সাহাবাগন কতটা দায়িত্ব নিয়ে কুরআন মুখস্ত করেছেন
আরবী***
৭৫। তাবেঈ হযরত আলকামা থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একবার আমরা ( সিরিয়ার ) হেমস নগরীতে ছিলাম। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ ( রাঃ ) সূরা ইউসুফ পাঠ করলেন। সেখানে উপস্থিত এক ব্যক্তি বললো- এটা এভাবে নাযিল হয় নি। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ ( রাঃ ) বললেন, আল্লাহর শপথ, আমি এ সূরা স্বয়ং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সামনে পড়েছি। আমার পাঠ শুনে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “তুমি ঠিকভাবে পড়েছ”। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ ( রাঃ ) লোকটির সাথে কথা বলছিলেন, এ সময় তিনি তাঁর মুখ থেকে মদের গন্ধ পেলেন। তিনি বললেন- তুমি শরাব পান করেছো আর কুরআন শুনে তা মিথ্যা সাব্যস্ত করতে চাচ্ছ? অতএব তিনি তাঁর উপর ( মদ পানের অপরাধে ) শাস্তির দণ্ড কার্যকর করেন। — ( বুখারী ও মুসলিম )
এ হাদিসটি এখানে উল্লেখ করার উদ্দেশ্য হচ্ছে- সাহাবাদের মধ্যে যারা লোকদের মাঝে কুরআন পৌঁছানোর দায়িত্ব পালন করেছেন—তারা হয় সরাসরি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুখে শুনে তা মুখস্ত করেছেন, অথবা অন্যের কাছে শুনে তা মুখস্ত করে তা আবার রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে শুনিয়েছেন। তিনি তা শোনার পর এর সমর্থন করেছেন যে, তুমি সঠিক মুখস্ত করেছো। এভাবে আমাদের কাছে কুরআন পৌঁছানোর কোন মাধ্যম এরূপ ছিলনা যে সম্পর্কে বিন্দুমাত্র সন্দেহ করার অবকাশ থাকতে পারে।
কুরআন মাজীদ কিভাবে একত্রে জমা করা হয়েছিলো
আরবী***
৭৬। হযরত যায়েদ ইবনে সাবিত ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, যে সময় ইয়ামামার যুদ্ধে অসংখ্য সাহাবা শহীদ হলেন, হযরত আবু বকর ( রাঃ ) আমাকে ডেকে পাঠালেন। আমি উপস্থিত হয়ে দেখলাম হযরত উমরও ( রাঃ ) সেখানে হাযির আছেন। আবু বকর (রাঃ) আমাকে বললেন- উমর আমার কাছে এসেছে এবং সে বলছে- “ইয়ামামার যুদ্ধে কুরআনের অসংখ্য কারী ( যাদের কুরআন মুখস্ত ছিল এবং লোকদের তা পড়ে শুনাতেন ) শহীদ হয়ে গেছেন। আমার আশংকা হচ্ছে— অন্যান্য যুদ্ধেও যদি কুরআনের কারীগন শহীদ হয়ে যায়, তাহলে কুরআনের বিরাট অংশ বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে। এজন্য আমার রায় হচ্ছে এই যে, আপনি কুরআনকে একত্রিত ( বইয়ের আকারে গ্রন্থাবদ্ধ ) করার নির্দেশ দেন।”
