কুরআন ও কুরআনের মর্যাদা অনুধাবনের উপায়
কুরআন মাজীদকে বুঝতে হলে প্রারম্ভিক সুত্র হিসেবে এ কিতাব নিজে এবং এর উপস্থাপক হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে, মূল বিষয় বিবৃত করেছেন তা গ্রহন করতে হবে। এ মূল বিষয় নিম্নরূপ –
১। সমগ্র বিশ্ব জাহানের প্রভু, সৃষ্টিকর্তা, মালিক ও একচ্ছত্র শাসক সর্বশক্তিমান আল্লাহ তাঁর বিশাল সাম্রাজ্যের অংশ বিশেষ এ পৃথিবীতে মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। তাঁকে দান করেছেন জানার, বুঝার ও চিন্তা করার ক্ষমতা। ভালো ও মন্দের মধ্যে পার্থক্য করার, নির্বাচন, ইচ্ছা ও সংকল্প করার এবং নিজের ক্ষমতা ব্যবহার করার স্বাধীনতা দান করেছেন। এক কথায় মানুষকে একধরনের স্বাধীনতা ( Autonomy ) দান করে তাঁকে দুনিয়ায় নিজের খলিফা বা প্রতিনিধি পদে অভিষিক্ত করেছেন।
২। মানুষকে এই পদে নিযুক্ত করার সময় বিশ্ব জাহানের প্রভু সর্বশক্তিমান আল্লাহ মানুষের মনে একথা দৃঢ় বদ্ধমূল করে দিয়েছিলেন- আমিই তোমাদের এবং সমগ্র সৃষ্টিলোকের একমাত্র মালিক, মা’বুদ ও প্রভু। আমার এই সাম্রাজ্যে তোমরা স্বাধীন স্বেচ্ছাচারী নও, কারোর অধীন নও এবং আমার ছাড়া আর কারোর তোমাদের বন্দেগী, পূজা ও আনুগত্য লাভের অধিকারও নেই। দুনিয়ার এই জীবনে তোমাদেরকে কিছু স্বাধীন ক্ষমতা-ইখতিয়ার দিয়ে পাঠানো হয়েছে। এটি আসলে তোমাদের জন্যে পরীক্ষাকাল। এই পরীক্ষা শেষ হয়ে গেলে তোমাদের আমার কাছে ফিরে আসতে হবে। তোমাদের কাজগুলো যাচাই বাছাই করে আমি সিদ্ধান্ত নেবো তোমাদের মধ্য থেকে কে সফল হলো এবং কে হলো ব্যর্থ। তোমাদের জন্যে সঠিক কর্মনীতি একটিই- তোমরা আমাকে মেনে নেবে তোমাদের একমাত্র মা’বুদ এবং শাসক হিসেবে। আমি তোমাদের জন্যে যে বিধান পাঠাবো সেই অনুযায়ী তোমরা দুনিয়ায় কাজ করবে। দুনিয়াকে পরীক্ষাগৃহ মনে করে এই চেতনা মোতাবেক জীবন যাপন করবে যেন আমার আদালতে শেষ বিচারে সফলকাম হওয়াই তোমাদের জীবনের আসল উদ্দেশ্য হয়। বিপরীত পক্ষে এর থেকে ভিন্নতর প্রত্যেকটি কর্মনীতি তোমাদের জন্যে ভুল এবং বিভ্রান্তিকর। প্রথম কর্মনীতিটি গ্রহন করলে ( যেটি গ্রহন করার পূর্ণ স্বাধীন ক্ষমতা তোমাদের দেয়া হয়েছে ) তোমরা দুনিয়ায় শান্তি, নিরাপত্তা এবং নিশ্চিন্ততা লাভ করবে। তারপর আমার কাছে ফিরে আসলে আমি তোমাদের দান করবো চিরন্তন আরাম ও আনন্দের আবাস জান্নাত। আর দ্বিতীয় কর্মনীতিটি গ্রহন করলে ( যেটি গ্রহন করার পূর্ণ স্বাধীন ক্ষমতা তোমাদের দেয়া হয়েছে ) তোমাদের দুনিয়ায় বিপর্যয় ও অস্থিরতার মুখোমুখি হতে হবে এবং দুনিয়ার জীবন শেষ করে আখিরাতে প্রবেশ কালে সেখানে জাহান্নাম নামক চিরন্তন মর্মজ্বালা, দুঃখ, কষ্ট ও বিপদের গভীর গর্তে তোমরা নিক্ষিপ্ত হবে।
৩। এ কথা ভালোভাবে বুঝিয়ে দেয়ার পর বিশ্ব জাহানের মালিক সর্বশক্তিমান আল্লাহ মানব জাতিকে পৃথিবীতে বসবাস করার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। মানব জাতির দুই সদস্য ( আদম ও হাওয়া ) বিশিষ্ট প্রথম গ্রুপকে তিনি পৃথিবীতে জীবন যাপন করার জন্যে বিধান দান করেন। এই বিধান অনুযায়ী তাঁদের এবং তাঁদের সন্তান সন্তুতিদের দুনিয়ার সমস্ত কাজ কারবার চালিয়ে যেতে হবে। মানুষের এই প্রাথমিক বংশধরেরা মূর্খতা, অজ্ঞতা এবং অন্ধকারের মাঝে সৃষ্টি হননি। আল্লাহ পৃথিবীতে তাঁদের জীবন সূচনা করেন সম্পূর্ণ আলোর মধ্যে। তারা সত্যকে জানতেন। তাঁদেরকে জীবন বিধান ( ইসলাম ) দেয়া হয়েছিলো। আল্লাহর আনুগত্য ছিল তাঁদের জীবন পদ্ধতি। তারা তাঁদের সন্তানদেরকেও আল্লাহর আনুগত্য অনুযায়ী জীবন যাপন করতে শিখিয়ে গেছেন। কিন্তু পরবর্তীকালে শত শত বছরের জীবনাচরনে মানুষ ধীরে ধীরে এই সঠিক জীবন পদ্ধতি ( অর্থাৎ দ্বীন ) থেকে দূরে সরে গিয়ে বিভিন্ন ধরনের ভুল কর্মপদ্ধতি অবলম্বন করেছে। গাফলতির ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে একসময় তারা এই সঠিক জীবন পদ্ধতি হারিয়ে ফেলেছে। আবার শয়তানী প্ররোচনায় একে বিকৃতও করেছে। তারা পৃথিবী ও আকাশের মানবিক ও অমানবিক এবং কাল্পনিক ও বস্তুগত বিভিন্ন সত্ত্বাকে আল্লাহর সাথে তাঁর কাজ কারবারে শরীক করেছে। আল্লাহ প্রদত্ত যথার্থ জ্ঞানের ( আল ইলম ) মধ্যে বিভিন্ন প্রকার কল্পনা, ভাববাদ, মনগড়া মতবাদ ও দর্শনের মিশ্রন ঘটিয়ে তারা অসংখ্য ধর্মের সৃষ্টি করেছে। তারা আল্লাহ নির্ধারিত ন্যায়নিষ্ঠ ও ভারসাম্যপূর্ণ নৈতিক ও সাংস্কৃতিক নীতি ( শরীয়ত ) পরিহার বা বিকৃত করে নিজেদের প্রবৃত্তি, স্বার্থ ও ঝোঁক প্রবনতা অনুযায়ী জীবন যাপনের জন্যে নিজেরাই এমন বিধান তৈরি করেছে যার ফলে আল্লাহর এই যমীন জুলুম নিপীড়নে ভরে গেছে।
