কৌশলী কর্মপন্থা
খুবই সতর্কতার সাথে হাজী শরীয়তুল্লাহ তাঁর আন্দোলন ও সংস্কারের কর্মপন্থা নির্ধারণ করেছিলেন।
স্থানীয় জমিদার এবং ইংরেজদের সাথে যাতে কোন ধরনের সংঘর্ষ না বাধে, সে ব্যাপারে তিনি সতর্ক ছিলেন।
তিনি নীরবে তাঁর কাজ চালয়ে যাচ্ছিলেন। ফলে দিন দিন তাঁর অনুসারী সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছিল।
কৃষক, তাঁতিসহ সাদারণ মানুষকে হাজী শরীয়তুল্লাহর অধীনে সংঘবদ্ধ হতে দেখে জমিদাররা আতঙ্কিত হতে থাকে।
আগে হিন্দু জমিদাররা তাদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে মুসলমান প্রজাদের নিকট থেকে টাকা পয়সা আদায় করতো।
অথচ এটা ছিল ঈমানের সাথে সাংঘর্ষিক।
হাজী শরীয়তুল্লাহ হিন্দুদের পূজার চাঁদা দিতে নিষেধ করেন।
হিন্দু জমিদারদের প্রমাগ গোণার এটাও একটা কারণ ছিল।
এছাড়া এতোদিন মুসলমানরা বিচ্ছিন্ন থাকায় তারা যে কোন ধরনের অত্যাচার করতে পারতো। এবার সেই পথও তাদের বন্ধ হবার উপক্রম হলো। তবু তারা নানাভাবে মুসলমানদের হয়রানি করতে থাকে।
তাই জীবনের শেষ দিকে শক্তি প্রয়োগের কথা ভাবতে থাকেন হাজী শরীয়তুল্লাহ। তারই ফলে দুদু মিয়ার সময় জমিদারদের সাথে সংঘর্ষ হয়েছিল। তবে দুদু মিয়াও বেশ কৌশলে সবদিক মুকাবিলা করেছিলেন। দুদু মিয়া জমিদার এবং নীরকরদের বিরুদ্ধে দুর্বার গতিতে লড়াই করেছেন। তাঁর নেতৃত্বে বাঙালি মুসলমানরা জমিদারদের বিরুদ্ধে সফলতা লাভ করে। এর আগে সাইয়েদ নিসার আলী তিতুমীর জমিদার ও ইংরেজদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ [১৮২৭-১৮৩১] করেছিলেন। কিন্তু তা ব্যর্থতায় রূপ নেয়।
তবে দুদু মিয়া অনেক বেশি সফলতা পেয়েছিলেন।
সরকারের সাথে প্রকাশ্যে বিরোধিতায় না জড়িয়ে প্রথমশত্রু অর্থাৎ জমিদারদের তিনি ঠিকই শায়েস্তা করেছিলে। প্রশাসনিক এবং আইনী সুযোগও তিনি পুরোপুরিভাবে কাজে লাগাবার চেষ্টা করেছেন।
সেই সময়ে আন্দোলনগুলো বা ব্যক্তি মতাদর্শ প্রচারের জন্যে প্রায়ই বহাস নামে বিতর্ক সভার আয়োজন করা হতো।
আর এগুলোর প্রায়ই সমাপ্ত হতো মারামারির মাধ্যমে।
সমস্যার মীমাংসা হওয়ার চাইতে সমস্যা আরো গুরুতর রূপ ধারণ করতো। তাই হাজী শরীয়তুল্লাহ সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়েছিলেন এ ধরনের বিরোধ এড়াতে। তিতুমীর এবং তারিখে মোহাম্মদীর পাটনা গ্রুপের সাথে হাজী শরীয়তুল্লাহর সম্পর্ক ভাল ছিল।
