তিনি সন্ধান পেলেন মক্কার আর এক বুজুর্গ ব্যক্তি। তাঁর নাম মাওলানা তাহের চোম্বল।
মক্কায় তিনি ছোটো আবু হানিফা নামে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।
হাজী শরীয়তুল্লাহ এই বুজুর্গ আলেমে দীন- মাওলানা তাহের চোম্বলের কাছে প্রায়ই যেতেন।
মাওলানা তাহের মক্কায় একজন আধ্যাত্মিক পণ্ডিত ও সংস্কারক হিসাবেও পরিচিত ছিলেন।
তাঁর চরিত্র মাধর্যে এবং তা৭র শিক্ষা ও সংস্কারে মুগ্ধ হয়ে হাজী শরীয়তুল্লাহও তাঁকে অনুসরণ করেন।
মক্কায় বিশ বছর ছিলেন হাজী শরীয়তুল্লাহ। এ সময়ের মধ্যে তিনি একাধিক হজ পালন করেন।
স্বদেশের দিকে
মক্কা বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা দান এবং মাওলানা তাহের চোম্বলের কাছে ইসলাম ও আত্মশুদ্ধি সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করতে থাকেন হাজী শরীয়তুল্লাহ।
কিন্তু স্বদেশে ফেরার জন্যে তাঁর হৃদয়টা ব্যাকুলতা হয়ে উঠলো।
কেবলই মনে পড়তে থাকলো তাঁর আপন মাতৃভূমির কথা। স্বজনদের কথা। প্রিয় চাচার কথা।
চাচা মুহাম্মদ আজিমের অসুস্থতার খবরও তিনি পেয়ে গেছেন।
এসব কথা ভাবতে গিয়ে মক্কার প্রবাস জীবনে অস্থির হয়ে ওঠেন হাজী শরীয়তুল্লাহ।
সিদ্ধান্ত নেন মক্কা থেকে স্বদেশে ফিরে আসার।
অবশেষে তিনি ফিরে এলেন স্বদেশের মাটিতে। সময়টা ছিলো আঠারো শো আঠারো সাল।
হাজী শরীয়তুল্লাহ দীর্ঘ প্রবাস জীবন শেষে যখন নিজ গ্রাম শামাইলে পৌছুলেন,তখন দেখলেন তাঁর একমাত্র জীবিত চাচা মুহাম্মদ আজিম তালুকদার ভীষণ অসুস্থ।
প্রাণ-প্রিয় চাচার এই করুণ অবস্থা দেখে ডুকরে কেঁদে উঠলেন হাজী শরীয়তুল্লাহ!
চারদিকে আঁধার কালো
খুব শৈশবে গ্রাম ছেড়েছিলেন শরীয়তুল্লাহ।
তিনি মক্কা থেকে ফিরে এসে তখনকার সেই পরিচিত মুখগুলোর মধ্যে অনেককেই আর দেখতে পেলেন না!
এর মধ্যে হারিয়ে গেছে তাঁর কত যে চেনা মুখ! কত যে কাছে মানুষ! কত যে খেলার সাথী!
স্বজন হারানোর এই বেদনা হাজী শরীয়তুল্লাহকে খুব ব্যথিত করে তুললো। কিন্তু তার চেয়েও তিনি বেশি ব্যথিত হলেন চার পাশের মানুষ ও তাদের পরিবেশ দেখে।
আতকে উঠলেন তাদের অধঃপতন দেখে!
কুসংস্কার, অশিক্ষা, কুশিক্ষা, অভাব দারিদ্র আর শোষণ নির্যাতনে মুষড়ে পড়া মুসলিম পরিবারগুলোর দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারেন না
হাজী শরীয়তুল্লাহ!
চারদিকে আঁধারের কালো ছায়া!
