মক্কার পথ
The Road of Mecca
মুহাম্মদ আসাদ
শাহেদ আলী অনুদিত
‘The Road of Mecca’ গ্রন্থের রচয়িতা আল্লামা মুহাম্মদ আসাদ। গ্রন্থটি বাংলা অনুবাদ করেছেন অধ্যাপক শাহেদ আলী।
‘মক্কার পথে’ লেখকের নাটকীয় জীবনের বহু কথা তিনি অবলিলাক্রমে ব্যক্ত করেছেন। তিনি জ্ঞান-বিজ্ঞানে অগ্রসর বর্তমান পাশ্চাত্য সভ্যতাকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন-এর বাহ্য জাকজমকের অন্তরালে লুকায়িত অতল-গর্ভ শূন্যতাকে দুনিয়ার সামনে উদঘাটিত করে দিয়েছিলেন। অন্যদিকে, তিনি সাংবাদিকতার উদ্যেশ্যে জেরুযালেম আসেন এবং আরবদের জীবন পদ্ধতির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। তাঁদের সঙ্গে অন্তরঙ্গ মেলামেশার পর তিনি আবিষ্কার করেন ট্রেডিশনাল মুসলিম সমাজের মধ্যে রয়েছে মন ও ইন্দ্রিয়ের এক সহজাত সঙ্গতি,- যা ইউরোপ হারিয়েছে। তিনি তাঁদের মধ্যে আবিষ্কার করেন হৃদয়ের নিশ্চয়তা এবং আত্ম-অবিশ্বাস থেকে মুক্তি,যে মুক্তি ইউরোপীয়দের স্বপ্নের অগোচর। এ বিশ্বাসের প্রতি অনুরক্ত হয়ে তিনি ১৯২৬ সনে ইউরোপ ফিরে সস্ত্রীক ইসলাম ধর্ম কবুল করেন।
উৎসর্গ
স্বকীয় তাহযীব তমদ্দুনের ভালোবাসায়
গর্বিত,আনন্দ-স্লাত,
একান্ত শুভানুধ্যায়ী,অগ্রজ-প্রতিম
শামসুল হুদা চৌধুরী
শ্রদ্ধাস্পদেষু
“দুটি কথা”
‘মক্কার পথ’ প্রখ্যাত চিন্তাবিদ, লেখক ও সাংবাদিক মুহাম্মদ আসাদ কর্তৃক লিখিত ‘The Road of Mecca’ গ্রন্থ এর অনুবাদ। মুহাম্মদ আসাদ জাতিতে ছিলেন ইহুদী। কিন্তু কিশোর বয়সেই তিনি ইহুদী ধর্মের প্রতি তাঁর আকর্ষণ হারিয়ে ফেলেন। বয়োবৃদ্ধির সংগে সংগে তিনি পাশ্চাত্যের নব্য আধুনিক জীবন-পদ্ধতি ও তার জীবনাচরনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েন। একদিকে পাশ্চাত্যের জড়বাদী ভোগবাদ, অন্যদিকে যাজকদের অপার্থিব শরীর-বিমুক্ত আধ্যাত্মিক চিন্তাধারা তাঁকে পাশ্চাত্য বলয় থেকে দূরে সরিয়ে নেয় এবং তাঁকে প্রাচ্যমুখী করে তোলে। তিনি আরবীয় এবং দেহ ও আত্মার সামঞ্জস্যবাদী মধ্যপন্থী ইসলামী জীবনবাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। ১৯২১ সালে তিনি ইসলাম কবুল করেন এবং মুহাম্মদ আসাদ নাম গ্রহণ করেন।
‘The Road of Mecca’ বা ‘মক্কার পথ’ মুহাম্মদ আসাদের রূহানী আত্মজীবনী। দেশ সফরের বিচিত্র অভিজ্ঞতা বর্ণনা প্রসংগে তিনি তাঁর আত্মিক উন্মোচনের কহিনী তুলে ধরেছেন। এ গ্রন্থে তাঁর ভ্রমণ-জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা, আরবীয় দুনিয়ার জীবনধারা এবং তার সংগে প্রাচ্য-প্রতীচ্যের জীবনধারার তুলনামুলক বৈশিষ্ট্য যেমন গল্পের আংগিকে বর্ণিত হয়েছে, তেমনি চিত্রিত হয়েছে এক অতৃপ্ত সত্যসন্ধানী চিত্তের সত্যোপলদ্ধির মর্মস্পর্শী কাহিনী।
বলাবাহুল্য, এ বইটি লিখেছেন এ যুগের এমন একজন চিন্তাশীল মনীষী, যিনি সাধারণ যুক্তিহীন আবেগাক্রান্ত ধর্মন্তরিত মুসলিম নন। তিনি এক অনন্যসাধারণ প্রতিভান্বিত ব্যক্তি যিনি ধর্ম গ্রহণের পূর্বে তাঁর সমস্ত বিদ্যা ও বুদ্ধির আলোকে ধর্মকে বুঝতে এবং তার মর্ম উপলদ্ধি করতে প্রয়াস পেয়েছেন।
এই অতি উঁচু মানের সাহিত্য-গুণসম্পন্ন চিত্তাকর্ষক গ্রন্থের বাংলা অনুবাদ করেছেন প্রখ্যাত কথাশিল্পী ও ইসলমী চিন্তাবিদ, ‘ইসলমি ফাউন্ডেশন পত্রিকা’ ও ‘সবুজ পাতা’র সাবেক সম্পাদক শাহেদ আলী। গল্প লেখার ভাষা তাঁর জাদুকরী হাত এই গ্রন্থটির বর্ণনাধর্মী সাহিত্যিক ভাষার অনুবাদে যে দারুণভাবে সফল হয়েছে তাতে সন্দেহ নেই এবং যে-কোন পাঠক এর প্রাঞ্জল প্রসাদগুণ উপভোগ করে আনন্দ উপভোগ করবেন এবং এর বিশাল পৃষ্ঠযাত্রায় যে ক্লান্ত হবেন না, আনন্দের সংগে সে সংবাদ আমরা দিতে পারি। আর এ কারণেই পাঠকদের উপহার দিতে আমরা এ গ্রন্থখানির পুন:নবকলেবরে প্রকাশ করছি। ‘মক্কার পথ’ কে অনুবাদ না বলে বলা যায় নতুন সৃষ্টি, বাংলা সাহিত্যে এটি একটি অভিনব সংযোজন।
আমরা আশা করি, এ গ্রন্থ পাঠে পাঠক ইসলামের ধর্মাদর্শ উপলব্ধিতে নতুন চিন্তার খোরাক পাবেন এবং এবং ইসলামের প্রতি আরও গভীর বিশ্বাসে জেগে উঠবেন।
-শরীফ হাসান তরফদার
প্রকাশক
পূর্বকথা
