সূরা কাহাফের প্রথম দশ আয়াতের ফযিলত
আরবী****
১৯। হযরত আবু দারদা ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- যে ব্যক্তি সূরা কাহাফের প্রথম দশ আয়াত মুখস্থ করবে, সে দাজ্জালের ( বিপর্যয় ) থেকে নিরাপদ থাকবে। —-( সহীহ মুসলিম )
সূরা কাহাফের প্রথম দশ আয়াতে যা বর্ণনা করা হয়েছে তা হচ্ছে এই যে, যে সময় তৎকালীন রোম সাম্রাজ্যের অধীন খ্রিষ্টানদের উপর কঠোর নির্যাতন চালানো হচ্ছিলো এবং তাঁদেরকে একথা স্বীকার করতে বাধ্য করা হচ্ছিলো যে, তারা এক আল্লাহকে পরিত্যাগ করে রোমীয়দের মা’বুদ এবং দেবতাদের প্রভু হিসাবে মেনে নিবে এবং এদের সামনে মাথা নত করবে। এই কঠিন সময়ে কয়েকজন নওজোয়ান হযরত ঈসা ( আঃ ) এর উপর ঈমান আনে এবং তারা এই অমানুষিক অত্যাচার থেকে বাঁচার জন্য নিজেদের ঘর-বাড়ি সব কিছু ফেলে রেখে পালিয়ে আসে। তারা এই সিদ্ধান্ত নেয় যে, আমরা কোন অবস্থাতেই আমাদের মহান প্রতিপালককে পরিত্যাগ করবো না এবং শিরকের পথও ও অবলম্বন করবোনা- এতে যাই হোক না কেন। সুতরাং তারা কারো আশ্রয় না চেয়ে কেবল আল্লাহর উপরে ভরসা করে পাহাড়ে গিয়ে এক গুহায় বসে যায়।
বলা হয়েছে যে ব্যক্তি সূরা কাহাফের এই প্রাথমিক আয়াতগুলো মুখস্থ করে নিবে এবং তা নিজের মন- মগজে বসিয়ে নেবে সে দাজ্জালের ফিতনা থেকে নিরাপদ থাকবে। প্রকাশ থাকে যে, দাজ্জালের ফিতনাও এই ধরনেরই হবে- যেমন ঐ সময়ে এই যুবকগন যার সম্মুখীন হয়েছিলো। এজন্য যে ব্যক্তির সামনে আসহাবে কাহাফের দৃষ্টান্ত মওজুদ থাকবে সে দাজ্জালের সামনে মাথা নত করবে না। অবশ্য যে ব্যক্তি এই দৃষ্টান্ত ভুলে গেছে সে দাজ্জালের ফিতনার স্বীকার হয়ে পড়তে পারে। এরই ভিত্তিতে বলা হয়েছে যে ব্যক্তি এই আয়াতগুলো নিজের স্মৃতিপটে সংরক্ষণ করবে সে দাজ্জালের বিপর্যয় থেকে বেঁচে যাবে।
সূরা মুমিনুনের ফযিলত
আরবী****
২০। হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর যখন অহী নাযিল হতো তখন তাঁর মুখের কাছ থেকে মৌমাছির গুনগুন শব্দের মতো আওয়াজ শুনা যেত। আমি কিছুক্ষন বসে থাকলাম তিনি কিবলার দিকে ফিরলেন এবং দুই হাত তুলে বললেন- “হে আল্লাহ, আমাদের আরো দাও এবং কমিয়ে দিওনা, আমাদের মনে- সম্মান দান করো এবং অপদস্থ করোনা, আমাদের ( তোমার নিয়ামত ) দান করো এবং বঞ্চিত করোনা, আমাদের অন্যদের অগ্রবর্তী করো, অন্যদেরকে আমাদের অগ্রবর্তী করোনা, আমাদের উপর তুমি রাজী হয়ে যাও এবং আমাদের সন্তুষ্ট করো।” অতঃপর তিনি বললেন- “এই মাত্র আমার উপর এমন দশটি আয়াত নাযিল হয়েছে যার মানদণ্ডে কেউ উত্তীর্ণ হলে সে নিঃসন্দেহে জান্নাতে যাবে।” অতপর তিনি পাঠ করলেন- “নিশ্চিতই ঈমানদার লোকেরা কল্যাণ লাভ করেছে। –অতঃপর তিনি দশটি আয়াত পাঠ সম্পন্ন করলেন।”—( তিরমিযি, নাসাঈ, আহমাদ, হাকেম )
আরবী****
২১। হযরত ইয়াজীদ ইবনে বাবনুস ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়েশা ( রাঃ ) কে জিজ্ঞেস করলাম, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চরিত্র কিরূপ ছিল? তিনি বললেন, কুরআনই হল রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালামের চরিত্র। অতঃপর তিনি পাঠ করলেন- “নিশ্চিতই ঈমানদার লোকেরা কল্যাণ লাভ করেছে——- তিনি “এবং যারা নিজেদের নামায সমূহের পূর্ণ হেফাজত করে,” পর্যন্ত পাঠ করলেন। অতঃপর তিনি বললেন, “এরূপই ছিল রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চরিত্র।”———–( নাসাঈ )
আরবি*****
২২। হযরত আনাস ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- আল্লাহ তায়ালা নিজ হাতে ‘আদন’ নামক জান্নাত সৃষ্টি করেছেন। এর একটি থাম সাদা মুক্তা পাথরের, একটি থাম লাল চুনি পাথরের এবং একটি থাম সবুজ পুষ্পরাগ মনির তৈরি। এর মেঝে কস্তুরির, এর নুড়ি পাথরগুলো মোতির তৈরি এবং লতাকুঞ্জ কুমকুমের তৈরি। অতঃপর তিনি তাঁকে বললেন, কথা বল। সে বলল, নিশ্চিতই ঈমানদার লোকেরা কল্যাণ লাভ করেছে। তখন আল্লাহ বললেন, আমার ইজ্জত, শানশওকত ও মহত্ত্বের শপথ, কোন কৃপণ তোমার মধ্যে প্রবেশ করার জন্যে আমার কাছে প্রার্থনা করতে পারবেনা। অতঃপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পাঠ করলেন, “বস্তুত যেসব লোককে তাঁদের দীলের সংকীর্ণতা থেকে রক্ষা করা হয়েছে তারাই কল্যাণ লাভ করবে।”
হাদীসের যে দশটি আয়াতের কথা বলা হয়েছে তা নিম্নরুপঃ
আরবি*****
“মুমিন লোকেরা নিশ্চয়ই কল্যাণ লাভ করেছে, যারা নিজেদের নামাযে ভীতি ও বিনয় অবলম্বন করে। যারা অনর্থক কাজ থেকে বিরত থাকে। যারা যাকাতের পন্থায় কর্মতৎপর হয়। যারা নিজেদের লজ্জাস্থানের হেফাজত করে। নিজেদের স্ত্রীদের ছাড়া এবং সেই মেয়েদের ছাড়া- যারা তাঁদের দক্ষিন হস্তে মালিকাধিন হবে। এই ক্ষেত্রে ( হেফাজত না করা হলে ) তারা তিরস্কারযোগ্য নয়। অবশ্য যে ব্যক্তি এদের ছাড়া অন্য কিছু চাইবে তারা সীমা লংঘনকারী হবে। যারা নিজেদের আমানত এবং নিজেদের ওয়াদা-চুক্তি রক্ষনাবেক্ষন করে। যারা নিজেদের নামাযের হেফাজত করে। এরাই হচ্ছে উত্তরাধিকারী। তারা ফিরদাউসের উত্তরাধিকারী হবে এবং সেখানে চিরদিন থাকবে।”
এখানে মুমিন বলতে সেই সব লোকদের বুঝানো হয়েছে, যারা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দাওয়াত কবুল করে নিয়েছে, তাঁকে নিজেদের পথপ্রদর্শক হিসেবে গ্রহন করেছে এবং তাঁর উপস্থাপিত জীবন-বিধানকে অনুসরন করে চলতে প্রস্তুত হয়েছে।
