কুরআনকে শত্রুর এলাকায় নিয়ে যেও না
আরবী***
৫৩। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কুরআন সাথে নিয়ে শত্রু এলাকায় সফর করতে নিষেধ করেছেন। —– ( সহীহ বুখারী ও মুসলিম )
মুসলিমের অপর বর্ণনায় আছে, কুরআন শরীফ সাথে নিয়ে দুশমনদের এলাকায় যেও না কেননা শত্রুর হাতে পড়ে যাওয়া সম্পর্কে আনি নিরাপদ মনে করি না।
মোট কথা যে এলাকায় কুরআন নিয়ে গেলে তাঁর অসম্মান হওয়ার আশংকা আছে সেখানে যেনে শুনে কুরআন নিয়ে যাওয়া ঠিক নয়।
আসহাবে সুফফার ফযিলত
আরবী***
৫৪। হযরত আবু সাঈদ খুদরী ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি একদিন দুর্বল ( গরীব ও নিঃস্ব ) মুহাজিরদের একটি দলের সামনে বসা ছিলাম। তারা নিজেদের লজ্জা নিবারনের জন্য পরস্পর লেগে বসেছিল। কেননা এসময় তাঁদের কাছে সম্পূর্ণ শরীর ঢাকার মতো কাপর ছিল না। এই মুহাজিরদের মধ্যেকার একজন কারী আমাদের কুরআন তেলাওয়াত করে শুনাচ্ছিলেন। এমন সময় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাশরীফ আনলেন এবং আমাদের দলের সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেলেন। তিনি যখন দাঁড়িয়ে গেলেন তখন কুরআন পাঠকারী চুপ হয় গেলো। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের সালাম দিলেন। অতঃপর তিনি বললেন- তোমরা কি করছিলে? আমরা আরজ করলাম, আমরা আল্লাহর কিতাব শুনছিলাম। তিনি বললেন- মহান আল্লাহর জন্য যাবতীয় প্রশংসা যিনি আমার উম্মতের মধ্যে এমন লোকদের সন্নিবেশ ঘটিয়েছেন যাদের সম্পর্কে আমাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, আমি যেন তাঁদের সঙ্গী হয়ে ধৈর্য ধারন করি। আবু সাঈদ ( রাঃ) বলেন, তিনি আমাদের মাঝে এমনভাবে বসে গেলেন যে, আমাদের এবং তাঁর মাঝে কোন পার্থক্য থাকলো না। ( মনে হচ্ছিলো তিনি আমাদের মধ্যেকারই একজন বিশেষ কেউ নন )। অতপর তিনি হাতের ইশারায় বললেন- এরূপ বস। অতঃপর তারা বৃত্তাকারে বসে গেলেন এবং তাঁদের সবার চেহারা তাঁর সামনে উন্মুক্ত হয়ে গেলো। অতঃপর তিনি বললেন- নিঃস্ব মুহাজিরদের জামায়াত, তোমরা পূর্ণাংগ নূরের সুসংবাদ গ্রহন করো, যা তোমরা কিয়ামতের দিন লাভ করেবে। তোমরা ধনীদের চেয়ে অর্ধদিন আগে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আখেরাতের অর্ধদিন দুনিয়ার পাঁচশো বছরের সমান। ———-( আবু দাউদ )
দুর্বল মুহাজির বলতে বৃদ্ধ অথবা শারিরীক দিক থেকে দুর্বল এমন লোকদের বুঝানো হয় নি, বরং এর অর্থও হচ্ছে নিতান্ত গরীব এবং আর্থিক অনটনে জর্জরিত। অর্থাৎ যেসব মুহাজির কোন অর্থ-সম্পদ ছাড়াই শুধু এক কাপড়ে নিজেদের ঘরবাড়ি পরিত্যাগ করে চলে আসছিলেন। তাঁদের কাছে না ছিল পরনের কাপড়, না ছিল খাবার সামগ্রী, আর না ছিল মাথা গোঁজার ঠাই। কিন্তু আল্লাহর দীনের সাথে তাঁদের সংশ্রব এবং কুরআনের প্রতি তাঁদের আকর্ষণ এমনই ছিল যে, অবসর বসে থেকে অনর্থক কথাবার্তায় সময় কাটানোর পরিবর্তে তারা আল্লাহর কালাম শুনতেন এবং শুনাতেন।