লিও-পোলড উইস নামক একজন ইহুদী পন্ডিত ইসলাম কবুল করেছেন-এ খবর সম্ভবত স্কুল জীবনেই শুনেছিলাম; কিন্তু তিনি যে একজন লেখক, একজন অসাধারণ প্রতিভাশীল চিন্তাবিদ একথা জানলাম অনেক পরে। তাঁর মুসলিম নাম মুহাম্মদ আসাদ। আমার স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে রইলেও তাঁর কোন রচনা পড়ার সৌভাগ্য তখনো আমার হয়নি। বিট্রিশ আমলে তিনি ভারতে ছিলেন, পাকিস্থান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর পশ্চিম পাঞ্জাব সরকারের ইসলামী পুনর্গঠন সংস্থার পরিচালক ছিলেন এবং তিনি ‘আরাফাত’ নামক একটি অতি উন্নতমানের ইংরেজী সাময়কী সম্পাদনা করেন। এর বেশী কিছু তাঁর সম্পর্কে জানতাম না।
একদিন, খুব সম্ভব ১৯৫৮-এর দিকে ব্যরিষ্টার এ.টিম.মুস্তাফা, যিনি পরে পাকিস্থানের কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রী হয়েছিলেন, কথা প্রসংগে বলেন, ‘ভাইয়া, আপনি কি ‘The Road of Mecca’ পড়েছেনে? জীবনে আমি যত বই পড়েছি সেগুলোর মধ্যে এটি হচ্ছে বই।
মুস্তাফা ভাই কেবল একজন মশহুর আইনবেত্তাই ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন আপোসহীন সক্রিয় ইসলামী সংস্কৃতিকর্মী এবং সুধী পাঠক; দুনিয়ার কোথায় কোন শ্রেষ্ঠ লেখক ইসলামের উপর বই-পুস্তক লিখেছেন তিনি তার আপ-টু-ডেট খবর রাখতেন। তার মুখে ‘The Road of Mecca’ –র উচ্ছ্বাসিত প্রসংশা শুনে বইটি সংগ্রহ করার জন্য আমি ব্যস্ত হয়ে পড়ি এবং কিছুদিন পর এক কপি লাহোর থেকে পার্শেল করে আনাই। বইটি হাতে পেয়ে তার মধ্যে ডুবে যাই, শৈশব থেকে ইসলাম গ্রহণ পর্যন্ত আসাদের দীর্ঘ চাঞ্চল্যকর আধ্যাত্মিক সফরে তাঁর সহযাত্রী হয়ে আমিও ঘুরি ইউরোপ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে, পথে-প্রান্তরে, হাটে-গঞ্জে, শহরে-বন্দরে, সমুদ্রে, আর নতুন করে দেখি জগতকে; ধীরে ধীরে ইসলামের পরিপূর্ণ রূপটি পাপড়ির পর মেলে বিকশিত হয়ে ওঠে আমার দৃষ্টির সম্মুখে। বার বার পড়লাম ‘The Road of Mecca’এবং পড়তে পড়তেই অন্তরে এ উপলব্ধি হলো-এ বই-এর বাংলা তরজমা বাংলাভাষী পাঠক-পাঠীকাদের জন্যে ইসলামী জীবন-দৃষ্টির এক নতুন দিগন্ত উন্নোচিত করবে।
সীমিত সামর্থ্য আর সময়ের অভাব সত্ত্বেও আমি বইটির তরজমায় হাত দিই এবং আমার সম্পাদিত ইসলামিক একাডেমী পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে ছাপাতে থাকি। বিয়ষবস্তু এবং আসাদের অপূর্ব রচনশৈলীর গুনে আমার অক্ষম তরজমাও পাঠক মহলে প্রবল সাড়া জাগায়; কেবল এই তরজমার জন্যেই বহু পাঠক ইসলমিক একাডেমী পত্রিকা’র গ্রাহক হন এবং পত্রিকাটির প্রকাশনা কখনো অনিয়মিত হয়ে পড়লে ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
‘The Road of Mecca’ বা মক্কার পথ মুহাম্মদ আসাদের রূহানী আত্মজীবনী। আসাদ গল্পচ্ছলে নিজের জীবনের কাহিনী লিখেছেন। উপন্যাসের চেয়েও সরস এ কাহিনী আসাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার প্রামাণিকতায় হয়ে উঠেছে এ-কালের মানুষের জন্যে ইসলামের এক অনাস্বাদিতপূর্ব বিশ্লেষণ। বইটির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ছড়িয়ে রয়েছে এক নতুন স্বাদ, এক অভিনব রস, যা পাঠককে কেবল আনন্দই দেয় না, এক সুগভীর তৃপ্তিকর অভিজ্ঞতায় করে ঐশ্বর্যবান; লেখকের সফর সংগী হয়ে পাঠকও অন্তিমে গিয়ে পৌঁছান মক্কা তথা ইসলামী জীবন-দৃষ্টির মর্মকেন্দ্র, আর ইসলামের পথে তাঁর দীর্ঘ অভিযাত্রা হয় পূর্ণ, আসাদের ভাষায় যা হচ্ছে home-coming- স্বগৃহে প্রত্যাবর্তন।
মুহাম্মদ আসাদ সাংবাদিক, চিন্তাবিদ, ইসলামের এক অনন্য ব্যাখ্যাতা-কিন্তু মূলত তিনি দিব্যদৃষ্টির অধিকারী সৃজনধর্মী একজন প্রতিভা; ‘The Road of Mecca’ তাঁর এক অপূর্ব সৃষ্টি। বইটি তিনি উৎসর্গ করেন তাঁর স্ত্রী পোলা হামিদা আসাদকে। তাঁর এই সৃষ্টিকে বাংলা ভাষার আধারে পরিবেশন করতে গিয়ে যতদূর সম্ভব মূলের ছন্দ প্রবাহ, বাকভঙ্গি ও রচনাশৈলী অক্ষুণ্ণ রেখে আসাদের রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতাকে তুলে ধরবার চেষ্টা করেছি। কিন্তু কোনো সৃষ্টিকেই তো হুবহু ভাষান্তরতি করা যায় না। তাই আমি এ দাবী করি না যে, আসাদের এ অনুপম সৃষ্টিকে আমি পুরোপুরি আমার নিজের ভাষায় তুলে ধরতে পেরেছি। তবে আমার সান্তনা এই যে, এ বই-তরজমার পেছনে প্রথম থেকে শেস পর্যন্ত সক্রিয় ছিল সৃজনধর্মী রচনার প্রতি আমার সহজাত অনুরাগ এবং ইসলামী জীবনাদর্শের প্রতি আমার অশৈশব ভালোবাসা। বইটির তরজমা বংলাভাষী পাঠক-পাঠিকাদের হাতে তুলে দিতে পেরে আমি আমার নিজের উপর