ইমামের সংগ্রামী জীবনের শেষ অধ্যায়
সাতশো বারা হিজরিতে আবার তাতারীদের আক্রমণের খবর শোনা গেলো। তার বিশা সেনাবাহিনী নিয়ে দামেস্কের দিকে এগিয়ে আসছে। তাতারী আক্রমণ প্রতিরোধ করার সিদ্ধান্ত নিলে সুলতান নাসিরুদ্দিন কালাউন। তিনি সেনাবাহিনী নিয়ে সিরিয়ার পথে রওনা হলেন জিহাদের নিয়তে। ইমাম ইবনে তাইমিয়াও হলেন সেনাবাহিনীর সহযোগী। কিন্তু সিরিয়ায় পৌঁছে তারা শুনলেন তাতারীরা ফিরে গেছে। সেনাবাহিনী ফিরে গেলো মিসরে। কিন্তু ইমাম ইবনে তাইমিয়া দামেস্কে থেকে গেলেন।
তালাকের ঝগড়া
দীর্ঘ সাত বছর পর ইমাম দামেস্কে ফিরে এসেছিলেন। দামেস্কবাসীরা তাঁকে সাদর অভ্যর্থনা জানালো। হাজার হাজার লোক নগরীর বাইরে এসে তাঁকে স্বাগত জানালো। বিপুল সংখ্যক মহিলাও এ অভ্যর্থনায় অংশ নিয়েছিল। জিহাদে অংশ গ্রহণের সুযোগ না পেয়ে ইমাম বাইতুল মাকদিস যিয়ারতের নিয়ত করলেন। বায়তুল মাকদিসে কিছুদিন অবস্থান করে সেখান থেকে আরো বিভিন্ন এলাকা সফর শেষে দামেস্কে ফিরে এলেন। এখানে তিনি আবার নিজের অধ্যাপনা, জ্ঞান চর্চা ও সংস্কারমূলক কাজে আত্মনিয়োগ করলেন। এ পর্যায়ে তিনি ফিকহ শাস্ত্র আলোচনা ও এর বিভিন্ন মাসায়েল বিশ্লেষণের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দিলেন। ইমাম ও তার পূর্ব পুরুষরা ছিল হাম্বলী মযহাবের অনুসারী। কিন্তু এ স্বত্বেও তিনি স্বাধীনভাবে মাসায়েল আলোচনা করতেন এবং বিভিন্ন মাসায়েল সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সহীহ হাদিসের প্রতি নজর রাখতেন। কাজেই বিভিন্ন মাসায়েলে হাম্বলী মযহাবসহ অন্যান্য মযহাবের সাথেও তাঁর বিরোধ বাধে। এমনি একটি বিরোধীয় বিষয় ছিল তাঁর এক বৈঠকে তিন তালাকের তিন তালাক হওয়ার বিষয়টি। চার মযহাবসহ অন্যান্য বহু ইমাম এ বিষয়ে একমত ছিলেন। কিন্তু ইমাম এর বিরোধিতা করেন। তাঁর পক্ষে সহি হাদিস সহ কতিপয় প্রথম শ্রেণীর সাহাবীর মতও ছিল। মূলত এটি ছিল একটি ফিকহী বিরোধ। আর ইসলামী ফিকহে এ ধরনের বিরোধের অবকাশ রয়েছে। কিন্তু বিরোধী পক্ষের সংকীর্ণমনতা এতটুকুও বরদাশত করতে রাজী ছিল না। ইমামের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের জোয়ার উঠলো। কিন্তু ইমাম নিবিষ্ট মনে নিজের কাজ করে যেতে লাগলেন।