এদেশে তখনো ইংরেজদের দখলে।
ইংরেজদের শোষণ আর অত্যাচারে অতিষ্ট শহরের মানুষ। তার চেয়েও বেশি অতিষ্ট গ্রামের মানুষ।
পাড়া-গ্রামে চলছে অত্যাচারী জমিদার, মহাজন আর নীল করদের একচেটিয়া দাপট।
শুধু ইংরেজই নয়।
এদেশের হিন্দু জমিদাররাও তাদের সাথে মিশে অত্যাচারের বিষে জর্জরিত করছে সাধারণ মুসলমানকে।
সে সময়ে গ্রামের অধিকাংশ মুসলমানই ছিলো অত্যন্ত দরিদ্র।
তাদেরকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে দিতো না একদিকে ইংরেজ, নীলকর এবং অপরদিকে এ দেশীয় হিন্দু এবং হিন্দু মহাজন ও জমিদাররা। অসহায় দরিদ্র মুসলমানদের অধিকাংশই ছিলো অশিক্ষিত।
একটু যারা শিক্ষিত তারাও ছিলো অনেকটা অসচেতন। ইংরেজরা হিন্দু ও হিন্দু জমিদারকে খুব সুনজরে দেখতো। হিন্দুদেরকে তারা খুব কদর করতো। আর মুসলমানরা ছিলেঅ তাদের দু’চোখের বিষ।
তারা মুসলমানদেরকে শত্রু ভাবতো।
তাই তারা সুকৌশলে সকল সময় হিন্দুদেরকে ক্ষেপিয়ে তুলতো দরিদ্র অশিক্ষিত মুসলমানদের ওপর।
ইংরেজদের আশকারা আর মদদ পেয়ে হিন্দুরা ছলে-বলে-কৌশলে মুসলমানদের গ্রাস করতে উদ্যত হতো।
তারা গ্রাস করতো মুসলমানদের অর্থ-সম্পদ, জমি-জায়গা।
তাতেও তারা খুশি হতো না।
এরপর তারা মুসলমানদের ধর্মীয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক দিক দিয়েও ধ্বংস করার চেষ্টা করতো সর্বক্ষণ।
মুসলমানদের ইসলাম থেকে, তাদের ঐতিহ্য থেকে দূরে রাখার সকল প্রকার অপকৌশল প্রয়োগ করতো হিন্দুরা।
তাদের হাতে ক্ষমতা আর অর্থ থাকার কারণে তারা সহজেই প্রভাবিত করতে পারতো দরিদ্র-অশিক্ষিত মুসলমানদেরকে।
এইভাবে এক সময় মুসলমানরা কুসংস্কারের অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে পড়লো। হাজী শরীয়তুল্লাহ দেখলেন মুসলমানদের এই করুণ পারিবারিক ও সামাজিক অবস্থা।
তিনি দেখলেন, মুসলমানরা রোযা-নামাযসহ আল্লাহর ইবাদাত ছেড়ে দিয়ে, আপন সংস্কৃতি ভুলে গিয়ে হিন্দুদের সংস্কৃতিকে গ্রহণ করে নিয়েছে!
তারা নামেই কেবল মুসলমান আছে।
তাদের মধ্যে নেই ইসলামের কোনো ছায়া চিহ্ন।
ইসলামের কোনো কিছুই তারা পালন করে না।
দীর্ঘকাল হিন্দুদের দ্বারা প্রভাবিত হবার কারণে হিন্দুয়ানী আচার অনুষ্ঠান ও হিন্দু সংস্কৃতিতে তারা গা ভাসিয়ে দিয়েছে।
ইসলারেম যে মৌলিক ও পৃথক সংস্কৃতি বলে কিছু আছে- এ কথাও তারা ভুলে গেছে।
কি সর্বনাশে ব্যাপার!
