সুন্নাতে রাসূলের আইনগত মর্যাদা
একটি গুরুত্বপূর্ণ পত্র বিনিময়
(‘বাযমে তুলূয়ে ইসলাম’ শীর্ষক মাসিক পত্রিাকার একজন প্রসিদ্ধ সদস্য জনাব ডকটর আবদুল ওয়াদুদ এবং এই গ্রন্তকারের মধ্যেত সুন্নাহকে ইসলামী আইনের ভিত্তি হিসাবে গ্রহণ করার ব্যাপারে যে পত্র বিনিময় হয়েছিল একানে তা উদ্ধৃত করা হল)।
ডকটর সাহেবের প্রথম পত্র
মাখদূম ও মুহতারাম মওলানা! আপনি দীর্ঘজীবি হোন।
আসসালামু আলাইকুম। সংবিধান গ্রণয়নের এই চূড়ান্ত পর্যায়ে প্রতিটি সং মুসলমানের দীনী আশা-আকাংখার মৌলিক দাবী এই যে, পাকিস্তানের আইন ইসলামের স্থায়ী ও স্বকীয় মূল্যেবোধের ভিত্তিতে প্রণীত ও পূর্ণতাপ্রাপ্ত হোক। এ প্রসংগে আইন কমিশনের প্রশ্নমালার জওয়াবে আপনার এবং অপরাপর বিশিষ্ট আলেমগণের এই অভিন্ন দাবীও আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়েছে যে, পাকিস্তানের জন্য প্রণীত আইনের ভিত্তি কুরআন ও সুন্নাতের উপর প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। “সুন্নাতের” বাস্তব গুরুত্বকেও আমি অস্বীকার করছি না এবং তার এই গুরুত্বকে খতম করার অভিপ্রায়ও আমার নেই। কিন্তু সুন্নাতকে যখন ইসলামী আইনের ভিত্তি হিসাবে উল্লেখ করা হচ্ছে তখন এটি সন্দেহ অবশ্যম্ভাবীরূপে মন-মগজে উত্থিত হয় এবং তার পরিণতিতে যেসব প্রশ্নের উদয় হয় তা আপনার সামনে পেশ করছি এবং আশা করছি আপনি প্রথম অবসরেই এই সন্দেহের অপনোদনকল্পে উত্তর প্রদান করবেন। প্রশ্নগুলো নিম্নেপ্রদত্ত হলঃ
১. আপনার মতে “সুন্নাত”-এর অর্থ কি? অর্থাৎ যে যেভাবে কিতাব বলতে কুরআন মজীদকে বুঝায় অনুরূপভাবে সুন্নাত (রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহে ওয়া সাল্লামের সুন্নাত ) – এর অর্থই বা কি?
২. আমাদের নিকট (কুরআনের মত) এমন কোন কিতাব আছে কি যার মধ্যে রসূলুল্লাহ (স)-এর সুন্নাত ধারাবাহিকভাবে সুগ্রথিত হয়েছে? অর্থাৎ কুরআনের মত সুন্নাতেরও কোন মৌলিক ও অর্থবহ গ্রন্থআছে কি?
৩. রসূলুল্লাহ (স)-এর সুন্নাতের এই গ্রন্থের মূলপাঠ সকল মুসলমানের নিকট কি কুরআন মজীদের মূল পাঠের অনুরূপ গ্রহণযোগ্য ও সর্বসমর্থিত এবং সন্দেহ ও সমালোচনার উর্ধ্বে?
৪. অনুরূপ কোন কিতাব যদি বর্তমান না থাকে তবে কুরআনের কোনো আয়াত বা আয়াতাংশ সম্পর্কে যেমন সহজেই বুঝা যায় যে, এটি কুরআন মাজীদের আয়াত, তেমটি এটা কিভাবে জানা যাবে যে, অমুক কথা রসূলুল্লাহ (স)-এর সুন্নাত কিংবা সুন্নাত নয়?
আমি আপনাকে নিশ্চয়তা প্রদান করছি যে, আমি অন্তর ও দৃষ্টির পূর্ন একাত্মতা সহকারে ইসলামী আইনকে এতোটা গুরুত্বপূর্ন মনে করি যে, এটাকে একজন মুসলমানের জীবনের উদ্দেশ্য হিসাবে স্বীকার করি। আমার এই অকৃত্রিম আবেদনের উদ্দেশ্য হলো, আমি চাই ইসলামী আইনের দাবী করতে গিয়ে ইসলামপ্রিয় লোকদের মন-মগজে তার একটি সুস্পষ্ট, অভিন্ন ও কার্যোপযোগী রূপরেখা বর্তমান থাকুক। যাতে দেশের ধর্মহীন বুদ্ধিজীবীরা পূর্ণ শক্তিতে ইসলামী আইনের বিরুদ্ধে যেরূপ তৎপর রয়েছে তার মোকাবিলা করার জন্য ইসলামপ্রিয় শক্তির মধ্যে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি না হয়। আইনের ব্যাপারে যেহেতু জনসাধারণের মনে পেরেশানী লক্ষ্য করা যায়, তাই তাদের অবহিতির জন্য আপনার প্রদত্ত উত্তর পত্রিকায় প্রকাশ করা হলে আশা করবো তাতে আপনার কোন আপত্তি থাকবে না। ওয়াসসালাম।
বিনীত
আবদুল ওয়াদুদ
উত্তর
শ্রদ্ধেয়,
আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহ
২১ মে , ১৯৬০ ঈসাঈ তারিখে আপনার পত্র হস্তগত হয়েছে। আপনি যেসব প্রশ্ন করেছেন তা আজ আপনি প্রথম করেননি। ইতিপূর্বেই বিভিন্ন মহল থেকে তা উত্থাপিত হয়েছে এবং তার জওয়াবও আমি পরিষ্কার ভাষায় প্রদান করেছি। বিভিন্ন মহল থেকে বারবার একই ধরনের প্রশ্নাবলীর পুনরাবৃত্তি করা এবং পূর্বের দেয়া উত্তরসমূহের প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করা কোন যুক্তিসংগত কথা নয়। যদি ধরে নেয়া হয় যে, এ সম্পর্কে অনেক পূর্বেই আমি যে জবাব দিয়েছি তা আপনি অবহিত নন, তবে আমি আপনাকে তার বরাত বলে দিচ্ছে(দ্র. তরজমানুল কুরআন,জানুয়ারী ১৯৫৮ খৃ., পৃ. ২০৯-২২০: ডিসেম্বর ১৯৬৮ খৃ.,পৃ. ১৬০-১৭০)। আপনি তাঅধ্যয়নপূর্বক বিস্তারিতভাবে জানান যে, আপনার প্রশ্নাবলীর মধ্যে কোন প্রশ্নের জবাব সেখানে নাই এবং যেসব প্রশ্নের উত্তর বর্তমান আছে তার উপর আপনার কি আপত্তি আছে।
আপনি যদি আপনার এই পত্রের সাথে আমার ঐ উত্তরমালাও ছাপানোর ইচ্ছা রাখেন তবে অনুগ্রহপূর্বক আমার উল্লেখিত প্রবন্ধদ্বয়ও হুবহু ছাপিয়ে দিন। কারণ মূলত আমার পক্ষ থেকে সেগুলিই আপনার প্রশ্নাবলীর জবাব। এজন্য আপনি বলতে পারেন না যে, আমি আপনার প্রশ্নবলীর উত্তর দিতে অনীহা প্রকাশ করেছি।
বিনীত
আবুল আ’লা
ডকটর আবদুল ওয়াদুদ সাহেবের দ্বিতীয় পত্র
শ্রদ্ধেয় মাওলানা, আপনার মর্যাদা বৃদ্ধি হোক!
আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহ। আপনার পত্র পেয়েছি। পত্রোত্তরের জন্য আমি আপনার নিকট কৃতজ্ঞ। আমি জানি, এই ধরনের প্রশ্নাবলী ইতিপূর্বেও বিভিন্ন মহল থেকে করা হয়েছিল। কিন্তু আমার জন্য বিশেষভাবে তার বিস্তারিত ব্যাখ্যার প্রয়োজন এজন্য হয়েছে যে, উল্লেখিত প্রশ্নাবলীর সুনির্দিষ্ট ও সুস্পষ্ট জবাব পর্যন্ত আমার নজরে পড়েনি।
আপনি আপনার যেসব প্রবন্ধের প্রতি দিকনির্দেশ করেছেন তা আমি দেখেছি। কিন্তু আমাকে খুবই আফসোসের সাথে এই আবেদন করতে দিন যে, সেখানেও আমি আমার প্রশ্নাবলীর সুনির্দিষ্ট জবাব পাইনি। বরং তাতে আমার অস্থিরতা আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। কারণ সেখানে এমন কয়েকটি কথা আছে যা আপনার অন্যান্য প্রবন্ধের বিপরীত। যাই হোক বিতর্ক আমার উদ্দেশ্য নয় (আর না আপনার মর্যাদার দিকে লক্ষ্য রেখে তার দুঃসাহস আমি করতে পারি), বরং বক্তব্য অনুধাবনই আমার উদ্দেশ্য। তাই আপনার প্রবন্ধ পাঠে আমি যা কিছু অনুধাবন করতে পেরেছি তা নিম্নেপেশ করছি। আমি যদি সঠিক অনুধাবন করে থাকি তবে তার স্বীকৃতি দিন, আর ভুল বুঝে থাকলে অনুগ্রহপৃর্বক তার ব্যাখ্যা প্রদান করুন। এজন্য আমি আপনার নিকট কৃতজ্ঞ থাকব।
১. আপনি বলেছেন, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম তেইশ বছরের নবূওয়াতী জীবনে কুরআন মজীদের ব্যাখ্যা প্রদান করতে গিয়ে যা কিছু বলেছেন, অথবা কার্যত করেছেন, তাকে রসূলুল্লাহ (স) এর সুন্নাত বলা হয়।
এই বক্তব্য থেকে দুটি সিদ্ধান্তে পৌছা যায়।
(ক) রসূলুল্লাহ (স) এই তেইশ বছরের জীবনে যেসব কথা ব্যক্তি হিসাবে বলেছেন অথবা কার্যত করেছেন তা সুন্নাতের অন্তর্ভুক্ত নয়।
(খ) ‘সুন্নাত’ হচ্ছে কুরআনের বিধান ও মৌলনীতির ব্যাখ্যা। কুরআন ব্যতীত দীন ইসলামের মূলনীতি অথবা বিধান নির্ধারণ করা যায় না এবং ‘সুন্নাত’ কুরআনের কোন নির্দেশ রহিত (মানসূখ) করতে পারে না।
২. আপনি বলেছেন, এমন কোন গ্রন্থ বর্তমান নাই যার মধ্যে রসূলুল্লাহ (স)-এর সুন্নাতের সবই পূর্ণরুপে সংকলিত পাওয়া যেতে পারে এবং যার মূল পাঠ (মতন) কুরআন মজীদের মূল পাঠের মত সমস্ত মুসলমানের নিকট।
৩. আপনি আরও বলেছেন, হাদীসের বর্তমান সংকলনসমূহ থেকে সহীহ হাদীসসমূহ পৃথক করা যাবে। এজন্য হাদীসসমূহ যাচাইয়ের যে মূলনীতি পূর্ব থেকে স্থিরিকৃত আছে তা চুড়ান্ত নয়। রিওয়ায়াতের মূলনীতি ছাড়াও দিরায়াতের সাহায্য নেয়া যেতে পারে এবং যেসব লোকের মধ্যে ইসলামী জ্ঞান বিজ্ঞানের দীর্ঘ চর্চার ফলে সুগভীর দূরদৃষ্টি সৃষ্টি হয়েছে তাদের দিরায়াতই গ্রহণযোগ্য হবে।
৪. হাদীসসমূহের এভাবে যাচাই করার পরও একথা বলা যায় না যে, কুরআন যেমন আল্লাহর বাণী, এটাও তেমনি রসূলুল্লাহ (স) এর বাণী।
আমি আপনার উত্তরের অপেক্ষায় রইলাম। ওয়াসসালাম।
বিনীত
আবদুল ওয়াদূদ
উত্তর
মুহতারামী ও মুকাররামী,
আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহ। আপনার চিঠি ২মে, ১৯৬০ খৃ. তারিখে ডাক মারফত হস্তগত হয়েছে। এরপর আপনি পুনর্বার ২৮ মে একই চিঠির প্রতিলিপি লোক মারফতও পাঠিয়েছেন। কিন্তু অবিরাম ব্যস্ততার কারণে এখন পর্যন্ত উত্তর দিতে পারিনি। এই অপারগতার জন্য আমি দঃখিত।
আপনি আপনার পত্রে এই নিশ্চয়তা প্রদানে আমি আনন্দিত যে, পত্র বিনিময়ের মাধ্যমে বিতর্কে লিপ্ত হওয়া আপনার উদ্দেশ্য নয়,বরং আপনি বিষয়টি হৃদয়ংগম করতে চাচ্ছেন। আপনার মত ব্যক্তিত্বের নিকট আমি এটাই আশা করছিলাম। কিন্তু বিষয়টি বুঝার জন্য আপনি পত্র মাধ্যমে যে পন্থা অবলম্বন করেছেন তা আপনার নিশ্চয়তা প্রদানের সাথে সামান্যতম সামঞ্জস্য রাখে, অন্তত আপনার চিঠি থেকে তা আমি অনুভব করতে পারছি না। আপনার ২১ মে তারিখের চিঠিটি বের করে পুনরায় পাঠ করুন। তাতে আপনি চারটি সুনির্দিষ্ট প্রশ্ন আমার সামনে রেখে সেগুলোর উত্তর চেয়েছিলেন। আমি ঐ তারিখেই সে পত্রের উত্তরে আপনাকে লিখেছিলাম, আপনি তরজমানুল কুরআনের ১৯৫৮ সনের জানুয়ারী সংখ্যা এবং ডিসেম্বরে সংখ্যায় আমার অমুক অমুক প্রবন্ধ অধ্যয়নপূর্বক আমাকে বিস্তারিতভাবে বলুন যে, আপনার প্রশ্নবলীর মধ্যে কোন প্রশ্নটির জবাব তাতে নেই এবং যেসব প্রশ্নের জবাব তাতে বর্তমান আছে তার উপর আপনার কি আপত্তি আছে। কিন্তু আপনি ঐসব প্রবন্ধ পাঠ করে আপনার প্রথম দিককার প্রশ্নবলীর আলোকে সে সম্পর্কে কোন বক্তব্য রাখার পরিবর্তে আরও কিছু প্রশ্ন যোগ করেছেন এবং এখন আপনি চাচ্ছেন যে, আমি এগুলোর উত্তর দেই। একটি আলোচনা শেষ করার পূর্বে আরেকটি আলোচনা উত্থাপন করা এবং কোন সমাপ্তি ছাড়া একইভাবে বক্তব্যের পর বক্তব্যের ধারা অব্যাহত রাখাটা কি বাস্তবিকই কোন বিষয় হৃদয়ংগম করার কোন পন্থা হতে পারে?
