তাতারীদের অপরিবর্তিত চেহারাঃ ইবনে তাইমিয়ার প্রচেষ্টা
তাতারীদের মধ্যে ইসলাম প্রচারের জন্য বিভিন্ন স্থানে মুসলমানদের গোপন প্রতিষ্ঠান কাজ করে যাচ্ছিল। তাই তাতারীদের ইসলাম গ্রহণের ধারা কখনো বন্ধ হয়ে যায়নি। তবে তার গতি কখনো দ্রুত হচ্ছিল কখনো হয়ে পড়েছিল মন্থর। মুসলমানদের ওপর তাতারীদের প্রথম আক্রমণ হয় ৬১৬ হিজরি সনে। সে আক্রমণ পরিচালনা করেন তাতারী সরদার চেংগীজ খান নিজেই। আর প্রথম তাতারী সম্রাট ইসলাম গ্রহণ করেন ৬৫৬ হিজরি সনে। মাত্র ৪০ বছরের মধ্যে তাতারীরা শত্রুদের ধর্মে দীক্ষিত হতে থাকে।
কিন্তু ইসলাম গ্রহণের সাথে সাথেই তাতারীদের আপাদমস্তক পরিবর্তন হয়ে যায়নি। তারা মুসলমানদের সাথে সব শত্রুতা ভুলে তাদেরকে বন্ধু ও ভাই বলে বুকে জড়িয়ে ধরেনি। অবশ্যই কোথাও কোথাও এর ব্যতিক্রম দেখা যায়। যেমন প্রথম ইসলাম গ্রহণকারী তাতারী সম্রাট বারকা খান ইসলাম গ্রহণের পর মুসলমানদের ওপর আর আক্রমণ করবেন না বলে অঙ্গীকার করেন। কিন্তু সব তাতারী সম্রাট এমন ছিলেন না। ইসলাম গ্রহণের সংগে সংগেই তাদের মধ্যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন শুরু হয়ে যায়নি। যেমন ইরান ও ইরাকের বাদশাহ কাজান ৬৯৪ হিজরি সনে ইসলাম গ্রহণ করেন। ইসলাম গ্রহণ করার পরও মুসলমানদের বিরুদ্ধে তার আক্রোশ ও অভিযান চলতে থাকে। ৬৯৯ হিজরিতে তিনি সিরিয়া আক্রমণ করার প্রস্তুতি নেন। আসলে তাদের জীবন যাপন প্রণালী যে অবস্থায় ছিল তাতে ইসলাম গ্রহণের পর মাত্র চার পাঁচ বছরের মধ্যেই তাদের জীবনে ও চরিত্রে কোন বড় রকমের পরিবর্তন আশা করা মোটেই স্বাভাবিক ছিল না। তাই কাজানের পক্ষে সিরিয়া আক্রমণের প্রস্তুতি নেয়া সম্ভবপর হয়েছিল।
তাতারী সম্রাট কাজানের মুখোমুখি ইবনে তাইমিয়া
তাতারীদের আক্রমণের খবর যখন সিরিয়ায় পৌছলো, সিরিয়ার বিভিন্ন শহর ব্যাপক ভীতির সঞ্চার হলো। তাতারী আক্রমণের ধ্বংসকারিতা সম্পর্কে মুসলমানরা অবহিত ছিল। তাই আশেপাশের বিভিন্ন শহর থেকে লোকেরা রাজধানী দামেস্কের দিকে চলে আসতে লাগলো। দামেস্কের মুসলমানদের মধ্যেও কম ভীতির সঞ্চার হয়নি। কিন্তু সেখানে তখন আল্লাহর এমন একজন মর্দে মুজাহিদ উপস্থিত ছিলেন যার ঈমানী শক্তি মুসলমানদের মর্দা দিলে সাহস যোগাচ্ছিল। তিনি হলেন যুগের শ্রেষ্ঠ আলেম ও মুজাদ্দিদ ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহমাতুল্লাহে আলাইহি।