তাদের এই অধঃপতন দেখে খুবই মর্মামহত হলেন হাজী শরীয়তুল্লাহ।
তিনি পথভোলা মানুষের কাছে নতুন করে ইসলামের দাওয়াত দেবার প্রয়োজনবোধ করলেন। এই বোধ থেকেই তিনি শুরু করলেন ইসলামের দাওয়াতী তৎপরতা।
বেদগান করলেন তাঁর সংস্কার আন্দোলন।
মানুষকে আহ্বান জানান তিনি সত্যের দিকে। আল্লাহর দিকে।
সাধারণ মুসলমানকে তিনি বুঝান ইসলারেম আকীদা-বিশ্বাস।
বুঝান ইসলামের সুমহান আদর্শ ঐতিহ্য।
বুঝান সত্য আর মিথ্যার পার্থক্য।
কিন্তু কি আফসোস!
গ্রামের মুসলমানরা এতোটাই অন্ধকারে ডুবেছিলো যে, হাজী শরীয়তুল্লাহর শত আহ্বানেও তারা প্রথমত এতোটুকু সাড়া দেয়নি।
তারা চিনতে ভুল করলো সত্য-সঠিক পথ। বুঝতে ভুল করলো হাজী শরীয়তুল্লাহকে।
অন্ধ মানুষের মধ্যে দীনের দাওয়াত দিতে গিয়ে প্রথম দিকেই ব্যর্থ হলেন হাজী শরীয়তুল্লাহ।
তাদের গুমরাহীতে ভীষণ কষ্ট পেলেন তিনি।
ভেবেছিলেন, অন্ধকারাচ্ছন্ন-পথভোলা গ্রামের আপন মানুষকে তিনি পথের দিশা দেখাবেন।
তাদেরকে আবার ইসলামের আলোয় আলোকিত করবেন। কিন্তু পারলেন না তিনি।
পারলেন না হাজী শরীয়তুল্লাহ।
কারণ তাঁর কথা কেউ শুনলো না।
আবারো মক্কার পথে
আপন গ্রামের মানুষকে সত্যের পথে ডেকে যখন তাদের কোনো সাড়া পেলেন না, তখন কিছুটা হতাশ হয়ে আবারো মক্কার উদ্দেশ্যে রওয়ানা করলেন হাজী শরীয়তুল্লাহ।
বুকে তাঁর ব্যর্থতার যন্ত্রণা! কষ্টের তুফান! কোনো যানবাহনে নয়।
এবার চললেন তিনি সম্পূর্ণ পায়ে হেঁটে।
মক্কায় যাবার পথে প্রথমে তিনি বাগদাদে গেলেন।
বাগদাদে ঘুমিয়ে আছেন বহু শহীদ, গাজী, পীর-দরবেশ, আলেম-উলামা এবং অজস্র নেক ব্যীক্ত।
হাজী শরীয়তুল্লাহ সেই সকল পবিত্র কবর যিয়ারত করেন। যিয়ারত করেন যারা দীনের জন্যে, ইসলামের জন্যে নিজেদের জীবনকে কুরবানী করে ঘুমিয়ে পড়েছেন গহীন কবরে।
এই সকল কবরের মধ্যে আছে দয়ার নবীজীর (সা) কলিজার টুকরা, নয়নের মণি নাতি- হযরত হুসাইনের (রা) পবিত্র কবরও।
দীনের জন্যে আত্মত্যাগের এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী ইমাম হোসাইনের (রা) স্মৃতি-বিজড়িত কারবালা প্রান্তরে ইমামের শাহাদাতগাহ, তাঁর কবর এবং আবদুল কাজের জিলানীর (র) কবরও যিয়ারত করেন হাজী শরীয়তুল্লাহ।
