১ : জীবনের পথচলা
চিরন্তন ও জীবন্ত বাস্তবতা
কুরআন হচ্ছে মহান প্রেমময় আল্লাহর বাণী। সর্বকালের সকল মানুষের দিগদর্শন হিসেবেই পবিত্র কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে। কুরআনের মাধ্যমে আল্লাহ মানুষের সাথে কথা বলেছেন। কুরআন পড়ার মানে হচ্ছে আল্লাহর বাণী কে শ্রদ্ধা করা, তাঁর সঙ্গে কথা বলা, তাঁর পথে চলা। এ হচ্ছে জীবন সংগ্রামে জীবন দাতার সম্মুখীন হওয়া। আল্লাহ ছাড়া কোন মাবুদ নেই। তিনি চিরঞ্জীব এবং তিনি কারো মুখাপেক্ষী নন (সকলেই তাঁর মুখা পেক্ষী)। তিনিই তোমাদের জন্য অবতীর্ণ করেছেন মহাসত্যসহ মহা গ্রন্থ মানব জাতির দিক-নির্দেশনা হিসেবে। (আলে ইমরান-৩: ২-৩)
তাদের নিকট পবিত্র কুরআন ছিল এক জীবন্ত বাস্তবতা, যারা নবীজীর (সাঃ) মুখ থেকে সর্বপ্রথম ঐ বাণী শোনার সৌভাগ্য লাভ করেছিলেন। এ ব্যাপারে তাদের বিন্দুমাত্র সন্দেহ ছিলনা যে, নবীজীর (সাঃ) মাধ্যমে মহান প্রভু আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাদের সাথেই কথা বলছেন। আর একারণেই তাদের হৃদয় এবং মন সম্পূর্ণ ভাবে এর দ্বারা দখল হয়ে গিয়েছিল। তাদের দেহে কম্পন সৃষ্টি হয়েছিল এবং চোখ থেকে নেমে ছিল অশ্রুধারা। কুরআনের প্রতিটি শব্দকে অতি গভীরভাবে তাদের জীবনের অভিজ্ঞতা এবং উপলব্ধির সসাথে বাস্তবভাবে সঙ্গতিপূর্ণ দেখাছিলেন এবং এটাকে পরিপূর্ণভাবে তাদের জীবনের সাথে একাত্ম করে নিয়েছিলেন। তারা ব্যাক্তিগত এবং সামষ্টিকভাবে কুরআনের সংস্পর্শে এক নতুন জীবন দানকারী স্বাতন্ত্র্য ও বৈশিষ্ট্যে প্রজ্জ্বলিত হয়েছিলেন। ওইসব লোক একদা যারা মেষ চরাতেন, ঊট পালন করতেন এবং সামান্য ব্যাবসায়-বাণিজ্যে নিয়োজিত ছিলেন, তারাই এই মহান গ্রন্থ আল-কুরআনের বদৌলতে বিশ্বমানবতার নেতৃত্বে সমাসীন হলেন।
ঐ একই কুরআন আজ আমাদের কাছে রয়েছে। কুরআনের লক্ষ লক্ষ কপি আজ প্রচারিত। রাত-দিন বিরামহীনভাবে বাড়ী, মসজিদ ও মঞ্চ থেকে কুরআন তিলাওয়াত হচ্ছে। এর অর্থ বুঝানোর জন্য বিপুল পরিমাণ ব্যাখ্যামূলক রচনা-গ্রন্থাদির সমাহার হয়েছে। কুরআনের শিক্ষা ব্যাখ্যা করার জন্য এবং তদনুযায়ী জীবন পরিচালনার জন্য অব্যাহত গতিতে বের হয়ে এসেছে অনেক শব্দমালা। এতকিছু সত্ত্বেও চোখ আজ শুকনোই রয়ে যাচ্ছে, হৃদয় আলোকিত হচ্ছে না। মন কোন স্পর্শ অনুভব করছে না। বিপর্যয় এবং অধঃপতনই যেন আজ কুরআনের আনুসারীদের ভাগ্যের লিখন হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেন এমনটি হলো? কারণ কুরআনকে তো আমরা জীবন্ত বাস্তবতা হিসেবে গ্রহণ করে অধ্যয়ন করি না। আমরা মনে করি এটা অতীতকালের একটি পবিত্র গ্রন্থ। যাতে মুসলমান, কাফির, ইয়াহুদী ও খৃষ্টানদের কথা আছে। আর আছে এক সময়ে যারা বিশ্বাসী এবং মুনাফিক ছিলো, তাদের কথা।