এ স্থানে ভালো করে বুঝে নিতে হবে যে, কুরআন মাজীদে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে একথা কেন বলা হয়েছিলো, তাঁদের সাথে ধৈর্য ধারন করো এবং রাসুলুল্লাহ সাল্লালালহু আলাহি ওয়া সাল্লাম এজন্য আল্লাহ তায়ালার প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন কেন? একথা কুরআন মাজীদের এমন স্থানে বলা হয়েছে, যেখানে আল্লাহ তায়ালা তাঁর রাসুলকে পথ নির্দেশ দান করেছেন যে- মক্কার এই বড় বড় সর্দার এবং ধনিক শ্রেনীর লোকেরা সত্যকে প্রত্যাখ্যান করার কোন পরোয়াই করবে না। এবং কখনো এ চিন্তায়ও লেগে যাবে না যে- তাঁদের কেউ যদি তোমার দলে ভিড়ে যেত তাহলে তাঁর প্রভাব প্রতিপত্তি ও ব্যক্তিত্বের উসিলায় এ দীনের প্রসার ঘটতো বরং তাঁর পরিবর্তে যেসব দরিদ্র লোক এবং কাংগাল কিন্তু ঈমান গ্রহন করে তোমার কাছে এসেছে- তুমি তাঁদের নিত্য সাথী হয়ে তাঁদের সাথে ধৈর্য ধারন করো, তাঁদের সুখ-দুঃখের ভাগী হয়ে যাও এবং তাঁদের সাহচর্যে আশ্বস্ত থাকো।
***সূরা কাহাফে মহান আল্লাহ এ প্রসঙ্গে বলেন-
“হে নবী, তোমার দলকে এই লোকদের সংস্পর্শে স্থিতিশীল রাখো যারা নিজেদের প্রতিপালকের সন্তোষ লাভের সন্ধানী হয়ে সকাল ও সন্ধ্যায় তাঁকে ডাকে। আর তাঁদের দিক থেকে কখনো অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিও না। তুমি কি দুনিয়ার চাকচিক্য ও জাকজমক পছন্দ করো? এমন কোন ব্যক্তির আনুগত্য করো না যার অন্তরকে আমি স্মরণশুন্য করে দিয়েছি এবং যে লোক নিজের নফসের খাহেশের অনুসরন করে চলার নীতি গ্রহন করেছে, আর যার কর্মনীতি সীমা লংঘনমুলক। পরিস্কার বলে দাও, এই মহাসত্য এসেছে তোমাদের প্রভুর নিকট থেকে। এখন যার ইচ্ছা তা মান্য করবে আর যার ইচ্ছা তা অমান্য করবে, অস্বীকার করবে।”—( আয়াত নং ২৮, ২৯ )
কোন ব্যক্তি যখন আল্লাহর দীনের প্রচারের জন্য বের হয়ে যায় তখন তাঁর আকংখা থাকে, প্রভাবশালী লোকেরা তাঁর ডাকে সাড়া দিক। তাহলে তাঁর আগমনে কোথাও দীনের কাজের প্রসার ঘটবে। এই অবস্থায় যখন গরীব ও দুর্বল লোকেরা, যাদের সমাজে বিশেষ কোন পদমর্যাদা নেই, এসে তাঁর আহবানে নিজের উৎসাহ প্রকাশ করে এবং এ কাজের জন্য নিজেকে পেশ করে দেয়- তখন সে চিন্তা করে এই যেসব লোকের সমাজে কোন স্থান নেই তাঁদের নিয়ে আমি কি করবো? এরা যদি ভেড়ার পালের মতোও জমা হয়ে যায় তবুও এসব গুরুত্বহীন