৭: সামষ্টিক পাঠ
গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা
কুরআনের জ্ঞান ভান্ডারে পরিক্রমণের জন্য আপনাকে একটি অনুসন্ধান ও অধ্যয়নের সম্পদায়ের সাথে যোগ দিতে হবে বা সম্পৃক্ত হতে হবে। নিঃসন্দেহে আপনি ব্যক্তিগতভাবে কুরআন অধ্যয়ন করবেন। কিন্তু আপনি যদি অন্যান্য বিশ্বাসী এবং কুরআন অনুসন্ধানীদের সাথে সহপাঠী হিসেবে যোগ দেন, তাহলে অনেকগুণে আপনি লাভবান হবেন। সহচার্য আপনার হৃদয়কে অনেক বেশী উৎফুল্ল করবে এবং অনেক মন একসাথে মিলিত হয়ে অর্থকে আরও ভালো এবং অধিকতর শুদ্ধভাবে বুঝতে পারবে। কুরআন যে দীনের দায়িত্ব ও মিশন আমাদের জন্য নির্ধারিত করেছে এবং আমাদের জীবন যেমন হওয়া উচিত তা কেবলমাত্র অন্যদের সাথে মিলিতভাবেই অর্জন করা সম্ভব। সেই মিশন পূরন করে এবং কাজের মাধ্যমেই কেবলমাত্র আপনি কুরআনের সাম্ভাব্য পূর্ণ আশীর্বাদ পাওয়ার যোগ্যতা লাভ করতে পারেন।
তাৎপর্যপূর্ণভাবে কুরআনের অভিভাষণ প্রায় সর্বদাই সমষ্টিক। মুহাম্মদ (সা) যে মুহূর্ত থেকে কুরআনের প্রত্যাদেশ লাভ করা শুরু করেন, তখন থেকেই কুরআনকেন্দ্রিক একটি সমাজ বা সম্প্রদায় গড়ে তোলার ব্যবস্থা গ্রহণ করেন এবং তাঁর জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত (সময়) তিনি এ কাজে লাগিয়েছেন। ‘পড়ো’ এই আহবান- এর পরপরই এসেছিল ‘উঠো’, ‘জাগো’, ‘সতর্ক হও’- এই নির্দেশ। তোমার প্রভুর কিতাবে যা অবতীর্ণ হয়েছে, তা পড়া অব্যাহত রাখার অব্যবহিত পরই নির্দেশ আসে-
“হে নবী, তোমার আল্লাহর কিতাব হতে যা কিছু তোমার প্রতি ওহী হিসাবে নাযিল করা হয়েছে, তা শুনিয়ে দাও। তাঁর বলা কথার রদবদল করার অধিকার কারো নেই। তাঁর থেকে বেঁচে পালাবার কোন আশ্রয়ই তুমি পাবে না। আর তোমার দিলকে সেই লোকদের সংস্পর্শে স্থিতিশীল রাখো, যারা নিজেদের খোদার সন্তুষ্টি লাভের সন্ধানী হয়ে সকাল ও সন্ধায় তাঁকে ডাকে।” (আল কাহাফ- ১৮:২৭-২৮)
কুরআনে এইসব শিক্ষা অত্যন্ত পরিস্কার ও দৃঢ়ভাবে কুরআন গঠন ও তার উপর প্রতিষ্ঠিত একটি সংঘবদ্ধ ও শক্তিশালী সমাজের প্রয়োজনীয়তার সাথে যোগসূত্র রচনা করে।