স্ব-আরোপিত একটি দায়িত্ব পালন করেছি, যার জন্য পুরষ্কার পরম করুনাময় আল্লাহ তাআলার কাছে মুহাম্মদ আসাদেরই প্রাপ্য। তরজমা সম্পূর্ণ করে পুস্তকাকারে প্রকাশ করার জন্য অগণিত উৎসুক এবং আগ্রহী পাঠক আমাকে নিরবচ্ছিন্নভাবে তাগিদ দিয়েছেন; দেখা হলেই এ প্রসংগ তুলেছেন। তাঁদের সাগ্রহ প্রতীক্ষার এতদিনে অবসান হলো, তাঁদের দাবী এতদিনে পূর্ণ হলোঃ এজন্য আমি নিজেকে ভারমুক্ত মনে করছি এবং আল্লাহতা আলার প্রতি শুকরিয়া জানাচ্ছি। এই সব অগণিত পাঠকের মধ্যে ভাই শাহ্ আবদুল হান্নানের কথা কিছুতেই ভুলবার নয়; তাঁর ঐকান্তিক আগ্রহ ও দাবী, আমার মধ্যে যখনি অনুবাদে শৈথিল্য এসেছে, আমাকে নতুন করে উৎসাহিত করেছে।
বইটির তরজমার প্রথম পর্যায়ে সাবেক ইসলামকি একাডেমীর মোহাম্মদ আজিজুর ইসলাম ও শেখ তোফাজ্জল হোসেন দীর্ঘদিন আমার মৌখিত তরজমা লিপিবদ্ধ করেছেন। দ্বিতীয় পর্যায়ে এই দায়িত্বের এই দায়িত্বে পুরোটাই পালন করেছেন কবি মাসউদ-উশ-শহীদ। এতোটা আনন্দের সংগে মসউদ তাঁর প্রাত্যহিক জীবনের এক মূল্যবান অংশ এ কাজে আমার সংগে ব্যয়-এর প্রুফ দেখার দায়িত্ব সানন্দে বহন করেছেন আবদুল মুকীত চৌধুরী। বইটির নির্ঘন্ট তৈরী করে দিয়েছেন ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রেসের কালাম আজাদ। এঁরা প্রত্যেকেই আমার স্নেহভাজন; ধন্যবাদ দিয়ে এঁদের আন্তরিক সহযোগিতার মূল্যকে আমি লঘু করতে চাই না।
জ্ঞানকোষ প্রকাশনী বইটির তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশ করে গোটা বাংলা-ভাষী পাঠক সমাজের কৃতজ্ঞভাজন হয়েছেন।
শাহেদ আলী
আল্লামা মুহাম্মদ আসাদের নাটকীয় জীবনের কিছু কথা
অধ্যাপক শাহেদ আলী
মুসলিম বিশ্বের আকাশ থেকে প্রজ্ঞা ও মনীষার উজ্জ্বলতম নক্ষত্রটি খসে পড়ে ১৯৯৪ সনে। পশ্চিমা জগতের দৃষ্টিতে এই নক্ষত্রটির আলো ছিলো প্রখর, চোখ ধাঁধানো; তাই তারা প্রায় শতাব্দীকাল এক চোখের সামনে দেখেও না দেখার ভান করেছে। এই মনীষী জন্মগ্রহণ করেছিলেন পশ্চিমে ইউরোপীয় পরিবেশে। অথচ তিনি জ্ঞান-বিজ্ঞানে অগ্রসর বর্তমান পাশ্চাত্য সভ্যতাকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন-এরা বাহ্য জাকজমকের অন্তরালে লুকায়িত অতল-গর্ভ শূন্যতাকে দুনিয়ার সামনে উদঘাটিত করে দিয়েছিলেন। এজন্য পাশ্চাত্য জগত তাঁকে বরাবর বিরক্তির সাথে উপেক্ষা করার চেষ্টা করেছে। তাঁর ইন্তেকালের খবর কোন প্রচার পায়নি পশ্চিমা প্রচার মাধ্যমে।
আর রাতকানা মানুষ চাঁদ-নক্ষত্র কিছুই দেখেনা, অন্ধ যেমন সূর্য দেখেনা, তেমনি মুসলিম বিশ্বের দৃষ্টিতেও এই নক্ষত্রের কিরনের জ্যোতি কখনো পুরোপুরি প্রতিবিম্বিত হয়নি। তাই তার আকাশের উজ্জ্বলতম নক্ষত্রটির খসে পড়লেও তার কোন শূন্যতা মুসলিম বিশ্ব অনুভব করেনি-সূর্য বা নক্ষত্রের উদয়-অস্তে অন্ধের কিছুই আসে যায় না। তাদের নিজস্ব কোন প্রচার মিডিয়াও নেই। তাছাড়া যা কিছু আছে তাতেও এই মৃত্যু তেমন কোন গুরুত্বই পাইনি। তাঁর নাকি অসিয়ত ছিলো-তাঁর কবর যেন হয় মক্বায়-যেখানে তিনি দীর্ঘদিন বসবাস করে ইসলামকে আবিস্কার করেছিলেন, ইসলামের সেরা ব্যাখাতা এবং প্রতিনিধি হয়ে উঠেছিলেন, ইসলাম কবুল করে সারা বিশ্বের মোকাবেলায় ইসলামের শ্রেষ্ঠত্বকে তুলে ধরেছিলেন, লিখেছিলেন ‘Road To Mecca’ –র মত বিশ্বে আলোড়ন জাগানো বই। কিন্তু তাঁর সাধ পূরণ হয়নি। তিনি স্পেনে ইন্তেকাল করেন এবং সেখানেই তাঁকে দাফন করা হয়।
মুহাম্মদ আসদ, ইসলাম কবুল করার আগে যার নাম ছিলো লিওপোন্ড লুইস, তাঁর স্ত্রী পোলা হামিদা আসাদকে নিয়ে প্রায় ২৬/২৭ বছর বাস করেছিলেন মরক্কোর তানজির্য়াস শহরে। তিনি রাবাত আল-আলমই ইসলামের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলেন কোরানুল করিমের একখানি সংক্ষিপ্ত তফসীরসহ তরজুমা করার জন্য। প্রথম ১০ পারার তফসির প্রকাশিত হলে কোন কোন আলিম, তাঁর কোন কোন ব্যাখ্যা সম্বন্ধে ভিন্নমত পোষণ করেন। তখন আসাদ রাবিতার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে মরক্কো চলে যান এবং আর্থিক অসুবিধা সত্ত্বেও, কেবল তাঁর স্ত্রী ও কতিপয় বন্ধু-বান্ধবের সহায়তায় তিনি একায় অনুবাদ ও তাফসীর সম্পূর্ণ করে তা প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেন। সুদীর্ঘ ২০ বছরের সাধনার পর তাঁর তরজমা ও তাফসীর তিনি প্রকাশ করেন। আধুনিক বিশ্ব কোরআনুল করিমের আধুনিকতম তরজমা ও তফসীরকারের দায়িত্ব পালন করেন।
