ইমামের তাজদীদী কার্যক্রম
আল্লাহ তাঁর দীনকে নবীদের মাধ্যমে মানুষের সমাজে পরিচিত ও প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এজন্য নবীর পর নবী এসেছেন। এক একটি যুগ সীমানা চিহ্নিত হয়েছে, তার মধ্যে একজন নবী এসেছেন। আবার একযুগে এক সঙ্গে কয়েকজন নবীও এসেছেন। দুনিয়ায় বিভিন্ন দেশে একই সময়ে কয়েকজন নবী আল্লাহর দীন প্রচার ও প্রতিষ্ঠার কাজ চালিয়ে গেছেন। এমনকি একই দেশে আল্লাহ একই সংগে একাধিক নবী পাঠিয়েছেন। তাঁদের একজনকে বানিয়ে দিয়েছেন অন্য জনের সহযোগী। এভাবে দেখা যায় মানব জাতির ইতিহাসে নবীদের সিলসিলা কখনো বিচ্ছিন্ন বা ক্ষণকালের জন্য হলেও স্থগিত হয়নি। মানুষকে অন্ধকারের মধ্যে রেখে আল্লাহ তায়ালা তাদের সম্পর্কে কোন সিদ্ধান্ত শনিয়ে দেননি। তাই মানুষের ইতিহাসের সাথে সাথে নবীদের ইতিহাসও সমান্তরাল রেখায় চলে এসেছে। বরং বলা যায় নবীরাই মানুষের ইতিহাসকে এগিয়ে নিয়ে এসেছেন।
কিন্তু শেষ নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর আর কোন নবী নেই। এরপর যত দীর্ঘকাল যত হাজার বছর অতিবাহিত হয়ে যাক না কেন আল্লাহ তা আলা আর কোন নবী পাঠাবেন না বলে ঘোষণা করে দিয়েছে। এ সময় উম্মতে মুহাম্মাদীয়ার মধ্যে থেকে এমন সব দীন ও শরীয়তের নির্ভুল জ্ঞান সম্পন্ন সত্যনিষ্ঠ নির্ভীক মর্দে মুজাহিদকে তিনি এগিয়ে আনবেন যারা সত্যিকার অর্থে দীনকে পুনরুজ্জীবিত করার দায়িত্ব পালন করবেন। এ সম্পর্কে ইমাম আবু দাউদ তাঁর গ্রন্থে হযরত আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহুর উদ্ধৃতি দিয়ে একটি হাদিস বর্ণনা করেছেন। তাতে বলা হয়েছেঃ
*************আরবী*************
অর্থাৎ প্রত্যেক শতকের শিরোভাগে আল্লাহ এই উম্মতের জন্য এমন লোক সৃষ্টি করবেন যিনি উম্মতের জন্য তার দীনকে সবল ও সতেজ করবেন। আল্লাহর এই সত্যনিষ্ঠ বান্দাগণ মহানবীর স. দীন ও শরিয়তের তাজদীদ বা পুনরুজ্জীবনের কাজ করেন বলেই তাদেরকে বলা হয় মুজাহিদ। ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহমাতুল্লাহি আলাইহি ছিলেন তেমনি একজন মুজাদ্দিদ। সপ্তম অষ্টম হিজরি শতকে তিনি ইসলামী শরীয়তের জন্য নবুওয়তের সাতশো আটশো বছরের মধ্যে দীন ও শরীয়তের ওপর যে ময়লা ও আবর্জনার পলেস্তারা জমে উঠেছিল তা ধারালো অস্ত্র দিয়ে চেঁছে ফেলে দেন। ইসলাম তার বেতরের ঔজ্জ্বল্যে আবার ঝকমকিয়ে ওঠে। তাঁর পূর্বে আরো বহু মুজাদ্দিদ ইসলামকে এভাবে বাইরের আবর্জনা মুক্ত করে গেছেন। কিন্তু তাঁর কাজটি ছিল মনে হয় তাঁদের সবার চাইতে অনেক বেশি ব্যাপক, সুস্পষ্ট ও সুতীক্ষ্ণ।
ইমাম ইবনে তাইমিয়ার এই তাজদীদী কাজকে মূলত চার ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। (১) তওহীদী আকীদার পুনরুজ্জীবন এবং মুশরিকী আকীদা বিশ্বাস, রীতি নীতি ও আচার আচরণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সৃষ্টি। (২) দর্শন, ন্যায় শাস্ত্র ও কালাম শাস্ত্রের সমালোচনা এবং কুরআন ও সুন্নাতের দৃষ্টিভঙ্গি ও যুক্তি উপস্থাপন পদ্ধতিকে অগ্রাধিকার দান। (৩) ইসলাম বিরোধী ধর্ম, ফেরকা, সম্প্রদায় ও গোষ্ঠীগুলোর সমালোচনা এবং তাদর চিন্তা, কর্ম ও আচরণের মোকাবিলা করা। (৪) শরীয়তের ইলম ও ইসলামী চিন্তার পুনরুজ্জীবন।
ইমামের সময় স্বদেশে বিদেশে উলামার সংখ্যা কিছু কম ছিল না। বড় বড় ও বিশ্ব জোড়া খ্যাতি সম্পন্ন আলেমের সংখ্যাও তখন যথেষ্ট ছিল। তাঁদের বৃহদাকার কিতাবগুলো, তাঁদের পাণ্ডিত্যের বিপুলায়তন প্রমাণের জন্য যথেষ্ট। হাদিস, ফিকহ, তাফসীর, উসুল ও কালাম শাস্ত্রে তাদের পাণ্ডিত্য ছিল গগনচুম্বী। সম্ভবত তারা যুগের ফিতনাগুলো সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। কিন্তু এর মোকাবিলায় কাউকে এগিয়ে আসতে দেখা যায়নি। বক্তৃতা, লেখনী ও সংগঠন এ তিনটি শক্তির কোন একটিকে ব্যবহার করেছেন এমন কোন আলেমের নাম তৎকালীন ইতিহাসে পাওয়া যায় না। যুগের গতি ধারায় আত্মসমর্পণ করে সবাই যেন গড্ডালিকা প্রবাহে ভেসে চলছিলেন। এ গৌরব একমাত্র ইমাম ইবনে তাইমিয়ার জন্য নির্দিষ্ট। যুগের ফিতনাকে তিনি সঠিকভাবে অনুধাবন করেছিলেন এবং সর্বশক্তি য়ে তার মোকাবিলা করে ইসলামকে তার যথার্থ রূপে পুনঃ প্রতিষ্ঠিত করে গেছে। ইসলামী সমাজকে শিরক ও বিদআতের দুর্গন্ধ মুক্ত করে সেখানে যথার্থ তওহীদ ও রিসালাতের স্বচ্ছ স্রোতধারার স্বচ্ছন্দ প্রবাহকে স্বতঃ উৎসারিত করে গেছে। এটাইতো আম্বিয়া আলাইহিমুস সালামদের কাজ। এক্ষেত্রে তিনি নবীদের প্রতিনিধিত্ব করে গেছেন। দীনের মুজাদ্দিদগণ আসলে নবীদের দায়িত্বই আনজাম দিয়ে যান।
ইমাম যে সমাজের সংস্কার সাধনে ব্রতী হয়েছিলেন সেটা কোন ধরনের সমাজ ছিল? যথার্থ ইসলামী সমাজের সাথে তার কতটুকু সম্পর্ক ছিল, এটা যথাযথভাবে অনুধাবন করার মতো একটি বিষয়। অমুসলিম ও বিভিন্ন অনারব জাতিদের সাথে মেলামেশা এবং ইসমাঈলী ও বাতেনী শাসকদের প্রভাব আবার এর সংগে একদল অজ্ঞ ও গোমরাহ সূফীর শিক্ষা ও কর্মের ফলে সাধারণ মুসলমানদের মধ্যে শিরক মিশ্রিত আকীদা বিশ্বাস, চিন্তা ও কর্মের বিস্তৃতি ঘটতে থাকে। ইহুদী নাসারাদের মতো মুসলমানরাও প্রকাশ্য শিরকে লিপ্ত হয়ে পড়ে। অমুসলিমরা তাদের মহাপুরুষদের কবরে গিয়ে যা কিছু করতো মুসলমানরাও নিজেদের বুযর্গানে দীনদের মাজারে গিয়ে তারই পুনরাবৃত্তি করতো। তারা কবরবাসীদের কাছে ফরিয়াদ জানাতো, সাহায্য চাইতো যেমন আল্লাহর কাছে চাওয়া হয়। ইবনে তাইমিয়া তাঁর আররদ্দু আলাল বিকরী গ্রন্থে এসব লোকের কার্যকলাপ সম্পর্কে লিখেছেনঃ তাদের অনেকে কবরে শায়িত ব্যক্তিকে আল্লাহর মর্যাদা দিয়েছে এবং ঐ কবরের খাদেম জিন্দাপীরকে পয়গম্বরের আসনে বসিয়েছে। তারা মৃতের কাছে নিজের আরদ্ধ কাজ সম্পন্ন করার জন্য সাহায্য প্রার্থনা করে। তারা ঐ জিন্দাপীর খাদেমকে এমন উচ্চ আসনে বসিয়েছে যে, সে যেটাকে হালাল বলবে সেটা হালাল আর যেটাকে হারাম বলবে সেটা হারাম হয়ে যাবে। তারা আসলে আল্লাহকে ইলাহর দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দিয়েছে।
এইসব শিরক ও বিদআত পরস্তদের সম্পর্কে তিনি আররদ্দু আলাল আখনায়ী গ্রন্থে লিখেছেনঃ অনেকের বিশ্বাস, যে মহল্লা বা জনপদে কোন বুযর্গের মাজার থাকে তারই বরকততে এলাকার অধিবাসীরা রিজিক পেয়ে থাকে, সাহায্য লাভ করে থাকে এবং দুশমনদের আক্রমণ থেকে সংরক্ষিত থাকে। তারই বরকতে দেশও দুশমনের আক্রমণ থেকে রেহাই পায়। যে ব্যক্তি সম্পর্কে তারা এ ধরনের আকীদা রাখে তার সম্পর্কে বলে থাকে যে, তিনি হচ্ছেন অমুক শহরের রক্ষক। যেমন সাইয়েদ নাফীসা মিসর ও কায়রোর রক্ষক। অমুক অমুক বুযর্গ দামেস্কের রক্ষক। অমুক অমুক বুযর্গ বাগদাদ প্রভৃতি শহরে প্রহরারত আছেন। তাদের আকীদা হচ্ছে, ঐসব নবী ও সৎ লোকদের কবরের বরকতে সংশ্লিষ্ট শহর ও জনপদগুলো বালা মুসিবত থেকে সংরক্ষিত আছে।
দুশমনরা যখন বাগদাদ ও দামেস্কের ওপর আক্রমণ চালাচ্ছিল তখন তারা অলি ও বুযর্গদের মাযারে গিয়ে ধর্না দিচ্ছিল, আল্লাহর দরবারে যাবার প্রয়োজন বোধ করেনি।
মুসলমানদের আকীদাকে শিরক মুক্ত করার প্রচেষ্টা
মানুষের রক্ত মাংসের দেহটার স্রষ্টা হচ্ছেন আল্লাহ। তার মধ্যে যা কিছু বিমূর্ত গুণাবলী রয়েছে সেগুলোও আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন। কাজেই এসবের জন্য কোন কৃতিত্ব মানুষের প্রাপ্য নয়, প্রাপ্য একমাত্র আল্লাহর। তাই কুরআনের শুরুতেই বিশ্ব জগতের যে কোন বিষয়ের যে কোন কৃতিত্বের মূল অধিকারী হিসেবে সমস্ত প্রশংসার মালিক একমাত্র আল্লাহকেই ঠাওরানো হয়েছে। বলা হয়েছে- আলহামদুলিল্লাহ। মানুষ জীবিত হোক বা মৃত তার কোন শ্রেষ্ঠত্ব নেই। শ্রেষ্ঠ একমাত্র আল্লাহ। আল্লাহু আকবার।
কিন্তু মানুষের গোমরাহীর ইতিহাস আলোচনা করলে দেখা যাবে, এ ইতিহাসের প্রথম থেকেই মানুষ মানুষের পূজা করে আসছে। এটা জীবিত ও মৃত উভয় পর্যায়েই স্থান করে দিয়েছে। বীর পূজা, আউলিয়া পূজা, পীর পূজা, কবর পূজা, মাজার পূজা, প্রভৃতি বিভিন্ন পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়েছে এটা। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, মুসলমানরা কোন দিন প্রকাশ্য শিরক বা মূর্তি পূজায় লিপ্ত হবে না। অবশ্যই মুসলমানরা কোন দিন প্রকাশ্য শিরকে লিপ্ত হয়নি। কিন্তু শিরক মিশ্রিত কার্যকলাপ তাদের মধ্যে ব্যাপক বিস্তৃতি লাভ করেছে। এই মূর্তি পূজার পরিবর্তে মুসলমানদের একটি গ্রুপ আউলিয়া পূজা ও কবর পূজায় লিপ্ত হয়েছে। কবরের মধ্যে আবার বিশেষ গুরুত্ব লাভ করেছে শহীদদের মাজার। এগুলোকে বলা হয় মাশহাদ বা শাশাহিদ। আউলিয়া পূজা ও মাশহাদ পূজার কারণে মসজিদের তুলনায় মাশহাদের মর্যাদা ও গুরুত্ব বেড়ে যায়। লোকেরা মাজার আর মাশহাদের যিয়ারতে মেতে ওঠে। এগুলোই সাধারণ ও জাহেল মুসলমানদের কিবলায় পরিণত হয়। ইসলামী জাহানের বিভিন্ন নগরে বন্দরে এসব মাজার ও মাশহাদের জাল বিস্তৃত হয়। রাতারাতি হাজার হাজার মাশহাদ ও মাজার গড়ে ওঠে। সুলতান, বাদশাহ ও আমীরগণ এগুলোর পিছনে দরাজ হস্তে অর্থ সম্পদ ব্যয় করেন। এগুলোর নামে অনেক সম্পত্তিও ওয়াকফ করা হয়। এগুলোর ওপর বড় বড় ইমারত ও গম্বুজ বানানো হয়। এগুলো দেখাশুনো করার জন্য খাদেম, ঝাড়ুদার ও কর্মচারীদের এক বিরাট গোষ্ঠী গড়ে ওঠে। লোকেরা জাঁকজমকের সাথে এগুলো যিয়ারত করার জন্য সফর করতে থাকে। আল্লাহর ঘর জিয়ারতকারী হাজীদের কাফেলার মতই দেখা যায় তাদের কাফেলা। আবার অনেক সময় দেখা যায় তার চাইতেও বড়। এভাবে মসজিদ থেকে মাশহাদের দিকে সাধারণ মুসলমানদের দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়। সপ্তম ও অষ্টম হিজরিতে এভাবে কাবাঘরের পরিবর্তে মাজার ও মাশহাদ মুসলমানদের দীনি জীবনের কেন্দ্রে পরিণত হয়।