আবার কোন নামাযই কুরআন পাঠ ব্যতীত সম্পূর্ণ হতে পারে না অথবা জামায়াত ছাড়া নামায পূর্ণ হতে পারে যদি না কোন উপযুক্ত কারণ বিদ্যমান থাকে। যদি কুরআন শ্রবণ করা, তা হৃদয়ংগম করা এবং তা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করার প্রয়োজন না থাকবে, তবে নামাযে কুরআন পাঠের উদ্দেশ্যই বা কি? এইভাবে দিনে পাঁচবার সামষ্টিক প্রয়াসের মাধ্যমে নামাযে কুরআন পাঠের উদ্দেশ্য হাসিল হতে পারে। কুরআনের পয়গাম বা বাণী সমগ্র মানব জাতির কাছে পৌঁছে দেয়ার দায়িত্বও কুরআন পাঠ এবং যথাযথভাবে ব্যাখ্যা করার সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। তিলাওয়াত শব্দটি যখন আরবী ‘আলা’ অব্যয়ের সাথে ব্যবহৃত হয়, তখন অর্থ হয় ‘যোগাযোগ করা’, ‘প্রচার করা’, ‘বিশ্বাস ঘটানো’, ‘শিক্ষা দেয়া’। এইভাবে তিলাওয়াত করা নবূয়াতের অন্যতম মৌলিক কাজ, অতএব নবীর উম্মতদের জন্যও।
“হে আল্লাহ! এদের প্রতি এদের জাতির মধ্য থেকেই এমন একজন রাসূল প্রেরণ কর, যিনি তাদেরকে তোমার আয়াতসমূহ পাঠ করে শুনাবেন। তাদেরকে কিতাব ও হিকমাত শিক্ষা দান করবেন এবং তাদের বাস্তব জীবনকে পরিশুদ্ধ ও সুষ্ঠুরূপে পড়বেন। তুমি নিশ্চয়ই বড় শক্তিমান ও বিজ্ঞ।” (আল-বাকারা ২:১২৯)
“যেমন আমি তোমাদের প্রতি স্বয়ং তোমাদেরই মধ্য থেকে একজন রাসূল পাঠিয়েছে, যে তোমাদেরকে আমার আয়াত পড়ে শুনায়, তোমাদের জীবন পরিশুদ্ধ ও উৎকর্ষিত করে, তোমাদেরকে কিতাব ও হিকমাতের শিক্ষা দেয় এবং যেসব কথা তোমাদের অজ্ঞাত, তা তোমাদেরকে জানিয়ে দেয়।” (আল-বাকারা:১৫১)
সূরা জুমআয় আল্লাহর হিদায়াত বুঝা ও তদনুযায়ী জীবন পরিচালনার ব্যর্থতাকে জুমআর নামাযে অংশ ব্যর্থতার আলোকে জোর দেয়া হয়েছে, যাতে জুমআর নামাযের সময় পার্থিব যাবতীয় কর্মকান্ড নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
পরিবার ও বাড়ীর লোকদের নিকট কুরআন পাঠ করার ব্যাপারে নিম্নোক্ত আয়াতে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে।
“স্মরণ রেখো আল্লাহর আয়াত ও হিকমাতপূর্ণ সেইসব কথা যা তোমাদের ঘরে শুনানো হয়ে থাকে, নিশ্চয়ই আল্লাহ সূক্ষ্মদর্শী ও অভিজ্ঞ।” (আল-আহযাব ৩৩:৩৪)
যারা কুরআন পাঠ ও অধ্যয়নের জন্য সমবেত হন, তারা আশীর্বাদপুষ্ট। কারণ তাদের উপর মহান আল্লাহর অশেষ করুনা নিয়ে ফেরেশতা নাযিল হয়। আল্লাহর রাসূল (সা) বলেন-
যখন মানুষ আল্লাহর কোন ঘরে কুরআন অধ্যয়ন এবং একে অপরকে শিখানোর জন্য সমবেত হয়, তখন তাদের উপর শান্তি বর্ষিত হয়, আল্লাহর ক্ষমা ও রহমতের ছায়াতলে তারা স্থান পায়, ফেরেশতাগণ পাখা দিয়ে তাদেরকে আচ্ছাদিত করে রাখেন এবং আল্লাহ তাদের সম্পর্কে তাঁর চারপাশের সবাইকে অবহিত করেন। (মুসলিম)