আপনার নতুন প্রশ্নাবলীর উপর আলোকপাত করার পূর্বে আমি চাই, আপনি আপনার প্রথম দিককার প্রশ্নবলীর দিকে প্রত্যাবর্তন করুন এবং স্বয়ং দেখুন, ঐ প্রশ্নগুলোর একেকটির কি উত্তর আপনি আমার সেসব প্রবন্ধে পেয়েছেন এবং তা কিভাবে উপেক্ষা করেছেন।
সুন্নাত কি?
আপনি চারটি প্রশ্ন এই কারণে উত্থাপন করেছেন যে, আমি আইন কমিশনের প্রশ্নমালার জবাব দিতে গিয়ে “ইসলামী আইনের ভিত্তি হিসাবে সুন্নতের উল্লেখ করেছিলা”।অন্য কথায় আপনার এই প্রশ্ন কয়টি “সুন্নাতের আইনগত মর্যাদার” সাথে সংশ্লিষ্ট ছিল। এই প্রসংগে আপনার প্রথম প্রশ্ন ছিল: “আপনার মতে সুন্নাতের অর্থ কি? অর্থাৎ কিতাব বলতে যেভাবে কুরআন মজীদকে বুঝায়, অনুরূপভাবে সুন্নাত (অর্থা রসূলুল্লাহর সুন্নাত) বলতে কি বুঝায়”?
এই প্রশ্নের যে উত্তর আমার পূর্বেকার প্রবন্ধসমূহে দেখতে পেয়েছেন, তা এইঃ:
এই মুহাম্মদী শিক্ষা সেই উচ্চতর আইন যা সর্বোচ্চ বিধানদাতার (অর্থাৎ আল্লাহ তাআলার) মর্জি ও ইচ্ছার প্রতিনিধিত্ব করে। এই বিধান মুহাম্মাদ (স) থেকে আমাদের নিকট দুইটি মাধ্যমে পৌছেছে। এক, কুরআন মজীদ যা অক্ষরে অক্ষরে মহান আল্লাহর বিধান ও তাঁর হেদায়াতের সমষ্টি। দুই, মুহাম্মাদ (স)-এর উসওয়া-ই হাসানা (অনুসরণীয় উত্তম আদর্শ) , অথবা তাঁর সুন্নাত যা কুরআন মজীদের উদ্দেশ্যের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে। মুহাম্মদ (স) শুধুমাত্র আল্লাহর পত্রবাহকই ছিলেন না যে, তাঁর কিতাব পৌছে দেয়া ব্যতীত তাঁর আর কোন দায়িত্ব ছিল না, বরং তিনি তাঁর নিয়োগকৃত পথপ্রদর্শক, আইনপ্রণেতা ও শিক্ষকও ছিলেন। তাঁর দায়িত্ব ছিল নিজের কথা ও কাজের মাধ্যমে কানূনে ইলাহীর ব্যাখ্যা প্রদান করা, তার সঠিক উদ্দেশ্য বুঝিয়ে দেয়া, তার উদ্দেশ্য অনুযায়ী লোকদের প্রশিক্ষণ দেয়া। অতপর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত লোকদের সমন্বয়ে একটি সুসংগঠিত জামায়াতের রূপ দান করে সমাজের সংশোধন ও সংস্কারের উদ্দেশ্যে প্রচেষ্টা চালানো। অতপর এই সংশোধিত সমাজকে একটি সং ও সংশোধনকারী রাষ্টের রূপ দান করে দেখিয়ে দেয়া যে, ইসলামের আদর্শ ও নীতিমালার উপর একটি পূর্ণাংগ সভ্যতা কিভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। মহনবী (স)-এর এই সমগ্র কাজই হচ্ছে সুন্নাত যা তিনি তেইশ বছরের নবূওয়াতী জীবনে আঞ্জাম দিয়েছেন। তাঁর এই সুন্নাত কুরআনের সাথে মিলিত হয়ে সর্বোচ্চ আইন প্রণেতার উচ্চতর আইনের রূপায়ন ও পূর্ণতা বিধান করে। আর ইসলামী পরিভাষায় এই উচ্চতর আইনের নাম শরীআত” (তরজমানুল কুরআন, জানুয়ারী ১৯৫৮ খৃ.পৃ.২১০-২১১)।
“এ এক অনস্বীকার্য ঐতিহাসিক সত্য যে, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম নবূওয়াতের পদে সমাসীন হওয়ার পর আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে শুধুমাত্র কুরআন মজীদ পৌছে দিয়েই ক্ষান্ত হননি, বরং একটি সামগ্রিক বিপ্লবও পরিচালনা করেন, যার ফলশ্রুতিতে একটি মুসলিম সমাজের জন্ম হয়, সভ্যতা- সংস্কৃতির একটি নতুন ব্যবস্থা অস্তিত্ব লাভ করে এবং একটি রাষ্টীয় ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রশ্ন জাগতে পারে, কুরআন মজীদ পৌছে দেয়া ছাড়াও মুহাম্মদ (স) অন্য যে কাজটি করলেন তা শেষ পর্যন্ত কি হিসাবে করলেন? তা কি নবী হিসাবে করেছেন-যেখানে তিনি কুরআনের অনুরূপ আল্লাহর মর্জি ও ইচ্ছার প্রতিনিধিত্ব করতেন? অথবা তাঁর নবূওয়াতী পদমর্যাদা কি কুরআন মজীদ পৌছে দেয়ার পর শেষ হয়ে গেছে এবং অতপর তিনি সাধারণ মুসলমানদের মত একজন মুসলান হিসাবে থেকে যান-যাঁর কথা ও কার্যবলী নিজের মধ্যে সরাসরি কোন আইনগত মর্যাদা রাখে না? প্রথম কথা স্বীকার করে নিলে সুন্নাতকে কুরআনের সাথে আইনের উৎস হিসাবে স্বীকৃতি দেয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। অবশ্য দ্বিতীয় অবস্থায় তাকে আইনের উৎস হিসাবে স্বীকৃতি দেয়ার কোন কারণ থাকতে পারে না।
এ ব্যাপারে কুরআনের বক্তব্য সম্পূর্ন সুস্পষ্ট যে, মুহাম্মাদ (স) শুধুমাত্র পত্রবাহক ছিলেন না, বরং আল্লাহর পক্ষ থেকে নিযুক্ত পথপ্রদর্শক, আইন প্রণেতা এবং শিক্ষকও ছিলেন, যাঁর আনুগত্য ও অনুবর্তন মুসলমানদের জন্য বাধ্যতামূলক এবং যাঁর জিন্দেগীকে গোটা ঈমানদার সম্প্রদায়ের জন্য আদর্শ সাব্যস্ত করা হয়েছে। বিবেক বুদ্ধি একথা মেনে নিতে সম্মত নয় যে, একজন নবী শুধুমাত্র আল্লাহর কালাম পড়ে শুনিয়ে দেয়ার সীমা পর্যন্তই নবী এবং তারপরে তিনি একজন সাধারণ মুসলমান ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিটি যুগে এবং তাঁর আদেশ-নিষেধকে বাধ্যতামূলক বলে মেনে নিয়েছে। এমনকি কোন অমুসলিম পন্ডিতও এই বাস্তব বিষয়টি অস্বীকার করতে পারেনা যে, মুসলমানগণ সর্বদা মুহাম্মদ (স)-এর এই মর্যাদাই স্বীকার করে নিয়েছে আর এই কারণে ইসলামের আইন ব্যবস্থা কুরআনের পাশাপাশি সুন্নাতকে আইনের দ্বিতীয় উৎস হিসাবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। এখনি আমি বলতে পারছি না যে, কোন ব্যক্তি সুন্নাতের এই আইনগত মর্যাদাকে কিভাবে চ্যালেঞ্জ করতে পারে যতক্ষণ পর্যন্ত সে পরিষ্কারভাবে এ কথা না বলে যে, মুহাম্মদ (স) কে এই মর্যাদা কি স্বয়ং সে দিচ্ছে, নাকি কুরআন তাঁকে এই মর্যাদা প্রদান করেছে? প্রথম ক্ষেত্রে ইসলামের সাথে তার বক্তব্যের কোন সম্পর্ক নাই। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে তাকে কুরআন থেকে নিজ দাবীর সমর্থনে প্রমাণ পেশ করতে হবে”-(তরজমানুল কুরআন, জানুয়ারী ১৯৫৮ খৃ.পৃ.২১৬-২১৭)।
এবার আপনি বলুন, “সুন্নাত বলতে কি বুঝায়” আপনার সে প্রশ্নের জবাব আপনি পেয়েছেন কি? আর আপনি জানতে পারছেন কি না যে, ইসলামী আইনের ভিত্তি হিসাবে যে সুন্নাতের উল্লেখ করা হয় তা কি জিনিস? অন্যান্য প্রশ্ন উত্থাপনের পূর্বে আপনাকে একথা পরিষ্কার করতে হবে যে, আপনার মতে রসূলুল্লাহ (স) কুরআন পড়ে শুনিয়ে দেয়া ছাড়াও দুনিয়াতে আরও কোন কাজ করেছেন কি না, যদি করে থাকেন তবে তা কি হিসাবে করেছিলেন? যদি আপনার মতে এই কাজ করে দেয়ার পর মহানবী (স) সাধারণ মুসলমানদের মতই একজন মুসলমান হয়ে গিয়ে থাকেন এবং কুরআন পাঠ করে শুনিয়ে দেয়ার অতিরিক্ত কথা ও কাজে তাঁর নবী সুলভ মর্যাদা ছিল না, তাহলে আপনি একথা পরিষ্কার করে বলুন এবং এটাও বলে দিন যে, আপনার এই মতের উৎস কি? এটা কি আপনার মনমগজ প্রসূত কথা,নাকি কুরআনে এর সমর্থনে কোন প্রমাণ আছে? আপনি যদি একথা স্বীকার করেন যে, আল্লাহ তাআলার মনোনীত পথপ্রদর্শক, আইনপ্রণেতা,বিচারক, শিক্ষক ও অভিভাবক হিসাবে মহানবী (স) একটি মুসলিম সমাজ গঠন করার এবং একটি রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা প্রণয়ন করে এবং চালিয়ে দেখানোর যে কাজ আঞ্জাম দিয়েছেন, তাতে তাঁর একজন নবীসুলভ মর্যাদা ছিল, তবে তা সেই সুন্নাত কি না ইসলামে যার আইনের ভিত্তি হিসাবে মর্যাদাথাকা উচিৎ? এটা পরের কথা যে, এই সুন্নাত কোন জিনিসের উপর প্রয়োগ হয় এবং কোন জিনিসের উপর প্রয়োগ হয়না। প্রথমে তো আপনাকে একথা পরিষ্কার বলতে হবে যে. কুরআন মজীদ ছাড়াও রসূলুল্লাহ (স) এর সুন্নাত স্বয়ং কোন জিনিস কি না? এবং সেটাকে আপনি কুরআনের পাশাপাশি আইনের উৎস হিসাবে স্বীকার করেন কি না? যদি তা স্বীকার না করেন তবে তার অনুকূলে আপনার প্রমাণ কি? এই মৌলিক কথা যতক্ষণ না সুস্পষ্ট হবে ততক্ষণ আপনার দ্বিতীয় পত্রে উত্থাপিত প্রশ্নবলীর উপর আলোকপাত করে কি লাভ?
সুন্নাত কি অবস্থায় বর্তমান আছে
আপনার দ্বিতীয় প্রশ্ন ছিল, “কুরআনের অনুরূপ আমাদের এখানে কি এমন কোন গ্রন্থ বর্তমান আছে যার মধ্যে রসূলুল্লাহ (স) এর সুন্নাত ধারাবাহিকভাবে মওজুদ রয়েছে? অর্থাৎ কুরআনের মত সুন্নাতের কি পূর্ণাংগ কোন কিতাব আছে?”
