পটভূমি: তাতারী আক্রমণে বিধ্বস্ত মুসলিম বিশ্ব
মুসলমানদের তাতারী আতংক
সপ্তম হিজরির প্রথমার্ধে তাতার শব্দটি ছিল মুসলমানদের কাছে ভীতি ও আতংকের প্রতীক। তাতারীদের হাতে একের পর এক মার খেতে খেতে মুসলমানরা বিশ্বাস করে নিয়েছিল, তাতারীরা অজেয়। আরবীতে প্রবাদ প্রচলিত ছিল: ইযা কীলা লাকা ইন্নাত তাতরা ইনহ্যযামু ফালা কতুসাদ্দিকু যদি বলা হয় তাতারীরা হেরে গেছে, তাহলে সে কথা বিশ্বাস করো না।
মুসলমানদের ওপর তাতারীদের এই মার আসলে আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদের জন্য নির্ধারিত হয়েছিল। কয়েকশো বছর থেকে তারা দীনের দায়িত্ব পালনে অবহেলা করে আসছিল। ভোগ বিলাসিতা ও পার্থিব লোভ লালসার পেছনে ছুটে বেড়াচ্ছিল তারা অন্ধের মতো। অনৈক্য, বিভেদ, আত্নকলহ তাদের দীন ও মিল্লাতের সংহতি বিনষ্ট করে ফেলেছিল এবং বিশেষ করে দুনিয়ায় ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা ও অন্যায়ের মূলোৎপাটনের যে দায়িত্ব তাদের উপর অর্পিত হয়েছিল তার সম্পূর্ণ উলটো পথে তারা চলতে শুরু করেছিল। ফলে আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদের জন্য এই ধরনের মারাত্মক শাস্তি ছাড়া আর কি আশা করা যেতে পারে?
মুসলমানদের ওপর এ শাস্তি শুরু হয় ৬১৬হিজরী থেকে। প্রায় ৪০বছর পর্যন্ত একটানা এ শাস্তি চলতে থাকে। তাদেরকে যেন স্টিম রোলারের সাহায্যে পিষে গুঁড়ো করে দেয়া হয়।
৬১৬ হিজরিতে সুলতান আলাউদ্দিন খাওয়ারযাম শাহের আমলে চেংগীজ খান সর্বপ্রথম ইসলামী রাষ্ট্রের সীমান্তে আক্রমণ চালায়। প্রথম আক্রমণের শিকার হয় ঐতিহ্যবাহী বোখারা শহর। বোখারা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। শহরের একটি লোকও প্রাণ নিয়ে পালিয়ে আসতে পারেনি। ঘরবাড়ী সব পুড়িয়ে ছাই করে দেয়া হয়। এরপর সমরকন্দ নগরীকে ভস্মীভূত করা হয়। এখানকার সমস্ত অধিবাসীকে হত্যা করা হয়। তারপর বড় ছোট সব শহর এই একই পরিণতির শিকার হয়। হামদান, কাযভীন, রায়, যানজান, মার্ভে, নিশাপুর ইত্যাদি শহরগুলো একের পরন এক ধ্বংশস্তুপে পরিণত হতে থাকে।
এ সময় ইসলামী বিশ্বের পূর্ব এলাকায় খাওয়ারযাম শাহ ছিলেন একমাত্র শক্তিশালী শাসনকর্তা। তিনি প্রতিরোধ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলার পর অন্যান্য ছোট খাটো শাসনকর্তারা সামান্যক্ষণের জন্যও ময়দানে টিকতে পারলেননা। তবুও আলাউদ্দিন খাওয়ারযাম শাহের পর তাঁর পুত্র জালাল উদ্দীন খাওয়ারযাম শাহ তাতারদের বিরুদ্ধে লড়ে চললেন। কিন্তু তাঁর অবস্থাও শেষ পর্যন্ত চরম পর্যায়ে এসে পৌঁছুল। লড়াইয়ে একের পর এক পরাজয় বরণ করতে করতে সেনাদল ও বন্ধু বান্ধবরা তাকে ছেড়ে চলে গেলো। তাতারীরা তাঁর পেছনে লেগে থাকল ছায়ার মত। মেষে তাতারীদের ভয়ে মাত্র কয়েকজন বিশ্বস্ত অনুচরের সাথে একটি অজ্ঞাত দ্বীপে তিনি মৃত্যু বরণ করলেন।