খবর এল মিসরের বাদশাহ তাঁর বিপুল সেনাবাহিনী নিয়ে দামেস্কের মুসলমানদের সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসছেন। নগরীতে যেন প্রাণের সাড়া জাগলো। মুসলমানরা নতুন উদ্যমে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে লাগলো। ৬৯৯হিজরীর ২৭রবিউল আউয়াল কাজানের সাথে মিসরের সুলতানের সংঘর্ষ হলো। অনেক চেষ্টা করেও এবং অসীম সাহসিকতার সাথে লড়াই করেও মুসলমানরা শেষ রক্ষা করতে পারল না। মুসলমানরা হেরে গেলো। মিসরের সুলতান পরাজিত সেনাবাহিনী নিয়ে কায়রোর পথে রওয়ানা হলেন।
দামেস্কবাসীরা পড়লো মহাসংকটে। তাতারী সেনাদল এবার বিজয়ীর বেশে নগরে প্রবেশ করবে। তারপর নগরবাসীদের ভবিষ্যৎ যে কোন অন্ধকারে তলিয়ে যাবে তা একমাত্র আল্লাহই ভালো জানেন। তাতারী বিভীষিকার কথা চিন্তা করে বড় বড় আলেম ও নেতৃস্থানীয় লোকেরাও শহর ত্যাগ করতে শুরু করলো। শাফেয়ী ও মালেকী কাজী এবং অন্যান্য পরিচিত আলেম ওলামা, সরকারী অফিসার, বড় বড় ব্যবসায়ী এমনকি শহরের গভর্নর নিজেও শহর ত্যাগ করে মিসরের পথে পাড়ি জমালেন। সরকারী কর্মচারীদের মধ্যে কেবলমাত্র দুর্গরক্ষক শহর ত্যাগ করেননি। জনগণের এক অংশও শহর ত্যাগ করেছিল। এদিকে জিনিসপত্রের দামও অস্বাভাবিক বেড়ে গিয়েছিল। বিপদের ওপর আরো একটি বাড়তি বিপদ দামেশকবাসীদের ঘাড়ে সওয়ার হয়েছিল। কয়েদিরা জেলখানা ভেঙ্গে বের হয়ে এসেছিল। সারা শহরে দিনরাত তারা সমানে লুটতরাজ চালিয়ে যাচ্ছিল।
এদিকে কাজানের সেনাদলের দামেস্ক প্রবেশের সময় ঘনিয়ে আসছিল। জনতা উভয় সংকটে পড়ে দিশেহারা হয়ে যাচ্ছিল। এ অবস্থায় ইমাম ইবনে তাইমিয়া এবং শহরের নেতৃস্থানীয় লোকেরা বসে একটা ত্বরিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। তাঁরা সিদ্ধান্ত নিলেন, ইমাম ইবনে তাইমিয়ার নেতৃত্বে নগরবাসীদের একটি প্রতিনিধিদল কাজানের দরবারে উপস্থিত হয়ে নগরবাসীদের জন্য শান্তি ও নিরাপত্তার ফরমান লিখে আনবে। রবিউস সানি মাসের তিন তারিখে মহাপরাক্রমশালী তাতারী সম্রাট কাজানের সামনে হাজির হলেন ইসলামের দূত ইমাম ইবনে তাইমিয়া তাঁর দলবল নিয়ে। ইমাম আদল, ইনসাফ ও ন্যায়নীতি সম্পর্কিত কুরআন হাদিসের উদ্ধৃতি দিয়ে যাচ্ছিলেন কাজানের সামনে। তাঁর আওয়াজ ধীরে ধীরে বুলন্দ ও গুরুগম্ভীর হচ্ছিল। আয়াত ও হাদিস শুনাতে শুনাতে তিনি কাজানের নিকটে, আরো নিকটে চলে যাচ্ছিলেন। এমনকি শেষ পর্যন্ত তাঁর ও কাজানের মাঝখানে এক বিঘতও ফাঁক ছিলনা। কিন্তু সবচাইতে বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, মহাপরাক্রমশালী কাজান