লোকের দ্বারা দীনের আর কি প্রসার ঘটবে? দীনের জন্য কাজ করতে উদ্যোগী লোকের এরূপ চিন্তা আল্লাহ তায়ালার পছন্দনীয় নয়। এজন্য তিনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে হেদায়াত দান করলেন যে, তিনি যেন ঈমান গ্রহণকারী সাধারন মর্যাদা সম্পন্ন গরীব লোকদের কম গুরুত্বপূর্ণ বা গুরুত্বহীন মনে না করেন, তিনি যেন তাঁদের সাথে ধৈর্য ধারন করে থাকেন, তাঁদের প্রতি সন্তুষ্ট থাকেন। তিনি যেন তাঁদের উপেক্ষা করে বড় বড় শেখ ও প্রতিপত্তিশীল লোকদের দলে আনার চিন্তায় বিভোর না হয়ে যান।
মক্কার কাফেরদের নেতারাও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বিদ্রুপ করে বলতো- কৈ তাঁর উপর তো মক্কার কোন গুরুত্বপূর্ণ লোক ঈমান আনছে না, জাতির বিচক্ষন ও প্রভাবশালী লোক- যাদের কাছে লোকেরা নিজেদের যাবতীয় ব্যাপারের ফায়সালার জন্যে আসে, তাঁদের কেউই তো তাঁর সাথে নেই। এই নীচু শ্রেনীর লোকেরাই তাঁর উপর ঈমান এনেছে এবং তিনি মনে করেছেন এদের নিয়েই তিনি দুনিয়াতে আল্লাহর দ্বীন ছড়িয়ে দেবেন। তাঁদের এই বিদ্রুপের জবাবে এই কথা বুঝানো হয়েছে, যে ব্যক্তি ঈমান এনেছে সেই মূলত মূল্যবান মানুষ। যে ব্যক্তি ঈমানকে প্রত্যাখ্যান করেছে সে না জ্ঞানী হতে পারে আর না কোন নেতা বা শেখ হতে পারে। আজ যদিও কোন ব্যক্তি শেখ হয়ে আছে কিন্তু আগামীকাল তাঁর এই শেখগীরি খতম হয়ে যাবে এবং এই মর্যাদাহীন, দুঃস্থ গরীব লোকেরাই তাঁদের গদি উলটিয়ে দেবে। এ জন্য বলা হয়েছে, যেসব লোক তোমার দলে এসে গেছে তাঁদের সাথে ধৈর্য ধারন করো এবং তাঁদের দিক থেকে অন্যদিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিও না।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন এই দুর্দশাগ্রস্ত মুহাজিরদের দেখলেন যে, তারা কতটা আগ্রহ ও ভালবাসার সাথে কুরআন পড়া শুনছেন তখন তিনি বললেন, আল্লাহ তায়ালার শুকরিয়া তিনি এমন লোকদের আমার সঙ্গী করেছেন যাদের সাথে আমাকেও সবর করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। অন্যভাবে বলতে গেলে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ জন্য শুকরিয়া আদায় করলেন যে, তাঁর সাথে এমন লোকেরা এসে গেছে যাদের মধ্যে এই যোগ্যতা বর্তমান রয়েছে এবং তারা এতটা মজবুত ঈমানের অধিকারী যে আল্লাহর দীনের খাতিরে নিজেদের বাড়িঘর, সন্তান-সন্তুতি সব কিছু ছেড়ে চলে এসেছে।
