শেষ কথা
প্রতিভা মাত্রই বিশিষ্ট। তবুও তার মধ্যে কিছু প্রতিভাকে আমরা আবার বলি কালোত্তীর্ণ। তারা নিজেদের যুগকে অতিক্রম করে গেছে। এমনকি পরবর্তী কালগুলোর ওপরেও তাদের ছাপ অমলিন থেকেছে। এমনি একটি প্রতিভা ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহমাতুল্লাহে আলাইহি।
তারুণ্যের প্রথম শিহরণ থেকে শুরু করে বার্ধক্যের স্থবিরত্বের মধ্যেও জীবনের শেষ মুহূর্তটি পর্যন্ত তিনি নিজের দায়িত্ব পালন করে গেছেন। ব্যর্থতা ও অপারগতাকে তিনি কোন দিন স্বীকার করে নেননি। যেন এক অথৈ সমুদ্র। তরঙ্গের পর তরঙ্গ আছড়ে পড়ছে। আবার তরঙ্গ আসছে। অফুরন্ত জীবনী শক্তি তার বুকে। ভাবতে অবাক লাগে ইমামও তেমনি যেন এক সমুদ্র। অফুরন্ত তাঁর হৃদয়ের শক্তি, তার যেন শেষ নেই। স্বদেশে, বিদেশে, সফরে, পথে কোথাও অবস্থানকালে এবং কারাগারে অন্তরীণ অবস্থায়ও তাঁর মনের জোর ও কর্মশক্তির অফুরান সম্পদ সে দিনের বিশ্বকে চমকিত করেছিল। সাধারণ মানুষ তাঁর হৃদয়ের সন্ধান পেয়েছিল। তিনি ছিলেন তাদের হৃদয় রাজ্যের শাসক।
যুগের গতিধারাকে তিনি কতটুকু পরিবর্তন করতে সক্ষম হয়েছিলেন? ইসলামকে তার সঠিক রূপে সুপ্রতিষ্ঠিত করার ব্যাপারে তার সাফল্য কতটুকু? রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় তিনি কোন পরিবর্তন সাধনে সক্ষম হয়েছিলেন কিনা? ইমামের ইসলামী পুনরুজ্জীবন প্রচেষ্টার প্রেক্ষিতে এ প্রশ্নগুলি স্বাভাবিকভাবেই এসে যায়। ইসলামের ইতিহাসে ইমামের স্থান নির্ণয়ে এ প্রশ্নগুলো আমাদের সহায়তা করবে।
বিস্তারিত আলোচনার পূর্বে এ প্রসঙ্গে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একটি হাদীস উদ্ধৃত করতে চাই। তিনি বলেছেনঃ
*************আরবী*************
অর্থাৎ আমার উম্মত হচ্ছে বৃষ্টির মতো, বলা যায় না তার প্রথমাংশ ভালো, না শেষাংশ ভালো। ইমাম তিরমিযি হযরত আনাস ইবনে মালিক র.থেকে হাদিসটি বর্ণনা করেছেন। হাদিসটির প্রেক্ষিতে বলা যায়, ইসলামী পুনরুজ্জীবনের কাজে উম্মতের যেসব ব্যক্তি নেতৃত্ব দিয়েছেন তাদের সবার কৃতিত্ব সমান। কিন্তু পরিবেশ পরিস্থিতির কারণে তাদের কারোর কাজ হয়েছে কারোর চাইতে কঠিন। ইমাম ইবনে তাইমিয়া কোন ধরনের পরিবেশ ও পরিস্থিতির মোকাবিলায় এগিয়ে এসেছিলেন। হিজরী সপ্তম শতকের প্রথমার্ধে ইমামের জন্মের পূর্বে তাতারী আক্রমণে মিসর ও সিরিয়া ছাড়া সিন্ধু নদ থেকে নিয়ে ফোরাত নদী পর্যন্ত ইসলামী বিশ্বের সমগ্র ভূভাগ বিধ্বস্ত হয়ে গিয়েছিল। এই এলাকার যেসব মুসলমান বেঁচে ছিল তারা আবাস পরিবর্তন করতে করতে প্রায় একটি যাযাবর জাতিতে পরিণত হয়েছিল। অর্থনৈতিক অবনতির সাথে সাথে তাদের সম্মান ও মর্যাদারও অবনতি ঘটেছিল। জ্ঞান ও শিক্ষা সংস্কৃতির কেন্দ্রগুলোর ধ্বংসের কারণে তারা যথার্থই ধ্বংসের কবলে নিক্ষিপ্ত হয়েছিল। নিরবচ্ছিন্ন আতংক, অশান্তি ও বিশৃংখলা তাদের জাতিসত্তাকে কিংকর্তব্যবিমুঢ় করে দিয়েছিল। যদিও শেষের দিকে অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন হতে শুরু করেছিল অর্থাৎ তাতারীরা ইসলাম গ্রহণে এগিয়ে আসছিল। কিন্তু তাতে মুসলমানদের দুর্গতি কতটুকু কমেছিল? এই তাতারী নও মুসলিম শাসক গণ জাহেলিয়াতের ব্যাপারে অমুসলিম শাসকদের চাইতে কোন অংশে কম ছিল না। তাদের শাসনাধীনে এসে মুসলিম জনগণ, আলে সমাজ, ফকীহ, কাযী ও মাশায়েখগনের নৈতিক চরিত্রের অবনতি ঘটেছিল অনেক বেশি। আলেম সমাজের একটি অংশ জালেমদের খেদমতে নিজেদেরকে সোপর্দ করে দিয়েছিল। (অথচ কুরআনে সুরা আল কাসাস এ আল্লাহ হযরত মুসা আলাইহিস সালামের মুখ দিয়ে একথা ব্যক্ত করেছেনঃ