তিনি ঘুরে ঘুরে বিখ্যাত সকল ব্যীক্তর কবর যিয়ারত করলেন।
এরপর তিনি বাইতুল মাকদিস ও মিসর সফর শেষে পৌঁছে যান পবিত্র মক্কায়। মক্কায় পৌঁছে হাজী শরীয়তুল্লাহ পুনরায় খোঁজ করেন তাঁর প্রিয় শিক্ষক মাওলানা তাহের আলীকে।
তাঁর সাথে সাক্ষাতের পর হাজী শরীয়তুল্লাহ আবারো হজ পালন করেন। তারপর রওয়ানা হলেন মদীনার পথে।
হাজী শরীয়তুল্লাহ এবার মাত্র দু’বছর থাকেন মক্কায়ে।
সেখানে থাকাকালীন সময়ে তিনি গভীরভাবে ইসলামের খুঁটিনাটি বিষয়সমূহ ছাড়াও আধ্যাত্মিক সাধনায় নিজেকে ব্যস্ত রাখেন।
তিনি মদীনায় গিয়ে নবীজীর (স) কবর মুবারক যিয়ারত করেন।
রাসূলের (সা) পবিত্র রওজযা মুবারকে দাঁড়িয়ে হাজী শরীয়তুল্লাহ স্বদেশের মুসলমানদের বিপর্যয়ের কথা স্মরণ করে তাদের মুক্তি ও হিদায়েতের জন্যে বিশেষভাবে দোয়াও করলেন।
সেখানে অবস্থানকালে তিনি একে একে তিনবার প্রাণ-প্রিয় রাসূলুল্লাহকে (সা) স্বপ্নে দেখেন।
রাসুল (সা) প্রতিবারেই তাঁকে দেশে ফিরে ইসলাম প্রচারের নির্দেশদেন। এই আশ্চর্যজনক স্বপ্নের কথা হাজী শরীয়তুল্লাহ খুলে বললেণ তাঁর মক্কার শিক্ষক মওলানা তাহের আলীকে।
বিজ্ঞ আলেমে দ্বীন মাওলানা তাহের আলী সকল কথা শুনে হাজী শরীয়তুল্লাহকে একজন সৌভাগ্যবান ব্যক্তি বলে অভিহিত করলেন।
তারপর তাঁকে বললেণ, স্বদেশে ফিরে ইসলাম প্রচারের কাজে আত্মনিয়োগ করতে।
দু’বছর মক্কা ও মদীনা সফর করার পর হাজী শরীয়তুল্লাহ আবারো রওয়ানা দিলেন স্বদেশের পথে।
সালটি ছিলো আঠারো শো বিশ।
আল্লাহর কি অপার মহিমা!
হাজী শরীয়তুল্লাহ এবার দেশে ফিরে দেখেন অন্য অবস্থা!
ভিন্ন এক পরিবেশ!
তিনি দেখেন চারদিকে জেগে উঠেছে মজলুম জনতা।
আন্দোলন এবং সংগ্রামের ঝড় উঠেছে হিন্দু জমিদার এবং ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে।
এসব দেখে তিনি অত্যন্ত খুশী হলেন। আর তাঁর দোয়া কবুল হবার জন্য শুকরিয়া জানালেন মহান রাব্বুল আলামীনকে।
হাজী শরীয়তুল্লাহর বুকে আরও প্রচণ্ড বেগে শুরু হলো সেই ঝড়ের তোলপাড়!
