পশ্চিম পাকিস্তান হাইকোর্টের একটি গুরুত্বপূর্ণ রায়
[পশ্চিম পাকিস্তান হাইকোর্টের বিচারপতি জনাব মুহাম্মদ শফীর যে রায়টির অধিকাংশের অনুবাদ-[মূল রায়টি ছিলো ইংরেজী ভাষায়। জনাব মালিক গোলাম আলী তার ঊর্দূ অনুবাদ করেন। রায়ের ইংরেজী কপি সহজলভ্য না হওয়ায় এখানে তার ঊর্দূ অনুবাদের বাংলা অনুবাদ করা হয়েছে] নিম্নে প্রদত্ত হচ্ছে তা মূলত একটি আপিল মামলার রায়। এর মূল বক্তব্য বিষয় ছিলঃ কোনো বিধবা নারী তার নাবালক সন্তানদের বর্তমানে যদি এমন কোন ব্যক্তির সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়, যে তার সন্তানদের মুহরিম নয় তবে এই অবস্থায় উক্ত মহিলার জন্য সেই সন্তানদের অভিভাবকত্বের দায়িত্ব অবশিষ্ট থাকে কি না? এই বিতর্কিত বিষয়ে রায় প্রদান করতে গিয়ে বিজ্ঞ বিচারপতি বিস্তারিতভাবে একটি মৌলিক বিষয়ের উপরও নিজের মত ব্যক্ত করেন। তা এই যে, ইসলামে আইনের ধারণা ও রূপরেখা এবং আইন প্রণয়নের পদ্ধতি কি, কুরআনের সাথে হাদীসকেও মুসলমানদের জন্য আইনের উৎস হিসাবে মেনে নেয়া যায় কি না এবং বিশেষত পাকিস্তানের মুসলমানদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশকে হানাফী ফিকহ-এর নীতিমালার কতটা অনুসারী মনে করা যেতে পারে? এই প্রসংগে মোকদ্দমার এ রায় ইসলামী আইনের মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ দিকসমূহ নিজের যুক্তি ও আলোচনার আওতায় নিয়ে এসেছে।
এই রায়ের যে অংশ আসল মোকদ্দমার সাথে সংশ্লিষ্ট তা বাদ দিয়ে শুধুমাত্র এর মূলনীতিগত যুক্তিসমূহের অনুবাদ এখানে প্রদান করা হচ্ছে। এর কোনো কোনো স্থানে কুরআনের যেসব আয়াত উধৃত করা হয়েছে তা অনুবাদসহ শুধুমাত্র সূরা ও আয়াত নম্বর উল্লেখ করা হয়েছে। পি, এল, ডি, ১৯৬০ খৃ. লাহোর (পৃ. ১১৪২-১১৭৯) কর্তৃক মুদ্রিত ইংরেজী পাঠের এখানে উর্দূ অনুবাদ করা হয়। মূল ও পূর্ণাংগ আলোচনা পূর্বোক্ত মুদ্রিত গ্রন্থে দেখা যেতে পারে।–মালিক গোলাম আলী।]
৪. মনে করুন যদি একথা স্বীকার করে নেয়া হয় যে, অভিভাবক নিয়োগ অত্যাবশ্যক ছিল এবং Guardianship and Words Act-এর ১৭ ধারা এই মোকদ্দমার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হত, তবে যে বিরাট সিদ্ধান্তের প্রশ্ন আমাদের সামনে আসে তা এই যে, সেই আইন-বিধান কি যা এক নাবালক মানতে বাধ্য? একথা সম্পূর্ণ সঠিক যে, নাবালকগণ এবং তাদের পিতামাতা মুসলমান এবং মুসলিম আইনের অধীন। কিন্তু এই প্রশ্নের উত্তর সহজ নয় যে, নাবালকের অভিভাবকত্বের বিষয়ে সে আইন কোনটি যার অনুসরণ অপরিহার্য? প্রায় সমস্ত গ্রন্থাবলী অন্তর্ভুক্ত আছে, এমন আইন-কানুন ও নীতিমালা বর্ণিত আছে, নাবালকদের সত্তা এবং সহায়-সম্পদের অভিভাবকত্বের বিষয়ে, দীর্ঘকাল ধরে ভারত ও পাকিস্তানে অনুসৃত হয়ে আসছে। ভারতের সুপ্রিম কোর্টসহ সমস্ত বিচারালয় বিভাগ-পূর্ব বৃটিশযুগ থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত কঠোরভাবে এসব আইনের অনুসরণ করে আসছে। এমনও হতে পারে যে, বৃটিশ রাজত্বের পূর্বেকার কাযীগণ এবং আইনজ্ঞগণও এসব নীতিমালার অনুসরণ করে থাকবেন এবং পরেও তার অনুসরণ চলতে থাকে। কারণ ইংরেজগণ অথবা অন্য কোন অমুসলিম জাতি স্বীয় উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য অনুযায়ী কুরআন পাকের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করুক এবং আইন প্রণয়ন করুক তা মুসলিম আইনজ্ঞগণ পছন্দ করতেন না। মুসলিম আইনের সাথে সম্পর্কিত যাবতীয় ব্যাপারে ফাতওয়া আলমগীরী নামক গ্রন্থের যে গুরুত্ব রয়েছে তা এই সত্যের প্রতি দিকনির্দেশ করে। ক্নিতু এখন পরিস্থিতি সম্পূর্ণ পরিবর্তিত হয়ে গেছে। সংক্ষেপে এখানে উল্লেখিত নীতিমালা তুলে ধরা হল।
[এরপর ধারা নং ৪-এর অবশিষ্ট অংশে এবং ৫ ও ৬ নং ধারার বিজ্ঞ বিচারপতি অভিভাবকত্ব সম্পর্কে হানাফী, শাফিঈ ও শীআ ফিকতের বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরেন।]
৭. যেমন আমি ইতিপূর্বে বলেছি, আসল যে প্রশ্নের সন্তোষজনক মীমাংসার দাবী রাখে তা হচ্ছে, এসব বিধিবিধানকে কি কোন প্রকার অকাট্যতার সাথে সে রকম অবশ্য পালনীয় আইন বলা যেতে পারে, যে মর্যাদা রয়েছে কোন গ্রন্থবদ্ধ আইনের? ভিন্নভাবে বলা যায় যে, এটা কি সেই আইন যার অনুসরণ Guardianship and Words Act-এর ১৭ নং ধারায় উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য অনুযায়ী একজন মুসলিম নাবালকের জন্য বাধ্যতামূলক?
৮. মুসলমানদের আকীদা-বিশ্বাস অনুযায়ী তারা যে ফেরকার সাথেই সম্পর্কিত হোক না কেন, যে আইন তাদের জীবনের প্রতিটি বিভাগে বলবৎ হওয়া উচিৎ চাই তা তাদের জীবনে ধর্মীয়, রাজনৈতিক, সামাজিক বা অর্থনৈতিক বিভাগ হোক, তা কেবলমাত্র আল্লাহর আইন। মহান আল্লাহই সর্বোচ্চ আইনদাতা, মহাজ্ঞানী ও সুবিচারক এবং একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী। ইসলামে আল্লাহ ও বান্দার মাঝখানের সম্পর্ক সহজ সরল এবং সরাসরি। কোন নেতা, ইমাম, পীর অথবা অন্য কোন ব্যক্তি (চাই সে জীবিত হোক অথবা মৃত, কবরে হোক অথবা কবরের বাইরে) এই সম্পর্কের মাঝখানে মধ্যস্থতাকারীর বেশে প্রতিবন্ধক হতে পারে না। আমাদের এখানে পেশাদার নেতা বা ধর্মীয় গুরুদের এমন কোন সংস্থা বর্তমান নাই যা নিজের ধ্যানধারণাকে রাজকীয় ভংগীতে আমাদের উপর চাপিয়ে দিতে পারে। কুরআন মজীদ যে সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে তার আওতায় অবস্থান করে মুসলমানদের চিন্তা ও কাজ করার পূর্ণ স্বাধীনতা রয়েছে। ইসলামে মানসিক ও আত্মিক স্বাধীনতার পরিবেশ বর্তমান রয়েছে। আইন যেহেতু মানবীয় স্বাধীনতার উপরে বাধ্যবাধকতা আরোপকারী শক্তি, তাই আল্লাহ তাআলা আইন প্রণয়নের ক্ষমতা পূর্ণরূপে নিজের হাতে রেখেছেন। ইসলামে কোন ব্যক্তির এমনভাবে কাজ করার অধিকার নেই যেন সে অন্যদের নিকট জবাবদিহির উর্ধে। কুরআন ব্যক্তিপূজা ও একনায়কত্ব খতম করে দিতে চায়। ইসলাম বিশ্বভ্রাতৃত্ব ও পূর্ণ সাম্যের শিক্ষা দিয়ে নিজের নৈতিক ব্যবস্থার অধীনে মানুষের বিশ্বভ্রাতৃত্ব ও পূর্ণ সাম্যের শিক্ষা দিয়ে নিজের নৈতিক ব্যবস্থার অধীনে মানুষের উপর থেকে মানুষের প্রাধান্য ও শ্রেষ্ঠত্বকে সম্পূর্ণরূপে উচ্ছেদ করেছে, চাই সেই প্রাধান্য বুদ্ধিবৃত্তিক ময়দানে হোক অথবা জীবনের অন্য কোন শাখায়। গোটা বিশ্বের মুসলমানরা না হলেও অন্তত একটি দেশের মুসলমানদের একই মালায় সুগ্রথিত করে দেয়া অত্যাবশ্যক। ইসলামী রাষ্ট্রের এমন লোকের অস্তিত্ব অসম্ভব যে একনায়কসুলভ ও রাজতান্ত্রিক ক্ষমতার দাবী করতে পারে। একটি ইসলামী রাষ্ট্রের সরকার প্রধানের কার্যাবলীও সঠিক অর্থে এই যে, সে আল্লহার বিধান ও তাঁর ফরমানসমূহ বাস্তবায়িত করবে। কুরআন তথা ইসলাম এব ব্যক্তি কর্তৃক সমস্ত মুসলমানদের জন্য আইন প্রণয়ন করার ধারণার সাথে সম্পূর্ণ অপরিচিত। কুরআন মজীদ বারবার ঘোষণা করছে যে, আল্লহা এবং একমাত্র আল্লাহ তাআলাই দুনিয়া ও আখেরাতের শাহানশাহ এবং তাঁর বিধানই সর্বশেষ এবং চূড়ান্ত। ৬:৭, ১২:৪০ ও ৬৭ নং আয়াতে বলা হয়েছে যে, শাসনক্ষমতার অধিকার একমাত্র আল্লাহর। অনুরূপভাবে ৪০:১২ আয়াতে বলা হয়েছেঃ (আরবী*******************) “সিদ্ধান্ত প্রদানের ক্ষমতা আল্লাহর যিনি সমুন্নত ও মহান”।
একথা ৫৯:২৩ আয়াকে পরিস্কারভাবে উল্লেখ আছে যে, সার্বভৌমত্বের অধিকারী হচ্ছেন আল্লাহ তাআলার সত্তা।
(আরবী*******************************************)
“তিনি আল্লাহ, তিনি ছাড়া কোন ইলাহ নাই, তিনিই অধিপতি, তিনিই পবিত্র, তিনিই শান্তি, তিনিই নিরাপত্তা বিধায়ক, তিনিই রক্ষক, তিনিই পরাক্রমশালী, তিনিই প্রবল, তিনিই অতীব মহিমান্বিত, তারা যাকে শরীক স্থির করে আল্লাহ তা থেকে পবিত্র, মহান। তিনিই আল্লাহ, সৃষ্টিকর্তা, উদ্ভাবনকর্তা, রূপদাতা, সকল উত্তম নাম তাঁরই। আকাশ মন্ডল ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে সমস্তই তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে। তিনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়”-(সূরা হাশরঃ ২৩-২৪)।
৯. মহানবী (সা) ও তাঁর চার খলিফার কার্যক্রম একথার সুস্পষ্ট সাক্ষ্য বহন করে যে, রাজতন্ত্র সম্পূর্ণরূপে ইসলামের পরিপন্থী, অন্যথায় তাদের জন্য নিজেদেরকে মুসলিম জাতির বাদশা হিসাবে ঘোষণা দেয়ার চেয়ে সহজতর কথা আর কিছুই ছিল না। তাঁরা যদি তাই করতেন তবে তাদের দাবী ত্বরিৎ সমর্থন করা হত। কারণ তাদের যোগ্যতা, বিশ্বস্ততা ও দৃঢ়তা ছিল সন্দেহ সংশয়ের উর্ধে। একথাও নিশ্চয়তার সাথে বলা যায় যে, তাঁরা নিজেদের ইসলামী দুনিয়ার একনায়ক ও স্বার্বভৌম শাসক হিসাবে না চিন্তা করতেন আর না এর ঘোষণা দিতেন। তাঁরা যে কাজই করতেন অন্য মুসলমানদের সাথে পরামর্শের ভিত্তিতেই করতেন। সমস্ত মুসলমান ছিল একটি ভ্রাতৃবন্ধনে আবদ্ধ যা ছিল তাদের অথবা অন্য কথায় ইসলামী আকীদার অপরিহার্য দাবী। এই আকীদা-বিশ্বাসের স্বাভাবিক স্পীরিট এই ছিল যে, মানুষের উপর প্রাধান্য খতম হয়ে গেছে। কেউ রাজাও ছিল না এবং কেউ প্রজাও ছিল না। আর না কোন পুরোহিত বা পীর ছিল। প্রত্যেক ব্যক্তিই নেতা হতে পারত। কিন্তু সাথে সাথে তাকে তাকওয়া বা অন্য কোন যোগ্যতার দিক থেকে তার চেয়ে উত্তম লোকদের অনুসরণ করতে হত। আমীর মুআবিয়াই প্রথম ব্যক্তি যিনি ইসলামের ভ্রাতৃবন্ধনের উপর একটি কষাঘাত করেন এবং নিজের পুত্রকে রাষ্ট্রের উত্তরাধিকারী ঘোষণা করে গোটা জাতিকে নিজের গোত্রের আওতায় জড়ো করেন। আমাদের গণতন্ত্রপ্রিয় রসূল (সা)-এর ইন্তেকালের পরপরই ইসলামের আনীত গণতন্ত্রকে সাম্রাজ্যবাদে পরিবর্তিত করে দেয়া হয়। আমীর মুআবিয়া বংশগত খিলাফতের সূচনা করে ইসলামের মূল শিকড়ের উপর কুঠারাঘাত হানেন। মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ (সা) যদিও নিজের কোন নিকটাত্মীয়ের প্রতি গভীর ভালোবাসা পোষণ করতেন, কিন্তু তিনি তাদের মধ্যে কাউকেও নিজের পরে মুসলিম উম্মাহর শাসক নিয়োগ করেননি। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গী ছিল সব সময় সুস্পষ্টভাবেই গণতান্ত্রিক। আমীর মুআবিয়ার মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র খিলাফতের উপর জবরদখল প্রতিষ্ঠা করে এবং স্বয়ং মহানবী (সা)-এর নাতি নিজের এবং নিজের প্রিয়তমদের জীবন পর্যন্ত কোরবানী করে দিলেন। এটা ছিল উমাইয়্যা বংশের অপপ্রচার যে, ইমাম হুসাহইন (রা) খিলাফতকে আহলে বায়ত-এর জন্য সংরক্ষিত করার উদ্দেশ্যে জীবন দিয়েছেন। এই অপপ্রচার ছিল সম্পূর্ণত মিথ্যার উপর ভিত্তিশীল। আশ্চর্যের বিষয় যে, শীআ সম্প্রদায়ও এই অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। দুর্ভাগ্যবশত ইমাম হুসাইন (রা) সফল হতে পারেননি। যার ফল এই দাঁড়ায় যে, রাজতন্ত্র ও একনায়কত্ব মুসলমানদের মধ্যে একটি স্বীকৃত পন্থার রূপ পরিগ্রহ করে। এরপর থেকে নিজেদের শাসক নির্বাচনের ক্ষেত্রে মুসলমানদের কোন অধিকার থাকল না এবং নিজেদের বিষয়াবলীর উপর নিজেদের কোন নিয়ন্ত্রণ থাকল না। আমীর মুআবিয়া যে কাজের সূচনা করেন তাৎক্ষণিকভাবে সম্ভবত তার কোন বিরূপ প্রতিক্রিয়ার প্রকাশ ঘটেনি, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা মুসলিম সমাজের সুস্থ ও সুষ্ঠু ক্রমোন্নতি ও পরিপালনকে অবশ্যম্ভাবীরূপে প্রভাবিত করে এবং আজ আন্তর্জাতিক ভ্রাতৃত্বের ক্ষেত্রে তার মর্যাদা দ্বিতীয় পর্যায়ের রয়ে গেছে।
১০. কুরআন মজীদের আলোকে মুসলমানদের আমীর কেবলমাত্র সেই ব্যক্তি হতে পারে যে বুদ্ধিজ্ঞান ও দৈহিক দিক থেকে এই পদের যোগ্য বিবেচিত হবে। এর দ্বারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বংশীয় ভিত্তি সম্পূর্ণরূপে নাকচ হয়ে যায়। এই প্রসংগে নিম্নোক্ত আয়াতের উল্লেখ যুক্তিসংগত হবেঃ
(আরবী********************************************)
“এবং তাদের নবীঢ তাদের বলেছিল, আল্লাহ তালূতকে তোমাদের রাজা করেছেন। তারা বলল, আমাদের উপর তার কর্তৃত্ব কিভাবে হবে যখন আমরা তার চেয়ে কর্তৃত্বের অধিক হকদার, এবং তাকে প্রচুর ঐশর্য দেয়া হয়নি। নবী বলল, আল্লাহ-ই তাকে তোমাদের জন্য মনোনীত করেছেন এবং তিনি তাকে জ্ঞানে ও দৈহিক দিক থেকে সমৃদ্ধ করেছেন। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা স্বীয় কর্তৃত্ব দান করেন। আল্লাহ প্রাচুর্যময়, প্রজ্ঞাময়”-(সূরা বাকারাঃ ২৪৭)।
১১. যেমন উপরে বর্ণিত করা হয়েছে যে, ইসলামী আইনের সাথে সম্পূর্ণ সামঞ্জস্যশীল বিধান রচনার অধিকার আল্লাহর এবং একমাত্র আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট। আদম (আ) থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত আল্লাহ তাআলা নবী-রসূলগণের মাধ্যমে তাঁর বিধান কার্যকর করেছেন। অতপর এমন একটি যুগসন্ধিক্ষণ উপস্থিত হল যখন মহান আল্লাহর পূর্ণতম প্রজ্ঞার ইচ্ছা অনুযায়ী মানবজাতির সর্বশেষ শরীআত দান করা হয়। এই ওহী লিপিবদ্ধ করে নেয়া হয় কিংবা স্মৃতিপটে মুখস্ত করে ধরে রাখা হয় এবং পরবর্তী পর্যায়ে তাকে একটি গ্রন্থের রূপ দান করা হয়, যা ‘কুরআন’ নামে খ্যাত। এরপর থেকে মানবজাতির সমস্ত পুরুষ, নারী ও শিশুদের সাথে সম্পর্কিত ব্যাপারসমূহের সমাধান ও মীমাংসা আল্লাহ তাআলা কর্তৃক নাযিলকৃত কুরআন অনুযায়ীই করা হত। এই বিধানই বলে দেয় কোনটি সঠিক, কোনটি ভুল, কি পছন্দনীয়, কি অপছন্দনীয়, কোনটি বৈধ, কোনটি অবৈধ, কোনটি মুস্তাহাব ও কোনটি মাকরূপহ। মোটকথা কুরআন মজীদ মুসলিম সমাজের এক অপরিহার্য ভিত্তি। এটা সেই কেন্দ্র যার চারপাশে ইসলামী আইন আবর্তিত হয়।
১১ (ক). এ এক স্বীকৃত সত্য যে, মানুষের সমন্বয়ে গঠিত সমাজ একটি দারুন জটিল জিনিস। প্রকৃতি যদিও চিরস্থায়ী ও চিরঞ্জীব ইচ্ছার প্রকাশের নাম এবং তা একটি স্থায়ী বিধানের অধীন, কিন্তু মানবীয় অবস্থা ও রুচি প্রতি যুগ ও প্রতিটি স্থানের বিচারে এক নয়। ব্যক্তিত্ব ও বস্তুগত অবস্থার সমন্বয় ভবিষ্যতের ঘটনার জন্য কোন নমুনা রেখে যায় না। মানুষের হাজারো রকমের ব্যাপার রয়েছে যেখানে হাজারো ধরনের অবস্থা ও পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়। আল্লাহর ইচ্ছা এই যে, পৃথিবীতে প্রতিটি শিশু নিজের সাথে কল্পনার এক নতুন জগত নিয়ে পদার্পণ করে। নিত্য নতুন অচিন্তনীয় পরিবর্তন সাধিত হচ্ছে। এই পৃথিবীতে যেহেতু মানবীয় পরিবেশ ও সমস্যা নিত্য নতুন রূপ নিচ্ছে, তাই এই সদা পরিবর্তনশীল জগতে চিরস্থায়ী ও পরিবর্তনের অযোগ্য কোন বিধান চলতে পারে না। কুরআন মজীদও এই স্বাভাবিক নিয়মের ব্যতিক্রম নয়। এ কারণে কুরআন মজীদ মানব জাতির পথ প্রদর্শনের জন্য বিভিন্ন ব্যাপারে কতিপয় ব্যাপক ও সাধারণ নীতি নির্ধারণ করে দিয়েছে। তা আমাদেরকে একক নীতিমালার একটি পূর্ণতর ব্যবস্থা এবং কল্যাণ ও সুফলের উপর ভিত্তিশীল একটি নৈতিক ব্যবস্থা দান করেছে। কতিপয় বিশেষ ব্যাপারে (যেমন উত্তরাধিকার) তা অধিক সুস্পষ্ট ও বিস্তারিত। এমন কতিপয় ব্যাপার রয়েছে যার উল্লেখ দৃষ্টান্ত ও ইশারা-ইংগীতের আকারে করা হয়েছে। এমনও কতক বিষয় রয়েছে যে সম্পর্কে কুরআন মজীদ সম্পূর্ণ নীরবতা অবলম্বন করেছে –যাতে মানুষ কালের পরিক্রমায় এসব ব্যাপারে পরিবর্তিত পরিস্থিতি অনুযায়ী কর্মপন্থা নির্ণয় করতে পারে। কুরআন মজীদে পুনপুন একথার উপর জোর দেয়া হয়েছে যে, তা নেহায়েত সহজ ভাষায় নাযিল করা হয়েছে যাতে প্রত্যেকেই তা বুঝতে পারে। যেসব আয়াতে এ কথার উপর জোর দেয়া হয়েছে তা এখানে উধৃত করা উপকারী হবে। [অতপর বিজ্ঞ বিচারপতি নিম্নোক্ত আয়াতসমূহ ও তার অনুবাদ পেশ করেন]।
২৫:২৪২, ৬৫:৯৯, ১০৬, ১২৭, ১১:১, ১২:২, ১৫:১, ১৭:৮৯, ১০৬, ৩৯:২৮, ৫৪:১৭, ২২, ৫৭:৯, ১৭, ২৫, ৩০:৫৮, ৪১:৪৪।
অতএব বিষয়টি সম্পূর্ণ সুস্পষ্ট যে, কুরআন পড়া ও তা হৃদয়ংগম করা এক দুই ব্যক্তির একচেটিয়া অধিকার নয়। কুরআন সহজ-সরল ভাষায় অবতীর্ণ হয়েছে যাতে প্রত্যেক ব্যক্তি তা বুঝতে পারে, সমস্ত মুসলমান ইচ্ছা করলেও বুঝতে পারে এবং তদনুযায়ী কাজ করতে পারে। এটা এমন এক অধিকার যা প্রত্যেক মুসলমানকে দান করা হয়েছে এবং কোন ব্যক্তি-যত বড় পদমর্যাদা সম্পন্নই হোক-সে মুসলমানদের নিকট থেকে কুরআন পড়ার ও বুঝার এ অধিকার ছিনিয়ে নিতে পারে না। কুরআন মজীদের বক্তব্য হৃদয়ংগম করার জন্য কোন ব্যক্তি অতীত কালের নির্ভরযোগ্য তাফসীরকারদের ভাষ্যগ্রন্থসমূহ থেকে মূল্যবান সাহায্য গ্রহণ করতে পারে। কিন্তু ব্যাপারটা এ পর্যণ্তই সীমিত থাকা উচিৎ। এসব তাফসীরকে স্ব স্ব আলোচ্য বিষয়ের চূড়ান্ত রূপ বলা যেতে পারে না। কুরআন মজীদ পড়া ও হৃদয়ংগম করার বিষয়টি স্বয়ং দাবী করে যে, পাঠক তার ব্যাখ্যা বিশ্লেসণ করবে এবং তার ব্যাখ্যা প্রদানের সময় সে সমকালীন পরিস্থিতি ও পৃথিবীর পরিবর্তিত প্রয়োজনের উপর তার প্রয়োগ করবে। এই পবিত্র গ্রন্থের যেসব ব্যাখ্যা অতীত কালের ভাষ্যকারগণ, যেমন ইমাম আবু হানীফা, ইমাম মালিক, ইমাম শাফিঈ প্রমুখ করেছেন যার প্রতি সমস্ত মুসলমান এবং স্বয়ং আমি সম্মান প্রদর্শন করি –তা আজকের যুগে অক্ষরে মান্য করা যেতে পারে না। তাদের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ মূলত অন্যান্য অনেক বিজ্ঞ আলেমও সমর্থন করেননি যাদের মধ্যে তাদেরই শাগরিদবৃন্দও রয়েছেন। কুরআন মজীদের বিভিন্ন আয়াতের যে গভীর অধ্যয়ন তাঁরা করেছেন তা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, সমকালীন পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিক ঘটনাবলীর দ্বারা তা জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে ব্যাপকভাবে প্রাভাবিত হয়েছে। তাদের যুগে অথবা তাদের দেশে উদ্ভুত সমস্যাবলী সম্পর্কে তাঁরা একটি বিশেষ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। আজ থেকে ১২/১৩ শত বছর পূর্বেকার তাফসীরকারদের বক্তব্যকে যদি চূড়ান্ত ও সর্বশেষ ভাষ্য মেনে নেয়া হয় তবে ইসলামী সনমাজ একটি লৌহপিঞ্জরে বন্দী পড়ে থাকবে এবং কালের পরিক্রমায় তা ক্রমবিকাশের সুযোগ পাবে না। অতপর তা আর একটি চিরস্থায়ী ও বিশ্বজনীন জীবন ব্যবস্থা হিসাবে টিকে থাকতে পারবে না, বরং যে যুগে ও স্থানে নাযিল হয়েছিল তা সে পর্যন্তই সীমাবদ্ধ হয়ে থাকবে। যেমন উপরে বর্ণনা করা হয়েছে যে, কুরআন যদি কোন অপরিবর্তনীয় নীতিমালা নির্ধারণ না করে থাকে তবে ইমাম আবু হানীফা প্রমুখের ভাষ্যসমূহ সম্পর্কেও অনুমতি দেয়া যায় না যে, তা মাঝখানে সেই পরিণতির কারণ হবে। দুর্ভাগ্য বশত সমকালীন পরিস্থিতির আলোকে কুরআন মজীদের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের পথ কয়েক শতক ধরে সম্পূর্ণ রুদ্ধ করে দেয়া হয়েছে, যার ফল এই দাঁড়িয়েছিল যে, মুসলমানগণ ধর্মীয় স্থবিরতা , সাংস্কৃতিক বন্ধ্যাত্ব, রাজনৈতিক শূন্যতা এবং অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের শিকার হয়েছে। যে বৈজ্ঞানিক গবেষণা উন্নতিতে এককালে মুসলমানদের একচেটিয়া অবদান ছিল তা অন্যদের হাতে চলে গেছে এবং মনে হচ্ছে যে, মুসলমানরা চিরনিদ্রায় শুয়ে পড়েছে। এই পরিস্থিতিতে অবশ্যই পরিসমাপ্তি হওয়া উচিৎ। মুসলমাদের জাগ্রত হয়ে যুগের সাথে পাল্লা দিয়ে চলতে হবে। সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দিক থেকে যে অসচেতনতা ও অকর্মন্যতা মুসলমানদেরকে ঘিরে ফেলেছে তা থেকে অবশ্যই নিস্কৃতি পেতে হবে। কুরআন মজীদের সাধারণ মূলনীতিগুলোকে সমাজের পরিবর্তিত প্রয়োজনের উপর প্রয়োগ করার জন্য তার এমন যুক্তিগ্রাহ্য ও বুদ্ধিবৃত্তিক ব্যাখ্যা করতে হবে যাতে লোকেরা নিজেদের ভাগ্য, নিজেদের চিন্তাধারা ও নৈতিক কাঠামো তদনুযায়ী গঠন করতে পারে এবং নিজেদের দেশেও যুগোপযোগী পন্থায় কাজ করতে পারে। অন্য লোকদের মত মুসলমানরাও জ্ঞান ও বুদ্ধিবিবেকের অধিকারী এবং এই শক্তি ব্যবহার করার জন্যই দেয়া হয়েছে, অযথা নষ্ট করার জন্য দেয়া হয়নি। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের লোকদের এই স্বাধীনতা রয়েছে যে, তারা চিন্তা গবেষণা করে দেখবে যে, আল্লাহর নিকট কুরআনের আয়াতের দাবী ও তাৎপর্য কি এবং তাকে কিভাবে নিজেদের বিশেষ পরিস্থিতির উপর প্রয়োগ করা যেতে পারে? অতএব সকল মুসলমানকে কুরআন পড়তে হবে, হৃদয়ংগম করতে হবে এবং তার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করতে হবে।
