৬:সাধারণ মূলনীতি
একটি জীবন্ত বাস্তবতা হিসাবে উপলব্ধি
একঃ কুরআনের প্রত্যেকটি শব্দ এমনভাবে বুঝতে চেষ্টা করুন যেন মনে হবে এটা যেন আজই নাযিল হয়েছে। ১৪০০ বছর আগে যখন এটা প্রথম প্রেরণ করা হয়, তখন এই গ্রন্থটি যেমন প্রাসংগিক ও জীবন্ত ছিল আজকের আধুনিক কালেও এটিকে তেমনি ভাবে গ্রহণে করতে হবে। যেহেতু এটা চিরন্তন এবং এর আবেদন এখনও কোন ভিন্ন বক্তব্য পরিবেশন করে না। কোন অবস্থাতেই কুরআনের কোন বক্তব্যকে কোন অতীতের কথা হিসাবে গ্রহণ করবেন না। তখনই কেবলমাত্র আপনি কুরআনের বাণীকে চিরন্তন বুঝতে পারবেন চিরঞ্জীব আল্লাহর কথা হিসেবে-যিনি সর্বদা প্রতিটি সৃষ্টির মধ্যে জাগ্রত আছেন।
এটি কুরআন অধ্যয়নে মনোনিবেশে আপনার আত্মার জন্য জরুরী, আপনার হৃদয় ও বুদ্ধিমত্তার সর্বদা এই নির্দেশিকার মাধ্যমেই আবেদন জানানো উচিত। এর তাৎপর্য অনেক। এটি কুরআনে যা আছে তার অর্থ করতে আপনাকে সহায়তা করবে যাতে এর আলোকে আপনি আপনার জগতকে বুঝতে পারেন।
এর আলোকে আপনি তখন এটি আপনার নিজের জীবনের সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রয়োগ করুন। সমসাময়িক চিন্তার বিষয়, বিভিন্ন ইস্যু, অভিজ্ঞতা এবং জ্ঞানের স্তর ও আপনার সময়ের প্রযুক্তি সবকিছুই কুরআনে তার জবাব খুঁজে পাবে।
আপনার জন্য একটি বাণী হিসেবে বুঝুন
দুইঃ আরও গুরুত্ব সহকারে কুরআনের প্রতিটি বাণীকে এভাবে নিন যেন তা আপনার ও আপনার সম্প্রদায়ের জন্য। একবার যদি কিছু অগ্রগতি সাধন করতে পারেন, তাহলে কুরআনের প্রতিটি আয়াত আপনাকে ব্যক্তিগতভাবে কি শিক্ষা দেয় তা বুঝতে চেষ্টা করা উচিত। আপনি এটি আগেও দেখেছেন যে, আপনার হৃদয়ের গভীর থেকে উপলব্ধির জন্য এটা কিভাবে করা উচিত। এখন আপনার অনুভব করা উচিত কুরআন বুঝতে এটি আপনার হৃদয়কে কিভাবে উন্মুক্ত করে দেয়। একদা এক ব্যক্তি রাসূল (সা) এর নিকট কুরআন শিখতে আসলো। রাসূল (সা)সূরা যিলযাল শিক্ষা দিলেন। যখন তিনি এই আয়াতের নিকট পৌঁছালেন,”উপরন্তু যে লোক বিন্দু পরিমাণ নেক আমল করে থাকবে, সে তা দেখতে পাবে এবং যে লোক বিন্দু পরিমাণ বদ আমল করে থাকবে, সেও তা দেখতে পাবে।” তিনি বললেন, এটিই আমার জন্য যথেষ্ট। এই বলে তিনি চলে গেলেন। মহানবী (সা) মন্তব্য করলেন, “এই লোকটি একজন ফকীহ হয়ে ফিরলো।” (আবু দাউদ)