ইসলামী ফিকহ একটি চলমান ও গতিশীল প্রতিষ্ঠান। ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। কিয়ামত পর্যন্ত এ জীবন বিধান নিজেকে স্বকীয় জীবন ধারায় প্রতিষ্ঠিত রাখবে। এ চির প্রতিষ্ঠার মূলে রয়েছে এই ফিকহের গতিশীলতা। ইমাম ইবনে তাইমিয়া ইসলামী ফিকহের এই গতিশীলতা অপরিবর্তিত রাখার প্রচেষ্টা চালাচ্ছিলেন। ইসলামী ফিকহ স্থবিরত্বে পৌঁছে গেলে, ইজতিহাদ ও ইসতিমবাতের ধারা শুকিয়ে গেলে নতুন নতুন সমস্যার যথাযথ ইসলামী সমাধান দিতে সক্ষম না হলে ইসলামকে পূর্ণ অবয়বে কিয়ামত পর্যন্ত টিকিয়ে রাখা কোনক্রমেই সম্ভব হবে না। তাই ইমামের অবদান এ ক্ষেত্রে অসামান্য ও অতুলনীয়।
কিন্তু অন্ধকারে থাকতেই যারা অভ্যস্ত, দিন দুপুরের ঝলমলে আলো তারা সহ্য করবে কেমন করে? তাই জায়েজ সীমার মধ্যে অবস্থান করে তাঁর স্বাধীন মত প্রকাশকে বিরোধী পক্ষ বরদাশত করতে পারলোনা। এ সময়ে হলফ বিত তালাকের বিষয়ের আলোচনা চলছিল জোরেশোরে। লোকেরা বিভিন্ন ব্যাপারে বিশেষ করে লেন দেনের ক্ষেত্রে তালাক শব্দ ব্যবহার করতো খুব বেশি করে। কোন বিষয়ে জোর দেবার জন্য বা নিজের দৃঢ় সংকল্প, সদিচ্ছা ও অঙ্গীকারের সত্যতা প্রমাণ করার জন্য লোকেরা বলতো, আমি অবশ্যই এমনিটি করবো, নয়তো আমার স্ত্রী তালাক হয়ে যাবে। আমি অবশ্যই উমুক তারিখে তোমাকে টাকাটা দেবো, নয়তো আমার স্ত্রী তালাক হয়ে যাবে। অথবা আমি যদি এ পণ্য দ্রব্যটি এত টাকায় না কিনে থাকি তাহলে আমার স্ত্রী তালাক হয়ে যাবে। এ ধরনের বিভিন্ন কথায় ও অঙ্গীকারে তালাক দেয়ার কোন নিয়তই লোকদের শর্তাধীন তালাক বা তালাক বিশশর্ত মনে করে এর ওপর তালাকের বিধান জারি করা হতো। এভাবে শত শত সংসার ও পরিবার উজাড় হয়ে যাচ্ছিল। আবার রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও এ শব্দটির ব্যবহার চলছিল ব্যাপকভাবে। হাজ্জাজ বিন ইউসুফের জামানা থেকে সরকারের প্রতি অনুগত্যকে পাকাপোক্ত করার জন্য বাইয়াতের সংগে তালাক শব্দও ব্যবহারের রেওয়াজ চলে আসছিল। লোকেরা বলতো: আমি যদি উমুক শাসকের প্রতি আনুগত্য পরিহার করি তাহলে আমার স্ত্রী তালাক হয়ে যাবে।
এ বিষয়টি সমাজে বিরাট বিশৃঙ্খলা ও জটিলতা সৃষ্টি করেছিল। ইমাম ইবনে তাইমিয়া এ বিষয়টির ওপর ব্যাপক চিন্তা গবেষণা করেন। অবশেষে তিনি একটাকে নিছক একটি হলফ ও অঙ্গীকার বলে গণ্য করেন। এ অঙ্গীকার ভঙ্গ করলে শুধুমাত্র কসমের কাফফারা আদায় করতে হবে বলে তিনি ঘোষণা করেন, এর ফলে কোনক্রমেই স্ত্রী তালাক হবে না। তার এ ফতোয়াটিও প্রচলিত আইনের বিরুদ্ধে পড়ে। ফলে বিভিন্ন মযহাবের উলামা ও কাযীরা তার বিরোধী হয়ে পড়েন। এ ফতোয়া প্রত্যাহার করার জন্য তাঁর উপর চাপ প্রদান করা হয়। প্রধান বিচারপতি শামসুদ্দীন ইবনে মুসলিম তাঁর সাথে সাক্ষাত করে হলফ বিত তালাকের ব্যাপারে ভবিষ্যতে ফতোয়া না দেবার জন্য তাঁকে অনুরোধ জানান। তিনি রাজী হয়ে যান। ইত্যবসরে এ ফতোয়া দান থেকে বিরত রাখার জন্য মিসর