বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
কুরআন শিক্ষাদানকারীর মর্যাদা
আরবী****
১। হযরত উসমান ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি কুরআন শিক্ষা করে এবং অন্যদের তা শিক্ষা দেয়- তিনিই তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম। ( সহীহ বুখারী )
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বানীর তাৎপর্য এই যে, যে ব্যক্তি নিজে সর্বপ্রথম কুরআন থেকে হিদায়াত লাভ করে, অতঃপর আল্লাহর বান্দাদের কাছে তা পৌঁছানোর দায়িত্ব পালন করে – তোমাদের মধ্যে সেই সর্বোত্তম মানুষ।
কুরআনের শিক্ষাদান দুনিয়ার সর্বোত্তম ধন-সম্পদের চেয়েও উত্তম
আরবী*****
২। হযরত উকবা ইবনে আমের ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ( তাঁর হুজরা থেকে ) বেড়িয়ে আসলেন আমরা তখন সুফফায় ছিলাম। তিনি বললেন, তোমাদের কে এটা পছন্দ করে যে, সে প্রতিদিন বোথহান বা আকীকে যাবে এবং উচ্চ কুজ বিশিষ্ট দুটি উট নিয়ে আসবে কোনরূপ অপকর্ম বা আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা ছাড়াই? আমরা সবাই বললাম। হে আল্লাহর রাসুল, আমাদের প্রত্যেকেই এটা পছন্দ করে। তিনি বললেন, তোমাদের কোন ব্যক্তি মসজিদে যাবে এবং আল্লাহর কিতাব থেকে দুটি আয়াত লোকদের শিক্ষা দেবে অথবা পাঠ করবে, তার এ কাজ প্রতিদিন দুটি করে উট লাভ করার চেয়েও অধিক মূল্যবান। যদি সে তিনটি আয়াত শিক্ষা দেয় অথবা পড়ে তাহলে এটা তিনটি উট লাভ করার চেয়ে উত্তম। এভাবে যতগুলো আয়াত শিখানো হবে অথবা পড়বে তত সংখ্যক উট লাভ করার চেয়ে উত্তম। —–( সহীহ মুসলিম )
মসজিদের নববীর চত্তরকে সুফফা বলা হতো। এর উপরে ছাপরা দিয়ে তা মসজিদে নববীর সাথে জুড়ে দেয়া হয়েছিলো। মক্কা মুয়াযযামা এবং আরবের অন্যান্য এলাকা থেকে যেসব মুসলিম হিজরত করে মদিনায় এসেছিলেন তারাই এখানে অবস্থান করতেন। তাঁদের কোন বাড়ি-ঘরও ছিলো না এবং আয়- উপার্জনও ছিলো না। মদীনার আনসারগন এবং অপরাপর মুহাজিরগন যে সাহায্য করতেন তাতেই তাঁদের দিন চলতো। এসব লোক রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সম্মুখে সারাক্ষন উপস্থাইত থাকতেন। বলতে গেলে তারা ছিলেন একটি স্থায়ী আবাসিক প্রতিস্থানের ছাত্র। বোতহান এবং আকীক মদিনা তাইয়েবার সাথে সংযুক্ত দুটি উপত্যকার নাম। একটি মদিনার দক্ষিন পার্শে এবং অপরটি উত্তর-পশ্চিম পাশে অবস্থিত ছিল। এই দুটি উপত্যকা এখনো বর্তমান আছে। ততকালে এই দুই স্থানে উটের বাজার বসতো। হুজুর ( সাঃ ) অর্থহীন, সম্পদহীন সুফফাবাসীদের সম্বোধন করে বললেন, ভাই, তোমাদের কে দৈনিক বোতহান এবং আকীকে গিয়ে উচ্চ কুজ বিশিষ্ট দুটি করে উট বিনামূল্যে নিয়ে আসতে চায়? তারা আরজ করলেন- হে আল্লাহর রাসুল, আমাদের প্রত্যেকেই তা ভালবাসবে। অতঃপর তিনি বললেন- তোমাদের মধ্যে কেউ অপরকে কুরআনের দুটি আয়াত শিক্ষা দিলে তা বিনামূল্যে দুটি উৎকৃষ্ট উট লাভ করার চেয়েও উত্তম। এভাবে সে যতগুলো আয়াত কাউকে শিক্ষা দেবে তা তত পরিমান উট পাওয়ার চেয়েও উত্তম বলে বিবেচিত হবে। লক্ষ্য করুন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রশিক্ষন পদ্ধতি কি অসাধারন ছিল। তিনি জানতেন, এই সুফফাবাসীরা শুধু এ কারনে নিজেদের বাড়ি- ঘর পরিত্যাগ করে চলে এসেছেন যে, তারা আল্লাহর দ্বীনকে গ্রহন করে নিয়েছিলেন এবং পার্থিব সুযোগ- সুবিধাকে তারা মোটেই পছন্দ করতেন না। তাঁদেরকে বাধ্য হয়ে নিজেদের বাড়ি- ঘর ছেড়ে চলে আসতে হয়েছে। শয়তান তাঁদের এই নিঃসম্বল অবস্থার সুযোগ নিতে পারে এই আশংকায় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সুকৌশলে তাঁদের চিন্তাধারার মোড় ঘুরিয়ে দিলেন। এবং বললেন- তোমরা যদি আল্লাহর বান্দাদের কুরআন পাঠ করে শুনাও এবং তাঁদেরকে কুরআন শিক্ষা দাও তাহলে