*************আরবী*************
হে আমার রব!তুমি আমার ওপর যে অনুগ্রহ করেছো তার কারণে আমি কখনো কোন অপরাধী তথা জালেমের সহযোগী হবো না। ) ইজতিহাদ সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল বরং এক অর্থে বলা যায়, গোনাহে পরিণত হয়েছিল। ফিকহ ভিত্তিক মযহাবগুলো এক একটা স্বতন্ত্র দীনে পরিণত হয়েছিল। আল্লামা আবুল আলা মওদূদী রহমাতুল্লাহি আলাইহির মতে তৎকালে অশিক্ষিত ও গোমরাহ জনসাধারণ, দুনিয়া পূজারী ও সংকীর্ণমনা আলেম সমাজ এবং মূর্খ জালেম শাসক শ্রেণীর ত্রয়ী সম্মিলন এমন জোরদার হয়ে ওঠে যে, এই সম্মিলিত জোটের ছুরির নীচে নিজের গলা বাড়িয়ে দেয়ার চাইতে কিছু কম ছিল না। (তাজদীদে এহইয়ায়ে দীন, পৃষ্ঠা ৮১ ষষ্ঠ সংস্করণ, ১৯৫৫ইং লাহোর। )এ প্রেক্ষিতে আমরা বিচার করতে পারি, ইমাম কত বড় ও কত কঠিন কাজ হাতে নিয়েছিলেন। তিনি কেবল কুরআন ও হাদীস সঞ্জাত যথার্থ ও নির্ভুল ইলম চর্চার ধারা পুনঃপ্রবাহিত করেননি বরং এই সঙ্গে নবতর সমস্যাগুলোর সমাধানের জন্য ইজতিহাদের পথও অবলম্বন করেন। তাঁর সংস্কারমূলক কাজগুলোকে আমরা কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করতে পারি।
এক. তিনি গ্রীক দর্শনের কঠোর সমালোচনা করেন। তার সমালোচনার ফলে গ্রীক দর্শনের মুখ থেকে জ্ঞান ও অভ্রান্তির মুখোশ খসে পড়ে এবং তার সব দুর্বলতা সুস্পষ্টভাবে মূর্ত হয়ে ওঠে। মূলত তার সমালোচনার প্রভাবেই পাশ্চাত্যবাসীদেরও দৃষ্টিসীমা থেকে তমসা করে যেতে থাকে এবং তারাও এ দর্শনের সমালোচক হয়ে ওঠে তাঁর অনেক পরে হলেও।
দুই. ইসলামী আকীদা বিশ্বাস বিধি বিধান ও আইনের স্বপক্ষে তিনি শক্তিশালী যুক্তি উত্থাপন করেন। তাঁর যুক্তি ও বক্তব্য ছিল ইসলামের সত্যিকার প্রাণশক্তির ধারক। তিনি গ্রীক পদ্ধতি পরিহার করে সাধারণ জ্ঞানের ওপর নির্ভর করে যুক্তি প্রদর্শনের ভিত্তি স্থাপন করেন। এটিই ছিল কুরআন ও সুন্নাতের নিকটতর পদ্ধতি।
তিন. অন্ধভাবে কোন ইমামের তাকলীদ করার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ উত্থাপন করেই কেবল তিনি ক্ষান্ত হননি বরং এই সঙ্গে নিজে ইজতিহাদ করে দেখিয়েও দিয়েছেন। তিনি কুরআন সুন্নাহ ও সাহাবাদের জীবন থেকে বিভিন্ন প্রমাণ সংগ্রহ করেন এবং বিভিন্ন ফিকহ ভিত্তিক মযহাবগুলোর মতবিরোধের স্বাধীন ও ন্যায়সঙ্গত পর্যালোচনা করে অসংখ্য নতুন নতুন বিষয়ের অবতারণা করেন। এর ফলে ইজতিহাদের নতুন পথ আবিষ্কৃত হয়। এই সঙ্গে তিনি শরীয়তের হিকমত এবং নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আইন প্রণয়ন পদ্ধতির ওপর সুক্ষ গবেষণা কার্য পরিচালনা করেন। তাঁর ফতোয়াগুলো এ ব্যাপারে মিল্লাতের একটি অমূল্য সম্পদ। তাঁর পর যারা ইজতিহাদ করেছেন এবং যারা ভবিষ্যতে করবেন তাদর জন্য তার এ সাহিত্য পথ প্রদর্শকের কাজ করবে।