৪। আল্লাহ যদি তাঁর স্রষ্টাসুলভ ক্ষমতা প্রয়োগ করে বিপথগামী মানুষদেরকে জোর পূর্বক সঠিক কর্মনীতি ও জীবনধারার দিকে ঘুরিয়ে দিতেন তাহলে তা হতো মানুষকে আল্লাহ প্রদত্ত সীমিত স্বাধীনতা দান নীতির পরিপন্থী। আবার এ ধরনের বিদ্রোহ দেখার সাথে সাথেই তিনি যদি মানুষকে ধংস করে দিতেন তাহলে সেটি হতো সমস্ত মানব জাতিকে পৃথিবীতে কাজ করার জন্যে তিনি যে সময় ও সুযোগ নির্ধারণ করে দিয়েছেন তাঁর সাথে অসামঞ্জস্যশীল। সৃষ্টির প্রথম দিন থেকে তিনি যে দায়িত্বটি গ্রহন করেছিলেন সেটি ছিল এই যে, মানুষের স্বাধীনতা অক্ষুন্ন রেখে কাজের মাঝখানে যেসব সুযোগ সুবিধা দেয়া হবে তাঁর মধ্য দিয়েই তিনি তাঁকে পথ নির্দেশনা দেয়ার ব্যবস্থা করবেন। কাজেই নিজের উপর আরোপিত দায়িত্ব পালনের জন্যে তিনি মানব জাতির মধ্য থেকে এমন একদল লোককে ব্যবহার করতে শুরু করেন যারা তাঁর উপর ঈমান রাখতেন এবং তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে তাঁর নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করে যেতেন। এদেরকে তিনি করেন নিজের প্রতিনিধি। এদের কাছে পাঠান নিজের অলংঘনীয় বানী। যথার্থ সত্য জ্ঞান এবং জীবন যাপনের সঠিক বিধান এদেরকে দান করে তিনি বনী আদমকে ভুল পথ থেকে এই সহজ সত্য পথের দিকে ফিরে আসার দাওয়াত দেয়ার জন্যে এদেরকে নিযুক্ত করেন।
৫। এরা ছিলেন আল্লাহর নবী। বিভিন্ন দেশে এবং বিভিন্ন জাতির মধ্যে আল্লাহ তাঁর নবী পাঠাতে থাকেন। হাজার হাজার বছর থেকে তাঁদের এ আগমনের সিলসিলা বা ধারাবাহিকতা চলতে থাকে। তাঁদের সংখ্যা ছিল হাজার হাজার। তারা সবাই একই দীনের তথা জীবন পদ্ধতির অনুসারী ছিলেন। অর্থাৎ সৃষ্টির প্রথম দিন থেকেই মানুষকে যে সঠিক কর্মনীতির সাথে পরিচয় করানো হয়েছিলো তারা সবাই ছিলেন তাঁরই অনুসারী। তারা সবাই ছিলে একই হিদায়াতের প্রতি অনুগত। অর্থাৎ প্রথম দিন থেকেই মানুষের জন্যে নৈতিকতা এবং সমাজ সংস্কৃতির যে চিরন্তন নীতি নির্ধারণ করা হয়েছিলো তারা ছিলেন তাঁরই প্রতি অনুগত। তাঁদের সবার একই মিশন ছিল। অর্থাৎ তারা নিজেদের বংশধর, গোত্র ও জাতিকে এই দ্বীন ও হিদায়াতের দিকে আহবান জানান। তারপর যারা এ আহবান গ্রহন করে তাঁদেরকে সংগঠিত করে এমন একটি উম্মতে পরিনত করেন যারা নিজেরা হন আল্লাহর আইনের অনুগত এবং দুনিয়ায় আল্লাহর আইনের আনুগত্য কায়েম করার এবং তাঁর আইনের বিরুদ্ধচারন প্রবনতা প্রতিরোধ করার জন্যে প্রচেষ্টা ও সংগ্রাম চালাতে থাকেন। এই নবীগন প্রত্যেকেই তাঁদের নিজেদের যুগে অত্যন্ত সুচারুরূপে এ মিশনের দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু সব সময় দেখা গেছে মানব গোষ্ঠীর একটি বিরাট অংশ তাঁদের দাওয়াত গ্রহন করতে প্রস্তুতই হয়নি। আর যারা এই দাওয়াত গ্রহন করে উম্মতে মুসলীমার অঙ্গীভূত হয় তাঁরাও ধীরে ধীরে নিজেরাই বিকৃতির সাগরে তলিয়ে যেতে থাকে। এমনকি তাঁদের কোন কোন উম্মত আল্লাহ প্রদত্ত হিদায়াত একেবারেই হারিয়ে ফেলে। আবার কেউ কেউ আল্লাহর বানীর সাথে নিজেদের কথার মিশ্রন ঘটিয়ে এবং তাঁর মধ্যে পরিবর্তন সাধন করে তাঁর চেহারাই বিকৃত করে দেয়।
