ইমামের সংগ্রামী জীবনের প্রথম অধ্যায়
ইলমি ঘরানা
অষ্টম হিজরি শতকে ইমাম তাকীউদ্দীন ইবনে তাইমিয়া সমগ্র ইসলামী বিশ্বে ইসলামী পুনর্জাগরণে যে বিশিষ্ট ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন তার মূলে তাঁর খান্দানের অবদানও কম ছিল না। সমগ্র পরিবারটিকেই একটি ইলমী ঘরানা হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। তাঁর পরিবারের চতুর্থ পুরুষ ছিলেন তাঁর পরদাদা মুহাম্মদ ইবনুল খিযির। এই মুহাম্মদ ইবনুল খিযিরের মাতার নাম ছিল তাইমিয়া। তিন অসাধারণ বাগ্মী ছিলেন। বাগ্মিতায় তাঁর অসাধারণ খ্যাতি কিছুদিনের মধ্যে পরিবারটিকে তাইমিয়া পরিবার নামে সর্বত্র পরিচিত করে।
শায়খুল ইসলাম তাকীউদ্দীন আহমদ ইবনে তাইমিয়ার দাদা আল্লামা আবুল বারাকাত মাজদুদ্দীন ইবনে তাইমিয়া হাম্বলী মযহাবের শ্রেষ্ঠ আলেমদের মধ্যে গণ্য হতেন। কেউ কেউ তাঁকে মুজতাহিদ হিসেবেও উল্লেখ করেছেন। হাদিসের রিজাল শাস্ত্রে পারদর্শী ইমাম হাফেজ যাহাবী তাঁর বিলা গ্রন্থে লিখেছেনঃ মাজদুদ্দীন ইবনে তাইমিয়া ৫৯০ হিজরিতে জন্মগ্রহণ করেন। প্রথমে নিজের চাচা বিখ্যাত খতীব ও বাগ্মী ফখরুদ্দীন ইবনে তাইমিয়ার কাছে শিক্ষালাভ করেন। অতঃপর হিরান ও বাগদাদের আলেম ও মুহাদ্দিসদের কাছে উচ্চ শিক্ষালাভ করেন। ফিকহে তিনি পরিপূর্ণ জ্ঞান অর্জন করেন। এক্ষেত্রে তিনি ইমামের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত ছিলেন বলা যায়। তাঁর অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা ও ফিকহে গভীর পাণ্ডিত্য সর্বত্র প্রবাদের ন্যায় প্রচলিত ছিল। একবার জনৈক আলেম তাঁকে একটি ইলমী প্রশ্ন করেন। তিনি বলেন, প্রশ্নটির ৬০টি জবাব দেয়া যেতে পারে। এরপর একের পর এক করে ষাটটি জবাব দিয়ে গেলেন। ৬৫২ হিজরিতে তিনি ইন্তেকাল করেন। তাঁর শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ মুনতাকিউল আখবার। এ গ্রন্থে তিনি প্রত্যেকটি ফিকহী অধ্যায়ের সাথে সংশ্লিষ্ট হাদিসসমূহের উল্লেখ করেছেন, যেগুলোর উপর মযহাবের ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। ত্রয়োদশ হিজরি শতকের শ্রেষ্ঠ আলেম ও মুহাদ্দিস আল্লামা মুহাম্মদ ইবনে আলী আশ শওকানী, নাইলুল আওতার নামে বারো খণ্ডের এ গ্রন্থটির ব্যাখ্যা লিখে গ্রন্থটির বিষয়বস্তুর গভীরতা ও এর শ্রেষ্ঠত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন।
শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়ার পিতা শিহাবুদ্দীন আবদুর হালীম ইবনে তাইমিয়াও একজন শ্রেষ্ঠ আলেম, বুহাদ্দিস ও হাম্বলী ফিকহ শাস্ত্রবিদ ছিলেন। হিরান থেকে দামেস্কে চলে আসার পরপরই তিনি দামেস্কের জামে উমুরীতে দরসের সিলসিলা জারি করেন। দামেস্কের এ কেন্দ্রীয় মসজিদটি ছিল দেশের শ্রেষ্ঠ উলামা, ফকীহ ও মুহাদ্দিসগণের কেন্দ্রস্থল। কাজেই দেশের শ্রেষ্ঠ আলেমগণের উপস্থিতিতে দরস দেয়া চাট্টিখানি কথা ছিল না। তাঁর দরসের বৈশিষ্ট্য ছিল এই যে তিনি মুখে মুখে দরস দিতেন। সামনে কোন গ্রন্থ গ্রন্থের স্তূপ থাকতো না। সম্পূর্ণ স্মৃতির ওপর নির্ভর করে বড় বড় গ্রন্থের বরাত দিয়ে যেতেন। নিজের স্মৃতিশক্তির ওপর তাঁর নির্ভরতা ছিল অত্যধিক। এই সংগে তিনি দামেস্কের দারুল হাদিস আসসিকরিয়ায় শায়খুল হাদিস নিযুক্ত হন। ৬৮২ হিজরিতে তিনি ইন্তেকাল করেন।
শৈশব ও কৈশোর
দাজলা ও ফোরাতের দোয়াব অঞ্চল দুভাগে বিভক্ত। এর দক্ষিণ ভাগের এলাকাগুলোকে ইরাকে আরবী বলা হয়। বাগদাদ, বসরা প্রভৃতি শহরগুলো এর অন্তর্ভুক্ত। আর উত্তর বাগের এলাকাগুলো প্রাচীন আরবী সাহিত্যে দিয়ারে বাকার, দিয়ারে রাবীআ ও দিয়ারে মুদার নামে উল্লেখিত হয়েছে। আরব ভৌগলিকরা এ এলাকাকে বলেন আলজাযীরাহ। এর উত্তরে আর্মেনিয়া, দক্ষিণে ইরাকে আরবী, পূর্বে কুর্দিস্তান এবং পশ্চিমে এশিয়া মাইনর ও সিরিয়া মরুভূমি। এই এলাকায় আররিহা অবস্থিত। আররিহার দক্ষিণে প্রায় ৮ঘন্টা চলার পর যে শহরটিতে প্রবেশ করা যায় তার নাম হিরান। ইমাম ইবনে তাইমিয়ার পূর্ব পুরুষগণ এই হিরান শহরের অধিবাসী। ৬৬১ হিজরির ১০রবিউল আউয়ালে এই শহরে ইমাম ইবনে তাইমিয়ার জন্ম। ইতিপূর্বে আমরা ইমাম তাকীউদ্ধীন ইবনে তাইমিয়ার জন্ম এবং শৈশবেই তাতারীদের আক্রমণ থেকে নিষ্কৃতি লাভের জন্য তাদের দামেস্কে হিজরতের কথা বর্ণনা করেছি। তখন ইমামের বয়স ছিল মাত্র সাত বছর। তাতারী আক্রমণের দিগুলি ছিল অত্যন্ত ভীতি, আশংকা ও ভয়াবহতায় পরিপূর্ণ। মানুষ নিজের সব কিছু বিক্রি করা যায় কিন্তু পরিবারে কয়েক পুরুষ থেকে সঞ্চিত তাদের ইলমী মিরাস পারিবারিক পাঠাগারটি বিক্রি করতে তারা প্রস্তুত ছিলেন না। জানা যায় যাবে তবুও এ বিশাল পাঠাগারটি মাথায় করে নিয়ে হলেও তারা পথ অতিক্রম করবে, এ ছিল পরিবারের প্রত্যেকটি লোকের সংকল্প। ফলে এই ইলমী ঘরানাটি তাদের অনেক পারিবারিক প্রয়োজনীয় দ্রব্য বাদ দিয়ে কিতাবগুলো গাড়ি বোঝাই করতে লাগলো। কয়েকটি গাড়ি স্রেফ কিতাবেই ভরে গেলো। এবার সমস্যার ওপর সমস্যার ওপর সমস্যা হলো গাড়ি টানার জন্য গাধা বা ঘোড়ার অভাব। প্রায় সবাই দেশ ত্যাগ করছে। কাজেই মাল পত্র বহনের জন্য গাধা ঘোড়ার প্রয়োজন সবার। তাই এর অভাব দারুণভাবে দেখা দেবে এতো সহজ কথা।
শেষে এমন অবস্থা হলো, অনেকগুলো কিতাবের গাড়ি গাধা ঘোড়ার পরিবর্তে পরিবারের জওয়ান কিশোররা টেনে নিয়ে চললো। মাঝে মাঝে প্রৌঢ় ও বৃদ্ধরাও তাদের সাহায্য করতে লাগলো। কাফেলার গতি ছিল মন্থর। ফলে তারা পড়ে গেলো সবার পেছনে। এক জায়গায় শোনা গেল তাতারীরা এসে পড়েছে। কাফেলার গতি দ্রুত করা দরকার। কিন্তু একটা নতুন সমস্যা দেখা দিল। কিতাবের গাড়িগুলোর চাকা হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেলো। সেগুলো আর চলতে চায় না। গাড়ির চাকা গুলো ছিল বহু পুরাতন। এতদূর চলার মত ক্ষমতাও তাদের ছিল না। তবুও আল্লাহর মেহেরবানীতে এতক্ষণ চলে আসছিল। কিন্তু এখন হাজার ধাক্কা দিয়ে ও শত টানাটানি করেও চাকাগুলো আর ঘুরতে চায় না। পরিবারের সবাই মিলে আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করে দোয়া করতে শুরু করলো। আল্লাহ তাদের দোয়া কবুল করলেন। গাড়ি আবার চলতে লাগলো। কাফেলা দ্রুত এগিয়ে চললো।
দামেস্কে পৌছার পর দামেশকবাসীরা তাদেরকে সাদর অভ্যর্থনা জানালো। দামেস্কের বিদগ্ধ সমাজ আবুল বারাকাত মাজদুদ্দীন ইবনে তাইমিয়ার ইলমী কর্মকাণ্ড সম্পর্কে অবগত ছিল। আর শিহাবুদ্দীন আবদুল হালীম ইবনে তাইমিয়ার জ্ঞান ও পাণ্ডিত্যের খ্যাতিও দামেস্কে কম ছিল না। কিছুদিনের মধ্যেই পিতা আবদুল হালীম জামে উমুবীতে দরস এবং দারুল হাদিস আসসিকরিয়ায় অধ্যাপনার দায়িত্ব লাভ করলেন। কাজেই নতুন শহরের নতুন পরিবেশে তাইমিয়া পরিবার নিজেদেরকে মোটেই আগন্তুক মনে করলো না। শীঘ্রই তাদের জীবনযাত্রা স্বাভাবিক হয়ে এল। কিশোর ইবনে তাইমিয়া শীঘ্রই কুরআন মজিদের হিফয সম্পন্ন করে হাদিস, ফিকহ ও আরবী ভাষার চর্চায় মশগুল হলেন। এই সংগে তিনি পিতার সাথে বিভিন্ন ইলমী মজলিসে শরীক হতে থাকলেন। ফলে বিদ্যাশিক্ষার সাথে সাথে তাঁর জ্ঞান চর্চা ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের গতিও দ্রুত হলো।
ইমামের খান্দানের সবাই অসাধারণ স্মরণশক্তির অধিকারী ছিলেন। তাঁর পিতা ও দাদার কথা তো আগেই বলেছি। কিন্তু তাদের তুলনায় ইমাম তাকীউদ্দীন ইবনে তাইমিয়ার স্মরণশক্তি ছিল অসাধারণ। শিশুকাল থেকে তাঁর অদ্ভুত স্মরণশক্তি শিক্ষকদের অবাক করে দিয়েছিল। দামেস্কেও তাঁর স্মরণশক্তির চর্চা ছিল লোকের মুখে মুখে।