(আরবী***************************************)
“তাদের মধ্যে কতেকে তোমার কথা শুনে, অতপর তোমার নিকট থেকে বের হয়ে গিয়ে যারা জ্ঞানবান তাদের বলে, এই মাত্র সে কি বলেছে? এদের অন্তরে আল্লাহ মোহর মেরে দিয়েছেন এবং এরা নিজেদের খেয়াল-খুশীরই অনুসরণ করে”-(মুহাম্মদঃ ১৬)।
(আরবী******************************************)
“তিনি উম্মীদের মধ্যে তাদের একজনকে পাঠিয়েছেন রসূল হিসাবে –যে তাদের নিকট তাঁর আয়াতসমূহ পাঠ করে, তাদের পবিত্র করে এবং শিক্ষা দেয় কিতাব ও হিকমাত। ইতিপূর্বে এরা তো ছিল ঘোর বিভ্রান্তিতে” (সূরা জুমুআঃ ২)।
জনগণের কর্তব্য হল তারা যেন কুরআন সম্পর্কে গভীর চিন্তাভাবনা করে এবং নিজেদের অন্তরের উপর তালা ঝুলিয়ে না দেয়।
(আরবী*****************************************)
এক কল্যাণময় কিতাব, তা আমি তোমার উপর নাযিল করেছি যাতে মানুষ এর আয়াতসমূহ অনুধাবন করে এবং বোধশক্তি সম্পন্ন ব্যক্তিগণ উপদেশ গ্রহণ করে”-(সাদঃ ২৯)।
লোকদের কর্তব্য হচ্ছে, তারা কুরআন নিয়ে চিন্তাভাবনা করবে এবং তা হৃদয়ংগম করার চেষ্টা করবে। অন্যান্য উদ্দেশ্য লাভের জন্য যেভাবে দুনিয়াতে কঠোর চেষ্টাসংগ্রাম করতে হয়, অনুরূপভাবে কুরআন বুঝবার এবং তার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যে পৌঁছার কঠোর পারিশ্রমের নামই হচ্ছে ইজতিহাদ।
(আরবী*********************************************)
“যে কেউ চেষ্টা সাধন করে সে তো নিজের জন্যই তা করে। আল্লাহ তো বিশ্ববাসীর মুখাপেক্ষী নন”-(আনকাবুতঃ ৬)।
পুনর্বার একথার উপর জোর দেয়া হয়েছে যে, লোকেরা কুরআন মজীদের সঠিক ও পূর্ণ জ্ঞান অর্জনে সচেষ্ট হবে।
(আরবী**********************************************)
“এরা যখন সমাগত হবে তখন আল্লাহ তাদের বলবেন, তোমরা কি আমার নিদর্শন প্রত্যাখ্যান করেছিলে, অথচ তা তোমরা নিজেদের জ্ঞানে আয়ত্ত করতে পারনি? না, তোমরা অন্য কিছু করছিলে” –(সূরা নামলঃ ৮৪)।
(আরবী**************************************************)
“আর কঠোর প্রচেষ্টা চালাও আল্লাহর (পথে) যেভাবে তাঁর জন্য প্রচেষ্টা চালানো উচিৎ। তিনি তোমাদের মনোনীত করেছেন। তিনি দীনের ব্যাপারে তোমাদের উপর কোন সংকীর্ণতা আরোপ করেননি। এই পন্থা তোমাদের পিতা ইবরাহীমের। তিনি পূর্বে তোমাদের নাম রেখেছেন মুসলিম এবং এতেও, যাতে রসূল তোমাদের উপর সাক্ষী হন এবং তোমরা সাক্ষী হও মানব জাতির জন্য। অতএব তোমরা নামায কায়েম কর, যাকাত দাও এবং আল্লাহকে অবলম্বন ধর, তিনিই তোমাদের অভিভাবক। কত উত্তম অভিভাবক তিনি এবং কত উত্তম সাহায্যকারী”।–(সূরা হজ্জঃ ৭৮)।
(আরবী***********************************************)
“আল্লাহ অতি মহান, প্রকৃত অধিপতি। তোমার উপর আল্লাহর ওহী সম্পূর্ণ হওয়ার পূর্বে কুরআন পাঠে তুমি ত্বরা কর না এবং বল, হে আমার প্রতিপালক! আমার জ্ঞানের বৃদ্ধি সাধন কর”-(সুরা ত-হাঃ ১১৪)।
উল্লেখিত সব আয়াত থেকে প্রতীয়মান হয় যে, সমস্ত মুসলমানের নিকট শুধু তাদের বিশেষ পর্যায়ের লোকের নিকট নয়, এই আশা করা হচ্ছে যে, তারা কুরআনের জ্ঞান অর্জন করবে, তা উত্তমরূপে হৃদয়ংগম করবে এবং তার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করবে। ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে কতিপয় স্বীকৃতি নীতির অনুসরণ একান্ত অপরিহার্য। এসব মূলনীতির মধ্যে কয়েকটি এও হতে পারেঃ
১. কুরআন মজীদের কতক বিধান গুরুত্বপূর্ণ ও মৌলিক। কখনো সেগুলো অমান্য করা এবং সেগুলোর বিরোধিতা করা যাবে না, বরং সেগুলোর উপর অক্ষরে অক্ষরে আমর করতে হবে।
২. এমন কতিপয় আয়াত রয়েছে যার ধরন পথনির্দেশনামূলক এবং কমবেশী যার অনুসরণ করা অপরিহার্য।
৩. যেখানে বক্তব্য সম্পূর্ণ সরল ও সুস্পষ্ট, যা সুনির্দিষ্ট ও সুস্পষ্ট অরর্থ প্রকাশ করে, সেখানে তার সেই অর্থই গ্রহণ করতে হবে, যা অভিধান ও ব্যাকরণের আলোকে সঠিক ও গ্রহণযোগ্য অন্য কথায় এই পবিত্র গ্রন্থের শব্দাবলী নিয়ে কোনরূপ টানাহেঁচড়া করা ঠিক নয়।
৪. একথা স্বীকার করে নেয়া উচিৎ যে, কুরআন মজীদের কোন অংশে অর্থহীন, অপূর্ণাংগ অথবা প্রয়োজনের অতিরিক্ত নয়।
৫. পূর্বাপর সম্পর্ক থেকে বিচ্ছিন্ন করে কোন অর্থ নির্গত করা উচিৎ নয়।
৬. কুরআনের ব্যাখ্যা যুক্তিগ্রাহ্য হওয়া উচিৎ। এ কথার উদ্দেশ্য এই যে, তাকে পারিপার্শ্বিক দ্বারা প্রভাবিত হওয়া মানবীয় রীতিনীতির সাথে সংগতিপূর্ণ হতে হবে। সর্বদা নতুন ও অনাকাংখিত অবস্থার প্রকাশ ঘটতে থাকে, একথা বিবেচনার যোগ্য। সমাজের প্রয়োজনের তালিকা দিন দিন বর্ধিত হচ্ছে এবং এসব পরিস্থিতি ও প্রয়োজনের আলোকে কুরআন ব্যাখ্যা প্রদান করা আবশ্যক।
১১ (খ). স্থান-কালের ব্যবধানের কারণে যে বিভিন্নরূপ অবস্থার উদ্ভব ঘটে তার মধ্যে সাদৃশ্য ও বৈশাদৃশ্যের পারস্পরিক তুলনা হওয়া উচিৎ। তুলনা করার সময় আমাদেরকে পরিস্থিতি ও প্রচলিত রীতিনীতির প্রতি লক্ষ্য রাখার বিষয়টি বিবেচনায় রাখতে হবে এবং দূরের ও কাছের সত্যসমূহ যাচাই করতে গিয়ে অতীত ও বর্তমানের দিকে এমনভাবে অগ্রসর হতে হবে যে, কল্পিত বিষয়, অনুমান, অস্বাভাবিক ও বর্জনযোগ্য আকীদা-বিশ্বাস সবই আমাদের দৃষ্টির সামনে থাকবে।
১২. দুর্ভাগ্যবশত এই দুনিয়ায় অন্ততপক্ষে খিলাফতে রাশেদার পরে এমন কোন সঠিক ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম হয়নি যেখানে লোকেরা পূর্ণ সচেতনতা, আগ্রহ ও পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে কুরআন মজীদের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের কাজ করতে পারতো। কুরআন মজীদের নির্ধারিত মূলনীতি চিরস্থায়ী, কিন্তু তার প্রয়েঅগ চিরন্তন নয়। কারণ প্রয়োগ এমন সত্য তথ্য ও উদ্দেশ্যের ফলশ্রুতি যা অব্যাহতভাবে পরিবর্তিত হবে থাকে। এখন যদি কুরআন মজীদের কোন একটি বিশেষ আয়াতের একাধিক ব্যাখ্যা সম্ভব হয় এবং প্রত্যেক মুসলমানকে যদি নিজ নিজ অনুধাবন ক্ষমতা ও রুচি অনুযায়ী ব্যাখ্যা প্রদানের অধিকার দেয়া হয় তবে এর ফলে অসংখ্য ব্যাখ্যা অস্তিত্ব লাভ করে একটি বিশৃংখলার কারণ হয়ে দাঁড়াবে। অনুরূপভাবে কুরআন মজীদ যেসব ব্যাপারে নীরব, সে সম্পর্কেও যদি প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার দৃষ্টিভংগী অনুযায়ী একটি নীতিমালা তৈরীর অধিকার দেয়া হয় তবে সে ক্ষেত্রেও একটি বিশৃংখল ও অসংলগ্ন সমাজের সৃষ্টি হবে। অন্যান্য সমাজের মত ইসলামী সমাজও যতোটা সম্ভব কষ্টের সাথে হলেও সর্বাধিক সংখ্যক লোককে সুখশান্তির আশ্বাস দেয়। তাই অধিকাংশের রায়ই বিজয়ী হবে।
১৩. এক বা কয়েক ব্যক্তি প্রকৃতিগতভাবে বুদ্ধিজ্ঞান ও শক্তিতে অপূর্ণাঙ্গ হয়ে থাকে। কোন ব্যক্তি যতই অধিক শক্তিশালী ও মেধার অধিকারী হোক না কেন, তার কামেল (পূর্ণাঙ্গ) হওয়ার আশা করা যায় না। একজন উচ্চ স্তরের সচেতন ও গভীর দৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তিও নিজের পর্যবেক্ষণের আওতায় আসা সমস্ত বিষয়ের গুরুত্ব সঠিকভাবে অনুমান করতে পারে না। একটি সুশৃংখল সামাজিক ব্যবস্থা ও কাঠামোর অধীন বসবাসকারী লাখো কোটি মানুষ সামগ্রিকভাবে ব্যক্তির তুলনায় অধিক জ্ঞান ও শক্তির অধিকারী। তাদের পর্যবেক্ষণশক্তি ও ধারণাশক্তি তুলনামূলকভাবে উত্তম ও উন্নত হয়ে থাকে। কুরআন মজীদের আলোকেও আল্লাহর কিতাবের ব্যাখ্যা এবং পরিস্থিতির উপর তার সাধারণ মূলনীতিসমূহের প্রয়োগের কাজটি এক ব্যক্তি অথবা কয়েক ব্যক্তির উপর ছেড়ে দেয়া যায় না, বরং একাজ মুসলমানদের পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে হওয়া উচিত।
(আরবী******************************************)
“যারা নিজেদের প্রতিপালকের ডাকে সাড়া দেয়, নামায কায়েম করে, পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে নিজেদের কার্য সম্পাদন করে এবং তাদের আমি যে রিযিক দিয়েছি তা থেকে ব্যয় করে”-(সূরা শূরাঃ ৩৮)।
(আরবী**********************************************)
“আর তোমরা সম্মিলিতভাবে আল্লাহর রজ্জু দৃঢ়ভাবে ধর এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হও না। তোমাদের উপর আল্লাহর অনুগ্রহের কথা স্মরণ কর-যখন তোমরা ছিলে পরস্পর শত্রু এবং তিনি তোমাদের অন্তরে ভালোবাসার সঞ্চার করেন। ফলে তাঁর অনুগ্রহে তোমরা পরস্পর ভাই হয়ে গেলে। তোমরা অগ্নিকুন্ডের প্রান্তে ছিলে, আল্লাহ তা থেকে তোমাদের রক্ষা করেছেন। এভাবে আল্লাহ তোমাদের জন্য তাঁর নিদর্শন স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেন যাতে তোমরা সৎপথ পেতে পার”।-(সূরা আল ইমরানঃ ১০৩)।