ইমাম ইবনে তাইমিয়ার রচনাবলীর বিরাট অংশ জুড়ে আছে সেকালের মুসলমানদের এই গোমরাহীর আলোচনা। ইমাম দেখিয়েছেন, জাহেল ও স্বার্থান্বেষী মুসলমানদের মধ্যে এ ফিতনাটিকে সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করার ব্যাপারে সব চাইতে বেশি সাহায্য করেছে মিসরের বাতেনী তথা ফাতেমী শাসকরা। তিনি এও দেখিয়েছেন যে রাফেযী ও শিয়ারা শুরু থেকেই মসজিদের চাইতে মাশহাদকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে এসেছে। হারামাইন (মক্কা-মদিনা) শরীফের চাইতে নজফ ও কারবালার সাথে তাদের আত্মিক সম্পর্ক বেশি।
অবশ্য ইমাম ইবনে তাইমিয়ার জন্মের পূর্বেই মিসরের ফাতেমী শাসকদের যুগ শেষ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তাদের মানসিক, সাংস্কৃতিক ও তমদ্দুনিক প্রভাব মুসলিম সমাজের ওপর তখনো ছিল সক্রিয়। বিশেষ করে সিরিয়ায় শিয়া ও ইসমাঈলীদের সংখ্যা ছিল বিপুল। একই সমাজে বাস করার কারণে সাধারণ মুসলমানদের ওপর তাদের প্রভাব পড়ছিল। এই সংগে সূফীবাদের ইসলাম বিরোধী ধারটির অবদানও কম ছিল না। এই গোমরাহ সুফি দর্শনে মাজার ও মাশহাদের ওপর বিশেষ গুরুত্ব ও পবিত্রতা আরোপ করা হয়েছিল। তারা এসব মাজার ও মাশহাদের বার্ষিক জলসা বা উরুস অনুষ্ঠান করতো। এসব মাজার ও মাশহাদের উল্লেখ করে ইমাম তাঁর আররদ্দু আলাল বিকরী গ্রন্থে লিখেছেনঃ অনেকে কবরে হজ্ব করে। অনেকে আবার এ সফরের আদব ও নিয়ম কানুনের ওপর বিশেষ বইপত্র লিখেছে। এসব গ্রন্থর নামকরণ তারা এভাবে করেছে যেমন, আল মানুসিকুল হাজ্জিল মাশাহিদ। অর্থাৎ মাশহাদগুলোয় হজ্জব্রত সম্পাদন করার নিয়ম কানুন। জনৈক শিয়া আলেম আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে নোমানও এ নামে একটি বই লিখেছেন। এ গ্রন্থে তিনি আহলে বায়েতের নামে এমন বহু হাদিস বর্ণনা করেছেন যা আসলে ভিত্তিহীন। এ গ্রন্থের অন্য এক স্থানে ইমাম লিখেছেনঃ অনেক লোক এইসব কবর ও মাশহাদে হজ্জ করাকে কাবা শরীফে হজ্জ করার ওপর অগ্রাধিকার দেয়। তারা বলে থাকে, উমুক বুজুর্গের মাজার তিনবার যিয়ারত করলে তা কাবা শরীফের একটি হজ্বে পরিণত হয়।
এভাবে সপ্তম অষ্টম হিজরিতে সমগ্র ইসলামী বিশ্বে মসজিদগুলো বিরান হয়ে যেতে থাকে এবং তার তুলনায় মাজার ও মাশহাদগুলোর চাকচিক্য ও জাঁকজমক বেড়ে যায়। সেগুলোর আঙিনা সবসময় গুলজার থাকে। অনেক সময় মসজিদগুলো রাতের বেলা আধারে ঘিরে থাকে। মাজার আর মাশহাদগুলোয় ঘিয়ের প্রদীপ ও ঝাড় লণ্ঠন জ্বলতে থাকে সারারাত। কখনো হয়তো মহল্লার গরীব মুসলমানরা মসজিদের দিকে নজর দেবার ফুসরত পায়না। তাদের অর্থ মাজারের পেছনে ব্যয় হয়।
এসময় বিভিন্ন দেশে বড় বড় ও শক্তিশালী ইসলামী সরকার প্রতিষ্ঠিত ছিল। বড় বড় ফকীহ ও মুহাদ্দিস বিভিন্ন মাদরাসা ও ইসলামী শিক্ষাকেন্দ্রে অধ্যাপনা করছিলেন। কিন্তু সাধারণ মুসলমানদের এসব আকিদা ও আমলগত গোমরাহীর বিরুদ্ধে কোন প্রতিরোধ আন্দোলন শুরু করার প্রয়োজন তারা অনুভব করেননি। বরং তাদের অনেকে এসব আকায়েদ ও আমল সম্পর্কে সন্দেহ সংশয়ের মধ্যে অবস্থান করছিলেন। তাদের রচনাবলী ও ফতোয়াসমূহ অধ্যয়ন করলেন তাদের এই সংশয়ের আভাস পাওয়া যাবে। এ যুগের দুজন শ্রেষ্ঠ আলেম ইবরাহীম আখনায়ী ও ইয়াকুব আল বিকরীর গোমরাহ চিন্তাধারার সমালোচনায় ইমাম ইবনে তাইমিয়ার বিশেষভাবে লিখিত দুখানা গ্রন্থই তার প্রমাণ। মূলত সরাসরি কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে প্রচলিত চিন্তা,আকীদা বিশ্বাসও কর্মকাণ্ডকে বিশ্লেষণ করার দিকে তারা অগ্রসর হননি। অথচ ইসলামের মূল উৎসই হচ্ছে কুরআন ও সুন্নাহ। ইমাম ইবনে তাইমিয়া আলেম সমাজকে এই উৎসের দিকে ফিরে আসার আহবান জানান।
দর্শন ও কালাম শাস্ত্রের ভ্রান্তি উন্মোচন
ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহমতুল্লাহি আলাইহি মুশরিকী আকীদা বিশ্বাসের প্রভাবমুক্ত করে ইসলামী আকীদা বিশ্বাসকে পুনর্গঠিত ও পূনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন। এটা ছিল তার প্রথম সংস্কারমূলক কাজ। এ সম্পর্কে ইতিপূর্বে আলোচনা করেছি। এবার তাঁর দ্বিতীয় সংস্কারমূলক কাজটির আলোচনা করতে চাই। ইমামের দ্বিতীয় সংস্কারমূলক কাজটি ছিল দর্শণ, ন্যায় শাস্ত্র ও কালাম শাস্ত্রের সমালোচনা এবং তার পরিবর্তে কুরআন ও সুন্নাহের যুক্তি গ্রহণ পদ্ধতির প্রচলন। তাঁর এ কাজটির গুরুত্ব ও ব্যাপকতা বুঝতে হলে সেকালে মুসলিম শিক্ষিত সমাজে দর্শন ও ন্যায় শাস্ত্রের অবস্থান জানতে হবে। মুসলিম চিন্তাবিদ ও বিদগ্ধ সমাজ দর্শন ও ন্যায়শাস্ত্রকে কত বড় মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছিলেন তা জেনে নিতে হবে আগে।
বনু উমাইয়া আমল থেকে আরবীতে গ্রীক জ্ঞান বিজ্ঞানের অনুবাদের কাজ শুরু হলেও আসলে আব্বাসীয় আমলে তা ব্যাপক রূপ লাভ করে। আব্বাসীয় বাদশাহ মনসুরের আমল থেকে (সম্ভবত১৩৬ হিজরি) গ্রীক দর্শন ও ন্যায় শাস্ত্রের আরবীতে অনুবাদের কাজ ব্যাপকভাবে শুরু হয়। তবে বাদশাহ মামুনের সময়ে এসে তার ব্যাপকতা এত বেড়ে যায় যে, তা রীতিমত একটি আন্দোলনের রূপলাভ করে। মামুন নিজে এ ব্যাপারে এত বেশি আগ্রহী ছিলেন যে, রোমের বাদশাহের কাছে গ্রীক দর্শন সম্পর্কিত শ্রেষ্ঠ গ্রন্থগুলো পাঠাবার জন্য তিনি অনুরোধ জানান। রোম সম্রাটও আফলাতুন(প্লেটো), আরাস্তু তালিস(এরিস্টটল), সুকরাত(সক্রেটিস), জালিনুস, উকলিদাস, বাতলিমুস প্রতি দার্শনিকদের গ্রন্থ গুলো পাঠান। মামুন অত্যন্ত জাঁকজমকের সাথে সেগুলোর অনুবাদ করান। রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সেগুলোর প্রকাশনার ব্যবস্থা করা হয়। লোকদেরকে এ গ্রন্থগুলো পড়ার জন্য উৎসাহিত করা হয়।
ফলে কিছুদিনের মধ্যেই মুসলিম সমাজে গ্রীক দার্শনিকদের চিন্তাধারা ছড়িয়ে পড়ে। ইতিহাস পাঠে জানা যায়, চতুর্থ হিজরির শেষ অব্দে গ্রীক দার্শনিকদের প্রায় সমস্ত বড় বড় গ্রন্থ আরবীতে অনুদিত হয়ে যায়। কিন্তু মুসলিম দার্শনিকদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রসার লাভ করে আরাস্তুর (এরিস্টটল)গ্রন্থগুলো। আরান্তু তাদের মধ্যমণি হয়ে ওঠেন। এটাকে মুসলমানদের দুর্ভাগ্য ছাড়া আর কি বলা যেতে পারে যে, আরাস্তুসহ যেসব গ্রীক দার্শনিকের চিন্তাধারা মুসলিম সমাজে ছড়িয়ে পড়েছিল তাদের একজনও আল্লাহ প্রেরিত দীন নবুওয়ত সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিল ছিলেন না। তাদের চিন্তার সাথে আল্লাহ প্রেরিত দীন ও আসমানী কিতাবগুলোর ছিল সুস্পষ্ট বিরোধ। সেগুলো ছিল মূলত বস্তুবাদী চিন্তা ও জীবন দর্শনের ধারক।
প্রথম দিকে ইসলামী বিশ্বের দার্শনিক ও চিন্তাবিদগণ আরাস্তুর চিন্তা ও দর্শনকে চোখ বুজে স্বীকার করে নেননি। তাঁরা এর সমালোচনা করেন। একে ভুলের ঊর্ধ্বে মনে করেননি। আনেকেই এর সমালোচনায় বই লিখেছেন। যেখানেই গ্রীক চিন্তার দুর্বলতা তাদের চোখে পড়েছে সেখানেই তারা বেধড়ক সমালোচনা করেছেন। যে মুতাজিলারা গ্রীক দর্শনের প্রভাব সবচেয়ে বেশি গ্রহণ করেছিলেন তারাই ছিলেন আবার তার সবচেয়ে বড় সমালোচক। তাদের মধ্যে নিজাম ও বু আলী জিবাইর নাম সবার আগে উল্লেখ করা যেতে পারে। তৃতীয় হিজরিতে হাসান বিন মুসা তাঁর কিতাবুল আরা ওয়াদদীয়ানাত গ্রন্থে আরাস্তুর ন্যায়শাস্ত্রের বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের সমালোচনা করেন। চতুর্থ হিজরিতে ইমাম আবুবকর বা কিল্লানী দাকায়েক নামে একটি গ্রন্থ লেখেন। এ গ্রন্থে তিনি গ্রীক দর্শনের কঠোর সমালোচনা করেন এবং গ্রীক দর্শনের ওপর আরবীয় দর্শনের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেন। পঞ্চম হিজরিতে আল মিলাল ওয়ান নিহাল গ্রন্থের লেখক আল্লামা আবদুল করীম শাহরিস্তানী আরাস্তু ও অন্যান্য গ্রীক দার্শনিকদের চিন্তাধারার সমালোচনায় একটি বই লেখেন এবং ন্যায়শাস্ত্রের নিয়মানুযায়ী তাদের যুক্তিগুলোর কঠোর সমালোচনা করেন। এ শতকের শেষের দিকে ইমাম গাযালী রহঃ তাঁর তাহায়ফাতুল ফালাসিফা গ্রন্থের মাধ্যমে গ্রীক দার্শনিকদের চিন্তাধারার গলদ এমনভাবে সুস্পষ্ট করে দেন যার ফলে একশো বছর পর্যন্ত গ্রীক দর্শনের সুউচ্চ প্রাসাদে কম্পন অনুভূত হতে থাকে। ষষ্ঠ শতকে আবুল বারকাত বাগদাদী ও ইমাম ফখরুদ্দীন রাযীও এই গ্রীক দর্শনের বিরুদ্ধে ব্যাপক অভিযান চালান।
কিন্তু এতসব স্বতেও মুসলিম বিদগ্ধ সমাজের যে অংশটি গ্রীক দর্শনের ধারক ছিল, গ্রীক দর্শনের অনুবাদ, ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ও প্রসারকে যারা নিজেদের দায়িত্ব বলে মনে করছিল, তারা ছিল আরাস্তুর ব্যক্তিত্ব ও দর্শনের পূজারী। আরাস্তুর চিন্তা ও দর্শনকে তারা সকল সমালোচনার ঊর্ধ্বে মনে করতো। কালের আবর্তনের সাথে সাথে আরাস্তুর প্রতি তাদের প্রীতি, শ্রদ্ধা ও আনুগত্য বেড়েই চলছিল। এ ব্যাপারে মুসলিম দার্শনিক আবু নসর ফারাবী(৩৩৯হিঃ-৯৫০খৃ) বু আলী ইবনে সীনা(৪২৮হিঃ) এবং স্পেনে ইবনে রুশদ এর (৫৯৫হিঃ) নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করা যেতে পারে। ইবনে সিনা আরাস্তু প্রেমে এই মাতোয়ারা যে তাঁর মতে আরাস্তুর পর শত শত বচর অতিক্রান্ত হলেও আজে ন্যায়শাস্ত্র সম্পর্কে তিনি যা লিখেছেন তার চাইতে বেশি ও নতুন কিছু কেউ লিখতে পারেননি এবং তাঁর যুক্তির ওপর কারোর যুক্তি স্থান পায়নি। তিনিই যেন সত্যের একমাত্র মানদণ্ড। বু আলী সিনার চাইতে আরো এ ধাপ এগিয়ে গেছেন ইবনে রুশদ। সুফিদের পরিভাষা মোতাবেক বলা যায় যে, আরাস্তুর ব্যাপারে তিনি ফানা ফিশশায়খ এর পর্যায়ে অবস্থান করতেন। বিখ্যাত লেখক লুতফী জুময়া তাঁর তারিখ ফালা সিফাতিল ইসলাম ফিল মাশরিক ওয়াল মাগরিব গ্রন্থে ইবনে রুশদের একজন জীবনীকারের বরাত দিয়ে লিখেছেনঃ আরাস্তুর শ্রেষ্ঠত্ব ও পবিত্রতার ব্যাপারে ইবনে রুশগদ চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেছেন। এমনকি তিনি তাঁকে খোদা বানাতেও প্রস্তুত ছিলেন। বুদ্ধি ও শ্রেষ্ঠত্বের ক্ষেত্রে মানুষের পর্যায় থেকে আরাস্তু অনেক ওপরে পৌঁছে গিয়েছিলেন বলে তিনি মনে করতেন। এমনকি ইবনে রুশদ যদি একাধিক ইলাহ মতবাদের সমর্থক হতেন তাহলে তিনি আরাস্তুকে রব্বুল আরবার অর্থাৎ সমস্ত খোদার বড় খোদা বলে মেনে নিতেন।