এই সুরার প্রথম ৯ টি আয়াতে ঈমানদার লোকদের সাতটি বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- কোন মুমিন ব্যক্তি এই সাতটি গুন অর্জন করতে পারলে সে নিশ্চিতই বেহেস্তে যাবে। স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা দশম ও একাদশ আয়াতে এদেরকে সর্বশ্রেষ্ঠ বেহেশত জান্নাতুল ফিরদাউসের উত্তরাধিকারী ঘোষণা করেছেন। অতএব আয়াতে উল্লেখিত গুন বৈশিষ্ট্য গুলো অর্জন করার একান্ত চেষ্টা করা আমাদের কর্তব্য।
প্রথম গুন হচ্ছে- বিনয় ও নম্রতা সহকারে নামায আদায় করা। ‘খুশু’ শব্দের অর্থ কারো সামনে বিনীতভাবে অবনত হওয়া, বিনীত হওয়া, নিজের কাতরতা ও অক্ষমতা প্রকাশ করা, স্থির রাখা। অন্তরের ‘খুশু’ হচ্ছে এই যে, ব্যক্তি আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্ত্বের কথা চিন্তা করে সন্ত্রস্থ হয়ে পড়বে। আর দেহের ‘খুশু’ হচ্ছে এই যে, ব্যক্তি যখন নামাযে দাঁড়াবে তখন মাথা নত করবে, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অবসাদ গ্রস্থ হয়ে পড়বে, দৃষ্টি অবনমিত হবে, কণ্ঠস্বর নরম ও বিনয়পূর্ণ হবে। এই খুশুই হচ্ছে নামাযের আসল প্রানশক্তি ও ভাবধারা। একবার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দেখলেন, এক ব্যক্তি নামায পড়ছে আর মুখের দাড়ি নিয়ে খেলা করছে। তখন তিনি বললেন-
আরবী****
“এই ব্যক্তির অন্তরে যদি ‘খুশু’ থাকতো তাহলে তাঁর অংঙ্গ- প্রতংঙ্গের উপর ‘খুশু’ পরিলক্ষিত হতো।’’ ( তাফসীরে মাযহারী, তাফহীমুল কুরআন )
দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- অনর্থক কাজ থেকে বিরত থাকা। মূল শব্দ হচ্ছে ‘লাগবুন’-। এমন প্রতিটি কথা ও কাজকে ‘লাগবুন’ বলা হয় যা অপ্রয়োজনীয়, অর্থহীন এবং নিষ্ফল। যেসব কথা ও কাজের কোনই ফল নাই, উপকার নাই, যা থেকে কোন কল্যাণকর ফলও লাভ করা যায় না, যার প্রকৃতই কোন প্রয়োজন নেই এবং যা থেকে কোন ভালো উদ্দেশ্য লাভ করা যায়না- এ সবই অর্থহীন, বেহুদা ও বাজে জিনিস এবং ‘লাগবুন’ বলতে এসবই বুঝায়। ঈমানদার লোকদেরকে এসব জিনিস থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে। অপর এক আয়াতে বলা হয়েছে-
আরবী****
“মুমিন লোকেরা যদি এমন কোন জায়গায় গিয়ে পড়ে যেখানে অর্থহীন ও বাজে কাজ বা কথা হচ্ছে – তাহলে সেখান থেকে আত্মমর্যাদা সহকারে কেটে পড়ে।” (সূরা ফুরকান, আয়াত-৭২)
মুমিন ব্যক্তি সুস্থ স্বভাবের অধিকারী হয়ে থাকে। সে পবিত্র চরিত্র ও উন্নত রুচির ধারক। সে অর্থপূর্ণ কথা বার্তাই বলবে, কিন্তু অর্থহীন গল্প-গুজব করে সময় নষ্ট করতে পারেনা। সে হাস্যরস ও রসিকতা করতে পারে, কিন্তু তাৎপর্যহীন হাসিঠাট্টা নয়। সে অশ্লীল গালিগালাজ, লজ্জাহীন কথাবার্তা বলতেও পারেনা, সহ্যও করতে পারেনা। আল্লাহ তায়ালা বেহেশতের একটি বৈশিষ্ট এই উল্লেখ করেছেন যে,
আরবী****
“সেখানে তারা কোন অর্থহীন ও বেহুদা কথাবার্তা শুনবেনা।” ( সূরা গাশিয়া, আয়াত- ১১ )
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-
আরবী****
“মানুষ যখন অর্থহীন বিষয়াদি ত্যাগ করে, তখন তাঁর ইসলাম সৌন্দর্যমণ্ডিত হতে পারে।”
—( তিরমিযি, ইবনে মাজাহ, মুয়াত্তাই ইমাম মালেক, মুসনাদে আহমাদ )
তৃতীয় বৈশিষ্ট হচ্ছে- যাকাত দেয়া এবং যাকাতের পন্থায় কর্মতৎপর হওয়া। যাকাত অর্থ একদিকে যেমন আত্মার পবিত্রতা অর্জন, অন্যদিকে এর অর্থ ধন সম্পদের পবিত্রতা বিধান।
চতুর্থ বৈশিষ্ট হচ্ছে- লজ্জাস্থানের হেফাজত করা। এর দুটি অর্থ রয়েছে। এক, নিজের দেহের লজ্জাস্থান সমূহকে ঢেকে রাখা, নগ্নতাকে প্রশ্রয় না দেয়া এবং অপর লোকদের সামনে নিজের লজ্জাস্থানকে প্রকাশ না করা।
দুই, তারা নিজেদের পবিত্রতা এবং সতীত্বকে রক্ষা করে। অর্থাৎ অবাধ যৌনাচার করে বেড়ায়না। পাশবিক প্রবৃত্তিকে চরিতার্থ করার ক্ষেত্রে সীমা লংঘন করেনা।
পঞ্চম বৈশিষ্ট হচ্ছে- আমানতের রক্ষনাবেক্ষন ও তা প্রত্যর্পণ। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-
আরবী*****
“যার আমানাতদারীর গুন নাই তাঁর ঈমান নাই।” ( বায়হাকীর শুয়াবুল ঈমান )
ষষ্ঠ বৈশিষ্ট হচ্ছে- ওয়াদা- চুক্তির রক্ষনাবেক্ষন করা। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-
আরবী****
“ যে ওয়াদা – চুক্তি রক্ষা করেনা তাঁর কোন ধর্ম নাই। ” ( বায়হাকীর শুয়াবুল ঈমান )
বস্তুত আমানতের খেয়ানত এবং ওয়াদা- চুক্তিকে ভঙ্গ করাকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মোনাফিকের চারটি লক্ষনের অন্যতম দুইটি বলে উল্লেখ করেছেন।
“সে যখন ওয়াদা করে ভংগ করে এবং তাঁর কাছে যদি আমানত রাখা হয় তাঁর খেয়ানত করে।”——–( সহীহ বুখারী ও মুসলিম )
সপ্তম বৈশিষ্ট হচ্ছে—নামাযের হেফাজত করা। নামাযের হেফাজতের অর্থ হচ্ছে নামাযের নির্দিষ্ট সময় সমূহ, এর নিয়ম- কানুন, শর্ত ও রোকন সমূহ, নামাযের বিভিন্ন অংশ- এক কথায় নামাযের সাথে সম্পর্কিত বিষয়সমূহের পূর্ণ সংরক্ষণ করা।
যে ব্যক্তি এসব গুন বৈশিষ্টের অধিকারী হয়ে যায় এবং এর উপর স্থির থাকে, সে পূর্ণাঙ্গ মুমিন এবং দুনিয়া ও আখিরাতের সাফল্যের অধিকারী।
সূরা ইয়াসিনের ফযিলত
আরবী****
২৩। হযরত আনাস ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- প্রতিটি জিনিসেরই একটি হৃদয় আছে এবং কুরআনের হৃদয় হচ্ছে সূরা ইয়াসীন। যে ব্যক্তি সূরা ইয়াসিন পাঠ করে, আল্লাহ তায়ালা তা পাঠের বিনিময়ে তাঁকে দশবার পূর্ণ কুরআন পাঠ করার সওয়াব দান করবেন।—— ( ইমাম তিরমিযি এ হাদীস বর্ণনা করেছেন এবং একে গরীব হাদীস বলেছেন )
আরবী*****
২৪। হযরত আবু হুরাইরাহ ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- যে ব্যক্তি রাতের বেলা সূরা ইয়াসীন পাঠ করে- সে ক্ষমাপ্রাপ্ত অবস্থায় সকালে ঘুম থেকে উঠে। আর যে ব্যক্তি সূরা হা-মীম পাঠ করে। যার মধ্যে ধোঁয়ার কনা উল্লেখ আছে ( অর্থাৎ সূরা দোখান ) – সে ক্ষমাপ্রাপ্ত অবস্থায় সকালে ঘুম থেকে উঠে। —– ( হাফেজ তাঁর গ্রন্থে এ হাদীস উল্লেখ করেছেন )
আরবী****
২৫। হযরত জুনদুব ইবনে আব্দুল্লাহ ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- যে ব্যক্তি মহামহিম আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য রাতের বেলা সূরা ইয়াসীন পাঠ করে- তাঁর গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে।
আরবী***
২৬। হযরত মা’কিল ইবনে ইয়াসার ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- “এটা তোমাদের মুমূর্ষু ব্যক্তিদের নিকট পাঠ করো।” অর্থাৎ সূরা ইয়াসীন। -( আবু দাউদ, নাসাঈ, ইবনে মাযাহ, মুসনাদে আহমাদ )
আরবী****
২৭। হযরত ইবনে আব্বাস ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- আমি আশা করি আমার উম্মতের প্রতিটি ব্যক্তির হৃদয়ে এই সূরাটি ( সুয়ার ইয়াসীন ) গাঁথা থাক। ———– ( সহীহ বুখারী )
হাফেজ ইমামুদ্দীন আবুল ফিদা ইসমাঈল ইবনে কাসীর দামেশকী ( মৃত ৭৭৪ হিঃ ) বলেন, এসব হাদীসের পরিপ্রেক্ষিতে বিশেষজ্ঞ আলেমগন বলেছেন, কোন কঠিন বিপদ বা শক্ত কাজ সামনে উপস্থিত হলে – তখন এই সূরা পাঠ করার বরকতে আল্লাহ তায়ালা সেই বিপদ বা কাজকে সহজ করে দেন। মুমূর্ষু ব্যক্তির নিকট এই সূরা পাঠ করতে বলার অর্থ হচ্ছে এই যে, এসময় আল্লাহ তায়ালা রহমত ও বরকত নাযিল করেন এবং সহজভাবে রূহ বের করে নেয়া হয়। আসল ব্যাপার আল্লাহই ভালো জানেন। ইমাম আহমাদ ( রঃ ) বলেছেন- আমাদের প্রবীণরা বলতেন, মুমূর্ষু ব্যক্তির নিকট সূরা ইয়াসীন পাঠ করা হলে আল্লাহ তাঁর কষ্ট লাঘব করে দেন। ( তাফসীরে ইবনে কাসীর, ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা- ১৫৪ )
আল্লামা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদী বলেন- ইবনে আব্বাস, ইকরামা, দাহহাক, হাসান বসরী ও সুফিয়ান ইবনে উআইনা বলেন- ‘ইয়াসীন’ অর্থ ‘হে মানুষ’ বা ‘হে ব্যক্তি’। কোন কোন তাফসীরকার বলেছেন, ইয়া সাইয়েদ ( হে নেতা ) কথাটির শব্দ সংক্ষেপ হচ্ছে ‘ইয়াসীন’। এই সব কটি অর্থের দিক দিয়ে বলা যায়, এখানে হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়আ সাল্লামকেই সম্বোধন করা হয়েছে।
‘সূরা ইয়াসীন কুরআনের হৃদয়’ – এই উপমাটি ঠিক তেমনি যেমন বলা হয়েছে ‘সূরা ফাতিহা কুরআনের মা’। সূরা ফাতিহাকে কুরআনের মা বলার অর্থ হচ্ছে এই যে, এর মধ্যে কুরআন মাজীদের সমস্ত শিক্ষার সারকথা বিবৃত হয়েছে। অনুরূপভাবে সূরা ইয়াসীন কুরআনের জীবন্ত ও প্রানবন্ত দীল এই হিসাবে যে, এই সূরা কুরআনের দাওয়াতকে অতীব জোরালোভাবে পেশ করে। এর প্রচণ্ডতায় স্থবিরতা চূর্ণ হয় এবং প্রানে অগ্নিশীলতা সৃষ্টি হয়।
মুমূর্ষু ব্যক্তির সামনে সূরা ইয়াসীন পাঠ করার তাৎপর্য হচ্ছে এই যে, এর ফলে মুসলমানের মনে মৃত্যুকালে সমস্ত ইসলামী আকীদাহ তাজা ও নতুন হয়ে যায় এবং তাঁর সামনে আখেরাতের পুরা নক্সা উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। দুনিয়ার জীবন শেষ হওয়ার পর তাঁকে পরবর্তী কোন সব মঞ্জিলের সম্মুখীন হতে হবে- তা সে স্পষ্ট জানতে পারে। এই কল্যাণ দৃষ্টির পূর্ণতা বিধানের জন্যে- আরবী বোঝেনা এমন সব লোকের সামনে এই সূরা পাঠ করার সাথে সাথে তাঁর অর্থও পড়ে শুনানো আবশ্যক। এর সাহায্যেই নসিহত স্মরণ করিয়ে দেয়ার কাজটিও পূর্ণ মাত্রায় সম্পন্ন হতে পারে। -( সূরা ইয়াসীনের ভূমিকা, তাফহীমুল কুরআন, চতুর্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা- ২৪৪ )
সূরা মুলকের ফযিলত
আরবী****
২৮। হযরত ইবনে আব্বাস ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কোন এক সাহাবী কবরের উপর তাবু টানান। তিনি অনুমান করতে পারেননি যে, এটা একটা কবর। এটা ছিল একটি লোকের কবর। ( সাহাবী শুনতে পেলেন ) সে সূরা মুলক পাঠ করছেন। তা শেষ পর্যন্ত পাঠ করলো। তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে বললেন, হে আল্লাহর রাসুল, আমি একটি কবরের উপর আমার তাবু টানাই। আমি জানতাম না যে, তা একটি কবর। তাঁর মধ্যে একটি লোক সূরা মুলক পাঠ করছে ( শুনলাম )। সে তাঁর শেষ পর্যন্ত পাঠ করলো। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, এটা কবরের আযাব প্রতিরোধকারী, এটা তাঁর পাঠকারীকে কবরের আযাব থেকে বাচায়। -( তিরমিযি )
আরবী****
২৯। হযরত আউ হুরাইরাহ ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- কুরআন মাজীদে ত্রিশটি আয়াত সম্বলিত একটি সূরা আছে। তা কোন ব্যক্তির জন্য সুপারিশ করলে তাঁকে মাফ করে দেয়া হয়। সূরাটি হচ্ছে- “তাবারা কাল্লাজি বিয়াদিহুল মুলক—–” ( তিরমিযি )
৩০। হযরত যাবের ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সূরা “আলিফ-লাম-মীম তানযীল ( সাজদাহ ) এবং ‘তাবারা কাল্লাজি বিয়াদিহুল মুলক’ না পড়া পর্যন্ত ঘুম যেতেন না। ———–( তিরমিযি )
সূরা ইখলাছ কুরআনের এক-তৃতীয়াংশের সমান
৩১। হযরত আবু দারদা ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- তোমাদের কেউ কি প্রতি রাতে এক তৃতীয়াংশ কুরআন শরীফ পড়তে অক্ষম? সাহাবীগন বললেন- এক রাতে এক তৃতীয়াংশ কুরআন কিভাবে পড়তে পারে? তিনি বললেন – “কুল হু আল্লাহু আহাদ, আল্লাহুস সামাদ” ( সূরা ইখলাছ ) এক তৃতীয়াংশ কুরআনের সমান। ————-( মুসলিম, ইমাম বুখারী এ হাদীসখানা হযরত আবু সাঈদ খুদরীর সুত্রে বর্ণনা করেছেন )