অতপর নবী সাল্লালালহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই মুহাজিরদের সুসংবাদ দিলেন যে, তারা কিয়ামতের দিন পরিপূর্ণ নূরের অধিকারী হবে এবং তারা সম্পদশালী লোকদের চেয়ে পাঁচশো বছর আগে বেহেশতে প্রবেশ করবেন। অর্থাৎ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁদের শান্তনার বানী শুনিয়ে দিলেন, আল্লাহর দীনের খাতিরে তোমরা যে দুঃখ কষ্ট ভোগ করছ, যে ভয়-ভীতির মধ্যে তোমাদের জীবন যাপন করতে হচ্ছে, যে জন্য তোমরা তোমাদের নিজেদের বাড়িঘর ত্যাগ করেছো এবং দুঃখ-দারিদ্রকে আরাম-আয়েশের উপর অগ্রাধিকার দিয়েছ- এর বিনিময়ে তোমাদের জন্য সুসংবাদ রয়েছে যে, তোমরা কিয়ামতের দ্বীন পরিপূর্ণ নূরের অধিকারী হবে এবং ধনী লোকদের অর্ধদিন আগে বেহেশতে প্রবেশের সৌভাগ্য লাভ করবে। কিয়ামতের অর্ধদিন দুনিয়ার পাঁচশো বছরের সমান।
আখেরাতের অর্ধদিন এবং এটা দুনিয়ার পাঁচশো বছরের সমান হওয়ার তাৎপর্য কোন ব্যক্তিই নির্দিষ্ট করে বলতে পারে না। ঐ জগতের সময়ের মানদণ্ড এই দুনিয়ার চেয়ে ভিন্নতর এবং প্রতিটি জগতেই সময়ের মানদণ্ড ভিন্নরূপ- একথা হৃদয়ঙ্গম করানোর জন্য রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সময়ের উল্লেখ করেছেন। এ জন্য এর খোঁজখবর ও অযথা ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে লিপ্ত হওয়ার কোন প্রয়োজন নেই। একথা সেখানে গিয়েই জানা যাবে সেখানকার সময় এবং কালের অর্থ কি এবং এর মানদণ্ডই বা কি?
সুমধুর স্বরে কুরআন পাঠ করো
৫৫। হযরত বারাআ ইবনে আযেব ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- তোমরা সর্বাধিক সুমধুর স্বরে কুরআন পাঠ করো। ( আহমাদ, আবু দাউদ, দারেমী )
অর্থাৎ যতদূর সম্ভব সুন্দর উচ্চারন ভঙ্গিতে এবং মার্জিত আওয়াজে কুরআন শরীফ পাঠ করো। এমন অমার্জিত পন্থায় পাঠ করোনা যার ফলে অন্তর কুরআনের দিকে ধাবিত হওয়ার পরিবর্তে আরো দূরে চলে যায়।
কুরআন পড়া শিখে তা ভুলে যাওয়া বড়ই দুর্ভাগ্যের ব্যাপার
আরবী***
৫৬। হযরত সা’দ ইবনে উ’বাদা ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- যে ব্যক্তি কুরআন শরীফ পড়ার পর তা ভুলে যায়- সে কিয়ামতের দিন কুষ্ঠ অবস্থায় আল্লাহর সামনে হাযির হবে। —-( আবু দাউদ, দারেমী )
হাদীস বিশারদগণ বর্ণনা করেছেন যে, এ হাদীসে কুষ্ঠ হওয়ার অর্থ শুধু দৈহিকভাবে কুষ্ঠ হওয়া নয়, বরং একথা প্রবাদ বাক্য হিসাবে বলা হয়েছে এবং এর অর্থ হচ্ছে সম্পূর্ণ অসহায়। যেমন আমরা বলে থাকি, মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়েছে। মূলত মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়েনি। বরং মানুষের ঘাড়ে কঠিন বিপদ এসে চাপলেই এরূপ বলা হয়। অনুরূপভাবে আরবী ভাষায় কারো অসহায়ত্ব প্রকাশ করার জন্য বলা হয়ে থাকে- তাঁর হাত কাঁটা। ইতিপূর্বে একটি হাদীসে এসেছে, “আল কুরআনু হুজ্জাতুন লাকা আও আলাইকা”। অর্থাৎ কুরআন তোমার পক্ষে