১৪.
বাংলাদেশঃ আমাদের মিলিত সংগ্রাম
বাংলাদেশী শাসকদের সামনে পাকিস্তানের মতো জাতিগঠনের দুরতিক্রম্য বাধা নেই। ভারতের মতো বহুজাতিক দেশ না হওয়ায় এবং শ্রীলংকা বা মালয়েশিয়ার মতো ব্যুৎপত্তিগত সমস্যা না থাকায় এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সুবিধা বেশি। কিন্তু বাংলাদেশের শাসকদের চারটি মৌলিক ভুলের কারণে স্বাধীনতার পরপরই এখানে কতকগুলো সমস্যা সৃষ্টি হয়।
প্রথমতঃ জাতীয় ভাবমুর্তি বা National Image প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে জনগণের ইতহাস, ঐতিহ্য, বিশ্বাস ও অনুভূতিকে অস্বীকারের চেষ্টা করা হয়।
দ্বিতীয়তঃ জাতীয় ঐক্যের অভিন্ন সূত্রগুলো খুঁজে বের করে সেই সূত্রে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করার পরিবর্তে বিভেদাত্মক নীতি অনুসরণ করা হয়।
চতুর্থতঃ দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব সুসংহত করতে যথার্থ ভূমিকা পালনে ব্যর্থতার পরিচয় দেওয়া হয়।
জাতি-স্বাতন্ত্র্য প্রশ্নে সাময়িক বিভ্রান্তি
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরপরই বাংলার মুসলমানদের ঐতিহ্যবাহী সংগ্রামের দীর্ঘ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে অর্জিত নিজস্ব বোধ, বিশ্বাস এবং জাতিগত চেতনা ও প্রেরণার ধারাটি পাল্টে দেওয়ার জন্য জীবন থেকে নিজস্ব সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যসমূহ মুছে ফেলার বা জোর করে উৎখাত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়।
১৯৭১ সালের স্বাধীনতার পর প্রথম ঈদুল আযহার প্রাক্কালে কোরবানীর বিরুদ্ধে একশ্রেণীর হঠাৎ রং পাল্টানো বুদ্ধিজীবীর বিবৃতি প্রচার করা হয়। স্বাধীনতা যুদ্ধের নয় মাস স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে কুরআনের বানী প্রচার করে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করা হলেও স্বাধীনতার পর ‘বাংলাদেশ বেতারে’‘কুরআন তিলাওয়াত’, ‘আসসালামু আলাইকুম’‘খোদা হাফেজ’ প্রভৃতি বন্ধ করে দেওয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রাবাসগুলোর নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দ বাদ দেওয়া হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোগ্রাম এবং শিক্ষা বোর্ডের মনোগ্রাম থেকে কুরআনের আয়াত মুছে ফেলা হয়। সেখানে এ এলাকার জনগণের বোধ-বিশ্বাসের বিপরীত ‘মঙ্গর প্রদীপ’ প্রতিস্থাপন করা হয়। হাজী মুহাম্মদ মুহসিনের দানের টাকায় প্রতিষ্ঠিত ইসলামিয়া ইন্টারিমিডিয়েট কলেজের নাম পরির্তন করে রাখ হয় কাজী নজরুল কলেজ। সীমাহীন হীনমন্যতার কারণে এই পরিবর্তনের সময় অর্থের তোয়াক্কা না করে কবি নজরুলের নামের শেষাংশের ‘ইসলাম’ শব্দটিও বাদ দেওয়া হয়।
ইসলামের প্রতি অসহিষ্ণু একটি দৃষ্টিভঙ্গি হঠাৎ করেই এমনভাবে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে যে, ‘দৈনিক পূর্বদেশে’র এক উপ-সম্পাদকীয় নিবন্ধে সে সময়ে জুমুআর খুতবা ও নামাযশেষে মুনাজাতে ‘সাম্প্রদায়িক’ বক্তব্য রাখার অভিযোগ করা হয়। আযানের সময় কথাবার্তা বন্ধ রাখার ঐতিহ্য এখানে দীর্ঘ দিনের। অথচ স্বাধীনতার পরপর বিভিন্ন জনসভায় বক্তৃতা চলাকালে মসজিদে আযান দিতে গিয়ে মুয়াজ্জিনগণ বাধাপ্রাপ্ত হন। বিভ্রান্তির সে চোরাবালিতে দাঁড়িয়েই দাউদ হায়দার রচনা করে মহাবনী (স)-এর বিরুদ্ধে এক চরম ঔদ্ধত্যপূর্ণ কবিতা। যে দেশের মুক্তিযোদ্ধারা ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনি দিয়ে শক্রর বিরুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েছে এবং তাদের মা-বোন তাদের সাফল্যের জন্য রোযা রেখে নামায পড়ে দোয়া করেছে, এসব ঘটনা সেই জনগণের মধ্যে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে।
সাম্প্রদায়িকতা নির্মূলের নামে এভাবে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর আবেগ-অনুভূতির প্রতি এবং তাদের সত্তার গভীরে প্রোথিত বিশ্বাস ও মূল্যবোধের প্রতি আঘাত দেওয়ার ফলে সৃষ্টি হয় জনমনে বিভ্রান্তি। দ্বাদশ শতকের সেন শাসিত বাংলাদেশে বৌদ্ধ-সভ্যতা নির্মূলের জন্য যে ব্রাহ্মণ্যবাদী আর্য আগ্রাসন চালানো হয়েছিল, কুড়ি শতকের বাংলাদেশের এসব ঘটনা মুসলিম সভ্যতা নির্মূলের জন্য তেমনি আরেকটি অভিযানের আলামত মনে করে জনচিত্ত দারুণভাবে আলোড়িত হলো।
তখনকার অবস্থা সম্পর্কে বাংলাদেশের ‘এল্ডার স্টেটসম্যান’ আবুল মনসুর আহমদ লিখেছেনঃ