এই প্রশ্নের জবাবও আমার উধৃত প্রবন্ধে বর্তমান ছিল এবং আপনি তা গভীরভাবে অধ্যয়ন করে থাকলে এর জবাবও পেয়ে থাকবেন। আমি পুনরায় তা এখানে তুলে দিচ্ছি যাতে আপনি পূর্বে পেয়ে না থাকলে এখন তা পেয়ে যান।
“সুন্নাতকে স্বয়ং আইনের উৎস হিসাবে স্বীকার করে নেয়ার পর এই প্রশ্ন উঠতে পারে যে, তা জানার উপায় কি? আমি এর উত্তরে আরজ করব, আজ চৌদ্দশত বছর অতীত হওয়ার পর আমরা প্রথমবারের মত এই প্রশ্নের সম্মুখীন হইনি যে, দেড় হাজার বছর পূর্বে যিনি নবী হিসাবে প্রেরিত হয়েছিলেন তিনি কি সুন্নাত রেখে গিয়েছিলেন? দুটি ঐতিহাসিক সত্য অনস্বীকার্যঃ
এক, কুরআন মজীদের শিক্ষা এবং মুহাম্মদ (স)-এর সুন্নাতের ভিত্তিতে ইসলামের সূচনাতে যে সমাজ প্রথম দিন কায়েম হয়েছিল তা সেই সময় থেকে আজ পর্যন্ত ধারাবাহিক ভাবে জীবন্ত রয়েছে, তা গোটা জীবনকালে এক দিনের জন্যও বিচ্ছিন্ন হয়নি এবং তার সবগুলো প্রতিষ্ঠিত এই সমগ্রকালে উপর্যুপরি কর্মতৎপর থাকে। আজ দুনিয়ার সমস্ত মুসলমানের মধ্যে আকীদা-বিশ্বাস, চিন্তাপদ্ধতি,নৈতিক মূল্যবোধ (value), ইবাদত-বন্দেগী, আচার-ব্যবহার, লেনদেন, জীবনদর্শন ও জীবনপদ্ধতির দৃষ্টিকোণ থেকে যে গভীর সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়, যার মধ্যে মতভেদের তুলনায় ঐক্য ও মিলনের উপাদান অধিক পরিমাণে বর্তমান, যা তাদেরকে গোটা পৃথিবীতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সত্ত্বেও একই উম্মাত হিসাবে গেথে রাখার সর্বাপেক্ষা মৌলিক ও বুনিয়াদী কারণ হয়ে রয়েছে-তা প্রমাণ করে যে, এই সমাজকে কোন একক সুন্নাতের উপরই কায়েম করা হয়েছিল এবং সেই সুন্নাত এই দীর্ঘ কালের পরিক্রমায় ক্রমাগতভাবে অব্যাহত রয়েছে। এটা কোন লুপ্ত জিনিস নয় যার অন্বেষণের জন্য আমাদের অন্ধকারে হাতড়িয়ে বেড়ানোর প্রয়োজন রয়েছে।
দ্বিতীয় উজ্জ্বল ও স্পষ্ট ঐতিহাসিক সত্য এই যে, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের পর থেকে প্রতিটি যুগে মুসলমানগণ নিরবচ্ছিন্নভাবে জানতে চেষ্টা করে যে, প্রামান্য ও প্রতিষ্ঠিত সুন্নাত কি এবং কি জিনিস কোন কৃত্রিম পন্থায় তাদের জীবন ব্যবস্থায় অনুপ্রবেশ করছে। যেহেতু সুন্নাত তাদের নিকট আইনের মর্যাদা সম্পন্নএবং এর ভিত্তিতে সুন্নাত তাদের বিচারালয়সমূহে রায় প্রদান করা হতো এবং তার ভিত্তিতে তাদের ঘর থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের যাবতীয় বিষয় পরিচালিত হতো, তাই এর বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে নির্লিপ্ত থাকা তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। এই বিশ্লেষণের উপায়-উপকরণ এবং তার ফলাফলও ইসলামের প্রাথমিক খিলাফত থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত বংশ পরস্পরায় উত্তরাধিকার সূত্রে আমরা লাভ করেছি এবং কোন বিচ্ছিন্নতা ছাড়াই প্রতিটি বংশধরের (generation) সম্পাদিত কাজ সংরক্ষিত রয়েছে।
এই দুটি সত্যে যদি কেউ উত্তমরূপে অনুধাবন করে এবং সুন্নাতকে জানার মাধ্যমসমূহ যথারীতি অধ্যয়ন করে তবে সে কখনও এমন সন্দেহের শিকার হতে পারে না যে, আজ হঠাৎ সে এক অসমাধানযোগ্য সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে”– (তরজমানুল কুরআন, জানুয়ারী ১৯৫৮খৃ., পৃ.২১৮)।
একই বিষয়ের উপর পুর্নবার আলোকপাত করতে গিয়ে আমি আমার দ্বিতীয় প্রবন্ধে, যার বরাতও আগেই আপনাকে দিয়েছি, লিখেছিলাম যেঃ
“মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সল্লাম তাঁর নবূওয়াতী জিন্দেগীতে মুসলমানদের জন্য শুধুমাত্র একজন পীর-মুরশিদ ও ধর্মীয় বক্তাই ছিলেন না, বরং কার্যত নিজের জামাআতের নেতা, পথপ্রদর্শক, আইনপ্রণেতা, বিচারক, রাষ্টনায়ক, পৃষ্ঠপোষক, শিক্ষক সবকিছুই ছিলেন এবং আকীদা-বিশ্বাস ও ধ্যান-ধারণা থেকে শুরু করে বাস্তব জীবনের সর্বক্ষেত্রে মুসলিম সমাজের সম্পূর্ণ গঠন তাঁরই নির্দেশিত, শিখানো এবং নির্ধারিত পন্থায় হয়েছিল। এজন্য কখনও এটা হয়নি যে, তিনি নামায, রোযা ও হজ্জের অনুষ্ঠনাদির যে শিক্ষা দান করে থাকবেন কেবল তাই মুসলমানদের মধ্যে চালু আছে এবং অন্যান্য সব কথা তারা কেবল ওয়াজ-নসীহত হিসাবে শুনেই ক্ষান্ত থাকবেন। বরং বাস্তবে যা ঘটেছে তা এই যে, যেভাবে তাঁর শিখানো নামায সাথে সাথে মসজিদে চালু হয় এবং জামাআতসমূহও কায়েম হতে থাকে, ঠিক সেভাবেই বিবাহ-শাদী, তালাক ও উত্তরাধিকার সম্পর্কে যে আইন-কানুন তিনি নির্ধারন করেন, মুসলিম পরিবারগুলোতে তার বাস্তব অনুসরন শুরু হয়ে যায়। লেনদেন আদান-প্রদানের যে নিয়ম কানূন তিনি নির্ধারণ করে দেন, বাজারসমূহে তার প্রচলন হয়ে যায়। মোকদ্দমাসমূহের যে রায় তিনি প্রদান করেন তাই রাষ্টীয় বিধান হিসাবে স্বীকৃতি পায়। যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুপক্ষের সাথে তিনি যে আচরণ করেন এবং বিজয়ী হয়ে বিজীত এলাকায় জনগণের সাথে তিনি যে আচরণ করেন তা-ই মুসলিম রাষ্টের বিধিবদ্ধ আইনে পরিণত হয় এবং সার্বিকভাবে ইসলামী সমাজ ও তার জীবন ব্যবস্থা তার সমস্ত শাখা-প্রশাখাসহ সেইসব সুন্নাতের উপর প্রতিষ্ঠিত হয় স্বয়ং তিনি যার প্রচলন করেন অথবা পূর্ব থেকে প্রচলিত রীতিনীতির মধ্যে যেগুলোকে বহাল রেখে তিনি ইসলামী সুন্নাতের অংশে পরিণত করেন।
এগুলো ছিল জ্ঞাত, পরিচিত ও প্রসিদ্ধ সুন্নাত যেগুলো মসজিদ থেকে শুরু করে পরিবার, বাজার, বিচারালয়, রাজপ্রসাদ এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতি পর্যন্ত মুসলমানদের সামাজিক জীবনের সমস্ত শাখা ও বিভাগ মহানবী (স)-এর জীবদ্দশায়ই কার্যকর হতে থাকে এবং পরে খুলাফায়ে রাশেদীনের যুগ থেকে নিয়ে বর্তমান কাল পর্যন্ত আমাদের সামাজিক প্রতিষ্ঠানসমূহের কাঠামো তার উপর প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। বিগত শতক পর্যন্ত তো এসব প্রতিষ্ঠানের ধারাবাহিক সূত্র একদিনের জন্যও কর্তিত হয়নি। এরপরে যদি কোনরূপ বিচ্ছিন্নতার সূত্রপাত হয়ে থাকে তবে তা শুধুমাত্র সরকার, বিচার বিভাগ এবং আইন বিভাগ ইত্যাকার প্রতিষ্ঠনসমূহ কার্যত এলোমেলো হয়ে যাওয়ার কারণে হয়েছে। এসব সুন্নাতের ব্যাপারে একদিকে হাদীসের নির্ভরযোগ্য রিওয়ায়াত এবং অন্যদিকে উম্মাতের অব্যাহত আমল, দুটিই পরস্পরের সাথে সামাঞ্জস্যপূর্ণ- (তরজমানুল কুরআন, ডিসেম্বর ১৯৫৮ খৃ., পৃ. ১৬৭)।
পুনরায় সামনে অগ্রসর হয়ে এ প্রসংগে আরো ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে আমি এও লিখেছিলামঃ
এসব জ্ঞাত ও প্রসিদ্ধ সুন্নাত ব্যতীত আরেক প্রকারের সুন্নাত এরুপ ছিল যা রসূলুল্লাহ (স)-এর জীবদ্দশায় প্রসিদ্ধ লাভ করেনি এবং সাধারণভাবে প্রচলিত হয়নি, সেগুলো বিভিন্ন সময়ে মহানবী (স)-এর কোন সিদ্ধান্ত,বাণী, আদেশ-নিষেধ, মৌন সমর্থন [মৌন সমর্থন মূলে রয়েছে ‘তাকরীর’। এর অর্থ রসূলুল্লাহ (স) নিজের উপস্থিতিতে কোন কাজ হতে দেখলেন, অথবা কোন পন্থার প্রচলন হল এবং তিনি তা নিষিদ্ধ করেননি। অন্য কথায় তাকরীর এর অর্থ কোন জিনিস বহাল রাখা-(গ্রন্থকার)।] ও অনুমতি অথবা কাজ দেখে বা শুনে বিশেষ বিশেষ ব্যক্তির গোচরে এসেছিল এবং সাধারন লোকেরা সে সম্পর্কে অবহিত হতে পারেনি।
এসব সুন্নাতের জ্ঞান, যা বিভিন্ন ব্যক্তির নিকট বিক্ষিপ্ত অবস্থায় ছিল, উম্মাত সংগ্রহ করার অব্যাহত প্রচেষ্টা মহানবী(স)-এর ইন্তেকালের পরপরই শুরু করে দেয়। কারণ খলীফা,প্রশাসকবর্গ, বিচারকমন্ডলী, মুফতী ও জনসাধারণ সকলে স্ব স্ব কর্মক্ষেত্রে আগত সমস্যা সম্পর্কে কোন ফয়সালা অথবা কাজ নিজের রায় ও মাসআলা নির্গত করার ভিত্তিতে করার পূর্বে এটা জ্ঞাত হওয়া অত্যাবত্যকীয় মনে করতেন যে, এই প্রসংগে মহানবী (স)-এর কোন পথনির্দেশ বর্তমান আছে কি না। এই প্রয়োজনের তাগিদেই এমন প্রত্যেক ব্যক্তিকে অনুসন্ধান করা শুরু হয় যার নিকট সুন্নাতের কোন জ্ঞান ছিল। আর যার নিকটই এই জ্ঞান বর্তমান ছিল তিনি তা অন্যদের নিকট পৌছে দেয়া স্বীয় দায়িত্ব ও কর্তব্য মনে করতেন। এটাই হাদীস রিওয়ায়াতের সূচনা বিন্দু এবং ১১ হিজরী থেকে ৩য়-৪র্থ হিজরী শতক পর্যন্ত বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে থাকা এই সুন্নত একত্রিত করার প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকে। জাল হাদীস প্রণয়নকারীরা তার সাথে সংমিশ্রণ ঘটানোর যত অপচেষ্টাই করেছে তা প্রায় সম্পূর্ণই ব্যর্থ করে দেয়া হয়। কারণ যেসব সুন্নাতের মাধ্যমে কোন জিনিস প্রমাণিত অথবা পরিত্যক্ত হত, যার ভিত্তিতে কোন জিনিস হারাম অথবা হালাল সাব্যস্ত হত, যারভিত্তিতে কোন ব্যক্তি শাস্তি ভোগ করত অথবাকোন অপরাধী মুক্তি পেত, মোটকথা যেসব সুন্নাতের উপর আইন-কানুনের ভিত্তি ছিল সেগুলো সম্পর্কে সরকার, বিচার বিভাগ এবং ফতোয়া বিভাগের এতটা বেপরোয়া হওয়ার প্রশ্নই উঠে না যে, হঠাৎ দাঁড়িয়েই কোন ব্যক্তি “কালান-নাবিয়্যু সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম” (নবী স. বলেন) বলে দিত আর একজন বিচারক, প্রশাসক অথবা মুফতী তা মেনে নিয়ে কোন হুকুম দিয়ে বসতেন। এজন্য যেসব সুন্নাত আইন-কানূনের সাথে সম্পর্কিত ছিল সেগুলো সম্পর্কে পূর্ণরূপে অনুসন্ধান চালানো হয়। সমালোচনার কঠোর চালুনি দ্বারা তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। রিওয়ায়াতের মূলনীতির আলোকেও তা পরখ করা হয় এবং দিরায়াত (বুদ্ধি-বিবেচনা)-এর মূলনীতির আলোকেও। আর যেসব মূলনীতির ভিত্তিতে কোন রিওয়ায়াত গ্রহন অথবা বর্জন করা হয়েছে সেগুলোও সংকলিত করে রাখা হয়েছে, যাতে পারবর্তী কালেও প্রতিটি ব্যক্তি তা গ্রহণ বা বর্জন সম্পর্কে অনুসন্ধান করে সিদ্ধান্ত গ্রহন করতে সক্ষম হয়”-(তরজমানুল কুরআন, ডিসেম্বর ১৯৫৮ খৃ.পৃ. ১৬৮-১৬৯)