সপ্তম হিজরি শতকে গ্রীক দর্শনের সবচেয়ে বড় প্রবক্তা ছিলেন নাসিরুদ্দিন তুসী। তাকে মুহাককিক তুসীও বলা হয়ে থাকে। এটা ছিল তাতারী আক্রমণের যুগ। ইসলামী দুনিয়ার বৃহত্তম অংশ এ আক্রমণে বিধ্বস্ত হচ্ছিল। এই সংগে জ্ঞানগত ক্ষেত্রেও মুসলমানরা চরম বিপর্যয়ের মধ্যে অবস্থান করছিল। তুসী ছিলেন মুসলমানদের শত্রু তাতারী সম্রাট হালাকু খানের বিশ্বস্ত অনুচর। তুসীর ছাত্রবৃন্দ এ সময় এবং এর পরবর্তীকালে বিভিন্ন স্থানে অধ্যাপনা ও গ্রন্থ রচনার কাজে হাত দেন। তাদেরই প্রচেষ্টায় ইরানে এমন একটি শিক্ষা ব্যবস্থার ভিত্তি রচিত হয় যার কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করে দর্শন ও মানতেন বা ন্যায়শাস্ত্র। (পরবর্তীকালে এরই একটি সুসংস্কৃতি সংস্করণ দরসে নিজামী নামে হিন্দুস্থানের মাদ্রাসাগুলোতে চালু হয় বলে কেউ কেউ মত প্রকাশ করেছেন)নাসিরুদ্দিন তুসী ও তার শাগরিদবৃ্ন্দ আরস্তুকে আকলে কুল সমগ্র জ্ঞানময় সত্তা বা পূর্ণ জ্ঞানময় সত্তা মনে করতেন এবং তাঁর গবেষণা ও অনুসন্ধানকে চূড়ান্ত আখ্যা দিতেন। ইমাম রাযীর মোকাবিলায় তারা আরাস্তুর দর্শন সমর্থন করেন জোরেশোরে এবং এভাবে তারা আরাস্তুর দর্শনকে নব জীবন দান করেন।
ইমাম ইবনে তাইমিয়ার জন্ম হয় নাসিরুদ্দিন তুসীর মৃত্যুর দশ বছর আগে। ইবনে তাইমিয়া যখন জ্ঞান জগতে প্রবেশ করেন তখন চতুর্দিকে দর্শন ও মানতেকের রাজত্ব ছিল। নাসিরুদ্দিন তুসী ও তাঁর শাগরিদরাই ছিলেন এর প্রধান ধারক। মানতেক ও ফালসফার(দর্শন) ভাষাই তখন ছিল ইলমের ভাষা। মানতেক ও ফালসফায় যে যত পারদর্শী সেই তত বড় জ্ঞানী ও পণ্ডিত বিবেচিত হতো। মুহাদ্দিস ও ফকীহদের এ ময়দানে কোন গুরুত্ব ছিল না। তারা সবাই প্রায় এ পরিস্থিতিকে মেনে নিয়েছিলেন। দর্শন ও ন্যায়শাস্ত্র যে ক্ষেত্রে সত্যকে সুস্পষ্টভাবে অস্বীকার করে যাচ্ছিল সে ক্ষেত্রে তারা মাথা হেট করে চলাকেই নিজেদের মর্যাদা রক্ষার গ্যারান্টি মনে করেছিলেন। এ অবস্থায় দর্শন ও ন্যায় শাস্ত্রের কঠোর ও নির্ভীক সমালোচনার প্রয়োজন অপরিহার্য হয়ে পড়েছিল। আরাস্তুর ব্যক্তিত্ব যে অতি মানবিক নয় এবং তার গবেষণা ও অনুসন্ধান চূড়ান্ত নয় বরং তার মধ্যে ভুল থাকতে পারে, একথা প্রমাণ করার খুব বেশি প্রয়োজন ছিল।
এ দায়িত্ব ইমাম ইবনে তাইমিয়া পালন করেন। এ দায়িত্ব তিনি এমন সুষ্ঠুভাবে আনজাম দেন যে, সাতশো বছর পর সমগ্র ইসলামী বিশ্বে আজো এর প্রভাব অক্ষুণ্ণ রয়েছে। আজকের পাশ্চাত্য দর্শনের মূলেও রয়েছে এই গ্রীক দর্শন। আর এ গ্রীক দর্শনের ভ্রান্তি উন্মোচন করে দিয়ে তিনি আজকের পাশ্চাত্য দর্শনের গলদ নির্দেশের পথও উন্মুক্ত করে গেছেন। এই সংগে কুরআনী যুক্তিবাদিতার সারল্য, হৃদয়গ্রাহিতা ও শ্রেষ্ঠত্ব অনুধাবন করারও পথ দেখিয়ে গেছেন।
কুরআনের যুক্তি গ্রহণ পদ্ধতির শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ
যে জ্ঞান আম্বিয়া আলাইহিমুস সালাম আল্লাহর কাছ থেকে পেয়েছেন তা মানুষ নিজের চেষ্টায় কোনক্রমেই লাভ করতে পারে না। সারা দুনিয়ার সবচাইতে বুদ্ধিমান মানুষটিও যদি এ ব্যাপারে শত বছর ধরে চিন্তা গবেষণা করেন তাহলে শত বছর পরেও দেখা যেভাবে তিনি সেখানেই দাঁড়িয়ে আছেন যেখানে শত বছর আগে দাঁড়িয়ে ছিলেন। এক কদমও তিনি সামনে এগিয়ে যেতে পারেননি। গ্রীক দর্শন বিশ্ব জ্ঞান ভাণ্ডারে যা উপহার দিয়েছে তা এর চাইতে বেশি কিছু নয়। গ্রীসের বিজ্ঞান, অংক, ভূগোল, জ্যোতির্বিদ্যা, সাহিত্য প্রভৃতি বিশ্বমানব সভ্যতার অগ্রগতির সহায়ক হয়েছে। ইমাম ইবনে তাইমিয়া র.ও একথা স্বীকার করেছেন। তিনি স্বীকার করেছেন আরব ও ইসলামী বিশ্ব এগুলোর চর্চা করে সভ্যতার ক্রমোন্নতিতে সাহায্য করেছে। কিন্তু তিনি অবাক হয়েছেন যখন তিনি দেখেছেন আল্লাহ, ফেরেশতা ও পরকাল সম্পর্কে গ্রীক দার্শনিকদের পর্বতপ্রমাণ অজ্ঞতা। তিনি আররদ্দু আলার মানতিকিয়্যীন গ্রন্থে লিখেছেনঃ
আল্লাহ সম্পর্কে প্রথম শিক্ষক আরাস্তুর রচনা গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে একজন সাধারণ শিক্ষিত লোককে অবাক হতে হয়। তাকে শেষ পর্যন্ত এ সিদ্ধান্তে পৌছতে হয় যে, দুনিয়ায় বোধ হয় এই গ্রীক দার্শনিকদের চাইতে রব্বুল আলামীন সম্পর্কে বেশি অজ্ঞ অর কেউ নেই। লোকেরা যখন আল্লাহ সম্পর্কে এই গ্রীক দার্শনিকদের রচনাবলীকে নবী ও রসূলগণের শিক্ষার সাথে তুলনা করে তখন সত্যিই মনে হয় যেন তারা কর্মকারদের সাথে ফেরেশতাদের এবং সারা বিশ্ব জাহানের মালিক ও প্রভুর সাথে গ্রামের জমিদারের তুলনা করছে। এখানে তবুও তো তুলনা করার কোন না কোন পর্যায় থাকতে পারে। কিন্তু যারা দর্শনিদেরকে নবীদের সাথে তুলনা করে তারা যেমন জালেম তেমনি মূর্খ। কারণ গ্রামের জমিদার তবুও তো গ্রামের শাসন শৃঙ্খলা রক্ষার কাজ করে থাকে। এদিক থেকে মহাপ্রভু ও বিশ্ব জাহানের বাদশাহর সাথে তার আংশিক সামঞ্জস্য আছে। কিন্তু দার্শনিক ও নবীদের ব্যাপারটি হচ্ছে সম্পূর্ণ খাপছাড়া। নবীরা যে জ্ঞান লাভ করেন দার্শনিকরা তার ধারেকাছেও ঘেষতে পারেন না। বরং বলা যায়, কাফের, মুশরিক ও ইহুদিরাও আল্লাহ সম্পর্কে এ দার্শনিকদের চাইতে অনেক বেশি জানে।
গ্রীক দার্শনিকদের এ অজ্ঞতার কারণ কি? এর কারণ বিশ্লেষণ করতে হলে গ্রীসের প্রাচীন ইতিহাস পর্যালোচনা করতে হয়। ইতিহাসের অধিকাংশ সময়ে গ্রীক জাতিকে দেখা যায় মূর্তি ও নক্ষত্র পূজারী হিসেবে। এ সময় তাদের জাতীয় চিন্তাধারা অতি কল্পনাবাদ, ভাববাদ ও পৌরণিকতাবাদে আচ্ছন্ন ছিল। আধুনিক ইতিহাস বিশ্লেষণে একথা প্রমাণিত হয়েছে যে, প্রাচীন গ্রীসের সর্বত্র মূর্তি পূজা ও নক্ষত্র পূজার প্রচলন ছিল। দেশের সর্বত্র দেব দেবীর মন্দির গড়ে উঠেছিল। দেবতাদের হাজার হাজার নাম মানুষের মুখে মুখে ছিল। যে গ্রীক দর্শন অনুদিত হয়ে ইসলামী বিশ্বের লাইব্রেরীগুলো অলংকৃত করেছিল এবং তারপর মুসলমানদের মাধ্যমে ইউরোপে পৌঁছেছিল তা আসলে এই মূর্তি পূজা ও নক্ষত্র পূজার রঙ্গে আপাদমস্তক রঞ্জিত ছিল। গ্রীক দার্শনিকগণ তাদের এই মুশরিকী চিন্তাকে দর্শনের মুখরোচক পারিভাষিক শব্দমালায় সুসজ্জিত করেন। মুসলিম আলেম ও পণ্ডিতগণ গ্রীসের প্রাচীন ইতিহাস ও গ্রীক দার্শনিকদের ধর্মীয় চিন্তা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল না থাকার কারণে তাদের এ দার্শনিক আলোচনা গুলোকে গভীর তত্বজ্ঞান মনে করে নিজেরা এ নিয়ে গবেষণায় মেতে ওঠেন। এগুলোকে সত্য ও যথার্থ প্রমাণ করার জন্য তারা নিজেদের সমস্ত শক্তি, সামর্থ্যও যোগ্যতা নিয়োগ করেন। ইমাম ইবনে তাইমিয়া কিন্তু এ গ্রীক দর্শনের গোড়ায় পৌছুতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি সূরা ইখলাসের তাফসির প্রসঙ্গে লিখেছেনঃ গ্রীসের প্রাচীন দার্শনিকদের সম্পর্কে যত দুর জানা যায়, তারা ছিলেন কট্টর মুশরিক। যাদুর প্রতিও তাদের আকর্ষণ ছিল অত্যধিক। তারা নক্ষত্র ও মূর্তি পূজা করতো। জ্যোতির্বিদ্যা ও নক্ষত্র মণ্ডলী সম্পর্কে তাদের গভীর আগ্রহের মূলেও এটি কাজ করেছে।
মুসলমানদের মধ্যেও যারা এদের দর্শনের অনুসারী হয়েছে তারাও মানুষকে শিরক করতে বাধা দেয়না এবং তাওহীদকে অপরিহার্য্য মনে করে না। বরং শিরককে জায়েজ গণ্য করে।
ইমাম ইবনে তাইমিয়ার মতে গ্রীসের প্রাচীন দার্শনিকদের মধ্যে আরাস্তুর (এরিস্টটল) পূর্ববর্তীগণ অদৃশ্য জ্ঞান যেমন আল্লাহ,ফেরেশতা, আখিরাত প্রভৃতি এবং দীনি তত্ব সম্পর্কে অনেক কিছু জ্ঞাত ছিলেন এবং তারা ইসলাম ও আল্লাহর সত্য দীনের নিকটবর্তী ছিলেন। এর বর্ণনা প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন যে, আরাস্তুর পূর্ববর্তী দার্শনিকগণ যেমন পিথাগোরাস, সক্রেটিস, প্লেটো এরা গ্রীসের বাইরে বের হয়েছেন এবং সিরিয়া, মিসর প্রভৃতি দেশ সফর করেছেন, যেখানে বিভিন্ন নবীর জন্ম হয়েছে। তারা হযরত দাউদ আ. ও হযরত সুলাইমান আ. সাহাবী ও অনুসারীদের সাথে সাক্ষাত করেছেন এবং তাদের থেকে অদৃশ্য জগত সম্পর্কে জ্ঞান লাব করেছে। কিন্তু আরাস্তুর ক্ষেত্রে তা সম্ভব হয়নি। তিনি কখনো ঐসব দেশ সফর করেননি। তার কাছে নবীদের শিক্ষার কোন অংশও ছিল না। তার জাতি নক্ষত্র পূজা করতো। এ সম্পর্কিত কিছু জ্ঞান তার কাছে ছিল। এর ওপরই তিনি নিজের চিন্তা গবেষণার বুনিয়াদ রাখেন। পরবর্তীকালে তার অনুসারীরা চোখ বন্ধ করে তার পথে হেটে চলেন।
দুর্ভাগ্যবশত ইসলামী বিশ্বে এই আরাস্তুর দর্শনেরই প্রচলন হয়। ফারবী, ইবনে সিনা, ইবনে রুশদ, সোহরাওয়ার্দী প্রমুখ মুসলিম দার্শনিকগণ এই দর্শনের চর্চা করেন। তারা আরাস্তুর নাম দেন মুয়াল্লিমে আউয়াল বা প্রথম শিক্ষক।
মুসলিম দার্শনিকদের বিভ্রান্তির জবাবে ইলমে কালামের উদ্ভব হয় তার বক্তব্য উপস্থাপন পদ্ধতিতেও ইমাম ইবনে তাইমিয়া সন্তুষ্ট ছিলেন না। ইমামের মতে দীনি ও অদৃশ্য সত্যগুলো প্রমাণ করার জন্য কালাম শাস্ত্রবিদরা দর্শনের পরিভাষা ও দর্শনের বক্তব্য প্রমাণ পদ্ধতি গ্রহণ করেছিল। আর এ পদ্ধতি বহুলাংশে ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছে। বরং বহুক্ষেত্রে তা বুমেরাং হয়ে ইসলামের ক্ষতিসাধন করেছে। তিনি বহু মুতাকাল্লিামের (কালাম শাস্ত্রবিদ) দুর্বলতা উল্লেখ করেছেন যে, তারা অনেক ক্ষেত্রে ইসলামের বিরুদ্ধে বড় বড় প্রশ্ন উত্থাপন করেন এবং ইসলামের বিরুদ্ধে উপস্থাপিত সংশয়গুলোকে বেশ জোড়ালো পদ্ধতিতে পেশ করেন। কিন্তু তাদের জবাবগুলো হয় তুলনামূলকভাবে অনেক দুর্বল ও নরম। তিনি ইমাম রাযীর রা. উল্লেখ করে আন নবুওয়ত গ্রন্থে লিখেছেনঃ ইমাম রাযী শেষ বয়সে সুস্পষ্টভাবে স্বীকার করেছেন যে, তিনি কারীমী পদ্ধতি ও দার্শনিক উপস্থাপন প্রক্রিয়ার ওপর অনেক চিন্তাভাবনা করেছেন। শেষে তিনি এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, এর ফলে কোন রোগীর রোগ নিরাময় হয় না, কোন পিপাসার্তের তৃষ্ণা মেটে না। তিনি বলেন, কুরআনের পদ্ধতিকেই আমি নিকটতর পেয়েছি।
ইমাম ইবনে তাইমিয়া লিখেছেন, আল্লাহর অস্তিত্ব, তাঁর সত্তা ও গুণাবলী সম্পর্কে কালাম শাস্ত্রবিদ ও মুসলিম দার্শনিকগণ যে বুদ্ধিবৃত্তিক যুক্তি প্রমাণ পেশ করেছেন, তার মোকাবিলায় কুরআন মজীদের যুক্তি প্রমাণ অনেক বেশি সুস্পষ্ট, স্বচ্ছ, দ্ব্যর্থহীন ও হৃদয়গ্রাহী। এছাড়াও দার্শনিক ও কালামীগণ তাদের বক্তব্যের মাধ্যমে যে নতুন জটিলতা ও সংশয়ের সৃষ্টি করেন কুরআনী পদ্ধতিতে তারও কোন অবকাশ থাকেনা।
খৃষ্টবাদীদের জবাব
ইমাম ইবনে তাইমিয়া হিজরি অষ্টম শতকে ইসলামকে পুনরুজ্জীবিত করার দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছিলেন। নবুওয়তের সাতশ বছর পর ইসলামের নিশানবরদারদের মধ্যে যে স্নায়বিক দুর্বলতা দেখা দিয়েছিল তা নেহাত কম ছিল না। দুশ বছরের ক্রুসেড যুদ্ধ, তারপর তাতারীদের আক্রমণ তাদেরকে একেবারে পর্যুদস্ত করে দিয়েছিল। এই সুযোগে এবং মুসলমানদের এ দুর্বল মুহূর্তে অন্যান্য ধর্ম ও মতবাদগুলো তাদের ওপর প্রবল আক্রমণ চালায়। বিশেষ করে খৃষ্টধর্ম ও খৃষ্টীয় মতবাদ ও এসময় তাতারীদের বিজয়কে নিজেদের বিজয়রূপে চিহ্নিত করতে থাকে। ইতিপূর্বে আমরা তাতারীদের হাতে মুসলমানদের একটি শহরের পতনে শহরের খৃষ্টান অধিবাসীদের উল্লাস এবং তাদের ইসলাম ও মুসলমান বিরোধী কার্যকলাপের উল্লেখ করেছি। এসব কারণে এ সময় মুসলমানদের সামনে খৃষ্টীয় মতবাদ বেশ জোরালোভাবে উত্থিত হচ্ছিল। এর ফলে অনেক মুসলমানের ঈমান ও আমলের প্রাচীরে ফাটল ধরতে শুরু করেছিল।
ইমাম ইবনে তাইমিয়া যথাসময়ে মুসলমানদের এ রোগ নিরাময়ের অভিযান শুরু করেন। তাঁর রচনাবলীর মধ্যে এ সম্পর্কিত অজস্র প্রসঙ্গ ছড়িয়ে রয়েছে। এমন কি তিনি এর ওপর চার খন্ডে ১৩৯৫ পৃষ্ঠা সম্বলিত একটি বই লেখেন। বইটির নাম আল জওয়াবুস সহী লিমান বাদ্দালা দীনাল মসীহ (যারা হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের ধর্ম বিকৃত করেছে তাদের যথার্থ জবাব)।
আসলে এ সময় ইসলামী দেশগুলোয় বিশেষ করে মিসর ও সিরিয়ার বিপুল সংখ্যক খৃষ্টানদের বসবাস ছিল। আর সিরিয়ার পরই ছিল খৃষ্টান দেশগুলোর সিলসিলা। বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের সীমানা ছিল সিরিয়ার লাগোয়। হিজরি পঞ্চম শতকের শেষ থেকে ইউরোপীয়রা সিরিয়া ও ফিলিস্তিনের ওপর হামলার যে সিলসিলা শুরু করে এবং পরবর্তী দুশো বছর পর্যন্ত যা অব্যাহত থাকে তার ফলে সিরিয়ার একটি অংশ মুসলমানদের দখলচ্যুত হয়। এই সংগে ৯০ বছর পর্যন্ত বায়তুল মাকদিস খৃষ্টানদের কব্জায় থাকে। পরে অবশ্য সুলতান সালাহ উদ্দীন আইউবী হিত্তীনের যুদ্ধে ক্রুসেড বাহিনীকে বিপুলভাবে পর্যুদস্ত করে বায়তুল মাকদিস উদ্ধার করেন। কিন্তু এরপরও সিরিয়ার উপকুলে খৃষ্টানদের একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত করার পর খৃষ্টান ধর্মপ্রচারক ও শাসকদের হিম্মত অনেক বেড়ে গিয়েছিল। তারা সমগ্র সিরিয়াকে খৃষ্টধর্মের পতাকাতলে আনার এবং সমগ্র এলাকায় খৃষ্টধর্ম প্রচারের স্বপ্ন দেখছিলেন। ঠিক এ সময়ই তাতারীদের হাতে মুসলমানদের শোচনীয় পরাজয়কে তারা ঈশ্বরের পক্ষ থেকে তাদের জন্য সৃষ্ট বিরাট সুযোগ মনে করতে থাকে। এটাকে তারা নিজেদের বিজয়ের পূর্বাভাস মনে করে সর্বত্র এ আওয়াজ বুলন্দ করতে থাকে যে, যীশুর ধর্মই হচ্ছে সত্য ধর্ম এবং এই সত্য ধর্মই এবার বিজয় লাভ করেছে।
এ সময় খৃষ্ট জগত থেকে ইসলাম বিরোধী বইপত্রের আমদানি হতে থাকে বিপুলভাবে। এসব বইয়ের মাধ্যমে মুসলমানদের মধ্যে ইসলাম সম্পর্কে বিভ্রান্তি ছড়াবার এবং খৃষ্ট ধর্মকে আল্লাহর একমাত্র ধর্ম প্রমাণ করার প্রচেষ্টা চালানো হয়। ইমাম ইবনে তাইমিয়া ব্যাপকভাবে এই ফিতনার মোকাবিলা করেন। ইতিপূর্বে অনেক মুসলিম আলেম, গবেষক ও সমালোচক খৃষ্টধর্মের সমালোচনা করেছিলেন। কিন্তু তাদের অধিকাংশই খৃষ্টধর্মের ইতিহাসের সাথে সঠিকভাবে পরিচিত ছিলেন না। তারা খৃষ্টধর্মকে হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের কথা ও তাঁর সম্পর্কিত ঘটনার সমষ্টি মনে করে তাকে আসমানী বা খোদায়ী ধর্মের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছিলেন। ফলে খৃষ্টধর্ম মুসলমানদের কাছে যতটুকু গুরুত্ব লাভের অধিকারী ছিল তার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্ব লাভ করেছিল। এ অবস্থা মানসিক ব্যাধি পীড়িত মুসলমানদের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর প্রমাণিত হয়েছিল।
কিন্তু ইমাম ইবনে তাইমিয়া খৃষ্টধর্মের ইতিহাস এবং রোম ও গ্রীস দেশে এর ধর্ম গেহে যে ব্যাপক পরিবর্তন ও অপারেশন এবং সেখানে এর যে প্রাথমিক বিকাশ হয় সে সম্পর্কে পূর্ণ অবহিত ছিলেন। তিনি পুরোপুরি অবগত ছিলেন যে, সমকালীন খৃষ্টধর্ম আসলে হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের শিক্ষা এবং রোমীয় ও গ্রীকদের মুশরিকী আকিদা, বিশ্বাস, রসম রেওয়াজ ও পৌরাণিক দেবী দেবতাদের কার্যকলাপের একটি সংমিশ্রণ ছাড়া আর কিছুই নয়। তিনি আল জওয়াবুস সহী গ্রন্থে লিখেছেনঃ
রোম, গ্রীস প্রভৃতি দেশের অধিবাসীরা আসলে ছিল মুশরিক ও মূর্তি পূজারী। তারা হাইকেল ও ঠাকুর দেবতার মূর্তি বানিয়ে পূজা করতো। খৃষ্টানরা দুটি ধর্ম মিলিয়ে একটি ধর্ম বানিয়েছে। একটি হচ্ছে তওহীদবাদী নবীদের ধর্ম এবং অন্যটি মুশরিকদের ধর্ম। তাদের ধর্মের একটি অংশ নবীদের শিক্ষা এবং অন্য অংশটি মুশরিকদের ধর্ম থেকে গৃহীত কথা ও কর্মের সমষ্টি। এভাবে তারা একটি নতুন ধর্ম সৃষ্টি করেছে, নবীদের কালামে যার কোন সন্ধানই পাওয়া যায় না।
এভাবে তিনি তিনি খৃষ্টধর্মের বিবর্তন ও বিকৃতির বিভিন্ন যুগ ও স্তর নির্দেশ করেন। এই সংগে ইনজিল সম্পর্কিত মুসলমানদের ধারণাও সুস্পষ্ট করেন। অনেক মুসলিম আলেম ইনজিলকে কুরআন মজীদের সমপর্যায়ের আল্লাহর কিতাব মনে করে ভুল করেন। ফলে ঈসায়ী মুবাল্লিাগদের প্রোপাগান্ডায় তারা সহজেই প্রভাবিত হয়ে পড়েন। তাই এ সম্পর্কেও তিনি সুস্পষ্ট আলোচনা করেন। তিনি বলেন, যে ইনজিল আজ খৃষ্টানদের হাতে আছে সে সম্পর্কে তারা নিজেরাই স্বীকার করেন যে এটা হযরত ঈসার আ. সময়ে বা তাঁর নির্দেশে লেখা হয়নি। হযরত ঈসার আকাশে উঠে যাওয়ার পর তাঁর দুজন হাওয়ারী(সাহাবী) মথি ও যোহন এবং হযরত ঈসাকে আ. দেখেননি এমন আরো দুজন (মার্কও লুক) ঈসায়ী মিলে গ্রন্থটি লেখেন। (১. মথি ও যোহান হযরত ঈসার (আ.) সাহাবী ছিলেন কিনা এ সম্পর্কেও আজ প্রশ্ন উঠেছে। দেখুন ফরাসী নও মুসলিম ডাঃ মরিস বুকাইলির গ্রন্থ কুরআন বাইবেল ও বিজ্ঞান) তিনি এও বলেন, মুসলমানদের কাছে রসূলের বাণী, কার্যকলাপ, দীন ও আকায়েদ যেমন নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারীদের সিলসিলার মাধ্যমে সংরক্ষিত হয়েছে ইনজিল ও তওরাতের বাণীকে ঠিক সে পর্যায়ে ফেলা যায়না।
কুরআন মজিদ এবং তাওরাত ও ইনজিলের পার্থক্য বর্ণনা করে তিন বলেছেনঃ কুরআন মজীদের স্বাদ ও অর্থ রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে নির্ভরযোগ্য বর্ণনা পরম্পরায় চলে এসেছে। এর ওপর ইজমা অনুষ্ঠিত হয়েছে এভাবে রসুলের সুন্নত এবং তাঁর অবস্থা ও ঘটনাবলীও। এগুলোর নির্ভুলতা বিভিন্নভাবে প্রমাণিত হয়েছে।
…কুরআন মজীদ মুসলমানদের সিনায় সংরক্ষিত রয়েছে। কুরআন মুখস্থ করার জন্য কোন লিখিত ও মুদ্রিত বই পড়ার শর্ত নেই। খোদা না খাস্তা বইগুলো কোনদিন ধ্বংস হয়ে গেলেও কুরআন মুখস্থ করার ক্ষেত্রে কোন অসুবিধে হবে না। বিপরীত পক্ষে আজ বাইবেল গ্রন্থটি যদি কোন কারণে ধ্বংস হয়ে যায়, তাহলে ঈসায়ীদের কাছে এর শব্দগুলোর কোন বিকল্প ষ্টক নেই। এ জন্য এ ধরনের গ্রন্থগুলোর মধ্যে যুগের পর যুগ নানান পরিবর্তন (শাব্দিক ও অর্থগত) সাধিত হচ্ছে।
ঈসায়ীরা তাদের ধর্মের মধ্যে যে, বিকৃতি সাধন করেছে তার একটা বড় কারণ হিসেবে ইমাম ইবনে তাইমিয়া এও উল্লেখ করেছেন যে, ঈসায়ীরা আম্বিয়া আলাইহিমুস সালামদের অনেক কথার সঠিক অর্থ বুঝতে পারেনি। ফলে তারা অনেক শব্দের আসল অর্থের মধ্যে বিকৃতি সাধন করেছে। এ ব্যাপারে ইহুদীরা ঈসায়ীদের চাইতে আরো এক ধাপ এগিয়ে আছে। তিনি এ ব্যাপারে অত্যন্ত জোর দিয়েছেন যে, আসমানী কিতাবগুলো সঠিকভাবে অনুধাবন এবং সেখান থেকে নির্ভুল শিক্ষা গ্রহণ করতে হলে নবীদের কথা, ইংগিত ও পরিভাষা বুঝা একান্ত অপরিহার্য। যেমন ঈসা আলাইহিস সালামকে খোদার পুত্র বলার ব্যাপারটা। হাওয়ারীরা বলেন, হযরত মসীহ তাদের বলেছেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ আমার ও তোমাদের পিতা এবং আমার ও তোমাদের মাবুদ। তাওরাতে সমস্ত বনী ইসরাইলকে খোদার পুত্র বলা হয়েছে। মিসরবাসীদেরকে ফেরাউনের পুত্র বলা হয়েছে। এর চাইতেও আরো অগ্রসর হয়ে পশুর বাচ্চাদেরকে পশু মালিকের বাচ্চা বলা হয়েছে। তাই বলে কি তারা সত্যিই পশু মালিকের স্ত্রীর গর্ভজাত সন্তান হয়ে গেছে? ঈসায়ীদের এসব ভ্রান্তি ইমাম ইবনে তাইমিয়া চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন।
শিয়া মতবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম
খৃষ্টানদের পর মুসলমানদের অন্তর্গত যেসব চরমপন্থি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ইমাম ইবনে তাইমিয়া সংগ্রাম পরিচালনা করেন তার মধ্যে শিয়াদের নামকে শীর্ষে রাখা যেতে পেরে। শিয়াদের চরমপন্থি আকায়েদ ও কার্যক্রমের বিরুদ্ধে তিনি একটি পৃথক বই লেখেন। আসলে সমকালীন তাতারী আক্রমণ ও ক্রুসেড যুদ্ধে বিধ্বস্ত মুসলিম মিল্লাতের মধ্যে চরমপন্থি শিয়াদের আগ্রাসী প্রচারণা বিপুল নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়। মুসলিম মিল্লাতকে এহেন নৈরাজ্য থেকে উদ্ধার করাই ছিল ইমাম ইবনে তাইমিয়ার লক্ষ।
এখানে শিয়া প্রসঙ্গে ইমাম ইবনে তাইমিয়ার কার্যক্রম আলোচনার পূর্বে পাঠকবর্গকে শিয়া সম্প্রদায়য়ের উৎপত্তি ও তাদের আকায়েদ সম্পর্কে কিছু জানানো প্রয়োজন। খিলাফত আলা মিনহাজিন নবুওয়তের অবসানের পর থেকে মুসলমানদের মধ্যে যে মতবিরোধ, হাংগামা, যুদ্ধবিগ্রহ ইত্যাদি দেখা দেয় এবং বনি উমাইয়া ও বনি আব্বাসীয় আমলের বিস্তৃত পরিসরে যার জের চলতে থাকে পুরোদমে, তার মধ্যে সৃষ্টি হয় অসংখ্য ফিতনা। এ ফিতনাগুলোর মূলে ছিল চারটি বড় বড় ফিতনাঃ শিয়া, খারেজী, মরুজিয়া ও মুতাজিলা এই চারটি মুল ফিতনার উৎস থেকেই পরবর্তীকালের সমস্ত ফিতনার জন্ম।
শিয়া অর্থ হচ্ছে দল। শিয়ার বহুবচন শীয়াআন। প্রথম দিকে হযরত আলীর রা. সমর্থকবৃন্দকে শীয়াআনে আলী বলা হতো। পরবর্তীকালে পারিভাষিক অর্থে তাদের শিয়া বলা হতে থাকে। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইন্তিকালের পর বনি হাশেমের কিছু লোক এবং অন্যান্য কতিপয় সাহাবাও হযরত আলীকে রা. খিলাফতের জন্য সবচেয়ে যোগ্য মনে করতেন। আবার কেউ কেউ অন্যান্য সাহাবাদের বিশেষ করে হযরত উসমানের রা. চাইতে তাঁকে বেশি যোগ্য মনে করতেন। অনেকে কেবলমাত্র নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে তাঁর আত্মীয়তার সম্পর্কের কারণেই তাঁকে খিলাফতের হকদার মনে করতেন। কিন্তু হযরত উসমানের রা. খিলাফত আমল পর্যন্ত এ চিন্তাগুলো নিছক চিন্তা ও ধারণার পর্যায়ভুক্ত ছিল। তখনো পর্যন্ত এগুলো কোন মতবাদ বা আকীদার রূপ গ্রহণ করেনি।
যে সব লোক এ ধরনের চিন্তা ও ধারণা পোষণ করতেন তারা সবাই হযরত উসমান রা. সহ পূর্ববর্তী তিনজন খলিফার খিলাফত স্বীকার করে নিয়েছিলেন এবং তাঁদের হাতে বাইয়াতও করেছিলেন। তাঁদের কোন কাজের প্রতিবাদও তারা করেননি।
যে সব লোক এ ধরনের চিন্তা ও ধারণা পোষণ করতেন তারা সবাই হযরত উসমান রা. সহ পূর্ববর্তী তিনজন খলিফার খিলাফত স্বীকার করে নিয়েছিলেন এবং তাঁদের হাতে বাইয়াতও করেছিলেন। তাঁদের কোন কাজের প্রতিবাদও তারা করেননি।
কিন্তু এ বিশেষ চিন্তাগুলো একটা মতবাদ ও আকীদার রূপ নেয় হযরত আলীর রা. সাথে হযরত তালহা রা. ও হযরত যুবাইরের রা. জামাল যুদ্ধ, হযরত মুআবিয়ার রা. সিয়ফফীন যুদ্ধ ও খারেজীদের নাহরাওয়ান যুদ্ধের সময় ও তার পরবর্তীকালে। তারপর কারবালার প্রান্তরে হযরত ইমাম হুসাইনের রা. মর্মন্তুদ শাহাদত লাভ এ চিন্তানুসারীদেরকে একত্রিত ও একটি দলের রূপে আত্মপ্রকাশ করতে সাহায্য করে। এই সংগে খিলাফতের পরপরই বনি উমাইয়াদের বিশেষ ধরনের রাজতান্ত্রিক শাসন ও জুলুমতন্ত্রের প্রবর্তনের ফলে সাধারণ মুসলমানদের মনে তাদের বিরুদ্ধে আক্রোশের আগুন জ্বলতে থাকে এবং এর পরই বনি আব্বাসদের আমলে হযরত আলীর রা. বংশধর ও তাঁর সমর্থকদের ওপর যে অমানুষিক জুলুম নির্যাতন চালানো হয় তার ফলে সাধারণ মুসলমানদের মনে তাদের প্রতি সহানুভূতি ও সমর্থনের ভাবধারা জেগে ওঠে। এসবগুলো পূর্বোল্লিখিত দলটিকে মজবুতভাবে শিকড় গাড়ার ও দলগতভাবে শক্তিশালী হবার সুযোগ দান করে। কুফা ছিল এ দলটির শক্তিশালী কেন্দ্র। আল্লামা ইবনে খালদুন তাঁর মুকাদ্দমা এবং করীম শক্তিশালী কেন্দ্র। আল্লামা ইবনে খালদুন তাঁর মুকাদ্দমা এবং আবদুল করীম শাহরিস্তানী তাঁর আল মিলাল ওয়ান নিহাল গ্রন্থে শিয়াদের বিশেষ মতবাদ সম্পর্কে যা বর্ণনা করেছেন তার সারসংক্ষেপ হলোঃ
এক. ইমামতের (শিয়ারা খিলাফত স্বীকার করে না, তার পরিবর্তে তারা ইমামতের পরিভাষা গ্রহণ করেছে) ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা সাধারণ মানুষের নেই। কাজেই সাধারণ মুসলমানদের ওপর ইমাম নির্বাচনের দায়িত্ব অর্পণ করা যেতে পারে না। আর সাধারণ মুসলমানরা কাউকে ইমাম নির্বাচন করলেও সে ইমাম হয়ে যাবে না। ইমামত হচ্ছে দীনের একটি রুকন এবং ইসলামের আসল বুনিয়াদ। এ ব্যাপারে নবী নিজে কোন প্রকার গাফলতি করতে পারেননা। উম্মতের উপর ইমাম নির্বাচনের দায়িত্ব অর্পণ করে তিনি চলে যেতে পারেন না। উম্মতের উপর ইমাম নির্বাচনের দায়িত্ব অর্পণ করে তিনি চলে যেতে পারেন না। বরং তিনি নিজে ইমাম নির্বাচন করে যাবেন।
দুই. ইমাম হবেন মাসুম অর্থাৎ গুনাহ ও পাপের কালিমামুক্ত। চোট বড় সব রকমের গুনাহ থেকে তিনি সংরক্ষিত থাকবেন। তার কোন ভুল হবে না। তিনি যা কিছু বলবেন ও করবেন সবকিছু হবে হবে হক নির্ভেজাল সত্যে প্রকাশ।
তিন. রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত আলীকে নিজের পরে ইমাম নিযুক্ত করে গিয়েছিলেন।
চার. প্রত্যেক ইমামের পর পরবর্তী ইমাম নিযুক্ত হবে পূর্ববর্তী ইমামের সুস্পষ্ট নির্দেশ। কারণ এ দায়িত্ব সমগ্র উম্মতের কাছ থেকে নিয়ে একমাত্র ইমামের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে।
পাঁচ. শিয়াদের সমস্ত ফেরকা এ ব্যাপারে একমত ছিল যে, হযরত আলীর রা. আওলাদ ও বংশধারাই ইমামতের একমাত্র হকদার।
উপরের মতবাদগুলো প্রণয়ন করার ব্যাপারে শিয়ারা এক ধরনের হাদিসের আশ্রয় গ্রহণ করেছে, যেগুলোর প্রণেতা তারা নিজেরাই। তারা নিজেরাই এগুলো রেওয়ায়ত করেছে এবং নিজেদের মযহাব অনুযায়ী তার ব্যাখ্যা করে নিয়েছে। সাধারণ আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াত এ হাদিসগুলো সম্পর্কে বিন্দু বিসর্গও জানেনা। বরং ইবনে খালদুনের ভাষায় বলা যায়, হাদিসগুলোর অধিকাংশই মওযু অর্থাৎ মিথ্যা, বানোয়াট ও জাল। এই হাদিসগুলোর বর্ণনাকারীরা ত্রুটিমুক্ত নয়। যাক আমাদের আগের আলোচনায় ফিরে আসি। উপরোল্লিখিত মতবাদের ব্যাপারে অধিকাংশ শিয়া একমত হলেও অন্যান্য বহু বিষয়ে মতভেদের কারণে তারা আবার বিভিন্ন ফেরকায় বিভক্ত হয়ে পড়েছে। তবে তাদের মধ্যে বড় দল হচ্ছে, দুটি: ইমামিয়া ও যায়দীয়া। যারা রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর হযরত আলীর ইমামত এবং তাঁর পর তাঁর আওলাদের ইমামতের সিলসিলার ওপর ঈমান রাখে তারা ফিরকা ই ইমামিয়ার অন্তর্ভুক্ত। আর যারা হযরত ফাতেমার রা. আওলাদের মধ্যে ইমামতকে সীমাবদ্ধ রাখে তাদেরকে বলা হয় যায়দীয়। অর্থাৎ তারা এ মযহাবের প্রতিষ্ঠাতা যায়েদ ইবনে আলী ইবনে হুসাইনের সাথে নিজেদেরকে সম্পর্কিত করে।
সাধারণ মুসলমানদের সম্পর্কে শিয়াদের বিভিন্ন দল বিভিন্ন মত পোষণ করে। এদের মধ্যে সবচাইতে বেশি ভারসাম্যপূর্ণ মতের অধিকারী শিয়াদের মতে হযরত আলী হচ্ছেন সমগ্র সৃষ্টির সেরা। যারা তাঁর সাথে যুদ্ধ করেছে এবং যারা তাঁর প্রতি শত্রুতা ও বিদ্বেষ পোষণ করে তারা চিরকাল জাহান্নামে বাস করবে। কাফের ও মুনাফিকদের সাথে তাদের হাশর হবে। হযরত আলীর রা. পূর্বে আবু বকর রা. উমর রা. ও উসমান রা. কে খলিফা বানানো হয়েছিল। হযরত আলী রা. যদি তাদের খিলাফত মানতে অস্বীকার করতেন এবং তাদের প্রতি নিজের মানসিক অসন্তোষ প্রকাশ করতেন তাহলে এদের মতে তারাও জাহান্নামে বাস করতো (নাউযুবিল্লাহ)। কিন্তু যেহেতু আলী রা. তাদের নেতৃত্ব মেনে নিয়েছেন, তাদের হাতে বাইয়াত করেছেন এবং তাদের ইমারতিতে নামায পড়েছেন তাই তারাও হযরত আলীর কার্যক্রম অনুযায়ী এদেরকে মেনে নিয়েছে। তারা আলী ও নবীর মধ্যে নবুওয়তের মর্যাদা ছাড়া আর কোন পার্থক্য করতে প্রস্তুত নয়। অন্য সব ক্ষেত্রে আলী ও নবী সমান মর্যাদা সম্পন্ন।
এতো ছিল ভারসাম্যপূর্ণ শিয়াদের মত। আর এর মোকাবিলায় চরমপন্থি শিয়াদের অভিমত ছিল, হযরত আলীর আগে যেসব খলীফা খিলাফত গ্রহণ করেছিলেন তারা ছিলেন গাসেব আত্নসাতকারী ও খেয়ানতকারী। আর যারা তাদেরকে খলীফা বানিয়েছিলেন তারা ছিল গোমরাহ ও জালেম। কারণ তারা নবীর অসিয়াত অস্বীকার করেছে এবং সত্য ও যথার্থ ইমামকে তার হক থেকে বঞ্চিত করেছে। এদের একদল আবার আরো একটু বেশি অগ্রসর হয়ে প্রথম তিন খলিফা ও তাদের নির্বাচনকারীদেরকে কাফের আখ্যা দেয়। এদের মধ্যে সবচেয়ে নরমপন্থী হলো যায়দীয়ারা। তারা হযরত আলীকে শ্রেষ্ঠ বলে। কিন্তু তাদের মতে শ্রেষ্ঠের বর্তমানে অশ্রেষ্ঠরাও ইমাম হতে পারে। এছাড়াও তারা মনে করে, হযরত আলীর ইমামতির পক্ষে রসুলুল্লাহ স. এর সুস্পষ্ট কোন নির্দেশ নেই। তাই তারা আবু বকর ও উমরের খিলাফত স্বীকার করে। তবুও তাদের মতে ফাতেমার আওলাদ থেকেই ইমাম নিযুক্ত হতে হবে।
ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহমতুল্লাহ আলাইহি তাঁর রচনাবলীর বিভিন্ন স্থানে শিয়াদের এই সমস্ত আকিদা বিশ্বাস ও কার্যক্রমের প্রতিবাদ করেছেন। আর অন্য দিকে সুন্নত ও আহলে সুন্নাতের আকীদা বিশ্বাস এবং খোলাফায়ে রাশেদীন ও সাহাবায়ে কেরামের পক্ষ থেকে প্রতিরক্ষার দায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু তাঁর যুগে শিয়াবাদ যেভাবে প্রবল হয়ে উঠতে থাকে এবং তা মুসলমানদের মুল আকিদা বিশ্বাস ও রসুলের হাতে গড়া মুসলমানদের শ্রেষ্ঠতম দল আসহাবে রসূলের চরিত্রে যেভাবে কলঙ্ক আরোপ, তাদেরকে গালিগালাজ এবং তাদের কার্যকলাপের বিরুদ্ধে ন্যক্কারজনক প্রতিবাদের তুফান সৃষ্টি করে, তা ইমামকে ভীষণভাবে বিচলিত করে। তিনি মনে করেন, রসূলের হাতে গড়া মুসলমানদের শ্রেষ্ঠতম দলই যদি নিন্দিত হয় তাহলে মুসলমানদের সামনে আর কোন মডেল থাকবে না। ফলে তারা চারিত্রিক নৈরাজ্যের শেষ প্রান্তে পৌঁছে যাবে। আর বিশেষ করে সে সময়ের তাতারী বাদশাহ ওলিজা খুদাবান্দা খানের আর্শীবাদপুষ্ট শিয়া আলেম ইবনুল মোতাহার শিয়াবাদ ও ইমামতের সমর্থনে এবং খিলাফত ও আহলে সুন্নাতের বিরুদ্ধে মিনহাজুল কিরামাহ ফি মারিফাতিল ইমামাহ নামে যে বিরাট গ্রন্থটি প্রণয়ন করেন তা মুসলমানের মধ্যে দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে থাকে। শিয়ারা এ গ্রন্থটি নিয়ে বেশ হৈ চৈ করতে থাকে এবং এর প্রতিপাদ্য বিষয়সমূহের কোন জবাব দেয়া সম্ভব নয় বলে দাবী করে। এ গ্রন্থ হযরত আলী রা. ও আহলে বায়েতের ইমামত ও ইসমাতের (তথা মাসুমিয়াত অর্থাৎ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা সকল প্রকার ভুল ও গুনাহ থেকে মুক্ত) প্রমাণ পেশ এবং তিনজন খলীফার খিলাফতের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও সাহাবায়ে কেরামের নিন্দা করা হয় এবং এ নিয়ে বিরাট আলোচনার আসর জমানো হয়। কুরআনের আয়াত ও হাদিস থেকে এগুলো প্রমাণ করার চেষ্টা করা হয়। সমগ্র গ্রন্থটি এমন তাত্ত্বিক আলোচনা ও যুক্তি প্রমাণে পূর্ণ ছিল যে, একজন সাধারণ পাঠকের পক্ষে তার বক্তব্যের বিরোধী মত পোষণ করা কোনক্রমেই সম্ভব ছিল না।
অষ্টম শতকের শিয়া আলেমদের ন্যায় এ গ্রন্থকারও উসূল ও আকীদার দিক থেকে ছিলেন মুতাজিলা সম্প্রদায়ভুক্ত। ফলে আহলে সুন্নাতের আকীদা বিশ্বাসের ওপর তাঁর আক্রমণ চলে সম্পূর্ণ দার্শনিক ও মুতাকাল্লিমদের কায়দায়। এজন্য মুসলিম বুদ্ধিজীবী সমাজেও এর প্রভাবে পড়ে।
এ ধরনের গ্রন্থের জবাব লেখা সাধারণ আলেম বা লেখকের পক্ষে সম্ভব ছিল না। আবার দুর্ভাগ্য বশত সাধারণভাবে শিয়া আলেমগণ হাদিস তৈরি করার এবং এই তৈরি করা হাদিসের বরাত দেয়ার ব্যাপারে অত্যন্ত নির্ভীক প্রমাণিত হয়েছিলেন। এই সংগে হাদিস শাস্ত্র তখন অত্যন্ত ব্যাপকতা লাভ করেছিল। লক্ষ লক্ষ হাদিস গ্রন্থাবদ্ধ হয়েছিল। এদের বিভিন্ন সংকলন ইসলামী বিশ্বের বিভিন্ন শহরের গ্রন্থাগারে ছড়িয়ে ছিল। জারাহ ও তাদীল এবং আসমাউর রিজাল তথা হাদিসের নির্ভূলতা ও অকাট্যতা যাচাই করার ইলমও বিস্তৃতি লাভ করেছিল। কোন এক শহরের কোন একটি গ্রন্থাগারে এগুলো একত্র ছিল না। কোন এক ব্যক্তির পক্ষে উল্লেখিত গ্রন্থে বর্ণিত হাদিসগুলো নির্ভূলতা যাচাই করা তাই এক্ষেত্রে মোটেই সহজসাধ্য ছিল না। এ কাজ একমাত্র তার পক্ষেই সম্ভবপর ছিল যিনি ছিলেন হাদিস ও রিজাল শাস্ত্রের হাফেজ, হাদিস ও রিজাল শাস্ত্রের হাফজ, হাদিসের প্রতিটি গ্রন্থ এবং রাবীদের নাম ও অবস্থা যার নখদর্পণে ছিল,প্রতিপক্ষ মিথ্যা বরাতের মাধ্যমে যাকে কোন প্রকারে ধোঁকা দিতে পারতো না। এই সংগে ইসলামের ইতিহাসও যার সামনে ছিল উন্মুক্ত কিতাবের মতো। ইতিহাসের কোন গোলক ধাঁধায় ফেলে যাকে নাকাল করাও সম্ভবপর ছিল না।
এ ধরনের একজন সর্বজ্ঞান সমন্বিত আলেম হিসেবে সে যুগে একমাত্র ইমাম ইবনে তাইমিয়ার নামই করা যেতে পারতো। দর্শন ও কালাম শাস্ত্রে তিনি যেমন পণ্ডিত ছিলেন প্রতিপক্ষের দার্শনিক ও যুক্তিসিদ্ধ আলোচনার গলদ নির্ণয় তাঁর পক্ষে যেমন সম্ভবপর ছিল তেমনি হাদিস শাস্ত্রের ক্ষেত্রেও তাঁর ছিল অগাধ পাণ্ডিত্য। সে যুগে তাঁকে হাদিসের বিশাল গ্রন্থাগারের সাথে তুলনা করা হতো। তাঁর সম্পর্কে তো বিদগ্ধ সমাজে প্রচলিতই ছিল, ইমাম ইবনে তাইমিয়া যে হাদিসটির ব্যাপারে একথা বলেছেন যে, তিনি এটি জানে না, সেটি আসলে কোন হাদিসই নয়।
ইবনে মোতাহারের গ্রন্থের একথা প্রমাণ করেছেন যে, শিয়া আলেম ইবনে মোতাহার যেভাবে আফযালুল খালায়েকে বাদাল আম্বিয়া নবীদের পরে সমগ্র মানব জাতির মধ্যে শ্রেষ্ঠ জন অর্থাৎ আসহাবে রসূলকে গালিগালাজ করেছেন এবং তাদেরকে আল্লাহর নিকৃষ্টতম সৃষ্টি হিসাবে দেখিয়েছেন তাতে তিনি ইসলামের ভিত্তিমূলে কুঠারাঘাত করেছেন বলা যায়। এর ফলে নবুয়তে মুহাম্মাদীর ওপর আক্রমণ, এর সমালোচনা ও নাস্তিক্যবাদের দরজা খুলে যায়। এ গ্রন্থের প্রথম খন্ডের এক স্থানে তিনি লিখেছেনঃ এই শিয়ারা, নবী ও রসূলগণের পরে প্রথম ও শেষের সমস্ত উম্মতের মদ্যে যারা ছিলেন শ্রেষ্ঠ ও সবচাইতে সৎ তাদেরকে সমগ্র মানব জাতির মধ্যে নিকৃষ্টতম ও সব চাইতে অসৎ হিসেবে চিত্রিত করেছে। এদের বড় বড় দোষ বর্ণনা করেছে। এদের গুণগুলোকে দোষে রূপান্তরিত করে দিয়েছে। আর এর মোকাবিলায় যেসব স্বার্থবাদী লোক নিছক স্বার্থোদ্ধারে নিজেদেরকে ইসলামের সাথে জড়িত করে রেখেছিল। যাদের চাইতে বড় ফাসেক ফাজের মিথ্যুক,বেঈমান, জালেম এবং গুনাহ ও কুফরী কর্মে লিপ্ত লোক আর ছিল না তাদেরকে তারা সৎ ও সৃষ্টির সেরা হিসেবে প্রমাণ করেছে। এভাবে তারা সমগ্র উম্মতের তাকফীর করেছে, অথবা তাদেরকে গোমরাহ প্রমাণ করেছে কেবলমাত্র নিজেদের ছোট্ট একটি দল ছাড়া, যাদের সম্পর্কে তাদের বিশ্বাস একমাত্র তারাই সত্যপন্থী।
এ গ্রন্থের দ্বিতীয় খন্ডের এক স্থানে তিনি ইমাম শাবীর একটি বাণী উদ্ধৃত করেছেন। তাতে ইমাম শাবী বলেছেনঃ ইয়াহুদী ও খৃষ্টানরা শিয়াদের তুলনায় তাদের পয়গম্বরদের বেশি মর্যাদা দান করে। ইয়াহুদীদেরকে জিজ্ঞেস করা হলো, তোমাদের মিল্লাতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ কারা? তারা জবাব দিল হযরত মুসার আ. সাথিরা। খৃষ্টানদেরকে জিজ্ঞেস করা হলো, তোমাদের মিল্লাতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ কারা? তারা জবাব দিল, হযরত ঈসার আ. হাওয়ারী অর্থাৎ সাথিগণ। আর শিয়াদেরকে জিজ্ঞেস করা হলো, তোমাদের মিল্লাতের মধ্যে নিকৃষ্টতম কারা? তারা জবাব দিল, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবারা। এ সদাচারী লোকদেরকে গালিগালাজ করেছে।
দ্বিতীয় খন্ডের আর এক স্থানে শিয়াদের একটি অভ্যাস বর্ণনা প্রসঙ্গে লিখেছেনঃ শিয়াদের চিরন্তন অভ্যাস হচ্ছে তারা মুসলমানদের জামায়াত চেড়ে হামেশা ইয়াহুদ, নাসারা ও মুশরিকদের সাথে সহযোগিতা করে এবং তাদের সাথে বন্ধুত্বের আলাপনই করে। তাদের চাইতে বড় গোমরাহ আর কে হতে পারে যারা মুহাজির ও আনসারদের প্রথম সারির লোকদের সাথে শত্রুতা পোষণ করে এবং মুনাফিক ও কাফেরদের সাথে সখ্যতা রাখে?
তারপর বিভিন্ন জাতীয় সমস্যায় শিয়াদের ভূমিকা বর্ণনা করেছেন। বিশেষ করে জাতীয় সংকটকালে কাফেরদের সাথে সহযোগিতা করার ঘটনাবলী উল্লেখ করে লিখেছেন, তাদের অধিকাংশই মনে প্রাণে কাফেরদের সাথে সখ্যতা পোষণ করে মুসলমানদের মোকাবিলায় অনেক বেশি। কাজেই যখন তাতারীরা পূর্বদিক থেকে ইসলামী বিশ্বে অভিযান চালালো, মুসলমানদেরকে হত্যা করলো, খোরাসান, সিরিয়া, হালব(আলেপ্পো) প্রভৃতি এলাকায় যেসব শিয়া ছিল তারা দুশমনদের সহায়তা করলো। অনুরূপভাবে খৃষ্টানরা যখন সিরিয়ায় মুসলমানদের সাথে লড়াই করলো তখন শিয়ারা ছিল তাদের সহায়ক। এভাবে দেখা যায়, যদি ইরাকে বা অন্য কোথাও ইয়াহুদীদের সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় তাহলে শিয়ারা তাদের সবচাইতে বড় সহায়ক শক্তি প্রমাণিত হবে। তাই তারা সবসময় কাফের ও মুশরিক এবং ইয়াহুদ ও নাসারাদের সাহায্য করার এবং মুসলমানদের মোকাবিলায় তাদেরকে সহায়তা দান করার জন্য তৈরি থাকে।
ইসলামী ইলম ও চিন্তার পুনর্গঠন
ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহমতুল্লাহে আলাইহি ইসলামের ইতিহাসে সবচাইতে আলোড়ন সৃষ্টিকারী ব্যক্তিত্ব। ইতিহাসের গতিধারায় তিনি হক, ইনসাফ, ইলম ও মনীষার এমন এক স্বর্ণোজ্জল স্বাক্ষর রেখে গেছেন, যা কিয়ামত পর্যন্ত মিল্লাতকে সত্য ও ন্যায়ের পথে উদ্বুদ্ধ করতে থাকবে। নবুওয়ত ও খিলাফত আলা মিনহাজিন নবুয়তের অবসানের সাড়ে ছশ বছর পর তিনি ইসলাম ও মিল্লাতে ইসলামীয়াকে পুনর্বার নতুন জীবন রসে সমৃদ্ধ করেন। নবী যখন ইসলামের দাওয়াত দেন তার মধ্যে কোন অস্পষ্টতা থাকে না, কোন অসম্পূর্ণতা থাকে না। নবীর তিরোধানের পর চতুর্দিকের ময়লা আবর্জনা ইসলামকে ঘিরে ফেলে, ইসলাম ধীরে ধীরে অস্পষ্ট হতে থাকে, আপাতদৃষ্টিতে তার সম্পর্কে অসম্পূর্ণতা থাকেনা। নবীর তিরোধানের পর চতুর্দিকের ময়লা আবর্জনা ইসলামকে ঘিরে ফেলে, ইসলাম ধীরে ধীরে অস্পষ্ট হতে থাকে, আপাতদৃষ্টিতে তার সম্পর্কে অসম্পূর্ণতার ধারণাও আসতে থাকে। এ সময় ইসলামের দেহ থেকে ময়লা আবর্জনা ঝেড়ে মুছে ফেলে যারা যথার্থ ইসলামকে আবার সুস্পষ্ট করেন এবং ইসলামকে আবার সুস্পষ্ট করেন এবং ইসলামের অসম্পূর্ণতার ধারণার মূলোৎপাটন করেন তারাই হচ্ছেন যথার্থ আলেম এবং দীনের মুজাদ্দিদ। সত্য ও মিথ্যা তাদের কাছে সুস্পষ্ট থাকে যেমন দুপুরের সূর্য। এ জন্য আল্লাহর সাথে সরাসরি সম্পর্ক বা জ্ঞানের কোন ডাইরেক্ট পাইপ লাইনের কথা বলছি না। কুরআন ও সুন্নাতই যথেষ্ট। সত্য ও জ্ঞানের ক্ষেত্রে আল্লাহর সাথে সম্পর্কের এ দুটিই একমাত্র চ্যানেল।
ইমাম ইবনে তাইমিয়া ছিলেন এমনি একজন যথার্থ আলেম ও দীনের মুজাদ্দিদ। নবুওয়তের সাতশ বছর পর তিনি ইসলামকে আবার তার স্বরূপে প্রতিষ্ঠিত করেন। এজন্য ভিতর ও বাইরের সমস্ত আবর্জনা থেকে তাকে মুক্ত করেন। এ প্রসঙ্গে আমরা ইতিপূর্বে ইমামের তিনিটি তাজদীদী কাজের আলোচনা করেছি। তাঁর তাজদীদী কাজটি ছিল শরীয়তের ইলম ও ইসলামী চিন্তার পুনর্গঠন।
ইমামের যুগ পর্যন্ত শরীয়তের ইলম যথেষ্ট ব্যাপকতা লাভ করেছিল। বিশেষ করে তাফসীর, হাদিস, ফিকহ, উসূলে ফিকাহ ও কালাম শাস্ত্র ভিত্তিক বিরাট বিরাট পাঠাগার তৈরি হয়ে গিয়েছিল। এগুলোর যে কোন একটিতে পারদর্শিতা অর্জন সে যুগের একজন সাধারণ শিক্ষার্থীর খ্যাতি লাভের জন্য যথেষ্ট ছিল। তবুও একাধিক শাস্ত্রে পণ্ডিত লোকের সংখ্যাও কম ছিল না। শুধুমাত্র তাবকাতুশ শাফেইয়াতুল কুবরা কিতাবটি পড়লে এমন অসংখ্য আলেমের সন্ধান পাওয়া যাবে যারা একই সংগে শরীয়তের সমস্ত ইলমে পারদর্শী ছিলেন। তাদেরকে সেযুগের শরীয়তের ইলমের ইনসাইক্লোপিডিয়া বলা যেতে পারে। কিন্তু শরীয়তের ইলমের এই বিপুল চর্চা ও ব্যাপকতা স্বতেও ইলমের গভীরতা অতি অল্প আলেমরই ছিল। এই অল্প সংখ্যকদের মধ্যে ইমাম ইবনে তাইমিয়ার নাম ছিল শীর্ষে।
ইমামের স্মৃতিশক্তি ছিল নজিরবিহীন। যার ফলে সব ধরনের ইলমে পারদর্শিতা অর্জন তার পক্ষে হয়েছিল অত্যন্ত সহজসাধ্য। এই সঙ্গে আল্লাহ প্রদত্ত তীক্ষ্ণ মেধার কারণে তিনি প্রত্যেক জ্ঞানের গভীরে প্রবেশ করেছিলেন। তিনি যে বিষয়ে লিখতেন সে বিষয়ের কোন না কোন নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতেন। বিশেষ করে তিনি কুরআন মজীদ ও শরীয়তের জ্ঞান অর্জন করার এক নতুন পথ খুলে দেন। কুরআনের তাফসীর তাঁর একটি বিশেষ ও সবচাইতে প্রিয় আলোচনার বিষয়। তার এমন কোন গ্রন্থ নেই যেখানে কুরআনের তাফসীরের বিষয়বস্তু নেই। কুরআনের আয়তের বিস্তারিত আলোচনার পর সেখান থেকে যুক্তি প্রমাণ গ্রহণ করেননি এমন কোন গ্রন্থই তার পাওয়া যাবে না। তাঁর শাগরিদবৃন্দের মতে তিনি তাফসির সংক্রান্ত যেসব আলোচনা রেখে গেছেন তা সব একত্রিত করলে ৩০ খন্ডে কুরআনের একটি তাফসীর সমাপ্ত হতে পারে। কিন্তু বিচিত্র ঘটনা বহুল সংগ্রামী ও সার্বক্ষণিক জিহাদি জীবন যাপন করার ফলে তাঁর সব পাণ্ডুলিপি যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা সম্ভব পর হয়নি। তবুও গুণীজনদের প্রচেষ্টায় তাঁর তাফসীর সংক্রান্ত বেশ কিছু গ্রন্থ সংরক্ষিত হয়ে গেছে। তার মধ্যে সূরা নুর, সূরা ইখলাস ও সূরা মুআওয়াবিযাতাইনের তাফসীর মিসর থেকে ছাপা হয়ে গেছে। সাম্প্রতিককালে তাঁর বিভিন্ন কিতাব থেকে তাফসীর সংক্রান্ত আলোচনাগুলো একত্রিত করে তাফসীরে ইবনে তাইমিয়া নাম দিয়ে বোম্বাই থেকে একটি বই ছাপা হয়েছে। তাফসীরের মূলনীতি সংক্রান্ত উসূলে তাফসীর নামে তাঁর একটি বইও পাওয়া যায়। হাদিসের ব্যাপারে ইমাম ইবনে তাইমিয়া তাঁর যুগে একটি দৃষ্টান্ত হিসেবে বিবেচিত হতেন। কিন্তু এ স্বতেও হাদিসের ওপর তাঁর কোন স্বতন্ত্র গ্রন্থ নেই। তবে উসূলে হাদিস, আসমাউর রিজাল জারাহ ও তাদীল, নাকদে হাদিস, ফিকহে হাদিস প্রভৃতি আলোচনা তাঁর রচনায় এভাবে ব্যাপকতা লাভ করেছে যে, তা সব একত্রিত করলে কয়েক খন্ডে তাঁর একটি বিরাট রচনা হিসেবে গৃহীত হতে পারে। বিশেষ করে মওযু, মিথ্যা, জাল ও বানোয়াট হাদিসের ব্যাপারে তাঁর কিতাবগুলোয় যে ধরনের গবেষণামূলক আলোচনা পাওয়া যায় তা আর কোথাও পাওয়া যায় না। এ ব্যাপারে শিয়াদের বিরুদ্ধে লেখা তাঁর মিনহাজুস সুন্নাহ গ্রন্থটিতে সবচাইতে বেশি আলোচনা পাওয়া যাবে।
উসূলে ফিকহের উপরও তার আলোচনা কম নেই। এক্ষেত্রে তিনি একজন মুজতাহিদের মর্যাদার অধিকারী। মূলগতভাবে তিনি নিজে হামবলী ফিকহের অনুসারী হলেও নিজের স্বাধীন রায় প্রকাশের ব্যাপারে মোটেই কার্পণ্য করেননি। এ ব্যাপারে তার ফতওয়া ই ইবনে তাইমিয়া ও ইকতিযাউ সিরাতিম মুসতাকীম কিতাবের নাম করা যেতে পারে। উসূলে ফিকহের ওপর তাঁর একটি স্বতন্ত্র গ্রন্থ হচ্ছে মিনহাজুল উসূল ইলা ইলমিল উসূল।
ইলমে কালাম সংক্রান্ত ইমামের রচনাবলী একত্রিত করলে দেখা যাবে ইলমে কালাম ও আকায়েদ তাঁর সমগ্র রচনাবলীর শতকরা চল্লিশ ভাগ অঙ্গন জুড়ে আছে। এ সংক্রান্ত তাঁর কিতাবগুলোর নামের ব্যাপারে একটা বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। কিতাবগুলোর নাম বিভিন্ন শহরের সাথে সংযুক্ত। অর্থাৎ যেসব শহর থেকে প্রশ্ন এসেছিল সেইসব শহরের নামে বইগুলোর নামকরণ করা হয়েছে। যেমন শারহে ইসবানিয়া(ইস্পাহান), রিসালায় হামাভীয়া, তাদমীরিয়া, ওয়াসিতীয়া, কাইলামিয়া, বাগদাদীয়া আযহারীয়া ইত্যাদি। ইলমে কালাম সংক্রান্ত ইমামের গ্রন্থগুলো পড়লে তাঁর জ্ঞানের পরিধি ও ব্যাপকতার সন্ধান পাওয়া যাবে।
ফিকহের ক্ষেত্রে তাঁর অবদান একজন মুজতাহিদের চাইতে কম নয়। যদিও তাঁর সময় পর্যন্ত সব মযহাবের ফিকহ সংকলন ও বিন্যাসের কাজ পুরোপুরি শেষ হয়েছিল তবুও সেক্ষেত্রে তাঁর বিশিষ্ট অবদান রয়েছে। তিনি মুজতাহিদের দৃষ্টিতে ফিকহের বিভিন্ন মাসায়েল ও আহকাম পর্যালোচনা করেন এবং কিতাবুল্লাহ, সুন্নাতে রসূল, ইজমা, কিয়াস ও উসূলে ফিকহের আলোকে আহকাম বিশ্লেষণ করে ইজতিহাদ ও ইসতিমবাতও করেছেন। ফিকহের রায় ও খুঁটিনাটি মাসায়েলকে সহী হাদিসের অনুসারী করার চেষ্টা করেছেন। এক্ষেত্রে তাঁর ফতওয়ার বিরাট বিরাট কিতাব রয়ে গেছে। এ গ্রন্থগুলো বহুখন্ডে মুদ্রিত হয়েছে। সম্প্রতি মিসর থেকে ১৫৮৬ পৃষ্ঠা সম্বলিত ৪ খন্ডে ফতওয়ায়ে শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া নামে তাঁর একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। অন্যদিকে সৌদি সরকার ৩০ খন্ডে তাঁর ফতওয়াগুলোর বৃহত্তম সংকলন প্রকাশ করেছেন।
পরবর্তীকালে কয়েকশ বছর পর্যন্ত ইমামের ইলম সমগ্র ইসলামী বিশ্বে যাদুর মতো প্রভাব বিস্তার করেছিল। এমনকি আজকের যুগেও তাঁর তাঁর ইলমের প্রভাব মুক্ত কোন শ্রেষ্ঠ আলেম ও ইসলামী চিন্তাবিদের সন্ধান পাওয়া কঠিন।
দুনিয়ায় বহু চিন্তা ও মতবাদের প্রচলন রয়েছে। এগুলো গড়ে উঠেছে বিভিন্ন ধারণা, কল্পনা, যুক্তি, আন্দাজ, অনুমান, অভিজ্ঞতাও পরীক্ষা নিরীক্ষা লব্ধ জ্ঞান, আলোচনা ও বিতর্কের ভিত্তিতে। বিপরীত পক্ষে ইসলামী চিন্তা ও মতবাদের ভিত গড়ে উঠেছে অহি ও নবুয়তের মুহাম্মদীর ওপর। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর সত্তা ও গুণাবলী, তাঁর কার্যাবলী, বিশ্ব জাহানের সূচনা ও সমাপ্তি, দুনিয়ায় মানুষের প্রথম পদার্পণ ও তার পরিণাম, কিয়ামত, হাশর নশর, মানুষের আমলের ফলাফল এবং দীনী জীবনের সাথে সম্পর্কিত অন্যান্য অতি প্রাকৃতিক বিষয়াবলী সম্পর্কে যা কিছু বলে দিয়েছেন তাই হচ্ছে ইসলামী আকিদা বিশ্বাস চিন্তা মতবাদ। নবীর ওপর আল্লাহর অহি ছাড়া এ বিষয়গুলো জানার দ্বিতীয় কোন পথ নেই। চিন্তা গবেষণা, আন্দাজ অনুমান করে এ বিষয়গুলো জানার কোন সম্ভাবনাই নেই। আল্লাহর সত্তা ও গুণাবলীর ধারে কাছেও পৌঁছানো মানুষের বুদ্ধিবৃত্তির পক্ষে সম্ভব নয়। এ ব্যাপারে মানুষের কোন অভিজ্ঞাও নেই। এসব চোখে দেখাও যায় না। কুরআনে সুস্পষ্ট ভাষায় বলে দেয়া হয়েছেঃ লাইসা কামিসলিহী শাইউন কো জিনিসের সাথে তাঁর সাদৃশ্য নেই। কাজেই এক্ষেত্রে একমাত্র আল্লাহ প্রদত্ত জ্ঞানের ওপরই নির্ভর করতে হবে। আর এ জ্ঞান একমাত্র নবীদের কাছেই পাওয়া যায়। নবীদের হৃদয় এ জ্ঞানের আলোকে এমন উদ্ভাসিত যেন তাঁরা সবকিছু প্রত্যক্ষ করেছেন। তাদের জ্ঞানের মধ্যে সংশয়ের কণামাত্রও নেই। তাই নবীদের জ্ঞানের ব্যাপারে সামান্যতম সংশয় প্রকাশেরও অবকাশ নেই। কুরআনে এ বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করে বলা হয়েছে –
*************আরবী*************
তিনি বললেন, তোমরা কি আল্লাহর ব্যাপারে আমার সাথে বিতর্ক করেছো? অথচ আল্লাহ এ ব্যাপারে আমাকে পথ দেখিয়েছেন।
এটা এমন একটা ব্যাপার যা দুপুরের সূর্যটার মতোই সত্য ও সুস্পষ্ট। এ ধরনের প্রোজ্জ্বল সত্যের উপস্থিতিতে আর কোন দর্শন এবং আল্লাহর সত্তা ও গুণাবলী প্রমাণের জন্য আর কোন বুদ্ধিবৃত্তিক যুক্তির প্রয়োজন নেই। তবুও মানুষের বুদ্ধিবৃত্তির ইতিহাস আলোচনা করলে দেখা যাবে হাজার হাজার বছর ধরে মানুষ বুদ্ধিবৃত্তির মাধ্যমে এসবের বিচার বিশ্লেষণের প্রয়াস চালিয়ে আসছে। অথচ এ ব্যাপারে নিজের অক্ষমতার মানুষ নিজেই স্বীকৃতি দিয়েছে। এসব বিষয়ের আলোচনার জন্য দার্শনিকরা নিজেদের তরফ থেকে কিছু পারিভাষিক শব্দ তৈরি করে নিয়েছেন। সেগুলোর অর্থ তারা নিজেরাই করেছেন। পরবর্তীকালে মুসলিম মুতাকাল্লিমগণ এই দার্শনিকদের বিভ্রান্তির জবাব দিতে গিয়ে তাদেরই পরিভাষাগুলো ব্যবহার করেছেন। ফলে অনেক ক্ষেত্রে তাদের শব্দগুলোর সীমিত অর্থের স্বীকৃতিও দেয়া হয়েছে। এমন কি অনেক ক্ষেত্রে আল্লাহর সত্তা ও গুণাবলী সম্পর্কে তারা এমন নিশ্চয়তার সাথে আলোচনা চালিয়েছেন, যেন মনে হয় এসব তাদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা, দর্শন ও অনুভূতি লব্ধ। দর্শনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝাণ্ডা হাতে নিয়ে বের হয়ে তারা নিজেদের অজ্ঞাতসারে দার্শনিকদের দলে ভিড়ে পড়েছেন এবং দার্শনিকদের সমস্ত বাহাস ও বিতর্কের পুনরাবৃত্তি করেছেন। কুরআন মজীদ কেমন চমৎকারভাবে দার্শনিকদেরকে সম্বোধন করে বলেছেঃ
*************আরবী*************
তোমরা কি শুনেছো? তোমরা তো এমন সব কথা নিয়ে বিতর্ক করেছো যার সম্পর্কে তোমাদের জ্ঞান ছিল সামান্য। তাহলে এখন আবার কেন বিতর্ক করছো এমন সব কথা নিয়ে যেগুলো সম্পর্কে তোমাদের কোন জ্ঞান নেই? আর আল্লাহ জানেন কিন্তু তোমরা জানো না। (আল ইমরানঃ৬৬)
ইমাম ইবনে তাইমিয়ার সময়ে এবং তাঁর পূর্ববর্তী কয়েকশো বছর থেকে ইসলামী চিন্তা ও গবেষণার ক্ষেত্রে যে স্থবিরতা দেখা দিয়েছিল তার ফলে আল্লাহর সত্তা, তওহীদ, আখিরাত এবং অন্যান্য অদৃশ্য ও অতি প্রাকৃতিক সত্যগুলো প্রমাণ করার জন্য দার্শনিকদের গড়া ভিত্তির ওপর মুতাকাল্লিমগণ যে আকায়েদের প্রাসাদ নির্মাণ করেছিলেন তাকেই দীনের আসল বুনিয়াদ মনে করা হতে থাকে। মুহাদ্দিস ও ফকীহদের ছোট্ট একটি গোষ্ঠী বাদে বাকী সবাই মুতাকাল্লিমদের বুদ্ধিবৃত্তিক সিদ্ধান্তকেই ইসলামী আকায়েদের মানদণ্ড মনে করতো। আল্লাহর কিতাব ও রসুলের সুন্নাতকে আকায়েদের মানদণ্ডে পরিণত করার পরিবর্তে মুতাকাল্লিমদের বইগুলোকেই তারা মানদণ্ড বানিয়ে নিয়েছিল। প্রশ্ন ও আপত্তি থেকে বাঁচার জন্য তারা আয়াত ও হাদিসের তাবীল অর্থাৎ মনগড়া ব্যাখ্যা করতো। দর্শন ও ইলমে কালামের প্রভাব তাদের ওপর এমনভাবে চেপে বসেছিল যে, তার মধ্যে কোন ভুল তারা কল্পনাও করতে পারতো না বরং কুরআন হাদিসকে কাটছাঁট করে সেই মোতাবেক করার চেষ্টা করতো।
ইমাম ইবনে তাইমিয়া এই মানসিকতার কঠোর সমালোচনা করেছেন। তিনি দর্শন, ইলমে কালাম ও বুদ্ধিবৃত্তির পরিবর্তে কুরআন ও হাদিসের ভিত্তিতে ইসলামী আকায়েদ চিন্তা ও মতবাদের ভিত্তি গড়ে তোলেন। (সাম্প্রতিককালে এই দৃষ্টিভঙ্গিতে সবচেয়ে সার্থক ইসলামী আকায়েদ গ্রন্থ রচনা করেছেন মিসরের মুহাম্মদ আল গাযালী। তাঁর গ্রন্থটির নামঃ আকীদাতুল মুসলিম। বইটি বাংলাদেশ ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে বাংলায় ইসলামী আকীদা নামে প্রকাশিত হয়েছে। )
ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহমাতুল্লাহে আলাইহি বুদ্ধিকে অপ্রতিহত ও অসীম ক্ষমতা দান এবং আল্লাহ, রসূল ও পরকালের ব্যাপারে তাকে সিদ্ধান্ত দানকারী শক্তি হিসেবে স্বীকৃতি দেবার বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদ জানান। সঠিক অর্থে এ ব্যাপারে তিনিই প্রথম সার্থক প্রতিবাদকারী। বুদ্ধির অবিমৃশ্যকারিতার বিরুদ্ধে তিনিই সার্থক বিদ্রোহী।
ইতিপূর্বে ইমাম গাযালী রহমাতুল্লাহে আলাইহি দর্শনে বর্ণিত আল্লাহ সম্পর্কিত বিষয়াবলীর বিরুদ্ধে লেখেন, এগুলোর কঠোর সমালোচনা করেন এবং দার্শনিকদের বুদ্ধির দৌড় নিয়ে বেশ জমিয়ে রসিকতা করেন। কিন্তু বুদ্ধির অসীম ক্ষমতা এবং যে বিষয়ে তার সঠিক জ্ঞান নেই সে বিষয়ে গভীর তত্ব আলোচনায় প্রবৃত্ত হওয়ার বিরুদ্ধে তিনি কোন শক্তিশালী আওয়াজ বুলন্দ করেননি।
ইমাম ইবনে তাইমিয়া তাঁর সমস্ত স্থান ও পাণ্ডিত্যের শক্তি ব্যবহার করে একথা প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন যে, আকীদা বিশ্বাস ও অদৃশ্য সত্যগুলোর মূল উৎস হচ্ছে আল্লাহর কিতাব ও নবীর সুন্নাতের মধ্য থেকে আহরণ করা হয়। বুদ্ধি এর শক্তি বৃদ্ধি ও এর সত্যতা প্রমাণের সহায়ক হতে পারে, কিন্তু এর প্রমাণের ভিত্তি হিসেবে দাঁড়াতে পারে না। তিনি সারীহুল মাকুল লিসাহীহিল মানকুল গ্রন্থের প্রথম খন্ডে লিখেছেনঃ
শরীয়তকে প্রমাণ করার জন্য বুদ্ধি আসলে কোন ভিত্তির কাজ করতে পারে না। তাকে এমন কোন গুণে গুণান্বিত করা হয়নি যার অধিকারী সে আগে ছিল না। অর পূর্ণতার গুণেও তাকে ভূষিত করা হয়নি।
তাঁর বক্তব্য হচ্ছে, বুদ্ধি কেবল একজন পরিচিতি উদঘাটনকারী ও পথ প্রদর্শকের ভূমিকা পালন করতে পারে। রসূলের সত্যতা ও নিষ্কলুষতার স্বীকৃতি পর্যন্তই সে মানুষকে পৌছিয়ে দিতে পারে মাত্র। এরপর তার আর কোন ক্ষমতা নেই। বুদ্ধি এটা প্রমাণ করতে পারে যে, রসূল যেসব বিষয়ের খবর দিচ্ছেন সেগুলো সত্য এবং তিনি যে হুকুমগুলো দিয়েছেন সেগুলো পালন করা ওয়াজিব। যেমন একটা দৃষ্টান্ত দেয় যাকঃ এক শহরে একজন আগন্তুক এল। সে শহরের মুফতির সন্ধান করলো। একজন সাধারণ শহরবাসী তাকে মুফতির ঘরের পথ দেখিয়ে নিয়ে গেলো এবং মুফতি সাহেবকে দেখিয়ে দিয়ে বললো, ইনিই শহরের মুফতি ও আলেম। এরপর ঐ সাধারণ শহরবাসীটি ও মুফতির মধ্যে কোন বিষয়ে মতবিরোধ হরে আগন্তুকের উচিত হবে মুফতির কথা ও সিদ্ধান্ত মেনে নেয়া এবং এক্ষেত্রে সাধারণ শহরবাসীটির এই বলে চাপ দেয়ার কোন অধিকার থাকে না যে, মুফতির কাছে সে পথ দেখিয়ে না আনলে আগন্তুক মুফতির সন্ধান পেতো না, কাজেই তার সিদ্ধান্তই তাকে মেনে নিতে হবে। ইমাম লিখেছেন, রিসালাত সম্পর্কে জানার পর বুদ্ধির কাজ হচ্ছে রসূলের প্রতি ঈমান আনা, তাঁর আনুগত্য করা এবং কোন প্রশ্নজালে নিজেকে জড়িয়ে না ফেলে তাঁর প্রত্যেকটি হুকুম মেনে চলা। তাঁর কথাকে চূড়ান্ত মনে করা। এভাবে অদৃশ্য ও অতিপ্রাকৃতিক বিষয়াবলী সম্পর্কেও রসূলের কথাকে চূড়ান্ত মনে করতে হবে। তার মতে আল্লাহর রসূলের মোকাবিলায় সাধারণ মানুষের কোন মর্যাদাই নেই। রসূল হন সত্যবাদী। তাঁরা সব সময় নির্ভুল খবর পেয়ে থাকেন। তাঁদের খবর ও জ্ঞান সত্যের বিপরীত হবে একথা কল্পনাও করা যায় না। আর যেসব লোক নেহাত নিজেদের বুদ্ধির কসরত দেখিয়ে তাঁদের খবর ও জ্ঞানের মোকাবিলা করে তাদের মূর্খতা ও ভূলের শেষ নেই।
দর্শন ও বুদ্ধিবাদিতায় প্রভাবিত লোকদের মানসিক গঠন এমন পর্যায়ে এসে পৌঁছেছিল যে তারা শরীয়তের যে কথাটি বুদ্ধি ও দর্শনের দৃষ্টিতে গ্রহণীয় হতো তাকে সহজেই গ্রহণ করে নিতো। কিন্তু যে কথাটি তাদের তৈরী যুক্তি ও বুদ্ধিবাদিতার বিরোধী মনে হতো তাকে মেনে নেয়া তাদের পক্ষে সম্ভবপর হতো না। তাদের মধ্যকার অতি সাহসীরা সরাসরি তা মেনে নিতে অস্বীকার করতো। তারা প্রকাশ্যে বলে বেড়াতোঃ শরীয়ত অবশ্যই হবে বুদ্ধির অনুগামী। একথাটা বুদ্ধি বিরোধী। কাজেই এটা গ্রহণযোগ্য নয়। আর যারা এতটা সাহসী নয় তারা শরীয়তের বক্তব্যের ব্যাখ্যার পর ব্যাখ্যা করতে থাকতো। এমন এমন ব্যাখ্যা তারা আনতো যার সাথে শরীয়তের ঐ বক্তব্যের সামান্যতম মিলও থাকতো না। এইসব লোকের মানসিকতাকে সামনে রেখে ইমাম ইবনে তাইমিয়া একথা প্রকাশ করেছেন যে, রসূলের ওপর শর্তহীন ঈমান আনা মুসলমানের জন্য অপরিহার্য। শর্তসাপেক্ষে রসূলের ওপর ঈমান আনাকে কোনক্রমেই ঈমান বলা যেতে পারে না। তিনি লিখেছেনঃ ইসলামের ব্যাপারে একথা চূড়ান্তভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, রসূলের সত্যতার স্বীকৃতি দান ও তাঁর ওপর এমন পর্যায়ের ঈমান আনা ওয়াজিব, যা চূড়ান্ত ও সর্বব্যাপী, যার সাথে কোন শর্ত থাকবে না। তাঁর প্রত্যেকটি খবরকে সত্য বলে মেনে নিতে হবে। তাঁর প্রত্যেকটি হুকুমের আনুগত্য করতে হবে। এর বিরোধী যে কোন কথা বাতিল বলে গণ্য হবে। যে ব্যক্তি রসুলের এমন সব কথাকে সত্য বলে মেনে নেয় যেগুলো তাঁর বুদ্ধির সীমার মধ্যে আসে আর এমন সব কথাকে অস্বীকার করে যা তার নিজের মত ও বুদ্ধি বিরোধী এবং রসূলের খবরের ওপর নিজের বুদ্ধিকে অগ্রাধিকার দেয় আবার এই সংগে রসূলকে সত্য বলে মেনে নেয়ার দাবীও করতে থাকে, সে আসলে পরস্পর বিরোধী। আর যে ব্যক্তি বলে রসূলের কোন কথাকে নিজের জ্ঞান বুদ্ধি দিয়ে বিচার করে তাকে বুঝে না নেয়া পর্যন্ত আমি তাকে সত্য বলতে রাজী নই, তার কুফরীতে কোন প্রকার সন্দেহ নেই।
ইমাম ইবনে তাইমিয়া বুদ্ধির দাবীদারদের বক্তব্য পর্যালোচনা করে একথা প্রমাণ করেছেন যে, নবী রসূলদের বাণীর বিরুদ্ধে এবং কুরআন ও সুন্নাহর উজ্জ্বল সত্যের মোকাবিলায় যেসব বুদ্ধিভিত্তিক সিদ্ধান্ত খাড়া করা হয়, সেগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রে হয় নিছক কল্পনা ও ভাববিলাসীতা এবং গভীরভাবে চিন্তা করলে সেগুলো বুদ্ধির আকাশ কুসুম কল্পনাই প্রমাণ করে। তিনি বলেন, দার্শনিকরা তাদের যে সব বড় বড় সিদ্ধান্ত নিয়ে গর্ব করে সেগুলোকে আল্লাহ তত্ব নাম দিয়েছে এবং যেগুলোকে তারা নবীদের কালামের মোকাবিলায় পেশ করে,নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে বিচার করলে সেগুলোর এবং পাগলের প্রলাপের মধ্যে কোন পার্থক্য দেখা যাবে না।
কিন্তু ইমাম সাহেব বুদ্ধিকে তার যথার্থ মর্যাদা দিতে মোটেই কার্পণ্য করেননি। তাঁর মতে কুরআন মজিদে বিভিন্ন স্থানে বুদ্ধি ব্যবহার করার এবং বুদ্ধিকে কাজে লাগাবার উপদেশ দেয়া হয়েছে। তার মতে নির্ভুল ও ভারসাম্যের অধিকারী বুদ্ধি ও নবী রসূলদের নির্ভুল বাণীর মধ্যে কোন বিরোধ হতে পারে না। তিনি নিজের গভীর ও ব্যাপক অধ্যয়নের ফল বর্ণনা করে বলেছেন, বুদ্ধি ও রসূলের বাণীর মধ্যে আমি কোন বিরোধ দেখিনি। তবে শর্ত হচ্ছে, বুদ্ধি হতে হবে ভারসাম্যপূর্ণ, যাকে কুরআনে বলা হয়েছে আকলে সালীম এবং নবীর বাণী হতে হবে সঠিকভাবে সংরক্ষিত, যার মধ্যে কোন বিকৃতি হয়নি। এ বিষয়বস্তুর ওপর তিনি চার খন্ডে একটি কিতাব লিখেছেন। কিতাবটির নাম হচ্ছে বায়ানু মাওয়ায়িফকাতে সারীহিল মাকুল লিসাইহিল মানকুল। এ কিতাবে তিনি একথা প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন যে, যুক্তিসংগত নির্ভুল বুদ্ধিবৃত্তি ও নবী রসূলদের অবিকৃত বাণীর মধ্যে কোন বিরোধ নেই। নির্ভুল বুদ্ধিবৃত্তি সব সময়ই এ ধরনের বাণীর সত্যতা প্রমাণে সহায়তা করেছে।
তিনি গভীর নিষ্ঠার সাথে দাবী করেছেন, একটি হাদিসও বুদ্ধি বিরোধী নয়। আর যদি এমন কোন হাদীস থেকে থাকে তাহলে দেখা যাবে হাদীস বিশারদদের কাছে আগেই তা যঈফ (দুর্বল) ও মওযু (বানোয়াট) হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। তিনি দার্শনিক ও মুতাকাল্লিমদের এ দাবী মেনে নিতে অস্বীকার করেছেন যে কুরআনের ভিত্তি নিছক উদ্ধৃতি ও শ্রুতির ওপর। তিনি প্রমাণ করেছেন, কুরআনে সর্বোত্তম যুক্তিপ্রমান ও বুদ্ধি বৃত্তিকে আলোচনা রয়েছে। কুরআনের যুক্তি প্রমাণ এমনি অকাট্য যে তার বিরুদ্ধে হাজার যুক্তি আনলেও তা খণ্ডন করা সম্ভব নয়।
মোটকথা ইমাম ইবনে তাইমিয়া সব সময় একথা বলে এসেছেন যে, ওহী ও নবুয়ত হচ্ছে আকীদা বিশ্বাসের ভিত্তি, বুদ্ধি ও যুক্তি নয়। তাঁর বিভিন্ন কিতাবে তিনি একথা প্রমাণের চেষ্টা করেছেন। সম্ভবত তাঁর এমন কোন বই নেই যেখানে তিনি এ বক্তব্য পেশ করেননি বা অন্তত এর আভাস দেননি। এভাবে তিনি সমকালীন বুদ্ধিবৃত্তিকে কুরআন ও সুন্নাতের নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করেন। তাঁর এ প্রচেষ্টায় ইসলামী চিন্তা ও ভাবধারা শক্তিশালী হয় এবং পরবর্তী কয়েকশ বছর পর্যন্ত তা মিল্লাতকে শক্তি যোগাতে থাকে।