আবু বকর ( রাঃ ) বলেন, আমি উমরকে বললাম, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে কাজ করেননি তা তুমি কিভাবে করবে? উমর ( রাঃ ) বললেন, আল্লাহর শপথ এটা খুবই ভালো কাজ। সে এ ব্যাপারে আমাকে বরাবর পীড়াপীড়ি করতে থাকলো। অবশেষে আল্লাহ তায়ালা– এ কাজের জন্য আমার অন্তরকে উম্মুক্ত করে দিলেন। ( অর্থাৎ আমি আশ্বস্ত হলাম যে, এটা খুবই উপকারী কাজ এবং তা একটি শরঈ প্রয়োজনকে পূর্ণ করবে।) আমার অভিমতও উমরের অভিমতের সাথে মিলে গেলো।
যায়েদ ( রাঃ ) বলেন, অতপর আবু বকর ( রাঃ ) আমাকে বললেন, “তুমি একটি যুবক বয়সের লোক এবং বুদ্ধিমান। তোমার ব্যাপারে আমাদের কোন সন্দেহ নেই ( অর্থাৎ তুমি যে কোন দিক থেকে নির্ভরযোগ্য )। তুমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অহী লেখার কাজেও নিয়োজিত ছিলে। অতএব তুমি কুরআন মাজীদের অংশগুলো খুঁজে বের করো এবং একত্রে জমা করো।” যায়েদ ( রাঃ ) বলেন, আল্লাহর শপথ, তিনি যদি আমাকে পাহাড় তুলে আনার হুকুম দিতেন তাহলে এটা আমার কাছে এতো কঠিন মনে হতোনা— যতটা কঠিন মনে হচ্ছে তাঁর এই কাজের নির্দেশ। আমি আরজ করলাম, আপনি একাজ কেমন করে করবেন যা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম করেননি? আবু বকর ( রাঃ ) আমাকে জবাব দিলেন, আল্লাহর শপথ এটা বড়ই ভালো কাজ।
অতপর আবু বকর ( রাঃ ) এ কাজের জন্য আমাকে বার বার তাগাদা দিতে থাকলেন। অবশেষে আল্লাহ তায়ালা এ কাজের জন্য আমার বক্ষ উন্মুক্ত করে দিলেন— যার জন্য তিনি আবু বকর ( রাঃ ) এবং উমরের ( রাঃ ) অন্তরকে উন্মুক্ত করে দিয়েছেন। অতপর আমি কুরআন মাজীদকে খেজুরের বাঁকল, সাদা পাথরের পাত এবং লোকদের বুক ( স্মৃতি ) থেকে তালাশ করে একত্রে জমা করা শুরু করে দিলাম। অবশেষে আমি সূরা তাওবার শেষ আয়াত আবু খুজাইমা আনসারীর ( রাঃ ) কাছে পেলাম। তা আর কারো কাছে পেলাম না। আয়াতটি হচ্ছে- “লাকাদ- জায়াকুম—রাসুলুম- মিন আন ফুসিকুম” শেষ পর্যন্ত। এভাবে কুরআন মাজীদের যে সহীফা একত্রিত করা হল বা লেখা হল তা হযরত আবু বকরের ( রাঃ ) জীবদ্দশা পর্যন্ত তাঁর কাছে থাকে। অতঃপর তা হযরত উমরের ( রাঃ ) কাছে তাঁর জীবনকাল পর্যন্ত থাকে। অতঃপর তা উম্মুল মু’মিনিন হযরত হাফসা ( রাঃ ) এর যিম্মায় থাকে। —- ( সহীহ বুখারী )
হযরত আবু বকরের ( রাঃ ) মনে এই সন্দেহ উদ্রেক হয় যে, কুরআন মাজীদ একত্রে জমা করা যদি কোন জরুরী কাজ হতো এবং দীনের হেফাজতের জন্য এটা করার প্রয়োজন হতো তাহলে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সালামই তাঁর জীবদ্দশায় কুরআন মাজীদকে একত্রিত করে পুস্তকের আকারে সংকলিত করিয়ে যেতেন। কিন্তু তিনি যখন একাজ করেননি আমরা তা করার দুঃসাহস কি করে করতে পারি? কিন্তু