বারবার লড়ে যায় বীর
বারো শো তিন সাল থেকে সাড়ে পাঁচশো বছর পর্যন্ত বছর পর্যন্ত মুসলমানরা বাংলার শাসন পরিচালনা করেছিলেন।
অবশেষে এলো সতেরো সাতান্ন সাল।
পলাশীর যুদ্ধে পরাজিত হলেন বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজদ্দৌলাহ। এই যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে ইংরেজরা কেড়ে নিলো মুসলমানের হাত থেকে বাংলাদেশের শাসন ক্ষমতা।
কেড়ে নিলো তারা জনগণের সকল স্বাধীনতা।
ইংরেজ শাসনের সময় হিন্দুরা ছিলো তাদের অনুগত দাসানুদাস।
আর মুসলমানা ছিলো বিদ্রোহী।
পলাশীর যুদ্ধে পরাজয় বরণ করে মুসলমানরা কেবল রাজ্যই হারালেনা, তারা হারালো সর্বস্ব।
একদিন যে মুসলমানের হাঁক-ডাকে সরব হয়ে উঠতো চারদিক, মুহূর্তেই থেমে গেলা তাদের সেই তুমুল গর্জন।
একদিন যে মুসলমানের জন্যে দরিদ্র কিংবা নিঃস্ব হওয়া চিলো প্রায় অসম্ভব, ইংরেজরা ক্ষমতা দখলের পরপরই সেই মুসলমানরা পরিণত হলো কাঠুরিয়া এবং ভিস্তিওয়ালায়।
লাঞ্চিত এবং বঞ্চি হতে থাকলো তারা নির্মমভাবে।
মীর জাফরের মতো গুটিকয়েক অপরিণামদর্শী। উচ্চাভিলাষী নামদারী মুসলমান ইংরেজ ও হিন্দুদের ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে বেপথু হয়ে সিরাজদ্দৌলাহকে পলাশীতে বিপর্যয়ের মধ্যে ফেলে দিলো।
সেকান থেকেই মুসলমানের ভাগ্যে অংকিত হয়ে গেলো অপমমান আর লাঞ্ছনার কালো চিহ্ন।
তবুও সংগ্রাম থেমে থাকেনি একটি মুহূর্তের জন্যেও। কেনই বা থামবে?
মুসলমানদের রক্তে মিছে আছে ঈমান আর অসীম সাহসের বারুদ! প্রয়োজনে তারা জ্বলে ওঠে বারবার। গর্জে ওঠে সিংহরে মতো। যেমন গর্জে উঠেছিলো সেদিন অনেকেই। ইংরেজদের দুঃশাসন আর হিন্দুদের অত্যাচার থেকে এই দেশকে মুক্ত করার জন্যে, এই জাতিকে রক্ষা করার জন্যে সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো সময়ের সাহসী পুরুষেরা।
আবারো জেগে উঠলো তাদের সাথে মুসলমান।
তাদের সংগ্রামকে প্রতিহত করার জন্যে হিন্দুদের সহযোগিতায় ইংরেজরাও তৎপর হয়ে উঠলো।
মুসলমানদের ওপর তারা চালাতে শুরু করলো অকথ্য জুলুম আর নির্যাতনের স্টিম রোলার।
তবুও থেমে থাকলো না সংগ্রামের দাবানল!
সতেরো শো চৌষট্টি সাল।
বিদ্রোহী নবাব মীর কাসিম বাংলার স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের জন্যে প্রত্যক্ষ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লেন।
কিন্তু বক্সারের যুদ্ধে তিনি পরাজিত হলেন চরমভাবে। ব্যর্থ হলো প্রাণ-প্রিয় বাংলঅকে রক্ষা করার তাঁর সর্বশেষ প্রচেষ্টাও।
বক্সারের যুদ্ধের পূর্বেই জেগে উঠেছিলো এদেশের আর এক বিদ্রোহী গোষ্ঠী। ‘ফকির বিদ্রোহ’ নামে খ্যাত এই বিদ্রোহী গোষ্ঠীতে ছিলেন সেই যুগের বহু পীর, ফকির ও অসংখ্য আলেম।
এই বিদ্রোহের নাম ছিল ‘ফকির বিদ্রোহ’।
ফকির বিদ্রোহের নেতা ছিলেন দুঃসাসী এক লড়াকু সৈনিক মজনু শাহ।
সতেরো শো তেষট্টি সাল।
ফকির বিদ্রোহীরা আকস্মিকভাবে আক্রণ করলেন বাকেরগঞ্জ ইংরেজ কোম্পানীর কুঠি।
তাঁরা মীর কাসিমের বাহিনীতেও যোগ দিয়েছিলেন।
তাঁরা সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিলেন ইংরেজদের বিরুদ্ধে। ফকির বিদ্রোহীদের নেতা মজনু শাহরে মৃত্যুর পর মুসা শাহ, চেরাগ আলী, সোবহান শাহ, মাদার বকশ, করিম শাহ প্রমুখ ফকির নেতা এই বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন।
তাঁদের সংগ্রাম ছিলো মূলত ইংরেজদের বিরুদ্ধে।
এই বিদ্রোহের ফলে ইংরেজ কোম্পানীর সৈন্যদের সাথে তাঁদের অনেক যুদ্ধ হয়েছে।
অনেক সংঘর্ষ হয়েছে।
কিন্তু তারা এতোটুকুও পিছু হটেননি। বরং বাংলাদেশের উত্তর অঞ্চলের একটি বিশাল এলাকা জুড়ে তাঁরা ইংরেজদেরকে কাঁপিয়ে তুলেছিলেন।
তাঁদের সেই সংগ্রামের কথা আজো ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে।
আঠারো শো ছাব্বিশ সাল।
ফকির বিদ্রোহ যখন একটু ঝিমিয়ে পড়েছে তখনই গর্জে উঠলেন আর এক সাহসী সৈনিক- সৈয়দ আহমদ শঞীদ!