প্রকৃতপক্ষে আমি বিশ্বাস করি পবিত্র কুরআনে এমন একটি অনুচ্ছেদও নেই, যা আপনার জন্য ব্যক্তিগতভাবে কোন বার্তা বহন করে আনবে না অথবা আপনার জন্য শিক্ষণীয় নয়। কিন্তু এটি উপলব্ধি করার অন্তর্দৃষ্টি আপনার থাকতে হবে। আল্লাহ তাআলার প্রতিটি কথাই তাঁর সাথে আপনার একটি গভীর সম্পর্ক গড়ে তোলার আহবান জানায়। পরকালের প্রতিটি বর্ণনা আপনাকে এর জন্য প্রস্তুতি নিতে বলে অথবা এর পুরস্কারের জন্য অনুপ্রাণিত করে অথবা এর খারাবি থেকে ক্ষমা চাইতে বলে। প্রতিটি সংলাপ আপনাকে এর সাথে জড়িত করে। প্রতিটি চরিত্র একটি নমুনা পেশ করে। আপনাকে হয় অনুসরণ করতে হবে, না হয় অস্বীকার বা প্রত্যাখান করতে হবে। প্রতিটি আইনগত বিধি তা যদি দৃশ্যতঃ বর্তমান অবস্থায় আপনার উপর প্রযোজ্য নয় বলেও প্রতীয়মান হয়, তথাপি তার একটি পয়গাম বা বার্তা রয়েছে আপনার জন্য। অতি সাধারণ বিবৃতি যা সর্বদাই আপনার জন্য বিশেষ অর্থবহ হতে পারে, আবার খুবই বিশেষ একটি বিবৃতি যা ঘটনা ও পরিস্থিতির কারণে আপনার জীবনে সর্বদাই সাধারণ অর্থ প্রকাশক হতে পারে।
সমগ্র কুরআনের অংশ হিসেবে বুঝুন
তিনঃ সমগ্র কুরআন নিজের মধ্যেই একটি একক । এটি একটি একক প্রত্যাদেশ। যদিও বিভিন্ন পন্থায়, বিভিন্নভাবে এই বাণী প্রেরণ করা হয়েছে, তথাপি খোদ এই বাণীটি হচ্ছে একটি বাণী। এর রয়েছে একটি বিশ্বদৃষ্টি এবং একটি সামগ্রিক পথ-নির্দেশনার কাঠামো। সবগুলো যন্ত্রাংশই পুরোপুরিভাবে একটি অন্যটির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এটি যে আল্লাহ প্রদত্ত অবতীর্ণ ব্যবস্থা এটি তারই একটি চিহ্ন।
“এরা কি কুরআন গভীর মনোনিবেশ সহকারে চিন্তা করে না? এটি যদি আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নিকট হতে আসতো, তবে এতে অনেক কিছুই বর্ণনা-বৈষম্য পাওয়া যেতো।” (আন-নিসা ৪:৮২)
এই একটি মাত্র বাণী এবং অবকাঠামো পরিপূর্ণভাবে আত্মস্থ করতে চেষ্টা করা উচিত। তখন প্রতিটি জিনিস আপনি একক গ্রন্থ কুরআনের বাণীর অংশ হিসেবে বুঝতে পারবেন, তা একটি মাত্র শব্দ, আয়াত, অনুচ্ছেদ অথবা সূরাই হোক। কখনও কোন কিছুকে কুরআনী কাঠামো থেকে আলাদা করবেন না। অন্যথায় আপনি একটি বিকৃত অর্থের সন্ধান পেতে পারেন। যে অর্থই আপনি পান না কেন, তা সামগ্রিক প্রতিপাদ্যের সাথে যাচাই করে নিন। যখন কোন নির্দিষ্ট অনুচ্ছেদ পাঠ করেন, তখন আপনাকে তা ব্যাখ্যা করতে হবে, গভীরভাবে বিশ্লেষন করতে হবে এবং প্রতিটি বাক্য এবং পৃথকভাবে প্রতিটি শব্দ বুঝার চেষ্টা করতে হবে। কিন্তু সবগুলোকে সম্মিলিতভাবে একটি রূপ দিতে ভুললে চলবে না। এবং ঐ সমন্বিত চিত্রটি কুরআনের সামগ্রিক বক্তব্যের নিরিখে বিচার করতে হবে। অন্যথায় আপনার নির্ধারিত পাঠ আপনাকে বিপরীত দিকে নিয়ে যাবে। এটি ব্যতীত নির্ধারিত পাঠ কুরআন দ্বারা পরিচালিত হবার বদলে আপনার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির পক্ষে নির্দিষ্ট আয়াত ব্যবহারের ভ্রান্তিতে আপনাকে নিমজ্জিত করতে পারে।