হযরত উমরের ( রাঃ ) যুক্তি ছিল এই যে, কোন একটি কাজ যদি উত্তম বলে বিবেচিত হয় এবং শরীয়ত ও ইসলামের মৌলিক কাজের অনুকূল হয়, তাহলে এর শরঈ প্রয়োজন থাকা এবং তা স্বয়ং একটি ভালো ও কল্যাণকর কাজ হওয়া এবং এর বিপক্ষে কোন নিষেধাজ্ঞা বর্তমান না থাকাটাই সেই কাজ জায়েজ হওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। এজন্যই তিনি বলেছেন, আল্লাহর শপথ, আমার দৃষ্টিতে এ কাজ উত্তম।
“খোদার শপথ, তিনি যদি আমাকে পাহাড় তুলে নিয়ে আসার নির্দেশ দিতেন তাহলে এ কাজ আমার কাছে এতটা কঠিন মনে হতো না, যতটা কঠিন মনে হচ্ছে তাঁর এই কাজের নির্দেশ”। —– হযরত যায়েদের ( রাঃ ) এই মন্তব্য তাঁর তীক্ষ্ণ অনুভূতির প্রতিনিধিত্ব বহন করে যে, কুরআন একত্রে জমা করা একটি কঠিন দায়িত্বপূর্ণ কাজ।
কুরআন মাজীদকে বিভিন্ন জায়গা থেকে একত্রিত করা, অতঃপর তা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নির্দেশিত ক্রমানুযায়ী লিপিবদ্ধ করা এবং তাতে কোনরূপ ভুল—ভ্রান্তি না হওয়া মূলতই এক কঠিন দায়িত্বপূর্ণ কাজ ছিল। “আমার দ্বারা যদি বিন্দু পরিমাণও ভুল হয়ে যায় তাহলে ভবিষ্যৎ বংশধরদের কাছে কুরআন ভ্রান্তি সহকারে পৌছার সমস্ত দায়দায়িত্ব আমাকেই বহন করতে হবে।” —হযরত যায়েদ ( রাঃ ) এর মনে এই অনুভূতি পূর্ণ মাত্রায় বিদ্যমান ছিল। এই অনুভূতির কারনেই তিনি বলেছেন—পাহাড় উত্তোলন করে নিয়ে আসার চেয়েও অধিক কঠিন কুরআন সংকলনের এই বোঝা আমার উপরে চাপানো হয়েছে।
এ হাদীস থেকে জানা যায়, তিনটি উৎস থেকে কুরআন মাজীদ সংগ্রহ করা হয়েছে।
একটি উৎস এই ছিল যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে কুরআন মাজীদ লিখিয়েছিলেন তা খেজুর বাঁকল, সাদা পাথরের পাতলা তক্তির উপর লেখা ছিল। রাসুলুল্লাহর ( সাঃ ) নীতি ছিল— যখন অহী নাযিল হতো, তিনি লেখাপড়া জানা কোন সাহাবীকে ডেকে তিনি নির্দেশ দিতেন— এই সূরাটি অথবা এই আয়াতগুলো অমুক অমুক স্থানে লিখে দাও। এই সাহাবীদের কাতিবে অহী বা অহী লেখক বলা হতো। লেখা শেষ হলে আবার তিনি তা পড়িয়ে শুনতেন যাতে এর নির্ভুলতা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারেন। অতপর তা একটি থলের মধ্যে ঢেলে দিতেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর জীবনের শেষ পর্যায়ে ( সামনের হাদীসে আসছে ) এও বলে দিয়েছেন যে, অমুক আয়াত অমুক সুরার অংশ এবং অমুক আয়াতের পরে এবং অমুক আয়াতের পূর্বে সংযোজিত হবে। অনুরূপভাবে সূরা সমূহের ক্রমবিন্যাসও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম করে দিয়েছেন। এতে লোকেরা জানতে পারল যে, সূরাগুলোর ক্রমবিন্যাস কিভাবে করা হয়েছে। কিন্তু তিনি কুরআন মাজীদকে একটি পুস্তকের আকারে লিখাননি—যে আকারে আজ তা আমাদের সামনে রয়েছে।