“(শাসকদের) মধ্যে এমন ধারণাও সৃষ্টি হইয়াছিল যে, নিজেদের ‘মুসলমান’ ও নিজের রাষ্ট্রকে ‘মুসলিম রাষ্ট্র’ বলিলে সাধারণভাবে হিন্দুরা এবং বিশেষভাবে ভারত সরকার অসন্তুষ্ট হইবেন। এ ধারণা যে সত্য ছিল না, তা বুঝিতে যে রাজনৈতিক চেতনা ও অভিজ্ঞতা থাকা দরকার, তরুণ আওয়ামী নেতা ও মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেরই তা ছিল না। ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী শ্রীজগজীবন রাম বাংলাদেশকে মুসলিম রাষ্ট্র আখ্যা দিয়া যে সদিচ্ছা প্রণোদিত প্রশংসা করিয়াছিলেন (১৯৭১ সালের ১৮ ডিসেম্বর দিল্লীর রামলীলা ময়দানে), অতি উৎসাহী ধর্মনিরপেক্ষ একজন অফিসার সে প্রশংসা প্রত্যাখ্যান করিয়া ছিলেন, সে হীনমন্যতা হইতেই। আমাদের রেডিও টেলিভিশন হইতে কোরআন তেলাওয়াত, আসসালামু আলাইকুম ও খোদা হাফেজ বিতাড়িত হইয়াছিল এবং ওসবের স্থান দখল করিয়াছিল সুপ্রভাত, শুভসন্ধ্যা ও শুভরাত্রি এই কারণেই। বাংলাদেশের জনসাধারণ আমাদের স্বাধীনতার এই রূপ দেখিয়া চমকিয়া উঠিয়াছিল এমন পরিবেশেই”। (আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর, পৃষ্ঠা ৫৮৮)
বাংলাদেশের স্বাধীনতায় দ্বিজাতিতত্ত্ব মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে, এই প্রচারণাকে ‘সাংঘাতিক মারাত্মক বিভ্রান্তি’ আখ্যা দিয়ে আবুল মনসুর আহমদ লিখেছেনঃ
“বাংলাদেশের স্বাধীনতায় পাকিস্তানও ভাঙ্গে নাই, ‘দ্বিজাতিতত্ত্ব’ ও মিথ্যা হয় নাই। এক পাকিস্তানের জায়গায় লাহোর প্রস্তাব মত দুই ‘পাকিস্তান’ হইয়াছে। লাহের প্রস্তাবে ‘পাকিস্তান’ শব্দটার উল্লেখ নাই, শুধু ‘মুসলিম মেজরিটি রাষ্ট্রের’ উল্লেখ আছে। তার মানে রাষ্ট্র-নাম পরে জনগণের দ্বারাই নির্ধারিত হওয়ার কথা। পশ্চিমা জনগণ তাদের রাষ্ট্রের নাম রাখিয়াছে ‘পাকিস্তান’। আমরা পুরবীরা রাখিয়াছি বাংলাদেশ। এতে বিভ্রান্তির কোন কারণ নাই”। (পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৬১৭)
‘সাংঘাতিক মারাত্মক’ এই ‘বিভ্রন্তি’র বিপদ সম্পর্কে তিনি বলেনঃ
“দ্বিজাতিতত্ত্ব’ যদি মিথ্যা প্রমাণিত হইয়া থাকে তবে ’৪৭ সালের ভারত বাটোয়ারার আর কোন জাস্টিফিকেশন থাকিতেছে না। কোরিয়া, ভিয়েতনাম ও জার্মানির মতই ভারতেরও পুনর্যোজনার চেষ্টা চলিতে পারে। ভারতবর্ষের বেলা সে কাজে বিলম্ব ঘটিলেও বাংলার ব্যাপারে বিলম্বের কোন কারণ নাই”। (পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৬১৫)
‘হাজার বছর পরে বাংলাদেশ এই প্রথম স্বাধীন হয়েছে’ এই ধরনের একটি ধারণাও সে সময় প্রচার করা হয়। এর মাধ্যামে প্রকৃতপক্ষে বাংলার জনগণের হাজার বছরের সংগ্রামী ইতিহাসের মূল সত্যকেই অস্বীকার করা হয়। অস্বীকার করা হয় জনগণের জাতি-স্বাতন্ত্র্যকে। এই বিভ্রান্তির সৃষ্টির চেষ্টার জবাবে আবুল মনসুর আহমদ লিখেছেনঃ
“ইংরাজ আমলের দুইশ’ বছর আজকের বাংলাদেশ ছিল কলিকাতার হিন্টারল্যান্ড। কাঁচামাল সরবরাহের খামার বাড়ি। পঁচিশ বছরের পাকিস্তান আমলে এই খামারে একটি মধ্যবিত্ত শ্রেণী ও কিছু শিল্প-বাণিজ্য গড়িয়া উঠিয়াছে। ….. ইংরাজ আমলের দুইশ’ বছর বাঙালি মুসলমানদের ইতিহাস গৌরবের ইতিহাস। সেখানেও তাদের রূপ বাঙালি রূপ। সে রূপেই তারা বাংলা ভাষা ও সাহিত্য সৃষ্টি করিয়াছে। সেই রূপেই বাংলার স্বাধীনতার জন্য দিল্লীর মুসলিম সম্রাটের বিরুদ্ধে লড়াই করিয়াছে। সেই রূপেই বাংলার মুসলমানদের রাষ্ট্রিক, ভাষিক, কৃষ্টিক ও সামরিক, মনীষা ও বীরত্বের যুগ। সে যুগের সাধনা মুসলিম নেতৃত্বে হইলেও সেটা ছিল উদার অসাম্প্রদায়িক। হিন্দু-বৌদ্ধরাও ছিল তাতে অংশীদার। এ যুগকে পরাধীন বাংলার রূপ দিবার উদ্দেশ্যে ‘হাজার বছর পরে আজ স্বাধীন হইয়াছে’ বলিয়া যতই গান গাওয়া, স্লোগান দেওয়া হউক, তাতে বাংলাদেশের জনগণকে ভুলান যাইবে না। আর্য জাতির ভারত দখলকে বিদেশী শাসন চলিবে না; তাদের ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, রাজপুত্র, কায়েস্থকে বিদেশী বলা যাইবে না, শুধু শেখ-সৈয়দ-মোগল-পাঠানদেরই বিদেশী বলিতে হইবে’ এমন প্রচারে দালালরা পাঞ্জাবী দালালদের চেয়ে বেশী সফল হইবে না”। (পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৬১৯-৬২০)
ঐক্যের বদলে বিভেদের বীজ
বাংলাদেশ সৃষ্টির মাত্র আটত্রিশ দিন পর ‘দালাল আইন’ ও ‘সরকারি আইন’ নামে প্রেসিডেন্টের আট ও নয় নম্বর আদেশ জারি করা হয়। এটা সরকারে দ্বিতীয় ভুল। এ সম্পর্কে আবুল মনসুর আহমদ তাঁর ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’ নামক গ্রন্হে বলেনঃ