তিনি তাদের আন্দোলনে যোগ না দিলেও পারস্পরিক বিরোধ থেকে তাঁরা সবাই মুক্ত ছিলেন।
মাওলানা কেরামত আলীর আন্দোলনও একই সময়ে পরিচালত হয়েছিল। আহলে হাদীস আন্দোলনও সেই সময় একটু জোরে শোরে শুরু হয়েছিল। মাওলানা কেরামত আলী জৌনপুরি বাঙলায় আসেন ১৮৩৫ সালে।
১৮৭৩৪ সালে ইন্তেকালের পূর্ব পর্যন্ত তিনি বাংলায় ইসলাম প্রচারে নিমগ্ন ছিলেন।
ফরায়েজী আন্দোলনের সাথে তাঁর মূল বিরোধ ছিল ঈদ এবংজুআর নামাজ আদায় না করা এবং খুঁটিনাটি আরো কিছু বিষয়ে।
মাওলানা কেরামত আলী সমাজে প্রচলিত অনেক ব্যাপারে নমনীয় হয়ে কিছুটা ছাড় দেয়ার পক্ষপাতী ছিলেন।
তারিখে মোহাম্মদ আন্দোলন ধর্মীয় আন্দোলন হিসেবে শুরু হয়েছিল ১৮১৮ সালে।
কয়েক বছরের মধ্যেই তা রাজণৈতিক আন্দোলন রূপ নেয়।
কিন্তু নিম্ন বাংলার কৃষক সমাজের কাছে সেটা তেমন সাড়া জাগাতে পারেনি। সাইয়েদ আহমদ শহীদের আন্দোলন দিনাজপুর, মালদহ, রাজশাহী, মুর্শিদাবাদ, নদীয়া, বর্ধমান, যশোর, কলকাতা এবং চব্বিশ পরগনায় জোরালো ছিল। অর্থাৎ গঙ্গা এবং ভাগিরথি নদীর দু’কূলে ছিল তাদের প্রচার ভূমি।
একই সময়ে এতগুলো সংস্কার আন্দোলন ও শোষণ-নিপীড়নের বিরুদ্ধে সংগ্রাম অব্যাহত ছিল।
কিন্তু কোনো নেতা অন্যের আন্দোলনকে অবজ্ঞা করেননি।
লিপ্ত হননি সরাসরি কোনো বিরোধিতায়।
হাজী শরীয়তুল্লাহ এই সময় অত্যন্ত কৌশলী কর্মপন্থা গ্রহণ করেন।
দারুল হরব
হাজী শরীয়তুল্লাহ যখন মক্কায় চিলেন, তখন তাঁর পরিচয় ঘটে মক্কার মুহাম্মদ বিন আবদুল ওয়াহ্হাব নজদর ইসলামী সংস্কার আন্দোলনের সাথে। এই আন্দোলনের প্রতি হাজী শরীয়তুল্লাহ আকৃষ্ট হযে পড়েন।
দিল্লিতে শাহ আবদুল আযীয দেহলভীর নেতৃত্বে ভারতেও আবদুল ওয়াহ্হাব নজদীর অনুকরণে ইসলামী সংস্কার আন্দোলন শুরু হয়।
তিনি ভরবর্ষকে ‘দারুল হরব’ বলে ঘোষণা করেন।
‘দারুল হরব’ কে ‘দারুল ইসলাম’ তথা একটি ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্যে যাঁরা অক্লান্তভাবে চেষ্ট করেছিলেন।
তাঁদের মধ্যে ছিলেন সাইয়েদ আহমদ বেরেলভী,শাহ আবদুল আযীযের ভ্রাতুষ্পুত্র শাহ ইসমাইল ও জামাতা মাওলানা আবদুল হাই।
হাজী শরীয়তুল্লাহও এদেশকে ‘দারুল হরব’ ঘোষণা করেন।
তিনি ঘোষণা দেন, এদেশ যতোদিন ‘দারুল ইসলাম’ না হবে, ততোদিন এখানে ‘জুমআ’ ও ঈদের নামায হবে না।
হাজী শরীয়তুল্লাহ এদেশে যেমন ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্যে চেষ্টা করেছেন, ঠিক তেমনি অন্য দেশেও ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্যে তাঁর অবদান ছিলো অসামান্য।