এই উত্তর মনোনিবেশ সহকারে অধ্যয়ন করার পর এবার বলুন, আপনার দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর আপনি পেয়েছেন কি না? হয়ত আপনি প্রতিউত্তরে বলতে পারেনঃআপনি “কুরআনের অনুরূপ একটি পূর্ণাংগ গ্রন্থের” নামই তো উল্লেখ করতে পারেননি, যার মধ্যে“রসূলুল্লাহ (স)-এর সুন্নাত সুবিন্যস্তভাবে সংকলিত আছে। কিন্তু আমি বলব, আমার এই উত্তরের উপর এইরূপ আপত্তি একটি স্থুল বিতর্ক ছাড়া আর কিছুই নয়। আপনি একজন শিক্ষিত বুদ্ধিমান ব্যক্তি। আপনি কি এতটুকু কথাও বুঝতে পারেন না যে, একটি সমাজ ও রাষ্ট্রের গোটা ব্যবস্থাপনা শুধুমাত্র একটি সুবিন্যস্ত আইনের গ্রন্থের উপর ভিত্তি করেই পরিচালিত হয় না। বরং এই আইন গ্রন্থের সাথে সাধারণ প্রথা (Convention),ঐতিহ্য (tradition),নজির বা পূর্বদৃষ্টfন্ত (precedent), বিচার বিভাগীয় সিদ্ধান্ত, ব্যবস্থাপনা আইন, নৈতিক নির্দেশনা ইত্যাদির একটি দীর্ঘ ধারাক্রমও থাকে যা আইন গ্রন্থের ভিত্তিতে কার্যত একটি জীবন ব্যবস্থা পরিচালিত হওয়ার ফল। এই জিনিস একটি জাতির জীবন ব্যবস্থার প্রাণসত্তা যা থেকে বিচ্ছিন্ন করে কেবলমাত্র না আইন গ্রন্থ তার জীবন ব্যবস্থার পূর্ণ চিত্র পেশ করতে পারে, আর না তা সঠিকভাবে অনুধাবন করা যেতে পারে। আর এই জিনিস পৃথিবীর কোথাও কোন একটি গ্রন্থে সুবিন্যস্ত আকারে লিপিবদ্ধ থাকে না, থাকতেও পারে না। আর এই ধরনের একটি গ্রন্থে অভাব থাকার অর্থ এই নয় যে,এই জাতির নিকট উক্ত আইন গ্রন্থ ব্যতীত কোন রীতিনীতি বা আইন-কানূন বর্তমান নাই। আপনি ইংল্যান্ড, আমেরিকা অথবা দুনিয়ার অপর কোন জাতির সামনে একথা বলে দেখুন যে, তোমাদের নিকট তোমাদের রচিত আইন (Condified Law) ব্যতীত যা কিছুই আছে তা সবই অনির্ভরযোগ্য এবং তোমাদের সমস্ত প্রথা-ঐতিহ্য প্রভৃতি হয় একটি গ্রন্থের আকারে লিপিবদ্ধ থাকতে হবে অন্যথায় সেগুলোকে আইনগত দিক থেকে সম্পূর্ন অনির্ভরযোগ্য সাব্যস্ত করতে হবে। অতপর আপনি নিজেই জানতে পারবেন, আপনার এই কথা কতটা গুরুত্ব পাওয়ার অধিকারী হয়।
নবী যুগের প্রচলিত প্রথা, ঐতিহ্য,নজির, সিদ্ধান্তসমূহ, আইন-কানূন ও নির্দেশাবলীর পূর্ণ রেকর্ড একটি গ্রন্থের আকারে সুবিন্যস্ত পাওয়া উচিত ছিল কেউ যদি এরূপ দাবী করে, তাহলে তা মূলত একটি নিরেট অবাস্তব চিন্তা এবং এমন ব্যক্তিই এরূপ দাবী করতে পারে, যে কল্পনার জগতে বাস করে। আপনি প্রাচীন কালের আরবদের অবস্থা বাদ দিয়ে কিছু সময়ের জন্য আজ এই যুগের অবস্থার কথা চিন্তা করুন, যখন ঘটনাবলী ও অবস্থা রেকর্ড করার উপায়-উপকরণসমূহের অস্বাভাবিক রকম উন্নতি হয়েছে। মনে করুন এই যুগে এমন কোন নেতা আছেন যিনি ২৩ বছর পর্যন্ত রাতদিনের ব্যস্ত জীবনে এক মহান বিপ্লব সংগঠিত করেন। হাজার হাজার লোককে শিক্ষা প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নিজের উদ্দীষ্ট বিপ্লবের জন্য প্রস্তুত করেন, তাদের কাজে লাগিয়ে গোটা দেশের চিন্তাগত, নৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক জীবনে বিপ্লব সাধন করেন, নিজের নেতৃত্ব ও পরিচালনার মাধ্যমে একটি নতুন সমাজ এবং একটি নতুন রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন করেন। এই সমাজে তার ব্যক্তিত্ব প্রতিটি মুহূর্তে হেদায়াতের একটি স্থায়ী নমুনা হিসাবে বিরাজ করে। সর্বাবস্থায় লোকেরা তাকে দেখে দেখে শিক্ষা গ্রহণ করে যে, কি করা উচিত আর কি করা উচিৎ নয়। সর্বস্তরের লোক রাতদিন তার সাথে মিলিত হতে থাকে এবং তিনি তাদেরকে আকীদা-বিশ্বাস,চিন্তাধারা, চরিত্র নৈতিকতা, ইবাদত বন্দেগী, লেনদেন,আচার-ব্যবহার মোটকথা জীবনের প্রতিটি দিক ও বিভাগ সম্পর্কে মৌলিক দিকনির্দেশও দিয়ে থাকেন এবং আনুষংগিক ব্যাপারেও। তাছাড়া রাষ্ট্রের পরিচালক, বিচারক, আইন প্রণেতা, পরিকল্পনাকারী এবং সেনানায়কও তিনি হয়ে থাকেন এবং দশ বছর পর্যন্ত এই রাষ্ট্রের বিভাগসমূহকে তিনি নিজের মৌলনীতির উপর স্থাপন করেন এবং তার ভিত্তিতে নিজে তা পরিচালনা করেন। আপনি কি মনে করেন, আজ এই যুগেও এই সমস্ত কাজ কোন একটি দেশে সম্পাদিত হলে তার সমস্ত রেকর্ড “একটি গ্রন্থে” আকারে সংকলিত হতে পারে? সব সময় কি এই নেতার সাথে টেপ রেকর্ডার লাগিয়ে রাখা সম্ভব? প্রতিটি মূহুর্তে কি তার দিনরাতের প্রতিটি গতিবিধি সংরক্ষণের জন্য তার পেছনে ক্যামেরা লাগিয়ে রাখা সম্ভব? যদি তা সম্ভব না হয় তাহলে এই নেতা লাখলাখ লোকের জীবনের উপর, গোটা সমাজের চেহারায় এবং রাষ্ট্রের ব্যবস্থাপনার উপর যে ছাপ রেখে গেছেন তা কি কোন সাক্ষ্যই নয় যার উপর নির্ভর করা যেতে পারে? আপনি কি এই দাবী করবেন যে, এই নেতার ভাষণসমূহ শ্রবণকারী, তাঁর জীবনাচার অবলোকনকারী এবং তার সাথে সম্পর্ক রক্ষাকারী অসংখ্য লোকের প্রদত্ত রিপোর্ট সম্পূর্ণই অনির্ভরযোগ্য, কারণ স্বয়ং ঐ নেতার সামনে তা “একটি গ্রন্থাগারে” লিপিবদ্ধ করা হয়নি এবং তিনি তার সত্যায়ন করেননি? আপনি কি বলবেন যে,তার বিচার বিভাগীয় ফয়সালা, তারা ব্যবস্থাপনা, আইন, তার আইনগত ফরমানসমূহ এবং যুদ্ধ ও সন্ধি সংক্রান্ত যত তথ্য বিভিন্ন উৎসে ও বিভিন্ন আকারে বর্তমান আছে তার কোন মূল্য ও মর্যাদাই নেই, কারণ তা তো একটি “পূর্ণাংগ গ্রন্থরূপে” সংকলিত নেই?
এসব বিষয়ের উপর যদি বিতর্কের উদ্দেশ্যে নয় বরং বক্তব্য অনুধাবনের উদ্দেশ্যে চিন্তাভাবনা করা হয় তবে একজন বুদ্ধিবিবেক সম্পন্ন ব্যক্তি স্বয়ং অনুধাবন করতে পারবে যে, “একটি গ্রন্থের” এই দাবী কতটা অর্থহীন। এই ধরনের কথা একটি বদ্ধ কক্ষে বসে কতিপয় অর্ধ-শিক্ষিত ও প্রতারিত অনুসারীদের সামনে বলাবলি করলে কিছু যায় আসে না, কিন্তু উন্মুক্ত ময়দানে শিক্ষিত মানুষের সামনে তা চ্যালেঞ্জ হিসাবে পেশ করা বড়ই দুঃসাহসের ব্যাপার।
সুন্নাত কি সর্বস্বীকৃত এবং তার যথার্থতা পরীক্ষার উপায় কি?
আপনার তৃতীয় প্রশ্ন ছিলঃ “রসূলুল্লাহ (স)-এর সুন্নাতের সেই গ্রন্থখানির মূলপাঠ কি সব মুসলমানের নিকট কুরআন মজীদের মূল পাঠের মতো সর্বস্বীকৃত এবং সংশয়-সন্দেহ ও সমালোচনার উর্ধে?”
এবং চতুর্থ প্রশ্নঃ “যদি এরূপ কোন গ্রন্থ বর্তমান না থাকে তবে যে ভাবে সহজেই জানা যায় যে, এই বাক্য বা বাক্যাংশটুকু কুরআন মজীদের আয়াত, অনুরূপভাবে এটা কিভাবে জানা যাবে যে, অমুক কথা রসূলুল্লাহ (স)-এর সুন্নাত কি না?
উল্লেখিত প্রশ্নদ্বয়ের উত্তরের জন্য আমি যেসব প্রবন্ধের প্রতি আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলাম, যদি আপনি তা পাঠ করে থাকেন তবে সেখানে আপনি নিম্নোক্ত বক্তব্য অবশ্যই দেখে থাকবেনঃ
“নিসন্দেহে সুন্নাত সম্পর্ক তথ্যানুসন্ধান এবং তা নির্ণয় করতে গিয়ে মতবিরোধ হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও হতে পারে। কিন্তু এই ধরনের মতবিরোধ কুরআন মজীদের অনেক হুকুম-আহকাম ও বক্তব্যের অর্থ নির্ণয় করতে গিয়েও হয়েছে এবং হতে পারে। এ ধরনের মতবিরোধ যদি কুরআন মজীদ পরিত্যাগ করার অনুকূলে প্রমাণ না হতে পারে, তবে কী করে সুন্নাত পরিত্যাগ করার পক্ষে তাকে প্রমাণ হিসাবে গ্রহণ করা যেতে পারে? এই মুলনীতি পূর্বেও স্বীকার করা হত এবং আজও স্বীকার করাছাড়া উপায় নাই যে, যে ব্যক্তিই কোন নির্দেশকে কুরআনের অথবা সুন্নাতের নির্দেশ বলে দাবী করবে তাকে অবশ্যি তার বক্তব্যের অনুকূলে প্রমাণ পেশ করতে হবে। তার বক্তব্য যথার্থ হয়ে থাকলে উম্মাতের বিশেষজ্ঞ আলেমগণের অথবা অন্তত তাদের কোন বৃহৎ অংশের দ্বারা তা সীলমোহর করাতে হবে। আর যে কথা দলীল-প্রমাণের ভিত্তিতেই পৃথিবীর বিভিন্ন অংশের কোটি কোটি মুসলমান কোন একটি ফিকহী মাযহাবে দলবদ্ধ হয়েছে এবং তাদের বৃহৎ বৃহৎ জনপদ কুরআনিক নির্দেশের কোন ব্যাখ্যা এবং প্রতিষ্ঠিত সুন্নাতের কোন সংকলনের উপর নিজেদের সামগ্রিক জীবনের ব্যবস্থা কায়েম করেছে-(তরজমানুল কুরআন, জানুয়ারী ১৯৫৮ খৃ., পৃ.২১৯)।
“মতবিরোধপূর্ণ সুন্নাত যদি স্বয়ং কোন উৎস ও প্রাধিকার (Authority) না হতে পারে, বরং যা কিছু মতবিরোধ হয়েছে তা এই বিষয়ে যে, কোন বিশেষ ব্যাপার যে জিনিসকে সুন্নাত হওয়ার দাবী করা হয়েছে তা বাস্তবিক প্রামাণ্য সুন্নাত কি না, তবে কুরআন মজীদের আয়াতের অর্থ ও উদ্দেশ্য নির্ধারণেও এরূপ মতভেদ হয়েছে। প্রত্যেক জ্ঞানবান ব্যক্তি এই বিতর্ক উত্থাপন করতে পারে যে, কোন বিষয়ের যে হুকুম কুরআন মজীদ থেকে নির্গত করা হচ্ছে-তা মূলত কুরআন থেকে নির্গত হয় কি না? সম্মানিত পত্রলেখক স্বয়ং কুরআন মজীদের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে মতবিরোধের কথা উল্লেখ করেছেন এবং এই ধরনের মতভেদের সুযোগ সত্ত্বে তিনি স্বয়ং কুরআনকে আইনের উৎস ও প্রাধিকার হিসাবে মান্য করেন। প্রশ্ন হচ্ছে-অনুরূপভাবে ভিন্ন ভিন্ন মাসআলার ব্যাপারে সুন্নাতের প্রমাণ ও তথ্য অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে মতভেদের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও স্বয়ং সুন্নাতকে আইনের উৎস ও প্রাধিকার স্বীকার করতে তাঁর এত সংশয় কেন?