আপনি যুগের সমস্যার সমাধানের জন্য কুরআনের প্রযোগ করতে হলে আপনাকে সমগ্র কুরআনকেই আপনার অধ্যয়নের আওতায় নিতে হবে। অন্যথায় আপনি কুরআনের দৃষ্টিতে সমালোচনামূলকভাবে মূল্যায়নের পরিবর্তে কুরআনকে কেবলমাত্র সমসাময়িক চিন্তাধারার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ করার মারাত্মক ভুলটাই করে বসবেন।
উপরের আলোচনার প্রেক্ষিতে একটি সূচীর মাধ্যমে কুরআন অধ্যয়নের ব্যাপারে অগ্রসর হওয়ার কথা বলা যায় না। অবশ্য, কুরআন বারবার অধ্যয়ন এবং তা পুরোপুরি বুঝা ব্যতীত আয়াতের সূচী সংগ্রহ করে কোন বিষয়ের অধ্যয়ন করবেন না। আপনার নিজস্ব অধ্যয়নের ভিত্তিতে যখন আপনি একটি রেপারেন্স দেখার প্রয়োজন অনুভব করবেন কেবল তখনই তা ব্যবহার করুন।
সামঞ্জস্যপূর্ণ একক বিষয় হিসেবে বুঝুন
চারঃ বাহ্যিকভাবে এলাপাথাড়ি মনে হলেও মূলতঃ কুরআনের সর্বোন্নত মানের সামঞ্জস্য ও শৃংখলা রয়েছে। একটি অংশের সাথে অন্যটি সম্পর্কিত, আয়াতের সাথে আয়াত এবং সূরার সাথে সূরা সম্পর্কিত। বিষয়বস্তুর বাহ্যিক ওঠানামার অন্তরালে একটি ঐক্যসূত্র বিদ্যমান। আর এ কারণেই অনুলিপি লেখকদের মহানবী (সা) নির্দেশ দিয়েছেন কোন্ প্রত্যাদেশটির স্থান কোথায় হবে। এই অন্তর্নিহিত সামঞ্জস্য আপনার খুঁজে বের করা উচিত, যদিও বা প্রথম পাঠেই আপনার পক্ষ্যে তা করা সম্ভব নাও হতে পারে কিংবা এজন্য দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন হতে পারে। কেবলমাত্র তখনই প্রতিটি অংশের পূর্ণ অর্থ আপনি বুঝতে সক্ষম হবেন।
আপনার সামগ্রিক সত্তা দিয়ে বুঝতে চেষ্টা করুন
পাঁচঃ অধ্যয়নে আপনার পুরো সত্তাকে বিলীন করে দিয়ে কুরআন বুঝতে চেষ্টা করুন। হৃদয় ও অন্তর, অনুভূতি এবং প্রজ্ঞা সবকিছুই আপনার ব্যক্তিসত্তার মধ্যে নিমজ্জিত। কুরআন কোন মোড়ক নয় যা বুদ্ধি দিয়ে মোড়ানো যায়। কেবলমাত্র স্বর্গীয় উপদেশ বাণীও নয়, যা পরমানন্দে উপভোগ করা যায়। কুরআনকে বিভিন্নভাবে বুঝতে চাওয়া ঠিক নয়, কুরআন অধ্যয়নের সময় বুদ্ধিমত্তা বা অনুভূতি এর কোনটাই পিছনে ফেলে আসা উচিত নয়, উভয়কেই এক সাথে সমন্বিত করতে হবে।
কুরআন কি বলছে তা বুঝতে চেষ্টা করুন
ছয়ঃ আপনি যা বলেন, তা নয় বরং কুরআন কি বলে তা বুঝুন। কখনও আপনার মতামতের সমর্থন পাওয়ার জন্য, আপনার দৃষ্টিভঙ্গির নিশ্চয়তার জন্য, আপনার আবেদন প্রমাণের জন্য কুরআনের দ্বারস্থ হবেন না। আপনাকে অবশ্যই খোলা মন নিয়ে কুরআনের দিকে অগ্রসর হতে হবে। আল্লাহর বাণী শুনতে এবং তার প্রতি আত্মসমর্পণ করতে প্রস্তুত থাকতে হবে।
ঐকমত্যের ভিতর থাকুন