চার. তিনি বিদআত ও মুশরিকী রীতিনীতির বিরুদ্ধে বলতে গেলে দস্তুরমতো জিহাদ পরিচালনা করেন। এ জন্য মারাত্নক বিপদের সম্মুখীন হন। কিন্তু তার কোন পরোয়াই তিনি করেননি। এ প্রসঙ্গ আলোচনায় আল্লামা আবুল আলা মওদূদী র. বড় চমৎকারভাবে বলেছেন, ইসলামের পরিষ্কার ঝর্ণা ধারায় এ পর্যন্ত যতগুলো অস্বচ্ছ স্রোতের মিশ্রণ ঘটেছিল ইমাম ইবনে তাইমিয়া তার কোন একটিকেও নিষ্কৃতি দেননি। তাদের প্রত্যেকটির বিরুদ্ধে তিনি কঠোর সংগ্রাম চালান এবং প্রত্যেকটিকে ছেঁটে বের করে দিয়ে নির্ভেজাল ইসলামের পদ্ধতিকে পৃথকভাবে দুনিয়ার সামনে পেশ করেন। প্রতিপক্ষ তাঁর বিরুদ্ধে কোন অস্ত্র ব্যবহারে পিছিয়ে থাকেনি। তার বিরুদ্ধে মিথ্যা মোকদ্দমা, হত্যা করার জন্য সশস্ত্র আক্রমণ থেকে শুরু করে রাজরোষে নিক্ষেপ করে তাঁকে কারাগারে পাঠানো পর্যন্ত সব রকমের অস্ত্র ব্যবহার করা হয়। কিন্তু তিনি ধৈর্যের সাথে সব পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। জালেম শাসকের নাংগা তরবারির নীচে তিনি অকুতোভয়ে;দাড়িয়ে যান। শাসকের রক্তচক্ষু হক কথা বলা থেকে তাঁকে এক মুহূর্তের জন্যও ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি।
তাহলে কি নির্দ্বিধায় বলা যায়, যুগের গতিধারাকে তিনি পরিবর্তন করতে পারেননি? মোটেই না। সপ্তম শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত মুসলমানরা যেভাবে চলছিল অষ্টম শতকের প্রথমার্ধে নিঃসন্দেহে সেভাবে চলেনি। মুসলমানদের চলার মধ্যে অনেক পরিবর্তন এসে গিয়েছিল। এখন তারা মর্যাদার সাথে মাথা উঁচু করে চলতে শিখেছিল। তারা নিজেদের জীবনের উদ্দেশ্য খুঁজে পেয়েছিল। এখন ইসলাম ও কুফরীর পার্থক্য তাদের সামনে সুস্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল।
এসবই ছিল বিশেষভাবে একজন আল্লাহর বান্দা একজন মর্দে মুজাহিদেরই কৃতিত্ব। মৃত্যুর পর বিশ্বব্যাপী মিসর থেকে সুদূর চীন পর্যন্ত সমগ্র মুসলিম অধ্যুষিত বিশ্বে তার গায়েবানা জানাজার ব্যবস্থা মুসলমানদের মধ্যে তাঁর বিপুল জনপ্রিয়তাই প্রমাণ করে। আর ইসলামকে সঠিকভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য তিনি কম সংগ্রাম করেননি। প্রচলিত রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় যতদূর সংস্কার সাধন করা সম্ভব তা করার তিনি চেষ্টা করেছেন। এজন্য প্রয়োজনে রাজশক্তির বিরুদ্ধে খড়গহস্ত হয়েছেন আবার কখনো তাদের সাথে সহযোগিতা করেছেন। তবে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধনের প্রচেষ্টা চালানো তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। এমনকি এদিকে অগ্রসর হবার মতো কোন পদক্ষেপও তিনি নিতে পারেননি।
গ্রন্থপঞ্জী
১. তারীখে দাওয়াত ও আযীমাত ১ম খন্ড ও ২য় খন্ড- মাওলানা আবুল হাসান আলী নদবী
২. ইমাম ইবনে তাইমিয়া – শায়খ আবু যোহরা(মিসর)
৩. তরীখে ইসলাম- মওলানা আকবর শাহ নাজীবাবাদী
৪. প্রিচিং অফ ইসলাম – টি, ডবলিউ, আরনলড
৫. মাসিক উর্দু ডাইজেষ্ট লাহোর – ফেব্রুয়ারী,১৯৬৮
৬. মাসিক তর্জুমানুল কুরআন লাহোর – এপ্রিল, ১৯৩৮
৭. ফাতাওয়া ইমাম ইবনে তাইমিয়া
৮. তাজদীদ ও এহ ইয়ায়ে দীন – মওলানা সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী
৯. খিলাফত ও মূলুকীয়্যাত – মওলানা সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী