২ : মৌলিক পূর্বশর্তাবলী
কুরআনের সাথে সফল সম্পর্কের জন্য হৃদয় ও মনের কতিপয় মৌলিক অবস্থা ও দৃষ্টিভঙ্গি একান্ত জরুরী পূর্বশর্ত। যতটা পারা যায় সেগুলোকে সমৃদ্ধ করুন। সেগুলোকে আপনার চেতনার অংশে পরিণত করুন এবং সেগুলোকে চিরঞ্জীব ও সক্রিয় করুন। সেগুলোকে আপনার কর্মে সঙ্ঘত করুন। আপনার মধ্যে ঐসব হৃদয়াবেগ ও দৃষ্টিভঙ্গি গভীরভাবে প্রবেশ করতে দিন। অভ্যন্তরীণ এসব সম্পদের সহযোগিতা ছাড়া আপনি কুরআনের আশীর্বাদ ও করুণা গ্রহণ করতে সক্ষম হবেন না। জীবন চলার পথে এসবই হবে আপনার অপরিহার্য সাথী ও বন্ধু।
এই অভ্যন্তরীণ সম্পদ কঠিন কিছু নয় এবং এসবের খোঁজ মেলা অসম্ভব কোন ব্যাপারও নয়। সদা সতর্কতা, বিচার-বিবেচনা এবং সঠিক কথা ও কাজের মাধ্যমে আপনি অভ্যন্তরীণ শক্তি অর্জন ও তা বৃদ্ধি করতে পারেন। আপনি যত এটা করবেন, তত আপনি কুরআনের নৈকট্য লাভে সমর্থ হবেন। আর যত বেশী কুরআনের নৈকট্য আপনি অর্জন করবেন আপনার সাফল্য হবে তত বেশী।
বিশ্বাস : আল্লাহর বাণী
প্রথমতঃ এ ব্যাপারে শক্তিশালী ও গভীর বিশ্বাস নিয়ে কুরআনের কাছে আসুন, আমাদের মহান স্রষ্টা ও প্রভুর বাণী হচ্ছে এই কুরআন।
কেন এই ধরনের বিশ্বাস একটি অপরিহার্য পূর্বশর্ত? নিঃসন্দেহে কুরআনের শক্তি ও আকর্ষণ এতই বেশী যে, যদি কেউ এটা নিয়ে পড়াশূনা করেন, তাহলে তিনিও এ থেকে উপকৃত হতে পারবেন। যেমন কোন সাধারণ গ্রন্থ থেকে কেউ উপকৃত হন যদি তিনি তা খোলা মনে পড়েন। কিন্তু এই গ্রন্থ কোন সাধারণ গ্রন্থ নয়। এর সূচনাই হয়েছে জোরালো বক্তব্য দিয়ে, এটা আল্লাহর কিতাব- এর মধ্যে বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ নেই। (বাকারা-২ : ২)
কুরআন পাঠে ও অধ্যয়নে আপনার উদ্দেশ্য কোন সাধারণ উদ্দেশ্য নয়। আপনি এ থেকে দিক-নির্দেশনার বা হিদায়াত চাচ্ছেন, যা আপনার পুরো যিন্দেগীকে বদলে দেবে। আপনাকে সহজ সরল সিরাতুল মুস্তাকীমের পথে আনবে ও পরিচালিত করবে। “আমাদেরকে সহজ সরল পথ দেখাও হে প্রভু”(সূরা ফাতিহা ১ : ৫)। এই আর্ত চিৎকারেরই জবাব হচ্ছে আল-কুরআন।
আপনি কুরআনের প্রশংসা করতে পারেন, এমনকি কুরআন থেকে অনেক কিছু অবহিত হতে পারেন, কিন্তু কুরআন আপনাকে পরিবর্তন করতে পারবে না যতক্ষণ পর্যন্ত না এর বাণী আপনাকে জাগাতে পারছে, আঁকড়ে ধরছে, আপনাকে নিরাময় করছে এবং বদলিয়ে দিচ্ছে। সেগুলো যে অর্থে আল্লাহর বাণী আপনি তা সেভাবে গ্রহণ না করা পর্যন্ত এটা হতে পারে না। কুরআনের গভীরতায় পৌঁছতে এবং তার বাণী আত্মস্থ করতে যেসব অভ্যন্তরীণ সম্পদ ও শক্তি প্রয়োজন, বিশ্বাস ছাড়া তা অর্জনই সম্ভব নয়। এটা যদি একবার হৃদয়ে আসন করে নেয়, তাহলে উদ্দেশ্যের ঐকান্তিকতা, বিনয় ও সম্ভ্রম, ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতা, আস্থা, নির্ভরশীলতা, কঠোর পরিশ্রমে আগ্রহ, এর সত্যতা সম্পর্কে দৃঢ় আস্থা, এর বাণীর প্রতি আত্মসমর্পণের মনোভাব, এর নির্দেশের প্রতি আনুগত্য, কুরআনের সম্পদ থেকে বঞ্চিত করতে পারে এমন বাধা-বিপত্তি সম্পর্কে সতর্কতা ইত্যাদি মহৎ গুণাবলীতে বিভূষিত না হয়ে আপনি পারেন না।