১৪০০ বছর আগে কুরআন যেমন ছিল আজও কি তেমন শক্তিধর, প্রাণবন্ত, প্রেরণাদায়ক শক্তি হতে পারে? এটাই হচ্ছে সবচাইতে কঠিন প্রশ্ন, যার জবাব আমাদের অবশ্যই দিতে হবে, যদি আমরা কুরআনেরপথ-নির্দেশনা অনুযায়ী আমাদের লক্ষ্যস্থল নতুন করে নির্ধারণ করতে চাই।
মনে হয় এ পথে বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। কুরআন অবতীর্ণ হয়েছিলো সময়ের একটি নির্দিষ্ট পর্যায়ে। ঐ সময় থেকে আমরা অনেক পথ পরিভ্রমণ করে এসেছি। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব উন্নয়ন সাধিত হয়েছে এবং মানবেতিহাস উল্লেখযোগ্য সামাজিক পরিবর্তন সংঘঠিত হয়েছে। উপরন্তু আজ কুরআনের প্রাণবন্ত ভাষা সম্পর্কে সামান্য ধারণাই রয়েছে। কুরআনের অর্থ গভীরভাবে আত্মস্থ করার জন্য এবং এর পথের সন্ধান লাভের জন্য কুরআনের প্রকাশভঙ্গি, বাগধারা, রূপালংকার সম্পর্কে যতটুকু ধারণা থাকা প্রয়োজন, তাদের কাছে তা আশা করা যায় না। এতদসত্ত্বেও শাশ্বত স্রষ্টার বাণী হওয়ার কারণেই নিজস্ব বৈশিষ্ট্যাই সকল মানুষের জন্য কুরআনের পথ-নির্দেশনার এক সার্বজোনীন আবেদন রয়েছে। এই সত্যতার জন্যই আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে, কুরআনের প্রথম শ্রোতাদের মতই আমাদের পক্ষেও কুরআন বুঝা, হৃদয়ংগম করা, গ্রহণ করা সম্ভব হবে, পুরোপুরি না হলেও অন্ততপক্ষে একটি পর্যায় পর্যন্ত। আমাদের বিশ্বাস, পরিপূর্ণ সৌন্দর্য এবং ঐশ্বররযসহই আল্লাহর প-নির্দেশনা লাভের অধিকার এবং সুযোগ আমাদের আছে। অন্যথায় বলা যায়, একটি নির্দিষ্ট ভাষায়, একটি নির্দিষ্ট সময় ও স্থানে কুরআন অবতীর্ণ হওয়ার ঐতিহাসিক ঘটনা সংঘটিত হলেও যেহেতু কুরআনের বাণী চিরন্তন এবং সার্বজনীন, সেহেতু কুরআনকে বুঝা ও গ্রহণ করার সামর্থ আমাদের থাকা উচিত। মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের চিরন্তনতার কারণেই প্রথম প্রথম বিশ্বাসীদের মতই আমাদের, উচিত কুরআনের বাণির সাথে জীবনকে সম্পূর্ণ একাত্ম করে নেয়া এবং অপরিহার্যভাবে সকল বিষয়ে কুরআনের নির্ধারিত পথে চলা।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, কি করে এটা সম্ভব? এ সম্পর্কে খুবই স্পষ্ট করে বলা যায় যে, কুরআনের মধ্যে আমরা এমনভাবে প্রবেশ করি যেন আল্লাহ আজই এই মুহূর্তে আমাদের সাথে কথা বলছেন এবং যাবতীয় শর্তসমূহ পূরণ করে সে ধরনের একটা পরিস্থিতির যদি সম্মুখীন হই, তখনই কেবলমাত্র পবিত্র কুরআন বুঝা, হৃদয়ংগম করা বা গ্রহণ সম্ভব হবে।
প্রথমতঃ আল্লাহর বাণী হিসেবে কুরআন কি এবং আমাদের নিকট কুরআনের তাৎপর্য কি, তা আমাদের উপলব্ধি যে তৎপরতা দাবী করে – সকল মহিমা, ভালোবাসা, আকাঙ্ক্ষা, ইচ্ছাসহ তদনুযায়ী কাজ করতে হবে।
