হান্টারের পরিচয়
হান্টারের পুরো নাম ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টার।চাকরি কতেন বৃটিশের অধীনে।
তিনি ছিলেন বৃটিশের একজন পদস্থ রাজকর্মচারী।অন্যান্য ইংরেজদের মতো হান্টারও ছিলেন মুসলমানদের বিদ্রোহের ঘোর বিরোধী। মুসলিম বিদ্ধেষী তো বটেই। হান্টারের যোগ্যতা ছিলো লেখায়।
তিনি ভালো লিখতে পারতেন। তার এই যোগ্যতার কারণে ইংরেজ তাকে দায়িত্ব দিয়েছিলো মুসলমানদের বিদ্রোহ সম্পর্কে গোপন তথ্য সংগ্রহের। তার বিশেষ দায়িত্ব ছিলো সৈয়দ আহম শহীদের আন্দোলনের ওপর রিপোর্ট তৈরি করে বৃটিশ সরকারের কাছে পেশ করা।
ইংরেজের দেয়া এই দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে হান্টার তৎকালীন মুসলমানদের আন্দোলন ও বিদ্রোহ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। ‘দি ইন্ডিয়ান মুসলমানস্’ নামে একটি গ্রন্থও তিনি লেখেন।
এই গ্রন্থে হান্টার বিভিন্ন জায়গায় মুসলমানদের আন্দোলন ও বিদ্রোহ সম্পর্কে তীর্যক-তীক্ষ্ম ভাষায় অনেক কিছুর উল্লেখ করেছেন।
হান্টার মুসলমানদের কোনো বন্ধু ছিলেন না।
তিনি তার দায়িত্ব পালনের জন্যে মুসলমান ও তাদের আন্দোলন সম্পর্কে যা আলোচনা করেছেন তা মুসলমানদের কল্যাণের জন্য করেননি।
করেছেন ইংরেজদের হুকুম পালন করার জন্যে।
তাদের তুষ্টির জন্যে।
তবুও তার এই পর্যালোচনা রিপোর্ট এবং তার মতামতের মধ্যে মুসলমানদের শৌর্য, সাহস ও আন্দোলন তৎপরতা সম্পর্কে হান্টার যে তথ্য পরিবেশন করেছেন তা আমাদের জন্যে আজো রীতিমত বিস্ময়ের ব্যাপার! তার অনেক সত্য উচ্চারণের মাধ্যমে আমরা সেই সময়কার একটি চালচিত্র পেয়ে যাই।
এখানে হান্টারের কয়েকটি অভিমত উপস্থাপানের মধ্য দিয়ে তখনকার আন্দোলন-বিদ্রোহ সম্পর্কে আমরা কিছুটা ধারণা লাভ করবো।
হান্টারেরর অভিমত
‘দি ইন্ডিয়অন মুসলমানস্’ গ্রন্থে মিঃ হান্টার ইংরেজদের তাবেদার হয়েও স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন যে,
“গাঙ্গের ব-দ্বীপ এলাকার ধর্মান্ধ মুসলমানরা নিজেদের ওয়াহাবী না বলে ফরায়েজী অর্থাৎ ইসলাম ধর্মের অনাবশ্যকীয় আচারানুষ্ঠানাদি বর্জন হিসেবে পরিচিত করে।… কলকাতার পূর্ব দিকের জেলাসমূহে এদের সংখ্যা বিপুলভাবে বৃদ্ধি পায়। ১৮৪৩ সালে এই সম্প্রদায়টি এতদূর বিপজ্জনক হয়ে ওঠে যে, তাদের সম্পর্কে তদন্তের জন্যে সরকারকে বিশেষ তথ্যানুসন্ধান কমিশন নিয়োগ করতে হয়। বাংলার পুলিশ প্রধান কর্তৃক প্রদত্ব রিপোর্টে বলা হয় যে, মাত্র একজন প্রচারক [হাজী শরীয়তুল্লাহ] প্রায় আশি হাজার অনুগামীর এক বিরাট দল গড়ে তুলেছে এবং তারা প্রত্যেকের ব্যক্তিগত স্বার্থেকে গোটা সম্প্রদায়ের স্বার্থ বলে বিবেচনা করে থাকে।”..
‘দি ইন্ডিয়ান মুসলানস্’ গ্রন্থে হান্টার আরো বলেন:
“সারা ভারতে তাদের প্রতিনিধি পাঠিয়ে ইতিহাসের এক বৃহত্তম ধর্মীয় পুনরুত্থান সাধিত করল তারা। তাঁদের অসংখ্য ছোট ছোট মিশনারী দল ছিল। দক্ষ সংগঠনের মাধ্যমে তারা মুরীদগণের তাকিদে যেখানে প্রয়োজন সেখানেই আস্তানা স্থাপন করতে পারত।… প্রত্যেক জেলাতেই একজন করে প্রচারক নিযুক্ত হয়। ভ্রাম্যমান মিশনারীরা মাঝে মাঝে এই সকল জেলা সফর কালে সেখানকার স্থায়ী প্রচারকদের উদ্যমকে জাগ্রত রাখতে থাকে। এইসব প্রচারকদের অশুভ প্রভাব ব্যাপক আকার ধারণ করেছিল।.. এরা এমন ধর্মান্ধদের তহবিলে দান করেছিল… দলের পর দল সংগ্রহ করে ধর্মান্ধ শিবিরে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছিল। দেশের সর্বত্র মুসলমান জনসাধারণের মধ্যেতারা গভীর আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল… অজস্র রাজদ্রোহমূলক সাহিত্য, পাটনায় অবস্থিত কেন্দ্রীয় প্রচার কেন্দ্র এবং সারা বাংলার আনাচে কানাচে প্রচারকদের আনাগোনা ছাড়াও জনগণের মধ্যে রাজদ্রোহমূলক কাজে উৎসাহ সৃষ্টির জন্যে ওয়াহাবীরা [?] একটু চতুরথ সংগঠন গড়ে তুলেছে।… এইভঅবে পল্লী বাংলার বিভিন্ন স্থানে এক ধরনের বিদ্রোহী কলোনী গড়ে উঠেছে।… অর্থ সংগ্রহ ব্যবস্থাটা সহজ ও স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল। গ্রামগুলোকে বিভিন্ন আর্থিক এলাকায় বিভক্ত করে প্রত্যেক এলাকার জন্যে একজন করে প্রধান ট্যাক্স আদায়কারী নিয়োগ করা হয়। যে গ্রামের জনসংখ্যা খুব বেশী সেখানে একাধিক আদায়কারী নিয়োগ করা হয় এবং তার মধ্যে একজন মৌলবী থাকতেন যিনি সমাজে ইমামতি করতেন…. একজন জেনারেল ম্যানেজার রাখা হয় যিনি মুসলমানদের দুনিয়াবী কাজের তদারক করতেন। এছাড়াও একজন অফিসার থাকতেন, তার কাজ ছিল বিপদজনক চিঠি-পত্র বিলি বন্টন ও রাজদ্রোহমূলক খবরাখবর আদান প্রদান করা।..”