৬। সব শেষে বিশ্ব জাহানের প্রভু সর্বশক্তিমান আল্লাহ আরব দেশে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে পাঠান। ইতোপূর্বে বিভিন্ন নবীকে যে দায়িত্ব দিয়ে তিনি দুনিয়ায় পাঠিয়েছিলেন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপরও সেই একই দায়িত্ব অর্পণ করেন। সাধারন মানুষের সাথে সাথে পূর্বের নবীদের পথভ্রষ্ট উম্মতদেরকেও তিনি আল্লাহর দিকে আহবান জানান। সবাইকে সঠিক কর্মনীতি ও সঠিক পথ গ্রহনের দাওয়াত দেন। সবার কাছে নতুন করে আল্লাহর হিদায়াত পৌঁছে দেয়ার এবং এই দাওয়াত ও হিদায়াত গ্রহণকারীদেরকে এমন একটি উম্মতে পরিনত করাই ছিল তাঁর কাজ যারা একদিকে আল্লাহর হিদায়াতের উপর নিজেদের জীবন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করবে এবং অন্য দিকে সমস্ত দুনিয়ায় সংশোধন ও সংস্কার সাধনের প্রচেষ্টা ও সংগ্রাম চালাবে। এই দাওয়াত ও হিদায়াতের কিতাব হচ্ছে এই কুরআন। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর মহান আল্লাহ এই কিতাবটি অবতীর্ণ করেন।
কুরআনের মূল আলোচ্য
কুরআন সম্পর্কিত এই মৌলিক ও প্রাথমিক কথাগুলো জেনে নেয়ার পর পাথকদের জন্যে এই কিতাবের বিষয়বস্তু, এর কেন্দ্রীয় আলোচ্য বিষয় ও লক্ষ্য বিন্দু সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান লাভ করা সহজ হয়ে যায়।
এর বিষয়বস্তু মানুষ। প্রকৃত ও জাজ্বল্যমান সত্যের দৃষ্টিতে মানুষের কল্যাণ কিসে- এ কথাই কুরআনের মূল বিষয়বস্তু। এর কেন্দ্রীয় আলোচ্য বিষয় হচ্ছে এই যে, আপাত দৃষ্টি, আন্দাজ-অনুমান নির্ভরতা অথবা প্রবৃত্তির দাসত্ব করার কারনে মানুষ আল্লাহ, বিশ্ব জাহানের ব্যবস্থাপনা, নিজের অস্তিত্ব ও নিজের পার্থিব জীবন সম্পর্কে যেসব মনগড়া মতবাদ গড়ে তুলেছে এবং ঐ মতবাদগুলোর উপর ভিত্তি করে যে দৃষ্টিভংগী ও কর্মনীতি অবলম্বন করেছে যথার্থ জাজ্বল্যমান সত্যের দৃষ্টিতে তা সবই ভুল ও ত্রুটিপূর্ণ এবং পরিনতির দিক দিয়ে তা মানুষের জন্যে ধংসকর। আসল সত্য তাই যা মানুষকে খলীফা হিসেবে নিযুক্ত করার সময় আল্লাহ নিজেই বলে দিয়েছিলেন। আর এই আসল সত্যের দৃষ্টিতে মানুষের জন্যে ইতোপূর্বে সঠিক কর্মনীতি নামে যে দৃষ্টিভঙ্গি ও কর্মনীতির আলোচনা করা হয়েছে তাই সঠিক, নির্ভুল ও শুভ পরিনতির দাবীদার।
এর চূড়ান্ত লক্ষ্য ও বক্তব্য হচ্ছে, মানুষকে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি ও কর্মনীতি অবলম্বনের প্রতি আহবান জানানো এবং আল্লাহর হিদায়াতকে দ্ব্যর্থহীনভাবে পেশ করা। মানুষ নিজের গাফলতি ও অসতর্কতার দরুন এগুলো হারিয়ে ফেলেছে এবং তাঁর শয়তানী প্রবৃত্তির কারনে সে এগুলোকে বিভিন্ন সময়ে বিকৃত করার কাজই করে এসেছে। এই তিনটি মৌলিক বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি রেখে কুরআন পাঠ করতে থাকলে দেখা যাবে এই কিতাবটি তাঁর সমস্ত পরিসরে কোথাও তাঁর বিষয়বস্তু, কেন্দ্রীয় আলোচ্য বিষয় এবং মূল লক্ষ্য ও বক্তব্য থেকে এক চুল পরিমাণও সরে পড়েনি। প্রথম থেকে নিয়ে শেষ পর্যন্ত তাঁর বিভিন্ন ধরনের বিষয়াবলী তাঁর কেন্দ্রীয় আলোচ্য বিষয়ের সাথে এমনভাবে সংযুক্ত আছে যেমনভাবে একটি মোতির মালার বিভিন্ন রঙের ছোট বড় মোতি একটি সুতোর বাঁধনে একসাথে, একত্রে একটি নিবিড় সম্পর্কে গাঁথা থাকে। কুরআনে আলোচনা করা হয় পৃথিবী ও আকাশের গঠনাকৃতির, মানুষ সৃষ্টির প্রক্রিয়া-পদ্ধতি এবং বিশ্ব জগতের নিদর্শন সমূহ পর্যবেক্ষণের ও অতীতের বিভিন্ন জাতির ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর। কুর্বানে বিভিন্ন জাতির আকীদা বিশ্বাস, নৈতিক চরিত্র ও কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করা হয়। অতি প্রাকৃতিক বিষয়াবলীর ব্যাখ্যা করা হয়। এই সাথে অন্যান্য আরো বহু জিনিসের উল্লেখও করা হয়। কিন্তু মানুষকে পদার্থ বিদ্যা, জীব বিজ্ঞান, ইতিহাস, দর্শন বা অন্য কোন বিদ্যা শিক্ষা দেয়ার জন্যে কুর্বানে এগুলো আলোচনা করা হয়নি। বরং প্রকৃত ও জাজ্বল্যমান সত্য সম্পর্কে মানুষের ভুল ধারনা দূর করা, যথার্থ সত্যটি মানুষের মনের মাঝে গেঁথে দেয়া, যথার্থ সত্য বিরোধী কর্মনীতির ভ্রান্তি ও অশুভ পরিনতি সুস্পষ্ট করা তুলে ধরা এবং সত্যের অনুরূপ ও শুভ পরিনতির অধিকারী কর্মনীতির দিকে মানুষকে আহবান করাই এর উদ্দেশ্য। এ কারনে এতে প্রতিটি বিষয়ের আলোচনা কেবলমাত্র ততটুকুই এবং সেই ভঙ্গিমায় করা হয়েছে যতটুকু এবং যে ভঙ্গিমায় আলোচনা করা হয় তাঁর মূল লক্ষ্যের জন্যে প্রয়োজন। প্রয়োজন মতো এসব বিষয়ের আলোচনা করার পর কুরআন সব সময় অপ্রয়োজনীয় বিস্তারিত আলোচনা বাদ দিয়ে নিজের উদ্দেশ্য ও কেন্দ্রীয় আলোচ্য বিষয়ের দিকে ফিরে এসেছে। একটি সুগভীর ঐক্য ও একাত্মতা সহকারে তাঁর সমস্ত আলোচনা ‘ইসলামী দাওয়াতের’ কেন্দ্রবিন্দুতে ঘুরছে———–।