একথা পত্রলেখকের মত একজন আইনজ্ঞের নিকট অজ্ঞাত থাকতে পারেনা যে, কুরআন মজীদের কোন নির্দেশের বিভিন্ন সম্ভাব্য ব্যাখ্যার মধ্যে যে ব্যক্তি, সংস্থা অথবা বিচারালয় ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের প্রচলিত বুদ্ধিবৃত্তিক পন্থা প্রয়োগের পর শেষ পর্যন্ত যে ব্যাখ্যাকে বিধানের আসল উদ্দেশ্য নির্ধারণ করে, তার জ্ঞান ও কার্যসীমার মধ্যে ঐটিই আল্লাহর নির্দেশ। যদিও চূড়ান্তভাবে এই দাবি করা যায় না যে, প্রকৃতপক্ষে এটা আল্লাহর নির্দেশ। সম্পূর্ণ এভাবেই সুন্নাতের পর্যালোচনার ইলমী উপায়-উপকরণ প্রয়োগ করে কোন বিষয়ে যে সুন্নাতই কোন ফকীহ অথবা আইন পরিষদ অথবা বিচারালয়ের নিকট প্রমাণিত হবে, তাই তার জন্য রসূলুল্লাহ (স) এর হুকুম,যদিও চূড়ান্তভাবে একথা বলা যায়না যে, প্রকৃতপক্ষে এটাই রসূলুল্লাহ (স) এর নির্দেশ। এই উভয় অবস্থায় বিষয়টি যদিও বিতর্কিত থেকে যায় যে, আমার নিকট আল্লাহ তাআলা অথবা তাঁর রসূল (স)-এর নির্দেশ কি এবং আপনার নিকট কি, কিন্তু তথাপি আপনি এবং আমি যতখন আল্লাহ ও তাঁর রসূল (স) কে চুড়ান্ত কর্তৃপক্ষ (Final Authority) মেনে নিচ্ছি তখন আল্লাহ ও তাঁর রসূল (স)-এর নির্দেশ আমাদের জন্য আইনবিধান কি না এবং সেগুলো অবশ্য পালনীয় কিনা তা আমাদের নিকট বিতর্কিত বিষয় হতে পারে না” -(তরজমানুল কুরআন, ডিসেম্বর ১৯৫৮ খৃ., পৃ.১৬২)।
“সুন্নাতের উল্লেখযোগ্য অংশের ব্যাপারে ফকীহ ও মুহাদ্দিসগণের মধ্যে ঐক্যমত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং একটি অংশে মতভেদ আছে। কতিপয় লোক কোন জিনিসকে সুন্নাত হিসাবে গ্রহণ করেছেন এবং কতেকে তা সুন্নাত হিসাবে গ্রহণ করেননি। কিন্তু এই ধরনের সব মতবিরোধী সম্পর্কে শত শত বছর ধরে বিশেজ্ঞ আলেমগণের মধ্যে আলোচনার ধারা অব্যাহত আছে এবং অতিশয় বিস্তারিতভাবে প্রতিটি দৃষ্টিকোণের সপক্ষে প্রদত্ত যুক্তি-প্রমাণ এবং যে মৌলিক উপাদানের উপর এই যুক্তির ভিত্তি রাখা হয়েছে তা সবই ফিকহ ও হাদীসের গ্রন্থাবলীতে বর্তমান আছে। কোন জিনিসের সুন্নাত হওয়া বা না হওয়া সম্পর্কে নিজস্ব তথ্যানুসন্ধানের ভিত্তিতে কোন সিদ্ধান্তে পৌছে আজ কোন শিক্ষিত লোকের জন্য কষ্টকর নয়। তাই আমার বুঝে আসে না যে, সুন্নতের নামে কারো শংকিত হওয়ার কি যুক্তিসংগত কারণ থাকতে পারে? অবশ্য যারা জ্ঞানবিজ্ঞানের এই শাখা সম্পর্কে অবহিত নয় এবং যারা দূর থেকে হাদীসের মধ্যে মতবিরোধের কথা শুনে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে তাদের কথা স্বতন্ত্র”-(তরজমানুল কুরআন, ডিসেম্বর ১৯৫৮ খৃ.পৃ.১৬৯)।
আমি আপনার উপরোক্ত প্রশ্নদ্বয়ের জবাবে এই আলোচনা অধ্যয়নের পরামর্শ এই আশায় দিয়েছি যেন, একজন শিক্ষিত ও সচেতন ব্যক্তি যিনি বক্তব্য অনুধাবনের আকাংখী, তা অধ্যয়নের মাধ্যমে নিজের প্রশ্নাবলীতে নিহিত মৌলিক ভ্রান্তিসমূহ অনুধাবনে সক্ষম হন এবং তিনি সরাসরি বুঝতে পারেন যে, সুন্নাতের পর্যালোচনায় মতপার্থক্য সুন্নাতকে আইনের ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে না, যেমন কুরআন ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে সৃষ্ট মতভেদ কুরআনকে আইনের উৎস হিসেবে গ্রহণ করতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে না। কিন্তু আপনি না এই ভ্রান্তি অনুভব করেছেন, আর না বক্তব্য হৃদয়ংগম করার চেষ্টা করেছেন, বরং উল্টোদিকে আরও কয়েকটি প্রশ্ন নিক্ষেপ করেছেন। আমি আপনার উত্থাপিত এসব প্রশ্নের উপর তো পরে আপত্তি তুলব, প্রথমে আপনি পরিষ্কার বলুন যে, আপনার মতে যদি শুধুমাত্র মতভেদমুক্ত জিনিসই আইনের উৎস হতে পারে তবে এই আসমানের নীচে পৃথিবীতে এমন কি জিনিস আছে যা মানব জীবনের বিভিন্ন বিষয় ও সমস্যা সম্পর্কে আলোচনা করে এবং তাতে মানবীয় জ্ঞান মতভেদের কোন সুযোগ পায় না? আপনি কুরআন মজীদ সম্পর্কে এর অতিরিক্ত দাবী করতে পারেন না যে, তার মূলপাঠ সর্বস্বীকৃত এবং এর কোন আয়াত বা আয়াতাংশ কুরআনের আয়াত হওয়ার ব্যাপারে কোন মতপার্থক্য নেই। কিন্তু আপনি কি একথা অস্বীকার করতে পারেন যে, কুরআনের আয়াতসমূহের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অনুধাবনের এবং তা থেকে বিবিধ নির্দেশ নির্গত করার ক্ষেত্রে প্রচুর মতবিরোধ হতে পারে এবং হয়েছেও? যদি কোন আইনের আসল উদ্দেশ্য শব্দাবলীর মূলপাঠ বর্ণনা না হয়ে বরং বিধান বর্ণনা হয়ে থাকে তবে এই উদ্দেশ্যের বিচারে শব্দাবলীর (মূল পাঠ) ক্ষেত্রে ঐক্যমতে কি লাভ, যখন বিধান নির্ণয় করতে গিয়ে মতবিরোধ হয়ে যায় এবং সর্বদা হতে পারে? এজন্য হয় আপনাকে আপনার এই দৃষ্টিভংগির পরিবর্তন করতে হবে যে, “আইনের ভিত্তি কেবল এমন জিনিসই হতে পারে যার মধ্যে মতবিরোধের সুযোগ নাই” অথবা কুরআনকে আইনের উৎস হিসাবে গ্রহণে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করতে হবে। মূলত এই শর্ত সহকারে পৃথিবীতে কোন আইনই তো রচিত হতে পারে না। যেসব দেশের মোটেই কোন লিখিত সংবিধান (Written constitution) নাই (যেমন ব্রিটেন) তাদের সার্বিক ব্যবস্থার কি অবস্থা হতে পারে? বরং যাদের নিকট একটি লিখিত সংবিধান আছে তাদের মধ্যেও আইনের মূল পাঠেই কেবল মতৈক্য আছে, কিন্তু তার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের ক্ষেত্রেও যদি মতৈক্য থেকে থাকে তবে অনুগ্রহপূর্বক তা দেখিয়ে দিন।
চারটি মৌলিক সত্য
তাছাড়া আমার উল্লেখিত বক্তব্যে আরও কয়েকটি বিষয় রয়েছে যার প্রতি আপনি দৃষ্টিপাত না করে আসল সমস্যা থেকে সরে দাঁড়ানোর জন্য ভিন্ন প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন। কিন্তু আমি আপনাকে পশ্চাদাপসরণ করতে দেব না, যতক্ষণ না আপনি এসব বিষয় সম্পর্কে কোন পরিষ্কার বক্তব্য পেশ করছেন। হয় আপনি তা সহজভাবে স্বীকার করে নেবেন এবং নিজের অবস্থান পরিবর্তন করবেন, অথবা শুধুমাত্র দাবীর ভিত্তিতে নয়, বরং যুক্তিসংগত দলীল প্রমাণের ভিত্তিতে তা প্রথ্যাখ্যান করুন। সেই বিষয়গুলো হচ্ছেঃ
১. “সুন্নাতের বিরাট ও ব্যাপক অংশের উপর উম্মাতের মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।” ইসলামী জীবন ব্যবস্থার মৌলিক ছাঁচ যেসব সুন্নাতের মাধ্যমে গঠিত হয় তার প্রায় সবগুলোতেই মতৈক্য রয়েছে। তাছাড়া যেসব সুন্নাতের উপর শরীআতের মূলনীতির ভিত্তি স্থাপিত সেসব ক্ষেত্রে যথেষ্ট মতৈক্য বিদ্যমান। যেসব সুন্নাত থেকে আনুষংগিক বিধান নির্গত হয়েছে, অধিকাংশ মতভেদ কেবল সেই সুন্নতগুলোকে কেন্দ্র করেই হয়েছে। তারও সবগুলো মতবিরোধপূর্ণ নয়, বরং তার একটি উল্লেখযোগ্য অংশের উপর উম্মাতের আলেমগণের মতৈক্য লক্ষ্য করা যায়। “মতভেদযুক্ত মাসআলাগুলোই বেশীর মঞ্চে উত্থাপনকরা হয়েছে” এই কথা ‘সুন্নাত সম্পূর্ণতই বিতর্কিত’ এরূপ সিদ্ধান্তে পৌছার জন্য যথেষ্ট নয়। অনুরূপভাবে কতিপয় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উন্মাদ ও অধিকাংশ ক্ষেত্রে অজ্ঞ লোকের দলের কখনও কোথাও আত্মপ্রকাশ করে সর্বস্বীকৃত জিনিসকেও বিরোধপূর্ণ বানানোর অপচেষ্টা সুন্নাতের বিরাট অংশ সর্বস্বীকৃত হওয়ার পথে প্রতিবন্ধক হতে পারে না। এধরনের গ্রুপ শুধুমাত্র সুন্নাতের উপর অত্যাচার করেই ক্ষান্ত হয়নি, বরং তাদের মধ্যে কতেক কুরআন মজীদ তাহরীফ (বিকৃত) হওয়ার দাবী পর্যন্ত করেছে। কিন্তু এ ধরনের মুষ্টিমেয় লোকের অস্তিত্ব মুসলিম উম্মাতের সম্মিলিত মতৈক্য বাতিল করতে পারে না। এ ধরনের দুই চার শত বা দুই চার হাজার লোককে শেষ পর্যন্ত এই অনুমতি কেন দেয়া হবে যে, গোটা দেশের জন্য যে আইন রচিত হচ্ছে তার মধ্য থেকে এমন একটি জিনিসকে বাদ দেয়ার জন্য উঠে দাঁড়াবে যাকে কুরআনের পরে গোটা উম্মাত ইসলামী আইনের দ্বিতীয় ভিত্তি হিসাবে মেনে নিয়েছে এবং সর্বকালে মেনে আসছে?