“এর ফলে নেতৃত্বের প্রতি জনগণের আস্থায় ফাটল ধরিল। অনাস্থা হইতে সন্দেহ, সন্দেহ হইতে অবিশ্বাস, অবিশ্বাস হইতে শক্রতা পয়দা হইল। পল্লী গ্রামের স্বাভাবিক সামাজিক নেতৃত্বে যে আলেম সমাজ ও মাতব্বর শ্রেণী, তাদের প্রভাব তছনছ হইয়া গেল। ছাত্র-তরুণের উপর শিক্ষক-অধ্যাপকদের আধিপত্যের অবসান ঘটিল। সে সামগ্রিম সন্দেহ, দলাদলি ও অবিশ্বসের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র প্রত্যর্পণ ব্যাহত হইল।….. সার্বজনীন অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা পুলিশ বাহিনীর আওতার বাহিরে চলিয়া গেল”।
আর- নয় নম্বর আদেশের ফলে প্রশাসনিক মেরুদণ্ড ভেঙে পড়ল।
গোড়াতেই ঐক্যের পরিবর্তে বিভেদের বীজ ছড়িয়ে দেওয়া হলো সবখানে। জাতিকে ‘দেশপ্রেমিক’ ও ‘দেশদ্রোহী’, ‘মুক্তিযোদ্ধা’ ও ‘অমুক্তিযোদ্ধা’, ‘ভারত ফেরত’ ও ‘পাকিস্তান প্রত্যাগত’ নামে বিভক্ত করা হলো। রাজনৈতিক দলগুলোকে ‘দেশপ্রেমিক’‘আদেশপ্রেমিক’ এবং মুক্তিযোদ্ধাদেরকে ‘অমুক বাহিনী’‘তমুক বাহিনীর’ নামে শতধা বিচ্ছিন্ন করা হলো। ফেরত প্রায় এক লাখ তরুণ-যুবকের কেউ রাজনৈতিক মতাদর্শগত কারণে লাইসেন্স পারমিটের ব্যবসা পেল, আর কারো ভাগ্যে জুটলো জেল-জুলুম। মুক্তিযোদ্ধাদের জাতিগঠন ও উৎপাদনমুখী কাজে লাগতে ব্যর্থ হলেন শাসকগণ। গুম, খুন ও গুপ্তহত্যার শিকার হলো অনেকে। এ সময় বিবিসি’র জনৈতক ভাষ্যকার ঘোষণা করেনঃ
“বাংলাদেশে প্রতিদিন যত গুপ্তহত্যা হয়, পৃথিবীর বৃহত্তম ভূমিকম্পেও তত লোক মারা যায়নি”।
মূলে সন্দেহ
জাতীয় মর্যাদা রক্ষা ও দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব সুসংহত করার ক্ষেত্রে শাসকগণ গোড়াতেই বড় বকম যে ব্যর্থতার পরিচয় দেন তার ফলে পাকিস্তানী বাহিনী ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ করেছিল ভারতীয় বাহিনীর কাছে, বাংলাদেশ বাহিনী কিংবা তথাকথিত ‘যৌথ কমান্ডে’র কাছে নয়। আত্মসমর্পণের দলিলে তাই স্বাক্ষর পড়েছিল জগজিৎ সিং আরোরা ও নিয়াজির। ভারতীয় বাহিনী ঢাকা শহর এবং সারা বাংলাদেশের ওপর পাকিস্তানের পরিবর্তে নিজের কর্তৃত্ব ভালোভাবে স্থাপন করার পর ভারতীয় সরকারের তত্ত্বাবধানেই বাংলাদেশ সরকারের কেন্দ্র কলকাতা থেকে ঢাকায় স্থানান্তরিত হয়। (বদরুদ্দীন উমরঃ গণকণ্ঠ, ১৭ ডিসেম্বর, ১৯৭৩)
একেবারে শুরু থেকেই এ অভিযোগ উঠতে থাকে যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব ভারতীয় শাসকগোষ্ঠীর নিকট বিসর্জন দেওয়া হয়েছে এবং আটটি গোপন চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশকে ভারতের কাছে বিকিয়ে দেওয়া হয়েছে। ২৫ বছর মেয়াদি সামরিক চুক্তি ও সীমান্ত বাণিজ্যের মতো জাতীয় স্বার্থ-বিরোধী চুক্তি সম্পাদন করা হয়েছে। সোভিয়েট রাশিয়া প্রত্যক্ষভাবে এবং ভারতের মাধ্যমে আমাদের সার্বভৌমত্বে হস্তক্ষেপ করছে। জনগণের মুখ বন্ধ করার উদ্দেশ্যে শাসকগণ ‘মিত্র রাষ্ট্র’ ভারত ও রাশিয়া র সমালোচনা করার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন।
বিরোধী রাজনৈতিক নেতা অলি আহাদ এ সময় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব সংরক্ষণে শাসকদের ব্যর্থতার সমালোচনা করে বলেনঃ
“স্বাধীনতার অর্থ যদি সার্বভৌমত্ব হয় তবে তা মোটেই অর্জিত হয়নি। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বা ব্যবসা-বাণিজ্যের কারণে বিদেশ যেতে হলে যাত্রাপথে বা ফেরার পথে বাংলাদেশের নেতৃবৃন্দকে অবশ্যই দিল্লীতে হাজিরা দিতে হয়। বিদেশের সাথে আমাদের আলোচনা কার্যকর হবে কি হবে না, তা নির্ভর করে দিল্লী সরকারের সম্মতির উপর। সুতরাং আমরা দিল্লীর দাসে পরিণত হয়েছি। “The spirit of the great revolaution has been betrayed by the Sheikh Governmet.” (অলি আহাদা, সাপ্তাহিক সোনার বাংলাকে প্রদত্ত সাক্ষাৎকার, ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭২)
ভারতের পশ্চিম বঙ্গ সিপিএম-এর নেতা মি. সুন্দরায়া ৭২ সালের জুলাই মাসে মাদুরাই- এ এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেনঃ
“ভারত সরকার তার বৃহৎ পুঁজির স্বার্থে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করছে”।
একই সাংবাদিক সম্মেলনে মি. প্রমোদ দাসগুপ্ত ভারতীয় হস্তক্ষেপের দুটি উদাহরণ তুলে ধরে বলেনঃ
“ভারত সরকার কয়েকজন ভারতীয় অফিসারকে বাংলাদেশে মোতায়েন করেছেন। দ্বিতীয়তঃ ছদ্মবেশে কিছু ভারতীয় সৈনিককে ভারত সরকার এখানো বাংলাদেশে রেখে দিয়েছে”।
এভাবে শাসকদের ব্যর্থতার কারণে নিজেদের স্বাধীন অস্তিত্ব সম্পর্কেই জনমনে প্রশ্ন সৃষ্টি হয়।
জনতার মিলিম সংগ্রামঃ মাওলানা ভাসানীর নাম