আপনি আল্লাহর মহানুভবতা, গৌরব ও শক্তি সম্পর্কে ভাবুন, আপনি তাঁর বাণীর জন্য অনুভব করবেন সম্ভ্রম, বিনয় ও গভীর অনুরাগ। আপনি তাঁর দয়া ও করুণার কথা বিবেচনা করুন, আপনার হৃদয় কৃতজ্ঞতা, ভালোবাসা ও তাঁর বাণীর প্রতি আকাংখায় ভরপুর দেখতে পাবেন। তাঁর প্রজ্ঞা, জ্ঞান ও করুণা সম্পর্কে জানুন- আপনি আগ্রহী, উদগ্রীব ও প্রস্তুত হয়ে উঠবেন তাঁর নির্দেশ মানার জন্যে। এ কারণেই অনেক সূরার সূচনাতেই বার বার কুরআন আপনাকে এই গুরুত্বপূর্ণ সত্যটি সম্পর্কে স্মরণ করিয়ে দেয়।
আর এ কারণেই মহানবী (সা)-কে নির্দেশ দেয়া হয়েছে নিজের বিশ্বাস সম্পর্কে ঘোষণা দেয়ার জন্য- বল হে রাসূল, আল্লাহ যে কিতাব নাযিল করেছেন আমি তার প্রতি ঈমান এনেছি। (আশ-শুরা-৪২ : ১৫)
রাসূল সেই হিদায়াত বা পথ নির্দেশকেইবিশ্বাস করেছেন, যা তাঁর পরোয়ারদিগারের নিকট হতে তাঁর প্রতি নাযিল হয়েছে। (আল-বাকারা-২ : ২৮৫)
আপনাকে অবশ্যই এ ব্যাপারে সদা সর্বদা সতর্ক থাকতে হবে যে, প্রতিটি শব্দ যা আপনি পড়ছেন, শুনছেন, আবৃত্তি করছেন বা বুঝার চেষ্টা করছেন, তা আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ হয়েছে।
আপনার কি সত্যিকার অর্থে এ বিশ্বাস আছে? এর জবাবের জন্য খুব বেশীদূর যাবার প্রয়োজন নেই। কেবলমাত্র আপনার অন্তর ও ব্যাবহারকে পরীক্ষা বা পর্যবেক্ষণই এজন্য যথেষ্ট। সত্যিই যদি আপনার এ বিশ্বাস থাকে, তাহলে কোথায় কুরয়ানের সাহায্য লাভে আপনার ব্যাকুলতা ও আকাংখা, কোথায় কুরআন বুঝার জন্য আপনার সেই সাধনা ও কঠোর পরিশ্রম, কোথায় সেই মহান বাণীর প্রতি আত্মসমর্পণ ও আনুগত্য?
কি করে এ বিশ্বাস অর্জন করা যাবে এবং কি করেই বা এ বিশ্বাসকে জীবন্ত রাখা যায়? এ জন্য অনেক উপায় রয়েছে। মাত্র একটির কথা আমি উল্লেখ করছি। সবচাইতে কার্যকর পন্থা হচ্ছে কুরআন তিলাওয়াত করা। এতে মনে হবে আমরা যেন একটি বৃত্তের মধ্যে আবর্তিত হচ্ছি। কিন্তু মূলত তা নয়। কেননা, কুরআন পাঠ করলে আপনি নিশ্চিতভাবেই উপলব্দধি করতে পারবেন যে এটা হচ্ছে আল্লাহর বাণী। আপনার বিশ্বাস তখন আরও গভীর এবং দৃঢ় হবে।
প্রকৃত ঈমানদার তো তারাই যাদের অন্তর খোদার স্মরণের সময় কেঁপে ওঠে। আল্লাহর আয়াত যখন তাদ্র সামনে পাঠ করা হয়, তখন তাদের ঈমান বৃদ্ধি পায়। (আল-আনফাল-৮ : ২)
নিয়তের পরিচ্ছন্নতা
দ্বিতীয়তঃ কুরআন পাঠ করুন কেবলমাত্র আল্লাহর পথ-নির্দেশ পাওয়া, তাঁর নোইকট্য লাভ এবং তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য।
আপনি কুরআন থেকে কি পেলেন তা নির্ভর করে আপনি কুরআন থেকে কি পেতে চান তার উপর। নিয়তই হচ্ছে এক্ষেত্রে চূড়ান্ত। নিঃসন্দেহে কুরআন এসেছে আমাদের হিদায়াতের জন্য। কিন্তু খারাপ উদ্দেশ্যে এবগ্ন অসৎ অভিপ্রায় নিয়ে কুরআন পাঠ করলে আপনি বিপথগামী হতে পারেন। কুরআন হচ্ছে আল্লাহর বাণী। সুতরাং আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগীতে যে ধরনের নিয়তের পবিত্রতা এবং উদ্দেশ্যের মহত্ত্ব পয়োজন কুরআন অধ্যয়নের জন্যও প্রয়োজন ঠিক সেই ধরনেরই উদ্দেশ্যের মহত্ত্ব ও নিয়তের পবিত্রতা।
শুধুমাত্র বুদ্ধিবৃত্তিক চাহিদা ও আনন্দ লাভের জন্যই কুরআন অধ্যয়ন করবেন না। আপনার বুদ্ধিবৃত্তিকে পরিপূর্ণভাবে কুরআন বুঝতে এবং তদনুযায়ী বাস্তবায়িত করার নিমিত্তে নিয়োজিত করুন। অনেকে কুরআনের ভাষা, এর ধরন, ইতিহাস, ভূগোল, আইন শাস্ত্র এবং নীতি শাস্ত্র অধ্যয়নে জীবন শেষ করে দেয়। এতদ্সত্ত্বেও কুরআনের আসল বক্তব্যের নাগাল তারা পায় না বা কুরআনের মূলকথা থেকে বঞ্চিত থেকে যায়। কুরআন অনেক স্থানেই ঐসব লোকের কথা উল্লেখ করেছে, যাদের জ্ঞান আছে অথচ তা থেকে তারা উপকৃতি হতে পারছে না।