২. আনুষংগিক বিধানের সাথে সম্পর্কিত যেসব সুন্নাতের ক্ষেত্রে মতবিরোধ আছে তার ধরনও এরূপ নয় যে, তাকে কেন্দ্র করে প্রত্যেক ব্যক্তি অপর ব্যক্তির সাথে দ্বিমত পোষণ করে, বরং “পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে কোটি কোটি মুসলমান কোন একটি ফিকহ-ভিত্তিক মাযহাবের অধীনে সংঘবদ্ধ হয়ে গেছে এবং তাদের বৃহৎ বৃহৎ জনপদ কুরআনী বিধানের কোন একটি ব্যাখ্যার উপর এবং সুপ্রতিষ্ঠিত সুন্নাতের কোন একটি সংকলনের উপর নিজেরদের সামগ্রিক জীবন ব্যবস্থা স্থাপন করেছে।” উদাহরণস্বরূপ আপনি আপনার নিজের দেশ পাকিস্তানের দিকে তাকান যার আইন প্রণয়নের বিষয়টি আলোচনাধীন। আইনগত দিক থেকে এ দেশের গোটা মুসলিম জনবসতি মাত্র তিনটি বৃহৎ সম্প্রদায়ে বিভক্তঃহানাফী, শীআ ও আহলে হাদীস। এদের মধ্যে প্রত্যেক সম্প্রদায়ের লোকেরা কুরআনিক বিধানের একটি ব্যাখ্যা এবং প্রমাণ্য সুন্নাতের একটি সংগ্রহ গ্রহণ করে নিয়েছে। আমরা কি গণতান্ত্রিক মূলনীতির ভিত্তিতে আইনের বিষয়টির এভাবে সমাধান করতে পারি না যে, ব্যক্তিগত আইনের সীমা পর্যন্ত প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য তাদের কুরআনিক ব্যাখ্যা ও প্রামান্য সুন্নাতের সংকলন নির্ভরযোগ্য বিবেচিত হবে, যা তারা অনুসরণ করছে, আর জাতীয় আইন-এর ক্ষেত্রে কুরআনের যে ব্যাখ্যা ও সুন্নাতের যে সংগ্রহের উপর অধিকাংশের ঐক্যমত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তা নির্ভরযোগ্য বিবেচিত হবে?
৩. “এটা কি করে জানা যাবে যে, অমুক কথা রসূলুল্লাহ (স)-এর হাদীস নি না”-এই প্রশ্ন সমাধানের অযোগ্য কোন প্রশ্ন নয়। যেসব সুন্নাত সম্পর্কে মতবিরোধ সৃষ্টি হয়েছে যে, তা প্রামাণ্য কি না-“সেগুলোকে কেন্দ্র করে শত শত বছর ধরে বিশেষজ্ঞ আলেমদের মধ্যে আলোচনা অব্যাহত রয়েছে এবং যথেষ্ট বিস্তারিতভাবে প্রতিটি দৃষ্টিকোণের সপক্ষে প্রদত্ত যুক্তিপ্রমাণ এবং যার উপর এসব যুক্তির ভিত্তি রাখা হয়েছে তা সবই ফিকহ ও হাদীসের গ্রন্থাবলীতে মওজুদ আছে। কোন জিনিসের সুন্নাত হওয়া বা না হওয়া সম্পর্কে তথ্যানুসন্ধানের ভিত্তিতে কোন সিদ্ধান্তে পৌছা আজ আর কোনো জ্ঞানী ব্যক্তির জন্যেই কষ্টকর ব্যাপার নয়।
৪.অতপর আইন-বিধানের উদ্দেশ্যে এই বিষয়ের চূড়ান্ত সমাধান হচ্ছে:“কুরআন মজীদের বিভিন্ন সম্ভাব্য ব্যাখ্যার মধ্যে যে ব্যক্তি,সংস্থা অথবা বিাচারালয় ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের সুপ্রসিদ্ধ ইলমী ও যৌক্তিক পন্থা প্রয়োগপূর্বক অবশেষে যে ব্যাখ্যাকে বিধানের আসল উদ্দেশ্যে নির্ধারণ করে,তার জ্ঞান ও কার্যসীমার মধ্যে ঐটিই আল্লাহর নির্দেশ। যদিও চুড়ান্তভাবে এই দাবী করা যায় না যে, বাস্তবেও এটাই আল্লাহর নির্দেশ। সম্পূর্ণত এভাবেই সুন্নাত পর্যালোচনার বুদ্ধিবৃত্তিক উপায় উপকরণ ব্যবহার করে কোন বিষয়ে যে সুন্নাতই কোন ফকীহ অথবা আইন পরিষদ অথবা বিচারালয়ের নিকট প্রমাণিত হবে তা তার জন্য রসূলুল্লাহ (স)-এর হুকুম,যদিও চূড়ান্তভাবে একথা বলা যায় না যে, এটাই রসূলুল্লাহ (স)-এর নির্দেশ।
এখন আপনি নিজেই ঈমানদারীর সাথে নিজের বিবেকর নিকট জিজ্ঞাসা করুন, আমার উধৃত বাক্যসমূহে আপনার সামনে যেসব বিষয় এসে গেছে তার মধ্যে আপনি আপনার তৃতীয় ও চতুর্থ প্রশ্নের জবাব পেয়েছেন কি না? এর সম্মুখীন হয়ে এ সম্পর্কে সুস্পষ্টভাবে একটি ইতবাচক অথবা নেতিবাচক বক্তব্য পেশ করার পরিবর্তে আপনি আরও প্রশ্নবাণ নিক্ষেপের যে চেষ্টা করেছেন তার যুক্তিসংগত কারণ কি যার উপর আপনার বিবেক আশ্বস্ত হতে পারে?
দ্বিতীয় পত্রের জওয়াব
এরপর আমি আপনার দ্বিতীয় চিঠিটি সামনে রাখছি। এই পত্রে আপনি অভিযোগ করেছেন, আপনার প্রথম চিঠির জওয়াব আমি যেসব প্রবন্ধ নির্দেশ করেছিলাম তার মধ্যে আপনি আপনার প্রশ্নাবলীর সুনির্দিষ্ট উত্তর পাননি, বরং আপনার অস্থিরতা আরও বেড়ে গেছে। কিন্তু এখন আমি আপনার প্রশ্নাবলী সম্পর্কে যে বিস্তারিত আলোচনা পেশ করলাম তা পাঠ করে আপনি নিজেই সিদ্ধান্ত নিন যে, তার মধ্যে আপনি প্রতিটি প্রশ্নের একটি সুনির্দিষ্ট জওয়াব পেয়েছন কি না এবং তাতে আপনার অস্থিরতা বৃদ্ধির আসল কারণ কি উল্লেখিত প্রবন্ধসমূহ না কি আপনার মন-মগজ?
আপনি আরও বলেছেন যে, উল্লেখিত প্রবন্ধে এমন কতগুলো কথা আছে যা আমার অন্যান্য প্রবন্ধের সাথে সাংঘর্ষিক। এর উত্তরে আমি বলতে চাই, অনুগ্রহপূর্বক আমার সেসব প্রবন্ধের বরাত উল্লেখ করুন এবং বলুন যে,তার মধ্যে কোন বিষয়গুলো এই প্রবন্ধের বিপরীত। তবে আমার আশংকা হচ্ছে, আপনি পশ্চাদাপসরণ করার জন্যে আরেকটি প্রশস্ত মাঠ খুঁজেছেন। এজন্য আলোচনার ক্ষেত্রকে আলোচ্য বিষয়ের মধ্যে কেন্দ্রীভূত রাখার খাতিরে এই জওয়াব দেয়ার পরিবর্তে আমি আবেদন করব, আমার অন্য প্রবন্ধের কথা আপাতত বাদ দিন, এখন আমি আপনার সামনে যেসব কথা পেশ করছি সে সম্পর্কে বলুন যে, তা আপনি কবুল করছেন না প্রত্যাখ্যান করছেন। যদি প্রত্যাখ্যান করেন তবে তার অনুকূলে যুক্তিগ্রাহ্য কি দলীল আপনার নিকট আছে?
চার দফার সারসংক্ষেপ
এরপর আপনি আমাকে নিশ্চয়তা প্রদান করেছেন যে, এই পত্রালাপে আপনার উদ্দেশ্যে বিতর্ক নয়, বরং বিষয়টি অনুধাবনই হচ্ছে আসল উদ্দেশ্য। একথা বলার পর আপনি চার দফা আকারে আমার প্রবন্ধাবলীর নির্যাস নির্গত করে আমার সামনে পেশ করছেন এবং আমার নিকট দাবী করছেন, হয় আমি একথা স্বীকার করে নেব যে, আমার ঐসব প্রবন্ধের নির্যাস তাই, অথবা প্রমাণ করব যে, আপনি এসব প্রবন্ধের তাৎপর্য ভুল বুঝেছেন।
যেসব দফা আপনি নির্যাস আকারে আমার প্রবন্ধ থেকে বের করেছেন সে সম্পর্কে এখনই ক্রমিক নম্বর অনুযায়ী আলোচনা করব। কিন্তু এই আলোচনার পূর্বে আমি আপনার নিকট আরয করব, আমার প্রবন্ধসমূহ থেকে আমি যেসবপয়েন্ট উপরে পেশ করেছি তার সামনে আপনার গৃহীত এই পয়েন্টগুলো রেখে আপনি নিজেই দেখুন এবং সিদ্ধান্ত নিন যে, যে মনমগজ ঐ পয়েন্টগুলো পরিবর্তে এই পয়েন্টগুলোর দিকে আকৃষ্ট হয়েছে তা কি বক্তব্য হৃদয়ংগম করার আকাংখী না বিতর্কপ্রিয় রোগী?
প্রথম দফা
আপনার বের করা প্রথম দফা হলো: “আপনি বলেছেন, মহানবী (স) তেইশ বছরের নবূওয়াতী জীবনে কুরআন মজীদের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করতে গিয়ে যা কিছু বলেছেন অথবা কার্যত করেছেন তাকে রসূলুল্লাহ (স)-এর সুন্নাত বলা হয়। এই বক্তব্য থেকে দুটি জিনিস পাওয়া যাচ্ছে:
(ক) রসূলুল্লাহ (স) এই তেইশ বছরের জীবনে ব্যক্তি হিসাবে যেসব কথা বলেছেন অথবা কার্যত করেছেন তা সুন্নাতের অন্তর্ভূক্ত নয়।
(খ) সুন্নাত হচ্ছে কুরআনের বিধান ও মূলনীতির ব্যাখ্যা। তা কুরআনের অতিরিক্ত দীন ইসলামের কোনো মূলনীতি অথবা বিধান প্রণয়ন করে না এবং সুন্নাত কুরআনের কোন নির্দেশও রহিত করতে পারেনা।”
রসূলুল্লাহ (স)-এর কাজের ধরন
আমার বক্তব্য থেকে আপনি যে নির্যাস বের করেছেন তার প্রথম অংশই ভুল। আমার এসব প্রবন্ধের কোন স্থানে একথা লিখিত আছে যে, “মহানবী (স) তেইশ বছরের নবূওয়াতী জীবনে কুরআন মজীদের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করতে গিয়ে যা কিছুবলেছেন অথবা কার্যত করেছেন তাকে রসূলুল্লাহ (স)-এর সুন্নাত বলা হয়?” বরং এর বিপরীতে আমি তো বলেছি যে, মহানবী (স)-এর নবূওয়াতী জীবনের সমস্ত কাজ যা তিনি তেইশ বছরে আঞ্জাম দিয়েছেন, কুরআন মজীদের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের ব্যাখ্যা দিয়েছেন এবং এই সুন্নাত কুরআনের সাথে মিলিত হয়ে সর্বোচ্চ সত্তার (অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা) মহান বিধানের গঠন ও পূর্ণতা প্রদান করে এবং এই সমগ্র কাজ মহানবী (স) যেহেতু নবী হিসাবে করেছেন, তাই তিনি এসব কাজে কুরআন মজীদের মতই আল্লাহ তাআলার ইচ্ছা ও মর্জির প্রতিনিধিত্ব করেছেন।
আপনি যদি অন্যের বক্তব্যের মধ্যে আপনার নিজের ধারণা পড়তে অভ্যস্থ না হয়ে থাকেন তবে আপনার প্রথম প্রশ্নের জবাবে আমি যা কিছু বলেছি তা অধ্যয়নপূর্বক দেখে নিন আমি কি বলেছিলাম এবং তাকে কি বানিয়ে দিয়েছেন।
অনন্তর আপনি তা থেকে যে দুটি সিদ্ধান্তে পৌছেছেন তার উভয়টি এই কথার সাক্ষ্য দেয় যে, আপনি আমার উক্ত বক্তব্যের মধ্যে প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধানের পরিবর্তে একটি নতুন বিতর্কের পথ খুজেছেন। কেননা আপনার প্রথম প্রশ্ন ঐ বক্তব্যের সাথে সম্পর্কযুক্ত ছিল না, আর আমিও আপনাকে আমার পূর্বোক্ত প্রবন্ধের বরাত এজন্য দেইনি যে, আপনি এই সমষ্যার সমাধান তার মধ্যে অনুসন্ধান করবেন। তথাপি আমি আপনাকে একথা বলার সুযোগ দিতে চাই না যে, আমি আপনার নিক্ষিাপ্ত প্র্শ্নাবলীর জবাব দিতে পশ্চাৎপদ হয়েছি। তাই আমি এই দুটি সিদ্ধান্ত সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা পেশ করছি।
মহানবী (স)-এর ব্যক্তিসত্তা ও নবূওয়াতী সত্তার মধ্যে পার্থক্য
