জন্ম ও শৈশব
সতেরো শো একাশি সাল।
দিনিটির কথা কেউ আর বলতে পারে না।
এই বছরের কোনো একদিনে হাজী শরীয়তুল্লাহ জন্মলাভ করেন। গ্রামের নাম শামাইল।
গ্রাটি ছিলো বর্তমান মাদারীপুর জিলার বাহাদুরপুরের অন্তর্গত।
তাঁর জন্ম হয়েছিলো একটি প্রখ্যাত জমিদার পরিবারে।
শরীয়তুল্লাহর আব্বার নাম আবদুল জলিল তালুকদার।
তিনি ছিলেন একজন বিখ্যাত ব্যক্তি।
তা৭র নাম ডাক ছিলো চারদিকে।
তিনি ছিলেন যেমনি ভদ্র, তেমনি দয়ালূ। এ কারণে সবাই তাঁকে ভালোবাসতো প্রাণ দিয়ে।
শরীয়তুল্লাহর পিতা আবদুল জলিল ছিলেন একজন প্রজাবৎসল তালূকদার। অন্যান্য তালুকদারের মতো তিনি সাধারণ প্রজাদের ওপর জুলুম-নির্যাতন চালাতেন না।
শোষণের কুড়াল মারতেন না প্রজাদের মাথায়।
তিনি ছিলেন তাদের প্রতি অত্যন্ত দয়ালূ।
সাধারণ প্রজাদের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার সাথে আবদুল জলিল নিজেকেও যুক্ত করতেন। শরীক হতেন তাদের ব্যাথা-বেদানার সাথে
সমবেদনা জানাতেন। সাহায্য করতেন সাধ্য মতো। এজন্যে তাঁর নামটি ছড়িয়ে পড়েছিলো অনেক দূর পর্যন্ত।
সবাই তাঁকে শ্রদ্ধা করতো। সম্মান দেখাতো।
শরীয়তুল্লাহ এই বিখ্যাত ও সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।
আবদুল জলিল তালুকদার চেয়েছিলেন- তাঁর ছেলেও হবে মানুষের মতো মানুষ।
সে হবে শিক্ষিত এবং আদর্শবান।
সাধারণ মানুষের সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করবে সে।
শরীয়তুল্লাহ শৈশবে বর্ণজ্ঞান লাভ করে তাঁর পরিবারের কাছে। তারপর গ্রারেম মক্তবে।
পিতার ইচ্ছা ছিলো শরীয়তুল্লাহর শিক্ষা জীবনের সফলতা নিজের চোখে দেখে যাবেন।
কিন্তু তিনি সে সময় আর পাননি।
শরীয়তুল্লাহ এবং এক কন্যা সন্তানকে শিশু অব্থায় রেখে ইন্তেকাল করলেন আবদুল জলিল তালুকদার।
আবদুল জলিল তালুকদারের ছিলেন আরও দুই ভাই।
এক ভাইয়ের নাম মুহাম্মদ আজিম। তিনি শামাইল গ্রামেই থাকতেন।
অপর ভাই মুহাম্মদ আশেক। থাকতেন মুর্শিদাবাদ। তিনি মুর্শিদাবাদের নবাবের দরবারে মুফতি ছিলেন।
তিনি ছিলেন মস্ত বড়ো এক আলেম।
পিতার ইন্তিকালের পর বালক শরীয়তুল্লাহর লালন-পালন এবং শিক্ষার দায়িত্বগ্রহণ করলেন আপন চাচা মুহাম্মদ আজিম। তিনি ছিলেন নিঃসন্তান। মুহাম্মদ আজি আপন সন্তানের মতোই আদর যত্নে লালন করছিলেন শরীয়তুল্লাহকে।
অসীম স্নেহ আর ভালোবাসায় তিনি ভরে দিতেন শরীয়তুল্লাহর শিশুমনকে। কিন্তু শরীয়তুল্লাহর শিক্ষার ব্যাপারটি ছিলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ
তখন গ্রামে ছিলো না ভালো কোনো স্কুল, মাদরাসা। ছিলো না তেমন কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। সুতরাং শিক্ষা লাভের জন্যে অবশ্যই দূরে কোথাও যেতে হবে।
কিন্তু কোথায় যাওয়া যায়?
একান্তে ভাবেন কিশোর শরীয়তুল্লাহ!