আরও অনেক আয়াতে মুসলমানদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে, তারা যেন কুরআন মজীদ বুঝবার এবং তার আয়াতসমূহের উপর গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করবার চেষ্টা করে। এর অর্থ এই যে, ব্যক্তিগত পর্যায়ে নয় বরং সমষ্টিগতভাবে কাজ আঞ্জাম দিতে হবে।
১৪. আলোচনার এই প্রাসংগিকতার মধ্যে অবস্থান করেই ‘কানূন’ (বিধান) শব্দের অর্থ জানার চেষ্টা করা জরুরী। আমার মতে ‘কানূন’ বলতে সেই নিয়ম প্রণালী ও রীতিনীতিকে বুঝায়, যে সম্পর্ক অধিকাংশ লোক এই ধারণা পোষণ করে যে, তাদের যাবতীয় বিষয় তদনুযায়ী চলা উচিৎ।
১৫. প্রাথমিক পর্যায়ে মানবজাতির সংখ্যা অনেক কম এবং তারা বিক্ষিপ্তভাবে বসবাস করত। তাদের প্রত্যেক ব্যক্তি নিজ নিজ মর্জি মাফিক চলতে পারত। পরবর্তীকালে মানব জাতির সংখ্যা যখন বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় এবং তাদের বিভিন্ন দল ও গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে বসবাসের প্রয়োজন দেখা দিল। উদাহরণস্বরূপ পঞ্চাশ ব্যক্তির একটি দলে হত্যাকান্ড সংঘটিত হল। অধিকাংশের ধারণা অনুযায়ী এটা ছিল না। শক্তি যেহেতু অধিকাংশের কুক্ষিগত ছিল, তাই তারা সংখ্যালঘুদের উপর নিজেদের ইচ্ছা জোরপূর্বক কার্যকর করে এবং সেটাই আইনের মর্যাদা লাভ করে, হয়ত এই পঞ্চাশ ব্যক্তির মধ্যে কেউ হত্যাকারী না হতে পারে। এই যুক্তি বর্তমান কালের দৃষ্টিভংগী থেকেও সঠিক। কয়েক কোটি অধিবাসীর একটি দেশে অধিকাংশ অধিবাসীর কুরআনের একাধিক ব্যাখ্যা সাপেক্ষ আয়াতসমূহের এমন ব্যাখ্যা পেশ করা উচিৎ যা হবে তাদের পারিপার্শিক অবস্থার সাথে অধিকতর সামঞ্জস্যপূর্ণ। অনুরূপভাবে কুরআনের সাধারণ নীতিমালাকে বর্তমান পরিস্থিতির উপর প্রয়োগ করা উচিৎ যাতে চিন্তা ও কর্মের মধ্যে ঐক্য সৃষ্টি হতে পারে। তদ্রুপ যেসব সমস্যা ও ব্যাপারসমূহের ক্ষেত্রে কুরআন নীরব, সেসব ক্ষেত্রেও আইন প্রণয়নের দায়িত্ব অধিকাংশকে পালন করতে হবে।
অতপর যে প্রশ্নটি আলোচনার দাবী রাখে তা এই যে, কোটি কোটি মানুষ কুরআন মজীদের ব্যাখ্যা, এর প্রয়োগ এবং যে বিষয়ে কুরআন নীরব সে সম্পর্কে আইন প্রণয়নের অধিকার কিভাবে ব্যবহার করবে? কোন দেশের পারিপার্শ্বিক অবস্থা পর্যবেক্ষণপূর্বক এই বিষয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছা যেতে পারে যে, তথাকার অদিবাসীদের জন্য নিজেদের প্রতিনিধি নির্বাচনের সর্বোত্তম পন্থা কি হতে পারে যাদের উপর তারা বিশ্বস্ততার সাথে নিজেদের এখতিয়ার ও মত প্রকাশের অধিকার অর্পণ করতে পারে। তারা এক ব্যক্তিকেও নিজেদের প্রতিনিধি নির্বাচন করতে পারে। কিন্তু ইতিহাস আমাদের বলে দিচ্ছে যে, এক ব্যক্তিকে সঠিক কর্তৃত্বের অধিকারী বানানোর পরিণাম সর্বকালেই ধ্বংসাত্মক প্রমাণিত হয়েছে। ক্ষমতার নেশা ব্যক্তি, সংগঠন ও আইনের শাসনে প্রতিবন্ধকতা ও বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায় এবং একচ্ছত্র ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব তিন গুণ বিপর্যয়সহ নিজের শেষ সীমায় পৌঁছে যায়। কোন দেশের ইতিহাসে এমন অবস্থারও সৃষ্টি হতে পারে যে, পরিস্থিতি পরিবর্তন ও দেশকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য এক ব্যক্তিকে নিজের হাতে সার্বিক ক্ষমতা তুলে নেয়ার প্রয়োজন দেখা দিতে পারে। কিন্তু এটা একটা অস্বভাবিক অবস্থা, যা গণতন্ত্র বহাল করতে এবং ক্ষমতার আমানত জনগণের নিকট হস্তান্তরের জন্য ক্ষমতার বন্টনের বিষয়টি অতীব গুরুত্বপুর্ণ, যাতে তাদের প্রত্যেকে পরস্পরের জন্য নিয়ন্ত্রক এবং জবাবদিহির কারণ হতে পারে এবং সকলে মিলে গোটা জাতির পথ প্রদর্শনের জন্য আইন-কানূন ও নীতিমালা প্রণয়ন করতে পারে। পরিস্থিতির স্বাভাবিক দাবী এই যে, এই কর্তৃত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিগণ সাধারণ লোকদের নিকট জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকবে। কেবলমাত্র এই অবস্থায়ই একটি সুশৃংখল কর্মপন্থা সহকারে কোন কর্মসূচীকে সাফল্যের স্তরে পৌঁছানো যেতে পারে। ইসলামে সমস্ত মুসলমান সমানভাবে ক্ষমতার অধিকারী এবং তাদের উপর রয়েছে কেবলমাত্র আল্লহার স্বার্বভৌমত্ব। তাদের সিদ্ধান্তসমূহ স্বাধীন নাগরিক হিসাবে সামগ্রিকভাবে ও সাধারণভাবে গ্রহণ করা হয়। এরই নাম “ইজমা” (ঐক্যমত)।
“ইজতিহাদ” আইনের একটি স্বীকৃত উৎস। এর অর্থ কোন সন্দেহপূর্ণ বা কঠিন আইনগত সমস্যার সমাধান বের করার জন্য নিজের বুদ্ধিবৃত্তিক যোগ্যতাকে পূর্ণভাবে প্রয়োগ করা। ইমাম আবু হানীফা ব্যাপকভাবে ইজতিহাদের প্রয়োগ করেছেন। ইজতিহাদের যেসব ক্ষেত্রে ইমাম আবু হানীফা ও অপরাপর ফকীহগণ কর্মরত ছিলেন সে গুলো হচ্ছে কিয়াস, ইসতিহসান, ইসতিসলাহ ও ইসতিদলাল। মুসলিম ফকীহগণ এক ব্যক্তি বা কয়েক ব্যক্তির ইজতিহাদকে বিপদজনক মনে করতেন। তাই তাঁরা কোন বিশেষ আইনগত সমস্যার ক্ষেত্রে ফকীহগণের অথবা মুজতাহিদগণের ইজমা অথবা সংখ্যাগরিষ্ঠের রায় অনুসারে সিদ্ধান্ত গ্রহণকে অগ্রাধিকারযোগ্য মনে করতেন। অতীতকালে ইজতিহাদকে কতিপয় ফকীহর মধ্যে সীমিত রাখা হয়ত সঠিক ছিল। কারণ জনগণের মধ্যে স্বাধীনভাবে এবং ব্যাপক আকারে জ্ঞানের প্রসার ঘটানো হত না। কিন্তু আধুনিক কালে এই দায়িত্ব জনগণের প্রতিনিধিদের আঞ্জাম দেয়া উচিৎ। কারণ যেমন আমি ইতিপূর্বে বর্ণনা করেছি, কুরআন মজীদ পাঠ করা, অনুধাবন করা এবং তার সাধারণ নীতিমালাকে বিরাজমান পরিস্থিতির উপর প্রয়োগ করা এক অথবা দুই ব্যক্তির বিশেষ অধিকার নয়, বরং সমস্ত মুসলমানের অধিকার ও কর্তব্য এবং একাজ তাদেরই আঞ্জাম দেয়া উচিৎ যাদেরকে মুসলমানগণ এই উদ্দেশ্যে নির্বাচন করে থাকবে। অতএব একথা আপনা আপনি অপরিহার্য হয়ে পড়ে যে, যেসব ব্যাপারে কুরআন মজীদের নির্দেশ সুস্পষ্ট তা মুসলমানদের জন্য আইনের মর্যাদা রাখে এবং যেখানে কুরআন মজীদের ব্যাখ্যা এবং তার সাধারণ নীতিমালাকে আনুষঙ্গিক বিষয়ের উপর প্রয়োগের ব্যাপার রয়েছে সেখানে সর্বসাধারণের নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ যা কিছু সিদ্ধান্ত নিবে তাও আইনের মর্যাদা লাভ করবে।
১৬. উপরে যে দৃষ্টিভংগীর বর্ণনা দেয়া হয়েছে তা কয়েকটি উদাহরণের সাহায্যে সুস্পষ্ট করা যায়। আমি সর্বপ্রথম কুরআন মজীদের সূরা নিসার তৃতীয় আয়াতটি পেশ করব যা বেশীরভাব ক্ষেত্রে ভ্রান্তভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে।
(আরবী********************************************)
“তোমরা যদি আশংকা কর যে, ইয়াতীম মেয়েদের প্রতি সুবিচার করতে পারবে না, তবে বিবাহ করবে মহিলাদের মধ্যে যাকে তোমার ভালো লাগে-দুই দুই, তিন তিন, চার চার। আর যদি আশংকা কর যে, সুবিচার করতে পারবে না তবে একজনকে অথবা তোমাদের অধিকারভুক্ত দাসী বিবাহ কর। এতে পক্ষপাতিত্ব না করার অধিকতর সম্ভাবনা রয়েছে”।
যেমন আমি আমার রায়ের প্রাথমিক অংশের বর্ণনা করেছি যে, কুরআন মজীদের কোন হুকুমের কোন অংশই অর্থহীনব মনে করা উচিৎ নয়। জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাজ হলঃ তারা এ বিষয়ে আইন প্রণয়ণ করবে যে, একজন একের অধিক বিবাহ করতে পারবে কি না, যদি করতে পারে তবে কি অবস্থায় এবং কোন কোন শর্ত সাপেক্ষে। কিয়াসের দিক থেকে এই ধরনের বিবাহ ইয়াতীমদের উপকারের জন্য হওয়া উচিৎ।
১৭. যাই হোক এই আয়াতের দ্বারা শুধু বৈধতা প্রমাণিত হয়, বাধ্যতামূলক নয় এবং আমার জ্ঞানমতে সরকার এই অনুমতিকে সীমিত করতে পারে। যদি পঞ্চাশ ব্যক্তি সমন্বয়ে গঠিত দলের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যগণ এই আইন প্রণয়ন করতে পারে যে, তাদের মধ্যে কেউই নরহত্যার অপরাধ করবে না, তবে এই উদাহরণের উপর কিয়াস করে বলা যায় যে, যদি কোন একজন মুসলমানের জন্য একথা বলা সম্ভব হয় যে, “আমি একের অধিক বিবাহ করব না, কারণ এই সামর্থ আমার নেই”, তবে আট কোটি (তৎকালীন পাকিস্তানের জনসংখ্যা) মুসলমানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল গোটা জাতির জন্য এই বিধান প্রণয়ন করতে পারে যে, জাতির অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক অথবা রাজনৈতিক পরিস্থিতি কোন ব্যক্তিকে একের অধিক বিবাহ করার অনুমতি দেয় না। এই আয়াতটি কুরআন মজীদের অন্য দুটি আয়াতের সাথে মিলিয়ে পড়া উচিৎ। প্রথম আয়াত ২৪:৩৩, যাতে বলা হয়েছেঃ বিবাহ করার উপায়-উপকরণ যার নাই তার বিবাহ করা অনুচিৎ। উপায়-উপকরণের স্বল্পতার কারণে যদি এক ব্যক্তিকে এক বিবাহ করা থেকে বিরত রাখা যায় তবে এসব কারণে অথবা এ জাতীয় কারণে তাকে একের অধিক বিবাহ করা থেকেও বিরত রাখা উচিৎ। বিবাহ স্ত্রী ও সন্তানদের অস্তিত্বের যামিনস্বরূপ। পরিবারের ভরণপোষণের অভাবহেতু যদি এক ব্যক্তির জন্য বিবাহ নিষিদ্ধ হতে পারে তবে তাকে যতটি বাচ্চার ভরণপোষণে সে সক্ষম ততটি জন্মদানে বাধ্য করা যেতে পারে। সে নিজে যদি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে তবে সরকারকে তার জন্য একাজ করে দিতে হবে। এই নীতির ব্যাপক আকারে প্রয়োগ করতে গিয়ে, যেমন কোন দেশের খাদ্য পরিস্থিতি যদি খারাপ হয় এবং জন্মনিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন হয় তবে সরকারের জন্য এরূপ আইন প্রণয়ণ সম্পূর্ণ বৈধ হবে যে, কোন ব্যক্তি একের অধিক স্ত্রী রাখবে না এবং একজনও এমন অবস্থায় রাখবে যখন সে নিজের স্ত্রীর ভরণপোষণের প্রয়োজন পূরণ করতে পারবে এবং সন্তানও একটি নির্দিষ্ট সংখ্যায় সীমিত রাখবে। তাছাড়া উপরোক্ত আয়াতে বিশেষভাবে এই নিদের্শ দেয়া হয়েছে যে, কোন মুসলমান নিজ স্ত্রীদের মধ্যে সবিচার প্রতিষ্ঠা করতে পারবে না বলে আশংকা বোধ করলে সে কেবল একজন স্ত্রীলোকই বিবাহা করবে। সূরা নিসার ১২৯ নং আয়াতে আল্লাহ তাআলা একথা পরিষ্কারভাবে বলে দিয়েছেন যে, স্ত্রীদের মধ্যে সুবিচার প্রতিষ্ঠা করা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়।