একবার হলবের (আলেপ্পো) একজন বিখ্যাত আলেম দামেস্কে আসেন। তিনি এখানকার তাকীউদ্দীন আহমদ ইবনে তাইমিয়া নামক একটি কিশোরের অদ্ভুত স্মরণশক্তির চর্চা শুনলেন। এর সত্যতা পরীক্ষা করার জন্য মাদ্রাসা যাবার পথে এক দরজীর দোকানে বসে গেলেন। কিছুক্ষণ পরে পথে অনেক ছেলেকে আসতে দেখা গেলো। দরজী দেখিয়ে দিল, ঐ বড় তখতি বগলে ছেলেটি ইবনে তাইমিয়া। তিনি ছেলেটিকে ডাকলেন। তার তখতিতে তের চৌদ্দটি হাদিসের মতন (মূল বর্ণনা) লিখে দিয়ে বললেন, পড়ো। কিশোর ইবনে তাইমিয়া একবার গভীর মনেযোগের সাথে পড়লেন। তিনি তখতিটি উঠিয়ে নিয়ে বললেন, মুখস্থ শুনিয়ে দাও। ইবনে তাইমিয়া গড়গড় করে বলে গেলেন। তখতি মুছে ফেলে এবার তিন একগাদা সনদ লিখে দিয়ে বললেন, পড়ো। পড়া হয়ে গেলে মুখস্থ বলতে বললেন। গড়গড় করে এবার সনদও বলে গেলেন। অবাক হয়ে গেলেন হলবের আলেম। বললেন, বড় এ ছেলে অসাধ্য সাধন করবে। কারণ এ ছেলে যে যুগে০ জন্মেছে সে যুগে এ ধরনের স্মরণশক্তি কল্পনাই করা যায় না।
জ্ঞান অর্জন ও জ্ঞান চর্চা
অষ্টম হিজরি শতকে ইমাম তাকীউদ্দীন আহমদ ইবনে তাইমিয়া ইসলামী পুনরুজ্জীবনের যে দায়িত্ব সম্পাদন করেন তার মূলে ছিল তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্য এবং দীনি ইলমে অসাধারণ পারদর্শিতা। এ ব্যাপারে সমকালীন আলেম ও বিদ্ধজ্জনমন্ডলীর মধ্যে তাঁকে অপ্রতিদ্বন্দ্বী বলা যায়। এই অতুলনীয় জ্ঞান তিনি লাভ করেন শিক্ষা, অনুশীলন ও চর্চার মাধ্যমে। নবী ও রসূলগণ আল্লাহর নিকট থেকে সরাসরি জ্ঞান লাভ করেন। এ জন্য তাঁদের দুনিয়ার কোন গ্রন্থ ও শিক্ষকের দ্বারস্থ হতে হয়নি। কিন্তু অন্য সকল মানুষকেই শিক্ষা ও অনুশীলনের মাধ্যমেই এ পৃথিবীতে জ্ঞান লা। ভ করতে হয়। আল্লাহ প্রদত্ত স্মৃতিশক্তি ও মেধা জ্ঞানের ডালি পরিপূর্ণ করার ক্ষেত্রে সহায়তা করে মাত্র।
ইমাম ইবনে তাইমিয়া সাত বছর বয়সে শিক্ষায়তনে প্রবেশ করেন এবং মাত্র বাইশ বছর বয়সে তাঁর জ্ঞানের ভাণ্ডার পরিপূর্ণ করে তোলেন। কুরআন, হাদিস, ফিকহ ও উসুলের সাথে সাথে তিনি আরবী ভাষা ও সাহিত্যে পারদর্শিতা অর্জন করার প্রতিও বিশেষ নজর দেন। তিনি দুশোর বেশি উস্তাদের কাছ থেকে হাদিস শেখেন। কুরআনের তাফসীরের প্রতি তাঁর আকর্ষণ ছিল সব চেয়ে বেশি। তিনি নিজেই বলেছেন, কুরআনের জ্ঞান আয়ত্ত করার জন্য তিনি ছোট বড় একশোরও বেশি তাফসীর গ্রন্থ অধ্যয়ন করেন। কুরআন মজীদ অধ্যয়ন এবং এর ওপর অত্যধিক চিন্তা গবেষণার কারণে আল্লাহ তায়ালা কুরআনের গভীর তত্ত্ব জ্ঞানের দরজা তার জন্য উন্মুক্ত করে দেন। তাফসীর গ্রন্থ পাঠের মধ্যেই তিনি নিজের জ্ঞান স্পৃহাকে আবদ্ধ করে রাখতেন না বরং এই সংগে গ্রন্থ প্রণেতার কাছেও চলে যেতেন। তাঁর সাথে সরাসরি আলোচনার মাধ্যমেও জ্ঞান বৃদ্ধি করতেন।
কুরআন অধ্যয়ন সম্পর্কে তিনি নিজেই বলেছেনঃ কখনো কখনো একটি আয়াতের অন্তর্নিহিত অর্থ অনুধাবন করার জন্য আমি একশোটি তাফসীরও অধ্যয়ন করেছি। তাফসীর অধ্যয়ন করার পর আমি আল্লাহর কাছে দোয়া করতাম, হে আল্লাহ, আমাকে এ আয়াতটির অর্থ সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান দান করো। আমি বলতাম, হে আদম ও ইবরাহীমের শিক্ষক! আমাকে শিক্ষা দাও আমি বিরান এলাকা ও মসজিদে চলে যেতাম এবং মাটিতে কপাল রেখে বলতাম, হে ইবরাহীমের জ্ঞানদাতা! আমাকে জ্ঞান দাও। কুরআন, হাদিস ও ফকীহর সাথে সাথে কালাম শাস্ত্রেও তিনি গভীর পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। সে সময় কালাম শাস্ত্রে ইমাম আবুল হাসান আশআরীর দর্শন ও নীতিশাস্ত্রের চর্চা ছিল সবচাইতে বেশি। ইমাম ইবনে তাইমিয়া ও তাঁর পরিবারবর্গ ছিলেন হাম্বলী মযহাবের অনুসারী। আর হাম্বলীদের সাথে আশ আরীদের ছিল প্রচণ্ড বিরোধ। আসলে প্রতিপক্ষের দর্শন ও যুক্তি পদ্ধতি সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান লাভ করার জন্যই তিনি কালাম শাস্ত্র ভালভাবে অধ্যয়ন করেন। এর ফলে তিনি ইলমে কালামের ভেতরের দুর্বলতা, তাদের লেখকদের দুর্বল যুক্তি পদ্ধতি এবং এমনকি গ্রীক দার্শনিকদের গলদগুলোও সঠিকভাবে অনুধাবন করতে পারেন। ইলমে কালাম গভীরভাবে অধ্যয়ন করার পরেই তিনি এর যাবতীয় গলদের বিরুদ্ধে লেখনী পরিচালনা করন এবং শক্তিশালী যুক্তি প্রমাণের অবতারণা করে এম কতিপয় গ্রন্থ রচনা করেন যার জবাব সমকালীন লেখক ও দার্শনিকদের পক্ষে দেয়া সম্ভব হয়নি।
মোটকথা, আমাদের বক্তব্য হচ্ছে, ইবনে তাইমিয়া তাঁর যুগে কুরআন ও সুন্নাতের যথার্থ প্রতিনিধিত্ব এবং আল্লাহর দীনের শ্রেষ্ঠত্ব ও সত্যতা প্রমাণ করার সাথে সাথে মানুষকে ইলম ও আমলের গোমরাহি থেকে বাঁচার জন্য এমন ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করেন, যা আসলে ইতিহাসের সেই অধ্যায়ে প্রয়োজন ছিল। তাঁর সময় মানুষের চিন্তা ও জ্ঞান রাজ্যে যে নৈরাজ্য দেখা দিয়েছিল তিনি পরিপূর্ণরূপে তার মোকাবিলা করার ক্ষমতা লাভ করেন। তাঁর জ্ঞান ও কর্মের মধ্যে কোথাও জড়তা ও ভেজাল ছিল না। সবই ছিল স্বচ্ছ ও নিখাদ। কোন শাস্ত্রে বিশেষ পারদর্শী ব্যক্তি তাঁর সাথে সংশ্লিষ্ট শাস্ত্র সম্পর্কে বিতর্কে লিপ্ত হবার পর তাঁর কাছ থেকে সে সম্পর্কিত কোন নতুন জ্ঞান নিয়েই ফিরে এসেছেন, সাধারণত এটাই দেখা গেছে। তাঁর জনৈক বিখ্যাত প্রতিদ্বন্দ্বী আল্লামা কামালউদ্দীন যামসালকানী জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় তাঁর পারদর্শিতা সম্পর্কে মন্তব্য প্রসঙ্গে বলেছেন। কখনো দেখা যায়নি যে, তিনি কারোর সাথে বিতর্কে হেরে গেছে। কোন বিষয়ে কারোর সাথে বিতর্কে নামার পর দেখা গেছে সেই বিষয়ের বিশেষজ্ঞদেরকেও তিনি হার মানিয়েছেন।
বাইশ বছর কাল পর্যন্ত জ্ঞান লাভের পর তিনি জ্ঞান বিস্তারে কাজে আত্মনিয়োগ করেন। তাঁর বাইশ বছর বয়সের সময় তার মহান পিতা শিহাবুদ্দীন আবদুল হালীম ইবনে তাইমিয়া(৬৮২হিঃ) ইন্তেকাল করেন। তিনি ছিলেন দামেস্কের প্রধান দারুল হাদিস আসসিকারিয়ার প্রধান মুহাদ্দিস। তাঁর মৃত্যুতে এ পদটি শূন্য হয়। পর বছর তার সুযোগ্য পুত্র ইমাম তাকীউদ্দিন ইবনে তাইমিয়া এ পদটি পূরণ করেন। তিনি বাইশ বছর বয়সে হাদিসের প্রথম দরস দেন। এ দরসে দেশের শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস ও আলেমগণ উপস্থিত ছিলেন। যুবক আলেমের জ্ঞান ও পাণ্ডিত্য সবাইকে মুগ্ধ ও চমৎকৃত করে। এর একমাস পরে জুমার দিন শহরের প্রধান মসজিদ জামে উমুবীতে তিনি পিতার শূন্যস্থানে কুরআনের তাফসীর করার দায়িত্বে নিযুক্ত হন। তাঁর জন্য বিশেষভাবে মিম্বার তৈরি করা হয়। প্রতি সপ্তাহে তার তাফসীরের জনপ্রিয়তা বড়তে থাকে। কুরআনের তাফসীরে তিনি সমকালীন সব সমস্যা ও তার কুরআনিক সমাধানও বর্ণনা করতেন। এই সংগে তাঁর নিজের ব্যক্তিগত তাকওয়া, ঈমানী বলিষ্ঠটা ও সৎকর্মশীলতা জনগণকে বিপুলভাবে প্রভাবিত করে। এ সময় তাঁর সুনাম চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে।
অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রথম অভিযান