লিওপোন্ড লুইসের জন্ম ১৯০০ সনে, বর্তমান পোলান্ডের লেমবার্গ শহরে, এক ইহুদী পরিবারে। তাঁর পিতামহ ছিলেন কয়েক পুরুষ বিস্তৃত এক ইহুদী রাব্বী বা পুরোহীত পরিবারের শেষ রাব্বী হিসাবে। তাঁর পিতাকে ট্রেডিশনাল ইহুদী রাব্বী হিসাবে গড়ে তোলার জন্য শিক্ষা দেয়া হলেও তিনি সে পারিবাকি ঐতিহ্য ত্যাগ করে ব্যরিষ্টারী অধ্যয়ন করেন, নামকরা আইনজীবি হয়ে উঠেন এবং বিয়ে করেন এক ব্যাংকার পরিবারে। স্কুলের সাধারণ পড়াশুনার সঙ্গে লুইস হিব্রু ভাষা অনর্গল বলতে ও পড়তে শিখেন, এবং আর্মায়িক ভাষার সঙ্গেও সুপরিচিত হয়ে উঠেন। এই বয়সেই তিনি তালমুাদের মূল পাঠ ও ভাষ্যের সঙ্গে সম্যক পরিচয় লাভ করেন। বহু বছর পর এ বিষয়ে তিনি তাঁর আধ্যাত্মিক আত্মরচিত ‘Road To Mecca’–তে লিখেন “আমার মনে হলো ওল্ড টেষ্টামেন্ট এবং তালমুদের আল্লাহ যেন তাঁর পূজারীরা কিভাবে তাঁর পূজা করবে তার অনুষ্ঠানগুলো নিয়েই ব্যস্ত। আমার আরো মনে হতো আল্লাহ যেন বিশেষ একটি জাতির ভাগ্য নিয়ে বিস্ময়কররূপে ব্যস্ত রয়েছেন পূর্ব থেকেই। ইব্রাহিমের বংশধরগণের ইতিহাসরূপে ওল্ড টেষ্টামেন্টের কাঠামোটিই এমন যে মনে হয় আল্লাহ যেন গোটা মানবজাতির স্রষ্টা ও পালনকর্তা নন, বরং তিনি যেন এক উপজাতীয় দেবতা, যে দেবতা একটি মনোনীত জাতির প্রয়োজনের সঙ্গে গোটা সৃষ্টির সংগতি বিধান করে চলেছেন।”
ইহুদী মতবাদ নিয়ে নিরাশ হলেও লুইস কিন্তু অন্য কোন পন্থায় আধ্যাত্মিক সত্যানুসন্ধানে গেলেন না। প্রথম মহাযুদ্ধের পর তিনি ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং আনেকটা উন্নাসিকতার সঙ্গে শিল্প ও দর্শনের ইতিহাস অধ্যয়নে মনোযোগী হন। কিন্তু এই একাডেমিক জীবন তাঁর ধর্মীয় তাৎপর্য অনুসন্ধানের অন্তর্নিহিত তৃষ্ণা নিবারণে ব্যর্থ হলো। তাঁর অ্যাডভেনচারের বাসনাও তাতে তৃপ্ত হলোনা। প্রথম মাহযুদ্ধের পর ভিয়েনা কিন্তু মরিয়া হয়ে নিয়েজিত ছিলো তার স্বকীয়তা ও আত্মপরিচয় লাভের প্রয়াসে। যুদ্ধ এবং ৬০০ বছরের পুরানো হ্যারসবুর্গ রাজতন্ত্রের পতন পুরানো মূল্যবোধ ও ঐতিহ্যগুলোর ভিত্তি ধ্বসিয়ে দেয়। অবশ্য এর পূর্বে এগুলো শিল্পবোদ্ধা ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর আক্রমণের বিষয় হয়ে উঠেছিলো। এক সংশয়বাদী পরিবারে প্রভাবে লুইস তাঁর তরুণ বয়সের অন্য বহু বালকের মতোই সকল আনুষ্ঠানিক ধর্মকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে বসেন। তাঁর তখন লক্ষ্য ছিলো কর্ম, দুঃসাহসিক অভিযান এবং উত্তেজনা। এই তাড়নাবশে তিনি অস্ট্রীয় সামরিক বাহিনীতে যোগ দিতে চেয়েছিলেন এক ছদ্মনামে কারণ তখনো তাঁর বয়স ১৮ বছর হয়নি। ফলে তার স্বপ্ন ব্যর্থ হলো্। চার বছর পর যখন তিনি আইনত ভর্তি হলেন সামরিক বাহিনীতে তার আগেই তাঁর সামরিক গৌরবের স্বপ্ন ভেঙ্গে গেছে। কারণ কয়েক সপ্তাহ পরেই ঘটলো বিপ্লব, অষ্ট্রীয় সাম্রাজ্য ভেঙ্গে পড়ল এবং যুদ্ধও শেষ হয়ে গেলো।
কিন্তু আন্ত-একাডেমিক জীবনের কোন আকর্ষণই লুইসের ছিলোনা। তিনি অনুভব করছিলেন, জীবনের সাথে গভীরভাবে মোকাবেলা করার আকাংখা-জীবনে প্রবেশ করার বাসনা। নিরাপত্তা-প্রিয় মানুষ নিজের চারপাশে যে-সব প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলে লুইস সেগুলোর আশ্রয় না নিয়ে প্রবেশ করতে চেয়েছিলেন জীবনে-চেয়েছিলেন সবকিছুর পিছনে যে আধ্যাত্মিক নিয়ম-শৃঙ্খলা রয়েছে তা উপলদ্ধি পথ নিজেই খুঁজে বের করতে।
বিশ শতকের গোড়ার দিকের দশকগুলোর একটি বিশেষ লক্ষণ ছিলো আধ্যাত্মিক শূন্যতা। বহুশত বছর ধরে ইউরোপ যে-সব মূল্যবোধে অভ্যস্ত ছিলো, সে সমুদয়ই ১৯১৪-১৯১৮ এর মধ্যে যা ঘটলো তাতে নিজস্ব রূপরেখা হারিয়ে নিরাকার, নিরবয়ব হয়ে পড়লো। সে শূন্যতা পূরণ করতে পারে এমন নতুন কোন মূল্যবোধ কোথাও দেখা যাচ্ছিলো না। ক্ষুণভঙ্কুরতা ও অনিশ্চয়তার ভাব, সামাজিক, মানসিক ওলটপালটের পূর্বাভাস মানুষের চিন্তা ও প্রয়াসে স্থায়ী বলে কিছু নেই এমন একটা সন্দেহের জন্ম দেয় তরুণ মনে। তরুণের আত্মিক চাঞ্চল্য কোথাও কোন নির্ভর খুঁজে পাচ্ছিলো না লুইস এবং তাঁর মত নবীনের যে –সব প্রশ্নে হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছিলো নৈতিকতার কোন নির্ভরযোগ্য মানের অভাবে কেউ তাদের সেইসব প্রশ্নের সন্তোসজনক