(আরবী************************)
“আর তোমার যতই ইচ্ছা কর না কেন তোমাদের স্ত্রীদের প্রতি সমান ব্যবহার কখনই করতে পারবে না। তবে তোমরা কোন একজনের দিকে সর্ম্পূণভাবে ঝুঁকে পড়বে না এবং অপরকে ঝুলন্ত অবস্থায় রেখ না। যদি তোমরা নিজেদের সংশোধন কর এবং সাবধান হও তবে নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু”
এই দুই আয়াতের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানের জন্য আইন প্রণয়ন এবং একাধিক বিবাহের উপর বিধিনিষেধ আরোপ করা সরকারের দায়িত্ব।
১৮. সরকার বলতে পারে যে, দুই স্ত্রী বিবাহ করার ক্ষেত্রে যেহেতু বছরের পর বছরের অভিজ্ঞতা থেকে প্রকাশ পেয়েছে এবং কুরআনেও স্বীকার করা হয়েছে যে, দুই স্ত্রীর সাথে সমান ব্যবহার অসম্ভব, তাই এই প্রথা চিরকালের জন্য বন্ধ করে দেয়া হল। এই তিনটি আয়াত সাধারণ নীতিমালা বর্ণনা করে। এই তিনটি মূলনীতির প্রয়োগ সরকারকেনিজ তত্ত্ববাধানে করতে হবে। সরকার লোকদের একাধিক বিবাহ করে নিজেকে এবং নিজের সন্তানদের ধ্বংস করা থেকে বাঁচাতে পারে। জাতীয় এবং রাষ্ট্রীয় স্বার্থের দাবী এই যে, যখনই প্রয়োজন অনুভূত হবে বিবাহের উপর বিধিনিষধ আরোপ করা হবে।
১৯. চুরির ব্যাপারে সূরা ৫ঃ ৩৮-এ নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, পুরুষে চোর অথবা নারী চোর উভয়ের হাত কাটা যাবে। এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদের অপরাধের দৃষ্টান্তমূক শাস্তি। একই সূরার ৩৯ নং আয়াতে বলা হয়েছে যে, “যে কেই যুলুম করার পর তওবা করলে এবং সংশোধন হলে নিশ্চয় আল্লাহ তার তওবা কবুল করেন।“ অতএব সাধারণ মূলনীতি এই যে, চুরির সর্বোচ্চ শাস্তি হাত কেটে দেয়া। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত নেয়া সরকারের দায়িত্ব যে, চুরি কি এবং কোন ধরনের চুরির কি শাস্তি? এ থেকে যে সিদ্ধান্ত পাওয়া যায় তা এই আইন-কানূন রচনার এখতিয়ার সরকারের রয়েছে। এই এখতিয়ারের আওতা বহুত প্রশস্ত, এবং সুশৃংখল বাস্তব কর্মসূচী কার্যকর করার জন্য তার স্বাধীন ব্যবহার হওয়া উচিত।
২০. ভারত ও পাকিস্তানে যতগ্রলো গ্রন্থ আইনগত দিক থেকে নির্ভরযোগ্য মনে করা হয় সেগুলোর মধ্যে অপ্রাপ্ত বয়স্ক সন্তাদের সম্পর্কে বর্ণিত নীতিমালা কুরআন মজীদের উপর ভিত্তিশীল নয়। এই পবিত্র গ্রন্থে নাবালক শিশুদের সম্পর্কে যে বিধান রয়েছে তার কয়েকটি এখানে উল্লেখ করা হলঃ
(আরবি***************************)
“যে পিতা দুধপান-কাল পূর্ণ করতে চায়, তার জন্য মায়েরা তাদের সন্তাদের পূর্ণ দুই বছর দুধ পান করাবে। এমতাবস্থায় পিতার কর্তব্য যথারীতি তাদের (মায়েদের) ভরণপোষণের ব্যবস্থা করা। কারো উপর তার সামর্থের অধিক দায়িত্বভার চাপিয়ে দেয়া ঠিক নয়। কোন মাকে তার সন্তানের জন্য এবং কোন পিতাকে তার সন্তানের জন্য কষ্টে নিক্ষেপ করা উচিত নয় এবং উত্তরাধিকারীদেরও অনুরূপ কর্তব্য রয়েছে। কিন্তু তারা যদি পারস্পরিক সম্মতি ও পরামর্শক্রমে দুধপান বন্ধ রাখতে চায় তবে তাদের কারো কোন অপরাধ নাই। তোমরা যা কিছু মূল্য নির্ধনারণ করবে তা যদি নিয়মিত আদায় কর, তবে অন্য মেয়েলোক দ্বারা তোমাদের সন্তানদের দুধ পান করা চাইলে তোমাদের কোন পাপ নাই। আল্লাহকে ভয় কর এবং জেনে রাখ, তোমরা যা কিছু কর আল্লাহ তার সম্যক দ্রষ্টা” (সূরা বাকারাঃ ২৩৩)।
“তোমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী তোমরা যে স্থানে বাস কর তাদেরকে সেই স্থানে বাস করতে দাও, তাদের উত্ত্যক্ত করো না সংকটে ফেলার জন্য। তারা গর্ভবতী হয়ে থাকলে সন্তান প্রসব পর্যন্ত তাদের জন্য ব্যয় করবে, যদি তারা তোমাদের সন্তানদের দুধ পান করায় তবে তাদের পারিশ্রমিক দেবে এবং সন্তানের কল্যাণ সর্ম্পকে তোমরা সংগতভাবে নিজেদের মধ্যে পরার্মশ করবে। তোমরা যদি নিজ নিজ দাবীতে অনমনীয় হও তবে অন্য স্ত্রীলোক তার পক্ষে স্তন দান করবে”( সূরা তালাকঃ ৬)।
উপরোক্ত আয়াতগুলো আলোকে মায়েদেরকে পূর্ণ দুই বছর পর্যন্ত শিশুদের স্তনদান করতে হবে। পিতাকে যাবতীয় খরচ বহন কর হবে যার মধ্যে বাহ্যত শিশু ও মা উভয়ের জন্য ব্যয় অন্তরভূক্ত রয়েছে। এ থেকে শীআ আইনের সর্মথন পাওয়া যায় আলোকে সন্তানের ব্যাপারে মায়ের অভিভাবকত্বের অধিকার দুই বছর পর্যন্ত সীমিত। কিন্তু অভিভাবকত্ব সম্পর্কে ছেলে ও মেয়েদের মধ্যে যে পার্থক্য করা হয় তার সপক্ষে কুরআন থেকে আমি কোন বৈধ কারণ খুঁজে পাইনি। কুরআন মজীদ পিতা-মাতার প্রত্যেকের উপর এই জিম্মাদারী ন্যস্ত করে যে, তারা সন্তানের লালন পালন করবে। সন্তান থেকে না পিতাকে বঞ্চিত করা যায়, আর না মাতাকে। যাই হোক কুরআন মজীদে এমন কোন দিকনির্দেশনাই নাই যে, কোন মহিলা তালাকপ্রাপ্তা হওয়ার পর দ্বিতীয় বিবাহ করলে প্রথম স্বামী তার নিকট থেকে সন্তান কেড়ে নিতে পারে। সে দ্বিতীয় বিবাহ করেছে শুধুমাত্র এই কারণে যদি বাচ্চা থেকে বঞ্চিত করা যেতে পারে –তবে আমি এর কোন কারণ খুঁজে পাচ্ছি না যে, স্বামী দ্বিতীয় বিবাহ করার ক্ষেত্রে কেন বঞ্চিত হবে না? সৎমাতা সৎপিতার চেয়ে অধিক না হলেও অন্তত তার সমান কষ্টকর এবং বিপদজনক তো অবশ্যই।
যাই হোক নাবালকদের সম্পর্কে আইন প্রণয়ন সরকারের দায়িত্ব। কারণ কুরআন এ সম্পর্কে সম্পূর্ণ নীরব।
Guardianship and Words Act সম্পর্কে ধারণা করা যেতে পারে যে, নাবালকদের বিষয়সমূহ এই আইনের অধীন। পাকিস্তানের ইসলামী রাষ্ট্র অস্তিত্ব লাভ করার পর দেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ এই আইন অনুমোদন করেছিলেন। কিন্তু এই আইনেও মায়ের দ্বিতীয় বিবাহের পর নাবালক সন্তানদের অভিভাবকত্বের অধিকার কার উপর বর্তাবে সে সম্পর্কে কোন সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট নীতিমালা নাই। কুরআন এবং এই আইন উভয় অনুযায়ী একমাত্র বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে শিশুর কল্যাণ ও স্বাচ্ছন্দ্য বিধান। শিশুর কল্যাণ ও স্বাচ্ছন্দ্যের দাবী যদি এই হয় যে, বাচ্চা মায়ের কাছে থাকবে, তবে মায়ের দ্বিতীয় বিবাহ সত্ত্বেও বাচ্চা তার তত্ত্বাবধানেই থাকা উচিৎ। প্রতিটি মামলার রায় তার বিশেষ পরিস্থিতি, ধরন ও অবস্থার দিকে লক্ষ্য রেখে প্রদান করতে হবে।
২১. কুরআন ছাড়াও হাদীস অথবা সুন্নাতকে মুসলমানদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ কর্তৃক ইসলামী আইনের একটি অশেষ গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসাবে গ্রহণ করা হয়েছে। সুনির্দিষ্ট অর্থে হাদীস বলতে মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ (স)-এর বাণীকে বুঝায়। কিন্তু সাধারণভাবে হাদীস বলতে রসূলের কথা ও কাজকে বুঝায় যা তিনি পছন্দ বা অপছন্দ করেছেন অথবা অপছন্দ করেননি। ইসলামী আইনের উৎস হিসাবে হাদীসের মূল্য ও মর্যাদা কি তা পূর্ণরূপে হৃদয়ংগম করার জন্য আমাদের জানতে হবে যে, ইসলামী দুনিয়ার রসূলে পাক (স)-এর মর্যাদা ও গুরুত্ব কি? আমি এই রায়ের প্রাথমিক অংশে বলেছি যে, ইসলাম আল্লাহ প্রদত্ত একটি দীন। তা নিজের সনদ আল্লাহ এবং একমাত্র আল্লাহর নিকট থেকে লাভ করে। এটা যদি ইসলামের সঠিক ধারণা হয়ে থাকে তবে তা থেকে অপরিহার্যরূপে এই সিদ্ধান্ত বের হয়ে আসে যে, নবীর কথা, কাজ ও আচার-ব্যবহারের আল্লাহর তরফ থেকে আগত ওহীর সমান মর্যাদা প্রদান করা যেতে পারে না। তা থেকে সর্বাধিক এতটুকু অবগত হওয়ার জন্য সাহায্য নেয়া যেতে পারে যে, বিশেষ পরিস্থিতিতে কুরআনের ব্যাখ্যা কিভাবে করা হয়েছিল, অথবা কোন বিশেষ ব্যাপারে কুরআনের সাধারণ নীতিমালাকে বিশেষ ঘটনাবলীর উপর কিভাবে প্রয়োগ করা হয়েছিল? কোন ব্যক্তি অস্বীকার করতে পারে না যে, মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ ছিলেন একজন পূর্ণাংগ মানব। কোন ব্যক্তি দাবী করতে পারে যে, মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ যে সম্মান ও মর্যাদা পাওয়ার অধিকারী অথবা আমরা তাঁর জন্য যে সম্মান ও মর্যাদা প্রকাশ করতে চাই তার প্রকাশের শক্তি ও যোগ্যতা তার রয়েছে। কিন্তু রসূলদের মত তিনিও মানুষই ছিলেন। [অতপর বিজ্ঞ বিচারপতি নিম্নোক্ত আয়াতসমূহের অনুবাদসহ উধৃতি দেনঃ ১২:১০৯, ১৪:১০, ১১, ৩:১৪৩, ৭:১৮৮, ৪১:৬, ৫১:৫১। এসব আয়াতে মহানবী (সা)-এর ব্যক্তি সত্তার উল্লেখ রয়েছে। এরপর বিজ্ঞ বিচারপতি বলেন]-
তাঁকেও ঠিক সেইভাবে আল্লাহর বিধানের আনুগত্য করতে হত যেভাবে আমাদের করতে হচ্ছে, বরং সম্ভবত তাঁর যিম্মাদারী কুরআন মজীদের আলোকে আমাদের যিম্মাদারীর তুলনায় অনেক বেশী ছিল। তাঁর উপর যতটুকু নাযিল হত তার অধিক তিনি মুসলমানদের দিতে পারতেন না।
(আরবী**********************************************************)