কলকাতায় গমন
শিক্ষার প্রতি ছিলো বলক শরীয়তুল্লাহর অদম্য আগ্রহ।
এই আগ্রহের কারণে অল্প বয়সেই শরীয়তুল্লাহ পাড়ি জমালেন শামাইল থেকে সুদূর কলকাতা।
তাঁর এই সিদ্ধান্তে চাচা আজিমও খুব খুশি হলেন। কারণ তিনিও চান মানুষের মতো মানুষ হোক আদরের শরীয়তুল্লাহ।
সালীট ছিলো সতেরো শো তিরানব্বই।
কলকাতায় গিয়ে শরীয়তুল্লাহ ওঠেন মাওলানা বশারত আলীর কাছে।
মাওলানা বশারত আলী ছিলেন এক মস্ত বড়ো আলেম। ছিলেন পাক্কা দীনদার।
বালক শরীয়তুল্লাহর শিক্ষার প্রতি অসম্ভব আগ্রহ দেখে তিনি খুব খুশি হলেন। অত্যন্ত আন্তরিকতা ও স্নেহের সাথে তিনি শরীয়তুল্লাহর সামনে তুলে ধরলেন শিক্ষা ও জ্ঞানের প্রদীপ।
শরীয়তুল্লাহও ছিলেন অত্যন্ত শান্ত ও মেধাবী। ভদ্রতা ছিলো তাঁর সকল সময়ের ভূষণ।
একাগ্রতার সাথে তিনি মাওলানা বশারত আলীর কাছে পড়তে থাকলেন। শরীয়তুল্লাহর লেখাপড়ার প্রতি মনোযোগ দেখে এবং তাঁর চরিত্র-মাধুর্যে মোহিত হয়ে মাওলানা বশারত আলী তাঁর এই প্রিয় ছাত্রের লেখা-পড়ার যাবতীয় দায়িত্বভার তুলে নিলেন নিজের কাঁধে।
শরীয়তুল্লাহকে তিনি পরবর্তীতে ভর্তি করে দিলেন হুদলী মাদরাসায়। মাদরাসাটি ছিলো হুগলিরি ফুরফুরায়।
মাদরাসায় ভর্তি হবার পর শরীয়তুল্লাহ লেখা-পড়ায় আরও বেশী মনোযোগী হলেন।
দুর্ঘটনার কবলে
কলকাতায় মাওলানা বশরাত আলীর তত্ত্বাবধানে লেখা-পড়া করার সময় শরীয়তুল্লাহ একবার মুর্শিদাবাদ গেলেন।
সেখানে থাকেন চাচা মুফতী মুহাম্মদ আশিক।
চাচার সাথে সাক্ষাৎ করলেন শরীয়তুল্লাহ। এরপর থেকে তিনি প্রায়ই যেতেন চাচার কাছে। হৃদয়ের টানে।
চাচা ছিলেন অত্যন্ত কর্মব্যস্ত মানুষ।
এজন্য বহুদিন হলো আপন মাতৃভূমিতে আসার সুযোগ পাননি তিনি।
এর মধ্যে শরীয়তুল্লাহর ওপর দিয়েও গড়িয়ে গেছে অনেকটা সময়। তিনিও অনেকদিন যাবত বাড়ি ছাড়া।
যোগাযোগ নেই গ্রামের সাথে। গ্রামের মানুষ আর অবারিত সবুজের সাথে।
গ্রামে ফেরার জন্যে তাই মনটা তাঁর কেবলই আনচার করে ওঠে।
ব্যাকুল হয়ে ওঠে তাঁর কিশোর হৃদয়।
চাচা মুফতী আশক একদিন শরীয়তুল্লাহকে বললেন, চলো আমরা বাড়ি থেকে একবার বেড়িয়ে আসি।
কথাটি শুনার সাথে সাথে শরীয়তুল্লাহর চোখে আপন বাস্তু ভিচার ছবিটা ছবির মতো ভেসে উঠলো।
তাঁর হৃদয়টা দুলে উঠলো মুহূর্তেই।
তিনি রাজি হয়ে গেলেন চাচার কথায়।
মুর্শিদাবাদ থেকে রওয়ান হলেন তাঁরা। নৌকাযোগে আসছেন নিজ গ্রাম- ফরিদপুরেরর শামাইলে।
সাথে আছে চাচা ও চাচী। নৌকা চলছে গঙ্গার বুক দিয়ে। পানি কেটে কেটে।
শাঁ শাঁ গতিতে। প্রমত্তা গঙ্গ!