হান্টর তার লেখায় ‘ওহাবী’ বলে যে সংগঠনের কথা বলেছেন আসলে তা আদৌ সঠিক নয়।
এটা ছিলো সম্পূর্ণ মিথ্যাচার।
‘ওহাবী’ বলতে পৃথিবীতে কোনো সংগঠনের অস্তিত্ব ছিল না।’
‘ওয়াহাবী’ বা ‘ওহাবী’ পরিভাষাটি ইউরোপীয়দের কল্পনারাজ্যের সৃষ্টি এবং ইসলামী আন্দোলনের জন্যে একটি গালি মাত্র।
সাইয়েদ আহমদ বেরেলভীর ‘জিহাদী আন্দোলনকে’ উপহাস করার জন্যে তারা তাদেরকে ‘ওহাবী’ বলে আখ্যায়িত করেছেন।
এটা ছিলো তাদের ঘৃণ্য এক পরিভাষা।
যেটা এখনো কাম্য ছিলো না।
প্রকৃত অর্থে ‘ওহাবী’ কথাটি সম্পূর্ণ সত্যের খেলাফ এবং ইসলাম বিরোধী। তাদের শত ষড়যন্ত্র আর অপপ্রচরের মধ্যেও ইংরেজের রিুদ্ধে এ সময় বিরামহীন সংগ্রাম চলছিলো।
ইংরেজরা তাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করে চেয়েছিলো মুসলমানদের সংগ্রামকে প্রতিহত করতে।
কিন্তু তারা তা পারেনি।
পারেনি শত চেষ্টা করেও এই সংগ্রামকে দমাতে।
এ প্রসঙ্গে হান্টারের একটি উদ্ধৃতি এখানে উল্লেখযোগ্য। তিনি লেখেন:
“আমাদের সীমান্ত অঞ্চলে ১৮৩১ খৃস্টাব্দ থেকে শুরু করে ১৮৬৮ খৃস্টাব্দ তাদের বিরুদ্ধে আমাদের সর্বশেষ অভিযান পর্যন্ত ইতিহাস আলোচনা করলাম। ওহাবীরেদ [?] যুদ্ধাত্মক তৎপরতা ভারতের সর্বত্র যে বিস্তার লাভ করেছিল তার ইতিহাস আলোচনা করতে গেলে এই গ্রন্থের কলেবর বিরাট আকার ধারণ করবে… ধর্মান্ধদের দ্বারা সীমান্তে বিরামহীন অশান্তি বিরাজমান রাখা ছাড়াও তিনবার বৃহদাকার ঐক্যজোট সংঘটিত হয়েছে এবং প্রত্যেক বারই বৃটিশ ভারতকে একেকটি যুদ্ধের মাধ্যমে তার মুকাবিলা করতে হয়েছে।… কিন্তু এদের নির্মূল করার জন্যে আমাদে সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে।… নিজেদের অবস্থা শেষ পর্যন্ত যে ভেঙ্গে পড়েছে তার নিদর্শন তাদের নিজেদের অবস্থা থেকেই বুঝা যাচ্ছে। তাদের প্রধান নেতারা ইতিমধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছে এবং অবশিষ্টরাও বুঝতে পেরেছে যে সক্রিয় হলে তাদেরও একই পরিণামের সম্মুখীন হতে হবে। কিন্তু সীমান্তের সশস্ত্র বিরাট ধর্মীয় মহা সম্মিলন রূপ গ্রহণ করবে। আজ সকালেই [১৪ই জুন, ১৮৭১] আমি এই পরিচ্ছেদ রচনার কাজ শেষ করার সময় জানতে পারলাম যে, ব্লাক মাউন্টেনের উপর বিদ্রোহী শিবির থেকে আরেকটি আক্রমণ পরিচালিত হয়েছে।”
তখনকার আন্দোলন সম্পর্কে হান্টারের আর একটি বিবেচনা:
“বাংলার মুসলমানরা আবার বিচিত্র রূপ ধারণ করেছে, গ্রাম পড়িয়েছে, আমাদের প্রজাদের হত্যা করেছে এবং আমাদের সীমান্তের ওপরে মাসের পর মাস ধরে গড়ে ওঠা শত্রু-বসতির লোক নিয়মিতভাবে সংগ্রহ করা হয়েছে বাংলাদেশের অভন্তরে থেকে। বিভিন্ন সময়ে অনুষ্ঠিত রাজনৈতিক মোকাদ্দমার বিচার থেকে একথাই প্রমাণিত হয় যে, আমাদের প্রদেশসমূহের সর্বত্র বিস্তারিত হয়েছে এক ষড়যন্ত্রের জাল। পাঞ্জাবের উত্তরে অবস্থিত জনহীন পর্বতরাজির সঙ্গে উষ্ণ মণ্ডলীয় গঙ্গা অববাহিকার জলাভূমি অঞ্চলের [বাংলার] যোগসূ্ত্র স্থাপিত হয়েছে রাজদ্রোহীদের নিরবিচ্ছিন্ন সমাবেশের মাধ্যমে। সুসংগঠিত প্রচেষ্টায় তারা ব-দ্বীপ অঞ্চল [বাংলা] থেকেঅর্থ ও লোক সংগ্রহ করে এবং দুই হাজার মাইল দূরে অবস্থিত বিদ্রোহী শিবিরে তা চালান করে দেয়।… বাংলার এমন কোন জনপদ ছিল না যেখানকার মুসলমানদের মধ্যে সৈয়দ সাহেবের সংস্কারের বাণী ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেনি। প্রতিটি ধার্মিক পরিবারের যুবকরা সীমান্তে গিয়ে জিহাদ করার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করত। বৃটিশ সরকারের গোয়েন্দার চোখ ফাঁকি দিয়ে একদিন তারা হঠাৎ করে সীমান্তের মুজাহিদ কাফেলায় যোগ দেবার উদ্দেশ্যে বের হয়ে পড়ত। জমির খাজনা পরিশোধ করতে অসমর্থ কৃষকরাও জিহাদের জন্য নিয়মিত অর্থ প্রদান করতে কুণ্ঠিত হতো না।”
হান্টারের লেখায় এই ভাবেই বিষেদগারের পাশাপাশি অনেক সত্যও বেরিয়ে আসে।
কয়েকটি বিবেচনা
ফরায়েজী আন্দোলনকে বিশ্লেষণ করে প্রাজ্ঞজনেরা কয়েকটি বিবেচনায় উপনীত হয়েছেন। বিবেচনায় উপনীত হয়েছেন। বিবেচনাগুলো:
১. মহান মর্দে মুজাহিদ হাজী শরীয়তুল্লাহর গড়ে তোলা এই আন্দোলন ছিলো পূর্ব ভারতের প্রথম একমাত্র ইসলামী আন্দোলন।
যার লক্ষ্য ছিলো বিদেশীদের হাত থেকে মুসলমানদের স্বাধীন ও মুক্ত করা এবং সংগঠিত করা।
২. হাজী শরীয়তুল্লাহর এই আন্দোলন কোনো সাময়িক আবেগতাড়িত ব্যাপার ছিলো না, বরং এটি ছিলো একটি প্রাণবন্ত আন্দোলন।
আর এই কারণেই এতো দীর্ঘ সময় ধরে আমরা এর প্রাণস্পন্দন দেখতে পাই।
৩. প্রথম দিকে এই আন্দোলন ছিলো ইসলামী সংস্কারমূলক। কারণ তখনকার কর্মসূচী ছলো আকীদা বিশ্বাসের সংশোধন এবং বিদয়াতমূলক আচার অনুষ্ঠান উচ্ছেদ।
কিন্তু পরবর্তীকালে ধীরে ধীরে সামাজিক ও রাজনৈতিক দিকগুলো ও এর সাথে যুক্ত হয়ে যায়।
এমনকি এক পর্যায়ে সময়ের প্রয়োজনে লাঠিয়াল বাহিনীরূপে সামরিক শক্তিও গড়ে তোলা হয়।
৪. ফরায়েজী আন্দোলনের আকীদা বিশ্বাসের কথা বলতে গেলে বলতে হয়, এই বিপ্লবের প্রতি ঐতিহাসিকরা যথাযথ গুরুত্ব প্রদান করেনন। বরং বিকৃতভাবে তারা সেটা উপস্থিাপিত হয়েছে।
কারণ তাদের লেখায় আকীদা বিশ্বাসের তুলনায় এই আন্দোলনের সামাজিক কাজকর্ম বেশি মাত্রায় ফুটে উঠেছে। অথচ আকীদা বিশ্বাসের সংশোধন এবং ধ্যান ধারণা পরিশুদ্ধির ক্ষেত্রেও এই আন্দোলন ব্যাপক তথা প্রধান ভূমিকা পালন করেছে।
৫. এই আন্দোলন ছিলো ইসলামী আদর্শভিত্তিক স্বাধীনতা আন্দোলন।
এতে যেমন ঈমান আকীদার পরিশুদ্ধির প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছিলো তেমনি সাধারণ মানুষের অধিকার আদায়েরও বলিষ্ঠ প্রতিশ্রুতি এতে ছিলো। এর ছায়াতলে সংঘবদ্ধ হতে অনুপ্রেরণা লাভ করেছিলো অসংখ্য কৃষক। তাই এ আন্দোলনকে কৃষক আন্দোলনও বলা যায়।
প্রতিপক্ষের শ্যৈন দৃষ্টি
হিন্দুরা কখনই মুসলমানদেরকে সুনজরে দেখেনি।
তারা মুসলমানদের ইংরেজ-বিরোধী আন্দোলনকেও সহ্য করতে পারতো না। তারা ইংরেজদেরকে তুষ্ট করার জন্যে সর্বদা তৎপর থাকতো।
আর মুসলমানদের বিরোধিতা করাই ছিলো তাদের মজ্জাগত স্বভাব।
আঠারো শো সাতান্ন সালে যখন স্বাধীনতা সংগ্রামী ইংরেজের কামানের গোলায় জীবন দিচ্ছিলো, তখন হিন্দু পত্রিকায় লেখা হয়েছিলো:
“আমরা পরমেশ্বরের সমীপে সর্বদা প্রার্থনা করি, পুরুষানুক্রমে যেন ইংরেজাধিকার থাকিতে পারি। ভারত ভূমি কত পুণ্য করিয়াছিলেন এই কারণে ইংরেজ স্বামী পাইয়াছেন, মৃত্যুকাল পর্যন্ত যেন ইংরেজ ভূপালদিগের মুখের পান হইয়া পরম সুখে কাল যাপন করেন।” [সংবাদ ভাস্কর: ২০শে জুন, ১৮৫৭]
এই ছিলো হিন্দুদের মনোভাব!
স্বাধীনতা সংগ্রামী মুসলমানদেরকে হিন্দু পত্রিকাগুলো কোন দৃষ্টিতে দেখতো এবং বন্দী স্বাধীনতা সংগ্রামীদের প্রতি কি ধরনের নিষ্ঠুর মনোভাব প্রকাশ করতো তা নিচের আর একটি উদ্ধৃতি থেকেই সহজে অনুমান করা যায়।
আঠারো শো সাতান্ন সালের আঠারো ও বিশে জুনের ‘সংবাদ ভাস্কর’-এ আবারও লেখা হয়:
“আগ্রা, দিল্লী, কানপুর, অযোধ্যা, লাহোর প্রদেশীয় ভাস্কর পাঠক মহাশয়েরা এই বিষয়ে মনোযোগ করিবেন এবং পাঠ করিয়া বিদ্রোহীদের আড্ডায় ইহা রাষ্ট্র করিবেন এবং পাঠ করিয়া বিদ্রোহীদের আড্ডায় আড্ডায় ইহা রাষ্ট্র করিয়া দিবেন, সিপাহীরা জানুক বৃটিশ গভর্নমেন্ট সিপাহী ধরা আরম্ভ করিয়াছেন, আর বিদ্রোহী সকল শোন্ শোন্, তোদের সর্বনাশ উপস্থিত হইল, যদি কল্যাণ চাহিস তবে এখনও বৃটিশ পদান হইয়া প্রার্থনা কর-ক্ষমা করুন।.. গত বুধবার বেলা দুই প্রহর, ঘন্টাকালে সৈন্য পরিপূর্ণ এক জাহাজ উত্তর দিক হইতে আসিয়িা কলিকাতা দুর্গের দক্ষিণাংশে লাগিল। সে সময় উক্ত জাহাজ অতি সুদৃশ্য দৃষ্ট হইল, গোরা সৈন্যরা পাঁচশ’ সিপাহীকে হাতে হাতকড়ী পায়ে পবেড়ী দিয়া লইয়া আসিয়াছে, গভর্ণমেন্ট সিপাহীদিগের প্রতি যে প্রকার ক্রোধ করিয়া রহিয়াছেন, তাহাতে বলিদান দিনে ইহাই জ্ঞানগ্রাহ্য হইতেছে। কালিঘাটে বহুকাল নরবলি হয় নাই। আমাদিগের রাজেশ্বর যদি হিন্দু হিইতেন, তবে এই সকল নরবলি দ্বারা জগদম্বার তৃপ্তি করিতেন।”
অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় বটে!
তবুও এটাই সত্য যে, হিন্দুরা কখনই ইসলামী আন্দোলন ও স্বাধীনতা- সংগ্রামকে সুনজরে দেখেনি।
বরং এর তীব্র বিরোধিকা করেছে প্রতিটি পদক্ষেপে।
আশার কথা, তবুও থেমে থাকেনি হাজী শরীয়তুল্লাহসহ মর্দে মুজাহিদদের সংগ্রাম। দুর্বার আন্দোলনের ক্রমধারা!
একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য
ভারতীয় রাজনীতি পর্যালোচনা করতে গিয়ে স্যার উইলিয়াম হান্টার আঠারো শো একাত্তর সালে লেখেন,
“এতে কোনো সন্দেহ নেই যে ভারত গভর্নমেন্ট যদি পূর্ব থেকেই ষড়যন্ত্র আইনের ৩ নং ধারা অনুযায়ী ভারতের আলেমদের কঠোর হস্তে শাসন করতো, তাহলে ভারত গভর্নমেন্টকে মুজাহিদ আলেমদের আক্রমণের ফলে এত দুঃখ ভোগ করতে হতো না। কতিপয় আলেমকে গ্রেফতার হতো না এবং লক্ষ লক্ষ পাউন্ড বেঁচে যেত। এমন কি উক্ত লড়াই-এর পরও যদি কঠোর হস্তে আলেমদেরকে দমন করা হতো তবে অন্ততপক্ষে ১৮৬৮ খৃস্টাব্দে কালাপাহাড় অভিযান হতে রক্ষা পাওয়ার আশা ছিল।”
উইলিয়াম হান্টর এখানে আলেমদের কঠোর হস্তে দমন না করায় দুঃখ ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছন!
কিন্তু প্রকৃত সত্য হলো, ইংরেজরা তাদের সাধ্যানুসারে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে এমন কোনো কঠোর পদক্ষেপ নিতে বাদ রাখেনি।
ফকির বিদ্রোহকে তারা কঠোর হাতেই দমন করেছিলো!
তিতুমীর ও হাজী শরীয়তুল্লাহর সংগ্রামকেও দমন করার জন্যে ইংরেজরা সকল প্রকার জুলুম নির্যাতন চালিয়েছিলো!
সংগ্রামরত মুসলমানদের প্রতি ইংরেজরা ছিলো বরাবরই কঠোর ও নির্মম!
সমগ্র ভারত বর্ষ বিস্তৃত সাইয়েদ আহমদ বেরেলভীর স্বাধীনতা সংগ্রামকেও শত রকম নির্যাতনের মাধ্যমে তারা প্রতিহত করার চেষ্টা করেছিলো।
ইংরেজদের শত বাধা এবং হিন্দুদের হাজার চেষ্টাতেও এ উপমহাদেশের সংগ্রামরত বীর মুজাহিদদের আন্দোলন কখনো থেমে থাকেনি।তাদের রক্ত-চক্ষুকে উপেক্ষা করে সর্বদা এগিয়ে গেছেন সকল সাহসী সৈনিক! এই সাহসী সৈনিকদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন হাজী হাজী শরীয়তুল্লাহ।
আমৃত্যু তিনি লড়ে গেছেন একজন প্রকৃত সৈনিকের মতো!
লড়ে গেছেন সত্যের পক্ষে এবং মিথ্যার বিরুদ্ধে।
ইতিহাসের পুনর্পাঠ
২৮শে জানুয়ারী ১৯৯৯ সাল।
এই দিনে বাংলাদেশের একটি দৈনিক পত্রিকা প্রকাশ করলো হাজী শরীয়তুল্লাহর ওপর একটি সংখ্যা।
যেটা ছিলো ব্যতিক্রম এবং অভিনন্দনযোগ্য।
মূল শিরোনামছিলো- “বাংলাদেশের জাতীয় জাগরণের অন্যতম পথিকৃত ঐতিহাসিক ফরায়েজী আন্দোলনের স্থপতি মহান স্বাধীনতা সংগ্রামী হাজী শরীয়তুল্লাহর ১৫৯তম মৃত্যু বার্ষিকী বিশেষ সংখ্যা।”
এই বিশেষ সংখ্যায় দু’টি গুরুত্বপূর্ণ লেখা প্রকাশিত হয়।
প্রথমটির লেখক অধ্যাপক আবদুল গফুর। শিরোনাম- “হাজী শরীয়তুল্লাহ এবং বৃটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রাম।”
দ্বিতীয়টি লেখক মুন্শী আবদুল মান্নান। তাঁর শিরোনাম ছিল- “ফরায়েজী আন্দোলন : তার পটভূমি ও লক্ষ্য।”
খুবই প্রসঙ্গিক হওয়ায় গ্রন্থের দ্বিতীয় সংস্করণে প্রবন্ধ দু’টির অংশবিশেষ এখানে সংযুক্ত করা হলো।
অধ্যাপক আবদুল গফুর তাঁর প্রবন্ধে উল্লেখ করেন:
“আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে হাজী শরীয়তুল্লাহ লাল হরফে লিখে রাখার মত একটি নাম।
হাজী শরীয়তুল্লাহর নামের সাথে জড়িয়ে আছে ফরায়েজী আন্দোলন নারেম একটি সংস্কার আন্দোলনের ইতিহাস।
ফরায়েজী আন্দোলণ পাঠকদের কাছে পরিচিত হয়ে আছে একটি ধর্মীয়, সামাজিক সংস্কার আন্দোলন হিসেবে।
তার প্রতিষ্ঠাতা স্বাধীনতা সংগ্রামে ভূমিকা রাখেন কি করে, এ প্রশ্ন উত্থাপিত হওয়া খুবই স্বাভাবিক।
এ প্রশ্নের জওয়াব পেতে হলে আমাদের ফরায়েজী আন্দোলনের প্রকৃতি ও পটভূমির দিকে সন্ধানী দৃষ্টিতে তাকাতে হবে।
হাজী শরীয়তুল্লাহকে আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ হিসেবে মেনে নিলেও তাঁর হাতে যে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম সূচনা হয়নি, এটাও এক ঐতিহাসিক সত্য।
অবিশ্বাস্য হলেও সত্য এই যে, ১৭৫৭ সালের পলাশীতে আমাদের স্বাধীনতা হারাবার মাত্র আট বছরের মাথায় ১৭৬৪ সালে আমাদের স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার সংগ্রামের সূচনা করেন এমন এক ব্যক্তি, যিনি পলাশী ষড়যন্ত্রেরও অন্যতম সহযোগী ছিলেন।
তিনি মীর জাফর আলী খাঁর জামাতা মীর কাসিম আলী।
ইংরেজরা মীর জাফরকে সরিয়ে মীর কাসিমকে নবাব করার অল্পদিন পরই তিনি ইংরেজ আধিপত্যের বিরুদ্ধে প্রথম সংঘাতে, পরে সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত হন।
কিন্তু ধনুক থেকে একবার তীর ছোঁড়া হয়ে গেলে তা যেমন ফিরে আসে না, মীর কাসিমের এ স্বাধীনতা সংগ্রামও তেমনি স্বাভবিক কারণেই ব্যর্থ হয় এবং স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার সংগ্রাম শুরুর দায়ে তাকে করুণ মৃত্যুবরণ করতে হয়।
মীর কাসিমের প্রায় সমসাময়িক কালেই মজু শাহের নেতৃত্বে উত্তরবঙ্গে আরেকটি স্বাধীনতা সংগ্রাম সূচিত হতে দেখা যায়।
ইতিহাসে এটি ফকির আন্দোলন রূপে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে।
১৭৬৩ সালে ফকির বাহিনী ঢাকায় ইস্ট কোম্পানীর কুঠির ওপর প্রথম আক্রমণ পরিচালনা করেন।
ইংরেজদের হাতে পর্যুদস্ত রণক্লান্ত মীর কাসিম ১৭৭৭ সালে অসহায়ভাবে ইন্তেকাল করেন।
কিন্তু ফকির মজনু শাহের সূচিত ফকির আন্দোলন ১৭৮৭ সাল তাঁর মৃত্যুর পরও বহুদিন পর্যন্ত জারি ছিল।
মজনু শাহের মৃত্যুর পর তাঁর ভাই মুসা শাহ ফকির আন্দোলনের নেতা হন। ১৭৯১ পর্যন্ত মুসা শাহ ও তাঁর অন্যতম সহযোগী চেরাগ আলী যে রংপুর ও ময়মনসিংহ এলকায় সক্রিয় ছিলেন তার প্রমাণ পাওয়া যায়।
তবে ফকিররা প্রধানত ইংরেজদের এবং তাদের আশীর্বাদপুষ্ট জমিদারদের ওপর আচমকা আক্রমণ চালিয়ে তাদের জানমালের ক্ষয়ক্ষতি সাধনের বাইরে স্বাধীনতা আন্দোলনে কোনো সুপরিকল্পিত সাংগঠনিক কর্মসূচী নিয়ে অগ্রসর হননি বলে এ আন্দোলনকেও আঠার শতকের শেষাশেষি স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করে।
স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে ফরায়েজী আন্দোলনের গুরুত্ব অনুধাবন করতে হলে আমাদের অবশ্য এর পটভূমি এবং এর প্রতিষ্ঠানের জীবন, কর্ম ও চিন্তাধারাকে সূক্ষ্মভাবে পর্যালোচনা করতে হবে।…
হাজী শরীয়তুল্লাহ মক্কায় যান ১৭৯৯সালে এবং সেখানে একটানা ২০ বছর কাটিয়ে ১৮১৮ সালে দেশে প্রত্যাবর্তন করেন।
এই দীর্ঘ সময়কাল তিনি কাটান ধর্মীয় অধ্যয়ন ও সাধনায়।
আরব দেশে তখন মুহাম্মদ ইবনে আবদুল ওহাব [১৮০৩-৯২] পরিচালত ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনের জোয়ার চলছে।
তিনি এ আন্দোলনের সংস্পর্শে এসে মুসলিম সমাজে শিরক, বিদয়াত প্রভৃতি অবাঞ্ছিত ইসলাম বিরোধী কুসংস্কারের অনুপ্রবেশ সম্পর্কে সচেতনতা লাভ করলেও ঐ আন্দোলনের সাথে যোগ দেননি।
কারণ মুহাম্মদ ইবনে আবদুল ওহাবের সূচিত আন্দোলনের মাযহাব বিরোধিতা তাঁর মনঃপুত হয়নি।
বাংলাদেশের অধিকাংশ মুসলমান মাযহাব হানাফী মাযহাব বাদ দিয়ে হাম্বলী মাযহাবে দাখিল হওয়ার কোন জরুরত তিনি অনুভব করেননি।
তিনি মক্কা শরীফেও একাধিক হানাফী আলেম ও বুজুর্গের কাছে ইসলাম সম্পর্কে উচ্চতর শিক্ষা লাভ করেন।
দুই বছর তিনি কায়রোর আল-আজহারে শিক্ষা লাভকরেন।
আরব দেশে দীর্ঘকাল অবস্থান এবং ধর্ম সম্পর্কে গভীর অধ্যয়ন ও গবেষণার পর তিনি যে স্বপ্ন স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন পরাধীন দেশবাসীর করুণ অবস্থা দেখে তাঁর সে স্বপ্ন অনেকাংশেই উবে যেতে চাইলো। হাজী শরীয়তুল্লাহ দেখলেন, তাঁর দেশবাসী যেন শুধু রাজনেতিক ভাবেই গোলামীর শিকরে বাঁধা পড়িন, ধর্মীয়, সামাজিক,সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক দিক দিয়েও স্বাধীন স্বতন্ত্র সত্তা হারিয়ে বসে আছে।
স্বাধীনতা হারানোর ছয় দশকের মধ্যেই তাদের এ করুণ অবস্থা দেখে তাঁর মন বেদনার্ত হয়ে উঠলো।
তিনি দেখলেন পৃথিবীতে যে ইসলাম এসেছিল মানুষকে জীবনের সর্বপর্যায়ে স্বাধীনভাবে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর শিক্ষা দিতে, সেই ইসলামের অনুসারী হয়েও তাঁর স্বদেশবাসী অধঃপতনের নিম্নতম পর্যায়ে নেমে গেছ।
তাদের চোখের সামনে ইসলামের সে বিপ্লবী রূপের সামান্যতম ছবিও আর উপস্থিত নেই।