হযরত যায়েদ ( রাঃ ) বলেন, এই থলের মধ্যে পাথরের যেসব তক্তি এবং খেজুর বাঁকল ছিল আমি তা বের করে নিলাম। এর সাথে আরো একটি কাজ এই করলাম যে, যেসব লোকের কুরআন মুখস্ত ছিল তাঁদের ডেকে তাঁদের পাঠ পাথর ও বাকলে লেখা কুরআনের সাথে মিলিয়ে দেখলাম। এভাবে দুইটি উৎসের সাথে কুরআনের আয়াতগুলোর সামঞ্জস্য নির্ণীত হওয়ার পর তা একটি পুস্তক আকারে লিপিবদ্ধ করা হল।
হযরত যায়েদ ( রাঃ ) যে বলেছেন, সূরা তাওবার সর্বশেষ আয়াত আমি কেবল হযরত খুজাইমা ( রাঃ ) এর কাছে পেয়েছি— এর অর্থ এই নয় যে, এই আয়াত ঐ থলের পাণ্ডুলিপির মধ্যেই ছিল না। কেননা এই ব্যবস্থা করা হয়েছিলো যে, এই থলের মধ্যে যা কিছু পাওয়া যায় তা হাফেজদের মুখস্ত কুরআনের সাথে মিলানোর পরে লেখা হবে। অতএব তাঁর কথার অর্থ হচ্ছে এই যে, আমি কুরআনের যে কয়জন হাফেজ পেলাম, তাঁদের মধ্যে সূরা তাওবার এই শেষ আয়াত কেবল খুজাইমা আনসারীর ( রাঃ ) মুখস্ত ছিল। আমি থলের পাণ্ডুলিপির সাথে মিলানোর পর তা সংকলন করলাম।
মাসহাফে উসমানী কিভাবে প্রস্তুত করা হয়
আরবী***
৭৭। হযরত আনাস ইবনে মালেক ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, হযরত হুজাইফা ইবনুল ইয়ামান ( রাঃ ) হযরত উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহুর কাছে আসলেন। এটা সেই যুগের কথা যখন তিনি সিরিয় বাহিনীর সাথে আর্মেনিয়া বিজয়ে এবং ইরাক বাহিনীর সাথে আজারবাইজান বিজয়ে অংশ গ্রহন করেছিলেন। লোকদের বিভিন্ন রীতিতে কুরআন পাঠ হযরত হুজাইফাকে ( রাঃ ) উদ্বিগ্ন করে তুলল। তিনি হযরত উসমানকে ( রাঃ ) বললেন, হে আমিরুল মু’মিনীন, ইহুদী-খ্রিস্টানদের ন্যায় আল্লাহর কিতাবে বিভেদ সৃষ্টির পূর্বে আপনি এই জাতিকে রক্ষা করার চিন্তাভাবনা করুন।
অতএব, হযরত উসমান ( রাঃ ) হাফসাকে ( রাঃ ) বলে পাঠালেন, আপনার কাছে কুরআন শরীফের যে সহীফা ( অর্থাৎ মাসহাফে সিদ্দিকী ) রয়েছে তা আমাকে পাঠিয়ে দিন। আমরা এটা দেখে আরো কপি নকল করিয়ে দেব। অতপর মূল কপি আপনাকে ফেরত দেব। হযরত হাফসা ( রাঃ ) মাসহাফ খানা ( পুস্তকাকারে সংকলন ) হযরত উসমানের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। অতপর তিনি হযরত যায়েদ ইবনে সাবিত আনসারী ( রাঃ ), হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়ের ( রাঃ ), হযরত সাঈদ ইবনুল আস ( রাঃ ) এবং হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে হারিস ইবনে হিশাম ( রাঃ ) এই চার ব্যক্তিকে এ কাজে