৬৯৩ হিজরিতে এক অপ্রীতিকর ঘটনায় তাঁকে সর্বপ্রথম মাঠে ময়দানে নেমে আসতে হয়। এ সময় আসসাফ নামক একজন ঈসায়ী সম্পর্কে লোকেরা সাক্ষী দেয় যে, সে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিরুদ্ধে অশোভন বাক্য উচ্চারণ করেছে। এ অন্যায় কাজ করার পর জনৈক আরবের কাছে সে আম্রয় নিয়েছে। একথা জানার পর ইমাম ইবনে তাইমিয়া ও দারুল হাদিসের শায়খ যয়নুদ্দীন আল ফারকী গভর্নর ইযযুদ্দীন আইউবের কাছে গিয়ে ঘটনার তদন্ত করে অপরাধীর শাস্তি দাবী করেন। গভর্নর অপরাধীকে ডেকে পাঠান। লোকেরা আসাফের সাথে একজন আরবকে আসতে দেখে আরবটিকে গালিগালাজ করতে থাকে। আরবটি বলে এ ঈসায়ীটি তোমাদের চেয়ে ভালো। এ কথা শুনে জনতা ক্ষিপ্ত হয়ে তাদেরকে ঢিল মারতে থাকে। মুহূর্তের মধ্যে বিরাট হাঙ্গামার সৃষ্টি হয়। গভর্নর এজন্য ইমাম ও তার সাথিকে দায়ী মনে তাঁদেরকে কারাগারে নিক্ষেপ করেন।
ঘটনার আকস্মিকতা ও নাটকীয় পট পরিবর্তনের প্রভাবিত হয়ে ঈসায়ীটি ইসলাম গ্রহণ করে। গভর্নর তার প্রাণের নিরাপত্তা বিধান করেন, পরে তিনি নিজের ভুল বুঝতে পেরে ইমাম ও তার সাথিকে কারামুক্ত করে তাঁদের নিকট মাফ চান। ইমামের জনপ্রিয়তা আরো বেড়ে যায়।
স্বার্থবাদী মহলের বিরোধী জোট
সপ্তম হিজরি শতকের শেষের দিকে ইমাম তাকীউদ্দীন আহমদ ইবনে তাইমিয়া যে সংস্কারমূলক কার্যাবলী শুরু করেন কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর মধ্যে ধীরে ধীরে তার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ জমে উঠতে থাকে। ইমাম মানুষকে সরাসরি কুরআন, সুন্নাহ এবং সাহাবা ও তাবেঈগণের কার্যক্রমের প্রতি আহবান জানান। অথচ এইসব কায়েমি স্বার্থগোষ্ঠী মানুষকে তাদের নিজেদের মনগড়া চিন্তা ও স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কর্মের দিকে পরিচালিত করছিল। সাধারণ মানুষ ও ইলমী মহলে ইমামের জনপ্রিয়তা দ্রুত বেড়ে যাচ্ছিল। কায়েমি স্বার্থবাদীদের চোখে এটা কাঁটার মত বিঁধছিল। ৬৯৮ হিজরিতে এই মহলের পক্ষ থেকে ইমামের বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম বিরোধিতা শুরু হয়। বিরোধীরা তাঁর চিন্তাধারার সাথে সাথে তাঁর ব্যক্তিত্বের ওপরও আক্রমণ চালায়।
ইবনে তাইমিয়ার পরিবার সিরিয়ায় মোটেই অপরিচিত ছিল না। ইতিপূর্বে আমরা এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছিল যে, তাঁর পরিবার তিন চার পুরুষ থেকে সিরিয়ায় ইলমী মহলে সুপরিচিত ছিল। তাঁর পিতা সমগ্র সিরিয়ায় এবং বিশেষ করে দামেস্কে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। ইমাম নিজেও শ্রেষ্ঠ ইলমী ব্যক্তিত্ব হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছিলেন। এরপরও বিরোধী পক্ষ তাঁর ইলমী যোগ্যতা, জ্ঞান, আকীদা বিশ্বাস ও কর্মকাণ্ডের ওপর আক্রমণ চালায়। ইমাম আল আকীদাতুল হামুবিয়াতুল কুবরা নামক একটি পুস্তিকা লিখে তাদের সমস্ত প্রশ্নের জবাব দেন। ৫০ পৃষ্ঠার এ পুস্তিকায় তিনি কুরআন, সুন্নাহ, সাহাবী ও তাবেঈগণের বাণী ও আমল থেকে সরাসরি যুক্তি ও প্রমাণ পেশ করেন। গ্রীক, রোমীয় ও ভারতীয় দর্শন প্রভাবিত মুসলিম দার্শনিক ও মুতাকাল্লিমগণের বিভ্রান্তির প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করেন। তাঁদের কুরআন ও সুন্নাহ বিরোধ চিন্তা ও বক্তব্যের যথাযথ পর্যালোচনা করেন। কঠোর ভাষায় তাদের শরীয়ত বিরোধী বক্তব্যের সমালোচনা করেন।
তাঁর এ পুস্তিকাটি বিরোধী মহলের চাপা আক্রোশকে যেন সজোরে উৎক্ষিপ্ত করলো। সত্যের এ অকুণ্ঠ প্রকাশ তারা বরদাশত করতে পারলো না। বিরোধী পক্ষগুলো একত্র হয়ে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনলো। তারা দাবী করলো, হানাফী কাজী শায়খ জালালুদ্দীনের মজলিসে তাঁকে হাজির হতে হবে এবং নিজের রচনা সম্পর্কে সাফাই পেশ করতে হবে। ইবনে তাইমিয়া তাদের এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন। এই বিবাদে শহরের গভর্নর আমীর সাইফুদ্দীন ইমামের পক্ষাবলম্বন করে বিরোধী পক্ষকে আহবান করলেন। কিন্তু তাদের অনেকেই আত্মগোপন করলেন। জুমার দিন ইমাম যথানিয়মে জামে উমুবীতে তাফসীর খতম করে কাজী ইমামুদ্দীন শাফেয়ীর মজলিসে গেলেন। শহরের শ্রেষ্ঠ আলেমদের একটি দলও তাঁর সহযোগী হলো। তাঁরা সবাই আল আকীদাতুল হামুবীয়্যা পুস্তিকাটি সম্পর্কে নানান প্রশ্ন করতে থাকলেন। ইমাম তাদের প্রশ্নের জবাব দিতে থাকলেন। ইমামের যুক্তিপূর্ণ জবাবে সবার মুখ বন্ধ হয়ে গেলো। ইমাম বিজয়ীর বেশে ফিরে এলেন। ফলে বিরোধী পক্ষের সমস্ত জারিজুরি খতম হয়ে গেলো। বিরোধিতাও আপাতত বন্ধ হয়ে গেলো।
কিন্তু সত্য ও ন্যায়ের বিরুদ্ধে যারা দাঁড়ায় তাদের মধ্যে খুব কমই আন্তরিকতা থাকে। খালেস নিয়তে একমাত্র দীনের স্বার্থে যারা কোন হকের বিরোধিতায় এগিয়ে আসে তারা এক পর্যায়ে তাদের ভুল বুঝতে পারে। কিন্তু স্বার্থবাদী ও বলিষ্ঠ মহলের চোখে ঠুলী বাঁধা থাকে, তাদের মন ও মস্তিষ্ক থাকে পুকুরের পচা পাঁকে ডুবানো। সত্যকে বুঝবার ও গ্রহণ করার তওফিক আল্লাহ তায়ালা তাদের কোন দিনই দেন না। এজন্য হাজার বার সত্য প্রকাশিত হলেও, দিনের আলো মতো তা চারদিকের আঁধার সম্পূর্ণরূপে দূর করলেও স্বার্থবাদী মহল তা কোনদিন উপলব্ধি করতে পারে না। তাই বইবেন তাইমিয়ার বিরোধিতা সাময়িকভাবে বন্ধ হলেও ভেতরে ভেতরে তা আবার পুঞ্জিভূত হতে থাকে। কিন্তু ঠিক এ সময়ই সিরিয়ায় তাতারী ফিতনা মাথা চাড়া দেবার কারণে দীর্ঘকাল পর্যন্ত তাঁর বিরুদ্ধে আর কোন পক্ষ এগিয়ে আসার সুযোগ পায়নি।
অন্যায় দমনে দল গঠন
৭০২ হিজরিতে সিরিয়া তাতারী আক্রমণ থেকে মুক্ত হবার পর ইমাম ইবনে তাইমিয়া আবার তাঁর সংস্কারমূলক কার্যাবলী শুরু করেন। অধ্যাপনা, তাফসীর ও দরসের কাজ তিনি যথারীতি চালিয়ে যেতে থাকেন। শিরক, বিদআত ও জাহেলিয়াতের বিরুদ্ধে আবার অভিযান পরিচালনা করতে থাকে। এ যুগে ঈসায়ী ও ইহুদীদের সাথে একত্রে বসবাসের কারণে মুসলমানদের মধ্যে অনেক ইসলাম বিরোধী আকীদা ও শিক্ষা বিস্তার লাভ করে। মুসলমানরা এমন অনেক কাজে লিপ্ত হয়, যা জাহেলিয়াতের স্মৃতিকে তাজা করে তোলে এবং কাফের ও মুশরিক কওমের কার্যাবলীর অনুরূপ বরং প্রকৃত পক্ষে তাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সঞ্জাত। দামেস্কের নহরে ফুলুতের তীরে ছিল একটি বেদী। এ বেদীটি সম্পর্কে অদ্ভুত ধরনের অলৌকিক কাহিনী প্রচলিত ছিল। জাহেলও কুসংস্কারাচ্ছন্ন মুসলমানদের জন্য এটা ফিতনা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। মুসলমানরা সেখানে গয়ে মানতে করতো। ৭০৪ হিজরিতে ইবনে তাইমিয়া একদল মজুর ও পাথর কাটা মিস্ত্রীদের নিয়ে সেখানে হাযির হন। তাদের সহায়তায় বেদীটি কেটে তার টুকরোগুলো নদীতে নিক্ষেপে করে তিনি শিরক ও বিদআতের এই কেন্দ্রটিকে ধ্বংস করেন। এভাবে মুসলমানরা একটি বিরাট ফিতনা মুক্ত হয়।
রসুলুল্লাহর সঃ অন্যায়ের বিরুদ্ধে জিহাদ সম্পর্কিত হাদিসটির ওপর তিন পুরোপুরি আমল শুরু করে দন। এ হাদিসটিতে বলা হয়: তোমাদের কেউ শরীয়ত বিরোধী কোন কাজ দেখলে নিজের শক্তি প্রয়োগ করে তা বদলে দাও। যে এভাবে মুক্তি প্রয়োগ করতে পারবে না, বাকশক্তি প্রয়োগ করে তাকে এর বিরোধিতা ও সংস্কার সাধন করতে হবে। আর যে তাও পারবে না সে নিজের মনের মধ্যে এর প্রতি বিরোধিতা ও ঘৃণা পুষে রাখবে। আর এটা হচ্ছে দুর্বলতম ঈমান। এ হাদিস অনুযায়ী শরীয়ত বিরোধী কোন কাজ দেখলেই তিন নিজের শক্তি ও সামর্থ্য মোতাবেক তার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণ করতেন। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তুলতেন। তা সংশোধন করে শরীয়ত অনুযায়ী তাকে বিন্যস্ত করতে সচেষ্ট হতেন।