তাতারী আতঙ্ক মুসলমানদের মধ্যে এমনভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল যে, কোন তাতারীকে দেখলে মুসলমান মনে করতো যেন তার আজরাইল এসে গেছে। অনেক সময় একজন তাতারী একটি গলির মধ্যে ঢুকে একাই একশোজন মুসলমানকে হত্যা করেছে। তাদের কারোর হিম্মত হতো না তাতারীটির বিরুদ্ধে টু শব্দ করবে। এমন কি একবার একটি তাতারী মহিলা পুরুষের বেশে একটি গৃহে প্রবেশ করে একের পর এক সবাইকে হত্যা করে যেতে থাকে। দেখে মনে হচ্ছিল এতক্ষণ ধরে সবাই যেন শুধুমাত্র গলাটি বাড়িয়ে মৃত্যুকে বরণ করে নেবার জন্য প্রস্তুতি চালিয়ে আসছিল। হঠাৎ একজনের হুশ হলো, আরে এতো একটি তাতারী মেয়ে। সে তরবারির এক আঘাতে মেয়েটিকে সাবাড় করে দিল।
আর এক শহরের ঘটনা। একজন তাতারী একটি গৃহে প্রবেশ করে একজন মুসলমানকে গ্রেফতার করে। তার কাছে তরবারি ছিল না। তাই সে গৃহের মধ্যে রাখা একটি পাথর নিয়ে আসে। মুসলমানটির কল্লা সেই পাথরের গায় ঠেকিয়ে রাখে। সে হুকুম করে, আমি এখনই বাজার থেকে তরবারি এনে তোকে হত্যা করবো। তুই ঠিক এমনিভাবে থাকবি। খবরদার একটুও নড়বি না। এই বলে তাতারী বাজারে চলে যায়। কিন্তু তাতারীর আতংকে আধমরা মুসলমানটি পালাবার কথা চিন্তাই করেনি। ঠিক একইভাবে হাড়িকাঠে মাথা দিয়ে রাখে। ফলে বেশ কিছুক্ষণ পর তাতারীটি বাজার থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করে এনে নিশ্চিন্তে মুসলমানটির গলা কাটে।
মুসলমানদের মধ্যে এই অবিশ্বাস্য তাতারীভীতি সেকালের একটি জ্বলন্ত সত্য ছিল। আজকের যুগের মুসলমানরা একথা শুনে অবশ্যই অবাক হবে। আজকেরই বা কেন, সে যুগেই তাতারী আতংক কমে যাবার পর মুসলমানরা অবাক বিস্ময়ে চিন্তা করেছে, তাদের কি হয়ে গিয়েছিল? তারা জীবন্মৃত হয়ে গিয়েছিল কেন? আসলে আল্লাহর ভয় যখন মুসলমানদের মন থেকে তিরোহিত হয় তখন তারা দুনিয়ার সব কিছুকে ভয় করতে থাকে। আর আল্লাহর ভয়ে যখন তারা ভীত থাকে তখন আফগানিস্তানের মতো একটা ছোট অনুন্নত দেশের সাধারণ মুজাহিদ হলেও তারা রাশিয়ার মতো আধুনিক বিশ্বের একটি পরাশক্তিকেও তুচ্ছ জ্ঞান করতে শেখে।
ধ্বংসের প্রতীক তাতারী
তাতারীরা মুসলমানদের শুধু প্রাণনাশ ও ধনসম্পদ লুণ্ঠন করে ক্ষান্ত থাকেনি, তারা মসজিদ মাদ্রাসা ও লাইব্রেরিগুলোও ধ্বংস করে। তারা ছিল মধ্য এশিয়ার বর্বর উপজাতি। শিক্ষা দীক্ষা, সভ্যতা, সংস্কৃতির সাথে তাদের কোন সম্পর্ক ছিলনা। তাই মুসলমানদের সভ্যতা সংস্কৃতিকে ধ্বংস করার পাশবিক উন্মাদনায় তারা মেতে উঠেছিল। সমগ্র ইসলামের ইতিহাসে মুসলমানরা এ ধরনের অমর্যাদাকর পরিস্থিতির সম্মুখীন আর কোনদিন হয়নি। তাতারীদের এই জুলুম অত্যাচার ও ধ্বংসযজ্ঞের কাহিনী বর্ণনা করতে গিয়ে সে যুগের মুসলিম ঐতিহাসিকদের কলম কেঁপে উঠেছে। ঐতিহাসিক ইবনে আসীর লিখেছেন:
দুনিয়ার ইতিহাসে এ ধরনের মহাদুর্ঘটনার কোন নজীর নেই। এ ঘটনার সম্পর্ক সব মানুষের সাথে তবে মুসলমানদের সাথে এর সম্পর্ক বিশেষভাবে। কোন ব্যক্তি যদি দাবী করে, আদম আলাইহিস সালামের পর থেকে নিয়ে আজ পর্যন্ত দুনিয়ায় এই ধরনের ঘটনা আর ঘটেনি, তাহলে সে মোটেই মিথ্যা দাবী করবেনা। —– এই বর্বরতা কারোর প্রতি একটুও করুণা করেনি। তারা নারী, শিশু, পুরুষ, বৃদ্ধ সবাইকে হত্যা করেছে। গর্ভবতী মেয়েদের পেটে তরবারি মেরে পেট চিরে ফেলেছে এবং পেট থেকে বের হয়ে আসা অপরিপুস্ট বাচ্চাটিকেও কেটে টুকেরা টুকরো করেছে।
তাতারী ফেতনা সে সময় শুধু মুসলমানদের জন্য নয় সারা দুনিয়ার মানুষের জন্য ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এশিয়ায় মুসলমানদের ওপর তাতারীদের জুলুম নির্যাতনের কাহিনী শুনে ইউরোপের অধিবাসীরাও আতংকে কেঁপে উঠেছিল। তাতারীদের বর্বর অভিযান চেংগীজ খান থেকে শুরু হয় এবং তার প্রপৌত্র কুবলাই খান পর্যন্ত ৪০বছর ধরে চলতে থাকে তুফানের বেগে।
লাশের নগরী বাগদাদ
ঘরের শত্রু বিভীষণরাই চিরকাল ইসলাম ও মুসলমানদের সর্বনাশ করে এসেছে। অবশ্য সব দেশেই এরা জাতির শত্রু হিসেবে চিহ্নিত। কিন্তু ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য এরা যে ধ্বংস ডেকে আনে তার তুলনা নেই। কারণ মুসলমানদের পরাস্ত করতে পারে এমন শক্তি দুনিয়ায় নেই। একমাত্র আভ্যন্তরীণ কোন্দল ও বিরোধের কারণে যখন তাদের ঐক্য ও সংহতি বিনষ্ট হয় তখনই বাইরের কোন শত্রু মুসলমানদের পর্যুদস্ত করতে সক্ষম হয়। আর এই ঘরের শত্রু বিভীষণরা মুসলমানদের সেই আভ্যন্তরীণ বিরোধের আগুন উসকিয়ে দেয়।
এই বিভীষণরা হয় তিন জাতের। একদল হয় ইসলামের শত্রু। একদল মুসলমানদের শত্রু। আর একদল দেশের শত্রু। তবে তিন জাতের হলেও তাদের মধ্যে একটা অভাবনীয় সখ্যতা রয়েছে। যারা ইসলামের শত্রু তারা যে মুসলমানদের ও দেশের প্রেমে গদগদ এমনটি বলা যাবেনা। ইসলাম তাদের আক্রমণের কেন্দ্রস্থল। ইসলামের ওপর তারা এলোপাথাড়ি এবং সর্বশক্তি নিয়ে আক্রমণ চালায়। তবে অন্য দুটোর ওপরও কখনো কখনো চলে ছিটেফোঁটা আক্রমণ। মুসলমান ও দেশের শত্রুদের সম্পর্কেও এই একই কথা। ইসলামের দার্শনিক রূপকার কবি আল্লামা ইকবালও তাঁর এক কবিতায় ঘরের শত্রু বিভীষণদের এ তিনটি জাতের প্রতি ইংগিত করেছেন: তিনি বলেছেনঃ জাফর আয বাঙ্গাল সাদেক আয দক্ষিণ/ নাঙ্গে দ্বী, নাঙ্গে মিল্লাত, নাঙ্গে ওয়াতন বাংলার বিশ্বাসঘাতক মীর জাফর আর দাক্ষিণাত্যের মীর সাদেক, এরা হচ্ছে, দীন