নিজের মত, দৃষ্টিভঙ্গি ও মতবাদের পক্ষে সমর্থন পাওয়ার নির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে কুরআন অধ্যয়ন করা উচিৎ নয়। সে অবস্থায় হয়তো আপনি নিজের কন্ঠের প্রতিধ্বনিই শুনতা পাবেন, আল্লাহর নয়। কুরআন নুঝা ও ব্যাখ্যার এই পদ্ধতিকে মহানবী (সা) তীব্র নিন্দা করেছেনঃ
যে ব্যাক্তি নিজের মত অনুযায়ী কুরআন ব্যাখ্যা করবে, তার স্থান হবে জাহান্নামে। (তিরমিযী)।
দুনিয়াবী নাম, যশ, খ্যাতি ও অর্থলাভের জন্য কুরআনকে ব্যাবহার করার মত দুর্ভাগ্যজনক আর কিছুই হতে পারে না। প্রভাব-প্রতিপত্তি, সুনাম, অর্থ-সম্পদ সবই আপনি পেতে পারেন। কিন্তু এতে অর্থহীনভাবে একটি অমূল্য সম্পদকে আপনি বিনিময় করে ফেলবেন। অবশ্যই আপনি অপরিসীম ক্ষতির সম্মুখীন হবেন। আল্লাহর রাসূল (সা) বলেন, “যদি কেউ জনগণের নিকট থেকে জীবিকা নির্বাহের জন্য কুরআন অধ্যয়ন করে, তাহলে কিয়ামতের দিন তার মুখ এমন হবে যেন একটি গোশতবিহীন হাড্ডী”(বায়হাকী)। তিনি আরও বলেন:
যে ব্যাক্তি দুনিয়াবী কোন স্বার্থে কুরআন শিখে, আবৃত্তি করে বা শিক্ষা দেয়, তাকে জাহান্নামের জ্বলন্ত অগ্নিতে নিক্ষেপ করা হবে। (মুসলিম)
কুরআনের বাণী থেকে ছোটখাট কতিপয় বিষয়ে আপনি উপকার পেতে পারেন, যেমন দৈহিক নিপীড়ন, মানসিক অশান্তি, দারিদ্র থেকে মুক্তি ইত্যাদি। এসব পাওয়ায় কোন বাধা নেই। কিন্তু এসবই আপনার কুরআন থেকে অর্জন করার জন্য সবকিছু হতে পারে না। এবং এগুলো আপনার নিয়তেরও লক্ষ্য হতে পারে না। আপনি অবশ্য এসব অর্জন করতে পারেন। কিন্তু আপনি এক মহাসমুদ্র হারাবেন, যা আপনি পেতে পারতেন। কুরআনের প্রতিটি শব্দ পাঠের জন্য রয়েছে এক মহাপুরস্কার। প্রতিটি পুরস্কারের জন্য আপনাকে সজাগ থাকতে হবে। এবং এতাকে আপয়ান্র নিয়তের অংশে পরিণত করুন। কেননা, সেগুলোই আপনাকে কুরআনের সাথে অতিবাহিত করতে অনুপ্রাণিত করবে। কিন্তু এ কথা কখনও ভুলবেন না যে, কুরআন বুঝা, আত্মস্থ করা এবং অনুসরণের জন্য আপনাকে দুনিয়া ও আখিরাতে বিপুলভাবে পুরস্কৃত করার প্রশ্রুতি দেয়া হয়েছে। এটাই হওয়া উচিত আপনার লক্ষ্য।
শুধুমাত্র নিয়তের পরিচ্ছন্নতাই যাওথেষ্ট নয়। কুরআন এবং এর বাণীসমূহ ও এর জীবন্ত প্রতীক সুন্নাহ আপনার কাছে থাকা অবস্থায় কোনক্রমেই অন্য কিছুকে হিদায়াতের উৎস হিসেবে আপনি নিতে পারেন না। এরকম করার অর্থ হবে মরীচিকার পিছনে দৌড়ানো। তার অর্থই হবে কুরআনে আস্থার অভাব এবং কুরআনের অবমাননা। এটা হবে আনুগত্যের বিভক্তির শামিল।
আর কোন কিছু আপনাকে আপনার প্রভুর এত নিকটবর্তী করতে পারে না সেই সময় ব্যাতীত যখন আপনি আপনার প্রভুর বাণীর সাথে অতিবাহিত করেন। কুরআন হচ্ছে আপনার জন্য সেই অপূর্ব নিয়ামত, যাতে আপনি আপনার উদ্দেশ্যে মহান প্রভুর ‘কন্ঠ’ শুনতে পান। সুতরাং কুরআন অধ্যয়নকালে আপনার অন্তর্নিহিত কামনা হওয়া উচিৎ আল্লাহর নৈকট্য লাভ।
মহান আল্লাহ যে হিদায়াত আপনার প্রতি পাঠিয়েছেন তাতে হৃদয়, মন ও সময় উৎসর্গ করে আপনি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করবেন এই হওয়া উচিৎ আপনার নিয়তের লক্ষ্য। যার ভিত্তিতে আপনি আল্লাহর প্রতি আত্মসমর্পণ করেন এটা হচ্ছে আপনার সেই চুক্তি। “মানুষের মধ্যেই এমন লোক রয়েছে, যে কেবলমাত্র খোদার সন্তোষ লাভের উদ্দেশ্যেই নিজের জীবনপ্রাণ উৎসর্গ করে। বস্তুত আল্লাহ এসব বান্দার প্রতি খুবই অনুগ্রহশীল।”(আল-বাকারা-২ : ২০৭)