পুরা কুরআন শরীফে নিম্নোক্ত বিষয়বস্তু আলোচিত হয়েছেঃ
(এক), আহকাম বা আইন-কানুন, (দুই) নবীদের ঘটনাবলী অর্থাৎ ইতিহাস, (তিন), আকায়েদ বা ইসলামী বিশ্বাসের শিক্ষা- প্রশিক্ষণ। যেহেতু আকায়েদের মূল হচ্ছে তৌহিদ এবং তৌহিদকে বাদ দিলে ইসলামী আকীদার কোন অর্থই বাকী থাকে না। এজন্য সূরা ইখলাছ তৌহিদের পূর্ণাঙ্গ বর্ণনা হওয়ার কারনে এটাকে এক তৃতীয়াংশের সমান সাব্যস্ত করা হয়েছে।
চিন্তা করুন, রাসুলুল্লাহ সাল্লালালহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শিক্ষা পদ্ধতি এবং প্রশিক্ষনের ধরন কতটা অতুলনীয় ছিল। তিনি এমন সব কথা ও বাক্যের মাধ্যমে শিক্ষা দিতেন যার ফলে শিক্ষার্থীদের মনে তা দ্রুত অংকিত হয়ে যেত এবং তাঁর মানসটে গেঁথে যেত। কোন ব্যক্তির মনে একথা দৃঢ়মূল করার জন্য অর্থাৎ সূরা ইখলাছের কি গুরুত্ব রয়েছে তা বুঝানোর জন্যে কয়েক ঘণ্টার বক্তৃতার প্রয়োজন। কিন্তু রাসুলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মাত্র সামান্য কয়েকটি কথার মাধ্যমে তা বুঝিয়ে দিলেন এবং বললেন, যদি তোমরা সূরা ইখলাছ একবার পাঠ করো তাহলে এটা যেন এক তৃতীয়াংশ কুরআন পাঠ করার সমতুল্য হয়ে গেলো।
এই একটি মাত্র বাক্যে এই সুরার যে গুরুত্ব মানুষের মনে দৃঢ়মূল হয়ে যায় তা কয়েক ঘণ্টার বক্তৃতায়ও সম্ভব নয়। এটা ছিল রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিশেষ প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা যার মাধ্যমে তিনি সাহাবাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন।
সূরা ইখলাছ আল্লাহর নৈকট্য লাভের মাধ্যম
আরবী****
৩২। হযরত আয়েশা ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক ব্যক্তিকে একটি ক্ষুদ্র বাহিনীর অধিনায়ক বানিয়ে পাঠালেন। সে নিজের সঙ্গীদের নামাজ পড়ানোর সময় সূরা ইখলাছের মাধ্যমে সর্বদা কিরাত শেষ করতো। তাঁর যখন অভিযান থেকে ফিরে আসলো, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে একথা ব্যক্ত করলে, ত্নি বললেন- তোমরা গিয়ে জিজ্ঞেস করো সে কেন এরকম করেছে? সুতরাং তারা তাঁকে একথা জিজ্ঞেস করলো। সে বলল, এই সুরার মধ্যে আল্লাহ তায়ালার পরিচয় বর্ণনা করা হয়েছে। এজন্যে আমি এই সূরাটি পড়তে ভালোবাসি। একথা শুনে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন- তাঁকে গিয়ে সুসংবাদ দাও আল্লাহ তায়ালাও তাঁকে ভালোবাসেন। ———– ( সহীহ বুখারী ও মুসলিম )
যে সামরিক অভিযানে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বয়ং অংশ গ্রহন করতেন না তাঁকে সারিয়াহ বলা হতো। আর যে সামরিক অভিযানে তিনি নিজে অংশ গ্রহন করতেন তাঁকে গাযওয়া বলা হয়।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং সাহাবাদের যুগে এবং পরবর্তীকালেও একটা উল্লেখযোগ্য কাল পর্যন্ত এই নিয়ম চালু ছিল যে, যে ব্যক্তি জামায়াতের আমীর হতো সে-ই দলের নামাজের ইমামতি করতো। অর্থাৎ যদি কোন ব্যক্তি কোন সামরিক অভিযানের অধিনায়ক হতো তাহলে নামাজ পড়ানোর দায়িত্ব তাঁর উপরেই থাকতো। অনুরূপভাবে কেন্দ্রে খলীফা ( ইসলামী রাষ্ট্রের প্রধান ) নামাযে ইমামতি করতেন এবং লোকদের উদ্দেশ্যে খুতবা দিতেন। এখানে যে সামরিক অভিযানের কথা বর্ণনা করা হয়েছে তাঁর অধিনায়কের অভ্যাস ছিল তিনি নামাযে সূরা ফাতিহা পাঠ করার পর একান্তভাবেই সূরা ইখলাছ পাঠ করতেন। একথা যখন রাসুলুল্লাহ সাল্লালালহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের গোচরে আনা হল এবং তাঁর নির্দেশ অনুযায়ী ঐ ব্যক্তির কাছে জিজ্ঞেস করার মাধ্যমে এর কারন জানা গেলো তখন তিনি তাঁকে সুসংবাদ দিলেন, তুমি যখন এই সূরা পাঠ করতে এতো পছন্দ করো যে, এতে উত্তম পন্থায় আল্লাহ তায়ালার পরিচয় বর্ণনা করা হয়েছে- তাই আল্লাহ তায়ালাও তোমাকে ভালোবাসেন। পূর্ববর্তী- হাদীসে বলা হয়েছে সূরা ইখলাছ এক তৃতীয়াংশ কুরআনের সমান। আর এখানে বলা হয়েছে- সূরা ইখলাছে সুন্দরভাবে তৌহিদের বর্ণনা থাকার কারনে যে ব্যক্তি এই সুরাকে পছন্দ করে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে আল্লাহর প্রিয় হওয়ার সুসংবাদ দিয়েছেন।
দুনিয়ার কোন কিতাবেই এতো সংক্ষিপ্ত বাক্যে তৌহিদকে পূর্ণাংগভাবে বর্ণনা করা হয়নি, যার মাধ্যমে দুনিয়ায় বিরাজমান সমস্ত গোমরাহির মূল শিকড় একই সাথে কেটে ফেলা হয়েছে। এতো সংক্ষিপ্ত বাক্যে এত বড় বিষয়বস্তু এমন পূর্ণাঙ্গভাবে কোন আসমানি কিতাবেই বর্ণিত হয়নি। সমস্ত আসমানি কিতাব যা অল্প বিস্তার বর্তমানে দুনিয়াতে পাওয়া যাচ্ছে, তাতে এই বিষয়বস্তু অনুপস্থিত। এই ভিত্তিতে যে ব্যক্তি এটাকে বুঝতে চেষ্টা করে, এর প্রানসত্তার সাথে পরিচয় লাভ করেছে সে এই সুরার সাথে গভীর ভালোবাসা রাখে। স্বয়ং এই সুরার নাম সূরা ইখলাছই- এই নিগূঢ় তত্ত্বের প্রতিনিধিত্ব করে যে, এটা সেই সূরা যা খালেছ তৌহিদের শিক্ষা দেয়। তা এমন তৌহিদের শিক্ষা দেয় যার সাথে শিরকের নাম গন্ধ পর্যন্ত অবশিষ্ট থাকে না। এ জন্যে যে ব্যক্তি উল্লেখিত কারনে এই সুরার সাথে মহব্বত রাখে সে আল্লাহ তায়ালারও প্রিয় বান্দাহ হিসাবে গণ্য হয়।
সূরা ইখলাছের প্রতি আকর্ষণ বেহেশতে প্রবেশের কারন
আরবী****