ইসলাম, মিল্লাতে ইসলামিয়া ও স্বদেশের কলঙ্ক। অর্থাৎ এ ঘরের শত্রু বিভীষণরা তি জাতেরেই হয়ে থাকে। এরা ইসলামের শত্রু, মুসলিম মিল্লাতের শত্রু এবং মুসলমানদের স্বদেশ ভূমিরও শত্রু। মুসলমানদের দেশে ও মুসলিম মিল্লাতের মধ্যে বাস করে কোন এক ব্যক্তি ইসলামের প্রতি চরম শত্রুতা পোষণ করার পরও মুসলিম মিল্লাত ও মুসলমানদের স্বদেশ ভূমির প্রেমে পাগলপারা হতে পারে কেমন করে, একথা মোটেই বোধগম্য নয়। আসলে ইসলামকে বাদ দিলে মুসলিম মিল্লাত ও মুসলমানদের স্বদেশভূমির পৃথক কোন অস্তিত্ব ও গুরুত্ব থাকেনা।
ইসলামের ইতিহাসে এই ঘরের শত্রু বিভীষণদের অস্তিত্ব কোনদিন বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। নিত্য নতুন রূপে এদের আবির্ভাব ঘটেছে। এখনো ঘটছে। সেদিন বাগদাদে এরাই ঘটিয়েছিল চরম ধ্বংস যজ্ঞ। ঘটনাটি ছিল ৬৫৬ হিজরি সালের।
ইসলাম, মুসলিম মিল্লাত ও তদানীন্তন ইসলামী বিশ্বের কেন্দ্রভূমি বাগদাদের বিশ্বাসঘাতকদের নেতৃত্ব দিচ্ছিল বাগদাদের শিয়া প্রধানমন্ত্রী ইবনে আলকামী ও তাতারী শাসকদের মুসলিম পরামর্শদাতা নাসিরুদ্দিন তুসী। এই বিশ্বাসঘাতকরা বাগদাদকে ধ্বংস করার জন্য একটি বিরাট ষড়যন্ত্র জাল বিস্তার করে। এ বিশ্বাস ঘাতকরা মনে করেছিল বর্বর তাতারীরা বাগদাদ আক্রমণ করে হত্যা ও লুণ্ঠন করে চলে যাবে তারপর তারাই হবে বাগদাদের একচ্ছত্র মালিক। এছাড়া ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব তাদের জন্য ছিল চক্ষুশূল। মুসলমানের ছদ্বাবরণে তারা ছিল আসলে মুনাফিক। তাই ইসলাম, মুসলমান ও মুসলিম জনপদের লাঞ্ছনা তাদের কলজে ঠাণ্ডা করে দেবার জন্য যথেষ্ট ছিল।
বর্বর তাতারী সেনারা তখন ছিল অপ্রতিরোধ্য। একের পর এক মুসলিম জনপদ ও নগরগুলো ধ্বংস করে তারা সারা ইসলামী জাহানে ত্রাস সৃষ্টি করে ফিরছিল। এ সময় ইবনে আলকামী ও নাসিরুদ্দিন তুসীর প্ররোচনায় তাতারীরা বাগদাদের দিকে এগিয়ে এলো। চেংগীজের নাতি হালাকু খান তার বিরাট বাহিনী নিয়ে বাগদাদের উপকণ্ঠে হাজির হলো।
ওদিকে প্রধানমন্ত্রী ইবনে আলকামী বাদশাহ মুসতাসাম বিল্লাহকে পরামর্শ দিল হালাকুর সাথে সন্ধি করার। বিপুল পরিমাণ সোনা ও উপঢৌকন পেলে হালাকু চলে যাবে বলে আশ্বাস দিল। আলকামীর পরামর্শে বাদশাহ হালাকুর শিবিরে গিয়ে তার সাথে সন্ধির শর্তগুলো চূড়ান্ত করে নিতে প্রস্তুত হলেন। বাদশাহর শিবিকা হালাকুর ছাউনিতে পৌঁছে গেলো। তারপর সন্ধিপত্রে সাক্ষী হিসেবে সই করার জন্য বাদশাহর উপর চাপ প্রয়োগ করে নগরের সব নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের তাতারীদের ছাউনিতে আনার ব্যবস্থা হলো। তারা আসার সাথে সাথে তাদের সবাইকে বাদশাহর সামনে হত্যা করা হলো। এভাবে বাদশাহর পত্র আদায় করে একের পর এক শহরের