কুরআন অধ্যয়নের পদ্ধতি
কুরআন একটি অসাধারন গ্রন্থ। দুনিয়ার অসংখ্য মানুষ অসংখ্য উদ্দেশ্য নিয়ে কুরআনের দিকে এগিয়ে আসে। এদের সবার প্রয়োজন ও উদ্দেশ্যের প্রতি দৃষ্টি রেখে কোন পরামর্শ দেয়া মানুষের পক্ষে সম্ভবপর নয়। এই বিপুল সংখ্যক অনুসন্ধানীদের মধ্যে যারা একে বুঝতে চান এবং এ কিতাবটি মানুষের জীবন সমস্যার সমাধানের ক্ষেত্রে কোন ধরনের ভুমিকা পালন করে এবং তাঁকে কিভাবে পথ দেখায়- একথা জানতে চান- আমি কেবল তাঁদের ব্যাপারেই আগ্রহী। এই ধরনের লোকদের কুরআন অধ্যয়নের পদ্ধতি সম্পর্কে আমি এখানে কিছু পরামর্শ দেবো। আর এই সংগে সাধারন লোকেরা এ ব্যাপারে যেসব সমস্যার সম্মুখীন হয় তারও সমাধান করার চেষ্টা করবো। কোন ব্যক্তি কুরআনের উপর ঈমান রাখুন আর নাই রাখুন তিনি যদি এই কিতাবকে বুঝতে চান তাহলে সর্বপ্রথম তাঁকে তাঁর নিজের মন- মস্তিষ্ককে পূর্ব প্রতিষ্ঠিত চিন্তাধারা ও মতবাদ এবং অনুকূল – প্রতিকুল উদ্দেশ্য ও স্বার্থ চিন্তা থেকে যথাসম্ভব মুক্ত করতে হবে। এ কিতাবটি বুঝার ও হৃদয়ঙ্গম করার নির্ভেজাল ও আন্তরিক উদ্দেশ্য নিয়ে এর অধ্যয়ন শুরু করতে হবে। যারা মনের মধ্যে বিশেষ ধরনের চিন্তাধারা পূর্বে রেখে এ কিতাবটি পড়েন তারা এর বিভিন্ন ছত্রের মাঝখানে নিজেদের চিন্তাধারাই পড়ে যেতে থাকেন। আসল কুরআনের সামান্য বাতাসটুকুও তাঁদের গায়ে লাগেনা। দুনিয়ার যেকোন বই পড়ার ব্যাপারেও এ ধরনের অধ্যয়ন রীতি ঠিক নয়। আর বিশেষ করে কুরআন তো এই ধরনের পাঠকদের জন্যে তাঁর অন্তর্নিহিত সত্য ও গভীর তাৎপর্যময় অর্থের দুয়ার কখনোই উন্মুক্ত করে না।
তারপর যে ব্যক্তি কুরআন সম্পর্কে ভাসাভাসা জ্ঞান লাভ করতে চায় তাঁর জন্য সম্ভবত একবার পড়ে নেয়াই যথেষ্ট। কিন্তু যে এর অর্থের গভীরে নামতে চায় তাঁর জন্যে তো দুইবার পড়ে নেয়াও যথেষ্ট হতে পারে না। অবশ্যই তাঁকে বার বার পড়তে হবে। প্রতি বার একটি নতুন ভংগিমায় পড়তে হবে। একজন ছাত্রের মতো পেন্সিল ও নোট বই সাথে নিয়ে বসতে হবে। জায়গা মতো প্রয়োজনীয় বিষয় নোট করতে হবে। এভাবে যারা কুরআন পড়তে প্রস্তুত হবে, কুরআন যে চিন্তা ও কর্মধারা উপস্থাপন করতে চায় তাঁর সামগ্রিক ব্যবস্থাপনটা যেন তাঁদের সামনে ভেসে উঠে- কেবলমাত্র এই উদ্দেশ্যেই তাঁদের অন্ততপক্ষে দুইবার এই কিতাবটি পড়তে হবে। এই প্রাথমিক অধ্যয়নের সময় তাঁদের কুরআনের সমগ্র বিষয়বস্তুর ওপর ব্যাপক ভিত্তিক জ্ঞান লাভ করার চেষ্টা করতে হবে। তাঁদের দেখতে হবে, এই কিতাবটি কোন কোন মৌলিক চিন্তা পেশ করে এবং সে চিন্তাধারার উপর কিভাবে জীবন ব্যবস্থার অট্টালিকার ভিত গড়ে তোলে? এ সময়কালে কোন জায়গায় তাঁর মনে যদি কোন প্রশ্ন জাগে বা কোন খটকা লাগে, তাহলে তখনি সেখানেই সেসম্পর্কে কোন সিদ্ধান্ত না নিয়ে বরং সেটি নোট করে নিতে হবে এবং ধৈর্যসহকারে সামনের দিকে অধ্যয়ন জারী রাখতে হবে। সামনের দিকে কোথাও না কোথাও তিনি এর জবাব পেয়ে যাবেন, এরি সম্ভাবনা বেশী। জবাব পেয়ে গেলে নিজের প্রশ্নের পাশাপাশি সেটি নোট করে নেবেন। কিন্তু প্রথম অধ্যয়নের পর নিজের কোন প্রশ্নের জবাব না পেলে ধৈর্য সহকারে দ্বিতীয় বার অধ্যয়ন করতে হবে। আমি নিজের অভিজ্ঞতায় বলতে পারি, দ্বিতীয় বার গভীর মনোযোগ সহকারে অধ্যয়ন করার পর কালেভদ্রে কোন প্রশ্নের জবাব অনুদঘাটিত থেকে গেছে।