এটা তোমাদের হাতে বিনামূল্যে উট এসে যাওয়ার চেয়েও অধিক উত্তম হবে। তোমরা যদি অন্যদের কাছে গিয়ে তাঁদেরকে কুরআনের দুটি আয়াত শিখিয়ে দাও তাহলে এটা বিনামূল্যে দুটি ভালো উট লাভ করার চেয়ে অনেক কল্যাণকর। এভাবে তাঁদের মন- মগজে এ কথা বসিয়ে দেয়া হয়েছে যে, যদি তোমরা আল্লাহর দীনের উপর ঈমান এনে থাকো এবং এই দীনের খাতিরেই হিজরতের পথ বেছে নিয়ে এখানে এসে থাকো তাহলে এখন সেই দীনের কাজেই তোমাদের সময় এবং শ্রম ব্যয়িত হওয়া উচিৎ যে জন্য তোমরা বাড়ি- ঘর ছেড়ে চলে এসেছ। তোমরা দুনিয়াকে পাওয়ার আকাংখা করার পরিবর্তে বরং তোমাদের সময় দীনের কাজে ব্যয়িত হওয়া উচিৎ। এতে আল্লাহর সাথে তোমাদের সম্পর্ক গভীর থেকে গভীরতর হতে থাকবে এবং আল্লাহর সৃষ্টির সেবা করে এবং তাঁর বান্দাদের সত্য- ন্যায়ের পথ দেখিয়ে দিয়ে তোমরা আল্লাহ পাকের অনুগ্রহ লাভের অধিক উপযোগী হতে পারো।
এসব লোককেই তাঁদের ধৈর্য এবং সহিষ্ণুতার কারনে আল্লাহ তায়ালা পার্থিব জীবনেই বিশাল সাম্রাজ্যের মালিক বানিয়ে দিলেন। তারা নিজেদের জীবনেই দেখে নিলেন যে, মানুষ যদি ধৈর্য সহকারে আল্লাহর দীনের পথ অবলম্বন করে তাহলে এর ফল কি হয়।
কুরআন সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদ
আরবী****
৩। হযরত আবু হুরাইরাহ ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- তোমাদের কেউ নিজ বাড়িতে ফিরে গিয়ে তাঁর ঘরে তিনটি মোটা তাজা এবং গর্ভবতী উস্ট্রী পেতে কি পছন্দ করে? আমরা বললাম, হ্যাঁ। তিনি বললেন- তোমাদের কারো নামাজে কুরআনের তিনটি আয়াত পাঠ করা তিনটি মোটা তাজা এবং গর্ভবতী উস্ট্রীর মালিক হওয়ার তুলনায় অধিক কল্যাণকর। ——–( সহীহ মুসলিম )
মোটা তাজা ও গর্ভবতী উস্ট্রী আরবদের কাছে অত্যন্ত মূল্যবান সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হতো। এ জন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মাধ্যমে উদাহরণ পেশ করে বলেছেন- যদি তোমরা নামাজের মধ্যে কুরআনের তিনটি আয়াত পাঠ করো তবে টা তোমাদের ঘরে বিনামূল্যের তিনটি উট এসে হাজির হয়ে যাওয়ার চেয়ে অধিক কল্যাণকর। এই উদাহরণের মাধ্যমে রাসুলুল্লা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুসলমান সর্বসাধারণের মধ্যে এ কথা বদ্ধমূল করে দিতে চেয়েছেন যে, কুরআন তাঁদের জন্য কতো বড় রহমতের বাহন এবং কুরআনের আকারে কতো মূল্যবান সম্পদ তাঁদের হস্তগত হয়েছে। তাঁদের মনমগজে এই অনুভূতি জাগ্রত করা হয়েছে যে, তাঁদের কাছে যেটা বড় থেকে বিরাটতর সম্পদ হতে পারে – কুরআন এবং এর একটি আয়াত তাঁর চেয়েও অধিক বড় উত্তম সম্পদ।
কুরআন না বুঝে পাঠ করলেও কল্যাণের অধিকারী হওয়া যায়
আরবী****
৪। হযরত আয়েশা ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- কুরআনের জ্ঞানে পারদর্শী ব্যক্তি, কুরআন লিপিবদ্ধকারী সম্মানিত এবং পুতপবিত্র ফেরেশতাদের সাথে থাকবে। আর যে ব্যক্তি কুরআন পড়তে গিয়ে আটকে যায় এবং অতি কষ্টে তা পাঠ করে তাঁর জন্যে দ্বিগুণ পুরস্কার রয়েছে। ——–( বুখারী ও মুসলিম)
কুরআন মাজীদেই বলা হয়েছে, আল্লাহ তায়ালার দরবারে এই কুরআনকে মহাসম্মানিত এবং অতীব পবিত্র ফেরেশতাগণ লিপিবদ্ধ করে থাকেন। এ জন্য বলা হয়েছে – যে ব্যক্তি কুরআন থেকে জ্ঞান অর্জন করে, গভীর বুৎপত্তি সৃষ্টি করে এবং এ সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞানের অধিকারী হওয়ার চেষ্টা করে সে এই ফেরেশতাদের সাথী হবে। এর অর্থ এই নয় যে, সে এই ফেরেশতাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে। বরং এর অর্থ হচ্ছে এই যে, এই ফেরেশতারা যে স্থান ও মর্যাদা লাভ করেছে তাকেও সেই মর্যাদা ও স্থানের অধিকারী করা হবে।