দ্বিতীয়তঃ সেইভাবে কুরআন পড়তে হবে, যেভাবে আমাদের পড়তে বলা হয়েছে আল্লাহর বাণিবাহক যেভাবে নির্দেশনা দিয়েছেন এবং যেভাবে তিনি এবং তাঁর সাহাবীগণ পড়েছেন।
তৃতীয়তঃ কাল, কৃষ্টি ও পরিবর্তনের প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে কুরআনের প্রতিটি শব্দকে আমাদের জীবনের বাস্তবতা, অভিজ্ঞতা ও সমস্যার সাথে সম্পর্কিত করতে হবে।
কুরআনের প্রথম শ্রোতাদের জন্য এটা ছিল তাদের সমকালীন প্রসংগ। কুরআনের ভাষা এবং রচনাশৈলী, যুক্তি এবং অলংকার, বাগধারা এবং রূপক, উপমা এবং উৎপ্রেক্ষা, কাল এবং ঘটনা সবকিছুই একটা বিশিষ্ট বৈশিষ্ট্যমন্ডিত। কুরআন অবতীর্ণ হওয়ার ঘটোনাটি যেহেতু তাদের নিজেদের কালের, সেহেতু কুরআনের প্রথম শ্রোতাগণ একদিকে যেমন ছিলেন এর সাক্ষী অন্যদিকে তেমনি তৎকালীন ঘটনা প্রবাহের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণকারী। এই একই সুযোগ আমাদের নেই। এতদ্সত্ত্বেও বলা যেতে পারে একই ব্যাপার আমাদের বেলায় ঘটতে বাধ্য।
আমাদের অবস্থানে থেকে কুরআন হৃদয়ংগম এবং অনুসরণ করলে আমরা দেখতে পাবো যে, আগের লোকদের কাছে এটা যেমনি ছিল সাম্প্রতিক বা সমকালীন, তেমনি আমাদের কাছেও। এর অন্তর্নিহিত কারণ এটাই যে, মানুষের সত্তার পরিবর্তন হয়নি এবং তা অপরিবর্তনীয়। কেবলমাত্র তার বাহ্যিক আচরণ, অবয়ব, ধরন ও প্রযুক্তির পরিবর্তন হয়েছে। মক্কায় পৌত্তলিকরা হয়তো বা নেই, নেই ইয়াসরিবের ইয়াহূদীগণ কিংবা নাজরানের খৃষ্টানগণ, মদীনার বিশ্বাসী এবং অবিশ্বাসীগণও নেই, কিন্তু আমরা আমাদের চারিদিকে একই চরিত্রের অস্তিত্ব অনুভব করি। প্রথম শ্রবণকারীদের মত আমরা অবিকল একই মানুষ। তথাপি এ সহজতম সত্যটির গভীর তাৎপর্য হৃদয়ংগম করা আমাদের অনেকের জন্য খুবই কঠিন।
আপনি যদি এই সত্য উপলব্ধি করতে সক্ষম হন এবং তা অনুসরণ করেন এবং যেভাবে প্রথম বিশ্বাসীগণ কুরআনের নিকটোবর্তী হয়েছিলেন, আপনার কাছেও ঠিক তেমনি মনে হবে যেমনটি মনে হয়েছিল তাদের নিকট এবং আপনারা তাদের মত ঘটনার অংশীদারে পরিণত হবেন, কেবলমাত্র তখনই কুরআন মজীদ একটি পবিত্র, মহিমান্বিত এবং অলৌকিক আশীর্বাদের গ্রন্থ হওয়ার পরিবর্তে প্রেরণাদায়ক, আলোড়ন সৃষ্টিকারী, গতিশীল এবং সুগভীর ও সর্বোচ্চ সাফল্যদানকারী শক্তিতে পরিণত হবে, যেমনটি হয়েছিল সেকালের লোকদেরজন্য।
নতুন পৃথিবীর হাতছানি