নিযুক্ত করলেন। তারা মাসহাফে সিদ্দিকী থেকে আরো কয়েকটি মাসহাফ তৈরি করবেন। উপরোক্ত এই চার ব্যক্তির মধ্যে কুরাইশ বংশের তিন ব্যক্তিকে ( হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়ের, হযরত সাঈদ ইবনুল আস এবং হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে হারিস ) তিনি নির্দেশ দিলেন, যদি কখনো কুরআনের কোন জিনিস নিয়ে তোমাদের সাথে যায়েদের মতবিরোধ দেখা দেয়, তাহলে তোমরা কুরআনকে কুরাইশদের বাক্যরীতি অনুযায়ী লিপিবদ্ধ করবে। কেননা তা এই রীতিতে নাযিল হয়েছে। তারা তাই করলেন। যখন তারা পুস্তকাকারে কুরআনের নতুন সংকলন তৈরির কাজ শেষ করলেন হযরত উসমান ( রাঃ ) মাসহাফে সিদ্দিকী হযরত হাফসা ( রাঃ ) এর কাছে ফেরত পাঠালেন। তিনি কুরআনের এক একটি সংকলন ইসলামী খেলাফতের বিভিন্ন অঞ্চলে পাঠিয়ে দিলেন। তিনি আরো নির্দেশ দিলেন, এই সংকলন ছাড়া আর যতো সংকলন রয়েছে তা যেন আগুনে জালিয়ে দেয়া হয়।
অধঃস্তন রাবী ইবনে শিহাব যুহরী বলেন, যায়েদ ইবনে সাবিতের পুত্র আমাকে বলেছেন, তিনি তাঁর পিতাকে বলতে শুনেছেন, আমরা যখন এই মাসহাফে উসমানী সংকলন করছিলাম তখন আমি সূরা আহযাবের একটি আয়াত খুঁজে পাচ্ছিলাম না যা আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে পড়তে শুনেছি। আমি এ আয়াতের খজে লেগে গেলাম। তা খুজাইমা ইবনে সাবিত আনসারী ( রাঃ ) এর কাছে পাওয়া গেলো। আয়াতটি হচ্ছে—“মিনাল মুমিনিনা রিজালুন সাদাকু মা আহাদুল্লাহ আলাইহি—– ”। অতএব আমরা তা এই মাসহাফে উল্লেখিত সূরায় সংযোজন করলাম। —– ( বুখারী )
হযরত হুজাইফাহ ইবনুল ইয়ামানের ( রাঃ ) শংকিত হওয়ার কারন ছিল এই যে, লোকদেরকে যেহেতু নিজ নিজ আঞ্চলিক রীতিতে কুরআন পাঠ করার অনুমতি দেয়া হয়েছিল— এজন্য পরবর্তীকালে যখন বড় বড় যুদ্ধ সংঘটিত হল এবং আরবের বিভিন্ন এলাকার লোকেরা এসে সেনাবাহিনীতে যোগদান করে বিভিন্ন এলাকায় যুদ্ধ করতে যায় সেখানে তাঁদের মধ্যে কুরআনের পাঠ নিয়ে মতবিরোধ দেখা দেয়। এই অবস্থা দেখে হযরত হুজাইফাহ ইবনুল ইয়ামান ( রা; ) অস্থির হয়ে পড়েন। তিনি শংকিত অবস্থায় হযরত উসমান ( রাঃ ) এর দরবারে হাযির হন। তিনি তাঁকে বললেন, আপনি এই উম্মাতের কথা চিন্তা করুন। তা না হলে তাঁদের মধ্যে কুরআন নিয়ে এমন কঠিন মতবিরোধ সৃষ্টি হয়ে যাবে— যেরূপ তাওরাত ও ইঞ্জীল কিতাব নিয়ে পর্যায়ক্রমে ইহুদী এবং খ্রিষ্টানদের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে। সুতরাং হযরত উসমান ( রাঃ ) বিষয়টির নাজুকতাকে সামনে রেখে কুরআনের একটি নিখুঁত সংকলন তৈরি করার ব্যবস্থা করে দিলেন।