তিনি সাইয়েদ আহমদ বেরেলভীর ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের কাজে সহায়তা করার জন্যে এদেশ থেকে বহু মুজাহিদ এবং যাকাত, ফিতরা থেকে সংগৃহীত অর্থসহ নানা ধরনের সাহায্য ভাতের সিত্তানা কেন্দ্রে পাঠাতেন।
জুলুম নির্যাতন
যে কোনো ভালো কাজ করতে গেলেই দুষ্ট লোকেরা বাধ সাধে। বাধ সাধে এজন্যে যে, তাদের স্বার্থে আঘা লাগে।
হাজী শরীয়তুল্লাহও বিনা বাধায় কাজ করতে পারেননি।
তাঁর আন্দোলনী জীবনে বারবার বাধা এসেছে। বাধা এসেছে জমিার ও ইংরেজদের পক্ষ থেকে।
তাঁর কর্মীদের পুলিশ নির্মমভাবে অত্যাচার করেছিলো।
তাঁকেও সইতে হয়েছিলো নানা ধরনের নিপীড়ন। তাঁকে রামনগর থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিলো।
আঠারো ঊনচল্লিশ সাল পর্যন্ত তাঁকে বেশ কয়েকবার গ্রেফতারও করা হয়েছিলো।
কিন্তু কোনোভাবেই হিন্দু জমিদার এবং ইংরেজরা পরাস্ত করতে পারেননি সত্যের সৈনিক হাজী শরীয়তুল্লাহকে।
বরং তাদের পক্ষ থেকে যতোই বাধা আসতো ততোই তিনি তাঁর সংগ্রামী ভূমিকা পালন করে যেতেন দুর্বার গতিতে।
সামনে এগিয়ে যেতেন দিগুণ সাহসের সাথে।
হাজী শরীয়তুল্লাহর নতুন কর্মক্ষেত্র ছিলো ঢাকা জিলার নয়া বাড়িতে।
কিন্তু হিন্দু জমিদারদের চরম বিরোধিতার ফলে তিনি ঢাকার নয়া বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হন।
এখান থেকে ফিরে যান তিনি তাঁর নিজের গ্রাম- শামাইলে।
সেখানে থেকেই হাজী শরীয়তুল্লাহ পূর্ণ গতিতে ফরায়েজী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে থাকেন।
অত্যাচারী হিন্দু জমিদার, নীল কুঠিয়াল এবং ইংরেজ দস্যুরা আরো বেশি ক্ষেপে গেলো হাজী শরীয়তুল্লাহর ওপর।
জুলুম-অত্যাচার ছাড়াও হাজী শরীয়তুল্লাহ এবং তাঁর আন্দোলন সম্পর্কে সে সময়ে বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হলো না প্রকার কল্পকথা।
যেসব কথার কোনো ভিত্তিই ছিলো না।
তাতে ছিলো না সত্যের লেশ মাত্র।
এখানে মাত্র একটি উদাহরণ দিলেই ব্যাপারটি বুঝা যাবে সহজে।
পত্র-পত্রিকার ভাষ্য
হিন্দু যে ফরায়েজী আন্দোলনকে মোটেই সহ্য করতে পারতো না তা বুঝা যায় তাদের পত্রিকা ‘সমাচার দর্পণের’ ভাষ্য থেকেই।
আঠারো শো সাইত্রিশ সালের বাইশে এপ্রিল তারিখে এই পত্রিকায় একটি পত্র ছাপা হয়। পত্রটি ছিলো এ রকম:
“ইদানিং জিলা ফরিদপুরের আন্তঃপিাতি শিবচর থানার সরহদ্দে বাহাদুরপুর গ্রামে সরিতুল্লাহ নামক একজন বাদশাহী লওনেচ্ছুক হইয়া ন্যূনাধিক বার হাজার জোলা ও মুসলমান দলবদ্ধ করিয়া নতুন এক সরা জারি করিয়া নজ মতাবলম্বী লোকদিকের মুখে দাড়ি, কাছা খোলা, কটি দেশের ধর্মের রুজ্জুভৈল করিয়া তৎতুর্গিস্থ হিন্দুদিগের বাড়ি চড়াও হইয়া দেবদেবী পূজার প্রতি অশেষ প্রকার আঘাত জন্মাইতেছে- এই জিলা ঢাকার অন্তঃপাতি মতলবগঞ্জ থানার রাজনগর নিবাসী দেওয়ান মৃত্যুঞ্জয় রায়ের স্থাপিত দ্বাদশ শিবলিঙ্গ ভাঙ্গিয়া নদীতে বিসর্জন দিয়াছে এবং ঐ থানায় সরহদ্দে দ্বাদশ শিবলিঙ্গ ভাঙ্গিয়া নদীতে বিসর্জন দিয়াছে এবং ঐ থানার সরহদ্দে পোড়াগাছা গ্রামে একজন ভদ্রলোকের বাটিতে রাত্রিযোগে চড়াও হই সর্বস্ব হরণ করিয়া তাহার গৃহে অগ্নি দিয়া অবশিষ্ট যেটুকু ছিল ভষ্ম রাশি করিলে একজন যবন মৃত হইয়া ঢাকায় দাওরায় অর্পিত হইয়াছে।
… আর শ্রত হওয়া গেল, সরিতুল্লাহ দলভুক্ত দুষ্ট যবনের ঐ ফরিদপুরের অন্তঃপাতি পাটকান্দা গ্রামের বাবু তারিনী চরণ মজুমদারের প্রতি নানা প্রকার দৌরাত্ম্য অর্থাৎ তাহার বাটিতে দেবদেবী পূজায় আঘাত জন্মাইয়া গোহত্যা ইত্যাদি কুকর্ম উপস্থিত করেলে মজুমদার বাবু যবনদিগের সহিত সম্মুখ যুদ্ধ অনুচিত বোধ করিয়া- ঐ সকল দৌরাত্ম্য ফরিদপুরের ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের হুজরে জ্ঞাপন করিলে ঐ সাহেব বিচারপূর্বক কয়েকজন যবনকে কারাগারে বদ্ধ করিয়াছেন এবং এ বিষয়ে বিলক্ষণ অনুসন্ধান করিতেচেন। সে সম্পাদক মহাশয়, দুষ্ট যবনেরা মফঃস্বলে এ সকল অত্যাচার ও দৌরাত্ম্যে ক্ষান্ত না হইয়া বরং বিচার গৃহে আক্রমণ করিতে প্রবৃত্ত হইল। শ্রুত হওয়া গেল, ফরিদপুরের ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের হুজরে যে সকল আমলা ও মোক্তার-কারেরা নিযুক্ত আছে, তাহারা সকলেই সরিতুল্লাহ যবনের মতাবলম্বী- তাহাদের রীতি এই যদি কাহার নামে মিথ্যা অভিযোগ করিতে হয়, তবে কেহ ফরিয়াদী কেহ বা সাক্ষী হইয়া মোকদ্দমা উপস্থিত করে সুতরাং ১২০০০ লোক দলবদ্ধ। ইহাতে ফরিয়াদীর সাক্ষীর ত্রুটি কি আছে… আমি বোধ করি, সরিতুল্লাহ যবন যে প্রকার দলবদ্ধ হইয়া উত্তর উত্তর প্রবল হইতেছে অল্পদিনের মধ্যে হিন্দু ধর্ম লোপ পাইয়া অকালে প্রলয় হইবেক। সরিতুল্লাহর চোটপাটের শত অংশের এক অংশ তিতুমীর করিয়াছিল না। ইতি সন ১২৪৩ সাল, তারিখ ২৪শে চৈত্র।”
সুতরাং এই একটি মাত্র চিঠির মাধ্যমেই পরিষ্কার হয়ে যায় যে, হাজী শরীয়তুল্লাহকে কত ভাবে আক্রমণ করা হয়েছিল!