জবাব দিতে পারছিলেন না। লুইস দেখতে পেলেন, “বিজ্ঞান বলে জ্ঞানই সব অথচ একট নৈতিক লক্ষ্য ছাড়া জ্ঞান কেবল বিশৃঙ্খলাই সষ্টি করতে পারে।” এতে সন্দেহ নেই যে, সে সময়কার সমাজ সংস্কারক, বিপ্লবী এবং কমিউনিষ্টরা একটা মহত্তর এবং অধিকতর সুখী দুনিয়া নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু লুইসের তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ধরা পড়লো এরা সকলে চিন্তা করছে, কেবল বাহ্য সামাজিক অর্থনৈতিক অবস্থার আলোকে এবং এসব ক্ষেত্রে এই ক্রটি সংশোধনের জন্য ওরা ‘জিয়ান’ বাদী ধারণাকে এক নতুন অধিবিদ্যা বিরোধী অধিবিদ্যায় উন্নীত করেছে। তারা দেখতে পেল, তাদের চারপাশের পথিবীতে যা যা কিছু ঘটছে অনেক সময় কল্পিত ঐশী গুণাবলীর সঙ্গে তার অসঙ্গতি প্রচন্ড। আল্লাহর প্রতি যে-সব গুণ আরোপ করা হয়, মানব ভাগ্যের নিয়ন্ত্রক শক্তিগুলো যেন সেগুলো স্পষ্টভাবে স্বতন্ত্র ও আলাদা। এ থেকে তারা সিদ্ধান্তে এলো আল্লাহ বলে কিছু নেই। ধর্মের আত্মাভিমানী অভিভাবকেরা আল্লাহকে তাদের নিজেদের পোষাক পরিয়ে মানুষের ভাগ্য থেকে আল্লাহকে বিচ্ছিন্ন, সম্পর্কহীন করে ফেলেছিলো। কিন্তু এতে তো সমস্যার সমাধান হলো না, ব্যক্তি-জীবনে কিংকর্তব্য সম্বন্ধে এই অনিশ্চয়তা ও পরিবর্তনশীলতা ঘোর বিশৃংখলার কারণ হয়ে উঠতে পারে, সৃষ্টি করতে পারে মানুষের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সৌন্দর্য বোধের প্রতি অশ্রদ্ধা। এই সহজাত উপলদ্ধির কারণে লুইস এখানেই থামলেন না। তাঁর জন্য মহত জীবনকে গড়ে তোলা তাঁর দিকে আশার একটি সৃজনধর্মী পথ অনুসন্ধানের জন্য সহায়ক হয়ে উঠলো। এই তাগিদেই তিনি ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি হয়ে তার মূল পাঠ্য বিষয় হিসাবে বেছে নিয়েছিলেন শিল্পকলার ইতিহাস। কিন্তু পাঠ্য বিষয় লুইসকে তৃপ্ত করতে পারালো না। তিনি দেখতে পেলেন তাঁর শিক্ষকেরা- যাদের মধ্যে স্ট্রজিগোভস্কি এবং দূভোরাক ছিলেন বিখ্যাত এবং বিশিষ্ট সৌন্দর্যতত্ত্বের যে-সব নিয়ম-কানুন দ্বারা শিল্প সষ্টি নিয়ন্ত্রিত হয়, সেগুলো আবিষ্কার করতেই ছিলেন অতিমাত্রায় ব্যস্ত;এর মর্মমূলে যে আধ্যাত্মিক তরঙ্গভিঘাত রয়েছে তা উৎঘটনের চেষ্টা খুব সামান্যই করেছেন, অর্থাৎ লুইসের মতে শিল্পকলার প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি সেইসব রূপ ও আঙ্গিকের মধ্যে ছিলে সংকীর্ণভাবে সীমাবদ্ধ, যেগুলোর মাধ্যমে আর্ট লাভ করা অভিব্যক্তি।
লুইস তাঁর যৌবনোচ্ছল বিভ্রান্তির দিনগুলোতে ইউরোপে নবীন মনোবিকেলন শাস্ত্রের যে-সব সিদ্ধান্ত নিয়ে মেতে উঠেছিলো তার সঙ্গে পরিচিতি হয়েও তিনি তাতে তৃপ্তি পেলেন না-পেলেন না তার জিজ্ঞাসার জবাব, যদিও তখন মনোবিকোলন তত্ত্ব দেখা দিয়েছিলো একটা প্রথম শ্রেণী বিপ্লবরূপে। মানুষের ব্যক্তিত্ব গঠনে নির্জ্ঞান মনের কামনা-বাসনার যে ভুমিকা রয়েছে তার আবিষ্কার গভীরতর আত্মেপলদ্ধির পথ সন্দেহতীতভাবে মুক্ত করে দিয়েছে-তরূণ লিওপোন্ড লুইসের এই বিশ্বাস বেশীদিন স্থায়ী হলো না। তাঁর কাছে ফ্রয়েডীয় চিন্তাধারার উদ্দীপনা ছিলো মদের মাদকতার মতোই তীব্র। ভিয়েনার ক্যাফেগুলোতে তিনি তন্ময় হয়ে শুনেছেন মনোবিকোলন তত্ত্বের শুরুর দিকের কয়েকজন পথিকৃত-আলেফ্রেড এডলার, হার্মান ষ্টিকেল এবং অটোগ্রোস প্রমুখ পন্ডিতদের নিজেদের মধ্যে উত্তেজনাপূর্ণ তর্ক-বিতর্ক, কিন্তু লুইস এই নতুন বিজ্ঞানের বুদ্ধিগত ঔদ্ধত্যে বিচলিত হয়েছেন। কারণ তাঁর মতে, “এ বিজ্ঞান মানুষের আত্মার সকল রহস্যকে কতগুলো স্নায়বিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় পর্যবসিত করতে চায়।” তিনি উপলদ্ধি করলেন পরম সত্যগুলোর কাছাকাছি পৌঁছানোর ক্ষমতাও এই নতুন শাস্ত্রের সিদ্ধান্তগুলোতে নেই। তাছাড়া, মহৎ ও উন্নত জীবনের দিকে কোন নতুন পথের নির্দেশও তিনি এতে পেলেন না। মহাযুদ্ধের পর পর সাধারণভাবে প্রতিষ্ঠিত মূল্যগুলোর ব্যাপক ভাঙন শুরু হলো, সেই ভাঙনের ধারায় নারী-পুরুষের সম্পর্কের মধ্যে বিদ্যমান অনেক বাধা-নিষেধও শিথিল হয়ে পড়লো। এ ছিলো একটি অবস্থা থেকে তার সম্পূর্ণ বিপরীত আর একটি অবস্থায় নিক্ষিপ্ত হওয়া, যেখানে সবাকিছু হয়ে পড়েছিলো বিতর্কের বিষয়, অর্থাৎ অবস্থাটা এই দাঁড়ালোঃ কান পর্যন্ত মানুষের নিরবচ্ছিন্ন উর্ধ্বভিসারী অগ্রগতিতে মানুষের যে বিশ্বাস ও আস্থা ছিলো তা থেকে মানুষ নিক্ষিপ্ত হলো স্পেসলারের তিক্ত নৈরাশ্যের দিকে, নীটশের নৈতিক আপেক্ষিকতাবাদ ও মনোবিকলন সৃষ্ট আধ্যাত্মিক শূন্যতার মধ্যে। শরীরের যুক্তি অভিলাসী তরুণ-তরুণীদের মধ্যে যৌন সম্পর্ক হলো নির্বিচার আপতিক, অবাধ। লিওপোন্ড লুইসের মনে হতো এ আর কিছুই নয়, ফাকা প্রথার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। তাঁর মনে হলো একজন পুরুষ থেকে আর একজন পুরুষকে যে ভয়ংকর নিঃসঙ্গতা বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে হয়তো তার দূর হতে পারে এটি নারী ও পুরুষের মিলনে। এই মানসিক চাঞ্চল্য ও অস্থিরতার মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া তাঁর পক্ষে আর সম্ভব হলো না। তাঁর আব্বা তাঁকে পন্ডিত,পি,এইচ,ডি বানাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তা ছেড়ে দিয়ে তিনি তাঁর পিতার অমতে বেছে নিলেন সাংবাদিক জীবন-তিনি লেখক হবেন এবং লেখাই হবে তার পেশা। ভিয়েনা থেকে তিনি পৌঁছলেন প্রাগে-যেখানে তিনি একটি পুরানো ক্যাফে, দ্য ওয়েষ্টেনসে শিল্পী-সাহিত্যিকদের এক ঐন্দ্রজালিক চক্রের সঙ্গে পরিচিত হলেন। কিছুদিন পর তাঁর পিতা খবর পেয়ে চিঠি লিখলেন, ‘‘আমি এখন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি তুমি এক ভবঘুরে বাউন্ডলে হিসাবে মরে পড়ে রয়েছ রাস্তার পাশে নর্দমায়।” প্রবল আত্মবিশ্বাসী জেদী তরুণ লুইস জবাব দিলেন-“না ”। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, তিনি লেখক হতে চান; তাঁর এই বিশ্বাস জন্মেছিলেন-তাঁর জন্য সাহিত্যিকদের জগত অপেক্ষা করছে সাগ্রহে, দরাজ দু’হাত বাড়িয়ে।
কিন্তু সেদিনে মশহুর কোন সংবাদপত্রে প্রবেশাধিকার ছিলো কঠিন ব্যাপার। বার্লিনের রাস্তায় রাস্তায় দিনের পর দিন পায়াচারী করেছেন, সাবওয়ে বা ট্যাক্সির ভাড়া নেই্। বহু সপ্তাহ তিনি কাটালেন, কেবল চা এবং বাড়ীওয়ালী সকালে যে দু’টি পাউরুটীর টুকরা দিতেন তা খেয়ে। তাঁর তখনকার এই দিনগুলোর নিয়তি ছিলো নির্জলা উপবাস। আর তাঁর রাতের স্বপ্ন ঠাসা থাকতো সতেজ আর মাখন মাখানে পুরু রুটির টুকরায়।
এই চরম আর্থিক দৈন্যের মধ্যে এক চলচ্চিত্র প্রযোজকের সহকারী হিসাবে কাজ করে এবং পরে তাঁর ভিয়েনিজ বন্ধু এস্তোন কুহের জন্যে ফিল্মের সিনারিও লিখে দিয়ে এবং পরে আরে একটি সিনারিও লিখে কিছু অর্থ উপার্জন করে কিছুদিন কাটালেন। এরপর আরে একটি বছর মধ্য ইউরোপের বিভিন্ন শহরে নানারকম অস্থায়ী কাজ করে শেষ পর্যন্ত তিন প্রবেশ করলেন খবরের কাগজের জগতে ১৯২১ সনে। জার্মান ক্যাথোলিক সেন্টার পার্টির বিত্তশালী সদস্য ডর ডেমার্ট, জার্মান রাজনৈতিক অঙ্গনের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ত্ব যিনি ইউনাইটেড প্রেস অব আমেররিকান সহযোগিতায় ইউনাইটেড টেলিগ্রাফ নামে একটি বার্তা সংস্থা শুরু করতে যাচ্ছিলেন। তাঁরই প্রতিষ্ঠানে সহকারী হিসাবে কাজ করারা আবেদন জানিয়ে পেলেন টেলিফোনিষ্টের কাজ। তাঁর উচ্চাকাংখার জন্য এ ছিলো একটি অতি অবসানজনক কাজ। কিন্তু কাজটি গ্রহণ না করে লুইসের উপায় ছিল না। এভাবে একমাস কাজ করার পর তিনি গোপনে বার্লিনে আগম মাদাম ম্যাক্সিম গোর্কী, যিনি ১৯২১-এর রাশিয়ার চরম দুর্ভিক্ষের সময় এখানে এসেছিলেন মধ্য ইউরোপীয় রাজধানীগুলোতে কার্যকরি ত্রাণ ও সাহায্যের জন্য জনমত গঠন করতে। তাঁরই সঙ্গে এক সাক্ষাতকার ঘটিয়ে টেলিফেনিষ্ট লিওপোন্ড লুইস হয়ে পড়লেন এক রিপোর্টার। তিনি হলেন সাংবাদিক।
লিওপোন্ড লুইস তখন ২২ বছরের উত্তার তরুণ। সমাজ বদলে দেবার, সমাজকে নতুন করে গড়ে তোলার বাসনায় লুইস এবং তাঁর বয়সী তুরুণেরা তখন অস্থির। সমাজকে কিভাবে গঠন করা উচিত যাতে করে মানুষ যাথার্থ এবং পরিপূর্ণ জীবন-যাপন করতে পারে। কিভাবে বিন্যাস্ত হওয়া উচিত তাদের সম্পর্ক যাতে করে যে একাকীত্ব ও নিঃঙ্গতা প্রত্যেকটি মানুষকে ঘিরে রেখেছে ভেঙ্গে–চুরে সকলে বেরিয়ে আসতে পারে এবং সত্যিকার পারস্পরিকক বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার মধ্যে কাটাতে পারে পারে জীবন? ভাল কি, মন্দ কি, ভাগ্য কি, কিংবা ভিন্নভাবে বলতে গেলে মানুষের কি করা উচিত যাতে করে সে যথার্থ অর্থে কেবল মুখে নয় তার জীবনের সাথে এক ও অভিন্ন হতে পারে এবং বলতে পারে আমি এবং আমার অদৃষ্ট আলাদা নয়-একই!
সর্বত্র যখন নৈতিক ও সামাজিক অনিশ্চয়তার আবহাওয়া প্রবল তাই জন্ম দিয়েছিলো বেপরোয়া আশাবাদের। আর তার প্রকাশ ঘটেছিলে একদিকে, -তাঁর সে সময়কার সঙ্গীতে, চিত্রকলা ও নাটকে দুঃসাহসিক পরীক্ষণ-নিরীক্ষণে, অন্যদিকে সংস্কৃতির কাঠামোও রূপরেখার সম্পর্কে অন্ধভাবে হাতড়ানোতে প্রায়শ বৈপ্লবিক অনুসন্ধানে রত ছিল। কিন্তু এই জোর করে বাঁচিয়ে রাখা আশাবাদের পাশাপাশিই তখন চলছে একটি আধ্যাত্মিক শূন্যতা। একটা অস্পষ্ট উন্নাসিক আপেক্ষিকতাবাদ ক্রমবর্ধমান এক নৈরাশ্যবাদের মধ্যে যার জন্ম। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর উচ্চগ্রামে বাঁধা ভাবাবেগ পীড়িত অসন্তুষ্ট উত্তেজিত ইউরোপীয় জগতে কিছুই আর চলছিলোনা আগের মত স্বাভাবিক ও সুশৃঙ্খলভাবে। লুইসের চেখে ধরা পড়লো পশ্চিমা জগতের আসল মাবুদ আর আধ্যাত্মিক কিছু নয়। এর একমাত্র উপাস্য হচ্ছে কমফোর্ট, আরাম-আয়াস-গড়পড়তায় একজন ইউরোপীয়, সে গণতন্ত্রী কমিউনিষ্ট, মজুদুর বুদ্ধিজীবি যেই হউক তাঁর কাছে অর্থপূর্ণ বিশ্বাস ছিলো একটি বৈষয়িক উন্নতির পূজা, কারণ জীবনকে ক্রমাগত সহজতর করে তোলা ছাড়া জীবনের আর কোন লক্ষ্য থাকতে পারে না। সম্প্রতিক ভাষায় প্রকৃতির কবল থেকে মানুষকে আজাদ করাই জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য। এই নতুন ধর্মের মন্দির হচ্ছে বিশাল কলকারখানা, সিনেমা, রাসায়নিক গবেষণাগার, নৃত্যশালা, প্রাণিবিদ্যা সংস্থাসমূহ। আর এ ধরণের মন্দিরের পুরোতঠাকুর হচ্ছে ব্যাংকার, ইঞ্জিনায়ার, রাজনীতিবিদ, চিত্রতারকা, পরিসংখ্যানবিদ, শিক্ষা পরিচালক, রেকর্ড স্রষ্টা, বৈমানিক এবং কমিসারেরা। ভালো এবং মন্দের ধারণার ক্ষেত্রে সার্বিক মতানৈক্য এবং সকল সমাজিক ও অর্থনৈতিক বিষয়ের সুবিধাবাদের আশ্রয় গ্রহণ-এর মধ্যে ঘটলো নৈতিক ব্যর্থতার প্রকাশ-সেই সুবিধাবাধিতার যা রাস্তার বীরঙ্গনার সাথে তুলনীয়, যে বীরঙ্গনা যখনই এবং যারাই বাঞ্ছিতা হয় তখনই তার কাছে দেহ দান করে। সেই বয়সেই লুইস দেখতে পেলেন ক্ষমতা এবং সুখের অতৃপ্ত লালসাই পাশ্চত্য জগতকে অনিবার্যভাবেই পরস্পরভিরোধী বিভিন্ন দলে বিভক্ত করে রেখেছে। যে দলগুলোর প্রত্যেকেই মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত এবং যখনই সেখানে তাদের পারস্পরিক স্বার্থে আঘাত লাঘছে, তারা একে অপরকে ধ্বংস করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। তখন ন্যায়-অন্যায়ের সর্বোচ্চ মাপকাঠিই ছিলের বাস্তব উপযোগিতা, জাগতিক, সাফল্য। লুইসের সেই সময়কার অবস্থা , লুইসের ভাষায় “ আমি দেখতে পেলাম জীবন কতো অসুখী এবং বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছে। মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগ কত সামান্য। যদিও সমাজ ও জাতির উপর জোর দেওয়া হচ্ছে কান ফাটানো উন্মত্ত চিৎকারের সঙ্গে। আমরা আমাদের সহজাত অনুভূতির দুনিয়া থেকে কত দূরে সরে পড়েছি। আর আমদের আত্মা কতো সংকীর্ণ এবং দীপ্ত হয়ে উঠেছে। তখন আমাদের সকল চিন্তার আদি এবং অন্ত ছিলো ইউরোপ।”
লুইস বলেন, ‘‘কিন্তু আমার চারপাশে যারা রয়েছে তাদের কিংবা তাদের মধ্যকার কোন দলের বিভিন্নমুখী সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক আশা-আকাংখায় শারিক হতে আমার অক্ষমতা কালক্রমে আমার মধ্যে এই অস্পষ্ট ধারণার রূপ নেয় যে, আমি ঠিক ওদের কেউ নই, ওদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক নেই এবং তারই সঙ্গে আমর এ বাসনা জন্মাল যে আমাকে কারো অঙ্গীভূত হতেই হবে-তবে কার? কোন কিছুর অংশ হতে হবেই –তবে কিসের’’ বুকভরা এই আকুতি ও অস্থিরতা নিয়েই তিনি ১৯২২ সনে তাঁর মাথা কোরআনের আহবানে ২২ বছর বয়সে পাড়ি দিলেন আরক মূলক জেরুযালেমে। দীর্ঘদিন আরবদের সঙ্গে মেলামেশা করে তিনি পেলেন সেই জবাব। –তিনি কার অঙ্গীভূত হবেন, কিসের অংশ হবেন। ফ্রাংকফুর্টার শাইটুম নামক এক জগত বিখ্যাত কাগজের সংবাদদাতা হয়ে তিনি আসেন জেরুজালেম এবং কয়েক বছর পর করেন, ফিলিস্তীন, ট্রান্সজর্ডান, ইরাক, পারস্য, আফগানিস্থান। জেরুযালেমে অবস্থানকালে, তিনি প্রথম ইসলামের সংস্পর্শে আসেন এবং আরবদের জীবন পদ্ধতির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। আরবদের সঙ্গে অন্তরঙ্গ মেলামেশার পর তিনি আবিষ্কার করলেন, ট্রাডিশনাল মুসলিম সমাজের মধ্যে রয়েছে মন ও ইন্দ্রিয়ের এক সহজাত সঙ্গতি, -যা ইউরোপ হারিয়ে বসেছে। তিনি তাদের মধ্যে আকিষ্কার করলেন হৃদয়ের নিশ্চয়তা এবং আত্ম-অবিশ্বাস থেকে মুক্তি, যে মুক্তি ইউরোপীয়দের স্বপ্নের অগোচর। তিনি কিসের অংশ হবেন, অবশেষে সেই জিজ্ঞাসার জবাব পেলেন লিওপোন্ড লুইস এবং ১৯২৬ সনে ইউরোপ ফিরে তিনি সস্ত্রীক কবুল করলেন ইসলাম। তাঁর মুসলিম নাম হলো মুহাম্মদ আসাদ। আসাদের আত্মকথা ‘মক্কার পথ’ গ্রন্থ তাঁর এই ইসলাম কবুল কে বলা হয়েছে ‘স্বগৃহ প্রর্ত্যাবর্তন’। ইসলামের দীক্ষিত হবার পর আসাদ প্রায় ৬ বছর আরব দেশে বাস করেন, আরব জীবন ও ভাষার সঙ্গে তাঁর গভীর পরিচয়। তিনি বাদশা ইবনে সউদের অন্তরঙ্গ হয়ে উঠেন। এরপর তিনি আরব দেশ ছেড়ে ভারতে যান এবং মহান মুসলিম কবি ও দার্শনিক আল্লামা ইকবালের সঙ্গে পরিচিত হন। তাঁরই পরামর্শে আসাদ তাঁর পূর্ব তুর্কীস্তান, চীন এবং ইন্দোনেশিয়া সফরের পরিকল্পনা ত্যাগ করেন, ইসলামী রাষ্ট্রের বুদ্ধিবৃত্তিক সূত্রগুলোর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের জন্যে তিনি ভারতে থেকে যান। ইসলামী রাষ্ট্র তখন এক স্বাপ্নিক কবির স্বপ্ন বিহবল মনের স্বপ্ন মাত্র ছিলো। মুহাম্মদ আসাদের ভাষায় “আমার কাছে ইকবালের মতই স্বপ্ন ছিলো-ইসলামের সমস্ত ঘুমন্ত আত্মাকে পুনর্জীবিত করে তোলার একটি পথের –বস্তুত একমাত্র পথের পথিকঃ একটি জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক সত্তা সৃষ্টি, যার সংহতির ভিত্তি একই রক্ত-মাংস নয়, বরং এটি আদর্শের প্রতি সাধারণ আনুগত্য। বহু বছর আমি নিজেকে নিবেদিত রাখি এই লক্ষ্যে অধ্যয়ন, রচনা ও বক্তৃতায় এবং কালে ইসলামী আইনের ব্যাখ্যাতা হিসাবে কিছুটা খ্যাতি অর্জন করি।” কিন্তু এই অর্জন কিছুটা নয়, আসলে বিশ্বব্যাপী খ্যাতি অর্জন।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হলে এই রাষ্ট্রের সরকার ইসলামী পুনর্গঠন বিভাগ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার এবং পরিচালনার জন্য মুহাম্মদ আসাদকে আহবান করে,-এর লক্ষ্য রাষ্ট্র ও সমাজ সম্পর্কে আদর্শগত ইসলামী ধ্যান-ধারণাগুলোকে বিশদভাবে তুলে ধরা, যার উপর নবজাত রাজনৈতিক সংগঠনটি তার আদর্শিক দিক-নির্দেশনার জন্য নির্ভর করতে পারে। মুহাম্মদ আসাদ দু’বছর এই অতিশয় উদ্দীপনাপূর্ণ কাজটি চালিয়ে যাবার পর পাকিস্তান ফরেন সার্ভিসে যোগদান করেন। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র দপ্তরে তিনি হন মধ্যপ্রাচ্য ভিভিশনের প্রধান। ইহুদীবাদের বিরুদ্ধে ফিলিস্তীনিদের পক্ষে পাকিস্তান জাতিপুঞ্জ প্রতিষ্ঠানে যে যুক্তি ও তথ্যের লড়াই সাফল্যের সঙ্গে পরিচালনা করে তার সমর্থনে সকল ঐতিহাসিক তথ্য ও দলিল প্রমাণাদি সরবরাহ করেন মুহাম্মদ আসাদ। পররাষ্ট্র দপ্তরে তিনি আত্মনিয়োগ করেন, পাকিস্তান ও মুসলিম বিশ্বের মধ্যে সম্পর্ক মজবুত করে তোলার জন্য। এই সময়ে মুহাম্মদ আসাদ নিযুক্ত হলেন জাতিপুঞ্জ প্রতিষ্ঠানে পাকিস্তানী মিশনে মিনিষ্টার প্লেনিপোটেনশিয়ার হিসেবে। পরে ১৯৫২ সালের শেষেরদিকে তিনি এই পদে ইস্তাফা দিয়ে তাঁর অমর ‘‘The Road To Mecca’’গ্রন্থ রচনায় আত্মনিয়েগে করেন।