কোন কোন লোক এরূপ ধারনা করে যে, কুরআন শরীফ শুধু তেলাওয়াত করে আর কি ফায়দা- যদি সে তা না বুঝে পাঠ করে। কিন্তু এরূপ ধারনা পোষণ করা ঠিক নয়। কুরআন শরীফ শুধু তেলাওয়াত করার মাঝেও অনেক ফায়দা আছে। যেমন আপনি দেখতে পাবেন, এমন অনেক গ্রাম্য প্রকৃতির লোক রয়েছে যার মুখের ভাষা পরিস্কার রূপে ফুটেনা। সে অনেক কষ্ট করে এবং মাঝে মাঝে আটকে যাওয়া সত্ত্বেও কুরআন পড়তে থাকে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সম্পর্কেও বলেছেন যে, – তাঁর জন্যও দ্বিগুণ পুরস্কার রয়েছে। একটি পুরস্কার কুরআন তেলাওয়াত করার এবং অপরটি কুরআন পড়ার জন্য কষ্ট স্বীকার করার বা পরিশ্রম করার।
এখন কথা হলো, না বুঝে কুরআন পড়ার কি লাভ? এ প্রসংগে আমার প্রশ্ন হচ্ছে- আপনি কি পৃথিবীতে কখনো এমন কোন লোক দেখেছেন যে ইংরেজী বর্ণমালা পড়ার পর ইংরেজী ভাষার কোন বই নিয়ে পড়তে বসে গেছে এবং এর কিছুই তাঁর বুঝে আসছে না। চিন্তা করুন, কোন ব্যক্তি কেবল এই কুরআনের সাথেই এরূপ পরিশ্রম কেন করে। সে আরবী বর্ণমালার প্রাথমিক বই নিয়ে কুরআন পাঠ শেখার অনুশীলন করে, শিক্ষকের সাহায্যে তা শেখার চেষ্টা করে, ধৈর্য সহকারে বসে তা পড়তে থাকে যদিও তাঁর বুঝে আসে না কিন্তু তবুও তা পড়ার চেষ্টা করতে থাকে – সে শেষ পর্যন্ত কেন করে থাকে? যদি তাঁর অন্তরে ঈমান না থাকতো, কুরআনের প্রতি তাঁর বিশ্বাস না থাকতো, সে যদি এটা মনে না করতো যে, কুরআন আল্লাহর কালাম এবং তা পাঠে বরকত ও কল্যাণ লাভ করা যায়- তাহলে শেষ পর্যন্ত সে এই শ্রম ও কষ্ট কেন স্বীকার করে? পরিস্কার কথা হচ্ছে কুরআন আল্লাহর কালাম এবং কল্যাণময় প্রাচুর্যময় কালাম – এই বিশ্বাস ও প্রত্যয় নিয়েই সে তা পাঠ করার জন্য কষ্ট স্বীকার করে। অতএব, প্রতিদান না পাওয়ার কোন কারণই থাকতে পারেনা।
আবার এ কথাও মনে করা ঠিক নয় যে, এমন ব্যক্তির জন্য কুরআন শিক্ষা করা এবং তা বুঝার জন্য উপযুক্ত হওয়ার চেষ্টা করা উচিৎ নয়। এ চেষ্টা তাঁকে অবশ্যই করতে হবে। কিন্তু যে লোক মনে করে যে, কুরআন যদি কারো বুঝে না আসে তবে তা পাঠ করা তাঁর জন্য অনর্থক এবং মূল্যহীন। এরূপ ধারনা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। কুরআন না বুঝে পড়ার মাঝেও নিশ্চিতই ফায়দা রয়েছে।
যার সাথে ঈর্ষা করা যায়
আরবী*****
৫। হযরত ইবনে উমর ( রঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- দুই ব্যক্তি ছাড়া কেউ ঈর্ষার পাত্র নয়। এক, যে ব্যক্তিকে আল্লাহ তায়ালা কুরআনের জ্ঞান দান করেছেন এবং সে দিনরাত তা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে ( অর্থাৎ নামাজে দণ্ডায়মান অবস্থায় তেলাওয়াত করছে অথবা তাঁর প্রচার- প্রসার বা শিক্ষা দেয়ার কাজে ব্যপৃত রয়েছে )। দুই, যে ব্যক্তিকে আল্লাহ তায়ালা ধন সম্পদ দান করেছেন এবং সে দিনরাত তা আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করে। —-( সহীহ বুখারী ও মুসলিম )
এ হাদীসের মাধ্যমে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঈমানদার- সম্প্রদায়ের চিন্তা চেতনায় যে কথা বসিয়ে দিয়েছেন, তা হচ্ছে- কোন ব্যক্তির পার্থিব উন্নতি, প্রাচুর্য এবং নামকাম কোন ঈর্ষার বস্তুই নয়। ঈর্ষার বস্তু কেবল দুই ব্যক্তি। এক, যে ব্যক্তি কুরআনের জ্ঞান অর্জন করেছে এবং সে দিনরাত নামাজের মধ্যে তা পাঠ করার জন্য দণ্ডায়মান থাকে, অথবা আল্লাহর বান্দাদের তা শেখানোর কাজে ব্যস্ত থাকে, তা শেখার জন্য মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে এবং এর প্রচার করে। দুই, যে ব্যক্তিকে আল্লাহ তায়ালা ধন সম্পদ দান করেছেন এবং সে তাঁর অপচয় না করে, বিলাসিতায় ও পাপ কাজে ব্যয় না করে বরং দিনরাত আল্লাহর নির্দেশিত পথে তা ব্যয় করে – – এ ব্যক্তিই ঈর্ষার পাত্র।
