৮.
বাংলায় মুসলিম নবজাগরণ
‘ভেতর থেকে সংস্কার’
সিপাহী বিপ্লবোত্তর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ইঙ্গ-হিন্দু দ্বিমুখী সাঁড়াশী হামলার শিকার মুসলমানদের আপহীন মুক্তিসংগ্রামের জিহাদী কাফেলা বহু আত্মদান সত্ত্বেও ক্রমশ পিছু হটতে থাকে। এই নতুন প্রেক্ষাপটে ধ্বংসোন্মুখ মুসলমানদের রক্ষার জন্য নতুন নেতৃত্বের উদ্ভব হয়। ১৮৬৩ সালের ২ এপ্রিল ফরিদপুরের নওয়াব আবদুল লতিফ কলকাতায় ‘মোহামেডান লিটারারী সোসাইটি’ গঠন করেন। ১৮৬৪ সালে সৈয়দ আহমদ খানের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘গাজীপুর ট্রান্সলেশন সোসাইটি’। এটি পরে ‘আলীগড় সায়েন্টিফিক সোসাইটি’ নাম ধারণ করে। ১৮৭৭ সালে সৈয়দ আমীর আলী কায়েম করেন ‘সেন্ট্রাল ন্যাশনাল মোহামেডান এসোসিয়েশন’।
জিহাদ আন্দোলনের অন্যতম নেতা মওলানা কারামত আলী জৌনপুরীও এ সময় ধ্বংসোন্মুখ মুসলমানদের আপসহীন সশস্ত্র লড়াই থেকে নিবৃত্ত করার লক্ষ্যে তাদের মধ্যে ‘ভেতর থেকে সংস্কার’ তথা অন্তর্বিপ্লবের কর্মসূচি ঘোষণা করেন। ১৮৬৭ সালে তিনি জিহাদ আন্দোলনের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। ১৮৭০ সালে নওয়াব আবদুল লতিফের ‘মোহামেডান লিটারারী সোসাইটি’র এক সভামঞ্চ থেকে তিনি ঘোষণা করেন যে, ইংরেজ কবলিত ভারত ‘দারুল হরব’ নয়।
তাঁর এই ফতওয়া দীর্ঘদিন পর্যন্ত মুসলমানদের মাঝে বাহাস-বিতর্ক জিইয়ে রাখলেও জনযুদ্ধের ইতিহাসের সর্বাপেক্ষা তাৎপর্যপূর্ণ মোড় পরিবর্তনের সূচনা হয়। এ সময় বাংলার সনাতনপন্হি এবং জিহাদী ও ফরায়েজীদের মধ্যে বৃহত্তর সমঝোতার ক্ষেত্র রচনায় জামালউদ্দীন আফগানীর (১৮৩৮-৯৭) ‘প্যান ইসলামাবাদ’ বিশেষ অবদান রাখে।
নওয়াব আবদুল লতিফ, সৈয়দ আহমদ খান ও সৈয়দ আমীর আলী ইংরেজদের সাথে নমনীয় নীতি অবলম্বনের মাধ্যমে অধঃপতিত মুসলমানদের অধিকার ও ন্যায্যা হিস্যা আদায়ের নীতিগ্রহণ করেন। হিন্দু জাতীয়তাবাদী উত্থানের প্রবল জোয়ারের বিপরীত ধারায় দাঁড়িয়ে এই তিন কান্ডারীর নেতৃত্বেই এ সময় বিপর্যস্ত মুসলমানদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার আদায় এবং সাংস্কৃতিক অধিকার ও স্বাতন্ত্র্য সুরক্ষার আন্দোলন দানা বেঁধে ওঠে। মুসলমানদের স্বকীয় সত্তা, তাদের বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত কৃষ্টি ও ঐতিহ্যের স্বতন্ত্র প্রেরণাকে উপজীব্য করে মুসলিম জাগরণের লক্ষ্যে শিক্ষিত ও তুলনামূলকভাবে অবস্থাপন্ন মুসলিম পরিবারগুলো আলেম সমাজের আন্দোলনমুখী কার্যক্রমের সাথে যোগদান করেন। তাঁরা নতুনভাবে সংগঠিত এই আন্দোলনের মধ্যে মুসলিম জনগণকে রাজনৈতিকভাবে উদ্বদ্ধ, জাগ্রত ও সংগঠিত করার এবং হিন্দু এলিটদের বিরুদ্দে সংগ্রাম পরিচালনার এক সম্ভাবনাময় শক্তির সন্ধান পান। ঢাকা, কলকাতা, হুগলীও চট্টগ্রামের সদ্র প্রতিষ্ঠিত উচ্চতর মাদরাসা থেকে বেরিয়ে আসা গ্র্যাজুয়েটগণ এবং দেওবন্দী আলেমগণ বাংলার মুসলিম গণজাগরণে এ সময় মুখ্য ভূমিকায় এগিয়ে আসতে থাকেন।
এ সময় মুসলমানদের বহু নতুন মাদরাসা গড়ে ওঠে এবং আলেমগণ ধর্মীয় পুস্তক রচনা ও মাহফিলে বক্তৃতার মাধ্যমে জনগণকে উদ্বদ্দ করতে থাকেন। নসিহতনামা জাতীয় বই-পুস্তক ছাড়াও প্রকাশিত হতে থাকে জাতীয় জাগরণমূলক বইপত্র। খ্রিস্টান মিশনারীদের ব্যাপকক তৎপরতা মোকাবিলার জন্য ‘ইসলাম মিশন ফান্ড’ গঠন করা হয়। এ সময় বিশেষত ফুরফুরার পীর সাহেবের অনুপ্রেরণায় মুসলমানদের কয়েকটি পত্র-পত্রিকা প্রকাশিত হয়।
খ্রিস্টান মিশনারী তৎপরতার বিরুদ্ধে সর্বাপেক্ষা উল্লেখোগ্য ভূমিকা পালনকারী যশোরের মুনশী মেহেরউল্লাহ (১৮৬১-১৯০৭) বইপত্র রচনা, সংগঠন কায়েম, পত্র-পত্রিকা প্রকাশ এবং বিশেষভাবে এদেশে শান্তিপুর্ণ ধর্মীয় সমাবেশরূপে ওয়াজ মাহফিলকে ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় করে তোলেন। বিশ শতকের গোড়ার দিকে এসে প্রচারক ও রাজনীতিকদের কাছে এই মাহফিল সম্মেলনের গুরুত্ব উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়। এ চমৎকার জনসংযোগ মাধ্যম ব্যবহারের মধ্য দিয়ে শিক্ষার পশ্চাতপদ জনগণের কাছে আন্দোলনের বাণী দ্রুত পৌঁছিয়ে দেওয়া সম্ভব হয়। জনগণের মধ্যে ব্যাপক সাড়া সৃষ্টি হওয়ার ফলে বিভিন্ন আঞ্জুমান ও মক্তব-মাদরাসা প্রতিষ্ঠার সংখ্যা বৃদ্ধি পায় এবং মসজিদগুলোতে মুসল্লিদের সংখ্যা বেড়তে থাকে। এভাবে মুসলিম সমাজ সমস্বার্ত ও অভিন্ন আদর্শের পথ ধরে আত্ম পরিচয়ে উদ্বদ্ধু হতে থাকে এবং তাদের মধ্যে ক্রমশ জাতিগত ঐক্য-চেতনা দানা বেঁধে ওঠে। ড. রফিউদ্দীন আহমদের ভাষায়ঃ
“By 1905 the building blocks which eventually went into the making of Pakistan were already there.” (The Bengal Muslims, 1871-1906)
মুসলিম সাংবাদিকতা ও স্বাতন্ত্র্য চেতনা
আবুল কালাম শামসুদ্দীন লিখেছেনঃ
“বাঙালি মুসলমান কর্তৃক সংবাদপত্র প্রকাশের সত্যিকার চেষ্টা হয় সম্ভবত ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দে। তখন কয়েকজন উদ্যমশীল মুসলমান সাহিত্যিকের আবির্ভাব হয় যাঁদের সমাজ হিতৈষণা মুসলিম বাংলার ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। এই সমাজপ্রাণ ও সাহিত্যিকগোষ্ঠী হচ্ছেন মুন্সী মোহাম্মদ রিয়াজউদ্দীন আহমদ, পণ্ডিত রিয়াজউদ্দীন মাশহাদী, মৌলভী মেরাজউদ্দীন, মুন্সী মোহাম্মদ মেহেরউল্লাহ, মীর্জা মোহাম্মদ ইউসুফ আলী, শেখ আবদুর রহীম এবং শান্তিপুরের কবি মোজাম্মেল হক। বাংলার মুসলমানের দুঃখ-দৈন্য অভাব-অভিযোগ এঁদের প্রাণে একটা তীব্র জ্বালার সৃষ্টি করছিল। এঁরা বুঝতে পারেন, বাংলার মুসলমানের অভাব-অভিযোগ, দুঃখ-বেদনা ব্যক্ত করার জন্য চাই তার একটা বাংলা সাপ্তাহিক মুখপত্র। এঁদেরই চেষ্টায় ‘সুধাকর’ প্রকাশিত হয়। মুন্সী মোহাম্মদ রিয়াজউদ্দীন আহমদ এই সাপ্তাহিক পত্রের সম্পাদক পদে বরিত হন”। (দৃষ্টিকোন, পৃষ্ঠা ১৬৯)
এই উদ্ধৃতি থেকেই তখনকার দিনের মুসলমানদের একটা সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশের প্রয়োজনীয়তা এবং সাধ্যের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কেও আন্দায করা যায়। এর আগে বাংলার মুসলানদের বাংলা-ফারসি দ্বি-ভাষিক প্রথম সাময়িকপত্র প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৩১ সালের মার্চ মাসে, স্বল্পকালের জন্য। সময়ের বিস্তর ব্যবধানে ১৮৭৭ সালে প্রকাশিত হয় উর্দু-বাংলা দ্বি-ভাষিক সাময়িকপত্র ‘মোহাম্মদী আখবার’। ১৮৭৪ সালে বাংলা সাময়িকপত্র ‘আজিজন নেহার’, ১৮৮১ সালে ‘নব সুধাকর’, ১৮৮৪ সালে ‘মুসলমান’, ১৮৮৫ সালে ‘মুসলমান বন্ধু’ ও ‘ইসলাম’, ১৮৮৬ সালে ‘আহমদী’, প্রকাশিত হয়। এসবই ছিল অত্যন্ত স্বল্পায়ু পত্রিকা।
১৮৮৯ সালে সাপ্তাহিক ‘সুধাকর’ প্রকাশের পর ১৮৯০ সালে মীর মশারফ হোসেন প্রকাশ করেন পাক্ষিক ‘হিতকারী’। ১৮৯১ সালে প্রকাশিত হয় ‘ইসলাম প্রচারক’, ১৮৯২ সালে ‘মিহির’ ও ‘হাফেজ’। ১৮৯৪ সালে শেখ আবদুর রহীমের ‘মিহির’ এবং শেখ মোহাম্মদ রিয়াজউদ্দীন আহমদ-এর ‘সুধাকর’ যুক্ত হয়ে যৌথ সম্পাদনায় ‘মিহির’ ও সুধাকর’ নামে ১৯১০ সাল পর্যন্ত প্রকাশিত হয়। ১৮৯৮ সালে ‘কোহিনূর’, ১৮৯৯ সালে ‘ইসলাম’, ১৯০০ সালে ‘নূর অল ইমান’, ১৯০১ সালে ‘মুসলমান’ পত্রিকা প্রকাশিত হয়। এভাবে বাংলা চৌদ্দ শতকের একেবারে সূচনালগ্ন থেকেই বলা চলে বাংলার মুসলমান পরিচালিত ও সম্পাদিত সাময়িকপত্র ও সংবাদপত্র প্রকাশের সূচনা হয়। এরপর বহু সাপ্তাহিক, পাক্ষিক, মাসিক ও ত্রৈমাসিক পত্র-পত্রিকার জন্ম হয়। এ সময় থেকে কুড়ি শতকের ত্রিশের দশকের ভিতর প্রকাশিত পত্র-পত্রিকার মধ্যে ১৯২৬ সালে প্রকাশিত ‘সওগত’ এবং ১৯২৭ সালে প্রকাশিত ‘মোহাম্মদী’ স্থায়িত্ব ও ভূমিকার বলিষ্ঠতার বিবেচনায় সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য। অধঃপতিত মুসলমানদের অবস্থার উন্নয়ন তথা বাংলার মুসলমানদের নবজাগরণ ছিল এ সময়কার সকল পত্র-পত্রিকার মূল কথা।
হিন্দু পুনরুজ্জীনবাদী আন্দোলনের পটভূমিতে প্যান-ইসলামী আদর্শের প্রবক্তা ছিল এ সকল পত্র-পত্রিকা। সাধারণভাবে মুসলমানদের মাঝে ইতিহাস-ঐতিহ্যের ব্যাপারে সচেতনতা সৃষ্টি, মুসলিম স্বাতন্ত্র্য ও শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা প্রচার,ইসলামী আন্তর্জাতিকতা বা উম্মাহ-ধারণার প্রচার, তুর্কী খিলাফতের প্রতি আনুগত্য, ইতিহাস, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় মুসলিম অবদানের মহিমা প্রচার, ইংরেজ ও বর্ণ-হিন্দুদের প্রচার মাধ্যমে সমাজের দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করে তার প্রতিকারের উপায় অনুসন্ধান, শিরক-বিদআত-কুসংস্কার দূর করে শরীআতের অনুশাসনের ভিত্তিতে সকল প্রকার আলস্য ও জড়তা কাটিয়ে নতুন হিম্মতে জেগে ওঠার আহবান প্রচার প্রভৃতি বিষয় ছিল এ সকল পত্র-পত্রিকার প্রধান উপজীব্য। বিজাতীয় সাংস্কৃতির আগ্রাসন প্রতিরোধ এবং নিজস্ব তাহযীব-তমদ্দুনের বিকাশ সাধন ছিল এ সকল পত্র-পত্রিকার একটি সুচিহ্নিত বিশেষ লক্ষ্য। এমনকি পরবর্তীকালের ‘শিখা’‘সাম্যবাদী’, ‘জয়তী’ প্রভৃতি পত্রিকার অন্তরের বাণীও ছিল মুসলিম সংস্কৃতিভিত্তিক স্বাতন্ত্র্য চেতনা। তাদের বক্তব্যও ছিল ইসলামের সাথে সঙ্গতি-সন্ধানে প্রয়াসী।
তৎকালীন মুসলিম বাংলার সাময়িকপত্র সম্পর্কে ডক্টর আনিসুজ্জামান লিখেছেনঃ
“যে চেতনা ইতিহাস চর্চার মূলে ক্রিয়াশীল ছিল, সমাজ সংস্কার চেষ্টার মূলে প্রেরণাস্বরূপ ছিল, তুরস্কের প্রতি অসামান্য প্রীতির উদ্বোধন করেছিল, সে চেতনা স্বাভাবতই এক ধরনের স্বাতন্ত্র্যবোধের সৃষ্টি করেছিল”। (মুসলিম বাংলার সাময়িকপত্র, পৃষ্ঠা ৪০)
মুসলিম বাংলা সাময়িকপত্র প্রকাশের প্রথম দশকগুলোতে সাংবাদিকতার সাথে যারা যুক্ত হয়েছিলেন, তাঁরা মূলত সাহিত্যিক, সমাজ সংস্কারক ও সংস্কৃতিসেবী। অধঃপতিত অনগ্রসর মুসলমানদের অবস্থা লক্ষ্য করে সমাজ সংস্কার এবং মুসলিম জাগরণ ও স্বাধীনতার প্রেরণা সৃষ্টির লক্ষ্যে তাঁরা এ কঠিন সাধনায় অংশ নিয়েছেন। তাঁদের আর্থিক স্বচ্ছলতা ছিল না। জাতির প্রতি অকৃত্রিম দায়িত্ববোধ তাঁদেরকে আর্থিক অনটনের মধ্যে পত্রিকার একেকটি সংখ্যা প্রকাশ করতে অনুপ্রাণিত করেছে। তাঁরা সকলেই যে যুগান্তকারী সৃজনধর্মী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন, এমনও নয়। স্ব-সমাজের প্রতি অকৃত্রিম দরদ ও সহমর্মিতা এবং অধঃপতিত জাতিকে জাগিয়ে তোলার প্রেরণাই সংবাদপত্রের সেবায় নিয়োজিত হতে তাদেরকে উদ্বদ্ধ করেছে। পেশাদারী সাংবাদিকতা কিংবা সংবাদপত্রকে শিল্পরূপে বিকশিত করার ধারণাও তখন সৃষ্টি হয়নি। সকল কিছুর ঊর্ধ্বে তাদের জীবন-মিশন ছিল কর্দমে প্রোথিত মুসলিম জাতির জাগরণ। সেকালের অন্য সকল মুসলিম সাহিত্যিকের প্রবন্ধ রচনার মূলেও কাজ করেছে এই অভিন্ন প্রেরণা।
সাময়িক পত্র-পত্রিকা প্রকাশের এই বাধা-সংকুল পথ ধরেই দুই দশক পর ১৯০৯ সালে আবদুল গফুর সিদ্দিকীর সম্পাদনায় মুসলিম বাঙালার প্রথম দৈনিক সংবাদপত্র ‘হাবলুল মতীন’ প্রকাশিত হয়। মুফাফঅর আহমদ, কাজী নজরুল ইসলাম ও ফজলুল হক সেলবার্ষী ১৯১৯ সালে প্রকাশ করেন ‘নবযুগ’। এর পর দৈনিক সেবক, দৈনিক মোহাম্মদী, দৈনিক সুলতান’ দৈনিক তরক্কী’ দৈনিক কৃষক মুসলিম সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়। এসব পত্রিকার মধ্যে ১৯৩৬ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘আজাদ’ ছাড়া সবকটি দৈনিক সংবাদপত্রই ছিল স্বল্পস্থায়ী। আজাদ থেকেই বাংলায় মুসলিম দৈনিকের স্থায়ী প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়েছে।
আবুল কালাম শামসুদ্দিন লিখেছেনঃ
“মুন্সী মোহাম্মদ রিয়াউদ্দীন আহমদ ও শেখ আবদুর রহীম নিঃসন্দেহে বাংলার মুসলিম সাংবাদিকতার পাইওনীয়র, কিন্তু সংবাদপত্রকে সাহিত্যের পর্যায়ে উন্নীত করেছেন এবং তার মারফতে মুসলিম বাংলাকে চিন্তার খোরাক যোগাতে শুরু করেন প্রধানত মাওলানা মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, মাওলানা আকরাম খাঁ এবং মওলবী মুজীবুর রহমান মুসলিম সাংবাদিকতাকে শুধু যে চিন্তা, আদর্শ-নিষ্ঠা ও নির্ভিকতায় মণ্ডিত করেন, তা নয়, তাঁরা একে বাংলায় শ্রদ্ধেয় করে তোলেন। বাংলার সংবাদপত্র-ক্ষেত্রে কারুর পক্ষেই মুসলমানদেরকে যে আর উপেক্ষা করার উপায় নাই, এদেরই সাধনায় তা বাস্তবে সম্ভব হয়ে উঠল”। (দৃষ্টিকোণ, পৃষ্ঠা ১৭৪)
জাতিগত ঐক্য-চেতনার জন্ম
উনিশ শতকের শেষ ও কুড়ি শতকের প্রথম বছরগুলোতে আলেম সমাজ ও নব্য শিক্ষিত শ্রেণীর মিলিত চেষ্টার মধ্য দিয়ে বাংলায় মুসলিম জাগরণের আভাস স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আলেম সমাজের সাথে নব্য শিক্ষিত মুসলমানগণ ধর্মীয় সংস্কার ও মুসলমানদের সামাজিক জাগরণ প্রচেষ্টায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে থাকেন। এই সময়ের মুসলমানদের জাগরণ প্রয়াসের বৈশিষ্ট্যগুলো হলোঃ
ক. মুসলিম সমাজে পরস্পরবিরোধী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে বিরোধ ও বাহাস-বিতণ্ডা প্রশমিত হয় এবং পারস্পরিক নির্ভরতা ও সহযোগিতার ক্ষেত্র প্রসারিত হয়।
খ. গ্রামীণ মুসলমানগণ বিচ্ছিন্নতা কাটিয়ে সামাজিক ও রাজনৈতিক সংযোগধারায় মিলিত হতে শুরু করেন।
গ. মুসলমানদের রাজনৈতিক ও দীনী সচেতনতা বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে বহু নতুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সমাজকল্যাণ সংগঠন ও আঞ্জুমান কায়েম হয়।
ঘ. বিপুলসংখ্যক নসিহতমূলক, ধর্মীয় সংস্কারমূলক, ইতিহাস ও ঐতিহ্যধর্মী, আত্মপ্রত্যয় ও আত্মগৌরবমূলক এবং জাতিসত্তা-উদ্দীপক বই-পত্র রচিত ও প্রকাশিত হয়।
ঙ. মুসলমানদের আশা ও আকাঙ্ক্ষার কথা তুলে ধরার জন্য বাংলা ভাষায় এ সময় মুসলিম সম্পাদিত অনেক পত্র-পত্রিকা প্রকাশিত হয়।
চ. এ সময়ই শান্তিপূর্ণ ধর্মীয় সম্মেলনরূপে ওয়াজ মাহফিল ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে এবং জনগণকে রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে উদ্বুদ্ধ ও সংগঠিত করতে এসব মাহফিল অবদান রাখে।
তখনকার মুসলমানদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক রাজনৈতিক জীবনে সংঘাত ও বিরোধের বহু উপাদানের উপস্থিতি সত্ত্বেও উনিশ শতকের শেষ বছরগুলোতে তাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্বার্থের দু’টি ধারা জাতিগত ঐক্যচেতনার ভিত্তিতে অভিন্ন রাজনৈতিক লক্ষ্যে পরিচালিত হতে শুরু করে। ১৯০৫ সালের মধ্যে তা একটি পরিণত পর্যায়ে উপনীত হয়।