সুতরাং কেবলমাত্র একা কুরআন পড়ে ও অধ্যয়ন করে আপনার সন্তুষ্ট থাকা উচিত নয়। বরং কুরআনের ব্যাপারে অনুসন্ধানী এবং আগ্রহী যারা আছেন, তাদের খুঁজে বের করে দাওয়াত দিন যাতে সবাই এক সাথে কুরআন অধ্যয়ন করতে পারেন।
সামষ্টিক পাঠ দুই ধরনের হতে পারে
একঃযেখানে ছোট একটি গ্রুপ অধ্যয়নের জন্য প্রস্তুতি নিয়ে হাযির হন, কুরআন প্রশিক্ষণ প্রক্রিয়ায় প্রত্যেকে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন, তাদের মধ্যে কেউ বেশী জানা-শোনার অধিকারী হন এবং অধ্যয়ন পরিচালনা করে থাকেন। এ ধরনের অধ্যয়নকে আমরা স্টাডি সার্কেল বলতে পারি।
দুইঃযেখানে একটি বড় বা ছোট গ্রুপ সমবেত হন এবং একজন বিজ্ঞ মুফাসসিরের আলোচনা মনোযোগ দিয়ে শ্রবণ করেন। অংশগ্রহণকারীরা শুধু প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেন। এ ধরনের পাঠকে আমরা দারস, বক্তৃতা বা আলোচনা বলতে পারি।
আপনার জানা উচিত একটি স্টাডি সার্কেল কিভাবে পরিচালনা করতে হয় এবং কিভাবে দারস পেশ করতে হয়। এখানে আমরা একটি সাধারণ পথ-নির্দেশ দিতে পারি। আবার এটা উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, এর কোন নির্দিষ্ট মানদন্ড বা স্থায়ী প্রক্রিয়া হতে পারে না। প্রত্যেককেই তাদের নিজস্ব পদ্ধতির উন্নতি সাধন করতে হবে এবং তাদের প্রত্যেকের অবস্থা, সময় ও পরিবেশের উপর এটা নির্ভরশীল হবে। নিম্নে এ সম্পর্কে যে নির্দেশাবলী দেয়াহলো, তা পরামর্শ মাত্র। এসব পরামর্শ আপনার প্রয়োজন এবং সামর্থ্য অনুযায়ী প্রয়োগ করতে হবে।
চারটি মৌলনীতি
যেকোন সামষ্টিক পাঠের সাফল্যের জন্য চারটি নীতি রয়েছে।
একঃআপনার দায়িত্ব পালনের জন্য আপনাকে অবশ্যই সর্বদা যাবতীয় প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। এ কাজটি হালকাভাবে নেয়া যাবে না। সর্বশেষ মুহূর্ত পর্যন্ত প্রস্তুতি চালিয়ে যেতে হবে। অতি দ্রুততার সাথে নজর বুলিয়ে যাওয়াকে যথেষ্ট মনে করা যাবে না। গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা না করে কখনও কুরআন সম্পর্কে কিছু বলবেন না। এটা সর্বদা উত্তম যে, আপনি যা অধ্যয়ন করেছেন এবং যা বলতে চান, তার জন্য একটি নোট তৈরি করবেন।