স্বাধীনতার পর সৃষ্ট বিভ্রান্তি ও অনৈক্যের কারণগুলো দূরক করা, জাতিসত্তার সুরক্ষা এবং জনগণের আধিপত্যবাদ বিরোধী সংগ্রামে এ সময় সাংস্কৃতিক ফ্রন্টে নেতৃত্ব দেন আবুল মনসুর আহমদ এবং রাজনৈতিক ফ্রন্টে জনগণের সাহসী সংগ্রামে কান্ডারির ভূমিকা পালন করেন মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী
১৯৭২ সালের ২২ জানুয়ারি ভারত থেকে দেশে ফিরে মাওলানা ভাসানী বাংলাদেশের বুকে রুশ-ভারত আধিপত্যবাদী ও সম্প্রসারণবাদী থাবা বিস্তার, সীমান্ত পথে দেশের মূল্যবান সম্পদ অবাধে পাচার ও নীতিবোধ বিবর্জিত দুর্ণীতিবাজ স্বার্থন্বেষী মহলের অবাধ লুণ্ঠন ও শোষণের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানান। ২ এপ্রিল পল্টনের জনসভায় তিনি বলেনঃ
“বাঙালিরা ভারত, চীন, ব্রিটেন কিংবা আমেরিকা- কারো গোলামিই স্বীকার করবে না। প্রতি বিন্দু রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করবো ইনশাআল্লাহ”।
স্বাধীনতার পর এই প্রথম কুরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে জনসভা অনুষ্ঠিত হলো এবং মাওলানা নিজেই তাঁর ভাষণে ‘নারায়ে তাকবীর- আল্লাহু আকবার’ ধ্বনি উচ্চারণ করেন।
২১ এপ্রিল দিনাজপুরের বড় ময়দানের জনসভায় তিনি সীমান্তের দশ মাইলের মধ্যে অবাধ বাণিজ্য চুক্তি অবিলম্বে বন্ধ করার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানান। তিনি পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশ বাংলাদেশের সৈয়দপুরে বারো হাজার বিহারী কেন খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করতে বাধ্য হলো, সরকারের কাছে তার কৈফিয়ত দাবি করেন।
২৪ মে যশোরের ঈদগাহ ময়দানের জনসভায় তিনি দশ দিনের মধ্যে হিন্দুস্তানের সৈন্য প্রত্যাহার দাবি করেন এবং দেশের মাদরাসাগুলোর তালা অবিলম্বে খুলে দেওয়ার জন্য সরকারের কাছে আহ্বান জানান। বিভিন্ন জনসভায় এ সময় তিনি প্রশ্ন করেনঃ
“স্কুল খুলেছে, কলেজ খুলেছে, বিশ্ববিদ্যালয় খুলেছে, হাজার মাদরাসায় আজো তালা কেন? লক্ষ লক্ষ মাদরাসা ছাত্রের জীবন নিয়ে এই ছিনিমিনি খেলা কেন? স্বাধীনতার পর সমাজে আজান দেওয়া, ইমামতি, জুমা, ঈদ, খুতবা, জানাযা পড়ার প্রয়োজনও কি শেষ হয়ে গেছে?”
দেশে ফেরা মাত্র এক মাস পর মাওলানা ভাসানী ১৯৭২ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার থেকে ‘হক কথা’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। জনগণের মুক্তির আকুতি ব্যক্ত করার মুখপত্ররূপে স্বল্পস্থায়ী এই পত্রিকাটি এ যুগসন্ধিক্ষণে সকল রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে অসামান্য ভূমিকা পালন করে। এ পত্রিকায় ভারতের সাথে বাংলাদেশের গোপন চুক্তিগুলোর বিবরণ তুলে ধরা হয়। বাংলাদেশ সরকারের অভ্যন্তরীণ কার্যক্রমে বাংলাদেশের ‘বেসরকারি প্রধানমন্ত্রী’ ডি পি ধরের মাধ্যমে ভারত সরকারের নিয়মিত ও অব্যাহত হস্তক্ষেপ সম্পর্কে চাঞ্চল্যকর তথ্যসমূহ প্রকাশ করে ‘হক কথা’ দেশবাসীকে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে সজাগ ও সচেতন করে তোলে।
দুঃশাসনের প্রতিবাদে এবং ভারতের দিক থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার উপর আপতিত বিপদ সম্পর্কে দেশবাসীকে হুশিয়ার করার জন্য মাওলানা ভাসানী ১৯৭৩ সালে আমরণ অনশন শুরু করেন। এ উপলক্ষে তিনি ১৪ মে সাপ্তাহিক ‘হলিডে’ পত্রিকায় প্রকাশিত সাক্ষাতকারে বলেনঃ
“যুবক হইয়া বাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জে গিয়ে জনসভা করিয়া সরকারের অত্যাচার অবিচারের বিরুদ্ধে মানুষের মনে বিদ্রোহের আগুন জ্বালাইবার ক্ষমতা আমার নাই। তাই আমি অনশন ধর্মঘট করিয়া দেশের মানুষের মনে বিদ্রোহের আগুন জ্বালাইতেছি”।
অনশনের পর এক বিবৃতিতে মাওলনা ভাসানী ইসলামী শাসন কায়েমের আহ্বান জানিয়ে বলেনঃ
“সেদিন বেশি দূরে নহে, শুধু বাংলাদেশ নয়, দুনিয়ার বহু দেশে সংগ্রামী ইসলামী জোয়ানদের সংগ্রামের মাধ্যমে ইসলামী সমাজ কায়েম হইবে”।
ভারতীয় পর্ণ বর্জন, ভারতের সাথে সকল গোপন চুক্তি বাতিল প্রভৃতি দাবিতে মাওলানার ডাকে ২৯ আগস্ট সারা দেশে পূর্ণ হরতাল পালিত হয়। ৯ ডিসেম্বর মাওলানা ভাসানী আহূত পল্টন ময়াদানের জনসভায় তার স্বাক্ষরযুক্ত একটি প্রচারপত্রে ‘জনসাধারণকে সশস্ত্র সাড়াশী আক্রমণ চালিয়ে আওয়ামী লীগ ও তার প্রভূ ভারতীয় সম্প্রসারণবাদকে চূড়ান্তভাবে কবরস্থ করার” আহ্বান জানিয়ে বলা হয়, “১৬ ডিসেম্বর পূর্ববাংলার জনগণের সবচে গ্লানিকর দিবস”। প্রচারপত্রটিতে আরো বলা হয়ঃ