এতে মোটেই বিরক্তি বা ক্রোধ প্রকাশ করছিলেন না। বরং তিনি নিবিষ্ট মনে কান লাগিয়ে সব কথা শুনছিলেন। মনে হচ্ছিল ইমাম তাকে সাংঘাতিকভাবে প্রভাবিত করতে পেরেছেন। তিনি লোকদের জিজ্ঞেস করলেন: এ আলেমটি কে? আমি এমন লোক ইতিপূর্বে দেখিনি। এর চাইতে কোন সাহসী ও দৃঢ় সংকল্প ব্যক্তি আজ পর্যন্ত আমার চোখে পড়েনি। আমাকে কেউ তো এমন করে প্রভাবিত করতে পারেনি।
লোকেরা ইমাম ইবনে তাইমিয়া সম্পর্কে তাঁকে জানালো এবং ইমামের ইলম, জ্ঞান ও কার্যাবলী সম্পর্কে তাঁকে অবহিত করলো।
ইমাম ইবনে তাইমিয়া কাজানকে বললেনঃ তুমি নিজেকে মুসলমান বলে দাবী করো। আমি জানতে পেরেছি তোমার সাথে কাজী, শায়খ ও মুয়াজ্জিনরাও আছেন। কিন্তু এসব স্বত্বেও তুমি মুসলমানদের ওপর আক্রমণ করেছো। অথচ তোমার বাপ দাদা কাফের হওয়া স্বত্বেও এ ধরনের কাজ করতে ইতস্তত করতেন। তারা নিজেদের ওয়াদা পালন করেছেন। আর তুমি ওয়াদা ভেঙ্গেছ। তুমি যা কিছু বলেছিলে তা পালন করনি। তুমি আল্লাহর বান্দাদের ওপর জুলুম করেছো।
প্রধান বিচারপতি আবুল আব্বাস ইমামের সঙ্গে ছিলেন। তিনি লিখেছেন: কাজানের মজলিসে তাইমিয়া ও তাঁর সাথিদের সামনে খাবার রাখা হলো। সবাই খেতে লাগলেন কিন্তু ইবনে তাইমিয়া হাত গুটিয়ে নিলেন। খাচ্ছেন না কেন জিজ্ঞেস করা হলে তিনি দৃপ্ত কণ্ঠে জবাব দিলেন: এ খাবার তো হালাল নয়। কারণ গরীব মুসলমানদের থেকে লুঠ করা ভেড়া ও ছাগলের গোশত থেকে এ খাদ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। আর মজলুম মানুষের গাছ থেকে জরবদস্তি কাঠ সংগ্রহ করে এ খাদ্য তৈরি করা হয়েছে। কাজান তাঁকে দোয়া করার আবেদন জানালেন। তিনি দোয়া করতে লাগলেন: হে আল্লাহ! তুমি ভালো জানো, যদি কাজানের এই যুদ্ধের উদ্দেশ্য তোমার কালেমাকে বুলন্দ করা এবং আল্লাহর পথে জিহাদ করাই হয়ে থাকে তাহলে তুমি তাকে সাহায্য করো। আর যদি দুনিয়ার রাজত্ব লাভ এবং লোভ লালসা চরিতার্থ করাই তার উদ্দেশ্য হয়ে থাকে তাহলে তুমিই তার সাথে বোঝাপড়া করো। সবচাইতে আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে এই যে, ইমাম দোয়া করছিলেন আর কাজান আমীন বলে যাচ্ছিলেন।
কাজী আবুল আব্বাস আরো লিখেছেন যে, ইমাম যখন বক্তৃতা দিয়ে যাচ্ছিলেন তখন আমরা সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিলাম এবং নিজেদের জামাকাপড় গুটিয়ে নিচ্ছিলাম কি জানি কখন ইমামের ওপর জল্লাদের তরবারি ঝলসে উঠবে এবং তাঁর রক্তে আমাদের বস্ত্র রঞ্জিত হবে। কাজী সাহেব লিখেছেন: কাজানের দরবার থেকে ফিরে আসার সময় আমরা ইমামকে বললাম, আমরা আপনার সাথে যাবো না। আপনি তো আমাদের সবাইকে মেরে ফেলার ব্যবস্থা করেছিলেন। ইমাম জবাবে বললেন, আমি তোমাদের সাথে যাবোনা। কাজেই আমরা সবাই তাঁকে ছেড়ে চলে এলাম। ইমাম একাই রওয়ানা দিলেন। ইমামের একাকীত্বের খবর শুনে মেয়েরা ঘর থেকে বের হয়ে এলো। বহু নেতৃস্থানীয় লোক তাঁকে সঙ্গ দিল। তিনি তিন চারশো ভক্তকে সঙ্গে নিয়ে রাজার হালে শহরে ফিরে এলেন। আর আমরা রাস্তায় একদল লুটেরার হাতে সর্বস্ব খুইয়ে ঘরে ফিরলাম।
ইমাম ইবনে তাইমিয়া কাজানের দরবার থেকে ফিরে আসেন অত্যন্ত মর্যাদার সঙ্গে। নগরবাসীদের জন্য লিখিয়ে আনেন নিরাপত্তার পরোয়ানা। তাতারীরা যেসব মুসলমানকে বন্দী করেছিল তাদের ছাড়িয়ে আনেন। তাতারীদের বর্বরতার কাহিনী তিনি অনেক শুনেছিলেন। নিজের চোখে দেখেছিলেনও অনেক। কিন্তু সেসব তাঁকে একটুও বিচলিত করতে পারেনি। তাতারী সম্রাটের সাথে মুখোমুখি কথা বলতে এবং তাতারী সেনাদের মধ্যে অবাধে চলাফেরা করতে তিনি একটুও ভীতি অনুভব করেননি। তিনি বলতেন, যার দিলে কোন রোগ আছে একমাত্র সেই গাইরুল্লাহকে ভয় করতে পারে।
তাতারীদের অঙ্গীকার ভঙ্গ ও নির্যাতন
ইমাম নিরাপত্তার পরোয়ানা লিখিয়ে আনলেও নগরবাসীদের মনে স্বস্তি ছিল না। তারা যে ভয় করছিল বাস্তবে হলোও তাই। কিছুদিনের মধ্যে নগরবাসীদের মনের শান্তি উবে গেল। তাতারীরা নগরে প্রবেশ করেনি ঠিকই, কিন্তু নগরের বাইরে তারা ছাউনি করে পড়ে রইলো। শহর প্রাচীরের বাইরের শহর তলীতে তাদের অবাধ লুণ্ঠন ও হত্যা চলতে লাগলো তাতারী সোদের বহুদিনের গড়ে তোলা অভ্যাস হত্যা ও লুটতরাজ ছাড়া যেন তাদের বিজয় সম্পন্ন হতে পারেনা। শহরের বাইরের সমগ্র এলাকাকে দস্তুরমতো একটা যুদ্ধক্ষেত্রই মনে হতো। সশস্ত্র তাতারী সেনারা দল বেঁধে জনপদে ঢুকে পড়েছে। মুসলমানদের বাড়ির মধ্যে ঢুকে লুকোনো সম্পদ বের করে দেবার জন্য গৃহকর্তার হাতে পায়ে বেঁধে বেদম প্রহার চালাচ্ছে। ছোট ছোট চেলে মেয়েদের ধরে ধরে আছাড় মারছে। মেয়েদের কানফাটা চীৎকার কাকুতি মিনতি সব মিলে দামেস্কের মুসলমানদের শান্তি মনে হচ্ছিল চিরদিনের জন্য বিদায় নিয়েছে।
তাতারীদের ঘেরাও ও জুলুম নির্যাতনের কারণে আশেপাশের এলাকা থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির সরবরাহ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ফলে বাজারে জিনিস পত্রের দামে যেন আগুণ লেগেছিল। তার ওপর কড়ি ফেললেও জিনিস পাওয়া যেতোনা। ফলে খাদ্যের অভাবে অনাহারেও লোক মরতে লাগল এর ওপর তাতারীরা আবার নগরবাসীদের কাছে এক অভিনব দাবী করে বসলো। নগরে যত ঘোড়া অস্ত্রশস্ত্র আছে তাদর কাছে এনে জমা দিতে হবে। নগদ টাকা পয়সাও যা কিছু নগরবাসীদের কাছে লুকানো আছে তা সব গোপন কুঠরি থেকে বের করে এনে তাদের হাতে তুলে দিতে হবে।
সাইফুদ্দীন কুবজুক নামে একজন তুর্কী বংশোদ্ভূত নও মুসলিম তাতারীকে তারা নগরের নতুন শাসনকর্তা নিযুক্ত করে নগরে পাঠিয়ে দিল। কুবজুক নগরবাসীদের ওপর একের পর এক চাপ সৃষ্টি করে চললো। এদিকে নগরের ওপর তাতারীদের আধিপত্য পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কেবলমাত্র আরজাওয়াশ দুর্গটি তখনো স্বাধীনভাবে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়েছিল। দুর্গাধিপতি কোনক্রমেই বশ্যতা স্বীকার করতে প্রস্তুত হচ্ছিলেন না। ঐতিহাসিক ইবনে আনিসর লিখেছেন: ইমাম ইবনে তাইমিয়ার নির্দেশই দুর্গাধিপতির মনে সাহস সঞ্চার করেছিল। ইমাম তাঁকে লিখে পাঠিয়েছিলেন, যতক্ষণ কেল্লার একটি ইটও অক্ষত থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত অস্ত্র সংবরণ করবেন না। কেল্লার দরজা কোনক্রমেই তাতারীদের জন্য খুলে দেবেন না। দুর্গাধিপতি শেষ মুহূর্তটি পর্যন্ত এ নির্দেশ মেনে চলেন। ফলে তাতারীরা এ দুর্গটি আর দখল করতে পারেনি।
তাতারী সেনাদের জুলুম নির্যাতন অব্যাহত গতিতে চলতে থাকে। তারা হাজার হাজার মুসলমান নারী পুরুষকে বন্দী করে তাদেরকে গোলাম ও বাদীতে পরিণত করে। একমাত্র সালেহীয়া পল্লীতে তারা চারশো মুসলমানকে হত্যা করে, প্রায় চার হাজারকে গ্রেফতার করে গোলাম ও বাদীতে পরিণত করে, এর মধ্যে অনেক অভিজাত বংশের লোকও ছিল। অনেক বড় বড় পাঠাগারে লুণ্ঠন করে লক্ষ লক্ষ টাকার বই পত্র নামমাত্র মূল্যে বিক্রি করা হয়।
এ অবস্থা দেখে ইবনে তাইমিয়া আর একবার কাজানের সাথে দেখা করতে মনস্থ করলেন। তিনি দলবল নিয়ে রবিউস সানী মাসের ২৫ তারিখে সুলতান কাজানের সাথে সাক্ষাত করতে গেলেন। কিন্তু দুদিন ধরে অপেক্ষা করার পর তাকে সুলতানের সাথে সাক্ষাত করতে দেয়া হলো না। ইত্যবসরে দামেস্কে খবর ছড়িয়ে পড়লো তাতারীরা এবার শহরের মধ্যে প্রবেশ করতে চাচ্ছে। এতদিন তাতারী সৈন্যরা শহর প্রাচীরের বাইরে তাঁবু খাটিয়ে ছিল। এবার তারা শহরের মধ্যে প্রবেশ করবে, এ খবর শুনে শহরবাসীরা ভয় পেয়ে গেল। এতদিন বাঘ শিকারের সামনে বসে তামাসা দেখছিল। এবার যেন শিকারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে চায়। শহরে হৈ চৈ শুরু হয়ে গেলো। লোকেরা নগর ছেড়ে বাইরে চলে যেতে চাইলো। কিন্তু যাবে কোথায়? চারদিকেই তাতারীদের অবরোধ। তাতারীরা কেল্লা জয় করার ব্যবস্থা করতে লাগলো। তারা কেল্লার চারদিকে পরিখা খনন করলো। মিনজানিক বসালো কিল্লার প্রাচীরে পাথর নিক্ষেপ করে ফাটল ধরাবার জন্য। লোকেরা ঘর থেকে বের হওয়া বন্ধ করলো। কারণ তাতারীরা পথেঘাটে কাউকে দেখলেই তাকে ধরে নিয়ে গিয়ে বেগার খাটাতো। তাদেরকে দিয়ে পরিখা খনন করাতো। ইবনে কাসীর তাঁর আলবেদায়া ওয়ান নেহায়া গ্রন্থে লিখেছেন: পথঘাট একেবারে সুনসান হয়ে গেলো। কখনো কখনো পথে ঘাটে এক দুজনকে দেখা যেতো। জামে মসজিদে নামাজিদের সংখ্যা একবারেই কমে গেলো। জুমার নামাযে জামে উমূবীতে (কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ)বড়জোর একটি কাতার পূর্ণ হতো। আর হয়তো দু-চারজন লোক পিছনে থাকতো। যে ব্যক্তি নেহায়েত প্রয়োজনে বাইরে বের হতো সেও তাতারীদের পোশাক পরে নিতো। নিজেরে কাজ চটপট সেরে নিয়ে সে সোজা ঘরে ফিরতো। তবুও মনের মধ্যে সবসময় খটকা রেগে থাকতো, কি জানি হয়তো আর ঘরে ফেরা যাবে না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাতারীরা আর কেল্লা আক্রমণ করলো। কাজান তার সেনাবাহিনী নিয়ে ইরাকের দিকে রওয়ানা দিলেন। সিরিয়ায় রেখে গেলেন নিজের প্রতিনিধি এবং তার অধীনে ষাট হাজার তাতারী সৈন্য। যাবার পথে বলে গেলেন, আমি নিজের প্রতিনিধি ও সেনাদল রেখে যাচ্ছি, আগামী বছর শীতকালে আবার আসবো। সে সময় আমরা সিরিয়ার সাথে মিসরও জয় করে নেবো।
কাজান চলে যাওয়ার পর দ্বিতীয় তাতারী আমীর বুলাই খান দামেস্কের চারপাশে লুটতরাজ শুরু করলো। ফলে কিছুদিনের মধ্যে বিপুল জনসংখ্যা অধ্যুষিত এলাকাগুলো বিরান হয়ে গেলো। বহু মুসলমান ছেলেমেয়ে গোলাম ও বাদীতে পরিণত হলো। দামেস্ক শহর থেকেও সে বহু টাকা পয়সা আদায় করলো। অবস্থা চরম পর্যায়ে পৌছলে ইমাম ইবনে তাইমিয়া বুলাই খানের সেনানিবাসে হাজির হলেন। বন্দীদের মুক্তির ব্যাপারে তার সাথে আলাপ করলেন। বিপুল সংখ্যক বন্ধীকে মুক্ত করে নিয়ে ফিরে এলেন। মুক্তি-লাভকারীদের মধ্যে কেবল মুসলমানই ছিল না, অনেক অমুসলিমও ছিল। একদিন দামেস্কের কেল্লাধিপতির পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হলো, সিরিয়ার সাহায্যের জন্য মিসরীয় সেনাবাহিনী দামেস্কের দিকে এগিয়ে আসছে। এর পরের দিন বুলাই খান তার সেনাবাহিনী নিয়ে শহর ত্যাগ করে চলে গেলো। শহরে আর একটিও তাতারী দেখা গেলো না। এ সময় দামেস্কে কোন দায়িত্বশীল গভর্নর বা শাসক ছিল না। তাতারী হামলায় নগর প্রাচীর স্থানে স্থানে ভেঙ্গে পড়েছিল। আরজাওয়াশ কেল্লার অধিপতি নগরবাসীদেরকে রাতে নিদ্রা না গিয়ে নগর প্রাচীর পাহারা দেবার নির্দেশ দিলেন। লোকদের সাথে সাথে ইবনে তাইমিয়াও রাতের পর রাত ভগ্ন প্রাচীর পাহারা দিয়ে কাটাতে থাকেন। সাতশো হিজরি পর্যন্ত তাতারীদের বিরাট অংশ মুসলমান হয়ে গেলেও মুসলমানদের সাথে তাদের যুদ্ধের সিলসিলা খতম হয়ে যায়নি। আর খতম হয়ে যাওয়াটাও স্বাভাবিক ছিল না। কারণ ইসলামের উন্মেষের সাতশো বছর পর মুসলিম সমাজ যে অবস্থায় এসে পৌঁছেছিল ইসলামের মূলনীতি ও মুসলিম চরিত্রের উন্নততর গুণাবলী সেখানে এমন ব্যাপকভাবে বিকৃত হয়েছিল, যার ফলে একটি নও মুসলিম সমাজের পক্ষে তার প্রতি আকর্ষণ অনুভব করা মোটেই সহজতর ছিল না। ফলে মুসলমানদের থেকে তারা নিজেদেরকে শ্রেষ্ঠ মনে করতো। তারা মনে করতো, মুসলমানদের বর্তমান শাসকদের মুসলমানদের ওপর শাসন কর্তৃত্ব চালাবার কোন অধিকার নেই। বরং সমগ্র মুসলিম এলাকার শাসন কর্তৃত্ব একমাত্র তাতারীদের প্রাপ্য। এটা তাতারীদের দীনি ও ঈমানী অসম্পূর্ণতা ও অপরিপক্বতার প্রমাণ।
সিরিয়ায় তাদের স্বল্পকালীন শাসনও তাদের এ দীনি অসম্পূর্ণতা ও অপরিপক্বতার প্রকাশ ঘটায়। এ সময় তাতারী নও মুসলিম সাইফুদ্দীন কুবজুক চিলেন দামেস্কের শাসক। তিনি নগরে মদ ব্যবসায়ের অবাধ লাইসেন্স দেন। এটি ছিল রাষ্ট্রীয় আয়ের বৃহত্তম উৎস। নগরে মদের প্রচলন ব্যাপকতা লাব করে। অসংখ্য নতুন নতুন মদের দোকান খোলা হয়। নগরের অমুসলিম বাসিন্দারা এ কাজে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।
বেদীনী ও ফিতনা নির্মূলে ইবনে তাইমিয়া
তাতারীদের নগর ছেড়ে চলে যাবার পর গোনাহের এ উৎসগুলো অক্ষত রাখার কোন প্রয়োজনীয়তা মুসলমানরা অনুভব করলো না। অন্যদিকে দামেস্কের সাহায্যের জন্য মিসরীয় সেনাবাহিনীর আগমনের খবরও শোনা যাচ্ছিল। এ অবস্থায় মুসলমানদের হিম্মত আরো বেড়ে যাচ্ছিল। তারা অগ্রসর হয়ে মদের দোকানগুলো আক্রমণ করলো। এ অভিযানে নেতৃত্ব দিলেন ইমাম ইবনে তাইমিয়া। তিনি নিজের ছাত্র ও শুভানুধ্যায়ীদের বিরাট বাহিনী নিয়ে সারা শহর প্রদক্ষিণ করলেন। মদের দোকান দেখলেই তার মধ্যে দলবল নিয়ে ঢুকে পড়তেন। মদের সোরাহী, জগ, কুঁজো, পেয়ালা, পিপে সব ভেঙ্গে বাইরে ফেলে দিতেন। দোকানের সমস্ত মদ নালায় ঢেলে দিতেন। দোকানে যেসব নেশাখোর লোক এবং গুণ্ডাপাণ্ডা থাকতো তাদেরকে ইসলামের নির্দেশ বোঝাতেন, তওবা করাতে এবং প্রয়োজনে শাস্তিও দিতেন। ইমামের এ অভিযানে সারা শহরে বিপুল প্রাণ চাঞ্চল্যের সঞ্চার হয়।