এভাবে কুরআন সম্পর্কে একটি ব্যাপক দৃষ্টিভঙ্গী লাভ করার পর এর বিস্তারিত অধ্যয়ন শুরু করতে হবে। এ প্রসঙ্গে পাঠককে অবশ্যি কুরআনের শিক্ষার এক একটি দিক পূর্ণরূপে অনুধাবন করার পর নোট করে নিতে হবে। যেমন মানবতার কোন ধরনের আদর্শকে কুরআন পসন্দনীয় গণ্য করেছে অথবা মানবতার কোন ধরনের আদর্শ তাঁর কাছে ঘৃণার্হ এবং প্রত্যাখ্যাত এ কথা তাঁকে বুঝার চেষ্টা করতে হবে। এ বিষয়টিকে ভালোভাবে নিজের মনের মধ্যে গেঁথে নেয়ার জন্যে তাঁকে নিজের নোট বুকের মধ্যে একদিকেলিখতে হবে ‘পসন্দনীয় মানুষ’ আবার আওন্নদিকে লিখতে হবে ‘অপসন্দনীয় মানুষ’ এবং উভয়ের নীচে তাঁদের গুনাবলী ও বৈশিষ্ট্য লিখতে রাখতে হবে। অথবা যেমন, তাঁকে জানার চেষ্টা করতে হবে, কুরআনের দৃষ্টিতে মানুষের কল্যাণ ও মুক্তি কোন কোন বিষয়ের উপর নির্ভরশীল এবং কোন কোন জিনিসকে সে মানবতার জন্যে ক্ষতিকর ও ধংসাত্নক গণ্য করে – এ বিষয়টিকেও সুস্পষ্ট ও বিস্তারিতভাবে জানার জন্যে আগের পদ্ধতিই অবলম্বন করতে হবে। অর্থাৎ নোট বইতে কল্যাণের জন্য ‘অপরিহার্য বিষয় সমূহ’ এবং ক্ষতির জন্য ‘অনিবার্য বিষয় সমূহ’ – এই শিরোনাম দুটি পাশাপাশি লিখতে হবে। অতঃপর প্রতিদিন কুরআন অধ্যয়ন করার সময় সংশ্লিষ্ট বিষয় দুটি সম্পর্কে নোট করে যেতে হবে। এ পদ্ধতিতে আকীদাহ-বিশ্বাস, চরিত্র-নৈতিকতা, অধিকার, কর্তব্য, সমাজ, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, রাজনীতি, আইন, দলীয় সংগঠন- শৃঙ্খলা, যুদ্ধ, সন্ধি এবং জীবনের অন্যান্য বিষয়াবলী সম্পর্কে কুরআনের বিধান নোট করতে হবে এবং এর প্রতি বিভাগের সামগ্রিক চেহারা কী দাড়ায়, তারপর এগুলোকে একসাথে মেলালে কোন ধরনের জীবন চিত্র ফুটে ওঠে, তা অনুধাবন করার চেষ্টা করতে হবে। আবার জীবনের বিশেষ কোন সমস্যার ব্যাপারে অনুসন্ধান চালাতে হলে এবং সে ব্যাপারে কুরআনের দৃষ্টিভঙ্গি জানতে হলে সেই সমস্যা সম্পর্কিত প্রাচীন ও আধুনিক সাহিত্য গভীরভাবে অধ্যয়ন করতে হবে। এই অধ্যয়নের মাধ্যমে তাঁকে সংশ্লিষ্ট সমস্যার মৌলিক বিষয়গুলো সুস্পষ্টভাবে জেনে নিতে হবে। মানুষ আজ পর্যন্ত সে সম্পর্কে কি কি চিন্তা করেছে এবং তাঁকে কিভাবে অনুধাবন করেছে? কোন কোন বিষয় এখনো সেখানে সমাধানের অপেক্ষায় আছে? মানুষের চিন্তার গাড়ি কোথায় গিয়ে আটকে গেছে? এই সমাধানযোগ্য সমস্যা ও বিষয়গুলোকে সামনে রেখেই কুরআন অধ্যয়ন করতে হবে। কোন বিষয় সম্পর্কে কুরআনের দৃষ্টিভঙ্গি জানার এতিই সবচেয়ে ভালো এবং সুন্দর পথ। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে আমি বলতে পারি, এভাবে কোন বিষয়ে গবেষণা ও অনুসন্ধানের উদ্দেশ্যে অধ্যয়ন করতে থাকলে এমন সব আয়াতের মধ্যে নিজের প্রশ্নের উত্তর পাওয়ায় যাবে, যেগুলো ইতোপূর্বে কয়েকবার পড়া হয়ে থাকলেও এই তত্ত্ব সেখানে লুকিয়ে আছে একথা ঘুনাক্ষরেও মনে জাগে নি।
কুরআনের প্রানসত্তা অনুধাবন
কিন্তু কুরআন বুঝার এই সমস্ত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও যে কাজ করার বিধান ও নির্দেশ নিয়ে কুরআন এসেছে কার্যত ও বাস্তবে তা না করা পর্যন্ত কোন ব্যক্তি কুরআনের প্রানসত্তার সাথে পুরোপুরি পরিচিত হতে পারেনা। এটা নিছক কোন মতবাদ বা চিন্তাধারার বই নয়। কাজেই আরাম কেদারায় বসে বসে এ বইটি পড়লে এর সব কথা বুঝতে পারা যাবার কথা নয়। দুনিয়ার প্রচলিত ধর্ম চিন্তা অনুযায়ী এটি নিছক একটি ধর্ম গ্রন্থও নয়। মাদ্রাসায় ও খানকায় বসে এর সমস্ত রহস্য ও গভীর তত্ত্ব উদ্ধার করাও সম্ভব নয়। শুরুতে ভুমিকায় বলা হয়েছে, এটি একটি দাওয়াত এবং আন্দোলনের কিতাব। সে এসেই এক নিরব প্রকৃতির সৎ ও সত্যনিষ্ঠ ব্যক্তিকে নির্জন ও নিঃসংগ জীবন ক্ষেত্র থেকে বের করে এনে আল্লাহ বিরোধী দুনিয়ার মোকাবেলায় দাড় করিয়ে দিয়েছে। তাঁর কণ্ঠে যুগিয়েছে বাতিলের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদের ধ্বনি। যুগের কুফরী, ফাসেকী ও ভ্রষ্টতার পতাকাবাহীদের বিরুদ্ধে তাঁকে প্রচণ্ড সংঘর্ষে লিপ্ত করেছে। সচ্চরিত্র সম্পন্ন সত্যনিষ্ঠ লোকদেরকে প্রতিটি গ্রহান্তর থেকে খুঁজে বের করে এনে সত্যের আহবায়কের পতাকাতলে সমবেত করেছে। দেশের প্রতিটি এলাকার ফিতনাবাজ ও বিপর্যয় সৃষ্টিকারীদেরকে বিক্ষুব্ধ ও উত্তেজিত করে সত্যানুসারীদের সাথে তাঁদের যুদ্ধ বাধিয়ে দিয়েছে। এক ব্যক্তির আহবানের মাধ্যমে নিজের কাজ শুরু করে খিলাফতে ইলাহিয়ার প্রতিষ্ঠা