প্রমান হবে বা বিপক্ষে প্রমান হয়ে দাঁড়াবে। এখন এমন এক ব্যক্তির কথা চিন্তা করুন যার ঈমান আছে এবং সেই ঈমানের ভিত্তিতে সে কুরআন পাঠ করেছে কিন্তু তা পড়ার পর ফের ভুলে গেছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে তাঁর কাছে এমন কোন প্রমান অবশিষ্ট আছে যা সে আল্লাহর দরবারে পেশ করবে? কুরআন ভুলে যাওয়ার পর তো তাঁর প্রমান তাঁর হাত থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এখন তাঁর কাছে এমন কোন জিনিস নেই যা সে নিজের নির্দোষিতার স্বপক্ষে পেশ করবে। এ হচ্ছে সেই অসহায় অবস্থা- কিয়ামতের দিন সে যাতে লিপ্ত হবে। এটা এভাবে বর্ণনা করা হয়েছে যে, কিয়ামতের দিন সে হাত কাটা অবস্থায় উঠবে।
তিনদিনের কম সময়ে কুরআন খতম করোনা
আরবী***
৫৭। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- যে ব্যক্তি তিন দিনের কম সময়ে কুরআন খতম করেছে সে কুরআন বুঝেনি। —–( তিরমিযি, আবু দাউদ, দারেমী )
অর্থাৎ কোন ব্যক্তি যদি তিন দিনের কম সময়ের মধ্যে গোটা কুরআন খতম করে ফেলে তাহলে প্রশ্ন জাগে যে, সে কুরআনের কি বুঝল? এ জন্য রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নির্দেশ হচ্ছে- কমপক্ষে তিন দিনে কুরআন খতম করো। এর চেয়ে অধিক সময় নিয়ে কুরআন খতম করতে পারলে তা আরো ভালো, কিন্তু এর কম সময় নয়। কেননা যদি কোন ব্যক্তি দৈনিক দশপারা কুরআন মধ্যম গতির চেয়েও দ্রুত পাঠ করে তাহলে সে এ অবস্থায় কুরআনের কিছুই বুঝতে পারবে না।
প্রকাশ্যে অথবা নিরবে কুরআন পড়ার দৃষ্টান্ত
আরবী***
৫৮। হযরত উকবা ইবনে আমের ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- যে ব্যক্তি প্রকাশ্য আওয়াজে কুরআন পাঠ করে সে ঐ ব্যক্তির মতো যে প্রকাশ্যে দান- খয়রাত করে। আর যে ব্যক্তি নিরবে কুরআন পাঠ করে সে গোপনে দান- খয়রাতকারীর সাথে তুল্য। –( তিরমিযি, আবু দাউদ, নাসাঈ )
অর্থাৎ নিজ নিজ স্থানে উভয় পন্থায়ই কুরআন পাঠ করার সওয়াবও লাভ হয় এবং উপকারও হয়। কোন ব্যক্তি যদি প্রকাশ্যে দান খয়রাত করে তাহলে অন্যদের উপরও তাঁর প্রভাব পড়তে পারে এবং তাদেরও দানখয়রাত করার দিকে মনোনিবেশ বাড়তে পারে। তাঁদের অন্তরেও আল্লাহর রাস্তায় দানখয়রাত করার আগ্রহ সৃষ্টি হতে পারে। অপরদিকে কোন ব্যক্তি যদি গোপনে দানখয়রাত করে তাহলে তাঁর মধ্যে নিষ্ঠা এবং ঐকান্তিকতা সৃষ্টি হয় এবং সে রিয়াকারী বা প্রদর্শনেচ্ছা থেকে নিরাপদ থাকতে পারে। কুরআন পাঠ করার মধ্যে ফায়দা হচ্ছে এই যে, আল্লাহর বান্দাদের পর্যন্ত এর শিক্ষা পৌছে যায় এবং লোকদের মাঝে কুরআন পড়ার আগ্রহ সৃষ্টি হয়। পক্ষান্তরে অস্পষ্ট আওয়াজে বা গোপনে কুরআন পড়ার ফায়দা হচ্ছে এই যে, এভাবে কোন ব্যক্তি ইখলাছ ও নিষ্ঠা সহকারে এবং প্রদর্শনেচ্ছা মুক্ত হয়ে আল্লাহর সন্তোষ লাভের জন্য কুরআন পাঠ করতে পারে এবং এর মধ্যে অন্য কোনরূপ আবেগের সংমিশ্রণ ঘটতে পারে না।
কুরআনের উপর কার ঈমান গ্রহণযোগ্য
৫৯। হযরত সুহাইব ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- যে কুরআনের হারাম করা জিনিসকে হালাল করে নিয়েছে- সে কুরআনের উপর ঈমান আনেনি। ————- ( তিরমিযি )
কুরআন যে আল্লাহর কালাম- এর উপর ঈমান আনা এবং কুরআনে হারাম ঘোষিত জিনিসকে হালাল বানানো— এ দুইটি জিনিস একত্রে জমা হতে পারে না। কুরআন এমন একটি গ্রন্থ যা মানুষের কাছে কতিপয় গ্রহন করার এবং কতিপয় জিনিস পরিত্যাগ করার দাবী করে। যে ব্যক্তি কুরআনের হারামকৃত জিনিসকে হালাল করে নিয়েছে এবং সে কুরআনকে বাস্তবিকই আল্লাহর কিতাব বলে স্বীকার করে—তাঁর জীবন যাপন থেকে এর কোন প্রমান পাওয়া যায় না—তাঁর কুরআন মানার দাবী করার এবং তা পাঠ করার ফায়দা কি আছে?
নবী ( সাঃ ) এর কিরআত পাঠের ধরন
আরবী***
৬০। হযরত ইয়া’লা ইবনে মামলাক ( তাবেয়ী ) থেকে বর্ণিত। তিনি উম্মে সালামাকে জিজ্ঞেস করলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কিভাবে কিরআত পাঠ করতেন? তখন উম্মে সালামা এমনভাবে কুরআন পাঠ করে শুনালেন যাতে প্রতিটি শব্দ আলাদাভাবে কানে আসলো। —— ( তিরমিযি, আবু দাউদ, নাসাঈ )
অর্থাৎ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খুব দ্রুত গতিতে কুরআন পাঠ করতেন না, বরং তিনি এমনভাবে কুরআন পাঠ করতেন যে, লোকেরা প্রতিটি অক্ষর পরিস্কার শুনতে পেতো। সামনের হাদীসে এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা আসবে।
আরবী****
৬১। হযরত উম্মে সালমা ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম টুকরা টুকরা করে কুরআন পাঠ করতেন ( অর্থাৎ প্রতিটি বাক্য পৃথক পৃথক করে পড়তেন- অতঃপর থামতেন। ) —- ( তিরমিযি )
এখানে আরো পরিষ্কারভাবে বলে দেয়া হয়েছে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দ্রুত গতিতে বা তাড়াহুড়া করে কুরআন পাঠ করতেন না। অর্থাৎ তিনি একই নিঃশ্বাসে “আলহামদু লিল্লাহ থেকে অলাদ দয়াল্লিন” পর্যন্ত পড়ে ফেলতেন না। বরং প্রতিটি বাক্যের শেষে বিরতি দিতেন।
কতিপয় লোক কুরআনকে দুনিয়া লাভের উপায় বানিয়ে নেবে
আরবী***
৬২। হযরত যাবের ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদিন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘর থেকে বের হয়ে আমাদের কাছে আসলেন। আমরা তখন বসে কুরআন পাঠ করছিলাম। আমাদের মাঝে আরবী ভাষী লোকও ছিল এবং অনারব লোকও ছিল। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের কুরআন পাঠ শুনে বললেন- পড়ে যাও, তোমাদের সকলের পাঠই সুন্দর। অচিরেই এমন একদল লোকের আবির্ভাব হবে যারা খুবই শুদ্ধভাবে এমন ভঙ্গিতে কুরআন পাঠ করবে যেভাবে তীর লক্ষ্য ভেদ করার জন্য সোজা করা হয় কিন্তু এর দ্বারা তাঁদের পার্থিব স্বার্থ লাভই হবে উদ্দেশ্য, আখেরাত লাভ তাঁদের উদ্দেশ্য নয়। ———- ( আবু দাউদ, বায়হাকী )
যাবের ( রাঃ ) এই যে বললেন, আমাদের মাঝে আরবী ভাষী লোকও ছিল এবং ভিন্ন ভাষাভাষী লোকও ছিল। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের সবাইকে বললেন, পড়ে যাও, সবাই সঠিক পড়ছ—তিনি একথা বলে বুঝাতে চাচ্ছেন যে, যেহেতু এই জামায়াতে বিভিন্ন জাতি, সম্প্রদায় ও গোত্রের লোক ছিল এজন্য তাঁদের পাঠের ধরণও পৃথক পৃথক ছিল। কিন্তু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁদের সকলের পাঠের সৌন্দর্য বর্ণনা করলেন। বাহ্যত তাঁদের প্রত্যেক ব্যক্তি সম্পূর্ণ ভিন্ন পন্থায় সঠিক উচ্চারনে এবং সঠিক ভঙ্গিতে কুরআন পাঠকারী ছিলেন না। আর প্রত্যেক ব্যক্তির কণ্ঠও সুমধুর ছিল না। তাছাড়া তাঁদের কারো কারো ভাষা ও উচ্চারন ভংগির মধ্যে ত্রুটিও থাকতে পারে। এজন্য তাঁদের কুরআন পাঠের পদ্ধতি ও ভংগির মধ্যে পার্থক্য বর্তমান থাকাও সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁদের দেখে বললেন, তোমরা সকলেই সঠিকভাবে পাঠ করছ এবং তোমরা এই উদ্দেশ্যে কুরআন পাঠ করছ যে, তোমরা দুনিয়াতে তদানুযায়ী জীবন যাপন করবে। এজন্য তোমরা সঠিক অর্থে কুরআন পাঠ করার হক আদায় করছ, তোমাদের পাঠ সম্পূর্ণ ঠিক আছে। চাই তোমরা উন্নত পর্যায়ের তাজবীদ শাস্ত্র জানো বা নাই জানো এবং কিরআত পাঠের নীতিমালা সঠিক এবং উত্তম পন্থায় তা পাঠ করে থাক বা না থাকো। এমন একটি সময় আসবে যখন কুরআন ঠিকই পড়া হবে, তা সঠিক কায়দা-কানুন এবং তাজবীদে শাস্ত্রের উত্তম নীতিমালা অনুযায়ী সঠিকভাবে পড়া হবে—যেমন লক্ষ্যবস্তু ভেদ করার জন্য তীর সোজা করা হয়। কিন্তু তাঁদের এ পাঠের উদ্দেশ্য হবে সামান্য পার্থিব স্বার্থ লাভ করা, আখেরাত লাভ করা তাঁদের উদ্দেশ্য হবে না। অতএব তাঁদের এই পাঠ মোটেই কোন কাজে আসবে না। অবশ্য তোমাদের এই পাঠ একজন সাধারন গ্রাম্য লোকের পাঠের মতো যতই নিম্নমানের হোক না কেন—তাই কাজে আসবে। মূলত এই পাঠই আল্লাহ তায়ালার কাছে গ্রহণযোগ্য ও পছন্দনীয় হবে। সুতরাং তোমাদের সকলের কুরআন পড়াই সুন্দর।
গান ও বিলাপের সুরে কুরআন পাঠ করোনা
আরবী***