ক্ষমতাশালী ও মর্যাদাশালী লোকদের তাতারী শিবিরে এনে নৃশংসভাবে হত্যা করা হলো। কিন্তু তাতারীরা বাদশাহকে হত্যা করতে ভয় পাচ্ছিল। কারণ তারা ছিল কুসংস্কারে বিশ্বাসী। তারা শুনেছিল বাদশাহর রক্ত জমিনে পড়ার সাথে সাথেই কোন বিরাট আকারের ধ্বংস দেখা দেবে। তাই তারা ইতস্তত করছিল। তখন নাসিরুদ্দিন তাদের এমন একটা পরামর্শ দিল যার ফলে বাদশাহ মারা যাবে কিন্তু তার এক ফোটা রক্ত জমিনে পড়বে না। নাসিরুদ্দিনের পরামর্শে তারা বাদশাহকে বিরাট তোষকের মধ্যে পেঁচিয়ে বেধে ফেললো। তারপর লাথি ও আছাড় মারতে মারতে তাঁকে শেষ করে দিল।
বাগদাদের ভাগ্যে তারপর যা লেখা ছিল তাই হলো। ৪০দিন পর্যন্ত চললো হত্যা ও লুটতরাজ। চল্লিশ দিন পর সমকালীন বিশ্বের শ্রেষ্ঠ নগরী, স্বপনপুরী, জ্ঞান ও শিক্ষার কেন্দ্রভূমি, সভ্যতা ও সংস্কৃতির লালন ক্ষেত্র বাগদাদ প্রেতপুরী বলে মনে হলো। শহর সুনসান হয়ে গেলো। পথে ঘাটে, হাটে বাজারে কোথাও মাত্র দুচারটাতে মানুষ দেখা যেতো।
পথে হাঁটলে কিছু দুরে দুরে দেখা যেতো লাশের স্তূপ। মনে হতো যেন ছোট খাটো লাশের পাহাড়। এ সময় বৃষ্টি হলো। লাশ ফুলে গেলো। পচন ধরলো। সমস্ত শহরে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়লো। যারা বেঁচে ছিল তারা মহামারীতে আক্রান্ত হলো। এ দুর্গন্ধ বাগদাদ ছাড়িয়ে সিরিয়া সীমান্তেও প্রবেশ করলো। ঐতিহাসিকদের মতে এ সময় বাগদাদে প্রায় ১৮লাখ লোক নিহত হয়। হালাকু বাগদাদে প্রবেশ করে খৃষ্টানদের প্রকাশ্যে শরাব পান ও শুয়ারের গোশত খাবার নির্দেশ দিল। রমযান মাস ছিল। কিন্তু মুসলমানদের জোর করে শরাব পানে বাধ্য করা হলো। মসজিদের মধ্যে মদ ঢেলে দেয়া হলো। আযান নিষিদ্ধ করা হলো। বাগদাদ ছিল তদানীন্তন ইসলামী বিশ্বের কেন্দ্রস্থল। শহরের জনবসতি শুরু হবার পর থেকে এই প্রথমবার কাফেরদের করতলগত হলো বাগদাদ। সমগ্র ইসলামী বিশ্বে চরম হতাশা ছড়িয়ে পড়লো। বাগদাদের ধ্বংস কাহিনী যেখানে পৌছুলো সেখানকার মুসলমানরা মাতম করতে লাগলো। কিন্তু তারা কিছু করতে পারছিলনা। বিশ্বাসঘাতক শুধু বাগদাদেই নয়, সারা ইসলামী বিশ্বের সব দেশেই সক্রিয় ছিল। এই বিশ্বাসঘাতকদের নির্মূল না করা পর্যন্ত ইসলামী বিশ্বের সংকট মুক্তির কোন সম্ভাবনা ছিল না।
তাতারী অজেয় নয়
বাগদাদের পর তাতারীরা সিরিয়া অধিকার করলো। সিরিয়ার পথঘাট মুসলমানদের রক্তে ভেসে গেলো। নগরে গ্রামে লাশের স্তূপ জমে উঠলো। সর্বত্র একই অবস্থা। তাশখন্দ থেকে বোখারা, বোখারা থেকে বাগদাদ আর বাগদাদ থেকে দামেস্ক। কোথাও মুসলমানদের মাথা গুঁজবার ঠাই নেই। এরপর মিসরের পালা। মিসরবাসীরা ভালোভাবে বুঝতে পারলো তাদের দিন শেষ হয়ে আসছে। আল্লাহর গযব তাদের দিকে এগিয়ে আসছে।
কিন্তু মিসরবাসীরা শেষ পর্যন্ত চমক সৃষ্টি করলো। তারা এগিয়ে এসে তাতারীদের মোকাবিলা করার সিদ্ধান্ত নিলো। ৬৫৮ হিজরিতে মিসরের সুলতান আলমালিকুল মুযাফফর সাইফুদ্দীন কাতার আল্লাহর ওপর ভরসা করে তার সেনাবাহিনী নিয়ে এগিয়ে এলেন। মিসরের সীমানা পেরিয়ে তারা সিরিয়ার জালুত নামক স্থানে তাতারীদের বাধা দিলেন। তাতারীদের এতদিনকার সমস্ত রেকর্ড ভঙ্গ হলো। তারা পরাজয় বরণ করলো। প্রথম পরাজয়। শোচনীয় পরাজয়। অন্যদিকে মুসলমানদের বুকের বল হাজার গুণ বেড়ে গেলো। তাতারীরা অজেয়, এ বিশ্বাস ও ভয় তাদের মন থেকে মুছে গেলো। তারা দুরন্ত সাহসী হয়ে উঠলো। তাতারীদের তাড়িয়ে নিয়ে গেলো সিরিয়ার দূরদূরান্ত পর্যন্ত। তাতারীদের লাশ পথে ঘাটে চড়িয়ে পড়লো। তারা মরতে লাগলো মুসলমানদের হাতে শিয়াল কুকুরের মতো। বিপুল সংখ্যক তাতারীকে কয়েদীও বানানো হলো।
এরপরও তাতারীরা অবশ্য মিসরীয়দের হাতে আরো কয়েকবার পরাজিত হয়েছে। কিন্তু চতুর্দিকে যেভাবে তাতারীদের বিজয় অভিযান তুফানের বেগে এগিয়ে চলছিল তাতে মিসরীয়দের দৃঢ়তা কতটুকুইবা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিতে সক্ষম হয়েছে। তাছাড়া তখন তাতারীরা ছিল আক্রমণকারী আর মুসলমানরা করছিল প্রতিরক্ষার যুদ্ধ। এ অবস্থায় আক্রমণকারী অবশ্য ভালো পজিশনে ছিল, তাতে সন্দেহ নেই। সমগ্র ইসলামী বিশ্ব তাতারীদের তুফানী আক্রমণে ও বর্বর নির্যাতনে ধ্বংসের সীমান্তে এসে দাঁড়িয়েছিল। মনে হচ্ছিল মুসলমানদের আয়ু বুঝি আর বেশি দিন নেই। আল্লাহ বুঝি এ জাতিকে তার পাপের শাস্তি এ দুনিয়ায়ই দেবার সিদ্ধান্ত করে নিয়েছেন।
কিন্তু না, আল্লাহর সত্য দীনের যথার্থ অনুসারীরা তখনো দুনিয়ায় ছিলেন বিপুল সংখ্যায়। সামগ্রিকভাবে মুসলমানরা তখন আল্লাহর দীনের দায়িত্ব পালন করেনি। তাই জাতিগতভাবে তাদের ওপর নেমে এসেছিল আল্লাহর রোষাগ্নি। কিন্তু জাতিগতভাবে তারা আল্লাহর দীনকে পরিত্যাগ করেনি এবং তাদের একটি অংশ তখনো দীনের দায়িত্ব পালন করেন যাচ্ছিল। আর তাতারী আক্রমণের বিভীষিকা মুসলমানদের নিজেদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে নতুন করে চিন্তা করার এবং খাটি মুসলিম ও আল্লাহর অনুগত বান্দা হিসেবে বেচে থকার জন্য উদ্বুদ্ধ করলো। তাই আল্লাহ মুসলিম মিল্লাতকে দুনিয়ার বুকে আর একবার টিকে থাকার সুযোগ দিলেন। নয়তো এ পর্যন্ত কোন জাতি এধরনের ধ্বংসের সম্মুখীন হয়ে দ্বিতীয়বার মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি। যে জাতি একবার এক নতুন সভ্যতার জন্ম দিয়েছিল, পৃথিবীর বুকে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব চিহ্নিত ও সুপ্রতিষ্ঠিত করেছিল, কালের আবর্তনে একদিন তার নাম নিশানা মুছে গেছে। আবার দ্বিতীয়বার তার সেই একই স্বরূপে আত্মপ্রকাশ করে দুনিয়ার বুকে শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা লাভ করার সুযোগ হয়নি। গ্রীক, রোমান ও মিসরীয় জাতিদের সভ্যতা আমাদের সামনে রয়েছে। এই উপমহাদেশে আর্য সভ্যতার বিস্তার ও ব্যাপকতাও ছিল ঐতিহাসিক। কিন্তু একবার ধ্বংসের পর তারা শুধুমাত্র অতীতের পাতায়ই আশ্রয় নিয়েছে। তাদের ধর্ম, নৈতিকতা, রীতিনীতি সবই আজ বাসি। বনি ইসরাইলরা হাজার হাজার বছর পরে আবার আজকে ভূমধ্যসাগরের পাড়ে একটা নতুন রাষ্ট্র নিয়ে জেঁকে বসলেও তাদের আজকের সমাজ সভ্যতায় মূসা আলাইহিস সালামের দীনের ছিটেফোঁটাও নেই। পাশ্চাত্য সমাজ সভ্যতার অন্ধ অনুসারী হিসেবে তারা আসলে পাশ্চাত্য সভ্যতার এক অংকের অভিনয়ের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে মাত্র। আধুনিক ভারত সম্পর্কেও একই কথা।
কিন্তু ইসলাম আল্লাহর মনোনীত জীবন বিধান। কিয়ামত পর্যন্ত সমাজ সভ্যতার যে উপাদান এ জীবন বিধান সরবরাহ করে যাবে, মুসলমানরা দুনিয়ার যে এলাকায় যখনই তাকে আঁকড়ে ধরবে তখনই সাফল্য ও প্রতিষ্ঠা তাদের পায়ের তলায় এসে লুটোপুটি খাবে। তারা দুনিয়ায় মর্যাদার সাথে শ্রেষ্ঠ জাতি হিসেবে বেঁচে থাকতে পারবে। আজকের দুনিয়ার মুসলমানরাই এর প্রমাণ। ইসলামকে ত্যাগ করে পাশ্চাত্য সামাজিকতা ও মূল্যবোধকে আত্মস্থ করতে গিয়েই মুসলমানরা দুনিয়ার সর্বত্রই আজ লাঞ্ছিত। অথচ দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ সম্পদগুলো তাদের অধিকারে রয়েছে। পাশ্চাত্য চিন্তাধারা ও মূল্যবোধ তাদের ঐক্য বিনষ্ট করে একজনকে অন্যজনের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়েছে।
যাক, মুসলমানদের আধুনিক সংকটের কথা বাদ দিয়ে আমরা আবার সপ্তম হিজরিতে ফিরে আসছি। সেদিন ইসলামের দিকে প্রত্যাবর্তনই মুসলমানদের বাঁচিয়েছিল। এটা ইসলামের অফুরন্ত প্রাণশক্তির একটা প্রমাণ। কোন নির্জীব ও মৃতপ্রায় জাতি এটা গ্রহণ করার সাথে সাথেই তার বুকে জাগে প্রাণের জোয়ার। দুনিয়ায় শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত তার অভিযান চলতে থাকে।
ইসলামের ছায়াতলে তাতারীরা
প্রায় অর্ধশতাব্দীকাল তাতারীদের হাতে নির্যাতিত ও নিষ্পেষিত হবার পর মুসলমানরা আবার কেমন করে চাঙ্গা হয়ে উঠলো, সে এক চমকপ্রদ ইতিহাস। যারা মুসলমানদেরকে সবংশে নির্মূল করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল তারা নিজেরই মুসলমানদের সারিতে এসে দাঁড়াল। ইসলামকে দুনিয়ার বুক থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেবার জন্য যারা কসম খেয়ে বসেছিল তারা নত মস্তকে ইসলামের বাণী শিরোধার্য করে নিল। বিনা শর্তে তারা ইসলামকে নিজেদের একমাত্র জীবন বিধান বলে মেনে নিল। মধ্য এশিয়ার অর্ধসভ্য ও বর্বর তাতারীরা অবশেষে ইসলামের শ্রেষ্ঠত্বের কাছে মাথা নত করলো। তারা ইসলাম গ্রহণ করলো। তাতারীদের হাতে সপ্তম হিজরির ইসলামী বিশ্বের ধ্বংসযজ্ঞ যতটা বিস্ময়কর ছিল না তার চাইতে অনেক বেশি বিস্ময়কর ছিল তাদের ইসলাম গ্রহণের ঘটনা। কারণ মুসলিম সমাজ ও ইসলামী বিশ্বের আভ্যন্তরীণ দুরবস্থা সেকালে তাতারীদের মতো একটি তাজাদম ও কষ্টসহিষ্ণু জাতির বিজয়কে নিশ্চিত করে দেবে এতে বিস্ময়ের তেমন কিছু নেই। কিন্তু ইসলামকে লাঞ্ছিত ও ধ্বংস করতে এসে ইসলামের নিকট বিজিত হওয়া সত্যিই ইতিহাসের সবচাইতে বিস্ময়কর ঘটনা। ঐতিহাসিক টি, ডবলিউ আর্নল্ড তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ Preaching of Islam এ এই বিস্ময়কর ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে লিখেছেন:
কিন্তু ইসলাম তার অতীতের শান শওকতের ভস্মস্তূপ থেকে আবার জেগে উঠলো। যে বর্বর মোগলরা মুসলমানদের ওপর সব রকমের নির্যাতন চালিয়েও ছিল মুসলিম ধর্ম প্রচারক ও বক্তাগণ তাদেরকে ইসলামে দীক্ষিত করে নিলেন। এ কাজটা মুসলমানদের জন্য ছিল অত্যন্ত কঠিন। কেননা অন্য দুটি ধর্মের প্রচারকরা তাতারীদেরকে তাদের ধর্মে দীক্ষিত করার প্রচেষ্টা চালিয়েছিল। ইসলামের পক্ষে এ সময় খৃষ্ট ধর্ম ও বৌদ্ধ ধর্মের মোকাবিলা করে মোগলদের এ দুটি ধর্ম থেকে সরিয়ে এনে ইসলামের অনুসারী করা একরকম অসম্ভব কাজ বলে মনে হচ্ছিল। কারণ মোগলদের হাতে মুসলমানরাই হয়েছিল সবচেয়ে বেশি পর্যুদস্ত। যেসব বড় বড় শহর ইসলামী জ্ঞান চর্চার কেন্দ্রস্থল ছিল এবং যেখানে গড়ে উঠেছিল মুসলিম জ্ঞানী ও পণ্ডিত লোকদের আবাস, সেগুলো তাতারী মোগলদের অস্ত্রাঘাতে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল। মুসলমান আলেম ও ফকীহগণ হিত অথবা গোলামে পরিণত হয়েছিল। মোগল খানরা ইসলাম ছাড়া সব ধর্মের প্রতি ছিল উদার। ইসলামের প্রতি তারা পোষণ কতো অসীম ঘৃণা ও শত্রুতা। ——–ইসলামের প্রতি মোগলদের এ ধরনের হিংস্র মনোভাব পোষণ করার পরও তারা যে জাতিকে নিজেদের পায়ের তলায় দাবিয়েছিল অবশেষে তাদেরই ধর্ম গ্রহণ করে নিয়েছিল। (এটা সম্ভব হয়েছিল একদল আলেম, বুযর্গ ও সৎ মুসলিম ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর ঐকান্তিক প্রচেষ্টার কারণে। তবে এ ব্যাপারে সবচাইতে বড় ইতিবাচক ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন উচ্চশিক্ষিতা মুসলিম মহিলাবৃন্দ, তাতারীরা যাদেরকে লুণ্ঠন করে নিজেদের হেরেমে স্থান দিয়েছিল। এই সুন্দরী, সুশিক্ষিতা, সুরুচিসম্পন্ন ঈমানদার মহিলাগণ অন্তঃপুরে বসে বসে তাদের স্বামীদের অন্তর্জগতকে ইসলাম ও ঈমানের জন্য উর্বর করে তুলেছিলেন। )