ইসলামের কালেমা এসেছিল ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’… এক আল্লাহ ছাড়া মানুষের আর কোনো প্রভু নেই- এই বিপ্লবী আদর্শ শিক্ষা দিতে।
অথচ তার স্বজাতির মধ্যে চলছে অসংখ্য নকল খোদার দাপট আর প্রবুত্ব।
ইসলাম এসেছিল দুনিয়ায় তৌহিদের আদর্শ এক আল্লাহর বন্দেগী বা আনুগত্য শিক্ষা দিতে।
অথচ শরীয়তুল্লাহ দেখলেন, তাঁর সমাজের লোকেরা এক আল্লাহর ইবাদাতের স্থলে পীর পূজা, কবর পূজা, ইংরেজ পূজা, জমিদার পূজা, মহাজন পূজার মাধ্যমে অসংখ্য নকল খোদার পূজায় লিপ্ত রয়েছে।
মুসলিম শাসনামলেও যে সমাজের সর্বস্তরে ইসলামের বিধান পুরোমাত্রায় চালু ছিল, তা হয়ত নয়।
তবুও মানুষের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা তখন অনেকটাই সমুন্নত ছিল।
ফলে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সকলের নিজ নিজ ধর্মীয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক জীবনে পর্যাপ্ত স্বাধীনতা ও সমৃদ্ধি ছিল।
সোনার বাংলার সেদিনের সেই সমৃদ্ধি সম্পদের লোভেই সাত সমুদ্রের ওপর থেকে এসে বণিকবেশী ইংরেজরা ষড়যন্ত্র পাকিয়েছিল এদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে।
পলাশীর ষড়যন্ত্রে ইংরেজদের সাথে হাত মিলিয়ে জগৎশেঠ, রাজবল্লভ, রায়দুর্ভল ও উমিচাঁদেরা এদেশে মুসলিম শাসন উৎকাতে সাহায্য করার পারিতোষিক ঠিকই পেয়েছিল সুদে-আসলে।
পলাশী যুদ্ধের আট বছরের মধেই আশি হাজার মুসলমান সেনাবাহনিী থেকে বরখাস্ত হয়।
একে একে সমস্ত মুসলমান আমীর-ওমরাহকে সরকারী পদ থেকে অপসারিত করে সেখানে ইংরেজভুক্ত হিন্দুদের নিয়োগ করা হয়।
বেছে বেছে মুসলমান আয়মদার, জায়গীরদার উৎখাত করে সেখানে ইংরেজ খয়ের খাঁ হিন্দুদের বসানো হয়।
মুসলিম শাসনামলে জমিদাররা কখনও জমির মালিক ছিল না, জমির প্রকৃত মালিক ছিল কৃষকরা, জমিদাররা শুধু নির্দিষ্ট মেয়াদে রাজস্ব আদায় করত। ১৭৯৩ সালে সে ব্যবস্থা রহিত করে কৃষকদের মাথার ওপরে জমিদারদের জমির চিরস্থায়ী মালিক করে বসিয়ে দেয়া হল।
বলাবাহুল্য এই নতুন জমিদারদের প্রায় সবাই ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত।
এরা কৃষকদের ওপর করের পর কর বসিয়ে তাদের জীবনকে অতিষ্ঠ করে তুললো।
জমিদারের ছেলে মেয়েদের বিবাহ ও নানা পার্বণ উপলক্ষে প্রজাদের কাছ থেকে কর আদায় করা হতে লাগলো।
মুসলমান প্রজাদের ওপর অতিরিক্ত থাকত দাড়ির ট্যাক্স এবং আজান ও গরু কুরবানির ওপর নিষেধাজ্ঞার মত জঘন্য অত্যাচার।
একদিকে জমিদারদের জুলুম, নির্যাতন, অন্যদিকে নব্য ধনিক হিন্দু মহাজনদের কুমিদ ব্যবসা- দুইযে মিলে গ্রামের সাধারণ মানুষ, বিশেষকরে মুসলমানদের জীবন দুর্বিসহ হয়ে উঠেছিল।
মুসলিম শাসনামলের যে মসলিন বস্ত্র-শিল্প একদা সারা বিশ্বে খ্যাতি অর্জন করেছিল, তাকে ধ্বংস করে দেয়ার জন্য মসলিন শিল্পীদের হাতের আঙ্গুল কেটে ফেলার মত নৃশংসতা প্রদর্শনেও ইংরেজদের দ্বিধা হয়নি।
পলাশী বিপর্যয়ের পর মুর্শিদাবাদসহ বাংলার সম্পদ লুন্ঠনের মাধ্যমে ইংল্যান্ড নতুন করে সমৃদ্ধি নির্মাণের পালা শুরু হয়, যার ফলে সেদেশে শিল্প বিপ্লব সম্ভব হয়।
ইংল্যান্ডের বস্ত্র-শিল্পের জন্য জায়গা করে দিতে এদেশের উন্নত বস্ত্র-শিল্পই শুধু ধ্বংস করা হল না, কৃষকদের অর্থনৈতিক মেরুদন্ড অর্থকারী ফসলের স্থলে নীলচাষেকৃষকদের বাধ্য করা হতে লাগলো।
বিদেশী শাসক এবং তাদের এতদ্দেশীয় দালালদের মিলিত ষড়যন্ত্রের ফলে- যে দেশে মুসলিম শাসনের ৫০০ বছরে কোনো দুর্ভিক্ষহয়নি, পলাশী বিপর্যয়ের মাত্র দুই দশকের মধ্যেই ছিয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ দেখা দিল। এই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষে কুকুর-বিড়ালের মত প্রাণ হারালো এদেশের লাখ কোটি বনি আদম।
একদিকে এদেশের জনগণের করুণ অবস্থা, অন্যদিকে শিক্ষা-দীক্ষা, অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, ধর্ম-সংস্কৃতি সকল দিকে মুসলমানদের অসহায়তা পর্যায়ে।
মুসলমানদের ভুলিয়ে দেয়া হয়েছিল তাদের সুমহান সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের কথা।
তারা হিন্দুদের অনুকরণে বসন্ত রোগে শীতলা দেবীর পূজা, সর্প দংশনে মজমা পূজা প্রভৃতিতে লিপ্ত হতে লাগলো বিনা দ্বিধায়।
অন্যান্য পূজায় সরাসরি অংশ না নিলেও পূজা-পার্বনে চাঁদা দেয়া ও নৈবেদ্য ভক্ষণে অংশগ্রহণ নিজেদের দায়িত্বের অন্তর্গত করে নিয়েছিল।
তারা শিশুর নাম রাখতে লাগল হিন্দুদের অনুকরণে।
হজ্ব, যাকাত তো আগেই ভুলেছিল, নামায-রোযাও আস্তে আস্তে ভুলে যেতে লাগল।
একদিকে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে এসব বিচ্যুতি, অন্যদিকে ইসলামের সামাজিক সাম্য, ভ্রাতৃত্বের কথা ভুলে গিয়ে হিন্দুদের কুলীণ-অকুলীন, বড়জাত-ছোটজাতের ভেদ বৈষম্যের অনুকরণে বিভক্ত করে ফেললো।
শ্রেণীতে নিজেদের বিভক্ত করে ফেললো। রাসূল [সা] যেখানে বলেছেন, পরিশ্রমের মাধ্যমে জীবিকা অর্জনকারী আল্লাহর বন্ধু, সেখানে কৃষকদের ‘চাষা’, তাঁতীদের ‘জোলা’ বলে তাদের নীচু জাতের মানুষ ভাবতে শুরু করলো মুসলমানরা।
ইসলামেযে বলা হয়েছিল- বর্ণ, রক্ত, বংশ, গোত্র বা পেশার ভিত্তিতে নয়,একমাত্র ধর্মনিষ্ঠা তথা তাকওয়ার ভিত্তিতেইইসলামে মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব নির্ধারত হয়, সেই শিক্ষা এভাবেই মুসলমানরা ভুলে গিয়েছিল।
হাজী শরীয়তুল্লাহ শুধু ইসলাম সম্পর্কে অধ্যয়নই করেননি, স্বদেশে ও স্বজাতির এই দুঃজনক অবস্থার কারণে নিয়েও যথেষ্ট পড়াশুনা ও চিন্তাভাবনা করেন গভীরভাবে।
স্বদেশে ও স্বজাতির এই চরম দুরবস্থার প্রধান কারণ যে পরাধীনতার প্রভাব, এ সম্বন্ধে তাঁর মনে কোনই সন্দেহ ছিল না।
কিন্তু স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের জন্য মুসলমানদের যে প্রস্তুতি প্রয়োজন, সচেতনতা অপরিহার্য তার কোনো লক্ষণই মুসলিম সমাজে তিনি দেখতে পেলেন না।
এমনকি ইসলামের অনুসারী কোনো জনগোষ্ঠী যে কোনো পর্যায়েই আল্লাহ ছাড়া কারো গোলামীকে মেনে নিতে পারে না- সেই চেতনা, সেই অনুভূতি কোথায়?
শুধু স্বাধীনতার কথা বললেই তো আর হবে না!
মীর কাসেম ও মজনু শাহদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ব্যরথতার ইতিহাস হাজী শরীয়তুল্লাহর সামনেছিল।
তাই জাতির মন-মানসিকতার ক্ষেত্রে স্বাধীনতার ভিত রচনার লক্ষ্যে তাদের মধ্যে প্রথমে একটি স্বাধীনতাকামী জাতি হিসেবে কর্বত্য সচেতনতা সৃস্টির সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য নিয়ে তিনি কাজে নামলেন।
হাজী শরীয়তুল্লাহ জাতির স্বাধীনতাকে চূড়ান্ত লক্ষ্য হিসেবে রেখে যে সংস্কার আন্দোলনের সূত্রপাত করেন তার নাম- ‘ফরায়েজী আন্দোলন’।… সেদিনের মুসলিম সমাজকি আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে, কি সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক- সকল ক্ষেত্রেই তার আদর্শ হারিয়ে ফেলেছিল।
হারিয়ে ফেলেছিল একটি পূর্ণাঙ্গ আদর্শ ইসলামের আলোকে তার অবশ্য পালনীয় দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতনতা।
এই দায়িত্ব তথা অপরিহার্য কর্তব্য সচেতনতা জাতির মধ্যে সৃষ্টি করতেই তিনি তাঁর আন্দোলনের নাম ‘ফরায়েজী আন্দোলন।’
এই আন্দোলনের মাধ্যমে মুসলমানদের মধ্যে তিনি ধর্মীয়, আধ্যাত্মিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে কর্তব্য সচেতনতা সৃষ্টির আহ্বান জানান।
ইসলামে আধ্যাত্মিকতার যে উচ্চস্থান রয়েছে, তা মেনে নিয়েও শরীয়তুল্লাহ সমাজের এক শ্রেণীর ধর্ম ব্যবসায়ীর পীর-মুরিদী ব্যবসাকে নিরুৎসাহিত করার লক্ষ্যে ‘পীর’-‘মুরিদ’ শব্দ দু’টি পরিহার করে তার স্থানে আধ্যাত্মিক শিক্ষককে ‘ওস্তাদ’ ও অনুসারীকে ‘শাগরেদ’ বলে আখ্যায়িত করতে প্রয়াস পান এবং অতীতের ইহুদী নামাবাতের মত ধর্মগুরুদের প্রভু বলে পূজা করার প্রবণতার বিরুদ্ধে সকলকে সাবধান করে দেন।
ইসলামের সামাজিক ক্ষেত্রে সাম্য-ভ্রাতৃত্বের আদর্শের আলোকে হিন্দু কুলীন-অকুলীন প্রথার মত মুসলমান সমাজে আশরাফ-আতরাফ শ্রেণীভেদ সৃষ্টির বিরুদ্ধে তিনি সকলকে সতর্ক করে দেন।
যেহেতু ইসলামে শ্রমের মাধ্যমে জীবিকা অর্জনকারীর অতি উচ্চ মর্যাদা, তাই তাদেরকে চাষা, জোলা প্রভৃতি বলে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করার বিরুদ্ধে তিনি সকলকে হুঁশিয়ার করে দেন এবং সকল স্তরের মানুষের মধ্যে সাম্য, ভ্রাতৃত্ব ও শ্রমের মর্যাদা প্রভৃতি ইসলামী মূল্যবোধ প্রবর্তনের প্রয়াস পান।
মুসলমানদের মধ্যে সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মুসলমানদের মধ্যে যে আচার আচরণ ও অনৈসলামী কুসংস্কার অনুপ্রবেশ করেছিল, সেসব দূর করার জন্যে তিনি আকুল আহবান জানান।
ধর্মীয় আবশ্যিক কর্তব্যাদি যেমন- কালেমা, নামায, রোযা, হজ, যাকাত- এগুলো পালনের পাশাপাশি তিনি মুসলমানদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ সৃষ্টি এবং অন্যায়-অনাচার প্রতিরোধে তাদেরকে সংঘবদ্ধ করে তোলেন।
শিরক, বিদআত, অনৈসলামী কুসংস্কার ও বিজাতীয় অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে পরিচালিত আদর্শবাদী সংস্কার আন্দোলনে তিনি মুসলমানদের সংঘবদ্ধ করে তোলেন।
তাঁর আন্দোলন যদিও প্রত্যক্ষভাবে সীমাবদ্ধ ছিল ধর্মীয়, আধ্যাত্মিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে- তবুও পরোক্ষভাবে তিনি অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনেরও বুনিয়াদ গড়ে তোলেন।
যার ভিত্তিতে তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর সুযোগ্য পুত্র মুহাম্মদ মহসিন উদ্দিন ওরফে দুদু মিয়া গড়ে তোলেন বিপ্লবী রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক আন্দোলন। দুদু মিয়ার সেই আন্দোলনের ফলে একদিকে বৃটিশশাসকগোষ্ঠী, অপরদিকে তাদের আশীর্বাদপুষ্ট শোষক জমিদার গোষ্ঠীর ভিত্তিমূল পর্যন্ত প্রকম্পিত হয়ে ওঠে।
ফলে, ফরায়েজী আন্দোলনের সেই সিংহপুরুষকে বৃটিশরাজ প্রায় আমৃত্যু কারাগারে শৃংখলিত রাখতে বাধ্য হয়।
হাজী শরীয়তুল্লাহর চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিল যে বৃটিশ শাসনের অবসান ঘটিয়ে দেশকে স্বাধীন করে তোলা, তার বড় প্রমাণ- পরাধীন দেশকে ‘দারুল হরব’ [ইসলাম বিরোধী রাষ্ট্র] ঘোষা করে স্বাধীনতা না আসা পর্যন্ত ঈদ ও জুমআর নামায স্থগিত রাখার পক্ষেতাঁর ঘোষণা। দেশের মুসলিম শাসক বা তার প্রতিনিধির উপস্থিতি এখানে অপরিহার্য।
এই দৃষ্টিতে তিনিএ রায় ঘোষণা করেন।
তিনি নিজে ঈদ বা জুমআর ভক্ত ছিলেন না, তা নয়।
স্বাধীনতা সংগ্রামের ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব দিতেই তিনি এ ঘোষণা দিয়েছিলেন। জনগণের মধ্যে স্বাধীনতা সংগ্রামের মন-মানসিকতা সৃষ্টিতে তাঁর ঐতিহাসিক ভূমিকা কোনো মতেই অস্বীকার করা সম্ভব নয়।
হাজী শরীয়তুল্লাহর উত্তরসূরিগণ স্বাধীনতার লক্ষ্যে প্রবর্তিত তাঁর আন্দোলনকে নানা বাধা-বিপত্তির মধ্য দিয়েও যৌক্তিক পরিণতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যান।
শরীয়তুল্লাহর পুত্র মুহাম্মদ মহসিন উদ্দিন দুদু মিয়ার সময় ফরায়েজী আন্দোলন শক্তিশালী গণ-আন্দোলনে পরিণত হয়।
দুদু মিয়া তাঁর প্রভাবাধীন এলাকাকে কয়েকটি খণ্ডে বিভক্ত করেন এবং একেক অংশেরজন্য একেকজন খলীফা নিয়োগ করেন।
তার প্রভাবাধীন এলাকায় জনগণের মামলার শালিসের ব্যবস্থা তিনিই করতেন। কোনো মামলা-মোকদ্দমার জন্য ইংরেজদের আদালতে যাওয়ার তিনি নিষেধ করে দেনে।
এদেশে কৃষক আন্দোলনের ভিত্তি রচনা করে তিনি ঘোষণা দেন- জরি মালিক আল্লাহ। সুতরাং চাষীরা তাদের আয়ত্তাধীন জমির খাজনা সরকার বা জমিদারকে দেবে না।
এতে করে স্বাভাবিকভাবেই সরকার ও জমিদারদের সাথে তাঁর সংঘাত এবং সংঘাত থেকে সংঘর্ষ বেধে যায়।
এসব সংঘর্ষ-সংঘাতের শেষ পরিণতিতে সরকার তাঁকে দীর্ঘদিন কারারুদ্ধ করেরাখে।
দীর্ঘ কারা ভোগের ফলে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং কারাগার থেকে মুক্তি লাভের অল্পদিন পরেই তিনি ইন্তিকাল করেন।
দুদু মিয়ার মৃত্যুর পর তাঁর তিন পুত্র গাজী উদ্দিন হায়দার [১৮৬২-৬৪], আব্দুল গফুর ওরফে নয়া মিয়া [১৮৬৪-৮৩] এবং খান বাহাদুর মাইনউদ্দিন আহমদ [১৮৮৩-১৯০৬] যথাক্রমে ফরায়েজী আন্দোলনের নেতা মনোনীত হন।
শেষোক্ত মাইনউদ্দিন আহমদ বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন সমর্থন করেন। সাইফুদ্দিনের পর তাঁর পুত্র আবু খালেক রশিদ উদ্দিন ওরফে বাদশা মিয়া ফরায়েজীদের ওস্তাদ মনোনীত হন।
তিনি খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়ে কারাবরণ করেন।
জীবনের শেষপ্রান্তে তিনি পাকিস্তান আন্দোলনে যোগ দেন।
বাদশা মিয়া ১৯৫১ সালের ১৩ ডিসেম্বর ইন্তিকাল করেন।
১৯৪৭ সালে বৃটিশ শাসনের অবসান ও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর তিনি তাঁর অনুসারীদের ঈদের নামায আদায়ের অনুমতি দেন।”
মুন্শী আবদুল মান্নান তার প্রবন্ধে উল্লেখ করেন-
“পলাশী বিপর্যয়ের [১৭৫৭ সালের ২৩শে জুন] মধ্য দিয়ে কার্যত বাংলার মুসলিম শাসনের অবসান সূচিত হয়।
পরবর্তীতে নামকাওয়াস্ত কয়েকজন নবাবের আবির্ভাব ঘটলেও এরা সবাই ছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর হাতের ক্রীড়নক মাত্র।
এদের মধ্যে একমাত্র নবাব মীর কাসিমই উপলব্ধি করতে পারেন যে, বাংলার এত দিনের মুসলিম শাসন মারাত্মকভাবে বিপন্ন হয়ে পড়ছে।
তিনি পলাশী ট্রাজেডির আট বছরের মধ্যে অর্থাৎ ১৭৬৪ সালে স্বাধীনতা সুরক্ষা বা পুনরুদ্ধারের জন্য কোম্পানীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন।
‘বক্সারের যুদ্ধ’ নামে পরিচিত এই যুদ্ধে তাঁর শোচনীয় পরাজয় ঘটে।
ঐতিহাসিকদের মতে, এটা পরাজয়ের মধ্য দিয়ে প্রকৃত ক্ষমতা ও পূর্ণ কর্তৃত্ব কোম্পানীর হাতে চলে যায়।
রাজনৈতিক ক্ষমতাও তাদের করতলে চলে গিয়েছিল।
১৭৬৫ সালে দেওয়ানী গ্রহণের মধ্য দিয়ে নিরংকুশ ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের অধিকারী হয়ে যায় কোম্পানী।
এই পরিবর্তনের ফলে কেবল স্বাধীন নবাব বিদেশীদের শাসনে আবদ্ধ হলেন না, একই সাথে শাসক মুসলমান শাসিতের শ্রেণীতে পরিণত হয়ে গেল।
যেহেতু মুসলমানদের হাত থেকেই ক্ষমতা ছিনিয়ে নেয়া হয়, সুতরাং মুসলমানরাই নব্য শাসকদের সর্বপ্রকার অন্যায়, জুলূম, পীড়ন ও শোষণের শিকারে পরিণত হয়।
কোম্পানী মুসলমানদের রাজনৈতিক, সামরিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে উৎখাত করার দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হয় এবং একে একে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে।
প্রথমেই নব্য শাসকরা দ্বিমুখী নীতি গ্রহণ করে।
মুসলমানদের সরারী বা রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে সরিয়ে দেয়।
তাদের স্থলে প্রতিবেশী হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকদের নিয়োগ করে।
অর্থনৈতিক ও অন্যান্য ক্ষেত্রে এদের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে পুরোপুরি নিজেদের দলে ভিড়িয়ে নেয়।
লাখেরাজ ও আয়মা সম্পত্তি থেকে মুসলিমদের বঞ্চিত করা হয়।
বিভিন্ন প্রকার নিপীড়নমূলক কর তাদের ওপর ধার্য করা হয়।
সরকার ও সেনাবাহিনী থেকে মুসলমানদের অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে সরিয়ে দেয়া হয়।
এক হিসাব থেকে দেখা যায়, ১৭৫৭ থেকে ১৭৬৫ সালের মধ্যে কেবল সামরিক বাহিনী থেকেই ৮০ হাজার মুসলমানকে তাড়িয়ে দেয়া হয়।
১৭৫৭ সালের পট পরিবর্তনেরপর সর্বব্যাপী এমন এক শোষণ, পীড়ন ও নাশকতার উদ্ভব ঘটে যে, ১২ বছরের মাথায় স্মরণকালের সবচেয়ে বিভীষিকাময় দুর্ভিক্ষ নেমে আসে গোট বাংলায়।
ইতিহাসে ছিয়াত্তরের [বাংলা ১১৭৬ সন] মন্বন্তর নামে চিহ্নিত এই মহাদুর্ভিক্ষে লাখ লাখ মানুষের খাদ্যাভাবে অসহায় মৃত্যু ঘটে।
জমিদারের খাজনা, নীলকরদের অমানুষক নির্যাতন, মহাজনের দেনার চাপ এবং শাসকদের শোষণ-শাসন-পড়নে যখন জনগণ বিপন্ন ও দিশাহারা ঠিক তখনই এই মন্বন্তর আঘাত হেনে গোটা বাংলাকে প্রায় গোরস্তানে পরিণত করে।
এরপর ১৭৭২ থেকে ১৭৭৩ সালের মধ্যে কোম্পানী যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চাপিয়ে দেয়, তা ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে দাঁড়ায়।
১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের ফলে ভূীম ব্যবস্থায় যে পরিবর্তন ঘটে, তাতে বাংলার কৃষক সাজ বস্তুত ভূমিদাসে পরিণত হয় এবং কৃষক সমাজের অর্থনৈতিক অবস্থা পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়ে।
অপরদিকে মুসলিম জমিদার তালুকদাররা জমিদারী-তালুকদারী হারিয়ে সর্বস্বহীন হয়ে পড়ে এবং তাদের জমিদারী-তালুকদারী তাদেরই নামের গোমস্তারা হস্তগত করে নেয়।
এদের অধিকাংশই ছিল কোম্পানীর সহযোগী-সহায়তাকারী হিন্দু সমাজের অন্তর্গত।
শুধু তাই নয়, ডাকাত-দস্যুরা পর্যন্ত কোম্পানীর শাসকদের অনুকুল্যে রাতারাতি ‘রাজা’ মহারাজা’ বনে যায়।
দস্যু দলপতি দেবী সিংয়ের ‘রাজা’ হওয়ার কথা এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়।
দেবী সিংহ শুরুতে খাজনা আদারে ইজারাদারী লাভ করে।
দুর্ভিক্ষের সময় খাজনা আদায়ের নামে এই দেবী সিং উত্তরবঙ্গের কৃষকদের ওপর এমন নিপীড়ন ও অত্যাচার চালায় যে, হাজার গ্রাম জনশূন্য হয়ে পড়ে।
পরবর্তীতে দেবী সিং রাজা উপাধি পায় এবং বিরাট জমিদারী পত্তন করে। বাংলা কৃষিনির্ভর আর্থ-সামাজিক কাঠামোর ওপর দাঁড়িয়ে থাকলেও শিল্পক্ষেত্রে পিছিয়ে ছিল না।
সমকালীন বিশ্বে শিল্পক্ষেত্রে বাংলার বিশিষ্ট স্থান ও অবস্থান ছিল।
সেই সময় ঢাকাই মসলিনের খ্যাতি ছিল বিশ্বজোড়া।
বস্ত্র ছাড়াও বিভিন্ন পণ্য রফতানী করে বাংলা প্রতি বছর বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতেন।
শাসকগোষ্ঠী নানা কৌশল ও ষড়যন্ত্র করে এই শিল্পকেও ধ্বংস করে দেয়। এক হিসাবে দেখা যায়, ১৭৮৭ সালে কেবল ঢাকা থেকেই ৩০ লাখ টাকার মসলিন ইংল্যান্ডে রফতানী হয়।
মুসলিম ব্যবসায়ী ও শিল্পীদের ওপর অপরিসীম জুলুম, শোষণ ও নির্যাতন চালিয়ে এমন কি শিল্পীদের আঙ্গুল কেটে দিয়ে এই শিল্পের অস্তিত্ব বিরৈা করে দেয়া হয়।
দেখা যায়, কোম্পানী শাসন প্রতিষ্ঠার ৫০ তেকে ৭০ বছরের মধ্যে বাংলার মুসলমান সমাজ, আর্থ, রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয়- সকল ক্ষেত্রে পতিত হয়ে পড়েছে।
বিপদ-বিপর্যয়ের তাদের সীমা-পরিসীমা নেই।
তাদের অস্তিত্ব হয়ে পড়েছে মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন।
রাজনৈতিক ও আর্থিক দুরবস্থার সুবাদে বাংলার জনসমাজের নিম্নতম অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে গরিষ্ঠ সংখ্যার অধিকারী মুসলমানরা।
অনিবার্যভাবে ধর্মীয় সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও তারা দিক-দিশাহীন গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়েছে।
সুদীর্ঘকাল ধরে হিন্দু সমাজ সম্প্রদায়ের পাশাপাশি বসবাস করার কারণেই মুসলমান সম্প্রদায় সমাজের কোন কোন স্তরে বা পর্যায়ে হিন্দু আচার-সংস্কৃতির প্রভাব পড়েছিল।
রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক অবস্থান হারানোর বিপর্যয়ের মধ্যে এই প্রভাব ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করার সুযোগ পায়।
যার ফলে মুসলমানসমাজে শিরক, বিদয়াত ও অনৈসলামিক আচার-প্রথা এমন এক অবস্থায় আধিপত্য বিস্তার করে যে, পৃথক পরিচয়ে মুসলমান চিহ্নিত করাই দুরূহ হয়ে পড়ে।
মুসলমানদের মধ্যে পীর পূজা, মাজার পূজা ব্যাপক প্রচলন ঘটে।
হিন্দুদের ভূত-প্রেত বিশ্বাস তাদের বিশ্বাসেও পরিণত হয়।
হিন্দুদের বিভিন্ন পূজা, যেমন- গো পূজা, শীতলা দেবীর পূজা, মনসা পূজা ইত্যাদি মুসলিম সমাজেও প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
হিন্দুদের দুর্গা পূজার আদলে তাজিয়া মিছিল ও তাজিয়া বিসর্জনের প্রথাও প্রচলিত হয়।
অর্থাৎ তৌহিদাবাদী ধর্মীয় সম্প্রদায় হিসেবে মুসলমানদের পরিচয় ও অস্তিত্বে মুছে যাওয়ার পর্যায়ে এসে দাঁড়ায়।
ঠিক এই পটভূমি ও পরিস্থিতিতে ইসলামের অবিনশ্বর জ্যোতিতে উদ্ভাসিত এক মহান ব্যক্তির আবির্ভাব ঘটে পতিত ও বিলিয়মান এই মুসলিম সমাজে। তাঁর নাম- আল্লামা হাজী শরীয়তুল্লাহ।
তিনি পতিত স্বধর্মীয় সমাজ উদ্ধারে এবং ব্যক্তি পর্যায়ে ও সমাজের সর্বস্তরে মহান ইসলামের আলো ছড়িয়ে দেবার শপথ গ্রহণ করে সংস্কারবাদী আন্দোলনের সূচনা করেন, যার নাম- ‘ফরায়েজী আন্দোলন।’..