অতপর উসমান ( রাঃ ) এই সংকলনকে অবশিষ্ট রেখে বাকি সব সংকলন জ্বালিয়ে দেয়ার নির্দেশ এজন্য দিলেন যে, লোকেরা যখন লেখা ও পড়ার উপযুক্ত হয়ে গেল তখন তারা নিজ নিজ গোত্রের বাক্যরীতি অনুযায়ী কুরআন শরীফ লিখেও নিয়েছিল। তাঁদের এই সংকলনগুলো যদি পরবর্তীকালে সংরক্ষণ করা হতো তাহলে হযরত উসমানের তত্ত্বাবধানে তৈরিকৃত এবং দেশের বিভিন্ন এলাকায় প্রেরিত সংকলনের সাথে বিরোধ দেখা দিত। বিভিন্ন রকমের সংশয়ের সৃষ্টি হতো। এজন্য যার যার কাছে লিখিত কুরআন বা তাঁর অংশ বিশেষ, এমনকি কোন আয়াত ছিল তাও তাঁদের কাছ থেকে ফেরত নিয়ে তা জ্বালিয়ে দেয়া হয়। সাথে সাথে এই মর্মে সরকারী নির্দেশ জারি করা হয় যে, সরকারী তত্ত্বাবধানে কুরআনের যে সংকলন তৈরি করা হয়েছে, এটাই এখন আসল নোসখা হিসাবে গণ্য হবে। যে ব্যক্তি কুরআনের নিজস্ব কপি তৈরি করতে চায় সে এই সরকারী নোসখা দেখেই তা তৈরি করবে। এভাবে ভবিষ্যতের জন্য কুরআনের লেখন ও পঠন মাসহাফে উসমানীর উপর সীমাবদ্ধ করে দেয়া হয়।
যায়েদ ইবনে সাবিত ( রাঃ ) বলেছেন, সূরা আহযাবের একটি আয়াত আমি কেবল হযরত খুজাইমা আনসারীর ( রাঃ ) কাছে পেয়েছি। এক্ষেত্রে লক্ষ্য রাখা দরকার যে, হযরত আবু বকরের ( রাঃ ) যুগে যে মাসহাফ লেখা হয়েছিলো— মনে হয় এর কাগজ খুব শক্ত ছিল না। খুব সম্ভব ঐ আয়াতটি দুর্বল কাগজে লিপিবদ্ধ ছিল। মাসহাফে উসমানী নকল করার সময় পরিস্কার ভাবে তাঁর পাঠোদ্ধার করা যায় নি। তাই এ সম্পর্কে অনুসন্ধান করার প্রয়োজন দেখা দেয়। তাছাড়া আরো লক্ষ্য করার বিষয়, যায়েদ ইবনে সাবিতের যদিও স্মরণে ছিল যে, উল্লেখিত আয়াতটি সূরা আহযাবের নির্দিষ্ট স্থানে ছিল, কিন্তু তবুও তিনি এমন ব্যক্তির খোঁজ করার প্রয়োজন মনে করলেন যার এ আয়াত মুখস্ত আছে। তাতে পরিস্কারভাবে প্রমান হয়ে যাবে যে, এ আয়াতটি মূলত কুরআন মাজিদেরই অংশ। খোঁজ করতে গিয়ে তিনি এ আয়াতটি খুজাইমা আনসারীর কাছে পেয়ে গেলেন। অতএব তিনি তা লিখে নিলেন।
কুরআন শরীফ লিখন ও সংরক্ষণের ব্যাপারে সাহাবাদের কঠোর সতর্কতা অনুমান করুন। স্বয়ং যায়েদের ( রাঃ ) এ আয়াত মুখস্ত ছিল এবং তিনি নিজেই মাসহাফে সিদ্দিকীতে তা লিপিবদ্ধ করেছেন। তাঁর এও মনে আছে যে, তিনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এ আয়াত পাঠ করতে শুনেছেন। এতদসত্ত্বেও তিনি কেবল নিজের স্মৃতির উপর নির্ভর করে তা কুরআনের অন্তর্ভুক্ত করে নেননি— যতক্ষন অন্তত একজন সাক্ষী এর স্বপক্ষে পাওয়া না গেছে।
সূরা সমূহের ক্রমবিন্যাস রাসুলুল্লাহ ( সাঃ ) করেছেন
আরবী***