ভয়ঙ্কর তার স্রোত!
তার ওপর আকাশে মেঘ এবং ঝড়ের পূর্বাভাস। ওলোট পালোট বাতাস। ঝড়ের ইঙ্গিত! তবুও নৌকা চলছে প্রবল গতিতে।
হঠাৎ শুরু হয়ে গেলো গঙ্গার বুকে ঝড়েড় দপাদপি! সে কি ঝড়!
ঝড়ের কবলে পড়ে মুহূর্তেতই যাত্রী বোঝাই নৌকাটি তলিয়ে গেলো গঙ্গার বুকে! আর তারই সাথে গঙ্গার প্রচণ।ড স্রোতের তোড়ে চিরতরে হারিয়ে গেলেন চাচীজান। হারিয়ে গেলেও চাচাও।
হারিয়ে গেলেন একজন বিখ্যা আলেমে দীন- মুফতী আশিক।
গঙ্গা তখনো ফুঁসছে ক্রমাগত।
গঙ্গার সেই ভয়ালো ঝড় আর ঢেউকে উপেক্ষা করে আল্লাহর অসীম রহমতে সাঁতরিয়ে কূলে উঠে দাঁড়ালেন শরীয়তুল্লাহ!
অলৌকিক ব্যাপার বটে! প্রাণে বেঁচে গেলেণ তিনি।
মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে গিয়ে অশেষ শুকরিয়া জানালেন মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দরবারে।
কূরে উঠে তিনি গঙ্গার দিকে তাকিয়ে হতাশ হলেন। কেঁপে উঠলো তাঁর বুক!
শূন্যতায় ভরে গেলো তাঁর কোমল হৃদয়।
কূরে দাঁড়িয়ে তিনি গঙ্গার বুকে কোথাও খুঁজে পেলেন না চাচা, চাচী এবং সেই নৌকাটিকে!
ফরিদপুর আর আসা হলেঅ না শরীয়তুল্লাহর
দেখা হলো না আর প্রাণ-প্রিয় মাতৃভূমি শামাইল।
এক বুক বেদনা আর স্বজন হারানো কষ্ট নিয়ে তিনি আবারো ফিরে গেলেন কলকাতায়।
ফিরে গেলেন প্রিয় শিক্ষক মাওলানা বশারত আলীর কাছে।
কলকাতায় ফেরার পর শরীয়তুল্লাহর মুখ থেকে সকল কথা শুনলেন মাওলানা বশারত আলী।
শুনলেন তাঁর স্বজন হারানোর বেদনার কথা। নৌকাডুবির কথা।
তিনি শুনলেণ শরীয়তুল্লাহর আল্লাহর রহমতে অলৌকিকভাবে বেঁচে যাবার কথা।
সকল কথা শুনার পর মাওলানা বশারত আলী অবাক হলেন।
তিনি শরীয়তুল্লাহকে আরো বেশি আদর-স্নেহে কাছে টেনে নিলেন।
সতেরো শো নিরানব্বই সাল।
মাওলানা বশারত আলী মক্কায় যাবার সিদ্ধান্ত নিলেন।
মক্কায় যাবেন তিনি নবীজীর (সা) পবিত্র কবর মুবারক যিয়ারত করার জন্যে। শরীয়তুল্লাহকে সাথে নেবার ইচ্ছাও প্রকাশ করলেন তিনি।
কি সৌভাগ্য তাঁর!
এক অলৌকিকভাবে তাঁর মক্কা যাবার স্বপ্ন বাস্তবায়ন হতে যাচ্ছে!
তিনি ভাবতেই পারেননি এতো সহজে মক্কায় যেতে পারবেন।
আল্লহর কুদরত ও রহমতের শুকরিয়া জানিয়ে তিনি রাজি হয়ে গেলেন। রাজি হয়ে গেলেন মাওলানা বশারত আলীর প্রস্তাবে।
কিছু দিনের মধ্যেই শরীয়তুল্লাহ তাঁর প্রিয় শিক্ষক মাওলানা বশারত আলীর সাথে মক্কার পথে যাত্রা শুরু করলেন।