এই সেই শিক্ষা যার মাধ্যমে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম লোকদের দৃষ্টি ভঙ্গির আমূল পরিবর্তন সাধন করেন এবং তাঁদেরকে নতুন মূল্যবোধ দান করেন। তিনি তাঁদেরকে বলে দিলেন, মর্যাদা ও গুরুত্ব দান করার মতো জিনিস মূলত কি এবং মানবতার উচ্চতম নমুনাই বা কি যার ভিত্তিতে তাঁদের নিজেদের গঠন করার আকাংখা ও প্রচেষ্টা চালানো উচিৎ।
হাদীসের মূল পাঠে বিদ্বেষ শব্দ ব্যবহার করার পরিবর্তে ঈর্ষা শব্দ ব্যবহার করার কারন হচ্ছে – ঈর্ষার এমন একটি জিনিস যা হিংসা বিদ্বেষের মতো মানুষের মনে আগুন লাগিয়ে দেয় না। হিংসা বিদ্বেষ যদিও ঈর্ষারই একটি ভাগ কিন্তু তা এতটা তীব্র যে এর কারনে মানুষের মনে আগুনের মতো একটি উত্তপ্ত জিনিস লেগেই থাকে। হাসাদ যেন এমন একটি গরম পাত্র যা প্রায়ই সারা জীবন মানুষের মনে আগুন জালিয়ে রাখে। এজন্য এখানে ঈর্ষার আবেগের তীব্রতা প্রকাশ করার জন্যে হাসাদ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে।
হাসাদের মধ্যে মূলত দোষের কারন হচ্ছে এই যে, মানুষ চায় অমুক জিনিসটি সে না পেয়ে বরং আমি পেয়ে যাই অথবা তাঁর কাছ থেকে কেড়ে নেয়া হোক এবং আমাকে তা দেয়া হোক অথবা তা যদি আমার ভাগ্যে না জোটে তাহলে এটা যেন তারও হাতছাড়া হয়ে যায়। এটাই হচ্ছে হাসাদের মূল অর্থ। কিন্তু এখানে হাসাদ শব্দটি এই অর্থে ব্যবহার হয় নি।
এখানে কেবল ঈর্ষার অনুভুতির প্রখরতা ব্যক্ত করার জন্যই হাসাদ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। অর্থাৎ তোমাদের মনে যদি ঈর্ষার আগুন লাগতেই চায় তাহলে এই উদ্দেশ্যেই লাগা উচিৎ যে, তোমরা দিনরাত কুরআন শেখা এবং শেখানোর কাজে ব্যাপৃত থাকো। অথবা তুমি সম্পদশালী হয়ে থাকলে তোমার এই সম্পদ অকাতরে আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করো, রাতদিন সর্বদা আল্লাহর সৃষ্টির কল্যাণ সাধনের জন্য, তাঁর দীনের প্রচার- প্রতিষ্ঠার জন্য তা ব্যয় করতে থাকো। এভাবে তুমি অন্যদের জন্যও ঈর্ষার পাত্রে পরিনত হয়ে যাও।
কুরআন মাজীদের সাথে মুমিনের সম্পর্ক
আরবী****
৬। হযরত আবু মুসা আশয়ারী ( রঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- যে মুমিন কুরআন পাঠ করে সে কমলা লেবুর সাথে তুলনীয়। এর ঘ্রাণও উত্তম এবং স্বাদও উত্তম। আর যে মুমিন কুরআন পাঠ করে না সে খেজুরের সাথে তুলনীয়। এর কোন ঘ্রান নেই কিন্তু তা সুমিষ্ট। আর যে মুনাফিক কুরআন পাঠ করে না সে মাকাল ফল তুল্য। এর কোন ঘ্রাণও নেই এবং স্বাদও অত্যন্ত তিক্ত। আর যে মুনাফিক কুরআন পাঠ করে সে রাইহান ফলের সাথে তুলনীয়। এর ঘ্রান অত্যন্ত সুমিষ্ট কিন্তু স্বাদ অত্যন্ত তিক্ত। ———–( বুখারী ও মুসলিম )
অপর বর্ণনায় আছে, “যে মুমিন বাক্তি কুরআন পাঠ করে এবং তদানুযায়ী কাজ করে সে কমলা লেবু সদৃশ। আর যে মুমিন ব্যক্তি কুরআন পাঠ করে না কিন্তু তদানুযায়ী কাজ করে সে খেজুর তুল্য।”
কুরআন মাজীদের মর্যাদা ও মহানত্ত হৃদয়ঙ্গম করানোর জন্য রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কি অতুলনীয় দৃষ্টান্ত দিয়েছেন। অর্থাৎ কুরআন মাজীদ স্বয়ং একটি সুগন্ধী। মুমিন ব্যক্তি এর তেলাওয়াত করলেও সুগন্ধি ছড়াবে আর মুনাফিক ব্যক্তি পাঠ করলেও ছড়াবে।
অবশ্যই মুমিন এবং মুনাফিকের ব্যক্তিত্বের মধ্যে যে পার্থক্য তা ঈমান ও নিফাকের কারনেই হয়ে থাকে। মুমিন বাক্তি যদি কুরআন পাঠ না করে তাহলে তাঁর সুগন্ধি ছড়ায় না, কিন্তু তাঁর ব্যক্তিত্ব মিষ্টি ফলের মতই সুস্বাদু। কিন্তু যে মুনাফিক কুরআন পাঠ করেনা তাঁর সুগন্ধিও ছড়ায় না ও তাঁর ব্যক্তিত্ব তিক্ত এবং খারাপ স্বাদযুক্ত ফলের মতো।
অপর এক বর্ণনায় আছে- যে মুমিন ব্যক্তি কুরআন পাঠ করে এবং তদানুযায়ী আমল করে সে কমলা লেবু ফল- সদৃশ। আর যে মুমিন কোরআন পড়ে না কিন্তু তদানুযায়ী আমল করে সে খেজুরের সদৃশ। উল্লেখিত দুটি বর্ণনার মধ্যে পার্থক্য কেবলমাত্র এতোটুকু যে, এক বর্ণনায় কুরআন তেলাওয়াত এবং এর উপর ঈমান রাখার পরিনাম বর্ণনা করা হয়েছে এবং অপর বর্ণনায় কুরআন তেলাওয়াত এবং তদানুযায়ী কাজ করার পরিনাম বর্ণনা করা হয়েছে। মৌলিক দিক থেকে উভয়ের প্রানসত্ত্বা একই।