হাজী শরীয়তুল্লাহ যথার্থই উপলব্ধি করেন যে, মুসলমানদের এই অধঃপতন, দুর্গতি ও বিপর্যয়েল প্রধান কারণ বিদেশী ও বিধর্মীয় দুঃশাসন।
এই দুঃশাসনের অবসান ঘটিয়ে স্বাধীনতা ও স্বশাসন কায়েম করা ছাড়া দেশ ও দেশবাসীর মুক্তি- বিশেষত মুসলমানদের স্বগৌরবে অস্তিত্বের পুনঃপ্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়।
বিদেশী-বিধর্মীয় শাসন উৎখাতের জন্য ‘জিহাদ’ ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। এই উপলব্ধি থেকে তিনি ঘোষণা দেন:
‘এদেশ শত্রু কবলিত রাষ্ট্র।
ইংরেজ ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে অবৈধভাবে দেশ শাসন করছে। সুতরাং তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করে দেশকে স্বাধীন করা জনগণের একটি বৈধ অধিকার এবং এটি দেশবাসীর একটি পবিত্র দায়িত্ব।’
তাঁর এই দু’টি ঘোষণা নির্যাতিত, নিপীড়িত, শোষিত মুসলমানের মধ্যে উদ্দীপনার সৃষ্টি করে।
পক্ষান্তরে শাসক ও জমিদার শ্রেণর মধ্যে বিরাট আশংকা ও উব্দেগ সঞ্চার করে।
ঢাকা জেলার নয়াবড়ী নামক স্থানের কেন্দ্র করে তিনি তাঁর আন্দোলন শুরু করেন।
অল্প কিছুদিনের মধ্যে ঢাকা, পাবনা, বরিশাল, নদীয়া, মোমেনশাহী প্রভৃতি অঞ্চলে এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে।
তিনি গ্রামে গ্রামে গিয়ে কৃষকদের সংগঠিত করেন এবং ইসলারেম ফরজ প্রতিষ্ঠা, বিদেশী-বিধর্মিদের শাসন উৎখাতের এবং জমিদার ও শোষক শ্রেণীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানান।
জনগণ পর্যায়ে- বিশেষত কৃষক তাঁতী সম্প্রদায়ের মধ্যে তাঁর আন্দোলন ব্যপকভাবে বিস্তার লাভ করে।
তিনি তাদের পথ প্রদর্শক ও অবিসংবাদী নেতায় পরিণত হন।
হাজী শরীয়তুল্লাহ দেশকে ‘দারুল হরব’ বা জিহাদের মাধ্যমে এই শত্রু শাসনউৎখাত করে দেশকে ‘দারুল ইসলাম’ বা ইসলামের আলোয় হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার স্বপ্ন দেখেছিলেন এবং এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্যে তাঁর আন্দোলন ছিল উড়ে এসে জুড়ে বসা কোম্পানী শাসকদের বিরুদ্ধে এবং জমিদার মহাজনদের বিরুদ্ধে।
ফলে তারাই যুগপৎভাবে তাঁর বিরুদ্ধে সকল শক্তি নিয়োজিত করেছিল।
কিভাবে হাজী শরীয়তুল্লাহকে সরানো যায়, কেমন করে তাঁকে শায়েস্তা করা যায়- এসব চিন্তা-ভাবনা ও ষড়যন্ত্র একই সাথে চলতে থাকে।
এই পর্যায়ে যখন নয়াবাড়ীর জমিদার ও স্থানীয জোতদারদের সাতে হাজী শরীয়তুল্লাহর সরাসরি বিরোধ দেখা যেদয়, তখন তাঁকে গ্রেফতার করা হয় এবং পরে নয়াবাড়ী থেকে বিতাড়িত করা হয়।
তিনি তাঁর সূচিত আন্দোলনের পূর্ণ সাফল্য দেখে যেতে পারেননি।
১৮৪০ সালে মাত্র ৫৯ বছর বয়সে এই মর্দে মুজাহিদ, কৃষক বন্ধু, স্বাধীনতা সংগ্রামের অগ্রসাধক এবং দারুল ইসলাম প্রতিষ্ঠার স্বপ্নদ্রষ্টা ইন্তিকাল করন।
পরবর্তীকালে ফরায়েজী আন্দোলনের নেতৃত্ব দান করেন তাঁর সযোগ্য পুত্র মোহসিন উদ্দিন।
সিপাহী বিদ্রোহ পর্যন্ত এই আন্দোলন প্রবলভাবে অব্যাহত থাকে।”
এই দুটি পুনর্মূল্যায়নই আমাদের ইতিহাসের জন্য যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি গুরুত্বপূর্ণ হাজী শরীয়তুল্লাহকে জানা ও বুঝার ক্ষেত্রেও।
হাজী শরীয়তুল্লাহ এবং তাঁর সংগ্রামী জীবন যে কত বিশাল-ব্যাপক ছিল, তার তুলনা তিনি নিজেই।
তার সেই বিশাল ভূমিকা ও ইতিহাস আমাদের সাহস ও উদ্দীপনা সৃষ্টির জন্য বার বার সামনে মেলে ধরা প্রয়োজন।
কেননা ৩৮ বছর বয়সে হাজী শরীয়তুল্লাহ তাঁর ফরায়েজী আন্দোলন শুরু করেছিলেন।
সারা জীবন তিনি এখানকার মানুষের মুক্তির সংগ্রামই করে গেছেন।
ফরায়েজী আন্দোলন শুধু ধর্মীয়রূপেই ছিল না, সেই সাথে এটা ছিল আর্থ-সামাজিক ও সংস্কার আন্দোলন।
ইসলামই ছিল এখানে প্রধান ভূমিকায়।
ইসলাম যে কোনো ধরনের অত্যাচারের বিরুদ্ধে এবং শোষিত জনগণের পাশে থাকে, তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্তই রেখেছিলেন হাজী শরীয়তুল্লাহ!
সেই আদর্শই পরবর্তীকালে আরো বিকশিত হয়েছে।