শাসক সমাজ নিজেদের প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনে ব্যস্ত ছিলেন। জনগণের আমল আকীদার সংস্কার ও পরিচর্যা করার কোন দায়িত্ব তারা অনুভব করতেন না। আলেমগণ অনেক সময় সুস্পষ্ট শরীয়ত বিরোধী কাজের বিরুদ্ধে এগিয়ে আসতে ইতস্তত করতেন। কাজেই ইবনে তাইমিয়া একাই এর বিরুদ্ধে লড়ে যেতে থাকেন। এ জন্য তিনি নিজের ছাত্র ও সমর্থকদের একটি জামায়াত গড়ে তোলেন। এ জামায়াতটি সবসময় তাঁর সঙ্গে থাকতো। তাঁর বিভিন্ন কাজে সহায়তা করতো। এ জামায়াতটির সাহায্যে তিনি জনগণের দীনি জীবন নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করতেন।
এ সময় তার কাছে আল মুজাহিদ ইবরাহীম ইবনুর কাত্তান নামক এক বৃদ্ধকে আনা হয়। বৃদ্ধটি বিরাট সুফি দরবেশ হিসেবে পরিচিত ছিল। পোশাক ছিল ফকীরদের নানা বর্ণের শততালি দেয়া আজানুলম্বিত আলখাল্লা। মাথায় ছিল সন্ন্যাসীদের দীর্ঘ জটা। হাতের নখগুলো ছিল কয়েক ইঞ্চি লম্বা। মোচ এত দীর্ঘ ছিল যে তাতে সমস্ত মুখ ঢেকে গিয়েছিল। কথায় কথায় গালি দিতো। নেশা ভাং তার সার্বক্ষণিক অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। ইবনে তাইমিয়ার নির্দেশে তার আলখাল্লা কেটে টুকরো টুকরো করে দেয়া হলো। মাথার চুল কমিয়ে গোঁফ ছেঁটে দেয়া হলো। নখ কেটে দিয়ে তাকে তওবা করানো হলো যেন আর কখনো নেশা না করে এভাবে তিনি ব্যক্তিগত পর্যায়ে আরো বহু গোমরাহ লোকের সংস্কার সাধন করেন। তাদের পুনর্বার দীনের পথে আনেন।
দুটি ভ্রান্ত মতবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম
দুটি দার্শনিক মতবাদ মুসলিম সুফি ও দার্শনিকদের মধ্যে প্রবল হয়ে ওঠে অষ্টম হিজরি শতকে। ইমাম ইবনে তাইমিয়াকে এ দুটি ভ্রান্ত মতবাদের বিরুদ্ধে বিরাট সংগ্রাম করতে হয়। এ মতবাদ দুটি হচ্ছে ওয়াহদাতুল ওজুদ এবং হুলুর ও ইত্তেহাদ। আমাদের এ উপমহাদেশের দার্শনিক পরিভাষায় এ মতবাদ দুটিকে বলা হয় অদ্বৈতবাদ ও সর্বেশ্বরবাদ। পরবর্তীকালে উপমহাদেশের সুফিদের মধ্যেও এ মতবাদ দুটি প্রবল হয়ে ওঠে। মুজাদ্দিদে আলফেসানী হযরত সাইয়েদ আহমদ সরহিন্দকে এর বিরুদ্ধে এখানে প্রচণ্ড সংগ্রামে লিপ্ত হতে হয়। এ ব্যাপারে ইমাম ইবনে তাইমিয়া সর্বেশ্বরবাদ ও অদ্বৈতবাদের প্রধান প্রবক্তা মুহিউদ্দিন ইবনে আরাবীর (মৃত্যু ৬৩৮ হিজরি) ফুসুসুল হাকাম গ্রন্থের বরাত দিয়ে লিখেছেন, ইবনে আরাবী ও তাঁর অনুসারীদের মতে এ বিশ্বে একটি মাত্র স্বত্বার অস্তিত্ব রয়েছে। সৃষ্টির অস্তিত্বই হচ্ছে স্রষ্টার অস্তিত্ব। এ বিশ্ব জাহানে তারা সৃষ্টি ও স্রষ্টাকে দুটো পৃথক সত্তা হিসেবে স্বীকার করেন না। তারা একজন যে অন্য জনের স্রষ্টা একথা মানতে তারা প্রস্তুত নন। বরং তাদের মতে স্রষ্টাই হচ্ছে সৃষ্টি এবং সৃষ্টিই হচ্ছে স্রষ্টা। তাই তাদের মতে বনি ইসরাইলিদের যারা বাছুর পূজা করেছিল তারা আসলে আল্লাহকেই পূজা করেছিল। তাদের মতে ফেরাউনের আনা রব্বুকুমুল আলা আমিই তোমাদের শ্রেষ্ঠ খোদা এ দাবীটি যথার্থ ছিল। ইবনে আরাবী হযরত নূহ আলাইহিস সালামের সমালোচনা করে বলেন, তার কাফের কওম মূর্তি পূজার মাধ্যমে আসলে আল্লাহকেই পূজা করেছিল, আর তাঁর সময়ের তুফান ছিল আসলে মারেফাতে ইলাহির তুফান। এ তুফানের মধ্যে তারা ডুবে গিয়েছিল। ইবনে আরাবীর পরপরই এ দর্শনের আরো কয়েকজন বড় বড় প্রবক্তা দেখা যায়। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ইবনে সাবঈন, সদরুদ্দীন কুনুবী, বিলয়ানী ও তিলমিসানী। এদের মধ্যে তিলমিসানী কেবল বক্তব্য রেখেই নিশ্চেষ্ট ছিলেন না, তিনি বাস্তবেও এ দার্শনিক নীতি মেনে চরতেন। কাজেই তিনি ও তার অনুসারীরা মদ পান করতেন, হারাম কাজ করতেন। কারণ তাদের মতানুযায়ী অস্তিত্ব যখন একটি মাত্র সত্তায় বিরাজিত তখন হালাল হারামের পার্থক্য থাকবে কেন? তিলমিসানীকে বলা হয়, আপনাদের বক্তব্য কুরআনের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। জবাবে তিনি বলেন, কুরআন তো আসল শিরকে পরিপূর্ণ। কারণ কুরআন রব ও আরদের মধ্যে পার্থক্য করে। তার বিপরীত পক্ষে আমাদের বক্তব্যের মধ্যে আসল তওহীদ নিহিত। তিনি এও বলেন যে তাদের বক্তব্য কাশফের মাধ্যমে প্রমাণিত।
ভারতীয় বেদান্তবাদ ও বৌদ্ধ মহনির্বানবাদ প্রভাবিত এই ওয়াহদাতুল ওজুদ ও হুলুলী মতবাদের প্রকাশ্য বিরোধিতা করাকে ইমাম ইবনে তাইমিয়া তাতারীদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধের মতোই সমান গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। তিনি এ প্রসঙ্গে বিভিন্ন খৃষ্টান সম্প্রদায়ের সর্বেশ্বরবাদী মতবাদ(pantheism) এবং পূর্ববর্তী উম্মতগণের এ ধরনের যাবতীয় গোমরাহির বিস্তারিত তাত্ত্বিক পর্যালোচনা করেন। অতঃপর ইবনে আরাবী ও তার শাগরেদবৃন্দের মতবাদের কুরআন ও হাদিসের ভিত্তিতে চুলচেরা পর্যালোচনা করেন।
ইসলামের নামে প্রচলিত এসব ভ্রান্ত মতবাদের কঠোর সমালোচনা ইবনে তাইমিয়াকে কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর চক্ষুশূল পরিণত করে। একদল তথাকথিত তাত্ত্বিকও তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে। এক পর্যায়ে তারা সরকারের সহায়তা লাভ সমর্থ হয়। মিসরের তদানীন্তন শাসককে তারা ইবনে তাইমিয়ার বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলে। আর সে সময় সিরিয়া ও মিসর ছিল একই রাষ্ট্রভুক্ত। রাজধানী ছিল মিসরের কায়রোয়। সিরিয়া ছিল মিসরের অন্তর্ভুক্ত একটি প্রদেশ। সিরিয়ার ইলমী মহলে ইমাম ইবনে তাইমিয়ার প্রভাব ছিল অপ্রতিহত। প্রাদেশিক সরকারও তাঁর মতামত ও কাজের কদর করতেন। সিরিয়ার মুসলিম জনগণের তিনি ছিলেন চোখের মণি। তাই অনেক সময় প্রকাশ্যে ইসলাম ও শরীয়ত বিরোধী কাজে বাধা সৃষ্টি করার ব্যাপারে সরকারের নিশ্চেষ্টতা ও নির্বিকার-ত্বের ক্ষেত্রে তিনি নিজের শাগরেদবৃন্দ ও জনগণের বাহিনীর সহায়তায় এগিয়ে আসতেন। শরীয়ত বিরোধ কাজ বলপূর্বক বন্ধ করে দিতেন।
মিসরের কারাগারে
এ ছিল সিরিয়ায় তাঁর অবস্থা। কিন্তু মিসরের জনগণের মধ্যে তাঁর এ ধরনের প্রভাব তখনো বিস্তৃত হয়নি। কেন্দ্রীয় সরকারও তাঁর সম্পর্কে পুরোপুরি ওয়াকিবহাল ছিল না। কাজেই চক্রান্তকারীরা সহজেই এই সরকারকে প্রভাবিত করে। ৭০৫ হিজরির কোন মাসে মিসর থেকে বিশেষ শাহী ফরমানের মাধ্যমে ইমাম ইবনে তাইমিয়াকে কায়রোয় চলে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। ইমামের ছাত্র ও বন্ধুমহল প্রমাদ গোনেন। গভর্নর তাঁকে বাধা দেন। তিনি সুলতানের সাথে পত্র ও দূতের মাধ্যমে এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করার এবং তাঁর ভুল ধারণা দুর কারার দায়িত্ব নেন। কিন্তু ইমাম কারোর অনুগ্রহ গ্রহণ করতে চাননি। সবার অপরিসীম ভীতি ও আশংকাকে পেছনে রেখে তিনি কায়রোর পথে রওয়ানা হন। ২২ রমযান জুমার দিন তিনি মিসরে পৌঁছেন। কেল্লার জামে মসজিদের নামাজ পড়ার পর আলোচনা শুরু করতে চান। কিন্তু তাঁকে অনুমতি দেয়া হয়নি। সেখানেই জনতাকে তার বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলা হয়। তাঁর চিন্তা আকীদা ইসলাম বিরোধী। কাজেই জনতা তাঁর কোন কথাই শুনতে প্রস্তুত নয়। কাজী ইবনে মাখলুফ মালেকীর নির্দেশে তাঁকে কেল্লার বুরুজে কয়েকদিন আটক রাখার পর ঈদের রাতে মিসরের বিখ্যাত জুব (কুয়া) কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া হয়।
পরের বছর ৭০৬ হিজরির ঈদের রাতে গভর্নর এবং কয়েকজন কাজী ফকীহের পক্ষ থেকে ইমামকে মুক্ত করার প্রচেষ্টা চলে। তাদের কেউ কেউ এজন্য ইমামকে তাঁর আকীদা থেকে তওবা করার শর্ত আরোপ করেন। ইবনে তাইমিয়া এতে সম্পূর্ণ অস্বীকৃতি জানান। এ ব্যাপারে ছ’বার তাকে ডাকা হয় সরাসরি এসে কথা বলার জন্য। কিন্তু তিনি এ ডাকে সাড়া দেননি। প্রতিবারই তিনি হযরত ইউসুফের ন্যায় বলেন:
*********আরবী**************
তারা আমাকে যে দিকে ডাকছে তার চেয়ে এই কারাগার আমার কাছে অনেক প্রিয়।
নিজের শ্রেষ্ঠত্ব মাহাত্ম্য প্রতিষ্ঠা যেমন ইমামের লক্ষ ছিল না তেমনি অসৎ আলেমদের প্রভাব থেকে সরকারকে মুক্ত করাও তার ছিল একটি প্রধান উদ্দেশ্য। মুসলমানদের চিন্তা, আকীদা, বিশ্বাস ও কর্মকে সকল প্রকার শিরকের আবীলতা মুক্ত করে প্রভাত সূর্যের আলোর মত উজ্জ্বল করে তোলা এবং আল্লাহর দীনকে সব রকমের জড়তা ও বিভ্রান্তি মুক্ত করে সজীব ও সচল করে তোল তোলাই ছিল তাঁর জীবনের সাধনা। তাই নিজের গায় কোন প্রকার কলঙ্ক কালিমা মেখে কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করাকে তিনি দীনের গায় কলঙ্ক লেপন করার সমতুল্য বিবেচনা করেন।
ইমাম ইবনে তাইমিয়ার চরিত্রে এ বৈশিষ্ট্য আমাদের আজকের আলেম সমাজের জন্য যথেষ্ট চিন্তার খোরাক যোগাবে সন্দেহ নেই। দীনের ব্যাপারে যাতে কোন প্রকার বিভ্রান্তি সৃষ্টি না হয় এজন্য তিনি নিজেও ব্যক্তিগত সুখ সুবিধা আরাম আয়েশ বিসর্জন দেন। কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে দৈহিক ও মানসিক নির্যাতন সয়ে যেতে প্রস্তুত হন কিন্তু দীনের ওপর কোনও প্রকার নির্যাতন বরদাশত করতে মুহূর্তকালের জন্যও প্রস্তুত হননি।
ইমাম ইবনে তাইমিয়ার কারাগারের সাথি ছিলেন তাঁর সহোদর শায়খ শরফুদ্দীন ইবনে তাইমিয়া। শায়খ শরফুদ্দীন মজমুআ ইলমীয়া গ্রন্থে কারাগারের ঘটনাবলী বিস্তারিতভাবে লিপিবদ্ধ করে গেছে। তা থেকে সত্য ও ন্যায়ের ব্যাপারে ইমামের দৃঢ়তা, ধৈর্য ও অবিচল সংগ্রামের কথা জানা যায়।
মিসরের নায়েবে সালতানাতের পক্ষ থেকে একদিন জেলের দারোগা তাঁর কাছে আসেন। তিনি কারাগার থেকে মুক্তি লাভের ব্যাপারে ইমামের সাথে আলাপ করতে চান। ইমাম তাঁকে বলেন, কারাগারে তিনি দীর্ঘদিন আছেন অথচ তাঁর বিরুদ্ধে চার্জ কি, তিনি কি অপরাধ করেছেন, তা তিনি বিন্দুমাত্রও জানে না। কাজেই এ ব্যাপারে কোন আলাপ করতে হলে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের অন্তত চারজন দায়িত্বশীল জ্ঞানী গুণী লোকের একটি প্রতিনিধিদল আসতে হবে। তাদের সামনে তিনি নিজের বক্তব্য রাখবেন। তাহলে সেখানে তাঁর বক্তব্য বিকৃত আকারে সুলতানের কাছে পৌঁছবার সম্ভাবনা কম থাকবে।
এ কথায় দারোগা চলে গেলেন। কিন্তু তারপরও কোন প্রতিনিধি দল এলো না। দারোগা আবার এলেন। এবার সংগে করে আনলেন আলাউদ্দিন তাবরাগী নামক এক ব্যক্তিকে। আলাউদ্দিন তাবরাগী তাঁর কাছ থেকে ভুলের স্বীকৃতি আদায় করতে চাইলেন। আলাউদ্দিন নিজের পক্ষ থেকে একটা স্মারকলিপি লিখে এনেছিলেন। ইমামকে পীড়াপীড়ি করতে লাগলেন তাতে সই করার জন্য। এতে ইমামের বিরুদ্ধে অনেক মিথ্যা অভিযোগ ছিল। তিনি যা বলেননি এবং যা বিশ্বাস করেন না এমনই অনেক কথা এতে ছিল। ইমাম এর জবাবে বলেন, এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দেবার কোন অধিকার আমার নেই। এ বিষয়টি আল্লাহ, রসূল ও সমগ্র মুসলিম সমাজের সাথে সম্পর্কিত। আল্লাহর দীনের মধ্যে পরিবর্তন করার কোন ক্ষমতা আমার নেই। অথবা আপনাদের বা অন্য কারোর কারণে আমি আল্লাহর দীন থেকে সরে যেতে পারিনা। আল্লাহর দীনের ওপর কোন প্রকার মিথ্যা আরোপ করার মতো দুষ্কর্ম আমার দ্বারা সম্ভবপর নয়।
সরকারী প্রতিনিধির বেশি পীড়াপীড়ি দেখে ইমাম নিজেকে আরো শক্ত করে নিলেন। তিনি প্রতিনিধিকে সাবধান করে দিলেন যে, এভাবে পীড়াপীড়ি করে কোন লাভ নেই। বরং এই বাজে কাজ ছেড়ে নিজের কোন দরকারি কাজ থাকলে তা করার পরামর্শ দিলেন। তিনি বললেন, আমি কারাগার থেকে মুক্তিলাভের জন্য কারোর কাছে আবেদন জানাইনি। এ সময় ওপরের দরজা বন্ধ ছিল। ইমাম ওপরের দরজা খুলে দিতে বললেন। তিনি চলে যেতে প্রস্তুত হলেন। এরপরও তিনি সরকারী প্রতিনিধিকে বললেন, আমি নিজে উদ্যোগ নিয়ে কোন কথা বলিনি। আমার কাছে ফতোয়া এসেছে, লোকেরা আমাকে জিজ্ঞেস করেছে, তার জবাবে আমি বলেছি। দীন ও শরীয়তের দৃষ্টিতে সত্য গোপন করার কো অধিকার কি আমার আছে? রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ
*************আরবী*************
অর্থাৎ যে ব্যক্তিকে দীনের এম কোন কথা জিজ্ঞেস করা হয় যে সম্পর্কে তার জানা আছে কিন্তু সে তা গোপন করে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তার মুখে আগুনের লাগাম পরিয়ে দেবেন। কাজেই আপনাদের কথায় কি আমি সত্য সন্ধানীর প্রশ্নের যথার্থ জবাব দেবোনা?
তাবরাগী চলে যাবার পর দারোগা আবার এলেন। এবার তিন ইমামকে বললেন যে, নায়েবে সালতানাত আপনার আকীদার ব্যাপারে লিখিত আকারে জানতে চান। ইমামকে তিনি নিজের আকীদার বিষয়গুলো একটা কাগজে লিখে দিতে বলেন। ইমাম ইবনে তাইমিয়া লিখিত আকারে কিছু দিতে অস্বীকার করে বলেন, এখন আমি যদি কিছু লিখে দেই তাহলে লোকেরা বলবে, ইবনে তাইমিয়া তার সাবেক আকীদা বদলে ফেলেছে। ইমাম বলেন, এভাবে দামেস্কেও আমার কাছে নিজের আকীদার ব্যাপারে লিখিতভাবে চাওয়া হয়। কিন্তু সেখানেও আমি তা দেইনি। সেখানে নিজের লিখিত গ্রন্থগুলো পেশ করি। আমার চিন্তা ও বক্তব্য সেখানে দ্ব্যর্থহীনভাবে ফুটে উঠেছে। আমার এসব বক্তব্যও গ্রন্থ সিরিয়ার গভর্নর ডাকযোগে সুলতানের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছেন। আমি জানি সেগুলো সুলতানের কাছে আচে। আর আকীদা নিজের পক্ষ থেকে উদ্ভাবন করার মত কোন জিনিস নয়। প্রতিদিন কি আমি এ ধরনের এক একটা নতুন নতুন আকীদা তৈরি করতে থাকবো। আমার আকীদা তাই যা আমি আগে ঘোষণা করেছি, যা আমার রচনা ও গ্রন্থাবলীতে রয়েছে। সেগুলো আপনাদের কাছে আছে। সেগুলো দেখে নিন।
দারোগা এবারও ফিরে গিয়ে আবার আসেন। এবার তিনি ইমামকে বলেন, অন্তত লিখিত আকারে কিছু দিন। এই যেমন ধরুন ক্ষমাপত্র অথবা কারোর সাথে আপনি বিরোধ করবেন না। ইমাম বললেন, হ্যাঁ তা হতে পারে, কাউকে কষ্ট দেয়া, কারোর ওপর প্রতিশোধ নেয়া আমার উদ্দেশ্য নয়। যারা আমার ওপর জুলুম অত্যাচার করে, আমার সাথে অন্যায় ও অসদ্ব্যবহার করেছে, আমি তাদের জন্য ক্ষমাপত্র লিখে দিতে চাই। কিন্তু আসলে এসব লিখিত আকারে দেবার কোন রীতি নেই। তাই আমি মুখে এসব কথা বলে দেয়া যথেষ্ট মনে করি।
দারোগার সাথে আলোচনা শেষ করে ইমাম কারাগারের অভ্যন্তরে চলে আসেন। সেখানে এসে তিনি দেখেন কয়েদীরা নিজেদের মন ভোলাবার জন্য নানারকম আজে বাজে খেলা ধূলায় মত্ত হয়ে পড়েছে। কেউ তাস, কেউ দাবায় মশগুল। নামাজের দিকে তাদের কোন খেয়াল নেই। নামাজ কাযা হয়ে যাচ্ছে খেলার ঝোঁকে। ইমাম এতে আপত্তি জানান। তিনি কয়েদীদেরকে নামাজের প্রতি আকৃষ্ট করেন। আল্লাহর সুস্পষ্ট নির্দেশগুলো তাদের সামনে তুলে ধরেন। তাদেরকে সৎকাজে উদ্ভূত করেন। নিজেদের পাপ কাজগুলো সম্পর্কে তাদেরকে সজাগ করেন এবং এসবের জন্য তাদেরকে আল্লাহর দরবারে নিরন্তর ক্ষমা প্রার্থনা করার পরামর্শ দেন। এভাবে কিছুদিনের মধ্যে জেলখানার কয়েদীদের মাঝে দীনি ইলমের এমন চর্চা শুরু হয়ে গেলো যে, সমগ্র জেলখানাটিই একটি মাদ্রাসায় পরিণত হলো। কারাগারের কর্মচারী ও কয়েদীরা ইমাম ইবনে তাইমিয়াকে মনে প্রাণে ভালোবেসে ফেললেন। কারাগারের ইলমী ও সুস্থ পরিবেশ কয়েদীদের চোখে মায়ার অঞ্জন লাগিয়ে দিল। অবস্থা এমন দাঁড়াল যে, এ সময় অনেক কয়েদী তাদের কারামুক্তির ঘোষণা শুনার পরও জেলখানা ছেড়ে যেত চাইল না। তারা সাইখুল ইসলামের খেদমতে আরো কিছুদিন থেকে যাবার আর্জি পেশ করলো। চারমাস পর ৭০৭ হিজরির সফর মাসে আবার তাঁর মুক্তির প্রচেষ্টা চললো। কাযী বদরুদ্দীন ইবনে জামাআহ কারাগারে ইমামে সাথে সাক্ষাত করেন। দীর্ঘক্ষণ আলোচনার পরও তিন সরকারী শর্তে ইমামকে কারাগার থেকে মুক্তিলাভ সম্মত করাতে সক্ষম হলেন না। অবশেষে রবিউল আউয়াল মাসে আমীর হুসামুদ্দনি কসম দিয়ে নিজ দায়িত্বে ইমামকে নায়েবে সুলতানের কাছে আনেন। আমীর হুসামুদ্দীন তাকে অনুরোধ করেন মিসরে কিছুদিন থেকে যাবার জন্য। মিসরের লোকেরা তাঁর ইলম ও তাকওয়া সম্পর্কে যাতে সঠিকভাবে অবহিত হতে পারে এবং তার কল্যাণ ধারায় নিজেদের জীবন ধন্য করতে পারে এজন্য তিনি পূর্ণ প্রচেষ্টা চালাবার দায়িত্ব নেন।