কুরআন হচ্ছে দুনিয়া ও আখিরাতের উন্নতি লাভের মাধ্যম
আরবী****
৭। হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব ( রঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- আল্লাহ তায়ালা এই কিতাবের ( কুরআন ) মাধ্যমে একদল লোককে উন্নত করবেন এবং অপর দলকে পতন ঘটাবেন। —– ( সহীহ মুসলিম )
এ হাদীসের তাৎপর্য হচ্ছে- যেসব লোক এই কিতাব নিয়ে দাঁড়িয়ে যাবে আল্লাহ তায়ালা তাঁদের উন্নতি বিধান করবেন এবং দুনিয়া ও আখিরাতে তাঁদের মস্তক সমুন্নত রাখবেন। কিন্তু যেসব লোক এই কিতাব নিয়ে অলস হয়ে বসে থাকবে এবং তদানুযায়ী কাজ করবেন। অথবা যেসব লোক এই কিতাবকে প্রত্যাখ্যান করবে আল্লাহ তায়ালা তাঁদেরকে নিম্নস্তরে নামিয়ে দেবেন। দুনিয়ায়ও তাঁদের জন্য কোন উন্নতি নেই এবং আখেরাতেও কোন সুযোগ- সুবিধা নেই।
কুরআন তেলাওয়াতের শব্দ শুনে ফেরেশতারা সমবেত হয়
আরবী****
৮। হযরত আবু সাঈদ খুদরী ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। উসাইদ ইবনে হুদাইর ( রাঃ ) বলেন যে, তিনি একরাতে নিজের ঘরে বসে নামাজের মধ্যে সূরা বাকারা পড়ছিলেন। তাঁর ঘোড়াটি নিকটেই বাধা ছিল। হঠাৎ ঘোড়াটি লম্ফ- ঝম্ফ শুরু করে দিলো। তিনি তখন তেলাওয়াত বন্ধ করলেন ঘোড়াটি শান্ত হয়ে গেলো। তিনি যখন পুনরায় তেলাওয়াত শুরু করলেন ঘোড়াটি আবার লাফ-ঝাপ শুরু করে দিলো। অতঃপর তিনি পাঠ বন্ধ করলেন। ঘোড়াটিও শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো। তিনি আবার কুরআন পড়া শুরু করলে ঘোড়াটিও দৌড়ঝাঁপ করতে লাগলো। তিনি সালাম ফিরিয়ে নামাজ শেষ করে নিলেন। কারন তাঁর ছেলে ইয়াহিয়া ঘোড়ার নিকটেই ছিল। তাঁর ভয় হল ঘোড়া হয়তো লাফালাফি করে ছেলেকে আহত করতে পারে। তিনি ছেলেকে এর কাছ থেকে সরিয়ে দিয়ে আসমানের দিকে মাথা তুললেন। তিনি ছাতার মত একটি জিনিস দেখতে পেলেন এবং তাঁর মধ্যে আলোকবর্তিকার মতো একটি জিনিস দেখলেন। সকালবেলা তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে গিয়ে এই ঘটনা বর্ণনা করলেন। তিনি বললেন- হে ইবনে হুদাইর, তুমি পড়তে থাকলে না কেন? হে ইবনে হুদাইর, তুমি পড়তে থাকলে না কেন? রাবী বলেন- আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল, আমার ভয় হল ঘোড়াটি না আবার আমার ছেলে ইয়াহিয়াকে পদদলিত করে। কেননা সে এর কাছেই ছিল। আমি নামাজ শেষ করে সালাম ফিরিয়ে ছেলেটির কাছে গেলাম। আমি আসমানের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে হঠাৎ দেখতে পেলাম- যেন একটি ছাতা এবং তাঁর মধ্যে একটি আলোকবর্তিকা জ্বলজ্বল করছে।
আমি ( ভয় পেয়ে ) সেখান থেকে চলে আসলাম ( অর্থাৎ খোলা আকাশের নীচ থেকে ) যেন আমার দৃষ্টি পুনরায় সেদিকে না যায়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন- তুমি কি জান এগুলো কি? তিনি বললেন, না। রাসুলুল্লাহ ( সাঃ ) বললেন- এরা ছিল ফেরেশতা। তোমার কুরআন পড়ার আওয়াজ শুনে তারা কাছে এসে গিয়েছিলো। তুমি যদি তেলাওয়াত অব্যাহত রাখতে তাহলে তারা ভর পর্যন্ত অপেক্ষা করতো এবং লোকেরা তাঁদের দেখে নিতো কিন্তু তারা লোক চক্ষুর অন্তরাল হতো না। —– ( বুখারী ও মুসলিম )