উদ্দেশ্য ও অভিপ্রায় হচ্ছে দেহের প্রাণশক্তির মত, একটি বীজের অভ্যন্তরীণ শক্তির অনুরূপ। অনেক বীজ একই রকম দেখায়। কিন্তু এগুলো যখন বাড়তে থাকে এবং বৃক্ষে পরিণত হয়ে ফল দেয়, তখনই তাদের পার্থক্য প্রকাশ হয়ে পরে। উদ্দেশ্য যত পবিত্র ও উন্নত হবে আপনার পদক্ষেপ তত বড়, মূল্যবান ও ফলদায়ক হবে।
সুতরাং সর্বদাই আত্মপর্যালোচনা করুন এবং নিজেকে জিজ্ঞেস করুন, কেন আমি কুরআন পড়ছি? অব্যাহতভাবে নিজেকে বলুন, কেন আপনার কুরআন তিলাওয়াত করা উচিৎ। উদ্দেশ্য ও অভিপ্রায় পবিত্র রাখার এটাই হচ্ছে সর্বোত্তম পন্থা।
কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন এবং প্রশংসা
তৃতীয়তঃমহান আল্লাহ তাআলার অশেষ কৃতজ্ঞতা ও প্রশংসার সাথে এ ব্যাপারে সজাগ ও সতর্ক থাকা উচিৎ যে, আল্লাহ তাআলা দয়া করে তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ উপহার দিয়েছেন আপনাকে এবং সেইসাথে কুরআন পাঠ ও অধ্যয়নের সুযোগও দান করেছেন তিনি।
একবার যদি আপনি অনুভব করতে পারেন কি এক অসাধারণ ও অমূল্য সম্পদ আপনার হাতে রয়েছে, তাহলে স্বতঃস্ফূর্তভাবে আপনার হৃদয় আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠবে, নেচে উঠবে এবং আপনি নিজেই বলে উঠবেন সমস্ত প্রশংসা কেবল আল্লাহরই জন্য, যিনি আমাদেরকে এই পথ দেখিয়েছেন। আমরা নিজেরা কিছুতেই পথ পেতে পারতাম না যদি আল্লাহই আমাদের পথ না দেখাতেন। (আল-আরাফ-৭ : ৪৩)
আল্লাহ তাআলা আপনার উপর যত রহমত ও আশীর্বাদ বর্ষণ করেছেন তার মধ্যে কোনোটির সাথেই কুরআনের তুলনা হয় না। আপনার শরীরের প্রতিটি চুল যদি জবান হয়ে আল্লাহর প্রশংসা ও গুণকীর্তন করতে থাকে, যদি আপনার রক্তের প্রতি ফোঁটা আনন্দাশ্রুতে রূপান্তরিত হয়, তথাপি কুরআনের মহত্ত্বের সাথে আপনার প্রশংসা, কৃতজ্ঞতার তুলনা হতে পারে না।
যদি কুরআন আমাদের উপর অবতীর্ণ নাও হতো, তথাপি কুরআনের পবিত্রতা, সৌন্দর্য, মহানুভবতা এবং উজ্জ্বল দীপ্তি আমাদের সমস্ত প্রশংসার যোগ্য হতো। কিন্তু এই মহিমান্বিত ও পবিত্র দান আমাদের প্রভুর এক অসাধারণ উচ্চ-মর্যাদাসম্পন্ন বাণী আমাদেরকে দেয়া হয়েছে কেবলমাত্র আমাদের মুক্তির জন্য।
সে কারণে ‘আল্লাহর প্রতি আমাদের অশেষ কৃতজ্ঞতা ও শুকরিয়া’জ্ঞাপন করা উচিৎ।
এমন গভীর প্রশংসা অনিবার্যভাবেই গভীর কৃতজ্ঞতায় পর্যবসিত হয়। আল-হাম্দ শব্দটি যত ব্যাপক ও গভীরভাবে আল্লাহর প্রশংসা ও শুকরিয়া আদায় করতে সক্ষম, তা আর কোন শব্দ দিয়ে সম্ভব নয়। ‘আলহামদুলিল্লাহিল্লাযী হাদানা লিহাযা __’
আমাদেরকে কুরআন দান করার জন্য কেন আল্লাহর শুকরিয়া জানানো হবে? এইভাবে তিনি আমাদেরকে জীবনের উদ্দেশ্য ও অর্থ সম্পর্কে অবহিত করেছেন এবং আমাদের সরল পথ প্রদর্শন করেছেন। এই দুনিয়ার সম্মান ও গৌরবের কথা আপনার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে। এই কুরআনে আপনি আল্লাহর সাথে কথা বলতে পারেন।