৩৩। হযরত আনাস ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, এক ব্যক্তি বলল- ইয়া রাসুলুল্লাহ, আমি এই সূরা অখলাছকে ভালোবাসি। তিনি বললেন- তোমার এই ভালোবাসা তোমাকে বেহেশতে প্রবেশ করাবে। ——–( তিরমিযি, বুখারী )
জানা গেলো যে, এই সুরার প্রতি ভালোবাসা একটি স্থিরিকৃত ব্যাপার। কোন ব্যক্তির জান্নাতে প্রবেশ করার সিদ্ধান্ত এই কথার দ্বারাই হয়ে গেছে যে, এই সূরাটি তাঁর প্রিয় ছিল। কিন্তু কোন ব্যক্তির অন্তর শিরকের যাবতীয় মলিনতা থেকে সম্পূর্ণ পাক হওয়া এবং খালেছ তৌহিদ তাঁর মন মগজে বদ্ধমূল হওয়া ছাড়া এই সুরার প্রেমিক হওয়া সম্ভব নয়। অন্তরে খালেছ তৌহিদ বদ্ধমূল হয়ে যাওয়াটাই বেহেশতের চাবি। যদি তৌহিদের ধারনায় ত্রুটি থেকে যায় তাহলে বেহেশতের কোন প্রশ্নই আসে না। মানুষের জীবনে যদি অন্যান্য ত্রুটি- বিচ্চুতি থেকে থাকে তা আল্লাহ তায়ালা মাফ করে দিবেন, কিন্তু তৌহিদের বিশ্বাসের মধ্যে গোলমাল থাকলে তা ক্ষমার অযোগ্য।
যদি কারো মনে নির্ভেজাল তৌহিদ বদ্ধমূল হয়ে যায় তাহলে তাঁর মধ্যে অন্যান্য ত্রুতি-বিচ্চুতি খুব কমই অবশিষ্ট থাকবে। কিন্তু যদিও বা থেকে যায় তাহলে সে তওবা করার সৌভাগ্য লাভ করবে। মনে করুন, যদি তওবা করার সুযোগও না পায় এবং সে তওবা করতে ভুলে গিয়ে থাকে তবুও আল্লাহ তায়ালার দরবারে তাঁর ক্ষমা হয়ে যাবে। কেননা খালেছ তৌহিদ হচ্ছে এমনই এক বাস্তব সত্য- আল্লাহর প্রতি মানুষের বিশ্বাসী বা অবিশ্বাসী হওয়া যার উপর নির্ভরশীল। যে ব্যক্তি খালেছ তৌহিদের অনুসারী- সে আল্লাহর বিশ্বাসভাজনদের অন্তর্ভুক্ত। আর অবিশ্বাসী ও বিশ্বাসঘাতকদের সাথে আল্লাহর আচরন যেমন হয়- তাঁর বিশ্বাসভাজনদের প্রতিও তাঁর আচরন তদ্রূপ নয়। এজন্যই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঐ ব্যক্তিকে বলেছেন- এই সুরার প্রিয়পাত্র হওয়াটাই তোমার বেহেশতে প্রবেশের ফায়সালা করে দিয়েছে।
সূরা ফালাক ও সূরা নাস- দুটি অতুলনীয় সূরা
আরবী****
৩৪। হযরত উকবা ইবনে আমের ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে বললেন- তুমি কি দেখেছো আজ রাতে এমন কতগুলো আয়াত নাযিল হয়েছে যার নযীর কখনো দেখা যায়নি? তা হচ্ছে- “কুল আউউযুবি রাব্বিল ফালাক—এবং কুল আউসু বি রাব্বিন নাস” সূরাদ্বয়। —( সহীহ মুসলিম )
এখানে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সূরা নাস ও ফালাক সম্পর্কে বলেছেন যে, এ দুটি অতুলনীয় সূরা, যার দৃষ্টান্ত আগে কখনো পাওয়া যায়নি। এর কারন হচ্ছে- পূর্বেকার আসমানি কিতাব গুলোতে এই বিসয়বস্তু সম্বলিত কোন সুরার উল্লেখ নেই। এ সূরাদ্বয়ও অত্যন্ত সংক্ষেপে কিন্তু পূর্ণাংগ ভাবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়বস্তু বিবৃত হয়েছে। আর দ্বিতীয় যে কারনে এ সূরা দুটির বিষয়বস্তু ভালোভাবে হৃদয়ঙ্গম করে নেয়া যায় তাহলো- এটা মানুষকে যে কোন ধরনের শংসয়- সন্দেহ, দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি দান করে এবং যে কোন ব্যক্তি পূর্ণ নিশ্চিন্ততা ও আত্মবিশ্বাসের সাথে হকের রাস্তায় চলতে পারে।
প্রথম সূরাটিতে বলা হয়েছে এই কথা বলে দাও যে, আমি সেই মহান রবের আশ্রয় প্রার্থনা করি যিনি ভোরের উন্মেষকারী, সমস্ত সৃষ্ট বস্তুর অনিষ্ট থেকে হেফাজতকারী, অন্ধকার রাতে আবির্ভাব হওয়া যাবতীয় ভয়-ভীতি ও শংকা থেকে মুক্তি দানকারী এবং যেসব দুষ্ট লোক যাদুটোনা এবং অন্যান্য উপায়ে মানুষের ক্ষতি সাধনে তৎপর তাঁদের আক্রমন থেকে নিরাপত্তা দানকারী। দ্বিতীয় সূরায় বলা হয়েছে, তুমি বলে দাও – সেই মহান সত্তার আশ্রয় গ্রহন করছি যিনি মানুষের রব, মানুষের মালিক এবং মানুষের উপাস্য। যেস মানুষ এবং শয়তানেরা অন্তরের মধ্যে সন্দেহ-শংসয় সৃষ্টি করে- আমি এদের আক্রমন থেকে বাঁচার জন্যে তাঁর আশ্রয় প্রার্থনা করছি।
কোন ব্যক্তি যদি ‘আইউযুবি রাব্বিল ফালাক’ এবং ‘আউউযুবি রাব্বিন নাস’ বাক্যগুলো নিজের জবানে উচ্চারন করে এবং সে যেসব বিপর্যয় ও অনিষ্ট থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছে- সেগুলোকে আবার ভয়ও করছে – তাহলে তাঁর মুখ থেকে এই শব্দগুলো বের হওয়া নিরর্থক। যদি সে একনিষ্ঠ এবং হৃদয়ঙ্গম করে একথাগুলো উচ্চারন করে তাহলে তাঁর দুশ্চিন্তামুক্ত হয়ে যাওয়া উচিৎ যে, কেউই তাঁর কোন ক্ষতি করতে পারবেনা। তাঁর মধ্যে এই বিশ্বাস বদ্ধমূল হয়ে যাওয়া উচিৎ যে, এখন কেউই তাঁর কোন বিপর্যয় ঘটাতে পারবে না। কেননা সে মহান আল্লাহর আশ্রয় গ্রহন করেছে, যিনি এই মহা বিশ্বের মালিক এবং সমগ্র মানব কুলেরও একচ্ছত্র অধিপতি। যখন সে তাঁর আশ্রয় গ্রহন করলো এবং ঘোষণা করে দিলো, এখন আমি আর কারো অনিষ্টের আশংকা করি না- এরপর তাঁর আর ভীত- সন্ত্রস্ত্র হওয়ার আর কোন কারন থাকতে পারে না। মানুষ তো কেবল এমন সত্তারই আশ্রয় নিয়ে থাকে যার সম্পর্কে তাঁর আত্মবিশ্বাস রয়েছে যে, সে তাঁকে আশ্রয় দেয়ার শক্তি রাখে। যদি কেউ আশ্রয় দেয়ার শক্তিই না রাখে তাহলে তাঁর কাছে কেবল নির্বোধ ব্যক্তিই আশ্রয় চাইতে পারে। এক ব্যক্তি বিবিধ বিশ্বাসের ভিত্তিতে কারো আশ্রয় গ্রহন করে থাকে। এক, যে তাঁকে আশ্রয় দেয়ার মতো ক্ষমতা রাখে। দুই, যাদের ক্ষতি থেকে আত্মরক্ষার জন্য সে ভেগে এসে তাঁর আচলে আশ্রয় নিচ্ছে- এদের সবার শক্তি ও ক্ষমতা তাঁর কাছে মূল্যহীন। যতক্ষন তাঁর মধ্যে এ দুটি বিষয়ে প্রত্যয় সৃষ্টি না হবে, সে তাঁর আশ্রয় গ্রহন করতে পারে না। সে যদি এই প্রত্যয় সহকারে তাঁর আশ্রয় গ্রহন করে তাহলে তাঁর ভয়-ভীতি ও আশংকা বোধ করার কোন অর্থই হয় না।