কারামুক্তির পর
কারাগার থেকে মুক্তিলাভ করার পর ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহমাতুল্লাহ আলাইহি মিসরের সাধারণ মানুষের সাথে বেশি করে মেলামেশা করতে লাগলেন। সুলতান তাঁর কাছে মূল্যবান হাদিয়া পাঠালেন এবং রাজকীয় মর্যাদায় ভূষিত করার জন্য তাকে খেতাব দান করলেন। কিন্তু তিনি এর কোনটি গ্রহণ করলেন না। তিনি দেখলেন সরকার ও প্রশাসনের সাথে বিভিন্ন পর্যায়ে তাঁকে বিরোধে লিপ্ত হতে হচ্ছে। তাদের কোন প্রকার অনুগ্রহের সাথে নিজেকে জড়িয়ে ফেলা কোনক্রমেই উচিত নয়। তাই যথাসম্ভব প্রশাসন যন্ত্রের প্রভাব থেকেও নিজেকে আলাদা রাখলেন। দ্বিতীয়ত তাঁর বিরুদ্ধে এতদিন যারা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন তাদের সবাইকে মাফ করে দিলেন। তিনি সুস্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করে দিলেন, কারোর বিরুদ্ধে তাঁর কোন নালিশ নেই।
এসব দিনে মিসরে অদ্বৈতবাদী দর্শনের প্রভাব বেড়ে চলছিল। বিশেষ করে মিসরের প্রখ্যাত সুফি কবি আবুল ফারেয (মৃত্যু ৬৩২ হিজরি) ছিলেন এ মতবাদের একজন বলিষ্ঠ প্রবক্তা। তার প্রচেষ্টায় কাব্যের সুষমামণ্ডিত হয়ে এ মতবাদটি সাধারণ মানুষ ও সুফি সমাজের মধ্যে ব্যাপক বিস্তার লাব করছিল। মিসরের বিপুল সংখ্যক সুফি ও মাশায়েখ এ মতবাদে প্রভাবিত ছিলেন। ইমাম ইবনে তাইমিয়া মিসরের বুকে বসে প্রকাশ্যে এ মতবাদের বিরোধিতা শুরু করে দিলেন। তিনি অদ্বৈতবাদী দর্শনের ধারাকে কুরআন ও হাদিসের সম্পূর্ণ পরিপন্থী এবং পরবর্তীকালের সুফিদের অভিনব উদ্ভাবন ও দীনের মধ্যে অবিমৃশ্যকারিতারুপে চিহ্নিত করলেন। হযরত শায়খ আবদুল কাদের জিলানী র.ও শায়খ আদী ইবনে মুসাফির উমূবীর র. ন্যায় সুফিদের আকীদা ও কর্মকাণ্ডের তিনি প্রশংসা করলেন, কিন্তু তার নিজের সমকালীন সূফী ও মাশায়েখদের কঠোর সমালোচনা করতে থাকলেন। তাঁর মতে এসব সুফি ও মাশায়েখ গ্রীক, মিসরীয় ও ভারতীয় জড়বাদী ও তওহীদ বিরোধী দর্শন দ্বারা বিপুলভাবে প্রভাবিত।
এইসব বিভ্রান্ত মাশায়েখ ও সুফিদের বিরুদ্ধে ইমাম ইবনে তাইমিয়ার র. বলিষ্ঠ ও ব্যাপক সমালোচনায় সুফি মহলে বিপুল ক্ষোভের সঞ্চার হয়। মিসরের মশহুর শায়খে তরীকত ইবনে আতাউল্লাহই ইস্কানদারী সুফিদের প্রতিনিধি হিসেবে দুর্গে গিয়ে সুলতানের কাছে ইমামের বিরুদ্ধে নালিশ করেন। সুলতান দারুল আদলে সবার আয়োজন করে এ অভিযোগটির যথাযথ তদন্তের নির্দেশ দেন। ইবনে তাইমিয়াকে এ সভায় আহবান করা হয়। তাঁর বক্তব্যের বলিষ্ঠতা, যুক্তিবাদিতা, কুরআন ও হাদিসের সুস্পষ্ট সাক্ষ্য প্রমাণ এবং যাদুকরী বক্তৃতা শ্রোতাদেরকে বিমোহিত করে। সভাস্থলের সবার মুখ বন্ধ হয়ে যায়। ফলে তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সব রকমের ব্যবস্থা গ্রহণের প্রচেষ্টা স্থগিত হয়।
রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে তাঁর বিরুদ্ধে কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের প্রচেষ্টা বন্ধ হয়ে গেলেও বিরোধী মহলের অপপ্রচার ও চাপা আক্রোশ মাঝে মধ্যে ফুসে উঠতে থাকে। বিরোধীরা এখন তাঁর বিরুদ্ধে অপপ্রচারের ভিন্ন পথ অবলম্বন করে। তারা অভিযোগ আনে, ইমাম প্রচার করে বেড়াচ্ছেন: আল্লাহ ছাড়া আর কারোর দোহাই দেয়া জায়েজ নয়। একমাত্র আল্লাহর কাছেই যা কিছু চাওয়ার চাইতে হবে। এমনকি রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছেও ফরিয়াদ জানানো যাবেনা। এসব অপপ্রচারের জবাবে কোন কোন আলেম মন্তব্য করে, এ ধরনের চিন্তাধারা তেমন কোন দোষের নয়, তবে এটা এক ধরনের বে আদী বলে বিবেচিত হবে। কিন্তু এ ধরনের চিন্তাধারাকে তারা কুফরির পর্যায়ে ফেলতে প্রস্তুত হয়নি। ফলে এ যাত্রায়ও ইমাম রেহাই পেলেন।
কিন্তু এর পরও বিরোধীদের মুখ বন্ধ হলো না। তারা প্রতিদিন নতুন নতুন অপপ্রচারে মেতে ওঠে। দিনের পর দিন এইভাবে এক নাগাড়ে অভিযোগ, নালিশ ও দোষারোপে অতিষ্ঠ হয়ে সরকার ইমামের কাছে তিনিটি প্রস্তাব রাকে। তিনটির মধ্যে যে কোন একটি তাঁকে কিছু শর্ত মেনে চলতে হবে। অন্যথায় তৃতীয় প্রস্তাবটি হচ্ছে কারাগারে অবস্থান করা। ইমাম কারাগারে অবস্থান করাকেই অগ্রাধিকার দেন। কিন্তু তার ছাত্রবৃন্দ ও বন্ধুবর্গ দামেস্কে ফিরে যাবার জন্য চাপ দিতে থাকে। তাদের পীড়াপীড়িতে তিনি অবশেষে দামেস্কে যাবার প্রস্তুতি শুরু করেন। ৭০৭ হিজরির ৮ শাওয়াল তিনি দলবল নিয়ে শহর থেকে বের হয়েও পড়েন। কিন্তু সেদিনই আবার তাঁকে পথ থেকে মিসরে ফিরিয়ে আনা হয়। তাঁকে বলা হয়, সরকার তাঁকে কারাগারে রাখাই ভালো মনে করেন। কিন্তু কাযী ও আলেমগণ তাঁর বিরুদ্ধে এবার কোন সুস্পষ্ট অভিযোগ আনতে পারলেন না। তাই তারা সংশয়ের দোলায় দুলছিলেন। উলাম ও কাযীদের মানসিক দ্বন্দ্ব লক্ষ্য করে ইমাম সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি নিজেই স্বেচ্ছায় কারাগারে যাবেন। কিন্তু কাযীরা তাঁকে কারাগারে পাঠাতে চাচ্ছিলেন না। ফলে তাঁকে নজরবন্দী অবস্থায় রাখা হলো। ছাত্র ও আলেমগণ তাঁর সাথ সাক্ষাত করতে পারতেন। তাঁর সাথে জ্ঞানচর্চা ও গুরুত্বপূর্ণ মাসায়েল নিয়ে আলোচনা চলতো। বিশেষ ব্যাপারে তার কাছ থেকে ফতোয়াও নেয়া হতো। কিছুদিন পরে উলামা ও ফকীহদের এক সম্মেলনে ইমামকে মুক্তি দেবার জন্য একটি সর্বসম্মত প্রস্তাব গৃহীত হয়। এ প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে সরকার তাঁকে মুক্তিদান করে। জনসাধারণ তাঁকে বিপুল সম্বর্ধনা জানায়। তাঁর জনপ্রিয়তা আগের তুলনায় অনেক বেড়ে যায়। জগণের মধ্যে তাঁর পরিচয় বাড়ার সাথে সাথে প্রভাব ও বেড়ে চলতে থাকে। আর তাঁর প্রভাব বাড়ার অর্থই হচ্ছে জনগণের মধ্য থেকে ইসলাম ও শরীয়ত বিরোধী আকীদা বিশ্বাস, বিদআত ও ইসলাম বিরোধী কর্মকাণ্ড বিলুপ্ত হয়ে যাবে। মুসলিম জনগণ কুরআন ও সুন্নাহর পথে যথাযথভাবে এগিয়ে যেতে পারবে। এভাবে বিরুদ্ধ পরিবেশে ইমাম তাঁর কাজ সঠিকভাবে করে যেতে থাকেন।
এ সময় রাজনৈতিক অবস্থার আকস্মিক গতি পরিবর্তনে ইমাম ইবনে তাইমিয়ার পথে আরো বেশি বাধার সৃষ্টি হয়। তাঁর বিরোধী পক্ষ তাঁর বিরুদ্ধে মারমুখী হয়ে ওঠে। নাসিরুদ্দিন কালাউন এসময় ছিলন মিসর ও সিরিয়ার সুলতান। তিনি ইমাম ইবনে তাইমিয়ার ইলম, পাণ্ডিত্য, তাকওয়া, আন্তরিকতা ও সাহসিকতা সম্পর্কে পুরোপুরি অবহিত ছিলেন। ইমামই তাকে তাতারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে উৎসাহিত করেছিলেন। এ সময় তিনি স্বচক্ষে ইমামের সাহসিকতা, বুদ্ধিমত্তা ও আন্তরিকতা প্রত্যক্ষ করেছিলেন। কাজেই মোটামুটি তিনি ইমামের বিরোধী ছিলেন না। কিন্তু ৭০৮হিজরীতে বিভিন্ন কারণে তিনি রাষ্ট্র শাসন থেকে সরে দাঁড়ান। ফলে রুকনুদ্দীন বাইবারস শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। সুলতান বাইবারসের আধ্যাত্মিক গুরু ও দীনী ব্যাপারে পরামর্শদাতা ছিলেন শায়খ নাসরুল মম্বাজী। ইমাম ইবনে তাইমিয়া ছিলেন এই শায়খের আকিদা, বিশ্বাস ও কর্মকাণ্ডের প্রধান সমালোচক। আবার অন্যদিকে ইমামকে সাবেক সুলতানের প্রিয়পাত্র মনে করাও হতো। কাজেই বিরোধীরা এবার তাঁর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণ করার পূর্ণ সুযোগ পায়।
এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে তারা মুহূর্তও দ্বিধা করেনি। কাজেই বাইবারস ক্ষমতাসীন হবার সাথে সাথেই ইমাম ইবনে তাইমিয়াকে ইস্কান্দারিয়ায় পাঠিয়ে সেখানে নজরবন্দী করে রাখার নির্দেশ দেয়া হয়। ৭০৯ হিজরির সফর মাসের শেষের দিকে তাঁকে ইস্কান্দারিয়ায় পাঠানো হয়। ইস্কান্দারিয়া ছিল সুফি ও সূফীবাদের প্রাচীন কেন্দ্র। শোনা যায়, সরকারের এও উদ্দেশ্য ছিল যে, সুফিদের এই প্রাচীন কেন্দ্রে কোন গোঁড়া ও তেজস্বী সুফি তাঁর দফারফা করে দেবেনে এবং সরকার তার রক্তের দায়িত্ব থেকে মুক্ত হয়ে যাবেন। কিন্তু সরকারের এ আশা পূর্ণ হয়নি।
ইস্কান্দারিয়ায় ইমামের তৎপরতা
ভূমধ্যসাগরের তীরে মিসরের প্রাচীন ঐতিহ্যমন্ডিত বন্দর ও এককালের রাজধানী নগরী ইস্কান্দারিয়া। অদ্বৈতবাদী দর্শনের প্রবক্তা সুফিদের সংখ্যা এ শহরে ছিল সবচেয়ে বেশি। সুফিদের এ গোমরাহ দর্শনের প্রভাব জনগণের মধ্যেও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল। এ শহরে ছিল এ দর্শনের বড় ড় প্রচারক। তারা কেবল মানুষের আকীদা বিশ্বাস ও চিন্তার মধ্যে শিরক ও বিদআতের অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে ক্ষান্ত থাকেনি, মানুষের চরিত্র ও কর্মকেও ইসলাম বিরোধী যাতে প্রভাবিত করেছিল। ফলে ইসলামী শরীয়ত ও অনুশাসনের প্রতি সাধারণ মানুষের অনীহা ও অবজ্ঞা প্রকট হয়ে উঠেছিল।
ইস্কান্দারিয়ায় পৌঁছে ইমাম ইবনে তাইমিয়া সুফি ও জনগণের চিন্তা ও কর্মের এই গলদ দূর করার সংকল্প করেন। প্রথমে কুরআন ও হাদিসের দরসের মাধ্যমে নিজের একটি ছাত্র ও সমর্থক গ্রুপ তৈরি করেন। ধীরে ধীরে তাঁর এ গ্রুপের কলেবর বেড়ে যেতে থাকে। সাধারণ মানুষ দলে দলে তার কাছে আসতে থাকে। ইমাম মহা উৎসাহে জনগণের চিন্তার পরিশুদ্ধির কাজে নেমে পড়েন। এই সঙ্গে শরীয়তের অনুশাসন অনুযায়ী তাদের কর্ম ও চরিত্র গড়ে তুলতে থাকেন। তিনি মাত্র আট মাস এ শহরে অবস্থান করেন। এ স্বল্প সময়ের মধ্যেই তিনি বিরোধী মহলের সমস্ত শক্তি ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। সাধার মানুষ ও শিক্ষিত প্রভাবশালী শ্রেণীর বিরাট অংশ ইসলাম বিরোধী দর্শনের অনুসারী সুফিদের খপ্পর তেকে বের হয়ে আসে। ইমাম তাদেরকে তওবা করান। একজন প্রভাবশালী নেতৃস্থানীয় সূফীও তাঁর হাতে তওবা করেন।
ইস্কান্দারিয়ায় ইমামের এই সাফল্য সম্পর্কে তাঁর সাথে অবস্থানকারী তাঁর ছোট ভাই শরফুদ্দীন ইবনে তাইমিয়া দামেস্কবাসীদের নামে লিখিত এক পত্রে লিখেছেনঃ ইস্কান্দারিয়বাসীরা ভাই সাহেবের প্রতি ব্যাপকভাবে আকৃষ্ট হয়ে পড়েছে এবং তাঁকে উচ্চ মর্যাদা প্রদান করেছে। তিনি সব সময় কুরআন ও সুন্নাতের প্রচারে ব্যাপৃত থাকেন। সাধারণ অসাধারণ নির্বিশেষে সবার মনে শায়খের প্রতি ভালবাসা ও মর্যাদা স্থায়ীভাবে স্থান লাভ করেছে। শাসক, বিচারক, ফকীহ, মুফতি, মাশায়েখ ও মুজাহিদ নির্বিশেষে প্রায় সব গোষ্ঠীই তাঁর ভক্তে ও অনুরক্তে পরিণত হয়েছে। একমাত্র মূর্খ জাহেল লোকেরাই তাঁর তেকে সরে আছে।
এদিকে সুলতান রুকনুদ্দীনের পতন ঘনিয়ে এসেছিল। স্বেচ্ছা নির্বাসিত সাবেক সুলতান নাসিরুদ্দিন কালাউন মাত্র এগার মাস পরে আবার রাজনৈতিক মঞ্চে অবতীর্ণ হন। রুকনুদ্দীন রাজকার্যে ইস্তফা দিয়ে দেশত্যাগ করে। এই সংগে তাঁর পরামর্শদাতা শায়খ নাসরুল মুমবাজীরও পতন হয়। ফলে ইমাম ইবনে তাইমিয়ার ভাগ্যাকাশে ঘনীভূত দুর্যোগের মেঘ কাটতে শুরু করে। সুলতান নাসিরুদ্দিন কালাউন মিসরে প্রবেশ করবার পর সর্বপ্রথম ইমাম ইবনে তাইমিয়ার মুক্তির ব্যাপারে চিন্তা করেন। সংগে সংগেই লোক পাঠিয়ে ইমামকে ইস্কান্দারিয়া থেকে আনার ব্যবস্থা করেন। ইমামের ইস্কান্দারিয়া ত্যাগের খবর মুহূর্তের মধ্যে শহরে চড়িয়ে পড়ে। লোকেরা দলে দলে এসে তাঁকে বিদায় সম্বর্ধনা জনাতে থাকে। হাজার হাজার ছাত্র ও বক্তার অশ্রু সজল দৃষ্টির সামনে ইমামের কাফেলা কায়রোর দিকে রওয়ানা হয়। কায়রোয় পৌছার পর সুলতান ও উৎফুল্ল নগরবাসীরা তাঁকে বিপুল সম্বর্ধনা জানান।
রাজদরবারে সত্য কথন
ইতিপূর্বে মিসর ও সিরিয়ার আলেমগণ অমুসলিম জিম্মিদের পোশাকের ব্যাপারে একটা বিশেষ বিধান জারী করেছিলেন। বিশেষ করে ক্রুসেড যুদ্ধের পর মুসলিম দেশগুলোয় ইউরোপ থেকে আগত খ্রিষ্টান পরিবার বসবাস করে আসছিল। তাদের অনেকে ইউরোপের খৃষ্টান দেশগুলোর পক্ষে গুপ্তচর বৃত্তিতে লিপ্ত ছিল। এমনকি একবার কায়রোয় একটি বিরাট অগ্নিকান্ড হয়। তাতে বহু মুসলমান নিহত ও মুসলমানদের কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি বিনষ্ট হয়। পরে তদন্ত করে জানা যায়, একদল খৃষ্টান সুপরিকল্পিতভাবে এ ধ্বংসযজ্ঞের ব্যবস্থা করছিল। এরপর থেকে জিম্মিরা যাতে মুসলমানদের মধ্যে অনুপ্রবেশ করে তাদের ক্ষতিসাধন করতে না পারে সেজন্য তাদের পোশাকের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করার প্রশ্ন ওঠে। উলামায়ে কেরামের ফতোয়া অনুযায়ী সরকার জিম্মিদেরকে নীল পাগড়ী ব্যবহার করার নির্দেশ দেয়। এতদিন জিম্মিরা এ নির্দেশ মেনে আসছিল। আজ দরবারে প্রধানমন্ত্রী সুলতানের নিকট জিম্মিদের জন্য একটা নতুন আইন পাশ করার প্রস্তাব আনলেন।
দরবারে ইবনে তাইমিয়াও সুলতানের পাশে বসেছিলেন। মিসরের শ্রেষ্ঠ কাযী, আলেম ও ফকীরগণও এখানে হাজির ছিলেন। আসলে ইবনে তাইমিয়ার প্রতি সম্মান প্রদর্শনার্থে দরবার আহুত হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী তার প্রস্তাবে এখন থেকে মুসলমানদের ন্যায় জিম্মিদেরও সাদা পাগড়ী ব্যবহারের কথা বলেন এবং এই সঙ্গে এ কথাও বলেন যে এর বিনিময়ে জিম্মিরা সরকারকে প্রতি বছর ৭ লাখ দীনার কর প্রদান করবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। জিম্মিরা বর্তমানে যেসমস্ত কর দিয়ে আসছে সেগুলো আগের মতোই দিয়ে আসবে।
প্রস্তাব পাঠ কারার পর সুলতান উলাম ও ফকীহদের দিকে তাকালেন এবং এ ব্যাপারে তাঁদের মতামত জানতে চাইলেন। আল্লামা যামালকানীর মতো শ্রেষ্ঠ ফকীহ ও অন্যান্য কাযীগণ চুপ করে রইলেন। ইমাম ইবনে তাইমিয়া দরবারের এ অবস্থা দেখে রাগে ফেটে পড়লেন। তিনি প্রধানমন্ত্রীকে সম্বোধন করে তাঁকে জেরা করতে লাগলেন। সরকারী নীতির কঠোর সমালোচনা করলেন। সুলতান তাঁকে ক্রোধান্বিত না হবার জন্য অনুরোধ করতে লাগলেন। কিন্তু তিনি সুলতানের অনুরোধের পরোয়া করলেন না। তাঁর অতিরিক্ত সাহস দেখে উপস্থিত আলেমগণ আতংকিত হয়ে উঠলেন। কি জানি এখনি দরবারে কী দুর্ঘটনা ঘটে যায়।