দুইঃআপনি একজন শিক্ষার্থীই হন, অথবা কিছু জ্ঞান আহরণ করে থাকুন, আপনি দারস পেশ করুন বা কোন চক্রের আলোচনায় অংশগ্রহণ করুন সর্বাবস্থায় নির্দিষ্ট অংশের উপর আলোচিত প্রক্রিয়া অনুযায়ী আপনার ব্যক্তি-অধ্যয়নের একটি পরিকল্পনা থাকতে হবে।
তিনঃ সর্বদা আপনার নিয়ত পরিচ্ছন্ন এবং সঠিক রাখুন। কুরআন বুঝা, তদনুযায়ী জীবন পরিচালনা এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের ব্যাপারে আপনার নিয়তের স্বচ্ছতা অপরিহার্য।
চারঃ নিছক আনন্দ লাভ, কিংবা বুদ্ধিবৃত্তিক কৌতূহল নিবৃত্ত করা অথবা যুক্তি ও আলোচনার জন্য কুরআন অধ্যয়ন করবেন না। আপনার কুরআন অধ্যয়ন অবশ্যই আপনাকে কুরআন মেনে চলতে যেন উৎসাহিত করে এবং কুরআন আপনাকে যে মিশন দিয়েছে, তা যেন আপনি পরিপূর্ণ করতে পারেন, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
পাঠচক্র
গ্রুপ স্টাডি কার্যকর হওয়ার জন্য নিম্নোক্ত নিয়মাবলী আপনার জন্য সহায়ক হতে পারে।
অংশগ্রহণকারী
একঃ অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা ৩ থেকে ১০ হাতে পারে। জ্ঞান ও বুদ্ধিবৃত্তির দিক থেকে সমমানের বা কাছাকাছি মানের হওয়া উচিত। কোন কিছু কম হলে এটি একটি সংলাপে পরিণত হতে পারে। পক্ষান্তরে বেশী হলে সবার সক্রিয় অংশগ্রহণে অসুবিধা হতে পারে।
দুইঃ সব সময় জোর দিতে হবে মূল বাণী, বিষয়বস্তু এবং কি পথ-নির্দেশ ও শিক্ষাগ্রহণ করতে হবে, তার উপর। কখনও এমন চমৎকার বিষয়বস্তুর দিকে ঝুঁকে পড়া যাবে না, যার বাস্তব জীবনে কোন কার্যকারিতা নেই।
তিনঃ সব সদস্যকে তাদের লক্ষ্য, সীমাবদ্ধতা ও প্রক্রিয়া সম্পর্কে পুরোপুরি সতর্ক থাকতে হবে।
চারঃ সার্কেলের সদস্যদের অধ্যয়নের প্রতি এবং তা বাস্তবায়নের প্রতি নিষ্ঠা ও একাগ্রতা থাকতে হবে। এজন্য গভীর মনোযোগ ও কঠোর পরিশ্রম দরকার হবে। বিশেষ করে নিয়মিত প্রস্তুতি ও উপস্থিত থাকাটা গুরুত্বপূর্ণ।
পাঁচঃ তাদেরকে জানতে হবে কিভাবে তারা কুরআনের পথে অগ্রসর হবেন এবং কুরআনের মাঝে পথ কিরে নিবেন। এই বইটি পাঠ করলে তাদের কিছুটা কাজে আসতে পারে।
ছয়ঃ তাদের আগন্তুকের মত বলা উচিত নয়। বরং কুরআন বুঝতে ও মেনে চলতে প্রতিশ্রুতিশীল বিশ্বাসী ভাই হিসেবে বলতে হবে।
কিভাবে পরিচালনা করতে হবে
একঃ একজন সদস্য প্রথমে তার অধ্যয়নের একটি ফলাফল অর্থাৎ নির্দিষ্ট অংশ পড়ে তিনি কি বুঝেছেন, তা উপস্থাপন করবেন।
দুইঃ অন্যরা তখন আলোচনায় অংশগ্রহণ করবেন। তারা আরও বিস্তারিত ব্যাখ্যা, সংশোধন, সংযোজন, প্রশ্ন উত্থাপন কিংবা জবাব দান করবেন।