যদি কোন ব্যক্তি আল্লাহ তায়ালার এরূপ শক্তি ও ক্ষমতার উপর বিশ্বাস রেখে তাঁর রাস্তায় কাজ করার জন্য প্রস্তুত হয়ে যায় তাহলে সে কাউকে ভয় করতে পারে না। দুনিয়ার এমন কোন শক্তি নেই- সে যার ভয় করতে পারে। সে সম্পূর্ণভাবে দুশ্চিন্তা মুক্ত হয়ে আল্লাহর রাস্তায় কাজ করবে এবং গোটা দুনিয়ার বাতিল শক্তির বিরুদ্ধে মোকাবেলায় অবতীর্ণ হবে।
হযরত মুসা আলাইহিস সালাম নিজের ভাইয়ের সাথে ফিরাউনের বিরুদ্ধে লাঠি নিয়ে পৌছে গেলেন। এতোবড় বিরাট শক্তির বিরুদ্ধে মাত্র দুটি প্রান কিভাবে রুখে দাঁড়ালেন? শুধু এই জন্য যে, আল্লাহর আশ্রয়ের উপর তাঁদের আত্মবিশ্বাস ছিল। যখন আল্লাহর আশ্রয় গ্রহন করা হয় তখন পরাশক্তির বিরুদ্ধেও চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ানো যায়। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ তায়ালার কালেমাকে সমুন্নত করার জন্য সমগ্র দুনিয়ার বিরুদ্ধে কিভাবে দাঁড়িয়ে গেলেন? কেবল আল্লাহর উপর ভরসা থাকার কারনেই তা সম্ভব হয়েছে। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, আমার পিছনে আল্লাহর শক্তি রয়েছে, যিনি সমগ্র বিশ্ব এবং সকল শক্তির মালিক। অনুরূপভাবে যেসব লোক আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করার জন্য দাঁড়িয়ে গেছেন, আল্লাহর কালেমাকে সমুন্নত করার জন্য সমস্ত শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর দৃঢ় সংকল্প রাখে- তাদেরও আল্লাহর উপর ভরসা করতে হবে এবং তাঁর আশ্রয়ের উপর অবিচল আস্থা- বিশ্বাস থাকতে হবে- চাই তাঁদের কাছে উপায়-উপকরন, সৈন্য সামন্ত এবং প্রয়োজনীয় অন্যান্য জিনিসপত্র থাক বা না থাক। মানুষ এরূপ দুঃসাহস তখনই করতে পারে যখন আল্লাহর আশ্রয় সম্পর্কে তাঁর পূর্ণ ঈমান থাকে। এ জন্যই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- এগুলো অতুলনীয় বাক্য যা এই দুটো সূরায় বর্ণিত হয়েছে। কেননা এতে যে কোনো ধরনের বিপর্যয় এবং বাতিল শক্তির বিরুদ্ধে কেবল আল্লাহ তায়ালার পক্ষপুটে আশ্রয় নেয়ার শিক্ষা দেয়া হয়েছে। এর ফলশ্রুতিতে একজন মুমিনের অন্তরে তাঁর দেয়া আশ্রয় সম্পর্কে আত্মবিশ্বাস সৃষ্টি হয়।
কুরআনের শব্দগুলোর মধ্যেও বরকত রয়েছে
আরবী****
৩৫। হযরত আয়েশা ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রাতে যখন বিছানায় শুতে যেতেব, নিজের উভয় হাতের তালু একত্রে মিলিয়ে তাতে সূরা “কুল হু আল্লাহু আহাদ—”, “কুল আউউযু বি রাব্বিল ফালাক” এবং “কুল আউউযু বি রাব্বিন নাস” পড়ে ফু দিতেন। অতপর তিনি নিজের হাতের তালুদ্বয় সমস্ত দেহে তা যতদুর পৌছতে সক্ষম ফিরাতেন। প্রথমে মাথায়, অতঃপর মুখমণ্ডলে, তারপর দেহের সামনের ভাগে। তিনি এভাবে তিনবার করতেন। -( সহীহ বুখারী ও মুসলিম )
কালামে ইলাহীর শব্দভাণ্ডারে, তাঁর উচ্চারনে এবং এর বিষয়বস্তু সব কিছুর মধ্যেই কল্যাণ, প্রাচুর্য ও বরকত লুকিয়ে আছে। এর সম্পূর্ণটাই বরকত আর বরকত, কল্যাণ আর প্রাচুর্যে পরিপূর্ণ। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেভাবে আল্লাহর কালাম বুঝতেন এবং তদানুযায়ী কাজ করতেন এবং এর উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য অনুযায়ী সমগ্র পৃথিবীতে আল্লাহর কালেমাকে সমুন্নত করার জন্য আপ্রান চেষ্টা করতেন, অনুরূপভাবে তিনি কালামে ইলাহীর মধ্যে নিহিত অন্যান্য বরকতও লাভ করার চেষ্টা করতেন। যেমন, কুরআনের আয়াত পড়ে পানিতে ফু দেয়া এবং নিজে পান করা বা অন্নকে পান করানো, তা পড়ে হাতে ফু দেয়া অতঃপর তা দেহে মর্দন করা- এভাবে তিনি কুরআনের বরকতের প্রকাশ্য এবং অপ্রকাশ্য কোন দিকই ছাড়তেন না। আজো যদি কোন ব্যক্তি এরূপ করে তবে করতে পারে এবং এটাও বরকতের কারন হবে। তবে একথা অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, এই বরকতের ফায়দা কেবল এমন ব্যক্তিই লাভ করতে পারে, যে কুরআনের বাহ্যিক দিকের সাথে সাথে এর বাতেনি দিকের সাথেও সম্পর্ক বজায় রাখে। যদি কোন ব্যক্তি কুরআনের উদ্দেশ্যের বিপরীত জীবন যাপন করে, আবার সূরা ইখলাছ, সূরা ফালাক এবং সূরা নাস পড়ে নিজের বুকে ফুক দেয়, তাহলে প্রশ্ন জাগে- সে অবশেষে কোন ধরনের বিপর্যয় ও অনিষ্ট থেকে পানাহ চাচ্ছে? সে যে সুদ খেয়ে সমাজের অনিষ্ট সাধন করেছে- এখন পুলিশ বাহিনী যেন তাঁকে গ্রেপ্তার না করে- এজন্য আশ্রয় প্রার্থনা করছে? এই জন্য একথা ভালোভাবে বুঝে নিতে হবে, যে ব্যক্তি বাস্তব ক্ষেত্রে কুরআনের লক্ষ্য অনুযায়ী কাজ করছে কেবল সে-ই এর বরকত ও কল্যাণ লাভ করতে সক্ষম হবে। এরপর কুরআনের শব্দগুলোর মধ্যে যে বরকত রয়েছে তা সে অনায়াসে লাভ করতে পারবে। কিন্তু যে ব্যক্তি রাত দিন কুরআনের বিরুদ্ধে লড়ছে এবং নিজের কথায় ও কাজে কুরআনের নির্দেশের পরিপন্থী কাজ করছে তাঁর জন্য এই বরকত ও কল্যাণ হতে পারে না।
কিয়ামতের দিন পক্ষ অবলম্বনকারী তিনটি জিনিস-
কুরআন, আমানাত ও আত্মীয়তার সম্পর্ক
আরবী****
৩৬। হযরত আব্দুর রহমান ইবনে আওফ ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- কিয়ামতের দিন তিনটি জিনিস আরশের নীচে থাকবে। এক, কুরআন যা বআন্দার পক্ষে বা বিপক্ষে আরজি পেশ করবে। এর বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণ দুটি দিক রয়েছে। দুই, আমানত এবং তিন, আত্মীয়তার সম্পর্ক। এই সম্পর্ক ফরিয়াদ করে বলবে, যে ব্যক্তি আমাকে রক্ষা করেছে- আল্লাহ তায়ালাও তাঁকে রক্ষা করবেন। আর যে ব্যক্তি আমাকে ছিন্ন করেছে- আল্লাহ- তায়ালাও তাঁকে ছিন্ন করবেন। ( ইমাম বাগাবীর শরহে সুন্নাহ)