থেকে সুলতানের ফরমানও এসে যায়। হাংগামা, গোলযোগ ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবার সম্ভাবনা দেখা দেয়ায় তিনি তাদের এ খায়েশ মেনে নেন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই ইমাম তাঁর সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেন। মনে হয় পরবর্তী পর্যায়ে তাঁর মনে এ চিন্তা আসে যে, শরীয়তের ব্যাপারে (কুরআন ও সুন্নাহর আলাকে তিনি যেটাকে সত্য মনে করেছেন) তার সত্য রায়কে হুকুমতের নির্দেশে গোপন রাখা জায়েজ নয় এবং এ ব্যাপারে এ ধরণের হুকুমতের যা খিলাফত আলা মিনহাজিন নুবওয়াত নয় নির্দেশ মেনে চলা অনুচিত। তাই কিছুদিন পরে লোকদের প্রশ্নের জবাবে ইমাম এ ব্যাপারে আবার ফতোয়া দিতে থাকেন।
ফলে উলামা ও কাযীরা আবার তাঁর বিরোধী হয়ে ওঠেন। তাঁদের সম্মিলিত আবেদনের ফলে গভর্নর তাকে দুর্গের মধ্যে নজরবন্দী করে রাখার নির্দেশ দেন। এ নির্দেশ অনুযায়ী ৭২০হিজরীতে তিনি কারারুদ্ধ হন। কিন্তু এবারের কারাবাস মাত্র ৫মাস স্থায়ী হয়। মিসর থেকে সুলতানের নির্দেশ আসায় কারাগারে প্রবেশের পাঁচ মাস পরে তিনি তা থেকে বের হয়ে আসেন।
এরপর প্রায় সাড়ে পাঁচ বছর তিনি জ্ঞান চর্চায় তেমন বিশেষ কোন বাধা পাননি। এ সাড়ে পাঁচ বছর তিন অধ্যাপনা, গ্রন্থ রচনা ও বক্তৃতার মাধ্যমে মুসলিম জনগণের ঈমান, আকিদা ও চরিত্র গঠনের কাজে ব্যাপৃত থাকেন। এ সময় তিনি কয়েকটি নতুন গ্রন্থ রচনা করেন।
দামেস্কের দুর্গে আটক
ইমাম ইবনে তাইমিয়া তাঁর জীবনের শেষ পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিলেন। কারাগার থেকে তিনি মুক্তি পেয়েছিলেন এবং গ্রন্থ রচনায় ব্যাপৃত হয়েছিলেন সত্য কিন্তু শত্রুরা তাঁকে নিশ্চিন্তে জীবন যাপন করতে দিল না। তারা আবার তাঁকে কারাগারে পাঠাবার ব্যবস্থা করলো। সংগ্রাম সংঘাতে যার জীবন পরিপূর্ণ তিনি কেমন করে নিশ্চিন্ত জীবন যাপন করতে পারেন। অন্যায় ও অসত্যের রাজত্বে নির্বিঘ্নে জীবনের শেষ দিনগুলো কাটিয়ে দিতে পারেন। আর তার চাইতে বড় কথা হচ্ছে, সমকালীন ইলমী ময়দানে তাঁর যে শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিল তা জন্ম দিয়েছিল তাঁর একদল স্থায়ী শত্রুর। তার সব সময় তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকতো। তাঁকে কিভাবে হেয় প্রতিপন্ন করা যায়, কিভাবে তার কহতি করা যায়, তাঁর বক্তব্যের বিকৃত ব্যাখ্যা করে তাঁকে নতুন ইসলাম আমদানীকারী, বুযর্গানে দীনের অবলম্বিত পথের বিরুদ্ধাচরনণকারী এবং ইসলামের অভিনব ও বিকৃত ব্যাখ্যা দাতা হিসেবে চিত্রিত করাই ছিল