কুরআনের সান্নিধ্যে আসলে আপনি একটি নতুন পৃথিবীর সন্ধান পাবেন। আর কোন জিনিসই আপনার জীবনে কুরআনের দিকে সফরের মত এত মূল্যবান গুরুত্বপূর্ণ আশীর্বাদ্ময় এবং উত্তম ফলদায়ক হতে পারে না। যিন্দেগীর এই সফর আপনাকে এমনি এক অশেষ আনন্দ এবং সমৃদ্ধির দিকে নিয়ে যাবে যা আপনার স্রষ্টা এবং প্রভু আপনার এবং মানবজাতির জন্য পাঠিয়েছেন। আপনার চিন্তাধারা ও কর্মকান্ডকে পরিশীলিত করার জন্য জীবনে চলার পথের নির্দেশনা, জ্ঞান এবং প্রজ্ঞার এক অফুরন্ত ভান্ডারের সন্ধান পাবেন আপনি এই কুরআনে। এতে আপনি আবিষ্কার করতে পারবেন আপনাকে সমৃদ্ধ করার জন্য গভীর দূরদৃষ্টি এবং পাবেন সত্য পথে চলার জন্য উজ্জীবনী শক্তি। এ থেকে আপনি গ্রহণ করতে পারবেন আপনার অন্তরের গভীরতম প্রদেশকে আলোকিত করার প্রজ্জ্বল আলোক-রশ্মি। আপনার গাল বেয়ে নামার মত অশ্রুধারা এবং হৃদয় বিগলিত হওয়ার মত উত্তাপ আর নির্মল আবেগের মুখোমুখি হবেন আপনি এই মহাগ্রন্থে।
এটা আপনার জন্য খুবই কঠিন ব্যাপার হবে, যেহেতু কুরআনের পথে চলতে প্রতিটি পদক্ষেপে আপনাকে বেছে চলতে হবে। আল্লাহর প্রতি আপনার অকুন্ঠ আনুগত্য প্রকাশ করতে হবে। কুরআন পড়ার মানে হচ্ছে স্বতঃস্ফূর্ততা, আন্তরিকতা, গভীর মনোনিবেশ এবং সামগ্রিকভাবে কুরআনের সাথে বেঁচে থাকা। আপনি কিভাবে আল্লাহর ডাকে সাড়া দিবেন তার উপরই নির্ভর করে আপনার সারা জীবনের সাফল্য। সুতরাং কুরআনের পথে চলার উপর নির্ভর করে আপনার অস্তিত্ব। মানুষ এবং মানব সভ্যতার ভবিষ্যত।
শত শত নতুন শব্দ আছে এই পদাবলীতে
শতাব্দীর পর শতাব্দী সংশ্লিষ্ট আছে এর ক্ষণিকের মাঝে।
(জাভেদনামাঃ আল্লামা ইকবাল)
জেনে রাখুন, এই হচ্ছে মহাগ্রন্থ আল-কুরআন। শুধুমাত্র এই কুরআনই আপনাকে এ দুনিয়ায় এবং পরলোকে সত্যিকারের সাফল্য এবং পরলোকে সত্যিকারের সাফল্য এবং গৌরবের দিকে পরিচালিত করতে পারে।
কুরআন কি?
মানুষের জন্য কুরআনের গুরুত্ব এবং মহত্ত্ব যে কত বিশাল এবং ব্যাপক, তা বর্ণনা করা তার জন্য সাধ্যাতীত। তথাপি কুরআন যে প্রতিশ্রুতি, পূর্ণ মনোনিবেশ এবং বিরামহীন প্রচেষ্টা দাবী করে, তা নিয়ে যাতে আপনি নিজেকে পরিপূর্ণভাবে উদ্দীপনার সাথে কুরআনের মধ্যে নিমজ্জিত করতে পারেন, সেজন্য সূচনাতেই কুরআন কি এবং সে সম্পর্কে আপনাকে কিছু ধারণা নিতে হবে।
কুরআন আল্লাহর পক্ষ থেকে আপনার জন্য এক মহান নিয়ামত। এটি হচ্ছে হযরত আদম (আ) এবং তাঁর প্রতি প্রদত্ত মহান আল্লাহর প্রতিশ্রুতির পূর্ণতা।
অতঃপর আমার নিকট থেকে যে জীবনবিধান তোমাদের নিকট পৌঁছবে, যারা আমার সেই বিধান মেনে চলবে, তাদের জন্য কোন চিন্তা ও ভাবনার কোন কারণ থাকবে না। (আল-বাকারা ২:৩৮)
দুনিয়ার লোভ-লালসা এবং শয়তানী শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার জন্য এটিই হচ্ছে আপনার ক্ষণস্থায়ী অস্তিত্বের একমাত্র সহায়ক হাতিয়ার। আপনার ভয় এবং দুশ্চিন্তা দূর করার এটিই হচ্ছে একমাত্র মাধ্যম। অন্ধকারের অমানিশায় মুক্তি ও সাফল্যের পথ দেখার জন্য এটিই হচ্ছে একমাত্র আলোকবর্তিকা (নূর)।