কিয়ামতের দিন কুরআন মাজীদ, আমানত এবং আত্মীয়তার সম্পর্কের আল্লাহ পাকের আরশের নীচে থাকার অর্থ এই নয় যে, উল্লেখিত জিনিসগুলো সেখানে মানুষের আকৃতি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে। বরং এর অর্থ হচ্ছে- এই তিনটি সেই গুরুত্বপূর্ণ জিনিস যা কিয়ামতের দিন মানুষের মোকদ্দমা সমূহের মীমাংশা করার জন্য সামনেই উপস্থিত থাকবে। এ তিনটি জিনিসকে দৃষ্টান্তের আকারে পেশ করা হয়েছে। যেমন কোন রাষ্ট্র প্রধানের দরবারে তাঁর তিনজন উচ্চপদস্থ প্রিয় ব্যক্তি দণ্ডায়মান হয়ে আছে। এবং তারা বলে দিচ্ছে কোন ব্যক্তি কেমন প্রকৃতির এবং কি ধরনের ব্যবহার পাওয়ার উপযোগী। এভাবে যেন একটি চিত্র ফুতিয়ে তোলা হয়েছে যে, কিয়ামতের দিন মানুষের যাবতীয় ব্যাপারে ফায়সালা করার জন্য সর্বপ্রথম যে জিনিসটি সামনে আসবে তা হচ্ছে- আল কুরআন। এই কুরআন সম্পর্কে বলা হয়েছে- “ইউহাজ্জুল ইবাদ”। এর দুটি অর্থ হতে পারে। একটি অর্থ হচ্ছে এই যে, কুরআন বান্দাদের বিরুদ্ধে মামলা পরিচালনা করবে। আর দ্বিতীয় অর্থ হচ্ছে এই যে, সে বান্দাদের স্বপক্ষে মামলা পরিচালনা করবে।
এই ধরনের বক্তব্য পূর্বের একটি হাদীসেও এসেছে – “আল কুরআনু উজ্জাতুন লাকা আও আলাইকা”। অর্থাৎ কুরআন হয় তোমার স্বপক্ষে দলীল হবে অথবা তোমার বিপক্ষে দলীল হবে। কুরআন এসে যাওয়ার পর এখন ব্যাপারটি দুই অবস্থা থেকে খালী নয়। যদি তোমরা কুরআনের নির্দেশ মতো কাজ করে থাকো তাহলে এটা তোমাদের অনুকূলে সাক্ষ্য দেবে। আর যদি তোমরা কুরআনের নির্দেশের বিপরীত কাজ করো, তাহলে এটা তোমাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে। কোন ব্যক্তিকে যখন আল্লাহর আদালতে পেশ করা হবে তখন যদি এই প্রমান পাওয়া যায় যে, আল্লাহ তায়ালা কুরআন মাজীদের আকারে যে নির্দেশনামা পাঠিয়ে ছিলেন- সে তদানুযায়ী আমল করার চেষ্টা করেছে, তখন কুরআনই তাঁর পক্ষে প্রমান পেশ করবে এবং আল্লাহ তায়ালার কাছে আরজ পেশ করবে- এই ব্যক্তি দুনিয়াতে আপনার নির্দেশ মতো জীবন যাপন করে এসেছে। তাই তাঁকে এই পুরস্কার দান করা হোক। কিন্তু যে ব্যক্তি কুরআনের নির্দেশ পাওয়ার পরও তাঁর বিপরীত কাজ করেছে – কুরআন তাঁর বিরুদ্ধে মামলা চালাবে।
আরো বলা হয়েছে, কুরআনের একটি বাহ্যিক দিক এবং একটি অপ্রকাশ্য দিক রয়েছে। এর তাৎপর্য হচ্ছে- কুরআনের একটি দিক হচ্ছে এর পরিস্কার শব্দমালা যা প্রতিটি ব্যক্তিই পড়তে পারে। আর দ্বিতীয় জিনিস হচ্ছে- এই শব্দমালার অর্থ ও এর লক্ষ্য। কিয়ামতের দিন কুরআনের শব্দও সাক্ষী হবে এবং এর অর্থও সাক্ষী হবে। কুরআন মাজীদে এমনি হুকুম বর্ণনা করে দেয়া হয়েছে যে, অমুক কাজ নিষিদ্ধ। কোন ব্যক্তি সেই নিষিদ্ধ কাজটি করলো। এই অবস্থায় কুরআনের শব্দ সমূহ তাঁর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য হয়ে দাঁড়াবে।
অনুরূপভাবে কুরআন মাজীদের শব্দমালার মধ্যে সেই তাৎপর্য নিহিত রয়েছে যার মাধ্যমে জানা যায় যে, কুরআন মানুষের মধ্যে কোন প্রকারের নৈতিকতার পরিপুষ্টি সাধন করতে চায় আর কোন ধরনের নৈতিকতার বিলোপ চায় ; কোন ধরনের জিনিস আল্লাহ তায়ালার পছন্দনীয় এবং কোন জিনিস অপছন্দনীয়। এভাবে কুরআন মাজীদ আল্লাহর কাছে পছন্দনীয় জীবন প্রনালী কি তাঁর নীল নকশাও পেশ করে। এখন কোন ব্যক্তি যদি এর বিপরীত জীবন প্রনালী অনুসরন করে তাহলে গোটা কুরআনই তাঁর বিরুদ্ধে সাক্ষী হয়ে দাঁড়াবে। পুরা কুরআনের প্রানসত্ত্বা এবং তাঁর তাৎপর্য এই ব্যক্তির বিপক্ষে দাঁড়াবে।
কুরআনের পড়ে দ্বিতীয় যে জিনিস আরশের নীচে বান্দাদের বিরুদ্ধে মোকদ্দমা পরিচালনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে তা হচ্ছে আমানত। এখানে আমানত শব্দটি সীমিত অর্থে ব্যবহৃত হয় নি। মানুষের মাঝে আমানতের যে সাধারন অর্থ প্রচলিত আছে তা হচ্ছে এই যে, এক ব্যক্তি অপর ব্যক্তির কাছে টাকা –পয়সা, অলংকারাদি অথবা অন্য কোন জিনিস একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য এই বিশ্বাসে জমা রাখলো যে, দাবী করার সাথে সাথে তা পুনরায় ফেরত পাওয়া যাবে। এটা আমানতের একটি সীমিত ধারনা। অন্যথায় আমানতের প্রকৃত অর্থ হচ্ছে- কোন ব্যক্তি যদি অন্য কোন ব্যক্তিকে নির্ভরযোগ্য বা বিশ্বাসযোগ্য মনে করে তাঁর কাছে নিজের কোন অধিকার এই ভরসায় গচ্ছিত রাখে যে, সে তাঁর এই হক আত্মসাৎ করবে না। এটাই হচ্ছে আমানত। যদি কোন ব্যক্তি এই আমানত আত্মসাৎ করে তাহলে কিয়ামতের দিন তা তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগকারী হয়ে দাঁড়াবে।