“হে রসূল! তোমার রবের নিকট থেকে তোমার উপর যা কিছু নাযিল হয়েছে তা পৌঁছে দাও, যদি তা না কর তবে তো তুমি তাঁর বাণী পৌঁছে দিলে না। আল্লাহ তোমাকে লোকদের (ক্ষতি) থেকে রক্ষা করবেন। আল্লাহ কাফের সম্প্রদায়কে সৎপথে পরিচালিত করেন না”।–(সূরা মাইদাঃ ৬৭)।
২২. একথার উপর জোর দেয়ার জন্য কুরআন মজীদের আয়াতের উধৃতি দেয়া আমার জন্য নিষ্প্রয়োজন যে, মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ যদি বড়ই উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন মানুষ ছিলেন, কিন্তু তাঁকে আল্লাহর পরে দ্বিতীয় স্থানই দেয়া যেতে পারে। তার নিকট আল্লার পক্ষ থেকে আগত ওহী ছাড়াও মানুষ হিসাবে তিনি নিজেও কিছু চিন্তার অধিকারী ছিলেন এবং নিজের এই চিন্তার প্রভাবাধীনে কাজ করতেন। একথা সত্য যে, মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাক কোন পাপ করেননি। কিন্তু তাঁর দ্বারা ভুলত্রুটি তো হতে পারত এবং এই সত্য স্বয়ং কুরআনে স্বীকার করে নেয়া হয়েছে।
(আরবী*************************************************************)
“যেন আল্লাহ তোমার অতীত ও ভবিষ্যৎ গুনাহসমূহ মাফ করেন এবং তোমর প্রতি তাঁর অনুগ্রহ পূর্ণ করেন এবং তোমাকে সরল পথে পরিচালিত করেন”।–(সূরা ফাতহঃ ২)।
কুরআন মজীদের একাধিক স্থানে একথা বলা হয়েছে যে, মুহাম্মানুর রসূলুল্লাহ বিশ্বের জন্য এক উত্তম আদর্শ, কিন্তু তার অর্থ কেবলমাত্র এতটুকুই যে, কোন ব্যক্তিকে তাঁর মতই ঈমানদার, সত্যবাদী, কর্মতৎপর, ধর্মভীরু ও মুত্তাকী হওয়া উচিৎ। তার অর্থ এই নয় যে, আমরাও হুবহু তার মতই চিন্তাভাবনা করব এবং কাজকর্ম করব। কারণ তা হবে একটা স্বভাববিরুদ্ধ কথা এবং তদ্রুপ করা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। যদি আমরা তদ্রুপ করার চেষ্টা করি তবে জীবনটাই দুর্বিষহ হয়ে উঠবে।
২৩. একথাও সত্য যে, কুরআন মজীদ মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ (স)-এর আনুগত্য করার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছে। কিন্তু তার অর্থ শুধু এই যে, তিনি যেখানে আমাদেরকে একটি বিশেষ কাজ একটি বিশেষ পন্থায় করার নির্দেশ দিয়েছেন, আমরা সে কাজটি সেভাবে করব। আনুগত্য তো কোন নির্দেশেরই হতে পারে। যেখানে কোন নির্দেশ নাই সেখানে আনুগত্যও নাই আর আনুগত্যহীনতাও নাই। রসূলুল্লাহ (সা) যা কিছু করেছেন আমরাও ঠিক তাই করব কুরআনের আয়াত থেকে এরূপ অর্থ গ্রহণ অত্যন্ত কষ্টকর। পরিস্কার কথা হচ্ছে, কোন একক ব্যক্তির জীবনকালের ঘটনাবলীর অভিজ্ঞতা একটি সীমিত সংখ্যার অধিক লোকের জন্য নজীর সরবরাহ করতে পারে না, সেই একক ব্যক্তি নবীই হোক না কেন। একথা জোরের সাথে বলা উচিৎ যে, ইসলাম নবীকেও খোদা মনে করেনি। এটা সুস্পষ্ট কথা যে, কুরআন ও হাদীসের মধ্যে মৌলিক ও বাস্তব পার্থক্য রয়েছে। কোন জাতির জন্য বিশেষ ব্যাপারসমূহে নৈতিক বিধান কি হবে এবং একটি নির্দিষ্ট মামলার রায় কিভাবে প্রদত্ত হবে সে সম্পর্কে সুবিচার এবং সমসাময়িক পরিস্থিতির দাবী অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
(আরবী***************************************************)
“আমানত তার প্রকৃত মালিককে ফেরত দিতে আল্লাহ তোমাদের নির্দেশ দিচ্ছেন। তোমরা যখন মানুষের মধ্যে বিচারকার্য পরিচালনা করবে তখন ন্যায়পরায়ণতার সাথে বিচার করবে। আল্লাহ তোমাদের যে উপদেশ দেন তা কত উৎকৃষ্ট! আল্লাহ সবকিছু দেখেন”-(সূরা নিসাঃ ৫৮)।
(আরবী****************************************************************************)
“তারা মিথ্যা শ্রবণে অত্যন্ত আগ্রহশীল এবং অবৈধ আহারে অত্যন্ত আসক্ত। তারা যদি তোমার নকিট আসে তবে তাদের বিচার নিষ্পত্তি কর অথবা তাদের উপেক্ষা কর। তুমি যদি তাদের উপেক্ষা কর তবে তারা তোমার কোন ক্ষতি করতে পারবে না। আর যদি বিচার নিষ্পত্তি কর তবে ন্যায়বিচার কর। আল্লাহ ন্যায়পরায়ণদের ভালোবাসেন”-(সূরা মাইদাঃ ৪২)।
(আরবী*****************************************************************)
“অতএব তুমি এদিকে আহবান কর এবং তাতে দৃঢ়প্রতিষ্ঠিত থাক যেভাবে তুমি আদিষ্ট হয়েছ এবং তাদের খেয়াল-খুশীর অনুসরণ কর না। বল, আল্লাহ যে কিতাব নাযিল করেছেন আমি তাতে ঈমান আনি এবং আমি তোমাদের মাঝে ন্যায়বিচার করতে আদিষ্ট হয়েছি। আল্লাহ-ই আমাদের প্রতিপালক এবং তোমাদেরও প্রতিপালক। আমাদের কাজের জন্য আমরা দায়ী এবং তোমাদের কাজের জন্য তোমরা দায়ী। আমাদের ও তোমাদের মধ্যে কোন বিবাদ নাই। আল্লাহ-ই আমাদের একত্র করবেন এবং প্রত্যাবর্তন তাঁরই নিকট”-(সূরা শূরাঃ ১৫)।
ব্যক্তিগত এবং জাতীয় বিষয়সমূহের সমাধান পেশ করার জন্য আমরা স্থান-কালের পার্থক্য উপেক্ষা করতে পারি না।
২৪. চার খলিফা মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ (সা)-এর কথা, কাজ ও আচার-ব্যবহারের কতটা গুরুত্ব দিতেন তা জ্ঞাত হওয়ার কোন নির্ভরযোগ্য সাক্ষ্য বিদ্যমান নাই। কিন্তু বিতর্কের খাতিরে যদি স্বীকার করেও নেয়া হয়, তাঁরা লোকদের সমস্যালী এবং জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াবলীর সমাধান পেশ করার জন্য ব্যাপকভাবে হাদীসের ব্যবহার করতেন, তবে তাঁরা ঠিকই করেছেন। করণ তারা স্থান- কালের প্রেক্ষিতে আমাদের তুননায় মুহাম্মদুর রসুলুল্লাহর অধিকতর নিকটবর্তী ছিলেন। কিন্তু আবু হানীফ, যিনি ৮০ হিজরীতে জন্মগহণ করেন এবং ৭০ বছর পরে মারা যান, মাত্র ১৭ অথবা ১৮ টি হাদীস তার সামনে পেশকৃত সমস্ত মাসআলার সমধানেরে ক্ষেত্রে ব্যবহার করেন। খুব সম্ভব এর কারণ এই ছিল যে, তিনি চার খলীফার অনুরূপ রসূলুল্লাহ যুগের নিকটবর্তী ছিলেন না। তিনি তার সমস্ত সিদ্ধান্তের ভিত্তি কুরআনের লিখিত নির্দেশনামার উপর রাখেন এবং কুরআনের মূল পাঠের শব্দাবলীর পেছনে সেইসব সক্রিয় উপাদান অনুসন্ধানের চেষ্টা করেন যা এই নির্দেশের কারণ ছিল। তিনি যুক্তিপ্রদান ও সমাধান বের করার পর্যপ্ত শক্তির অধিকরী ছিলেন। তিনি বস্তব অবস্থার আলোকে কিয়াসের ভিত্তিতে আইনের মূলনীতি ও নিয়ম-প্রণালী প্রণয়ন করেন। হাদীসের সাহায্য ব্যতিরেকে সমসাময়িক পরিস্থিতির আলোকে কুরানের ব্যাখ্যা প্রদানের অধিকার যদি ইমাম আবু হানীফার থেকে, তবে অন্য মুসলমানদের এই অধিকার প্রদারে বিষয়টি অস্বীকার করা যায় না। কুনআন মজীদের ব্যাখ্যা এবং মোকদ্দামার মীমংসায় আবু হানীফার বক্তব্যকে তাঁর ছাত্রগণ এবং অনুসারীগণ চূড়ান্ত মনে করেননি। যাই হোক তিনি মানুষই ছিলেন এবং ভুলের শিকার হতে পারেন। তাই একক ব্যক্তির রায়ের উপর সীমাবদ্ধ থাকা সঠিক নয়। কোন জাতির নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ ঐক্যবদ্ধভাবে যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও আইন প্রণয়ন করে, কেবল তার অনুসরণই তাদের জন্য বাধ্যতামূলক হতে পারে। আবু হানীফা বিশ্বাস করতেন যে, সমাজের জন্য যেসব আইন ও নীতিমালার প্রয়োজন তার সবগুলো নয়, বরং তার মধ্যে কতিপয় কুরআনে বিদ্যমান আছে। পক্ষান্তরে পরবর্তীকালে আবির্ভূত লোকদের কতকের মত এই ছিল তা তারা সাধারণের দৃষ্টির সামনে নিয়ে এসেছেন। ও বিষয়ে আমরা যে ব্যাপক মতবিরোধ রয়েছে সে সম্পর্কে আমরা কোন মত এখানে প্রকাশ করতে চাই না। বর্তমানে আমরা যখন একটি সুসংগঠিত ও সুশৃংখল পৃথিবীতে বসবাস করছি এবং যে কোন প্রকারের বুদ্ধিবৃত্তিক অনুসন্ধান আমাদের জন্য সহজতর হয়েছে, ঠিক এ সময়ে হাদীসের আইনের উৎস হওয়ার বিষয়টি পর্যালোচনা করে দেখা আমাদের জন্য মোক্ষম সময়।
তাছাড়া এই বিষয়টিও চিন্তা করে দেখা দরকার যে, ইমাম আবু হানীফা অথবা তাঁর মত অপরাপর উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন ফকীহগণের বক্তব্যের অনুসরণ কি আমাদের জন্য বাধ্যতামূলক, নাকি বর্তমান বাস্তব পরিস্তিতির আলোকে আমাদের জন্যও কিয়াস ও ইসতিমবাতের অধিকার বহাল করা যেতে পারে?
২৫. ইসলামের সমস্ত ফকীহগণ একবাক্যে স্বীকার করেন যে, যুগের পরিক্রমায় কৃত্রিম ও জাল হাদীসের একটি স্তূপ ইসলামী আইনের এক বৈধ ও স্বীকৃত উৎস হিসাবে পরিগণিত হয়ে আসছে। মিথ্যা হাদীস স্বয়ং মুহাম্মদুর রসূলুল্লাহ (সঃ)-এর যুগে প্রকাশ পাওয়া শুরু করে। মিথ্যা ও ভ্রান্ত হাদীসের সংখ্যা এত বেড়ে গিয়েছিল যে, হযরত উমার (রা) তাঁর খিলাফাতকালে হাদীস বর্ণনার উপর বিধিনিষেধ আরোপ করেন, বরং বর্ণন নিষ্ধি করে দেন। ইমাম বুখারী ছয় লাখ হাদীসের মধ্য থেকে মাত্র নয় হাজার হাদীস সহীহ হিসাবে নিবার্চন করেন। আমি বঝতে পারি না যে, কোন ব্যাক্তি কি একথা অস্বীকার করতে পারে যে, কুরআনকে যেভাবে সংরক্ষিত করা হয়েছে তদ্রূপ প্রচেষ্টা রসূলুল্লাহ (স)- এর নিজের যুগে হাদীসসমূহের সংরক্ষণের জন্য নেয়া হয়নি। পক্ষান্তরে যে সাক্ষ্য বর্তমান রয়েছে তা এই যে, মুহাম্মদুর রসূলুল্লাহ কঠোরভাবে হাদীস সংরক্ষণ করতে নিষেধ করেছেন। মুসলিম শরীফের রিওয়ায়াত যদি সহীহ হয় তবে চরমভাবে নিষেধ করে দিয়েছেন। তিনি নির্দেশ দেন যে, কোন ব্যক্তি তাঁর হাদীসসমূহ সংরক্ষণ করে থাকলে সে যেন তা অবিলম্বে নষ্ট করে ফেলে।
(আরবী***********************************************)
এই হাদীস অথবা এ ধরনেরই একটি হাদীসের তরজমা মাওলানা মহাম্মদ আলী তার “দীন ইসলাম” নামক গ্রন্থের ১৯২৬ সনের সংস্কারণের ৬২ নং পৃষ্ঠায় এভাবে দিয়েছেনঃ “বর্ণিত আছে যে আবু হুরায়রা (রা) বলেন, রসূলুল্লাহ (স) আমাদের নিকট এলেন, তখন আমরা হাদীস লিখছিলাম। তিনি জিজ্ঞস করেন, তোমরা কি লিখছ? আমরা বললাম, হাদীস যা আমরা আপনার নিকট শুনি। তিনি বলেন, এ কি! আল্লাহর কিতাব ব্যতীত আরও একটি কিতাব?
মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ (স)-এর ইন্তেকালের পরপরই চার খলীফার যুগে হাদীস সংরক্ষণ অথবা সংকলন করা হয়েছিল বলে কোন সাক্ষ্য বর্তমান নাই। এই বাস্তব ঘটনার কি অর্থ হতে পারে? এটা গভীর পর্যালোচানা দাবী রাখে। একথা বলা যায় কি- মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ (সা) এবং তাঁর পরে আগত চার খলীফা হাদীস সংরক্ষণের চেষ্টা এজন্য করেননি যে, এসব হাদীস সাধারণ প্রয়োগের জন্য ছিল না? মুসলমানদের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক লোক কুরআন মুখস্ত করে নিয়েছিল। যখন ওহি আসত তার পরপরই লেখার যেসব উপরকণ সহজলভ্য হত তার উপর লিখে নেয়া হত এবং এই উদ্দেশ্যে রসূলে করীম (স) কতিপয় সুশিক্ষিত সাহাবীকে নিয়োগ করেছিলেন। কিন্ত হাদীস সম্পর্কে বলা যায় যে, তা না মুখস্ত করা হয়েছিল, আর না সংরক্ষণ করা হয়েছিল। তা এমন লোকদের মগজে লুক্কায়িত ছিল যারা ঘটনাক্রমে কখনো অন্যদের সামনে তা বর্ণনা করার পরপরই মরে গেছে। এমনকি রসূলের ওফাতের কয়েক শত বছর পর তা সংগ্রহ ও সংকলনাবদ্ধ করা হয়। আমার ধারণামতে এই সম্পর্কে জানার জন্য একটি পূর্ণাংগ ও সুসংগঠিত গবেষণা পরিচালনার এখনই সময় এসছে যে, আরবদের আশ্চর্যজনক স্মৃতিশক্তি এবং অভাবনীয় স্মরণশক্তির অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও হাদীসকে বর্তমান আকারে নির্ভরযোগ্য ও সহীহ বলে মেনে নেয়া যায় কি? একথা স্বীকার করা হয় যে, পরবর্তীকালে প্রথম বারের মত রসূলুল্লাহ (স)-এর প্রায় একশত বছর পর হাদীসসমূহ সংগ্রহ করা হয়েছে, কিন্তু তার রেকর্ড আজ দুষ্প্রাপ্য। এরপর তা নিম্নোক্ত ব্যক্তিগণ সংগ্রহ করেনঃ ইমাম বুখারী ( মৃ.২৬৫ হি.) ইমাম মুসলিম
( মৃ.২৬১ হি.) আবু দাউদ (মৃ.২৭৫ হি.) জামে তিরমিযী ( মৃ ২৭৯ হি.) সুনানে নাসাঈ ( মৃ. ৩০৩ হি.) সুনানে ইবনে মাজা (মৃ ২৮৩ হি.) সুনানুদ দারীবী ( মৃ ১৮১ হি.) বায়হাকী (জ. ৩৮৪ হি.) ইমাম আহমাদ ( জ.১৬৪ হি.) শীআ সম্প্রদায় হাদীসের সংকলকদের যেসব সংকলনকে নির্ভরযোগ্য মনে করে তা এই যে, আবু জাফর (৩২৯ হি.), শায়খ আলী ( ৩৮১ হি.) শায়খ আবু জাফর মুহাম্মদ ইবনে আলী ইবনে হুসাইন ( ৪৬৬ হি.) সাইয়্যেদ আর-রাদী (৪০৬ হি.) বাহ্যতই এসব সংকলন ইমাম বুখারী প্রমুখের সংললনের আরো পরে তৈরী হয়। এমন হাদীস খব কমই আছে যার সম্পর্কে হাদীসের এই সংকলকগণ একমত হতে পেরেছেন। এই জিনিস ( মতানৈক্য) কি হাদীসসমূহের উপর তথ্যানুসন্ধানের কাজ অপর্ণ করা হবে তারা অবশ্যই এদিকে দৃষ্ট রাখবে যে, হাজার হাজার জাল হাদীস ছড়ানো হয়েছে যাতে ইসলাম ও মুহাম্মদুর রসূলুল্লাহ দুর্নাম গাওয় যেতে পারে। তাদেরকে এদিকেও দৃষ্টি রাখতে হবে যে, আরবদের স্মৃতিশক্তি যতই শক্তিশালী হোক না কেন-শুধুমাত্র স্মৃতিশক্তি থেকে নকলকৃত বিবরণ কি নির্ভরযোগ্য মনে করা যেতে পারে? শেষ পযর্ন্ত বর্তমান আরবদের স্মৃতিশক্তি তো তদ্রুপই রয়ে গেছে যেরূপ স্মৃতিশক্তি তেরশত বছর পূর্বে তাদের পূর্বপুরুষদের থেকে থাকবে। আজকাল আরবদের যা কিছু স্মরণশক্তি আছে তা আমাদের এই সিদ্ধান্তে পৌছতে এক গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশিকা হিসাবে কাজে আসতে পারে যে, যেসব রিওয়ায়াত আমাদের পযর্ন্ত পৌছেছে তা সঠিক ও যর্থাথ হওয়ার বিষয়টি কি নির্ভরযোগ্য? আরবদের বাড়াবাড়ি এবং যেসব বর্ণনাকারীর মাধ্যমে এসব রিওয়ায়াত আমাদের পযর্ন্ত পৌছেছে তাদের নিজেস্ব ধ্যানধারণা ও গোড়াঁমিও অবশ্যই ব্যাপক আকারে রিওয়ায়ত নকল করতে গিয়ে তাকে কদাকার করে থাকবে। শব্দভান্ডারে এমন পরিবর্তন সূচিত হয় যা প্রতিটি মস্তিষ্কের নিজস্ব ছাঁচের ফলশ্রুতি হয়ে থাকে। প্রতিটি মস্তিষ্ক তা নিজস্ব কায়দায় উলটপালট করে, এবং শব্দভান্ডার যখন অনেক মস্তিষ্ক অতিক্রম করে আসে তখন যে কোন ব্যক্তি ধারণা করতে পারে যে, তার মধ্যে কত বিরাট পরিবর্তন মাধিত হয়? মানবীয় স্বভাব-প্রকৃতি সব জায়গায় একই রকম-এ সত্য আমরা উপেক্ষা করতে পারি না। আল্লাহ মানুষকে অপূর্ণাংগ বানিয়েছেন এবং মানবীয় পর্যবেক্ষণ চরম অপক্ক ও দুর্বল।
২৬. কোন ব্যাক্তি যদি হাদীসের ভান্ডার অধ্যয়ন করে তবে তার মধ্যে অন্তত এমন কতক হাদীস বর্তমান দেখতে পাবে, যেগুলোকে অভ্যন্তরীণ সাক্ষ্যের ভিত্তিতে যথার্থ বলে মেনে নেয়া কষ্টকর। ইতিপূর্বে বিজ্ঞ বিচারপতি অনবাদসহ যে হাদীস উল্লেখ করেছেন তা মিশকাত শরীফের ফযলুল করীম সাহেব কৃত ইংরেজী অনুবাদ থেকে নেয়া হয়েছে (১৯৩৮ সালের সংস্করণ), যা ভুল নকল করা হয়েছে। মূল মিশকাতের সাথে তুলনা করে আমরা ভুল সংশোধন করে দিয়েছি- (গোলাম আলী)
“আতা থেকে বর্ণিত! তিনি বলেন, আমি আয়েশার নিকট গেলাম। আমি তাঁকে বললাম, আপনি মহানবী (স)- এর মধ্যে যে সর্বাধিক পছন্দনীয় বিস্ময়কর জিনিস দেখেছেন তা বলুন। আয়েশা কেঁদে দিলেন এবং বললেন, মহানবী ( স)-এর কোন অবস্থাটি আশ্চর্যজনক ও আনন্দদায়ক ছিল না!
১.এই বাক্যাংশের অনুবাদ রায়ের মূল পাঠ এভাবে করা হয়েছেঃ “এর চেয়ে অধিক আশ্চর্যজনক ও পছন্দনীয় কথা কোনটি হতে পারে।‘ এই অনুবাদ সঠিক নয়
এক রাতে তিনি এলেন এবং আমার সাথে আমার বিছানা অথবা লেপের মধ্যে ঢুকে পড়লেন। এমনকি আমার দেহ তাঁর দেহ স্পর্শ করল। অতপর তিনি বলেন, হে আবু বকর-এর কন্যা! আমাকে আমার প্রতিপালকের ইবাদত করতে দাও।
২. এই অংশের অনাবাদ রায়ের মূল পাঠে এভাবে আছেঃ আমাকে ছেড়ে দাও, তুমি ক তোমার প্রতিপালকের ইবাদত করবে?” এ অনুবাদ সঠিক নয়।
আমি বললাম, আপনার নৈকট্য আমার পছন্দনীয়, কিন্তু আমি আপনার আকাংখাকে অগ্রাধিকার পাওয়ার যোগ্য মনে করি। তাই আমি আপনাকে অনুমতি দিলাম। তিনি পানিভর্তি একটি কলসের নিকট গেলেন, উযু করলেন এবং অধিক পানি প্রবাহিত করেননি। অতপর তিনি দন্ডায়মান হয়ে নামায পড়াতে থাকেন এবং এতটা বেশী কাঁদেন যে, চোখের পানি তাঁর বুকে গড়িয়ে পড়ে। তিনি ক্রন্দনরত অবস্থায় রুকূ করেন, জিসদা করেন। এবং মাথা উত্তেলন করেন। তিনি এভাবে অবিরত কাঁদতে থাকেন। অবশেষে বিলাল এসে তাকে নামাযের (ওয়াক্ত হওয়ার) খবর দেন। আমি বললাম, হে আল্লাহর রসূল! আপনি কেন কাঁদেন, অথচ আল্লাহ আপনার পূর্বাপর সব গুনাহ মাফ করে দিয়েছেন। মহানবী (স) বলেন, আমি একজন কৃতজ্ঞ বান্দ হব না?
(আরবী*************************)
আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, মহানবী (স) তাঁর কোন স্ত্রীকে চুমা দিতেন অতপর উযু না করেই নামায পড়ে নিতেন।
(আরবী****************************)
“উম্মে সালমা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, উম্মে সুলাইম (রা) বললেন, হে আল্লাহর রসূল! আল্লাহ তাআলা সত্য প্রকাশের ব্যাপারে লজ্জাবোধ করেন না। মহিলাদের স্বপ্নদোষ হলে কি গোসল করতে হবে? তিনি বলেন, হাঁ, যখন সে বীর্যপাতের চিহ্ন দেখতে পায়। উম্মে সালমা (রা) লজ্জাবশত মখমন্ডল ঢেকে নেন এবং বলেনঃ হঁ, তোমার ডান হাত ধুলিমলিন হোক। বাচ্চা মায়ের সাদৃশ্য কিভাবে পায়ে (বুখারী, মুসলিম)।
মুসলিমে উম্মে সুলাইমের বর্ণনায় আছেঃ পুরুষদের বীর্য গাড় ও সাদা এবং মহিলাদের বীর্য পাতলা এবং হলুদ বর্ণ। এর মধ্যে যার বীর্যের প্রভাব অধিক হয় সন্তান তার সদৃশ্য পায়।“
(আরবী********************************)
“মুআযা থেকে বর্ণিত। তিনি বলে, আয়েশা (রা) বলেছেন, আমি ও রসূলুল্লাহ (স) একই পাত্রের পানি দিয়ে গোসল করতাম। পাত্রটি আমাদের উভয়ের মাঝখানে রাখা থাকত। তিনি আমার চেয়ে দ্রুত (গোসল) করতেন, এমনকি আমি বলতাম, আমার জন্য (পানি) অবশিষ্ট রাখুন। মুআযা বলেন, তাঁরা উভয়ে তখন নাজাকীর গোসল করতেন।“
(আরবী************************)
আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, “রসূলুল্লাহ (স)-এর নিকট এক ব্যাক্তি সম্পর্কে বিধান জিজ্ঞাসা করা হল যে, সে ( পরিধেয় বস্ত্র) ভিজা দেখতে পায় কিন্তু স্বপ্নদোষ হয়েছে কি না তা স্মরণ করতে পারছে না। তিনি বলেনঃ সে গোসল করবে। আরও এক ব্যক্তি সম্পর্কে বিধান জিজ্ঞাসা করা হয় যার স্বপ্নদোষের কথা স্মরণ আছে কিন্তু ভিজা দেখতে পাচ্ছে না। তিনি বলেনঃ তার উপর গোসল অপরিহার্য নয়। উম্মে সুলাইম ( রা) বলেন, যদি মেয়েরা তা দেখে তবে তাদের কি গোসল করতে হবে? তিনি বলেনঃ হাঁ, মেয়েরা পুরুষদের অর্ধাংশ
(আরবী****************)
আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলু্ল্লাহ ( স) বলেছেনঃ যৌনাংগের অগ্রভাগ পরস্পরের সাথে যুক্ত হলেই গোসল অপরিহার্য হয়। আমি ও রসুলুল্লাহ (স) এরূপ করেছি এবং গোছল করেছি।
(আরবী***********************)
আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ ( স) নাপাকির গোসল করার পর ( পুনরায় সংগম করার জন্য আমার সাথে মিশে শরীর গরম করতেন আমার গোসল পূর্বে।
(আরবী************************)
“আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, মহানবী (সা) এবং আমি একই পাত্র থেকে পানি তুলে গোসল করতাম-এই অবস্থায় যে, আমরা উভয়ে নাপাক ছিলাম। আমার মাসিক খতু অবস্থায় তিনি আমাকে শক্ত করে পাজামা পরিধানের নির্দেশ দিতেন এবং আমার সাথে আলিংগনাবদ্ধ হতেন। তিনি ইতেকাফ অবস্থায় নিজের মাথা (মসজিদের বাইরে) বের করে দিতেন এবং আমি মাসিক ঋতু অবস্থায় তা ধুয়ে দিতাম”।
(আরবী**************************************************************)
“আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত। আমি মাসিক ঋতু অবস্থায় পাত্র থেকে পান করতাম, অতপর তা মহানবী (সা)-এর দিকে এগিয়ে দিতাম। তিনি পাত্রের ঠিক সেই স্থানে মুখ লাগাতেন যেখানে আমার মুখ লেগেছে, অতপর তা মহানবী (সা)-কে দিতাম এবং তিমি আমার মুখ লাগানো স্থানে মুখ লাগিয়ে তা খেতেন”।
(আরবী************************************************************)
“আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি হায়েযগ্রস্ত হলে বিছানা ত্যাগ করে চাটাইয়ের উপর আশ্রয় নিতাম। অতপর পবিত্র না হওয়া পর্যন্ত আমি রসূলুল্লাহ (স)-এর নিকটবর্তী হতাম না”।–[রায়ের মূলপাঠে এ হাদীসের নকলকৃত শব্দাবলী ও অনুবাদ কিছু কিছু ভুল ছিল যার ফলে হাদীসের তাৎপর্য বিকৃত হয়ে যায়। এখানে সেসব ত্রুটি সংশোধন করে দেয়া হয়েছে-(গোলাম আলী)। ]
(আরবী********************************************************************)
“আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, মহানবী (সা) আমাকে বললেনঃ মসজিদ থেকে চাটাই তুলে আমাকে দাও। আমি বললাম, আমি হায়েয অবস্থায় আছি। তিনি বলেনঃ হায়েযের (চিহ্ন) তোমার হাতে তো লেগে নেই (অর্থাৎ তুমি হাত বাড়িয়ে দিয়ে মসজিদ থেকে চাটাই নিত পার)”।
২৭. উপরোক্ত অনেকগুলো হাদীসে যে বিষয়বস্তুর বর্ণনা দেয়া হয়েছে তা হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রা) ও হযরত উম্মে সালামা (রা)-র সাথে সংযুক্ত যে কোন দিক থেকে পূর্ণাংগ ছিলেন, তাঁরা এতটা ল্যাংটাভাবে নিজেদের এসব গোপনীয় বিষয় প্রকাশ করে থাকবেন যা তাদের ও মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ (স)-এর মধ্যে স্বামী-স্ত্রী হিসাবে ঘটে থাকবে।
২৮. আমি নিজেকে একথা বিশ্বাস করাতে পারিছি না, মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ (সা) একথা বলে থাকবেন যে, দোযখের অধিকাংশ অধিবাসী হবে নারী এবং জান্নাতের অধিকাংশ অধিবাসী হবে গরীব।
(আরবী********************************************************************)
“উসামা ইবনে যায়েদ (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ আমি জান্নাতের দরজায় দাঁড়ালাম এবং (দেখতে পেলাম) তাতে যেসব লোক প্রবেশ করছে তাদের অধিকাংশ ছিল দরিদ্রয মিসকীন, এবং সম্পদশালী লোকদের প্রতিরোধ করে রাখা হল। এছাড়া যেসব লোক দোযখে যাওয়ার উপযোগী তাদের দোযখে নিক্ষেপের নির্দেশ দেয়া হল। আমি দোযখের দরজায় দরজায় দাঁড়ালাম এবং (দেখতে পেলাম যে,) তাতে প্রবেশকারী অধিকাংশই নারী”।
[রায়ের মূল পাঠে (আরবী******) –এর অনুবাদ In anahion to উল্লেখ আছে। এই অনুবাদ সঠিক নয় –(গোলাম আলী)।]
(আরবী*********************************************************************)
“ইবনে আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ আমি জান্নাতে উকি মেরে দেখঝলাম, তার অধিকাংশ গরীব। আমি দোযখের দিকে উঁকি মেরে দেখতে পেলাম, তার অধিকাংশ বাসিন্দা নারী”।
২৯. এর অর্থ কি এই যে, মুসলমানদের জন্য যে কোন উপায়ে ধনসম্পদ উপার্জন নিষিদ্ধ করা হয়েছে? কেননা তারা যদি ধনসম্পদ উপার্জন করে তাদের জান্নাতে প্রবেশের সম্ভাবনা কম থাকবে। সকল মুসলমান যদি গরীব হয়ে যায় তবে তাদের কি অবস্থা হবে? তারা কি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যাবে না? এভাবে কি জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তাদের উন্নতি ব্যাহত হবে না? উপরন্তু এটা কি বিশ্বাসযোগ্য যে, বুখারীর ৮৫২ পৃষ্ঠায় ৭৪/৬০২ নং রিওয়ায়াতে আবদুল্লাহ ইবনে কায়সের সূত্রে বর্ণিত, “জান্নাতে একটি তাঁবুর বিভিন্ন স্থানে উপবিষ্ট নারীদের সাথে মুসলমানরা সহবাস করবে” –এরূপ কথা কি মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ (সা) বলে থাকবেন? হাদীসসমূহ এবং কুরআনের প্রাচীন তাফসীরসমূহ ইসলামের সীমা-পরিসীমা সংকীর্ণ করে দিয়েছে এবং তার ব্যাপকতা সীমিত হয়ে পড়ে আছে। এই অবস্থা বহাল থাকতে দেয়া কি আমাদের উচিৎ?
৩০. বিতর্কের খাতিরে যদি এটা স্বীকার করে নেওয়া হয় যে, মুহাদ্দিসগণ যেসব হাদীস সংকলন করেছেন তা সঠিক, তবুও একথার সাক্ষ্য বর্তমান আছে যে, এসব হাদীসের সম্পর্ক যদি দীনের সাথে না হয়ে থাকে তবে রসূলুল্লাহ (সা) এগুলোকে ‘শেষ কথার’ মর্যাদা দিতে চাইতেন না। মুসলিম শরীফে নিম্নোক্ত হাদীস রিওয়ায়াত করা হয়েছেঃ
(আরবী*********************************************************************************)
“রাফে ইবনে খাদীজা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, মহানবী (সা) মদীনায় এসে দেখতে পান যে, মদীনার লোকেরা পুরুষ খেজুর গাছের কেশর স্ত্রী খেজুর গাছের কেশরের সাথে যুক্ত করছে। তিনি বলেনঃ তোমরা কি করছ> তারা বলল, আমরা আগে থেকে এমনটি করে আসছি। তিনি বললেনঃ তোমরা যদি তা না করতে তবে মনে হয় ভালো হত। অতএব একথা তাঁর নিকট উল্লেখ করলে তিনি বলেনঃ আমি একজন মানুষ। আমি যখন তোমাদের দীনের ব্যাপারে তোমাদের কোন নির্দেশ দিই তা গ্রহণ কর। আর আমি যখন নিজের রায় থেকে কিছু বলি সেক্ষেত্রে আমি একজন মানুষই”।
এছাড়া একাধিখ হাদীসে নিজেদের সংগ্রহকৃত হাদীসসমূহের যথার্থতা সম্পর্কে নিশ্চিত ছিলেন না –শুধু এই একটি মাত্র বাস্তব ঘটনা থেকেই প্রতীয়মান হয় যে, তাঁরা মুসলমানদের বলেন না যে, তোমরা আমাদের জমাকৃত হাদীসগুলো যথার্থ বলে গ্রহণ কর। বরং তাঁরা বলেন, এগুলোকে আমাদের উদ্ভাবিত হাদীসের যথার্থতা যাচাইয়ের মানদণ্ডে যাচাই করে তোমরা নিশ্চিন্ত হও। এসব হাদীসের যথার্থতা সম্পর্কে তাঁরা যদি নিশ্চিত হতেন হবে যাচাইয়ের প্রশ্ন ছিল সম্পূর্ণ নিরর্থক ও নিষ্প্রয়োজন”।
৩২. এমন কতিপয় হাদীস রয়েছে যা মানুষের দৃষ্টি এই জগত থেকে ফিরিয়ে দেয়। আধ্যাত্মিকতা একটি উত্তম জিনিস, কিন্তু অনর্থক এটাকে চরম পর্যায়ে পৌঁছানোর অনুমতি ইসলাম আমাদের দেয় না। মূলগতভাবে আল্লাহ তাআলা আমাদের মানুষ বানিয়েছেন এবং তিনি চান যে, আমরা মানুষ হিসাবেই জীবন যাপন করি। তিনি যদি চাইতেন যে, আমরা আধ্যাত্মিক জীব অথবা ফেরেশতা হয়ে যাই তবে তার জন্য এর চেয়ে সহজ কথা আর কিছুই ছিল না যে, তিনি আমাদের তাই বানাতেন। যথার্থ ইসলামী আইন অনুযায়ী মুসলমানদের শক্তি ও সম্পদ শুধুমাত্র জীবনকে ফলপ্রসূ, উন্নততর এবং পরিপূর্ণরূপে সৌন্দর্যময় করার উদ্দেশ্যে বয় করা উচিৎ।
৩৩. আমরা হাদীসসমূহ অধ্যয়ন করলে জ্ঞাত হতে পারি যে, অধিকাংশ হাদীস খুবই সংক্ষিপ্ত ও সম্পর্কহীন যা পূর্বাপর সম্পর্কে ও যথাস্থান থেকে বিচ্ছিন্ন করে বর্ণনা করা হয়েছে। এগুলো সঠিকভাবে হৃদয়ংগম করা এবং এর যথার্থ তাৎপর্য ও দাবী নিরূপণ করা সম্ভব নয় –যতক্ষণ তার পূর্বাপর সম্পর্কের বিষয়টি সামনে না রাখা হবে এবং সেই পরিস্থিতি জ্ঞাত না হওয়া যাবে যে অবস্থায় রসূলে পাক কোন কথা বলেছেন অথবা কোন কাজ করেছেন। যাই হোক হাদীস শাস্ত্রের সম্পূর্ণ নতুনভাবে যাচাই-বাছাই ও তথ্যানুসন্ধানের প্রয়োজন রয়েছে। একথা বলা হয়েছে এবং যথার্থই বলা হয়েছে যে, হাদীস কুরআনের বিধানসমূহ রহিত করতে পারে না। কিন্তু অন্ততপক্ষে একটি বিষয়ে তো হাদীসসমূহ কুরআন পাকের সংশোধন করে ছেড়েছে, এবং তা ওসিয়্যাতের বিষয়টি। হাদীসসমূহ সম্পর্কে গভীর চিন্তাভাবনা ও বিবেচনার পর আমি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছতে বাধ্য হচ্ছি যে, এগুলোকে তার বর্তমান আকারে কুরআনের সমান মর্যাদা দেয়া উচিৎ নয়, আর তার প্রয়োগকে সাধারণ মনে করাও উচিৎ হয়। মুহাদ্দিসগণের সংগৃহীত হাদীসসমূহকে ইসলামী আইনের উৎসসমূহের মধ্যে একটি উৎস হিসাবে গ্রহণ করার পক্ষপাতী আমি নই –যতক্ষণ না তা পুনর্বার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হবে এবং এই পরীক্ষা-নিরীক্ষাও সংকীর্ণ দৃষ্টিভংগী এবং গোঁড়ামির উপর ভিত্তিশীল হওয়া উচিৎ নয়। বরং ইমাম বুখারী প্রমুখ অংখ্য মিথ্যা, মনগড়া ও জাল হাদীসসমূহ থেকে সহীহ হাদীসসমূহ পৃথক করার জন্য যে নীতিমালা ও শর্তাবলী নির্ধারণ করেছিলেন তাও সম্পূর্ণ নতুনভাবে ব্যবহার করতে হবে। অনন্তর বাস্তব অবস্থা ও অভিজ্ঞতা আমাদের যেসব মানদণ্ড দান করেছে তাও কাজে লাগাতে হবে।
আমার আরও একটি মত এই যে, বর্তমান বাস্তব অবস্থার আলোকে কিয়াস ও ইসতিদলাল-এর নাজুক সূক্ষ্ম পন্থাসমূহ কাজে লাগিয়ে বিচারকদের এবং জনসাধারণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কুরআন পাকের তাফসীর রচনা করতে হবে। আবু হানীফা ও অনুরূপ অপরাপর ফকীহগণ যেসব সিদ্ধান্ত ব্যক্ত করেছেন এবং যা বিভিন্ন গ্রন্থে উল্লেখিত আছে সেগুলোকে নজীর হিসাবে এতটুকু মর্যাদা দেয়া যেতে পারে যা সাধারণ বিচারালয়সমূহের রায়ের ক্ষেত্রে প্রদান করা হয়। কুরআন মজীদে উল্লেখিত বিধান স্থবির নয়, সক্রিয় এবং সুশৃংখল। সেইসব মানবীয় কর্মপন্থার সাথে কুরআন মজীদের ব্যাখ্যার ঐক্য ও সংগতি থাকা উচিৎ যা বর্তমান পরিস্থিতির দ্বারা প্রভাবিত হয় এবং বিভিন্ন উপাদান দ্বারা নির্ধারিত হয়। আবু হানীফার মত পার্থিব বিষয়সমূহের পর্যালোচনায় জ্ঞান ও বুদ্ধিবৃত্তিকে কাজে লাগাতে হবে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে পাক ভারত উপমহাদেশের মুসলমানদের আইন ব্যাপকভাবে রদবদলের প্রয়োজন রয়েছে এবং সেগুলোকে দেশের বর্তমান পরিস্থিতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে ঢেলে সাজানো অপরিহার্য।
[এরপর ৩৪ নং প্যারা থেকে ৪১ নং প্যারা পর্যন্ত বিজ্ঞ বিচারক আপীল মামলার মীমাংসাযোগ্য বিষয় অর্থাৎ অভিভাবকত্বের বিষয় সম্পর্কে আলোচনা করেছেন এবং এই রায় ব্যক্ত করেছেন যে, হাদীস সংকলকগণের রিওয়ায়াতসমূহকে যদি সঠিক এবং কুরআনের মত তার আনুগত্য বাধ্যতামূলক বলে স্বীকার করেও নেয়া হয়, তবুও তা থেকে অভিভাবকত্বের বিষয়ে মুসলমানদের মধ্যে প্রচলিত ব্যক্তিগত আইনের সমর্থন পাওয়া যায় না। যদিও রায়ের এই অংশ সম্পর্কেও গভীর চিন্তা ও দৃষ্টি আকর্ষণের দাবী রাখে, তথাপি তা যেহেতু মূল সিদ্ধান্তের বিষয়বস্তুর সাথে সংশ্লিষ্ট এবং তা আলোচনার আওতায় টেনে আনা উদ্দেশ্য নয় –তাই এর অনুবাদও এখানে দেয়া হয়নি। এই অংশ মূল রায়ের ইংরেজী অংশে দেখা যেতে পারে।]