সাতঃ কুরআন অধ্যয়ন এবং বুঝার ক্ষেত্রে আপনারাই প্রথম নন। আপনাদের পূর্বে রয়েছেন এক ধারাবাহিক মানব গোষ্ঠী। যারা এ কাজটি করেছেন এবং এর সমৃদ্ধ ঐতিহ্য রচনা করে গিয়েছেন, আপনি তাদের অবহেলা করতে পারেন না। সুতরাং কুরআনের পথে আপনার এমনভাবে অগ্রসর হওয়া উচিত নয় যেন আপনার আগে আর কেই তেমনটি করেননি। এমন কোন অর্থই বৈধ, সঠিক বা গ্রহণযোগ্য নয়, যা মুহাম্মদ (সা) এর বক্তব্যের বিপরীত অথবা যার উপর মুসলিম উম্মাহর এক্যমত্য রয়েছে তার বিপরীত। এক্ষেত্রে যুগ যুগ ধরে আমাদের যে সমৃদ্ধ ঐতিহ্য রয়েছে, তার থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং নতুন উপসংহারের ভিত্তি খুবই গভীর পান্ডিত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত হওয়া উচিত।
কেবলমাত্র কুরআনিক মানদন্ডে বুঝুন
আটঃ কুরআন অন্য কোন গ্রন্থের মত নয়। প্রতিটি দিক থেকেই এই গ্রন্থ অনন্য, কুরআনের রয়েছে নিজস্ব ভাষা, নিজস্ব অভিধা, নিজস্ব স্টাইল, নিজস্ব অলংকার, দর্শন এবং যুক্তি। উপরন্তু একটি অসাধারণ আবেদন এবং উদ্দেশ্য। কুরআন বহির্ভুত মানবিক মানদন্ড বুঝার চেষ্টা অর্থহীন।
এর একক উদ্দেশ্য হচ্ছে মানবতাকে, প্রতিটি মানুষকে তার স্রষ্টার দিকে পরিচালিত করা, মানব জীবনে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনায়ন এবং আল্লাহর সাথে সম্পূর্ণ এক নতুন সম্পর্ক স্থাপন করা। সবকিছুই এই লক্ষ্যস্থলে পৌঁছার জন্য এবং এ লক্ষ্যকে সামনে রেখেই সবকিছু নির্ধারিত। এর কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ তাৎপর্য রয়েছে।
প্রথমতঃ যদিও বা এর অর্থের মহাসমুদ্রের গভীরতার কোন শেষ নেই, তথাপি জীবন পরিচালনায় একজন সাধারণ সত্যানুসন্ধানীর জন্য অর্থগুলো সহজ ও বোধগম্য। সত্যিকারের মনোভাব নিয়ে এবং সত্যপথে অগ্রসর হতে চাইলে যেসব অর্থ হিদায়াতের জন্য যথেষ্ট, তা সহজেই বুঝা যায়।
দ্বিতীয়তঃ কুরআনের ভাষা এমন যে, সাধারণ লোক তা বুঝতে সক্ষম। দৈনন্দিন জীবনে সাধারণ মানুষ কথোপকথনে যেসব শব্দ ব্যবহার করে কুরআনে এসব শব্দই ব্যবহার করা হয়েছে। কুরআন নতুন অবোধগম্য পরিভাষা ব্যবহার করে না, কিংবা দর্শন, বিজ্ঞান, যুক্তিবিদ্যার টেকনিক্যাল ও একাডেমিক ভাষা ব্যবহার করে না। তবে পুরানো ও প্রতিদিনের ব্যবহৃত শব্দের মধ্যেই সম্পূর্ণ নতুন অর্থ প্রকাশ করে থাকে।
তৃতীয়তঃ কুরআন কোন ইতিহাসেরও গ্রন্থ নয় অথবা বিজ্ঞানেরও বই নয়। কিংবা দর্শন বা যুক্তিবিদ্যঅরও গ্রন্থ নয়। যদিও বা কুরআন এর সবগুলোই ব্যবহার করে থাকে। তবে তা কেবলমাত্র মানুষের হিদায়াতের জন্যই। সুতরাং কুরআনের মাধ্যমে সমসাময়িক মানবিক জ্ঞানের অনুমোদনের চেষ্টা করে না। কিংবা এটা বুঝার জন্য সেই জ্ঞান অপরিহার্য নয়। যদিও বা উপলব্ধি-ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য এ থেকে সাহায্য পাওয়া যেতে পারে।
কুরআনের সাহায্যে কুরআন বুঝুন
নয়ঃ কুরআনের সর্বোৎকৃষ্ট তাফসীর হচ্ছে কুরআন নিজেই। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় অনেক শব্দ ও বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি হয়েছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে উদ্দেশ্যহীন পুনরাবৃত্তি নয়। একটি নির্দিষ্ট শব্দ বা বক্তব্যের পুনরাবৃত্তির মাধ্যমে এর অর্থের নতুন একটি দিক তুলে ধরা হয় এবং এর অর্থে নতুন একটি দিক তুলে ধরা হয় এবং এর অর্থে নতুন আলোর সন্ধান দেয়। সেই অর্থটি আপনার বুঝতে চেষ্টা করা উচিত।
অতএব, কোন একটি শব্দ, আয়াত, অনুচ্ছেদ বুঝার জন্য কুরআনের উপরই দৃষ্টিপাত করুন। দৃষ্টান্তস্বরূপ রব, ইলাহ, দীন, আবাদত, কুফর, ঈমান, যিকর এসব গুরুত্বপূর্ণ শব্দ বিভিন্ন স্থানে কুরআনে ব্যবহার করা হয়েছে তা অধ্যয়ন করে ভালো বুঝতে পারেন।
হাদীস ও সীরাতের মাধ্যমে বুঝুন
দশঃ রাসূল (সা) এর প্রধান দায়িত্বের একটি ছিল কুরআনকে বুঝানো ও ব্যাখ্যা করা। এ দায়িত্বটি তিনি পালন করেছেন তাঁর কথা ও কাজে দৃষ্টান্ত স্থাপনের মাধ্যমে। সুতরাং গোটা হাদীস শাস্ত্র এবং সীরাত কুরআন বুঝার জন্য এক মূল্যবান উৎস। যে হাদীসে তাফসীর রযেছে কেবলমাত্র সেই হাদীসই নয় বরং সব হাদীসই এর জন্য সহায়ক। দৃষ্টান্তস্বরূপ ঈমান, জিহাদ ও তওবাহ বিষয়ক হাদীস কুরআন বুঝার জন্য আপনার বিরাট সহায়ক হবে, যখন আপনি অনুরূপ বিষয়বস্তুর মুখোমুখি হবেন।
ভাষা
একাদশঃ ভষাই কুরআনের প্রথম চাবি। ভাষার মাধ্যমে কুরআন নিজেকে সুস্পষ্ট, জীবন্ত এবং বোধগম্য করে তুলে। আরবী ভাষার কিছু বৈশিষ্ট্য যা কুরআনে ব্যবহার করা হয়েছে, সে সম্পর্কে আপনাকে সচেতন থাকতে হবে।
প্রথমতঃ কুরআনের স্টাইল বক্তৃতার মতো লিখনের মত নয়। একটি বক্তব্যে কিছু আরবী ভাষার কিছু জিনিস অব্যক্ত থেকে যেতে পারে, যা প্রত্যক্ষ শ্রোতাদের বুঝার জন্য অসুবিধাজনক নয়। এটা এর কার্যকারিতা ও শক্তিবৃদ্ধি করে। কেননা, শ্রোতারা অব্যাহভাবে বক্তা, তাঁর শব্দ এবং তাদের পরিবেশের সাথে পারস্পারিক যোগাযোগ করে। অনেক বেশি বিস্তারিত কথা বক্তৃতাকে নিরস করে দেয়।
কুরআনে দেখা যায় আকস্মৎ কালের পরিবর্তন। এগুলো মূল পাঠের জীবন্ত তাৎপর্য বাড়িয়ে দেয়। এসবের পরিবর্তনে আপনাকে সতর্ক থাকতে হবে এবং নির্দিষ্ট করতে হবে যে, কাকে কি বলছে, অনেক সময় আকস্মৎ থেমে যাওয়ার ঘটনা আছে, আপনাকে এসব সনাক্ত করতে হবে।
দ্বিতীয়তঃ কেবলমাত্র এটাই নয় যে, আরবী ভাষা খুবই সংক্ষিপ্ত ও বিশেষ অর্থবোধক। প্রায়ই এটি সংশ্লিষ্ট শব্দ ও বাক্যাংশ ব্যবহার করে না। সুতরাং এখানে রয়েছে অস্পষ্টতা, অনুল্লেখ, সংযোজন, বিয়োজন, গোপন করা, বিকল্প শব্দের ব্যবহার এবং অন্যান্য বৈশিষ্ট্যসমূহ। এ ব্যাপারে আপনাকে সদা সকর্ত থাকতে হবে। এসব আপনি শিখতে পারেন কেবলমাত্র তাফসীর ও শিক্ষকের নিকট থেকে।
তৃতীয়তঃ শব্দ বা মূল পাঠের সরাসরি অর্থ কুরআন বুঝার জন্য যথেষ্ট নয়। সামগ্রিক বিষয়দৃষ্টি, কুরআনের বাচনভংগি, সাহিত্য কৌশল থেকে আপনাকে কিছু বুঝ ও অনুভূতি অর্জন করতে হবে, কুরআন অবতীর্ণ হওয়ার কালের মতো আরবী ভাষার জ্ঞান থাকলে তা হবে খুবই সাহায্যকারী। যদিও বা শিক্ষার্থী হিসেবে শুরুতে এটা আপনার আয়ত্বের বাইরেই থাকবে।
পদ্ধতিগত দিক-নির্দেশনা
উপরের আলোচনার কাঠামো ও সাধারণ মূলনীতির ভিত্তিতে কিছু পদ্ধতিগত দিক-নির্দেশনা আপনার জন্য খুব প্রয়োজনীয় হতে পারে।
শব্দ অধ্যয়ন
একঃ প্রথমত আপনি ঐসব শব্দের অর্থ জানতে চেষ্টা করুন যেসব শব্দ দ্বারা মূল পাঠ বুঝতে পারা খুব কঠিন, আপনার প্রাথমিক গাইড হবে অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত তাফসীর গ্রন্থ। অভিধান চর্চা করুন কিন্তু অভিধানের অর্থকেই যথার্থ মনে করবেন না। আপনার সর্বোত্তম এবং চূড়ান্ত গাইড হচ্ছে শব্দের অব্যবহিত মূলপাঠ যেমন সমস্ত কুরআন এবং এর বিশ্বদৃষ্টি।
মূল পাঠের বিষয়বস্তু
দুইঃ আপনি যদি শব্দসমূহ ও সরাসরি অর্থ বুঝেন, তাহলে অনুচ্ছেদটি মূল পাঠের বিষয়বস্তুর মধ্যে স্থাপন করুন এবং বুঝতে চেষ্টা করুন অর্থ কি? সামনের এবং পিছনের মূল পাঠ পড়ুন এবং প্রয়োজনে গোটা সূরাটি পাঠ করুন।
ঐতিহাসিক পটভূমিকা
তিনঃ যতটা সম্ভব প্রযোজনীয় প্রাসংগিক ঐতিহাসিক তথ্য সংগ্রহ করুন। কিন্তু এর বিশ্বাসযোগ্যতা সম্পর্কে নিশ্চিন্ত হতে হবে।
এ প্রসংগে নাযিলের কারণ বর্ণনা সম্বলিত হাদীসের সাক্ষাত পাবেন আপনি। ঐসব হাদীস গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিবে। কিন্তু দুটি বিষয় আপনাকে মনে রাখতে হবে।
প্রথমতঃ-এসব বর্ণনায় ওহী নাযিলের সময়কার এতিহাসিক ঘটনা সর্বদা হুবহু নাও বলা হতে পারে। পক্ষান্তরে সেই পরিস্থিতি যাতে প্রাসংগিক ও বাস্তব বিবেচনা করা হয়েছে।
দ্বিতীয়তঃ-প্রত্যাদেশ সম্পর্কে মূল পাঠের প্রমাণ অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। যখন এতিহাসিক তথ্য গ্রহণ করা হচ্ছে, তখন এটি নির্দিষ্ট করা উচিত নয়।
তৃতীয়তঃ-মূল বক্তব্য বুঝার ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক তথ্য কুরআন বুঝার জন্য বাধার কারণ হওয়া উচিত নয়।
মূল অর্থ
চারঃ সরাসরি আক্ষরিক অর্থ আত্মস্থ করার পর যথাসম্ভব চেষ্টা করুন যেভাবে কুরআনের প্রথম শ্রোতারা বুঝেছিলেন সেইভাবে বুঝতে। আক্ষরিক অর্থ বুঝা হয়তো বা সহজে হতে পারে। কিন্তু ১৪০০ বছর পর ভিন্ন সভ্যতা ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে মূল অর্থ বের করা কঠিন ও জটিল একটি কাজ। অসুবিধাগুলো আলোচনার স্থান এটা নয়। কেবলমাত্র সতর্কতার জন্য উল্লেখ করা হলো।
বর্তমান প্রেক্ষিতে অনুবাদ
পাঁচঃ আপনার পরবর্তী কাজ হচ্ছে আপনার নিজস্ব অবস্থার প্রেক্ষিতে পড়া ও বুঝার চেষ্টা করা। এটাও মূল অর্থ নির্ধারণের মতই একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। বিশেষ করে আপনি যদি আপনার ধারণা অনুযায়ী কুরআন পাঠের ফাঁদে পড়তে না যান। আবার এ সম্পর্কে ব্যাখ্যার জটিল সমস্যাগুলো নিয়ে এখানে আলোচনা করাও সম্ভব নয়। কিন্তু এটি এমন একটি কাজ যা আপনি অবজ্ঞা করতে বা এড়িয়ে যেতে পারেন। একটি প্রাথমিক মৌল বিষয়ে আপনি মনোযোগী থাকেন এবং পর্যবেক্ষণ করেন, তাহলে খোলা মন নিয়ে কুরআনের কাছে আসুন এবং আপনি যা চিন্তা করেন, তাই সঠিক স্বীকৃতি এই রায় থেকে বিরত থাকুন। কারণ এটি একটি ফাঁদ যা আপনার এড়িয়ে চলাই উচিত। জটিল আইনগত ও নৈতিক বিষয়াদির পরিবর্তে আপনার জীবনের জন্য অপরিহার্য বাণীর উপরই আপনার মনোনিবেশ করা উচিত। এটা সম্ভব এবং কখনও প্রয়োজনীতাও দেখা দিতে পারে আমাদের সমসাময়িক কালের পরিভাষা, ব্যাখ্যা এবং পরিস্থিতি সম্পর্কে কুরআনের দৃষ্টিভংগি সামনে নিয়ে আসা। কিন্তু এ বিষয়ে অত্যন্ত সজাগ ও সচেতন থাকতে হবে যে, কোন অবস্থাতেই যেন আসল অর্থ ও পরিভাষা হারিয়ে না যায়।
অপ্রাসংহিক অর্থ
ছয়ঃ দুরবর্তী, কষ্টকল্পিত, রূপকাশ্রিত অন্তর্নিহিত অর্থ যা সাধারণ মানুষ বুঝে না, তা আবিষ্কারে নিজেকে নিয়োজিত করবেন না। এমন অর্থ সম্পর্কে ভাবার প্রয়োজন নেই, যা আপনার জীবনের সাথে সম্পর্কিত নয় এবং কুরআনের প্রথম যুগের বিশ্বাসীদের জীবন ধারার সাথেও সম্পর্কিত ছিল না।
জ্ঞান ও প্রজ্ঞার স্তর
সাতঃ যে জ্ঞান ও প্রজ্ঞার আপনি অধিকারী, সেই স্তরেই অর্থ বুঝতে চেষ্টা করুন। যাই হোক, প্রথম শোতারা যে জ্ঞান স্তরের ছিলেন তা হারাবেন না যাতে করে আপনি গোল্লায় যান। আপনার নিজের জ্ঞানের কথাই কুরআনে পড়তে শুর না করেন।
বর্তমান মানবিক জ্ঞান