পর্যন্ত পূর্ণ তেইশ বছর এই কিতাবটি এই বিরাট ও মহান ইসলামী আন্দোলনের নেতৃত্ব প্রদান করেছে। হক ও বাতিলের এই সুদীর্ঘ এবং প্রানান্তকর সংঘর্ষকালে প্রতিটি মঞ্জিল ও প্রতিটি পর্যায়েই সে একদিকে ভাংগার পদ্ধতি শিখিয়েছে এবং অন্যদিকে পেশ করেছে গড়ার নকশা। এখন বলুন, যদি আপনি ইসলাম ও জাহেলিয়াত এবং দ্বীন ও কুফরীর সংগ্রামে অংশগ্রহণই না করেন, যদি এই দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের মনযিল অতিক্রম করার সুযোগই আপনার না ঘটে, তাহলে নিছক কুরআনের শব্দগুলো পাঠ করলে তাঁর সমুদয় তত্ত্ব কেমন করে আপনার সামনে উদ্ঘাটিত হয়ে যাবে? কুরআনকে পুরোপুরি অনুধাবন করা তখনই সম্ভব হবে যখন আপনি নিজেই কুরআনের দাওয়াত নিয়ে উঠবেন, মানুষকে আল্লাহর দিকে আহবান করার কাজ শুরু করবেন এবং এই কিতাব যেভাবে পথ দেখায় সেভাবেই পদক্ষেপ নিতে থাকবেন। একমাত্র তখনই, কুরআন নাযীলের সময়কালীন অভিজ্ঞতাগুলো আপনি লাভ করতে সক্ষম হবেন। মক্কা ও হাবশা ( বর্তমান ইথিওপিয়া ও তায়েফের মনজিলও আপনি দেখাবেন ) বদর ও উহুদ থেকে শুরু করে হুনাইন ও তাবুক পর্যন্ত মনজিল আপনার সামনে এসে যাবে। আপনি আবু জেহেল ও আবু লাহাবের মুখোমুখি হবেন। মুনাফিক ও ইহুদীদের সাক্ষাতও আপনি পাবেন। ইসলামের প্রথম যুগের উৎসর্গিত প্রান মুমিন থেকে নিয়ে দুর্বল হৃদয়ের মুমিন পর্যন্ত সবার সাথেই আপনার দেখা হবে। এটা এক ধরনের ‘সাধনা’। একে আমি বলি ‘কুরআনী সাধনা’। এই সাধনা পথে ফুটে ওঠে এক অভিনব দৃশ্য। এর যতগুলো মনযিল অতিক্রম করতে থাকবেন তাঁর প্রতিটি মনযিলে কুরআনের কিছু আয়াত ও সূরা আপনা আপনি আপনার সামনে এসে যাবে। তারা আপনাকে বলতে থাকবে – এই মনযিলে তারা অবতীর্ণ হয়েছিলো এবং সেখানে এই বিধানগুলো এনেছিল। সে সময় অভিধান, ব্যাকরন ও অলংকার শাস্ত্রীয় কিছু তত্ত্ব সাধকের দৃষ্টির অগোচরে থেকে যেতে পারে কিন্তু কুরআনের নিজের প্রানসত্তাকে তাঁর সামনে উন্মুক্ত করতে কার্পণ্য করবে, এমনটি কখনো হতে পারে না।
আবার এই সাধারন নিয়ম অনুযায়ী মানুষ ততক্ষন পর্যন্ত কুরআনের বিধানসমুহ, তাঁর নৈতিক শিক্ষাবলী, তাঁর অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিধি বিধান এবং জীবনের বিভিন্ন দিক ও বিভাগ সম্পর্কে তাঁর প্রনীত নীতি নিয়ম- ও আইনসমূহ বুঝতে পারবে না যতক্ষন না সে নিজের বাস্তব জীবনে এগুলো কার্যকর করে দেখবে। যে ব্যক্তির ব্যক্তিগত জীবনে কুরআনের অনুসৃতি নেই সে তাঁকে বুঝতে পারবে না। আর যে জাতির সমস্ত সামাজিক প্রতিষ্ঠান কুরআন বিবৃত পথ ও কর্মনীতির বিপরীত দিকে চলে তাঁর পক্ষেও এসবের সাথে পরিচিত হয়ে সম্ভবপর নয়।
কুরআনী দাওয়াতের বিশ্বজনীনতা
কুরআন সমগ্র বিশ্ব মানবতাকে পথ দেখাবার দাবী নিয়ে এগিয়ে এসেছে, এ কথা সবাই জানে। কিন্তু কুরআন পড়তে বসেই কোন ব্যক্তি দেখতে পায়, সে অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাঁর নাযিল হওয়ার সমকালীন আরববাসীদেরকে লক্ষ্য করেই তাঁর বক্তব্য পেশ করেছে। তবে কখনো কখনো মানব জাতি ও সাধারন মানুষকেও সম্বোধন করা হয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে সে এমন সব কথা বলে যা আরববাসীদের রুচি-অভিরুচি, আরবের পারিপার্শ্বিক পরিবেশ, ইতিহাস ও রাজনীতির সাথেই সম্পর্কিত। এসব দেখে এক ব্যক্তি চিন্তা করতে থাকে, সমগ্র মানব জাতিকে পথ দেখাবার জন্যে যে কিতাবটি অবতীর্ণ হয়েছিলো তাঁর মধ্যে সাময়িক, স্থানীয় ও জাতীয় বিষয়সমূহ ও উপাদান এতো বেশী কেন? এ বিষয়টির তাৎপর্য অনুধাবন না করার কারনে অনেকের মনে সন্দেহ জাগে ; তারা মনে করেন, সম্ভবত এ কিতাবটি সমকালীন আরববাসীদের সংশোধন ও সংস্কারের জন্যে অবতীর্ণ হয়েছিলো কিন্তু পরবর্তীকালে জোর পূর্বক টানা হেঁচড়া করে তাঁকে চিরন্তনভাবে সমগ্র মানব জাতির জন্য জীবন বিধান রূপে গণ্য করা হয়েছে।