শুধুমাত্র এ দুনিয়ার জীবনে কুরআনকে অনুসরণ করে আপনি ক্ষমা, বেহেশত এবং মহান আল্লাহর রেযামন্দি হাসিল করতে পারেন আখিরাতে। কৃতজ্ঞতা ও আনন্দ নিয়ে যায় আস্থা, আশা এবং বড় পুরস্কারের দিকে। যিনি আপনাকে কুরআন দান করেছেন, তিনি অবশ্যই তা পড়তে, বুঝতে এবং অনুসরণ করতে আপনাকে সাহায্য করবেন। কৃতজ্ঞতা ও আনন্দ এমন এক চির-সতেজ প্রাণশক্তি সৃষ্টি করে, যা আপনাকে সর্বদা নব উদ্দীপনায় কুরআন পাঠে সাহায্য করে। আপনি যত বেশী কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবেন আল্লাহ তাআলা আপনাকে তত বেশী কুরআনের সম্পদ দান করবেন। মহত্ত্ব কৃতজ্ঞতা আনে আর কৃতজ্ঞতা আপনাকে মহৎ করে তোলে- এ হচ্ছে যতিহীন প্রক্রিয়া। আল্লাহর প্রতিশ্রুতিও তাই।
যদি তোমরা কৃতজ্ঞ হও, তাহলে আমি অবশ্যই তোমাদের আরো বেশী বেশী দান করবো। (ইবরাহীম-১৪ : ৭)
কুরআন পাওয়া সত্ত্বেও এর জন্য গভীর কৃতজ্ঞতা অনুভব না করার দুটো অর্থ হতে পারে- হয় আপনি কুরআন যে আশীর্বাদ বহন করে এনেছে, সে সম্পর্কে অজ্ঞ অথবা কুরআনের প্রতি আপনি কোন গুরুত্বি প্রদান করেননি। সর্বাবস্থায় এ ব্যাপারে আপনাকে অত্যন্ত গভীরভাবে ভাবতে হবে যে, কুরআনের সাথে আপনার সম্পর্ক কেমন? কৃতজ্ঞতার যে আবেগ হৃদয় ও মনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবাহিত, তা অবশ্যই ভাষায় প্রকাশিত হতে হবে অবিরাম উচ্ছ্বসিতভাবে। আপনার চলার পথে প্রতিটি পদক্ষেপের জন্য আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করুন ও কুরআনের সাথে সময় পাওয়ার জন্যে, শুদ্ধভাবে কুরআন পড়ার জন্যে এ থেকে আপনার পাওয়া প্রতিটি অর্থের জন্যে এবং কুরআন অনুসরণে সামর্থ লাভের জন্যে। কৃতজ্ঞতাকে অবশ্যই কর্মে পরিণত করতে হবে।
স্বীকৃতি এবং আস্থা
চতুর্থঃ বিন্দুমাত্র সন্দেহ ও দোদুল্যমানতা ছাড়াই কুরআনের দেয়া প্রতিটি জ্ঞান এবং নির্দেশিকা গ্রহণ করুন ও আস্থা রাখুন।
এ ব্যাপারে প্রশ্ন উত্থাপনের জন্য আপনার পূর্ণ স্বাধীনতা রয়েছে যে, কুরআন আল্লাহর বাণী কিনা। এর দাবী প্রত্যাখ্যানও করতে পারেন যদি আপনার পূর্ণ আস্থা না হয় বা প্রত্যয় না জন্মে। কিন্তু আপনি একবার আল্লাহর বাণী হিসেবে গ্রহণ করার পর এর একটি শব্দ সম্পর্কেও সন্দেহ পোষণ করার কোন যৌক্তিকতা বা ভিত্তি নেই। এমন করার অর্থই হচ্ছে যা আপনি গরহণ করেছিলেন তা প্রত্যখ্যান করে দিলেন। কুরআনের শিক্ষার প্রতি পূর্ণভাবে আত্মসমর্পণ করতে হবে। আপনার নিজস্ব বিশ্বাস, মতামত, রায়, দৃষ্টিভঙ্গি ও ঝোঁক-প্রবণতা যেন কুরআনের শিক্ষার কোন বিন্দুমাত্র অংশও অগ্রাহ্য করতে না পারে। কুরআন তাদের অপরাধী গণ্য করে, যারা কুরআনকে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত গ্রন্থ হিসেবে বিবেচনা করে এবং অতঃপর বিভ্রান্তি, হতবুদ্ধি ও সন্দেহপ্রবণ বিশ্বাসী হিসেবে আচরণ করে।
আর আসল কথা এই যে, আগের লোকদের পরে যাদেরকে কিতাবের উত্তরাদিকারী বানানো হয়েছে, তারা সেই ব্যাআপ্রে বড় প্রাণান্তকর সন্দেহে নিমজ্জিত হয়ে পরেছে (আশ-শুরা-৪২ : ১৪)।
কুরআন এ ব্যাপারে বার বার জোর দিয়েছে যে, নির্ভেজালভাবে আল্লাহর বাণী প্রেরণ ও পৌঁছানো নিশ্চিত করণার্থে যাবতীয় পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।
বরং এই কুরআন অতীব উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন, সুরক্ষিত ফলকে লিপিবদ্ধ (আল-বুরুজ-৮৫ : ২১)।