“পূর্ববাংলার মুসলিম ধর্মাবলম্বী জনগণের ওপর ধর্মীয় নির্যাতন চালানো হচ্ছে, তাদের তাহজীব-তমদ্দুনকে ধ্বংস করে স্পেনের মতো তাদের নাম নিশানা মুছে ফেলবার চক্রান্ত চলছে”।
মাওলানা ভাসানী একাত্তর পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের রক্তমূল্যে কেনা স্বাধীনতা হেফাযত ও জনগণের মুক্ নিশ্চিত করার জন্য ভারতীয় সরকার ও তার এদেশীয় কোলাবোরেটরদের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে যে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেন, সে কারণে এই নবপতিপর বৃদ্ধ আজীবন সংগ্রামী নেতাকে ভারতীয় মস্কোপন্হি কম্যুনিস্ট পার্টির নেতা রাজেস্বর রাও ঢাকার মাটিতে দাঁড়িয়ে “বাংলাদেশের অগ্রগতির পথে বাধা সৃষ্টিকারী”, ‘স্বাধীনতাবিরোধী’, ‘প্রতিক্রিয়াশীল’ বলে অভিহিত করেন। মোজফফর ন্যাপ, মনিসিংহের কম্যুনিস্ট পার্টি ও এক শ্রেণীর আওয়ামী লীগ নেতা এরপর সেই সুরে সুর মিলিয়ে মাওলানাকে ‘পাকিস্তানের দালাল’‘বাংলাদেশে চীনের রাষ্ট্রদূত’, ‘দেশদ্রোহী’ সাম্প্রদায়িক’ প্রভৃতি গালমন্দ করতে শুরু করেন। অন্যদিকে কলকাতার ‘আনন্দ বাজার’ ও ‘যুগান্তর’ পত্রিকায় মাওলানাকে ‘শয়তান’, ‘বেঈমান’, ‘ধূর্ত’, ‘ধুরন্ধর’, ‘পাগল,’ নিমকহারাম’ ইত্যাদি অশালীন ভাষায় গালাগাল করে ১৯৭৩ সালে অন্তত আটটি সম্পাদকীয় নিবন্ধ প্রকাশ করা হয়।
‘প্রফেট অব ভায়োল্যান্স’ নামে খ্যাত মাওলানা ভাসানী এসব নিন্দাবাদের প্রতিক্রিয়া খুবই ধীরস্থিরভাবে প্রকাশ করে বলেন, ‘যে যাই বলুক, আমিই মুজিবের প্রকৃত ভালাই চাই’।
মওলানা ভাসানীর রুশ-ভারত আধিপত্যবাদ বিরোধী ভূমিকার কারণে ক্ষিপ্ত হয়ে ১৯৭৩ সালের ২৯ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগ, মো-ন্যাপ ও সিপিবির সমন্বয়ে গঠিত ত্রিদলীয় ঐক্যজোটের উদ্যোগে বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ চত্বরে অনুষ্ঠিত জনসভায় মনিসিংহ মাওলানা ভাসানীকে টুকরো-টুকরো করে বাংলার মাটি থেকে উৎখাত করার হুমকি দেন। মাওলানা ভাসানী তার জবাবে বলেনঃ
“শ্রী মনিসিংহ দেশে বড় একটা গোলযোগ বাধাইয়া উহার উসিলায় এখানে রুশ-হিন্দের প্রভাব আরও প্রত্যক্ষ ও মজবুত করিতে চাহিতেছেন। আমি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষনা করিতেছি, এক বিন্দু রক্ত থাকিতে বাংলাদেশে রাশিয়া ও ভারতের কোন প্রকার ষড়যন্ত্রই কায়েম হইতে দিব না”।
১৯৭৪ সালেও মাওলানা ভাসানী সকল প্রকার অন্যায়-অবিচার শোষণ-লুটপাট এবং রুশ-ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে জাতির প্রধান কান্ডারির ভূমিকায় পাহাড়ের মতো দৃঢ় কদমে দাঁড়িয়ে লড়াই করছিলেন। ১৯৭৪ সালের জানুয়ারিতে তিনি জিহাদের ঘোষণা প্রচার করে বলেনঃ
“আমরা হিন্দুস্তান, হিন্দু মহাসভা এবং বাংলাদেশের শতকরা ৮৬ ভাগ মুসলমানদের অপরাপর শক্রর বিরুদ্ধে জিহাদ করিব, যাহারা আমাদের ধর্মীয় শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে নষ্ট করিয়া দিতে চায়। আমরা মাড়োয়ারীদের বিরুদ্ধে জিহাদ শুরু করিব, কারণ তাহারা আমাদের সকল ধান, চাউল, পাট, মাছ ও সোনা ইত্যাদি পাচার করিয়া লইয়া যাইতেছে। আমরা হত্যা ও লুটপাটকারী সকল বাহিনীর বিরুদ্ধে জিহাদ করিব”।
অপর এক বিবৃতিতে মাওলানা ভাসানী এ সময় দৃঢ়তার সাতে ঘোষণা করেনঃ
“আমি দ্বথ্যহীন কণ্টে ঘোষনা করিতেছি, একবিন্দু রক্ত থাকিতে বাংলাদেশে রাশিয়া ও ভারতের কোন প্রকার ষড়যন্ত্র কয়েম হইতে দিব না। এই সংকল্প আমার একার নহে। বিগত দুই বৎসরে ইহাও প্রমাণিত হইয়াছে যে, বাংলাদেশের কোটি কোটি স্বাধীনচেতা নাগরিক জান-মাল সব কিছু হারাইতে প্রস্তুত, কিন্তু রাশিয়া-ভারতের গোলামী মানিয়া লইবে না”।
মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে সে সময় সমগ্র জাতি নিজেদের জাতিসত্তা সুরক্ষার সংগ্রামে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল।
জাতিসত্তা ও সংবিধান
১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকে বাংলাদেশের সংবিধান বলবত হয়। তাতে ভারতীয় শাসনতন্ত্রের অনুকরণে চারটি মলূনীতি অন্তর্ভুক্ত করা হয। তার মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র নামক উপাদান দুটি ছিল এদেশের জনগণের সুদীর্গ সংগ্রাম, আশা-আকাঙ্ক্ষা, বোধ, বিশ্বাস ও ঐতিহ্য চেতনার সম্পূর্ণ পরিপন্হী। শাসক দল আওয়ামী লীগের সত্তরের নির্বাচনী ইশতেহার কর্মসূচিতে এ দু’টি অন্তর্ভুক্ত ছিল না, কিংবা সত্তরের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত প্রবাসী মুজিবগনর সরকারের ১৯৭১ সালের ঘোষণাপত্রেও ধর্মনিরপেক্ষতা বা সমাজতন্ত্রের প্রতি কোন অঙ্গীকার ছিল না।