যে ব্যক্তি নিছক অভিযোগ হিসেবে নয় বরং বাস্তবে কুরআন বুঝার জন্যে এ ধরনের অভিযোগ আনেন তাঁকে আমি একটি পরামর্শ দেবো। প্রথমে কুরআন পড়ার সময় সেই সব স্থানগুলো একটু দাগিয়ে রাখুন যেখানে কুরআন কেবলমাত্র আরবদের জন্য এবং প্রকৃত পক্ষে স্থান, কাল ও সময় ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ এমন আকীদা- বিশ্বাস, চিন্তা বা ভাবধারা অথবা নৈতিক বিধান বা কার্যকর নিয়ম কানুন উপস্থাপন করা হয়েছে। কুরআন একটি বিশেষ স্থানে একটি বিশেষ যুগের লোকদেরকে সম্বোধন করে তাঁদের মুশরীকি বিশ্বাস ও রীতি নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায় এবং তাঁদের আসে পাশের জিনিসগুলোকে ভিত্তি করে তাওহীদের পক্ষে যুক্তি ও প্রমান দাড় করায়- নিছক এতোটুকু কথার ভিত্তিতে কুরআনের দাওয়াত ও তাঁর আবেদন স্থানীয় ও সাময়িক- এ কথা বলা যথেষ্ট হবে না। এ ক্ষেত্রে দেখতে হবে, শিরকের প্রতিবাদে সে যা কিছু বলে তা কি দুনিয়ার অন্যান্য প্রতিটি শিরকের ব্যাপারে ঠিক তেমনিভাবে খাপ খেয়ে যায় না যেমন আরবের মুশরিকদের শিরকের সাথে খাপ খেয়ে গিয়েছিলো? সেই একই যুক্তি প্রমাণগুলোকে কি আমরা প্রতিটি যুগের ও প্রতিটি দেশের মুশরিকদের চিন্তার পরিশুদ্ধির ক্ষেত্রে ব্যবহার করতে পারি না? আর তাওহীদের প্রমান ও প্রতিষ্ঠার জন্য কুরআনী প্রমা পদ্ধতিকে কি সামান্য রদবদল করে সব সময় ও সব জায়গায় কাজে লাগানো যেতে পারে না? জবাব যদি ইতবাচক হয়ে থাকে, তাহলে একটি বিশ্বজনীন শিক্ষা কেবলমাত্র একটি বিশেষ কালে একটি বিশেষ জাতিকে সম্বোধন করা দান করা হয়েছিলো বলেই তাঁকে স্থানীয় ও সাময়িক বলার কোন কারণই থাকতে পারে না। দুনিয়ার এমন কোন দর্শন, জীবন- ব্যবস্থা ও চিন্তা দর্শন নেই যার প্রথম থেকে নিয়ে শেষ পর্যন্ত সমস্ত কথাই বস্তু নিরপেক্ষ ( Abstract ) বর্ণনা ভংগিতে পেশ করা হয়েছে। বরং কোন একটি বিশেষ অবস্থা বা পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে তাঁর ব্যাখ্যা দান করা হয়েছে। এ ধরনের পূর্ণ বস্তু নিরপেক্ষতা সম্ভন নয়। আর সম্ভন হলেও তা নিছক কাজীর গরুর মতো খাতাপত্রেই থাকবে, গোয়ালে তাঁর নাম নিশানাও দেখা যাবে না। কাজেই মানুষের জীবনের সাথে সংযুক্ত হয়ে তাঁর পক্ষে কোন বাস্তব বিধানের রূপ নেয়া কোন দিনই সম্ভব হবে না।
তাছাড়া কোন চিন্তামূলক, নৈতিক, আদর্শিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সম্প্রসারিত করতে চাইলে তাঁর জন্যে আদৌ এর কোন প্রয়োজন নেই। বরং যথার্থই বলতে হয়, শুরু থেকেই তাঁকে আন্তর্জাতিক বানাবার চেষ্টা করা তাঁর জন্য কল্যাণকরও নয়। আসলে তাঁর জন্য সঠিক ও বাস্তব সম্মত পন্থা একটিই। এই আন্দোলনটি যেসব চিন্তাধারা, মতবাদ ও মুলনীতির ভিত্তিতে মানুষের জীবনের ব্যবস্থাকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়, তাঁকে পূর্ণ শক্তিতে সেই দেশেই প্রবেশ করতে হবে যেখান থেকে তাঁর দাওয়াতের সূচনা হয়েছে। সেই দেশের লোকদের মনে এই দাওয়াতের তাৎপর্য অঙ্কিত করে দিতে হবে, যাদের ভাষা, স্বভাব, প্রকৃতি, অভ্যাস ও আচরনের সাথে আন্দোলনের আহবায়ক নিজে সুপরিচিত। তারপর তাঁকে নিজের দেশেই ঐ মূলনীতিগুলো বাস্তবায়িত করে তাঁর ভিত্তিতে একটি সফল জীবন ব্যবস্থা পরিচালনার মাধ্যমে বিশ্ববাসীর সামনে আদর্শ স্থাপন করতে হবে। তবেই তো দুনিয়ার অন্যান্য জাতিরা তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হবে। তাঁদের বুদ্ধিজীবী শ্রেণী স্বতঃস্ফ্রুতভাবে এগিয়ে এসে তাঁকে অনুধাবন করতে ও নিজের দেশে প্রতিষ্ঠিত করতে সচেষ্ট হবে। কাজেই কোন চিন্তা ও কর্মব্যবস্থাকে প্রথমে শুধুমাত্র একটি জাতির সামনে পেশ করা হয়েছিলো এবং কেবলমাত্র তাদেরকেই বুঝাবার ও নিশ্চিন্ত করার জন্য যুক্তি প্রদর্শনের পূর্ণ শক্তি নিয়োগ করা হয়েছিল বলেই তা একটি নিছক জাতীয় দাওয়াত ও আন্দোলন- একথা বলার পেছনে কোন যুক্তি নেই। প্রকৃতপক্ষে একটি জাতীয় ও একটি আন্তর্জাতিক এবং একটি সাময়িক ও একটি চিরন্তন ব্যবস্থার মধ্যে যে পার্থক্য রয়েছে তার বিশেষত্বগুলোকে নিম্নোক্তভাবে চিহ্নিত করা যেতে পারে-