তিনি ইংরেজদের বিরুদ্ধে, অত্যাচারী শিখ রাজার বিরুদ্ধে এক মহা বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন।
তাঁর আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিলো মুসলমানদের আল কুরআন ও আল হাদীসের শিক্ষায় পূর্ণভাবে ফিরে আনা এবং খোলাফায়ে রাশেদীনের সময়ের মতো ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা।
মুসলমানদের স্বাধীনতা এবং ইসলামের আদর্শ ও ঐতিহ্য প্রতিষ্ঠায়ও এই আন্দোলনের বিশেষ ভূমিকা ছিলো।
এই লক্ষ্যকে সামনে রেখে সৈয়দ আহমদ শহীদ তাঁর আন্দোলনকে বেগবান করে তুলেচিলেন বাঁধভাঙ্গা স্রোতেরমতো।
আফগান সীমান্তের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে ঘাঁটি গেড়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে মুসলমানরা শুরু করলো মুক্তির সংগ্রাম।
আঠারো শো ছাব্বশ সালে ইংরেজ-মিত শিখদের সাথে তাদের প্রথম যুদ্ধ হলো।
ভয়ংকর এক যুদ্ধ!
সৈয়দ আহমদ শহীদ এই প্রত্যক্ষ সংগ্রাম শুরুর প্রস্তুতি গ্রহণ করেছিলেন প্রায় এক দশক আগে।
বাংলাদেশসহ গোটা ভারত সফর করে তিনি সকল মুসলমাকে জাগিয়ে তুলেছিলেন।
আছারো শো একত্রিশ সাল।
এই বিদ্রোহের নায়ক সৈয়দ আহমদ বেরেলভী বালাকোটে শাহাদাত বরণ করলেন।
বিশ্বাসঘাতকদের শিকার হয়ে তিনি এবংতাঁর শীর্ষস্থানীয় সাথীরা শাহাদাত বরণ করেছিলেন।
বালাকোটে যারা শাহাদাত বরণ করেন তাঁদের মধ্যে নয়জন বাংলাদেশীর নাম পাওয়া যায়।
আহতদের মধ্যে ছিলেন আরও চল্লিশ জন।
নারকেল বাড়িয়ার রণাঙ্গনে পরাজয় ও শাহাদাত বরণ করেন বাংলার আরেক সিংহ পুরুষ, দুঃসাহসী- সেনাপতি সাইয়েদ নিসার আলী তিতুমীর!
সেটিও ছিলো আঠারো শো একত্রিশ সাল।
মহা বিস্ময়েরই ব্যাপার বটে!
এই সংগঠন আঠারো শো ছাব্বিশ সাল থেকে আঠারো শো আটষট্টি সাল- এই দীর্ঘকাল যাবত ইংরেজদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে চলেছিলো।
এই সকল আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় যুক্ত হলেন আর একজন সংগ্রামী পুরুষ।
আর একজন সাহসী বীর।
তাঁর নাম- হাজী শরীয়তুল্লাহ!