৭৮। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি হযরত উসমান ( রাঃ ) কে বললাম, কি ব্যাপার, আপনি যে সূরা আনফালকে সূরা তাওবার সাথে মিলিয়ে দিয়েছেন? অথচ সূরা আনফালের আয়াত সংখ্যা হচ্ছে ৭৫ এবং সূরা তাওবার আয়াত সংখ্যা একশোর বেশী। ( আর যেসব সুরার আয়াত সংখ্যা শতের অধিক সেগুলো কুরআন শরীফের প্রথম দিকে রাখা হয়েছে। তাছাড়া আপনি এই সূরা দুটির মাঝখানে বিসমিল্লাহ লিখেননি। আপনি সূরা আনফালকে প্রথম দিককার বৃহৎ সাতটি সুরার অন্তর্ভুক্ত করে দিয়েছেন— এর কারন কি? অথচ এর আয়াত সংখ্যা একশোর কম। )
উসমান ( রাঃ ) জবাবে বললেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নীতি এই ছিল যে, লম্বা সূরা সমূহ নাযিল হওয়ার যুগে যখন তাঁর উপর কোন আয়াত নাযিল হতো তিনি তাঁর কোন কাতিবকে ডেকে বলতেন, যে সূরায় এই এই বিষয় আলোচিত হয়েছে তাঁর মধ্যে এই আয়াত লিখে রাখো। এভাবে যখন কোন আয়াত তাঁর উপর নাযিল হতো, তিনি বলতেন- এ আয়াতটি অমুক সূরায় সংযোজন করো যাতে এই এই বিষয়ের উল্লেখ রয়েছে। সূরা আনফালও মদিনায় প্রথম দিকে নাযিল হওয়া সূরা সমূহের অন্তর্ভুক্ত। ( বদরের যুদ্ধের পরে এই সূরা নাযিল হয় ) আর সূরা তাওবা মাদানী যুগের শেষ দিকে নাযিল হওয়া সূরা সমূহের অন্তর্ভুক্ত। এই সূরা দুটির বিষয়বস্তুর মধ্যে যদিও সামঞ্জস্য রয়েছে কিন্তু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর জীবদ্দশায় আমাদেরকে পরিস্কারভাবে একথা বলেননি যে, সূরা আনফাল সূরা তাওবারই অংশ। এজন্য আমি এই সুরা দুটিকে পৃথক পৃথক এবং পাশাপাশি রেখেছি এবং এর মাঝখানে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম লিখিনি। এটাকে আমি বৃহৎ সাতটি সুরার অন্তর্ভুক্ত করেছি। — ( মুসনাদে আহমাদ, তিরমিযি, আবু দাউদ )
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নির্দেশ—“এই আয়াতকে অমুক সুরার অন্তর্ভুক্ত করো যার মধ্যে অমুক বিষয় আলোচিত হয়েছে”—- এতে প্রমান হচ্ছে যে, তিনি নিজেই সূরা সমূহের নামকরন করেছেন, তিনি বিষয়বস্তুর ভিত্তিতে এর নামকরন করেননি। অথচ বিভিন্ন সুরার নাম কেবল ( সুরার ) নিদর্শন হিসাবেই রাখা হয়েছে। যেমন দ্বিতীয় সুরার নাম ‘আল বাকারা’—রাখার কারন এই নয় যে, তাতে গাভীর সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। বরং এটা কেবল এজন্য রাখা হয়েছে যে, এই সুরার এক স্থানে গাভীর উল্লেখ আছে।