আপনার ভিতরের অসুস্থতা এবং যে সামাজিক ব্যাধি আপনাকে প্রতিনিয়ত গ্রাস করতে চায়, তার একমাত্র নিরাময় (শিফা) এটিই। এ হচ্ছে আপনার প্রকৃতি, গন্তব্য, অবস্থান, দায়িত্ব-কর্তব্য এবং ধ্বংস সম্পর্কে স্থায়ী এক স্ম্রণিকা (যিক্র)।
কুরআনকে ধরাপৃষ্ঠে বহন করে আনেন বেহেশতের এক শক্তিধর এবং বিশ্বস্ত ফিরিশতা হযরত জিবরাইল (আ)। আল্লাহর নিকট থেকে বহন করে আনার পর কুরআনের প্রথম আবাস ছিল প্রিয় নবীজী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র এবং মহিমান্বিত আত্মা, যা আর কোন মানুষের সাথে তুলনীয় হতে পারে না।
সবচাইতে বড় কথা, এটিই হচ্ছে স্রষ্টার সান্নিধ্য এবং নৈকট্য লাভের একমাত্র পথ। এর মহাগ্রন্থ আপনাকে আল্লাহ এবং আল্লাহর গুণাবলী সম্পর্কে অবহিত করে। কিভাবে মহান স্রষ্টা নিখিল বিশ্ব শাসন করেন এবং আপনার সাথে অন্য মানুষের এবং মানুষের সাথে অন্য সৃষ্টির কি ধরনের সম্পর্ক হওয়া উচিত, তাও তিনি অবহিত করেছেন কুরআনে।
কুরআনের পথে চলার যে পুরষ্কার এ পৃথিবীতে নিঃসন্দেহে তা অনেক এবং আরো অফুরন্ত ও অনন্ত পুরষ্কার রয়েছে আখিরাতে। কিন্তু এই পথ শেষে যা আল্লাহ তায়ালা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, সে সম্পর্কে হযরত আব্য হুরায়রা (রা) বলেন, চোখ কখনো দেখেনি, কান শোনেনি, মানুষের হৃদয় কোনদিন অনুভব করেনি। ইচ্ছে হলে পড়ে দেখতে পারো সূরা আস্-সাজদা-১৭ আয়াতঃ
তাছাড়া তাদের কর্মের প্রতিফল স্বরূপ তাদের জন্য চক্ষু শীতলকারী যে সামগ্রী গোপন রাখা হয়েছে কোন প্রাণীরই তার খবর নেই।
অসীম করুণা এবং মহিমা
সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার যা কুরআনে পড়া হয়, তা বিশ্বজাহানসমূহের প্রভু মহান আল্লাহর বাণী। তিনি মানুষের দয়া, করুণা ও ভালোবাসার কারণেই মানবীয় ভাষায় তা মানব জাতিকে উপহার দিয়েছেন।
পরম দয়ালু যিনি কুরআন শিক্ষা দিয়েছেন (আর-রহমান-৫৫: ১-২)
তোমাদের প্রভুর নিকট থেকে একটি করুণা (আদ-দোখান-৪৪: ৬)
আল্লাহর মহিমা এত অসাধারণ শক্তির অধিকারী যা কোণ মানুষের পক্ষে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। আল্লাহ নিজেই বলেছেন-
আমরা যদি এই কুরআন কোন পাহাড়ের উপর অবতীর্ণ করে দিতাম, তাহলে তুমি দেখতে যে, তা আল্লাহর ভয়ে প্রকম্পিত হয়ে বসে যাচ্ছে এবং দীর্ণ-বিদীর্ণ হয়ে যাচ্ছে (আল-হাশর-৫৯ : ২১)
মহান আল্লাহর এই দয়া এবং মহিমা মানুষকে বিস্মিত এবং কৃতজ্ঞতার সর্বোচ্চ শিখরে উদবুদ্ধ করতে প্রচেষ্টায় অনুপ্রাণিত করার জন্য যথেষ্ট। প্রকৃতপক্ষে, কুরআনের চাইতে আর কোন সম্পদই মানুষের নিকট মূল্যবান হতে পারে না।
যেমন আল্লাহ বলেছেনঃ