আটঃ এ ব্যাপারে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই যে, প্রতিটি ব্যক্তি কুরআন বুঝার জন্য তার নিজের জ্ঞানকে নিয়োজিত করবে। অবশ্য তার জ্ঞানটা কুরআনের মানদন্ডে উত্তীর্ণ হতে হবে। উত্থাপিত বিভিন্ন বিষয়ে দিক-নির্দেশনা পেতে হলে আধুনিক মানদন্ড প্রয়োজন। আপনার সমস্ত জ্ঞান বুদ্ধিকে কুরআন বুঝার জন্য আপনার সাহায্যে নিয়োজিত করুন। কিন্তু কখনও কুরআনকে আপনার সমসাময়িক জ্ঞানের সমর্থনে হাজির করবেন না। আজকের যুগের বিজ্ঞানের সমস্ত আবিষ্কার সম্পর্কে কুরআনকে দিয়ে ভবিষ্যদ্বণী করাবেন না। বিশেষ করে বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব সম্পর্কে সতর্ক থাকুন যেসব তত্ত্ব পরিবর্তনশীল বালিকণার মতো। কুরআনে আইনস্টাইন, কোপার্নিকাস, নিটশে অথবা বার্গসন এর তত্ত্ব অনুসন্ধান করা তেমনি ভুল হবে, যেমন ভুল ছিল টলেমি, এনিস্টটল এবং প্লেটো সম্পর্কে অনুসন্ধান।
যা আপনি বুঝতে পারেন না
নয়ঃ কুরআনে এমন অনেক শব্দ ও বাক্য রয়েছে অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও সেসবের অর্থ আপনি বুঝতে সক্ষম হবেন না। এটা এ কারণে হবে যে, আপনার পর্যাপ্ত জ্ঞান নেই অথবা এজন্য যে, এটা খুব কঠিন। এমন পরিস্থিতিতে অসুবিধাটা সম্পর্কে একটি নোট রেখে পরবর্তী অধ্যয়নে মনোনিবেশ করুন। এমন বিষয়ে সমস্যা সমাধানের জন্য সময় নষ্ট করবেন না, যা এক পর্যায়ে আপনার যোগ্যতাকে মিথা প্রতিপন্ন করবে।
রাসূল (সা) এর জীবন
কুরআন বুঝা এবং আত্মস্থ করার জন্য যতটা পারেন মহানকী (সা) এর নিকটবর্তী হন, যিনি প্রথম আল্লাহর নিকট থেকে কুরআন গ্রহণ করেছেন। তাঁর জীবন হচ্ছে কুরআনের অর্থ ও বাণীর সঠিক প্রতিচ্ছবি এবং নিশ্চিত হিদায়াতের প্রতীক এবং সর্বোত্তম ব্যাখ্যা। রাসূল (সা) এর জীবন হচ্ছে জীবন্ত কুরআন। আপনি যদি কুরআনকে দেখতে চান, তাহলে কেবলমাত্র পড়ার পরিবর্তে মুহাম্মদ (সা) এর জীবনকে দেখুন। কেননা হযরত আয়েশা (রা) বলেছেন, “তাঁর জীবনটা ছিল কুরআন ব্যতীত কিছুই নয়।” বিখ্যাত তাফসীর ইবনে কাছির, ইবনে জারীর, কাশশাফ এবং রাযীর চাইতে মহানবী (সা) এর জীবন চরিত্র কুরআন বুঝার জন্য আপনার কাছে অনেক বেশী সহায়ক হবে। নবী (সা) এর নৈকট্য লাভের জন্য প্রথমতঃ আপনাকে তাঁর জীবন চরিত্র পাঠ করা উচিত যতটা বেশী আপনার পক্ষে সম্ভব হয়। যদিও তাঁর জীবন বৃত্তান্ত সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু পাওয়া যাবে না তথাপি কুরআনের মধ্যে আপনি তাঁর জীবন চরিত্রের সর্বোত্তম বর্ণনা পাবেন। দ্বিতীয়তঃ তাঁর সুন্নাহকে অনুসরণ করার জন্য চেষ্টা করুন। এর মাধ্যমে আপনি সত্যি সত্যিই তাকে বুঝতে পারবেন। অতএব, কুরআনকে বুঝতে পারবেন এবং আল্লাহকে আপনি ভালোবাসবেন আর আল্লাহও আপনাকে ভালোবাসেন। (আলে ইমরান-৩:৩১)