ইমাম প্রধানমন্ত্রীকে ছেড়ে দিয়ে এবার সুলতানকে সম্বোধন করে বললেন, বড়ই পরিতাপের বিষয়, আজকে দরবারের কার্যক্রম এর সূচনা করা হলো এমন একটা বিষয়ের সাহায্যে যা ইসলাম ও মুসলমানের জন্য ধ্বংসকর। বড়ই দুঃখের বিষয়, এই ক্ষণস্থায়ী দুনিয়ার তুচ্ছ সাময়িক লাভর খাতিরে আপনি জিম্মিদের স্বার্থোদ্ধারে এগিয়ে যাচ্ছেন। অথচ এতে ইসলাম ও আহলে ইসলামের ক্ষতি ছাড়া কোন লাভ নেই। একবার ভেবে দেখুন, আল্লাহ আপনার ওপর কত বড় ইহসান করেছেন। কিছুদিন আগে আপনি রাজ্য হারিয়েছিলেন। আপনার সম্মান প্রতিপত্তি সব ভুলণ্ঠিত হয়েছিল। আল্লাহর মেহেরবানীতে আবার সব ফিরে পেয়েছেন। আল্লাহ আপার দুশমনকে লাঞ্ছিত করেছেন। বিরোধী পক্ষের ওপর আপনি বিজয় লাভ করেছেন। এখন আপনাকে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করা উচিত।
সুলতান ইমামের সত্য কথনে অত্যন্ত সন্তুষ্ট হলেন। প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবটি বাতিল করে দিলেন। ফলে জিম্মিরা আগের মতোই নীল পাগড়ী পরে বাইরে চলাফেরা করতে থাকলো।
শত্রুদের ক্ষমা করে দিলেন
ইমাম তাকিউদ্দীন আহমদ ইবনে তাইমিয়া সত্যের খাতিরে কখনো রাজদণ্ডের ভ্রুকুটির পরোয়া করেননি। সত্যের তিনি ছিলেন উলঙ্গ প্রকাশ। আফযালুল জিহাদে কালেমাতুল হাককে ইনদা সুলতানিল জায়ের- জালেম শাসকের সামনে হক কথা বলা শ্রেষ্ঠতম জিহাদ রসূলের এ বাণীটিকে তিনি অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলেছিলেন। তার সাতষট্টি বছরের জীবনে তিনি কোনদিন অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেননি। যেটাকে তিনি সত্য জেনেছেন সেটাকে সমুন্নত রাখার ও প্রতিষ্ঠিত করার জন্য জীবনপাত করেছেন। এ জন্য কেউ তাঁর সংগে আছে কিনা বা কে তাঁর সংগ দিল আর কে সংগ দিল না সেদিকে তিনি ফিরও তাকাতেন না। সারা জীবন সত্র ও ন্যায়ের জন্য প্রায় তাকে একাকীই লড়াই করতে হয়েছে।
ইস্কান্দারিয়া থেকে ফেরার পর তেমনি একটি ঘটনা ঘটে গেলো সুলতানের দরবারে সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিতভাবে। ইতিপূর্বেই এ ঘটনার উল্লেখ করেছি। সুলতান নাসিরুদ্দিন কালাউন নৈতিক দিক দিয়ে সেদিন এমন এক পর্যায়ে অবস্থান করছিলেন যার ফলে ইমামের সত্যের দুরন্ত প্রকাশকে মেনে নিতে তিনি বাধ্য হয়েছিলেন। নয়তো রাষ্ট্র ব্যবস্থা তখন এমন পর্যায়ে ছিল না যা সরকারের সিদ্ধান্তের বিরোধী কোন সিদ্ধান্তকে সহজে মেনে নিতে পারে। কিন্তু ইমামের সৎ সাহসের কারণ সেদিন তা সম্ভব হয়েছিল। সেদিন দেশের শ্রেষ্ঠ উলামায়ে কেরাম, চার মযহাবের শ্রেষ্ঠ কাযীগণ দরবারে উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু কেউ মুখ খোলেননি। যেখানে সত্যকে সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ করার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল সেখানে তারা নীরব ছিলেন। শুধু তাই নয় এই আলেমগণের একটি বিরাট অংশ তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিল। তাঁকে কায়রো থেকে দেশান্তর করে ইস্কান্দারিয়ায় অন্তরীণ করার ষড়যন্ত্রে তারা শরীক ছিলেন। ইতিপূর্বে সুলতান নাসিরুদ্দিনের ক্ষমতাচ্যুতির পেছনেও ছিল তাদের চক্রান্ত। সুলতান এ কথা ভুলতে পারছিলেন না। তিনি আলেম ও কাযীগণের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের কথা চিন্তা করতে লাগলেন।
সুলতান এই গাদ্দার কাযী ও আলেমদের হত্যা করার বৈধতা লাভের জন্য ইমামের কাছ থেকে ফতোয়া সংগ্রহ করতে চাইলেন। সুলতান বললেন এরা পলাতক সাবেক সুলতানের পক্ষে এবং আমার বিরুদ্ধে ফতোয়া দিয়েছিল। তিনি এ ফতোয়া বের করে ইমামকে দেখালেন। এই সংগে একথাও বললেন, এরাই আপনার বিরুদ্ধে ফতোয়া দিয়েছে এবং চক্রান্ত জাল বিস্তার করে আপনাকে নানাভাবে কষ্ট দিয়েছে। ইমামকে উত্তেজিত করাই ছিল সুলতানের উদ্দেশ্য। কিন্তু ইমাম তার উদ্দেশ্য বুঝতে পেরেই কাযী ও উলামায়ে কেরামের নানা প্রসঙ্গ তুলে তাদের প্রশংসা করতে থাকলেন। তিনি সুলতানের প্রস্তাবের কঠোর বিরোধিতা করলেন। তিনি সুলতানকে বুঝাতে থাকলেন যে, দেশের এই শ্রেষ্ঠ আলেমদের হত্যা করার পর আপনি এদের কোন বিকল্প আনতে পারবেন না, তখন দেশ ও জাতি অত্যন্ত মারাত্মক সংকটের সম্মুখীন হবে।
তারা আপনাকে হত্যা করার জন্য বারবার ষড়যন্ত্র করছে। তারা আপনাকে নানাভাবে কষ্ট দিয়েছে। সুলতান ইমামকে উত্তেজিত করার চেষ্টা করলেন।
আমার ব্যাপারে আমি এতটুকু বরতে পারি, যারা আমাকে কষ্ট দিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে আমার কোন অভিযোগ নেই। তাদেরকে আমি মাফ করে দিয়েছি। আর যারা আল্লাহ ও রসূলের নিকট গুনাহ করেছে তাদের কার্যকলাপের প্রতিশোধ নেবার জন্য আল্লাহ নিজেই যথেষ্ট। আমার নিজের জন্য আমি কখনো প্রতিশোধ নিই না। ইমাম দৃঢ় কণ্ঠে জবাব দিলেন।
এভাবে ইমাম বারবার সুলতানকে বুঝাতে থাকলেন। শেষে সুলতানকে নিরস্ত হতে হলো। উলামায়ে কেরামের বিরুদ্ধে সুলতান নিজের ক্রোধ দমন করলেন। এ যাত্রায় মিসর এক বিরাট রক্তপাত তেকে বেঁচে গেল।
মিসরে মালেকী মযহাবের সবচেয়ে বড় কাযী ইবনে মাখলুয়েফর একটি বিবৃতি ঐতিহাসিক ইবনে কাসীর উদ্ধৃত করেছেন। কাযী সাহেব বলেনঃ ইবনে তাইমিয়ার মতো এত বড় উদার হৃদয় ব্যক্তি আমি আর ইতিপূর্বে দেখিনি। আমরা তার বিরুদ্ধে সরকারকে ক্ষেপিয়ে তুলেছিলাম। কিন্তু তিনি যখন আমাদের কিছু করার ক্ষমতা অর্জন করলেন তখন আমাদের মাফ করে দিলেন। শুধু তাই নয়, বরং সুলতানের কাছে আমাদের পক্ষ থেকে সাফাই গাইলেন। সুলতানের দরবার থেকে ফিরে এসে ইমাম আবার তাঁর পুরাতন কাজে ব্যাপৃত হলেন। অধ্যাপনা, বক্তৃতা এবং ফতোয়া দান ও গ্রন্থ রচনা কায়রোয় এটিই ছিল তাঁর প্রারম্ভিক কাজ। দামেস্কের ন্যায় এখানেও তাঁর বিরাট ছাত্র ও সমর্থক গ্রুপ তৈরি হয়ে গিয়েছিল। ইমামের আগমনের খবরে তারা আবার তাঁর চারদিকে জমা হয়ে গেলো। এমন কি বিরোধী ও চক্রান্তকারী গোষ্ঠীর বহু লোকও তার কাছে এসে মাফ চাতে লাগলো। ইমাম সবাইকে বরে দিলেন, আমার পক্ষ থেকে আমি সবাইকে মাফ করে দিয়েছি। কারোর বিরুদ্ধে আমার কোন অভিযোগ নেই।
কিন্তু সবাই সন্তুষ্ট হতে পারে, আল্লাহর দুশমনরা কখনো সন্তুষ্ট হতে পারে না। ইমামের একদল কট্টর বিরোধী সুলতানে কাচে ও দেশের বরেণ্য আলেম উলামার কাছে ইমামের মর্যাদা বৃদ্ধিতে মোটেই সন্তুষ্ট হতে পারলো না। তারা ভিতরে ভিতরে জ্বলে পুড়ে মরতে লাগলো। তারা ইমামকে অপদস্থ করার জন্য জনগণকে উত্তেজিত করতে লাগলো। দামেস্কের জনগণের মধ্যে ইমামের যে মর্যাদা ছিল কায়রোর এখনো ইমাম সে মর্যাদা লাভ করতে সক্ষম হননি। কাজেই এখানকার মুসলিম জনতাকে ঈমান, আকায়েদ ও মযহাবের প্রশ্ন তুলে ইমামের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলা কোন কঠিন ব্যাপার ছিল না। বিরোধীরা এ অস্ত্র নিক্ষেপে করলো। ৭১১ হিজরি ৪ রজব কতিপয় দুর্বৃত্ত তাঁর ওপর আক্রমণ চালালো। দুর্বৃত্তরা তাকে আহত করলো। হোসাইনিয়া মহল্লার লোকেরা সঙ্গে সঙ্গেই এর প্রতিশোধ নেবার জন্য তৈরি হয়ে গেলো। কিন্তু ইমাম তাদের নিবৃত্ত করলেন।
ইমাম উপস্থিত জনতাকে উদ্দেশ্য করে বললেনঃ প্রথমত তাদের ওপর প্রতিশোধ নেয়া হচ্ছে আমার হক। আমি সর্বসমক্ষে আমার এ হক প্রত্যাহার করলাম। তাদের বিরুদ্ধে আমার কোন অভিযোগ নেই। দ্বিতীয়ত এটা তোমাদের হক হতে পারে। আর এ ব্যাপারে যদি তোমরা আমার কাচ থেকে পরামর্শ নিতে চাও এবং আমার কথা মানতে প্রস্তুত না হও তাহলে অবশ্যই তোমরা যা ইচ্ছে করতে পারো। আমার কিছু বলার নেই। তৃতীয়ত এটা হচ্ছে আল্লাহর হক। আর আল্লাহ ইচ্ছে তাঁর আদায় করে নেবেন। এ সময় আসরের নামাযের আযান হয়ে গেলো। ইমাম মহল্লার মসজিদ জামে হোসাইনীতে যাবার জন্য বের হয়ে পড়লেন। লোকেরা বাধা দিল। কিন্তু তিনি কোন বাধা শুনলেন না। ফলে একটি বিরাট দলও তাঁর সংগ নিল। তিনি সসম্মানে মসজিদ থেকে নামায পড়ে এলেন।