হে মানব সমাজ! তোমাদের কাছে তোমাদের খোদার নিকট থেকে নসীহত এসে পৌঁছেছে, যা দিলের যাবতীয় রোগের পূর্ণ নিরাময়কারী, আর যে তা কবুল করবে, তার জন্য হিদায়াত ও রহমত নির্দিষ্ট হয়ে আছে। হে নবী, বলঃ এটি আল্লাহর অনুগ্রহ ও অপার করুণা যে, তিনি এটি পাঠিয়েছেন। এজন্য তো লোকদের আনন্দ-ফূর্তি করা উচিত। এটি সেইসব জিনিস থেকে উত্তম যা লোকেরা সংগ্রহ ও আয়ত্ত করছে (সূরা ইউনুস-১০ : ৫৭-৫৮)।
বিপদ ও ঝুঁকি
আল্লাহর দয়া, মহিমা এবং মহানুভবতা আপনাকে অবশ্যই উদ্বেলিত করবে, আনন্দিত করবে। আপনার মধ্যে প্রেরণা ও অনুসন্ধিৎসা জাগিয়ে তুলবে। কিন্তু কুরআন তাদের জন্য হিদায়াতের দরজা খুলে দেয়, যারা আল্লাহর এই করুণার গুরুত্ব বুঝে হৃদয়ের গভীর ব্যাকুলতা, আন্তরিকতা, ঐকান্তিক নিষ্ঠা এবং একাগ্রতা ও মনোনিবেশ সহকারে কুরআনের দ্বারস্থ হয়। তারাই কেবলমাত্র কুরআনের মহিমাময় সম্পদ আহরণ করতে পারে, কুরআন অনুশীলন করতে গিয়ে সর্বস্ব ত্যাগ করে কুরআনের নির্দেশ মানতে ও কুরআনের পথে চলতে ও তা গ্রহণ করতে রঅ্যাী হয়ে যায়।
এমন ঘটনা সংগঠিত হওয়া অসম্ভব নয় যে, একজন অব্যাহতভাবে কুরআন অধ্যয়ন করেন, পাতার পর পাতা উল্টান, চমৎকারভাবে প্রতিটি শব্দ আবৃত্তি করেন, গবেষকদের মত অনুশীলন করেন, তা সত্ত্বেও তার জীবনকে কুরআনের আলোয় সমৃদ্ধ এবং উজ্জীবিত করার মত পরিস্থিতির সম্মুখীন তিনি নাও হতে পারেন। কেননা, যারা কুরআন পড়েন, তাদের সকলেই কুরআনথেকে যেভাবে লাভবান হওয়া উচিৎ সেরূপ লাভবান হতে পারেন না। অনেকে কুরআনের আশীর্বাদ থেকে বঞ্চিত থাকে আর অনেকে অভিশপ্তও হতে পারে।
কুরআনের পথে আছে মূল্যবান এবং অফুরন্ত পুরস্কার, ঠিক তেমনি আছে ঝুঁকি আর বিপদ। হাতের কাছে থাকা সত্ত্বেও অনেকে এই মহাগ্রন্থের দিকে ফিরেও তাকায় না, অনেকে এর দরজায় গিয়েও ফিরে যায়। অনেকে প্রায়ই গ্রন্থটি পড়ে এবং শূন্য হাতে ফিরে। অনেকেই পড়ে কিন্তু সত্যিকার অর্থে কুরআনের গভীরে প্রবেশ করে না। অনেকে সন্ধান পায় কিন্তু হারিয়ে ফেলে। তারা আল্লাহর শব্দের মধ্যেও আল্লাহকে শুনতে পায় না। আল্লাহর পরিবর্তে তারা নিজেদের কন্ঠ, নিজেদের শব্দই শুনতে পায়। অনেকে আল্লাহরবাণী শুনতে পায়, কিন্তু আল্লাহর ডাকে সাড়া দেয়ার মত ইচ্ছাশক্তি , দৃঢ়তা, সাহস এবং আল্লাহর পথে চলার শক্তি অর্জনে তারা ব্যার্থ হয়। অনেকে তার যা আছে তাও হারায়, জীবনের মূল্যবান নুড়ি আহরণের পরিবর্তে হাড়ভাংগা পাথরের স্তুপ নিয়ে ফেরে, যা থেকে সারাটি জীবন আঘাতই পেয়ে থাকে।
কেউ যদি কুরআনের শরণাপন্ন হওয়া সত্ত্বেও অন্তরে সংস্পর্শ না লাগে, হৃদয় আলোড়িত না হয়, জীবন অপরিবর্তিত থেকে যায়, খালি হাতে ফিরেন, যেভাবে এসেছিলেন ঠিক সেভাবেই প্রত্যাবর্তন করেন, তাহলে তার চেয়ে মর্মানিতিক দুর্ভাগ্য আর কি হতে পারে?