তাদের কাজ। আর দুর্ভাগ্যবশত সরকার যন্ত্রের চারপাশে এ ধরনের স্বার্থান্ধ আলেমদের ভিড় জমে বেশি। একদল আলেম সরকারী স্বার্থের কাচে নিজেদের দীন ও ঈমান বিক্রি করে সরকারের চাহিদা মতো ইসলামকে কাটছাঁট করতে গিয়ে নিজেদের আল্লাহ প্রদত্ত প্রকৃতির মধ্যেও কাটছাঁট করতে থাকে। এভাবে এমন এক পর্যায় আসে যখন তারা আর স্বাভাবিক মানবিক অবস্থায় টিকে থাকেতে পারেনা, মানুষের আকৃতিতে তখন তারা হয়ে উঠে অমানুষ। হিংসা, বিদ্বেষ, ক্রড়তা, নৃশংসতা, নির্মমতার বন্য স্বভাবগুলো তাদের মধ্যে প্রতিফলিত হতে থাকে। প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে তারা নিজেদের হিংস্র আক্রোশ উদগীরণ করেই ক্ষান্ত হয় না। তাকে লাঞ্ছনার শেষ পর্যায়ে উপনীত না করে তাদের মনে শান্তি আসেনা।
আবার প্রতিপক্ষ যদি ইসলামের সঠিক ব্যাখ্যা দাতা হবার সাথে সাথে কেবলমাত্র তাত্ত্বিক পর্যায়ে অবস্থান করে তাহলেও তাদের আক্রোশ ততটা ফুসে ওঠে না। তারা ওটাকে কোনক্রমে হজম করে নয়ে। কিন্তু তাত্ত্বিক পর্যায় অতিক্রম করে সঠিক ইসলামকে বাস্তবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য প্রতিপক্ষের প্রচেষ্টা ও সংগ্রামের সূচনা হতেই বা এর কোন কর্মসূচী হাতে নিতেই তাদের গাত্রদাহ শুরু হয়। তারা মারমুখী হয়ে ওঠে। কারণ তারা মনে করে এর আঘাতে সর্বপ্রথম তাদের স্বার্থের প্রাসাদ ধ্বসে পড়বে। মুসলিম জনতার সাম তাদের কৃত্রিম নেকী ও ভেজাল ইসলাম ধরা পড়ে যাবে। নিজেদের স্বার্থচিন্তার বাইরে দ্বিতীয় বৃহত্তর কিছু চিন্তা করার অবকাশ তাদের নেই।
নবুওয়তের সাতশো বছর পর ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহমাতুল্লাহে আলাইহি ইসলামের যথার্থ রূপটি শুধুমাত্র তাত্ত্বিক পর্যায়ে তুলে ধরে গুটিকয় বইপত্র লিখে ও ফতোয়া দিয়ে বসে থাকেননি। বরং এই সংগে তিনি ইসলামের এই যথার্থ রূপ মুসলিম জনগণের আকীদা বিশ্বাস পুনর্গঠনের কাজও চালিয়ে যান। তাঁর ছাত্র ও সমর্থক জনগোষ্ঠীকে নিয়ে তিনি একটি দুর্বার গণবাহিনীও গড়ে তোলেন। এ গণবাহিনীর সাহায্যে সমাজকে শিরক, বিদআত ও দুনীতির বিষ বাষ্প থেকে মুক্ত করার প্রচেষ্টা চালান। এমনকি এর মাধ্যমে সরকারের উপরও প্রভাব বিস্তার করেন। তবে যদি সরকার পরিবর্তন করার কোন পরিকল্পনা বা কর্মসূচী তাঁর থাকতো তাহলে আমাদের বিশ্বাস কোন সরকারও তাঁর প্রতি সহানুভূতিশীল ও তাঁর দ্বারা প্রভাবিত হতো না। তখন সরকারও তাঁর প্রতি হতো মারমুখী। তখন আলেমদের পরামর্শ সরকার তাঁকে কারাগারে নিক্ষেপ করতো না বরং সরকারের প্ররোচনায় ও নির্দেশে আলেমগণ তাঁকে কারাগারে নিক্ষেপ করার জন্য সরকারকে পরামর্শ দিতেন। মূলত আমাদের বক্তব্য হচ্ছে স্বার্থান্ধ আলম সমাজ ও ইসলামী খিলাফতের আদর্শ থেকে বিচ্যুত সরকার হামেশা সঠিক ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চালিয়ে এসেছে। সঠিক ইসলামের প্রবক্তারা সবসময় এদের হাতে লাঞ্ছিত হয়ে এসেছে। ইমাম ইবনে তাইমিয়া সারাজীবন এদের হাতে লাঞ্ছিত ও পর্যুদস্ত হয়ে এসেছেন। কাজেই শেষবারের মতো তাঁকে ৭২৬ হিজরির ৭ শাবান দামেস্কের দুর্গে আটক করা হলো। এ আটকের নির্দেশে ইমাম হাসিমুখে গ্রহণ করেছিলেন। তিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে বলে উঠেছিলেনঃ আনা কুনতু মনতাযিরান যালিকা, ওয়া হা যা ফীহেগ খা্ইরুন কাসীরুন ওয়া মাসালিহাতুন কারবীরাহ। অর্থাৎ আমিতো এর অপেক্ষায় ছিলাম,এর মধ্যে বিরাট কল্যাণ নিহিত ও এর তাৎক্ষনিক প্রয়োজন রয়েছে।
ইমামের খেদমত করার জন্য তার ছোট ভাই জয়নুদ্দীন ইবনে তাইমিয়াও গভর্নরের অনুমতিক্রমে কারাগারে তাঁর সাথে অবস্থান করতে থাকলেন।
ইমামের কারারুদ্ধ হবার পর শত্রু পক্ষ ইমামের দলবলের ওপর ও হাত উঠালো। বিভিন্ন স্থানে তারা আক্রমণ চালালো। ইমামের একদল সমর্থককে গ্রেফতার করে গাধার পিঠে চড়িয়ে শহর প্রদক্ষিণ করালো। অবশেষে প্রধান বিচারপতির কাছ থেকে নির্দেশ হাসিল করে একদল সমর্থককে গ্রেফতার করে কারাগারে নিক্ষেপ করলো। কিছু দিন পর আবার তাদের মুক্তি দেয়া হলো। কিন্তু ইমামের শ্রেষ্ঠ শাগরিদ আল্লামা হাফেজ ইবনে কাইয়েম তাঁর সাথে থাকলেন।
ইমামের কারাদণ্ড একদল বিকৃতমনা ইসলাম ব্যবসায়ীর মনে আনন্দের জোয়ার বইয়ে দিলেও হক্কানী আলেম সমাজ ও সাধারণ মুসলমান এ ঘটনায় ভীষণ মর্মাহত ও বিক্ষুব্ধ হলো। তারা একে সুন্নাতের মোকাবিলায় বিদআতের এবং হকের মুকাবিলায় বাতিলের বিজয় মনে করলো। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে শ্রেষ্ঠ আলেমগণ কায়রোয় সুলতানের কাছে পত্র পাঠাতে লাগলেন। তাঁরা যুগের শ্রেষ্ঠ আলেম ও ইসলামের শক্তিশালী কণ্ঠকে এভাবে কারাগারে আটক রাখার বিরুদ্ধে নিজেদের আন্তরিক ক্ষোভ প্রকাশ করলেন।
কেবলমাত্র বাগদাদের আলেমগণ সম্মিলিতভাবে যে স্মারকলিপি সুলতানের কাছে পাঠান তার একটা অংশ এখানে উদ্ধৃত করছিঃ শায়খুল ইসলাম তাকীউদ্দীন আহমদ ইবনে তাইমিয়ার ওপর জুলুম করা হচ্ছে শুনে পূর্ব এলাকার দেশগুলো এবং ইরাকের ইসলাম প্রিয় দীনদার লোকেরা ভীষণ মর্মাহত হয়েছে অন্য দিকে ইসলাম বিরোধীরা আনন্দে নাচতে শুরু করেছে। স্বার্থবাদী ও বিদআতি মহলও এতে খুশি হয়েছে। এসব এলাকার আলেমগণ যখন দেখলেন বিদআতি ও বাতিল পন্থীরা আলেমদের লাঞ্ছনা