১৯৭২-এর সংবিধান আওয়ামী লীগ শাসনামলে মাত্র দুই বছর এক মাস দশ দিনের মধ্যে চারবার সংশোধন করা হয়। ১৯৭৩ সালের ১৫ জুলাই মাত্র সাত মাসের মধ্যে আনীত প্রথম সংশোধনীর উদ্দেশ্য ছিল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। কিন্তু শেষ পর্যন্ত একশ পঁচানব্বই জন পাকিস্তানী সৈন্যের সর্বশেষ দলটিকেও দিল্লীর ডিক্টেশনে হস্তান্তর করা হয়। একই বছর ২২ সেপ্টেম্বর আনীত দ্বিতীয় সংশোধনীর মাধ্যমে কোনও ব্যক্তিকে নিবর্তনমূলক আইনে ছয় মাস পর্যন্ত আটক রাখার কালাকানুন বলবত করা হয়। এছাড়া এর দ্বারা প্রেসিডেন্টকে জরুরি অবস্থা ঘোষণার ক্ষমতা প্রদান করে সংবিধানে বর্ণিত ‘চলাফেরার স্বাধীনতা’, ‘সমাবেশের স্বাধীনতা’, ‘সংগঠনের স্বাধীনতা’, ‘বাকস্বাধীনতা’ এবং সম্পত্তির অধিকার সম্বলিত মৌলিক মানবাধিকারের বিধানসমূহ স্থগিত রাখার ক্ষমতা দেওয়া হয়। ১৯৭৪ সালের ২৮ নভেম্বর সংবিধানের তৃতীয় সংশোধনী গ্রহণ করা হয়। ভারতের কাছে বাংলাদেশের ভূখণ্ড বেরুবাড়ী হস্তান্তরের চুক্তি কার্যকর করা ছিল এই সংশোধনীর উদ্দেশ্য।
১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি মাত্র কয়েক মিনিটের সংসদীয় ক্যু-এর মাধ্যমে চতুর্থ সংশোধনী গ্রহণ করা হয়। এর মাধ্যমে সংবিধানের খোল-নলচে সম্পূর্ণরূপে পাল্টে ফেলা হয়। জনগণের প্রতিনিধিত্ব, মৌলিক অধিকার, মন্ত্রিসভার দায়িত্বশীলতা, আইন ও বিচার বিভাগের ক্ষমতা- সব কিছুর ব্যাপারে সকল রীতি-রেওয়াজ, পদ্ধতি ও আইনের আমূল পরিবর্তন করে মধ্যযুগীয় সামন্ততান্ত্রিক রাজতন্ত্রের আদলে ‘এক দলের’ নামে এই দেশের সবকিছু ‘এক ব্যক্তির’ ইচ্ছার কাছে বিসর্জন দেওয়া হয়। আর এই পরিবর্তনের নাম দেওয়া হয় ‘দ্বিতীয় বিপ্লব’।
যে মানসিকতা থেকে এই অভূতপূর্ব ‘বিপ্লব’ সাধিত হয়েছিল, সে সম্পর্কে আবুল মনসুর আহমদ ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’- এ এই তথাকথিত বিপ্লবের অনেক দিন আগেই লিখেছেনঃ
“সত্যই মুজিবর রহমানের মধ্যে এই দুর্বলতা ছিল যে, তিনি যেটাকে পার্টিপ্রীতি মনে করিতেন, সেটা ছিল আসলে তার ইগইযম- আত্মপ্রীতি। ‘স্বরাজ দেশে’র জন্য খুবই দরকার। কিন্তু সেটা যদি আমার হাত দিয়া না আসে তবে না আসাই ভাল। …… আমার বিবেচনায় মুজিবর রহমানের মধ্যে আত্মপ্রীতি ছিল খুবই প্রবল। এটাকে তিনি পার্টিপ্রীতি বলিয়া চালাইতেন”।
শেখ মুজিবের এই ‘ইগইযম’কে কাজে লাগিয়ে নিজেদের মতলব হাসিলের জন্য মস্কোপন্হি কম্যুনিস্টরাই চতুর্থ সংশোধনীর নেপথ্য-নায়কের ভূমিকা পালন করে।
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে দেশ তখন একটা ‘তলাহীন ঝুড়ি’। দেশের অর্থভাণ্ডার শূন্য। দ্রব্যমূল্য আকাশ ছোঁয়া। দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি সর্বগ্রাসী রূপ নিয়েছে। বিশ্বখ্যাত পত্রিকাগুলো কালোবাজারীকে ‘বাংলাদেশের জাতীয় সংস্কৃতি’রূপে চিহ্নিত করছে। মহানগরী পরিণত হয়েছে বেওয়ারিশ লাশের নগরীতে। মানুষ কলকাতায় লজ্জা ঢাকছে। ডাস্টবিনে চলছে মানুষে-কুকুরে কাড়াকাড়ি। গুম, খুন, ছিনতাই, রাহাজানি, সংবাদপত্রের খবর হওয়ার যোগ্যতা হারাচ্ছে। শিক্ষাঙ্গনে চলছৈ অস্ত্রের ঝনঝনানি। দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতিতে দেশের সধারণ মানুষের বিশীর্ণ মিছিলের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। সর্বস্তরের মানুষ চাইছে পরিবর্তন। ভুখা জনতার অসহায় ক্ষীণ কণ্ঠ ঊর্ধপানে শীর্ণ দু’খানি হাত তুলে ফরিয়াদ করছে, “খোদা গজব থেকে বাঁচাও”। এমনি পরিস্থিতিতে রক্ষীবাহিনী, লালবাহিনী ধারাো দাঁত-নখও ভোঁতা প্রামাণিত হচ্ছিল। এই পটভূমিতে ক্ষমতার মসনদকে আসন্ন গণরোষের হাত থেকে হেফাযত করার ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’রূপেই আনা হয় ‘চতুর্থ সংশোধনী’। দুনিয়া র রাজনীতির ইতিহাসে এ ধরনের সংশোধনীর নযীর নেই।
শেখ মুজিব তাঁর ক্ষমতার বিস্তার ও স্থিতির জন্য সব কিছু করতে প্রস্তুত ছিলেন। তাঁর এই ইগয়িস্ট মানসিকতাকে সহজেই কাজে লাগাতে পেরেছে আন্তর্জাতিক চক্রান্তের এদেশী এজেন্টরা। মধ্যপন্হি জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ ছিল আন্তর্জাতিকতাবাদী কম্যুনিজমের বিরোধী গণতান্ত্রিক শক্তি। এই নীতির ওপর ১৯৫৭ সালে আওয়ামী লীগ একবার ভাগ হয়েছিল। কিন্তু ৭৩ সালে দেশে বিরাজিত পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে মোজাফফর ন্যাপ ও মনিসিংহ’র কম্যুনিস্ট পার্টি আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে ঘাপটি মেরে থাকা তাদের এজেন্টদের সহযোগিতায় ‘গণঐক্য জোট’ নামে ত্রিদলীয় ঐক্যজোট গঠনে সক্ষম হয়। তাদেরই প্ররোচনায় আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব রাজনৈতিক সিদ্ধানের এমন এক পর্যায়ে প্রবেশ করে, যেখান থেকে ফিরে আসার সকল দুয়ার বন্ধ হয়ে যায়।
চতুর্থ সংশোধনী বাংলাদেশের মস্কোপন্হি কম্যুনিস্টদের ষড়যন্ত্রের সফল বাস্তবায়ন। এই সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রকাশ করেছেন নয়াদিল্লী জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রফেসর এবং ‘এশিয়ায় সোভিয়েট নীতি’ বিষয়ক গবেষক মি. ভবানী সেনগুপ্ত। ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বরের শেষের দিকে তিনি বাংলাদেশের কম্যুনিস্ট পার্টির চেয়াম্যান মি. মনিসিংহ-এর সাথে একঘন্টাব্যাপী সাক্ষাৎকারে মিলিত হন। প্রফেসর গুপ্ত ১৯৭৫ সালের মনিসিংহ এর বরাত দিয়ে মি. সেনগুপ্ত তাঁর প্রবন্ধে উল্লেখ করেন যে, ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বর মাসে বাংলাদেশের কম্যুনিস্ট পার্টি বাংলাদেশের জন্য সোভিয়েট অনুমোদিত একটি রাজনৈতিক নীলনকশা প্রকাশ করেন। মি. মনিসিংহ তাঁর সাক্ষাতকারে উক্ত রাজনৈতিক নীল-নকশা সম্পর্কে বলেনঃ “এই ব্যবস্থায় দেশে প্রেসিডেন্সিয়াল পদ্ধতির সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে। প্রেসিডেন্ট ‘প্রগ্রতিশীল, দক্ষ ও সৎ’ লোকদের সমন্বয়ে একটি কেবিনেট গঠন করবেন। একটি জাতীয় সংসদ থাকবে, যার ক্ষমতা থাকবে সীমিত। সংসদের কাছে কেবিনেট দায়ী থাকবে না”।
শেখ মুজিব মি. মনিসিংহদের রাজনৈতিক নীলনকশা গ্রহণ করবেন কেন, আর তিনি তা গ্রহণ না করলে কম্যুনিস্টরা ক করবে, প্রফেসর সেনগুপ্ত মনিসিংহকে এই প্রশ্ন করলে বাংলাদেশের কম্যুনিস্ট নেতা জবাবে বলেনঃ
“We strongly believe that the force of circumstances will compel the Sheikh to adopt our model…. we have told him that if he adopted our model, we would do our best to make it a success. If he rejects if, we will fight for it, whatever the consequences.”
‘আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস পরিস্থিতি শেখকে আমাদের পদ্ধতি গ্রহণে বাধ্য করবে। …. আমরা তাকে বলেছি, আমাদের পদ্ধতি গ্রহণ করলে তা সফল করতে আমরা সর্বশক্তি নিয়োগ করবো। শেখ এই পদ্ধতি প্রত্যাখ্যান করলে পরিণতি যা-ই-হোক, আমরা এর জন্য সংগ্রাম করবো”।
মনিসিংহ প্রফেসর ভবানী সেনগুপ্তকে দেওয়া তাঁর সাক্ষাতকারে খুব জোরের সাথে বলেন যে, বাংলাদেশ ‘সঠিক রাজনৈতিক লাইন’ অনুসরণ করলে সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো প্রয়োজনীয় সব ধরনের মদদ যোগাবে। এই সাক্ষাতকার প্রকাশের মাত্র এক মাসের মধ্যেই শেখ মুজিব চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে একদলীয় বাকশাল ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন।
পঁচাত্তরের পটপরিবর্তন ও সিপাহী-জনতার বিপ্লব
সংবিধান সংশোধন করে দেশের রাজনৈতিক পদ্ধতি এবং সামগ্রিক ব্যব্স্থায় যে অপ্রত্যাশিত আকস্মিক পরিবর্তন আনা হয়, তা ছিল এ দেশের সংগ্রামশীল জাতির কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত। অতীতে শত শত বছর ধরে সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য, রাজনৈতিক অধিকার, অর্থনৈতিক মুক্তি, স্বশাসন, গণতন্ত্র ও স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে এবং সকল প্রকার আধিপত্যবাদও আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে নিরাপোষ স্বাধীনচেতা গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যের অধিকারী সাহসী জাতিরূপে এ ভূখণ্ডের জনগণের যে মেজাজ ও মানস-কাঠামো গড়ে উঠেছে, চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে আনীত পরিবর্তন তাদের সেই মনস্তত্ত্বকে প্রচণ্ডভাবে আহত করে। ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক নানা কারণে জনমনে যে প্রচণ্ড ক্ষোভ পুঞ্জিভূত হয়েছিল, চতুর্থ সংশোধনী ছিল তার ওপর চূড়ান্ত আঘাত। পঁচাত্তরের পনেরই আগস্টের ঘটনা সে পটভূমিতেই সংঘটিত হয়।