এটা কোন জরুরী কথা নয় যে, যখনই কোন ব্যক্তি কুরআন পাঠ করবে এবং সেও অনুরূপ ঘটনার সম্মুখীন হবে। স্বয়ং হযরত উসাইদ ইবনে হুদাইরের সামনে প্রত্যহ এরূপ ঘটনা ঘটতো না। তিনি তো সবসময়ই কুরআন পাঠ করতেন। কিন্তু এই দিন তাঁর সামনে এই বিশেষ ঘটনাটি ঘটে- যে সম্পর্কে আমরা জানি না যে, তা কেন ঘটলো। ইহা তাহার একটি বিশেষ ‘কারামাত’ যাহা সব সময় প্রকাশ পায় না। এই জন্যেই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে বলেননি যে, তোমার সামনে হামেশাই এরূপ ঘটনা ঘটবে। অর্থাৎ প্রতিদিন রাতে তুমি যদি এভাবে কুরআন তেলাওয়াত করতে থাকো তাহলে ভোরবেলা এরূপ ঘটনা ঘটবে যে, ফেরেশতারা দাঁড়িয়ে থাকবে আর লোকেরা তাদের দেখে নেবে। এর পরিবর্তে তিনি বলেছেন- পুনরায় যদি কখনো এরূপ ঘটে তাহলে তুমি নিশ্চিন্তে কুরআন তেলাওয়াত করতে থাকবে। এর মধ্যে কোন শংকার কারন নেই।
কিন্তু আজকাল আমরা এরূপ অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হচ্ছি না কেন? আসল কথা হচ্ছে আল্লাহ প্রত্যেকের সাথে এরূপ ঘটনা ঘটান না। তিনি তাঁর প্রতিটি মাখলুক এমনকি প্রতিটি ব্যক্তির সাথে ভিন্ন ভিন্ন আচরন করে থাকেন। তিনি প্রতিটি ব্যক্তিকেই সব কিছু দেননি। আর এমন কেউ নেই যাকে সব কিছু দেয়া হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বিভিন্ন ব্যক্তিকে বিভিন্নভাবে দিয়ে থাকেন।
কুরআন পাঠকারীদের উপর প্রশান্তি নাযিল হয়
আরবী****
৯। হযরত বারআ ইবনে আযেব ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, এক ব্যক্তি সূরা কাহফ পড়ছিল এবং তাঁর নিকটেই একটি ঘোড়া দুইটি দড়ি দিয়ে বাঁধা ছিল। এ সময় একটি মেঘখণ্ড তাঁর উপর ছায়া বিস্তার করলো এবং ধীরে ধীরে নীচে নেমে আসতে লাগলো। তা যতো নীচে আসতে থাকলো তাঁর ঘোড়া ততই দৌড়ঝাঁপ শুরু করে দিলো। যখন ভোর হল তখন সে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি অয়া সাল্লামের কাছে এসে তাঁকে এ সম্পর্কে অবহিত করলো। তিনি বললেন- এটা হলো প্রশান্তি যা কুরআনের সাথে নাযিল হচ্ছিলো। —( সহীহ বুখারী ও মুসলিম )
পূর্ববর্তী হাদীসে উল্লেখিত ফেরেশতাদের পরিবর্তে এখানে প্রশান্তি শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। প্রশান্তির পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা করা বড়ই কঠিন। কুরআন মাজীদে বিভিন্ন জায়গায় ‘সাকীনাহ’ ( প্রশান্তি ) শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। আল্লাহ তায়ালার সেই রহমত বা অনুগ্রহ যা মানুষের মনে প্রশান্তি, নিশ্চিন্ততা ও শীতলতা সৃষ্টি করে এবং মানুষকে আত্মিক দিক থেকে অনাবিল শান্তি অনুভব করে তাঁর জন্যে ‘সাকীনাহ’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়। আল্লাহর পক্ষ থেকে যদি বিশেষ সাহায্য আসতে থাকে তবে তা বুঝানোর জন্যেও এ শব্দটি ব্যবহার করা হয়। অতএব, এটা মুশকিল যে, এখানে কি এ শব্দটি ‘ফেরেশতা’ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে অথবা আল্লাহর এমন কোন করুনার কথা বুঝানো হয়েছে যা সেই ব্যক্তির নিকটতর হচ্ছিলো।
এরূপ ঘটনাও সবার ক্ষেত্রে সংঘটিত হয় না এবং স্বয়ং ঐ ব্যক্তির ক্ষেত্রে সব সময় ঘটেনি। এটা এমন একটি বিশেষ অবস্থা ছিল যা ঐ ব্যক্তির সামনে প্রতিভাত হয়েছিলো। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যদি এর অর্থ তাৎপর্য বলে দেয়ার জন্যে বর্তমান না থাকতেন তাহলে ঐ ব্যক্তি সব সময় অস্থিরতার মধ্যে কালাতিপাত করতো যে, তাঁর সামনে এটা কি ঘটে গেলো।
উল্লেখিত দুইটি হাদীসেই এই বিশেষ অবস্থায় ঘোড়ার দৌড় এবং লম্ফ-ঝম্ফের কথা বলা হয়েছে। আসল কথা হচ্ছে, কোন কোন সময় পশু-পাখি এমন সব জিনিস দেখতে পায় যা মানুষের চর্মচক্ষুতে দেখা যায় না। আপনারা হয়তো একথা পড়ে থাকবেন যে, ভূমিকম্প শুরু হওয়ার পূর্বেই পাখিরা লুকিয়ে যায়। চতুষ্পদ জন্তুগুলো পূর্বক্ষণেই জানতে পারে যে, কি ঘটতে যাচ্ছে। মহামারীর প্রাদুর্ভাব হওয়ার পূর্বেই কুকুর এবং অন্যান্য প্রানী চিৎকার শুরু করে দেয়। এর মূল কারন হচ্ছে, আল্লাহ তায়ালা এগুলোকে এমন কিছু ইন্দ্রীয় শক্তি দান করেছেন যা মানব জাতিকে দেওয়া হয় নি। এর ভিত্তিতে বাকশক্তিহীন প্রাণীগুলো এমন কতগুলি বিষয়ের জ্ঞান অথবা অনুভূতি লাভ করতে পারে যা মানুষের জ্ঞান অনুভুতির সীমা বহির্ভূত।
