৪:পঠন পদ্ধতি
কুরআনের সাথে দীর্ঘস্থায়ী সাহচর্যই হতে হবে আমাদের হৃদয়ের সবচাইতে বড় আকাংখা ও কাজ। অতএব যত বেশী পারেন কুরআন অধ্যয়ন করুন। এ কাজে যত বেশী সময় আপনার পক্ষে ব্যয় করা সম্ভব, তত বেশী করুন। বিশেষ করে রাত্রিকালে। এভাবেই নবী (সা) এবং সাহাবা কিরাম আল্লাহর পথে নিজেদের প্রস্তুত করতে সক্ষম হয়েছিলেন সেই মহান গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের জন্য, যা কুরআন তাদের উপর ন্যস্ত করেছিল। এ ব্যাপারে কতিপয় নির্দেশিকা এবং বিধি রয়েছে, যা আপনাকে সর্বদাই বিবেচনায় রাখতে হবে।
আপনি কতবার পড়বেন
প্রতিদিন কুরআনের কিছু না কিছু অংশ আপনাকে অবশ্যই পড়তে হবে। বস্তুতপক্ষে এমন একটি দিনও অতিবাহিত হওয়া উচিত নয়, যেদিন আপনি কুরআনের জন্য কিছু সময় ব্যয় না করবেন। মাঝে-মধ্যে পড়া বা এক বড় অংশ পড়ার চাইতে নিয়মিত পড়াই উত্তম যদি তা খুব সামান্য অংশও হয়।
রাসূল (সা) বলেছেন, আল্লাহ সেই কাজই পছন্দ করেন, যা নিয়মিত করা হয়, তা যদি সামান্যও হয় (বুখারী, মুসলিম)। তিনি বিশেষ করে সতর্কবাণী উচ্চরণ করেছেন যে, আপনাকে অবশ্যই নিয়মিত কুরআন অধ্যয়নে মনোনিবেশ করতে হবে। অন্যথায় আপনি সহজেই ক্ষতিগ্রস্থ হবেন। কুরআনের সাথীদের কাহিনী হচ্ছে দড়িতে বাঁধা উটের মত, যতক্ষণ কেউ তা ধরে রাখে, ততক্ষণ তার হাতে থাকে আর যদি তা সে ছেড়ে দেয়, তাহলে পালিয়ে যায় (বুখারী, মুসলিম)।
কি পরিমাণ পড়বেন
এর কোন নির্দিষ্ট জবাব নেই। ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে এবং অবস্থাভেদে এটা কম-বেশী হবে। এর দিক-নির্দেশনা তাই হবে, যা আল্লাহ তাআলা যাবতীয় মানবিক উপায়-উপকরণ বিবেচনা করে বলেছেন-
যতটা কুরআন তুমি সহজে পাঠ করতে পার, ততটাই পড়তে থাক। (আল মুযযম্মিল- ৭৩:২০)
এ ব্যাপারে সাহাবা কিরাম ও তাঁদেরানুসারীদের প্রাকটিস সংগতভাবেই কম-বেশী ছিল। কেউ দুই মাসে, কেউ এক মাসে, কেউ দশ দিনে, কেউ এক সপ্তাহে এমনকি কেউ একদিনেও পুরো কুরআন শরীফ পড়ে শেষ করতেন। আমাদের উচিত নিন্মোক্ত হাদীসটিকে নিয়ন্ত্রক মাপকাঠি হিসেবে স্মরণ রাখা। যিনি তিন দিনের কম সময়ে কুরআন শেষ করেন, তিনি তা বুঝেন না। (আবু দাউদ, তিরমিযী)
একদা রাসূল (সা) হযরত ইবনে উমার (রা) কে এক মাসে কুরআন শেষ করতে বললে ইবনে উমার (রা) তার চাইতে কম সময়ে তা করতে পীড়াপীড়ি করলে রাসূল (সা) বলেন, সাত দিনের মধ্যে পড়ো, এর উপর বৃদ্ধি করো না (বুখারী)। কুরআন ৭ হিজব এবং ৩০ পারায় বিভক্ত। এ থেকেও কিছু ইংগিত পাওয়া যায় যে, কোনটা কাংখিত।
এ ব্যাপারে ইমাম নববীর উপদেশ বিশেষভাবে পণিধানযোগ্য। যিনি ধ্যানমগ্নভাবে কুরআন অধ্যয়ন করে এর গভীর অর্থ ও তাৎপর্য আবিষ্কার করতে পারেন, তার উচিত কম পরিমাণ পড়া। অনুরূপভাবে যাকে শিক্ষা, সরকারী কাজ বা ইসলাম কর্তৃক নির্ধারিত গুরুত্বপূর্ণ কাজে সময় নিয়োজিত করতে হয়, তিনি কম পড়তে পারেন। (কিতাবুল আযকার)
পড়ার পরিমাণটা নির্ভর করবে পড়ার উদ্দেশ্যের উপর। আপনি যদি শুধুমাত্র কুরআন অধ্যয়নে সময় দিতে চান অথবা দ্রুত সাধারণ ধারণা নিতে চান, আপনি দ্রুত পড়তে পারেন, বেশী পড়তে পারেন। আর আপনি যদি এ নিয়ে চিন্তা করতে চান ও বাস্তবে প্রতিফলিত করতে চান, তাহলে আস্তে-ধীরে পড়ুন এবং কম পড়ুন। ইমাম গাযযালী (রহ) একথাই বুঝিয়েছেন। তিনি বলেন, আমি কোন কোন সময় প্রত্যেক শুক্রবার কুরআন পড়ে শেষ করে ফেলি, কোন সময় প্রত্যেক মাসে আবার কোন সময় প্রত্যেক বছরে। এবং একভাবে আমি কুরআন সমাপ্ত করতে চেষ্টা করছি গত ত্রিশ বছর যাবত কিন্তু এ পর্যন্ত আমি তা পারিনি। (ইহ্য়িয়াউ উলুমিদ্দনি)
আমি মনে করি,আমাদের বর্তমান অবস্থায় আমাদের অধিকাংশেরই কমপক্ষে আট মাসে একবার করে কুরআনের সমস্ত অংশের একটি সাধারন পাঠ দেয়ার চেষ্টা করা উচিত। আপনি সরাসরি অর্থ বুঝুন আর অনুবাদের মাধ্যমেই বুঝুন এতে কোন মতেই প্রতিদিন ৫-১৫ মিনিটের বেশী সময় লাগার কথা নয়।
কিন্তু আপনার জীবদ্দশায় মাত্র কয়েকবার হলেও ৭ দিনে কুরআন পাঠ সমাপ্ত করতে চেষ্টা করা উচিত। অথবা এক মাসে বিশেষভাবে রমযান মাসে। কোন কোন সময় গভীর চিন্তা-ভাবনা করে খুব ধীরে-সুস্থে কুরআন অধ্যয়নে মনোনিবেশ করা উচিত যদি প্রতিদিন নাও হয়।
কখন পড়তে হবে
দিন বা রাতের কোন সময়ই কুরআন অধ্যয়নের জন্য অনুপযোগী নয়। কিংবা এ সম্পর্কে কোন দৈহিক ভংগিরও প্রয়োজন নেই। আল্লাহ বলেন, তোমার প্রভুর নাম স্মরণ কর সকালে এবং সন্ধ্যায় ও রাত্রির অংশবিশেষ। (আদ দাহর- ৭৬:২৫)
যারা উঠতে, বসতে ও শয়ন করতে সকল অবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ করে। (আলে ইমরান -৩:১৯১)