৬৩। হযরত হুজাইফা ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- তোমরা আরবদের স্বরে এবং সুরে কুরআন পাঠ করো। কিন্তু সাবধান, আহলে ইশক এবং দুই আহলে কিতাব ( ইহুদী-খ্রিস্টান ) সম্প্রদায়ের স্বরে এবং সুরে মতো নয়। অচিরেই আমার পরে এমন একদল লোকের আগমন ঘটবে যারা গানের সুরে বা বিলাপের সুরে কুরআন পাঠ করবে। কুরআন তাঁদের কণ্ঠনালীর নীচে পৌছবে না। তাঁদের অন্তর দুনিয়ার প্রতি মহগ্রস্ত হয়ে থাকবে এবং যারা তাঁদের পদ্ধতিকে অনুসরন করবে তাদের অন্তরও। — ( বায়হাকীর শুয়াবুল ঈমান )
আরবী স্বরে এবং আরবী সুরে কুরআন পাঠ করার তাকীদ করার অর্থ এই নয় যে, অনারব লোকেরাও আরবদের সুরে এবং স্বরে কুরআন পাঠ করবে। মূলত একথার দ্বারা যা বুঝানো উদ্দেশ্য তা হচ্ছে- কোন আরব যখন কুরআন পাঠ করে সে এমনভাবে পাঠ করে যেমন আমরা আমাদের ভাষায় কোন বই পড়ে থাকি। উদাহরণ স্বরূপ, আপনি যখন নিজের ভাষায় কোন বই পড়েন তখন আপনি তা ইনিয়ে বিনিয়ে এবং গানের সুরে পাঠ করেন না। বরং নিজের ভাষার বই পুস্তক যেভাবে পাঠ করার নিয়ম সেভাবেই পাঠ করেন। অনুরূপভাবে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কথার অর্থ হচ্ছে- কুরআন এমন সহজ সরল ও স্বভাবগত পন্থায় পাঠ করবে যেভাবে একজন আরবী ভাষী ব্যক্তি তা পাঠ করে থাকে। ইতপুরবে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এই বানী উল্লেখিত হয়েছে- “কুরআনকে তোমাদের উত্তম স্বরে সৌন্দর্যমণ্ডিত করো”। অতএব বুঝা যাচ্ছে উত্তম সুরে পড়া এবং আরববাসীদের মতো সাদাসিধাভাবে কুরআন পাঠ করার অর্থ একই। কেননা সাদাসিদাভাবে কুরআন পড়ার অর্থ এই নয় যে, কোন ব্যক্তি বেমানানভাবে এবং ভয়ংকর শব্দে কুরআন পাঠ করবে।
অতঃপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- সাবধান, আহলে ইশকের স্বরে কুরআন পাঠ করো না। অর্থাৎ গায়করা যেভাবে মানুষকে প্রেমের ফাঁদে ফেলে- অনুরূপভাবে কুরআন পাঠ করো না।
অতঃপর তিনি বলেছেন, অচিরেই এমন লোকের আগমন ঘটবে যারা কুরআনকে গানের সুরে পড়বে অথবা স্ত্রীলোকদের মতো বিলাপের সুরে পড়বে। কিন্তু এই পড়া তাঁদের কণ্ঠনালীর নিচে নামবে না। অর্থাৎ তাঁদের অন্তর পর্যন্ত কুরআনের আবেদন পৌছবেনা। শুধু তাই নয়, বরং তাঁদের অন্তঃকরণ দুনিয়াবী চিন্তায় লিপ্ত থাকবে। এবং তাঁদের অন্তঃকরনও যারা তাঁদের পাঠ শুনে দোল খেতে থাকে আর বলে সুবহানাল্লাহ।
নবী ( সাঃ ) এ ধরনের কুরআন পাঠকারী এবং তা শুনে মাথা দোলানো ব্যক্তিদের এ জন্য সতর্ক করেছেন যে, এই কুরআন কোন কবিতার বই নয় যে, বসে বসে তা শুনবে এবং প্রশংসার স্তবক বর্ষণ করবে আর মারহাবা মারহাবা প্রতিধ্বনি তুল্বে। বর্তমানে আমাদের এখানে কুরআন পাঠের মজলিশে যেমনটা হচ্ছে। কখনো কখনো তো এসব মাহফিলের অবস্থা এমন হয়ে দাড়ায় যেন কবিতার আসর বসছে আর কি? এই পন্থা ত্রুটি মুক্ত নয়।