তিনঃ যদি সকল সদস্যকেই অধ্যয়ন করতে হয়, তাহলে আপনি যদি পূর্বাহ্নেই নির্ধারিত করে দেন যে, কে প্রথম আলোচনা উপস্থাপন করবেন, তাহলে সুবিধা হবে। এতে উপস্থাপনার মান ভাল হবে। অথবা যে কাউকে আলোচনা বা উপস্থাপনার জন্য আহবান জানাতে পারেন। এ প্রক্রিয়া গ্রহণ করা হলে সবাই সতর্ক থাকবে এবং কঠোর পরিশ্রম করবে।
চারঃ যদি কমপক্ষে একজন সদস্যও বেশী জ্ঞানের অধিকারী হন এবং মূল উৎস প্রয়োগের যোগ্যতা ও সামর্থ্য রাখেন, তাহলে সেটা খুবই ফলদায়ক হবে। মূল উপস্থাপকের আলোচনার কোন কমতি থাকলে তিনি তখন তা পূরণ করতে পারবেন। তিনি আলোচনার ধারা ও গতি নির্ধারণেও ভূমিকা পালন করতে পারেন।
পাঁচঃ কুরআনে অভিজ্ঞ এমন কেউ যদি থাকেন, তাহলে শুরুতেই আলোচনায় তার হস্তক্ষেপ করা উচিত হবে না। পক্ষান্তরে অংশগ্রহণকারীগণ আলোচনায় কি বলতে চান, তা বলতে দেয়া উচিত এবং তাদের বক্তব্য শেষে যদি দেখা যায় তাদের আলোচনায় ভুল আছে, তাহলে খুব ভদ্র ও নম্রভাবে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে হবে বা সংশোধণ করতে হবে অথবা তাদের আলোচনায় সাথে নিজের অভিজ্ঞতা যোগ করতে হবে। তার আলোচনার পদ্ধতি বিতর্কমূলক না হয়ে তা হবে পরামর্শ ও জিজ্ঞাসামূলক।
ছয়ঃ পাঠচক্র শেষে কোন একজন সদস্য, পরিচালক বা শিক্ষক হলেই উত্তম, আলোচনায় ব্যাপক বিষয়বস্তুর উপর সংক্ষিপ্ত উপসংহার টানবেন। সংশ্লিষ্ট আলোচনার মূল বিষয়বস্তু ও দাবী কি, তা উল্লেখ করা উচিত।
দারস
নিম্নোক্ত নির্দেশাবলী অনুসরণ করলে একটি দারস কার্যকরী হতে পারে।
প্রস্তুতি
একঃ শ্রোতাদের সম্পর্কে একটি পরিচ্ছন্ন ধারনা নিতে হবে। শ্রোতাদের জ্ঞানের স্তর, বুদ্ধিমত্তা, ঈমানের অবস্থা, তাদের উদ্বেগ ও চিন্তা, তাদের প্রয়োজনীয়তা এবং চাহিদা সম্পর্কে জানতে হবে।
দুইঃ আপনি যা বলতে আগ্রহী, তার চাইতে বরং শ্রোতাদের অবস্থা সামনে রেখে ও বিবেচনা করে দারসের জন্য নির্ধারিত অংশ ঠিক করুন।
তিনঃ আপনার উপস্থাপনার ধরন, ভাষা ও প্রকাশভঙ্গি শ্রোতাদের প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে।
চারঃ কুরআনের সত্যিকার বাণী যাতে শ্রোতাদের সামনে আপনি পেশ করতে পারেন এ জন্য আল্লাহর কাছে দুআ করুন, প্রার্থনা করুন।
পাঁচঃ অনুচ্ছেদটুকু পাঠ করুন এবং আপনার নোট লিখুন। আপনি কি বলতে চান? কিভাবে ও কোন ক্রমানুসারে বলতে চান? কিভাবে শুরু ও শেষ করতে চান?