নিশ্চয় কুরআন অধ্যয়ন আল্লাহর স্মরণ বা যিকরের সর্বোত্তম পথ। ইমাম নববী (রহ) বলেন, সাহাবা কিরাম ও তাঁদের অনুসারীগণ দিনের বা রাতের যে কোন সময়ে কুরআন অধ্যয়ন করতেন, চাই তারা কোন জায়গায় অবস্থান করুক আর সফরই করুন।
এতদসত্ত্বেও এমন কিছু কাংখিত সময় আছে, যা কুরআন ও নবী (সা) কর্তৃক সুপারিশ করা হয়েছে- যে সময় কুরআন অধ্যয়ন করলে বেশী ফল পাওয়া যায় বা লাভবান হওয়া যায়। অতএব, নির্দিষ্ট কিছু ধরন বা মেজাজ আছে। রাতই কুরআন পাঠের সবচাইতে চমৎকার সময় এবং সবচাইতে কাংখিত ভংগি হচ্ছে নামাযে দাঁড়িয়ে। প্রাথমিক সূরা আল -মুযযাম্মিল এবং আরও কতিপয় স্থানে কুরআন আমাদের একথাই বলে। (আলে ইমরান- ৩:১১৩, আল আসরা- ১৭:৭৯, আয যুমার- ৩৯:৯)। রাত্রিকালীন নামাযে দাঁড়িয়ে কুরআন পড়া আপনার হৃদয়কে পাঠের সাথে একীভূত করে দেয় এবং আল্লাহর পথ নির্দেশের প্রতি আপনার আত্মসমর্পণের ইচ্ছাকে শক্তিশালী করে এবং তিনি যে মিশন আপনার উপর অর্পন করেছেন, তা পূরণ করতে সাহায্য করে।
এটা করতে হলে আপনার জন্য প্রয়োজন (ক) কুরআনের কিছু অংশ মুখস্ত করা এবং (খ) রাত্রিকালে কিছু সময়ের জন্য জেগে থাকা। কুরআর এ সীমাবদ্ধতা স্বীকার করে যে, নানা কারণেই সবসময় সবার পক্ষে এটা সম্ভব নাও হতে পারে। সুতরাং কুরআন আপনাকে এই অনুমতি দেয় যে, আপনি সহজভাবে যতটা পারেন, ততটা কুরআন পাঠ করতে থাকুন। এর অর্থ হচ্ছে যতটুকু অংশ সম্ভব, যত সময় সম্ভব এবং যে অবস্থায়ই সম্ভব আপনি কুরআন পাঠ করুন। রাত্রিকালীন নামাযে কুরআন অধ্যায়নের বিরাট প্রয়োজন ও অসাধারণ উপকারিতা রয়েছে। সুতরাং এ ব্যাপারে আপনার উচিত কিছু সময় ব্যয় করা তা যত কমই হোক, এমনকি কয়েক মিনিট হলেও। একটি নিয়মিত সমযের ব্যবধানে, ধরা যাক সপ্তাহে অথবা মাসে এ জন্য আপনাকে সময় দিতেই হবে।
এমনকি আদর্শ পথের সম্ভাব্য নিকটে থাকার জন্য আশা করা যেতে পারে যে, আপনি ফজর ও ইশা নামাযের আগে বা পরে অথবা সকালে কিংবা শয়নের আগে কুরআন শরীফ পাঠ করবেন। সকাল বেলা কুরআন শরীফ অধ্যয়নের ব্যাপারে বিশেষ ভাবে বলা হয়েছে (আল ইসরা ১৭:৭৮)। চেয়ারে বসে, বালিশে হেলান দিয়ে, বিছানা বা গাড়ীতে শয়ন করে কুরআন অধ্যয়ন যদিও কাম্য নয় তথাপি নিষিদ্ধও নয়। তবে বিনা কারণে কখনও এরূপ করবেন না বা এ ধরনের করবেন না। যাই হোক, কেউ যদি কুরআন পাঠ থেকে বঞ্চিত হন শুধু এ কারণেই যে, তিনি সঠিক ভঙ্গিমায় বসকে পারেননি, তিনি আরো মূল্যবান অনেক কিছু থেকেই বঞ্চিত হন।
শুদ্ধভাবে পড়া
আপনাকে অবশ্যই কুরআন শুদ্ধ করে পড়তে হবে। কমপক্ষে স্বরবর্ণ এবং অক্ষরগুলো সঠিকভাবে উচ্চরণ করতে হবে, যদিও বা তাজবীদের সমস্ত আর্ট শিখতে আপনি সক্ষম না হন। আরবী ভাষা এমন যে, স্বরবর্ণের উচ্চরণে সামান্য ভুল পড়লে মারাত্মকভাবে অর্থ পাল্টে যেতে পারে এবং অনেক সময় অর্থ সম্পূর্ণ বিকৃত হয়ে যায়।
এ ব্যাপারে নূন্যতম প্রাথমিক দক্ষতা হাসিলের জন্য প্রতিদিন এক ঘন্টা করে এক মাস অব্যাহত শিক্ষা লাভ একজন শিক্ষিত বয়ষ্ক লোকের জন্য যথেষ্ট।
শুদ্ধ কুরআন পড়া শিখার জন্য আন্তরিক প্রচেষ্টা থেকে কেউ ক্ষমা পেতে পারে না। যখন আপনি শিখেছেন, আপনি পারেন না- এটা আপনার পড়া পরিত্যাগ করার জন্য কোন কারণ হতে পারে না। একজন অনারব হয়তো কখনো শুদ্ধ পঠন কৌশল আয়ত্ত করতে পারবে না। অথবা আপনার তা শিখার সুযোগ নাও হতে পারে।
আমি এমন এক জনতার মধ্যে প্রেরিত হয়েছি, যাদের মধ্যে রয়েছে নিরক্ষর, বৃদ্ধ নরনারী, বালক-বালিকা এবং এমন সব লোক, যারা কখনও একটি বইও পড়েনি। (তিরমিযী)
হযরত জিবরাইল (আ) কে লক্ষ্য করে নবী করীম (সা) এর এ উক্তি থেকে প্রমাণিত হয় যে, এ ধরনের অসুবিধা সম্পর্কে তিনি সজাগ ছিলেন। সুতরাং আপনাকে এ সম্পর্কে তাঁর আশ্বাস-বাণীর কথা স্মরণ করা উচিত যদিও বা সেটাকে তিনি আপনার শিক্ষা লাভের উদ্যম শিথিল বা পরিহারের অযুহাত বানাননি।
যিনি কুরআন পাঠে পারদর্শী, তিনি সেই মহত ও পূণ্যবান ফিরিশতারই সাথী যিনি প্রত্যাদেশ নিয়ে আসেন। আর যিনি পড়তে গিয়ে হোঁচট খান এবং শুদ্ধভাবে পড়া যার জন্য কঠিন হয়ে পড়ে, তাকে পড়া এবং প্রচেষ্টা চালানোর জন্য দ্বিগুন পুরষ্কারে ভূষিত করা হবে। (বুখারী, মুসলিম)
সুন্দরভাবে পড়া
শুদ্ধভাবে কুরআন পড়ার পর এটাই কাম্য যে, কিরাআতের আর্ট শিখতে হবে যাতে করে সুন্দর, সুমধুর, মনোমুগ্ধকর এবং সুশ্রাব্য কন্ঠে কুরআন পড়তে পারেন। এ দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে অনেক হাদীস রয়েছেঃ
তোমার কন্ঠ দিয়ে কুরআনকে সৌন্দর্যময় করে তোল। (আবু দাউদ)
আল্লাহ অন্য কোন নবীর তিলওয়াত শুনেন না, যেরূপ তিনি কোন নবীর সুমধুর তিলওয়াত শুনেন (অর্থাৎ যিনি সুস্পষ্ট করে সুন্দরভাবে তিলাওয়াত করেন তা যেরূপ শুনেন তদ্রুপ অন্যের তিলাওয়াত শুনেন না)।
যে ব্যক্তি সুললিত কন্ঠে কুরআন পড়ে না, সে আমাদের অর্ন্ভুক্ত নয়। (বুখারী)