এ হাদীস থেকে দ্বিতীয় যে কথাটি জানা যায়, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়া সাল্লাম তাঁর জীবদ্দশায় সূরাগুলোর ক্রমিক বিন্যাস করতে থেকেছেন। অপর একটি হাদীস থেকে জানা যায়, তিনি এও বলতেন—“এই আয়াতকে অমুক আয়াতের পূর্বে এবং অমুক আয়াতের পরে ( দুই আয়াতের মাঝখানে ) সংযোজন করো।” এভাবে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগেই এক একটি সুরার ক্রমিক বিন্যাসও সম্পন্ন করা হয়েছিলো এবং তা পূর্ণাংগভাবে লিখেও রাখা হয়েছিলো। যখন নামাযে কুরআন মাজীদ পাঠ করা হতো তখন এর কোন ক্রমবিন্যাস ছাড়া তা পড়াও সম্ভব ছিল না। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে ক্রমিক ধারা অনুযায়ী বিভিন্ন সূরা লেখাতেন, সেও ক্রমিকতা অনুযায়ী তা পড়া হতো। আর সেই ক্রমধারা অনুযায়ী লোকেরা তা শুনত।
সূরা আনফাল এবং সূরা তাওবার মধ্যে পারস্পরিক সামঞ্জস্য রয়েছে। উভয় সুরার মধ্যেই জিহাদের আলোচনা হয়েছে। দুই সুরাই একই ধরনের সমস্যা নিয়ে আলোচনা করে। উভয় সূরায়ই কাফের ও মুনাফিকদের কঠোর সমালোচনা করা হয়েছে। দুটি সুরাতেই জিহাদের বিধান বর্ণিত হয়েছে এবং আমাদেরকে জিহাদে যোগদান করার জন্য উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। এভাবে বিষয়বস্তুর দিক থেকে দুইটি সুরার মাঝে যথেষ্ট সাদৃশ্য রয়েছে।
এই সূরা দুটিকে পৃথক পৃথক ভাবেই রাখা হয়েছে। কিন্তু সূরাদ্বয়ের মাঝখানে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম লিপিবদ্ধ করা হয় নি। এ ব্যাপারে হযরত উসমান ( রাঃ ) এর ভাষ্য হচ্ছে— বিষয়বস্তুর সামঞ্জস্যের ভিত্তিতে এই সূরা দুটিকে পরস্পর পাশাপাশি রাখা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তা একই সূরায় পরিনত করা হয়নি। কেননা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর জীবদ্দশায় পরিস্কার ভাবে একথা বলেননি যে, এ দুটি একই সূরা, তাছাড়া রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের লেখানো পাণ্ডুলিপিতে সূরা তাওবার প্রারম্ভে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ লেখা পাওয়া যায় নি—এজন্য মাসহাফে উসমানীতেও তা লেখা হয় নি। বর্তমানেও আপনারা কুরআন শরীফ পাঠ করছেন— একটি সূরা শেষ করে অপর সূরা শুরু করছেন— কিন্তু এই সূরা দুটির মাঝখানে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ লেখা নাই। এ থেকে আপনারা অনুমান করতে পারেন সাহাবায়ে কেরাম কতটা দায়িত্ব নিয়ে কুরআন মাজীদ সংকলন করেছেন। যেহেতু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে লেখানো পাণ্ডুলিপিতে যে সূরা তাওবা পাওয়া গেছে তাঁর সাথে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ নেই ( যেমন আমরা হাদীস থেকে জানতে পাই ) এ কারনে মাসহাফে উসমানীতেও এই সুরার সাথে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ লেখা হয় নি।
— সমাপ্ত —