এখন দেখুন আমাদের কাছে সর্বপ্রথম আমানত হচ্ছে আমাদের দেহ যা আমাদের প্রতিপালক আমাদের কাছে সোপর্দ করেছেন। এর চেয়ে মূল্যবান জিনিস দুনিয়াতে কিছু নেই। সমস্ত শরীর কথা তো প্রশ্নাতীত, এর কোন একটি অংগের চেয়ে মূল্যবান জিনিস আর নেই। অনুরূপভাবে আল্লাহর এই যমীন। এখানে আমাদের প্রতিটি লোকের কাছে যতটুকু ক্ষমতা ও কৃতিত্ব রয়েছে- কারো হাতে বেশী আবার কারো হাতে কম, এসবই আমানত। এরপর দেখুন মানবীয় ও সামাজিক সম্পর্কের প্রতিটি ক্ষেত্রেই শুধু আমানত আর আমানত। মানুষের পারস্পরিক জীবনের সম্পর্কের সূচনা বিবাহের মাধ্যমে হয়ে থাকে। সমগ্র মানব সভ্যতার ভিত্তি হচ্ছে একজন পুরুষ এবং একজন স্ত্রীলোকের দাম্পত্য সম্পর্ক। এখান থেকে গোটা মানব সমাজের সূচনা। এ সবই আমাদের কাছে আমানত। নারী একজন পুরুষের কাছে নিজেকে সমর্পণ করে। এই আত্মবিশ্বাসের ওপর সে নিজেকে তাঁর কাছে সপে দেয় যে, সে একজন ভদ্র এবং সম্ভ্রান্ত পুরুষ। সে তাঁর সাথে ভালো ব্যবহার করবে। অপরদিকে পুরুষ একজন স্ত্রীলোকের দায়িত্ব সাড়া জীবনের জন্য এই বিশ্বাসের ভিত্তিতে নিজের কাছে তুলে নেয় যে, সে একজন ভদ্র এবং সম্ভ্রান্ত মহিলা। সে তাঁর সাথে সহযোগিতা করবে, সে তাঁর ধন-সম্পদ, মান-ইজ্জত ইত্যাদি যা কিছুই তাঁর তত্ত্বাবধানে রাখবে- সে এর কোনরূপ খেয়ানত করবে না। অনুরূপভাবে সন্তানদের অস্তিত্বও আত্মবিশ্বাসের উপর নির্ভরশীল। পিতা মাতার প্রতি সন্তানদের এই আত্মবিশ্বাস রয়েছে যে, তারা তাঁদের কল্যাণেই ব্রতি হবে। স্বেচ্ছায় এবং স্বজ্ঞানে তাঁদের কোন অমঙ্গল করবে না ও তাঁদের স্বার্থের কোনরূপ ক্ষতি করবে না। সন্তানদের স্বভাব- প্রকৃতির মধ্যে এই আত্মবিশ্বাস নিহিত রয়েছে। যে সন্তান কেবল ভূমিষ্ঠ হল তাঁর স্বভাবের মধ্যেও এই গুন বর্তমান রয়েছে। মনে হয় যেন তাঁর এবং তাঁর পিতা-মাতার মাঝে অলিখিত চুক্তি হয়ে আছে।
অনুরূপভাবে কোন ব্যক্তি তাঁর কন্যাকে অপরের হাতে তুলে দেয় এই বিশ্বাসে যে, সে ভদ্র ও সম্ভ্রান্ত। কোন ব্যক্তি ওপর ব্যক্তির কন্যাকে তাঁর বংশের মান- মর্যাদার উপরে ভরসা করেই বিয়ে করে। আত্মীয়তার ব্যাপারটিও এরূপ- একে অপরকে নির্ভরযোগ্য মনে করে। স্বয়ং এক প্রতিবেশী ওপর প্রতিবেশীর উপর নির্ভর করে থাকে। সে বিশ্বাস করে তাঁর প্রতিবেশী দেয়াল ভেঙ্গে অবৈধভাবে তাঁর ঘরে অনুপ্রবেশ করবে না। এভাবে আপনি আপনার গোটা জীবনের প্রতি লক্ষ্য করে দেখবেন যে, সমস্ত মানবীয় সম্পর্ক এই বিশ্বাসের ভিত্তিতে স্থাপিত হচ্ছে যে, অপর পক্ষ তাঁর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবে না।
কোন দেশের পুরা সরকারী ব্যবস্থা একটি আমানত। গোটা জাতি তাঁর আমানত সরকারের হাতে তুলে দেয়। তারা নিজেদের ভবিষ্যৎ এবং নিজেদের যাবতীয় উপায়- উপকরন জাতীয় সরকারের হাতে সোপর্দ করে দেয়। সরকারের যতো কর্মচারী রয়েছে তাঁদের হাতে জাতির আমানতই তুলে দেয়া হয়। জাতীয় সংসদের সদস্যদের হাতে জাতি তাঁর পুরা আমানতই সপে দেয়। লাখ লাখ সদস্য সমন্বয়ে গঠিত সেনাবাহিনীর কথা চিন্তা করুন। জাতি তাঁদেরকে সুসংগঠিত করে দেশের অভ্যন্তরে রেখে দেয় এবং গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটিসমূহে তাঁদের স্থাপন করে। নিজেদের খরচে তাঁদের অস্ত্র-শস্ত্র কিনে দেয় এবং জাতীয় আয়ের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ তাঁদের পেছনে ব্যয় করা হয়। তাঁদেরকে এই বিশ্বাসে সংগঠিত করে প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে যে, তারা দেশ ও জাতির হেফাজতের দায়িত্ব পালন করবে। এবং তাঁদের উপর যে দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে তা সম্পাদন করার ব্যাপারে খেয়ানত করবে না।
এখন যদি এসব আমানতের চতুর্দিক থেকে খেয়ানত হতে থাকে তাহলে মানব সভ্যতা ও সংস্কৃতি চিরতরে শেষ হয়ে যাবে। এজন্য এই আমানত সেই দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ জিনিস যা কিয়ামতের দিন মানুষের পক্ষে অথবা বিপক্ষে সাক্ষী দেয়ার জন্যে উপস্থিত হবে। যে যতো বেশী খেয়ানত করেছে সে ততখানী শক্তভাবে পাকড়াও হবে। আর যে ব্যক্তি আমানতের যতো বেশী হক আদায় করেছে সে তত অধিক পরিমানে আল্লাহর তরফ থেকে পুরস্কার লাভের অধিকারী হবে।
তৃতীয় যে জিনিস কিয়ামতের দিন অসাধারন গুরুত্বের অধিকারী হবে তা হচ্ছে ‘আত্মীয়তার সম্পর্ক’ – রেহেম। আত্মীয়তার সম্পর্ক এমন একটি জিনিস যার উপর মানব সভ্যতার ইমারত গড়ে উঠেছে। মানবীয় সভ্যতার সূচনা এভাবে হয়েছে যে, কোন ব্যক্তির সন্তান-সন্ততি এবং তাঁর সামনে যেসব আত্মীয়- স্বজন রয়েছে তাঁদের সমন্বয়ে একটি বংশ বা গোত্রের সৃষ্টি হয়। এভাবে যখন অসংখ্য বংশ এবং গোত্র একত্রিত হয় তখন একটি জাতির সৃষ্টি হয়। এসব কারনে কুরআন মাজীদে আত্মীয়তার সম্পর্কের উপরে খুবই গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। এবং আত্মীয়তার সম্পর্ককে ছিন্ন করাকে মানবীয় সভ্যতা- সংস্কৃতির শিকড় কর্তনকারী জিনিস বলা হয়েছে। এজন্যে বলা হয়েছে রেহেম অর্থাৎ রক্তের সম্পর্ক হচ্ছে সেই তৃতীয় জিনিস যার ভিত্তিতে মানুষের মাঝে ফায়সালা করা হবে। এই দিন আত্মীয়তার সম্পর্ক চিৎকার করে বলবে, যে ব্যক্তি আমাকে অটুট রেখেছে আল্লাহ তায়ালা তাঁকে অটুট রাখবেন। আর যে ব্যক্তি আমাকে করতন করেছে আল্লাহ তায়ালাও তাঁকে ত্যাগ করবেন। যখন কোন ব্যক্তি নিজের আত্মীয়- স্বজনের প্রতি নির্দয় হয় এবং তাঁদের সাথে শীতল সম্পর্ক বজায় রাখে- সে দুনিয়াতে কারো বন্ধু হতে পারে না। যদি সে কারো বন্ধুরূপে আত্মপ্রকাশ করে তাহলে বুঝতে হবে সে প্রতারনার আশ্রয় নিয়েছে এবং নিজের কোন ব্যক্তি স্বার্থ উদ্ধারের জন্যে বন্ধুর বেশ ধারন করেছে। যতক্ষন তাঁর স্বার্থ রক্ষা পাবে ততক্ষণই সে তাঁর বন্ধু হয়ে থাকবে। যেখানে তাঁর স্বার্থে আঘাত লাগবে- সেখানেই সে তাঁর বন্ধুর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবে। কেননা, এটা যথার্থই বাস্তব সম্মত যে, যে ব্যক্তি নিজের ভযিকে আপন বলে গ্রহন করে না সে অপরের আপন কিভাবে হতে পারে? এ কারনেই কুরআন মাজীদে আত্মীয়তার সম্পর্ক অটুট রাখার উপরে এতো অধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে এবং এখানে হাদীসে উল্লেখিত শব্দে এর কিছু বর্ণনা করা হয়েছে।