তাতে কি!
সাহসী সৈনিক কি থেমে যায় কখনো? না!
হাজী শরীয়তুল্লাহও থেমে থাকেননি।
বরং তিনি অত্যন্ত সাহসিকতা ও দৃঢ়তার সাথে সকল বাধা ও প্রতিবন্ধকতা মুকাবিলা করে ক্রমাগত এগিযে গেছেন সামনের দিকে। ক্রমাগত সামনের দিকেই।
সমাজ সংস্কারক
দীর্ঘদিন হিন্দুদের সাথে মিলে মিশে এবং তাদের পাশাপাশি থাকার কারণে এবং যথাযথ ধর্মীয় বোধ না থাকার কারণে মুসলমানদের মধ্যে হিন্দু সমাজের অনেক রীতি নীতি ও ধ্যান ধারণা প্রবেশ করেছিলো।
যা ছিলো ইসলামের আকীদা বিশ্বাসের সম্পূর্ণ বিপরীত।
ছিল শিরক বিদআত পর্যায়ের।
হাজী শরীয়তুল্লাহ শরক বিদয়াত, পীর-ফকিরের মাজারে সিজদা, মানব ও হিন্দুদের পূজার মতো নানা খারাবী ও বাড়াবাড়ি ইসলামের মৌলনীতি কুরআন ও হাদীসের বিপরীত বলে ঘোষণা করেন।
তিনি সকল মুসলমানকে এসব কাজ থেকে বিরত থাকার জন্যে জোর আহ্বান জানান।
হাজী শরীয়তুল্লাহই এদেশে প্রথম শরীয়ত, তরীকতের ধারক ও বাহক পীরদের মর্যাদা সম্পর্কে মানুষকে জানান।
তাঁদের সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে বলেন যে, তাঁরা শিক্ষকের মতো। এর বেশি কিছু নয়।
অতেএব তাঁদেরকে শ্রদ্ধা করা যায়, কিন্তু এর বেশি আর কিছু করা যাবে না। অথচ তখনকার মুসলমানদের ধারণা ছিল যে, পীরেরা তাদের মুরীদানকে আল্লাহর কাছে সুপারিশ করে জান্নাতে নিয়ে যেতে পারবেন।
তাই অনেক মুরীদ খারাপ কাজে লিপ্ত থাকতো।
তারা ঠিকভাবে আল্লাহর হুকুম মেনে চলতো না।
তাদের বিশ্বাস ছিলো আমল এবং আখলাকে ঘাটতি থাকলেও পীর সাহেব তাদেরকে পার করে দিতে পারবেন।
জান্নাতে যাবার জন্যে যা যা দরকার তিনি সব বন্দোবস্ত করে দেবেন। কি সর্বনেশে চিন্তা!