জাতীয় ব্যবস্থা হয় একটি জাতির শ্রেষ্ঠত্ব, আধিপত্য বা তাঁর বিশেষ অধিকারসমূহের দাবীদার। অথবা তাঁর নিজের মধ্যে এমন কিছু নীতি ও মতাদর্শ থাকে যা অন্যান্য জাতির মধ্যে ঠাই পেতে পারে না। বিপরীত পক্ষে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় সকল মানুষের মর্যাদা হয় সমান, তাঁদের সমান অধিকার দিতেও সে প্রস্তুত হয় এবং তাঁর নীতিগুলোর মধ্যেও বিশ্বজনীনতার সন্ধান পাওয়া যায়। অনুরূপভাবে একটি সাময়িক ব্যবস্থা অবশ্যি এমন কিছু নীতির ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয় যেগুলো কালের পরিবর্তনের সাথে সাথে তাঁর সমস্ত কার্যক্রম হারিয়ে ফেলে। আর এর বিপরীত পক্ষে একটি চিরন্তন ব্যবস্থার নীতিগুলো সব রকমের পরিবর্তিত অবস্থার সাথে খাপ খেয়ে চলে। এই বিশিষ্টগুলো দৃষ্টির সামনে রেখে যদি কোন ব্যক্তি কুরআন অধ্যয়ন করেন বা বিষয়গুলোর কারনে সত্যি সত্যিই কুরআন উপস্থাপিত ব্যবস্থাকে সামটিক বা জাতীয় হবার ধারনা পোষণ করা যেতে পারে তা নির্ধারণ করার চেষ্টা করেন, তাহলে তিনি পুরোপুরি ব্যর্থ হবেন, এতে সন্দেহ নেই।
পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান
কুরআন সম্পর্কে একজন সাধারন পাঠকও শুনেছেন যে, এটি একটি বিস্তারিত পথ নির্দেশনা, জীবন বিধান ও আইন গ্রন্থ। কিন্তু কুরআন পড়ার পর সেখানে সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতি ইত্যাদি সম্পর্কে বিস্তারিত নির্দেশনা ও বিধি- বিধানের সন্ধান সে পায় না। বং সে দেখে নামাজ ও যাকাতের মতো গুরুত্বপূর্ণ ফরযও, যার উপর কুরআন বার বার জোর দিয়েছে, তাঁর জন্যও এখানে যাবতীয় বিধি বিধান বিস্তারিতভাবে দান করা হয় নি। কাজেই এ কিতাবটি কোন অর্থে একটি পথ নির্দেশনা ও জীবন বিধান তা বুঝতে মানুষ অক্ষম হয়ে পড়ে। পাঠকের মনে এ সম্পর্কে সন্দেহ জাগে। সত্যের একটি দিক মানুষের দৃষ্টির সম্পূর্ণ আড়ালে থাকার কারনেই এ ব্যাপারে যাবতীয় সমস্যা ও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। অর্থাৎ মহান আল্লাহ কেবল এই কিতাবটি নাযিল করেন নি, তিনি এই সাথে একজন পয়গম্বরও পাঠিয়েছেন। আসল পরিকল্পনাটাই যদি হতো লোকদের হাতে কেবলমাত্র একটি গৃহ নির্মাণের নক্সা দিয়ে দেয়া এবং তারপর তারা সেই অনুযায়ী নিজেদের ইমারতটি নিজেরাই বানিয়ে নেবে, তাহলে এ অবস্থায় নিঃসন্দেহে গৃহ নির্মাণ সংক্রান্ত ছোট বড় প্রতিটি খুঁটি নাটি বিষয়ের বিস্তারিত বিবরন আমাদের হাতে দিয়ে দিতে হতো। কিন্তু গৃহ নির্মাণের নির্দেশের সাথে সাথে যখন একজন ইঞ্জিনিয়ার সরকারীভাবে নিযুক্ত করা হয় এবং তিনি ঐ নির্দেশ অনুযায়ী একটি ইমারাতও তৈরি করে ফেলেন তখন ইঞ্জিনিয়ার ও তাঁর ইমারাতটিকে উপেক্ষা করে কেবলমাত্র নকশার মধ্যে সমগ্র ছোট বড় খুঁটি নাটি বিষয়ের বিস্তারিত চিত্র সন্ধান করা এবং সেখানে তা না পেয়ে নক্সাটার বিরুদ্ধে অসম্পূর্ণতার অভিযোগ আনা কোনমতেই সঠিক হতে পারে না। কুরআন খুঁটি নাটি বিষয়ের বিস্তারিত বিবরন সম্বলিত কোন কিতাব নয়। বরং এই কিতাবে মূলনীতি ও মৌলিক বিষয়গুলোই উপস্থাপিত হয়েছে। এর আসল কাজ ইসলামী জীবন ব্যবস্থার চিন্তাগত ও নৈতিক ভিত্তিগুলোর কেবল পরিপূর্ণ বিশ্লেষণ সহকারে উপস্থাপনই নয় বরং এই সংগে বৈজ্ঞানিক যুক্তি-প্রমান ও আবেগময় আবেদনের মাধ্যমে এগুলোকে প্রচণ্ড শক্তিশালী ও দৃঢ়ভাবে সংকল্পবদ্ধ করা। অন্যদিকে ইসলামী জীবনধারার বাস্তব কাঠামো নির্মাণের ব্যাপারে কুরআন মানুষকে জীবনের প্রতিটি দিক ও বিভাগ সম্পর্কে বিস্তারিত রীতি-নিয়ম ও আইন বিধান দান করে না এবং জীবনের প্রতিটি বিভাগের চৌহদ্দি বাতলে দেয় এবং সুস্পষ্টভাবে এর কয়েকটি কোনে নিশান ফলক গেঁড়ে দেয়। এ থেকে আল্লাহর ইচ্ছানুযায়ী সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর গঠন ও নির্মাণ কোন পথে হওয়া উচিৎ, তা জানা যায়। এই নির্দেশনা ও বিধান অনুযায়ী বাস্তবে ইসলামী জীবন ধারার কাঠামো তৈরি করা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাজ ছিল। দুনিয়াবাসীর সামনে কুরআন প্রদত্ত মুলনীতির ভিত্তিতে গঠিত ব্যক্তি চরিত্র এবং সমাজ ও রাষ্ট্রের বাস্তব আদর্শ উপস্থাপন করার জন্যই তিনি নিযুক্ত হয়েছিলেন।
( তাফহীমুল কুরআনের ভূমিকা থেকে )