সূরা ফাতিহার ফযিলত
আরবী*****
১০। হযরত আবু হুরাইরাহ ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- “যে ব্যক্তি এমন নামাজ পড়লো, যার মধ্যে উম্মুল কুরআন ( সূরা ফাতিহা ) পাঠ করে নি- তাঁর নামাজ অর্থ ও মূল্যহীন থাকে যাবে। (রাবী বলে ) একথাটি তিনি তিনবার উল্লেখ করলেন। “তাঁর নামাজ অসম্পূর্ণ থেকে যাবে”। আবু হুরাইরাকে জিজ্ঞেস করা হলো, আমরা যখন ইমামের পিছনে নামাজ পড়বো, তখন কি করবো? তিনি জবাবে বললেন- তখন মনে মনে পাঠ করো। কেননা আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি- “মহান আল্লাহ বলেন, আমি নামাজকে আমার এবং বান্দার মাঝে দুই সমান ভাগে ভাগ করে নিয়েছি। বান্দাহ যা চাইবে আমি তাকে তা দান করবো। বান্দাহ যখন বলে, “আল হামদু লিল্লাহি রাব্বিল আলামিন। ( যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহর জন্যে, যিনি সারা জাহানের প্রতিপালক ), তখন আল্লাহ তায়ালা বলেন- বান্দাহ আমার প্রশংসা করেছে। যখন সে বলে, আর-রাহমানির রাহীম ( তিনি দয়াময়, তিনি অনুগ্রহকারী ), তখন মহামহিম আল্লাহ বলেন, বান্দাহ আমার মর্যাদা স্বীকার করেছে এবং আমার কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। বান্দাহ যখন বলে, ইয়াকা না’বুদু ওয়া ইয়াকা নাস্তায়িন ( আমরা কেবল তোমারই ইবাদাত করি এবং কেবলমাত্র তোমারই কাছে সাহায্য প্রার্থনা করি ), তখন আল্লাহ বলেন, এটা আমার এবং বান্দার মাঝে ( অর্থাৎ বান্দাহ আমার ইবাদাত করবে, আর আমি তাঁর সাহায্য করবো ), আমার বান্দাহ যা চায়, আমি তা দেবো। যখন বান্দাহ বলে, ইহদিনাস সিরাতাল মুস্তাকিম, সিরাতাল্লাজিনা আন আমতা আলাইহিম গাইরিল মাগদুবি আলাইহিম অলাদ্দ দোয়াল্লিন ( আমাদেরকে সরল পথে পরিচালিত করুন, সেই সব বান্দাহদের পথে যাদের আপনি নিয়ামত দান করেছেন, যারা অভিশপ্তও নয় এবং পথ ভ্রষ্টও নয় ), তখন আল্লাহ বলেন, এটা আমার বান্দার জন্যে এবং আমার বান্দা যার প্রার্থনা করেছে তা সে পাবে।”—– ( মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিযি, নাসাঈ, ইবনে মাজাহ, মুসনাদে আহমাদ )
ইমামের পিছনে সূরা ফাতিহা পাঠ
জামায়াতে নামাজ পরাকালীন সময়ে মুক্তাদিগনকে সূরা ফাতিহা পাঠ করতে হবে কি-না এ সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ আলেমদের মধ্যে মতবিরোধ আছে। আবু হুরাইয়ারহ বলেছেন, মুক্তাদিগন চুপে চুপে সূরা ফাতিহা পাঠ করে নিবে। ইমাম শাফেয়ীর মতে মুক্তাদিগনকে সর্বাবস্থায় সূরা ফাতিহা পাঠ করতে হবে। ইমাম আবু হানিফার মতে, কোন অবস্থায়ই মুক্তাদিগন সূরা ফাতিহা পাঠ করবে না। ইমাম মালিক ও ইমাম আহমদের মতে, ইমাম ফাতিহা পাঠের শব্দ যদি মুক্তাদিগনের কানে আসে তাহলে সূরা ফাতিহা পাঠ করবে না, বরং ইমামের পাঠ মনোযোগ সহকারে শুনবে। কিন্তু ইমামের ফাতিহা পাঠের শব্দ মুক্তাদিগনের কানে না আসলে তারা ফাতিহা পাঠ করবে।
ইমাম আবু হানীফা প্রথম দিকে অনুচ্চ শব্দে কিরাত পাঠ করা নামাজে মুক্তাদিগনের সূরা ফাতিহা পাঠ করার পক্ষপাতি ছিলেন। বিশিষ্ট হানাফী আলেম আল্লামা মোল্লা আলী কারী, আবু হাসান সিন্ধী, আব্দুল হাই, রশীদ আহমাদ নিঃশব্দে কিরাত পাঠ করা নামাজে ইমামের পেছনে সূরা ফাতিহা পাঠ করতেন ( হক্কানী তাফসির- মাওলানা সামছুল হক ফরিদপুরী।
মাওলানা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদী বলেন, ইমামের পেছনে সূরা ফাতিহা পাঠ সম্পর্কে আমি যতটুকু অনুসন্ধান করেছি তাঁর আলোকে অধিকতর সঠিক পন্থা হচ্ছে এই যে, ইমাম যখন উচ্চস্বরে ফাতিহা পাঠ করবে, মুক্তাদিগন তখন চুপ থাকবে। আর ইমাম যখন নিঃশব্দে ফাতিহা পাঠ করবে, তখন মুক্তাদীরাও চুপে চুপে ফাতিহা পাঠ করবে। এই পন্থায় কুরআন ও হাদীসের কোন নির্দেশের বিরোধিতা করার কন সন্দেহ থাকে না। ফাতিহা পাঠ সংক্রান্ত যাবতীয় দলিল সামনে রেখে এরূপ একটি মধ্যম পন্থা অবলম্বন করা যেতে পারে।