হাজী শরীয়তুল্লাহ তাদের এইসব ভুল ধারণা ভেঙ্গে দেন।
হাজী শরীয়তুল্লাহ বিবাহ এবং অন্যান্য সামাজিক উৎসবগুলোতে অযথা খরচ করার বিরোধিতা করেন।
মুসলমান জাতির আর্থিক উন্নয়নের জন্যে তিনি বিশেষভাবে সচেষ্ট ছিলেন। আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে ভয় না করার জন্যে তিনি সকেলর প্রতি আহ্বান জানান।
কুরআন ও হাদীস অনুযায়ী সকল কাজ সম্পাদন করার জন্যে তিনি সকলকে নির্দেশ দেন।
হাজী শরীয়তুল্লাহকে এক সাথে অনেকগুলো শক্তিকে মুকাবিলা করতেহয়েছে। জাঁকিয়া বসা পীর তন্ত্র, নানা মারমী তরীকা, শিয়া মাজহাব, মাওলানা কেরামত আলীর আন্দোলন এবং সর্বোপরি স্থানীয় জমিদার এবং ইংরেজ শাসকবৃন্দকে তাঁকে শক্তভাবে মুকাবিলা করতে হয়েছে।
পীর ব্যবস্থাটি বাংলার মুসলমান সমাজে এতো গভীরভাবে প্রবেশ করেছিল যে, আত্ম-মর্যাদাবান জাতি হিসেবে অস্তিত্ব ঘোষণার জন্য সেই সময়ে এই প্রভাব থেকে বেরিয়ে আসা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
এদশে ইসলাম প্রচার ও প্রসারে পীর দরেবেশদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। বলতে গেলে তখনকার দিনে ধর্মীয় বিধি বিধান সম্পর্কিত জ্ঞান অর্জনের প্রধান মাধ্যমই ছিল তাঁরা।
কিন্তু ঊনবিংশ শতকের ঘোর অমানিশার সময়ে পীর-দরবেশ নামে অনেকেই বিভ্রান্ত ছড়াতো।
তাছাড়া মৃত অনেক পীরের নামে মানত করা, তাদের মাজারে শিরনি দেওয়ার রেওয়াজ ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল্
পাঁচ পীর, মানিক পীর, ঘোড়া পীর, মাদারী পীর, খাজে খিজির, জিন্দা গাজী, বদর পীর প্রমুখের প্রতি শিরনি বা মানত না করে কেউ কোনো কাজে হাত দিত না।
পীর ভক্তি তখন শিরকের পর্যায়ে চলে গিয়াছিল।
মুসলমানদের এই বিভ্রান্তি থেকে মুক্ত করা ছিল খুবই প্রয়োজনীয় একটি কাজ। তাই হাজী শরীয়তুল্লাহ এক্ষেত্রে ইসলামী চেতনার বিস্তার ঘটান।
পীর, সুফি, শেখ প্রভৃতি মাধ্যম বাদ দিয়ে আল্লাহর সাথে বান্দার সরাসরি সম্পর্কের কথা প্রচার করলেন।
শিক্ষার জন্যে কোনো মাধ্যম অবশ্যই প্রয়োজন।
তাই তিনি উস্তাদ-শাগরেদ ব্যবস্থা কায়েম করে নতুন দিগন্তের সূচনা করলেন। অবশ্য পরবর্তীকালে অনেকটা পীরদের মতোই তাঁর বংশধররাই ফরায়েজী আন্দোলনের প্রধান নির্বাচিত হতেন।
তবে এক্ষেত্রে আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের মতামত প্রয়োজন হতো।
হাজী শরীয়তুল্লাহ জানিয়ে দিলেন, সত্যিকারের মুসলমান হওয়ার জন্য কোনো পীর দরবেশের প্রয়োজন নেই।
জাঁকজমকপূর্ণ কোনো অনুষ্ঠানেরও দরকার নেই।
আল্লাহ ও তাঁর নবীকে (সা) স্বীকার তথা তৌহিদ ও রিসালাতে বিশ্বাস এবং ফরজ পালনের মধ্যেই যাবতীয় মুক্তি নিহিত রয়েছে।
এভাবে হাজী শরীয়তুল্লাহ মানুষকে সঠিক পথের সন্ধান দেন।
অন্যায় জুলুমরে বিপরীতে তিনি সকল মানুষকে এক হবার জন্যে তাকিদ দেন।
তাঁর এ মুক্তির আহ্বানে সাড়া দিয়ে মুসলমানরা সেদিন সংগ্রাম ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো।
হাজী শরীয়তুল্লাহর সংস্কার তথা ফরায়েজী আন্দোলন মূলত রাজ্যহারা, সম্পদহারা মুসলিম জাতির মনের আশা ও ভরসা এনে দিয়েছিলো।
তাঁর এ আন্দোলনের জন্যে যেন হাজার হাজার মুসলমান বহুদিন থেকে অপেক্ষায় প্রহর গুণছিলো।
সেই সুযোগ যখন এলো, তখন তাঁর কথায় এক সাথে সকলেই জেগে উঠলো অসহায় মুসলমানের মুক্তির জন্যে।
কম বিস্ময়ের ব্যাপার নয়!