ছয়ঃ আপনার হাতে যে সময় আছে তার প্রতি যথাবিহিত সম্মান দেখাতে হবে। কোনক্রমেই সময় অতিক্রম করবেন না। আপনার হয়তো অনেক সুন্দর সুন্দর পয়েন্ট বা কথা বলার থাকতে পারে এবং এসব বলার আগ্রহও আপনার মনে থাকতে পারে, কিন্তু মনে রাখবেন, আপনার শ্রোতারা সামর্থ্য খুবই কম, ধারণ-ক্ষমতাও সীমিত। তারা আপনার পান্ডিত্যের প্রশংসা করতে পারেন কিন্তু আপনার নিকট থেকে তেমন কিছু শিখতে তারা পারবেন না।
অনেক দীর্ঘ অনুচ্ছেদ সংক্ষেপে পেশ করা যায়, আবার অনেক ক্ষুদ্র অনুচ্ছেদ দীর্ঘক্ষণ ব্যাপী আলোচনা করা যেতে পারে। এর সবই নির্ভর করে একটি বিষয়ের উপর। আর তা হচ্ছে আপনার অদ্যয়নের প্রেক্ষিতে আপনি কি মেসেজ দিতেচান তা।
সাতঃ এ বিষয়ে পূর্ণ মনোযোগ দিতে হবে যে, আপনার মেসেজ অত্যন্ত পরিস্কার হতে হবে। আপনি শ্রোতাদের প্রতিক্রিয়া গ্রহণ এবং অনুসরণের জন্য যা উপস্থাপন করতে চান আলোচনায় তা পরিস্কার হওয়া জরুরী। অনুচ্ছেদের মূল বক্তব্যের সাথে এটি সংগতিপূর্ণ হতে হবে, আপনার ইচ্ছামত নয়।
কিভাবে পরিবেশন করবেন
একঃ আপনার মাত্র দুটি লক্ষ্য হবেঃ
প্রথমতঃ অন্যকে আল্লাহর বাণী শুনিয়ে আপনার দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে আল্লাহর রেযামন্দি বা সন্তুষ্টি হাসিল করা। দ্বিতীয়তঃ পরিচ্ছন্ন এবং কার্যকরভাবে আল্লাহর কুরআনের বাণীকে পরিবেশন করা।
দুইঃ মনে রাখবেন যে, শ্রোতাদের নিকট আপনার বক্তব্য কার্যকরভাবে পৌছা, তাদের হৃদয় ও মনের উপর প্রভাব বিস্তার করা সম্পূর্ণভাবে আল্লাহর উপর নির্ভরশীল। কিন্তু এর অর্থ এটা নয় যে, সম্ভাভ্য উত্তর প্রস্তুতি, কার্যকরভাবে পরিবেশন, কুরআনের বাণীকে তাদের কাছে জীবন্ত ও গতিশীল করে তোলা, তাদের উৎকন্ঠার সাথে সাদৃশ্য স্থাপন ইত্যাদির দায়িত্ব থেকে আপনি মুক্ত।
আপনার উপস্থাপনা উচ্চাঙ্গের ভাল বক্তাসুলভ কিংবা বাগ্মিতাপূর্ণ নাও হতে পারে। হতে পারে তা খুই সাদামাটা। কিন্তু আপনার নিয়ত এবং উদ্যমই হচ্ছে আসল জিনিস।
তিনঃ প্রথমে আপনি কুরআন তিলাওয়াত করবেন এবং তার অনুবাদ পেশ করবেন। এরপর প্রতিটি আয়াত পড়ে বা না পড়ে এবং অনুবাদ পুনরায় করে বা না করে ব্যাখ্যায় যেতে পারেন। অথবা সংক্ষিপ্ত ভূমিকা দিয়ে একটার পর একটা আয়াত অথবা কয়েকটি আয়াত একসঙ্গে ব্যাখ্যা করতে পারেন। কোন্ পদ্ধতি আপনি অবলম্বন করবেন, তা অবস্থা এবং সময়ের উপর নির্ভর করবে।
স্মরণ রাখবেন যে, শুরুতেই গোটা অংশ তিলাওয়াত করে নিতে হবে এটা সর্বদা জরুরী নয়। বিশেষ করে যদি সময় কম থাকে। বরং শ্রোতা মন্ডলীকে আপনার বক্তব্য শোনার জন্য পরিবেশ সৃষ্টিতে আপনি সেই সময় খরচ করতে পারেন।
চারঃ যতটা সম্ভব প্রতিটি আয়াত অথবা কতিপয় আয়াতের সাথে সম্পর্কিত বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির একটি সংমিশ্রণ আপনি ব্যবহার করতে পারেন। যদি আয়াত সংক্ষেপ এবং স্পষ্ট হয়, তবে আপনি তা প্রথমে পাঠ করে পরে বিস্তারিত ব্যাখ্যা করতে পারেন। ব্যাখ্যার আগে ও পরে আপনি মূল বক্তব্য দিয়ে যেতে পারেন।
যা আপনাকে নিশ্চিত করতে হবে তা হচ্ছে এই-প্রতিটি শ্রোতাই যেন এক সুসংগতিপূর্ণ একাত্মতা অনুভব করে। প্রতিটি বক্তব্য এমনভাবে উপস্থাপন করতেহবে যাতে আগের কথা ও পরের কথার মধ্যে একটি ধারাবাহিকতা বজায় থাকে।
পাঁচঃ আলোচনা শেষে আপনাকে অবশ্যই একটি মূল বিষয়বস্তুর সারমর্ম দিতে হবে এবং এতে কি শিক্ষণীয় পয়গাম রয়েছে তার উপর গুরুত্ব আরোপ করতে হবে। যদি সময় থাকে, তাহলে সমগ্র টেক্সট বা শুধুমাত্র অনুবাদও আপনি আবার পড়তে পারেন। সমাপ্তিকালে মুল পাঠ বা অনুবাদ পাঠ করার মাধ্যমে আপনি আপনার শ্রোতাদেরকে কুরআনের প্রত্যক্ষ সংস্পর্শে আনতে পারেন। এতে আপনার উপস্থাপনার আলোকে তারা কি বুঝতে পারলেন তারা তা অনুধাবন করতে পারেন।
ছয়ঃ এ ব্যাপারে আপনাকে সদা সতর্ক থাকতে হবে যে, আপনি নন, কথা বলবে কুরআন। যারা কুরআনের ভাষা এবং বাণী বাহককে জানতেন, তাদের জন্য কোন ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ ছাড়াই কুরআন ফলপ্রসু হয়েছে। এটা এখনও পর্যন্ত ফলপ্রসূ। শুধুমাত্র অতিরিক্ত নিজস্ব মতামত আরোপ করেই নয় বরং অতি দীর্ঘ এবং বিস্তারিত ব্যাখ্যা করতে গিয়েও আপনি কুরআনের বক্তব্যকে ব্যাহত করতে পারেন। আপনার দীর্ঘ ব্যাখ্যা- বিশ্লেষণ শেষ করতে করতেই আপনার শ্রোতারা কুরআনে কি বলা হয়েছে তার ভুলে যেতে পারেন। সুতরাং প্রথমত: আপনার বক্তব্য সংক্ষেপ করুন যতটা সম্ভব। দ্বিতীয়ত: কোন ক্ষেত্রে প্রয়োজনেই যদি দীর্ঘ হয়, তবে যতবার পারা যায় মূল পাঠে ততবার ফিরে আসা উচিত। কোনক্রমেই যেন আপনার শ্রোতা এবং কুরআনের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি না হয়। শুধু অর্থের দিক থেকেই নয় বরং শোনার দিক থেকেও।
সাতঃ আপনার নিজস্ব ব্যাখ্যা আল-কুরআনের ধাঁচে সাজান। হতে পারে সেটাই হবে সাফল্যের নিশ্চয়তা লাভের কার্যকর মাধ্যম।