পবিত্র কুরআনের মহিমা এবং আশীর্বাদ সীমাহীন। কিন্তু এ থেকে কে কতটুকু গ্রহণ করতে পারবে, তা সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করবে যে পাত্রে এটা গ্রহণ করা হবে তাতে কি পরিমাণ জায়গা আছে তার উপর। সুতরাং কুরআন অধ্যয়নের সূচনাতেই গভীরভাবে এ বিষয়টি সম্পর্কে সজাগ হতে হবে যে, কুরআন কি এবং কুরআনের দাবী কি? যথাযথভাবে কুরআন অধ্যয়নের জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হবে যাতে আপনি তাদের অন্তর্ভুক্ত হতে পারেন, যাদের সম্পর্কে কুরআন মজীদে বলা হয়েছেঃ
আমরা যাদের কিতাব দিয়েছি তারা যথোপযুক্তভাবে পড়ে, তারা এর প্রতি নিষ্ঠা সহকারে ঈমান আনে(বাকারা-২ : ১২১)।
কুরআন তিলাওয়াত
তিলাওয়াত এমন একটি শব্দ, যা কুরআন পড়ার কাজটি বোঝার জন্য কুরআনে ব্যাবহার করা হয়েছে। ইংরেজী বা অন্য কোন ভাষায় এক শব্দে সরাসরি এর অনুবাদ করা যায় না। ‘অনুসরণ’করা শব্দটির প্রাথমিক অর্থের সবচাইতে কাছাকাছি, পড়ার ব্যাপারটি দ্বিতীয় পর্যায়ের। কেননা, পড়ার মধ্যেও শব্দ শব্দকে অনুসরণ করে, একটির পর আরেকটি অত্যন্ত গভীরভাবে, সুশৃংখল এবং তাৎপর্যময় ধারাবাহিকতা বিদ্যমান। যদি একটি শব্দ অপরটিকে অনুসরণ না করে অথবা যদি বিন্যাস এবং ধারাবাহিকতা ক্ষুণ্ন হয়, তাহলে অর্থ বিকৃত হয়ে যায়।
সুতরাং প্রাথমিকভাবে তিলাওয়াত অর্থ ঘনিষ্ঠভাবে পশ্চাতে চলা, সামনে অগ্রসর হওয়া, ধারাবাহিকভাবে প্রবাহিত হওয়া, অভীষ্ট লক্ষয়ে পৌঁছার চেষ্টা চালানো, পথ-প্রদর্শোক, নেতা, প্রভু এবং আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করা, কর্তৃত্ব গ্রহণ করা, স্বেচ্ছায় গ্রহণ করা, আমল করা, পথ চলা, জীবন ব্যাবস্থার অনুশীলন করা, বুঝা, চিন্তার বাহনকে অনুসরণ করা অথবা অনুকরণ করা। কুরআন পাঠ করা, কুরআন বুঝা, কুরআন অনুসরণ করা। যারা দাবী করে যে, কুরআনের প্রতি তাদের বিশ্বাস আছে, এইভাবেই তারা নিজেদের জীবনকে এর সাথে সংশ্লিষ্ট করতে পারে।
তিলাওয়াত বা আবৃত্তি করা এমনই একটি কাজ যাতে একজন মানুষকে তার দেহ, হৃদয়, মন, ভাষা অর্থাৎ সংক্ষেপে গোটা মানবীয় অস্তিত্ব সহকারেই এতে অংশ নিতে হয়। কুরআন পড়তে দেহ ও মন, যুক্তি ও অনুভূতি তাদের পার্থক্য হারিয়ে ফেলে এবং সর্বস্বান্ত হয়ে যায়। যখন জিহবার সাহায্যে আবৃত্তি করা হয়, তখন ঠোঁট থেকে শব্দ বের হয়ে আসে, মন চিন্তা করতে করতে থাকে, হৃদয় প্রতিফলিত করে, আত্মা গ্রহণ করে, চোখ অশ্রুসজল হয়ে ওঠে, হৃদয়ে কম্পন সৃষ্টি হয়, শরীরে শিহরণ জাগে। আর এভাবেই সে তার প্রভুর আলোয় পথ চলে।
আল্লাহ অতি উত্তম কালাম নাযিল করেছেন- এ এমন এক কিতাব যার সমস্ত অংশ সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং যাতে বার বার একই কথার পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে। তা শুনে তাদের গাত্রে লোমহর্ষণ দেখা দেয়, যারা নিজেদের আল্লাহকে ভয় করে। পরে তাদের দেহ ও তাদের দিল নরম হয়ে আল্লাহর স্মরণে উৎসাহী ও উৎসুক হয়ে ওঠে। এ হচ্ছে আল্লাহর হিদায়াত, এর দ্বারা তিনি হিদায়াতের পথে নিয়ে আসেন যাকে তিনি চান। আর আল্লাহ যাকে হিদায়াত না করেন, তার জন্য হিদায়াতকারী কেউ নেই। (আয-যুমার-৩৯ : ২৩)।
যেভাবে কুরআন পাঠ করা উচিৎ, সেভাবে কুরআন পড়া সহজ কাজ নয়, কিন্তু খুব কঠিন বা অসম্ভবও নয়। অন্যথায় আমাদের মত সাধারণ লোকদের জন্য কুরআন পাঠানো হতো না কিংবা কুরআন সত্যিকার অর্থে যে করুণা ও পথ-নির্দেশনা দিয়ে থাকে, তা কেউ পেত না। কিন্তু স্পষ্টতই কুরআন অধ্যয়নে অনিবার্যভাবে হৃদয় ও মন, দেহ ও আত্মার কঠিন পরিশ্রম হতে বাধ্য। তাছাড়া অভ্যন্তরীন ও বাহ্যিকভাবে কতগুলো শর্ত মেনে চলতে হবে এবং অনিবার্য দাবী পূরণ করতে হবে। কুরআনের মহিমান্বিত জগতে প্রবেশের আগেই ঐসব বিষয় জানতে এবং তা পালনে যথাসাধ্য প্রচেষ্টা চালাতে হবে।
কেবলমাত্র তখনই মহান গ্রন্থ আল-কুরআনে মানুষের জন্য যে কল্যাণ ও মহিমা রয়েছে তা থেকে ফায়দা গ্রহণ বা ফল লাভ সম্ভব হবে। তখনই কুরআনের দরজা একজন মানুষের জন্য খুলে যাবে, কেবলমাত্র তখনই তিনি কুরআনের অভ্যন্তরে ঢুকতে পারবেন এবং কুরআন তার মধ্যে গভীর চিন্তা ও ভাবাবেগের উদ্রেক করবে। মায়ের গর্ভে নয় মাস অতিবাহিত করার পর এক ফোঁটা পানি হতে রূপান্তরিত হয়ে আপনি শ্রবণশক্তি, দৃষ্টিশক্তি ও চিন্তাশক্তির অধিকারী একজন জীবন্ত মানুষে পরিণত হন। আপনি কি কল্পনা করতে পারেন জীবনের কতটা সময় আপনি কুরআনের সাথে অতিবাহিত করতে পারেন- অনুসন্ধান, শ্রবণ, দেখা, চিন্তা ও সংগ্রাম করে এবং এটা আপনার জন্য কত প্রয়োজনে আসতে পারে। এটা আপনাকে এক সম্পূর্ণ নতুন মানুষে পরিণত করতে পারে যাদের অনেকের সামনে ফিরিশতারা পর্যন্ত মাথা নত করতে গৌরব বোধ করবেন।
কুরআনে গৃহীত প্রতিটি পদক্ষেপ এবং কুরআনের সাথের মুহূর্থগুলো অতিক্রমের মাধ্যমে আপনি অনুভব করবেন যে, আপনি ঊর্ধ্বমুখে আরোহণ করছেন। কুরআনের প্রবহমাণ শক্তি ও সোউন্দর্য আপনাকে আঁকড়ে ধরবে এবং আপনি হৃদয় দিয়ে তা উপলদ্ধি করতে থাকবেন। আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস (রা) থেকে বর্ণিত, নবী করীম (সা) বলেছেনঃ
কুরআনের সাথীকে বলা হবে, তিলাওয়াত কর এবং ঊর্ধ্বে আরোহণ কর। দৃঢ়ভাবে আরোহণ করতে থাকো ঠিক যেইভাবে সাবলীলভাবে তুমি কুরআন তিলাওয়াত করতে দুনিয়ায়। তোমার চূড়ান্ত প্রতীক্ষা হচ্ছে সেই উচ্চতা যা ভূমি সর্বশেষ আয়াতে পাঠ করেছ। (আবু দাউদ, তিরমিযী, আহমাদ, নাসাঈ)।