(ক) ইসলামী শরীআতে একথা সম্পূর্ণ স্বীকৃত যে, মহানবী (স) রসূল হিসাবে যেসব কথা বলেছেন এবং যেসব কাজ করেছেন তা সবই সুন্নাত এবং তার অনুসরণ উম্মাতের জন্য বাধ্যতামূলক। আর তিনি ব্যক্তি হিসাবে যেসব কথা বলেছেন অথবা কার্যত যেসব কাজ করেছেন তা অবশ্যি সম্মানার্হ্য, কিন্তু তার অনুসরণ বাধ্যতামূলক নয়। শাহ ওয়ালিউল্লাহ সাহেব (রহ) তাঁর সুপ্রসিদ্ধ গ্রন্থ “হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা”-য় “বাব বায়ানি আকসামি উলূমিন-নাবিয়্য (স)” শীর্ষক অনুচ্ছেদে এ সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত অথচ পূণাংঙ্গ ও অর্থবহ আলোচনা করেছেন। ইমাম মুসলিম (রহ) তাঁর “সহীহ” গ্রন্থে একটি পূর্ণ অনুচ্ছেদই এই মূলনীতির আলোচনায় ব্যয় করেছেন এবং তার শিরোনাম দিয়েছে: “বাব ওয়াজিবি ইমতিসালে মা কালাহু শারআন দূনা মা যাকারাহু (স) মিন মাআইশিদ-দুনয়া আলা সাবীলির-রায়” [অনুচ্ছেদ: মহানবী (স) শরীআতের বিধান হিসাবে যা বলেছেন তার অনুসরণ বাধ্যতামূলক,পার্থিব ব্যাপারে তিনি ব্যক্তিগত অভিমত হিসাবে যা বলেছেন তার অনুসরণ বাধ্যতামূলক নয়]। এখন প্রশ্ন হচ্ছে,মহনবী (স)-এর ব্যক্তি সত্তা ও নববী সত্তার মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করে শেষ পর্যন্ত কে এই সিদ্ধান্ত নিবে যে, তাঁর বক্তব্য ও কার্যবলীর মধ্যে কোন সুন্নাতের অনুসরণ অপরিহার্য এবং কোনগুলি শুধুমাত্র ব্যক্তিগত পর্যায়ের? প্রকাশ থাকে যে, আমরা স্বয়ং এই পার্থক্য ও সীমা নির্দেশ করার অধিকারী নই। এই পার্থক্য দুটি পন্থায়ই হতে পারে। হয় মহানবী (স) স্বয়ং তাঁর কোন কথা বা কাজ সম্পর্কে পরিষ্কার বলে দিয়ে থাকবেন যে, তা ব্যক্তিগত পর্যায়ের। অথবা মহানবী (স) এর প্রদত্ত শিক্ষা থেকে শরীআতের যে মূলনীতি নির্গত হয় তার আলোকে প্রজ্ঞাবান, সৎর্ক ও দূরদৃষ্টিসম্পন্নই আলেমগণ ব্যাপক বিশ্লেষণ করে দেখবেন যে, তাঁর বক্তব্য ও কার্যবলীর মধ্যে কোন ধরনের কথা ও কাজগুলো তাঁর নবূওয়াতী সত্তার সাতে সম্পর্কযুক্ত আর কোন ধরনের কথা ও কার্যাবলীকে ব্যক্তিগত পর্যায়ে ফেলা যায়। এ বিষয়ে আমি আমার একটি প্রবন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করেছি যার শিরোনাম হচ্ছে-“রসূলুল্লাহ (স)-এর ব্যক্তিসত্তা ও নবূওয়াতী সত্তা”-(তরজমানুল কুরআন, ডিসেম্বর ১৯৫৯ খৃ.)।
কুরআনের অতিরিক্ত হওয়া এবং কুরআনের বিরোধী হওয়া সমার্থবোধক নয়
(খ) এটা আপনার সম্পূর্ণ ভুল সিদ্ধান্ত যে, সুন্নাত কুরআনিক বিধান ও মূলনীতির ভাষ্যকার এই অর্থে যে, “তা কুরআনের অতিরিক্ত দীন ইসলামের কোনো মূলনীতি অথবা বিধান প্রণয়ন করে না।” আপনি যদি এর পরিবর্তে “কুরআনের পরিপন্থী” শব্দটি ব্যবহার করতেন তবে আমি শুধু ঐক্যমতই পোষণ করতান না, বরং উম্মাতের সকল ফকীহ ও মহাদ্দিসগণও এর সাথে একমত হতেন। কিন্তু আপনি “কুরআনের অতিরিক্ত” শব্দ ব্যবহার করেছেন যার অর্থ কুরআনের অতিরিক্তই হতে পারে। আর একথা পরিষ্কার যে, “অতিরিক্ত” হওয়া এবং “পরিপন্থী বা বিপারীত” হওয়ার মধ্যে আসমান-জমীন পার্থক্য রয়েছে।[প্রকাশ থাকে যে, কোন হাদেীসকে এমন অবস্থায় কুরআনের পরিপন্থী সাব্যস্ত করা যেতে পারে যখন কুরআন এক কাজ করার নির্দেশ দেয়, আর হাদীস তা করতে নিষেধ করে। অথবা কুরআন একটি জিনিস থেকে বিরত থাকতে বলে কিন্তু হাদীস তা করার নির্দেশ দেয়। কিন্তু হাদীস যদি কুরআনের কোন সংক্ষিপ্ত নির্দেশের ব্যাখ্যা দান করে অথবা তা কার্যকর করার নিয়ম বলে দেয় এবং তার উদ্দেশ্য পরিষ্কার করে দেয়, তবে তা কুরআনের “পরিপন্থী” নয়, বরং কুরআনের “অতিরিক্ত”।]সুন্নাত যদি কুরআন অীতরিক্ত কোন জিনিস না বলে তাহলে আপনি নিজেই চিন্তা করুন, এর প্রয়োজন কি? এর প্রয়োজন তো এজন্য যে, তা কুরআনের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য প্রতিভাত করে দেবে যা কুরআনে পরিষ্কারভাবে উল্লেখিত হয়নি। যেমন কুরআন মজীদ “নামায কায়েমের”নির্দেশ দিয়েই থেমে যায়। একথা কুরআন বলে না বরং সুন্নাতই বলে দেয় যে,নামাযের অর্থ কি এবং তা কায়েমের অর্থই বা কি। এ উদ্দেশ্য সুন্নাতই মসজিদে নির্মাণ,পাঁচ ওয়াক্ত আযান ও জামাআতের সাথে নামায আদায়ের পন্থা, নামাযের ওয়াক্তসমূহ,নামাযের ধরন, তার রাকআত সংখ্যা,জুমুআ ও দই ঈদের বিশেষ নামায এবং তার বাস্তব রূপ এবং আরও বিভিন্ন দিক বিস্তারিতভাবে আমাদের বলে দেয়। এসব কিছুই কুরআনের অতিরিক্ত, কিন্তু তার পরিপন্থী নয়।
অনুরূপভাবে জীবনের প্রতিটি দিক ও বিভাগে সুন্নাত কুরআনের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য অনুযায়ী মানবীয় চরিত্র ও নীতি-নৈতিকতা, ইসলঅমী সভ্যতা-সংস্কৃতি এবং রাষ্টীয় যে কাঠামো গঠন করেছে তা কুরআন থেকে এতটা অতিরিক্ত যে, কুরআনিক বিধানের আওতা থেকে সুন্নাতের পথনির্দেশনায় আওতা অনেকটা প্রশস্ত হয়ে গেছে। কিন্তু তার মধ্যে কুরআনের পরিপন্থী কিছু নেই, এবং যে জিনিসই বাস্তবিকপক্ষে কুরআনের পরিপন্থী হবে তাকে উম্মাতের ফকীহ ও মুহাদ্দিসগণের কেউ রসূলুল্লাহ (স)-এর সুন্নাত বলে স্বীকার করেন না।
সুন্নাত কি কুরআন মজীদের কোন হুকুম রহিত (মানসূখ) করতে পারে?
এ প্রসংগে আপনি আরও একটি সিদ্ধন্তে উপনীত হয়েছেন যে,“সুন্নাত কুরআন মজিদের কোন হুকুম রহিত করতে পারে না।” একথা আপনি একটা ভুলের শিকার হয়ে লিখেছেন যা পরিষ্কার করা প্রয়োজন। হানাফী মাযহাবের ফিকহবিধগণ যে জিনিসকে “সুন্নাতের সাহায্য কিতাবের হুকুম রহিতকরণ” পরিভাষার মাধ্যমে ব্যাখ্যা করেন তার অর্থ মূলত কুরআন মজীদের কোন সাধারণ হুকুমকে সীমাবদ্ধ করা এবং তার এমন উদ্দেশ্য বর্ণনা করা যা তার ভাষা থেকে প্রকাশ পায় না। যেমন, সূরা বাকারায় পিতামাতা ও নিকটত্মীয়ের জন্য ওসীয়াত করার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল (আয়াত নম্বর ১৮০)। তাছাড়া সূরা নিসায় উত্তরাধিকার (সম্পত্তি) বন্টনের হুকুম নাযিল হল এবং বলা হল যে, এই অংশ মৃত ব্যক্তির ওসীয়াত পূর্ণ করার পর বন্টন করা হবে (আয়াত নম্বর ১১-১২৩)। এর ব্যাখ্যায় মহানবী (স), বলেন (ওয়ারিশদের জন্য ওসীয়াত করা যাবে না)। অর্থাৎ এখন ওসীয়াতের মাধ্যমে কোন ওয়ারিশের অংশে হ্রাসবৃদ্ধি করা যাবে না। কারণ কুরআন মজীদে স্বয়ং আল্লাহ তাআলা ওয়ারিসদের অংশ নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। এসব অংশের মাধ্যে যদি কোন ব্যক্তি অসীয়াতের মাধ্যমে হ্রাসবৃদ্ধি করে তবে সে কুরআনের বিরোধিতা করল।
সুন্নাত এভাবে ওসীয়াতের সাধারণ অনুমতিকে, যা করআনের আয়াত থেকে সুস্পষ্টভাবে বুঝা যায়, এমন হকদারের জন্য নির্দিষ্ট করে দিয়েছে যারা ওয়ারিশ হতে পারে না। একথাও বলে দেয়া হয়েছে যে, আইনগতভাবে ওয়ারিশদের জন্য যে অংশ নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে তার মধ্যে হ্রাসবৃদ্ধি ঘটানোর উদ্দেশ্যে ওসীয়াতের এই সাধারণ অনুমতির সুযোগ গ্রহণ করা যাবে না।
অনুরূপভাবে কুরআন মজীদের উযু সম্পর্কিত আয়াতে (সূরা মাইদা:৬) পা ধৌত করার হুকুম দেয়া হয়েছে এবং সেখানে কোন অবস্থাকে ব্যতিক্রম করা হয়নি। মহানবী (স) মোজার উপর মাসেহ করে এবং অন্যদের তদ্রুপ করার অনুমতি প্রদান করে ব্যাখ্যা দান করেন যে, এই হুকুম মোজা বিহীন পায়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। মোজা পরিহিত অবস্থায় পা ধৌত করার পরিবর্তে মাসেহ করলেই এই উদ্দেশ্য পূর্ণ হয়ে যায়। এই জিনিসকে চাই ‘রহিতকরণ’ বলা হোক, অথবা ‘ব্যতিক্রমকরণ’ বলা হোক, কিংবা বলা হোক ‘ব্যাখ্যাকরণ’-এর অর্থ তাই এবং এটা সস্থানে সম্পূর্ণ সঠিক ও যুক্তিগ্রাহ্য জিনিস। এর উপর আপত্তি তোলার শেষ পর্যন্ত কি অধিকার সেইসব লোকের রয়েছে যারা নবী না হওয়া সত্বেও কুরআন মজীদের কোন কোন সুস্পষ্ট নির্দেশকে শুধুমাত্র নিজেদের ব্যক্তিগত দৃষ্টিভংগির ভিত্তিতে “মধ্যবর্তী কালের বিধান” সাব্যস্ত করেন-যার পরিষ্কার অর্থ এই দাঁড়ায় যে, ‘এই মধ্যবর্তী কাল’ যখন তাদের অশুভ মতানুযায়ী অতিক্রান্ত হয়ে যাবে কখন কুরআন মজীদের ঐসব বিধানও রহিত হয়ে যাবে।[জনাব পারভেয সাহেব কুরআন মজীদের উত্তরাধিার সংক্রান্ত বিধানসহ সাব্যস্ত মালিকানার বৈধতা প্রমাণকারী সমস্ত বিধানকে মধ্যবর্তী কালের বিধান সাব্যস্ত করেন। তার মতে কুরআনে হাকীমের এ সমস্ত বিধান তখনই রহিত হয়ে যাবে যখন পারভেয সাহেবের সকপোলকল্পিত “নিযামে রবূবিয়াত” (খোদায়ী ব্যবস্থা) কায়েম হয়ে যাবে।]
দ্বিতীয় দফা
দ্বিতীয় যে বিষয়টি আপনি আমার প্রবন্ধ থেকে নির্গত করেছেন তা হলো: আপনি বলেছেন যে, “এমন কোন কিতাব নেই যার মধ্যে মহানবী (স)-এর সুন্নাত সম্পূর্ন ও পূর্ণাংগভাবে সংকলিত আছে এবং যার মূল পাঠ সম্পর্কে কুরআনের মূল পাঠের মত সমস্ত মুসলমান একমত।”
আমার প্রবন্ধ থেকে আপনি এই যে নির্যাস বের করেছেন এ সম্পর্কে আমি কেবল এতটুকুই আরয করব যে, নিজের কল্পনায় ডুবে থাকা ব্যক্তিরা এবং যুক্তিসংগত কথা হৃদয়ংগম করতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপনকারী ব্যক্তিরা অন্যদের বক্তব্য থেকে এ ধরনের নির্যাস বের করতে অভ্যস্ত। এই কিছুক্ষণ পূর্বে আপনার এক নম্বর চিঠির উপর আলোচনাকালে দুই নম্বর প্রশ্নের উত্তরে যা কিছু লিখেছি তা পুনরায় পড়ে নিন। আপনি নিজেই জানতে পারবেন যে, আমি কি বলেছি আর আপনি তার কি নির্যাস বের করেছেন?