এটা আপনার নিকট প্রাথমিকভাবে খুব কঠিন মনে হতে পারে। কিন্তু ক্রমান্বয়ে আপনি যতই কুরআনের নিকটবর্তী হবেন, বারবার কুরআন পাঠ করবেন, মুখস্থ করবেন, সেটা ততই আপনার নিজস্ব স্টাইলের অংশে পরিণত হবে।
আপনাকে অবশ্যই স্মরণ রাখতে হবে যে, কুরআনিক রচনাশৈলির কতিপর্য বৈশিষ্ট্য রয়েছে- এক: কুরআনের আবেদন হচ্ছে যক্তি ও আবেগ উভয়ের প্রতি। দুই: কুরআন হচ্ছে সংক্ষিপ্ত, নির্ভুল, প্রত্যক্ষ, ব্যক্তিগত এবং স্মৃতি জাগিয়ে তোলার মতো। তিন: কুরআন তার শ্রোতাদেরকে পছন্দ ও সিদ্ধান্তের মুখোমুখি করে এবং তাদের মধ্যে কর্ম-প্রেরণা সৃষ্টি করে। চার: এর ভাষা এতই শক্তিশালী যে, কুরআনের বাণী আপনার ভিতরে গভীরভাবে প্রবেশ করে। পাঁচ: যুক্তিগুলো এমনই হয়ে থাকে, যা শ্রোতারা বুঝতে পারেন। কুরআন তাদের প্রাত্যহিক জীবন থেকেই উদাহরণ গ্রহণ করে থাকে এবং সর্বদাই তাদের মধ্যে একটি প্রতিধ্বনি দেখতে পায়। এটা বিমূর্ত, যুক্তিসম্মত ও দূরকারীও নয়।
আটঃ বিমূর্ত বক্তব্য পেশ করবেন না। কিংবা কল্পিতকরণ ও নিয়মাবদ্ধকরণের বিনিময়ে কুরআনের গতিশীল প্রভাব বিনষ্ট করবেন না। কিন্তু সঠিক ধারণা ও বৈজ্ঞানিক উপস্থাপনা কুরআনের মর্মবাণী পরিবেশের জন্য খুই গুরুত্বপূর্ণ, যদি তা সহজ-সরল ভাষায় শ্রোতাদের হৃদয়ংগম করার মত করে উপস্থাপন করা যায়। কাজের প্রতি আহবান, প্রতিশ্রুতিবদ্ধ করা অবশ্যই আপনার দারসের অপরিহার্য উপাদান হতে হবে। এটি প্রকৃতি বা ইতিহসাই হোক, নোটিশ, বিবৃতি, সংলাপ বা ভাষণই হোক, প্রতিটি ক্ষেত্রে সাড়া দেয়ার জন্য একটি আবেদন, এগিয়ে আসার আহবান, কিছু সিদ্ধান্ত, কিছু কাজ ও পদক্ষেপের কথা বলা উচিত।
নয়ঃ কুরআনকে আপনার মতামত উপস্থাপন করার জন্য ব্যবহার করবেন না। বরং আল্লাহর বাণীর প্রকাশক বা ব্যাখ্যাকার হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলুন।
দশঃ কুরআনকে আপনার শ্রোতাদের হৃদয়ে প্রবেশ করতে দিন, কুরআনকে তাদের অন্তরে স্থান করে নিতে দিন। আপনার উপলব্ধি, ভালোবাসা, কুতজ্ঞতা ও উদ্বেগকে আলোকিত করতে দিন। এটাই হওয়া উচিত আপনার দারসের তৃষ্ণা।
এগারঃ আপনার শ্রোতাদের সাড়ার প্রতি আপনাকে সর্বদা মনোযোগী হতে হবে। আপনি যদি মনে করেন কোন একটি যুক্তি শ্রোতাদের আকৃষ্ট করতে পারছে না বা তাদের উদ্দীপ্ত করতে সক্ষম হচ্ছে না, সে অবস্থায় তা যতই মূল্যবান বিবেচিত হোক না কেন, যুক্তিটি আপনি সংক্ষেপ বা পরিত্যাগ করতে পারেন। সর্বদাই আপনি পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে বা দাবী মনে করলে নতুন বিষয়, স্টাইল সংযোজন করতে পারেন।