এটি মূলতঃ এক সম্মানিত পয়গামবাহকের উক্তি, যে অত্যন্ত শক্তিশালী আরশের মালিকের নিক্ট উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন। তথায় তার আদেশ মানু করা হয়। সে আস্থাভাজন, বিশ্বস্ত (আত-তাকবীর-৮১ : ১৯-২১)।
এটি সুসম্মানিত ও নেককার লেখকদের হাতে থাকে (আবাসা-৮০ : ১৫-১৬)।
এরা সেই লোক, যাদের সামনে নসীহতের কালাম আসলে তারা তা মেনে নিতে অস্বীকার করল। কিন্তু আসল কথা এই যে, এটি একখানি বিরাট কিতাব। বাতিল না সামনের দিক থেকে এর উপর আসতে পারে, না পিছন থেকে। এটি এক মহাজ্ঞানী এবং সুপ্রশংসিত সত্তার নাযিল করা জিনিস। (হামিম আস্-সাজদা- ৪১ : ৪১-৪২)
আরও ঘোষণা করা হয়েছেঃ
এই কুরআনকে আমরা সত্যতা সহকারে নাযিল করেছি এবং সত্য সহকারেই এটি নাযিল হয়েছে। (আল-ইসরা-১৭ : ১০৫)
তোমরা খোদার বিধান সতৌতা ও ইনসাফের দিক দিয়ে পূর্ণ পরিণত। (আল আনআম- ৬:১১৫)
কুরআনকে সত্য এবং সম্পূর্ণ সত্য হিসেবে মেনে নেয়া এবং আস্থা স্থাপন করার অর্থ এ নয় যে, অন্ধবিশ্বাস, রুদ্ধ মানসিকতা বা অনুসন্ধানবিহীন উপলব্ধি।
কুরআনে যা রয়েছে, সে সম্পর্কে আপনার অনুসন্ধান, পর্যালোচনা, প্রশ্ন করা এবং বুঝার অধিয়াক্র রয়েছে। কিন্তু যা আপনি পুরোপুরি বুঝতে বা উপলব্ধি করতে পারেন না, তা অযৌক্তিক কিংবা অসত্য এমনটি মনে করার কোন কারণ নেই। একটি মাইন যার প্রতিটি পাথরকণা অমূল্য রত্ন বলে আপনি বিশ্বাস করেন এবং এটা প্রমাণিত- এসবের মধ্য থেকে যেগুলোর মূল্য আপনার চক্ষু নির্ধারণ করতে পারে না অথবা আপনার কাছে যে যন্ত্র আছে তা নির্ধারণের জন্য, তার দ্বারা তা নির্ধারণ করাও সম্ভব নয়- এমতাবশ্তাহ্য আপনি ঐসব পাথরকণা ছুড়ে ফেলতে পারেন না।
কিংবা কুরআনের কোন অংশ পুরনো, সেকেলে, পুরনো কালের গল্প মনে করে বাদ দেয়ার কোন অবকাশ নেই। যদি আল্লাহ তাআলা সর্বকালের প্রভু হয়ে থাকেন, তাহলে তাঁর বাণী চৌদ্দশ’ বছর পরও সমানভাবে অকাট্য সিদ্ধ।
কুরআনের কিছু অংশ গ্রহণ করা এবং কিছু অংশ প্রত্যখ্যান করার অর্থ গোটা কুরআনকেই প্রত্যাখ্যান করা। কুরআনের সাথে আপনার সম্পর্কের প্রশ্নে আংশিকভাবে বা খন্ডিতভাবে কুরআনকে গ্রহণ করার কোন সুযোগ নেই এবং এটা যুক্তিযুক্তও নয়। (আল-বাকারা-২ : ৮৫)
হৃদয় ও মনে অনেক ব্যাধি রয়েছে, যা আপনাকে কুরআনের বাণী গরহণ করতে এবং তার প্রতি আত্মসমর্পণ করতে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে যাচ্ছে। এ সবই কুরআনে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এসবের মধ্যে রয়েছে ঈর্ষা, কুসংস্কার, বাসনা চরিতার্থ করা এবং সমাজ প্রথা ও রীতির অন্ধ অনুকরণ। আপনার নিজস্ব মতামত পরিহার করতে, আল্লাহর কথা মেনে নিতে এবং বিনয়ের সাথে তা গ্রহণ করার পথে সবচাইতে বড় প্রতিবন্ধকতা হলো অহংকার ও অজ্ঞতা এবং স্বয়ংসম্পূর্ণতার মনোভাব।
আমি সেই লোকদের দৃষ্টি আমার নির্দশন্সমূহ থেকে ফিরিয়ে দিব, যারা কোন অধিকার ব্যাতীতই যমীনের বুকে বর মানুষী করে বেড়ায়। তারা যে নিদর্শনই দেখুক না কেন, তার প্রতি কখনও ঈমান আনবে না। সঠিক সুরল পথ তাদের সামনে আসলেও তারা তা গ্রহণ করবে না। বাঁকাপথ দেখা দিলে তাকেই পথরূপে গ্রহণ করে চলবে। কেননা, তারা আমার নিদর্শনসমূহকে মিথ্যা মনে করে অমানু করেছে এবং তাকে কিছুমাত্র পরোয়া করেনি। (আল-আরাফ ৭ : ১৪৬)