কিন্তু স্মরণ রাখতে হবে যে, সত্যিকার সৌন্দর্য তাই, যা অন্তরে আল্লাহর ভয় থেকে উৎসারিত।
তার তিলাওয়াত ও কন্ঠ এতই সুমধুর যখন আপনি তার তিলাওয়াত শুনবেন, তখন আপনি অনুভব করবেন যে, তিনি আল্লাহকে ভয় করছেন। (দারিসী)
মনোযোগের সাথে শ্রবণ
যখনই কুরআন তিলাওয়াত করা হয় মনোযোগের সাথে শুনুন এবং গভীর নীরাবতা অবলম্বন করুন।
এ সম্পর্কে কুরআন নিজেই বলেছে-
যখন কুরআন মজীদ তোমাদের সামনে পাঠ করা হয়, তখন তা খুব মনোযোগ সহকারে শ্রবণ কর এবং চুপচাপ থাকো। সম্ভবত তোমাদের প্রতিও রহমত নাযিল হবে। (আল আরাফ- ৭:২০৪)
এটা স্বাভাবিক যে, যখন আল্লাহ কথা বলেন, তখন আপনাকে অবশ্যই চুপচাপ থাকতে হবে। কিন্তু ‘শ্রবণের’ জন্য যে আরবী শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে তার অর্থ প্রাকৃতিক শ্রবণের একটি কাজই নয় বরং মনোনিবেশ ও গ্রহণের একটি বিশেষ পর্যায়কেও বুঝায।
কার্যত এ নির্দেশের বিপরীত কোন কিছুই করা যাবে না। কুরআন তিলাওয়াতের সময় কথা বলা বা বক্তৃতা করা কোনটাই করা যাবে না। কিরাতের ক্যাসেট বাজিয়ে তাকে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক হিসেবে ব্যবহার করে অন্য কিছু, যেমন কথা বলা বা হুইসপারিং করা- এসব করা যাবে না। সভা-সমাবেশ ও অনুষ্ঠানের শুরুতে যখন কুরআন তিলাওয়াত চলবে, তখন কেউ তার প্রতি মনোযোগ দিবে না তা হতে পারবে না।
কোন কোন ফকীহ নিকটস্থ কোন স্থানে উচ্চস্বরে কুরআন তিলাওয়াত চলাকালে নামায পড়াও নিষিদ্ধ করেছেন।
এ নিয়মের অপরিহার্য দাবী হচ্ছে, যদি উচ্চস্বরে কুরআন তিলাওয়াতের কারণে নিকটস্থ লোকেদের কুরআনের প্রতি মনোযোগ দিতে অসুবিধার সৃষ্টি হয় অথবা সাড়া দেয়া অসম্ভব হয় এমতাবস্থায় তিলাওয়াতকারীকে তার কন্ঠ নীচু করতে হবে অথবা নীরবে পড়তে হবে। প্রতিবেশীর প্রতি সদাচরণ-এটি হচ্ছে একজনের দায়িত্বের অংশবিশেষ। অধিকিন্তু কেউ যদি শুনতে আগ্রহী না হয়, তাহলে কুরআনের শ্রবণের ব্যাপারটা তার উপর চাপিয়ে দেয়া অনুচিত।
যারা শুদ্ধভাবে এবং সুন্দর তিলাওয়াত করতে পারে, তাদেরকে কুরআন তিলাওয়াত করতে অনুরোধ করা এবং অতঃপর মনোযোগের সাথে তা শ্রবণ করা খুবই কাংখিত। রাসূল (সা) তাঁর সাহাবাগণকে তাঁর নিকট কুরআন তিলাওয়াত করতে বলতেন। এ সম্পর্কে রাসূল (সা) যা বলেছেন, তা স্মরণ রাখা উচিতঃ
যিনি একটি আয়াত শ্রবণ করবেন, তাকে তার দ্বিগুণ পুরষ্কার দেয়া হবে। যিনি তিলাওয়াত করবেন এটি কিয়ামতের দিনে তার জন্য আলো হিসেবে হাজির হবে (আহমাদ)।
কুরআন খতম করা
যতবারই আপনি কুরআন খতম করুন না কেন, যখনই আপনি পুরো কুরআন পাঠ সমাপ্ত করবেন সে সময়টি আনন্দের, উৎসাহের এবং প্রার্থনার। ইমাম নববী (রহ) এ সম্পর্কে সাহাবা কিরাম (রা) ও তাবিঈনের অনুসৃত কতিপয় আমলের উল্লেখ করেছেন। এসব কাংখিত হলেও ফরয নয়। তবে আপনি যতটা পারেন তার অনুসরণ করুন।
একঃশুক্রবারের রাতে শুরু করা এবং বৃহস্পতিবার রাতে শেষ করা। কেউ কেউ সোমবার সকালে শুরু করা পছন্দ করতেন। অন্যরা ভিন্ন ভিন্ন সময় বেছে নিতেন, কোন সময়ই আশীর্বাদহীন নয়। প্রতিটি সময় কিয়ামতের দিন স্বাক্ষী হবে।
দুইঃশেষ অংশটুকু নামাযে পড়ুন, যদি খতম দেয়ার সময় আপনি একাকী হন।
তিনঃশেষ করার সময় অন্যদের ডাকুন এবং একসাথে আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পন করুন।
যখন সাহাবী আনাস ইবনে মালিক (রা) কুরআন খতম করতেন, তখন তিনি পুরো পরিবারের লোকদের সমবেত করতেন এবং আল্লাহর দারবারে দুআ করতেন (আবু দাউদ)। হাকাম ইবনে উতাইবা থেকে বর্ণিত, একদিন আমাকে মুজাহিদ এবং উবাদাহ ইবনে আবি হুযাফার নিকট পাঠানো হলে তারা বললেন, আমরা তোমাকে দাওয়াত করেছি কারণ আমরা কুরআন খতম করতে চাই এবং শেষ করার সময় আল্লাহর কাছে দুআ করতে চাই। অন্য একটি বর্ণনায় বলা হয়েছে, কুরআন খতম করার সময় আল্লাহর রহমত বর্ষিত হয়।
চারঃযেদিন কুরআন খতম করতে চান সেদিন রোযা থাকুন।
পাঁচঃকুরআন খতম করার পর পরই পরবর্তী খতমের জন্য আবার পাঠ শুরু করুন। অর্থাৎ সূরা নাস পড়ে শেষ করার পর সূরা ফাতিহা ও আল বাকারার কতিপয় আয়াত পাঠ করুন। এটি এক অর্থে হযরত আনাস ইবনে মালিক বর্ণিত হাদীসের দাবী পূরণ করবে।
‘উত্তম কাজ হচ্ছে পৌছা এবং অবস্থান করা ও যাত্রা শুরু করা।’ যখন জিজ্ঞেস করা হলো এর অর্থ কি? তিনি জবাব দিলেন, ‘কুরআন খতম করা ও পুনরায় শুরু করা।’
ছয়ঃকুরআন খতম করার সময় আল্লাহর কাছে নিজেকে সমর্পন করুন ও দুআ করুন। এ হচ্ছে আপনার দুআ কবুল এবং আল্লাহর রহমত নাযিলের সময়। এটি আমল করার জন্য বিশেষভাবে জোর দেয়া হয়েছে। কেউ যখন কুরআন তিলাওয়াত করে এবং অতঃপর আল্লাহর কাছে প্রার্থণা করে, চল্লিশ হাজার ফিরিশতা বলেন, আমীন। (দারিমী)
দুআ করুন বিনয়, ভীতি, আশা, নম্রতা ও দৃঢ়তা সহকারে। প্রার্থণা করুন নিজের জন্যে, তবে অবশ্যই সবকিছুর জন্য প্রার্থনা করুন। বিশেষ করে উম্মাহর গুরুত্বপূর্ণ সমষ্টিক বিষয়ে, উম্মাহর সম্মান ও মর্যাদার জন্য, এর শাসকদের ভালো হবার জন্য, দুশমনদের হাত থেকে মুসলিম উম্মাহর হিফাজতের জন্য, সৎকাজ ও তাকওয়ার বিষয়ে মুসলিমদের মধ্যে পারস্পারিক সহযোগিতা থাকার জন্যও প্রার্থনা করুন।
মুখস্ত করা
পবিত্র কুরআনের যতটা পারেন আপনি মুখস্ত করুন। হিফয তথা স্মৃতি সংরক্ষিত থাকার ক্ষেত্রে কুরআন অসাধারণ। আজকাল হিফয শব্দটিকে মুখস্থ করার সংকীর্ণ অর্থে ব্যবহার করা হলেও হিফয় বলতে বুঝে পড়া এবং আমল করা দুটোকেই বুঝায। সত্যিকার অর্থে ইংরেজীতে এমন কোন শব্দ নেই, যা যথার্থ ভাবে হিফয-এর সঠিক ও পুরো অর্থ প্রকাশে সমর্থ।
হিফয এমন একটি অতি প্রয়োজনীয় মাধ্যম যার দ্বারা কুরআন আপনারমধ্যে প্রবেশ করতে পারে। এটা কোন যান্ত্রিক বা শাস্ত্রীয় কাজ নয়। এটি উচ্চতর আধ্যাতিকতা ও একাগ্রতার গুরুত্ববহ। কেবলমাত্র হিফযের মাধ্যমেই আপনি নামাযে কুরআন তিলাওয়াত করতে পারেন এবং কুরআনের ঘোষকের সামনে দাঁড়িয়ে এর অর্থ সম্পর্কে ভাবতে পারেন। এছাড়াও হিফয কুরআনকে আপনার ভাষায় প্রবাহিত করে এবং এটা আপনার সর্বক্ষণিক সাথীতে পরিণত হয়। আপনি যত বেশী মুখস্ত করবেন কুরআন পাঠে গভীর মনোনিবেশ করতে এবং অর্থ হৃদয়ংগম করতে আপনার জন্য তত সহজ হবে।
মহানবী (সা) বিভিন্নভাবে এর উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। ‘কুরআন মুখস্ত কর, কেননা আল্লাহ সেই আত্মাকে শস্তি দেবেন না যার মধ্যে কুরআন রয়েছে।’ (শারহিস সুন্নাহ)
যার হৃদয়ে কুরআনের কিছু নেই তিনি হচ্ছেন এক নিঃসংগ বা ধ্বংস প্রাপ্ত বাড়ির মতে। (তিরমিযী)
অতএব, আপনার কুরআন অধ্যয়নের কিছু সময় থেকে এ জন্য বরাদ্দ করুন। একটি বৈজ্ঞানিক পন্থায় এ ব্যাপারে অগ্রসর হন। একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য আপনার লক্ষ্য স্থির করুন। ঐসব অংশ আপনার তালিকার অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত, যা নবী করীম (সা) নামাযে পড়তেন, অথবা দিন বা রাতের কোন অংশে পড়তেন, অথবা যা তিনি তাঁর সাহাবীদের পড়তে বলতেন, অথবা যেসবের উৎকৃস্টতা সম্পর্কে তিনি বর্ণনা করেছেন। কিছু অংশ কুরআন তিলাওয়াতকালে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই আপনাকে আকৃষ্ট করবে এবং আপনার উচিত এসব অংশও মুখস্ত করা।