কিন্তু যে ব্যক্তি কোন অবস্থাতেই ইমামের পেছনে ফাতিহা পাঠ করে না, অথবা সর্বাবস্থায় ফাতিহা পাঠ করে আমরা এটা বলতে পারিনা যে, তাঁর নামাজ হয় না। কেননা উভয় মতের স্বপক্ষে দলীল আছে এবং এই ব্যক্তি জেনে বুঝে উদ্দেশ্যমুলকভাবে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের নির্দেশের বিরোধিতা করছে না। বরং তাঁর কাছে দলীলের ভিত্তিতে যে মতটি প্রমানিত, সে সেই মতের উপর আমল করছে। ( রাসায়েল-মাসায়েল, ১ম খণ্ড, পাতা-১৭৯, ১৮০ )
কুরআনের সবচেয়ে বড় সূরা ফাতিহা
আরবী*****
১১। হযরত আবু সাঈদ ইবনে মুয়াল্লাহ ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা আমি মসজিদে নববীতে নামাজ পড়ছিলাম। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সাল্লাম আমাকে স্বশব্দে ডাকলেন। আমি ( তখন নামাজরত থাকার কারনে ) তাঁর ডাকে সাড়া দিতে পারলাম না। অতপর আমি তাঁর কাছে এসে বললাম- হে আল্লাহর রাসুল, আমি নামাজে রত ছিলাম। তিনি বললেন- মহান আল্লাহ কি বলেননি, “আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসুল যখন তোমাদেরকে ডাকেন তখন তাঁদের ডাকে সাড়া দাও।” ( সূরা আনফাল, আয়াত ২৪ ) অতপর তিনি বললেন, তোমার মসজিদ থেকে বের হয়ে যাবার পূর্বে আমি কি তোমাকে কুরআনের সবচেয়ে মহান এবং সবচেয়ে বড় সূরাটি শিখিয়ে দেবো না? একথা বলে তিনি আমার হাত ধরলেন। অতঃপর আমরা যখন মসজিদ থেকে বের হতে উদ্যত হলাম, আমি বললাম- হে আল্লাহর রাসুল, আপনি বলেছেন- “আমি তোমাকে কুরআনের সবচেয়ে মহান সূরাটি অবশ্যই শিখিয়ে দেবো।” তিনি বললেন- তা আলহামদু লিল্লাহি রাব্বিল আলামিন ( সূরা ফাতিহা )। এটাই সাবউল মাসানী ( পুনরাবৃত সাত আয়াত ) এবং তাঁর সাথে রয়েছে মহান আল কুরআন, যা আমাকে দান করা হয়েছে। —-( সহীহ বুখারী )
হযরত আবু সাঈদের ( রাঃ ) নামাজরত অবস্থায় তাঁকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ডাকার দ্বারা একথা পরিস্কার হয়ে যায় যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন তাঁকে ডাকছিলেন, তখন তিনি নফল নামাজ পড়ছিলেন। অতঃপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আহবান শুনার পর তাঁর কর্তব্য ছিল নামাজ ছেড়ে দিয়ে তাঁর কাছে হাজির হওয়া। কেননা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের ডাকে সাড়া দেয়া ফরয। আর তিনি তো তখন নফল নামায পড়ছিলেন। মানুষ যে কাজেই রত থাকুক- যখন তাঁকে আল্লাহর রাসুলের পক্ষ থেকে ডাকা হবে তখন এই ডাকে সাড়া দেয়া তাঁর উপরে ফরয।
‘সাবউল মাসানী’ – বাক্যাংশের অর্থ হচ্ছে – সেই সাতটি আয়াত যা নামাজে পুনঃ পুনঃ পাঠ করা হয়, অর্থাৎ সূরা ফাতিহা। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- এই সাতটি আয়াত সম্বলিত সূরাটি কুরআনের সবচেয়ে বড় সূরা এবং এর সাথে রয়েছে কুরআন মাজীদ। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে- এই আয়াত কয়টি পৃথক যা বার বার পাঠ করা হয় এবং তাঁর সাথে কুরআন মাজীদের অবস্থান। একথার তাৎপর্য হচ্ছে- একদিকে পুরা কুরআন শরীফ এবং অন্য দিকে সূরা ফাতিহা। এখান থেকেই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই মত পোষণ করেছেন যে, এটা কুরআন মাজীদের সবচেয়ে বড় সূরা। কেননা সমগ্র কুরআনের মুকাবেলায় এই সুরাকে রাখা হয়েছে। এখানে চিন্তা করার বিষয় হচ্ছে এই যে, ফাতিহাকে সবচেয়ে বড় সূরা বলার অর্থ এই নয় যে, তা শব্দ সংখ্যা বা আয়াত সংখ্যার বিচারে সবচেয়ে বড় সূরা। বরং এর অর্থ হচ্ছে- বিষয়বস্তুর বিচারে সূরা ফাতিহা সবচেয়ে বড় সূরা। কেননা কুরআন মাজীদের পুরা শিক্ষার সংক্ষিপ্তসার এই সুরার মধ্যে নিহিত রয়েছে।