নিশ্চিতই জেনো, যারা আমাদের আয়াতসমূহকে মিথ্যা মনে করে অস্বীকার করেছে এবং এর মোকাবিলায় বিদ্রোহের নীতি গ্রহণ করেছে, তাদের জন্য আকাশ-জগতের দুয়ার কখনো খোলা হবে না। তাদের জান্নাতে প্রবেশ ততখানি অসম্ভব, যতখানি অসম্ভব সূঁচের ছিদ্রপথে উষ্ট্র গমন। (আল-আরাফ-৭ : ৪০)
আনুগত্য ও পরিবর্তন
পঞ্চমতঃ জীবন, দৃষ্টিভঙ্গি ও ব্যাবহারে কুরআন যে পরিবর্তনই কামনা করে, তা মেনে নিতে দৃঢ় ইচ্ছা, সংকল্প এবং প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। আপনি যতক্ষণ কুরআনের বাণীর আলোকে আপনার চিন্তাধারা, কর্মকান্ড ঢেলে সাজাতে প্রস্তুত না হবেন, ততক্ষণ পররযন্তি আপনার নিষ্ঠা এবং পরিশ্রম ব্যার্থতায় পর্যবসিত হবে। কেবলমাত্র বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা এবং আনন্দদায়ক অভিজ্ঞতা কোন অবস্থাতেই আপনাকে কুরআনের সত্যিকারের সম্পদ ভান্ডারের নিকটবর্তী করতে পারবে না।
মানবিক দুর্বলতা, প্রলোভন, প্রাকৃতিক অসুবিধা, বাহ্যিক বাধা-বিপত্তির কারণে কুরআন মেনে চলা এবং সে অনুযায়ী জীবনে পরিবর্তন আনতে ব্যার্থতা এককথা, আর এজন্য কোন অভিপ্রায় না থাকা বা প্রচেষ্টা না চালানোর জন্য ব্যার্থতা সম্পূর্ণ ভিন্নকথা। এ অবস্থায় আপনি হয়তো বা কুরআনের একজন পন্ডিত হিসেবে খায়তি অর্জন করতে পারেন, কিন্তু এটি কখনও আপনার কাছে প্রকৃত সত্য ও আসল অর্থ উদঘাটন করতে করবে না। কুরআন অত্যন্ত কঠোর ভাষায় ধিক্কার দিয়েছে ঐসব লোকদের, যারা আল্লাহর এই কিতাবের উপর বিশ্বাসের দাবী করে অথচ তাদের যখন এটা মেনে চলতে বলা হয় অথবা যখন কোন সেদ্ধান্ত গ্রহণের সময় আসে, তখন তারা কুরআনের আহবান অবহেলা করে। তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। তাদেরকে আখ্যায়িত করা হয়েছে কাফির, ফাসিক ও যালিম বলে।
ঝুঁকি ও প্রতিবন্ধকতা
ষষ্ঠতঃ এ সম্পর্কে সদা সতর্ক থাকুন যে, যেই আপনি কুরআন অধ্যয়নে মনোনিবেশ করবেন শয়তান সম্ভাব্য সকল প্রকার বাধা-বিপত্তির সৃষ্টি করবে আপনার পথে, যাতে আপনি কুরআনের মহান সম্পদ লাভে সক্ষম না হন।
আল্লাহর সিরাতুল মুস্তাকীমের পথে কুরআনই একমাত্র নিশ্চিত গাইড। সেই পথে চলাই হচ্ছে মানুষের নিয়তি। যখন আদম (আ)-কে সৃষ্টি করা হলো, তখন মানুষকে তার ভাগ্য পূরণে যেসব বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করতে হবে, সে সম্পর্কে সতর্ক করে দেয়া হয়েছিল। মানুষের সকল দুর্বলতা বিশেষ করে ইচ্ছাশক্তি, সংকল্প এবং কৃতজ্ঞতাবোধের দুর্বলতা প্রকাশ করে দেয়া হয়েছিল। (তাহা-২০ : ১১৫)
এটা সহজবোধ্য ও স্পষ্ট যে, কিভাবে শয়তান চলার পথে প্রতিটি পদে পদে বাধার সৃষ্টি করবে।
আমি অবশ্যই তোমার সত্য-সরল পথের এই লোকদের জন্য ওত পেতে থাকবো, অতঃপর সামনে ও পিছনে, ডানে ও বামে সকল দিক হতেই তাদেরকে ঘিরে ফেলবো এবং তুমি এদের অধিকাংশকেই কৃতজ্ঞ পাবে না। (আল-আরাফ-৭ : ১৬-১৭)
কুরআন সুস্পষ্টভাবে আল্লাহর পক্ষ থেকে হিদায়াত এবং আপনার সবচাইতে শক্তিশালী মিত্র। শয়তানের বিরুদ্ধে এবং কুরআনের পথের সংগ্রামে আল্লাহর হিদায়াতের পথে বাঁচার সংগ্রামে এই কুরআনই আপনাকে সাহায্য করবে। সুতরাং আপনার কুরআন অধ্যয়নের সূচনা এবং সে অনুযায়ী জীবন যাপনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত শয়তান অনেক কৌশল ও ছল-চাতুরী, মোহ ও প্রবঞ্চনা, বাধা ও বিপত্তিসহ আপনার মুখোমুখি হবে, যা আপনাকে অতিক্রম করতে হবে।
শয়তান আপনার অভিপ্রায়কে কলুষিত করতে পারে, কুরআনের অর্থ ও পয়গাম সম্পর্কে আপনাকে অমনোযোগী করে রাখতে পারে, আপনার আত্মা ও আল্লাহর ভুবনের মধ্যে প্রতিবন্ধকতা দাঁড় করাতে পারে, মূল শিক্ষার পরিবর্তে প্রান্তিক শিক্ষার ফাঁদে ফেলতে পারে, কুরআন মেনে চলা থেকে বিরত থাকতে আপনাকে প্রলুব্ধ করতে পারে অথবা সাধারণভাবে কুরআন অধ্যয়ন করার ব্যাপারে আপয়াঙ্কে গাফিল করে তুলতে পারে। এই সবগুলো বিপত্তি সম্পর্কেও বিস্তারিত ব্যাখ্যা করা হয়েছে কুরআনেই।
খুব সাধারণ একটি জিনিসের কথাই ধরা যাক। প্রতিদিন কুরআন অধ্যয়ন করে তা বুঝলে খুবই সহজ মনে হয়। কিন্তু চেষ্টা করুন এবং দেখবেন কত কঠিন মনে হয়। সময় চলে যায়, অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কাজ এসে হাজির হয়। কেন্দ্রীভূত মন ও মনোযোগ তাই হয় যা আপনি এড়াতে চান, কেন দ্রুত শুধুমাত্র বরকতের জন্য পড়েন না। এই বিপদ থেকে সতর্ক থাকার জন্যে যখন আপনি কুরআন পড়েন তহকন কুরআনের অনুগত হয়ে বিভ্রান্ত ও প্রাত্যাখ্যাত শয়তানের হাত থেকে আল্লাহর নিকট পানা চান (আন-নহল-১৬ : ৯৮)।বলুন – আউযুবিল্লাহি মিনাশ শায়তানির রাজীম।
আস্থা ও নির্ভরশীলতা
সপ্তমতঃ আল্লাহর উপর পরিপূর্ণ আস্থা রাখুন যেন তিনি আপনাকে কুরআন পাঠের পুরো ফায়দার দিকে পরিচালিত করেন।
এটা আল্লাহর অসীম মেহেরবানী, যে কুরআন আল্লাহর কথাকে আপনার নিকট এনেছে এবং আপনাকে তাঁর নিকট নিয়েছে। সুতরাং আল্লাহর দয়াই আপনাকে সংকটজনক কাজে সাহায্য করতে পারে। আপনার দরকার গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান প্রতিবিধান যা সহজে লাভ করা যায় না। আপনাকে কঠিন বিপদের মুখোমুখি হতে হয়। যা অতিক্রম করা সহজ নয়। আল্লাহ ছাড়া আর কার দিকে আপনি তাকাতে পারেন, যিনি আপনার হাত ধরে সাহায্য করবেন এবং আপনার চলার পথের নির্দেশনা দিবেন।
আপনার ইচ্ছা এবং পদক্ষেপই হচ্ছে অত্যাবশ্যক মাধ্যম। কিন্তু আল্লাহর অসাধারণ দয়া এবং সমর্থনই একমাত্র গ্যারান্টি, যার সাহায্যে আপনি সাফল্যের সাথে আপনার পথ চলতে সক্ষম হবেন। আপনার জীবনের সবকিছুর জন্য শুধুমাত্র তাঁরই দিকে ফিরে যেতে হবে। আর কুরআনের চাইতে বেশী গুরুত্বপূর্ণ জিনিস আর কি থাকতে পারে।
আপনি কুরআনের জন্য যা করছেন এবং যা অর্জনে করতে পেরেছেন, সে সম্পর্কে কখনো গর্ব প্রকাশ করবেন না। সে কাজের যখন কোন তুলনা হয় না, যা আপনার কমতি এবং সীমাবদ্ধতার ব্যাপারে সর্বদা সজাগ রাখে।
সুতরাং বিনয়ের সাথে কুরআনের নিকট আবেদন করুন, আল্লাহর প্রতি পরম নির্ভরতার জযবা নিয়ে প্রতিপদে তাঁর সাহায্য ও সমর্থন চান।
বিশ্বাস, প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতার মানসিকতা নিয়ে আপনার ভাষা ও হৃদয়ের পারস্পরিক সমন্বয়ের মাধ্যমে তিলাওয়াত শুরু করুন- বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম- পরম করুণাময় ও দয়ালু আল্লাহর নামে। এই আয়াতটুকু কুরআনের ১১৪টি সূরার একটিমাত্র সূরা ব্যাতীত প্রতিটির সূচনাতেই বিদ্যমান। বান্দাহ তাঁর নিরাপত্তা চেয়ে প্রার্থনা করছেঃ হে আল্লাহ! তুমি যখন আমাদের সঠিক সোজা পথ দেখিয়েছ, তখন তুমি আমাদেরকে মনে কোন রকম বক্রতা ও জটীলতা সৃষ্টি করে দিও না। আমাদেরকে তোমার মেহেরবানির ভান্ডার থেকে অনুগ্রহ দান কর, কেননা প্রকৃত দাতা তুমিই (আলে-ইমরান-৩ : ৮)।