১৯৭৫ সালের পনেরই আগস্ট মুজিব সরকারের পতনের পর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের শীর্ষস্থানীয় সংবাদপত্রগুলোয় এ সম্পর্কে মূল্যায়নধর্মী অনেক প্রতিবেদন ও নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। সেগুলো ঢাকার কাগজগুলোয়, বিশেষত দৈনিক ইত্তেফাকে নিয়মিতভাবে পুনর্মুদ্রিত হয়। এসব বিদেশী পত্র-পত্রিকার প্রতিবেদনে মন্ত্রব্য করা হয় যে, জাতির আত্মপরিচয় বা জাতিসত্তা সংক্রান্ত বোধ, বিশ্বাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কে মূল্যায়নের ব্যর্থতা এবং বিশেষভাবে ইসলামের অমর্যাদা ও সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিকে আহত করা শেখ মুজিবের পতনের অন্যতম প্রধান কারণ ছিল।
১৯৭৫ সালের পনেরই আগস্টের পরিবর্তনের পর ৩ নভেম্বর থেকে ৬ নভেম্বর পর্যন্ত একটি প্রতিবিপ্লবের চেষ্টা চলে। কিন্তু সিপাহী জনতার নযীরবিহীন ঐক্যবদ্ধ শক্তি সাতই নভেম্বরের প্রত্যুষে তা নস্যাত করে দেয়। এরপর থেকে দেশে যে পরিবর্তনের ধারা সূচিত হয়, তার ফলে জাতীয় সংবিধনে পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে ধর্মনিরপেক্ষতার স্থলে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের আকাঙ্ক্ষার প্রতিধ্বনিরূপে ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর আস্থা ও বিশ্বাস’ প্রতিস্থাপিত হয়। সমাজতন্ত্র শব্দটি সংবিধানে নতুনভাবে ব্যাখ্যাত হয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন নৃতত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠীর উপস্থিতিকে সংবিধানে স্বীকার করে নিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদের স্থলে বাংলাশেী জাতীয়তাবাদ সন্নিবেশিত করা হয়। এভাবে জাতি তাদের সত্তা ও আত্মপরিচয় সম্পর্কে দীর্ঘদিনের বিভ্রান্তির কুজ্ঝটিকা কাটিয়ে একটা দিক নির্দেশনার দিকে যাত্রা শুরু করে। এরপর সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে ইসলামকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্মরূপে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
দেশ ছোট কিন্তু জাতি অনেক বড়
ইতিহাসের চাকা জোর করে পেছনে ঘুরানো যায় না। এ সত্য আমাদের অতীত ইতিহাসের বাবার প্রমাণিত হয়েছে। রাজা গণেশের চক্রান্ত নস্যাত করতে পঞ্চদশ শতকে নূর কুতব-এর নেতৃত্বে এ দেশের জনগণ রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। তার আগে এবং পরে এমনি আরো ঘটনা ঘটেছে। এভাবেই আমাদের জাতিসত্তা নস্যাতের চক্রান্ত বানচাল করে দিয়ে সাহসী সংগ্রামী এই জাতি ইতিহাসের বর্তমান মঞ্জিলে উপনীত হয়েছে।
জাতিসত্তা নির্মাণে ভুল ও বিভ্রান্তি একটি জাতির অস্তিত্বের জন্য মারাত্মক হুমকি। পাল আমল থেকে পাকিস্তান আমল পর্যন্ত বিভিন্ন যুগের শাসকের ভুলের অভিজ্ঞতা আমাদের সামনে স্পষ্ট। আমাদের যে কোন ভুলের সুযোগ নেওয়ার জন্য হাঙ্গরের মতো মুখ ব্যদান করে আছে এমন এক শক্তি, যাদের সাথে হাজার বছর লড়াই করে আমাদের সাহসী জতি এগিয়ে এসেছে এত দূর। স্বাধীন-সার্বভৌম ও সংহত অস্তিত্বের জন্য বাংলাদেশকে তার রাষ্ট্রগঠন কার্যক্রমের পাশাপাশি জাতিগঠনকে দিতে হবে অগ্রাধিকার। কাটিয়ে উঠতে হবে আত্মপরিচয়ের সকল বিভ্রান্তি। আর এ জন্যঃ
ক. বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর আশা-আকঙ্ক্ষা, ইতহাস-ঐতিহ্য এবং বিশ্বাস ও মূ্ল্যবোধের ভিত্তিতে জাতীয় ইমেজ ও আইডেন্টিটি নির্মঅণ করতে হবে।
খ. জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে ও সকল ক্ষেত্রে ঐক্য জোরদার করতে হবে। যে কোন ঐক্য-বিনাশী তৎপরতা দেশের শক্রদের হাতেই অস্ত্র তুলে দেবে। বিভিন্ন চেতনার ধুয়া তুলে জাতিকে ঘুমে অচেতন রেখে যারা জাতির সত্তা ও অস্তিত্বের সিন্দুক চুরি করতে চায়- তাদের সম্পর্কে সজাগ-সচেতন, জাগ্রত থাকতে হবে সকলকে।
গ. জনগণের আস্থা ও আশা-আকাঙ্ক্ষার পরিপূরক একটি স্থিতিশীল ও দৃঢ়বদ্ধ রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে সুসংবদ্ধভাবে চালু রাখতে হবে এবং যে কোন হুমকির হাত থেকে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার সুস্থ ধারার সুরক্ষঅর জন্য রাজনৈতিক মহলকে দূরদৃষ্টি- সম্পন্ন দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে।
ঘ. লর্ড এ্যাক্টনের ভাষায়ঃ “বিশাল শক্তি ও ঐশ্বর্যের অধিকারী দেশের দাসত্ব করার চাইতে দারিদ্র ও দুর্বল স্বাধীন দেশের মর্যাদাবান নাগরিকের জীবনই কাম্য”।
জনগণ যুগে যুগে তাদের এই আকাঙ্ক্ষা সুস্পষ্ট, দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ব্যক্ত করেছেন। “দেশ হিসেবে ছোট হলেও জাতি হিসেবে আমরা অনেক বড়”- এ উপলব্ধি এ জাতির বিরাট শক্তি ও সম্পদ। এতেই প্রোথিত এ জাতির আত্মরক্ষা ও আত্মবিকাশের বীজ।