তাতারীদের অবর্তমানে সিরিয়াবাসীরা আর একটি ফিতনা নির্মূল করতে সচেষ্ট হলো। এ ফিতনাটি ছিল সীমান্ত এলাকায়। সীমান্ত এলাকায় কিছু উপজাতি ছিল ইসলাম ও মুসলমানদের ঘোর বিরোধী। এরা মূলত ছিল খৃষ্টান এবং শিয়াদের বাতেনী, ইসমাইলি, দ্রুজী, নুসাইরী প্রভৃতি গোমরাহ ফেরকার অন্তর্ভুক্ত। ৬৯৯ হিজরিতে তাতারীরা যখন সিরিয়ায় প্রবেশ করে তখন এই গোমরাহ উপজাতিরা তাদের সাথে পূর্ণ সহযোগিতা করে এবং মুসলমানদের যতদূর সম্ভব ক্ষতি করতে সক্ষম হয়। তাতারীদের হাতে পরাজিত মুসলিম সেনাবাহিনী সীমান্ত অতিক্রম করে পলায়ন করার সময় তারা পরাজিত ও হতোদ্যম মুসলিম সৈন্যদের পশ্চাদ্ধাবন করে এবং বহু মুসলমান সৈন্য হত্যা করে। তাদের অস্ত্রশস্ত্র ছিনিয়ে নেয়। ঘোড়াগুলো দখল করে। ইতিপূর্বে তারা কখনো মুসলিম সেনাবাহিনীর অনুগত হয়নি। কুরআন ও সুন্নায় বিবৃত আল্লাহর যথার্থ দীন গ্রহণ করতে প্রস্তুত হয়নি। কখনো ইসলামী জীবন যাপন করতেও রাজী হয়নি।
সিরিয়া শত্রু-মুক্ত হবার পর আভ্যন্তরীণ দিক থেকে বিপদের কোন আশংকাই থাকলো না। এ অবস্থায় ইমাম ইবনে তাইমিয়া মনে করলেন, ইসলাম ও মুসলমানদের চিরকালের শত্রু এই গোমরাহ সীমান্ত উপজাতিদেরকে দমন করা এবং তাদেরকে দীনের শিক্ষাদান করা উচিত। মূলত এ সময় দামেস্ক শহরে সরকারী প্রশাসন বলতে কিছুই ছিল না। কাজেই ইমাম ইবনে তাইমিয়া ও তাঁর দলবল ইচ্ছামতো বিভিন্ন কাজ করতে পারছিলেন। তাঁরা শুনলেন মিসরের সুলতানের সহকারী জামাল উদ্দীন আকুশ কিছু সংখ্যক সৈন্য নিয়ে সীমান্তের পার্বত্য এলাকার দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। ইমাম এ সুযোগ হাতছাড়া করা সমীচীন মনে করলেন না। তিনি হুয়ান এলাকার যোদ্ধা অধিবাসী ও স্বেচ্ছাসেবকদের বিরাট বাহিনী নিয়ে জামাল উদ্দীনের সাথে মিলিত হলেন। মিসর সুলতানের সহারীর উপস্থিতির খবর শুনে গোমরাহ উপজাতিরা দলে দলে ইবনে তাইমিয়ার কাচে হাজির হতে থাকলো। ইমাম তাদের তওবা করালেন। তাদের যথার্থ ইসলামের শিক্ষা দিলেন। এতে অনেক উপকার হলো। ইতিপূর্বে মুসল মান সৈন্যদের নিকট তেকে তারা যা কিছু ছিনিয়ে নিয়েছিল তা ফেরত দেবার ওয়াদা করলো। বায়তুলমালের পক্ষ থেকে এজন্য তাদর ওপর বিপুল পরিমাণ অর্থ ধার্য করা হলো এবং তারা তা আদায় করার দায়িত্ব গ্রহণ করলো।