তৃতীয় দফা
আপনার গৃহীত তৃতীয় দফায় “আপনি বলেছেন, হাদীসের বর্তমান ভান্ডার থেকে সহীহ হাদীস পৃথক করা যেতে পারে। এজন্য রিওয়ায়াতের পরীক্ষা নিরীক্ষার যে নীতিমালা পূর্ব থেকে নির্দিষ্ট আছে তা শেষ কথা নয়। রিওয়ায়াতের মূলনীতি ছাড়া দিরায়াতের সাহায্যও নেয়া যেতে পারে। যেসব লোকের মধ্যে ইসলামী জ্ঞান চর্চার মাধ্যমে গভীর প্রজ্ঞাপূর্ণ দৃষ্টির সৃষ্টি হয়েছে, তাদের দিরায়াতই নির্ভরযোগ্য বিবেচিত হবে।”
হাদীসসমূহ পরীক্ষা-নিরীক্ষার ক্ষেত্রে রিওয়ায়াত ও দিরায়ারেত প্রয়োগ
আপনি যে বাক্যগুলোর এই আশ্চর্যজনক ও চরমভাবে বিকৃত নির্গত করেছেন-আমি সেই বাক্যগুলো এখানে হুবহু তুলে দিচ্ছি, যাতে আমার বক্তব্যের অবিকল চিত্র সামনে আসতে পারে এবং মনগড়া নির্যাসের প্রয়োজন না থাকে।
“হাদীস শাস্ত্র এই সমালোচনারই (অর্থাৎ ঐতিহাসিক সমালোচনার) অপর নাম। ১ম হিজরী শতক থেকে আজ পর্যন্ত এই শাস্ত্রের এই সমালোচনার ধারা অব্যাহত রয়েছে এবং কোনো ফকীহ অথবা মুহাদ্দিস এই কথার প্রবক্তা ছিলেন না যে, ইবাদত সংক্রান্ত হোক অথবা আচার-ব্যবহার ও লেনদেন সংক্রান্তই হোক-যে কোন বিষয় সম্পর্কিত রসূলুল্লাহ (স)-এর সাথে সংযুক্তকারী কোন হাদীস ঐতিহাসিক সমালোচনা ব্যতিরেকেই প্রমাণ হিসাবে স্বীকার করে নেয়া হবে। এই শাস্ত্র বাস্তবিকপক্ষে উপরোক্ত সমালোচনার সর্বোত্তম দৃষ্টান্ত এবং আধুনিক যুগের উত্তম থেকে সর্বোত্তম ঐতিহাসিক সমালোচনাকেও অতি কষ্টে উপরোক্ত সমালোচনার যোগফল অথবা বিকশিত রূপ (Improvement) বলা যেতে পারে। বরং আমি বলতে পারি যে, হাদীসবেত্তাগণের সমালোচনার নীতিমালার মধ্যে এমন মাধুর্য ও সূক্ষ্মতা রয়েছে-যে পর্যন্ত বর্তমান কালের ইতিহাস সমালোচকগণের বুদ্ধিমত্তা এখনো পৌছতে সক্ষম হয়নি। এর চেয়েও সামনে অগ্রসর হয়ে আমি প্রতিবাদের আশংকা ছাড়াই বলব যে, পৃথিবীতে কেবলমাত্র মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের সুন্নাত ও জীবনাচার এবং তার যুগের ইতহাসের রেকর্ডই এমন যা মুহাদ্দিসগণের গৃহীত এই কড়া সমালোচনার মানদন্ডের পরীক্ষা সহ্য করতে পারত। অন্যথায় আজ পর্যন্ত পৃথিবীর কোন মানুষ এবং কোন যুগের ইতহাসও সমালোচনার এরুপ কঠোর মানদন্ডের সামনে নিরাপদে টিকে থাকতে পারেনি এবং তা নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক রেকর্ড হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করতে পারেনি। তথাপি আমি একথা বলব যে, আরও অধিক সংশোধন ও উন্নতির পথ রুদ্ধ নয়। কোন ব্যক্তি এই দাবী করতে পারে না যে, রিওয়ায়াত যাচাই করার যেসব মূলনীতি মুহাদ্দিসগণ গ্রহণ করেছেন তাই চুড়ান্ত। আজ যদি কোন ব্যক্তি নিজের মধ্যে এসব মূলনীতি সম্পকের্ গভীর জ্ঞান ও প্রজ্ঞা অর্জন করার পর তার মধ্যে কোন স্থবিরতা ও ক্রটি নির্দেশ করেন এবং অধিক সন্তোষজনক সমালোচনার জন্য কিছু মূলনীতি যুক্তিসংগত দলীল-প্রমাণসহ পেশ করেন তবে অবশ্যি তাকে স্বাগত জানানো হবে। শেষ পর্যন্ত আমাদের মধ্যে কে না চাইবে যে,কোন জিনিসকে রসূলুল্লাহ (স) এার সুন্নাত সাব্যস্ত করার পূর্বে তা প্রমাণিত সুন্নাত হওয়ার ব্যাপারে নিশ্চয়তা লাভ করতে হবে এবং কোন কাঁচাপাকা কথা যেন মহানবী (স)-এর সাথে সম্পর্কিত হতে না পারে।
হাদীসসমূহের যাচই-বাছাই করার ক্ষেত্রে রিওয়ায়াতের সাথে দিরায়াতের ব্যবহারও একটি সর্বসমর্থিত জিনিস যার উল্লেখ সম্মানিত পত্রলেখক করেছেন ……. অবশ্য এই প্রসংগে যে কথাটি সামনে রাখা উচিত এবং আমি আশা করি যে, মুহতারাম পত্রলেখকও ভিন্নমত পোষণ করবেন না, তা এই যে, কেবলমাত্র এমন লোকদের দিরায়াত গ্রহণযোগ্য হবে যারা কুরআন, হাদীস ও ইসলামী ফিকহের অধ্যয়ন ও চর্চায় নিজেদের জীবনের উল্লেখযোগ্য অংশ কাটিয়ে দিয়েছেন, যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কালের অধ্যবসায় ও অনুশীলনে এক বিশেষ পর্যায়ের অভিজ্ঞাতা ও প্রজ্ঞার সৃষ্টি হয়েছে এবং যাদের জ্ঞানবুদ্ধি ইসলামী চিন্তা ও কর্ম ব্যবস্থার চৌহদ্দির বাইরের মতবাদ,মূলনীতি ও মূলবোধ গ্রহণ করে ইসলামী ঐতিহ্যকে ঐগুলোর মানদন্ডে পরখ করার ঝোঁক প্রবণতা নেই। নিসন্দেহে আমরা না বুদ্ধিজ্ঞানের ব্যবহারের উপর কোন বাধ্যবাধকতা আরোপ করতে পারি, আর না কারো জিভ টেনে ধরতে পারি। কিন্তু যাই হোক এটা নিশ্চিত ব্যাপার যে, ইসলামী জ্ঞান সম্পর্কে অজ্ঞ লোকেরা আনাড়ির মত কোন হাদীসকে মনোপূত পেয়ে গ্রহণ এবং কোন হাদীসকে নিজের মর্জি-বিরদ্ধ পেয়ে প্রত্যাখ্যান করতে থাকে অথবা ইসলামী-বিরোধী কোন চিন্তা ও কর্মব্যবস্থার মধ্যে প্রতিপালিত ব্যক্তিরা হঠাত উত্থিত হয়ে বিজাতীয় মানদন্ডের আলোকে হাদীসসমূহের গ্রহণ-বর্জনের পসরা বসায় তবে মুসলিম উম্মাহর নিকট তাদের দিরায়াত না গ্রনণযোগ্য হতে পারে আর না এই জাতির সামগ্রিক বিবেক ঐ ধরনের অর্থহীন বুদ্ধিবৃত্তিক সিদ্ধান্তের উপর কখনও আশ্বস্ত হতে পারে। ইসলামরে সীমার মধ্যে তো কেবল ইসলামের আলোকে লালিত ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জ্ঞানবুদ্ধিই এবং ইসলামের মেজাজের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ জ্ঞানই সঠিক কাজ করতে পারে। বিজাতীয় রং ও মেজাজে রঞ্জিত জ্ঞানবুদ্ধি অথবা প্রশিক্ষণহীন জ্ঞান বিশৃংখলা সৃষ্টি ব্যতীত কোন গঠনমূলক কাজ ইসলামের পরিসীমার মধ্যে করতে পারে না” (তরজমানুল কুরআন,ডিসেম্বর ১৯৫৮ খৃ. পৃ.১৬৪-১৬৬)।
উপরোক্ত বক্তব্যের সাথে আপনি নিজেই আপনার গৃহীত নির্যাসের তুলনা করে দেখুন। আপনার সামনে উত্তমরূপে প্রতিভাত হয়ে যাবে যে, বক্তব্য হৃদয়ংগম করার আকাংখার কতটা উত্তম নমুনা আপনি পেশ করেছেন।
চতুর্থ দফা
আপনি আমার প্রবন্ধ থেকে চতুর্থ যে দফাটি নির্গত করেছেন তা হলোঃ “হাদীসসমূহের এভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরও এটো বলা যায় না যে, তা আল্লাহর কালামের মত সুনিশ্চিতভাবে রসূলুল্লাহ (স) এর বণী।”
এও আরেকটি অতুলনীয় নমুনা যা বিতর্কপ্রিয়তার পরিবর্তে বক্তব্য অনুধাবনের আকাংখা হিসাবে আপনি পেশ করেছেন। যে বাক্য সমূহ থেকে আপনি উপরোক্ত সারসংক্ষেপ নির্গত করেছেন তা হুবহু এখানে তুলে দেয়া হল: “কুরআন মজীদের কোন নির্দেশের একাধিক সম্ভাব্য ব্যাখ্যার মধ্যে যে ব্যক্তি, অথবা সংস্থা অথবা বিচারালয় ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের প্রসিদ্ধ ইলমী পন্থা প্রয়োগরে পর অবশেষে যে ব্যাখ্যাকে বিধানের আসল উদ্দেশ্য নির্ধারণ করে, তার জ্ঞান ও কার্যসীমার মধ্যে ঐটিই আল্লাহর নির্দেশ। সম্পূর্ণ এভাবেই সুন্নাতের পর্যালোচনার ইলমী উপায়-উপকরণ ব্যবহার করে কোন বিষয়ে যে সুন্নাতই কোন ফকীহ অথবা আইন পরিষদ অথবা বিচারালয়ের নিকট প্রমাণিত মনে হবে তা তার জন্য রসূলুল্লাহ (স)-এর নির্দেশ।”
উপরোক্ত বক্তব্য যদিও আমি ইতিপূর্বে উল্লেখ করেছিলাম কিন্তু পুনরাবৃত্তি দূষনীয় হওয়া সত্ত্বেও আমি তা পুনরায় উল্লেখ করলাম যাতে আপনি নিজও আপনার নির্যাস নির্গত করার নৈপুণ্যের প্রতিষেধক দিতে পারেন। আর এই নৈতিক দু:সাহসের প্রতিষেধক আমি নিজের পক্ষ থেকে আপনাকে দিতেছি যে, আমার বক্তব্যকে ছিন্নভিন্ন করে আমার সামনে পেশ করে আপনি বাস্তবিকই বাহাদুরি প্রদর্শন করেছেন। ব্যক্তিগতভাবে আমি আপনার যথার্থ মূল্য দিচ্ছি এবং সেই কথারও যা আপনার মত একজন বিবেকবান মানুষের কাছে আশা করা যায় না, কিন্তু হয়ত “বাযমে তুলূয়ে ইসলাম” পত্রিকাই আপনাকে এই পর্যায়ে পৌছে দিয়েছে।
পত্রিকায় প্রকাশের দাবী
সবশেষে আমি আরজ করতে চাই যে, আপনার প্রথম টিঠি আপনি নিম্নোক্ত বাক্যে সমাপ্ত করেছেন:
“আইন প্রসংগে যেহেতু সর্বসাধারণের মনে এক ধরনের অস্থিরতা লক্ষ্য করা যায়, তাই তাদের অবগতির জন্য যদি আপনার প্রদত্ত জওয়াব পত্রস্থ করা হয় তবে আমি আশা করি যে, এ ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি থাকবে না।”
আমি এ সম্পর্কে বলতে চাই আপত্তি থাকা তো দূরের কথা আমার আন্তরিক বাসনা এই যে, আপনি এই পত্রালাপ হুবহু পত্রিকায় ছাপিয়ে দিন। আমি নিজেও তা তরজমানুল কুরআন পত্রিকায় ছাপিয়ে দিচ্ছি। আপনিও তা “তুলূয়ে ইসলাম” প্রত্রিকায় নিকটবর্তী কোন সংখ্যায় ছাপানোর ব্যবস্থা করুন, যাতে উভয় পক্ষের জনসাধারণ এ সম্পর্কে অবহিত হয়ে পেরেশানি থেকে মুক্তি পেতে পারে।
তরজমানুল কুরআনবিনীত
জুলাই ১৯৬০ খৃ.আবূল আ‘লা