ও দুর্ভোগে আনন্দে হাততালি দিয়ে বেড়াচ্ছে তখন তারা এ অবাঞ্ছিত ঘটনাটির খবর সরকারকে দেয়া জরুরী মনে করলো। এই সাথে তারা শায়খের ফতোয়ার সমর্থনে নিজেদের জবাবও লিখে পাঠাচ্ছে। তারা শায়খের ইলম, জ্ঞান ও পাণ্ডিত্যের স্বীকৃতি দিয়ে নিজেদের মনোভাব ও এখানে ব্যক্ত করেছে। এসব কিছুর মূলে দীনকে মর্যাদাশালী দেখার ও সুলতানের প্রতি কল্যাণ কামনার মনোভাব ছাড়া আর কিছুই নেই।
কারাগারে ইমামের তৎপরতা
সত্য ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠাকে যার নিজেদের জীবনের লক্ষ হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছে, তার দুনিয়ার কোন বাধাকে বাধা বলেই মনে করে না। অণুকুল ও প্রতিকুল যে কোন পরিবেশেই তারা নিজেদের দায়িত্ব পালন করে যেতে থাকে। একটা অণুকুল পরিবেশের আশায় তারা নিজেদের কাজ ও প্রোগ্রাম স্থগিত রেখে চুপচাপ বসে থাকেনা। কোন কারাপ্রাচীর এ ধরনের মর্দে মুজাহিদদের কর্মস্পৃহাকে স্তব্ধ করে দিতে পারেনা। একদিকের কাজ বন্ধ হয়ে গেলে তারা অন্যদিকের কাজের দরজা খুলে দেন।
দামেস্কের কারাগারে ইমাম ইবনে তাইমিয়াও সেই একই পথ অবলম্বন করলেন। বাইরে তিনি জ্ঞানের প্রসার, সংস্কার ও চরিত্র গঠনের যে দায়িত্ব পালন করছিলেন কারাগারে আটক থাকার কারণে সেগুলো বন্ধ হয়ে গেলো ঠিকই কিন্তু এতে তিনি মোটেই দমলেন না। কারাগারে একদিকে তিনি নিজের ইবাদত বন্দেগী ও কুরআন তেলাওয়াতে মশগুল হয়ে গেলেন এবং অন্যদিকে ব্যক্তিগত অধ্যয়নও গ্রন্থ রচনায় মন দিলেন বেশি করে। বিশেষ করে নিজের আগের লেখা বইগুলোর সংস্কার ও সম্পাদনায় ব্রতী হলেন। এ সময় তিনি কুরআন গবেষণায় ও কুরআনের জটিল গ্রন্থগুলো উন্মোচনের ব্যাপারে বেশি আগ্রহী হয়ে উঠলেন। সম্ভবত জ্ঞানের ক্ষেত্রে তিনি যে পরিপক্বতায় এসে পৌঁছেছিলেন তার সাথে কারাগারের নিরুপদ্রব পরিবেশ এবং নিবিষ্ট চিত্তে কুরআন অধ্যয়ন ও গবেষণার সুযোগ তাঁকে এ কাজে পারদর্শী করে তুলেছিল।
আস্তে আস্তে জেলের পরিবেশ তাঁর কাছে সহনীয় ও স্বাভাবিক হয়ে উঠলো। এখানে বসে বসে তিনি যা কিছু লিখতেন কিছুক্ষণের মধ্যে কারাগারের বাইরে তা ছড়িয়ে পড়তো। সারাদেশেও তা ছড়িয়ে পড়তো মাত্র কয়েকদিনের মধ্যে। জেলের বাইরে থেকে লোকেরা তাঁর কাছে ফতোয়া জানতে চেয়ে চিঠি লিখে পাঠাতো। জেলের মধ্যে বসে তিনি তার জবাব লিখে বাইরে পাঠিয়ে দিতে। কাজেই এ অবস্থায় জেলের ভেতর ও বাইর তাঁর জন্যে সমা হয়ে দাঁড়াল। বরং জেলের মধ্যে বসে তিনি নিশ্চিন্তে নিজের মত প্রকাশ করে যাচ্ছিলেন।
এসময় তিনি মিসরের মালেকী মযহাবের কাযি আবদুল্লাহ ইবনুল আখনায়ীর একটি মতের কঠোর সমালোচনা করলেন। এ সমালোচনা করতে গিয়ে তিনি কাযী সাহেবের শরীয়ত ও ফিকহের জ্ঞানের অপ্রতুলতা সম্পর্কেও মন্তব্য করলেন। এ মন্তব্যে কাযী সাহেবের ক্রোধকে উদ্দীপিত করলো। তিনি তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন। সুলতানের দরবারে নালিশ করলেন এবং ইমামের বিরুদ্ধে আক্রোশ প্রকাশ করে নিজের মনের ঝাল মেটালেন।
বই কলম ছিনিয়ে নেয়া হলো
সুলতান ফরমান জারি করলেনঃ ইমামের কাছে কাগজ কলম, দোয়াত ইত্যাদি যা কিছু লেখার সরঞ্জাম আছে ছিনিয়ে নেয়া হোক। বইপত্রও সব সরিয়ে নেওয়া হোক। তিনি যেন আর লেখাপড়া করতে না পারেন। তাঁর মতামত যেন আর কোনক্রমেই জনসমক্ষে প্রচারিত হতে না পারে।
একজন লেখক, সমালোচক ও সমাজ সংস্কারকের জন্য বোধহয় এর চেয়ে বড় আর কোন শাস্তি নেই। হয়তো মৃত্যুদণ্ড তাঁর কাছে এর চেয়ে শতগুণ সহজ। ৭২৮হিজরীর ৯ জমাদিউস সানী সরকারী ফরমান অনুযায়ী তাঁর সব কাগজপত্র ও লেখার সরঞ্জাম বাজেয়াপ্ত করে নেয়া হলো। এগুলো আদালতের লাইব্রেরীতে দাখিল করে দেয়া হলো। এখানে তাঁর প্রায় ৬০খানা গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি ছিল।
সরকারের এ দমননীতিতে ইমাম একটুও দমলেন না। তিনি সরকারের কাছে কোন অনুযোগ অভিযোগও করলেন না। নীরবে সব সহ্য করে গেলেন। দোয়াত, কলম, খাতাপত্র ও কাগজ কেড়ে নেবার পর তিনি বিচ্ছিন্ন ও টুকরো কাগজ কুড়িয়ে জমা করলেন। সেগুলোর ওপর কয়লা দিয়ে লিখতে লাগলেন। পরবর্তীকালে এভাবে লিখিত তাঁর কয়েকটি পুস্তিকা পাওয়া গেছে। এগুলো বহুকাল পর্যন্ত অপরিবর্তিত অবস্থায় ছিল। জীবনের এ অবস্থায়ও তিনি জিহাদের লিপ্ত রয়েছেন বলে মনে করতেন। মিসরীয় লেখক শায়খ আবু যোগরা তাঁর ইবনে তাইমিয়া গ্রন্থ ইমামের এ সময়কার লিখিত একটি পত্র উদ্ধৃত করেছেন। এ পত্রে তিনি বলেছেনঃ
আলহামদুলিল্লাহ! আল্লাহর পথে অনেক বড় জিহাদে লিপ্ত রয়েছি। এখানকার জিহাদ তাতারী সম্রাট কাযানের বিরুদ্ধে জিহাদ বা জাহামীয়া ও সর্বেশ্বরবাদীদের বিরুদ্ধে পরিচালিত আমাদের অতীতের জিহাদগুলোর চাইতে কোন অংশে কম নয়। এটা আমাদের ও জনগণের ওপর আল্লাহর বিরাট অনুগ্রহ। কিন্তু অধিকাংশ লোক এর তাৎপর্য বুঝতে অক্ষম।
পরকালের পথে যাত্রা
ইমামের সময়ও শেষ হয়ে এসেছিল। মৃত্যু শয্যায় দামেস্কের গভর্নর তাঁকে দেখতে এলেন। গভর্নর শোকাভিভূত কণ্ঠে তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। জবাবে ইমাম বললেনঃ আপনার বিরুদ্ধে আমার কোন অভিযোগ নেই। আপনাকে আমি মাফ করে দিয়েছি। আমি তাদেরকেও মাফ করে দিয়েছি যারা আমার সাথে শত্রুতা করেছে। আমার বক্তব্যের ও কর্মকাণ্ডের সত্যতা সম্পর্কে তাদের মনে কোন প্রকার সন্দেহ ছিল না এবং এখানো নেই। আমি সুলতানকেও মাফ করে দিয়েছি। কারণ সুলতান স্বেচ্ছায় নয় বরং উলামায়ে কেরামের ফতোয়ার কারণে আমাকে কারাগারে নিক্ষেপ করেছেন। আমি সবাইকে এ ব্যাপারে ক্ষমা করে দিয়েছি। তবে সেই ব্যক্তিকে আমি কোনদিনই ক্ষমা করতে পারিনা, যে আল্লাহ ও তার রসুলের শত্রু এবং আল্লাহ ও তঁর রসুলের প্রতি আক্রোশের বশবর্তী হয়ে আমার বিরুদ্ধে শত্রুতায় লিপ্ত হয়েছে এবং আমাকে কারাগারে নিক্ষেপ করে আত্মপ্রসাদ লাভ করেছে।
৭২৮ হিজরির ২২ জিলকদ ৬৭ বছর বয়সে তিনি দুনিয়া থেকে বিদায় নিন। দুর্গের মুয়াজ্জিন মসজিদের মিনারে উঠে তাঁর মৃত্যু সংবাদ ঘোষণা করেন। দুর্গের চারদিকের উঁচু বুরুজগুলো থেকে সমস্বরে এ ঘোষণা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। সংগে সংগে শহরের মসজিদগুলো থেকে শোক বর্তা ইথারে ইথারে চতুর্দিকে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হতে থাকে। মুহূর্তে শহরের সমস্ত আনন্দ কোলাহল স্তব্ধ হয়ে যায়। শোকের ছায়া নেমে আসে অলিতে গলিতে, রাজপথে, অলিন্দে, গৃহকোণে, মানুষের মুখে চোখে। দুর্গের পথে ঢল নামে শোকাহত মানুষের। শত্রুরাও শত্রুতা ভুলে যায়। তারাও মূর্ছিত, বেদনাহত।
দুর্গের সদর দরজা খুলে দেয়া হয়। লোকেরা দলে দলে যেতে থাকে ইমামের মরদেহ এক নজর দেখে হৃদয়ের শোকাবেগকে কিছুক্ষণের জন্য হলেও প্রশমিত করতে। গোসলের পর তাঁর জানাজা শহরের বৃহত্তম মসজিদ জামে উমুবীতে আনা হয়। দুর্গ ও জামে উমুবীর মধ্যকার দীর্ঘ রাজপথ লোকে লোকারণ্য হয়। ভিড় থেকে জানাজাকে রক্ষা করার জন্য সেনাবাহিনীর লোকদের ব্যবস্থাপনায় লাশ জামে মসজিদে আনা হয়। তৎকালীন ইসলামী বিশ্বের বৃহত্তম মসজিদ লিছ জামে উমুবী। এ মসজিদ ভরে গিয়ে সামনে ময়দান, রাজপথ, আশপাশের অলি গলি, বাজার সব লোকে ভরে যায়। ঐতিহাসিকদের মতে ইতিপূর্বে ইসলামী বিশ্বের আর কোথাও এত বড় জানাজা অনুষ্ঠিত হয়নি।
এদিন শহরের দোকান পাট সব বন্ধ থাকে। বহু লোক রোজা রাখে এবং বহু লোক খাবার কথা ভুলে যায়।
জানাজা গোরস্তানের দিকে নিয়ে যাবার সময়ও লোকের ভিড়ে চলা কঠিন হয়ে পড়ে। ফজরের পর দুর্গ থেকে জানাজা বের করা হয়। যোহরের পর জানাজার নামায অনুষ্ঠিত হয় এবং জনতার ভিড় ঠেলে নিকটবর্তী গোরস্তানে পৌছতে আসরের ওয়াক্ত হয়ে পড়ে।
অতি অল্প সময়ে ইমামের মৃত্যু সংবাদ সারা ইসলামী বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে এবং সর্বত্র গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।