অত্যাচারী জমিদারদের বিরুদ্ধে তারাও সোচ্চার হয়ে ওঠে হাজী শরীয়তুল্লাহর নেতৃত্বে।
ঝাঁপিয়ে পড়ে তারা সকল প্রকার ত্যাগ স্বীকার করে।
হাজী শরীয়তুল্লাহর এই সংস্কার প্রচেষ্টা বিফলে যায়নি। যাবার কথাও নয়।
সত্যিই একদিন তাঁর ফরায়েজী আন্দোলন সফলতার দ্বাপ্রান্তে উপস্থিত হয়েছিলো।
এ সম্পর্কে জেম্স ওয়াইজ তাঁর মোহামেডানস অব ইস্টার্ণ বেঙ্গল’ গ্রন্থে বলেন:
“হিন্দুদের বহু ইশ্বরবাদ নীতির সাথে দীর্ঘদিনের সম্পর্কের ফলে মুসলমানদের মধ্যে যেসব কুসংস্কার ও দুর্নীতি দেখা দিয়েছিল তার বিরুদ্ধে কথা বলার প্রথম সোচ্চার প্রচারক হিসেবে তাঁর [হাজী শরীয়তুল্লাহ] আবির্ভাব বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। কিন্তু বাংলার চেতনাহীন ও উদাসীন চাষী সমাজের মধ্যে তিনি উৎসাহ-উদ্দীপনা জাগ্রত করার ব্যাপারে যে সাফল্য অর্জন করেন, তা আরও বেশী চমকপ্রদ।
এ উদ্দেশ্যে সাধনের জন্যে একজন অকপট ও সহানুভূতিসম্পন্ন প্রচারকেরই প্রয়োজন ছিল। আর মানুষের মনে প্রভাব বিস্তারের অধিকতর ক্ষমতা শরীয়তুল্লাহর চেয়ে অপর কারুর মধ্যে কখনও দেখা যায়নি।”
হাজী শরীয়তুল্লাহ ছিলো উন্নত চরিত্র। ছিলো তাঁর অতুলনীয় মানবীয় গুণ ওবৈশিষ্ট্য।
সেই চমৎকার আকর্ষণীয় এবং মোহনীয় শক্তি ছিলো তাঁর। আর এজন্যই তাঁর চরিত্রে মুগ্ধ ছিলো হাজার হাজার মুসলমান।
আদর্শ ও চরিত্রের গুণেই তিনি জয় করেছিলেন ভাগ্যহত মানুষের মন।
তাঁর নির্মল চরিত্রের প্রশংসা করতে গিয়ে ডক্তর ওয়াইজও বলতে বাধ্য হয়েছেন যে,
“তাঁর নির্দেশ ও আদর্শ চরিত্র দেশবাসীদের ভক্তিশ্রদ্ধা আকর্ষণ করে। দুর্যোগের দিনে সৎ পরামর্শ ও ব্যথা-বেদনায় সান্ত্বনা প্রদানকারী পিতার মতোই দেশের জনগণ তাঁকে ভালোবাসতেন।”
প্রকৃত অর্থেই হাজী শরীয়তুল্লাহ ছিলেন একজন নির্ভীক ও নিবেদিত-প্রাণ সমাজ সংস্কারক।
এদেশের মুসলমানদের চরম দুর্দিনে তিনি যোগ্য অভিভাবকের মতো তাদের কাছে টেনে নিয়েছিলেন।
দেখিয়েছিলেন সত্য-সঠিক পথ।
এজন্যই ইতিহাসের পাতায় এখনো জ্বল জ্বল করে আছে তাঁর নাম- হাজী শরীয়তুল্লাহ!